২. ঝড় একটা আসবেই

সন্ধেবেলার দিকটায় মনস্থির করেই ফেলল ভজন। নাহ, ঘুঘুডাঙায় আর থাকা চলবে না তার। কাকা মারা যাওয়ার পর থেকেই সে বুঝতে পারছিল যে ঝড় একটা আসবেই। তবে সেটা যে এত তাড়াতাড়ি আসবে সেটা তার আন্দাজে ছিল না।

 শুতে যাওয়ার আগে ঘরটা একবার ভালো করে দেখে নিল ভজন। কাকা লখাই সামন্ত মারকুটে আর ডাকাবুকো লোক ছিল বটে, কিন্তু সংসারে তেমন হুঁশ ছিল না। ঘুঘুডাঙার শেষমাথায় এই বাড়িটা বানিয়ে গেছিলেন ভজনের বাবা’ই। ঘর বললে অবিশ্যি দালানকোঠা কিছু নয়। ইটের গাথনিতে দুটো ঘর, মাথায় টালির ছাউনি। একটায় ভজন থাকে, আরেকটাতে তার কাকা লখাই থাকত। ঘরের সামনে সামনে একটা ছোট বারান্দা। সেখানে বসে লখাই সামন্ত হাওয়া খেত আর সাধের লাঠিটাকে তেল খাওয়াত। ভজন অত বুঝত না, লাঠিকে অত তেল মালিশ করার কী আছে। লখাই হাসত আর বলত, ‘নিজের ভালোমন্দ নিজেকেই দেখতে হয় রে বাপধন। এই লাঠির জোরেই না যত চোর বদমাশ দূরে থাকে। নইলে বাড়িঘর সম্পত্তি টম্পত্তি লোকে লুটেপুটে নিয়ে যাবে না?’

তাদের কী এমন টাকাপয়সা আছে যা লোকে লুটেপুটে নিয়ে যাবে সে কথাটা ভজন কোনওকালেই বোঝেনি। তাদের যা সম্পত্তির বহর, চোর বা ডাকাত দেখলে হয়তো হেসেই ফেলবে। খাট বলতে দু’ঘরে দু’খানা পায়া ভাঙা চৌকি। ভাঙা পায়ার জায়গাটা ইট দিয়ে উঁচু করা। শোওয়ার ব্যবস্থা বলতে তেলচিটে বালিশ আর কয়েকটা ছেঁড়া কাঁথা। তৈজসপত্তরের অবস্থাও সেইরকমই, বারান্দার এককোণে একটা তোলা উনুন, আর কিছু তোবড়ানো হাঁড়িকুঁড়ি।

একটু আগেই একসেট থালা গেলাস নিজের চটের ঝোলাতে পুরে নিয়েছে ভজন। বাকি যা আছে সেসব নিয়ে যাওয়া আর রেখে যাওয়া একই ব্যাপার। এক সানকি পান্তাভাত নুন আর লঙ্কাপোড়া দিয়ে মেরে দিয়েছে ভজন। কাল রাত ভোর হতে হতে উঠে পড়তে হবে তাকে। তারপর সম্পত্তি বলতে তার যা যা আছে, দুটো লুঙ্গি, একটা ছেঁড়া প্যান্ট আর তিনটে রংচটা জামা, এসব নিজের ঝোলাতে নিয়ে কেটে পড়বে সে।

শুধুই কি তাই?

দোনোমোনো করে বহুকষ্টে জমানো বইগুলোর সঙ্গে সেই ডায়েরিটাও ঝোলায় পুরলো ভজন। কাকা যখন অত যত্ন করে লুকিয়ে রেখে গেছে, তার মানে এর মধ্যে নিশ্চয়ই তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে।

কাকা মারা যাওয়ার পর ভয়ে আর চিন্তায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছিল ভজনের। কী করবে, কোথায় যাবে, কীভাবে পেটের ভাত জুটবে, কিছুই মাথায় খেলছিল না। এদিকে হাতে টাকাপয়সাও নেই একদম। তাই সে কাকার ঘর আঁতিপাঁতি করে খুঁজছিল, যদি অন্তত পক্ষে দু-একটা ছেঁড়া ফাটা নোটও পাওয়া যায়। বালিশ, তোষক, খাটের তোরঙ্গ, খাটের তলা, কিছুই দেখতে বাকি রাখেনি সে। এমনকি দেওয়ালে টাঙানো ঠাকুরদেবতার ছবিগুলো অবধি নামিয়ে দেখেছে, যদি তার পেছনে দু-একটা নোট লুকিয়ে রাখা থাকে। কিন্তু কিচ্ছুটি পায়নি ভজন, একটা আধুলি অবধি না।

বেজাকাকা কি কিছুই দেয়নি কাকাকে? কাকা এমনি এমনি খেটে মরছিল?

শেষমেশ ঠাকুরের আসন ঘাঁটতে শুরু করে ভজন। আর সেই করতে গিয়ে সে ঠাকুরের আসনের নীচের মেঝেতে হালকা দাগটা খেয়াল করে। ভালো করে নজর না করলে বোঝা মুশকিল।

দুরু দুরু বুকে আসনটা সরায় ভজন, কাকা ওখানে কিছু লিখে রেখে যায়নি তো?

মাটি খুঁড়ে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট পায় ভজন। ভেবেছিল তাতে হয়তো কিছু টাকাপয়সা আছে। কিন্তু না, তার বদলে তার হাতে আসে এই ডায়েরিটা।

ডায়েরিটা সাইজে ছোটই, বড়জোর পাঁচ ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি সাইজ হবে। লাল রঙের চামড়ায় বাঁধানো, পাতার সংখ্যা খুব বেশি নয়। প্রথম পাতায় একটা বিদঘুটে ছড়া, সেটা এরকম,

গোপন ধনেরে খোঁজে যে জন ইঙ্গিতে বোঝে

 লীন হয়্যা যায় অজপদে।

কুঞ্জিকায় খোলে দ্বার দ্বারে খোলে কুঞ্জিকার

 সন্ধানী বুঝেন চিত্রপটে।

তারপরের চারটে পাতায় পরপর চারটে ছবি আঁকা। প্রথম পাতায় একটা মস্ত দরজার ছবি, তার দু-ধারে কী সব অদ্ভুত নকশা, দ্বিতীয় পাতার ছবিতে আবার দরজার সামনে একটা মস্ত বড় চাবি, তার উচ্চতা প্রায় দরজার সমান। তৃতীয় ছবিতে আবার দরজার জায়গায় চাবির ছবি আঁকা, তার গায়ে দরজার কারুকার্যগুলোই। চতুর্থ ছবিতে একটা ঘড়া, তার গা জড়িয়ে একটা ভয়ংকর সাপ। পরের বেশ কয়েকটা পাতায় কয়েকটা আবোলতাবোল ছবি, তার কোনও মাথা মুণ্ডু নেই।

ডায়েরিটা পুরে একটু থুম হয়ে বসে রইলো সে। এদ্দিনের বাস ছেড়ে পালিয়ে যেতে কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে বটে। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় কী?

গঙ্গা পেরিয়ে সামতাবেড়ের দিকে একটা চালকল খুলেছে বলে খবর পেয়েছে ভজন। পঞ্চায়েত বোর্ডের মেম্বার বিশু গুছাইতের ভায়রাভাই হরেন মুৎসুদ্দি সেখানের ম্যানেজার। গতবার পুজোয় হরেন মুৎসুদ্দি যখন ঘুঘুডাঙায় এসেছিল হরিণমারির বিলে মাছ ধরতে এসেছিল, তিনটি দিন তার খেদমত খেটেছে ভজন। তার কাছে গিয়ে কেঁদেকেটে পড়লে একটা ব্যবস্থা কি একেবারেই হবে না?

তেলচিটে কাঁথাটার মাথার দিকটা পাকিয়ে বালিশ মতো বানিয়ে নিল ভজন। তারপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।

কিন্তু শুলে কী হবে? খানিক উশখুশ করার পর ভজন বুঝল যে আজ রাতে তার ঘুম আসা মুশকিল। এতদিনের পুরোনো বাসা ছেড়ে যাওয়ার জন্য মনটা তো উদাস হয়ে আছেই। তা ছাড়াও রাতটা বেশ গোলমেলে। একফোঁটা হাওয়া নেই কোত্থাও। তার ওপর একটা ভ্যাপসা গরম যেন জাঁকিয়ে বসেছে চারিধারে। বাইরে বেশ একটা থমথমে ভাব। পকাইদের বাড়ির দিকটা থেকে কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠল কেঁউ করে।

বার চারেক এপাশ ওপাশ করার পর উঠে পড়ল ভজন। খানিকক্ষণ না হয় বারান্দায় বসা যাক। মাথাটা ঠান্ডা হলে যদি ঘুম আসে।

দাওয়া বসতেই সামনের অন্ধকারটা বেশ খলবলিয়ে উঠল ভজনের সামনে। রারান্দার সামনে রুমালের মতো খানিকটা ফাঁকা জমি। তার বাইরে ভাঙাচোরা চিঁটেবেড়া। চিঁটেবেড়ার ওপারে কাঁচা রাস্তা। দিন দুয়েক আগে ওখানে দাঁড়িয়েই বেশ নরমে গরমে তাকে দু-কথা শুনিয়ে গেছিল বিষ্ণুচরণ তেওয়ারি। তাকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। বছর দুয়েক আগে বিষ্ণুচরণের কাছে হ্যান্ডনোটে হাজার দুয়েক টাকা ধার নিয়েছিল লখাই। সেটাই নাকি এখন চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে দাঁড়িয়েছে হাজার দশেকে। অ্যাদ্দিন কাকা ছিল বলে বিষ্ণুচরণ তেমন ট্যাঁফোঁ করতে পারেনি। কিন্তু মাস খানেক আগে লখাই খুন হয়ে যাওয়ার পরেই বিষ্ণুচরণ যেন সাপের পাঁচ পা দেখেছে। দিন দুয়েকের ভালোয় ভালোয় টাকা ফেরত না পেলে যে ভজনকে তার পৈতৃক ভিটেখানির মায়া ছাড়তে হবে, সেটাও স্পষ্ট করে সেটাও জানিয়ে দিয়ে গেছে সে।

বলা বাহুল্য, ভজনের পক্ষে এখন দশ হাজার কেন, দশ টাকা দেওয়াও সম্ভব না। অ্যাদ্দিন ধরে কাকার দৌলতে পেটের ভাতটা জুটে যাচ্ছিল কোনওমতে। কিন্তু দিন দুয়েক হল সে একরকম উপোস করে আছে বললেই চলে। এদিক ওদিক উঞ্ছবৃত্তি করে কোনওক্রমে চলে যাচ্ছিল তার। এমনকি সদ্বংশের ছেলে হয়েও ভজন শেষমেশ রামপিয়ারি দুসাদের দুটো রিকশার একটা চালানো শুরু করেছিল। কিন্তু হপ্তাখানেক হল রামপিয়ারি রিকশাদুটো বেচে আর ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে চারটে টোটো কিনেছে। শুধু তাই নয়, দেহাত থেকে দুটো মুশকো মুশকো ভাতিজাকেও এনেছে সে। এখন রামপিয়ারি নিজে, তার ছেলে, আর দুটো ভাতিজা, এই চারটে ঘুঁফো মস্তান মিলে ঘুঘুডাঙা বাজার থেকে স্টেশন অবধি রাস্তাটাকে পাটনার রাজপথ করে ফেলেছে প্রায়। চারজনে মিলে দিনে হুমহাম খাটে, সন্ধেবেলায় রাক্ষসের মতো ছাতু খায়, রাতে ঢোল বাজিয়ে ছ্যা র্যাঁ র্যাঁ র্যাঁ করে গান গায় আর কেউ কিছু বলতে গেলেই চোখ পাকিয়ে মারতে আসে। ওদের সঙ্গে লড়তে যাবে ভজন? ছোঃ! তার প্রাণের ভয় নেই?

তা ছাড়া ভজনের হয়ে লড়ার মতো সেরকম কেউ নেইও এই জগতে। ভজনের জন্ম দিতে গিয়েই ভজনের মা মারা যান। ভজনের বাবা কানাই সামন্ত পত্নীবিয়োগের শোকে কয়েক বছর মুহ্যমান হয়ে থেকে একদিন সকালে বিবাগী হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান।

কানাই সামন্ত স্বভাব চরিত্রে লখাইয়ের একদম উলটো ছিলেন। লখাই যেমন ডাকাবুকো, কানাই তেমনই শান্ত ধীরস্থির মিঠে স্বভাবের। চমৎকার পালাগানা বাঁধতেন, ভালো বাঁশি বাজাতেন, মাটি ছেনে খুব ভালো মূর্তি গড়তে পারতেন। ছোটবেলার স্মৃতি খুব বেশি মনে পড়ে না ভজনের।

আজ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার আগের রাতে হু হু করে পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছিল ভজনের। কাকার কথাও মনে পড়ছিল খুব। লখাই সামন্ত উচ্চতায় ছিল পাঁচ ফুট, গায়ের রং ঘোর কালো, আর মেজাজে সাক্ষাৎ ডাকাত। দুর্মুখ এবং বদমেজাজি বলে কুখ্যাত লখাই তাঁর মা-মরা ভাইপোটিকে নিজের ছেলের মতই রক্ষা করে এসেছে এতদিন। লোকে বলত ভজনের জন্যই আর লখাইয়ের সংসার করা হয়ে উঠল না।

রাতের অন্ধকারটা বেশ জমাটি হয়ে এসেছে। কাকার কথা ভাবতে ভাবতে একটু ঢুলুনি এসেছিল ভজনের। সেই হালকা ঘুমের ঘোরেই তার মনে হল কানের কাছে একটা মশা যেন বিনবিন করছে। সেদিকে একটা আলতো চাপড় চালাল ভজন। বলা বাহুল্য, তাতে কিছুই হল না। ঢুলতে ঢুলতেই কানের কাছে হাত নেড়ে মশাটাকে তাড়াবার চেষ্টা করল সে। আর তখনই মনে হল তার কানের কাছে অত্যন্ত সরু গলায় কে তারস্বরে চেল্লাচ্ছে, ‘মর্কট, অলম্বুষ, জাম্বুবান, অলপ্পেয়ে, রাতদিন শুধু ঘুম আর খাওয়া, খাওয়া আর ঘুম।’

চটকা ভেঙে উঠে বসল ভজন। এই গলা তার চেনা বললে কম বলা হয়, আজীবন এই চোপা শুনেই মানুষ হয়েছে সে। কিন্তু এখন তো সেসব শোনার কথা নয়।

সেই সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল সে।

চারদিকে বেশ একটা থমথমে আবহাওয়া তো ছিলই। এবার তার সঙ্গে যোগ হয়েছে একটা অন্য ব্যাপার। সামনের অন্ধকারটা বেড়ে উঠে একেবারে আলকাতরার মতো কালো হয়ে জাঁকিয়ে বসেছে, আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। এমনকি ঝিঁঝিঁও ডাকছে না।

ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল ভজন। ফের তখনই তার কানে ফের সেই শব্দ, ‘ঢেঁড়স, কুঁড়ে, গোবরগণেশ। নিজের সাত পুরুষের বাস কেউ ছাড়ে? এইজন্য খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছিলাম তোকে?’

একেবারে সেই বাজখাঁই গলা আর গায়ে হুল ফোটানো গালমন্দ। ভুল করার কোনও চান্সই নেই। লখাই সামন্ত’র মেজাজকে ভয় করত না এমন মানুষ ঘুঘুডাঙায় একটিও নেই।

ভজনের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একে চারিদিকে একটা হুতুমথুমো অন্ধকার, নিঝুম রাত, একটাও শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তার মধ্যে এসব কী অলুক্ষুণে ব্যাপারস্যাপার?

আরও খানিকক্ষণ কান পেতে রেখেও যখন আর কিছু শুনতে পেল না ভজন, তখন সে ঠিক করল এবার গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া যাক। তার ঘুমটাও পেয়েছিল জব্বর, তাই বিছানায় শুতে শুতেই গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেল সে।

* * *

পরের দিন ঘুমটা ভাঙতে ভজন বুঝতে পারল যে তার বাড়ি থাকার মেয়াদ আরও একদিন বেড়ে গেছে। কারণ এখন বেলা বেড়ে সূয্যি ঠাকুর এখন প্রায় মাথার ওপর, আর তার একটু জ্বর মতো লাগছে।

গরিবের জ্বরজারি হল গিয়ে উটকো অতিথি, জ্বালায় বটে কিন্তু বেশিদিন থাকে না। তা ছাড়া রোগভোগবাতব্যাধিরও নানান কাজকম্ম আছে। একজায়গায় বসে থাকলে তাদের চলার কথা নয়। ফলে ব্যাপারটাকে আমল দিল না ভজন। কিন্তু তার চিন্তা অন্য জায়গায়। এক, আজকের দিনটা সে খাবে কী? দুই, বিষ্ণুচরণের লেঠেল এসে হাঁকার দিলে সে ঠিক কী বলে তাদের ঠেকাবে।

বিছানা থেকে উঠে কুয়োতলায় গিয়ে চোখেমুখে জল দিল ভজন। ফিরে আসবে, এমন সময় একটা জিনিস একটু অদ্ভুত লাগল তার।

কোণার শিউলি গাছটার পাশে পেয়ারা গাছটা ছিল না? এখন সে জায়গায় বেঁটে কুলগাছটা এল কী করে? আর পেয়ারা গাছটা অমন বেড়ার কাছ ঘেঁষে চলে গেল কী করে?

পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল সে। ছোটবেলা থেকে সে দেখে এসেছে শিউলি গাছের পাশে পেয়ারা গাছটা, আর তাদের পেছনে কুলগাছ। এখন কী করে সেটা বদলাবদলি হয়ে যায়? চোখে ভুল দেখছে না তো?

কাছে গিয়ে আরও ভোম্বল হয়ে গেল সে। গাছ যেরকম ছিল সেরকমই আছে। গাছের গোড়ার মাটি যেমন ছিল তেমনই আছে। অথচ ছোটবেলা থেকে গাছগুলোকে যেখানে যেখানে দেখে এসেছে সে গাছগুলো মোটেও সেখানে সেখানে নেই।

ভজন পুরো হতভম্ব হয়ে গেল। গাছেরা হেঁটে চলে বেড়ায় এমন গল্প কস্মিনকালেও শোনেনি সে। তার ওপর তারই বাড়ির পেছনের বাগানে এসব অনৈসর্গিক কাণ্ডকারখানা?

ভজনের গা’টা এই চড়া রোদেও একটু শিরশির করে উঠল। তার মাথার ব্যামো ধরল নাকি? কানে ভুল শুনছে, চোখে ভুল দেখছে, এসব তো ভালো লক্ষণ নয়!

সন্তর্পণে ঘাড়টা ঘুরিয়ে বাগানের বাকি গাছগুলো দেখার চেষ্টা করতে লাগল ভজন। আর তখনই সে দেখল কুলগাছটার কাছে মাটিতে একটা বটুয়া পড়ে আছে।

একটু দোনোমোনো করে বটুয়াটা হাতে তুলে নিল ভজন। তারপর সেটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তার ঠাকুমার বটুয়াটা না? যেটা পুরী ঘুরতে গিয়ে ন’পাড়ার দোক্তাদিদা এনে দিয়েছিল? একদম তাই। সেই রং জ্বলে যাওয়া বাসন্তী হলুদ রঙের বটুয়াটা। এখন মাটিফাটি লেগে তার অবস্থা কাহিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে এই বটুয়া তো ঠাকুমা ফেলে দিয়েছিল কবেই। সেটা এখানে এল কী করে?

বটুয়া’র দড়ি খুলল ভজন। ভেতরে একতাড়া নোট। সবই পঞ্চাশ আর একশো টাকার, একটা নোংরা সুতলি দিয়ে বাঁধা। কাঁপা কাঁপা হাতে নোটগুলো তুলে নিল সে। গুণে দেখল পাক্কা হাজার টাকা আছে।

এই আশ্বিনের সকালে গামছা পরে কলতলায় দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল ভজন। এ বটুয়া এখানে কী করে এল? তার মধ্যে এত টাকা কী করে এল?

তবে কি না পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। তাছাড়া সাতসকালে এতবার হতভম্ব হওয়াটা ভালো দেখায় না। ভজন বটুয়াটা ঘরে রেখে কুয়োর জলে ঝটপট স্নান করে নিল। তারপর কাল রাতে যে ঝোলাটায় জিনিসপত্র ভরেছিল সে সেখান থেকে একটা ছেঁড়া প্যান্ট আর একটা তাপ্পি মারা জামা পরে বেরিয়ে পড়ল সে। পকেটে পাঁচটা একশো টাকার নোট।

ঘুঘুডাঙার গঞ্জের বাজারের মুখটায় কচুরি বানায় হনুমান মিশির। সঙ্গে হিং দেওয়া আলু মটরের তরকারি। হনুমানের কচুরি দেবভোগ্য জিনিস। লোকে বলে একবার মুখে দিলেই পুনর্জন্মের গেরোটা অনেকটা আলগা হয়ে যায়। সকালে এইদিকটা কচুরির গন্ধে চারিদিক ম’ ম’ করতে থাকে, আর তার সামনে সিকি মাইল লম্বা লাইন। গোঁসাইপাড়ার কবিরাজ মাধব আচায্যি মশাই তো সেবার সার্টিফিকেটই লিখে দিলেন, ‘হনুমান হালুইকরের কচুরি অতি উৎকৃষ্ট খাদ্যবস্তু। ইহা একাধারে বলকারক, ক্ষুধাবর্ধক, মুখরোচক এবং অগ্নিমান্দ্যনাশক। আমি বহুকাল যাবৎ ইহার গুণাগুণ সম্পর্কে অবহিত আছি।’ সেই সার্টিফিকেট এখনও সযত্নে হনুমানের দোকানের দেওয়ালে টাঙানো।

এখন বাজার উঠে যাওয়ার মুখে, লোকজন বেশি নেই। হনুমানের দোকানের উনুনের আঁচও নিভুনিভু। সামনের বেঞ্চে বসে ভজন একটু দোনোমোনো করে বলল, ‘কচুরি হবে।’

হনুমান মিশির একটু টেরচা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হোবে তো বোটেই। কিন্তু মাংনা হোবে না ভজনা, পোয়সা লাগবে। তোমার আগের পোনচাস টাকা এখোনো বাকি আছে।’

পকেটে পয়সা থাকলে বুকে জোর আসে। ভজন পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বার করে হনুমানের দিকে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, ‘ভজনসামন্ত গরিব হতে পারে, কিন্তু ভিখিরি নয় হনুমানজী, এই নিন টাকা। আর হ্যাঁ, আগের টাকাগুলো কেটে রাখবেন কিন্তু।’

হনুমান মিশির টাকাটা ছোঁ মেরে নিয়ে বলল, ‘আরে আরে রামজি। এ তো তাজ্জবের বাত হোয়ে গেল রে ভজনুয়া। টেকা পেলি কোথা থেকে তুই?’

ভজন শার্টের ভাঙা বাটনটা লাগাবার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘সেসব কথা থাক ভজনজী। ঝট করে চারটে কচুরি দিন। দেখবেন, কচুরি যেন গরম থাকে, আর তরকারিতে যেন শুধু তলানির ঝোল না, কিছু আলু আর মটরও থাকে।’

হনুমান মিশির বুদ্ধিমান লোক। সে বুঝে গেল যে ক্যাবলার হাতে কিছু পয়সা এসেছে। সে হেঁ হেঁ করে বলল, ‘সে তো বোটেই, সে তো বোটেই। গরমাগরম কচৌরিই পাবি রে ভজোন।’ বলে দোকানের ছোকরা কর্মচারীটির দিকে একটা হাঁক দিল, ‘আরে ও রামপরসাদ, ভজুয়া বাবুকে লিয়ে চার ঠো কচৌরি ফটাফট ভেজে লিয়ে মেরে বাপ। আর সব্জি উব্জি ভি ঠিক ঠাক লে আনা, সমঝা কেয়া?’

হনুমানের দোকান থেকে এক ডজন কচুরি আর গন্ডা খানেক মিঠাই খেয়ে পেটটা ঠান্ডা হল ভজনের। বোধকরি পাঁচ ছ’মাস বাদে এমন অমৃত ভোজন জুটল। আর শুধু পেট ঠান্ডা কেন, বুকে বেশ একটু বলও অনুভব করছে সে। সেটা পেট ঠান্ডা হওয়ার জন্য না বুক পকেটে টাকা থাকার জন্য, বলা মুশকিল।

কিন্তু বিপত্তি ঘটল এর পরেই। হনুমানের দোকান থেকে বেরোবার মুখেই ভজনকে চেপে ধরল করিম খাঁ আর হরেকৃষ্ণ সাঁপুই, বিষ্ণুচরণের দুই পোষা লেঠেল। করিম খাঁ খপ করে ভজনের কলার চেপে বলল, ‘কী রে শালা, মালিকের পয়সা মেটাবার নাম নেই, এখানে বসে মস্তি করে কচুরি খাওয়া হচ্ছে?’

হরেকৃষ্ণও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ভজন নিজের কলারটা ছাড়িয়ে নিয়ে করিমের গালে একটা পেল্লায় থাপ্পড় কষিয়ে বলে উঠল, ‘চোপরাও বেয়াদপ। ভদ্রলোকের সঙ্গে কীভাবে কথা কইতে হয় কেউ শেখায়নি তোকে?’

ভজন রোগাপাতলা ছেলে, তারওপর আজ অবধি কেউ তাকে উঁচু গলায় কথা অবধি বলতে শোনেনি। করিম খাঁ তাই থাপ্পড়টা খেয়ে এত হতভম্ব হয়ে গেল যে নিজের গালে হাত বুলোবার কথাটা অবধি মনে রইল না তার। হরেকৃষ্ণ’র অবস্থাও তথৈবচ, তার হাত থেকে লাঠিটা ঠক করে পড়ে গেল মাটিতে। সেটা তুলে হরেকৃষ্ণ’র হাতে ধরিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় ভজন বলল, ‘একটু পরেই তোদের মালিকের সঙ্গে দেখা করতে যাবো। জানিয়ে রাখিস।’

* * *

বিষ্ণুচরণ কিন্তু পাঁচশ টাকা পেয়ে খুশি হল না মোটেই। টাকাটা ট্যাঁকে গুঁজে অপ্রসন্নস্বরে বললেন— ‘এ তো পাঁচশো রুপিজ হল রে ভজনা, রেস্ট অফ দ্য টাকা কোথায়?’

ভজন পায়ের ওপর পা তুলে বেশ একটা রাজকীয় হাসি হেসে বলল, ‘পেয়ে যাবেন বিষ্টুবাবু, এই সপ্তাহেই পেয়ে যাবেন। ভজন সামন্ত মিথ্যে কথা বলে না।’ কথাটা বেশ জাঁক করে বলল বটে, কিন্তু ভজনের বুকটা দুরুদুরু করছিল। এত টাকা সে পাবে কোথায়?

বিষ্ণুচরণ ভুরু কুঁচকে ভজনের বসার ভঙ্গিটা লক্ষ্য করল। সে ঘাঘু লোক, যা বোঝার বুঝে নিল। মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘সে তো বটেই, সে তো বটেই। আমি কি তোকে চিনি না ভজন, সেই চাইল্ডহুড থেকে তোকে দেখছি। সেদিন না হয় দুটো হার্ড কথা বলেই ফেলেছি। সেজন্য কিছু মনে করিসনি তো বাপধন?’

ভজন ভারিক্কিচালে বলল, ‘তাই বলে কারও বাড়িতে চড়াও হয়ে অপমান করাটা কোনও কাজের কথা নয় বিষ্টুকাকা। আপনার টাকাটা আশা করছি এই মাসেই দিয়ে দিতে পারব। আপাতত আমি উঠলাম।’ এই বলে বেশ রাজসিক ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল ভজন।

ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ সেদিকে রইল বিষ্ণুচরণ। তারপর বলল, ‘ম্যাটারটা কী ঘটল কিছু বুঝলি হরে?’

হরেকৃষ্ণ বলল, ‘ছোকরা কোনও গতিকে কিছু টাকাপয়সা পেয়েছে মনে হয়। নইলে আপনার গদিতে এসে আপনার ওপরেই চোটপাট করে যায় এমন লোক তো বেশি দেখিনি কর্তা।’

বিষ্ণুচরণ চিন্তিত মুখে বলল, ‘ছোকরা মানি পেল কোথায়? আর যদি ধারের টাকাটা মিটিয়েই দেয় তাহলে লখাইয়ের হাউসটাই বা হাতে পাই কী করে?’

করিম খাঁ মাথা চুলকে বললো, ‘গোস্তাখি মাফ করবেন হুজুর। কিন্তু ওই ভাঙাচোরা মকান কিনে কি খুব লাভ হবে? গাঁওয়ের একেবারে শেষের দিকের জমিন, তাও এত্তটুকু।’

‘জমিটা তো আমি চাইছি না রে করিম। আমার ওই বাড়িটা দরকার।’

‘কিন্তু সে তো একেবারে পোড়ো ঝুরঝুরে মকান হুজুর।’

‘ওই ব্রোকেন ঝুরঝুরে বাড়ির মধ্যেই কোথাও একটা স্মল ডায়েরি লুকোন আছে, বুঝলি করিম। ওইটে আমার চাই, যে করে হোক।’

হরেকৃষ্ণ মাথা চুলকে বলল, ‘একটা ডায়েরির জন্য এত খাটাখাটুনি কেন কর্তা?’

বিষ্ণুচরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আছে রে হরে, আছে। বিস্তর কারণ আছে। ওটার জন্যই নাইটে ভালো ঘুম হচ্ছে না আমার।’

করিম খাঁ ভারি অবাক হয়ে বলল, ”তার জন্য এত হাঙ্গামার দরকার কী হুজুর? বলেন তো শেখ পাড়ার মইনুল হাকিমকে ডেকে আনি, এমন দাওয়াই দেবে যে বিস্তরে শুলেই ঘুমিয়ে যাবেন।”

বিষ্ণুচরণ কুপিত হয়ে করিমের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মধুর স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ রে করিম, তোদের মইনুল হাকিমের কাছে ব্রেনে গ্রে ম্যাটার বাড়াবার কোনও ওষুধ নেই?’

করিম চিন্তিত মুখে বলল, ‘ছানবিন করলে হয়তো তাও পাওয়া যাবে। কিন্তু আপনার কি নিন্দের সাথ সাথ মগজের ঘিলুও চাই হুজুর? সে তো ঝামেলার কাম মালুম হচ্ছে। কাল তাহলে মইনুল চাচাকে এত্তেলা দিই?’

বিষ্ণুচরণ কথাটা শুনে এত অবাক হয়ে গেল যে মুখে কথা যোগাল না তার। সেই সুযোগে হরেকৃষ্ণ বলল, ‘কর্তা, বলছি কী, এসব ছোটখাটো জিনিস তুলে আনার জন্য গনু চোরই তো আছে। নইলে হুকুম দিন, চারটে লেঠেল নিয়ে সারা বাড়ি তছনছ করে ফেলি। ওই তো দুটো ভাঙাচোরা ঘর, খুঁজে পেতে কত সময়ই বা লাগবে?’

বিষ্ণুচরণ বলল, ‘উঁহু, ওসব প্যান্ডেমোনিয়াম একদম না। কয়েকদিন আগেই একটা ট্রাবল গেছে। সেসব থিতিয়ে যাওয়ার আগে আমি কোনওরকম কোনও ডিস্টার্বিং-এ জড়াতে রাজি নই।’

হরেকৃষ্ণ বলল, ‘ডায়েরিটা তো ভজনের কাছেও থাকতে পারে কত্তা। গোটা বাড়িটা দখল করার দরকার কি? ওকে একদিন তুলে এনে পেট থেকে কথা আদায় করে নিলেই তো হয়।’

বিষ্টুচরণ চিন্তিতমুখে বলল, ‘না রে হরে, আমার মনে হয় ডায়েরিটা ওই লখাইয়ের হাউসেই কোথাও লুকোনো আছে। বেজা মিত্তির কি যেমন তেমন হিউম্যান ছিল রে, বুদ্ধিতে আমাকেও টক্কর দিত। আমি তো প্রথমে বিলিভই করিনি যে লোকটা ডায়েরিটা নিজের অত বড় ম্যানসনের বদলে লখাইয়ের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে। ইন্টেলিজেন্সিয়াটা ভাব একবার। তোর কি মনে হয়, লখাই বা বেজা ওই ডায়েরিটা এমন জায়গায় হাইড রাখবে যেখানে ওই ভজনের হাত পৌঁছবে?’

হরেকৃষ্ণ চিন্তিতস্বরে বলল, ‘তাহলে তো ব্যাপারটা আরও ঘোরাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে কর্তা। যে ডায়েরি যে আমরাও উদ্ধার করতে পারব তারই বা গ্যারান্টি কি?’

বিষ্টুচরণ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘গ্যারান্টি থাক না থাক, ট্রাই আমাদের করতেই হবে রে হরে। ওর ওপর অনেক কিছু ডিপেন্ড করে আছে। অনেক দূর অ্যাডভানস করে এসেছি রে হরে, এখন আর ব্যাক করার উপায় নেই।’

 করিম বুক চিতিয়ে বলল, ‘তাহলে হুকুম দিন হুজুর, ভাতিজাকেও একদিন সময় সুযোগ বুঝে চাচা’র কাছে রওয়ানা করিয়ে দিই, ঝামেলা খতম।’

বিষ্ণুচরণ খেঁকিয়ে উঠল, ‘হরে, এই গাছপাঁঠাটাকে কাছারি থেকে এক্ষুনি থ্রো আউট করে দে তো। ব্যাটার বুদ্ধি তো নয়, খাজা জ্যাকফ্রুট। বলছি আমি কোনও হাঙ্গামা হুজ্জোতি চাইছি না, ইনি একেবারে রায়ট করতে ছুটেছেন। এইজন্যই বলি শুধু হাতে পায়েই বড় হয়েছিস তোরা, ব্রেনে বুদ্ধি বলতে কিস্যু নেই। এই কদিন আগেই একটা ব্লাডাব্লাডি হয়ে গেছে গ্রামে। তোদের কি ধারণা, পুলিশ নজর রাখছে না? তারপরও আরেকটা মার্ডার করতে চাস?’

দুই স্যাঙাত অনুতপ্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল।

”শোন করিম, যা করার মাথা কুল করে করতে হবে। তোরা শুধু গনুকে বলে দে ভজনের বাড়ির ওপর নোটিশ রাখতে। সাসপেক্টিং কিছু দেখলে যেন আমাকে এসে জানায়। আর টাকাটা ও পেল কোত্থেকে তার একটা পাত্তা লাগানোর ব্যবস্থা কর। যা করবি, চুপিচুপি। দেখিস, ক্রো বার্ডেও যেন টের না পায়।’

* * *

হেমনলিনী দেবী কুঁদুলে হিসেবে শুধু ঘুঘুডাঙা কেন, পুরো পরগণায় বিখ্যাত। অমন কাংস্যনিন্দিত কণ্ঠ, অমন বাছাবাছা বাক্যবাণের ছটা, অমন কথার পিঠে লাগসই কথা গুঁজে দেওয়া, অমন মন মাথা আর থুতনি নেড়ে তেড়ে আসা, সে জিনিস দেখেও সুখ, শুনেও পুণ্য। লোকে বলে কলহ পটিয়সী শূর্পণখা পরজন্মে হেমনলিনী হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। হেমনলিনী আসরে নেমেছেন শুনলেই মুখে মুখে কথা রটে যায়, আশেপাশের পাড়ার লোকজন ঠেলাঠেলি করে পিসিমার শো দেখতে আসে। এমনও দেখা গেছে হেমনলিনী মুখে ফেনা তুলে লড়ে যাচ্ছেন, ওদিকে চারিদিক দর্শকদের ‘কেয়াবাত’, ‘মাশাল্লাহ’, ‘বহোত খুব’ ধ্বনিতে মুখরিত।

আজকাল তো অনেকে হায়ার করেও নিয়ে যাচ্ছে হেমনলিনীকে। বিভিন্ন কাজের জন্য হেমনলিনী বিভিন্ন রেট হেঁকে থাকেন। স্কুলের হেড মাস্টারের সঙ্গে ঝগড়া করার রেট এক, ননদ বৌদির ঝগড়ার রেট আরেক, আর পাশের বাড়ির ভাড়াটে হলে আলাদা দাম। তবে সরকারি দফতরে গিয়ে ঝগড়া করার জন্য পিসি চড়া দরই হাঁকেন, সার্ভিস চার্জের সঙ্গে সার্ভিস ট্যাক্স আলাদা!

এদিকে হেমনলিনীর দৌলতে ঘুঘুডাঙার সম্মান গেছে বেড়ে। লোকে আজকাল হেমনলিনীকে ঝগড়ুটে বলে না, বলে কলহ শিল্পী, দেখলে সশ্রদ্ধভাবে রাস্তার ধারে সরে দাঁড়ায়, বলে মাননীয়া রোঁদে বেরিয়েছেন! পাড়ার লোকজন বিশু গুছাইতকে ধরে বসেছে, হেমনলিনীর জন্য একটা কোয়ারেলশ্রী উপাধির ব্যবস্থা করার জন্য।

আজ বিকেলের দিকটায় হেমনলিনী জলমুড়ি খেয়ে এসেছিলেন সতীশ চাকলাদারের দাঁতের ডাক্তারখানায়। সতীশ চাকলাদার এঁর ব্যাপারে শুনেছেন, তবে সাক্ষাৎ মোলাকাত আগে হয়নি একেবারেই। তিনি একটা মোটা মেডিক্যাল জার্নাল খুলে পড়ার চেষ্টায় ছিলেন। আগের দিনের মতোই একজন দুজন করে লোক জমা হচ্ছে আড্ডার নেশায়। গগন মল্লিক এখনও এসে পৌঁছননি।

হেমনলিনী ডাক্তারখানার সামনে দাঁড়িয়ে সতীশ চাকলাদারের উদ্দেশ্যে মধুর স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ রে ভালো মানুষের পো, তুইই আমাদের গেরামের নতুন দাঁতের ডাক্তার নাকি।’

সতীশ চাকলাদার আন্দাজে বুঝলেন ইনিই তিনি। মৃদু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ দিদি। আসুন, বসুন। দাঁতের কোনও অসুবিধা হয়েছে?’

‘খুবই অসুবিধা হচ্ছে রে বাছা, সে আর কী বলি। খেতে পারছি না, কথা বলতে পারছি না, ঝগড়া করতে পারছি না। বলছি কি, দাঁত তুলে দিতে পারবি ভাই?’

‘ওটাই তো আমার কাজ দিদি। বলুন না, কার দাঁত?’

‘আমারই দাঁত বাবা। তুলে দিতে পারবি তো? ঠিক করে বল, নইলে ও পাড়ার বছিরুদ্দিকে ডাকি তাহলে।’

‘বছিরুদ্দি মিঞা কুয়ো সারায় বলে শুনেছিলাম। সে দাঁতের ডাক্তারিও শুরু করলো নাকি?’ চিন্তিত হয়ে পড়েন সতীশ ডাক্তার, ‘এ তো বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল দেখছি দিদি!’

‘পারবি বাবা? ভরসা দিচ্ছিস তো? তাহলে চল বাবা। আর দেরি করিসনি। আমার বাঁধানো দাঁতখানা মুখ ধুতে গিয়ে কুয়োয় পড়ে গেছে। একটু তুলে দে দেখি।’

সতীশ চাকলাদার খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইলেন। উপস্থিত বাকিরাও তথৈবচ। হাতে পায়ে সাড় ফিরে পেতে সতীশ ডাক্তার হাতজোড় করে বললেন, ‘চোয়ালের দাঁত তুলে দিতে পারি দিদি। আপনি এলেন, চেয়ারে বসলেন একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে টক করে দাঁতটা তুলে দিলাম, তাও একটা মানে হত। কুয়োয় পড়া দাঁত তোলার বিদ্যে তো শিখিনি দিদিভাই।’

সঙ্গে সঙ্গে পিসিমা স্বরূপে প্রকটিত হলেন, ‘বলি ও অনামুখো অনাছিষ্টি অলপ্পেয়ে, বলি দাঁতটা যেখানে পড়ে আছে সেখানে না গেলে তুলবি কী করে শুনি? বলি এত নেকাপড়া করেছিস, বুদ্ধিশুদ্ধি কি সেই খোকাটির মতোই রয়ে গেছে, অ্যাঁ। হ্যাঁ রে মিনসে, তোর ডাক্তারের সাট্টিপিট্টি আছে তো? নাকি ভেজাল কাগজের টুকরো দিয়ে আমার মতো সাত চড়ে রা কাড়ে না এমন মানুষের বুকে পা দিয়ে দাড়ি উপড়োচ্ছিস?’

হেমনলিনী বোধহয় এই ব্লিৎজক্রিগ আরও কিছুক্ষণ জারি রাখতেন, যদি না পেছন থেকে গগন মল্লিকের বজ্রনির্ঘোষ ভেসে আসতো, ‘এখানে আবার কার ওপর ক্ষেপলে হেমদি?’

এই সসাগরা ধরিত্রীতে হেমনলিনী যদি কাউকে ভয় পান তো গগন মল্লিক। বয়সে হেমনলিনীর থেকে বছর তিনেকের ছোট হলে কী হবে, এই ভারিক্কী চালের ভাইটিকে ছোটবেলা থেকেই রীতিমতো সমীহ করে চলেন তিনি। তিনি হাঁউমাউ করে উঠলেন, ‘দেখ না ভাই, এই হতচ্ছাড়া ডাক্তার আমার দাঁত তুলে দিচ্ছে না।’

পুরো কাহিনী শুনে খানিকক্ষণ চারিপাশ কাঁপিয়ে নিজের ট্রেডমার্ক হাসিটা হাসলেন গগনবাবু। তারপর সস্নেহে বললেন, ‘বাড়ি যাও দিদি। আমি বছিরুদ্দিকে বলে দিচ্ছি। কাল সকালে গিয়ে তোমার দাঁত তুলে দিয়ে আসবে।’

হেমনলিনী বাড়ির রাস্তা ধরতে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন গগন মল্লিক। তারপর ফতুয়া’র খুঁটটা দিয়ে চশমাটা মুছতে লাগলেন।

সতীশ ডাক্তার একটা মস্ত শ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘খুব বাঁচা বাঁচালেন মল্লিকদা। নইলে আজই আমার এই গ্রামে ডাক্তারি করা ঘুচে যেত।’

গগন মল্লিক গম্ভীর গলায় বললেন, ‘হেমদি ছোটবেলা থেকেই ঝগড়ুটে বটে, তবে ব্রজ মারা যাওয়ার পর থেকেই একটু খ্যাপাটে হয়ে গেছে। অথচ ভালো মেজাজে থাকলে হেমদি’র মতো স্নেহময়ী মানুষ হয় না। ছোটবেলায় কতবার আমার আর আমার বোনের জন্য কোঁচড়ে করে নিজের বাড়ি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ভালো ভালো খাওয়ার নিয়ে এসেছে তার লেখাজোখা নেই। আমার নামে কেউ কিছু বললে হেমদিকে দেখেছি গাছকোমর বেঁধে লড়তে নামতে। বহু কষ্টে এমন গ্রামতুতো দিদি পাওয়া হে সতীশ, আমি সত্যিই ভাগ্যবান।’

‘সে তো শুনেছি আপনি পড়াশোনায় মারকাটারি ভালো ছিলেন বলে গ্রামের সবাই আপনাকে ভালোবাসতো, তাই।’

‘তখন দিনকাল অন্যরকম ছিল সতীশ। গরিব দুঃখীর বাড়িতে কেউ পড়াশোনা করার চেষ্টা করছে দেখলে দেশ গাঁয়ের মানুষ তার জন্যে যাহক করে এগিয়ে আসতো। এখনও যে আসে না তা নয়, তবে অনেক কম। এই আমার ব্যাপারটাই দেখো না। আমাদের সময় তো মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক এসব ছিল না, ছিল হায়ার সেকেন্ডারি। তার ফী’জ জমা দেওয়ার ডেট চলে যাচ্ছে, অথচ হাতে টাকা নেই। শেষমেশ হেমদি’র মুখে জানতে পেরে হেমদি’র বাবা, মানে যতীনকাকু আমাকে নিয়ে গিয়ে ফী’জ জমা করে এলেন। সে কী বকাবকি আমাকে, ওঁকে আগে জানাইনি কেন?’

গগন মল্লিকের গলাটা ধরে এসেছিল। সতীশ ডাক্তার কিছু বললেন না। গগন মল্লিক এই অঞ্চলের শ্রদ্ধেয় লোক। দিনমজুর পরিবার থেকে নিজের মেধার জোরে উঠে এসে গ্র্যাজুয়েশন অবধি পড়েছেন। এলাকার পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন। স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন কিছুদিন।

‘ব্রজ বলে কার যেন কার একটা নাম নিলেন?’

‘ব্রজ হচ্ছে ব্রজনারায়ণ মিত্র, ওরফে বেজা, আমার ছোটবেলার জিগরি দোস্ত। আর হেমদিদি আর ব্রজ হচ্ছে পিঠোপিঠি ভাইবোন। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি শোনো।

এই অঞ্চলের এককালের জমিদার ছিলেন মিত্তির ফ্যামিলি। জঙ্গল আর বাঁশবন কেটে তাঁরাই এই ঘুঘুডাঙার পত্তন করেন। তা এই মিত্র বংশেরই বর্তমান বংশধর হচ্ছে ব্রজরা। এখন মিত্তিরদের জমিদারি নেই বটে, তবে জমানো টাকা যা আছে সাত পুরুষে খেয়ে শেষ করতে পারবে না। তা ছাড়া ব্যবসাও আছে কিছু টুকিটাকি। গঞ্জের বাজারে ওদের চালকলটা দেখে থাকবে হয়তো। যতীনকাকু ব্যাঙ্কে চাকরি করেছেন অনেকদিন। এখন প্রায় সত্তরের ওপর বয়েস।’

‘তা এই ব্রজবাবু মারা গেলেন কী করে?’

‘সে এক লম্বা কাহিনী ভায়া। শোনার সময় আছে তোমার?’

‘তা আছে বইকি। হেমনলিনীদেবীকে এদিক পানে আসতে দেখে বাকি পেশেন্টরা সেই যে দৌড় দিয়েছে, এক সপ্তাহের আগে এদিক পানে এলে হয়। আপনি বলুন দাদা।’

‘ব্রজ ছিল আমার ছোটবেলার একমাত্র বন্ধু, বুঝলে। শুধু বন্ধু নয়, হরিহর আত্মা। অথচ হওয়ার কথা ছিল না। ব্রজ এলাকার বিখ্যাত সম্পন্ন বাড়ির ছেলে, আর আমার দিন আনি দিন খাই অবস্থা। শুধু তাই নয়, স্বভাব চরিত্রেও আমরা একে অন্যের একেবারে উলটো ছিলাম। আমি ছোটবেলা থেকেই লাজুক আর মুখচোরা, আর ব্রজ তেমনই একরোখা গোঁয়ার, আর খুব সাহসী। কী বলবো ভায়া, অমন ডানপিটে ছেলে কমই দেখেছি জীবনে। কতবার যে বেপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারপিট করে মাথা ফাটিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আর শুধু কি তাই? মাথায় বিচিত্র সব দুষ্টু বুদ্ধিও খেলত খুব। অন্য ছেলেদের কথা ছেড়েই দাও, স্যারেরাও নাজেহাল হতেন ওকে নিয়ে, লেখাপড়াতে খুব ভালো না হলেও মোটামুটি চলনসই ছিল বেজা, আর ছিল দুর্দান্ত ভালো স্পোর্টসম্যান। তাই আমাদের হেডস্যার উমাশঙ্করবাবু ওকে একটু স্নেহের চোখেই দেখতেন।

তবে যে বিষয়টায় ব্রজ সত্যিই ভালো ছিল সেটা হচ্ছে ইতিহাস। ওই বয়সেই ভারী ভারী বই পড়তে দেখেছি ওকে। তার মধ্যে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং গল্প মাঝেমধ্যে শোনাতো ও। বলতে বাধা নেই, সেই সূত্রেই আমরা অনেক অজানা কিছু জানতে পারতাম। যেমন ধর খ্রিষ্টধর্মের প্রথম দিককার ইতিহাস, জুলিয়াস সিজারের ব্রিটেন আক্রমণের গল্প, মায়া সভ্যতার গা শিউরে ওঠা কাহিনী, আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের কথা, মারাঠা বীর শিবাজীর বীরগাথা, মুঘল আমলের রসালো কেচ্ছা, কলকাতার আদিযুগের বিভিন্ন অজানা কাহিনী, এসব ওর থেকেই জেনেছিলাম আমরা।

এহেন ব্রজনারায়ণ হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে উধাও! সে প্রায় পাঁচ ছ’বছর আগেকার ঘটনা। সেই রাতেই যতীনকাকু কোন একটা জমির বায়না করার জন্য লাখ খানেক টাকা ক্যাশ এনেছিলেন। দেখা গেল সেটাও নেই, ব্রজও নেই।

সারা গ্রামে হুলুস্থুল পড়ে গেল। আশেপাশের আরও পাঁচটা গ্রাম, মায় গোটা পরগণা জুড়ে বিশাল উত্তেজনা। কেউ বলছে ব্রজ মাওবাদীদের দলে যোগ দিয়েছে, কেউ বলছে সন্ন্যাসী হয়ে গেছে, কেউ বা বলছে বম্বে গেছে হিরো হবে বলে। কাকীমা ঘন ঘন মূর্ছা যেতে লাগলেন।

মিত্রদের পরিবার এই এলাকার প্রভাবশালী পরিবার। ফলে পুলিশকে নড়েচড়ে বসতেই হল। কলকাতা থেকে পুলিশের বড় সাহেবরা এলেন, পুলিশের কুকুর অবধি আনা হল। ব্রজ’র বুজুম ফ্রেন্ড হিসেবে আমাকেও অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। কিন্তু হতচ্ছাড়া উধাও হওয়ার আগে আমাকে ঘুণাক্ষরেও কিছু বলে যায়নি, ফলে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। পুলিশ আরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ব্রজনারায়ণ মিত্তিরের অন্তর্ধান রহস্য রহস্যই থেকে গেল। ধীরে ধীরে সব কিছু থিতিয়ে গিয়ে সবকিছু আগের মতই চলতে লাগল।

‘ভেরি ইন্টারেস্টিং। তারপর?’

‘ব্রজ ফিরে এল আজ থেকে ঠিক ছ’মাস আগে। তখন সে পুরোপুরি স্যুটেড বুটেড বিলিতি বাবুসাহেব, চেকনাইয়ের জেল্লায় তখন তাকে চেনাই দায়। বোলচাল গেছে পালটে, কথায় কথায় উর্দু বলছে। সারা গ্রামে আবার হুলুস্থুল, তবে আগের মতো না। কাকীমা মারা গেছেন তাও প্রায় বছরদুয়েক হল। যতীনকাকু তো আনন্দে কেঁদেই ফেললেন প্রথমে। তারপর এদিক সেদিক মিলিয়ে কম করে গোটা পঞ্চাশেক মন্দিরে পুজোটুজো দিয়ে সে এক একাকার কাণ্ড।’

‘তা এই ব্রজবাবু ফিরে এসে জানালেন তাঁর বাড়ি ছাড়ার কারণ?’

‘সে তো জানালই। আরও জানাল এই পাঁচ ছ’বছর কী কী করেছে সে। তার আগে বিষ্ণুচরণের কথাটা বলে নেওয়া প্রয়োজন।

ঘুঘুডাঙার সম্পন্ন ব্যবসায়ী হরিচরণ তিওয়ারির ছেলে হচ্ছে বিষ্ণুচরণ। ইঁটভাটা থেকে শুরু করে সিনেমা হল, তেলকল থেকে শুরু করে পেট্রল পাম্প, ওদের পয়সার লেখাজোখা নেই। আর ওদের টাইটেল তিওয়ারি হলে কী হবে, শ’আড়াই বছর কলকাতায় থেকে ওরা বাঙালিই হয়ে গেছে একেবারে।

পয়সা হলে যা হয়, আমাদের সময়ে বয়ে যাওয়া বলতে যা বোঝাতো, বিষ্ণুচরণ ছিল তার জ্যান্ত উদাহরণ। ডেঁপোমিতে তার তল পাওয়া দায়। অল্প বয়সেই নেশা করতে শিখেছিল সে, সঙ্গে ছিল হাতটানের অভ্যেস। অমন অসভ্য ইতর বাউন্ডুলে বেহায়া ছোকরা জীবনে কমই দেখেছি।

এই বিষ্ণুচরণের সঙ্গে ব্রজ’র কী করে যে বন্ধুত্ব হল বলা মুশকিল। তবে দুজনের মধ্যে বেশ গুজুরগুজুর চলত দেখেছি। তবে সেটা কী নিয়ে তখন বুঝিনি। বুঝলাম এতদিন পর।

ব্রজদের জমিদারবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে একটি অতি প্রাচীন শিবমন্দির আছে, এখন পরিত্যক্ত। তার শিবলিঙ্গটির আকার বিশাল। এককালে দূর দূর থেকে লোকে দেখতে আসত।

সেই শিবলিঙ্গটির মাথায় এককালে তিনটি সোনার পাত আঁটা ছিল। সোনার ত্রিপুণ্ড্রক। আজ থেকে প্রায় একশো বিশ তিরিশ বছর আগে কেউ নাকি সেই সোনার পাত তিনটে চুরি করে নিয়ে পালায়।

ব্রজ বলেছিল, সে নাকি কোনও গতিকে সেই হারানো ত্রিপুণ্ড্রকের খোঁজ পেয়েছে। তার পেছনে নাকি এই বিষ্টুচরণের কোন এক পূর্বপুরুষের লিখে যাওয়া দলিল দস্তাবেজের হদিশ আছে।’

সতীশ ডাক্তার বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘এখানে আবার বিষ্টুচরণ এলেন কোথা থেকে?’

‘এলেন ওই পুরোনো দলিলের সূত্রে। চোর নাকি প্রথম দুটো পাত নিয়েই পালাতে পেরেছিল। থার্ডটা নাকি কোনও গতিকে রয়ে যায় বিষ্টুচরণের ওই পূর্বপুরুষের কাছে।’

‘সে কী?’ ভুরু কুঁচকে যায় সতীশ ডাক্তারের, ‘অমন অমূল্য জিনিস, যা নাকি চুরি গেছিল, সেটা কোনও গতিকে বিষ্টুবাবুর পূর্বপুরুষদের কাছে রয়ে যায় কী করে?’

হাত উলটোন গগন মল্লিক, ভ’সে কী করে বলি বলো? বেজা যা বলেছিল সেইটুকুই তোমায় বললাম। তবে এসব অতি গুহ্য কথা। কাউকে বোলো না যেন।’

সতীশ ডাক্তার খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচলে চুপ রইলেন। তারপর বললেন, ‘হুম। তা এই করিৎকর্মা মানুষটি মারা গেলেন কী ভাবে?’

‘সেটাই তো আশ্চর্যের হে। ব্রজ এসে ঘুঘুডাঙায় ফিরে কিছু সঙ্গীসাথীও জোটায়। পুরোনো আলাপী বিষ্টুচরণ তো ছিলই। যাদের জোটায় তাদের কারও ইতিহাসই যে খুব ধোয়ামোছা তা নয়। খবর আসত মিত্রবাড়িতে মাঝরাতে বিষ্টু আর বেজা’র গোপন মিটিং হচ্ছে। সঙ্গে আরও লোক আসছে যারা এই গাঁয়ের কেউ না। তারা বাইরের লোক। রাতেই আসে, রাতেই চলে যায়। এসবই গোপন খবর। তবে রাজনীতি করেছি বহুদিন, এসব সংবাদ আমার কানে চলে আসেই। জানি না কেন, আমার মনে হয়েছিল ব্রজ’র এখানে ফিরে আসাটা হঠাৎ নয়। এর পিছনে কোনও অন্য উদ্দেশ্য আছে।

আজ থেকে মাস খানেক আগের তেইশ তারিখ, অমাবস্যার রাত। আমি শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছি, এমন সময় হঠাৎ করে বোমা আর গুলির আওয়াজে ঘুঘুডাঙা পুরো কেঁপে উঠল যেন। আমি তো হতভম্ব। প্রথমে তো মনে হল ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ টুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে বুঝি, এমনই দাপট সে বোমাবাজির। একটু সামলে সুমলে উঠে থানার দারোগা ভূপেন আচায্যিকে ফোন করলাম। তিনি তো কেঁপেঝেঁপে অস্থির। তারপর গাঁয়ের আর পাঁচজনকে জুটিয়ে এনে দেখি, ওইদিকে মোড়ের মাথায় যে বটগাছটা, সেখানে গোটাকয়েক লাশ পড়ে। তার মধ্যে একটা আমাদের ব্রজবাবু’র।’

‘হুম। এ গল্পটা ভাসাভাসা শুনেছিলাম বটে। খবরের কাগজেও বেরিয়েছিল বোধহয়, ঘুঘুডাঙায় গোষ্ঠীসংঘর্ষে চারজন নিহত।’

‘হুম। চারজনের মধ্যে দুজন ছিল বাইরের লোক। ব্রজকে বাদ দিয়ে যে আরেকটা লাশ ছিল সেটা গ্রামেরই একটা ছেলের নাম লক্ষ্মণ সামন্ত, আমরা ডাকতাম লখাই বলে। লখাইয়ের নামে মার পিটের অভিযোগ ছিল, শোনা যায় ডাকাতিরও কিছু কেস ছিল ওর নামে। সেদিন রাতে কী যে হয়েছিল বলা মুশকিল। পুলিশ বোধহয় তদন্ত করছে এখনও। তবে রাতের বেলায় লোকে জায়গাটা এড়িয়ে চলছে আজকাল। অপঘাতে মৃত্যু, তাও বটতলায়। বোঝোই তো।’

‘তাতে আর ভয় কী। আপনার মতো ডাকাবুকো মানুষ আছেন যখন।’

গগন মল্লিক কাছে ঘেঁষে আসেন, ‘দিন কাল ভালো নয় ডাক্তার। চারিদিকের বাতাসে নানান গুজব ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেসব ফিসফিসানি সবই কানে আসে আমার। ঘুঘুডাঙায় খুব শিগ্গিরি একটা কিছু ঘটতে চলেছে ডাক্তার। খুব সাঙ্ঘাতিক একটা কিছু।’

সতীশ চাকলাদার গলা নামিয়ে বলেন, ‘কী ঘটতে চলেছে মল্লিকদা?’

‘ব্রজ নাকি দৈবগতিকে কোনও একটা গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছিল। সে নাকি অমূল্য জিনিস, টাকার অর্থে তার পরিমাপ হয় না। তার খোঁজেই ব্রজর ঘুঘুডাঙায় ফিরে আসা। কিন্তু সেটা কী, আর কোথায় আছে, কেউ জানে না।’

* * *

রাস্তা দিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে হাঁটছিল ভজন। টাকা পেয়ে সে প্রথমে যতটা খুশি হয়েছিল সেটা উবে গিয়ে এখন বেশ চিন্তা হচ্ছে তার। বাজারে বেশ কিছু কেনাকাটা করেছে সে। বলাবাহুল্য, ভজন নগদ ক্যাশ দিয়ে জিনিসপত্র কিনছে দেখে সব দোকানদারই একটু চমকিত। অনেকেই ঠারেঠোরে জানতে চাইছে ভজন টাকা পেল কোথা থেকে। ভজনও এ কদিনে বেশ শেয়ানা হয়ে গেছে। সে বুঝে গেছে যে সব সত্যি কথা সবাইকে বলতে নেই। তাই সে ইনিয়েবিনিয়ে সব্বাইকে বলেছে যে তার নাকি কোন দূরসম্পর্কের খুড়োমশাই মারা গেছেন, তাঁর উইলে ভজনের নামে কিছু টাকা রাখা ছিল, সেইটেই হাতে এসেছে আর কি।

তবে তাতে সবাই যে বিশ্বাস করছে তা নয়। হরেন গোঁসাই তো বলেই ফেলল, ‘তোর আবার দূরসম্পর্কের খুড়ো কোনকালে ছিল রে ভজা? খুড়ো বলতে তো তোর তিনকূলে ওই মাথাপাগলা লখাই সামন্ত ছাড়া আর কাউকে তো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’ ভব তালুকদার আবার এর এককাঠি ওপরে, মিষ্টি করে শুধোল, ‘অভাবে অনেকেরই অমন বেওয়ারিশ খুড়ো মেসো ইত্যাদি গজাতে দেখেছি রে ভজন। এই তো চাপড়ামারি’র স্বপন খাসনবিশ, এককালে রবিদাস হালুইয়ের মিষ্টির দোকানে কাজ করত। হঠাৎ দেখি গত ভোটের পর কোন পিসেমশাই না তালুইমশাই ধরে লালে লাল হয়ে গেল। এখন তার তিন তিনটে পাঞ্জাব লরি, গঞ্জের বাজারে দু’দুখানা চালকল, তার ওপর শুনছি নাকি প্রমোটারির ব্যবসাতেও নামবে। লোকে আগে ছেনো বলে ডাকতো, এখন বলে স্বপনবাবু। তা তুইও তেমন কোনও খুড়ো পাসনি তো ভজন? খুলে বল ভাই, তাহলে আজ থেকেই ভজনবাবু বলাটা প্র্যাকটিস করি।’

 দুপুর এখন বিকেল ছুঁইছুঁই। ঘুঘুডাঙা’র একপাশে সুন্দরী নদীর মরা খাত। এককালে বেশ জল ছিল তাতে, ভজন ছোটবেলায় কাকার হাত ধরে এখানে মাছ ধরতে আসত। এখন সুন্দরী নদী হেজেমজে গেছে। ভজন সেই শুকনো নদীখাত পেরোতে পেরোতে হঠাৎ করে কানের কাছে একটা বিনবিনে স্বর শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল। কে যেন চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলছে, ‘অসভ্য, ইতর, বাঁদর, গোমুখ্যু, রাতদিন হাড় মাস কালি করে তোকে মানুষ করেছি এই জন্যই?’

ভজন হাতজোড় করে বলল, ‘আর ভয় দেখিও না কাকা। সকালে যা খেল দেখালে তাতেই মাথা তাজ্ঝিম তাজ্ঝিম করছে। কী চাও এবার বল তো ঠিক করে।’

কানের কাছে সেই বিনবিনে স্বর এবার মারাত্মক ক্রুদ্ধ, ‘হতচ্ছাড়া, নিকম্মার ঢেঁকি, অপদার্থ। ভাবলি কী করে যে সামন্ত পরিবারের ভিটে বিষ্টুচরণের হাতে ছেড়ে দিয়ে পগারপার হবি তুই? তোর একটা মান অপমান বোধ নেই? নিজের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে লজ্জা করবে না তোর?’

ভজন কুঁইকুঁই করে বলল, ‘কী করব বল কাকা, আমার আর উপায় আছে কোনও? বিষ্ণুচরণ যে দু’বেলা বাড়ি এসে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে!’

‘বিষ্টু’র এত বড় সাহস হয় কী করে তোকে হুমকি দেওয়ার? তাকে মুখের ওপর না করে দিতে পারিসনি?’

‘না কাকা, আমার অত সাহস নেই। তা ছাড়া বিষ্টু বলেছে তুমি নাকি বাড়ি বন্ধক দিয়ে টাকা ধার নিয়েছিলে। এখন সে টাকা শুধতে পারলে আমি কী করব বল? তুমি বেঁচে থাকলে তাও না হয় একটা কথা ছিল।’

এবার প্রায় কামান গর্জন, ‘কী? আমি বাড়ি বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়েছি? এত বড় মিছে কথা? বিষ্টু হতচ্ছাড়া তাই বলেছে বুঝি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘ডাহা মিথ্যে কথা। আমি মোটেও বাড়ি বন্ধক রেখে টাকা নিইনি। টাকাটা নিয়েছিলুম হ্যান্ডনোটে। সেটা যে চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে বেড়ে দশ হাজারে দাঁড়াবে সেটাই বা আমি জানব কী করে?’

ভজন হতাশ সুরে বলল,’ সে আর এখন বলে কী লাভ, ধার নেওয়ার সময় মনে ছিল না? এখন বিষ্টুচরণ যদি গায়ের জোরে বাড়ি দখল করতে চায় তো আটকাবো কী করে?’

‘তাই বলে বাড়ি ছেড়ে পালাবি? হতচ্ছাড়া বেআক্কেলে…. ‘

ভজন একটু গরম হয়ে বলল, ‘দেখো কাকা, বেশি মেজাজ দেখিও না। ধার নিয়েছ তুমি, শুধতে হবে আমাকে, এটা কোথাকার আইন একটু বলবে আমাকে? আর সেটা না পারলে আমারই বা কী দোষ সেটা জানতে পারি কি?’

লখাইয়ের ভূত খানিক ম্রিয়মাণ হয়ে বলল, ‘কথাটা অবিশ্যি ঠিকই বলেছিস রে খোকা। তবে কি না..’

তার আগেই ভজন তিক্তস্বরে বলল, ‘তোমার ধার তোমারই শোধ করা উচিত ছিল কাকা। এখন তার আগেই ফৌত হয়ে বসে আমার ওপর চোটপাট করে লাভ আছে কিছু? এখন বরং এর থেকে বাঁচার কিছু উপায় থাকলে বল, নইলে আমি কালই চললাম বাড়ি ছেড়ে।’

‘ইঃ, ছেলের মেজাজ দেখো একবার। নেহাত বেজাবাবু বললেন তাই আসা। নইলে এত বড় একটা কাণ্ড বাধিয়েছিস সে খবর কি পেতুম?’

‘তা সে খবর পেয়ে লাভ আছে কিছু?’

‘নইলে আর তোকে বলছি কি। শোন ভজন, তোর সঙ্গে আমার কিছু গোপন শলাপরামর্শ আছে।’

ভজন একবার চারিদিকটা দেখে নিল। এই পড়ন্ত দুপুরে সুন্দরী নদীর চরে দূর দূর অবদি কেউ নেই। সে উদাসমুখে বলল, ‘শলাপরামর্শ শোনারও তো একটা খরচা আছে না কী। সকালে যা টাকা পেয়েছিলুম সেসব তো ফুটকড়াই হয়ে গেছে। এবার পরামর্শ’র সঙ্গে সঙ্গে কিছু নগদও ছাড়ো তো দেখি কাকা।’

‘হ্যাঁ রে খোকা, তুই আমাদের ভজন তো।’

‘এখনও অবধি তো তাই বলেই জানি।’

‘বলি সাত চড়ে তো রা কাড়তি না। তোর পেটে পেটে এত শেয়ানা বুদ্ধি গজালো কী করে বল দেখি?’

‘পেট খালি থাকলে শেয়ানাবুদ্ধি এমনই গজায় কাকা। সে বাদ্দাও, এখন কাজের কথা থাকলে বলো, নইলে চললাম।’

‘আহ, সেটাই তো বলতে এসেছি। মাথা ঠান্ডা করে শোন। বলি আমি কী করে কেন খুন হলাম সে নিয়ে জানিস কিছু?’

‘কী করে বলব? আমি কি পুলিশ? তা ছাড়া বেঁচে থাকতে তো তুমি শত্তুরের আর অভাব রাখোনি। ভেবেছি তাদেরই কেউ হয়তো ঠুকে দিয়ে গেছে। ভূপেন দারোগা তো বলেই দিল,’ ওরে ভজন, একদিক দিয়ে দেখতে গেলে তুই বেঁচেই গেলি বলতে পারিস। লখাই যেমন মারকুটে আর মাথাগরম লোক ছিল, কোনদিন হয়তো দেখলি রেগেমেগে তোর মাথাতেই বসিয়ে দিল এক ঘা। বলি এমন ডেঞ্জারাস এলিমেন্টের সঙ্গে ঘর করার থেকে বরঞ্চ একা থাকাই ভালো, বুঝলি কী না।’

‘বটে? ভূপেনর মতো গোমুখ্যুটার কথা শুনে বুঝি তুইও সেটাই সত্যি বলে মেনে নিলি? ওরে ছাগল, বলি আমার লাশের পাশে বেজাবাবুর মতো অমন মস্ত মানুষের লাশ, সে দেখেও তোদের কিছু মনে হল না?’

ভজন হাত উলটে বলল, ‘মনে হয়েই বা আমার লাভ কী? তখন কি আমার মাথার ঠিক আছে কাকা? একদিকে লোকে বলছে তোর খুড়ো ভালো মানুষ ছিল না কী না, তাই কেউ ঠুসে দিয়ে গেছে। এদিকে পুলিশ বলছে ঝটপট লাশ জ্বালিয়ে দে ভজন, নইলে পরে হাঙ্গামা হবে। আমার হাতে তেমন পয়সাও নেই যে তোমার দাহকার্য করতে পারব। তখন শেষমেশ ওই বিষ্টুচরণ নিজে এগিয়ে না এলে হয়তো তোমার দাহকার্য শ্রাদ্ধশান্তি এসবের কিছুই হত না। আর ব্রজবাবুর খুন নিয়ে হাঙ্গামা কেন হয়নি সে মিত্তিরবাড়িই বলতে পারবে।’

‘নাহ, যেমন ভোঁদাই ছিলিস তেমনই আছিস রে ভজন। সে অবশ্য একদিক থেকে ভালোই। তবে সে যাই হোক, এবার কাজের কথাটা মন দিয়ে শোন দিকি। আজ বাড়ি ফিরে আমার ঘরে ঢুকবি, বুঝলি। তারপর ঠাকুরের সিংহাসনের কাছে দাঁড়াবি। তারপর সিংহাসন সরিয়ে দেখবি…’

‘ওসব বহু আগেই দেখা আছে কাকা। সামনে এগোও।’

‘অ্যাঁ? তার মানে আমার ঘরে লুকিয়ে চুরিয়ে আগেই ঢুকেছিস তুই? তোকে না পই পই করে আমার ঘরে ঢুকতে মানা করেছিলাম? তোর তো দেখছি সাহস কম না ভজু?’

ভজন তেরিয়া হয়ে বলল, ‘তা তুমি ড্যাং ড্যাং করে ফৌত হওয়ার আগে কি ভেবেছিলে আমার কী হবে? কোথায় কী টাকাপয়সা লুকিয়ে রেখেছ সেসব জানবো কী করে আমি? ওই জন্যেই তো তোমার ঘরে কিছু ছানবিন করতে গিয়েই সিংহাসনের নীচে ওই গর্তটার খোঁজ পেলাম।’

‘ওরে শালা রে! তা সেই গর্তের মধ্যে কী পেলি তুই?’

‘দেখো কাকা, একদম গালমন্দ করবে না। সোজা কথা সোজাভাবে বল। গর্তের মধ্যে পেলাস্টিকে মোড়া একটা ছোট বইমতো ছিল। তুমি সেটার কথাই বলছ তো?’

‘ওরে বাবা রে! আমি কোথায় যাব রে! এ তো একেবারে মানুষ হয়ে উঠেছে দেখছি। জয় গৌর নেতাই, জয় কালী করালবদনী, জয় অঘোরীশম্ভু, ওগো তোমরা কে কোথায় আছ…দৌড়ে এসে দেখ, আমাদের ভজন যে একেবারে ডাকাবুকো মানুষ হয়ে পড়ল যে গো!’

ভজন কঠিনস্বরে বলল, ‘দেখ কাকা, ফালতু নাটক কোরো না। ওটা যে এমনি এমনি লুকিয়ে রাখোনি সে আমি বেশ বুঝেছি। এবার বলো ওটা নিয়ে করতে হবেটা কী।’

‘ওরে আমার সাত রাজার ধন এক মাণিক, চোখের মণি, বুকের পাঁজর…’

‘আহ কাকা, হচ্ছেটা কী? বড় হয়েছি তো না কি? শোনো, আগেই বলে দিচ্ছি এসব ফালতু কথায় চিঁড়ে ভিজবে না, কিছু নগদ খসাতে হবে তোমাকে। কাজটা কী খোলসা করে বল দিকি, আর জলদি কিছু টাকাপয়সা ছাড়ো।’

‘আহা, সোনামাণিক আমার। টাকার ব্যাপারে কি না করেছি রে ভজু? তবে কথা হচ্ছে কী না, ওই ডায়েরিটা কিন্তু খুব সাবধানে রাখতে হবে, বুঝলি। বিষ্টুচরণ যেন কিছুতেই ওটার খোঁজ না পায়।’

‘কেন? তাতে এমন কী আছে শুনি?’

‘কারণ আছে রে ভজন, মস্ত কারণ আছে। ওটার জন্যই তো এত ঝামেলা ঝঞ্ঝাট। তুই কী জানিস, বিষ্টুচরণও ওটার লোভেই তো লোক লাগিয়ে আমাকে আর বেজাবাবুকে খুন করেছে?’

ভজন খানিকক্ষণ গভীরভাবে ভেবে বলল, ‘সেটা আমি অনেকটাই আন্দাজ করেছিলুম কাকা। তার ওপর অনেকেই ঠারেঠোরে সে কথা আমাকে বলেছে বটে। কিন্তু ভূপেন দারোগা তো সেসব কিছুই মানতে চায়নি। তার ওপর আমাকে বলে কী না এই নিয়ে বেশি হম্বিতম্বি করলে আমাকেই নাকি সোজা ফাটকে পুরে দেবে।’

‘বলিস কী ভজন? ভূপেনর এত বড় সাহস হয়েছে?’

‘সাহস বলে সাহস? সে তো আমাকে এও বলল, ‘লখাইয়ের সঙ্গে যা হয়েছে সেসব ভুলে যা ভজন। এসব নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করিসনি। তোর ইয়াং ব্লাড, যাকে বলে একেবারে বয়েলিং। এসব পেছনে ফেলে লাইফটা নতুনভাবে শুরু কর, বুঝলি।’

‘হুম। বুঝছি। খুব নতুন ভাবেই বুঝছি রে ভজন। ভূপেনের সঙ্গে একবার দেখা না করলেই নয়।’

‘কিন্তু তুমি একটা কথা বলো কাকা, এক্ষেত্রে ডায়েরিটা বিষ্টুচরণের হাতেই তুলে দেওয়াটাই আমার পক্ষে ভালো নয় কী? তাতে হয়তো সে খুশি হয়ে বাড়িটার ওপর তার দাবি ছেড়েই দিল, চাই কী তার ওপর কিছু নগদও হয়তো হাতে ধরিয়ে দিতে পারে। তাতে ক্ষতি কী কাকা? আমি তো বরং লাভের পাল্লাটাই ভারী দেখছি।’

‘হে হে হে। তোর কী ধারণা বিষ্টু ওই ডায়েরি পেলে তোকে আর বাঁচিয়ে রাখবে রে ভজন? সে গুড়ে বালি। বিষ্টু এসবের সাক্ষী রাখবেই না। ডায়েরিটা পেয়েই তোকে গলা কেটে ডাইনিজলার জঙ্গলে পুঁতে রেখে আসবে। কিংবা হয়তো গ্যাঁড়াপোতার জঙ্গলে জ্বালিয়েই দিল, কে বলতে পারে?’

ভজন চুপ করে রইল। কথাটার মধ্যে যুক্তি আছে বটে।

‘শোন বাপধন আমার, ওসব গোখখুরিতে যাসনি। তার চেয়ে বরং মাথা ঠান্ডা করে আমার কথাটা শোন।

ওই ডায়েরিতে অনেক টাকাপয়সার হদিশ আছে বুঝলি? টাকার পরিমাপে তার ইয়ত্তা হয় না। সে সব হল গে মিত্তির পরিবারের পূর্বপুরুষদের জমানো গুপ্তধন। আর আমাদের বেজাবাবু নাকি সেটারই খোঁজ পেয়েছিল।’

‘আরিব্বাস! বলো কী কাকা? এসব কি সত্যি?’

‘ভূতেদের আজ অবধি কখনও মিথ্যে বলতে শুনেছিস?’

ভজন ভারী অভিমানভরে বলল, ‘কাকা, তোমার কী মনে হয় আমি দিনমানে নেত্যই ভূতেদের সঙ্গে বিবিধ রসালাপ করে থাকি?’

‘আহা, আমি কী তাই বলেছি রে পাগল? আমি তো বরং সদাসর্বদাই ভূতেদের সঙ্গে রসালাপ করাটাকে খুব সাঙ্ঘাতিক বলেই মেনে থাকি, বুঝলি কী না। আমি বেঁচে থাকলে তো তোকে ভূতেদের সঙ্গে আলাপ করতে বারণই করে দিতাম।’

‘আহা, কী কথাটাই না শোনালে কাকা। দিল একেবারে তররর হয়ে গেল।’

‘কথাটার মধ্যে কি কিছু প্যাঁচ আছে রে ভজন?’

‘হে হে হে, সে আছে বটে, কিন্তু সে বাদ দাও। এখন কাজের কথা বল তো কাকা, সে গুপ্তধন আছেটা কোথায়?

‘বললাম তো, মিত্তির বাড়ির গুমঘরে।’

‘সে গুমঘরের কথা তো গল্পেই শুনেছি কাকা, তার খোঁজ কেউ পেয়েছে বলে তো জানা নেই।’

‘সেটাই তো তোকে জানতে হবে রে ভজন, বেজাবাবুর ডায়েরিতে নাকি সেই গুমঘরের খোঁজই রয়েছে। আর ডায়েরির সংকেত অনুযায়ী সেই গুপ্তধন তোকেই খুঁজে বার করতে হবে।’

ভজনের গা’ টা খানিক শিউরে উঠল। সে বুঝতে পারল যে তার ঘাড়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে উঠেছে। কিন্তু লখাইয়ের কথা এখনও শেষ হয়নি।

‘আর শোন লখাই, এ কিন্তু সহজ রাস্তা নয়। পদে পদে বিপদের আশঙ্কা আছে। তবে সেসব যদি বুদ্ধি খাটিয়ে কাটিয়ে দিতে পারিস, তবে আর চিন্তা নেই।’

বিপদের কথা শুনে ভজনের গলাটা শুকিয়ে গেল। কোনওরকমে সে বলল, ‘কিন্তু কাকা, বিপদ এলে কী করব?’

ফের ঝাঁঝিয়ে উঠল সেই কণ্ঠস্বর, ‘ছেলের কথা শোনো। মনে হয় এক্ষুনি ঘেঁটি ধরে গঙ্গায় চুবিয়ে আনি। বিপদ এলে বাঘের বাচ্চার মতো লড়বি, বুঝলি, খবরদার পালাবি না, তাহলে বুঝব হ্যাঁ, সামন্ত পরিবারে একটা বাঘের বাচ্চা জন্মেছিল বটে।’

এই এক কথাতেই ভজনের ভীতু ভাবটা একেবারে কেটে গেল। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘কী করতে হবে সেটা এবার খুলে বল তো কাকা।’

লখাই সামন্ত ভারি খুশি হয়ে বলল, ‘শাব্বাস এই তো চাই। শোন খোকা, আমি আর বেজাবাবু তোর পেছনেই আছি, তার নমুনা তো দেখেইছিস। বাকিগুলোও ক্রমে ক্রমে হবে। যা হবে সেসব তোর ভালোর জন্যই হবে। তাতে কিন্তু ভয় পাস না। মনে রাখিস ওই গুপ্তধন কিন্তু তোকেই উদ্ধার করতে হবে, বুঝলি?’

‘বুঝলাম কাকা।’

ভজনের মনে হল একটা দমকা হাওয়া যেন একবার তাকে পাক মেরেই সাঁই করে ওপরে উঠে গেল।

* * *

সন্ধেবেলা ঘরে এসে তোলা উনুনে ভাত বসিয়েছিল ভজন। মাসখানেক হল এ বাড়িতে উনুনে আগুন পড়েনি। চেয়েচিন্তে যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই পেট ভরিয়েছে সে। তাই কাঠকুটো আর ঘুঁটের ধোঁয়াতে চোখে জল আসছিল ভজনের। তবে সেটা শুধু ধোঁওয়া নয়, অন্য কারণেও হতে পারে।

আয়োজন অবশ্য সামান্যই। সেদ্ধ ফ্যানাভাত, আলু সিদ্ধ, হাঁসের ডিম সিদ্ধ, নুন আর কাঁচালঙ্কা। অনেকদিন হল ডিমসিদ্ধ খায়নি ভজন। শুধু ডিম কেন, আমিষ খেয়েছে সেও প্রায় মাস দুয়েক হল। ভাবতে ভাবতেই জিভ থেকে দুটো ফোঁটা নতুন কেনা লুঙ্গিতে এসে পড়ল ভজনের। ভাত হয়ে গেছে বুঝে হাঁড়িটা উনুন থেকে নামাতে নামাতেই ভজন বুঝল যে টাগরা থেকে জিভের ডগা অবধি একটা খাই খাই ভাব উঠে আসছে। আর সে আসছে মানে তো আসছেই, বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে বাঁধ মানানো যাচ্ছে না। গলাটলা খাঁকড়ে নিজেকে বেশ ভারি গলায় তিষ্ঠ তিষ্ঠ বলে প্রবোধ দিল ভজন। তবে খাই খাই ব্যাপারটা সেই প্রবোধে তেমন আমল দিল বলে মনে হল না। এটা আগেও লক্ষ্য করেছে ভজন, খিদে ব্যাপারটা এসব ভারিক্কি শ্লোকটোককে তেমন পাত্তা টাত্তা দেয় না।

ভাতের ফ্যান গালার জন্য উঠতে যাবে ভজন, তখন সে খেয়াল করল যে ঘাড়ের কাছটা অজানতেই বেশ দপদপ করছে তার।

ভজন ভাবল হতেই পারে। দিনভর তো আর কম হুজ্জোত যায়নি তার ওপর দিয়ে। ঘাড়ে মুখে একটু জল দিয়ে আসলে যদি মাথাটা একটু ঠান্ডা হয়।

কুয়ো থেকে জল তুলে ঘাড়ে মুখে ছিটিয়ে মুছে নিল ভজন। আশ্বিনের আকাশ, সবে মহালয়া গেছে। আকাশে শুক্লপক্ষের চতুর্থীর চাঁদ বেশ ঝকঝক করছে। সেদিকে আলোয় চারদিকে একবার তাকিয়ে নিল ভজন, আর তখনই বেড়ার দিকে নজর গেল তার।

পুবদিকের করবীগাছটা তার নিজের জায়গায় নেই। সেটা প্রায় দু-হাত মতো সরে গেছে, তার গা ঘেঁষে এসেছে কাগজিলেবুর গাছটা।

এককালে ভজনের আতাক্যালানে বলে পাড়ায় নাম ছিল বটে, তবে সে ভজন আর এ ভজন নয়। সে বুঝে গেল এসব অশৈলী কাজকারবারের পেছনের কারণটা। কাকাকে বলেছিল বটে টাকার কথাটা। তবে সেটা যে এত তাড়াতাড়ি ফলে যাবে…

দুরুদুরু বুকে করবী গাছটার দিকে এগিয়ে গেল ভজন।

ওদের বাড়িটা পাড়ার একদম শেষ ভাগে। এদিকপানে হুট করে কেউ আসে টাসে না। তাও একবার চারিদিক তাকিয়ে নিল ভজন। আর তারপর করবী গাছের কাছে এসে দাঁড়াতেই মাটিতে পড়ে থাকা মানিব্যাগটা হালকা চাঁদের আলোয় চোখে পড়ল তার।

বাবার মানিব্যাগটা না?

হাতে নিয়ে ভজন বুঝল যে তার অনুমানই ঠিক। বাবার সেই ফাটা ময়লা মানিব্যাগটাই বটে। তফাতের মধ্যে সেটার মধ্যে কয়েকটা জরুরি কাগজ ছাড়া কোনওদিনই বিশেষ কিছু থাকত না। এখন সেটা বিস্তর পেটমোটা।

ঘরে এসে কুপিটা একটু উসকে দিল ভজন। তারপর মানিব্যাগটা খুলল। দু-হাজার টাকার পঁচিশটা নোট। মানে পঞ্চাশ হাজার টাকা।

হিসেব মতো এরপর ভজনের মূর্ছা যাওয়ার কথা। কিন্তু সে জানে এসব কেন হচ্ছে। তাই মাথাটাথা ঘুরলেও মোটামুটি সামলে নিল সে। মানিব্যাগটা একটা পুরোনো কার্ডবোর্ডের বাক্স’র ভিতর রেখে ঝটপট খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

ভজন জানতেও পারল না যে তার বাড়ির উলটোদিকের অশ্বত্থ গাছে চড়ে, সর্বাঙ্গে কালো চাদরে মোড়া একটা লোক তার বাড়ির দিকে নজর রাখছিল। ভজন ঘুমিয়ে পড়তেই হাতের শক্তিশালী বাইনোকুলারটা গুটিয়ে ফেরার পথ ধরল সে।

* * *

বিষ্ণুচরণ দশ হাজার টাকা বাক্সে ঢুকিয়ে মধুর হেসে বলল, ”আমি জানতামই যে ভজন একেবারে ওয়ান নাম্বারের অনেস্ট ছেলে, টাকা মারার বান্দাই নয়। ওরে কে আছিস, ভজনের জন্য গুড কোয়ালিটি টী নিয়ে আয়, ভজন কী আমাদের পর রে? সেই চিলড্রেনস ডে থেকে ওকে দেখছি।”

ভজনের গায়ে সদ্য কেনা টি শার্ট আর টেরিলিনের প্যান্ট। পায়ে নতুন হাওয়াই চপ্পল। এই দুদিনে তার চেহারার চেকনাই পালটে গেছে একেবারে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে একটা সুরুরর শব্দ তুলে সে বলল, ‘আগের দিনের কথাটাই আবার মনে করিয়ে দিই বিষ্ণুবাবুু। সুবিধা অসুবিধা মানুষের থাকেই, এই নিয়েই তো সংসার। তবে তাই বলে কারও বাড়ি গিয়ে চড়াও হয়ে অপমান করাটা কিন্তু কোনও কাজের কথা না।’

বিষ্ণুচরণ খানিক হেঁ হেঁ করে হেসে বলল, ‘আসলে দিনকাল তো ভালো না, তাই একটু সফট ওয়েতে মনে করিয়ে দেওয়া আর কি। তা তোর তো মনে হচ্ছে লাক ওপেন হয়ে গেছে রে ভজন। কী ব্যাপার, কোনও সিক্রেট ট্রেজার হাতে এল নাকি?’

ভজন চায়ের কাপটা মাটিতে নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিল, তার হাতটা সামান্য কেঁপে গেল। তবুও জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘আরে না না, গুপ্তধন টুপ্তধন কিছু নয়। সামতাবেড়েতে আমার এক দূরসম্পর্কের খুড়োমশাই মারা গেছেন কী না। তাঁর উইলে নাকি আমার নামে কিছু টাকা রাখা ছিল, সেইটেই হাতে এসেছে আর কি। তবে বেশি না, পেয়েছিলাম অল্পই। তার আবার সবটাই আপনাকে দিয়ে গেলাম।’

বিষ্ণুচরণ মাছি তাড়ানোর মতো করে কথাটা উড়িয়ে দিল। একটু খুক খুক করে হেসে বলল, ‘সেসব নিউজ অলরেডি কানে চলে এসেছে রে ভজন। সেই থেকেই তো ভাবছি, আমাদের কেন এমন আঙ্কেল হয় না বল দেখি।’

ভজন একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, ‘আসলে খুড়োমশাইরাও আজকাল ভাইপো দেখে জন্মাচ্ছেন কী না, সেই জন্যই হয়তো ব্যাপারটা মিস হয়ে গেছে।’

বিষ্ণুচরণ একটু ব্যাঁকা হেসে বলল, ‘সে তো লখাইকে দেখেই বুঝেছি। তা আজ কী পেয়ারাগাছের গোড়া থেকেই মোহরের থলেটা বেরোবে নাকি রে ভজন? নাকি কাগজিলেবু গাছটার ওপরেই নোটিশ রাখতে হবে বলছিস?’

এমনিতেই লোকটার হাবভাব ভালো ঠেকছিল না ভজনের। শেষের কথাটা শোনামাত্র তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল সে। হাতজোড় করে বলল, ‘তাহলে আজ উঠি বিষ্ণুবাবুু। টাকাটা তো পেয়েই গেলেন, আশা করি এরপর আর ওদিক পানে যাওয়ার দরকার হবে না আপনার। আর হ্যাঁ, দরকারে সময় বড় সাহায্য করেছিলেন, এই উপকারটুকু মনে রাখব।’

ভজন চলে যাওয়ার পর করিম আর হরেকৃষ্ণকে কাছে ডাকল বিষ্ণুচরণ। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘গনু চোর কী বলল? ভজন টাকা পাচ্ছে কোথায়?’

করিম মাথা চুলকে বলল, ‘গনু তো বলল ও ভজনকে দেখেছে বাগিচামে কী একটা পেঢ়ের নীচে থেকে টাকাটা কুড়িয়ে নিতে। কিন্তু টাকাটা কী করে ওখানে এল সেটা ও ঠিক বলতে ইয়াদ করতে পারছে না।’

বিষ্ণুচরণ মধুর হাসিতে ভুবন ভরিয়ে বলল, ‘হতেই পারে, তোর মতো অকালকুষ্মাণ্ড যখন আমার কাছারি এনলাইটেন করে থাকতে পারে, তখন গাছেরই বা টাকা বিয়োতে দোষ কী, তাই না রে করিম?’

করিম বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলল, ‘এ কথাটাও তো সচ-ই লাগছে হুজুর।’

বিষ্ণুচরণের হাতের কাছে একটা সুপুরি কাটার জাঁতি ছিল। সেইটে টিপ করে করিমের রগের দিকে ছুঁড়ে চ্যাঁচাতে লাগল ‘হতচ্ছাড়া বেল্লিক বেয়াদব স্কাউন্ড্রেল ইডিয়ট স্টুপিড মাথামোটা স্কন্দকাটা কোথাকার। এক্ষুনি দূর হ চোখের সামনে থেকে। ফের যদি তোকে আশেপাশে দেখেছি, ঠ্যাং খোঁড়া করে ছেড়ে দেব।’

করিম ”আইব্বাপ রে” করে একলাফে বৈঠকখানার বাইরে গিয়ে পড়ল। তারপর চোঁ চাঁ দৌড়। সেদিকে তাকিয়ে হরেকৃষ্ণ ভারী দুঃখিত মুখে বলল, ‘কথাটা কিন্তু ঠিক বললেন না কর্তা।’

লাল চোখ এদিকে ঘুরিয়ে বিষ্ণুচরণ বলল, ‘কোন কথাটা?’

‘করিম যদি কন্দকাটাই হবে তাহলে ওর মাথামোটা হয়ে লাভ কী, মানে মাথাই যখন আর থাকছে না? আর মাথামোটাই যদি হবে তো ওকে কন্দকাটা হওয়ার কী মানে?’

বিষ্ণুচরণ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল গদাইয়ের দিকে। তারপর খুব ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘জাঁতিটা একটু কুড়িয়ে এনে দিবি হরে?’

‘কেন কর্তা?”

‘আগের বারে টার্গেট মিস করেছি। এবারে আর করতে চাই না।’

হরেকৃষ্ণও আইব্বাপ করে লম্বা দিতে যাচ্ছিল। তার আগেই বিষ্ণুচরণ বাঘের থাবায় তাকে পেড়ে ফেলে বলল, ‘মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তোদের দুটোকেই সুন্দরীর চরে পুঁতে দিয়ে আসি, তাতে যদি আমার অ্যাঙ্গার কিছুটা মেটে।’

হরেকৃষ্ণ চিঁ চিঁ করছিল, তাকে ছেড়ে দিল বিষ্ণুচরণ। তারপর একটা বাঘাটে গলায় বললেন, ‘বাকি কাজ যা বলেছিলাম তার কী হল? সব রেডি?’

* * *

দশাসই শরীরটা ল্যাঙট পরে ঘুঘুডাঙা থানার বারান্দায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। একটা সিড়িঙ্গে চেহারার লোক সেই পাহাড় প্রমাণ লাশ দলাই মলাই করতে পা টিপতে টিপতে মৃদু সুরে বলল, ‘কত্তা, ঘুমোলেন নাকি?’

ভূপেন দারোগা আরামের আবেশে একটা ঘঁৎ করলেন প্রথমে। তারপর ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, ‘তোর হাতখানা ভাবছি এবার সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দেব রে গনু, তুই হলি একজন সত্যিকারের শিল্পী, বুঝলি?’

গনু একটু লজ্জা পেল প্রথমে, ‘তারপর বলল, ”শিল্পীর ব্যাপারটা কিন্তু খুব একটা ভুল বলেননি কত্তা। এই তো সেদিন পোড়াপীরতলায় জয়নাল চাচা’র বাড়িতে রাত্তিরে ঢুকেছি। খবর ছিল যে মেয়ের বিয়ের জন্য চাচা এক লাখ টাকা এনে রান্নাঘরের বাতায় ঝুলিয়ে রেখেছে। আমি যেই না তালাটি খুলে রান্নাঘরে ঢুকেছি, দেখি চাচা মেঝেতে সটান হয়ে বসে জুলজুল করে আমার দিকেই চেয়ে। আমি তো পালিয়ে বাঁচি না। চাচাই আমাকে ডেকে আদর টাদর করে বললেন, ‘ওরে পাগল, এককালে গোটা হুগলি জেলায় জয়নাল চোরের নাম প্রসিদ্ধ ছিল। সকালে যখন মুনিশ খাটার নাম করে সব দেখতে এসেছিলিস তখনই তোকে লক্ষ করেছি। তবে হ্যাঁ, তোর এলেম আছে বটে। অমন উঁচু পাঁচিল ডিঙিয়ে নামলি, বিন্দুমাত্র আওয়াজ হল না। আমার বাড়ি ভর্তি লোক, তিন তিনটে সা জোয়ান মরদ ছেলে, দু’দুখানা কাজের লোক কেউ টের পেল না বাড়িতে চোর ঢুকেছে। আমি অবশ্য জানতুম তুই আসবি। সেই থেকে এখানেই বসে আছি। আয় বাছা আয় দেখি। জয়নাল শেখ শিল্পীর মর্যাদা দিতে জানে। পোস্তবাটা আর লঙ্কাপোড়া দিয়ে দুটো আমানি খেয়ে যা দিকি।’ শুধু কি তাই, যত্ন করে একটা সুলেইমানি ভূতবন্ধন মন্ত্র অবধি শিখিয়ে দিলেন।’

.

ভুপেন দারোগা একটু ব্যথিত মুখে বললেন, ‘এই সাত সকালে হতচ্ছাড়াটার নাম না নিলে কি তোর চলছিল না ভজন? জানিস, এককালে জয়নাল চোরের জন্য তিন তিন খানা থানার দারোগা একসঙ্গে বদলি হয়ে গেছিল? আমার আগে যে দারোগাবাবু এসেছিলেন চিন্তায় চিন্তায় তাঁর বিশ কেজি ওজন কমে গেছিল? আর তারপর একদিন বড় কর্তার সামনে স্যালুট ঠুকতে গিয়ে কোমর থেকে প্যান্ট খুলে গিয়ে সে কী কেচ্ছা কেলেঙ্কারি?’

গনু একটু একটু দলাই মলাইয়ের স্পীড বাড়িয়ে দিল। ভূপেন দারোগা ফের আবেশে চোখ বুজে ফেললেন।

গনু একটু পর ফের মৃদুস্বরে বলল, ‘কত্তা, শুনছেন?’

‘গৌরচন্দ্রিকা বাদ দিয়ে বাকি যা বলার ঝট করে বলে ফেল গনু। ভূপেন দারোগা ঘুমোলেও চোখ কান সব সজাগ থাকে।’

‘বলছি আপনি আমাদের ভজন সামন্তকে চেনেন তো?’

‘ওই লখাইয়ের অপোগণ্ড ভাইপোটা তো? খুব চিনি। অমন হদ্দ কুঁড়ের বাদশা কমই হয়।’

‘তার যে চালচলন পালটে গেছে, সে খবরটা পেয়েছেন কি?’

‘কীরকম? ছোকরার নামে তো কোনওদিন বেচাল কিছু শুনিনি।’

‘আমাদের বিষ্টুদার কাছ থেকে লখাই কয়েক হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। সে টাকা সুদে আসলে দাঁড়িয়েছিল দশ হাজারে। তা লখাই ফৌত হওয়ার পর বিষ্টুদা গিয়ে ভজনকে বলল, হয় টাকা দাও না হয় বাড়ি ছাড়।’

‘খাতকের ধার কি সে মারা গেলে তার ভাইপোর ওপর অর্শায় রে গনু? আমি আবার আইনের ব্যাপারটা ভালো জানি না।’

‘হে হে হে। আপনি কিন্তু ভারি মজা কথা বলেন কত্তা। এই তো সেদিন মনসাপোঁতার নিতাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। চেনেন তো কত্তা? শিয়ালদা চন্ননগর লাইনের ফেমাস গ্যাঁড়াবাজ। লোকের পকেট থেকে মানিব্যাগ গ্যাঁড়াতে ওর জুড়ি নেই। নিতাই তো আপনার নাম শুনে হেসেই খুন। বলে তোদের দারোগাবাবু ভারি মজার মানুষ রে গনু। দেখলেই মনটা খুশিতে ভরে ওঠে।’

‘বাজে বকা’র একটা সীমা থাকে গনু। নিতাইকে বলে দিস পরেরবার যদি ওকে হাতের কাছে পাই তো পিটিয়ে সুন্দরীর চরে জ্যান্ত পুঁতে দিয়ে আসব। আমারই পকেট মেরে সেই টাকায় পাঁঠার মাংস কিনে ফিস্টি দেয় হতচ্ছাড়া? এত বড় সাহস?’

‘এ হে হে হে। নরম জায়গায় আঘাত দিয়ে ফেললাম নাকি কত্তা? বাদ দিন। আর আইনের কথা আবার কি? এই এলাকায় আপনার কথাই আইন, আপনার থানাই আদালত। এই তো সেদিন জয়হরি মুখুজ্জে বলেই ফেললেন…’

‘আহ, এসব ফালতু কথা ছেড়ে কাজের কথাটা বলবি?’

‘হেঁ হেঁ হেঁ.. তা সে কথাই তো বলছিলুম। তা বিষ্টুদা কিন্তু অন্যায্য কিছু বলেছেন কি কত্তা? তাঁরও তো অনেক কষ্টের টাকা, রক্ত মুখে তুলে উপার্জন করা টাকা, সেসব দানছত্তর করে দিলে চলবে কী করে বলুন তো?’

‘হুম তারপর?’

‘ভজনটার আস্পদ্দা দেখুন, সে কী না বিষ্টুদা’র সেই টাকাটা মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে গ্যাঁটম্যাট করে বেরিয়ে এল?’

মাথাটা এদিকে ঘুরিয়ে সামান্য উঠে বসলেন ভূপেন দারোগা, ‘বলিস কী রে গনু? এক লপ্তে দশ হাজার টাকা ফিরিয়ে দিল ভজন? অত টাকা পেল কোথায় ছোঁড়া?’

‘সেটাই তো কথা কত্তা। ভজন চাদ্দিকে বলে বেড়াচ্ছে তার নাকি কোন না কোনও খুড়ো পটল তুলেছে, আর তাতে নাকি মেলা টাকাপয়সা পেয়েছে সে। তার তো চালচলনই পালটে গেছে কত্তা। পরনে নতুন জামা, নতুন জুতো। মশমশ করে হাঁটে, মুখখানা গেরাম্ভারি করে ইদিকে উদিকে চায়। সেদিন আবার হারাণ নাপিতের কাছে ক্ষৌরি হয়ে আট টাকার ওপর দু’টাকা বকশিশ অবধি দিয়েছে।’

আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন ভূপেন দারোগা, ‘বলিস কী রে? ভজনের এত উন্নতি হয়েছে? একবার দেখতে হচ্ছে তো ব্যাপারটা।’

‘তবে আর বলছি কি কত্তা। সাপের পাঁচ পা দেখেছে বললেই হয়। সেদিনই তো রাখাল সাধুখাঁ’র সঙ্গে দেখা। সে তো বলল বাজারে জোর গুজব, ভজন নাকি কোন ডাকাতদলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কে নাকি ভজনকে দেখেছে অমাবস্যার রাতে একটা মস্ত খাঁড়া হাতে কুমোরহাটির জঙ্গলে সেঁধুতে।’

‘বটে? সাধুখাঁ অবশ্য তেমন সাধুপুরুষ কিছু নয়। আশায় আছি লোকটা একদিন মিথ্যে কথার কম্পিটিশনে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ব্রেক করবে। কিন্তু প্রশ্নটা যে থেকেই যাচ্ছে রে গনু। ভজনা এত টাকা পেল কোথায়?’

গনু কিছু বলার আগেই থানার হাবিলদার হুকুমচন্দ সিং দৌড়ে এসে খবর দিলো, ‘কলকাত্তা সে দো সাহাবলোগ আঁয়ে হ্যায়।’

অলস মন্থর ভঙ্গিতে উঠে পড়লেন ভূপেন দারোগা, ‘ভেতরে নিয়ে বসা। আমি স্নানটা সেরেই আসছি।’

* * *

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *