সেলেব্রিথ্রি

সেলেব্রিথ্রি

বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে যে বছর আমি ইঞ্জিনিয়ারিঙের ডিগ্রি অর্জন করি, সেটা ছিলো ২০০২। তার একবছর আগে জনৈক আট্টা এবং তাহার সহযোগীরা বোধহয় খানিকটা অন্যমনস্ক হয়েই ওয়ার্ল ট্রেড সেন্টারে দু-দুটি সস্তার প্লেন ঢুকিয়ে দিয়ে এই মরজগতের যাবতীয় জিহাদিদের চোখে দোসরা তারেক বিন জিয়াদ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে পড়েছেন। তদুপরি হোপ এইট্টিসিক্স থেকে শুরু করে তারামায়ের পদাশ্রয়ী, ‘ভোটে বাইরের লোক নিয়ে আসা আমাদের ঐতিহ্য’খ্যাত বীরবিপ্লবী শ্রীসুভাষও মৃদুমন্দ হাস্যধ্বনিসহ ‘আহা, এহেন অসামান্য কাজ করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতুম’ বলে এতদ্দেশীয় গুপ্তজিহাদিদের বিপুল হর্ষবর্ধন করছেন, এমন সময় আমরা, মানে কলেজে আমাদের ব্যাচের শচারেক ইঞ্জিনিয়ারিং এর লোকজন দেখলুম ভারি আতান্তরে পড়েছি!

আগে গোটা ব্যাচের আদ্ধেক চাকরি করতে যেত, আদ্ধেক যেত উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে। সেই বাজারে আদ্ধেক নয়, আমাদের মতন গুটিকতক শিকেয়-ছেঁড়া-চাকরি প্রাপ্তদের ছেড়ে, বেশিরভাগ ক্লাসমেটই দীর্ঘশ্বাস ফেলে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশগমনে ব্রতী হয়। এইখানে বলে রাখা ভালো যে এইরকম ”উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশগমনের” ইচ্ছেঠাকুরুণ যে আমার মনেও বাসা বাঁধেননি তা নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, আমার দৃঢ় ধারণা ছিলো আমার ফাইনাল মার্কশিট দেখে বিদেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে যে বিপুল হাস্যরোল উঠবে, সেই কলতরঙ্গ যদি কোনক্রমে গঙ্গা পেরিয়ে এদিকে আসে, তো বাড়িতে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে ধোলাই অনিবার্য। জিআরই আর টোয়েফল পরীক্ষা দেওয়ার ফিজের টাকাটা যে পকেটে ছিলো না সেটাও ঘটনা বটে, আর বোনের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও ঘাড়ের ওপর ছিল, সেটাও মনে রাখতে আমি বাধ্য। তবে কিনা কাঁহাতক আর ‘ও গো, আমি কি গরীব আর অসহায় ছিলুম সে আর বলে বোঝাতে পারবো না’ বলে করুণাফুটেজ খাওয়া বিবেকে পোষায় মশাই?

তা আমার সেই সেই পুণ্যপদাশ্রয়ী বন্ধুবর্গ সেইসব বিশ্ববিশ্রুত বিদ্যালয়সমূহে, আণ্ডার দোজ হ্যালোওড পোর্টালস, অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইয়াছিলো। তারই দুচারিটি স্মৃতিকথা সামান্য ঝাড়পোঁছ করে আপনাদের সামনে রাখলুম। এ সবই যাকে বলে সুনি হুই কাহানিঁয়া, সুহৃদ পাঠকবর্গ প্রমাণ চেয়ে বুকে দাগা দেবেন না বলেই বিশ্বাস!

সেলেব্রিওয়ানঃ

ঘটনার নায়িকা আমার এক অনিন্দ্যসুন্দরী বান্ধবী। না, তাই বলে অমন সন্দেহনয়নে তাকাবার কিছু হয়নি। উচ্চতায় ফুটচারেক,(এবং প্রস্থেও তদ্রূপ) সেই বীরাঙ্গনাটিকে আমরা কলেজেই ঝাঁসির রানীর দ্বিতীয় সংস্করণ বলে অভিহিত করতাম। বস্তুত, পান থেকে চুনের ফেঁটামাত্রেক উৎক্ষেপণে তেনার যা যা রণরঙ্গিণী মূর্তি দেখেছি সে আর কহতব্য নহে। জাত্যংশে রাজপুতানি সেই রায়বাঘিনীর আঁচরের কিছু দাগ এই অধমের শ্রীথোবড়াতেও রয়ে গেছে স্বীকার করতে লজ্জা নেই।

তাই সেই তিনি তখন অনেকানেক মহাত্মার হৃদয়ে বিরহবেদনা উদ্রেককান্তে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে একটি ফুল স্কলারশিপ বাগিয়ে হেথায় সগৌরবে পাড়ি দেন, এই ঘটনা তখনকার।

নেহাত অপ্রয়োজনীয়ই হবে, তবুও এখানে বলে রাখা শ্রেয় যে ভদ্রমহোদয়া নিজেদের পড়াশোনার লেভেল নিয়ে সামান্য ওভারপ্রোটেক্টিভ ছিলেন। আর ফলিত গণিতবিদ্যায় মহিলাটির কিঞ্চিৎ বুৎপত্তি ছিলো। তিনি গেম থিওরি নামক একটি দুরূহ কিন্তু অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক বিষয়ে কথঞ্চিৎ জ্ঞানবর্ধনমানসে কালাপানির ওপারে পাড়ি জমান।

তা গিয়ে বোধহয় এক দুসপ্তাহ হয়েছে। মোটামুটি তখনও গুছিয়ে বসা হয়নি। এক বিকেলে তিনি ক্যাম্পাসে হাঁটতে বেরিয়েছেন। খানিকক্ষণ পর তিনি আবিষ্কার করেন যে তেনার কফিতেষ্টা পাচ্ছে বেশ।

তা টুকটুক করে ক্যাম্পাসের মধ্যেই যে কফিশপটি আছে সেখানে গিয়ে দেখেন যে এক আজব দৃশ্য!

কফিশপের কাউন্টারের সামনে প্রচণ্ড রোগা এবং তালঢ্যাঙা লম্বা এক ভদ্রলোক কফি, চিনি, দুধ এসব নিয়ে খুবই চিন্তাকুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার বন্ধুনিটি কাছে গিয়ে বুঝলেন ভদ্রলোক কফিতে কতটা চিনি এবং দুধ মেশালে ব্যাপারটা খোলতাই হবে সেসব নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। বিড়বিড় করছেন নিজের মনেই, একবার চিনির পরিমাণ মাপছেন, আরেকবার চামচ তুলে নিয়ে কিসব ভাবছেন, মোটামুটিভাবে উনি কফি বানাচ্ছেন না পরমাণু বোমা হাবভাব দেখে বোঝার জো নেই!

আগেই বলেছি, ভদ্রমহোদয়া খানদানি রাজপুতানি, এইসব ছল্লিবল্লি তেনার বিলকুল নাপসন্দ। তিনি বোধহয় কফিশপের সেলসমহিলাটির চোখে ফুটে থাকা সশ্রদ্ধ সম্ভ্রমটি খেয়াল করেননি, কাছে গিয়ে পেছন থেকে সামান্য রূঢ়ভাবেই বলেন ‘বলি একটু না সরে দাঁড়ালে বাকিরাই বা কফি নেবে কি করে মশাই? আমরাও তো লাইনে আছি নাকি?’

ভদ্রলোক থতমত খেয়ে, ”এহেহে ভুল হয়ে গেছে, কিছু মনে করবেন না ভাই” টাইপের মুখ করে এদিকে ঘুরে দাঁড়ান, এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই চার ফুটিয়া মেয়েটির চোখ এবং ছফুটের ওপর লম্বা ভদ্রলোকটির বুক একই সমান্তরাল রেখায় চলে আসে, এবং মহিলার চোখের সামনে ভদ্রলোকের শার্টে আটকে থাকা পরিচয়জ্ঞাপক ব্যাজটি পরিস্ফুট হয়।

সেই ব্যাজে লেখা, ‘প্রফেসর জন ন্যাশ, প্রিন্সটন ইউনিভ’!

ফলিত গণিতবিদ্যার যে কোনও ছাত্রছাত্রীর পক্ষে এরপর দুম করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তার বদলে সেই রাজপুতকন্যাটি যা শুরু করে তাকে ইংরেজি ভাষায় নুইসেন্স ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। সে ‘ও মাই গড জন ন্যাশ, ইউ আর জন ন্যাশ, মাই গুডনেস জন ন্যাশ ইন ফ্রন্ট অফ মি, ও মাই গড, ইউ আর জন ন্যাশ’ বলে মহা শোরগোল তুলে ফেলে। পরে সে অবশ্য স্বীকার করেছিলো যে ভদ্রলোকের মানসিক স্থিতির কথা ভেবে কাজটা উচিৎ হয়নি। কারণ এরপর ভদ্রলোক নাকি ভারি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, এবং ‘আই অ্যাম সরি, আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি দ্যাট আই অ্যাম জন ন্যাশ, ইট উইল নেভার হ্যাপেন এগেইন’ বলতে বলতে উল্টোবাগে দৌড় দেন!

বন্ধুনীটির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এরপর নাকি গেম থিওরির মোস্ট সেলিব্রেটেড পার্সোনালিটি, ”আ বিউটিফুল মাইণ্ড” খ্যাত নোবেল লরিয়েট প্রফেসর জন ন্যাশ পাক্কা দুদিন বাড়ির বাইরে বেরোননি!

সেলেব্রিটুঃ

এই ঘটনাটি টাইম অ্যান্ড স্পেসের কোন অনির্দেশ্য বিন্দুতে ঘটিয়াছিল তার বিশদ বিবরণ, বা কলাকুশলীদের নামধাম পুরোপুরিভাবে খুলে বলতে একটু অসুবিধে আছে। কারণ যাঁরা এই ঘটনার নায়কনায়িকা, সেই দুই কত্তাগিন্নিই নাসাতে উচ্চপদে কর্মরত, শুধু এটুকু বলতে পারি, তেনারা কেউই বঙ্গসন্তান নন।

তা স্থান, বলেই ফেলি, মিশিগানের এক ইউনিভার্সিটি। কাল, এক মেদুর বিকেলবেলা। উপরোল্লিখিত কত্তাগিন্নি ঠিক করলেন অনেকদিন হলো শরীরচর্চাতে ছেদ পড়েছে, একটু হাত পা খেলিয়ে না নিলে আর চলছে না! এই ভেবে তাঁরা ইউনিভার্সিটির স্যুইমিং পুল, যা আড়েবহরে যেকোনও অলিম্পিক পুলকে গুনে গুনে দশ গোল দিতে পারে, সেখানে স্যুইমিং কস্ট্যুম পরেটরে হাজির!

তা দুইজনেই যাকে বলে খাতেপিতে ঘরকে লোগ। ফলে সেই হোঁদলকুতকুত দোঁহাতে যখন পুলে বডি ফেললেন, ছোটখাটো একটা প্রলয়ই হয়ে গেলো প্রায়। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সুচিন্তিত বয়ান অনুযায়ী, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে মাঝেমধ্যে হারিকেন হলে আতলান্তিকে অমন অতলান্তিক ঢেউ ওঠে বটে। আশেপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন, সভয়ে অনেকেই পেছনে সরে গেলেন, ডাঙায় দাঁড়িয়েও নাইতে কারই বা ভালো লাগে বলুন?

তা দুইজনে বেশ করে নেয়েটেয়ে যখন উঠলেন, পুলের আদ্ধেক জল তখন চারিপাশের মেঝেতে ঢেউ খেলছে। তেনারা নিজেদের পারফরমেন্সে ভারি পরিতৃপ্ত হয়ে, স্যুইমিং কস্টিউমের ওপর তোয়ালেস্যুট জড়িয়ে আশেপাশের পুল।পরিদর্শনে বেরোলেন।

তা পাশের পুলে গিয়েই তেনারা আটকে গেলেন। একজন সাঁতারু ছাড়া আর কেউ নেই। তা সেই সাঁতারু ছোকরাটির বয়েস কুড়ির আশেপাশেই হবে, পেটানো পেশীবহুল শরীর, লম্বাটে মুখ। পাশে আরেকজন প্রৌঢ়, তাঁরও বেশ নজরকাড়া স্বাস্থ্য। প্রৌঢ়টি কোচ বা ট্রেইনর হবেন। ছেলেটি মাথা নিচু করে প্রৌঢ়টির কিছু উপদেশ শুনছে। উপদেশশ্রবণ শেষ হলে ছেলেটি ধীরেসুস্থে স্টার্টিং পয়েন্টে এসে দাঁড়ালো, এবং পুলে ঝাঁপ দিলো।

একফেঁটা জল উপচে পড়লো না, বিশেষ কোনও তরঙ্গ উঠলো না, মনে হলো একটি অভিজ্ঞ স্যামন কি কাতলামাছ যেন দ্বিপ্রাহরিক আহারান্তে পাড়া বেড়াতে বেরুলেন!

আমাদের দাদাবৌদি জুটি তো খুবই ইম্প্রেসড! দুইজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন আর মোহিত হতে লাগলেন। আহা, কি স্পিড, কি স্ট্যামিনা, কি অনায়াস মসৃণ ছন্দ। দুইজনেই খানিকক্ষণ বাদে আর থাকতে না পেরে, ‘বাহ বেটা, শাব্বাশ, জিতে রহো, নাজুক নাজুক’ ইত্যাদি বিভিন্নপ্রকার প্রশংসাসূচক এবং উৎসাহব্যঞ্জক শাবাশি ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগলেন। একবার তো ‘তণখা বঢ় জায়েগি তুমহারি’ বলতে গিয়েও চেপে গেলেন, বলা যায় না, পুল থেকে উঠে স্যালারি ইনক্রিমেন্টের চিঠি চেয়ে চেপে ধরলে?

তা দুইজনে তো যাকে বলে খুবই উত্তেজিত, ভাবছেন এমন চৌখস ছেলে এই ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে আগে তো জানতেন না। এমন সময় দেখলেন যে প্রৌঢ় ট্রেইনর ভদ্রলোক ওঁদের পাশেই দাঁড়িয়ে।

এঁরা তো দুইজনে ভদ্রলোককে ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন, আহা, কি তৈরি করেছেন ছেলেটাকে চাবুক, চাবুক! ভদ্রলোক অবশ্য ঘাড়ফাড় নেড়ে ‘আমি তেমন কিছুই করিনি’ বলতে চেয়েছিলেন, এঁরা শুনলে তো। তা সেই প্রবল প্রশংসাসুনামি থামলে দুইজনেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এমন ছেলেকে তো আরও বড় এরেনাতে প্রেজেন্ট করা উচিৎ, তাই না?’ ভদ্রলোক চিন্তিত মুখে বললেন, ‘বড় এরেনা? তা হবে, বড় এরেনাতেই ও সাঁতার টাঁতার কাটে’। শুনে দুইজনে আরও খুশি, ‘বাহ বাহ, বেশ বেশ। তা প্রাইজটাইজ কিছু পেয়েছে?’

শুনে ট্রেইনর সাহেব গভীর ভাবনায় ডুবে যান, এবং কর গুনে বিস্তর হিবেসনিকেশ করে খানিকক্ষণ পরে জানান, ‘তা ধরুন, এখনও অবধি মাইকেলের ষোলখানা অলিম্পিক মেডেল আছে, প্রাইজ হিসেবে খারাপ নয়, কি বলুন?’

সেলেব্রিথ্রিঃ

এই ঘটনাটিও আমার এক বন্ধুর। বন্দোপাধ্যায় উপাধিধারী ভদ্রলোকের পিতৃদত্ত নামটি চেপে গেলাম, কবে ফট করে নোবেল কি ফিল্ডস প্রাইজ পেয়ে যাবে, তখন এইসব কুচ্ছো ছড়াবার দায়ে পুলিস যদি আমাকে যদি দায়রায় সোপর্দ করে? তাছাড়া ইনি এমনিতেও খুবই লাজুক মানুষ, ফট করে গাঁজাখুরি গপ্পতে নায়ক হয়ে পড়াটা কিভাবে নেবেন বোঝা যাচ্ছে না!



তা ঘটনাটি যখন ঘটে তখন ভদ্রলোক ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, অস্টিনে পাঠরত। চলতি কথায় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ইউটি,অস্টিন নামেই বিখ্যাত।

এই অসামান্য প্রতিভাধর বন্ধুটি অত্যন্ত দুর্বল, ক্ষীণতনু এবং কথাবার্তায় সামান্য ন্যাকা হওয়ার কারণে আমাদের কাছে খুবই প্যাঁক খেতেন। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার পর তাঁর মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেলো। জনশ্রুতি এই যে এক নীলনয়না স্বর্ণকেশীর প্ররোচনায় তিনি জিমে যাতায়াত শুরু করেন এবং অত্যল্পকালের মধ্যে তার ঈপ্সিত সুফল দেখা দিতে শুরু করে।

তা এক প্রসন্ন বিকেলে বাঁড়ুজ্জেমশাই নিত্যনৈমিত্তিক পালোয়ানি কসরতান্তে ফিল করলেন যে শরীর তখনও কিছু চাইছে। অন্যভাবে নেবেন না কথাটা, মানে আরও খানিকক্ষণ গা ঘামাতে ইচ্ছা যাচ্ছে আর কি। তা ইতিউতি চেয়ে দেখলেন সামনেই ইউনিভার্সিটির টেনিস কোর্ট। যদিচ ভদ্রলোক কোনওদিন লুডোর বেশি কিছু খেলেননি, তবুও মনে করলেন যে দেখাই যাক না, এমন আর কি ব্যাপার, র‌্যাকেট দিয়ে বল পেটানোই তো, এর বেশি তো কিছু নয়। এই চিন্তা করে উনি ‘জয় বাবা বরিসনাথ’ তিনবার আউড়ে স্ট্রেট ঢুকে পড়লেন।

তা ঢুকে তো পড়লেন, গিয়ে দেখেন আর কোত্থাও কেউ নেই, কেবল একটি বছর বাইশের ছেলে, ছ ফুটের ওপর লম্বা, পেশীবহুল শরীর, একা একাই দেওয়ালে বল মেরে মেরে খেলছে। বলা বাহুল্য, ব্রাত্য সর্বহারাদের প্রতি বাঙালিদের একটা ন্যাচারাল সিমপ্যাথি আছেই, ফলে বাঁড়ুজ্জেবাবুর বুকটা এই একলা একলা খেলে যাওয়া সঙ্গিহীন শিশুটির দুঃখে হু হু করে উঠলো। তিনি একটা টেনিস র‌্যাকেট তুলে গলা খাঁকারি দিয়ে ছোকরাকে ডেকে বললেন, ‘আরে এই যে ভাই, তুম একলা একলা কিঁউ খেল রাহা হ্যায়? মেরে সাথ একদান খেলোগে?’

তখন খানিকটা অন্ধকার হয়ে এসেছে, শেষ বিকেল। বন্ধুবর দেখলেন সে ছোকরা ভারি খুশি হয়ে ‘আরে কি সৌভাগ্য, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, আসুন কত্তা একহাত হয়ে যাক ‘ বলে র‌্যাকেট হাতে কোর্টের অন্যপ্রান্তে দাঁড়ালো। আমাদের শ্রীবন্দোপাধ্যায় চলো কোদাল চালাই, ভুলে মানের বালাই স্টাইলে র‌্যাকেট হাতে এপাশে দণ্ডায়মান হইলেন।

তা সে ছোকরা বোধহয় কিঞ্চিৎ শ্যাডো প্র্যাকটিসের মুডে ছিলো। বাঁড়ুজ্জেবাবু স্পষ্ট দেখলেন যে ছোকরা হাতও ওপরে উঠলো, র‌্যাকেটও নেমে এলো, কিন্তু কই, এদিকে তো বলটল কিছু এসে পৌঁছলো না! শ্যাডোই হবে, ভেবে ঈষৎ অন্ধকারে চোখটোখ কুঁচকে বাঁড়ুজ্জেবাবু ফের মনোনিবেশ করলেন।

ফের ছোকরা শ্যাডো করলো, সেই একই কেস, হাত উঠলো র‌্যাকেটও নামলো কিন্তু আমাগো বাবুর কাসে তো দেহি কিসুই আইয়া পৌঁসায় না!

চতুর্থবার শ্যাডো দেখার পর বাঁড়ুজ্জেবাবু খেয়াল করলেন, তাঁর রক্তে ঘুমন্ত বিদ্রোহী বাঙালটি আড়মোড়া ভাংছে। কাঙাল বলে হেলা করলেও করতে পারিস, তোরা হলি গে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী জাত। তা বলে বাঙাল বলেও হেলা? তোর ঘাড়ে কটা মাথা রে সোনামণি ?

পঞ্চমবারের বার সত্যিই ওঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। বড়দের সঙ্গে ফাজলামি হচ্ছে? বাড়িতে মা বাবা কি শিক্ষাই দিয়েছে, ছ্যাঃ! শিক্ষাদীক্ষা সংস্কার সভ্যতা, এ ছোকরা দেখা যাচ্ছে কিছুই শেখেনি! তিনি ভীষণ বিরক্ত হয়ে হাতছানি দিয়ে ছোকরাকে নেটের কাছে আসতে বললেন। সে ছেলে সামান্য অবাক হয়ে বিনীতভাবে কাছে এসে দাঁড়াতেই তিনি চোখ পাকিয়ে বজ্রাদপি কঠোর ন্ট্রে ক্রোধে ফেটে পড়লেন, ‘এইও, তোমার তো দেখ রাহা হ্যায় যে খেলার কোনওরকম ইচ্ছাই নেহি হ্যায়! এতক্ষণ ধরে কেবল শ্যাডোই কর রাহা হায়, শ্যাডোই কর রাহা হ্যায়। হামকো কেয়া উজবুক সমঝা হ্যায় রে ব্যাটা?’

তা ধমকটমক শুনে সে ছোকরা কানটান চুলকে বললো, ‘ ক্যানো? শ্যাডো ক্যানো করবো? পাঁচটাই সার্ভিস করলুম তো, তুমি দেখতে পাওনি?’

শুনে বন্ধুবর তো স্তম্ভিত! মানে? প্রত্যেকবার ছেলেটি যে র‌্যাকেট নামিয়ে এনেছে তা হাওয়ায় হাওয়ায় নয়?

এতক্ষণে তাঁর হৃদয়ঙ্গম হয় যে আগের পাঁচবারই সার্ভই করা হয়েছে বটেক, কিন্তু তার যা অসামান্য গতি, বন্ধুবরের নশ্বর চোখে ধরা পড়ে নাই! তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন কোর্টের বাইরে ইতোঃনষ্ট স্ততভ্রষ্ট অবস্থায় সেই পাঁচটি আগুনে গোলা পড়ে আছে!

খুব স্বাভাবিক ভাবেই খেলার আর মানে থাকে না এরপর, ওরকম বেগে একটা গোলা যদি বুকে বা মুখে এসে লাগে? তাছাড়া বেশ সন্ধেও হয়ে এসেছে তখন। বন্ধুটি র‌্যাকেট বগলে গুঁজে প্রথামাফিক নেটের ওপরে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে ওঠেন ‘ হেঁ হেঁ, কিছু মাইণ্ড নেহি করনেকা বাছা, বয়েস হয়েছে কিনা, চোখে সবকিছু আচ্ছাসে ঠাহর নেহি হোতা হ্যায়। তবে তুমহারা সার্ভিসমে বেশ জোর হ্যায় দেখছি। চালিয়ে যাও হে, কালেক্কে তুম লায়েক হোয়া, ইয়ে হামকো স্পষ্ট দেখতা হ্যায়। মেরা নাম বন্দোপাধ্যায়, ******* বন্দোপাধ্যায়’।

সে ছোকরা ভারি ভদ্র ও বিনয়ী বলতেই হবে, কারণ এর পরে সেও লাজুক হেসে হাত বাড়িয়ে বন্ধুর হাতটা খপ করে ধরে অমায়িক স্বরে নিজের পরিচয় দিলো,

‘আয়্যাম রডিক, অ্যাণ্ডি রডিক!’
1 Comment
Collapse Comments

Avik sir become a fan of you
And dear Bangla Library team

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *