মার্কেট ভিজিট ২

মার্কেট ভিজিট ২

যাঁরা আমাকে কণিকামাত্রও চেনেন, তারাই জানেন আমার দ্বিতীয় প্রেম ইস্টবেঙ্গল আর তৃতীয় প্রেম বিরিয়ানি।

আমি যে মার্কেটেই যাই, লাঞ্চের ব্যাপার টা আগে ঠিক করে ফেলি। হুঁহুঁ বাওয়া ,এসব হচ্চে সেলসের চাকরির মজা, ভালো ইংরেজিতে বললে ফ্রিঞ্জ বেনিফিট। আর তারপর যদি আমার মতন সুযোগ বুঝে যথাযথ রন্ধ্রে তৈলপ্রয়োগের ফলে ন্যাশনাল লেভেল অবধি উঠে থাকেন, তাহলে তো কথাই নেই। এই গতকাল দিল্লীতে করিমসে তন্দুরি কাবাব, তো আজ আগ্রাতে পেঁঠা, আর আগামিকাল বেনারসে রাবড়ি আর কচৌরি। এই জিনিস চলতেই থাকে লিপিড প্রোফাইলের এইসি কি ত্যইসি করে, চক্রবৎ।

কিন্তু হায়দ্রাবাদ আর লক্ষ্নৌর ব্যাপারটা আলাদা। এখানে আমি আসি শুধুমাত্র..

হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, বিরিয়ানির জন্যে। এবং শুধুমাত্র পছন্দের ঠেক থেকেই, হায়দ্রাবাদে যেমন প্যারাডাইস, লক্ষ্নৌতে তেমন দস্তরখান।

যাই হোক, আজ ভোর ছ’টা নাগাদ হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে লক্ষ্নৌ স্টেশনে নেমে, সাত বচ্ছর বাদে সূর্যোদয় দেখার আনন্দে ফের দুঘন্টা ঘুমিয়ে, তারপর স্নান করে, শেভ করে, ফিটফাট বাবুটি হয়ে গোমতীনগর মার্কেট নেমেছি দুটো নাগাদ বেরিয়ে যাব এই প্ল্যান নিয়ে। এখান থেকে স্ট্রেইট হজরতগঞ্জ এন্ড দেন, হেভেন।

তা আমার যা অভ্যেস, সেলসম্যানের সংগে হাত মেলাবার পরেই এবং তার হাসি মিলিয়ে যাবার আগেই, স্ট্যান্ডার্ড প্রশ্ন, ‘সকাল থেকে কটা কল করলি? কটা প্রোডাকটিভ?’।

এ ছোকরা ভারি লজ্জিত ভাবে ঘাড় মাথা চুলকে মিনমিন করে জবাব দিল সকাল থেকে উনি সাতটা কল করেছেন, জিরো প্রোডাকটিভ!

শুনেই চড়াৎ করে মাথায় রক্ত উঠে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। সাড়ে দশটা বাজে, মাত্র সাতটা কল করেছিস, একটাও প্রোডাকটিভ নয়, এই মাসের টার্গেটটা কে করবে, আমার বাবা?

খুব সম্ভবত আমার কান দিয়ে ধোঁয়াটেঁয়া বেরোচ্ছিল। ছোকরা সভয়ে পা তিনেক পিছিয়ে গিয়ে নিবেদন করলো বম্বে থেকে বড় সাহেব যখন ক্ষমাঘেন্না করে পায়ের ধুলো দিয়েই ফেলেছেন, এইবার একটা এসপার বা ওসপার না হয়ে যায় না, ‘গুসসা না হইয়েগা’।

ছোকরার ঘেঁটি ধরে বললাম ‘লেটস গো টু দ্য নেক্সট আউটলেট।’

নেক্সট দোকান দুবস্তা টাটা সল্ট নেবার পর রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছিল। সে বাবুও ‘ঠিক হ্যয় বাউজি’ বলে হাসিমুখে বেরিয়ে আসছিল, দরজায় আমি, আর আমার মুষ্টিবদ্ধ হাত দেখে ফের এবাউট টার্ণ।

এরপর কি ঝুলোঝুলি রে ভাই!! আরও তিনটে মাল গছালে।

তারপর থেকে দেখি ছোকরার উৎসাহ দেখবার মতন। প্রায় প্রতি দোকানেই সে প্রায় ঝাঁপ দিয়ে বডি ফেলে দিচ্ছে, সেলও হচ্ছে মন্দ নয়। ক্যালানির ভয়ে না দৈবানুগ্রহ বোঝা দায়!

ভাবলুম এই সুযোগ, প্রায় দুটো বাজে, দস্তরখানের দেবভোগ্য বিরিয়ানির সেই উদাত্ত আহবান আর উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। তখন তাকে ডেকে অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বল্লুম ‘শোন, আমি চল্লুম। মন দিয়ে কাজ করিস। ফাঁকিবাজিটা বন্ধ কর। ইয়েমস্তি করে জীবনে কারও উন্নতি হয়নি। তুই কি জানিস ফাঁকিবাজি নিয়ে নোয়াম চমস্কি কি বলেছেন?’

ছোকরা মনে হল একটু ঘাবড়ে গেলো, ”উয়ো চামচুকিয়া বাবু কা বোলা স্যার?’

‘উও বোলা অবহেলা করে যে গাড়ি চাপা পড়ে সে। বুঝলি? আভি হাম চলা। মার্কেট শেষ করকে হামকো রিপোর্ট পাঠানা। নইলে প্রচন্ড ক্যালানি তুমহারা কপাল মে নাচ রাহা হ্যায়, সমঝা?’

এত বড় সদুপদেশ শুনেও সে বাবু দেখি ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। বল্লুম ‘কি হল?’

‘আভি আপ যাইয়েগা?’

সেই রকমই তো ইচ্ছে। কেন? তোর পারমিশন লাগবে নাকি রে?

সে প্রায় ”আভি না যাও ছোড়কর” গোছের চোখমুখ করে বলল ‘আউর দো ঘন্টে রুখ যাইয়ে না সা’ব’।

ঝট করে মাথা গরম হয়ে গেলো, ওদিকে বিরিয়ানি ঠান্ডা হয়ে গেলো বলে ইনি এখন…

খ্যাঁক করে বল্লুম ‘কিঁউ বে?’

এরপর ছোকরা ভারি অভিমানভরে ‘আজ হাম আপনে দুঁয়াও কা অসর দেখেঙ্গে’ ন্ট্রে জানালো সাহেব কি চাননা এই গরীব দুসাদের বেটা অন্ততপক্ষে একটা মাস একটু সেলস ইন্সেন্টিভ কামাক!

হালায়, তুমি বাঙালরে সেন্টিমেন্ট দিতাস?

খুব, খুউউব বিরক্তিসহকারে জিজ্ঞেস করলুম আমি থেকে গেলে তার এক্সাক্টলি কোন চতুর্বর্গ লাভটা হবে শুনি?

জবাবে সে যা বলল, আমি শুনে ধাঁ।

তার বক্তব্য একে তার এলাকায় সেলপত্তর তেমন নেই। তদুপরি তার উপরওয়ালা সেলস অফিসারটি একটি জাতখচ্চর হারামি ভূমিহার। সে ইচ্ছে করেই প্রতি মাসে এমন টার্গেট দেয় যে এই অসামান্য প্রতিভাধর সেলসম্যানরত্নটির কাছে সেই সাত রাজার ধন সেলস ইনসেন্টিভখানি কেবলই ”পিসলাইয়া পিসলাইয়া’ যায়।

‘তা খোকন, এতে আমি কি করবো?’

সে খোকা ব্রীড়ানতা কুমারীর মতন নখ খুঁটতে খুঁটতে জানালে, লাস্ট সাতাশ দিনে যা সেল হয়নি, শুধু আজই সে প্রায় নামিয়ে ফেলেছে।

‘তো?’

এই তো’এর মানে আর কিচুই না। ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে আমি যদি আর ঘন্টা দুয়েক এঁর সঙ্গে ডেঁইড়্যে থাকি, উনি কালকের মধ্যেই টার্গেট নামিয়ে ফেলবেন। জাস্ট হাজার দশেক আর বাকি। ওটা পরশুর মধ্যে লিচ্চই হইয়ে যাবেক।

সে তো বুঝনু। তা ভাইটি, আমিই কেন?

এর উত্তরে সে ছোকরা যা বলল, লিখতে গিয়ে অবধি আমার গা টা কেমন শিউরে শিউরে উঠছে কাকা। মাইরি বলছি, একবন্ন বাড়িয়ে না।

আজ অবধি যা হয়নি, তা আজ হতে দেখে ছোকরার পাক্কা বিশ্বাস আজ স্বয়ং মা লক্ষী মুম্বাই থেকে শার্ট প্যান্ট পরিধানান্তে লক্ষণাবতীতে ওঁর এই অধম সন্তানটির সাহায্যবিধায় অবতীর্ণ হয়েছেন!

মানে?

মানে আর কি? বাবুর বয়েস একুশ। জাতিকূলসংস্কারবিধায় বছর দুয়েক আগে উনি উদ্বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, মাস খানেক আগে বাপও হয়েছেন। নেক্সট মাস কিছু খরচিলা টীকাকরণ কর্মসূচি আছে। টাকাটা উনি সসুরাল থেকে আদায় করবেন না গিন্নির বাউটিখানি বন্ধক রাখবেন স্থির করে উঠতে পারেন নি। ইন্সেন্টিভটুকু পেলে কাজ অবশ্যই হত, তবে কিনা প্রভু এর আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। ‘আজি এ প্রভাতে’ এই অধম ওনার পেছনে না লাগলে এই ‘বৃথা আশা মরিতে মরিতেও’ চেগে উঠতো না বলাই বাহুল্য।

অতএব আমি যদি আমার এই মহিমান্বিত চরণদুখানি ওনার মস্তোকপরি আরও ঘন্টা দুয়েক রাখি, তাহলে এই গরীব দুসাদের বাচ্চা বেকার বেফালতু ঝামেলা উমেলা না বাড়িয়ে পরের মাসে নিজের অওলাদটির ফুল টীকার ব্যবস্থাটা করে ফেলতে পারে।

উফফফ, পুরো সেন্টিমেন্টের ঝাউগাছ মাইরি। কানের গোড়ায় দুটো থাপ্পড় মেরে চলেই আসতুম। শালা, তোর বাচ্চার টীকা ইম্পর্ট্যান্ট না আমার বিরিয়ানি?

শেষ পর্যন্ত থাকতে বাধ্য হলুম। প্রথমত মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলা আমার ঠাকুর্দার শেষ কথাটা খুবই অপ্রাসঙ্গিক ভাবে মনে পড়ে গেছিলো, ‘কহনো লোক ঠকাইবানা, আর লুকযুনরে পারলে হেল্প করবা’।

আরও বড় কারণ আমার মাতৃদেবী।

আমার মাতামহ ছিলেন বরিশাইল্যা বাঙাল। তাঁর মেয়ের মধ্যে সেই গনগনে তেজোদীপ্ত ব্যাপারটা প্রবলভাবে বর্তমান। ”ছুডবেলা থেইক্যা” দেখেছি এইসব কারণে ভদ্রমহিলার স্নেহ একদমই নিম্নগামী হয় না। বরং জানতে পারলে পিঠের চামড়া উঠে ডুগডুগি হবার বিপুল চান্স হাড়ে হাঁটুতে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়।

অতএব আর কি। চারটে অবধি সে দেহাতিনন্দনের সঙ্গে মার্কেট করে খালি পেটে দু পেগ হুইস্কি চড়িয়ে এই লেখা লিখছি।

ডিনারেও দস্তরখান কপালে নেই। সে হতচ্ছাড়া খুব জোর দিয়ে বলেছে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আজ আমার জন্যে গরম গরম বাজরার রোটি আর দেসি চিকেনের ঝাল নিয়ে এসে আমার হোটেলে দিয়ে যাবে, ওনার জরু আমার জন্যে ইসপেসাল রান্না করে রেখেছে।

পুং মা লক্ষীর জন্যে ভোগপ্রসাদ আর কি!

ইয়ের চাকরি শালা !!!
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *