মার্কেট ভিজিট ১০

মার্কেট ভিজিট ১০

পাটনার সবচেয়ে উচ্চবিত্ত ও অভিজাত কলোনিটির নাম হল বোরিং রোড। নাম শুনে নাক সিঁটকোলে কি হবে, পাটনায় ওটিই কিন্তু একাধারে বালিগঞ্জ প্লেস, ডিফেন্স কলোনি এবং মালাবার হিলস, মানে মোস্ট হ্যাপেনিং প্লেস আর কি! ! ওই যে দেখছেন দোতলা বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে দাঁতুন করতে করতে থুক করে রাস্তায় থুতু ফেললেন যিনি, তিনি হয়তো রাজস্ব দপ্তরের মহাসচিব। কিংবা বিশাল বাংলোর হাতায় দাঁড়িয়ে যে দেহাতি মহিলাটি দেওয়ালে ঘুঁটে দিতে দিতে পাশেই এলিয়ে থাকা আয়তনয়না গরুটির দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে মৃদুমধুর হাসিতে মাতৃস্নেহের উদ্রেক করছেন, উনি হয়তো তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি। আর ওই যে পুরুষ্ট পুরুষটি হাতের খৈনিটা মুখে ফেলে, কোমরে লুঙ্গির গাঁট থেকে একটা মুঙ্গেরি ওয়ান শটার বের করে বগল চুলকোচ্ছেন, উনি হলেন গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর খাস পিএ, বুঝলেন তো? মোটমাট বোরিং রোড হল শহুরে বিহারের আঁভাগার্দ আর কি!

বোরিং রোড কলোনিতে ঢোকার মুখে আরেকটা যে রাস্তা পাটনার এই শঁজেলিজেটিকে আড়াআড়ি কেটে যায়, তার নাম বোরিং ক্যানাল রোড। মন্দির, ষাঁড়, ফুলবেলপাতা, জট লাগানো ট্র্যাফিক, ফর্মুলা ওয়ান বিজেতা রিকশাওয়ালা, মিশন ইম্পসিবল অনুপ্রাণিত পথচারী, জাগতিক ব্যপারে নিস্পৃহ এক সন্ন্যাসীপুলিশ, ইত্যাদি খচিত সেই বোরিং রোড চৌরাহা থেকে বাঁয়ে মুড়ে থোড়া সা আগে এগিয়ে পাবেন এস কে পুরী কলোনি। আর সেই কলোনি ঢোকার মুখেই রয়েছে,

পাটনা শহরের ”ফিরদৌস বররুয়ে”, সবচেয়ে বড় অথেনটিক মদের দোকানটি। একমাত্র এখানেই সমস্ত ব্র্যান্ড বলা মাত্র পাওয়া যায়,এবং নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে উটি খাঁটি মাল (পান ইন্টেন্ডেড)। মানে বস্তুটি কঙ্কড়বাগ বা চিতকোহরার কোন খাটা পায়খানা সংলগ্ন গোয়ালে চোলায়িত হয় নাই, এই নিশ্চয়তাটুকু গ্যারান্টিড, এই আর কি।

দুহাজার এগারোর শীতার্ত ডিসেম্বর। পাটনা এসেছি নতুন গো টু মার্কেট, বা জিটিএম মডেল ইম্পলিমেন্ট করতে। মিটিং ফিটিং ঝটপট শেষ করে আমি আর তৎকালীন এ এস এম বিহার, দুজনে হাসিমুখে সেই স্বর্গদ্বারের সমীপে। অনেক গভীর মনোজ্ঞ আলোচনার পর দুজনেই দ্রুত ব্লেন্ডার্স প্রাইডে একমত হয়ে, একটা ফুল বটল হাতে নিয়ে, টাকা মিটিয়ে বেরিয়ে আসবো, দেখি সামনে এক ঠেলাওয়ালা, বাদাম ছোলা চানাচুর ইত্যাদির পসরা নিয়ে, মদের দোকানের সামনে যেমন হয় তেমন আর কি।

মহেশের হাতে টুক করে বোতলটা দিয়ে বললাম পার্কিঙে গাড়িতে গিয়ে এটা রেখে গাড়িটা নিয়ে আয়, আমি কিছুমিছু নিয়ে নিই। কি খাবি, ছোলা দিয়ে বানাবো না বাদাম দিয়ে?

মহেশ খানিকক্ষণ গভীর চিন্তা করে বলল, বাদাম দিয়েই বানাতে বলিস, হ্যাঁ, একটু বেশি করে পিঁয়াজ দিতে বলতে ভুলিস না যেন, এই বলে তিনি বোতল হাতে নিয়ে দূরে পার্ক করে রাখা গাড়িটির দিকে রওনা দিলেন।

আমি অত্যন্ত পুলকিত হৃদয়ে অনভ্যস্ত ঠোঁটে ওড টু জয় শিস দিতে দিতে সেই ঠেলাওয়ালার সামনে এলাম।

তেনাকে দেখলেই মুক্তসাধক বলে মনে লয়। বসা গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে বৈরাগী দৃষ্টি। একটা শতচ্ছিন্ন বিতিকিচ্ছিরি রকমের নোংরা লুঙ্গি পরনে। প্রচুর কোম্পানি নিজেদের প্রচারের জন্যে ফ্রিতে টিশার্ট বিলোয়, তারই একটা গায়ে, পোস্ট কুরুক্ষেত্র কন্ডিশনে। সামনে একটি একটি কেঠো ঠেলা, ওই কুরুক্ষেত্র থেকেই আনা আর কি। তার ওপর বিভিন্ন বয়ামে (বোতল বা শিশি নয় হে, বয়াম,মাইন্ড ইট) বাদাম,ভাজা ছোলা, মুগডাল ভাজা, চানাচুর ইত্যাদি। সেই বয়ামক্ষেত্রের মধ্যে একটি বৌদ্ধযুগের রিকেটি দাঁড়িপাল্লা। দাঁড়িপাল্লার পাশে একটা স্টিলের বৌলে ভেজানো ছোলা, পাশের আরেকটা ঐ ঐ বৌলে ভেজানো ও সিদ্ধ কাবলি মটর। দাঁড়িপাল্লার পাশে একরাশ চারটুকরো করে কাটা পিঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা পড়ে। আরও আছে একটা ছোট্ট কিউবয়েড সাইজের কাঠের টুকরো, পিঁয়াজকুচি করার জন্যে।

যাই হোক। আসার আগে দুটো বিয়ার মেরেও এসেছিলুম। মনটা ভারি ফুরফুরে ছিল। এসে উদার মনে একশো গ্রাম বাদাম মাসালা অর্ডার দেবো, (কাঁচা লঙ্কা বেশি করে), ঠিক তক্ষুনি উনি এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন, পরনে সালওয়ার কামিজ, চুল মুঠো করে বাঁধা, একটা স্লিং ব্যাগ কাঁধের একপাশ থেকে ঝুলছে।

সেই ক্ষীনকটি তন্বীশ্যামাশিখরিদশনাপক্কবিম্বাধরোষ্ঠী মহিলাটির প্রতি কটাক্ষনয়নপাতমানসে ঘাড়টা ঘুরিয়েই আমি থ!

উনি শি নন, হি!

কিন্তু সে কথা কে স্বীকার করবে? সেই নতনেত্রদৃষ্টিসম্পাতে, লজ্জাপ্রকাশে, ব্রীড়ায়, লাস্যে, হাস্যে, হিল্লোলে, শরীরী বিভঙ্গে এবং কাজলনয়নকটাক্ষাঘাতে উনি সাক্ষাৎ অড্রে হেপবার্ন, রোমান হলিডের সেট থেকে ডিরেক্ট বিহারের এই সান্ধ্যবিহারে!

আশেপাশে অনেকেই দেখলাম একটু সরে গেলো। মদের দোকান থেকে এদিকে উঁকিঝুঁকি শুরু। ”মওসি আ গ্যয়ি ” বলে কে যেন দুই হাতের তালুতে চাপড় মেরে চটাস চটাস আওয়াজ তুলে বিশ্রী ভাবে হাসতে লাগলো। দোকান থেকে নেমে পাশ দিয়ে যাবার সময় একজনকে দেখলাম পানছোপানো দাঁত বার করে একটু চোখ টিপে যেতে।

আমারও, বলতে নেই একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ট্রেনে যা অসভ্যতা করতে দেখেছি এদের, রামঃ।

এমন সময় সেই উনি কাংস্যবিনিন্দিত ন্ট্রে বললেন ‘পাঁচ রুপাইয়েকা বাদাম দিজিয়েগা কাকা, পিঁয়াজ অওর মসালা জ্যাদা’। সেই ঠেলাওয়ালাও অত্যন্ত নৈর্ব্যক্তিক স্বরে ‘তিখা বানাউঁ?’ জিজ্ঞেস করে অভ্যস্ত হাতে বাদাম, পিঁয়াজকুচি আর কাঁচালঙ্কা কুচি একটা পায়খানার মগ টাইপ দেখতে প্লাস্টিকের ইয়েতে ফেলে, তাতে মাথাফুটো ছিপি লাগানো পুরোন প্লাস্টিকের বোতল থেকে টিপে একটু সর্ষের তেল ছিড়িক ছিড়িক করে ছিটিয়ে একটা ছোট্ট সরু কাঠের ডান্ডা দিয়ে নাড়াতে লাগলো। এরপর সেই ঘ্যাঁট একটা ঠোঙায় সযত্নে সাজিয়ে দিয়ে স্তিমিত স্বরে বললেন ‘ইয়ে লিজিয়ে, ছুট্টা দিজিয়েগা’।

সেই মানুষটি ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘মেরে পাস শ’রুপেয়া কা নোট হ্যায়, আপকে পাস ছুট্টা হোগা জী?’

প্রায় চমকে উঠেছিলুম, মাইরি বলছি। মানে ইয়ে আর কি, এইর’ম লোকজনদের সঙ্গে কথা বলতে এট্টু কেমন কেমন লাগে না? একটু সামান্য ভয়, অনেকটা ঘেন্না মেশানো একটা ইয়ে ইয়ে টাইপের আর কি। সেই ছোটবেলায় বাচ্চুকাকুদের বাড়িতে বাচ্চুকাকুর ছেলে হওয়াতে এরা ঢোল বাজাতে এসেছিল। বাচ্চুকাকুরা দরজা খোলেনি। ক্কি খিস্তি ক্কি খিস্তি মাইরি, তাও হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে। একজন তো ছ্যাড়ছ্যাড় করে পেচ্ছাপও করে দিলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রগড় দেখছিলাম, বাবা এসে কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো, স্পষ্ট মনে আছে।



সেই এদেরই একজন, আমার দিকে হাসিমুখে তাকাতে কেমন যেন মনে হল সেই প্রাচীন পেচ্ছাপের কয়েকটা ফেঁটা চোখেমুখে এসে লাগবে। ত্বড়িতগতিতে বলে উঠলাম ”ন্না, মানে অ্যাগদম খুজরা নেহি হ্যায়, বিশ্বাস কিজিয়ে”। আশেপাশের জটলা থেকে একটা হাসির হররা উঠলো, সিটির আওয়াজে আশপাশ মুখরিত। ইনি সামান্য অপ্রতিভ। এমন সময় সেই ঠেলাওয়ালা খুবই ক্লান্ত নিরাসক্ত স্বরে বললো, ‘ইধার দিজিয়ে, শায়েদ মেরে পাস ছুট্টা হ্যায়’। মিনিটখানেক পরে সেই মানুষটি যখন বেশি করে পিঁয়াজ দেওয়া ঝালঝাল বাদামমাখা আর পঁচানব্বই টাকা হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছেন, মদের দোকানের সামনে ”লচক মচক চলে জুবনা হামার” গান শুরু হয়ে গেছে সমস্বরে। মদের দোকানির মুখেও সস্নেহ মৃদু হাসি। প্রভূত অশ্লীল হাসির গরগরাহট স্তিমিত হয়ে এসেছে, এমন সময়ে আমি আমার অর্ডার দিয়ে স্বস্তির হাঁফ ছেড়ে সেই ঠেলাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘এইরকম জ্যায়সা লোগ আপনার কাছে আতা হ্যায়, আপনার খারাপ নেহি লাগতা হ্যায়?’

কোথায় একটু রঙ্গরসিকতা করবে বাকিদের মতন তা নয়, এ বাবু তেমনই নির্লিপ্ত স্বরে বললেন ‘কিঁউ? ইসমে খারাব লাগনেওয়ালি কেয়া বাত হ্যায়?’

না মানে, ছেলে না মেয়ে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, গলাটাও কেমন কেমন, কির”ম বিচ্ছিরি করে হাত্তালি দেয়, আশেপাশে এলে এট্টুস কেমন কেমন লাগে না?

উদাসীন ভাবে প্লাস্টিকের কৌটোয় ডান্ডা ঘোরাতে ঘোরাতে সেই নির্মোহ স্বরে উনি বললেন ‘উসমে হামরা ক্যায়া?’

তা নয়, তবে কিনা ঠিক আমাদের মতন ইয়ে, মানে নর্ম্যাল নয় কি না, দেখে এট্টুস গা” টা কেমন করে ওঠে না, অ্যাঁ?

সে ভদ্রলোক স্থিতধী বুদ্ধের প্রজ্ঞায় নির্লিপ্ততায় জিজ্ঞেস করলেন ‘ বাবুজি, এক চিজ বাতাইয়ে, আপকো ইয়া হামকো কওন বানায়া?’

সামান্য ঘাবড়ে গেসলুম, ”বানায়া” মানে? আমি কি, ইয়ে মানে বাদাম মাখা নাকি? তারপর যাকে বলে বক্তব্যটি প্রণিধান হল। হাসিমুখে বললুম ‘সব লোক তো বোলতা হ্যায় উপরওয়ালানে বানায়া হ্যায়, হ্যা হ্যা’।

‘হাম সবকো উওহি বানায়া, হ্যায় না?’

‘সে তো একশোবার হ্যায়’।

‘তো ফির উস ইনসান কো ভি উও উপরওয়ালে নে হি বানায়া হোগা। নেহি? আব ইসমে উপরওয়ালে কো কোঈ তকলিফ নেহি হুয়া, তো হামকো ক্যায়া? ইয়ে লিজিয়ে আপকা সামান, পচ্চিস রুপেয়া ছুট্টা দিজিয়েগা’।

টাকা মিটিয়ে চুপচাপ নিজের সামান নিয়ে বেরিয়ে এলুম।

ঈশ্বর যে কখন শিক্ষা দেন, কার হাত দিয়ে দেন, সে শুধু তিনিই জানেন!
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *