লজ্জামুঠি

লজ্জামুঠি

এক যে আছে মেয়ে, তার নাম হ’ল গে সুচিত্রা। সুচিত্রা তখনো হয়নিকো, এক শিবরাত্তিরে সুচিত্রার মা গঙ্গামণি রাত জেগে দেখেছিল তিনটে বায়োস্কোপ – সাগরিকা, হারানো সুর আর শিল্পী। উরিম্মা, কী বই, চোখ ছলছল, বুক ঢলঢল। শেষ রাত্তিরে বাড়ি ফিরে, পেসাদ পেয়ে চোখ দুটো একটু বুজেছে কি বোজেনি, এমন সময় বাঘছাল পরা এইয়া বড় ত্রিশূল হাতে স্বয়ং মহাদেব অশোকনগর রিফিউজি কলোনির সূর্য সেন ব্লকের গঙ্গামণির ঐ টিনের বেড়ায় ত্রিশূল ঘযছেন আর খটখটাং শব্দ করছেন। গঙ্গামণি দেখে তো থ। চোখের পলক পড়ে না, মুখের রা কাড়ে না। সাত তাড়াতাড়ি পঞ্চপ্রদীপ আর একটা ধূপকাঠি দিয়ে ভজনা করে। মহাদেব বললেন – গুড়মুড়ি খাব। গঙ্গামণি কলাইকরা বাটিভরা গুড়মুড়ি দেয়। বাবা মহাদেব ভুড়ুক ঢেকুর তুলে বললেন-খুশি হ’লাম রে খুব। কী চাস বল। বর দোবো। গঙ্গামণি ফস্ করে বলে ফেলল – সুচিত্রা সেন। যেন সুচিত্রা সেনের মতো একটা মেয়ে হয় আমার। মহাদেব মিলিয়ে গেলেন।

দশমাস দশদিন পর কোল আলো করে একটি মেয়ে এল গঙ্গামণির। শাশুড়ি বুড়ি বললে – এঃ, মাইয়া? ধাই বললে–উলু দাও। কেউ দিলে না। ধাই বললে–শাঁখ বাজাও, কেউ বাজালে না। গঙ্গামণির স্বামী বিড়িতে লম্বা টান মেরে দূরে আছাড় মেরে ছুঁড়ে ধানকলের কাজে চলে গেল। গঙ্গামণি তো কাউকেই বলেনি যে মহাদেবের বরে এই মেয়ে হয়েছে। বললে কি রক্ষা থাকত? বলতো–বেআক্কইল্যা বঊ, পোলা না চাইয়া মাইয়া চাইছ?

গঙ্গামণি ওর মেয়ের নাম রাখে সুচিত্রা। দিন যায়, সুচিত্রা শশীকলার মতো দিনে দিনে বাড়ে। জন্মের সময় চুল ছিল পাতলা পাতলা, চুল আর ঘন হয় না। নাকটা ছিল বোঁচা। দিনের মধ্যে কতবার নাকের গোড়া টিপে দিত, তবু বোঁচাই রয়ে গেল। চোখ দুটো গোল গোল।

গঙ্গামণি মেয়ের খুব যত্ন করে। চুল আঁচড়ায়। উকুন বাছে, শিক্‌নি মোছে। নিজে না খেয়ে মেয়েকে খাওয়ায়। দুপুরে লাল আইস্‌কিরিম কিনে দেয়। মহাদেবের বরের মেয়ে বলে কথা।

কিছুদিন পর সুচিত্রার একটা ভাই হ’ল! ধাই বলল, শাঁখ বাজাও, উলু দাও। পাড়া প্রতিবেশী শাঁখ বাজাল, উলু দিল, হুলুস্থূল কাণ্ড হ’ল। বাপ করল কি, দিনদুপুরে মাল খেল, আর কোত্থেকে টাকা ধার করে মাছ কিনে মাছের মুড়োয় দড়ি ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বাড়ি এল। বছর ঘুরতেই আর এক ভাই। আনন্দের আর সীমা নাই। শাশুড়িবুড়ির ফোকলা মুখ পদ্মহাসিতে ভরে গেল। বুড়ি যেদিন মরল, সবাই বলল–সুখে মরেছে।

তারপর তো পিঠাপিঠি ভাই দুটো হুটোপাটি করে বড় হয়, প্লাস্টিকের চটি পরে হাঁটি হাঁটি করে। বড় ভাইটা যখন সবে হাঁটতে শিখেছে তখন একদিন হ’ল কি, সকালের খেজুর রস বন্ধুরা মিলে বিকেলে খাবে বলে বারান্দার কোণে ফেনা-ওঠা হাঁড়িটা রেখেছিল সুচিত্রার বাপ, বড়ছেলেটা শট্‌ মেরে হাঁড়ি উল্টে দিয়েছিল, তাইতে বাপের বন্ধুরা ওর নাম রাখল চুনী। চুনী গোস্বামীর নাকি হেভি শট্‌। আর ছোটটা অটোমেটিক হয়ে গেল পান্না।

চুনী পান্না খায় আমের দু সাইড, বোন পায় আঁটিটা। কাঠাল কোয়া ভাল ভালটা ভাইরা খায়, বোন পায় দাগিটা। তিনজনকে মা একসঙ্গে খাইয়ে দিলে ডিমসিদ্ধর আধখানা চুনী, আধখানা পান্না, আর সুচিত্রার ভাতের গ্রাস একবার এ আধখানার গায়ে ছোঁয়, একবার ও আধখানার গায়ে ছোঁয়। হাবড়া হাটের লাল জামা গায়ে দু ভাই দিদির দু হাত ধরে স্কুলে যায়, বগলে লাল মলাটের বাল্যশিক্ষা, দিদির তখন কিশলয়।

ধানকল বন্ধ হ’ল, সুচিত্রার বাপ বেকার হ’ল। কত সব নতুন নিয়মের মেশিন বেরুচ্ছে, পুরনো নিয়মের মেশিনে পড়তা কম। দু দিন দ’ হয়ে বাড়িতে বসে রইল সুচিত্রার বাপ, তারপর একদিন বলে বাণিজ্যে যাবে।

সুচিত্রার বাপ রোজ রোক এগারটা দশের ট্রেনে বাণিজ্যে যায়। আড়তদারের থেকে চাল নেয়,চালের বস্তা নিয়ে ট্রেনে ওঠে। পুলিস-পেয়াদাকে ঘুস দিয়ে পাব্লিকের খিস্তি খেয়ে শহরে এনে চাল বেচে। একদিন হ’ল কি, ক’জন জিন্স পরা সওদাগর বনগাঁ বর্ডার থেকে ভিনদেশি কাপড়জামা আনছিল, ওদের সঙ্গে ট্রেনে মাল রাখা নিয়ে সুচিত্রার বাপের ঝগড়া লাগল, ওরা ধাক্কা মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিল সুচিত্রার বাপকে। ও বেচারা নূলো হয়ে ঘরে ফিরে এল।

বাপের ঐ অবস্থা দেখে চুনী পান্না বলল, মা, আমরা চায়ের দোকানে কাজ নেব। আমরা কাপ ধুতে পারি, গেলাস ধুতে পারি, তিরিশ পয়সা করে চার কাপ চায়ের দাম কষতে পারি। পাঁচ টাকার থেকে আশি পয়সা কাটিয়ে ফিরত কত বলতে পারি। ও কথা শুনে গঙ্গামণির চোখে জল এল। বলল, ও কথা বলিস নি। তোরা বই না দেখে ধনধান্যে পুষ্পে ভরা কইতে পারিস, হও ধরমেতে ধীর কইতে পারিস, ম্যাস্টর তোদের কত ভালবাসে, তোরা পড়। ম্যাট্রি পাশ দে। কালোব্যাগ নিয়ে কলকাতা যাবি। তোরা পড়। রোজগার আমিই দেখব। ঠোঙা বেচব।

সুচিত্রার ইস্কুল শেষ হ’ল। ঠোঙায় হাত লাগালে বরং সংসারের লাভ। ইস্কুলের খাতগুলোর লেখাপাতায় ছটাকি ঠোঙা হ’ল, সাদা পাতা দু ভাই পেল। মায়ে-ঝিয়ে কাগজ কাটে, নুলোবাপে আঠা আঁটে, দু ভাই লিখাপড়ি করে, দু ভাই পরীক্ষা পাস দেয়, গঙ্গামণি ভাবে, আহা রে, এট্টু ঘি, মাছের মুড়ো দিত পারলি ছাওল দুটো ফাস্ হ’ত।

একদিন হাবড়া থেকে ঠোঙা বেচে ফিরছে গঙ্গামণি, ট্রেনের সিটে বসে অফিসার আর অফিসারনী কথা কইছে।

অফিসার। দ্যাখো দ্যাখো তিল ক্ষেত। ওগুলো তিল ফুল।

অফিসারনী। আহা চোখ জুড়িয়ে যায়। কতদিন একটু সবুজ দেখি না। একেবারেই বন্দী যদি একটা মেয়েটেয়ে পেতাম, আদর করে রাখতাম।

অফিসার। তোমার মাসিকে বলে দেখো এদিকে যদি একটা মেয়ে পাওয়া যায়…

অফিসারনী। তবে নিজের মেয়ের মতোই আদরে রাখি। মলিটা আর জলিটাকে ওর হাতে দিয়ে আমরা টোনাটুনি তাহলে একটু ঘুরে বেড়াই।

গঙ্গামণি তখন মাথার ঘোমটা টেনে বলে, আমার একটা মেয়ে আছে, বড়ো লক্ষ্মী নিবেন?

অফিসারনী অমনি বলে, হ্যা-হ্যা-হ্যা নেব, নেব…।

-ব্যাতন?

বেতনের জন্য চিন্তা নেই, আমরা দু জনে চাকরি করি। ঠিকানা দাও, ফেরার সময় দেখে যাব।

গঙ্গামণি বাড়ি ফিরে বড়ছেলেকে বলে তোর তো অঙ্কে মাথা ভাল। ক’ দেখি, ডেলি ডেলি আড়াই গুরুস হইলে মাসে কত?

-পচাত্তর।

-চাইর শনিবারের চাইর সিনেমা, উকুন বাছা, হাত-পা-ব্যথা, কাজে মন নাই, – পনের গুরুশ বাদ দে। কত থাকে?

-ষাইট।

-ছয় টাকা গুরুশ হইলে ষাইট গুরুশ কত?

-তিনশ ষাইট।

-গুরুশ প্রতি কাগজ আঠা চাইর টাকা খরচ।ষাইট গুরুশে কত খরচ?

-দুইশ চল্লিশ।

-তিনশ ষাইটের থন দুইশ চল্লিশ বাদ দিলে কত হয়?

-একশ কুড়ি গ মা।

গঙ্গামণি হিসেব করে পায় সুচিত্রা মাসে একশ কুড়ি টাকার আয় দেয় এই সংসারে। খোরাকি আছে।খোরাকি ধরলে কিছুই থাকে না।

পরদিন বিকেল বেলা অফিসার আর অফিসারনী হাজির।বলে–কৈ গো, মেয়েটা দ্যাখাও।

গঙ্গামণি ঠোঁট কামড়াল। সত্যি সত্যিই চলে এল যে। গঙ্গামণি আসন পেতে বসতে দিল, নেবু নিংড়ে সরবৎ দিল। অফিসারনী সুচিত্রাকে দেখল। শুধোল–নাম কী? ‘সুচিত্রা’ নাম শুনে অফিসারনী হেসেই অস্থির। বলে সুচিত্রা ডাকতে পারব না বাপু। শুধু চিত্রা। বলল–কাজ কিছুই নেই। সংসার খুব ছোট। টুকটাক ফাইফরমাস খাটবে, চিত্রমালা-চিত্রহার দেখবে, মেয়ের মতো থাকবে।

বাপ মায়ে চোখাচোখি। মেয়ের মাথা নিচু, মুখে রা নেই। গঙ্গামণি বলে –দেড়শো টাকা দিবেন, মনি অর্ডারে পাঠাবেন।

দেড়শো বড়ো বেশি হয়, একশো কুড়ি।

বাপে মায়ে চোখাচোখি। মেয়ের মাথা নিচু, মুখে রা নেই। আইচ্ছা, একশো তিরিশ।

চক্ষের জলে বক্ষ ভাসিয়ে চিত্রা চলল কলকাতা। দু ভাইকে বলল–ভাল করে পড়িস, সব অঙ্ক রাইট করিস, সব বানান ঠিক করিস্। ফাস্ হলে চাকরানী দিদিকে চিঠিতে লিখিস। খাতা লাগলে কাগজ কিনিস, টিপিন বেলায় নজেন খাস্‌।

ঝাঁ চকচক ঘরের মেঝে, হাঁটতে গেলে পিছলে যায়। সাঁই সাঁই সাঁই গাড়ি ছুটছে, জানলা দিয়ে দেখা যায়। গ্যাসের উনুন, ঠাণ্ডা আলমারি, বাড়িতে কর্তা-গিন্নি আর জলি মলি। জলি হ’ল তোতাটা, মলি হ’ল পুষিটা। কর্তা-গিন্নি অফিস যায়, চিত্রা তোতাকে ছোলা দেয়, কাচালঙ্কা খাওয়ায়, খাঁচা পরিষ্কার করে।

তোতা বলে, তুমি আমার সই।

চিত্রা বলে, আচ্ছা।

তোতা বলে, সই তোমার দেশ কোথায় ছিল?

হাবড়া অশোকনগর। তোমার?

আমার? ভুলে গেছি গো, শুধু একটা নীল পাহাড়, সবুজ ঝিল আর লাল বটফলের গাছ মনে পড়ে।

সুচিত্রা বাবুদের বিছানার চাদর টানটান করে, বই আলমারির ধুলো ঝাড়ে, ঠাণ্ডা আলমারি সাফসুফ করে, কুটনোটা কুটে দেয়, বাটনাটা বেটে দেয়। কত্তা গিন্নি দুজনাই খুব ভালবাসে। ফুটপাতের ফ্রক দিল, লাইফবয় সাবান দিল, শোয়ার জন্য শতরঞ্জি দিল। বলল, আমাদের ছেলেমেয়ে হয়নিকো, তুই আমাদের ছেলে, তুই আমাদের মেয়ে।

গিন্নিমা একদিন বললেন, মা চিত্রা, তোর তো এখানে কাজ অনেক কম, কাজই নেই, দ্যাক না, পাশের বাড়ির রেবতীর কত কাজ, সংসারে সাতজনের কাজ, বলি কি ঠিকে ঝিটাকে ছাড়িয়ে দি। কটা আর বাসন, কটা আর ঘর। তোর মাইনে বাড়িয়ে দেব।

চিত্রা বলল, বেশ তো।

ঠিঁকে ঝি পেত পঞ্চাশ। চিত্রার কুড়ি টাকা বাড়ল। বাড়িতে চিঠি লিখল–মাগো, কুড়ি টাকা বেসি দিব চুনী পান্না যেন ফল খায়, বাবা যেন দুধ খায়।

তোতা বলল, কি গো সই, কেমন আছ?

চিত্রা বলল, সুখে আছি।

তুমি?

তোতা বলল, সুখে আছি। বড় বড় লাল লাল লঙ্কা খাচ্ছি!

চিত্রা বলল, তোমার খাঁচাটা খুব সুন্দর গো।

তোতা বলল, হিংসে কোরো না সই, তোমারটা বুঝি খারাপ?

সূর্য ডোবে রাত পোহায়। দিন যায় মাস যায়। গিন্নিমা বলেছেন ভাল দেখে বিয়ে দিয়ে দেবে। গিন্নিমা বলেছেন, কী সুন্দর হয়ে গেছিস রে। কলের জলে চান করে তোর রঙ খুলে গেছে।

পুকুরে নায় পাপী তাপী গঙ্গা নায় চোর

কলের জলে যে চান করে তার বহু পূণ্যের জোর।

দেশে যেবার গেল বাবা বলল, কী সুন্দর হয়েছিস তুই। বেশ কয়েকদিন কাটিয়ে এল চিত্রা।

তোতা শুধোলো, কীগো সই, মুখ শুকনো যে?

চিত্রা বলল, বাপ মরেছে।

তোতা চুকচুক শব্দ করল – আহা রে! কেমন করে গো?

রক্তবমি। আমার কোলে মাথা রেখে বাপ আমার সগ্‌গে গেলেন।

তোমার মা বুঝি বুড়ো বয়সে সুখে থাকার লোভে সব যত্ন ছেলেদের করেছে, বুড়োটা অযত্নে মরেছে?

ও কথা বোল না সই। শাখা ভেঙে কোরা কাপড়ে মার কী কান্না।

 কাঁদবেই তো। সোয়ামি মরলে স্তিরি তো আধথানা।

সে কথাই তো মা কইছিল। মা কাগজ কাটতো বাবা আঠা সাঁটতো। এখন মা আধখানা। কী করে সংসার চলবে? একা একা ঠোঙা হয়? কী করে চুনী-পান্না দেবে ম্যাট্রি পাশ?

তোতা বলল, আহা গো, তোমার ছোট কাঁধে কত বোঝা।

সুচিত্রা একদিন গিন্নিমাকে বলল, মাগো, হারু ধোপা আপনাদের চাদর কাচে, কাপড় কাচে, কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা খরচ হয়। ওসব বরং আমিই কাচি। ঐ পয়সাটা আমাকে দিন। মা বললেন, বেশ তো, কিন্তু তুই কি অমন পরিষ্কার করে কাচতে পারবি? ও বলল, ঠিক পারব। মা বললেন–দেখি কেমন পারিস; চিত্রা মাকে লিখল–কুরি টাকা আরও বেশি দিব মাগো।

ছেলেটির নাম রতনকুমার। ফোলা ফোলা চুল, চোখে নীল রঙের চশমা, জেল্লামারা লাল গেঞ্জি। মাঝে মাঝে আসে ক’দিন ধরে। বাড়িতে ঢোকার আগে সিগারেটটা ফেলে দেয়। সন্ধেবেলায় বাজারটা করে দেয়, দোকান থেকে ওষুধটা এনে দেয়। কিছুক্ষণ টিভি দেখে। সুচিত্রা চা দেয়। আঙ্গুলে আঙুল লাগে যেন ঝিরঝিরানি, শিরিষ পাতার শিরশিরানি চিত্রার গায়ে।

মা বলেছে রতন খুব ভাল ছেলে। বাবুর অফিসের বেয়ারা। পারমেন হলে সুচিত্রাকে ওর সঙ্গে বিয়ে দেবে।

রতনকুমার রতনকুমার ফুলেল জাদুমণি

অনেক গুণের গুণী

ফণীর মাথার মণি।

রতনকুমার পেরায় পেরায় বাবুকে বলে, স্যার কবে পারমেন হব? বাবু বলেন, দাঁড়া দাঁড়া, সবে তো মাসে ছদিনের ক্যাজুয়ালে ঢুকলি। এখন দু’চার বছর ডেইলি রেটে কর…।

চিত্রা, মানে সুচিত্রা সন্ধে হলে বারান্দার ধারে ঘুরঘুর করে। রতনকুমার না এলে ফ্যানের ঘোরায় মন খারাপের হাওয়া গুমরে মরে।

হ্যাঁরে তোতা, ও কবে পারমেন হবে?

তোতা খাঁচার ফাঁক দিয়ে আকাশের ফালি দেখল। চোখ পিট পিট করে বলল, জল এগোয় না, তৃষ্ণা এগোয়।

বুঝলাম না তোতা, বুঝিয়ে বল!

রাজহংসের চরণ দেখে বকের নেঙা পেঙা।

একদিন এক গরমের দিনের রোববার। গিন্নিমা মেঝেতে শোবেন। খাটের পিছনটা বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। ওখানে আঁচল বিছাতে গিয়ে গিন্নিমা পেলেন পোড়া সিগারেটের টুকরো। কপাল কুঁচকে উঠল গিন্নিমার। খুঁজতে লাগলেন আরও কিছু পান কিনা। পেলেন কি যেন। চিত্রাকে ডাকলেন। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, দ্যাক ঘরের কোনায় সিগারেট পোড়া। ও তো ছোয় না। ওঁর বন্ধুরা এলে বাইরের ঘরে বসে।

সুচিত্রা দু হাতে দরজার পর্দা চেপে ধরে।

এবার গিন্নিমার গলা চড়ে–সিগারেট কি করে এল?

জানি না মা।

 সুচিত্রার চোখ ঘরের লাল মেঝের মাঝখানের কালো পদ্মটার দিকে। স্থির।

মা ওর চোখ থেকে পা পর্যন্ত দৃষ্টি বুলোচ্ছেন। ঐ দৃষ্টির স্পর্শে সর্বাঙ্গ জ্বালা করতে থাকে সুচিত্রার। মার মুখ থেকে একটা আওয়াজ বের হল–হুম্‌।

মা নিয়ে এলেন লাল বাক্স। বাক্স খুললে কৌটোর মতো কি যেন। লম্বা তার জোড়া। মেশিন। মা বললেন, মিক্সি। মশলা বাটা হবে, ঘোল হবে, শরবত হবে, চাটনি হবে। ছ্যাঁত করে উঠল সুচিত্রার অন্তর। ভিতরের কাগজের ইংরিজি কথা পড়ছিলেন মা। সুচিত্রা বলল, মেশিনেই সব করবে? তাহলে আমি?

তোর কী ক্ষতি? তোর তো আরও ভাল হল। তোর বন্ধু হল, কাজের হেলপ হল। মেশিনটাকে টেবিলে রাখলেন মা, গর্তের মধ্যে দই দিলেন, জল দিলেন, চিনি দিলেন, সুইচ টিপলেন–ঘড় ঘড় শব্দ।চোখের নিমেষেই ফেনা ফেনা ফেনা। এ-সব আমায় দেখাবি না ঢং-এর মেশিন, ঢং রাখ তুই, ধিঙ্গিপনা দেখাবি না।

মা বললেন, বেশ গুণের মেশিন। তোকেও দেখিয়ে দেব, শিখিয়ে দেব, কিন্তু আমরা না বললে চালাবি না।

মা অন্য কাজে গেলে একা একা মেশিনটাকে দ্যাখে সুচিত্রা। সুচিত্রা জিভ ভ্যাঙালো। মেশিনটাও জিভ ভ্যাঙালো। সুচিত্রা ঝাঁঝ গলায় বলল, ক্যানো এসেছিস? মেশিন বলল, ইঃ! তোর তাতে কী? সুচিত্রা বলল, তুই আমার সই না শত্তুর? মেশিন বলল, যা ভাববি তাই। সুচিত্রা বলল, তুই তবে আমার সই, আমার মিতা। আয় আমরা ফুল পাতাই। পদ্ম হবি, পদ্ম?

বাবু এলে দইয়ের ঘোল খান গরমের দিনে। চামচে নেড়ে সুচিত্রাই করত এতকাল। আজ মা করে দিলেন। মেশিনে। রান্নাঘর থেকে সুচিত্রা বাবুর ‘বাঃ’ শুনতে পেল। আর ‘বাঃ’ শব্দটা সুচিত্রার চোখের কোনায় জলের ফোঁটা হয়ে দুলতে লাগল। অমনি মেশিনটা খল্‌ খল্ হাসতে লাগল। সুচিত্রা বলল–এমন হিংসে ভাল নয় পদ্ম, মরণ দেখে হাসি ভাল নয়। মেশিনটা ঢঙির মতো হাসল তবু। এমন সময় রতনকুমারের গলা শুনতে পেল সুচিত্রা।

রতন বলছে, ধোপাবাড়ি যেতে হবে নাকি?

মা বললেন, না।

বাজার?

না।

চানাচুর?

না।

ওষুধ?

না।

চিত্রমালা শুরু হয়ে গেছে। সুচিত্রা ও ঘরে যায় না। যেতে পারে না। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেশিনটার ধারালো রুপোলি দাঁত আঙুলে ঘোরায়।

একদিন এক রবিবারে প্রেশার কুকার ফোঁসফোসাঁছে, ওঘরে কত্তা-গিন্নির কথা হচ্ছে। গিন্নি বলেন, মানুষের চেয়ে মেশিন ভাল।

 কত্তা বলেন, ওটা কবে আনব বল।

গিন্নি বলেন, ম্যাচিওর করবে এন.এস.সি.।

কত্তা বলেন, তারপরেতেই নি আসছি।

গিন্নি বলেন, রতন যেন আর না আসে।

কত্তা বলেন, দেখতে পাবে আসছে মাসে।

অমনি হিস্ হিস্ করে তুমুল শব্দে প্রেশার কুকার ধোঁয়া ছাড়ল, আর টপ্‌টপ্ করে দু ফোঁটা জল সুচিত্রার গালে কেন গড়াল সুচিত্রা জানে না।

সকালবেলা সুচিত্রা আবার দেখল মেশিনের কেরামতি। মুহূর্তে হয়ে গেল পুদিনার চাটনি, পোস্তবাটা। কত্তা বললেন, কী মোলায়েম। মেশিনটা খিল-খিল হেসে উঠল। গিল্লি বলেন, তোর তো ভালই হল বল, বাটতে হল না। মেশিনটা আরও জোরে হেসে উঠল। গিন্নিমা অফিস যাবার সময় বললেন, মেশিনটা মুছেটুছে রেখে দিস।

জল দিয়ে ঝাকিয়ে জারটা পরিষ্কার করে সুচিত্রা। শুকনো কাপড়ে মোছে খুব সাবধানে, যেন নখের দাগ না লাগে। কী চকচকে শরীরটা ওর। বড়লোকের মেয়ের মতো গা। মোলায়েম করে মমতায় মমতায় মোছে।

তোতা বলে, কীগো মিতে? তোমায় কে বলেছে সোহাগ দিতে?

সুচিত্রা বলে, আমার মন বলেছে।

ভাল ভাবলেই ভাল

কালো ভাবলেই কালো

মনের কাছে সব রয়েছে।

তাই নারে পদ্ম?

মিক্সি মেশিন উত্তর দেয় না।

সুচিত্রা জারের উপরে মুখ নেয়। শ্বাস নেয়। হাল্কা পুদিনাপাতার ঘ্রাণ।

সুচিত্রা বলে, শোন সই, তোরে মনের কথা কই। রতনের কথা বলবে বলবে ভাবে, কিন্তু বলে না। বলে–পদ্ম সই, পদ্ম সই, তুই আমাকে ভালবাসিস? তুই আমার কাজ কমাবি?

মিক্সি মেশিন কিছু বলে না।

আমার চেয়ে তোর কাজ ভাল, আমার নিন্দে, তোর প্রশংসা, তবু আমি তোকে হিংসে করি না। করতে নেই।

একবার একটু ঘোর তো দেখি, ঘোর। দেখি তোর ঢং। সোহাগী। সোহাগ চাঁদবদনী ধনি। সুচিত্রা প্লাগ গুঁজে দেয়। সুইচ অন করে। ঘোরে না। রাগ করলি পদ্ম সই? মেশিন ঘোরে না। আলোর সুইচ টিপে দেখে জ্বলে না। ওঃ তবে লোডশেডিং। সুচিত্রা মেশিনের গায়ে আঁকিবুকি কাটে। লেখা রতন! রতন! ঐ আঙুলটা দিয়েই মেশিনের রূপোলি দাঁতগুলি ঘোরায়। কী ধার।

রতন! রতন!

পদ্মরে পদ্ম। পদ্ম সই! কোন সুখে তুই ফুটিসরে পদ্ম, তুই না সত্যের ফুল!

চলকে উঠল রক্ত। রক্তে মাখামাখি। চিৎকার করে উঠল সুচিত্রা। তুমুল চিৎকার করে উঠল। হঠাৎ ঘুরছে। মেশিন ঘুরছে। ভীষণ ঘুরছে। আঙুলের টুকরোটা লাফাচ্ছে… লাফাচ্ছে, ছিন্ন-ভিন্ন। ক্রমশ রক্ত-কাদা। জারের গায়ে লাল চন্দনের মতো লেগে রয়েছে রক্ত-কাদা। ডগাহীন হাতটা ঝাকাচ্ছে সুচিত্রা, দেওয়ালে ফুটে উঠছে রং নকশা, সুচিত্রা কাঁদছে, ফোঁপাচ্ছে। বিড়ালটা একটানা ডেকে চলেছে–মিউ-মিউ মিউ।

ঢাই কুড়কুড় ঢাকের বাদ্যি, মাইকে গান। রদ্দুরে-রদ্দুরে নাচে জরির ঝালর। পুজো এল।

‘অন্য বাড়ির হলে সেদিনই বিদেয় করে দিত, আমি বলেই পুজোয় আবার শাড়ি দিলাম।’ মা বলেছিলেন। ছাপা শাড়িটার নতুন গন্ধ। ব্যান্ডেজ বাঁধা শাড়ি ঘুরোতে কষ্ট। ব্যান্ডেজের ওষুধের গন্ধ নতুন শাড়ির গন্ধে মেশে। গিন্নিমার সঙ্গে একদিন বারোয়ারি পুজো দেখতে যায়। কিচ্ছু ভাল লাগে না। এত ভিড়েও মানুষ নাই, এত আলোয় অন্ধকার, এত শব্দেও নিঝুম। রতন আর আসে না।

দশমীর পরদিন হাসপাতালে যাবার তারিখ ছিল। পরতে পরতে খুলল ব্যান্ডেজ। আঙুলটার নখ নেই। নখের জায়গায় একটা দলামোচড়া এবড়ো-খেবড়ো মাংসপুঁটলি ব্যাঙের বাচ্চার মতে বসে আছে।

বিকেলে বাবু দেখতে চাইলে সুচিত্রা ওর লজ্জামুঠি খোলে না। একা-একা খুলল, তখন ডুকরে ডুকরে কাঁদল। সেই দিনই সন্ধের সময় লোকেরা এসে কি একটা মেশিন দিয়ে গেল। ওরা বোঝাচ্ছিল, বলছিল দু মিনিটেই এক্কেবারে পরিষ্কার, সাফসুফ। সুচিত্রা বুঝল আবার কিছু একটা মেশিন। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করল না। রাত্রে কত্তা- গিন্নির কথা হল–মেশিন ভাল না মানুষ ভাল, মানুষ ভাল না মেশিন ভাল, মেশিন–মানুষ, মানুষ–মেশিন।

ক’দিন পরে রবিবার। মা নিজে হাতে ছোলা দিলেন পাখিকে। বাবু চা খাচ্ছিলেন। মা বললেন, কৈ গো, একবারটি এসো, মলিকে ছেড়ে দিচ্ছি।

তারপর সুচিত্রাকেও বলল–মা, বেড়ালটাকে বিদেয় দেব, তাকেও আর কাজ করতে হবে না এখানে। তোকেও ছেড়ে দেব। আমরা ঝাড়া হাত-পা হব।

ছিরিক ছিরিক রক্ত ছলকায়। সে কী কথা!

সুচিত্রার গা টলমল, চোখ ছলছল।

যারে তোতা উড়ে যা…

খাঁচার গায়ে চুমো দিয়ে দরজা খুলে দিলেন মা। তোতা হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে আবার খাঁচায় ঢুকে যায়।

বাবু তাকান মায়ের দিকে, মা তাকান বাবুর দিকে। তোতাটা কারুর দিকে তাকায় না, খাঁচায় ঢুকে চোখ বুজে বসে থাকে।

সকালের জলখাবারে একটা বড় রসগোল্লা পেল সুচিত্রা। পাওনা টাকা বুঝে পেল। মা বলেছে নিজে গিয়ে শিয়ালদা স্টেশনে তুলে দিয়ে আসবে।

সুচিত্রা একা-একা এঘর-ওঘর করে। লাল সিমেন্টের কালো আলপনার গায়ে হাত বুলোয় বাথরুমের কলের চাবি ঘুরায়। ছর ছর জলের শব্দ শোনে।

তোতার কাছে যায়। তোতা তুই বড্ড বোকা। ছাড়া পেলি, গেলি না। তোতা বলে – খাঁচার বাইরে আমার কিচ্ছু নাই। ডানায় আমার শক্তি নাই। কেমন করে ডানা নাড়ে, কেমন করে আকাশে ওড়ে–ভুলে গেছি। আমার অচিন দেশের অশথ ছায়ায় তুই যা।

সুচিত্রার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। রতন। রতন।

রতন এল। কতদিন পর। ঢাই কুড়কুড় বাদ্যি বাজে। রতন বলে, বিজয়ার পোনামটা করতে এলাম। মা প্লেটে করে মিষ্টি দিল। সুচিত্রা এক গ্লাস জল নিয়ে গেল তাড়াতাড়ি। সুচিত্রার কাটা মাংস পুঁটুলি দেখে আঁতকে উঠল রতন। অন্য দিকে মুখ ফেরাল। ঐ গেলাসে জল খেল না। বোতল গড়িয়ে জল খেল। সুচিত্রার দিকে একটিবারও চাইল না। একটি কথাও কইল না। চলে যাওয়ার চটির শব্দ ঠাস্ ঠাস্ ঠাস্‌।

বালতি ব্যাগে শাড়িকাপড় গুছিয়ে চোখ মোছা ভেজা রুমালে টাকা কটা বেঁধে সুচিত্রা তৈরি। বাবুকে প্রণাম করল। মা ঘাড়ে পাউডার ঢালছে।

লাল সিমেন্টের কালো আল্পনাকে বলল–যাই। বারান্দার রেলিং, জলের কল, বেলুনচাকি, যাই। মিক্সি মেশিন, নতুন মেশিন, তোরা সুখে থাক, আমি যাই। যাইরে তোতা পাখি। তুই রইলি ডালে, আমি রইলাম জলে, দুইজনে দ্যাখা হবে মরণের কালে।

সন্ধে হয় হয়। কাকেরা ফিরছে, বকেরা ফিরছে। ধোঁয়ার গন্ধ, শাঁখের শব্দ – এ সময় বাড়ি ঢুকল সুচিত্রা। ঘরে গান হচ্ছে টেপ-রেকর্ডারে। ডিস্কো ড্যান্সার। ঘরে মা আর ছোট ভাই। মা ঠোঙা করছে। কী খুশি। মা বললেন, তোর কথাই ভাবছিলাম। কাল ভাইফোঁটা। গতবারেও আসিসনি। কদিন থাকবি?

ওসব কিচ্ছু বলে না সুচিত্রা। মুঠোর মধ্যে ভরে রাখে নষ্ট আঙুল। বলে, ভাইরা লেখাপড়ি করছে তো?

পান্নাটা পড়ছে যা হোক, চুনীটা পড়ে না আর। রোজগার করে। বর্ডারে যায়। এই তো টেপ-রেকট কিনেছে। ঐ যে, বেড়া লাগিয়েছে। পড়ালেখায় কি চাকরি হয়? কত এম.এ. বি.এ. ঘুরছে।

চুনী আসে রাত করে। ঠোটের উপর নতুন গোঁফের রেখা। চুল ফোলা ফোলা। গায়ে জেল্লামারা লাল গেঞ্জি।

একসঙ্গে ভায়ে বোনে খেতে দেয় মা। ও খায় না। লজ্জামুঠি খুলতে ওর ভয়। মেয়ে সন্তানের খুঁত হয়ে থাকার লজ্জা। লজ্জা কতক্ষণ আর গোপনে থাকে? রাত্রে প্রতিপদের চাঁদ ডুবে গেলে নক্ষত্র ছড়ানো আকাশের তলায় পুকুরঘাটের স্নান আলোয় মায়ে-ঝিয়ে কতক্ষণ কাঁদল। দিঘির জলে শালুক ফুল, শালুক ফুলে অন্ধকার। শালুক রে শালুক, এই নারীজন্ম তুই নে, তোর জন্ম আমায় দে।

পরদিন সকালে দুর্বা তুলে ধান সাজিয়ে চন্দন বেটে রেকাব সাজিয়েছে মা। চুনী পান্না দু ভাই বসেছে আসন পিঁড়ি। ওদের বড় তাড়াহুড়া। গ্যাঁড়া বাবলু স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকবে। চুনীর সঙ্গে পান্নাও যাবে আজ কাজ শিখতে। ভায়ের কপালে ফোঁটায় যম দুয়ারে কাঁটা দিল সুচিত্রা। তারপর এগিয়ে দিল মিষ্টির থালা। চেঁচিয়ে উঠল চুনী–দিদি, তোর আঙুল? সুচিত্রা আঁচল চাপা দেয় মুখে। মুখ নিচু করে। মা তখন অল্প করে বলেছিল আঙুল নষ্ট হবার গল্প।

ক্রমশ কপাল কুঁচকে উঠছিল চুনীর, মুখে ফুটছিল বিরক্তি রেখা। মায়ের সব কথা শেষ হবার আগেই হাতের খাবার দূরে ঠেলে দিল চুনী, কী ফ্যাসাদ বাধালি, অ্যাঁ? কী রকম বেঁকে রয়েছে ঠোঁট।

সুচিত্রারও নিচু মুখটা, ভারি মুখটা, ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে জেগে ওঠে, যেন জলের অতল থেকে মাথা তুলল মনসা-বাহন। তাকাল সোজা। নির্বাক। নিশ্বাসে প্রশ্বাসে কত কী বলে। কোঁচকায় কপাল, আর গোটা নারী জম্মটাকে জ্বলন্ত অঙ্গার করে ছুঁড়ে মারে চোখের দৃষ্টিতে। থপ্ থপ্ পায়ে ঘর থেকে বার হয়, মেদিনী কেঁপে ওঠে, স্বর্গসভায় বেহুলার পদ-নুপুরের আর্ত-নিক্কন চরাচরে বাজে। পৃথিবী টলোমলো, দিঘির জলে টলোমলো শালুক ফুল। গা গুলিয়ে ওঠে সুচিত্রার। সত্যি সত্যি গা গুলোয়। পুকুর পাড়ে বসে পড়ে। বসে পড়ে একটা ফ্যাসাদ হয়ে যাওয়া গোটা নারী-জন্ম। সারা শরীর থেকে কী যেন দলা পাকিয়ে উঠতে চায়। হড়-হড় করে বমি করে ফেলে। ঐ টক জল, ঐ ক্লেদ, শালুক পুকুরের দিকে বহে যায়। ঐ উদ্গার কেমন যেন অর্থবহ হয়ে ওঠে। ঐ উদ্‌গীরণ, ঐ লাভাস্রোত, ধোঁয়া ওঠা পৃথিবীর মাটিতে বহে যায়। মাটি ফেটে যায়, দু ভাগ হয়। মা ধরিত্রী বলে, আয়, কোলে আয়, শান্তি নে। সুচিত্রা তার লজ্জামুঠি খুলে ধরে। ময়ূর পাখনার মতো খুলে যায় হাত। বাতাস নাড়িয়ে তার তুমুল নিষেধ – যাব না, যাব না। কালো দিঘির জল বলে আয়, আয়, শান্তি নে। হাতের নিষেধে ওর যাব না যাব না।

লজ্জামুঠি খুলে গেছে। মাটির গায়ে ফুটে উঠছে চারটি নখের কঠিন আঁচড় চিহ্ন। আঁচড়ের সন্ত্রাস। মেয়েলি ভাষার ঐ ক্ষোভ চিত্রলিপি মাটিতেই পড়ে রইল। রতন জানল না, চুনী-পান্না না, জানল না বাপ পিতামহ পূর্বপুরুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *