গোরু চোর

গোরু চোর

(ফরাসী হইতে অনূদিত)

এক বছর ধরে হতভাগা য্যাক জেলখানার একটা ছোট কুঠরীতে বাস করছে। কুঠরীটি পাহাড়ের গর্ভের মতন আধাব। সেখানে ইঁদুর আর পাহারাদার ছাড়া কোন জ্যান্ত জীবের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় নি। পাহারাদার কিন্তু কখনো তার সঙ্গে কথাটি পর্যন্ত বলত না। তার নামে নালিশ হয়েছে কিনা, যদি বা হয়ে থাকে, তবে তার কসুর কি ; সে তার কিছুই জান্ত না ; জানবারও কোনও উপায় ছিল না।

সে প্রায়ই নিজে নিজে বত “আশ্চর্য্যি। এরা আমাকে এখানে আটকে রেখেছে—কেউ ত বলে না কেন? এক এক বছর ধরে মোকদ্দমাটা যে কি তাও ত বুঝি নে। আমি যে একটা বড় রকম খারাপ কাজ করে ফেলেছি তার আর সন্দেহ কি? কিন্তু সে কাজটি কি? আমি ত তন্ন তন্ন করে খুজলাম, জীবনের পাতা উটে দেখলাম, সব রকমে আমার কাজগুলি ভেবে দেখলাম—কিন্তু কই কিছুই পেলাম না।……সত্যিই ত, আমি একটা গরীব মানুষ, বুদ্ধিসুদ্ধি নেই, কারুর উপর কোনও আড়িও নেই!…… হতে পারে আমি যা মনে করি ভাল কাজ কিংবা কোনও অন্যায় কাজ নয়, সেগুলিই মস্ত বড় খারাপ কাজ ।……”

তার মনে এল একদিন সে একটা ছোট্ট ছেলেকে নদী থেকে ডুবতে বাঁচিয়েছিল; আর একদিন তার নিজের খুব ক্ষিধে থাকতেও সে পথের ধারের ক্ষিধেয় মরমর এক হতভাগাকে তার সমস্ত রুটিগুলি দিয়ে দিয়েছিল।

সে কাঁদতে কাঁদতে বলে “হয়ত তাই ! হয়ত এগুলিই ভয়ানক অন্যায় কাজ !……কারণ, খুব ভয়ানক অন্যায় কিছু না করলে আমি কেন এ কুঠুরীতে আটকে আছি ?……”

এই রকম চিন্তা তাকে কিছু সান্তনা দিত; কারণ তাতে অনিশ্চয়তার মধ্যে সে কিছু আলো পেত! তার বিশ্বাস, তার সম্বন্ধে আদালত বা হাকিমদের কোন ভুল হতে পারে না। তারা যা করেন, ঠিকই করেন।

যখন নতুন করে তার কষ্ট মনে জেগে উঠত সে নিজে নিজে আওড়াত এ তাই! এ তাই!……সত্যিই এ তাই ।…হতে পারে আরও কিছু যা আমি জানিনে!… ……কারণ, আমি ত কিছুই জানিনে, অন্য কেউ না, আমিও না। আমি নেহাৎ গরীব, আমার কিছুই নেই ; আমি কি করে জানব কি ভাল কি মন্দ!…… আমার মত গরীব লোকে যা করে সবই অন্যায়!……”

একদিন সকালে মনটাকে শক্ত করে সাহসে বেঁধে তার পাহারাদারকে সে জিজ্ঞেস করলে।…..পাহারাদারের চেহারাটি ছিল ভীষণ, কিন্তু সে লোকটি ছিল ভাল । সে জওয়াব দিলে, “খোদার কসম! আমার মনে হয় তারা তোকে ভুলে গেছে।……”

বলতে গিয়ে সে এক প্রচণ্ড হাসি হেসে উঠল। হাসির চোটে তার প্রকাণ্ড গোঁফজোড়া উচু হয়ে উঠল, যেমন দমকা হাওয়ায় আধ-ভেজানো জাল্লার পর্দা উঁচু হয়ে উঠে।

“আছে একজন”, সে আবার বলতে লাগল,“তার নম্বর ৮১৪ ; সে বাইস বৎসর এখানে হাজতে আছে!”

পাহারাদার বাড্‌সাইয়ের পাইপ রীতিমত পূরে দেশলাই ধরিয়ে আবার বলতে লাগল, “তুমি আর চাও কি ? এখন রাজ্যির লোকে জেল ভ’রে গেছে। হাকিমদেরই মাথা ঘুরে গিয়েছে, তারা কি করবেন ঠিক করতে পারছেন না। ……জেলখানায় এবার বন্যা এসেছে !……”

য্যাক জিজ্ঞেস করলে, “ব্যাপারখানা কি বল ত! কোনও ‘গদর’ ( বিপ্লব) হয়েছে নাকি?”

“বিপ্লবের চেয়ে সাঘাতিক।……একদল বেহায়া ডাকাতে ছোরা বেরিয়েছে, তারা রাস্তায় রাস্তায় সত্য ঘোষণা করে বেড়ায়! তাদের যতই তাড়াতাড়ি বিচার কর আর যতই তাড়াতাড়ি জেলে পোরে। সবই মিছে। এমন ব্যাপার রোজই হচ্ছে ! কেউ জানেনা কোপেকে এরা সব বেরুচ্ছে ।……” | এক গাল ধোয়া ছেড়ে সে আবার বলে “আঃ! এসবের আখের বড়ই খারাপ!………

কয়েদীর মনে একটা সন্দেহ এল। সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলে, “তবে আমিও কি না-জেনে না-শুনে রাস্তায় রাস্তায় সত্য ঘোষণা করেছি।”

পাহারাদার মাথা নেড়ে উত্তর দিলে “সে সম্ভব নয়।… তোর ত সে রকম ডাকাতে চেহারা নয়। তুই হয় ত’ একটা খুনে, নয় একটা জালিয়াত, নয় একটা চোর।……

এত কিছুই নয়। সত্যি কি, এ ভালই।…..কিন্তু তুই যা বলি সত্যিই যদি তা করে থাকি, তবে এদ্দিনে তোর বিচার হয়ে ফাঁসি কাঠে ঝুলতিস্……

“তবে যারা সত্য ঘোষণা করে, তাদের ফাঁসি কাঠেই ঝুলতে হয় ?”

“থাম…সত্যিই…তা’ সে মন্ত্রীই হ’ক আর বড় পাদ্রিই হক,…..কিম্বা লড়াইয়ে বাহাদুরীর জন্য তগমাই পাক তাদেরও তাই ঘটবে……হাঁ, তাই! …যাবি কোথায়?”

যাক একটু আশ্বস্ত হয়ে গুন গুন করে বলতে লাগল, “তাই ত’!…আমি ত কিছু সত্য ঘোষণা করি নি। সেটা দরকারি।” “দ্যাখ, দেখি, তোর ত’ কোন রাঙা গোরু নেই?…আজকালকার দিনে এটাও একটা অন্যায় জিনিস।”

পাহারাদার চলে গেল। যাক ভাবতে লাগল। “আমার তবে অস্থির হবার দরকার নেই।… আমি কখনও সত্য ঘোষণা করিনি।…কখখনও আমার রাঙা গোরু ছিল না।… তবে আমার ভাবনা কি ?”

সে রাত্রে সে আরামে ঘুমুল।

য্যাকের গেরেফতারের এক বছর সতের দিন পরে দুইজন সেপাই তাকে নিয়ে আদালতে হাজির করলে। সেখানকার আলোয় সে বেহুশ হয়ে পড়ে গেল। ব্যাপারটা বড়ই সঙ্গীন হ’ল। হতভাগা অস্পষ্ট শুনতে পেলে কতকগুলো লোক আস্তে আস্তে বলছে-“এ একটা বড় বদমায়েশ হবে।”

“এ একজন সত্য ঘোষণা করেছে।”

“এর চেহারা দেখে মনে হয় এর একটা রাঙা গোরু আছে।”

“লোকের বিচারে একে সঁপে দিলেই ছিল ভাল।” “দ্যাখো, লোকটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে।” “ফাঁসি,…ফাঁসি….ফাঁসি…।”

যখন য্যাকের হুশ হল, সে শুনলে একটি যুবক বলছে, “কেন তোমরা তার বিরুদ্ধে চীৎকার করছ ? তাকে গরীব আর কাতর দেখাচ্ছে।”

য্যাক দেখলে রাগে কয়েকটা মুখ বিকৃত হল, কয়েক টা ঘুষি উঠল।…যুবকটি মারের চোটে বেদম হয়ে রক্তাক্ত শরীরে দৌড়ে আদালতের কামরা থেকে বাইরে চলল। তার পিছে পিছে এক খুনে দল ও ছুটল।

“ফাঁসি,…ফাঁসি….ফাঁসি…।”

আদালত ঘরে একটা টেবিলের সামনে কয়েকজন লোক বসে আছেন। তাদের পিছনে একখানি প্রকান্ড রক্তাক্ত যীশু খ্রীষ্টের ছবি। তাঁদের পরনে লাল পোনাক, মাথায় সোনালি টোপর ।

সোনলি টোপরের নীচু থেকে একটা নাকি ভাঙা সুর এল “য্যাক, তোমার কি বলবার আছে ?”

য্যাক কিছুমাত্র চঞ্চল না হয়ে ধীরে ধীরে উত্তর দিলে, “হুজুর, আমার রাঙা গোরুকি অ-রাঙা গোক,কোথা থেকে খাবে ? আমার না আছে গোরুর গোয়াল, না আছে গোরু-চরানোর মাঠ।”

বিচারক কড়া ধমক দিয়ে বললেন, “তুই জওয়াব এড়াচ্ছিস। তুই যে একটা নেহাৎ পাজি এবং জঘন্য প্রকৃতির লোক তা তোর ভাবে বোঝা যাচ্ছে।……তোর নামে নালিশ হয় নি যে তোর গোয়াল আছে, কি তোর গোরু-চরানোর মাঠ আছে। সত্য বলতে কি সেগুলি মন্ত অপরাধের বিষয় হলেও আদালত দয়া করে তোর বিরুদ্ধে সে সব নালিশ নিচ্ছেন না।…তোর নামে কেবল এই নালিশ হ’য়েছে যে তোর একটা রাঙা গোরু আছে। …… বল্ তোর কি জওয়াব !”

হতভাগাটা আপত্তি করে বললে, “হায়! আমার লাল রঙের গোরু নেই, অন্য রঙেরও কোনও গোরু নেই। দুনিয়ার ওপর আমার নিজের বলতে কিছুই নেই।…বাড়ার ভাগে আমি হলফ করে বলছি আমার জীবনের কোনও সময় আমি কোনও সত্য ঘোষণা করি নি।”…

‘বেশ।” বিচারক এমন করে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন যে, য্যাকের মনে হল যেন তার জন্যে সারা জীবন কয়েদের হুকুম হয়ে জেলখানার দোর বন্ধ হয়ে গেল। “তোর ব্যাপার পরিষ্কার ; তুই বসতে পারি।”

সাঁঝের পরে কতকগুলো লোক যাদের য্যাক কোনও কালে চিনত না, তাদের ভিতর অনেক কথা কাটাকাটি হ’ল। কথার মধ্যে গালাগালির সঙ্গে সঙ্গে তার নাম ও রাঙা গোক বার বার সে শুনতে পেলে। তারপর রায় হ’ল তার যা নেই সেই রাঙা গোরু থাকার গুরুতর ও ভীষণ অপরাধের জন্য তার পঞ্চাশ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড।

লোকের ভিড় দণ্ড শুনে নিরাশ হ’ল-এত গুরুপাপে এই লঘু দণ্ড !

“ফাঁসি,…ফাঁসি….ফাঁসি…।”

সেপাইরা অতি কষ্টে হতভাগাকে ভিড়ের হাত থেকে বাঁচালে। তাদের চীৎকার আর ভয় দেখানোর ভিতর থেকে সেপাইরা তাকে উদ্ধার করে জেলখানায় তার কুঠরীতে নিয়ে এল। সেখানে পাহারাদার তার জন্য অপেক্ষা করছিল।

য্যাক একান্ত মুষড়ে প’ড়ে বলে-“আমাকে খুন ক’রে ফেলেছে।……আমি ত কিছুই জানি নে। দুনিয়ায় আমার কিছুই নেই, তবে কেমন করে আমার একটা রাঙা গোরু হ’ল !……”

গোরু চোর পাহারাদার রাত্রের মত শেষ পাইপ সাজতে সাজতে বলে-“কেউ কখখনও জানতে পারে না…….তুই জানিস্ নে কি করে তোর একটা রাঙা গোরু হল।…… আমি জানি নে কি করে আমি জেলখানার পাহারাদার হলাম। লোকের ভিড়ও জানে না কেন তারা ফাঁসি ফাঁসি বলে চেঁচায় !…দুনিয়া যে ঘোরে তা কি দুনিয়া জানে ?” তারপর সে চুপটা করে তার পাইপ টানতে লাগল।……

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *