প্রবাসে মুম্বাইয়ের বশে

প্রবাসে মুম্বাইয়ের বশে

দু হাজার চোদ্দ থেকে দু হাজার সতের, জীবনের তিন তিনটে অমূল্য বছর ভারতবর্ষের বাণিজ্য রাজধানী মুম্বাইতে কাটিয়েছি। বলত নেই, শহরটার প্রতি আমার একটা আশ্চর্য ভালবাসা আছে। আমার এক মুম্বাইবাসী সিনিয়র বলেছিলেন, মুম্বাই গ্রো’জ অন ইউ। সে কথাটা এখন প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। কলকাতার পর কোনও শহরকে যদি সত্যি ভালবেসে থাকি তাহলে তার নাম মুম্বাই।

অথচ যখন মুম্বাইতে থাকতাম তখন কিন্তু আমার মন পড়ে থাকত কলকাতায়। শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগের উপমা দিতে গিয়ে বড়লোক বাবুর বাড়িতে কর্মরতা ধাইদের উদাহরণ দিয়েছিলেন, যাঁরা পয়সার জন্যে মালকিনের সন্তানদের মাতৃসমস্নেহে পালন করেন বটে, কিন্তু মন পড়ে থাকে গ্রামের বাড়িতে অনাদৃত, অবহেলিত নিজের নাড়িছেঁড়া ধনটির প্রতি। মুম্বাইতে আমার অবস্থাটা ছিল ঠিক এই ধাত্রীদেবীদের মতই। যতই ভালোবেসে হরা চাটনি দিয়ে ভড়া পাও চিবই না কেন, মনটা সদাসর্বদাই পার্ক স্ট্রীটের কাটি রোলের জন্যে হাহাকার করতে থাকে। বন্ধুদের মধ্যে মনোজ্ঞ আড্ডায় কেউ বার্সা বললেই অবধারিত ভাবে আর্সা, মানে আরসালানের কথা মনে পড়ে যায়, রিয়াল মাদ্রিদ উল্লেখমাত্রে রয়্যালের মাটন চাঁপের স্মৃতি হৃদয় আর্দ করে তোলে।

শ্রীরাধিকা নাকি পূর্বরাগের শেষ দিকে কালো মেঘ দর্শনমাত্রে ”হা কৃষ্ণ” বলে ভাবাবিষ্ট হতেন। আমিও ফিনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ফ শুনেই একবার ”হা ফুচকা” বলে কেঁদে আকুল হতে যাচ্ছিলাম। নেহাত সিইও কড়া চোখে তাকাতে কান্নাটা কেঁৎ করে গিলে নিতে বাধ্য হই।

এতটা পড়েই যে সব মহাত্মনদের মনে এই কুটিল জিজ্ঞাসা জেগে উঠেছে যে ”এত্ত আঠা যখন, তাহলে এই ডিহি কলকেতা ছেড়ে মুম্বাই গেসলে ক্যান বাপু?” তাদের জন্যেই আসল গল্পটি খোলসা করে বলতে বাধ্য হচ্ছি। তার সঙ্গে রইলো আমার মুম্বাই প্রবাসের কিছু টক ঝাল মিষ্টি সুখস্মৃতি।

দু হাজার চোদ্দর জুন মাস। এপ্রিল থেকেই তৎকালীন বস খুবই উদারভাবে মুম্বাই আসার ঢালাও আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন, আমিও তা না না করে এড়িয়ে যাচ্ছিলুম। একবার তো স্পষ্ট ভাষায় বলেই দিলেন, ‘ভাই, ইস্ট রিজিওনের যা ক্ষতি করেছিস সে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। নসুপনা না করে মুম্বাইতে এসে আমার কেবিনের বাইরে একটা টুল পেতে বস দিকিন, কি কাজকম্ম করিস তার খোঁজপত্তর নিতে হচ্ছে যে। এতগুলো টাকা মাইনে নিস, ঘি টা ভস্মে ঢালছি কিনা সেটাও তো দেখতে হবে রে বাপু’! আমিও ‘হেঁ হেঁ হেঁ, কি যে বলেন ছার’ বলে ড্রিবল করে বেরিয়ে গেলুম।

এমন সময়ে এলো জামাইষষ্ঠী। তার আগের রাতে অনেক কেঁদেকঁকিয়ে চেষ্টাচরিত্র করে গিন্নির কাছ থেকে তিনটি পেগের অনুমতি আদায় করেছি, দিলটা তরর হয়ে আছে। কি একটা বই পড়তে পড়তে (মনু সংহিতা বা ফিফটি শেডস অফ গ্রে হবে) ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছি। জীবনটা বড় সুমধুর স্বপ্নের মতন লাগছে, এমন সময় কোন একটা উত্তেজক কিছু পড়তে পড়তে… (তাহলে ফিফটি শেডস অফ গ্রে ই হবে। মানে মনুসংহিতা পড়ে তো….)

ইররক..গ্লুলুস..ঘিঁআও…খ্যাঁকখক..

বাপ্পস..ভুল করে একটা পেগ পুরো নীট মেরে দিয়েছি যে! গলা বুক জ্বলে একশা কাণ্ড, মনে হলো একটা ছোটখাটো তরল আগ্নেয়গিরিই যেন গলা বেয়ে নেমে গেলো প্রায়! গিন্নি দৌড়ে এসে ব্যাপার বুঝেই জলের বোতল এনে হাজির। কেঁৎকেঁৎ করে খানিকটা জল গিলে, এসিটা আঠেরোতে নামিয়ে, হ্যা হ্যা করে হাঁপাতে লাগলাম। পঞ্চমবর্ষীয়া কন্যা দৌড়ে এসে এত কিছু দেখে, ‘বাবা কি মরে যাচ্ছে? হ্যাঁ মা, বাবা কি মরে যাচ্ছে’ টাইপের বেহুদ্দ ঘ্যানঘ্যানে প্রশ্নে শোরগোল আরও বাড়িয়ে তুলেছে, গিন্নি ”মদ্যপানের কুফল ও সমাজের ওপর ইহার অবাঞ্ছিত প্রভাব” সম্পর্কে কুড়ি নাম্বারের রচনা শোনাবার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে কি ভেবে রোষকষায়িত লোচনে শুধু বললেন ‘সবেতে তাড়াহুড়ো করা তোমার স্বভাব। জল ঢেলে খাও নি কেন? নীট খেতে কে বলেছিল তোমায়? সবেতে ওস্তাদি।’

হ্যা হ্যা করতে করতে একবার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করতে গিয়ে ভাবলুম থাক, দিন হামারা ভি একদিন আয়েগা। সেদিন দুটো কড়া কথা হামভি শুনায়গা, জরুর শুনায়গা।

পরের দিন তো কাজকম্ম সেরে, সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ফিরে, স্নানটান করে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে মেয়ে বউকে নিয়ে রিকশা করে চল্লুম শ্বশুরবাড়ি। জামাই আদরে ঘটিরা আমাদের, মানে বাঙালদের যে গুনে গুনে সাত গোলে হারাতে পারে, এ কথা আমি মাথা নিচু করে স্বীকার করতে বাধ্য। শ্বশুরমশাই অসুস্থ শরীরেও নিজের হাতে দোকানপাট সব করেছেন,এসব দেখে একটু অপরাধী অপরাধী লাগছিলো বটে, তবে কি না রান্নাঘর থেকে চিকেনরান্নার মনকাড়া গন্ধটা ভেসে আসতেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বেশ কম্বুর্ন্টেই বল্লুম ‘ইয়ে, অনেক্ষণ তো হলো, এবার বসে গেলে হয় না?’

রান্নাঘর থেকে গিন্নি বেরিয়ে এসে একটা কাঁসার বগি থালার ওপর ইয়াব্বড়বড় খান পাঁচেক ফুলকো লুচি রেখে গেলেন, সঙ্গে বড় জামবাটিতে কুচো নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল। ফলে হাসিমুখে গিয়ে বসতেই হলো,কারণ লুচি ঠাণ্ডা করে খেলে কুম্ভীপাক নরকে পার লুচি একশো বছর করে এক্সট্রা খাটতে হয় বলে শাস্ত্রে স্পষ্ট নির্দেশ আছে না? গিন্নি রান্নাঘরে চলে যাবার আগে গলদার মালাইকারির কথাটা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করাতে উনি চাপা গলায় ‘হ্যাংলা বাঙাল’ টাইপের কিছু একটা বলে গেলেন বলে মনে হলো, তবে কি না সেটা আমার শোনার ভুলও হতে পারে। যাগগে যাক… খাওয়াদাওয়াতে, যাকে বলে অত্যন্ত অভিনিবেশ সহকারে মন দিলাম।

তা ঘন্টাখানেক বাদে, যখন সেই চিংড়ি-চিকেনের ধ্বংসস্তূপ থেকে মুখ তুল্লুম, আমার স্নেহময়ী শাশুড়ির মুখে একটা সস্নেহ প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি, যেন রেমব্রাঁ ওনার আঁকা ”নাইটওয়াচম্যান” দেখে অভিভূত এক গুণমুগ্ধ কলারসিকের অভিবাদন প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করছেন। থালার দিকে তাকিয়ে দেখি গলদার খোসাটা, আর চিকেনের ঠ্যাঙগুলো ছাড়া থালা পুরো আয়নার মতন চকচক করছে। বেগুনভাজার খোসাটার চিহ্ন অবধি নেই। লুচির কথা ছেড়েই দিন। আড়চোখে দেখলুম গিন্নি থমথমে মুখে রান্নাঘরে ময়দা মাখতে বসেছে!

ইত্যাদির পর পরিতৃপ্তি সহকারে ড্রয়িংরুমে এসে বসেছি। শ্বশুরমশাই ভারি খুশি হয়ে আমার খাওয়াদাওয়ার প্রশংসা করছেন, ‘বুঝলে হে, আমরা যকন ইয়াং, ছিলুম, রোজ হেদোতে সাঁতার কেটে, বুইলে কি না, কারবালা ট্যাঙ্কের বাড়িতে ফিরে অ্যাই একধামা নুচি স্রেপ কাঁচানঙ্কা দিয়ে মেরে দিতুম, বুইলে কি না? তাপ্পর রাত্তিরে….’। শুনেই বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো, শুধু হেদোর বদলে ষষ্ঠীপুকুর, কারবালা ট্যাঙ্কের বদলে শিবপুর, একধামা নুচির বদলে একথালা ভাত আর কাঁচানঙ্কার বদলে গিমা শাক ভাজা, এইটুকুই যা তফাৎ!

এমন সময়ে গিন্নি ময়দামাখা হাত ধুয়ে বড় একটা রূপোর বাটিতে পায়েস এনে হাজির। হালকা বাদামী ক্ষীর দিয়ে বানানো পায়েস, ওপরে পেস্তা আর কাজু কিশমিশ বেশ আমন্ত্রণমূলক ভাবেই শুয়ে আছে। আমার তো মনে হলো ওখানেই গিন্নিকে কোলে তুলে ট্যাঙ্গো ট্যাঙ্গো জিঙ্গো জিঙ্গো গাই আর কি। নেহাত ব্যাপারটা শউরমশাই ততটা পছন্দ করবেন না হয়তো… বলে আনমনে ভাবতে ভাবতে এক চামচ মুখে দিয়েই…

ইররক..গ্লুলুস..ঘিঁআও…খ্যাঁকখক..

পুরো আগুনে গরম! মনে হলো একটা মিষ্টি লাভাস্রোত যেন জিভের ওপর খেলে বেড়াচ্ছে! পুরো শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা, ফেলতেও পারছি না, গিলতেও পারছি না। সবাই বিলক্ষণ শশব্যস্ত হয়ে পড়লো, হ্যা হ্যা করছি, গিন্নি একটা খবরের কাগজ নিয়ে দ্রুত হাওয়া আর দাঁত কিড়মিড় কচ্চেন, শাশুড়িমা খুবই উদ্বেগের সঙ্গে ‘আহা, একটু রয়েসয়ে খাবে তো’ টাইপের কিছু একটা বলার চেষ্টা কচ্চেন, এমন সময়ে আমার কন্যারত্নটি ন্যায্য উদ্বেগে ফেটে পড়লেন, ‘সবেতে তাড়াহুড়ো করা তোমার স্বভাব। জল ঢেলে খাও নি কেন? নীট খেতে কে বলেছিল তোমায়? সবেতে ওস্তাদি’।

পরের কথা এহ বাহ্য। সেদিনই ফিরে এসে গভীর রাতে আমার বসকে মুম্বাই যাবার ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দিই। জামাইষষ্ঠী চুলোয় যাক, ইজ্জতে গ্যামাক্সিন না পড়লেই হলো।

যদ্দিন না এ মেয়ের জ্ঞানগম্যি হচ্চে, তদ্দিন হেথা নয়, হেথা একদম নয়, অন্য কোথাও, অন্য যে কোন খানে!

তবে মুম্বাই এসেই বুঝেছিলাম যে এ ভারি ভালো শহর।

আগেই বলেছি যখন নিতান্তই দৈবদুর্বিপাকে এই মহাদ্রুমের পক্ষপুটে আশ্রয় নিতে বাধ্য হই, তখন যা মনের অবস্থা ছিল সে কহতব্য নয়। সে শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা, রানী পদ্মিনীর জৌহরব্রত আর নেতাজী সুভাষের মহাভিনিষ্ক্রমণ একসঙ্গে মিলিয়ে তার সামান্য আইডিয়া হলেও হতে পারে। যাবার সময় এয়ারপোর্টে বসে ঠিক ক’মাস অন্তর অন্তর কলকেতা শহরে একবার ঢুঁ মারলে কলজেটা ঠাণ্ডা হবে সেই হিসেব কষতাম। বসের মুখটা মনে পড়লেই মনে ‘ধনুর্দর আছ যত, সাজ শীঘ্র করি চতুরঙ্গে, রণরঙ্গে ভুলিব এ জ্বালা, এ বিষম জ্বালা যদি পারি রে ভুলিতে’ গোছের কুচিন্তা মনে উদয় হত। আরসালান, দুর্গাপুজো আর ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মুম্বাই যায় কোন আহাম্মক?

কিন্তু কবি বলে গেছেন দৈব, দৈবই সর্বত্র প্রবল। নইলে যে লোকটা বস হিসেবে দিব্যি তিন বছর শরিফ মেজাজে আমার দেখভাল করেছে, প্রোমোশন দেওয়ার নামে এমন লেঙ্গিটা সে আমাকে মারবে কেন?

তবে মুম্বাই যে আগে আগে আসিনি তা নয়। তবে কি না সে ছিল নেহাতই দীঘির পাড়ে জল তুলতে এসে নির্দোষ আঁখমিচোলি খেলা, প্রাজ্ঞজনেরা ম্লেচ্ছ ভাষায় যাকে বলেন ফ্লার্টিং। সকাল সকাল আর্লি মর্নিং এসে, মিটিং সেরে রাতের ফ্লাইট ধরা।

কিন্তু সেইবারই মুম্বাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেঁড়েমুষে সংসার করতে আসা!

প্রথমে এসে উঠলাম কম্পানির গেস্টহাউসে। এমনিতে গেস্ট হাউসে টানা এক সপ্তাহের বেশি থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু হেড অফিসে অ্যাডমিন দেখতেন এক উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা কাজলনয়না সুতনুকা। আর আমি যে কিরকম হ্যাণ্ডসাম, হেঁ হেঁ, বলতে লজ্জাই লাগছে আর কি, সে তো আপনারা জানেনই! ফলে সাড়ে তিনমাস দিব্য কাটিয়ে দিয়েছিলুম সেখানে। শেষে অবশ্য একদিন বলপ্রয়োগের আভাস পেয়ে ঠাঁইনাড়া হতে বাধ্য হই, কিন্তু সে আরেক গল্প।

যে এলাকায় শেষ পর্যন্ত ডেরাডাণ্ডা বাঁধি তার নাম পাওয়াই, সেন্ট্রাল লাইনে।

এখানে এই সেন্ট্রাল লাইন বিষয়টা ভালো করে না বোঝালে বাকিটা প্রণিধান করতে অসুবিধা হবে।

মুম্বাইতে এই সেন্ট্রাল লাইন, ওয়েস্টার্ন লাইন, ইস্টার্ন এক্সপ্রেসওয়ে, ইত্যাদি হচ্ছে বর্গীজীবনের অর্গি, চলাচলের পক্ষে এগুলি ছাড়া নান্য পন্থা বিদ্যতেহনায়ঃ। শাস্ত্রে বলে মহাজন যেন গতঃ স পন্থা, মহাজন (ক্রেডিট কার্ড কম্পানি নয়, মহৎ জন) যে রাস্তায় গেছেন সেটাই রাস্তা। মুশকিল হচ্চে মুম্বাইতে মহাজন, হীনজন, বজ্রজন সব্বার গতি ওই এক, তিনটি রেল লাইন, আর দুটি এক্সপ্রেসওয়ে। এদের নিয়ে না হয় আরেকদিন গপ্প করা যাবে। আজকের টপিক অন্য।

মুম্বাই শহর কখনও থামে না, এ কথা শুনে শুনে আপনারা হেজে গেছেন। তবুও আরেকবার শুনুন, কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। আমরা যারা ”পেনসনার্স সিটি” কলকাতা থেকে আসি, তারা প্রথমে এই অবিশ্রান্ত কর্মপ্রবাহ দেখে ঘাবড়ে যাই। এখানে বাজে কথা, বাজে সময় নষ্ট, এসব নিষেধ। এর সুফল কুফল দুইই আছে, বারান্তরে প্রকাশ্য।

যে কোনও শহরে নেমে সেই শহর সম্পর্কে প্রথম ধারণা হয়ে সেই শহরের ট্যাক্সি আর অটোওয়ালাদের আচরণ দেখে। ‘চেন্নাই কেমন লাগছে’ জিজ্ঞেস করুন চেন্নাইতে প্রথমবার পা রাখা যে কোনও লোককে, প্রথমেই চেন্নাইয়ের অটোওয়ালাদের উর্ধতন চৌদ্দ পুরুষের গুষ্টির তুষ্টি করে দেবে, বক্তার অপভাষা প্রয়োগে কিঞ্চিৎ প্রারব্ধ সঞ্চিত ব্যুৎপত্তি থাকলে সেই অটোওয়ালাদের উর্ধতন চৌদ্দ নারীর উদ্দাম লিবিডোর কাহিনীও শুনে ফেলতে পারেন। এককালে কলকাতার এয়ারপোর্টের আর হাওড়া রেলস্টেশনের ট্যাক্সিওয়ালাদের এই দুর্নাম ছিল। গত বছর পাঁচেক ধরে অবিশ্যি দেখছি ব্যবস্থাটা অনেক শুধরেছে।

এ বিষয়ে মুম্বাইয়ের অটো বা ট্যাক্সিওয়ালারা একশোতে একশো দশ পাবে। এমন ভদ্র, বিনয়ী, সৎ জনসেবক চট করে দেখা যায় না। বাকি দেশ তো ছেড়েই দিলাম, বিদেশেও এর জুড়ি মেলা ভার। না না, ব্যাজস্তুতি করছি না, ঘডনা পুরাই হইত্য!

পুরো মুম্বাই শহরেই একটি ব্যবহারিক সততা কাজ করে। এ জিনিস কলকাতা বা দিল্লিতে হয় না। ছ্যাঁচড়াপনা জিনিসটা খুব সম্ভবত পূর্ব ও উত্তরভারতের একচেটে। তিন বছর হয়ে গেলো মুম্বাইতে, সর্বত্র দেখেছি একটি স্বাভাবিক ন্যায়ের সার্বিক ধারণা সর্বদা ক্রিয়াশীল। দু চার টাকা অবৈধ উপার্জনের জন্যে জালিয়াতি বা চোখরাঙানি এখানে ভাবাই যায় না, না আছে লোকের প্রবৃত্তি, না সময়! অটো চড়লেও আপনি এ জিনিস দেখতে পাবেন। মোটামুটি ভালো থেকে বেশ ভালো সিট, ব্যবহার অতি ভদ্র, মিটারও একদম ঠিক, আজ অবধি মুম্বাই অটোর কোনও বেচাল পাইনি। যেখানে বলবেন সেখানে নিয়ে যাবে, ‘আজ আমার পেট খারাপ/ ওদিকে জুজু আছে, যাবো না/ আজ মাসির ননদের সেজোমাসির ভাশুরপোর বিয়ে, আমি নিতবর সেজেছি’ গোছের অপযুক্তি দেবে না। পঞ্চাশ টাকার ভাড়া উঠলে পাঁচশো টাকা দিন, তৎক্ষণাৎ খুচরো পাবেন, কলকাতার অটোমহাত্মনদের মতন প্রাকৃত ভাষায় অতি উচ্চাঙ্গের খেদোক্তি শুনতে হবে না। এই কাস্টমার সেন্ট্রিসিটি বা উপভোক্তামুখিনতায় মুম্বাই শহর কলকাতা সহ দেশের বাকি সমস্ত মেট্রোকে বলে বলে দশ গোল দেবে। এ জিনিস আপনি আপনার আদ্যন্ত কলকাতা প্রেমরসে ভিজিয়ে তার সঙ্গে মার্কের ক্লাস স্ট্রাগল আর গৌতম বাবুর সাব অল্টার্ন থিওরি পাঞ্চ করেও এক্সপ্লেইন করতে পারবেন না, কারণ কলকাতার অটো/ট্যাক্সিওয়ালা আর মুম্বাইয়ের অটোওয়ালাদের আর্থিক অবস্থা, সমাজ সচেতনতা, ক্লাস আইডেন্টিটি কিন্তু একই। তফাৎ এই যে আইন ভাঙ্গলে আপনি কারও পেছনে পার্টিশাসনের বরাভয় হস্ত উদ্যত করেছেন, আর কারও পেছনে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টের ডাণ্ডা। ফলাফল দেখতেই পাচ্ছেন।

মুম্বাইতে এক্স্যাক্ট কত অটো চলে বলা মুশকিল। মোটামুটি দেড় লাখ মতন অটো তো চলেই। কল্যাণ অ্যান্ড নভি মুম্বাই ধরে নিলে সংখ্যাটা ২ লাখের কিছু বেশি দাঁড়ায়। আর এখানে শেয়ার অটো বলে কিছু নেই, সবই মিটারে চলে। প্রথম আট কিলোমিটার আঠেরো টাকা, পরে প্রতি চার কিলোমিটারে দু টাকা। একটাকাও হতে পারে, ঠিক মনে নেই। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে দেখেছি যে মুম্বাইয়ের অটোওয়ালারা একটাকা দুটাকা কিছু মান্য করেন না। প্রথম প্রথম কলকাতা থেকে গিয়ে এটা খুব অদ্ভুত লাগতো। কলকাতায় অটো/ট্যাক্সিওয়ালারা যেমন যাত্রীরা একটাকা দুটাকা না দিতে পারলে বা বড় নোট দিলে যে ভাষায় যাত্রীর মা ও বোনের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ করার বাসনা প্রকাশ করতে থাকেন, সেসব এখানে ভাবাই যায় না। মুম্বাইতে এসব তুচ্ছ বিষয়ে কেউ ঝগড়া করে না, ব্যস্ত শহর, সবারই সময়ের দাম আছে। বাহান্ন টাকা বিল হয়েছে, পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে বললেন দুটাকা খুচরো নেই, অটোওয়ালা কিচ্ছুটি মাইন্ড করেন না, ‘কোই নেহি’ বা ‘ঠিক হ্যায়’ বলে কেটে পড়েন। একজন দুজন নয়, তিনবছরে দেখা প্রতিটি অটোওয়ালাই তাই। এটা আমরা যাত্রীরাও করি, আটচল্লিশ টাকা বিল হয়েছে, পঞ্চাশ দিয়েছি, অটোওয়ালা কাঁচুমাঁচু মুখে জানালো ‘দো রুপেয়া নেহি হ্যায় সা’ব’, আমরাও ‘ঠিক হ্যায়, কোই নেহি’ একটা উদার ভঙ্গিমা করে কেটে পড়ি, আজ অবধি কাউকে হল্লা জুড়তে দেখিনি।

মুম্বাইয়ের অটোওয়ালাদের একটি বৃহৎ অংশ বিহার ও ইউপির অধিবাসী। অতি দরিদ্র, অরাজক ও জনবহুল এই দুটি প্রদেশ থেকে অনেক কর্মহীন মানুষই ভাগ্যান্বেষণে অন্যান্য শহরে খেটে খান, এখানেও তাই। কিন্তু কলকাতার আপামর বাঙালিদের মতই সাধারণ মারাঠিরাও এঁদের খুবই সন্দেহের চোখে দেখেন। আমরা যেমন এঁদের খোট্টা বলে গাল দিই, মারাঠিরা বলে ‘ভাইয়া’। ভাইয়া শব্দটি মারাঠি জনজীবনে অসম্মানসূচক শব্দ। মারাঠিরা মনে করেন তাদের সমস্ত জীবিকার্জনের উপায়ে অবৈধ ভাগ বসাচ্ছে এই ‘ভাইয়া’রা, তাদের সস্তা শ্রম দিয়ে। আর মারাঠিরা অতি পরিশ্রমী, প্র্যাকটিক্যাল এবং নো ননসেন্স জাত। নিজের ভাতের হাঁড়িতে লাথি মেরে আন্তর্জাতিকতাবাদ, শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য ইত্যাদি নিয়ে গল্পদাদুর আসর বসায় না, আগে নিজের পেটের ভাতের যোগানটা ভালো করে সমঝে নেয়। ফলে এখানে প্রো-মারাঠি রাজনৈতিক শক্তি খুবই সিংহবিক্রমসহ বিদ্যমান। আর তাছাড়া জাতি হিসেবে মারাঠিদের একটু অহংও আছে। তারাই যে একমাত্র জাতি যারা প্রবলপ্রতাপ মোঘল সাম্রাজ্যকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, এবং বারংবার পর্যুদস্ত করে তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধের আগে অবধি অখণ্ড হিন্দু পাদপাদশাহী স্থাপন করেছিল, সে ব্যাপারটা সমস্ত আচরেকর থেকে যাবতীয় যোশি ইয়াদ রেখেছেন। ফলে মারাঠি অহং এ সামান্য আঁচড় পড়লে ফোঁস করতে দ্বিধাবোধ করেন না। রাস্তায় বিহারি অটোওয়ালার সঙ্গে মারাঠি যাত্রীর বিবাদ হলে যাত্রীটি সেই শিকড়ছেঁড়া অটোচালকটিকে, ‘তু ঝা শহরাত পুনহা পরত কা নেহি যাত?’ বলে সজোরে ডেঁটে দেন, অস্যার্থ, তুই নিজের শহরেই ফিরে যা না ড্যাকরা মিন্সে! একেনে জ্বালাতে এইচিস ক্যানে?

তবে সে যাই হোক, মুম্বাইয়ের অটোচালকদের কাস্টমার সার্ভিস….মাই ঘড! জাস্ট দুটো ব্যক্তিগত ঘটনার উল্লেখ করে দাঁড়ি টানবো।

ঘটনা একঃ সদ্য মুম্বাই এসেছি। অগাস্ট মাস। মুম্বাইয়ের বৃষ্টি সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। এ যে কি প্রলয়ঙ্করী জিনিস কি বলবো! যাই হোক। এমনই সময়ে আমি এক কলেজী বন্ধুর সঙ্গে কলেজি ফ্রাই (মেটে ফ্রাই) দিয়ে বিয়ার পানের আসর বসিয়েছে দাদরে। শনিবারের রাত, তখন এগারোটা বাজে, বেশ টইটুম্বুর হয়ে বাইরে বেরিয়ে উরিস্লা….. এ কি বৃষ্টি রে? এক হাত দূরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আকাশ পুরো ভেঙে পড়েছে, ঘনঘোর বরিষণ কি একেই বলে? তা বেশি বিহ্বল হওয়ার আগেই আমার সেই বন্ধুটি দৌড়ঝাঁপ করে একটি অটো ধরে দিলো। আমিও গুন্নাইট বলেটলে অটোতে উঠে পড়লুম।

নির্জন ইস্টার্ন এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ করেকেটেঘ্যাচাং! অটো চলে না, চলে না, চলে না রে…

এখন গান গাইছি বটে, তবে স্পষ্ট মনে আছে সেইসময় কিরকম আতান্তরে পড়েছিলুম। চারিদিকে যা বৃষ্টি, লাস্ট বোধহয় হয়েছিল নোয়া”র সময়ে। অটোর বাইরের দৃশ্যমানতা কিলোমিটারের বদলে মিলিমিটারে নেমে এসেছে। মাঝেমধ্যে একটা একটা গাড়ি দ্রুতবেগে সাঁৎ করে বেরিয়ে যাচ্ছে, আর দুনিয়ার নোংরা জল ছইছাঁপাছই করে ছিটকে অটোর মধ্যে! এছাড়া এই নিভৃত নির্জন চারিধারে জনমনিষ্যির চিহ্ন, আলোর আভাস, কিছুতেই কিছু নেই।

হঠাৎ মনে কুচিন্তা এলো, এখন এইখানে যদি লোকটা আমাকে মেরেই ফেলে? হয়তো এখানেই অটো থামে পরিকল্পনামাফিক। হয়তো ওর দলবল এক্ষুণি বাইক ফাইক চড়ে আসছে, অন দ্য ওয়ে আর কি! যদিও পকেটে কয়েকটা খুচরো নোট ছাড়া আর কিছু নেই। তবে কার কিসে কি পছন্দ বলা যায় না। দামী ঘড়িটা আছে, আর…. ভাবতেই ভাবতেই দেখলাম লোকটাকে নিজেই জিজ্ঞেস করছি, ‘ইয়ে, বোল রাহাথা যে কেয়া হুয়া? পার্টসগুলা সব ক্ষয় হো গ্যায়া নাকি ইঞ্জিনমে ময়লা জম গ্যায়া?’

সে বাবু ঋষিতুল্য নিঃস্পৃহ নিরাসক্ত গলায় বললো ‘ ইঞ্জিনমে পানি ঘুস গ্যায়া।’

‘তাহলে এখন উপায় কি হোগা?’

‘থোড়া বৈঠ যাইয়ে, ঠিক হো যায়েগা’

সেই প্রলয়ঙ্কর বৃষ্টির মধ্যে, নিশ্ছিদ্র, বিরামহীন ধারাপাতের মধ্যে, অটোর মধ্যে কাটানো নীরব আতঙ্কের মুহূর্তগুলি অনেকদিন মনে থাকবে।

তা সব দুর্ভোগেরই শেষ থাকে, নইলে মানুষ পরের দুর্ভোগে পড়ে কি করে? ফলে মিনিট পাঁচেক পর বরুণদেব সামান্য ক্ষান্তি দিলে রাস্তার ওপর জলের লেভেল কিছু কমলো। স্টার্টের হ্যাণ্ডেল টানাটানি করে অনেক পরিশ্রমে অটো স্টার্ট নিলে কণ্ঠাগতপ্রাণ খানিকটা স্বস্তি পেলো। আরো পঁচিশ তিরিশটি উদ্বিগ্ন মিনিটের পর অটো আমার বাসস্থানে ঢুকলে টের পেলুম হাতে পায়ে সাড় ফিরে এসেছে।

তখন বৃষ্টিও গেছে থেমে আর ভাড়া উঠেছে দেখলাম একশো সাতাশ টাকা।

এইবার মনে মনে প্যাঁচ কষতে লাগলুম ব্যাটাচ্ছেলের সঙ্গে কতটা দরাদরি চলবে। বৃষ্টির মধ্যে দাদর থেকে পাওয়াই এসেছে, অনেকখানি রাস্তা। আড়াইশো তিনশো তো চাইবেই, পাক্কা। কলকাতার ট্যাক্সি হলে তো এরকমই চাইতো। আমি দেড়শো থেকেই শুরু করি, না কি? পকেটে দেখি দৈবাৎ একটা একশো টাকা আরেকটা পঞ্চাশের নোট রয়ে গেছে। মানে আমাকে পাঁচশো বা দুশোর নোট দিতে হচ্ছে না, অর্থাৎ নেগোশিয়েশনের রাশ আমার হাতেই রইলো, কেমন?

এতটা ভাবতেই, বুঝলেন, বুকে দুনো বল এলো। নিজের এলাকা, সিকিওরিটি আছে, আলোকোজ্জ্বল পাওয়াইয়ের রাস্তায় আমি কি নেপোলিয়নের চেয়ে কম কিছু, অ্যাঁ? আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে?

খুব স্টাইলে তার দিকে দেড়শো টাকা এগিয়ে দিয়ে বীরদর্পে ওয়েট করতে লাগলাম। দেখি, লোকটা কোথা থেকে শুরু করে।

তা লোকটা শুরু করলো বটে। টাকাটা নিজের ওয়ালেটে ঢোকালো। তারপর একটা কুড়িটাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘তিন রুপেয়া দে রাঁহা হুঁ’!!

ঘোর কাটতে আমার বেশ কিছু সময় লেগেছিল!

না, যতটা পাষণ্ড আমাকে দেখায় ততটা আমি নই। সেই তেইশ টাকা তাকে দিয়ে এসেছিলাম, টিপস হিসেবে। নিজে যা লজ্জা পেয়েছিলুম সে কথা না হয় থাক!

ঘটনা দুইঃ এটি আমার এক বন্ধুর কাছে শোনা। ইনি একটু অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ বলে কুলোকে এঁকে চালবাজ, ঢপমাস্টার, বখতিয়ার খিলজি ইত্যাদি নানাবিধ অন্যায্য আখ্যায় ভূষিত করে থাকেন। গল্পটা তাঁর জবানীতেই বলি। বাই দ্য ওয়ে এতে কিন্তু মুম্বাই অটোর গুণগান নেই, নেহাতই গল্প।

‘থাট্টি ফাস্টের নাইট বুঝলি। বিকেল নাগাদ আমার গাড়িটা নিয়ে তিন বন্ধু বেরিয়েছি। প্রথমে গেলাম মেরিন ড্রাইভ, সেখানে চৌপাট্টিতে বসে একটা ফুল বিপি নামালাম। তারপর সেখান থেকে কোলাবা, প্যরামাউন্ট বার। সেখানে তিনজনে তিন তিরিক্কে ন’টা ট্যাকিলা শট মেরে খানিকক্ষণ উদমা নাচলাম। তারপর আবার ড্রাইভ করে আন্ধেরি, সেখানে আহলুওয়ালিয়ার বাড়ির পার্টিতে। সে ব্যাটা আমার জন্যেই নাকি ভালো স্কচ আনিয়ে রেখেছিল, আর তুই তো জানিস স্কচ আমার একমাত্র দুর্বলতা। তবে বেশি না, পাঁচ পেগের থেকে এক ফেঁটা বেশি খাইনি, একথা আমি হলফ রেখে বলতে পারি। যাই হোক, তারপর ঘাটকোপারে নাইট ক্যুইন ডিস্ক।

সেখানে কার সঙ্গে গেসলুম আর কি কি খেয়েছি, সত্যি কথা বলতে কি ভাই একদম মনে নেই। ইন ফ্যাক্ট কি কি করেছি তাও যে মনে আছে বিশেষ তাও নয়। শুধু খেয়াল হলো যে রাত প্রায় বারোটা বাজে, আর ঠিক এইসময় মুম্বাই পুলিশ সবকটা মোড় নাকাবন্দি করে আর মাতাল ড্রাইভার ধরে। একবার ধরতে পারলেই চিত্তির। ব্রেদ অ্যানালাইজার নিয়েই দাঁড়ায়, আর সুমুন্দির পো’দের কোনও মায়াদয়া নেই। কোনও পলিটিকাল দাদাকে ধরে কিছু করা যায় না, স্রেফ শ্রীঘর। আর আমার যা অবস্থা, ব্রেদ অ্যানালাইজারের দরকার নেই, দেখলেই বুঝতে পারবে যে আমি এখন উড়ছি। পা দুটো যে এখনও মাটিতে লেগে আছে সেটা কিঞ্চিৎ স্বকৃত পাপের ফল বৈ আর কিছু নয়।

এসব ক্ষেত্রে রিস্ক নেয় আহাম্মকরা। অনেক ভেবে দেখলাম যে আমি অনেক কিছু হতে পারি, কিন্তু আহাম্মক নই। ফলে একটা অটো নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

রাস্তায় যেতে যেতেই বুঝলাম আমার অনুমান কত নির্ভুল। প্রতিটা মোড়ে মোড়ে মামু দাঁড়িয়ে, প্রাইভেট কার দেখলেই ‘থাম্বা রে থাম্বা’ করে এগিয়ে এসে খপাৎ করে জাল ফেলছে আর ড্রাঙ্ক ড্রাইভার তুলছে। অটো, বা ট্যাক্সি বা হায়ার্ড ক্যাবগুলোকে অবশ্য কিছু বলছে না, জানে যে সওয়ারি মাতাল বলেই গাড়ি বা অটো ভাড়া করেছে।

আমি তো ভাই দেখেশুনে বুঝলাম কি বাঁচান বেঁচে গেছি। এই অটো না থাকলে আজ আমি এতক্ষণে থানায় বসে হাপু গাইছি।

মুশকিল হলো সকালে, বুঝলি। খোঁয়াড়ি কাটার পর বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে অটোটাকে দেখে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না যে অত রাতে অটো চালিয়ে আমি এতটা রাস্তা এলাম কি করে?

আর তার থেকেও বড় কথা, অটোটা কার!’

মুম্বাইয়ের অটো নিয়ে তো শুনলেন। এবার শুনুন মুম্বাইয়ের লাইফলাইন, লোক্যাল ট্রেনের কথা।

মুম্বই মহানগরীর প্রাণভোমরা হচ্ছে তার লোকাল ট্রেন সার্ভিস। দুরন্ত গতিময় এই শহর কখনও থামে না এমনিতে, সে সন্ত্রাসবাদী হামলাই হোক আর অতিবর্ষণ। কিন্তু যদি লোকাল ট্রেন থেমেছে, তো ব্যাস,আকা মুম্বই বন্ধ, বিড়ু ! লোকাল হলো মুম্বইএর লাইফলাইন, সাতরাজার ধন এক মাণিক, অন্ধের যষ্টি, বুকের পাঁজর। মুম্বাই লোক্যালের স্পিরিটভোমরা ধরা আছে এই বিজ্ঞাপনী প্যারডির মধ্যে,”ডর কে আগে জিত হ্যায়/ দাদর কে আগে সীট হ্যায়”

ঢাকার আয়ুর্বেদিক ঔষধালয় দেখে নাকি জনৈক বিবসনা সাধু অত্যাশ্চর্য একটি মন্তব্য করেছিলেন, ‘অ্যায়সা কাম সত্য ত্রেতা দ্বাপরমে কোঈ নেহি কিয়া’, এই ঘোর কলিতেই প্রথম। মুম্বই লোকালের মতন এমন বহুবর্ণ বিচিত্র প্রতিষ্ঠান দেখে তিনি কী বলতেন সে ভাবতেও রোমাঞ্চ জাগে। মুম্বাই লোকাল ট্রেন নিয়ে মহাকাব্য লেখা যায়। চলমান ভারতবর্ষ বলতে যদি কিছু বোঝায় তো তার নাম মুম্বাই লোকাল।

ইতিহাসের জানকারি রাখনেওয়ালা প্রাজ্ঞ জনগণ নিশ্চয়ই জানেন ভারতবর্ষে প্রথম ট্রেন চলে মুম্বইতে, ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস বা ভিটি (তখন নাম ছিল বোরি বন্দর) থেকে থানে অবধি। অবিশ্যি সে রামও নেই, অযোধ্যাও নেই। ভিটির নাম পালটে হয়েছে সিএসটি, ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস। কুলোকে অবশ্য বলে এটাই ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সেক্স চেঞ্জ অপারেশন, তবে সে কথায় কান না দেওয়াই মঙ্গল। এই লাইনটি বর্তমানে সেন্ট্রাল লাইন বলে পরিচিত।

আগেই বলেছিলাম, তিনটি লোকাল লাইন আর দুটি এক্সপ্রেসওয়ে, এই পঞ্চপাণ্ডব মিলে মুম্বইয়ের ভূভার বহন করেন। এদের মধ্যে বয়সে ও পদমর্যাদায় সেন্ট্রাল লাইন হলেন নৈকষ্যকুলীন। এর পর আছেন ওয়েস্টার্ন লাইন, মুম্বইয়ের পশ্চিম দিক দিয়ে। এঁয়ার দৌড় চার্চগেট থেকে ভিরার অবধি। আর নবীনতম সদস্য হচ্ছেন হারবার লাইন, নভি মুম্বইবাসীদের জন্যে। এঁর বিস্তার সিএসটি থেকে পানভেল অবধি।

একটা জিনিস জানিয়ে রাখা ভালো, এই পাঁচটি জনগণপথই উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত। মুম্বই শহরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাওয়া অনেক হ্যাঙ্গাম মশাই। ভাইসি ভার্সা পশ্চিম থেকে পূবেও তাই, তবে কিনা আজকাল একবার পশ্চিমে পাড়ি জমাতে পারলে কেউ পূবে বিশেষ ফিরছে টিরছে না দেখে বাহুল্যবোধে আর উল্লেখ করিনি!

তা এই তিনটি লাইনের মধ্যে অবশ্য ভাবভালোবাসার কমতি নেই। ওয়েস্টার্ন লাইন যেখানে সেন্ট্রাল লাইনের বুকে গুগাবাবার শেষে সন্তোষ দত্তের স্টাইলে ‘দাদারে’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তার নাম দাদর। এখানেই লোকে লাইন চেঞ্জ করে ওয়েস্ট থেকে সেন্ট্রাল বা সেন্ট্রাল থেকে ওয়েস্টে যায়। অতি জনবহুল, ব্যস্ত স্টেশন, তার খ্যাতি লেখার শুরুয়াতেই উল্লিখিত স্লোগানটি শুনে হৃদয়ঙ্গম হবে আশা করি। অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ হলো দাদর থেকে কল্যাণ বা ভিরারের জন্যে ‘ফাস্ট’ ট্রেনে ( কলকাত্তাই ভাষায় গ্যালপিং ট্রেনে) যারা উঠতে পারে, তাদের দুএকজনকে ঠেলেঠুলে অলিম্পিকে পাঠাতে পারলে রেসলিং এ দু চারটে গোল্ড মেডেল নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তবে নেহাত অলিম্পিক ভিলেজে ভড়া পাও পাওয়া যায় না বলেই হয়তো প্রস্তাবটা খাতায় কলমেই রয়ে গেছে।

হারবার লাইন যেখানে প্রেয়সীর মতন সেন্ট্রাল লাইনের গায়ে সাগর জলে সিনান করা মাথাটা এলিয়ে দিয়েছে, তার নাম কুরলা। এও বেশ জনবহুল স্টেশন বটেক। তবে হারবার থেকে ওয়েস্টার্ন লাইন যাওয়া অবশ্য অনেক হাঙ্গামা। আগে হিসেব করে দেখতে হবে আন্ধেরি কোথায়, বা কুরলা কোথায় থাকতে পারে। তারপর দেখতে হবে ওয়াডালা কই। তারপর দেখতে হবে সেই হিসেব মতন যখন আন্ধেরি কি কুরলা থেকে যখন ওয়াডালা গিয়ে পৌঁছবে, তখন ট্রেন কোথায় থাকবে…

পাতি কথা বলছি দাদা, নেহাত বাধ্য না হলে লোকে অটো নিয়ে নেয়!

মুম্বই লোকালের খ্যাতি অবশ্যই তার ভীড়ের জন্যে। মুম্বই লোকালের ভীড় আধুনিক ভারতের একটি আর্বান লিজেণ্ড বিশেষ। প্রায় আড়াই হাজার লোকাল ট্রেন সর্বসাকুল্যে রয়েছে মুম্বইতে, ভোর চারটে থেকে রাত একটা অবধি চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। রোজ কত লোক যাতায়াত করেন জানেন? মাথাটা চেপে ধরুন, বাঁই করে ঘুরে গেলে কম্পানী দায়ী নহে!

পঁচাত্তর লাখ!

মানে এক বছরে আড়াইশো কোটির একটু বেশি, পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ!

যাকগে, এসব নাম্বারের কচকচি বাদ দিয়ে মুম্বই লোকালের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের গল্পটাই না হয় বলি।

প্রথম যখন এই মহানগরীতে পদার্পণ করি, সেটা ছিল দশ বছর আগে, দুহাজার ছয় সালে, সামার ট্রেনিং নিমিত্ত। তা প্রথম দিন তো এয়ারপোর্ট থেকে নেমে সোজা অফিসে গেছি। আমাকে আমার তদানীন্তন বস তথা গাইড বললেন যে ‘ভাইটি, কাল সকাল দশটা নাগাদ ঘাটকোপার থেকে ট্রেন ধরে সিএসটি এসো। কোলাবা মার্কেট ভিজিটে যাবো’। তা আমিও তো সুবোধ বালকের মতন পরের দিন ছানটান করে চুল আঁচড়ে খেয়েদেয়ে, ঘাড়েমুখে পাউডার বুলিয়ে স্টেশনে গিয়ে তো হাজির।

গিয়েই দেখি, উরিত্তারা! ই কি? সারা স্টেশন জুড়ে থিকথিক করছে লোক, কিলো কিলো প্যাসেঞ্জার মশাই ! দুর্গাপুজোয় অষ্টমীর দিন সুরুচি সঙ্ঘ আর একডালিয়া এভারগ্রীনের মিলিয়ে যা ভীড় হয়, তার চারগুণ বললেই চলে। অফিস টাইমে শ্যালদা দেখেছি, এ তো তার এককাঠি নয়, রীতিমতো একবাঁশ ওপরে!

তা ভাবলুম হয়তো কোথাও কোনও জনসভাটভা আছে। এই ট্রেনটা ছেড়ে দিই, পরেরটায় বেশ আয়েশ করে যাবো না হয়।

তা তিনি এলেন। আগমন নয়, আবির্ভাব বললেই চলে। তিনি আসছেন এই খবর চাউর হতেই লোকজন দেখি সব স্ট্র্যাটেজিক পজিশন নেওয়া শুরু করেছে। সে কি একাগ্র লক্ষ্য, সে কি একরোখা তেজী ভাব, সে কি ভীতিপ্রদ চাউনি, দেখলে ভয়, ভক্তি, শ্রদ্ধা তিনটেই জাগে।

তা তিনি যখন এলেন, ও হরি দেখি তিনিও তদ্রুপ! ট্রেনের কামরার ভেতরে থিকথিক করছে লোক। বেশ কয়েকজন বাইরেও ঝুলছে। দুএকজনকে স্পষ্ট দেখলুম কোনও অবলম্বন ছাড়াই ঝুলতে, ভেতর থেকে কেউ কলার ধরে টেনে রেখেছে, তাই বাঁচোয়া!

এইবারে আমার মনে গূঢ় চিন্তার উদয় হলো। সহৃদয়া পাঠিকা জানেন, চিরকালই পরের জন্যে আমার প্রাণ কাঁদে। ভাবলাম, তাই তো, এইবার এই এত লোক যাবে কি করে? অনেকেরই তো আর্জেন্ট কাজও থাকতে পারে। ইনটারভিউ, হাসপাতাল, মিটিং, ইলেক্ট্রিক বিল, বসের বাড়ির বাজার করে দেওয়া, মায় গার্লফ্রেণ্ডের সঙ্গে ডেটিং অবধি, কিছু না কিছু তো আছেই।

ও মা, ভাবতে ভাবতেই দেখি মিনিটের মধ্যে সেই এক প্ল্যাটফর্ম লোক দিব্যি ট্রেনের মধ্যে সেঁধিয়ে প্ল্যাটফর্ম পুরো ফরসা, ট্রেনও দেখি সেই কলারের ওপর ভরসা করে ঝুলতে থাকা ছোকরাকে নিয়ে ধাঁ! যদি ওই এক প্ল্যাটফর্ম ভর্তি লোক যদি ট্রেনের মধ্যে সেঁধুতে পারে তাহলে ট্রেনের ভেতর কারা ছিল? যদি ওই ট্রেনে ভর্তি লোকই থাকবে তো প্ল্যাটফর্মে কারা ছিল? তিনকেজির বিড়াল যদি এককেজি মাংস খাওয়ার পরেও যদি তার তিনকেজি ওজন হয় তাহলে মাংসটা গেলো কই? ডিমনির পরেও যদি সেই পুরো পনেরো হাজার কোটিই ফিরে আসে তাহলে ব্ল্যাক মানি….

খানিকক্ষণ হাঁ হয়ে চেয়ে থাকার পর বুকে একটু নিশ্চিন্দির ভাব এলো। যাক, প্রায় ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম, পরের ট্রেনে উঠতে কষ্ট হবে না। কিন্তু…দেড় মিনিট। ঠিক দেড় মিনিট। ফের পিলপিল করে লোক এসে ঘাটকোপার স্টেশন যেন ব্রিগেডের জনসভা!

কবি লিখেছিলেন আধুনিক জীবনে মানুষের শোকের আয়ু দেড়দিন। মানুষের সুখের আয়ু যে দেড় মিনিট, সেটা কেউ কোথাও লিখে যাননি। লিখে রাখা উচিৎ ছিল! এর পর কি করে অকুস্থলে পৌঁছই তার বিবরণ চেয়ে সুধী পাঠিকা আমাকে বিপদে ফেলবেন না বলেই বিশ্বাস রাখি!

মুম্বই লোকালের প্রতিটি কামরা আদতে এক একটি মিনি ভারতবর্ষ। সুবেশ টাইধারী বাঙালি কর্পোযুবার পাশেই দেখবেন প্রৌঢ় গুজরাটি শেয়ার ব্রোকার, মালয়ালী দোকানদারের পাশে আধঘুমন্ত বিহারি ড্রাইভার, মারাঠি গৃহপরিচারিকার কোল ঘেঁষে পাঞ্জাবী উঠতি অভিনেত্রী। ভাষা, ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি, জীবিকা সবকিছু দিয়ে সঞ্জীবিত বহুবিচিত্র ভারতভূমির এমন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আর কোথাও পাওয়া যায় না বলেই বিশ্বাস। কার ঘাম কার ঘাড়ে, কার আঙুলের ওপর কার পা, কার কাঁধে কার মাথা বোঝা দায়। আর মুম্বই এর যা বৈশিষ্ট্য, কেউ কারো পারসোনাল স্পেসে হানা দেয় না। কলকাতার মতন এখানে সম্পূর্ন অনাত্মীয় সহযাত্রীর সঙ্গে ধোনির রিটায়ারমেন্ট টু ডিমনিটাইজেশন, সারদা টু শ্রীরামকৃষ্ণ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ভাবাই যায় না! ওই প্রচণ্ড চাপাচাপি গরমে বেশিরভাগই মোবাইলে গান শুনছে, বা গেম খেলছে বা ফেসবুক করছে দেখতে পাবেন। বৃদ্ধারা হয়তো বাবা রামদেবের জীবনচরিত পড়ছেন, তার পাশের উদ্ভিন্নযৌবনা খুকিটি হয়তো পেন্টহাউস লেটার্স, কারোরই কিছুতে কিছু এসে যায় না! বিগতযৌবন লোকটি হয়তো খবরের কাগজে মন দিয়ে শেয়ারের ভাও দেখছেন, সেই পেপারেরই পাশের পেজে মল্লিকা শেরাওয়াতের স্বল্পবসনা ছবিতে মগ্ন এক ইউপি’র যুবক, এ খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য। এহ বাহ্য, আমি নিজে স্বচক্ষে চিঁড়েচ্যাপটা ভীড় ট্রেনে এক স্থূলাঙ্গী মারাঠি মহিলাকে সিটে বসে বাড়ির আনাজপাতি কাটতে দেখেছি, অন্য পরে কা কথা! মোটমাট মুম্বই লোকালে পূজা-নমাজ, শৌচকার্য আর নিজ পার্টনারের সঙ্গে ঝিঙ্কুলুলুটুকুই যা করা যায় না আর কি!

মুম্বইয়ের জীবনযাপনের এক অন্যতম লক্ষণ হলো নন-ইন্টারফেয়ারেন্স। কেউ কারও বিষয়ে আগ বাড়িয়ে উদগ্র কৌতূহল প্রকাশ করতে যায় না। লিভ অ্যান্ড লেট লিভ, তুমি কি আমার পর? এই হচ্ছে মুম্বইয়ের আত্মার মূল কথা। মুম্বইয়ের লোকাল ট্রেনও তার ব্যত্যয় নয়। এই প্রসঙ্গে পড়ে গেলো, আমার এক মুম্বইবাসী বন্ধু কর্মব্যপদেশে একবার কলকাতা যান, ডেরাডাণ্ডা বাঁধেন পিয়ারলেস ইনে। তা কোনও এক মিটিঙে তাঁকে যেতে হবে সল্টলেকে, এদিকে শখ কলকাতার মেট্রো চড়বেন। আমি মশাই ভারি পরহিতৈষী মানুষ, একবার জিগাতেই এসপ্ল্যানেড থেকে মেট্রোতে শোভাবাজার, আর তারপর সেখান থেকে অটো ধরে উল্টোডাঙা হয়ে কি করে সল্টলেক যাওয়া যায় বাতলে দিলুম।

তা সন্ধ্যেবেলা যখন তত্ত্বতালাশ নিচ্ছি, তিনি ভারী গোমড়ামুখে বললেন ‘তোমরা বাঙালিরা কার্টেসি জানো না।’

এই রে! হঠাৎ এহেন অভিযোগ?

জিজ্ঞাসাবাদের পরে প্রকাশ পেলো, তিনি এসপ্ল্যানেডে উঠেই দরজার পাশে একটা সিট পেয়ে সেখানে জমিয়ে বসে নিজের প্রেয়সীকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি রগরগে মেসেজ করছিলেন। অনেকটা লিখে ফেলার পর হঠাৎ কাঁধে একটা টোকা পেয়ে চমকে দেখেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক তাকে ডাকছেন। ‘ইয়েস, হোয়াট হ্যাপেন্ড’ এর উত্তরে সেই ভদ্রলোক জানান যে তিনি একজন প্রাইভেট টিউটর এবং বন্ধুবর এতক্ষণ যা যা লিখেছেন তার গ্রামারে নাকি গণ্ডাখানেক ভুল! আর ম্যাস্টারবেশন শব্দটার স্পেলিং কি করে এক নব্যযুবা ভুল করতে পারে সেটা উনি ভেবেই পাচ্ছেন না! হতভম্ব বন্ধুটি কিছু জবাব দেওয়ার সুযোগই পাননি, কারন এর পরই নাকি আরেক ভদ্রলোক, যিনি নিজেও লেখাটা ওঁর ঘাড়ের ওপর দিয়ে পড়ছিলেন, তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং ওল্ড ইংলিশ স্পেলিং অ্যান্ড নিউ ইংলিশ স্পেলিং নিয়ে কামরাতে ধুন্ধুমার বেঁধে যায়! শেষে দুজনেই পরস্পরের দিকে যথাক্রমে নেসফিল্ড এবং রেন অ্যান্ড মার্টিন ছুঁড়ে মারলে সেদিনকার মত ঝগড়ার ইতি হয়!

মুম্বইতে আর একটি ভারী ভালো অভ্যাস আছে। চট করে এখানে রাস্তা, স্টেশন ইত্যাদির নামকরণ করা হয় না। একেবারে যে হয়না তা নয়, তবে কলকাতায় যেমন আপনি রাত্তিরে কলু মিস্ত্রি লেনে ঘুমোতে গেলেন, আর সকালে উঠে দেখলেন তার নাম বদলে হয়েছে দেশবরেণ্য লোকনায়ক মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত সরণি, এখানে তেমন এপিডেমিক হারে হয় না। রাজনৈতিক নেতাদের হুঁশপর্ব কিছু আছে, বেকার অপ্রয়োজনীয় কাজে ত্যানা প্যাঁচান না। সাকি নাকা বোধহয় সেই আদি অনন্ত কাল থেকেই সাকি নাকা। মালাড বা ভিরার অথবা পাওয়াই এর নাম বোধহয় গত একশো বছরে বদলায় নি। কোলাবা কি মালাবার হিলসের উল্লেখ তো বোধহয় ঋকবেদেও পাওয়া যাবে বলে আমার সন্দেহ! মুম্বই বোঝে এসব ফালতু কাজে দিমাগ না লাগিয়ে শেয়ার বাজারে লাগালে বরং দুটো পয়সা ঘরে আসে। নইলে নিদেনপক্ষে অন্তত মাটুঙ্গার নাম বদলে কি বালাসাহেব ঠাকরে ধরণী করা যেত না?

তা যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরোন নামই বজায় আছে, মাঝেমধ্যে একই স্টেশনের নাম তিনটে বিভিন্ন ভাষায় শুনলে চমক লাগে। যেমন যে স্টেশনের নাম ইংরেজিতে স্পষ্টাক্ষরে ঙ্কাত্বন্ডননত্থ লেখা আছে, ও আপনি বাইকুল্লা বাইকুল্লা জপতে জপতে বলে নামবেন বলে রেডি হচ্ছেন, তার নাম অ্যানাউন্সড হলো ‘ভায়খালা’, ওটাই আদত মারাঠি উচ্চারণ কি না! তারপর ধরুন সায়ন। ইংরেজিতে বলে সিয়ন, হিন্দিতে সায়ন, মারাঠিতে শীন! আর তো আর, বহুখ্যাত বান্দ্রা স্টেশনের নামই তিন আলাদা উচ্চারণে শুনতে পেয়ে রীতিমতো আমোদ পেয়েছিলুম মনে আছে, বান্দ্রা, ব্যান্ড্রা, ওয়ান্দ্রে!

আবার অনেক অদৃশ্য স্টেশনের অস্তিত্বও মুম্বইয়ের শতাব্দী প্রাচীন ট্রেনলাইনে বর্তমান। দাশনগর থেকে হাওড়া ঢোকার মুখে যেমন ‘একটু দাঁড়া’, ‘আবার দাঁড়া’ এবং ‘দাঁড়া ** ‘ নামের তিনটি আধিভৌতিক স্টেশনের জন্ম দিয়েছেন ডেলি পাষণ্ডরা, ইহারাও তেমনি। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত অবশ্য, বোরিভিলি আর কান্দিভিলির মাঝের অনির্দেশ্য স্টেশনটি, রসিক মারাঠি যার নাম দিয়েছে থাম্বিভিলি!

যাকগে, অনেক প্যাচাল পাড়লাম। কি করি, বয়েস বাড়ছে, পেটে দুপাত্তর পড়লেই কথায় পেয়ে বসে। তা মুম্বই লোকাল নিয়ে নানা কিসসা মুম্বইয়ের অলিগলিতে উড়ে বেড়ায়। তারই দুয়েকটা উমদা নমুনা রসিকজনের খিদমতে পেশ করে দাঁড়ি টানবো।

ইউপির গ্রাম থেকে এক ‘ভাইয়া’ এসেছেন মুম্বইতে রিস্তেদারের সঙ্গে মোলাকাত করতে। তারপর যথারীতি বেরিয়েছেন মুম্বই দর্শনে। ভিকরোলি থেকে ট্রেন ধরেছেন, কুরলা নামবেন। তা ইনি মুম্বই লোকালের বীভৎস ভীড় নিয়ে নানা সত্যিমিথ্যে মনগড়া গল্প শুনে তো যথেষ্ট নার্ভাস। সব্বাইকে বারবার বলছেন কুরলা এলেই যেন ওঁকে বলে দেওয়া হয়। তা দেহাতি ভাষায় নানাবিধ কাতর অনুরোধ শুনে দয়ার্দ হয়ে লোকজন ওঁকে ঠেলেঠুলে দরজার কোণে এনে সেট করে তো দিলো। এরপর নানাবিধ উপদেশ, যেই ট্রেন স্টেশনে ঢুকে একটু আস্তে হবে, তক্ষুণি যেন ইনি আলতো করে প্ল্যাটফর্মে নেমেই যেদিকে ট্রেন যাচ্ছে সেদিকে ছুটতে থাকেন, নইলে মুখ থুবড়ে পড়বেন, ইত্যাদি প্রভৃতি।

এবার ট্রেন যেই কুরলা স্টেশনে ঢুকে একটু স্লো হয়েছে, ভদ্রলোক নেমেই দৌড়তে লাগলেন, একদম ট্রেনের সঙ্গে, প্যারালাল করে। খানিকটা দৌড়ে থেমে গেলেই হতো, কিন্তু ভদ্রলোক খুব সম্ভবত নানা উদ্বেগ আর উপদেশে সামান্য ইয়ে হয়ে গেছিলেন, তিনি সমান তেজে দৌড়তেই থাকলেন। এদিকে ট্রেন ক্রমশ আরও স্লো হয়ে আসছে। ভদ্রলোক যেই দৌড়তে দৌড়তে পরের কামরার কাছে পৌঁছেছেন, সেখানকার লোকজনের দয়ার শরীর, ভেবেছে লোকটা ট্রেন ধরতে দৌড়চ্ছে, সক্কলে মিলে হাত বাড়িয়ে টুক করে ফের কামরায় তুলে নিয়েছে!

তারপর সে কি ধুন্ধুমার কাণ্ড! ভদ্রলোক শেষে হাঁউমাউ করে, টিকিট দেখিয়ে প্রমাণ করেন যে তিনি ছাড়ার জন্যেই দৌড়চ্ছিলেন, ধরার জন্যে না। শেষে কামরাভর্তি হো হো হাসি, ক্যাটকল ও হুইসলধ্বনির মধ্যে তাঁকে পরের স্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হয়।

ট্রেন সম্পূর্ণ থামলে!

পরেরটা আমার এক বন্ধুর চোখে দেখা। তার জবানীতেই বলি।

‘থানে থেকে বিদ্যাবিহার যাবো, ট্রেনে চেপেছি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছি, এমন সময় মুলুন্দ থেকে এক ব্রাউন সাহেব উঠলেন। ধোপদোরস্ত জামাকাপড়, স্যুটটাই পরিহিত, চোখে দামি গগলস, চকচকে জুতো। তিনি উঠেই আমার উল্টোদিকে দাঁড়ালেন। কানে একটা ব্লুটুথ লাগালেন তারপর পকেট থেকে মোবাইল বার করে কাকে কল করে মোবাইলটা পকেটে রেখে ‘হ্যালো, হ্যালো’ করতে লাগলেন।

মুলুন্দ থেকে ভাণ্ডুপের মাঝে সব অপারেটরেরই সিগন্যাল খুব উইক থাকে। তা ইনি বোধহয় সেটা জানতেন না। তিনি হ্যালো হ্যালো করে চেঁচিয়েই যাচ্ছেন, ওদিক থেকে নো উত্তর অ্যান্ড অল।

এমন সময় উলটোদিক থেকে এলো সিএসটি থানে ফাস্ট লোকাল। এখন কেসটা হচ্ছে যে সেন্ট্রাল লাইনের ট্র্যাকগুলো পুরোনো বলেই একটু কাছেকাছে। ফলে দুটো ট্রেন বিপুল বেগে পাশাপাশি চললেই প্রবল হাওয়ার উৎপত্তি হয়, উলটোদিকে চললে তো কথাই নেই! এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না, এবং সেই প্রবল বায়ুবীচিমালায় অনেক কিছুই আন্দোলিত হইতে দেখিয়াছি, চাচার অসংবৃত লুঙ্গি হইতে মামণির স্কার্ট অবধি। তাতে যে কথাও উড়ে যায় তিনি বোধহয় খেয়াল করেননি, যথারীতি হ্যালো হ্যালো, ক্যান ইউ হিয়ার মি, করে চলেছেন। গলার পর্দা ক্রমশ ওপরে চড়ছে। শেষে সেই হ্যালোনাদ যখন সমস্ত কামরা প্রকম্পিত করতে লাগলো, তখন তেনার পার্শস্থ এক প্রৌঢ় আধোঘুম ভেঙে তাঁর কাঁধে টোকা দিলেন, এবং কানের দিকে ইঙ্গিত করে ঋষিতুল্য নৈর্ব্যক্তিক সুরে জানালেন,

‘বস, উড় গ্যায়া!’
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *