কর্পোবাবুর পুজোদর্পণ

কর্পোবাবুর পুজোদর্পণ

আমাদের ছোটবেলায়, বিশ্বকর্মা পুজো শেষ হলেই বেশ একটা পুজো পুজো ভাব ছড়িয়ে পড়া মাত্র আমরা, অর্থাৎ কচিকাঁচারা বইপত্তর তাকে তুলে দিতাম। বড়রাও পুজোর প্রস্তুতি শুরু করে দিতেন, পুজোর মাস মানেই খরচের মাস। কেনাকাটা, দেওয়া থোওয়া ইত্যাদির প্ল্যানিঙের পর আরেকটি ছোট্ট বাজেট এন্ট্রি লিখতেন, ”চাঁদা”!

কয়েকদিন বাদেই পাড়া এবং পাশের পাড়ার দাদারা ভারি লাজুক মুখে মুখে চাঁদা তুলতে আসতো। তারপর শুরু হতো দরাদরি। তারা হয়তো পঞ্চাশ টাকার বিল কেটে এনেছে, এদিকে বাড়ির কর্তা কিছুতেই আড়াই টাকার ওপর উঠতে রাজি নন। শেষে বহু কাকুতিমিনতি করে, ‘আপনাদেরই তো পুজো কাকু, হেঁ হেঁ, আপনারা না দেখলে আর কি করে চলবে বলুন ‘ইত্যাদি বলেকয়ে, ছলছলে চোখে যথেচ্ছ বাৎসল্য রসের উদ্রেক করে শেষে তেনারা কুড়িটাকা মত আদায় করে বিদেয় হতেন। যে বাড়ির সুন্দরী কন্যাটি আশেপাশের দশ কিলোমিটারের মধ্যে তাবৎ উঠতি যুবকের মনোবেদনার কারণ, সেই বাড়িতে চাঁদা আনতে যাবার জন্যে সবার সে কি উৎসাহের ধুম! সুবেশ যুবকদের পল্টন দেখে লোকজন ধন্ধে পড়ে যেত, ঘোষবাড়িতে আজ স্বয়ংবরসভা নাকি? তারপর সুযোগ বুঝে ‘মাসিমা, একটু জল খাওয়াবেন?’ তো ছিলই! আর ছিল পাড়ার যশোপ্রার্থী সম্পন্ন গৃহস্থটিকে ‘এ বছরে কিন্তু আপনাকেই প্রেসিডেন্ট হতে হবে কাকু, না বললে কিন্তু শুনছি না একদম’ বলে পেড়ে ফেলা, বাজেটের সিংহভাগ ওইখান থেকেই আসতো কি না!

ছবিটা পালটে গেল মায়ের পুজো যবে থেকে থিমের পুজো হয়ে উঠলো। থিমবাবু শৌখিন লোক, দশ কুড়ি টাকার চাঁদায় তেনার শখ মিটবার কথাও নয়। আর নব্বই দশকের শেষে এসে বাঙালি হঠাৎ আবিষ্কার করলো যে প্রতিবাদী, বিশ্বনাগরিক বাঙালির এখন কলকারখানায় তালা, পেটে খিদে এবং হাতে হ্যারিকেন! ফলে তার পক্ষে আর শুধু চাঁদা দিয়ে আড়েবহরে বাড়তেই থাকা পুজোর বাজেট ঘাটতি মেটানো সম্ভব নয়। কিন্তু বীর বাঙালিকে আটকানো কি অতই সহজ দাদা? হুজুগে জাতের নবনবোন্মেষশালিনী প্রতিভা আবিষ্কার করলো পুজোর বাজেট যোগাড় করার আরেক উপায়, কর্পোরেট স্পনশরশিপ!

আমার গপ্প সেই নিয়েই।

আমি ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্র পাঠান্তে একটি বিখ্যাত পেইন্টস কম্পানিতে জয়েন করি, প্রথমে বিহারের ম্যানেজার হিসেবে ও তারপর কলকাতার। অধুনা পুজোর বাজারে সেরা পুজো বেছে নেবার যে হিড়িক, তার শুভসূচনা করে এই কম্পানিটি, ”শারদসম্মান” ট্যাগলাইন দিয়ে। যদিও পুরো ব্যাপারটাই মুম্বাইয়ের হেড অফিস থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। আমাদের, অর্থাৎ লোকাল টিমের কাজ ছিল সপ্তমীর সন্ধ্যায় কয়েকজন বাছাবাছা ডিলারদের নিয়ে গাড়ি বুক করে বেরিয়ে, কলকাতার সেরা পুজোগুলো (বাগবাজার থেকে বড়িষা, বেলেঘাটা থেকে বাদামতলা ) সারা রাত ধরে দেখে সকালে বাড়ি ফেরা। বুঝতেই পারছেন, লাইনটাইন দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভি ভি আই পি হিসেবে খুবই গম্ভীর মুখে ঢুকে, কতই যেন বুঝছি টাইপ মুখ করে মাথাটাথা নেড়ে, পুজো উদ্যোক্তাদের এনে দেওয়া সন্দেশ কোল্ড ড্রিঙ্কস ইত্যাদি গলাধঃকরণ করে, ‘হেঁ হেঁ, আমাদের পুজোটা একটু দেখবেন স্যার’ টাইপের হাত কচলানো মাতব্বরদের দিকে প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি হেসে বেরিয়ে আসা, এটুকুই যা কষ্ট!

এর পরে অন্য কম্পানিতে আমাকে দীর্ঘদিন কলকাতা ও দক্ষিণ বঙ্গ, এবং তদপরবর্তী সময়ে সমগ্র পূর্ব ভারতের দায়িত্ব সামলাতে হয়। এবং তখন এই কর্পোরেট স্পনসরশিপের পুরো ব্যাপারটিকে, যাকে বলে পরিপূর্ণ রূপে অবলোকনের সুযোগ পাই।

এখানে একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে দেওয়া ভালো যে এতে কিন্তু বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা ও ক্লাবগুলির মধ্যে রীতিমতো ”ডিল” হয়। চমকানো ধমকানোর বা জোরাজুরির কেসই নেই। অনেক ক্ষেত্রেই কম্পানিগুলি নিজেরাই বিভিন্ন পুজো কমিটিগুলিকে ডাকে এবং কত টাকার বিনিময়ে কম্পানিগুলি কি কি সুবিধা পাবে তা ফাইনাল হয়। পলিটিক্যাল লিডারদের চিঠি যে আসে না তা নয়, তবে সে সব ছাপা চিঠি, স্যুভেনিরের সঙ্গে আসে, এবং সব কম্পানির কাছেই আসে, পাত্তা না দিলেও চলে। একবারই শুধু আমার কাছে উত্তর কলকাতার একটি ক্লাবের হয়ে তৃণমূলের এক বিখ্যাত নেতার ফোন এসেছিলো, যিনি অধুনা মন্ত্রীও বটে। তিনি যে ভাষায় অনুরোধ করছিলেন, তাকে কাকুতিমিনতি বললেই চলে। আমি নিজেই ভারি অপ্রস্তুত হয়ে যখন বললাম যে ঠিক আছে, অত করে বলতে হবে না, ব্যবস্থা হয়ে যাবে, তিনি ঝাড়া পাঁচ মিনিট আমার এবং আমার পরিবারের প্রতি প্রাণঢালা আশির্বাণী শুনিয়ে, পুজোতে অষ্টমীতে কিন্তু ক্লাবে এসে ওঁর সঙ্গে ভোগপ্রসাদ খেতেই হবে দাবি জানিয়ে ফোন রাখেন, বোধহয় ফোনে চুমু খাওয়াটাই বাকি ছিল!

এবার আসল কথা, কম্পানিগুলির এতে লাভ কি? লাভ একটাই, নিজের প্রডাক্টস বা সার্ভিস আরো বড় করে লোকের সামনে তুলে ধরা। এটাও এক ধরণের ব্র্যান্ড বিল্ডিং অ্যাক্টিভিটি। ঠিক যে কারণে কম্পানিগুলি টিভি, রেডিও, খবরের কাগজ ইত্যাদি গণমাধ্যমগুলিতে বিজ্ঞাপন দেয়, ঠিক সে কারণেই দুর্গাপূজাতেও স্পনসরশিপ দেয়।

(জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, এই যে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া, একে মার্কেটিং এর পরিভাষায় বলে এটিএল বা অ্যাবভ দ্য লাইন অ্যাক্টিভিটি। কার কেন কিসের লাইন, সেসব বিজৃম্ভণক্লিষ্ট আলোচনায় আর ঢুকছি না)।

কিভাবে? আপনারা নিশ্চয়ই যে কোন প্যাণ্ডেলে ঢোকার মুখে দেখেছেন প্রচুর ব্যানার আর ফেস্টুন বাঁশের ব্যারিকেডে সাঁটানো। বা উঁচু উঁচু বাহারি বিজ্ঞাপনী গেট। বা বিভিন্ন কম্পানির স্টল। ওই গেট বা ফেস্টুন ইত্যাদি লাগানোর জায়গাটুকু ভাড়া নেয় বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা, এবং তার মধ্য দিয়ে নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন, এই হচ্ছে মোদ্দা কথা। এসবই হচ্ছে গণমানসে আমার কম্পানির আলালের ঘরের দুলালটিকে আপনার মনে একটু একটু করে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। যাতে পরের বার আপনার তেষ্টা মেটানোর সাধারণ প্রয়োজনীয়তাটুকু যেন শুধুমাত্র কোকা কোলা পানের চাহিদাটি হয়ে ওঠে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার প্রাথমিক ইচ্ছেটুকু যেন একমাত্র ডাভ সাবান দিয়েই শ্রীঅঙ্গ মার্জনের আকাঙ্ক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপারটা আশা করি জলবত্তরলং বুঝে গেছেন।

এসব কাহিনীর শুরু অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে। তখন থেকেই বিভিন্ন পুজো কমিটির স্যুভেনির পাঠানো ও অফিসে এসে তদ্বির তদারক করা শুরু। স্যুভেনিরে থাকে ওঁদের পুজোর ব্যাপারে ভাবগম্ভীর ব্যাখান (”জগদীশ্বরের কৃপায় আমাদের এই মাতৃবন্দনা আজ বিংশতিতম বর্ষে”), কোন কোন প্রাইজ জিতেছেন গত দশ বছরে তার লিস্টি (”নটিগার্ল” হাওয়াই চপ্পল কম্পানি থেকে ”অসুরের সেরা জুতো” পুরষ্কার ), এবং শেষ পাতায় কাজের কথা, অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে কত কাঞ্চনমুদ্রা এঁয়ারা ধার্য করেছেন। যত বিখ্যাত পুজো এবং যত বেশি ‘ভিজিবিলিটি’ অর্থাৎ দৃশ্যমানতা, তত বেশি দাম। যেমন গেটের দাম এক লাখ হলে, স্টল পঞ্চাশ হাজার। এক্সিট গেটের সামনে বিশাল ফ্লেক্স হলে ন্য)নপক্ষে পঁচিশ হাজার, আর স্যুভেনিরের কভার পেজ পাঁচ হাজার। আবার সুরুচি সংঘের পুজোর গেট এবং বাবলতলা আমরা সবাই ক্লাবের পুজোর গেটের মধ্যে চাঁদার পরিমাণে আকাশপাতাল তফাৎ।

এসব রেট প্রথমবার দেখে প্রাণান্তকর হেঁচকি উঠলেও পরের দিকে ব্যাপারটা চট করে বুঝে ফেলি। এক্ষেত্রে হাতির খাওয়ার দাঁত আর দেখানোর দাঁতের মধ্যে দুর্গম গিরি কান্তার মরু টাইপের ব্যবধান। একলাখি গেট সামান্য হাসিঠাট্টাতেই পঁচিশে নেমে আসে। এক্সিট গেটের ফ্লেক্স (‘ওটা কিন্তু দাদা পঁয়েরোর কমে হবে ন্না ন্না ন্না’) এককাপ চায়ের পরই সাড়ে সাতে ফাইনাল হয়ে যায়। ‘স্যুভেনিরটা একটু দেখবেন ভাইটি’ অনুরোধমত পাঁচহাজারি কভার পেজটি অক্লেশে এক হাজারে বুক হয়ে যায়।

মুশকিল হয় যদি আপনার অফিসের সামনে কোন বড় পুজো হয়। আমার অফিস ছিল পার্ক সার্কাস দরগা রোডে, গলির উলটোমুখেই পার্কসার্কাস সার্বজনীন। সেখানের ক্লাব কমিটির লোকজন সেপ্টেম্বর নাগাদ হানা দিতেন, সবচেয়ে শাঁসালো গেট বা ফ্লেক্সের জায়গাটি আমাদের জন্যে ছেড়ে। তাঁদের যিনি দলনেতা বা সেক্রেটারি ছিলেন, মধ্যচল্লিশের সেই ভারি সুপুরুষ যুবকটির সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতাই হয়ে গেছিলো।

তিনি এসেই ভারি আন্তরিক ভাবে ‘অ্যাক্কাপ চা খাওয়ান ভাইটি’ বলে বেশ জাঁকিয়ে বসতেন। চা পানান্তে তিনি ভারত ও মার্কিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ, আধুনিক বাংলা সাহিত্য কোন পথে, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের দুরবস্থা, আজকালকার ছেলেমেয়েদের মূল্যবোধের অভাব তথা সর্বব্যাপী সামাজিক অবক্ষয় ইত্যাদি বিষয়ে খুবই মনোজ্ঞ আলোচনার পর আসল বিষয়ে অবতীর্ণ হতেন। চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে একটা গভীর তৃপ্তির ‘আঃ’ উচ্চারণ করে ভারী গলায় বলতেন ‘আপনাদের পাড়ারই পুজো, বেশি কিছু বলার নেইও, বড় গেটটাই আপনাদের জন্যে রেখেছি। একলাখের বেশি একটি পয়সাও ঠেকাবেন না কিন্তু, এই বলে রাখলুম’। তবে প্রথম যেবার আমার সঙ্গে, যাকে বলে ”নয়নে নয়ান” হয়, সে অভিজ্ঞতা বোধহয় ভদ্রলোকের জন্যে খুব একটা সুখকর হয় নি। উনি যেই বলেছেন, ‘আপনাদের পাড়ারই পুজো ভাই’, আমিও ছলছল চোখে গলদশ্রু হয়ে বললাম ‘আপনাদের পাড়ারই কম্পানি দাদা, আপনাদের ওপর তো আমাদেরও তো একটা অধিকার আছে, না কি? গেটটাই যখন রেখেছেন দাদা, নিশ্চয়ইই নেবো, কিন্তু দশের বেশি দিতে পারছি না, বিশ্বাস করুন, এর বাইরে আমাদের বাজেটই নেই!’ ভদ্রলোক খানিক্ষণ স্তম্ভিত অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, ‘ভাইটি কি বাঙাল?’

বাঙালকে বাঙালই চেনে ভালো!

তবে যাঁরা এতটা পড়ে ভাবছেন এতেই কম্পানির পক্ষে ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির কর্তব্যকর্ম শ্যাষ, তাঁদের সবিনয়ে জানাই, আপনার মতন অজ্ঞানতিমিরান্ধস্যর কিন্তু ভালো দেখে এক পিস জ্ঞানাঞ্জনশলাকার আশু প্রয়োজন। আরে মশাই এ তো গেলো সাবস্ক্রিপশনের খরচা, আসল কাজ তো এর পর। এর পর যে ফ্লেক্স, ব্যানার, বা দ্রষ্টব্য বস্তুটি উক্ত স্থানে ঝুলিত বা শোভিত হইবেক, তাহারও তো ব্যবস্থা করতে হয়। এর প্রথম পর্যায় হলো ব্র্যাণ্ড ম্যানেজারকে ফোন করে ফ্লেক্স বা ব্যানারের ডিজাইনটি আনিয়ে নেওয়া, এবং এইখান থেকেই আপনার অগ্নিপরীক্ষার শুরু। সচরাচর প্রথম যে ডিজাইনটি আসে তার বাংলা বানান বা বাক্যগঠন দেখলে বাক্যি হ’রে যায়, গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে পড়ে, রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে ও ধর্মেন্দ্রবিক্রমে ‘কুত্তে, কমিনে, ম্যায় তেরা খুন পি জাউঙ্গা” বলে ম্যানেজারটির ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়ে দিতে ইচ্ছে করে। অতঃপর সেই কচি ম্যানেজারশাবকটিকে যথেষ্ট মানসিক যন্ত্রণাদানের পর ঠিকঠাক ডিজাইন তো এলো, এরপর ভেন্ডর ডেকে বাকি কাজ। এইসময়ে কাজের চাপ এতো বেড়ে যায় যে, দুদিন আগে যে কর্মপ্রার্থী ভেন্ডরভাইটি দুবেলাই কাজের খোঁজে অফিসে ধর্ণা দিতেন, পুজোর আগে তিনি সাক্ষাৎ ঝিলিকের মা! এতদসত্বেও অনেক কষ্টেসৃষ্টে, পুর্বজন্মের অশেষ সুকৃতির ফলে তাঁকে পাকড়াও করে দায়িত্ব সঁপে দিয়ে যদি ভাবি নাহ, এইবার পুজোগণ্ডার দিনে আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে কিছু গুষ্টিসুখ অনুভব করবো, তবে দাদা শুনে রাখুন সে গুড়ে শুধু বালি নয়, পুরো চন্দননগর!

মহালয়া থেকে পঞ্চমী অবধি নিত্যি ঝামেলা। রণেবনেবাথরুমে ফোন আসছেই।’ অ দাদা, মাঠে ড্যেঁইড়ে আচি তো দুফর থিক্যে, গেটের মাপ নেবু বল্যে, কমিটির লুকজন ত কেউ কত্থাও নাই গ’ শুনে চিড়বিড়িয়ে উঠেই ভাবছি ব্যাটার গর্দান নেবো কি না, এমন সময়ে ভারি সুললিত গলায় ‘ইয়ে, স্যার, আপনার কত ইঞ্চি? মানে ফ্লেক্সের পেছনে যে বাটাম দেবো তার ইঞ্চি কত?’ শুনে আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। তারপর প্রাজ্ঞ ভেন্ডরটি যখন অকুস্থল থেকে ফোন করেন, ‘সরকারবাবু, আপনার সঙ্গে পুজো কমিটির কথা হয়েছিল যে এক্সিটের ফ্লেক্সটা আপনাদের। এখন দেখছি ওখানে এগারোটা ফুচকার স্টল নিয়ে হার্বাল ফুচকাজোন তৈরি হচ্ছে, আপনার ফ্লেক্স কিন্তু ঢাকা পড়ে যাবে, ওটা এন্ট্রি গেটে করে দিই?’ তখন উপায়ান্তর না দেখে সহমত হতেই হয়। এদিকে ষষ্ঠী এসে গেছে, পুজোর বাজার হয়নি, গিন্নির নৈমিত্তিক গঞ্জনাতে জীবন দুর্বিষহ। ফলে বেরোতেই হয়, এবং গিন্নির পছন্দের জুতোটি কেনার সময় ফের সেই ফোনার্তনাদ, ‘ছ্যার, এয়াগো গ্যাটের বাশখান তো দেহি ব্যাবাক ত্যাড়া, প্যারেকখান সান্ধাইতাসে না, করুমডা কি?’ তখন একহাতে বাহারি জুতো নিয়ে আরেক হাতে ফোন ধরে এই জ্ঞানপিপাসুকে বঙ্কিম বংশদণ্ডে পেরেক পোঁতার অ্যালগরিদম বাতলাতে থাকি। আশেপাশের লোকজন শুনেই ছিটকে যায় ! গিন্নির মুখচন্দ্রমা ঘনকৃষ্ণ নবজলধর রূপ পরিগ্রহ করে।

তাতেও রেহাই নেই। সন্ধেবেলা বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে কিঞ্চিৎ আসবপানে প্রমত্ত। নেক্সট কয়েকদিন মোচ্ছবের যাবতীয় প্ল্যান রেডি। এমন সময়, ফের সেই! ফোন তুলতেই কাতর আর্তনাদ, ‘ও বড়দা, অমুক পুজো প্যাণ্ডেলে আর বাঁশ নেই যে, আমাকে কিছু বাঁশ দিন প্লিজ!’

অমন লোভনীয় আমন্ত্রণ থাকা সত্বেও ফোন অফ করতে বাধ্য হই, ষষ্ঠীর দিনে কে কার বড়দা?

রাত্রে গিন্নি বুকে হাত বুলিয়ে দেন, ‘খুব কাজের প্রেশার যাচ্ছে, না?’ তৎক্ষণাৎ পাশ ফিরে গিন্নিকে পাশবালিশ বানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

আর আমার পুজো শুরু হয়ে যায়।
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *