১. সেবারে পুজোয় ষষ্ঠীর দিন

চক্রসম্বরের পুঁথি – অভীক সরকার / প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০২০

.

উৎসর্গ

শ্রীমতী শর্মিলা পান এবং শ্রীপ্রবীর পান।
যে দু’জন মানুষ আমাকে জামাই হিসেবে নয়, নিজের ছেলের মতোই ভালোবেসে এসেছেন গত চোদ্দ বছর ধরে, তাঁদের করকমলে।

.

ভূমিকা

.

সে এক প্রখর রৌদ্রকরোজ্জ্বল জুনস্য প্রথম দিবস। অফিসে বসে প্রবল গরমে ঘামছি আর ভাবছি যে এত গরম লাগে যখন, তখন তো তিব্বত গেলেই হয়, এমন সময়ে এই সময়ের সেরা ইলাসাট্রেটর তথা মায়াকানন-এর সম্পাদক সুবিখ্যাত অর্ক পৈতণ্ডীর ফোন। মোবাইলটা কানে তুলতেই ভদ্রলোক আমাকে মায়াকানন বার্ষিকী ২০১৯-এর জন্য উপন্যাস লেখার কথাটা মধুমাখা স্বরে স্মরণ করিয়ে দিলেন।

মনে পড়ে গেল যে গত বছর মায়াকানন বার্ষিকীতেই ‘কালিয়া মাসান’ নামক একটি নভেলা লিখেছিলাম বটে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে নভেলাটি কিঞ্চিৎ জনপ্রিয়ও হয়। পরে সুবিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত ‘খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ’ বইটিতে উপন্যাসিকাটি স্থান পেয়েছে। তারও মার্কেট রিপোর্ট শুনেছি খারাপ না।

এ-ও মনে পড়ে গেল যে ‘কালিয়া মাসান’ পড়ার পর অগ্রজ সাহিত্যিক শ্রীসৌরভ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন যে তন্ত্র-টন্ত্র তো অনেক হল, এবার অন্য ধরনের লেখা লিখি না কেন? অগ্রজের পরামর্শ গুরুর আদেশতুল্য। এমনকি ‘মিশন পৃথিবী’ নামক ব্লকবাস্টার বইটির লেখিকা, ‘তিতিরপাখি ও প্রিন্সেস’-এর সহলেখিকা এবং সুহৃদ অনুষ্টুপ শেঠও অনেকদিন ধরেই খোঁচাচ্ছিলেন একটা ‘ডিটেক্টিভ নবেল’ লেখার জন্য। ‘চক্রসম্বরের পুঁথি’ লেখার দুঃসাহস তারই ফলশ্রুতি। শেষমেশ এ যে কী জিনিস দাঁড়িয়েছে বলতে পারব না। তবে আমি ছোটবেলায় যেমন গোয়েন্দা গল্প পড়তে পছন্দ করতুম, তেমনটি লিখতে চেয়েছি, এইটুকু বলতে পারি।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন কাহিনির মূল ধরতাই পেয়েছি ভগিনীসমা ঋতুপর্ণা চক্রবর্তীর কাছ থেকে। অনুরোধ করামাত্র তিনি খুশিমনে তাঁর স্বপ্নাদ্য প্লটটি আমাকে উপহার দিয়েছেন। অতএব যদি নিতান্ত বাজে লিখে থাকি তাহলে অর্ধেক গাঁট্টা এই মহিয়সীরও প্রাপ্য।

গল্পের মধ্যে দু’টি চর্যাপদের শ্লোক এবং একটি চর্যার-পরেরকার-সময়ের-হলেও-হতে-পারে শ্লোক রয়েছে। চর্যার শ্লোকদু’টি আমারই লেখা, ওই একই স্টাইল কপি করে। পরেরটি লিখে দিয়েছেন অগ্রজ প্রাবন্ধিক শ্রীরজতকান্তি পাল মহাশয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য সাপ্লাই দিয়ে আমাকে অশেষ কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ করেছেন বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় রাজা ভট্টাচার্য।

আপাতত এইটুকুই রইল। পাঠক পড়ে দেখবেন আশা করি। ভালো লাগলে জানাবেন। আর খারাপ লাগলে চ্যালাকাঠখানি পিঠে থোড়াসা মিঠে করে ভাঙবেন… এই আর কী!

অভীক সরকার

.

সেবারে পুজোয় ষষ্ঠীর দিনই একপশলা ঝড়বৃষ্টি হয়ে পুজোর প্রায় দফারফা। আমাদের সবারই তো মাথায় হাত। বছরে এই একটামাত্র সময়েই নিয়মকানুনের বাইরে গিয়ে একটু ফূর্তিফার্তা করার পারমিশন থাকে। সে-সব ভেস্তে গেলে কারই বা আনন্দ হয়? তা বাড়িতে বসে-থেকে-থেকে বেজায় মন খারাপ, মায়ের হাতের অমন চমৎকার পরোটা আর ঘুগনি অবধি পানসে লাগছে, এমন সময় তাপসের ফোন।

তাপস হচ্ছে আমার এক খুড়তুতো ভাইয়ের বন্ধু। আমি তখন আশুতোষ কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, ফিজিক্স অনার্স। কোনও একটা কলেজ ফেস্টেই আমার আলাপ তাপসের সঙ্গে, সে-আলাপ বন্ধুত্বে গড়াতে দেরি হয়নি বেশি। ছোটখাটো চেহারার হাসিখুশি ছেলে ছিল তাপস, পড়াশুনোয় তুখোড়। অঙ্কে পরিষ্কার মাথা, ধাঁধা আর রুবিক কিউব সলভ করত প্রায় তুড়ি মেরে। নানা ধরনের তাসের ম্যাজিকও দেখাত চমৎকার।

 সে যা-ই হোক, পরের দিন সকালে তাপস এসে হাজির। মা তো তাপসকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনিও অনেকদিন পর ওকে দেখতে পেয়ে খুব খুশি। একগাদা কুশল মঙ্গল ইত্যাদির পর সে ছোকরা সোফায় একটু থিতু হয়ে বসতেই প্রশ্ন করলাম, “বল ভাই, কী ব্যাপার। কাল তো তোর ফোন শুনে কিছুই বুঝলাম না। শুধু এটুকু বুঝলাম, কী-একটা ব্যাপারে আমার সাহায্য চাই তোর। এবার বল তো, তোর মতো এমন চৌখস ছেলের আবার আমার সাহায্য দরকার পড়ল কেন?”

জবাবে তাপস যেটা বলল সেটা যেমনই অদ্ভুত, তেমনই আশ্চর্যজনক।

তাপসের এক দূরসম্পর্কের জ্যাঠা থাকতেন দার্জিলিংয়ে। রক্তের সম্পর্কের কেউ না, তাপসের বাবার গ্রামতুতো দাদা। কলকাতার কোনও একটা বয়েজ স্কুলের হিস্ট্রির টিচার ছিলেন এককালে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের ওপর অগাধ জ্ঞান। বিদেশের কোনও জার্নালে নাকি পেপার-টেপারও বেরিয়েছিল এক-দু’বার। ভদ্রলোকের তিনকূলে কেউ নেই, বিয়েশাদির ঝামেলায় যাননি, বুড়ি মা-কে নিয়ে কাঁকুড়গাছির কাছে একটা অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকতেন। তাপসের বাবা তাঁর এই আধপাগল গ্রামতুতো দাদাকে একটু শ্রদ্ধাভক্তি করতেন। বাড়িতে প্রায়ই যাওয়া-আসা ছিল। সেই সূত্রে উনি তাপসকে ভাইপো বলতেন, তাপসও চিরকাল ওঁকে নারানজ্যেঠু বলে ডেকে এসেছে।

মা মারা যাওয়ার পর পরই কেমন যেন বিবাগী হয়ে যান মানুষটা, তাপসের ভাষায় ন্যালাখ্যাপা। হুট করে চাকরিটা ছেড়ে দেন, তখনও ওঁর রিটায়ার করতে বছর-দশেক বাকি। এককালের ডাকসাইটে নাস্তিক ভদ্রলোক নাকি তখন প্রায়ই বেনারস, কাঞ্চী, কামাখ্যা, কেদারনাথ এ-সব করে বেড়াতেন। শেষদিকটায় নাকি তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদির দিকেও ঝুঁকেছিলেন। তা-ও আবার দেশি কিছু না, খাস টিবেটান তান্ত্রিক পদ্ধতি! ভদ্রলোক শেষমেশ বছর-সাতেক আগে হঠাৎ করে কলকাতার বাড়িটাড়ি বেচে দিয়ে দার্জিলিংয়ে গিয়ে থিতু হন। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবরা অনেক মানা করেছিলেন বটে, কিন্তু শোনেননি। সেই যে গেলেন, তারপর থেকে নো খবর, নো পাত্তা। মাঝে-মাঝে এই তাপসই দেখতে যেত তার জ্যেঠুকে, ওর সঙ্গেই যা-একটু যোগাযোগ ছিল ভদ্রলোকের। ভদ্রলোক নিজেও দেশের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। ফলে যা হয় আর কী, লোকে মোটামুটি ভুলেই গিয়েছিল নরনারায়ণ ভট্টাচার্যকে।

তাপস বলল গতকাল সকালে নাকি ভদ্রলোক তাপসকে ফোন করেন। এবং ‘হ্যালো’ বলার পরেই নাকি নরনারায়ণবাবু ওকে আর বেশি কিছু বলার সুযোগ দেননি, কোনও ভণিতা না করে বলেন যে উনি একটা বিপদের আঁচ পাচ্ছেন। তাপস পারলে যেন চট করে একবার দার্জিলিংয়ে চলে আসে।

তাপস ভারি আশ্চর্য হয়েছে। কারণ নারানজ্যেঠু এমনিতে যেমন ধীরস্থির, আবার দরকার পড়লে তেমনই ডেয়ারডেভিল গোছের লোক। দুষ্প্রাপ্য পুঁথি আর মূর্তির খোঁজে কাঁহা-কাঁহা-মুল্লুক চলে যেতেন একাই। একবার খিদিরপুর না রাজাবাজার কোথায় যেন গুন্ডারা কোনও একটা দামি মুদ্রার খোঁজে তাঁর ওপর হামলা করে। ব্যাটাচ্ছেলেগুলো বিশেষ সুবিধা তো করতে পারেইনি, উল্টে নারানজ্যেঠুই ইট মেরে দুটোর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। এ-হেন শক্তপোক্ত লোকই ফোন করে বিপদের তার সাহায্য চাইছেন দেখে ভারি অবাক হয়েছে সে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বিপদটা কী-রকম আর কীসের সাহায্য চাইছেন উনি সেটা বলেছেন?”

তাপস জানায় যে পুরোটা খুলে বলেননি না জ্যেঠু। শুধু বোঝা গেছে যে তাঁর ধারণা হয়েছে তাঁর প্রাণ বেজায় বিপন্ন, কেউ বা কারা জ্যেঠুর পেছনে নাকি উঠে-পড়ে লেগেছে। তারা নাকি খুবই সাঙ্ঘাতিক মানুষ, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে দু-চারটে খুন জখম করা ওদের পক্ষে জলভাত। নারানজ্যেঠু এ-ও বলেন যে তিনি মরতে ভয় পান না। কিন্তু দৈবাৎ তাঁর হাতে এমন একটা জিনিস এসেছে যার ঐতিহাসিক মূল্য অসীম, টাকাকড়িতে তার পরিমাপ হওয়া সম্ভব নয়। যারা জ্যেঠুর পেছনে পড়েছে তারা চায় এটা যেন কিছুতেই প্রকাশ না পায়, তাতে ওদের পরিচয় ফাঁস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেটা হারিয়ে গেলে নাকি বাংলা ভাষার ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর সেটা জ্যেঠু কিছুতেই হতে দিতে পারেন না।

শুনে বেশ খানিকটা চুপ করে রইলাম। তারপর প্রশ্ন করলাম, “আর কী বললেন জ্যেঠু?”

তাপস বলল যে অনেক প্রশ্ন করতেও আর কিছুই ভেঙে বলেননি তিনি। শুধু বলেছেন “আমার কাছ থেকে এটা নিয়ে যা তাপস। আমি জায়গা বলে দেব, যে-করে-হোক সেখানে এটা পৌঁছে দিস, ব্যস। তাহলেই তোর ছুটি। তারপর আমি মরি বা বাঁচি, তাতে আমার কিচ্ছু এসে যায় না।” এর বাইরে নারানজ্যেঠু আর একটাও বেশি কথা বলেননি।

শুনে আমি আর তাপস দু’জনেই খানিকক্ষণ চুপটি করে বসে রইলাম। কাজটা যে ঝুঁকির তাতে সন্দেহ নেই। এদিকে কৌতূহলও হচ্ছে বিস্তর। এ-রকম ছোটখাটো দু-একটা অ্যাডভেঞ্চার ততদিনে আমরা করে ফেলেছি অলরেডি।

তবে এ-সব হচ্ছে আজ থেকে বছর কুড়ি-বাইশ আগেকার কথা। গ্র্যাজুয়েশন করে বাড়িতে বসে আছি আর বাপ-মায়ের অন্ন ধ্বংস করছি। তখন আমাদের বয়েস অল্প, বুকে দুর্জয় সাহস। তার ওপর নিয়মিত জিম করতাম, মার্শাল আর্টও শেখা ছিল অল্প-স্বল্প। মুশকিল হচ্ছে মা-কে নিয়ে, এ-সব ঝামেলার কথা খুলে বললে আমাকে তো যেতে দেবেনই না, তার ওপর তাপসের যাওয়াটাও পাক্কা ভন্ডুল করে দেবেন।

ফলে স্থির হল দু’জনের কারও বাড়িতে কিচ্ছুটি খুলে বলা চলবে না। নারানজ্যেঠু বহুদিন বাদে তাপসকে দেখতে চেয়েছেন, এই বলে চুপচাপ কেটে পড়তে হবে। আমিও যে যাচ্ছি সে-কথাটাও জানিয়ে দেওয়া হবে জ্যেঠুকে।

সেই প্ল্যানমাফিক দু’জনের বাড়িতেই আর্জি পেশ করা হল। আবেদন মঞ্জুরও হয়ে গেল ঝটপট। তাপসের বাবা তো বলেই দিলেন, আমরা যেন জ্যেঠুকে আরেকবার বুঝিয়ে-সুজিয়ে দার্জিলিংয়ের পাট গুটিয়ে কলকাতায় চলে আসার কথাটা বলি, “একলা মানুষ। কবে কোথায় মরে-টরে পড়ে থাকবে সে-খবরও পাব না। এখানে থাকলে অন্তত দেখাশোনাটা হবে।”

তখনকার দিনে টিকিট বুকিং করায় বিস্তর হ্যাপা ছিল। তখন পুজোর ছুটি পড়েছে, উত্তরবঙ্গের যে-কোনও ট্রেনে জায়গা পাওয়া আর ভগবানের দেখা পাওয়া একই ব্যাপার। বাঁচোয়া এই যে তাপসের কোন এক কাকা রেলওয়েতে কাজ করতেন, শেষমেশ তাঁকেই অনেক ধরে-কয়ে কোনওমতে দার্জিলিং মেলের স্লিপার ক্লাসের দুটো টিকিট ম্যানেজ করা হল। আমরাও দু’জনে দুগ্গা-দুগ্গা বলে রওনা দিলাম।  

.

যেদিন রওনা দিলাম সেটা ছিল বুধবার। নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছোলাম বিষ্যুদবারদিন সকালে। পাহাড়ে যেতে গেলে অনেকে স্টেশন থেকেই গাড়ি নিয়ে নেন। আমরা কিন্তু ওদিকে গেলাম না, ধীরেসুস্থে স্টেশনের কাছে একটা ছোট হোটেলে উঠলাম প্রথমে। একটা কারণ যদি হয় যে তখন অলরেডি পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে, তো আরেকটা হল যে আমাদের কেনাকাটিও বাকি ছিল কিছু। হোটেলে ধীরে-সুস্থে স্নান খাওয়া সেরে নিলাম। তারপর সবকিছু মিটিয়ে-টিটিয়ে যখন জগবাহাদুরের চেনা জিপে চড়ে দার্জিলিংয়ের দিকে রওনা দিলাম তখন বাজে ঠিক দুপুর দুটো।

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যেতে হলে কার্শিয়াং হয়ে পাংখাবাড়ির রুটটাই বেটার, এতে টাইম কম লাগে, তার ওপর সিনিক বিউটিও দুর্দান্ত। কিন্তু জগবাহাদুর বলল ওদিকে কী-একটা গড়বড় হয়েছে, রোহিনী টি-গার্ডেন থেকে মস্ত জ্যাম। অগত্যা সেবক হয়ে যাওয়াটাই ঠিক হল। আর সেইখান থেকেই বুঝতে পারলাম কিছু একটা গন্ডগোল আছে।

আমাদের জিপটা সবে করোনেশন ব্রিজ ডাইনে ফেলে কালীঝোরার দিকে একটু এগিয়েছে, এমন সময় একটা হেয়ার-পিন বেন্ড ঘুরেই দেখি রাস্তার ওপর এক ভদ্রলোক অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে, পায়ের কাছে রাখা মস্ত রুকস্যাক, আর আমাদের দিকে দু’হাত তুলে নাড়াচ্ছেন। ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট, ভদ্রলোক বিপদে পড়েছেন, আর আমাদের সাহায্য চান।

পাহাড়ের অলিখিত আইন হচ্ছে রাস্তায় বিপন্ন মানুষ দেখলেই হেল্প করা। জগবাহাদুরও তাই ভদ্রলোক যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তার সামনে গাড়িটাকে আস্তে করে সাইড করে রাখল।

আমরা নামতেই ভদ্রলোক দৌড়ে এলেন প্রায়। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে-মুছতে বললেন, “সো কাইন্ড অফ ইউ। এই দেখুন না, শিলিগুড়ি স্টেশন থেকে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি দার্জিলিং, মাঝখানে গাড়ি খারাপ হয়ে কী গেরো! সে তো কোনওরকমে সেবকে নেমে গেছে গাড়ি সারাই করাতে, আসার আর নামই নেই। সেই থেকে ঘণ্টা-দুয়েক ধরে…”

এত বলার দরকার ছিল না। তাপসই মিষ্টি হেসে বলল, “আরে ঠিক আছে, উঠে আসুন। ড্রাইভারের পাশের সিট ফাঁকাই আছে।” উনিও অমনি দিব্যি থ্যাঙ্কিউ-ট্যাঙ্কিউ বলে গাড়িতে উঠে পড়লেন। তারপর একগাল হেসে বললেন, “অনেক ধন্যবাদ ভাই। খুব উপকার করলেন। আপনারা না এলে যে কী আতান্তরেই পড়তুম। আজকাল আর এমন পরোপাকারী লোকজনের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম দেবাশিস বণিক, বাড়ি ভবানীপুরে।”

আমরাও আমাদের পরিচয়-টরিচয় দিলাম। কথায়-কথায় জানা গেল দেবাশিসবাবু ধর্মতলায় একটা কিউরিওশপ চালান, বাড়িতে বউ আছে, আর আছে একটি ছোট মেয়ে, বয়েস পাঁচ। মাঝে-সাঝেই এদিকে আসতে হয়, “চেনা গাড়ি ভাই, বরাবর ঠিকঠাক পৌঁছে দিয়েছে। এবারেই যে কী হল।” আক্ষেপ করছিলেন ভদ্রলোক।

গাড়িটা মংপো-র কাছাকাছি একটা চায়ের দোকানে গিয়ে থামতে সবাই নেমে একবার হাত-পা ছাড়িয়ে নিলাম। তাপস বলল এই রাস্তা দিয়ে গেলে নাকি এই দোকানে ম্যাগি আর চা খাওয়াটা মাস্ট। দাম অবশ্য দেবাশিসবাবুই দিলেন, আমরা পয়সা বের করতেই হাঁ-হাঁ করে উঠলেন ভদ্রলোক, “তোমরা আমার যে-উপকার করলে ভাই তার তুলনা নেই, অন্তত চা আর ম্যাগিটা খাওয়াতে দাও।”

দার্জিলিং পৌঁছোতে-পৌঁছোতে প্রায় সাতটা বাজল। পাহাড়ি এলাকায় তাড়াতাড়ি দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। দেবাশিসবাবুকে নামিয়ে দিলাম ম্যাল-এর সামনেটায়। উনি ফের একপ্রস্থ ধন্যবাদ-টন্যবাদ দিয়ে নেমে গেলেন, “হোটেল হিমালয়ান রিট্রিটে উঠেছি ভায়া। দিন চারেক আছি। এদিকে এলে একবার দর্শন দিয়ো।” বলে রুকস্যাকটা পিঠে ঝুলিয়ে ম্যালের দিকে উঠে গেলেন ভদ্রলোক।

একবার তাপসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর কপালে গভীর ভ্রূকুটি, কী যেন একটা ভাবছে মন দিয়ে। একবার ঠেলা দিলাম ওকে, “কী রে, কী ভাবছিস?” আমার দিকে একবার অন্যমনস্কভাবে তাকিয়েই ঝাড়া দিয়ে উঠল ও, “না কিছু না, চ’ চ’ লেট হয়ে যাচ্ছে।”  

.

*

“এইবার বলুন তো জ্যেঠু, কেসটা কী। সেদিন ফোনে কী যে বললেন তার কিছুই বুঝলাম না।”

কথাটা হচ্ছিল পরেরদিন সকালে। আমরা চারজন, অর্থাৎ আমি, তাপস, ইন্সপেক্টর গুরুং আর নারানজ্যেঠু চা খেতে বসেছি জ্যেঠুর বাংলোর দোতলায়। দোতলার আর্ধেকটা খোলা ছাদ, বাকি আর্ধেকটায় জ্যেঠুর স্টাডি কাম লাইব্রেরি। আমরা সকালেই একপ্রস্থ ঘুরে এসেছি লাইব্রেরি থেকে। কম-সে-কম হাজার দশেক বইয়ের সম্ভার, তার বেশিরভাগই বই-ই আবার বাংলা ভাষার আর সাহিত্যের ইতিহাসের ওপর। মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস নিয়েও বেশ কিছু বই দেখলাম। বৌদ্ধধর্মের ওপর বই তো অগুনতি!

আমরা বসেছি চা গাছের গুঁড়ি কেটে তৈরি একটা চমৎকার টি-টেবিল ঘিরে। আশ্বিনের সকাল, হাওয়ায় শীতের কামড় যথেষ্টই। আমার আর তাপসের গায়ে মোটা গরম-পোশাক। আমাদের চারজনের সামনেই ধোঁয়া-ওঠা চায়ের কাপ, তার গন্ধেই মাত হয়ে যেতে হয়, স্বাদের তো কথাই নেই। পরে জেনেছিলাম ওটা নাকি গোপালধারা টি-এস্টেটের চা।

জ্যেঠুর বাংলোটা ঠিক দার্জিলিংয়ে নয়, একটু দূরে, লেবং-এ। তবে দার্জিলিং থেকে দূরে হলে কী হবে, জায়গাটা যে জ্যেঠু জব্বর বেছেছেন তা মানতেই হবে। সামনের দিকে সোজা তাকালে পাহাড়ের শ্রেণী। কলকাতায় এখন বৃষ্টি হলেও এদিকে দিব্যি ঝকঝকে আকাশ। চুড়োগুলো একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পরে ওদের নামও জেনেছিলাম জ্যেঠুর কাছে, জানু, কাবরু, পান্ডিম, আর অফ কোর্স, দ্য গ্রেট কাঞ্চনজঙ্ঘা।

একটু নীচের দিকে তাকালে আবার লেবং রেসকোর্স -গোটা নর্থ বেঙ্গলে একমাত্র ঘোড়দৌড়ের জায়গা। জ্যেঠুর বাংলোর পাশ থেকে পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে নীচের দিকে,তার গা বেয়ে ঘন জঙ্গল, আর উঁচু-উঁচু গাছের বাহার। ঢালের গায়ে ছোট-ছোট চা বাগান, বাগানের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা, রুপোলি ফিতের মতো এঁকে-বেঁকে চলে গেছে সমতলের দিকে। ছাদের পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়ালে নীচের দিকে আরও একটা গ্রাম চোখে পড়ে, জ্যেঠু বললেন ওটার নাম হরসিং হাট্টা।

জ্যেঠুর সঙ্গে আলাপটা অবশ্য আজ সকালেই হল। কারণ কাল রাতে যখন বাংলোয় পৌঁছোই, তখন বাজে প্রায় আটটা। যে ছেলেটা দরজা খুলে দিল তার নাম লোবসাম। জ্যেঠু তখন জেগে ছিলেন না, ডাক্তারের নির্দেশে ওঁকে সাতটার মধ্যেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে হয়। লোবসামই আমাদের ঘর-টর দেখিয়ে ডিনারের ব্যবস্থা করে দেয়।

জ্যেঠু মাথা নিচু করে চায়ের কাপে চামচ নাড়াচাড়া করছিলেন। ভদ্রলোকের বয়েস প্রায় ষাটের কাছাকাছি। মাঝারি হাইট, হলদেটে ফর্সা রঙ আর একমাথা কাঁচাপাকা চুল, যাকে ইংরেজিতে বলে সল্ট অ্যান্ড পেপার। জ্যেঠুর পাশের চেয়ারে বসেছিলেন ইন্সপেক্টর গুরুং। ইনি হলেন গিয়ে দার্জিলিং থানার অফিসার-ইন-চার্জ, অর্থাৎ দারোগাবাবু। অবশ্য দারোগাবাবু বলতেই যে পেটমোটা গুঁফো চেহারা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার সঙ্গে এঁর কোনও সম্পর্ক নেই। যেমন চমৎকার পেটাই চেহারা, তেমনই সুন্দর দেখতে ভদ্রলোককে। তার ওপর এঁর পড়াশোনাটাও আবার কলকাতাতেই, তাই বাংলাটাও মাতৃভাষার মতই ঝরঝরে বলেন তিনি। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে বললেন মিস্টার গুরুং, “হ্যাঁ মাস্টারসা’ব, আপনি ব্যাপারটা এবার খুলে বলুন তো। এত জরুরি এত্তেলা কীসের?”

জবাবে জ্যেঠু কিছু বললেন না, শুধু পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করে, ভাঁজ খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। আমরা তিনজনে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।

একটা হলদে রঙের তুলোট কাগজ। দেখলেই বোঝা যায় যে তার বয়েস হয়েছে। তুলোট কাগজ সেকালেও খুব একটা চট করে পাওয়া যেত না, এখন তো বোধহয় আরও দুষ্প্রাপ্য। তার চারটে কোনায় চারটে অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা, আর মাঝখানে লাল রঙের কালিতে লেখা চার লাইনের একটা কবিতা। মুশকিল হচ্ছে যে, কবিতাটা বাংলা অক্ষরে লেখা বটে, কিন্তু ভাষাটা এক্কেবারে অচেনা, পড়ে কিছুই বুঝলাম না। লেখাটা এরকম,  

মোহেরা মাআজলঅ বান্ধএ পয়গম।
চৌদীস চ্ছড্ডু থাবর জঁগম।
ণাএ যো ভতারি ন সো সুবনকেড়ুয়াল।
অবেজ্জসূ কুম্ভীরে লুড়িউ আলাজাল।
দুহিলা দুধলপ্রভা সামায় উজুবাটে,
অটমহাসিদ্ধ মআকাল কাটে।

তিনজনেই হতবুদ্ধি হয়ে জ্যেঠুর দিকে তাকালাম। প্রথম প্রশ্নটা তাপসই করল, “এ আবার কোন ভাষা? মানে লিপিটা তো বাংলাই মনে হচ্ছে। কিন্তু এর তো মানেই বুঝতে পারছি না।”

ইন্সপেক্টর গুরুং খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন কাগজটার দিকে, কাগজটা হাতে তুলে নাকের কাছে নিয়ে এসে কী-একটা শুঁকলেন। তারপর ওটা নামিয়ে রেখে ভুরুটুরু কুঁচকে বললেন, “এটা কোথায় পেলেন আপনি?”

“গত শনিবার মর্নিং ওয়াকের জন্য দরজা খুলে বেরোতে যাব, দেখি লেটারবক্সে একটা বড় সাদা খাম। খামের ওপর কোনও নাম ঠিকানা কিচ্ছু নেই। ডাকঘরের সিল থাকার প্রশ্নই ওঠে না। খাম ছিঁড়ে দেখি এই চিঠি।”

“কিন্তু জ্যেঠু, চিঠিটার তো কোনও মানেই বুঝতে পারছি না। কী ভাষা এটা?” প্রশ্ন করলাম আমি।

“বাংলা।” জ্যেঠুর উত্তর।

“অসম্ভব। এটা বাংলা হতেই পারে না।” চ্যালেঞ্জ করার ভঙ্গিতে বলল তাপস।

জ্যেঠু কিছু বলার আগেই প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর গুরুং, “কিন্তু মাস্টারসা’ব, একটা কথা বলুন, আপনি বলছেন এ-সব নাকি থ্রেটনিং লেটার। কিন্তু আপনাকে অদ্ভুত ল্যাঙ্গুয়েজে থ্রেট দিয়ে এ-সব চিঠি-ফিঠি কে পাঠাবে? না আপনি কোনও বড় বিজনেসম্যান, না আপনি কোনও খাজানার মালিক হয়ে বসেছেন। তাহলে আপনাকে থ্রেট দিয়ে লাভ? এ-সব কোনও লোক্যাল ছেলে-ছোকরার কীর্তিকলাপ নয় তো?”

“না হে গুরুং, এ কোনও লোক্যাল ফচকে ছোঁড়ার কীর্তি নয়।” গম্ভীরমুখে বললেন জ্যেঠু, “তার কারণ দুটো। এক, এখানকার ছেলেমেয়েরা আমাকে কতটা ভালোবাসে সে তুমিও ভালো করেই জানো। আর দ্বিতীয় কারণটাই মোক্ষম। আজকের যুগে এই ভাষায় অরিজিনাল দুটো লাইন লেখার ক্ষমতা খুব কম লোকেরই আছে।”

ইন্সপেক্টর সাহেবের মুখ দেখে মনে হল কথাটা ঠিক ওঁর মনঃপূত হল না। চিঠিটা ফেরত দিয়ে চায়ের কাপটা এক চুমুকে শেষ করে বললেন, “দেখুন মাস্টারসা’ব, আমার মতে সে-রকম চিন্তার কিছু নেই। মনে হচ্ছে কোনও কারণে কেউ একজন প্র্যাংক করেছে আপনার সঙ্গে। তবুও সাবধানের মার নেই, আমি বরং একটা কনস্টেবলকে বলছি আপনার বাড়ি দু’বেলা খোঁজ নিয়ে যাবে। আমার মত হচ্ছে কয়েকটা দিন সাবধানে থাকুন। থানা আর আমার বাড়ি, দুটো ফোন নাম্বারই আপনার কাছে আছে। উল্টোপাল্টা কিছু ঘটতে দেখলে আমাকে ফোন করবেন, কেমন?” বলে কাপটা নামিয়ে রেখে উঠে চলে গেলেন ভদ্রলোক। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় জুতোর ‘ঠক ঠক’ আওয়াজ উঠে এল।

তাপস এতক্ষণ কাগজের টুকরোটাকে খুব মন দিয়ে দেখছিল। বলা ভালো চার কোণে আঁকা চারটে অদ্ভুত চিহ্নকে। এবার সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করল জ্যেঠুকে, “এবার বলো তো জ্যেঠু এটা কোন ভাষা? আর লেখাটার মানেটাই বা কী?”

“বললাম তো, বাংলা ভাষা। আর ওখানে যা লেখা আছে তার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে, মোহের মায়াজালে বদ্ধ পতঙ্গকে একদিন তার সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ছেড়ে যেতে হয়। নৌকায় যার অধিকার নেই, তার হাতে এসেছে সোনার দাঁড়, তাই অবিদ্যারূপী কুমির এসেছে সব তছনছ করে লুটে নিতে। বরং দুইয়ে নেওয়া দুধও উলটো পথে বইতে পারে, কিন্তু মহাকালরূপী অষ্টমহাসিদ্ধ-র হাত থেকে তার রক্ষা নেই।”

আমি আর তাপস অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে রইলাম জ্যেঠুর দিকে। জ্যেঠু বোধহয় আমাদের মনের কথাটা বুঝতে পারলেন। তারপর বললেন, “বুঝতে পারলি না, তাই তো? উচ্চমাধ্যমিকের বাংলার সেকেন্ড পেপারটা যে দু’জনের কেউ-ই মন দিয়ে পড়িসনি সেটা বুঝতে পারছি। বলি চর্যাপদ বলে কোনও বই বা পুঁথির নাম মনে পড়ছে?”

শুনে প্রমাদ গণলাম। এইচ এস-এ বাংলার সেকেন্ড পেপারে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ছিল বটে, অসিতকুমার বাঁড়ুজ্জে মশাইয়ের একটা গাবদা বইয়ের কথাও আবছাভাবে মনে পড়ল। সেখানেই চর্যাপদ বলে কিছু একটার কথা পড়েছিলাম বোধহয়। কিন্তু সে-বেড়া বহু কষ্টে টপকেছি, এখন কি আর সে-সব কিছু মনে থাকে?

জ্যেঠু আমার মুখ দেখে চুক-চুক আওয়াজ করে বললেন, “বাঙালি হয়েও যে আমরা বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানি না, এটা আমাদের পক্ষে খুবই লজ্জার বিষয়। সে যা হোক, ছোট করেই বলি, চর্যাপদ হচ্ছে একটা পুঁথির নাম। বাংলা ভাষাতেই লেখা বটে, কিন্তু এ হচ্ছে বাংলার আদিতম রূপ। এখন আমরা বাংলা ভাষা যে-ভাবে দেখি, বা বলি, বা লিখি, তার সঙ্গে এর সম্পর্ক সামান্যই।”

“ইয়েস, চর্যাপদ। বাংলা ভাষায় ছাপা প্রথম বই।” প্রায় লাফিয়ে উঠল তাপস, “মনে পড়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল বা ভুটানের রাজার গোয়ালঘর থেকে এ-বই উদ্ধার করেছিলেন। এইবার মনে পড়েছে।”

“প্রথম ছাপা বই না, বাংলা ভাষার ওল্ডেস্ট যে ফর্ম, সেই ফর্মে লেখা বই।” কেটে-কেটে বললেন নারাণজ্যেঠু, “আর গোয়ালঘরে না, খুঁজে পাওয়া গেছিল নেপালের রাজপরিবারের লাইব্রেরিতে। যিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর নামটা অবশ্য ঠিকই বলেছিস, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তাঁর দৌলতেই আমরা বাংলার আদিযুগের অনেক কথা জানতে পেরেছি। নমস্য পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন হরপ্রসাদ। শুধু বাংলার ইতিহাস না, পুরো বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসের ওপরেই একজন অথরিটি।”

আলোচনাটা ক্রমেই অন্যদিকে চলে যাচ্ছে দেখে আমিই বাধ্য হয়ে রাশ টেনে ধরলাম, “কিন্তু আসল কথাটা যে চাপা পড়ে গেল জ্যেঠু! লেখাটার মাথামুন্ডু যে কিছুই বুঝলাম না। আর তাতে করে আপনাকে কী করে ধমকি দেওয়া হচ্ছে সেটাও তো বুঝলাম না।”

“বুঝলি না, তাই তো? আসলে ওটার আক্ষরিক অর্থ আর প্রকৃত অর্থের মধ্যে একটা তফাৎ আছে। পড়ে যা বুঝছিস, তার একটা মানে তো আছেই, সে যতই দুর্বোধ্য হোক না কেন। তবে আসল মানেটা পাবি ওই প্রকৃত অর্থের মধ্যেই। সেটা বোঝা অবশ্য একটু ডিফিকাল্ট।”

“কেন জ্যেঠু?” প্রশ্ন করলাম আমি। ব্যাপারটা বেশ জটিল লাগছিল আমার কাছে।

“কারণ ওটাই চর্যাপদের বৈশিষ্ট্য।” ক্লাস নেওয়ার ঢংয়ে বলতে শুরু করলেন জ্যেঠু, “চর্যাপদ যাঁরা লিখেছিলেন তাঁরা বৌদ্ধধর্মের একটা আলাদা শাখার সাধক ছিলেন, যাকে বলে সহজিয়া বৌদ্ধধর্ম। তোরা নিশ্চয়ই জানিস যে, বুদ্ধদেব মারা যাওয়ার কয়েকশো বছরের মধ্যেই বৌদ্ধধর্ম হীনযান আর মহাযান, এই দুইভাগে ভেঙে গেছিল। মহাযান বৌদ্ধধর্মের শেষ দিকে একটা শাখা জন্মায়, নাম বজ্রযান। যান শব্দটার অর্থ পথ, বা রাস্তা। আজকে আমরা তান্ত্রিক বুদ্ধিজম বলতে আমরা যা-যা বুঝি, তার সবই এই বজ্রযানী বৌদ্ধদের কল্যাণে প্রাপ্ত।”

একনাগাড়ে এতটা বলে জ্যেঠু একটু থামতেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল তাপস, “হ্যাঁ-হ্যাঁ- ওই তারা, বজ্রযোগিনী, যমন্তক…”

“যমন্তক না, যমান্তক।” একটু কড়া গলায় বললেন জ্যেঠু, “যমের অন্ত করেন যিনি, তিনি যমান্তক। আর হ্যাঁ, এ-সবই বজ্রযানী বৌদ্ধদের দেবদেবী। এই বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম থেকে আসে সহজিয়া বৌদ্ধমত। আর সেটার জন্ম এই বাংলাদেশেই।”

“কিন্তু তার সঙ্গে এই চিঠির কী সম্পর্ক?” প্রশ্নটা আমিই করলাম, “আর ওই গোলমেলে আসল মানে, আক্ষরিক মানে, এ-সব আবার কী?”

“এ-সব যাঁরা লিখেছিলেন তাঁরা বৌদ্ধ সহজিয়া মতে সাধনা-টাধনা করতেন। তাঁরা চাইতেন যে, যাঁরা এই সাধনবিদ্যার অধিকারী, একমাত্র তাঁরাই যেন এ-সব জটিল পদের মানে বোঝেন। তাই তাঁরা এ-রকম হেঁয়ালিভরা ভাষায়, মানে এই একই বাক্যের দু’ধরনের মানে আছে এমন ভাষায় দোঁহা লিখে গেছেন। মানে পদকর্তা বলেই দিচ্ছেন যে যদি তুমি এ-পথের পথিক না হও, তাহলে তফাৎ যাও, এ-রাস্তা তোমার নয়।”

তাপস প্রশ্ন করল, “তার মানে এই যে চিঠিটা আপনাকে লেখা হয়েছে, তার ওই পতঙ্গ, কুমির, উজুবাট না কী-সব যেন বললেন, তার একটা অন্য মানেও আছে?”

“আছেই তো।”

“কী সেটা?”

“এখানে বলা হচ্ছে আমি লোভে পড়ে এমন একটা জিনিস দখল করেছি যার ওপর আমার কোনও অধিকার নেই। সেটাকে সুবনকেড়ুয়াল, অর্থাৎ সোনার দাঁড়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাই অবিদ্যারূপী কুমির অর্থাৎ কোনও খতরনাক ক্রিমিনাল লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ওপর আক্রমণ করার প্রতীক্ষায় আছে। এর কোনও প্রতিকার নেই। কারণ দুইয়ে নেওয়া দুধের উল্টোপথে বয়ে যাওয়া যেমন অসম্ভব, অষ্টমহাসিদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পাওয়াও তেমনই অসম্ভব ।”

শুনে দু’জনেরই ভারি আশ্চর্য লাগল। আমি কী-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই লোবসাম এসে বলল, “দত্তশাব আয়ে হ্যাঁয়।” শুনে নারানজ্যেঠু শশব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন।  

.

*

“আমি তো তোমাকে সেদিনই বলেছিলাম নারান, এ-জিনিস হাতের কাছে রেখো না। তোমার উচিত ছিল এটা হাতে পাওয়ামাত্র ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি বা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ অথবা এশিয়াটিক সোসাইটির মতো কোনও সংস্থার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা। তাহলে এত হ্যাঙ্গাম হতই না। তুমি তো আবার আমার কথা কানে তোলার প্রয়োজনই বোধ করো না।” দত্তবাবুর গলার স্বরে গমগম করছিল জায়গাটা।

আমরা হাঁ-করে চেয়ে ছিলাম ভদ্রলোকের দিকে। ষাট-পঁয়ষট্টি বছর বয়সে অমন সুপুরুষ আজকাল চট করে দেখাই যায় না। প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি হাইট, শরীরে সামান্য মেদ। কাশীর পেয়ারার মতো গায়ের রঙ, চোখা নাক আর গমগমে গলার আওয়াজে লোকটার ব্যক্তিত্ব জিনিসটা যেন আরও খোলতাই হয়েছে। তাছাড়া ভদ্রলোকের যে পয়সা আছে সেটা গায়ে চড়ানো বিদেশি পুলোভারেই মালুম দিচ্ছে।

দত্তবাবুর পরিচয়টা অবশ্য নারানজ্যেঠু বিশদেই দিয়েছিলেন আমাদের। উনি একজন রিটায়ার্ড সরকারি আমলা। কুচবিহারের লোক, বাবা ছিলেন রাজপরিবারের ম্যানেজার। দাপটে কাজ করেছেন সারা জীবন, “কোনওদিন অন্যায়ের সামনে মাথা নোয়াইনি হে। মাথা উঁচু করে কাজে ঢুকেছিলাম, মাথা উঁচু করে বেরিয়েছি।” গর্ব করে বলছিলেন ভদ্রলোক। এখন রিটায়ার্ড লাইফ কাটাচ্ছেন বাংলার ইতিহাস নিয়ে চর্চা করে। মাস-তিনেক হল এখানে এসেছেন, ভাবছেন এখানেই একটা বাড়ি কিনে থিতু হবেন। এর মধ্যেই জ্যেঠুর সঙ্গে হেব্বি দোস্তি হয়ে গেছে ভদ্রলোকের।

নারানজ্যেঠু অল্প হেসে বললেন, “আপনি তো জানেন দত্তদা, এই বিষয়টা আমার কাছে কতটা মূল্যবান। এমন একটা জিনিস হাতে এল, নিজে একটু নেড়ে-ঘেঁটে দেখব না?”

“দ্যাখো নারান, এ-সব ছেলে-ভুলোনো কথা আমাকে বোঝাতে আসবে না।” উত্তেজিত হয়ে পড়লেন দত্তসাহেব, “বরং স্বীকার করো যে এটা নিয়ে একটা পেপার-টেপার লিখে ঐতিহাসিক মহলে একটা হইচই লাগিয়ে দেবে, লোকে তোমাকে দ্বিতীয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলে ডাকবে, সেইটেই তোমার মনের ইচ্ছে। খ্যাতি, স্রেফ খ্যাতির লোভেই এতবড় রিস্কটা নিচ্ছ তুমি।”

হালকা হাসলেন জ্যেঠু, “এই শেষ বয়সে এসে যদি একটু খ্যাতির লোভ হয়েই থাকে, তাহলে সেটা কি খুব অন্যায় হবে দাদা? আপনি তো জানেন যে এই কাজেই আমি আমার সারাটা জীবন ব্যয় করেছি। এখন যদি বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের ইতিহাসে হই-হই ফেলে দেওয়ার মতো কিছু পেয়েই থাকি, তার দৌলতে কিছু খ্যাতি তো আমারও প্রাপ্য হয় দত্তদা।”

“তা সে-বস্তুটি এখনও বাড়িতেই আছে না অন্য কোথাও রেখেছ?”

কাষ্ঠহাসি হাসলেন নারানজ্যেঠু “প্রত্যেকবার এইটে জিজ্ঞেস করে কেন আমাকে বিড়ম্বনায় ফেলেন দাদা? আপনি তো জানেন পুঁথিটা কোথায় রেখেছি সেটা আমি আপনাকে কেন, কাউকেই বলব না। আপনি কী ভাবছেন, যারা আমার ওপর নজর রাখছে তারা কি আর আপনার ওপরেও স্পাই লাগায়নি? কাল যদি তারা পুঁথিটার খোঁজে আপনাকে পাকড়াও করে? না দাদা, আপনি বুড়ো মানুষ, এ-সব খবর জানিয়ে আপনাকে বিপদে ফেলার কোনও বাসনাই আমার নেই। তাছাড়া ওটা আমার লাইফ ইনশিওরেন্সও বটে। যতক্ষণ আমার কাছে গচ্ছিত আছে, ততক্ষণ আমি নিরাপদ। ওরা আমার কোনও অনিষ্ট করার আগে দশবার ভাববে। কিন্তু কোথায় আছে সেটা জানিয়ে আমি আর আপনাকে বিপদে ফেলতে পারলাম না, সরি।”

দত্তসাহেব গলার মধ্যে একটা ‘ঘোঁত’ শব্দ করে অপ্রসন্ন মুখে চুপ করলেন।

এইখানে আমি প্রশ্ন করলাম, “সকাল থেকে তো অনেক কিছুই শুনলাম জ্যেঠু। কিন্তু জিনিসটা যে কী সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”

নারানজ্যেঠু তাকালেন আমাদের দিকে, তারপর সামান্য চাপা গলায় বললেন, “পুঁথি, একটা প্রাচীন পুঁথি। নাম চক্রসম্বরধ্যানমালা।”

“কী? কোন ফুলের মালা?” আমরা দু’জনেই চমকে উঠলাম নামটা শুনে। প্রশ্নটা অবশ্য তাপসেরই।

“চক্র-সম্বর-ধ্যান-মালা।” কেটে কেটে উচ্চারণ করলেন নারানজ্যেঠু, কঠিনস্বরে বললেন “ফুলের মালা নয় তপু।”

“বাপ রে, কী-সব নাম। কীসের পুঁথি এটা, যার জন্য আপনাকে খুনের হুমকি পেতে হচ্ছে?”

এবার উত্তরটা দিলেন দত্তসাহেব, “তার কারণ অনেক জটিল হে। এই পুঁথি মহামূল্যবান, টাকায় এর ভ্যালু পরিমাপ করা যাবে না। যে কোনও ইতিহাসবিদ এর খোঁজ পেলে স্রেফ আনন্দেই পাগল হয়ে যাবে। আর ইতিহাস বলতে শুধু বাংলা ভাষার ইতিহাস না, বৌদ্ধধর্মের যে বজ্রযান নামের একটা তান্ত্রিক শাখা আছে সেটা জানো তো? তার ইতিহাসেও এই পুঁথির গুরুত্ব অনেক।”

“কিন্তু এই চক্রসম্বর না কী একটা বললেন, সেটা কী বস্তু? মানে পুঁথিটায় কী লেখা আছে? গুপ্তধনের হদিশ?”

“না রে…” দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন নারানজ্যেঠু, “গুপ্তলিপি বা গুপ্তধন নয়। এখানে চক্রসম্বর নামের এক বৌদ্ধ দেবতার পুজো-ধ্যান এ-সবের পদ্ধতি লেখা আছে। এই চক্রসম্বর হলেন বৌদ্ধদের একজন অতি ভয়ঙ্কর দেবতা। এঁর মূর্তি এতই ভয়াবহ যে রাত-বিরেতে দেখলে ঘাবড়ে যাবি তোরা।”

“সে না-হয় বুঝলাম, কিন্তু পুঁথিটা এত দামি কেন? মানে এ-রকম পুঁথি-টুঁথি তো আর দুনিয়াতে কম কিছু নেই। এটা এমন কী স্পেশাল যে লোকজন এর পেছনে একেবারে উঠে-পড়ে লেগেছে?”

 গম্ভীরমুখে মাথা নাড়লেন নারানজ্যেঠু, “এ-রকম পুঁথি যে দুনিয়ায় কম নেই সে কথাটা সত্যি। তবে তার মধ্যেই যে বেশ কিছু পুঁথি একেবারে তোলপাড় ফেলে দেওয়ার মতো সে-ও তো তোরা জানিস। ডেড সি স্ক্রোলের নাম শুনেছিস তো? ধরে নে এটাও সে-রকমই একটা পুঁথি।”

“কেন?” প্রশ্ন করলাম আমি।

“তার কারণ এই পুঁথিটার এমন দুটো বৈশিষ্ট্য আছে যা এই পুঁথিটাকে অমূল্য করে তুলেছে।”

“কী-রকম?” আমরা দু’জনেই বেশ ঘনিয়ে এলাম।

“প্রথম হচ্ছে এর লিপি। জানি না তোরা জানিস কি না, বৌদ্ধ দেবদেবীদের পুজো-আচ্চা করার নিয়মাবলী নিয়ে যে-সব পুঁথি আজ অবধি পাওয়া গেছে তার সবক’টাই সংস্কৃতে লেখা। কিন্তু এই পুঁথিটা লেখা একটা সম্পূর্ণ অন্য ভাষায়। কী সেই ভাষা সেটা বল দেখি?” প্রশ্ন করলেন নারানজ্যেঠু।

“চর্যাপদের বাংলা?” জিগ্যেস করল তাপস।

উত্তর শুনে তাপসের দিকে বেশ প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালেন দত্তসাহেব, “বাহ, তোমার ভাইপোটি তো বেশ ইনটেলিজেন্ট দেখছি নারান।”

চর্যাপদের ব্যাপারটা যে একটু আগেই জেনেছি সেটা বেমালুম চেপে গেলাম দু’জনেই।

“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। চর্যাপদের পুরোটাই সহজিয়া বৌদ্ধদের গান দোঁহা এ-সব নিয়ে লেখা। এদিকে আবার তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের কোনও ধারণী বা সূত্র চর্যাপদের ভাষায় লেখা হয়েছে বলে জানা নেই। তাই সেদিক দিয়ে তো এই পুঁথিটা অমূল্য তো বটেই। তবে দ্বিতীয় কারণটাই মোক্ষম। সেটাই এই পুঁথিটাকে অসাধারণ আর অমূল্য করে তুলেছে।”

এবার আর আমাদের কাউকে কিছু বলতে হল না। আমরা বড়-বড় চোখ করে কথাগুলো গিলছিলাম শুধু।

“সেটা বলার আগে একবার জেনে নেওয়া দরকার, বাংলা ভাষার ইতিহাসের ব্যাপারে তোমাদের কী-রকম-কী আইডিয়া?”

বলা বাহুল্য দু’জনেই জানালাম যে আমাদের এই বিষয়ে বিশেষ কেন, কোনও আইডিয়াই নেই। দত্তসাহেব বোধহয় মনে-মনে সন্তুষ্ট হলেন। তিনি নারানজ্যেঠুকে বললেন, “একটা চা দিতে বলো না তোমার ওই কাজের লোকটাকে, তেনজিং না কে যেন?”

“আপনার স্মৃতিশক্তিরও বলিহারি যাই দাদা। বলি তেনজিং কয়েকদিনের জন্য দেশে যাচ্ছে শুনে এই লোবসামকে যে আপনিই জুটিয়ে দিলেন, সেটা কি একবারেই ভুলে মেরে দিয়েছেন?” উঠে যেতে-যেতে বললেন নারানজ্যেঠু, “বাংলা আর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ছাড়া কি আর কিছুই মনে থাকে না আপনার?”

কথাটা শুনে দত্তসাহেব যে একটু অপ্রস্তুত হলেন সে বলাই বাহুল্য। তবে সে মুহূর্তের জন্য, নারানজ্যেঠু ভেতরে চলে যেতেই চেয়ারে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে গুছিয়ে বসলেন দত্তসাহেব। বোঝা গেল যে তাঁর লুপ্ত কনফিডেন্স ফিরে এসেছে।

“চর্যাপদ যে বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম পুঁথি সেটা তো জানোই। তা সেটা কবে লেখা হয়েছিল সেটা জানো তো?”

আমাদের মুখের দিকে একঝলক তাকিয়েই তিনি বুঝে নিলেন যে উত্তরটা কী হতে পারে।

“সুনীতিকুমার চাটুজ্জের মতে চর্যাপদ লেখা হয়েছিল মোটামুটি ন’শো পঞ্চাশ থেকে বারোশো খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। এ-নিয়ে পণ্ডিতমহলে এখনও বিস্তর বিতর্ক আছে যদিও। তবে এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত। আমিও এ-নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছি। আমার মতে চর্যাপদের সময়কাল কিছুতেই একাদশ শতাব্দী, মানে হাজার থেকে এগারোশোর পর হতে পারে না। আমার মতে ওই একশো বছরের মধ্যেই চর্যাপদ সঙ্কলিত হয়েছিল।

‘এবার বলো তো বাপু, চর্যাপদের পর নেক্সট কোন বইকে আমরা বাংলা ভাষায় লেখা দ্বিতীয় বই বলে গণ্য করি?”

বলা বাহুল্য, এ-সব আমাদের জানার কথা নয়। তাই উত্তরটাও দত্তসাহেবই দিলেন, “বইটার নাম শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বড়ু চণ্ডীদাসের লেখা। বেসিক্যালি শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে লেখা একটি গীতিকাব্য, প্রথম আর শেষদিকের পাতাগুলো পাওয়া যায়নি। ফলে এটাও ওই চর্যাপদের মতোই কত সালে লেখা সেটা সঠিক জানা যায় না। তবে আমরা ওই মোটামুটি চতুর্দশ শতকটাকেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচনাকাল বলে ধরে থাকি। অর্থাৎ তেরোশো থেকে চোদ্দশো সালের মধ্যে, চৈতন্যদেব জন্মাবার আগে।”

ইতিমধ্যে নারানজ্যেঠু ফিরে এসেছিলেন। হাতে একগোছা কাগজ। আমাদের আলোচনার শেষের দিকটা যে তিনি শুনেছেন বোঝা গেল যখন তিনি যোগ করলেন যে, “চর্যাপদের পুঁথি কোথা থেকে পাওয়া যায় সে তো সকালেই শুনলে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথিটা কোত্থেকে পাওয়া যায় জানো তো?”

আবার না-সূচক ঘাড় নাড়তে আমাদের যে বেশ লজ্জাই হচ্ছিল সে-কথা আর বলে কাজ নেই।

“উনিশশো নয় সালের ঘটনা। বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড় গ্রামের এক বাসিন্দা, নাম বসন্ত রঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ, আশেপাশের গ্রামে প্রাচীন পুঁথির খোঁজপত্তর করছিলেন। এই করতে-করতেই উনি বিষ্ণুপুরের কাছাকাছি কাকিল্যা গ্রামে দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামের একজন বেশ পয়সাওয়ালা গেরস্তের বাড়ি পৌঁছোন। সেখানে মুখুজ্জেবাবুর গোয়ালঘরের মাচায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুঁথিটা খুঁজে পান বসন্ত রঞ্জন। পরে জানা যায় যে এই দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বনবিষ্ণুপুরের রাজগুরু শ্রীনিবাস আচার্যের মেয়ের দিকের বংশধর। পুঁথিটির সঙ্গে একটা চিরকুট পাওয়া যায়। সেই থেকে জানা যায় যে আড়াইশো বছর আগে বইটা বিষ্ণুপুরের ‘গাঁথাঘর’ অর্থাৎ রাজ লাইব্রেরিতে ছিল।”

“কিন্তু তার সঙ্গে এই চক্র সংবর্ধনা না কী নাম, সে-পুঁথির সম্পর্ক কী?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

নারানজ্যেঠু গলা পরিষ্কার করে নিলেন একবার। তারপর বললেন, “ওইদিকে চর্যাপদ আর এইদিকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এই দুয়ের মাঝখানে আড়াইশো থেকে তিনশো বছরের লম্বা গ্যাপ। এর মধ্যে লেখা বাংলাভাষার আর কী-কী নিদর্শন পাওয়া গেছে বলো তো?”

আমরা ঠায় বসে রইলাম। মুখে কথা জোগালো না।

আস্তে-আস্তে বুড়ো আঙুল নাড়ালেন দত্তসাহেব, “একটাও না। সেই সময়ের বাংলায় লেখা একটা পুঁথিও আজ অবধি খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ সে-সময়ে কি বাংলা ভাষায় আর কোনও কিছু লেখা হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু আজ অবধি সে-সব পুঁথিপত্তরের একটাও যে কেন পাওয়া যায়নি, সে-ও এক রহস্য। অথচ সেই একই সময়ে সংস্কৃতে লেখা বেশ কিছু পুঁথি কিন্তু পাওয়া গেছে, যেমন ধরো জয়দেবের লেখা গীতগোবিন্দ। কিন্তু বাংলা ভাষা বা লিপির কোনও চিহ্নই নেই।”

এবার দু’জনেই আমাদের দিকে ঝুঁকে এলেন, নারানজ্যেঠু ফিসফিস করে বললেন, “এখানেই এই পুঁথিটার মাহাত্ম্য। আমাদের মতে এই পুঁথি হচ্ছে সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের বাংলার ভাষা, হরফ আর লিপির একমাত্র নমুনা।”

শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এবার বলা শুরু করলেন দত্তসাহেব, “আমরা চর্যাপদ থেকে সেই সময়কার বাংলা ভাষার একটা আন্দাজ পাই। তারপর আড়াইশো তিনশো বছর কমপ্লিটলি ব্ল্যাঙ্ক! তার পরেই সোজা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন! শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে শুরু করে আজ অবধি বাংলা ভাষা কোন পথে এগিয়েছে, সে-সব আমরা খুব ভালো করে জানি। শুধু জানি না বাংলা ভাষা আর লিপির ওই তিনশো বছরের ইতিহাস। কী হে ভাইপো, বুঝলে কিছু?”

তাপস একদৃষ্টিতে ছাদের দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল। বাঘাটে পুলিশি গলায় শেষের শব্দদুটো কানে যেতে একটু নড়ে-চড়ে বসল সে।

“এই পুঁথিটা হচ্ছে সেই মিসিং লিঙ্ক, আর সেইজন্যই এটা অমূল্য। টাকা দিয়ে এর কোনও পরিমাপ হয় না।” চাপা অথচ কনফিডেন্ট গলায় বললেন নারানজ্যেঠু।

তাপস দেখলাম ভুরু কুঁচকে কী-সব ভাবছে। কিছুক্ষণ বাদে মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু পুঁথিটা যে ওই সময়কারই, সেটা কী করে বুঝলেন?”

“ভাষা দেখে, সিম্পল। চর্যাপদের ভাষা জানো তো? ‘সোনে ভরিলী করুণা নাবী/ রূপা থোই নাহিক ঠাবী।’ অর্থাৎ করুণা নৌকা সোনায় পরিপূর্ণ, রূপা রাখার জায়গা নেই। আর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা হচ্ছে “রাজা কংসাসুরে মোএঁ করিবোঁ গোহারী। তোহ্মার জীবন তবেঁ নাহিঁক মুরারী।” অর্থাৎ রাজা কংসের কাছে আমি কাতর প্রার্থনা করব যাতে কংস তোমাকে হত্যা করেন। এই পুঁথিটার ভাষা ঠিক এই দুইয়ের মাঝামাঝি। যেমন ধরো, উমমম, এ-রকম হতে পারে-” বলে আবৃত্তি করলেন দত্তসাহেব,  

.

“দেও চক্কসম্বরঅ দেঁয় কালযানঅ

দশবোধিঁউ মুকে করিঅ দানঅ

সত্তসগ্গ করি বিচরণ মুঞি

বুঝিঁউ দেওকিপা লুটলুঁ উঁঞি।”

.

“আমি বাক্যগঠন, ব্যাকরণ ইত্যাদি দিয়েও বুঝিয়ে দিতে পারি। কিন্তু এই ভাষার প্রকারভেদটাই হচ্ছে বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায়।” বলে নারানজ্যেঠুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, “আজ কিছু পাব নাকি?”

নারানজ্যেঠু হাতে ধরা কাগজের গোছাটা এগিয়ে দিলেন। হাসিমুখে বললেন, “বাইশ থেকে আঠাশ নাম্বার পাতা অবধি কপি করেছি। সঙ্গে টীকাও করেছি আমার জ্ঞান-বুদ্ধি মতো। আশা করি গতবারের মতো এবারেও আপনি বেশ কিছু ভুল খুঁজে পাবেন এর মধ্যে।”

ব্যাপারটা আমার বেশ আশ্চর্য লাগল। পুঁথিটা দত্তসাহেব নিশ্চয়ই পড়েছেন। তিনি তো তাহলে নিজেই কপি করে নিতে পারেন। তাঁকে কপি করে দিতে হচ্ছে কেন?

দত্তসাহেব বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পারলেন। কাগজের গোছাটা পকেটে ঢোকাতে-ঢোকাতে তেরচা চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন, “তোমার জ্যেঠাটিকে যতটা সহজ ভাবো ততটা সহজ উনি নন ভায়া। যদি ভাবো তুমি বললেই উনি ঝপাস করে পুঁথিখানা এনে তোমার কোলে ফেলে দেবেন, তবে সে-গুড়ে শুধু বালি নয়, সেই চন্দননগর। আজ অবধি পুঁথিখানা স্বচক্ষে দেখবার সৌভাগ্য এই শর্মারও হয়নি। এই যে এতক্ষণ ধরে তোমাদের জ্ঞানবিতরণ করলুম, সে-ও এই তোমাদের জ্যেঠার করে দেওয়া কপি-র দৌলতে। উনি খুব সম্ভবত ভাবছেন যে পুঁথিটা একবার দেখলেও রাস্তা থেকে লোকজন এসে আমাকে ছুরি মেরে যাবে। হুঁহ্, যত্তসব।”

জ্যেঠু বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত হলেন না। হাসিমুখে বললেন, “আপনাকে তো আগেই বলেছি দাদা, ও-জিনিসের ওপর সাঙ্ঘাতিক কিছু লোকের নজর আছে। আপনি তাদের চেনেন না, কিন্তু আমি বোধহয় চিনি। আমি কিছুতেই আপনাকে এর মধ্যে টেনে আনতে পারি না।”

দত্তসাহেব গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে গেলেন। জ্যেঠু খানিকক্ষণ আকাশের দিকে চোখ তুলে চেয়ে থেকে তারপর বললেন, “চল রে তপু, লোবসামকে গাড়িটা বের করতে বলি। সুবোধ তো বোধহয় প্রথমবারের জন্য দার্জিলিং এল। ওকে দার্জিলিংটা ভালো করে দেখাব না, সে কি হয়? আজ ম্যালটা ঘুরে নে তোরা। কাল ভোরে টাইগার হিল থেকে শুরু করে আশেপাশের কিছু ট্যুরিস্ট স্পটে ঘুরিয়ে দিচ্ছি। তারপর দুপুর-দুপুর বেরোলে রাত আটটার মধ্যে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে যাবি। একবার দুগ্গা-দুগ্গা করে কলকাতা পৌঁছো তারপর কোথায় পুঁথিটা পৌঁছে দিতে হবে সেটা আমি পরে ফোন করে বলে দেব।”

“ইয়ে, কিন্তু পুঁথিটা হাতে পাব কখন?” ইতস্তত করে প্রশ্ন করলাম আমি, “মানে আপনাকে ব্যাঙ্কে যেতে হবে না? কাল তো সারাদিনই শুনলাম ঘোরাঘুরি আছে।”

নারানজ্যেঠু কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে হো-হো হাসিতে ফেটে পড়লেন, “তোমার কী ধারণা সুবোধ, ওটা আমি ব্যাঙ্কের লকারে রেখেছি?”

“রাখেননি?” এবার আমার অবাক হওয়ার পালা, “তাহলে ইয়ে, মানে কোথায় রেখেছেন? আর আমরাই বা কখন আর কী-ভাবে হাতে পাব ওটা?”

ধীর স্বরে বললেন নারানজ্যেঠু, “ধীরে বৎস, ধীরে। যখন সময় হবে নিশ্চয়ই দেখতে পাবে। কখন কী-ভাবে ওটা তোমাদের ট্রেনের কামরায় পৌঁছে দেওয়া হবে সে-দায়িত্ব আমার।”

এর ওপরে আর কথা হয় না। উঠতে-উঠতে তাপস শুধু একটাই প্রশ্ন করল, “আপনার এই কাজের ছেলেটি, মানে লোবসামের বাড়ি কোথায়?”

নারানজ্যেঠু বললেন, “ওই যে হরসিং হাট্টা বলে গ্রামটা দেখালাম না? ওখানে।”

“একে আপনি পেলেন কোথা থেকে?”

“ওর কাকার নাম বীরেন্দ্র থাপা, সে এই দত্তদা-র বাড়িতে কাজ করে। কাজ বলতে গাড়ি চালানো, বাজার করা, টুকটাক ফাইফরমাশ খাটা, এই আর কি। ছোকরার বাপ-মা নেই, ছোটবেলা থেকে কাকার কাছেই মানুষ। পড়াশোনাও বেশিদূর করেনি। তেনজিং ছিল আমার ডানহাত, ম্যান ফ্রাইডে বললেই চলে। এই মাস-দুয়েক আগে এক সকালে দেখি সে হাপিস, কাউকে না বলে একেবারে উধাও। বাড়ি থেকে কিছু চুরিটুরি যায়নি বলে ও নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি। আমি লোক খুঁজছি শুনে ওর কাকাই একদিন দত্তদাকে বলে-কয়ে আমার বাড়িতে এই লোবসামকে কাজে ঢুকিয়ে দেন। কেন বল তো?”

“না কিছু না। এমনি।” বলে উঠে পড়ে তাপস।  

.

*

দার্জিলিং আমি কমপক্ষে বার-তিরিশেক গেছি আজ অবধি, পরেও যাব। কিন্তু সেই ছিল আমার প্রথম দার্জিলিং দেখা। আর সে-দেখাও এমন একটা কাহিনির মধ্যে দিয়ে যে এখনও আমার মনে একটা স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। তবে এ-কথাটা মানতেই হবে যে গুচ্ছের ট্যুরিস্ট গিয়ে-গিয়ে জায়গাটা এখন বিস্তর ঘিঞ্জি আর নোংরা হয়ে গেছে। তখন পাহাড়ের রানি অনেক বেশি সুন্দর ছিল।

লেবং থেকে দার্জিলিং ম্যাল-এ যাওয়ার রাস্তাটা ভুটিয়া বস্তির মধ্যে দিয়ে। নারানজ্যেঠুর গাড়ি করে যেতে-যেতে দু’পাশের সৌন্দর্য দেখে তো আমি মোহিত। উঁচু-উঁচু পাইন আর ফার গাছের জঙ্গল, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ছে রাস্তার ওপর, আর চারিদিকে নাম-না-জানা পাখির ডাক। পাশ দিয়ে খাদ নেমে গেছে, খাদের গা বেয়ে-বেয়ে রাস্তা। একটা হেয়ার পিন ব্যান্ড ঘুরেই দেখি কতগুলো ভুটিয়া মেয়ে কাঁধে বিশাল বড় বেতের ঝুড়ি নিয়ে দল বেঁধে হাঁটছে। নারানজ্যেঠু বললেন ওরা যাচ্ছে কাছেরই একটা টি-এস্টেটে চা-পাতা তুলতে। “এদের মতো কষ্টসহিষ্ণু জাত কমই আছে হে। এই দেখছ এরা ডিউটিতে যাচ্ছে, এখন সারাদিন ধরে চা-পাতা তুলবে বাগান থেকে। তারপর বাড়ি গিয়ে ঘর সংসার সামলানো, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সেবা করা, এ-সব তো আছেই। তবুও দেখো, মুখের হাসিটি কিন্তু অমলিন।”

দার্জিলিং ম্যালে পৌঁছোতে সময় লাগল আধ-ঘণ্টাটাক। গিয়েই বুঝলাম অমন রংবাহারি জব্বর জায়গা আজ অবধি কমই দেখেছি। পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোথাও একই জায়গায় নানা জাতের নানা ভাষার আর নানা সাইজের অত ট্যুরিস্ট দেখা অসম্ভব। দিশিদের মধ্যে অবশ্য বাঙালিরাই বেশি। তাদের চেনার উপায়ও খুব সহজ, সোয়েটারচাপা ভুঁড়ি আর বোকা-সোকা মাঙ্কি ক্যাপ। ম্যালের মাঝমাঝি বেশ কয়েকটা রুগ্ন ঘোড়ার ওপরে চেপে হর্স রাইডিং করছে পুরুষ্টু বাচ্চারা, দেখে আমার ঘোড়াগুলোর জন্য বেশ কষ্টই হল। ম্যালের একদিকের একটা খাদের ধার ঘেঁষে বেঞ্চি বসানো, সেখানে লোকজন বসে রোদ পুইছে। বাকি ম্যাল জুড়ে বাচ্চাকাচ্চাদের ক্যালরব্যালরে, বড়দের হাঁকারে, টাট্টুঘোড়ার টগবগানিতে সে একেবারে জমজমাট ব্যাপার।

নারানজ্যেঠু এসেই একটা বেঞ্চির কোনা দখল করে বসেছিলেন। তিনি পাইপ ধরানোর চেষ্টা করছেন দেখে আমি আর তাপস অন্যদিকে হাঁটা দিলাম। তাপস অবশ্য একটু পরেই অক্সফোর্ড বুক অ্যান্ড স্টেশনারি লেখা মস্ত বড় একটা বইয়ের দোকান দেখে ভেতরে সেঁধিয়ে গেল। আমি আবার বইয়ের ভক্ত নই। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি পাশেই একটা টিবেটান কিউরিও শপ। তার ভেতরে ঢুকে সিল্কের কাপড়ের ওপর আঁকা একটা অদ্ভুত দেখতে দেবতার ছবি দেখছি, এমন সময় পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, “ওটাকে বলে থাংকা। টিবেটান আর্ট। আর যে-দেবতার ছবিটা অত মন দিয়ে দেখছ, ওনার নাম বজ্রভৈরব। ভারি ভয়ংকর দেবতা।”

ঘুরে দেখি আর কেউ নয়, আমাদের পথের আলাপী দেবাশিস বণিক।

দেবাশিসদা আমার দিকে সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “কেমন ভায়া, বলেছিলাম না দেখা হয়ে যাবেই। তা হাতে যেটা নিয়েছ সেটা কিন্তু খুবই উমদা চিজ। ভালো দাঁও পেলে ছেড়ো না হে, ওয়াল হ্যাঙ্গিং হিসেবে দারুণ।”

মনে পড়ে গেল যে ভদ্রলোক বলেছিলেন উনি একটা কিউরিও শপ চালান কলকাতায়। ফলে এ-সব নিয়ে যে ওঁর একটা থরো নলেজ থাকবেই সে আর আশ্চর্য কী?

হাতের থাঙ্কাটা রেখে দিয়ে দু’জনে বাইরে এলাম। দেবাশিসদা বললেন, “দোকানের জন্য কেনাকাটি করতে প্রায়ই দার্জিলিংয়ে আসতে হয় আমাকে। আর শুধু দার্জিলিং কেন, নেপাল, ভুটান এ-সব জায়গাতেও যাই বছরে দু-একবার। গেল বছর তো একটা বারোশো বছরের পুরোনো তিব্বতি ধনুকের খোঁজে লাসা-তেও গেসলুম, যেটা দিয়ে নাকি লামা পালগি দোরজে অত্যাচারী রাজা লাংদারমাকে বধ করেছিলেন। গিয়ে দেখি পুরো জালি কেস, বুঝলে। মাঝখান থেকে যাওয়া-আসার খরচাটাই জলে।”

“কী করে বুঝলেন জালি কেস?” আমার বেশ কৌতূহল হল। যদিও এই পালগি দোরজে বা লাংদারমা এরা কে বা কারা সে-নিয়ে আমার বিন্দুমাত্রও আইডিয়া নেই।

“ওই সময়ের টিবেটান ধনুক বিশেষ ধরনের হত বুঝলে, চিনের তাং পিরিয়ডের লং-বো যেমন হত, সেই টাইপের। কিন্তু যে ধনুকটা দেখানো হল, সেটা দেখেই বুঝলাম যে ওটা চিনের মিং রাজত্বের সময়কার রিফ্লেক্স বো ছাড়া আর কিছু নয়। মিং রাজত্ব শুরুই হয় লাংদারমাকে হত্যা করার দুশো বছর পর। ফলে ওটা জালি কেস নয় তো কী?”

বলা বাহুল্য, আমি এ-সবের কিছুই বুঝলাম না। শুধু এটুকু বুঝলাম যে এ-সব ঐতিহাসিক জিনিসপাতি নিয়ে ভদ্রলোকের অসীম জ্ঞান।

ততক্ষণে বইয়ের দোকান থেকে তাপসও বেরিয়ে এসেছে। আমাদের দেখেই এগিয়ে এল সে, ঠোঁটের কোনায় একটা চাপা হাসি, যার মানেটা আমি বিলক্ষণ চিনি।

“এসো ভায়া।” সোল্লাসে বললেন দেবাশিসদা, “এই এতক্ষণ তোমার বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করছিলাম। দার্জিলিং ঘুরছ কেমন?”

আমরা দু’জনেই যে ভালো ঘুরছি সে-কথাটা ভদ্রলোককে জানানো হল। উনি পরের প্রশ্নটা ফের তাপসকেই করলেন, “হাতে ওটা কী? বই কিনলে নাকি?”

আমিও আগে খেয়াল করিনি। ঘুরে দেখি তাপসের হাতে একটা বই, বুদ্ধিজম ইন অ্যানশিয়েন্ট বেঙ্গল, লেখক জেমস হুইটলার। দেবাশিসদা চোখ গোলগোল করে বললেন, “আরিব্বাস। দুর্দান্ত বই পেয়েছ ভায়া। এ-জিনিস তো বহুদিন আউট অফ প্রিন্ট ছিল। পেলে কী করে? তা তোমারও কি আমার মতো এই লাইনে ইন্টারেস্ট আছে নাকি?”

তাপস ওর ওই চাপা হাসিটা ঠোঁটের এককোণে চালান করে বলল, “ওই আর কি। তা আপনি আপনার দোকানের জন্য ভালো মেটেরিয়াল পেলেন কিছু?”

দেবাশিসদা হাত উলটে বললেন, “কই আর পেলাম। কয়েকটা মূর্তি, দুটো ঘণ্টা আর একটা প্রদীপ। তা-ও কোনওটাই একশো বছরের পুরোনো নয়। প্রদীপটাই যা একটু পদের, দলাই লামার প্যালেসে জ্বালানো হত বলছে। দেখি কী দর ওঠে। তা এখানেই কথাবার্তা বলবে নাকি নাথমলের চায়ের দোকানে দার্জিলিং-এর অথেনটিক চা খেতে-খেতে আড্ডাটা দেবে?”

আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম তাপস তাকিয়ে আছে ম্যালের ঠিক উল্টোদিকে। এখন একটু দুপুর-দুপুর, ট্যুরিস্টরা যে যার হোটেলে ফিরে গেছে লাঞ্চ করবে বলে। ম্যালে লোক একটু কম, ওদিকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তিনজনেই দেখলাম যে ওদিকে তখন নারানজ্যেঠুর পাশে একটা লোক বসে আছে। লোকটাকে দেখতে কেন জানি না একটু অদ্ভুত লাগল আমার। কেন লাগল সেটা তখন বুঝিনি, বুঝেছিলাম পরে। শুধু এইটা নজরে পড়ল যে নারানজ্যেঠু সেই লোকটার সঙ্গে কথা বলছেন, আর বলছেন চাপা, কিন্তু খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে।

দেবাশিসদার দিকে তাকালাম। মনে হলো লোকটা যেন দু’চোখ দিয়ে দৃশ্যটা গিলছিল। তাপসও বোধহয় সেটা আঁচ করে স্বাভাবিক ভাবেই বলল, “চলুন দেবাশিসদা, কোথায় দার্জিলিংয়ের অথেন্টিক চা খাওয়াবেন বলছিলেন না?”

দেবাশিসদাও যেন নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওদিক থেকে এদিকে মাথাটা ঘোরাতে বাধ্য হলেন। তারপর অমায়িক হেসে বললেন, “আচ্ছা চলো। মকাইবাড়ির ফার্স্ট ফ্লাশের চা খাওয়াব তোমাদের। অটাম ফ্লাশের মতো অত চমৎকার গন্ধ পাবে না হয়তো, তবে লিকারটি কিন্তু একেবারে মারহাব্বা দুর্দান্ত।”

সেদিনের আড্ডাটা তেমন আর জমেনি ভালো। তবে ভদ্রলোকের দৌলতে চায়ের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানলাম। মোটমাট বোঝা গেল ভদ্রলোকের বেশ কিছু বিষয়ে ভালো জ্ঞান আছে। আর কথা বলতেও পারেন বেশ গুছিয়ে। এ-গুণটা বোধহয় কিউরিও শপ চালিয়ে আয়ত্ত্ব করেছেন। আমার কেন যেন একবার মনে হল কোনও হাইস্কুলের ইতিহাস টিচার হিসেবে ভদ্রলোককে মানাতো বেশ। আর হ্যাঁ, সেদিন যে চা খেয়েছিলাম, মিথ্যে বলব না, সে-স্বাদ আজও মনে আছে।

নাথমলের দোকান থেকে বেরিয়ে নীচের দিককার রাস্তাটা ধরলেন দেবাশিসদা, বললেন মহাকালের মন্দিরটা একবার ঘুরে যাবেন, “আকাশ ক্লিয়ার থাকলে ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার একটা দুর্দান্ত ভালো ভিউ পাওয়া যায়। দেখি একবার ট্রাই নিয়ে।”

লোকটা চলে যাওয়ার পর ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল তাপস। আমি একবার ঠেলা দিয়ে বললাম, “কী রে, কী দেখছিস?”

তাপসের ঠোঁটের কোণে চাপা হাসিটা ফিরে এল, তারপর বলল, “ভদ্রলোক ধুরন্ধর বটে, তবে মিথ্যে কথা বলার আর্টটা এখনও ঠিক রপ্ত করে উঠতে পারেননি। ইনি অটাম ফ্লাশ আর ফার্স্ট ফ্লাশের তফাত বোঝেন না, মিং আর তাং ডাইন্যাস্টির টাইম পিরিয়ড গুলিয়ে ফেলেন… কিন্তু নিজেকে কিউরিও শপের মালিক বলে পরিচয় দেওয়ার এত আগ্রহ কেন কে জানে!”

আমি কিছু বলার আগেই নারানজ্যেঠু কাছে এসে দাঁড়ালেন। বোঝাই যাচ্ছিল যে জ্যেঠু একটু উত্তেজিত হয়ে আছেন। আমাদের বললেন, “চল, বাড়ি যাই। লাঞ্চ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে না হয় আবার আসা যাবে, কেমন?”

তখন যদি জানতাম, বিকেলের দিকে এদিকেই আসতে হবে বটে, তবে ঘুরতে নয়, অন্য কাজে!  

.

*

সেদিন দুপুরের খাওয়াটা জব্বর হয়েছিল। লোবসাম পাকা রাঁধুনে, রাই শাক আর মাটন দিয়ে কী একটা নেপালি ডিশ বানিয়েছিল। আমি তো চেয়ে-চেয়ে দু’বার খেলাম। তাপসেরও দেখলাম চিকেনের ঠ্যাং চিবোতে-চিবোতে চোখ দুটো বুজে এসেছে। মেন কোর্সে অবশ্য একটা দিশি মুর্গির ঝোল ছিল। তেল-মশলাহীন, কিন্তু অতীব সুস্বাদু।

খেয়ে-টেয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে দিবানিদ্রার উদ্যোগ নিচ্ছি, এমন সময় ঘন-ঘন কলিং বেলের আওয়াজ। আমি একেবারে অবটিউস অ্যাঙ্গেলে চিত হয়ে শুয়েছিলাম, নড়াচড়ার কোনও উপায়ই ছিল না। অগত্যা তাপসই দেখতে গেল কেসটা কী।

তাপস ফিরে এল ঠিক দু’মিনিটের মাথায়। ঝড়ের বেগে একটা জিন্স শর্টসের ওপরেই গলিয়ে নিতে-নিতে বলল, “ঝটপট তৈরি হয়ে নে। ম্যাল রোডের পাশের একটা লজে একজন খুন হয়েছে। ইনস্পেক্টর গুরুং এসেছে জ্যেঠুকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য, বডি শনাক্ত করতে হবে।”

আমার মাথাটা পুরো ঘেঁটে গেল। কে খুন হয়েছে, কেনই বা খুন হয়েছে, আর তার বডি শনাক্ত করার জন্যে নারানজ্যেঠুকেই বা যেতে হবে কেন সেটা আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ধরছিল না। তবে তাপসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৈরি হয়ে নিতে আমার সময় লাগল ঠিক দু’মিনিট।

আমরা যখন পুলিশের জিপে করে যাচ্ছি, তখন বিকেল শুরু হয়েছে। রাস্তাটাও পুলিশের জিপের বাকি সব্বার মতো খুব গম্ভীর। ড্রাইভার সাহেব দেখলাম এই কমে আসা আলোতেও কালো গগল্স্ পরে গাড়ি চালাচ্ছেন। পাকা হাত, গাড়ি তো চলছে না, মনে হচ্ছে যেন মসৃণ ভাবে উড়ে যাচ্ছে। পাশে বসে আছে গুরুং, সে-ও উৎকট রকমের গম্ভীর মুখে চুপ করে আছে। পেছনে আমি, তাপস, নারানজ্যেঠু আর দু’জন কনস্টেবল। কারও মুখে কোনও কথা নেই। আমি যে-আঁধারে ছিলাম, সেই আঁধারেই।

লজটায় পৌঁছতে লাগল ঠিক পঁচিশ মিনিট। ম্যালের যে-রাস্তাটা গ্লেনারিজের দিকে গেছে, সেটা দিয়ে একটু নীচে নেমে ডানদিকে একটা হেয়ার-পিন বেন্ড আছে। ঠিক তার মুখেই লজটা, নাম ড্যাফোডিল। খুনটা যে ওখানেই হয়েছে বোঝা যাচ্ছে লজের সামনে জমে ওঠা উত্তেজিত ভিড়টা দেখে। আমাদের জিপ দরজার সামনে এসে থামতেই ভিড়টা সরে গিয়ে যাওয়ার পথ করে দিল।

লজটা দেখেই বোঝা যায় যে সস্তার জায়গা। বিবর্ণ হলদেটে রঙ, এদিক-ওদিক শ্যাওলা ধরে আছে। ঢোকার দরজাটাও বোধহয় ব্রিটিশ আমলের বানানো, নেহাত দামি সেগুন কাঠ বলে এখনও দাঁড়িয়ে আছে, নইলে কবেই খসে পড়ে যেত। রিসেপশনে দাঁড়িয়ে ছোট-খাটো চেহারার অল্পবয়সী রিসেপশনিস্ট কাম ম্যানেজারটি বলির পাঁঠার মতো কাঁপছিলেন। গুরুংকে দেখেই অবোধ্য বাংলা মেশানো হিন্দিতে হাউমাউ করে কী-সব বকে যেতে থাকলেন। বক্তব্যটা বুঝতে অবশ্য অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাঁর কথায় ড্যাফোডিলের প্রায় আশি বছরের ইতিহাসে এরকম দুর্ঘটনা কখনও ঘটেনি। এতে তিনি বা তাঁর কর্মচারীদের কেউ জড়িত থাকার কথা ভাবাই যায় না। তিনি থাকতে লজের এমন বদনাম হল ভেবে তাঁর মাথা কাটা যাচ্ছে। পুলিশ সাহেব যেন ডেডবডিটা সরিয়ে নিয়ে গিয়ে এই নোংরা ব্যাপারটার একটা দ্রুত সুরাহা করেন।

গুরুং যে-চাউনিটা দিল, দেখে আমারই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল, ম্যানেজারটির তো কথাই নেই। কাটাকাটা স্বরে গুরুং জিজ্ঞেস করল, “আপনার বয়েস কত?”

ম্রিয়মাণ স্বরে ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, “আটত্রিশ।”

“এই চাকরিতে আপনার ক’দিন হল?”

“আজ্ঞে ছ’মাস।”

“ছ’মাসেই আপনি লজের আশি বছরের ইতিহাস জেনে গেলেন?”

স্পষ্ট দেখলাম ভদ্রলোক বার-দুয়েক খাবি খাওয়ার মতো মুখ করে ঢোঁক গিললেন। গুরুং সেদিকে তাকিয়ে পরের প্রশ্ন ছুড়ে দিল, “লজের মালিক তো আপনি নন। নাম কী মালিকের? আর তিনি আছেন কোথায় এখন?”

জানা গেল যে লজের মালিক কুচবিহারের এক বাঙালি ভদ্রলোক, উত্তরাধিকার সূত্রে এই লজের মালিকানা পেয়েছেন। মালিকের আসল ব্যবসা জড়িবুটির, বহুদিন ধরে কলকাতা আর দিল্লির বিভিন্ন ফার্মে আয়ুর্বেদিক ইনগ্রেডিয়েন্ট সাপ্লাই করে থাকেন। ড্যাফোডিল লজটা ওঁর সাইড ব্যবসা, ওটা ম্যানেজারের ওপরেই ছেড়ে রাখেন। আপাতত তিনি অকুস্থলে নেই, ফুন্টশোলিং গেছেন ভুটান থেকে আসা কিছু শেকড়বাকড়ের খোঁজে। তবে খবর পাওয়ামাত্র শিলিগুড়ির দিকে রওনা দিয়েছেন, রাতের মধ্যেই এসে পড়বেন আশা করা যায়।

“হুম।” বলে মেঝের দিকে তাকিয়ে কী যেন একটা ভাবল গুরুং, তারপর বললো, “বডিটা কোথায়?”

ম্যানেজারবাবুটি শশব্যস্ত হয়ে বললেন, “ওঁর ঘরেই স্যার, রুম নাম্বার তিনশো দুই।”

“প্রথম খবরটা কে দেয়?”

“ওয়েটার রামবিলাস স্যার। গেস্ট লাঞ্চের সময় বাইরে গেছিলেন। ফিরে আসেন বেলা দেড়টা নাগাদ। তারপর একজন আসেন গেস্টের সঙ্গে দেখা করতে।”

“আপনারা বাইরের লোককে গেস্টদের রুমে ঢুকতে অ্যালাউ করেন?”

“করি স্যার, তবে গেস্টকে জিজ্ঞেস করেই। এক্ষেত্রেও তাই-ই হয়েছিলো। গেস্ট অনুমতি দেওয়ার পরেই আমরা ভিজিটরদের গেস্টদের রুমে যেতে অ্যালাউ করি।”

“তারপর?”

“ভিজিটর বোধহয় গেস্টের রুমে আধ-ঘণ্টাটাক ছিলেন। তারপর চলে যান। তারও আধঘণ্টা বা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর পাশের ঘরে যিনি ছিলেন -মিস্টার গাঙ্গুলি, তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন বাইরে যাবেন বলে। তিনিই তিনশো দুইয়ের দরজার নীচ থেকে রক্ত চুঁইয়ে আসছে দেখে আমাদের খবর দেন।”

“হুম। তা আপনার এই মিস্টার গাঙ্গুলি আছেন কোথায় এখন? নিজের রুমেই?”

“আর বলবেন না স্যার। ওনার নাকি রক্ত দেখলে মাথা ঘোরে। তাই চটপট ওনাকে কাছেই রিপোজ নার্সিংহোমে ভর্তি করিয়েছি। কী হ্যাপা বলুন তো? এদিকে এই খুন, ওদিকে অসুস্থ রুগি…” কাঁদো-কাঁদো গলায় নিজের করুণ অবস্থাটা দাখিল করলেন ম্যানেজার সাহেব।

“তা সেই রহস্যময় ভিজিটরকে দেখতে কেমন?”

“বয়েস ধরুন মাঝবয়েসী। হাইটও অল্পও না বেশিও না। বেশ স্বাস্থ্যবান চেহারা, কথা শুনে বাঙালি বলেই মনে হয়, তবে কথার মধ্যে হিন্দি বা উর্দু শব্দ একটু বেশি ব্যবহার করেন।”

“চশমা পরা, খুঁড়িয়ে হাঁটা, কথা বলতে গিয়ে তোতলানো, এমন কিছু নজরে পড়েছে আপনার?”

“না স্যার। মানে অত খেয়াল করে দেখিনি। আসলে জানতাম না তো যে উনি খুন করবেন। জানলে হয়তো…”

“হুম, বুঝেছি। চলুন, এবার বডিটা দেখান।”

তিনতলা লজ, প্রতিটি তলায় আটটা করে ঘর, একতলাটা ছাড়া। ওখানে অফিস, রিসেপশন, গুদোমঘর, ডাইনিং হল বাদে দুটো মাত্র ঘর। সেই দুটো আর দোতলা তিনতলা মিলিয়ে মোটামুটি আঠেরোটা ঘর বোর্ডার বা গেস্টদের। লিফট নেই, তাই পায়ে হেঁটেই উঠতে হল। তিনতলায় উঠে দেখলাম সিঁড়ি শেষ হয়ে ডানদিকে টানা লম্বা বারান্দা। বারান্দার একদম শেষে তিনশো এক নম্বর রুম। ম্যানেজারবাবু বললেন যে এখানেই নাকি সেই গাঙ্গুলিবাবু ছিলেন। আপাতত রুমটা বন্ধই আছে। গাঙ্গুলিবাবু ফিরলে তাঁর জিনিসপত্র তাঁর হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

অভিশপ্ত তিনশো দুই নম্বর রুমের দরজাটা খোলাই ছিল। সেটা কেউ বন্ধও করেনি, বোধহয় পুলিশের হ্যাঙ্গামের কথা ভেবে। আমি আর তাপস উঁকি দিয়ে যে বীভৎস দৃশ্যটা দেখলাম তার কথা আমাদের বহুদিন মনে থাকবে।

দেখলাম, ঘরের বিছানা থেকে দরজার মাঝের যে অংশটা, সেখানে লম্বালম্বি পড়ে আছে একটা লোক। সরি, লোক নয়, একটা দেহ। লোকটাকে চিনতে কোনই অসুবিধা হল না। আজ দুপুরেই একে ম্যালে দেখেছি আমরা, নারানজ্যেঠুর সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে। এখনও লোকটার গায়ে সেই একই পোশাক পরা। তফাতের মধ্যে এই যে বুকে একটা নেপালি কুকরি আমূল গেঁথে আছে, আর সারা মেঝেটা রক্তে থৈ-থৈ। যদিও সেই রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে অনেকটা। আমি তার আগে কোনওদিন খুন হওয়া মৃতদেহ দেখিনি, ভয়ে আর ঘেন্নায় আমার প্রায় বমি পাচ্ছিল। আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে বমি আটকাবার চেষ্টা করছি এমন সময় দুটো জিনিস আমার নজরে পড়ল। এক, লোকটার মুখের ভাব। তাতে আতঙ্কের থেকে অবাক হওয়াটাই যেন বেশি করে ফুটে উঠেছে। আর দুই, যেখানে লোকটার দেহ শুয়ে আছে, তার পাশে মেঝেতে একটা অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা। ওই রক্ত দিয়েই। চিহ্নটা ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের মতো, শুধু মাথার দিকের আঁকড়িদুটোর মধ্যিখানে একটা স্টার সাইন আঁকা আছে।

চিহ্নটা আমরা সবাই দেখেছিলাম। শুধু আশ্চর্য লাগল জ্যেঠুকে দেখে। ভয়ে আর আতঙ্কে মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেছে জ্যেঠুর। হাতের দিকে নজর যেতে দেখলাম সামান্য কাঁপছে জ্যেঠুর হাত।

“মাস্টার সা’ব, আমাদের ইনফর্মেশন মোতাবেক আজ দুপুরে এই লোকটার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল ম্যালে। ঠিক কি না? চিনতে পারছেন?” প্রশ্ন করল গুরুং।

অনেক চেষ্টা করে নিজেকে সামলে নিলেন নারানজ্যেঠু। নিস্পৃহস্বরে বললেন, “হ্যাঁ, না চেনার কী আছে। এই তো সকালে ম্যালে ঘুরতে এসেছিলাম, তখন পাশে বসেছিল খানিকক্ষণ। আমি পাইপ খাচ্ছি দেখে আমার কাছে তামাক চাইছিল। দিইনি বলে সামান্য তর্কাতর্কিও হল লোকটার সঙ্গে। ব্যাস এইটুকুই, তারপর ওরাও চলে এল, আমিও ওদের নিয়ে বাড়ি চলে এলাম। এখন নীচে চলো বাপু, এ-রকম রক্তারক্তির দৃশ্য আমার একদম পোষায় না।”

কথাটা যে ডাহা মিথ্যে সে না বললেও চলত। লোকে রাস্তাঘাটে পাশে বসে খইনি চায় দেখেছি। কিন্তু কেউ অচেনা অজানা লোকের কাছে পাইপ খাওয়ার তামাক চায় এই প্রথম শুনলাম। গুরুং কথাটা একবর্ণও বিশ্বাস করেনি, সে ওর মুখচোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। তবে মাস্টারসা’বের প্রতি শ্রদ্ধা বা অন্য কোনও কারণে হোক, দেখলাম যে এ-নিয়ে সে আর কোনও উচ্চবাচ্য করল না। তবে তার কপাল জুড়ে থাকা গভীর ভ্রূকুটিতে বোঝা যাচ্ছিল যে ব্যাপারটা অত সহজে মিটে যাওয়ার নয়।

ততক্ষণে পুলিশের ফটোগ্রাফার এসে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে মৃতদেহের ছবি নিতে শুরু করেছে। গুরুং সঙ্গের দু’জন কনস্টেবলকে ওখানে দাঁড়াতে বলে নারানজ্যেঠুকে নিয়ে নীচে নেমে গেছে। ঘরের সামনে শুধু আমি, তাপস, সেই অতি নির্লিপ্ত দু’জন কনস্টেবল আর ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক। ঘরের ভেতরের দিকে তাকালেই আমার বেজায় বমি পাচ্ছিল, তাই আমি বারান্দার দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলাম। সেখান থেকেই একবার উঁকি দিয়ে দেখলাম যে লজের সামনে কৌতূহলী জনতার ভিড় ক্রমেই বাড়ছে, আর আমি ভাবছি এদের এড়িয়ে নামব কী করে। এমন সময় তাপস আমার কাঁধে হাত রেখে স্বাভাবিক স্বরে বলল, “চিন্তা করিস না, বিল্ডিং-এর পেছনে একটা সিঁড়ি আছে ওখান দিয়েই কেটে পড়ব। বাড়ি চল। কেস খুবই জটিল হয়ে উঠেছে, জ্যেঠুর সঙ্গে অনেক কথা আছে।”  

.

*

সন্ধে সাতটা। নারানজ্যেঠুর বাংলো থেকে তাকালে পাহাড় আর উপত্যকার বুক জুড়ে নেমে আসা ঘন অন্ধকার দেখা যায়। আর দেখা যায় অন্ধকারের বুকে জেগে থাকা পাহাড়ের গায়ে বসানো বস্তির আলোর বিন্দু। সেই হিম-হিম উপত্যকার বুক থেকে পাকিয়ে-পাকিয়ে উঠে আসছিল আশ্বিনের রাতের কুয়াশা। আমরা চারজন তার মধ্যে জবুথবু হয়ে বসে ছিলাম।

শীতটা অবশ্য আমার আর তাপসেরই বেশি লাগছিল। বাকি দু’জন, অর্থাৎ নারানজ্যেঠু আর গুরুংয়ের অতটা ঠান্ডা লাগছিল না। হাজার হোক, ওরা এখানকারই লোক।

কথাটা শুরু করল গুরুংই, “এইবার বলুন তো মাস্টারসা’ব, আমাকে মিথ্যে কথাটা বলার দরকার কী ছিল?”

নারানজ্যেঠু বিস্ময়ের ভান করলেন, “কোথায় মিথ্যে কথা বললাম?”

অন্ধকারের মধ্যেও গুরুংয়ের বাঁকা হাসিটা নজর এড়াল না আমাদের। একটু ঝুঁকে পড়ে ও বললো, “মাস্টারসা’ব, আমি পুলিশ, আপনি টিচার। আমি ব বলতে বন্দুক বুঝি, আপনি বোঝেন বই। আমাকে এ-সব মিথ্যে কথা বলে লাভ আছে?”

আমরা টান-টান হয়ে বসলাম। মনে হচ্ছে একটা শো ডাউন হতে চলেছে। নারানজ্যেঠু দেখলাম মাথা নিচু করে বসে আছেন।

কিন্তু কোথায় কী? আমাদের সব আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে গুরুং খুব নরম স্বরে, আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “লোকটা কে মাস্টারসা’ব? আমাকে সব কিছু খুলে বলবেন প্লিজ?”

অন্ধকারের মধ্যেও জ্যেঠুর ইতস্ততভাবটা আমার নজর এড়াল না। মনে হল যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন তিনি। তারপর ধীর স্বরে বললেন, “দোরজে, ওর নাম তাশি দোরজে। ও একজন অষ্টমহাসিদ্ধ।”

.

*

নারানজ্যেঠু অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। আকাশ থেকে তখন ঠান্ডা নীল আলোর স্রোত নেমে আসছিল রহস্যময় কুয়াশার মতো। তারই মধ্যে হরসিং হাট্টার বস্তি থেকে অতি ক্ষীণভাবে ভেসে আসছিল উচ্চকিত স্বরে গাওয়া নেপালি গান ‘ওয়রি যমুনা পারি যমুনা, যমুনাকো ফেডেইমা মনোকামনা’। এই গানটা আজ সকালেই আমরা অন্তত বার দশেক শুনেছি, নারানজ্যেঠুর গাড়িতে যেতে-যেতে, টেপ রেকর্ডারে।

“আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভ্যাগাবন্ডের মতো এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, এ-কাহিনি বোধহয় তোমরা সবাই জানো।” মৃদুস্বরে বলতে শুরু করলেন নারানজ্যেঠু। আমরা তিনজনেই আরও ঘনিয়ে এলাম গল্পটা শুনব বলে।

“তখন আমার মা মারা গেছেন। তার পরেই আমি চাকরিটা ছেড়ে দিই। বাপ-দাদারা যথেষ্ট টাকা রেখে গেছিলেন, তাই টাকার অভাব আমার কোনওদিনই ছিল না। যেটার অভাব ছিল, সেটা হচ্ছে সাহচর্যের। মা মারা যেতে আমি প্রায় পাগল হয়ে গেছিলাম। আমার শুধু মনে হত যে আমার মা নেই, এই দুনিয়ায় আমার দেখভাল করার মতো কেউ নেই। আমি একা, আমি অনাথ।

‘জানি কথাগুলো শুনে তোমরা হয়তো আমাকে পাগল ভাবছ। কিন্তু তপুর বাবা মানে, অসীম অন্তত বলতে পারবে আমার জীবন কতটা একলা কেটেছে, আর কেন আমি মা মারা যাওয়ার পর এমন দিশাহারা হয়ে গেছিলাম।

‘ছাত্রাবস্থায় আমি ঘোরতর ঈশ্বর অবিশ্বাসী ছিলাম, গোঁড়া নাস্তিক বললেই চলে। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর আমার সেই বিশ্বাস টলে গেল। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, মানুষ মৃত্যুর পর কোথায় যায়? এই যে আমার মা মারা গেছেন, তিনি মরে যাওয়ার পর কোথায় গেছেন? তিনি কি দেখতে পাচ্ছেন যে তাঁকে হারিয়ে আমি কত কষ্টে আছি?

‘এই নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে-করতেই পরলোকতত্ব বা প্রেততত্বের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়। আস্তে-আস্তে আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে এ-বিষয়ে লেখা বইপত্র বা অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করি। দিনে-দিনে আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। আমি ন্যাশনাল লাইব্রেরিসহ আশেপাশের সমস্ত লাইব্রেরিতে এই সংক্রান্ত বিষয়ে রাখা সমস্ত বইপত্র পড়তে শুরু করি।

‘এই করতে-করতে একদিন এই ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকেই আমি দৈবাৎ একটি অতি দুষ্প্রাপ্য বইয়ের খোঁজ পাই। তার নাম ‘প্র্যাকটিসিং দ্য কাল্ট অফ ডেড অ্যাওকেনিং ইন অ্যানশিয়েন্ট বেঙ্গল’। লেখকের নাম অ্যালান জেমস মুর। বইটা তখন আউট অফ অফ প্রিন্ট, বোধহয় লাস্ট কপিটাই ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ছিল।

‘এই বইতে জেমস সাহেব একটি অদ্ভুত কথা বলেন। তিনি জানান যে এগারোশো থেকে তেরোশো শতাব্দীর মধ্যে এই বাংলার উত্তরদিশায় এমন একদল গোপন বৌদ্ধতান্ত্রিক দলের জন্ম হয়, যাঁরা নাকি মৃতদের আত্মাকে জাগ্রত করার পদ্ধতি জানতেন। তাঁদের সাধনপদ্ধতি ছিল খুবই মারাত্মক এবং বিপজ্জনক। এই মৃত আত্মা জাগানোর জন্য তাঁরা এক অত্যন্ত ভয়ঙ্করদর্শন দেবতার পুজো করতেন।”

“চক্রসম্বর?” প্রশ্ন করল তাপস।

নারানজ্যেঠু সম্মতি দেওয়ার ভঙ্গিতে ঘাড় হেলালেন। আমার গা-টা কেমন যেন শিরশির করে উঠল। আড়চোখে দেখলাম যে গুরুং-ও একটু নড়েচড়ে বসল।

“এই জেমস সাহেব আরও লিখেছেন যে বৌদ্ধতান্ত্রিকদের এই গোপন দলটি কোনও মূর্তি নয়, একটি পুঁথিকে নিজেদের ইষ্টদেবতা মনে করেন। তাতে চক্রসম্বরের পূজার বিধিমন্ত্র এবং মৃতদের আত্মা জাগ্রত করার পদ্ধতি লেখা আছে। এই পুঁথিটি তাঁদের কাছে এতই পবিত্র যে তাঁরা সেটিকে সদাসর্বদা চোখের মণির মতো রক্ষা করে চলেন। দেখা বা পড়া তো দূরস্থান, তাঁদের সর্বোচ্চ গুরুকে বাদ দিয়ে আর কারও সেই পবিত্র পুঁথিটি স্পর্শ করার অধিকার অবধি নেই। সেটি রাখাও থাকে একটি অতি সুরক্ষিত জায়গায়। কেবলমাত্র বিশেষ-বিশেষ চক্রসাধনার দিনেই সেটিকে বাইরে আনা হয়। এবং এখানেই শেষ নয়, হুইটলার সাহেব আরও একটি অতি ইন্টারেস্টিং কথা লিখেছেন। আর সেটিই এই বইটির গুরুত্ব আমার কাছে বহুদূর বাড়িয়ে দেয়।”

আমরা নড়েচড়ে বসলাম, আমরা কাহিনির মূল খণ্ডে প্রবেশ করছি এবার। নারানজ্যেঠু দু’হাতে মাথার রগ টিপে বসে ছিলেন। সেই অবস্থাতেই ফের বলতে শুরু করলেন তিনি।

“তিনি লিখেছেন যে পুঁথিটির নিরাপত্তার জন্য আটজন বিশিষ্ট বলশালী ও পরাক্রমশালী তান্ত্রিক নিয়োগ করা হয়। তাঁরা বিষ, ওষধি সহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োগ তো জানতেনই, খালি হাতের মারামারি বা হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট স্কিলেও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। পুঁথিটিকে রক্ষা করার জন্য এঁরা যেমন অবলীলায় প্রাণ নিতেও পারতেন, তেমন প্রাণ দিতেও পারতেন। এই আটজনকে একত্রে বলা হত অষ্টমহাসিদ্ধ। তাঁরাই ছিলেন পুঁথিটির রক্ষক, কিপার অফ দ্য বুক।”

একটানে এতটা বলে থামলেন নারানজ্যেঠু। সেই সুযোগে প্রশ্ন করল তাপস, “তা এই পুঁথি বা অষ্টমহাসিদ্ধদের ব্যাপারে আর কোনও ইতিহাসবিদ কি কিছু বলেছেন? মানে আর অন্য কোনও রেফারেন্স? আপনি নিজেও তো ওই পিরিয়ডটার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ।”

ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন জ্যেঠু, “না, এই গোপন তান্ত্রিক গোষ্ঠীর ব্যাপারে আর কোত্থাও কোনও রেফারেন্স নেই। কেন নেই সেটা বলা অবশ্য সহজ, বইটা পড়লেই সেটা বোঝা যায়। জেমস মুর সাহেবের বক্তব্যটাই দাঁড়িয়ে আছে, ‘তোমরা বিশ্বাস করো, পুঁথিটা আমি দেখেছিলাম, আর ওদের সে-সব গোপন কার্যকলাপ আমি স্বচক্ষে দেখেছি’ মার্কা দাবির ওপর, স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। ফলে এইরকম দাবির ওপর ভিত্তি করে কোনও তথ্যকে প্রমাণিত বলে মেনে নেওয়াটা যে-কোনও সুস্থবুদ্ধির ইতিহাসবিদের পক্ষে ইমপসিবল।”

“এটাই কি সেই পুঁথি যেটা নিয়ে আপনাকে হুমকি চিঠি পাঠানো হচ্ছে?” প্রশ্নটা গুরুং-এর।

“হ্যাঁ।” ছোট্ট করে জবাব দিলেন নারানজ্যেঠু। তারপর সামান্য দম নিয়ে বলতে শুরু করলেন, “বলা বাহুল্য, এই বই পড়ামাত্র আমার কৌতূহল চতুর্গুণ বেড়ে যায়। তখন আমি যে শুধু প্রেততত্বে ঘোর বিশ্বাসী তা নয়, সে-নিয়ে প্রেতচক্র ইত্যাদিও বসানো শুরু করেছি। তার ওপর সহজিয়া বাংলায় লেখা ‘চক্রসম্বর সাধনমালা’-র কথা শুনে বাংলার ইতিহাসের ওপর আমার পুরোনো ইন্টারেস্টটা ফিরে আসে। ফলে আমি পূর্ণ উদ্যমে এই পুঁথি নিয়ে খোঁজখবর শুরু করে দিই।

‘এই নিয়ে নাড়াঘাঁটা করতে-করতে আমার প্রায় মাস-ছয়েক কেটে যায়। সেই সময় প্রায়ই দেখতাম যে আরও এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এসে এই একই বিষয়ে বইপত্র খুঁজছেন বা পড়ছেন। বলা বাহুল্য, দু’জনেরই ইন্টারেস্ট এক বলে আলাপ জমে যেতে দেরি হল না। ইনি ছিলেন বারাসতের কামিনীমোহন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক। ভদ্রলোকের নাম অব্যয়বজ্র দত্ত। নামখানা ভারিক্কি হলে কী হবে, একেবারে মাটির মানুষ আর সেইরকমই পণ্ডিত ব্যক্তি। বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে তিনিও অনেকদিন ধরেই গবেষণা করছিলেন।

‘এরকমই কোনও এক সেপ্টেম্বর মাসের বাদলা দিনে আমরা দু’জনে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বসে গবেষণা করছি, বাইরে ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে, সেই সময় এই ভদ্রলোক আমাকে একটা অদ্ভুত প্রস্তাব দেন।”

.

*

প্রস্তাবের কথাটা আর জানা হল না, কারণ কোনও নোটিশ না দিয়েই হুড়মুড়িয়ে আমাদের সঙ্গে সকালে আলাপ হওয়া শখের ইতিহাসবিদ দত্তসাহেব এসে হাজির, সঙ্গে আরও একজন ভদ্রলোক। দুটো চেয়ার ফাঁকাই রাখা ছিল, তারই একটাতে ধপ করে বসে দত্তসাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “এ কী কথা শুনছি নারান, পুলিশ নাকি তোমাকে কোনও একটা খুন হওয়া ভ্যাগাবন্ডের বডি আইডেন্টিফাই করতে ধরে নিয়ে গেসলো? এ-সব কী কাণ্ড, অ্যাঁ! আমি তো গেসলাম বাগডোগরা। ফেরার পথে ম্যালে দেখি মেলা ভিড়, খোঁজখবর করতে গিয়ে শুনি এই ব্যাপার। আমি তো শুনে অবাক! আরে কোথায় কোন ভিখিরির বাচ্চা খুন হয়েছে, আর সে নাকি খুন হওয়ার আগে তোমার সঙ্গে রাস্তায় দেখা করেছে বলেই তোমাকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করতে হবে, অ্যাঁ? আর আজকালকার পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লোকগুলোকেও বলিহারি যাই বাবা। কোথা থেকে কতগুলো অপদার্থ এসে জুটেছে। কাজের নামে অষ্টরম্ভা, শুধুমুধু লোকজনকে হ্যারাস করা।”

“পুলিশ শুধু-শুধু কাউকে হ্যারাস করার জন্য মাইনে পায় না দত্তবাবু।” অন্ধকারের মধ্যেই চিবিয়ে-চিবিয়ে কথাগুলো বলল গুরুং, “আর আমরা মাস্টারসা’বকে গ্রেফতার করিনি, জাস্ট হেল্প করতে বলেছিলাম। আশা করি সেটা এমন কিছু অপরাধ নয়।”

দত্তবাবু বোধহয় গুরুংকে প্রথমে লক্ষ করেননি। কথাটা শুনে একটু অপ্রস্তুতই হলেন প্রথমে। তবে সেটা মুহূর্তেকের জন্য, পরক্ষণেই তেড়েফুঁড়ে উঠে বললেন, “তাহলে নারানকে নিয়ে এই নাহক টানাহ্যাঁচড়া করার মানেটা কী শুনি? আমার তো রোজই কত লোকের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়, তাদের কারও কিছু হলেই আমাকে দৌড়তে হবে নাকি, অ্যাঁ?”

“হবে বৈ কি।” গম্ভীরমুখে বলল গুরুং, “বিশেষ করে আপনার সঙ্গে দেখা করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কেউ যদি রহস্যজনকভাবে খুন হয়, তাহলে আপনাকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করা হতেই পারে, সেটা আমাদের ডিউটির মধ্যেই পড়ে। যদি আপনিই খুন করে থাকেন তাহলে?”

ঝগড়া যে একটা পাকিয়ে উঠছিল সে বলাই বাহুল্য। নারানজ্যেঠু হাঁ-হাঁ করে মাঝখানে পড়ে ব্যাপারটা সামলে নিলেন। দত্তসাহেবকে বললেন, “আরে তেমন কিছু হয়নি দাদা। লোকটা তামাক চাওয়ার অছিলায় গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে চাইছিল, পাত্তা দিইনি বলে কেটে পড়ে। আর আমিও বাড়ি চলে আসি। তারপর শুনি এই কাণ্ড। তা পুলিশের কাজ পুলিশ তো করবেই, তাতে আর রাগ করে কী হবে দাদা? আর তাছাড়া গুরুং অতি ভালো ছেলে, আমাকে সে বিন্দুমাত্র অসম্মান করেনি। আপনি আর ও-নিয়ে উত্তেজিত হবেন না প্লিজ।”

কথাটায় কাজ হল, দু’পক্ষই একটু শান্ত হলেন। এ-ও বুঝলাম যে ওই অষ্টমহাসিদ্ধ’র ব্যাপারটা এখানে বলতে চাইছেন না জ্যেঠু। আমরাও ব্যাপারটা চেপে গেলাম।

দত্তসাহেব এবার একটু ঘুরে তাঁর সঙ্গে আসা অতিথির সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিলেন, বললেন “যাকগে যাক। আলাপ করিয়ে দিই, ইনি প্রফেসর যাদব, জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের প্রফেসর। এঁর রিসার্চের সাবজেক্ট হচ্ছে ভারতের মধ্যযুগের পুরোনো পুঁথিপত্র। এঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয় কলকাতা ইউনিভার্সিটির একটা সেমিনারে। তার পর থেকে এঁর সঙ্গে আমার পত্রালাপ ছিল অনেকদিনই। তা গত চিঠিতে জানতে পারলাম যে ইনি দার্জিলিং ঘুরতে আসছেন। ব্যাস, শোনামাত্র নিজের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে ফেলেছি। এঁকে রিসিভ করতেই আজ বাগডোগরা গেসলুম। ফেরার পথে শুনি এই কাণ্ড।”

প্রফেসর যাদব হাত তুলে নমস্কার করলেন। আমরাও প্রতি নমস্কার করলাম। তারপর আমাদের চমকে দিয়ে প্রফেসর যাদব স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণে বললেন, “অনেকদিন বাদে এই চত্বরে এসে বেশ থ্রিলিং লাগছে কিন্তু। সেই কলেজে পড়ার সময় লাস্ট এসেছিলাম, তারপর এই। ইচ্ছে আছে দিন তিনেক থাকব। আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে খুব ভালো লাগল। আশা করছি এবারের ছুটিটা ভালোই কাটবে।”

আমরা তো থ! দত্তসাহেব দেখি মিটিমিটি হাসছেন, ভাবখানা কেমন সারপ্রাইজ দিলুম! প্রফেসর সাহেব বোধহয় আমাদের অবাক হওয়ার ভাবটা উপভোগ করলেন খানিকক্ষণ, তারপর সহাস্যে বললেন, “আরে দাদা আমি মাণিকতলার ছেলে। বড় হওয়া, পড়াশোনা সবই এখানে। প্রথমে স্কটিশচার্চ, তারপর প্রেসিডেন্সি। বাংলাটা আমি কোনও বাঙালির থেকে খারাপ বলি না।”

আড্ডাটা বেশ জমে গেল। দত্তসাহেবের কথাতেই জানতে পারলাম যে প্রফেসর যাদব ভারতের মধ্যযুগের বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। এ-বিষয়ে ইনি দীর্ঘদিন রিসার্চ করছেন, এমনকি বাইরের বেশ কিছু ইউনিভার্সিটিতে লেকচারও দিয়ে এসেছেন। একই বিষয়ের একজন এক্সপার্টকে পেয়ে জ্যেঠুও বলা বাহুল্য বেশ উৎসাহী হতে উঠলেন।

কথায়-কথায় চক্রসম্বরের পুঁথির কথাটা উঠল। জ্যেঠুর বোধহয় এ-ব্যাপারে বিশদে বলতে খুব এক ইচ্ছে ছিল না। তবুও দত্তসাহেবের পীড়াপীড়িতে বলতেই হল। প্রফেসর যাদব তো পুরো ব্যাপারটা শোনামাত্র লাফিয়ে উঠলেন, “কী বলছেন কী নারায়ণবাবু! দত্তবাবু আভাস দিয়েছিলেন বটে। কিন্তু এ-যে রিমার্কেবল আবিষ্কার, বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের ইতিহাসটাই পালটে যাবে ! ইতিহাসে আপনার নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে যে মশাই।”

দত্তবাবু বেশ প্রসন্ন হাসি হাসলেন, “কী প্রফেসর সাহেব, কী বলেছিলাম আপনাকে? একটা সারপ্রাইজ দেব বলিনি?”

অন্ধকারেও দেখলাম প্রফেসর যাদবের চোখ বেশ জ্বলজ্বল করছে। তিনি একটু ঝুঁকে এসে প্রশ্ন করলেন, “পুঁথিটা একবার দেখা যায়?”

জ্যেঠু সবিনয়ে জানালেন যে পুঁথিটা উনি কাউকেই দেখাচ্ছেন না। তার কারণটাও সবিস্তারে বলতে হল। এমনকি হুমকি চিঠিটার কথাও উঠল। প্রফেসর যাদব ও-সব ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন, “এই লাইনে এ-সব উটকো চিঠিফিঠি এসেই থাকে দাদা। ও-সবে ভয় করলে চলে? এই তো দেখুন না, আমার কাছেই ফোনে বা চিঠিতে কতশত প্রলোভন বা হুমকি আসে। তার একটাকেও কি আমি পাত্তা দিই? দিই না। আমার কথা শুনুন, আপনিও এ-সবে একদম পাত্তা দেবেন না। আমার মনে হয় না আপনার ভয় পাওয়ার কোনও কারণ আছে বলে।”

নারানজ্যেঠু কিছু বলার আগেই প্রশ্নটা করল গুরুং, “কেন, আপনার কাছে হুমকি বা প্রলোভন আসে কেন?”

এই প্রথম আমি কাউকে শব্দ না করে হা-হা করে হাসতে দেখলাম। সেই হাসি দেখে জানি না কেন আমার গা-টা শিরশির করে উঠল।

হাসি থামলে পর প্রফেসর যাদব বললেন, “আপনারা প্রায়ই শোনেন না যে গাঁও দেহাতে কারও বাড়িতে, অথবা কোনও পুরোনো জমিন্দার হাভেলির লাইব্রেরি বা দলিল দস্তাবেজের মধ্যে পুরোনো পুঁথি খুঁজে পাওয়া গেছে? মাঝে-মাঝেই লোকে তাদের বাপ-দাদার জমানার পুঁথিপত্র খুঁজে পায়। তো আজকাল এ-সব কেউ নিজের হাতে রাখে না। রেখে করবেটাই বা কী? অনেকেই আমাদের কাছে, মানে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে দিয়ে যান। আর যদি পরিবারে চালাক-চতুর কেউ থাকে, তাহলে সে এ-সব পেলেই বেচে দেওয়ার ধান্ধা করে, যদি হাতে কিছু কাঁচা টাকা আসে সেই ভেবে।”

“কিন্তু এ-সব কেনে কারা?” বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।

কথাটা শুনে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন প্রফেসর যাদব। তবুও তাঁর ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা বাঁকা হাসিটা এই অন্ধকারের মধ্যেও আমার নজর এড়াল না। উনি বললেন, “কেনার লোকের কি অভাব আছে দাদা? জানি না আপনারা জানেন কি না, এ-সব পুরোনো পুঁথির ভালো ডিমান্ড আছে বিদেশি কালেক্টরদের কাছে। আর তেমন-তেমন হিস্টোরিক্যাল সিগনিফিক্যান্স থাকলে এ-সব পুঁথির দাম কোটিখানেক হওয়াও বিচিত্র নয়।”

“কিন্তু তাতে আপনার কাছে ধমকি চিঠি আসার কারণটা কী?” গুরুংয়ের দিক থেকে প্রশ্নটা তিরের মতো ধেয়ে এল।

“মুশকিল হচ্ছে যে এই সার্কিটে জাল পুঁথিও ঘুরে বেড়ায় খুব বেশি। পুঁথি জাল করাও অতি উচ্চদরের আর্ট, সে-নিয়ে আপনাদের জ্ঞান না-হয় পরে একদিন দেব। কিন্তু কথা হচ্ছে যে, যে-সব বিদেশি কালেক্টররা গাদাগুচ্ছের ডলার ঢেলে এ-সব কেনেন, তার অথেন্টিসিটি তাঁরা একেবারে বাজিয়ে দেখে নেন। তাঁরা আবার যেমন তেমন লোকের সার্টিফিকেশন নিয়ে সন্তুষ্ট হন না, এই সার্কিটে সার্টিফায়ার হিসেবে নাম আছে, একমাত্র তাঁদের অথেন্টিকেশনটাই চাই।

‘হয়তো অহঙ্কারের মতো শোনাবে, তবুও বলি যে ভারতের মধ্যযুগের পুঁথিপত্রের ব্যাপারে আমার থেকে বেশি জানকারিওয়ালা লোক এই দেশে খুব বেশি নেই। এই লাইনে এক্সপার্ট হিসেবে আমার কিছু সুনাম আছে। ফলে এই কারবারের জগতে আমার দেওয়া সার্টিফিকেটের যে কিছু মূল্য থাকবে সে আর বিচিত্র কী? তাই আমার কাছে হামেশাই প্রচুর পুরোনো পুঁথি আসে অথেন্টিকেশনের জন্য। আপনাদের বলতে বাধা নেই, সেই সুবাদে আমার কিছু আয়ও হয়, তার পরিমাণ কিছু কম না। ফলে বুঝতেই পারছেন যে কাজটা কতটা ঝুঁকির। তো আমার কাছে থ্রেটনিং চিঠি আসবে না তো কার কাছে আসবে বলুন?”

কথা শেষ হওয়া মাত্র একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসল গুরুং, “এ-সব পুঁথিপত্র দেশের বাইরে চালান করাটা বেআইনি না?”

প্রথমে সরু একটা চাউনি যেন লক্ষ করলাম প্রফেসর যাদবের চোখে। তবে সেটা সামলে নিয়েই বললেন তিনি, “কিছু পুঁথিপত্র বাইরে চালান করা অবশ্যই বেআইনি, বিশেষ করে ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এমন পুঁথি। তবে সে-সবে আমি নিজেকে বিলকুল জড়াই না, জানা-মাত্র হাত উঠিয়ে নিই। আর আমার কাছে তো আর বায়ার, মানে ক্রেতারা সরাসরি আসেন না, পুরো ডিলটাই হয় দালালের মাধ্যমে। এখন সে যদি এসে বলে যে সে শখের ইতিহাসবিদ, বা কোনও কলেজের প্রফেসর, তাহলে আমার আর কী-ই বা করার থাকে বলুন? ব্যাপারটাকে আমি তখন প্রফেশনালি দেখি। একহাতে সার্টিফিকেট দিই, আরেক হাতে টাকা নিই।”

উত্তরটা মনে হয় সন্তুষ্ট করল না গুরুংকে। ভুরু কুঁচকে কী যেন একটা ভাবতে লাগল।

এই সুযোগে দত্তসাহেব জ্যেঠুকে জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে পুঁথিটার ব্যাপারে কী ঠিক করলে নারান?”

“আপাতত আমার কাছেই এনে রেখেছি দাদা। গুরুং আপাতত একটা সিকিউরিটির জন্য লোক দেবে বলেছে। কালই ও-জিনিস আমি অন্য কোথাও পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। এমনিতেও পুঁথিটা আমার প্রায় পুরোটাই কপি করা হয়ে গেছে। এবার ওটা হাতে রেখে কোনও লাভ নেই।”

দত্তসাহেব কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আর শোনা হল না, কারণ ঠিক তখনই লোবসাম এসে খবর দিল যে গুরুংয়ের ড্রাইভার বলছে একবার বড়াসা’বকে থানায় যেতে হবে এক্ষুনি, ওই তাশি দোরজের ব্যাপারে কী-একটা খবর এসেছে। গুরুং শোনা-মাত্র উঠে পড়ল, শুধু যাওয়ার আগে বলে গেল যেন পরের কয়েকটা দিন জ্যেঠু দার্জিলিংয়ের বাইরে না যান, তাতে ওর তদন্তের অসুবিধা হবে। জ্যেঠু লোবসামকেই বললেন গুরুংকে দরজা অবধি এগিয়ে দিতে।

ওরা বেরোতেই প্রফেসর যাদব আরও ঝুঁকে এলেন জ্যেঠুর দিকে, বললেন, “আমি দার্জিলিং থেকে চলে যাওয়ার আগে কপিটা অন্তত একবার আমাকে দেখাবেন তো?”

নারানজ্যেঠু একটু কুণ্ঠিতস্বরে বললেন, “আরে এ-রকম করে বলছেন কেন প্রফেসর। আপনি এই বিষয়ে একজন এক্সপার্ট, আপনাকে একবার না দেখালে আমার চলবে?”

প্রফেসর যাদব উঠে পড়লেন, দেখাদেখি দত্তসাহেবও। যাওয়ার আগে হ্যান্ডশেক করে শুধু একটা কথাই বললেন প্রফেসর যাদব, “আমাকে প্রফেসর বলে ডাকবেন না দাদা, আমি আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট, আমাকে যোগেন্দ্র বলে ডাকবেন। দত্তবাবুও আমাকে নাম ধরেই ডাকেন।” জ্যেঠু একগাল হেসে বললেন, “তথাস্তু।”

সেদিন রাতে শোওয়ার সময় দেখি তাপস বিছানায় শুয়ে ভয়ানক ভাবে ভুরু কুঁচকে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একবার-দু’বার ডেকে দেখলাম সাড়া দিচ্ছে না। শেষে কাছে গিয়ে পেটে একটা খোঁচা দিতে আমার দিকে ফিরে তাকাল। আমি বললাম, “কী রে, কী এত উথাল-পাতাল ভাবছিস?”

অন্যমনস্ক ভাবে তাপস বলল, “কতগুলো খটকা মনের মধ্যে জেগে আছে রে। সলভ করতে পারছি না।”

“যেমন?”

“এই যেমন ধর দেবাশিস বণিক মশাই। প্রথম দিন উনি যখন গাড়ি থেকে নেমে আমাদের সঙ্গে চা আর ম্যাগি খাচ্ছিলেন, ওঁর জুতোটা ভালো করে লক্ষ করেছিলি?”

মাথা নাড়লাম। খামোখা আমি একটা লোকের জুতো লক্ষই বা করতে যাব কেন?

“যে লোকটা এয়ারপোর্টে নেমে সোজা গাড়ি ধরে দার্জিলিং যাচ্ছে, তার জুতোতে অত ফার্ন আর কাদা লেগে থাকবে কেন? আর সাধারণ একজন কিউরিও শপের মালিক মিলিটারি গ্রেড জুতো পরবেই বা কেন?”

“তুই ঠিক জানিস ওটা মিলিটারির জুতো?”

“একদম সেন্ট পার্সেন্ট শিওর। শুধু কি তাই? খটকা আরও আছে। যেমন ধর ওই তাশি দোরজে, মানে যে লোকটা খুন হয়েছে, সে যে খুন হওয়ার আগে জ্যেঠুর সঙ্গে দেখা করেছে, সেটা গুরুং জানল কী করে?”

“না জানার কী আছে? বোকার মতো কথা বলছিস।” এবার প্রতিবাদ করতেই হল, “ওরা পুলিশ, ওরা জানবে না?”

আমার দিকে ত্যারচা চোখে তাকাল তাপস, “সে আর জানবে না কেন। তাই বলে অত তাড়াতাড়ি? লোকটা যখন জ্যেঠুর সঙ্গে কথা বলছে তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। তারপর আমরা চলে এলাম। গুরুং এল দুপুর আড়াইটে নাগাদ। ততক্ষণে ওর কাছে খবর চলে এসেছে যে একটা লোক ড্যাফোডিল লজে খুন হয়েছে, সেটা বোঝা যায়। কিন্তু তখনও ও ডেডবডি দেখেনি, অথচ খুন হওয়ার আগে ওই লোকটা যে জ্যেঠুর সঙ্গে দেখা করেছে সে-খবরটা ও জানল কী করে?”

“কী করে জানলি তুই যে ও ডেডবডিটা আগে না দেখেই জ্যেঠুকে নিয়ে যেতে এসেছে?” চ্যালেঞ্জ করার ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলাম।

তাপস খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল, “নাহ্, কাকিমা ঠিকই বলেন। ব্যায়াম করে করে তোর সব বুদ্ধি হাঁটুতে গিয়ে জমা হয়েছে। শুনলি না লজের ম্যানেজারকে গুরুং জিজ্ঞেস করল খুনটা কোথায় কোন রুমে হয়েছে? আগে গিয়ে দেখে এলে কি আর প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করত?”

অকাট্য যুক্তি। ফলে মনে মনে বেজায় চটে গেলেও খোঁচাটা চুপচাপ হজম করে নিলাম। তবে তর্ক করতে ছাড়লাম না, “ওদের তো চর আছে এদিক-ওদিক। তারাই নিশ্চয়ই জানিয়েছে। পুলিশের সোর্স থাকে শুনিসনি?”

আমার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল তাপস তাপস, “না শোনার কী আছে? কিন্তু দার্জিলিং পুলিশ কি সব্বার ওপরে স্পাইগিরি করে বেড়ায়? নিশ্চয়ই না। তাহলে পুলিশের স্পাই এত তাড়াতাড়ি কী করে জানল যে এই তাশি দোরজে মারা যাওয়ার আগে জ্যেঠুর সঙ্গে দেখা করেছে?”

“তার মানে নিশ্চয়ই স্পাই বা পুলিশ ওর ওপর আগে থেকেই নজর রাখছিল।”

“এই তো বুদ্ধিটা হাঁটু থেকে কোমর অবধি উঠে এসেছে দেখছি। তা বাপু এবার কিডনি খাটিয়ে বলো দেখি পুলিশের লোক কাদের ওপরে সবসময় নজর রাখে?”

“কেন, কোনও সাসপেক্ট বা ক্রিমিনালদের ওপরে।” সদর্পে বললাম আমি। আর বলেই বুঝলাম কী বলে ফেলেছি!

আমার মুখের অবস্থা দেখে বোধহয় দয়া হল তাপসের, আমাকে আর ঘাঁটাল না সে। দেখি ও শোয়া অবস্থা থেকে উঠে, একটা বালিশ বুকে চেপে ধরে বসে আছে। মাথার ওপরে একটা ষাট পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছিল, সেই বাল্বের অল্প দুলুনিতে আমাদের ছায়া পড়ছিল মেঝেতে। সেদিকে তাকিয়ে ভারি অন্যমনস্ক স্বরে বলল তাপস, “কিন্তু আসল খটকাটা অন্য জায়গায়, বুঝলি। আজ সারাদিন যা কথাবার্তা শুনেছি, তাতে কেউ একজন এমন একটা কথা বলেছে যা লজিক্যালি কারেক্ট হতে পারে না। মানে ধর ওই কালীপুজোর রাতে নদীর চরে জ্যোৎস্নায় দেখার মতো বা গুড ফ্রাইডের ছুটি রোববারে পড়ার মতো একটা কথা, যেটা হওয়া অসম্ভব। মুশকিল হচ্ছে যে, খটকাটা মাথার মধ্যে বিঁধে আছে বটে, কিন্তু কে যে কখন কী বলল সেটা বুঝতেই পারছি না। অস্বস্তিটা মনের মধ্যে বড়ই জ্বালাচ্ছে রে।”

আমার আর কথা শোনা হল না। কারণ ততক্ষণে আমার দু’চোখ জুড়িয়ে আসছে। আমি আমার বিছানায় গিয়ে শোয়া মাত্র গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

আসল ঘটনা শুরু হল পরের দিন ঠিক সকাল থেকে।  

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *