মার্কেট ভিজিট ৮

মার্কেট ভিজিট ৮

এখনো মে মাস আসেনি, তাতেই মুম্বাইতে যা ফাটিয়ে গরম পড়েছে মশাই,সে আর কহতব্য নয়। বেশি বকাঝকাও করতে পারছি না ছেলেগুলোকে, মুখ খুললেই গলা শুকিয়ে কাঠ। আর সেই শুকনো গলা ভিজোতে গেলে যা করতে হয়, সেসব আবার অফিস টাইমে করলে বস স্রেফ একটা সাদা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবে, ”নিচে জাস্ট সইটা করে দিয়ে পাগলা, বাকিটা আমরা লিখে নেবো”!

এমন দিনে এই চাঁদিফাটা গরম টাকে নিয়ে মালাড এসেছি মার্কেট ভিজিটে। এই প্রবল বৈশাখে বাধ্য হয়ে পুরো মৌনী তাপস হয়ে আছি, হুঁ হাঁ করেই কাজ চলছে আপাতত। ছেলেগুলো ভয়ে কাঁটা, জনান্তিকে একে আরেকজনকে বলছে ‘স্যার বহোত গুসসে মে হ্যায় আজ, কুছ বোল তক নেহি র‌্যাহে হ্যায়’। গরমে রাস্তার পিচগুলো অবধি গলে উঠেছে, রাস্তায় কুকুর বিড়াল আর সেলসের গুটিকয় অবোধ ছাড়া জনমনিষ্যি নেই।

তা ঘন্টাচারেক বাদে মার্কেট শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, এমন সময় সেই মলয় সমীরণক্যালানো বিকেলে সেলসম্যান ছোকরাটি খুবই বিনয়ের সংগে হাত কচলাতে কচলাতে নিবেদন করল প্রভু যখন দয়াদাক্ষিণ্য দেখিয়ে আবির্ভূত হয়েই পড়েছেন, সংকটমোচন বিপত্তারণ হওয়ার একটু ইচ্ছে কি এই বিশাল হৃদয়ের কোন কোণায় ঘাপটি মেরে আছে, অ্যাঁ?

অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বল্লুম, ‘খুলে বল, কেসটা কি?’

খবরে প্রকাশ, পাশের মার্কেটে জনৈক বড় হোলসেলার, বালাজী ট্রেডার্স, ইনি নাকি ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে মিষ্টি অভিমানপূর্বক ব্যাবসাপত্তর বন্ধ করে রেখেছেন গত মাসদুয়েক ধরে। খুবই বড় হোলসেলার, পার মান্থ বিল ভ্যালুও খুব বেশি। রাজায় রাজায় এই যুদ্ধে এই উলুখাগড়াসম কচি সেলসম্যানটির ইন্সেন্টিভের ইয়ে মারা যাচ্ছে নিয়ম করে। ফলে উপস্থিত পালনহারের সকাশে এই করুণ আর্তি, তুমরে বিন হামরা কোঈ নেহি!

এসব আমার ডিউটির মধ্যেই পড়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘আচ্ছা, চল। দেখি কি করা যায়’।

গিয়ে যা বুঝলুম, কেস অতি সামান্য। একটি ড্যামেজ গুডস রিটার্ন নিয়ে ফালতু বাওয়াল। রিজিওনাল ম্যানেজারের বা আমার অতি সামান্য অ্যাপ্রূভালেই কাজ হয়ে যায়। ফলে কেস জমে ক্ষীর। চা এলো, ফুটপাথের তিন ফুটিয়া চা নয়, অন্দরমহল থেকে ঘন দুধের এলাচ আদা দেওয়া চা। অনেক সুখদুঃখের গল্প হল মালিকের সংগে, প্রায় অশীতিপর এই প্রাজ্ঞ লোকটির নাম অশোক কেবলরামানি। অনেক দুঃখ করলেন, একমাত্র ছেলে নিউ ইয়র্কে ফোটোগ্রাফির দোকান খুলে বসেছে, ব্লাডি ইন্ডিয়ার এই নোংরা বাজারের অন্ধকার দোকানে বসে, ঘেমো ফতুয়া পরে, হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে থাই চুলকোতে চুলকোতে ডাল আর শুকনো লংকা বেচতে তার বয়েই গেছে। তার ওপর ওনার নিজের হাই কোলেস্টেরল, শুগার। তার মধ্যে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হল দুটো চোখেই ছানি, শুগার বলে কাটাতেও পারছেন না। তারপর আজকালকার ছেলেছোকরাদের মতিগতি,আইপিএলে টাকার খেল, মমতা ও মোদীর তুলনাত্মক রাজনীতি, ভারতের অর্থনীতি কোনপথে, হিন্দি সিনেমাতে সংস্কৃতির অবক্ষয় ইত্যাদি অনেক মনোজ্ঞ আলোচনার শেষে নমস্কার করে উঠবো, ভদ্রলোক বললেন চলুন, রাস্তার মোড় অবধি আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসি।

যথারীতি ভদ্রতা করে বলতেই হল, ‘আরে না না, হেঁ হেঁ, তার আর দরকার হবে না।’

তিনি স্মিত হেসে বললেন ‘আরে চলুন চলুন, আমারও কাজ আছে ওদিকে।’

খুব সিরিয়াস কাজ নাকি? কোথাও নামিয়ে দিয়ে যাই?

জানা গেলো তা নয়, কাছেই বাবুলালের লেড়কা নতুন ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান খুলেছে, একটা মোবাইল না কিনলে খারাপ দেখায় খুবই, তারপর একটু লোকাল রেলস্টেশনে যাবেন, পরের সপ্তাহে আমেদাবাদ যাবার ট্রেনের টিকেটটা কনফার্ম হয়েছে কি না জানতে, তারপর ইলেক্টিসিটি আর গ্যাসের বিল জমা দিতে আসবেন পাড়ার মোড়ের মোবাইলের ক্যাশকার্ডের দোকানটায়, যেটা ওনার ছেলের ছোটবেলার ল্যাঙ্গোটিয়া ইয়ারবন্ধুটি এই রিসেন্টলি খুলেছে। দশ টাকা পার বিলের বিনিময়ে ওরাই সব টাকা জমা করে দিয়ে আসে। কিছু সবজি ওগ্যায়রাহ ওগ্যায়রাও কিনতে হবে, তাই…

একটু অবাক হলাম। আজকালকার দিনে এসব কিনতে বা করতে কেউ আবার বাইরে বেরোয় নাকি মশাই? আপনার হাতে দিব্যি দেখছি দামি মোবাইল (”লেড়কানে ভেজা, বাহোত কিমতি হ্যায়”), আরে অ্যাপ ডাউনলোড করুন, অর্ডার দিন, বাড়িতে এসে পৌঁছে দিয়ে যাবে যে! তার ওপর ডিসকাউন্ট, ক্যাশব্যাক, বোনাস ফ্রিবিজ, এই আনন্দবাজারে লোকে লুটেপুটে নিচ্ছে যে দাদা। আপনি এখন হেঁটে চললেন এদ্দুর এই সব করতে? বাড়িতে দুদুটো কাজের লোক থাকতেও?

ক্যায়সে হোতা হ্যায়? অ্যাপ জিনিসটা তো মালুম হ্যায়, কিন্তু…

কিন্তু আবার কি স্যার? মোবাইল কিনবেন,আরামসে কিনুন না! অ্যামাজন ফ্লিপকার্ট বাদ দিয়েও আরও একশোটা অ্যাপ আছে সস্তায় মোবাইল কিনবার, হেবি ডিসকাউন্ট, বাবুলালের লেড়কার সাধ্যই নেই ওই প্রাইস অফার করে। দুমিনিটের মামলা কাকা, ঘরে বসেই। আর টিকেটের স্টেটাস জানতে সেই স্টেশন যাবেন?? হ্যা হ্যা হ্যা হাসালেন কর্তা। ইরেইল ডাউনলোড করুন, তাছাড়াও আইআরসিটিসিরও সাইট আছে, বেফিকর আঙুল টিপবেন, দুমিনিটে স্টেটাস জ্বলজ্বল করে আপনার স্ক্রীনে, হেঁ হেঁ…ট্রেন তো বাদই দিন, ফ্লাইট বুক করুন, ট্রেন বুক করুন, ট্যাক্সি বুক করুন, হোটেল বুক করুন…অ্যাপ আছে গন্ডাগুচ্ছের এদিকওদিক… কয়েকমিনিটের ওয়াস্তা, স্মুদলি আপনার সব জরুরত, সব মুশকিল আসান করে দেবে চুটকি মেঁ। আর ইলিট্টিরির বা গ্যাসের বিল জমা দিতে এত কান্ড? খ্যাঁক খ্যাঁক খৌয়া খৌয়া ও হো হো হো, উফফফ হাসালেন দাদা। পেটিএম আছে, মোবিকুইক আছে, তিরিশ সেকেন্ডে পেমেন্ট শেষ। নো হ্যাসলস ডিয়ার স্যার। তার ওপর ক্যাশব্যাক, মাই গুডনেস, ক্যাশব্যাক! মানে হাজার টাকার কথা বলে হাজার টাকার বিল দিলেন, টুক করে দেখলেন একশোটাকা আপনার কাছেই ফিরে এলো, কি মজা, না? আর আপনি চললেন কেঁচড়ে ক্যাশ নিয়ে ছেলের বন্ধুর দোকানে, ছ্যা ছ্যা। আরে অশোকজী, অওর ছোড়ো, আজকাল তো সবজি অবধি ডেলিভার করে দিচ্ছে এই স্টার্টাপ গুলো। ঘরে বসে ডাল, সবজি, দুধ, মাখন…

আমার ওয়াইফের কচি পালং ভালো লাগে, কচি পালং, একটু শক্ত লাল কুমড়ো আর ছোট ভিন্ডি। বড় ভিন্ডি খেলে ওর শরীর খারাপ করে। আপনার অ্যাপওয়ালারা ওসব বেছে নিয়ে আসবে? আমি যেমন করে দেখেশুনে বেছে আনি, আমার গিন্নির জন্যে?

ইয়ে, বোধহয় না। তবে কিনা….

বাবুলাল বহুত আচ্ছা দোস্ত ছিল, গত বছর পারেল যাবার সময় লোকাল থেকে পড়ে যায়। বাচ্চা ছেলে ওর, এখনো গ্র্যাজুয়েশন দেয়নি,দোকান খুলেছে…

হেঁ হেঁ, সে তো বটেই…. তবে কি না,

আর স্টেশনের মাস্টার পারভেজজী অনেক দিন ধরে আছেন, অবরে সবরে হেল্প করেন, বুকিং ফুল থাকলেও একটা সীটের ব্যবস্থা করেই দেন। উনি ফাঁকা থাকলে একটু বসেও আসি। উনি অনেকটা ছোট যদিও আমার থেকে, একটু গল্পগুজবও করি। পারভেজজীর একটাই মেয়ে, শাদির পরে কি হল কে জানে, উও পাগলি গায়ে আগ লাগিয়ে মরে গেছে, বিবিও পাগল হয়ে গেছে, একটু কথা বললে ভালো লাগে, এই আর কি।

আর বন্ধুর ছেলে, আমার ছেলের মতই, ব্রাইট বয়, বাপ মিউনিসিপালিটির গেটকীপার ছিল। খেটে খাচ্ছে, দশটাকা দিলুম না হয়। চাচা চাচা বলে, চা খাওয়ায়, লোকজন আসে, দুটো কথা হয়, হালহকিকত জানতে পারি সব।

আহ, সে তো বুঝলুম, কিন্তু টেকনোলোজির এই দুনিয়াতে….

আমার ভালো লাগে দাদ্দা। দুকানে যাই, মার্কেটে যাই, দরাদরি করি, ঝগড়া করি, আমার ভালো লাগে, সমঝে? লোকজনের সংগে কথা বলি, হাসি মজাক হয়, আমার খুব ভালো লাগে। এত লোকজন, এত আলো, এত হাসি, এত মানুষ। আমার ভীষণ ভালো লাগে। আজকালকার নওজোয়ানদের সবাই দেখি মাথা নিচু করে মোবাইলে টুকটুক করে চলে, পাশের মানুষের সংগে বিলকুল বাতচিত করে না। আমার খারাপ লাগে দাদা। এত কিসের কামকাজ তোদের হামেশা?

আরে অশোকজী, আজকাল টেকনোলোজি এত এগিয়ে গেছে, সব কিছু অ্যাপের দৌলতেই হাতের মুঠোয়, আপনি বেকার বেকার সেন্টিমেন্টাল হচ্ছেন…

আচ্ছা? সব কিছুরই অ্যাপ আছে বলছেন দাদা?

আছেই তো, অলমোস্ট অল। আপনার এখন কিসের অ্যাপ লাগে বলুন, অ্যাঁ?

বৃদ্ধ প্রাজ্ঞ ব্যাবসায়ীটি ছোখ কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে, আলতো করে চোখ টিপলেন, আই অ্যাম সেভেন্টি ফাইভ দাদা। যে কোন দিন উপর থেকে বুলাওয়া আসবে, আসবেই। একটা কথা বলুন তো, সেই দিন আমার আরথি ওঠাবার জন্যে চারটে কাঁধ লাগবে। আছে নাকি দাদা এমন কোন অ্যাপ যে আমি মরলেই আশেপাশের থেকে জান পেহচান চারটে কান্ধা জোগাড় করে দেবে?

আমি মূক ও স্থবির!

আছে নাকি দাদা? আমার বউ, আমার ছেলে এরা আমার বডির ওপর কেঁদে পড়লে একটু শান্ত করার অ্যাপ? নেই বাবুমশাই, নেই। আমি বলছি নেই। তাই আমি এদের কাছে যাই। কথা বলি, হাসি মজাক করি, জরুরত পড়লে দেখি। এরাও আমাকে দেখে। এক হপ্তা বাজারে আমাকে না দেখলে আমার খোঁজ করতে আসে। অ্যাপ আসে না দাদা, মানুষ আসে। এখন বলুন, আছে নাকি কোন অ্যাপ, আমার আরথি ওঠাতে চারটে কান্ধা দেবার জন্যে?

বাজে বুড়ো, খচ্চর বুড়ো, নিজেকেই মনে মনে বললাম এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ফেরার সময়। আমাকে তাহলে শুরু করতে হবে নাকি এখন থেকেই? চারটে বন্ধু ফিক্স করে রাখতে হবে?

আমি মরে গেলে চারটে কাঁধের জন্যে???

ও মশাই, আছে নাকি এমন অ্যাপ, মরে গেলে চারটে কাঁধ দেবার জন্যে? কাছের লোকের চোখের জল মোছাবার জন্যে? অ্যাঁ? আছে?
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *