৪. কন্ট্রোল রুমের মধ্যে

‘আঙ্কল! আঙ্কল!’

দেবু’র ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন শঙ্কর গাঙ্গুলি। কন্ট্রোল রুমের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি।

প্রথমেই তাঁর নজর গেল বাইরের দিকে। সেখানে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। জানলার বাইরে, এই বাড়ির চৌহদ্দি পেরোলে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। তার ওপরে ঝুঁকে এসেছে তারা ভরা নির্মেঘ আকাশ। ডানদিকে তাকালে পাহাড়ের ঢেউ, দূরে দেখা যায় ক্ষীণতোয়া ডায়না নদী।

উঠে দাঁড়ালেন শঙ্কর। কন্ট্রোল রুমের লাগোয়া ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে চোখে জল দিয়ে এলেন তিনি। তারপর তিনি, দেবু আর মেজর বক্সি তিনটে চেয়ার টেনে বসলেন।

প্রথম প্রশ্ন করলেন মেজর বক্সি, ‘কোনো ক্লু পাওয়া গেল প্রফেসর? সকাল থেকে চিফ বারবার ফোন করছেন। প্রাইম মিনিস্টার নিজেও খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন।’

‘আপনাদের ইনটেলিজেন্স এজেন্সিগুলো কোনো খবর আনতে পারল? মানে এর পেছনে কোনো বৈদেশিক শক্তির ষড়যন্ত্র নেই তো?’

‘না প্রফেসর। খুব সম্ভবত এর পেছনে কোন বৈদেশিক শক্তির হাত নেই। পুরো ব্যাপারটাই ইন্টার্নাল। আপনার রিডিং কী বলছে?’

ভ্রূ কুঁচকে বাইরের দিকে তাকিয়েছিলেন শঙ্কর। অন্যমনস্কভাবে বললেন ‘আমার রিডিংও একই কথা বলছে। মনে হয়, আমি বুঝতে পেরেছি কী ঘটেছিল সেদিন।

এখানে যে যন্ত্রটি আছে, তার মতো পাওয়ারফুল জিনিস জীবনে কমই দেখেছি আমি। এই সাইলেক্ট্রোপ্রোটন যন্ত্রটি এতই শক্তিশালী যে তাতে স্থানীয়ভাবে একটি ছোট আকারের ব্লকড এনার্জি সেন্টার তৈরি করা সম্ভব। খুব সম্ভবত এখানে সেটাই ঘটেছে। পরীক্ষার ভুলে আচম্বিতে জন্ম নেওয়া ব্লকড এনার্জি সেন্টারটি স্পেসটাইম ফেব্রিকে, মানে স্থান ও কালের নিরবিচ্ছিন্ন চাদরে একটি গহ্বর তৈরি করেছে।

 বেশি বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে লাভ নেই। শুধু জেনে রাখুন, ওরা এখানেই আছে, কিন্তু টাইম আর স্পেসের অন্য ডাইমেনশনে।’

‘মানে? আপনি কী বলছেন আঙ্কল?’ প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে দেবু। মেজর বক্সিও বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে থাকেন শঙ্করের দিকে। শঙ্কর নীচু গলায় ব্যাখ্যা করেন।

‘সারাদিন ধরে এর শেষ রেকর্ড হওয়া রিডিংগুলো নিয়ে বসেছিলাম। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, প্রতিটা এক্সপেরিমেন্টের একটা প্যাটার্ন আছে। বেশ কয়েকদিন ধরে ধীরে-ধীরে যন্ত্রটার কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে মূল এক্সপেরিমেন্টের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

যে এক্সপেরিমেন্টটি হিতেশ করছিল, তার ডেটা-সেট নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামাতে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষার সময় মেশিনের ক্যালিব্রেশনে কিছু গণ্ডগোল হয়। তাতেই এই দুর্যোগ। ফলে অতি ক্ষুদ্র একটি জায়গায় একটি স্পেসটাইম ফিসার তৈরি হয়, তার মধ্যে দিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে হিতেশ আর বাকিরা ওপারে চলে গেছে।’

‘সাউন্ডস এক্সট্রিমলি স্ট্রেঞ্জ প্রফেসর।’ মেজর বক্সির গলায় সন্দেহের সুর স্পষ্ট হয়, ‘এসব তো সায়েন্স ফিকশনে হয় শুনেছি। আপনি শিওর?’

‘হ্যাঁ মেজর। আমি নিশ্চিত যে এটাই ঘটেছে।’

‘সেক্ষেত্রে তো এই সমস্যার সমাধান করা প্রায় অসম্ভব।’ উত্তেজিত শোনায় মেজরের গলা, ‘আমাদের তো তাহলে অন্য লেভেলে মুভ করতে হবে। পিএমও-র পক্ষ থেকে অবশ্য সার্নের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ওঁরা জরুরি ভিত্তিতে একদল উচ্চপর্যায়ের বৈজ্ঞানিক দল পাঠাচ্ছেন। বোধহয় কাল-পরশুর মধ্যেই তাঁরা…’

‘কাল বা পরশু? মাই গুডনেস!’ অস্থির হয়ে ওঠেন, শঙ্কর, ‘আপনি বুঝতে পারছেন না মেজর, সময় বয়ে যাচ্ছে। যেহেতু হিতেশ আর বাকিরা জীবিত অবস্থায় গেছে ওই জগতে, সেখানকার ইকুইলিব্রিয়াম এখন দ্রুত নষ্ট হতে থাকার কথা। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের ওপারের জগত দুটো কাজ করতে পারে। হয় পুরো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, নইলে ওদের জোর করে অন্য কোনো প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে পাঠিয়ে দিয়ে আগের অবস্থা রেস্টোর করতে পারে। দুই ক্ষেত্রেই ওদের আর ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’

মাথা নীচু করে কী যেন একটা চিন্তা করেন মেজর বক্সি, তারপর বলেন, ‘যদি আপনার কথা মেনেও নিই প্রফেসর, তাহলে আমাদের হাতে কতটা সময় আছে?’

‘সময় প্রায় নেই বললেই চলে মেজর বক্সি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের মুভ করতে হবে।’ উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যে হাঁটতে থাকেন শঙ্কর, ‘এই টাইম অ্যান্ড স্পেসের ইকুইলিব্রিয়াম একবার পুরোপুরি নষ্ট হলে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে ঠিক তিন দিন লাগে। এর মধ্যে দু’দিনের বেশি সময়ে চলে গেছে। আজ শেষ দিন, এখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। মেশিনটা চালু করে সেই ক্যালিব্রেশন স্ট্যান্ডার্ডে আনতে সময় লাগবে ঘণ্টা চারেক। অর্থাৎ তার পরে আমাদের হাতে আর আধঘণ্টার বেশি সময় নেই।’

‘তাহলে?’ জানতে চান মেজর, ‘আমরা এখন কী করব?’

‘এখন একটাই রাস্তা আছে।’ দৃঢ় স্বরে জবাব দেন শঙ্কর, ‘সেই এক্সপেরিমেন্ট চালু করে এই মেশিনটাকে ফের সেই অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে।’

‘তাতে কী হবে?’

‘তাতে সেইদিনের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তৈরি হবে গাইড পাথ। সেই পথ ধরে ওদের ফিরিয়ে আনতে হবে।’

‘গাইড পাথটা কী জিনিস?’

‘সময়ের রাস্তা দু’টি স্পেসটাইম পয়েন্টের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে ঠিকই।’ বোঝানোর চেষ্টা করেন শঙ্কর, ‘কিন্তু সেই রাস্তাটা পৃথিবীর রাস্তার মতো সোজাসুজি নয়। তার ডিরেকশন ক্রমাগত বদলাতে থাকে। সেটা চেঞ্জ হয় কোয়ান্টাম প্রব্যাবিলিটি অনুযায়ী।

যিনি ওদের গাইড করে নিয়ে আসবেন তাঁকে হতে হবে অঙ্কে তুখোড়। সেখানে কম্পিউটার বা ক্যালকুলেটর নিয়ে যাওয়া যাবে না। বোস-পঁয়কেয়ার থিওরেম মনে-মনে সলভ করতে করতে পথ চলতে হবে, একমাত্র তাহলেই প্রতিটি বদলে যাওয়া বাঁকের হদিস পাওয়া সম্ভব।’

দেবু আর মেজর বিস্মিত হন। পরের প্রশ্নটা দেবুই করে, ‘অমন প্রতিভাধর গণিতজ্ঞ পৃথিবীতে আদৌ কেউ আছেন আঙ্কল?’

‘একজনই আছেন দেবাদিত্য। তিনি একইসঙ্গে ফিজিক্স আর ম্যাথস অলিম্পিয়াডে গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। পেয়েছেন গণিতের সর্বোত্তম সম্মান ফিল্ডস মেডেল। যিনি ফার্মা’স লাস্ট থিওরেম সলভ করেছেন।’

‘তিনি কে ডক্টর?’ সামনে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করেন মেজর বক্সি।

‘আমি। সে মানুষটি আমি নিজে!’

বিষয়টা দেবু আর মেজর, কারও কাছেই বিশেষ পরিষ্কার হয় না। শেষমেশ দেবুই প্রশ্ন করে, ‘তার মানে…আপনি কী বলতে চাইছেন আঙ্কল?’

কাচের জানলার কাছে গিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকান শঙ্কর। তাঁর শক্ত চোয়ালের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছিল। ওইভাবে দাঁড়িয়েই বলেন তিনি, ‘একটাই মাত্র উপায় আছে। ওই এক্সপেরিমেন্ট রিপিট করে সময়ের ওপারে চলে যেতে হবে আমাকে। ওদের ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’

‘অসম্ভব!’ এবার মেজর উঠে দাঁড়ান, ‘আমি আপনাকে ফের এই বিপজ্জনক এক্সপেরিমেন্ট করার পারমিশন দিতে পারি না। এর ফলাফল যদি আরও ভয়ঙ্কর হয়? আর তাছাড়া আপনার মতো বৈজ্ঞানিকের জীবন নিয়ে এইরকম ঝুঁকি নেওয়া… না-না! এ জিনিস করা যাবে না।’

‘আমার জীবন?’ ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ান শঙ্কর, ‘আমার জীবনে আর কী আছে মেজর? আমার পরিবার নেই, স্বজন নেই, বন্ধু নেই, দুটো কথা বলার লোক নেই। বিজ্ঞানী সমাজে আমি ব্রাত্য। সুজন আর হিতেশ ছাড়া আমি যে এমনিও বাঁচব না মেজর বক্সি।’

এতক্ষণে বুঝতে পারল দেবু, কেন এত কাঠখড় পুড়িয়ে ওদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে! ভালোবাসা। প্রবল ভালোবাসা না থাকলে নিজের ওপর এত বড় ঝুঁকি আর কেই বা নেবে? কী যেন বলছিলেন না কৃষ্ণদা? ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড় তন্ত্র, সবচেয়ে বড় জাদু!

‘কিন্তু আঙ্কল, যদি আরও কোনো বড় ক্ষতি হয়?’ প্রশ্ন করে দেবু।

‘হবে না দেবাদিত্য। আমি কন্ট্রোল করার প্রসেসটা বুঝে নিয়েছি। আমি এই মেশিনটাকে ঠিক সেই ক্যালিবেশনেই সেট করব যাতে মাত্র একজনই পোর্টেড হন।’

মেজর বক্সির দিকে ঘোরেন শঙ্কর, ‘পারমিশন? পারমিশন আপনি পেয়ে যাবেন মেজর। আপনারা আসার আগে আমি চিফের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। তিনি আপনাকে ব্রিফ করে দেবেন।’

দেবু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ‘তাহলে মেশিনটা অপারেট করবে কে?’

‘ওটা তোমাকেই করতে হবে।’ দেবুকে বলেন শঙ্কর, ‘তুমি এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সের স্টুডেন্ট, তোমাকে ছাড়া এই যন্ত্র চালাতে পারে এখানে এমন আর কেউ নেই।

আমি ওই মেশিনের ঘরে থাকব। তোমাকে দেখিয়ে দিয়ে যাব কী করতে হবে। ভয় পাবে না একদম! খুব কঠিন কিছু নয়। শুধু মাথা ঠান্ডা রেখে, প্যানিকড না হয়ে ক্যালিব্রেটেড পয়েন্টে লিভারটা স্টেডি করে রাখতে হবে। যা খুশি হয় হোক, দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাক, সেই পয়েন্ট থেকে সরে আসা চলবে না। মনে থাকবে?’

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে দেবু।

আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে দ্রুত হাতে কন্ট্রোল প্যানেল চেক করতে থাকেন শঙ্কর, ‘অসুবিধা শুধু একটাই মেজর, আর সেটাই মোক্ষম। ওয়ার্ম হোল তৈরি হওয়ার সময় অনেক অনৈসর্গিক ব্যাপার-স্যাপার ঘটবে। সেটা সাধারণ মানুষের সামনে করাটা বড় রিস্কি হয়ে যাবে। তারজন্যে সেইদিনের মতো ঝড়জলের রাত চাই। অথচ আকাশে এখন একফোঁটা মেঘ নেই…’

ঠিক তখনই কাচের ওপারে ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। তিনজনেই চমকে তাকালেন বাইরের দিকে। এক ঝটকায় কাচের স্লাইডিঙের পাল্লা সরিয়ে দিলেন মেজর।

একটু আগের নির্মল আকাশ এখন ঘন মেঘে ঢাকা। হু-হু করে বেড়ে উঠছে মেঘের পর মেঘের স্তূপ। তার সঙ্গে উঠেছে প্রবল ঝড়। একটা তীব্র জোলো হাওয়ার স্রোত যেন তিনজনকে ধাক্কা মেরে ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে। অন্ধকারের মধ্যেই দেখা গেল, নদীর ধারের গাছগুলো পাগলের মতো মাথা নাড়াচ্ছে। কে যেন চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাচ্ছে তাদের।

‘দিস ইজ জাস্ট ইমপসিবল!’ চেঁচিয়ে উঠলেন শঙ্কর, ‘হাউ অন আর্থ…?’

অসমাপ্তই রয়ে গেল তাঁর কথা। গুমগুম আওয়াজের সঙ্গে একটা বাঁকানো তরবারির আকারের বিদ্যুতের ফলা আকাশের বুকে আছড়ে পড়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জ্বালিয়ে দিল।

চোখ বন্ধ করে ফেলল দেবু। তিনি আসছেন। তিনি শুনেছেন তাদের কথা। কালখড়গ হাতে, মহাঘোর রবে তিনি নেমে আসছেন সময়ের জঠর উন্মুক্ত করতে।

মহাকালী আসছেন!

*

বাতাসের বেগ ক্রমেই বেড়ে উঠছিল। দূরের গাছেদের মাথাগুলো দুলছিল ভয়ানকভাবে। পাগল হয়ে উঠছিল ডায়না নদী। বাতাস বয়ে যাওয়ার শোঁ-শোঁ শব্দে কান পাতা দায়।

তারই মধ্যে সাইলেক্ট্রোপ্রোটনের প্রধান মেশিনটা চালু করে দেবু। কমিউনিকেশন ডিভাইসের ওপর নজর রাখছিল সে। এখনও অবধি তেমন কিছু হয়নি। শঙ্কর গাঙ্গুলি মেশিনরুমের ভেতর আছেন। মেজর বক্সি সহ বাকি কম্যান্ডোরা আপাতত এই এলাকার বাইরে। কাচের দেওয়ালের বাইরে উথাল-পাতাল বাতাস আর ঝোড়ো বৃষ্টি। সেসব পেরিয়ে প্রায় কিছুই দেখা যায় না।

ঘড়িতে তখন দশটা পনেরো।

দশটা সাতাশ নাগাদ দেবু খেয়াল করে যে কোনো বোধগম্য কারণ ছাড়াই কমিউনিকেশন ডিভাইসগুলোর রিডিং ধীরে ধীরে কমে আসছে। ইলেক্ট্রিগ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ হিট করার প্রাথমিক লক্ষণ এটাই! এরপর ডিভাইসগুলোর রিডিং কমতে-কমতে শূন্য হয়ে যাবে। তারপর নষ্ট হয়ে যাবে এই এলাকার প্রতিটা সময় নির্দেশক যন্ত্রের সেটিং। তখন সময় মাপার জন্য শুধুমাত্র একটা জিনিসই কাজে আসবে দেবুর।

কন্ট্রোলরুমের কোণে রাখা বালিঘড়িটা!

বালিঘড়ি দিয়ে কী করে সময় মাপতে হয় সেটা দেবুকে বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রফেসর গাঙ্গুলি। এই এক্সপেরিমেন্টের প্রতিটা পদক্ষেপের খুঁটিনাটি ওকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। সেই মতো কয়েকটা সেটিং চেঞ্জ করে দেয় দেবু। এসি-র মধ্যেও কপালে ঘামের ফোঁটা জমতে শুরু করেছিল তার।

রাত দশটা একান্ন।

হঠাৎ করেই থরথর করে কেঁপে ওঠে মেশিনঘর। কন্ট্রোল ডিভাইসের কাছে দৌড়ে যায় দেবু। দ্রুত হাতে কয়েকটা নব ঘোরাতেই একটা চাপা গুমগুম আওয়াজ ভেসে আসে মেশিনঘর থেকে। তারপর একটা অদ্ভুত, বিজাতীয় শব্দে ভরে যায় সারা বাড়িটা। মনে হয় যেন লক্ষ লক্ষ মৌমাছি একই সঙ্গে ডানা ঝাপটাচ্ছে।

শুরু হয়েছে!

শিরদাঁড়া বেয়ে একটা আলাদা উত্তেজনার স্রোত বেয়ে যায় দেবুর শরীরে। কাঁপতে থাকা ঘেমো হাতে মেইন লিভারটা আঁকড়ে ধরে সে। তারপর ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে সেটাকে সর্বোচ্চ বিন্দুর দিকে নিয়ে যেতে থাকে।

এগারোটা পনেরো।

দ্রুত কমতে থাকে কমিউনিকেশন ডিভাইসের রিডিং। মেশিনের গোঁ-গোঁ শব্দটা বাড়ছে। চোয়াল শক্ত করে লিভারটাকে ক্যালিব্রেটেড পয়েন্টের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে দেবু। আস্তে-আস্তে কাঁপতে শুরু করে ঘরটা। এসি বন্ধ হয়ে যায়। আলোটাও যেন দপদপ করে ওঠে।

এতক্ষণ ধরে অন্য কোনোদিকে দেবুর কোনো নজর ছিল না। বিভিন্ন স্যুইচের নব চেঞ্জ করতে করতে হঠাৎ করে নিজের হাতের দিকে লক্ষ করে সে।

এ কী? তার হাতটা এতো আবছা দেখাচ্ছে কেন?

অবাক হয়ে নিজের শরীরের দিকে তাকায় দেবু। সবই কেমন ধোঁয়াশার মতো লাগছে না? লিভারের কন্ট্রোল হাতে রেখেই ভীতভাবে চারদিকে তাকিয়ে দেখে দেবাদিত্য।

এই ঘর, দেওয়াল, দরজা, ঘরের সিলিং, ঘরের মধ্যে থাকা ল্যাবের কন্ট্রোল প্যানেল, সবকিছুই যেন সিনেমার ছায়াচিত্রের মতো কাঁপতে-কাঁপতে গলে যেতে শুরু করেছে। প্রবল বর্ষায় জানলার কাচে জমা জলের স্রোত যেভাবে নীচের দিকে গড়িয়ে যায়, যেভাবেই তার চোখের সামনে গলে পড়ছে এই জগৎ।

যা হচ্ছে হোক, নিজের মুঠো শক্ত করে সে। ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে ওদের, যে কোনো মূল্যে। বাঁ-হাতের চেটো উলটো করে কপালে জমা থাকা ঘাম মুছে ফেলে দেবু।

এগারোটা সাতাশ।

আরও ধোঁয়াটে হয়ে এসেছে যেন সবকিছু। সাইলেক্ট্রোপ্রোটনের গুমগুম আওয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠেছে বজ্রপাতের শব্দ। ঘরের আলো নিভে এসেছে প্রায়। বিদ্যুতের ঝলক আছড়ে পড়ছে ঘরের মধ্যে। যন্ত্রের মতো কন্ট্রোল প্যানেল অপারেট করে চলে দেবু। মাথার মধ্যে এক ম্লান শূন্যতা তার সমস্ত অনুভূতি ভোঁতা করে দিচ্ছিল যেন।

এগারোটা ঊনত্রিশ।

থরথর করে কাঁপতে থাকা এই জগতের মধ্যে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি আবছা হয়ে আসে দেবাদিত্যর। মেশিনঘর থেকে বেরোনো শব্দটা আরও হিংস্র, আরও উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে, যেন বিশাল কোনো ক্ষুধার্ত নেকড়ে এক্ষুনি ছাড়া পেয়েছে খাঁচা থেকে। তার ক্রুদ্ধ গর্জন দেবুর মগজ অবধি পৌঁছতে পারে না। মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাবে ও। লিভারটা আর ইঞ্চিখানেক নড়াবার মতো শক্তিও তার শরীরে অবশিষ্ট নেই।

মাথাটা শূন্য হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে নিজের শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে পিকপয়েন্টে লিভারটা ঠেলে দেয় দেবাদিত্য। ঠিক সেই সময় তার চোখের সামনে দুনিয়াটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিলিয়ে যায়!

*

পৃথিবী উথালপাতাল করা তাণ্ডবের মধ্যেও নদীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। চারদিকে ঝড়ের ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন স্বয়ং মহাদেব দামাল হাওয়ার শূল হাতে এই বিশ্ব ধ্বংস করতে নেমে এসেছেন। নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠছিল পাগলের মতো। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছিল বড় বড় পাথর। উপড়ে আসছিল আস্ত গাছ।

ঝোড়ো বাতাস যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল সেই মানুষটিকে। ঝড়ের দাপটে কাপড় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল তাঁর। মুখে উড়ে আসছিল খড়কুটো। বৃষ্টির জল তীক্ষ্ন সুঁচের মতো বিঁধছিল তাঁর সর্বাঙ্গে। তবুও সেসব অগ্রাহ্য করে নদীর ওপারে থাকা বাড়িটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর চোখের সামনে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটছিল তখন।

বাড়িটার মাথার ওপর ধীরে ধীরে আবির্ভূত হচ্ছিল একটি অতি বিশাল বৃত্ত চাপ। দেখে মনে হচ্ছিল, অতিলৌকিক কোনও মহাসর্প তার কুণ্ডলীসমেত নেমে আসছে বাড়িটার ওপর। অমোঘ, দুর্লঙঘ্য, অনিবার্য নিয়তির মতো নেমে আসা সেই কালসর্পের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে ছিলেন মানুষটি। শ্মশানে অনেক পিশাচসাধনা করেছেন তিনি। অযুতসংখ্যক আধিদৈবিক এবং আধিভৌতিক দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। তবুও তাঁর শিরদাঁড়াতে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিল এই অতিজাগতিক অনৈসর্গিক দৃশ্যটি।

তাঁর চোখের সামনেই সেই বৃত্তাকার কুণ্ডলীটি নেমে এল বাড়িটার ওপর। তারপর বাড়িটাকে যেন পেঁচিয়ে ধরল সে। বাড়িটা গুঙিয়ে উঠল একবার, তারপর আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল।

হাতদুটো এক বিশেষ মুদ্রায় বদ্ধ করলেন কৃষ্ণানন্দ। তারপর চোখ বন্ধ করলেন। যুদ্ধ শুরু হয়েছে।

তাদের সামনে ক্রমাগত সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হতে থাকা বিশাল গুহামুখটির কোনো অবয়ব, কোনো আকার, কোনো বেধ বা কোনো মাত্রা ছিল না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, যেন অন্ধকার সমুদ্রের বুকে সজীব ঘূর্ণি জেগেছে কোথাও। প্রবেশপথটি অদ্ভুতভাবে কাঁপছিল। কেঁচোর মতো একবার সম্প্রসারিত হচ্ছিল সেটি, আরেকবার গুটিয়ে যাচ্ছিল। ক্ষণে-ক্ষণে অবস্থানও বদলে যাচ্ছিল তার।

‘আমাদের হাতে সময় আর বেশি নেই বন্ধুরা।’ গম্ভীর গলা শোনা যায় শঙ্করের, ‘লেটস স্টার্ট। আমি এক-একজনকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি গাইড পাথ ধরে। কিন্তু একজন চলে গেলেই এই গাইড পাথের প্রসারণশীলতা একটু কমে যাবে। আপনারা আপনাদের মনের সমস্ত শক্তিকে সংহত করুন। মনে রাখবেন এই আমাদের শেষ এবং একমাত্র সুযোগ।’

ছায়াগুলো ভিড় করে আসে সেই বদলাতে-থাকা পিণ্ডটির চারিপাশে। দেখে মনে হয়, যেন নিভু-নিভু আলোর পুঞ্জ ঘিরে ধরেছে কোনো আদিম গুহার দ্বার। শঙ্কর একজনকে ইঙ্গিত করেন, তিনি ভেসে এসে দাঁড়ান সেই পিণ্ডটির সামনে। তিনি হাঁউমাউ করে কী একটা বলার চেষ্টা করছিলেন এখানকার স্থানীয় ভাষায়। শঙ্কর হাত তুলে থামতে বলেন তাঁকে, তারপর একবার কী যেন একটা ভাবেন মনে-মনে। তারপর এগিয়ে আসা মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে মিলিয়ে যান পিণ্ডটির মধ্যে।

দু’জনে যাওয়ার একটু পর পিণ্ডটা একটু সঙ্কুচিত হয়ে যায়। মনে হয় কে যেন একটুখানি প্রাণশক্তি কেড়ে নিয়েছে তার থেকে। সামান্য ধীর হয় তার প্রসারণের ব্যাপ্তি।

কয়েক মুহূর্ত পরেই ফেরেন শঙ্কর। তাঁর প্রভা সামান্য ম্লান দেখাচ্ছিল।

‘নিজেদের চিৎশক্তিকে আরও জাগ্রত করুন বন্ধুরা।’ শঙ্করের ভাবনা সবার মনে ধাক্কা মারে, ‘আমাদের থেকে একজন কমে গেছেন, আমাদের মানসিক শক্তির মোট পরিমাণ ক্রমশ কমে আসছে। আমাদের আরও চেষ্টা করতে হবে। যদি বাঁচতে চান তবে আপনাদের সমস্ত চেতনাশক্তিকে সর্বোচ্চ স্তরে জাগ্রত করুন।’

পরে আরও একজনকে নিয়ে চলে যান শঙ্কর। আরো একটু সঙ্কুচিত হয় পিণ্ডটি। আরও ধীর হয় তার চলন। সবার চেতনাশক্তির ওপর চাপ বাড়তে থাকে।

ছয়জন, তারপর আরও ছয়জন চলে যান শঙ্করকে অনুসরণ করে। ততক্ষণে গাইড পাথটা কাঁপতে শুরু করেছে জ্বরো রুগির মতো। তার প্রবেশপথ ইতিমধ্যেই বেশ খানিকটা ছোট হয়ে এসেছে, আবছায়া হয়ে এসেছে তার অবয়ব।

সপ্তমবারে যখন ফিরে এলেন শঙ্কর তখন তাঁর স্বর আরও এলোমেলো, আরও বেপথু শোনায়। বোঝা যায়, অসহনীয় মানসিক চাপ ছিঁড়ে ফেলছে তাঁর চিন্তাশক্তির অভেদ্য বর্ম। এখানকার যেসব দেহাতি মানুষজন আটকে পড়েছিলেন, এতক্ষণ ধরে তাঁদের ফিরিয়ে দিয়ে এসেছেন তিনি। এবার পালা শেষ চারজনের।

‘আসুন লেফটেন্যান্ট সাওয়ান্ত!’ নিজের স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে-করতে বলেন শঙ্কর, ‘আপনাকে ওপারে পৌঁছে দিই।’

‘আমি একজন সৈনিক ডক্টর গাঙ্গুলি। আই অ্যাম আ টিমম্যান। আমার কাছে আমার থেকে আমার সঙ্গীদের জীবন অনেক বেশি মূল্যবান। তাঁদের ফেলে আমি একা চলে যেতে পারি না।’

‘এটা বাদানুবাদের সময় নয় লেফটেন্যান্ট।’ উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠেন শঙ্কর, ‘তাকিয়ে দেখুন, গাইড পাথ ইতিমধ্যেই ডিসইন্টিগ্রেট করতে শুরু করেছে। আমাদের হাতে আর একদম সময় নেই মেজর। মনে রাখবেন, এখানে আমিই আপনাদের টিম লিডার। ফলো মাই ইন্সট্রাকশনস প্লিজ।’

মেজর মাত্রে, সুজন আর হিতেশ সভয়ে তাকান সেই পিণ্ডটির দিকে। মনে হয় যেন মরণাপন্ন রুগির মতো নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে, তার প্রসারণের গতি অনেক ধীর, অনেক ম্লান। চারপাশের দুঃসহ, অভেদ্য, নিশ্চল অন্ধসমুদ্রের সঙ্গে তার প্রভেদ ক্ষীণ হয়ে এসেছে প্রায়।

লেফটেন্যান্ট সাওয়ান্ত আর দ্বিরুক্তি করলেন না। আরও সঙ্কুচিত হয় পিণ্ডগহ্বর। আগের আকারের প্রায় এক চতুর্থাংশ আকারের হয়ে এসেছে সে। প্রবল মানসিক চাপ এসে পড়ে বাকি তিনজনের ওপর।

সুজন এতক্ষণ ধরে নিজের সমগ্র সত্ত্বা এই সময় জঠরটির জন্যে নিয়োজিত করে রেখেছিল। কিন্তু ঠিক এইখান থেকে তার মানসিক স্থিতি নষ্ট হতে থাকে। তার মাথার মধ্যে আবার সবকিছু গোলমাল হয়ে যাওয়া শুরু হয়। অতীত থেকে একের পর এক দৃশ্যাবলী আছড়ে পড়তে থাকে তার মনের পর্দায়।

চার বছর বয়স তার। সে আর তার মা দাঁড়িয়ে আছে দরজা ধরে। তাদের ছেড়ে কে যেন একজন চলে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে ঘরের দরজা পেরিয়ে, উঠোন ডিঙিয়ে, রাস্তার ওপারে। এক ছোট্ট ছেলের বুকের ভেতর তিলে-তিলে গড়ে ওঠা নরম সাঁকোটা যেন তীব্র আগুনে পুড়িয়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। একবুক অভিমান নিয়ে সেই ছেলেটি তাকিয়ে আছে পুড়ে যাওয়া সাঁকো পেরোনো মানুষটার দিকে।

তার দিকে একবার ফিরেও তাকাবে না তার বাবা?

বহুযুগের ওপার থেকে শতসহস্র দুঃখের গাথা আজ ভিড় করে এল সুজনের স্মৃতির ভেতর। সারা জীবন ধরে বাবার অভাব বোধ করেছে সে। কী দোষ ছিল তার?

একবুক অভিমান তার বুকে উথলে উঠছিল বটে। কিন্তু তার আগেই সুজনের মাথায় গেঁথে যায় অন্য একটা কথা।

যে বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছিলেন, যাওয়ার সময় পিছন ফিরে তাকাননি অবধি, আজ কিন্তু তিনি নিজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরে এসেছেন! ফিরে এসেছেন সময়ের এই অন্ধ গহ্বর থেকে তাদের উদ্ধার করতে। ফিরে এসেছেন তার বাবা। নিজের সন্তানের বিপদ শুনে স্থির থাকতে পারেননি তিনি! এটা ভালোবাসা নয়?

সব গোলমাল হয়ে যায় সুজনের। এতদিন বাদে যে মানুষটা রক্তের টানে সবকিছু বাজি রেখে ফিরে আসতে পারে, তার ভালোবাসার কোনো দাম নেই?

না! বাবাকে আর কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবে না সে। এবার চলে যেতে চাইলে লোকটাকে শক্ত করে বেঁধে রাখবে সুজন। অস্তিত্বের সবটুকু নিজের চৈতন্যের মধ্যে সংহত করে ধ্যানস্থ হয় সে। বাঁচতে হবে তাদের। বাঁচতেই হবে।

শঙ্কর যখন ফিরে এলেন তখন অসংলগ্ন বকছেন তিনি, বোঝা যাচ্ছে যে এই বিপুল মানসিক চাপ তিনি আর নিতে পারছেন না। তাঁর চিন্তাভাবনা বিক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তাঁকে ঘিরে থাকা আলোকবৃত্ত, হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো কাঁপছে সেটি।

‘শঙ্কর, এবার একটু বিশ্রাম নে।’ বলার চেষ্টা করেন হিতেশ, ‘মেন্টাল স্ট্রেনন্থ আর একটু না বাড়লে…!’

‘পাগলের মতো কথা বলিস না।’ চিৎকার করে ওঠেন শঙ্কর, ‘দেখতে পাচ্ছিস গাইড পাথের স্টেবিলিটির অবস্থা? এক্ষুনি ডিসইন্টিগ্রেট করে যাবে। আমাদের হাতে আর সময় নেই। একদম সময় নেই।’

চারজনে মুহূর্তের জন্য তাকান পথটির দিকে। প্রায় আবছা হয়ে এসেছে সে। তার আয়ু শেষ হয়ে এল বলে।

‘একটা!’ উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠেন হিতেশ, ‘আর মাত্র একটাই এক্সিট বাকি। একসঙ্গে মাত্র তিনজনই যেতে পারবে ওই গাইড পাথ দিয়ে।’

কথা শেষ হয় না হিতেশের। কে যেন শঙ্কর, হিতেশ আর সুজনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় প্রায় মুছে আসা অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে। তার মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে তিনজনেই শোনেন মেজর মাত্রে’র শেষ কথা, ‘জীবনের ঋণ জীবনেই শোধ।’

সঙ্গে-সঙ্গেই বিপুল হাহাকার রব তুলে বন্ধ হয়ে যায় সেই সময়ের দরজা। কালের গর্ভ আবার ডুবে যায় নিরেট নিথর অন্তহীন অনন্তে।

*

দ্রুতস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে বাড়িটার দিকে চেয়েছিলেন মানুষটি। ঝড় আর বৃষ্টির বেগ এখন তুঙ্গে। ছোট পাহাড়ি নদীটি যেন পাগল হয়ে উঠেছে। তার ছোবল আছড়ে পড়ছে নদীর বুক জুড়ে পড়ে থাকা পাথরের বোল্ডারগুলোর ওপর।

গুরুগম্ভীর বজ্রগর্ভ মেঘে ছেয়ে গেছে দূর দিগন্ত জুড়ে থাকা পাহাড়ের মাথা। হাওয়ার দাপটে মথিত হয়ে যাচ্ছে এই জগৎ-সংসার। মনে হচ্ছে যেন মহাকালের পাশদণ্ড মহাঘোর রবে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে এই ক্ষুদ্র জনপদ।

প্রবল উদ্বেগ নিজের মধ্যে সংহত করে রেখেছিলেন তিনি। শরীরের সমস্ত পেশি শক্ত হয়ে আছে, চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ, কপালে ঘোর ভ্রূকুটি।

তাহলে কি ব্যর্থ হয়ে যাবে তাঁর গুরুর শিক্ষা? তিনি কি আসবেন না? মহাকালের গ্রাস থেকে ওদের উদ্ধার করতে নেমে আসবেন না তিনি?

ভাবতে-ভাবতেই একবার চোখটা বন্ধ করলেন কৃষ্ণানন্দ। তিনি যে শুনেছিলেন যে তাঁকে হৃদমাঝারে রাখলে নাকি এক আশ্চর্য আলো ফুটে ওঠে সাধকের হৃদয়পদ্মে? সে কি মিথ্যে? সে সবই কি তাহলে মিথ্যে?

তারপর চোখ খুলে সামনের দিকে তাকাতেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি।

ওটা কী! ওটা কী দেখছেন কৃষ্ণানন্দ?

পুরো বাড়িটা ঘিরে মাটি থেকে উঠে আসছে এক ক্ষীণ আলোর স্রোত! সেটা মুড়ে ফেলছে বাড়িটাকে। ঠিক যেভাবে পুরোনো বাড়ির গায়ে গজিয়ে ওঠে আগাছার চারা, সেভাবেই এই আলোর স্রোত ছড়িয়ে পড়ছিল বাড়িটার গায়ে। তফাত একটাই, এখানে প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত দ্রুত। যেন এক তরল আলোর বন্যা অস্বাভাবিক বেগে ছেয়ে ফেলছিল বাড়িটার শরীর।

সেই আলোর স্রোতের রঙ লাল! কালো অন্ধকারের মধ্যে সেই লাল আভার স্রোত দ্রুত বেড়ে উঠছিল, আরও দীপ্যমান হয়ে উঠছিল সেই আলোকবন্যা।

থরথর করে উত্তেজনায় কাঁপতে থাকলেন কৃষ্ণানন্দ। দু-হাত জড়ো করে মাথায় ঠেকালেন তিনি। ব্যর্থ হয়নি তাঁর পূজা। এসেছেন, তিনি এসেছেন!

মহাকালের সঙ্গে যুঝতে নেমে এসেছেন স্বয়ং মহাকালী!

*

সুজনের মনে হচ্ছিল, যেন সজীব, সচল, প্রাণবন্ত এক গুহার মধ্যে দিয়ে অতি ধীর গতিতে এগোচ্ছে তারা। দুপাশের দেওয়াল ক্রমেই সরে চেপে আসছে তাদের দিকে। সামনে এগোনো মাত্র পেছনের পথ বন্ধ হয়ে নিরেট অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। কে যেন কানের কাছে বলে যাচ্ছে, পিছনে ফিরবার রাস্তা নেই! এ পথ শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে জানে।

মুহুর্মুহু বদলে যাচ্ছে সামনের প্রায়ান্ধকার পথ। অবশ্য পথ বলা ভুল। একটু ভেসে গেলেই তাদের সামনে জমাট বাঁধছে পাথুরে অন্ধকার। তখনই শঙ্কর থেমে কিছু একটা ভাবছেন মনে-মনে, আর তারপর অন্ধকারের মধ্যে পরের স্পন্দনশীল অংশটি চিহ্নিত করে এগোচ্ছেন।

সুজনের মনে হচ্ছে, অসহ্য চাপে তার সমস্ত সত্ত্বা, সমস্ত চৈতন্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর বোধহয় শেষরক্ষা হবে না। তার চিন্তাভাবনার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে থাকে, শুধু মনের মধ্যে ফুটে উঠতে থাকে অদ্ভুত সব দৃশ্যাবলী।

উঁচু উঁচু গাছ…জঙ্গল…পাহাড়…পাহাড়ের মাথায় বরফ…পাহাড় থেকে নেমে এসেছে নদী…তার পাশে বনের মধ্যে কাঠের তৈরি কুঁড়েঘর…

কোলে করে কিছু একটা নিয়ে আসছে একটি কিশোর…তার হাতে কী ওটা? হাতটা একটু ফাঁক করে সেই কিশোর…কালো লোমওয়ালা তুলতুলে কী যেন একটা…?

আবার দৃশ্যান্তর হয়। পাহাড়ি নদীর পারে বড়-বড় ঘাসে ছাওয়া বিস্তীর্ণ প্রান্তর…তার মধ্যে বাঁকানো শিং আর বড় লোমওয়ালা ইয়াক চরাচ্ছে সেই কিশোর…হঠাৎ খেলার ছলে দৌড়তে থাকে সে…

তার পাশে-পাশে ওটা কী ছুটছে? আরে, এ তো একটা কুকুর! সিংহের মতো কেশরওয়ালা বিরাট একটা কুকুর…টিবেটান ম্যাস্টিফ!

আবার সেই কুঁড়েঘর…প্রবল তুষারপাত…মোটা কম্বলের তলায় শুয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে সেই কিশোর… তাকে জড়িয়ে ধরে আছে কুকুরটা… কী বিশাল, কী রাজসিক তার আকার!

আবার দৃশ্য পালটে যায়। গভীর হাওয়ার এক রাত… অন্ধকার জঙ্গল… কাকে যেন অনুসরণ করতে-করতে উদভ্রান্তের মতো হাঁটছে এক যুবক… হাঁটতে হাঁটতে এক অজানা পাথুরে চাতালে পৌঁছেছে সে… গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে সে… ভয় করছে তার… দূরে অনেকগুলো লোক… একজন বসে আছে… কীসব যেন মন্ত্র পড়ছে সে… ভয় করছে সেই যুবকের… বসে থাকা মানুষটার সামনে কী যেন একটা রাখা… তার ওপর থেকে কাপড় তুলতেই…

আহ! কষ্ট… কী কষ্ট…! মনে হল, কে যেন বুকের ভেতরটা জ্বালিয়ে দিল সুজনের… জ্বলে গেল রে… সবকিছু যেন জ্বলে গেল ওই মানুষটারও… তার বর্তমান-অতীত-ভবিষ্যৎ… নষ্ট হয়ে গেল সব।

হঠাৎ থেমে যান শঙ্কর। বিড়বিড় করে বলেন, ‘লাস্ট স্টেপ, এটাই লাস্ট! ওই, ওই দিকে।’

কিন্তু সেদিকে যে ক্ষীণতম স্পন্দনও নেই! হিতেশ বিমূঢ়ভাবে তাকান শঙ্করের দিকে।

‘এ কী! গেট ওপেন হচ্ছে না কেন? ভুল করলাম নাকি? আমি কি ভুল করলাম?’ গলা কাঁপতে থাকে শঙ্করের, ‘আ-আ-আমি পারছি না! কিচ্ছু পারছি না। মাথা ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। আমি বোধহয় আর পারব না। এই ইকোয়েশানটা সলভ করতে পারব না। হল না, আর বোধহয় হল না…!’

গাইড পাথের দেওয়াল প্রায় মিলিয়ে যাওয়ার মুখে। আর কয়েকটি মাত্র মুহূর্ত। চারদিকের নিশ্ছিদ্র ভয়াল অন্ধকার যেন এই তিনটি প্রাণীর ওপর আরও গভীর, আরও ঘন, আরও গাঢ় হয়ে নেমে আসে।

*

উচ্চৈস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন কৃষ্ণানন্দ। বাড়িটির সর্বাঙ্গ ঘিরে থাকা তরল আলোর প্রভা এখন আরও উজ্জ্বল। বৃত্তচাপ আর বাড়িটার মধ্যে এক দুর্ভেদ্য আবরণ তৈরি হয়েছে। মনে হচ্ছিল সেই পিচ্ছিল আলোর স্রোত পেরিয়ে কিছুতেই যেন বাড়ির দেহ অবধি পৌঁছতে পারছে না সেই সর্বনাশা নাগপাশ।

সেই লাল আলোর স্রোত এবার ধীরে-ধীরে ঘনকৃষ্ণ কালবৃত্তটির গায়ে সর্পিল নাগিনীর মতো উঠে আসতে শুরু করল। দেখে মনে হচ্ছিল, যেন আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে পর্বতের গা বেয়ে। ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে সেই নাগপাশের দেহ মুড়ে দিতে থাকে রক্তাভ আলোর স্তর।

এবার বাড়ির মাথায় জমে থাকা মেঘের দিকে নজর যায় কৃষ্ণানন্দের। আর তাঁর মন্ত্রোচ্চারণ থেমে যায় সঙ্গে সঙ্গে।

বাড়িটার ঠিক মাথার ওপর জমা হওয়া মেঘের পুঞ্জ যেন কার একটা অবয়ব নেওয়ার চেষ্টা করছে। একটা মুখ ফুটে উঠছে না মেঘের বুকে?

একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন কৃষ্ণানন্দ। ওই তো! মুখ, নাক, ঠোঁট, কুঞ্চিত কেশদাম, চোখ…সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন তিনি।

ঠিক তখনই ভয়ঙ্কর দু-চোখে দপ করে জ্বলে উঠল বিদ্যুৎ।

বিদ্যুতের রঙ লাল!

যেভাবে শিকারি অজগরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে নিরীহ হরিণশাবক, ঠিক সেভাবেই কৃষ্ণানন্দ সম্মোহিত চোখে তাকিয়ে রইলেন রক্তগর্ভ চোখ দুটির দিকে। ও কার চোখ? ও কার মুখ?

যেন তাঁর প্রশ্নের জবাব দিতেই ঝড়ের শোঁ-শোঁ আওয়াজ পেরিয়ে একটা খিলখিল অট্টহাসি ভেসে আসে কৃষ্ণানন্দের কানে। সমস্ত চরাচর জুড়ে সেই অট্টহাসি প্রাগৈতিহাসিক নূপুরনিক্কণের মতো বাজতে থাকে তাঁর কানে। সেই হাসির শব্দে ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় তাঁর। অপলক, নির্নিমেষ চোখে তিনি তাকিয়ে থাকেন সেদিকে।

মুখ খুলে যায় সেই অবয়বের। সেখান থেকে একখানি টকটকে লাল মেঘের টুকরো সামান্য বেরিয়ে আসে নীচের দিকে। দেখে মনে হয়, বিশাল রক্তপায়ী লোলজিহ্বা বেরিয়ে এল উন্মুক্ত মুখগহ্বর থেকে।

এবার সেই মেঘপুঞ্জর মধ্যে ফের ঝলসে ওঠে রক্তবিদ্যুৎ। মুহূর্তের মধ্যে সেই লোলজিহ্বা থেকে ছিটকে আসে বিদ্যুতের ফণা। অভিশপ্ত বাড়িটিকে ঘিরে ধরা কালবৃত্তটির ওপর প্রবল আক্রোশে আঘাত হানে চেতনার অতীত কোনো আদিম, প্রাগৈতিহাসিক মহাখড়গ!

একবার, তারপর আরেকবার, তারপর মুহুর্মুহু, বারংবার। সেই দৃশ্য দেখে আতঙ্কে ঠকঠক কাঁপতে থাকেন কৃষ্ণানন্দ। ভুল হয়ে যায় তাঁর মন্ত্রপাঠ, শিথিল হয়ে যায় তাঁর মুদ্রাবন্ধন। মাটির ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন তিনি। অবাধ শূন্যতা ছাড়া কোনো মন্ত্র, কোনো বিধান, কোনো মুদ্রা, কিছুই সাড়া ফেলে না তাঁর চৈতন্যে।

তিনিও কি তাহলে পারলেন না? শেষ হল না তাহলে তাঁর মন্ত্রসিদ্ধি। হেরে গেলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ?

*

‘এরপর?’ রুদ্ধকণ্ঠে জানতে চান হিতেশ।

‘জানি না, কিচ্ছু বলতে পারছি না।’ উন্মত্ত গলায় বলে ওঠেন শঙ্কর, ‘আমাদের বোধহয় আর ফেরা হল না। সুজন! সুজন রে…’

সুজনের চেতনার মধ্যে তখন একের পর এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটছিল দ্রুত।

পাহাড়ের গা বেয়ে, পাইন, ফার আর বার্চ গাছের ঘন জঙ্গল পেরিয়ে দ্রুত ওপরে উঠছে সে। একটু নীচে কাদের উত্তেজিত গলা শোনা যায়। একবার নীচের দিকে তাকায় সুজন। তারপর আরও দ্রুত উঠতে থাকে ওপরের দিকে। পাহাড়ের ওপারের দেশে পৌঁছতেই হবে তাঁকে।

তার হাতে কালো কাপড়ে জড়ানো কী যেন একটা ঝুলছে। দৌড়তে-দৌড়তে একটা খাদের পাশে দাঁড়ায় সুজন। কান পেতে শোনে, কারও পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে কি না। নিশ্চিন্ত হয়ে এইবার হাতে ধরা কালো কাপড়ের পুঁটুলিতে রাখা গোলমতো জিনিসটা বার করে হাতে নেয় সুজন।

মাথা। একটা কাটা মাথা। একটা কুকুরের লোমশ কাটা মাথা।

অবচেতনে বলে উঠল সুজন, ‘শিনজে!’

সুজনকে ধরে একবার জোরে ঝাঁকিয়ে দেন হিতেশ, ‘সুজন! কী বলছিস তুই? শিনজে? কে শিনজে? শুনতে পাচ্ছিস সুজন?’

সুজন সাড়া দেয় না। তার আচ্ছন্নবোধের ওপরে আঁচড় কেটে যায় আরও কত ছবি।

একটা ঘর। কার সামনে যেন বসে আছে সে। দুজনের মাঝখানে কাটা মাথাটা। অন্য মানুষটির আয়ত চোখ দু-খানি বিস্ফারিত। সেই কাটা মাথাটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে উত্তেজিত স্বরে কী যেন বলছেন তিনি।

অন্ধকার রাত… উন্মুক্ত প্রান্তর… তার পাশে নদী… দূরে পাহাড়…. সেখান থেকে নেমে এসেছে ছোট্ট একটি নদী… তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে সুজন…সামনে মশাল জ্বলছে…সেই অন্য মানুষটিকে এবার স্পষ্ট দেখতে পায় সে…তাঁর পরনে গেরুয়া পোশাক। তিনি মাটির দিকে নির্দেশ করে কী একটা যেন দেখাচ্ছেন তাকে…মাটিতে কীসব আঁকিবুঁকি কাটা… তার মধ্যিখানে শিনজের কাটা মাথাটা…সে কাঁদছে তাঁর সামনে…কী যেন একটা অনুরোধ করছে…!

হঠাৎ করেই যেন এক আশ্চর্য আলোয় ভরে গেল সেই সচল, সজীব এবং ক্রমেই ক্ষীয়মাণ হয়ে আসা সময়গহ্বর। চমকিত হলেন শঙ্কর, মাথা তুলে তাকালেন তিনি সামনের দিকে।

কোন অলৌকিক মন্ত্রে যেন আবার সচল হয়েছে সেই নিথর অন্ধগুহা! খুলে গেছে গাইড পাথের মুখ। কিন্তু…

তাঁদের সামনে কে যেন দৌড়ে চলেছে। একটু এগিয়ে গিয়ে বারবার ফিরে আসছে সে। যেন তাঁদের বলছে তাকে অনুসরণ করতে। সেই আলোকপুঞ্জের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকে সেই কৃষ্ণগহ্বর।

‘ওই যে!’ পাগলের মতো চেঁচিয়ে ওঠেন শঙ্কর, ‘ওই যে এক্সিট! এখখনি বেরোতে হবে এখান থেকে। এটাই শেষ ইকোয়েশন পাথ।’

ধ্যানস্থ সুজনের মাথার ভেতর বিস্ফোরিত হয় আতশবাজির সহস্রধারা স্রোত। সেই গেরুয়াধারী মানুষটি তার মাথায় হাত রাখছেন… বলছেন ‘হবে রে থুবতেন, হবে। তোর সঙ্গে শেষবারের মতো সাক্ষাৎ হবে শিনজের, আর তদ্দণ্ডেই উদ্ধার হবে সে। এইখানেই ঘটবে সেই ঘটনা, এই অষ্টভুজক্ষেত্রেই। জীবনমৃত্যুর আবর্তনে আবার জন্ম নিবি তুই। তখন তোর সঙ্গে আবার তার দেখা হবে, হবে, হবে…’

অন্ধের মতো, সম্মোহিতের মতো দু-হাত বাড়িয়ে সুজন এগিয়ে যায় সামনের দিকে, আরও একবার অস্ফুটে বলে, ‘শিনজে…শিনজে…তুই এসেছিস?’

চারিদিকে আলোর ফুলকি ছড়িয়ে, সিংহের মতো কেশর দুলিয়ে তার দিকে ছুটে আসে সেই উজ্জ্বল অবয়ব, আর ঝাঁপিয়ে পড়ে সুজনের বুকে।

নরম আলোর রোশনাইতে জ্বলে যায় সময়ের ছায়াপথ। মহাকালের বুক থেকে ঝরে পড়ে সহস্র হীরকচূর্ণ, যেন জোনাকিদের অযুত উল্লাস ঝাঁক বেঁধেছে ভালোবাসার গহীন গোপন কোটরে, যেন সহস্র দীপাবলির আলোকসজ্জা ঘিরে ধরেছে ভালোবাসার মানুষটিকে। সেই নরম আলোর বিস্ফোরণে চৈতন্য ধাঁধিয়ে যায় হিতেশ আর শঙ্করের।

বোধহয় মুহূর্ত মাত্র। তারপরেই সেই রোশনাই দৌড়ে যায় সামনের দিকে। চিৎকার করে ওঠেন শঙ্কর, ‘জাম্প সুজন, জাম্প!…হিতেশ!…হাত ধর আমার…’

তারপর সব স্তব্ধ।

*

ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাত্রে সম্মোহিত হয়ে বাড়িটার দিকে চেয়েছিলেন কৃষ্ণানন্দ। একটি অপার্থিব, অলৌকিক দৃশ্য তাঁকে স্থবির করে রেখেছিল।

তিনি দেখছিলেন, বাড়িটার মাথায় জমা হওয়া মেঘের করাল মুখাবয়বটি থেকে ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে বাড়িটার মাথায়। প্রতিটি বজ্রপাতের ক্ষণিকের ঝলকানির মধ্যে বাড়িটা একবার অদৃশ্য হচ্ছে, আবার পরের ঝলকানিতেই দৃশ্য হচ্ছে। আলোর বিস্ফোরণের মধ্যে একবার মনে হচ্ছে, বাড়িটার জায়গায় একটা জমাট বাঁধা শূন্যতা হাঁ করে আছে। পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, কই না তো? ওই তো সেই বাড়ি!

শেষ বজ্রপাতের সঙ্গে-সঙ্গে সেই বিশালায়তন কালবৃত্তটি এক গগনভেদী হাহাকার তুলে দৃশ্যপট থেকে মিশে যেতে থাকে। মিশে যেতে থাকে দু’পাশের জমাট অন্ধকারের মধ্যে। বাড়ির মাথায় জেগে থাকা একটি স্থির রক্তজিহ্বা শুষে নিতে থাকে সেই মহাকালবৃত্তের প্রতিটি গুঁড়ো।

বাড়িটিকে ঘিরে জেগে থাকা রক্তাভ আলোর স্রোত ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসে। মাটির বুকে মিশে যেতে থাকে সেই টকটকে রক্ত আলোর বন্যা। তারপর নিভে যায় একেবারে।

চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন কৃষ্ণানন্দ। কতক্ষণের জন্য, তা জানেন না। তবে যখন তিনি চোখ খুললেন, তখন ঝড় থেমে গেছে। মৃদুমন্দ জোলো বাতাস বয়ে যাচ্ছে তাঁর শরীর ঘিরে। একটা দুটো করে তারা ফুটছে পরিষ্কার হয়ে আসা আকাশের বুকে। মেঘেদের ঘনঘোর ছায়া সরিয়ে, অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে দাঁড়িয়ে থাকা দূর পর্বতশ্রেণি ছাপিয়ে, এক অনির্বচনীয় শান্তি জেগে উঠছিল কৃষ্ণানন্দের মনে।

এত দূর থেকেও বাড়িটার দিক থেকে ভেসে আসা আনন্দের কান্না আর উল্লাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি। সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইলেন মানুষটি। তারপর ধীর ক্লান্ত পায়ে ফেরার রাস্তা ধরলেন।

*

অলৌকিক জ্যোৎস্নার রাত ছিল সেটি। নদীর ধারে উন্মুক্ত পাথুরে জমি ভেসে যাচ্ছে চন্দন-চাঁদের থইথই সুঘ্রাণে। একটু দূরে আরণ্যক দ্রুমদল আকাশের দিকে হাত তুলে আছে, যেন বিশ্বপিতার কাছে সমর্পণ জানাচ্ছে সহজ প্রার্থনার ভঙ্গিতে।

দুজন মানুষ নদীর পাড়ে একটি বড় পাথরের ওপর বসেছিলেন পটে আঁকা স্থিরচিত্রটির মতো। তাঁদের মধ্যে যিনি নারী, তিনি তাঁর মাথাটি এলিয়ে বসেছিলেন আরেক পুরুষের ছাতিম-সুঠাম বুকে। তাঁর রুপোরঙা চুলের প্রান্ত থেকে চুঁইয়ে পড়ছিল অবিরল ভালোবাসা।

তাঁদের কোলের কাছে গুটিশুটি মেরে শুয়েছিল এক যুবক। এই অবারিত নক্ষত্র-কুড়োনো রাতে তার আর কিছুই চাইবার ছিল না। আশৈশব বিষাদধারা, আজন্ম দুঃখের মেঘরাত পেরিয়ে আজ তার বুকের মধ্যে আশ্চর্য জ্বরের মতো চারিয়ে যাচ্ছিল সদ্যোজাত গহীন সুখের আনন্দভৈরব।

খানিক পরে যুবকটি মৃদুস্বরে ডাকল, ‘বাবা।’

স্নেহস্বরে উত্তর ভেসে এলো, ‘বল।’

‘আমাদের ছেড়ে আর চলে যাবে না তো?’

মানুষটি আর কিছু বললেন না। সামান্য নীচু হয়ে হাত বুলিয়ে দিলেন যুবকটির মাথায়। বিচ্ছেদের সমস্ত নীল বিষাদ ভেঙে তাঁর বিরহদেহ ছুঁয়ে যাচ্ছিল স্বস্তির অবিরল আনন্দস্রোত।

নারীটি সামান্য নীচু হয়ে চুমু খেলেন যুবকটির মাথায়। তারপর তার মাথাখানি জড়িয়ে নিলেন নিজের বুকে। মাতৃস্নেহের অবিরল স্রোত অশ্রুধারা হয়ে বয়ে যাচ্ছিল তাঁর দু-চোখ বেয়ে। যুবকটির আশৈশবসঞ্চিত মনখারাপের কষদাগ ধুয়ে যাচ্ছিল প্রৌঢ়া মায়ের অযুত কল্যাণচুম্বনে।

প্রৌঢ় পুরুষটি সামান্য নীচু হলেন। তারপর একহাতে তাঁর সন্তান, আরেক হাতে নিজের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের মধ্যে।

স্থির বসেছিলেন তাঁরা। অশ্রুটপটপ নিমফুল ঝরে পড়ছিল তাঁদের ঘিরে। গর্ভিণী ধানের দুধের মতো এক অনাবিল সুখ যেন চারিয়ে যাচ্ছিল তাঁদের তিনজনের গ্রন্থি উপগ্রন্থিতে, শিরায় উপশিরায়।

দূরের জঙ্গলে একটি অশ্বত্থের ছায়ায় দাঁড়িয়েছিলেন আরেকজন মানুষ। তাঁর হৃদয় নরম হয়ে আসছিল এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে। মায়া থরথর নয়নে সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইলেন মানুষটি। তারপর দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন, ‘ভালো হোক। যারা ভালোবাসে, তাদের ভালো হোক। ভালো হোক।’

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *