মার্কেট ভিজিট ১২

মার্কেট ভিজিট ১২

‘আগেই বুঝেছি, তুই এদিককার নোস। নেহাত ভেঁদড় না হলে কেউ মিষ্টি দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করে না। ওটা চপ নয় স্টুপিড, ওটা নারকেল আর গুড়ের মিষ্টি, ওটাকে বলে ওবাট্টু। আরে আরে আরে,ওটা কি দিয়ে ভাত মাখছিস? আরে ওটা ডাল নয় রে বোকা, স্যুপ, ওটাকে বলে উলাভা চারু…..’

কিছু কি বুঝলেন? তা খুবই যে ধন্দে পড়েছেন বুঝেছি, আমি নিজেও বেদম বুঝভুম্বুল হয়ে পড়েছিলুম কি না…

আমরা যারা গাঙ্গেয় অববাহিকার উর্বরতা দেখে মাটির সাত আঙ্গুল উপর দিয়ে হাঁটি, গব্বে মাটিতে পা পড়ে না, তাদের একবার ইস্ট গোদাবরী জেলাটা দেখে যাওয়া উচিৎ।

যেদিকে তাকান বনানী আর গাঢ় সবুজের সমাহার। এসেছিও অবশ্য যাকে বলে বর্ষার মাঝামাঝি। সুন্দর ফসল খেলানো ক্ষেত, সদ্য গর্ভবতী শস্যচারারা একে অন্যের গায়ে হেসে লুটিয়ে পড়ছে প্রগলভ গ্রাম্য যুবতীদের মতো, গোদাবরী আর কৃষ্ণা থেকে কেটে আনা ক্যানালের টইটম্বুর জলে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে গ্রামের প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত ছোট্ট গ্রামদেবতার মন্দিরের ছায়াটি,সব মিলিয়ে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় টাইপ কেস। তার ওপরে অন্ধ্রপ্রদেশে ব্লেণ্ডার্স প্রাইডের রেট মুম্বাইয়ের থেকে বেশ খানিকটা সস্তা। ফলে দিব্য আনন্দে আছি…

অ্যাঁ? এখনও বুঝলেন নি? ওহো, দুঃখিত, আমারই যাকে বলে গলতি সে মিসটেক হো গ্যায়া।

দিব্যি মুম্বাইতে বসে খাচ্ছিলাম আর বগল বাজাচ্ছিলাম। টাটা কম্পানি ভারি ভালো কম্পানি, সেই টেনিদার সিটি কলেজের মতই, হেব্বি ছুটি দেয়। সেবারও পার্সি ইতুপুজো না ইরানী পুণ্যিপুকুর এই উপলক্ষ্যে পরপর একগাদা ছুটি ছিল। আম্মো ভালোমানুষের মতন বন্ধুবান্ধবী,তদভাবে বন্ধুদের বান্ধবীদের নিয়ে লোনাভালা ঘুরে আসাটা চিত্ত ও চরিত্রের পক্ষে সুসভ্য হবে কি না এমন গভীর ভাবনায়, অফিসে বসেই চোখটোখ বুঝে যাকে বলে নিমজ্জমান, এমন সময়ে কাঁধে একটা টোকা পেয়েই ‘তিন কত্তি তিন’ আউড়ে ঘাড় ঘুরিয়েই দেখি, বস!!!

তিনি ভারি গম্ভীর মুখে সমাজ ও জাতির অবনতি, অর্থনীতির দুরবস্থা ও সর্বব্যাপী রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা, তদুপরি যুবসমাজের সার্বিক অবক্ষয় নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ ভাষণ সমাপান্তে বললেন যে নেক্সট দুই সপ্তাহ কোস্টাল অন্ধ্র, অর্থাৎ অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশের প্রধান শহরগুলি ঘুরে আসাটা জাতির পক্ষে মঙ্গলজনক বলে হায়ার ম্যানেজমেন্টের দৃঢ়বিশ্বাস। দায়িত্বটা ওনাকেই দেয়া হয়েছিল, তবে কিনা উনিও চান সে সৌভাগ্যসিন্নির ছিটেফেঁটা আমাদের কপালেও জুটুক, ওনার মনটা যে সদা সর্বদাই আমাদের কল্যাণের জন্যে হুহু করতে থাকে সে কি আমরা ফিল করি না? ইত্যাদি প্রভৃতি…

ফলে আর কি,চোদ্দ দিনের লম্বা ট্যুরে বডি ফেলেছি এই এলাকায়। বিজয়ওয়াড়া, গুন্টুর, তেনালি হয়ে সেই বিশাখাপত্তনম আর বিজয়নগর, ফের ফিরতি পথে বিশাখাপত্তনম থেকে বিজয়ওয়াড়া হয়ে হায়দ্রাবাদ, সেখান থেকে দুগগা দুগগা করে ঘরের ছেলে ঘরে, মুম্বাইতে।

তা সেই লম্বা ট্যুরসংগ্রামে আপাতত ডেরাডাণ্ডা রাজামুন্দ্রিতে। গোদাবরীর অববাহিকাতে শুয়ে থাকা নিশ্চিন্ত জনপদ, স্থানীয় শস্যের বড় আড়তও বটে। জীবন এখানে হায়দ্রাবাদ বা অন্য মেট্রোর তুলনায় অতি ধীর ও শান্ত। অত্যন্ত সম্পন্ন মফস্বল শহর, অধিবাসীদের চেহারায় একটা সুখসমৃদ্ধির তৃপ্ত ছাপ। রাস্তার কুকুর আর ছাগলগুলো অবধি দেখলুম বেশ মোটাসোটা নধর চেহারা।

তা সেখানে দিনভর চললো উস্তমকুস্তম ধরণের মার্কেট ভিজিট। স্থানীয় সেলস অফিসারটিকে বোকাসোকা দেখে সুযোগ বুঝে একটু এক্সট্রা টার্গেট কমিট করিয়ে নিয়ে বেশ তুরীয়ানন্দ লাভ করেছি, এমন সময় দুপুর দুটো নাগাদ সে ছোকরা রীতিমতো বেজার মুখেই, (এক্সট্রা টার্গেটের দুঃখে কি না খোদায় মালুম) আমাকে বললে ‘স্যার, হোয়ের ডিনার ইউ হ্যাভ টু ওয়ান্ট?’.

খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসার কিছু হয়নি, এর থেকেও বাজে ইংরাজি আমরা বাঙালিরাই বলি, এর থেকেও জঘন্যতর উচ্চারণে। আর আমি সারা দেশের বিভিন্ন প্রদেশে মার্কেট ভিজিট করতে করতে বিভিন্নস্থানে ইংরেজি ভাষার যা শিহরণ জাগানো বিবিধরূপ বস্ত্রহরণ হতে দেখেছি, তাতে আমি অলরেডি একজন ভাষানীলকণ্ঠ হয়ে উঠেছি। ফলে এসব বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে একদম দেরি হয় না। আমি গম্ভীর হয়ে বল্লুম ‘আই ওয়ান্ট টু হ্যাভ অথেনটিক তেলুগু লাঞ্চ’।

খেয়াল করে দেখবেন, এক্ষেত্রে অবধারিত ভাবে উদ্দিষ্ট স্থানীয় লোকটির মুখে একটা আত্মপ্রসাদের হাসি খেলে যায়, এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না। সম্মুগম নামের সেই সেলস অফিসারটি বেশ প্রসন্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন ‘ইউ গুড ফ্যামিলি ফুড ওয়ান্ট স্যার? আই টেক ওয়ান ভ্যারিইই নাইস প্লেস ইউ। লেস স্পাইস,লেস অয়েল। বাট নো এসি, ওক্কে না? চ্যালেগা?’

চ্যালেগা কি রে ব্যাটা? দৌড়েগা। গুন্টুর হলো গিয়ে ভারতের শুকনো লঙ্কার রাজধানী। তা সেই গৌরব এতদঞ্চলের লোকজন মোটামুটি হৃদমাঝারেই রাখে, তাতে যে গত সাত আট দিনে পৌষ্টিকতন্ত্রের যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে সে আর কহতব্য না। লেস স্পাইসি খাবারই তো খুঁজছি কবে থেকে ভাইটু!

তা বাবু যেখানে এনে আমাকে হাজির করলেন, সেটাকে দেখেই আমার ছোটবেলায় দেখা হাওড়ার শিবপুরের কথা মনে পড়ে গেলো। তেমনই ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ নির্জন ঠাণ্ডা একটা পাড়া, সবই একতলা দোতলা বাড়ি, প্রত্যেক বাড়ির সঙ্গে একটা করে ছোট্ট বাগান, পাঁচিলের ওপর দিয়ে উঁকি মারে কচি কচি গাছেদের মাথা। এমনই একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে হাজির করে ছোকরা আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললে, ‘দিস ইজ প্লেস স্যার’।

একনজরে করে দেখলে বাড়িটাকে মন্দির টাইপ লাগে। সামনের বাগানে ছোট্ট ফুলের বাগান। বাইরে জুতো খোলবার জায়গা।তার পাশে আবার বড় ব্ল্যাকবোর্ড টাঙানো, তাতে চক নিয়ে জীবনের উদ্দেশ্য ও কর্তব্য সম্পর্কে চোস্ত ইংরেজিতে বিভিন্ন মহাপুরুষদের বাণী লিখিত। জুতো খোলার সময় একবার চট করে চোখ বুলিয়ে নিলাম, বেশিরভাগই শ্রীঅরবিন্দ, বিবেকানন্দ আর কালাম সাহেবের বিভিন্ন উক্তি।

বুঝলাম,রেস্তরাঁ মালিক একটি বিশিষ্ট জ্ঞান গোঁসাই!

তবে কিনা ভেতরে ঢুকেই যেটা সবার আগে নজর কাড়ে, সেটা হচ্ছে দরজার ঠিক উলটোদিকের দেওয়ালে শ্রীরামকৃষ্ণের একটা প্রমাণ সাইজের বাঁধানো ছবি। যদিও অবাক হইনি বিন্দুমাত্র, আগেও দেখেছি সমগ্র দক্ষিণ ভারতে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের প্রচুর অনুসারী, বাঙালিদের থেকে বেশি বৈ কম নয়! বেশ আয়েশ করে চেয়ারে বসে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম যে এটা আমাদের প্রচলিত অর্থে কোন রেস্তরাঁ নয়। একটা বাড়ির ড্রয়িংরুমে চার পাঁচটি চেয়ার টেবিল পেতে আয়োজন। রান্নাবান্না সবই লাগোয়া কিচেনে, ঘরোয়া পরিবেশে ঘরোয়া রান্নার ব্যবস্থা। এরকম অনেক দেখেছি সাউথের মফস্বল গুলিতে। নামজাদা রেস্তরাঁর থেকে কিছু কম ভীড় হয় না।

দরজার কাছে কাউন্টার, আর সেখানে যিনি কাউন্টার আলো করে বসে আছেন, দর্শনমাত্রে প্রতীতি জন্মায় যে ইনিই এখানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী!

ভদ্রমহিলার বয়েস ষাটের কাছাকাছি, কি তার ওদিকেই হবে, বিশাল শরীর, পুরো চেয়ারটাই যাকে বলে উপচে দখল করে বসে আছেন। কাশীর পেয়ারার মতন টকটকে ফরসা রঙ, নুন গোলমরিচের উরন্ত চুল, সোনার রিমলেস চশমা। গম্ভীর মুখে একটা বই পড়ে যাচ্ছেন। কথা বলুন না বলুন, সমীহের একটা সূক্ষ্ম মসলিনি বাতাবরণ যে ভদ্রমহিলাকে ঘিরে আছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

আমি তো হাতটাত ধুয়ে বসেছি, সামনে থালার মধ্যে কলাপাতা রেখে দিয়ে গেছে, একগাদা ছোট ছোট বাটি চারিদিকে, তার মধ্যে বিচিত্র সব তরকারি, ঘিয়ের একটা বড় বাটি পাশেই, চামচসুদ্ধু, তার পাশে দুটো খোপওয়ালা একটা পাত্র, তার একটা খোপে হলদে বাদামি টাইপের পাউডার একটা (এরা বলে গান পাউডার) আরেকটা খোপে গাঢ় বাদামি কালো রঙের আরেকটা পাউডার, এরা বলে মিঠা নিমপাত্তা পাউডার, বেসিক্যালি কারিপাতা শুকিয়ে মশলা মিশিয়ে গুঁড়ো করে রাখা।

তারপর দেখি একটা কি ভেজিটেবল চপের মতন দিয়ে গেলো, বেশ মুচমুচে বেসনে দিয়ে ভাজা, আর একটা ইয়াব্বড় শুকনো লঙ্কা,চপচপে করে তেল দিয়ে ভাজা। সঙ্গে থপাৎ থপাৎ করে দুচামচ চাটনি। তারপর দেখি পরিবেশনকারী ভদ্রলোক একটা ভাতের বালতি নিয়ে হাসিমুখে আমার দিকেই আগচ্ছতি। খিদের মুখে গরম ভাতের গন্ধটা যা চরম ভালো লাগে কি বলবো, খিদেটা যেন দুনো হয়ে উঠলো। আমি আবার কদিনে সামান্য ছেঁড়াখোঁড়া তেলুগু শিখেছি। ছাগল যেমন নতুন শিং গজালে সবেতেই একটু ঘষে নেয়, আম্মো চান্স পেলেই একটু তেলুগু বলে নিচ্ছি, আশেপাশের পাবলিক সেই শুনে আবার বিলক্ষণ মজাও পাচ্ছে। তা এখানেও আমার ভেতরের সেই ভাষাবিদ হরিনাথ সুযোগ পেয়েই বলে উঠলেন ‘কুঞ্জম রাইস কাওয়ালে’, অস্যার্থ আমার একটু ভাত চাই। কুঞ্জম মানে কিছুটা বা একটু , কাওয়ালে মানে আমার চাই।

বলেই গর্বে ইতিউতি চাইছি, আশেপাশের লোকজন বেশ প্রশ্রয়যুক্ত অ্যাপ্রূভালের ভঙ্গিতে মৃদু হাস্যে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াচ্ছেন, এমন সময় দেখি অচানক সব্বাই গম্ভীর হয়ে ফের স্ব-স্ব ক্ষুৎপাত্রে মনোনিবেশ করলেন।

ক্কি কেস? ঘাড় ঘোরাতেই দেখি মালকিন স্বয়ং!! রিমলেস চশমার মধ্যে দিয়ে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে আমাকে জরিপ করছেন। চোখে চোখ পড়তেই চোস্ত ইংরেজিতে প্রশ্ন ‘হোয়ের আর ইউ ফ্রম’।

আমিও চোস্ততর ইংরেজিতে বল্লুম, ‘আপাতত ফ্রম বিজয়ওয়াড়া’।

ভ্রূধনু কুঞ্চিত হলো, ‘ দ্যটস নট দ্য আনসার। হুইচ পার্ট অফ ইণ্ডিয়া? নর্থ?’।

এই রে!! তামিলনাড়ুতে নর্থ ইণ্ডিয়ার হিন্দিভাষীদের একদম পছন্দ করে না লোকজন, স্বচক্ষে দেখা। এরা আবার সেদিককার নাকি? কোস্টাল অন্ধ্রতেও কি সেরকম হেনস্থা হতে হবে? ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে নাকি? খেতে অবধি দেবে না, অ্যাঁ? এদিকে আমার যে হেব্বি খিদে পেয়েছে মাইরি!

ততক্ষণে ভাত অবশ্য ঢেলে দিয়েছে পাতে। গরম ধোঁওয়া ওঠা ভাত, (এরা আবার পোচ্চুর ভাত খায়, সে পরিমাণ দেখলে আমরা বাঙালিরা মুচ্ছো যাবো), তার মধ্যেই আধবাটি ঘি প্রায় উপুড়হস্তেই দিয়ে গেছে, গন্ধেই মাইরি পেট চুঁইচুঁই করছে, আমি অত্যন্ত গভীর গলায়, বেশ ওজনদার গাম্ভীর্য সহকারে ( যাতে খাবারটি ফস্কে না যায়) বল্লুম ‘ আয়্যাম ফ্রম ইস্ট ইণ্ডিয়া’।

বলেই খেতে যাবো, ঝটিতি পরের প্রশ্ন, ‘ হুইচ স্টেট? বিহার অর আসাম?’

আ মোলো যা। তাতে আপনার কি মাসিমা? ওখানকার লোক হলে ফ্রি তে খাওয়াবেন নাকি? ঝত্তসব, সামনে মাইরি গরম ধোঁয়াওঠা ভাত, ঘি দিয়ে, ভাবচি ওই যে ভেজিটেবিল চপটা দিয়ে গেলো সেটা দিয়ে দু গরাস মুখে তুলি, এমন সময় এমন সিবিআই মার্কা এনকোয়ারি ভাল্লাগে না মাইইরি..

চপটা ভেঙে অত্যন্ত গাঢ় গলায় বল্লুম ‘ ওয়েস্ট বেঙ্গল’।

‘ হুইচ সিটি?’ মিস মার্পলকে এবার অসহ্য লাগছিলো।

‘ক্যালকাটা’ বলেই চপটার ভেতরটা দেখে সন্দেহ হলো। নারকেল নাড়ুর মতন দেখতে কেন রে?

‘হুইচ পার্ট অফ ক্যালকাটা?’

এইবার সোজা হয়ে বসে ভদ্রমহিলাকে অবলোকন করতেই হলো, যদি বলি কড়েয়া কি হরিদেবপুর, ইনি কি চিনবেন, অ্যাঁ? তাইলে এত কৌতূহল কিসের মাসিমা? যাগগে যাক, আমি চপটার খানিকটা মুখে দিয়ে সগর্বে বল্লুম, ‘লেকটাউন’, বলেই আমি ধাঁ,কা রণ চপটা হাকুচ মিষ্টি, অ্যাকচুয়ালি বড় নরমপাকের নারকেল নাড়ু,একগাদা গুড় দিয়ে বানানো, বাইরেটা বেসন দিয়ে ভেজে চপের আকার!!!

ভদ্রমহিলা আমার মুখ দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, তারপর বিশুদ্ধ কলকাত্তাই বাংলায়…

‘আগেই বুঝেছি, তুই এদিককার নোস। নেহাত ভেঁদড় না হলে কেউ মিষ্টি দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করে না। ওটা চপ নয় স্টুপিড, ওটা নারকেল আর গুড়ের মিষ্টি, ওটাকে বলে ওবাট্টু। আরে আরে আরে, ওটা কি দিয়ে ভাত মাখছিস? আরে ওটা ডাল নয় রে বোকা, স্যুপ, ওটাকে বলে উলাভা চারু…..’ বাক্যস্রোত চলতেই থাকলো।

আর আমি বেহুদ্দ বেকুবের মতন হাঁ করে চেয়ে রইলাম। রাজামুন্দ্রিতে বাংলা? ইনি??

তবে খিদের সামনে বেশিক্ষণ বেকুব হয়ে থাকা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। ঠাকুমা ছোটবেলায় ছড়া কাটতেন, ‘অন্ন এমুন চিজ, খোদার থিইক্যা উনিশ বিশ’, ফলে ডাল দিয়ে ( এরা ডালকে বলে পাপ্পু) ভাত ভেঙে খেতে খেতে তেনার বক্তিমে শুনতে লাগলুম।

ভদ্রমহিলার জন্ম কর্ম বিবাহ কলকাতাতেই, সাউথ কলকাতায়, লেকের ধারে (‘হ্যাঁ রে, মেনকা সিনেমা আছে? ওর পাশেই তো আমাদের বাড়ি ছিল। আহা, ম্যাটিনি শোতে বাবা মায়ের হাত ধরে উত্তম কুমারের ছবি দেখতে যেতুম’), পড়াশোনা ওখানেই (‘ তখন তো স্কুলে মজা হতো কতো, রবীন্দ্রজয়ন্তীতে নাটক করেছি, শ্যামাতে নেচেছি, চিত্রাঙ্গদায় গান গেয়েছি, সরস্বতীপূজো করেছি। এখনও হয় রে? অবশ্য গার্লস স্কুল, তুইই বা জানবি কি করে বল’), কলেজও (‘ এখনও আশুতোষ কলেজে ডিবেট ক্লাবটা আছে? চমৎকার ডিবেট হতো আমাদের সময়ে , কি ভালো ক্যুইজ হতো, প্রেসিডেন্সি থেকে শার্প ছেলেমেয়েরা আসতো, আহহা, এখনও হয় রে?’)।

সারাক্ষণ ধরে এই চললো, মাঝেমধ্যে মৃদু ধমক, কার পরে কি খেতে হয় তার নির্দেশ দিয়ে। তারপর সেই অবিশ্রান্ত বকবক। তখনকার অশান্ত কলকাতা ( ভদ্রমহিলার কলেজ লাইফটা সত্তর দশকে বুঝতে দেরি হয়নি বেশি), ধরপাকড়, মিটিং মিছিল, শহর জুড়ে নিরন্ন উদ্বাস্তুদের ভিড়, কালীঘাট, চেতলা, গড়িয়াহাট, জবরদখল কলোনি, মনে হচ্ছিল একটুকরো ইতিহাস যেন চোখের সামনে সোনার রিমলেস চশমা পড়ে হাসিমুখে বসে। একবার পার্ক স্ট্রিটের কথা জিজ্ঞেস করলেন, আরেকবার গোলবাড়ির কথা। কলেজ স্কোয়ারের ফুচকার কথা জিজ্ঞেস করার সময় তো চোখদুটো চকচক করছিল, স্পষ্ট দেখলুম।

পুলিহারা বলে একটা আইটেম ছিল, একটু টক মতন ফ্রায়েড রাইস আর কি, দিব্যি খেতে। আমি খেতে খেতে এখানে এলেন কি করে জিজ্ঞেস করাতে সামান্য বিষন্নতার ছায়া পড়লো ভদ্রমহিলার চেহারায়, ‘তোর আঙ্কেল চাকরি করতো অডিটে, বুঝলি? সেও আমার মতই কলকাতায় বড় হয়েছে। এইট্টি ফাইভে এদিকে চলে আসি। তারপর ছেলেমেয়ে বড় হতে লাগলো, আমারও আর কলকাতা ফেরা হোল না। ‘

ততক্ষণে খাওয়া শেষ হয়ে গেছিলো, বিল মিটিয়ে একটু মৌরি চিবোতে চিবোতে বেরোবার সময় বল্লুম ‘এখনও চমৎকার বাংলা বলেন তো’।

রীতিমতো ক্ষুন্ন হলে তিনি, ‘ সে কি রে? ছোটবেলা থেকে শিখেছি, স্কুল কলেজ বন্ধুবান্ধব আড্ডা সবই বাংলাতে দিয়েছি, ভুলে যাব কি রে? তাছাড়া…. কি বলতো? ‘

নিচু হয়ে জুতো পরছিলুম, উঠে দাঁড়িয়ে বল্লুম ‘কি?’

ভদ্রমহিলা চোখ টিপে বললেন, ‘ইউ ক্যান টেক সামওয়ান আউট অফ ক্যালকাটা, বাট ইউ ক্যান নট টেক ক্যালকাটা আউট অফ হার ‘।

গাড়ি করে ফিরে আসার সময় এসি বন্ধ করে জানলার কাঁচটা নামিয়ে দিলাম। ঠাণ্ডা হাওয়া, বিকেল হয়ে নেমে আসছে নরম রোদ। সেই দিকে তাকিয়ে ভাবলাম আমার মতন যারা কলকাতা ছেড়ে এসেছি কাজের সূত্রে, আমরাও কি সব সময় বুকের মধ্যে একটুকরো কলকাতা বয়ে নিয়ে চলি না? সব সময় কি স্বপ্ন দেখি না, কোন এক অলৌকিক ভোরে এসে যাবে সেই রাজার চিঠি, সেই মায়ার ভূখণ্ডে ফিরে যাবার সনদ। আমার মতনই পৃথিবীজোড়া হাজার হাজার কলকাতা ছাড়া মানুষদের কি অমোঘ বাঁধনেই না বেঁধে রেখেছে সেই বুড়ি শহর..কি অনায়াসেই….



ডিমনিকাহিনী



বহু পূর্বকৃত পুণ্যবলে লোকে সেলসে চাগরি পায় মহাই, আজই হাতেনাতে প্রমাণ পেলুম।

হয়েছেটা কি, এই ডিমনি নামের মামণি এসে তো কয়েকদিনের জন্যে নাহক অসুবিধা সৃষ্টি করেইছেন, এ কথা শীতের ন্যাতাকাঁথা দিয়েও আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। আমার ব্যক্তিগত ভাবে যে খুব অসুবিধা হচ্ছিল তা নয়। এক অটোতে যাতায়াত, কাঁচা সবজি বাজার আর বাড়িতে গিন্নির সহকারিণীটিকে মাইনে, এ ছাড়া ক্যাশ আমার লাগেই না। তদুপরি পাওয়াই মার্কেটে জয়ন্তর দোকান থেকে মাছ কিনি, আর সেখানে বহুকাল থেকেই ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট নেয়, গত দুবছর যাবৎ তাই কিনছি।

কিন্তু সবাই জয়ন্ত নয়। সবার কাছে অনলাইন পেমেন্টের ব্যবস্থা নেই। এই যেমন সেদিন। পাওয়াই মার্কেটে মাছ কিনতে গিয়ে থমকে গেলাম! ইয়াব্বড়বড় গলদা মশাই, একেকটার ওজন দেড়শো গ্রামের কম হবে না, হলফ করে বলতে পারি। শুঁড় বাদ দিয়েও এক বিঘৎ লম্বা, আর তেমনই পুরুষ্টু, প্রায় মর্তমান কলার সাইজেরই। বাড়িতে কোকোনাট মিল্ক আছে দেখে এসেছি, নারকেলও এক পিস আছে বলেই মনে পড়ছে। দাম, হে হে, বলছি বলছি, মুচ্ছো যাবেন না কিন্তু, শক্ত করে কিছুমিছু একটা ধরে বসুন।

সাড়ে চারশো। না না, পার পিস না, কিলো সাড়ে চারশো। ফলে যদি ভাবিইই যে এই রোব্বারের দুপুরে লাঞ্চটা দেরাদুন রাইসের ভাত আর গলদার মালাইকারি দিয়েই সারবো, তাতে কি খুব ভুল হবে অ্যাঁ?

ভাবতে ভাবতেই আলতো করে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে লালাটা মুছে নিলাম। আরে না না স্বপ্ন নয়। অ্যাগদম সত্যি, আজই সকালে, আই আই টি পাওয়াই মার্কেটে।

তারপর? তারপর আর কি? আমি লোভাতুর নয়নে মাছের দিকে চেয়ে রইলাম, আর মাছউলি মউশি সতৃষ্ণনয়নে আমার দিকে।

আমার হাতে শুধু একটা দু হাজার টাকার নোট, মউশির কাছে দুটো একশো টাকার নোট, আর কয়েকটা খুচরো!

ফলে বুঝতেই পারছেন, পরিমাণটা তত বেশি না হলেও লাগে। আর চট করে বাড়ির কাজের মেয়েটিকে দুহাজারের নোট দিতে গায়ে লাগে, তাকে খুচরোতে দিতে হয়। আমার চালিয়ে নেওয়ার বিবিধ উপায় আছে, সে বেচারি অত উপায় পাবে কোত্থেকে?

তা গত মাসে নিজের পানবিড়ি ইত্যাদি খরচার জন্যে চেনা পানের দোকানীকে ধরেছিলাম। সিগারেট আর পানের ব্যবসা হাণ্ড্রেড পার্সেন্ট ক্যাশের ব্যবসা, আর এলইউপিঅর্থাৎ লো ইউনিট প্রাইস বিজনেস, এদের কাছে খুচরো থাকতে বাধ্য। তা চেনা দোকানী, আমাকে নিরাশ করেনি, দু হাজার নোটের বদলে আঠেরোশো দিয়েছে, বাকি দুশো টাকা দু হপ্তায় পান সিগারেট কিনলে কেটে নেবে এই কড়ারে। প্রিপেইড নেশা আর কি!

তা গতকাল বাড়িতে ফিরে ছানটান করে লুঙ্গিটা পরে মুড়ি বাদামের বাটিটা টেনে নিয়েছি কি নিই নি, ও মা, গিন্নি দেখি খপাৎ করে ওয়ালেটটা হাতে নিয়ে চিল চিৎকার, ‘তোমার কাছে এত্ত খুচরো, আমাকে বলোনি তো? জানো আমার কি অসুবিধা হচ্ছে? বলি এত বয়েস হলো, আক্কেলহুঁশ কবে হবে শুনি?’ আমিও কাষ্ঠহাসি হেসে কিছু বলতে গেলুম বটে, কিন্তু খেয়াল করে দেখলুম প্র্যাকটিক্যালি গলা দিয়ে ঘোঁ ঘুঁ ঘপাৎ ছাড়া আওয়াজই বেরোচ্ছে না!!

তা তিনি সতেরশো টাকা হাতিয়ে খুব কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘একশোটা টাকা রইলো, পুরুষ মানুষের হাতে বেশি ক্যাশ থাকা ভালো নয়। আর হ্যাঁ, দুটো দুহাজার টাকার নোট দিয়ে দিয়েছি, কাল সন্ধ্যেবেলায় যেন ভালোয় ভালোয় চল্লিশটা একশোটাকার নোট পাই। কথাটা যেন মনে থাকে। ‘

বাপ মার কথা অমান্য করা যায় মশাই, স্ত্রীর কথা অমান্য করলে যে ঝড়ঝঞ্ঝাবজ্রপাত আছড়ে পরে তার প্রতিকার মনু সংহিতা থেকে হ্যারি পটার কোত্থাও লেখা নেই। ফলে আজ খুবই চিন্তিত মুখে মার্কেট এসেছি, সেলসম্যান ছোকরা দেখি আরও চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে।

‘কি রে, মুখটা ভেঁদড়ের মতন করে রেখেছিস কেন?’

‘ধান্দা বিলকুল ঠপ পড়া হ্যায় স্যার। ইস মাহিনেকা টার্গেট নেহি হোগা।’

‘সে কি রে পাগলা? চাকরি থাকবে যে রে! না তোর চাকরি থাকবে, আর আমার তো নেইই ধরে নে। বলি ওরে পচমপকাই, আমরা তো সেলসের লোক। দুর্গমগিরিকান্তারমরু পার হয়ে ব্যবসা আনাই তো আমাদের কাজ রে পাগলা। ওরে তুই কি সামান্য লোক? বলি কবি ”মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত’ এ কাদের কথা বলেছেন? স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ কাদের জন্যে হয়েছিল? মহাকবি শ্রীজাত যে বলেছেন ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’, সে কার জন্যে, অ্যাঁ? ওরে তুই কি রাজা ভটচায্যির ভারতবর্ষ পড়িসনি? ছত্রে ছত্রে যে তোর বীরগাথাই লেখা আছে ‘ ইত্যাদি বলেটলে, ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন ‘, ‘ঊর্ধগগনে বাজে মাদল’ টাইপের পেপটক দিতেই সে ছোঁড়া বেশ চাঙ্গা হয়ে গা ঝাড়া দিয়ে বললো, ‘তাহলে চলুন স্যার’।

ঘন্টাপাঁচেক বাদে ফের সে দুজন একই জায়গায়। পঁচিশটা দোকানে কল করা হয়েছে, মাত্তর তিনটে প্রোডাক্টিভ। দোকানদাররা কম্পানির সেলসম্যান দেখলেই মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে তাড়িয়ে দিচ্ছে।

যাই হোক, এর পর অফিসে যেতে হয়, রিপোর্ট ফাইল করতে হবে। সে হতোদ্যম ছোঁড়াকে ‘সেলসের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’ ইত্যাদি বুঝিয়েটুঝিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছি, ছোকরা ডিস্ট্রিবিউটর পয়েন্টে যাবে বলে অ্যাবাউট টার্ন করেছি কি করেনি, খপ করে ওর হাত ধরেছি।

‘ক্যায়া হুয়া স্যার?’

‘ হ্যাঁ রে বুদ্ধুভুতুম দহিবড়া খাবি? ‘

ছোকরা ভারি অবাক হলো, ‘কিউঁ স্যার?’

‘ নইলে মিসল পাও খাবি নাকি? বেশ ঝাল ঝাল? নাকি ভড়াপাও বলে দিই দুটো?’

সে ভারি সন্দিগ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘কিঁউ বস? কেয়া হো গ্যায়া?’

এইবার খাপ খুলতেই হয়। ‘বলি কম করে তো কুড়িটা দোকান থেকে ক্যাশে ডিউ বিলের পেমেন্ট নিলি। ব্যাগটা খোল দিকিন সন্টিমন্টি’।

এইবার সে ছেলে হেসে ফেলে আমার মতলব বুঝে, ‘আপকো ছুট্টা চাহিয়ে ক্যায়া?’

আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। পকেটে চল্লিশটা একশো টাকার গরমাগরম পাত্তি। ডানদিকের হিপ পকেটটা যেভাবে ফুলে আছে, তাতে দক্ষিণ নিতম্বে টিউমার হয়েছে বলে কারো সন্দেহ বলার কিছু নাই। তবে ওসব তেমন কিছু না। মোদ্দা কথা এই যে আমার কাছে এখন, চল্লিশটা ইয়ে, তার মানে,

১. রাত্তিরে মাটন, আর

২. হে হে জানেনই তো , কাল লাঞ্চে গলদা!



কালকে কি বেহুদ্দ বেইজ্জত হয়েছি রে ভাই, মানে সে কি বিচ্ছিরি রকমের ইন্সাল্ট, সে আর কহতব্য নয়! ভালো বাংলায় যাকে বলে সুতীব্র অপমান, প্রায় সেটাই আর কি। গা”টা যা রাগে রি রি করছে না, মনে হচ্ছে সে ছোকরাকে ধরে কেলিয়ে পাটপাট করে দিই, তারপর থেঁতো করে, আগুনে পুড়িয়ে, হামানদিস্তায় ফেলে গুঁড়ো গুঁড়ো করে..

ব্যাস, শুনেই দাঁতফাঁত বার করে চলে এলেন না? কি ইল্লি মাইরি, আবদার শোনো একবার! আমার এত বড় অপমানের কথাটা নাকি ব্যাখ্যান করে শোনাতে হবে। যত্তসব করেকটেঘ্যাচাং টাইপের বন্ধু হয়েছে কতগুলো দেখছি, হুঁঃ

আচ্ছা আচ্ছা, আর রাগ করতে হবে নি, বলছি।

তা ঘটনা খুবই সামান্য। কয়েকদিন বাদে কলকাতায় যাবার একটা প্ল্যান আছেই। ফলে গত পরশু গেছি অফিসের পাশেই যে ইয়েস ব্যাঙ্কটা আছে, সেখানে, কিছু ক্যাশ তুলবো বলে। লাইনটাইন দেখলুম একটু কম। দুজনের পরেই আমার ডাক পড়লো। আমিও গিয়ে ভারি আহ্লাদী মুখ করে চেকটা গছিয়ে দিলুম কাউন্টারে।

চেকটা যাকে বলে অ্যাকনলেজ করে, দুটো সই করিয়ে নিয়ে, কাউন্টারাধিষ্ঠিতা বিধুমুখী ললনাটি একটি ভুবনমোহিনী হাসি উপহার দিয়ে মদালসা ন্ট্রে জানালেন, শুধুমাত্র দুহাজার টাকার নোটই পাবো, পাঁচশো, একশোর নোট সেদিনকার মতন শেষ। তার বদলে তিনি খুবই মিষ্টি করে বার দুয়েক সরি অবধি বললেন।

আপনারা তো জানেনই, আমি খুবই কোমলহৃদয়ের মানুষ। বিশেষ করে সুন্দরী মহিলাদের দুঃখ দুর্দশা এক্কেবারে সহ্য করতে পারি না। ফলে ‘ঠিকাচে ঠিকাচে, আপনাকে আর অত ইয়ে হতে হপে না’ কয়েটয়ে ব্যাঙ্কের পিয়নকে, ‘এইও, দেখতা নেহি ভদ্রমহিলা কি বিচ্ছিরি রকমের ঘাম রাহা হ্যায়, বলি এসিটা জোরসে চালানে মে কি তুমকা কিছু কষ্ট হোতা হয় রে ব্যাটা’ বলে একটু দাবড়ে দিয়ে বাইরে এসে ভাবলুম অতঃকিম? এইবার অন্তত একটা দুহাজার টাকার শিভ্যালরি ভাঙাই কোথায়? পকেটে তো দুটো একশো টাকার নোট ছাড়া আর কিছু নেই!

তা কাল বিকেলে অফিসফেরতা গেছি পাওয়াই হিরানন্দানিতে, বুইলেন। সে প্রায় বম্বের বুকে একটুকরো স্যুইৎজারল্যাণ্ড। বিশাল বিশাল বিদেশি ধাঁচের বাড়ি, ঝকঝকে রাস্তাঘাট, দারুণরকম ভালো দোকানপাট আর পাব, চওড়া ফুটপাথ, তাতে আবার সুবেশ তরুণ তরুণীদের ভিড়, মানে শুধু পারিজাতবন আর ঐরাবতটাই যা নেই আর কি!

তা সেই স্বর্গোদ্যানে গ্যালেরিয়া বলে একটি ছোট মার্কেট আছে। মানে নিউমার্কেটের ছোট সংস্করণ আর কি, অত্যন্ত গোছানো আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আর নিউমার্কেটের ফুটপাথের হকারদের বাঁদরামি তো একদমই নেই!

তা গ্যালেরিয়াতে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আর চেনা পুরোনো বইয়ের স্টলগুলোতে ঢুঁ মারছি, এমন সময় দেখি, যাঃ! পাশের টি শার্টের দোকানটা তো দেখি মাছি তাড়াচ্ছে যে! মানে লিটারেলি মাছি দেখলেই কাউন্টারের ছেলেটা তাড়াবার জন্যে দৌড়ে যাচ্ছে। আর মাছিগুলোও হয়েছে তেমন অবাধ্য আর ত্যাঁদড়, তাকে দেখলেই ‘ও যেন আমাকে টাচ না করে’ ভঙ্গিতে পগারপার, এদিকে আসার নামই নেই? সে তাড়াবার জন্যে মাছি খুঁজে খুঁজে কি হয়রান অবস্থা তার!

মনটা হু হু করতে লাগলো বুঝলেন? আহা রে, এই ডিমনির বাজারে ব্যবসাপাতির অবস্থা এমনিতেই মন্দা, তার ওপরে ছেলেটা এক একা মাছি তাড়াচ্ছে, ঠিক সহ্য হলো না। আর গ্রাফিক টি শার্ট আমার খুব পছন্দের জিনিস, সে তো আপনি জানেনই। বাড়িতে প্রায় খান পঞ্চাশেক মজুত আছে, তাও পেলেই কিনি। গিন্নিও চুপ থাকেন, কারন এর একটা গঠনমূলক দিক হলো যে বাড়িতে কখনো ন্যাতার অভাব হয় না!

তা দয়ার্দ চিত্তে আমি দোকানে ঢুকতেই সেই বালকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, দেখে তো মাইরি নিজের ওপর আমি নিজেই খুব ইম্প্রেসড! ফলে বেশ উদারভাবে আমার মিষ্টি ও গম্ভীর হাওড়া ইংরেজিতে সেই বিপণীবালককে বললাম ‘বঢ়িয়াঁ টি শার্ট হ্যায় তো দিখাও।’

সে খান পাঁচেক টি শার্ট ঝটাকসে কাউন্টারে নামিয়ে ফেলতেই আমি প্রায় গৌতম বুদ্ধ লেভেলের একটা হাসি হেসে তাকে বল্লুম, বৎস, তিষ্ঠ! আমি বিশেষ ডিজাইন ছাড়া টি শার্ট পরি না, সমঝা?

‘তো কেয়া দুঁ?’

‘জোকার কা দিখাও, হিথ লেজার ওয়ালি’।

দুটো উমদা পিস এলো বটে, কিন্তু রংটা এখনই ছেতড়ে গেছে। এ জিনিস একবার কাচলেই তো বাঁদিপোতার গামছা হয়ে যাবে বাবু সোনা!

‘ব্যাটম্যান দিখাও’

পছন্দ হলো না।

‘ সুপারম্যান দিখাও’

‘টি শার্ট নেহি হ্যায় জি, দো ঠো চাড্ডি হ্যায়’

মাথাটা দেওয়ালে ঠুকে দেওয়ার জন্যে হাতটা নিশপিশ করে উঠলেও নিজেকে সংযত করলাম।

‘ সিভিল ওয়ার হ্যায়’

‘খতম হো গ্যায়া জি’

‘থর? উলভেরাইন? স্টর্ম?’

‘উয়ো ক্যা জি?’

‘হাল্ক? ডক্টর স্ট্রেঞ্জ? অ্যাভেঞ্জার্স? আয়রন ম্যান? ‘

‘আয়রন ম্যান?’

ইক্কিরে বাওয়া, মালটা টনি স্টার্ককে অবধি চেনে না দেখছি! গ্রাফিক টি শার্ট কেন, এর তো দেখছি স্যান্ডো গেঞ্জি অবধি বেচা উচিৎ নয়।

তবে স্টার্ক শব্দটা মনে আসতেই…

‘গেম অফ থ্রোন্স তো হোগা?’

‘??????’

এবার অসহিষ্ণুহয়ে পড়ি, ‘হাউস অফ স্টার্ক, টারগেরিয়ান? ল্যানিস্টার? অল মেন মাস্ট ডাই? কম করকে আই অ্যাম খালিসি অন্তত তো হ্যায়?’

‘নেহি বাবু, ই সব নেহি রাখতে’

‘তো তুমারে পাস একঠো ভি কাম কা টি শার্ট নেহি হ্যায় দেখতা হ্যায়। আরে ভাই মেরে লিয়ে কুছ তুমহারে পাস হ্যায় ইয়া নেহি, অ্যাঁ? ‘

সে ছোকরা অপাঙ্গে একবার দেখলো আমাকে। তারপর সরাসরি আমার মধ্যপ্রদেশের দিকে নজর রেখে ভারি নিঃস্পৃহ গলায় বললো,

‘দো ঠো কুংফু পাণ্ডা হ্যায়, দিখাউঁ?’

বলেছিলাম না, মনে হচ্ছে সে ছোকরাকে ধরে কেলিয়ে পাটপাট করে দিই, তারপর থেঁতো করে, আগুনে পুড়িয়ে, হামানদিস্তায় ফেলে গুঁড়ো গুঁড়ো করে..
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *