রসবতী

রসবতী

বৈঠকখানায় বসে খবরের কাগজ পড়ছি ; মহাত্মা গান্ধী কি করছেন, হিন্দু-মুসলমানে কোথায় দাঙ্গা হয়েছে, জল-প্লাবনে লোকের কিরূপ অবস্থা ঘটেছে, কোনও মানহানির মোকদ্দমায় আসামীর জেরার রিপোর্ট —এই রকম দরকারী বেদরকারী খবর নিয়ে মশগুল আছি, এমন সময়ে এক ছোকরা বাবু নমস্কার করে ঘরে ঢুকলেন। খদ্দর পরা, নাকে চশমা আঁটা, পায় স্যাণ্ডেল, হাতে বই কাগজ, দেখে মনে হ’ল বন্যার জন্যে চাঁদা নিতে এসেছেন।

তিনি। মশায়, আগামী পূজোর জন্যে আমাদের কাগজে আপনার একটা ছোট গল্প চাই।

আমি। ওঃ! আপনি কোন পত্রিকার ?

তিনি। আজ্ঞে, আমি—পত্রিকার সহকারী সম্পাদক।

আমি। বেশ। তবে আমার কলমে তেমন গল্প জমে না। একটী ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখা আছে, যদি সেটা চান–

তিনি। মশায়, ওসব আমাদের কাগজে খাপ খাবে না। কোন গল্প টল্প–

আমি। ভাল কথা! একটা গল্প অনেক দিন হ’ল লিখে রেখেছি, তবে সেটা আপনাকে একবার শুনতে হবে।

তিনি। সানন্দে শুনব।

তখন আমি আমার পুরান ফাইল থেকে গল্পটা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।

রসবতী।

পাঁচু ছোট বেলায় বাপ-মা হারিয়েছে।

তিনি। মশায়, ক্ষমা করবেন। এই পাঁচু নামটা বদলে একটা ভাল নাম—যেমন ধরুন সুকুমার কি বিমল –

আমি। আচ্ছা, আগে আমার গল্পটা শেষ হ’ক, তারপর আপনার মন্তব্য বলবেন।

পাঁচু ছোট বেলায় বাপ মা হারিয়েছে। পাড়াগাঁয়ে তাদের বাড়ী ছিল ; তাও পদ্মায় গ্রাস করেছে। তাই সে শহরে তার মায়ের মাসতুতো ভাই রমেশ মামার বাসায় আশ্রয় নিয়েছে।

রমেশ বাবু ওকালতি করেন। কেমন পশার তা জানি নে। তবে তিনি কাগজপত্র নিয়ে সকল সময়ই অত্যন্ত ব্যস্ত, তা কোনও মক্কেল আসুক বা না আসুক। রমেশ বাবু বড় হিসেবী লোক। বাসায় আগে একটা চাকর ছিল। পাঁচু আসতে তার জবাব হ’ল। এখন বাজার করা, তামাক সাজা, এই সব ছোট খাট কাজ পাঁচুর জিম্মা।

পাঁচু স্থানীয় স্কুলের ক্লাস সেবেনে পড়ে। স্কুলে রোজ যায় আর মার খায়। বেচারা ঘরে পড়া তৈরির সময় পায় না। তবুও সে রোজ স্কুলে যায়।

স্কুলের পথে গোপাল ময়রার দোকান। দোকানের সামনে এসে পাঁচু একটু না দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। লাল, গোলাপী, সাদা কত রঙের, কত নামের মিঠাই দোকানে থরে থরে সাজান থাকে। লোকে কিনে ঘরে নিয়ে যায়, কেউ পথে দাঁড়িয়ে খায়, কেউ দোকানে বসে খায়। পাঁচু শুধু দেখে। তার মামা তাকে একদিনও একটা পয়সা দেন না, সে যে কিছু কেনে।

একদিন খুব সাহস করে পাঁচু তার মামার কাছে একটা পয়সা চাইলে। অমনি তিরস্কার বর্ষণ হতে লাগল। “হতভাগা, দু বেলা পেট ভরে ভাত খাও। পয়সা কি হবে ? হাঁ, পয়সা নিয়ে বিড়ি পান খাবে, তা হবে না।”

পাঁচু দুবেলা দোকানের সামনে দিয়ে যায়, আর একটু দাঁড়ায়। ওই একটা রসে ভরা লাল রসগোল্লা পেলে সে কত খুশী হয় ! ভদ্রলোকের ছেলে সে ত আর চাইতে পারে না। পয়সাও ত নেই।

একদিন বাসায় রাঁধতে দেরি হয়েছে। পাঁচু না খেয়েই স্কুলে এসেছে। ফিরবার পথে খিদেয় গা ঝিম ঝিম্ করছে। সে সেই দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। দোকানে কেউ নেই। লাল রসগোল্লাগুলি যেন তার দিকে চেয়ে বলছে “নে না ভাই! আমায় তোর গালে তুলে নে না।” পাঁচু আর থাকতে পারলে না। চারিদিকে একটু চেয়ে একটা বড় রসগোল্লা সাঁ করে তুলে নিয়ে দৌড় দিলে।

আর একজন স্কুলের ছেলে, তার বন্ধু নরেন, সে ও পিছু দৌড়ুল। কিছু দূর এসে নরেন পাঁচুকে ধরে ফেলে। “দে, ওটা আমাকে দে।” “কেন তোকে দেব ?” “বটে। মিঠাই চুরি করেছিস। তোর মামাকে আর মাস্টারকে বলে তোকে মার খাওয়াব।” “যাক্ ভাই, তুই অর্ধেকটা নে।” নরেন শুনলে না। তার গায় জোর ছিল। সে পাঁচুর হাত থেকে মিঠাইটা কেড়ে গালে পুরুলে।

ওদিকে গোপাল ময়রা পিছন থেকে এসে নরেনের কান ধরে গালে এক থাপ্পড় লাগিয়ে দিলে। নরেনের গাল থেকে রসগোল্লাটা পড়ে গেল। নরেন কাদো কাঁদো হয়ে বল্লে, “কেন তুমি মারলে ?”

“বদমাইশ ! মিঠাই চুরি ! ভদ্দর নোকের ছেলে হয়ে মিঠাই চুরি !”

“আমি চুরি করি নি। ও পাঁচু ক’রেছে।”

“কই সে ?”।

কোন ফাঁকে পাঁচু সরে পড়েছে, তা কেউ টের পায় নি। নরেন চারিদিকে চেয়ে বল্লে “সে পালিয়েছে”।

গোপাল ময়রা সে কথা না শুনে তার হাত ধরে তাকে দোকান ঘরের দিকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চল। নরেন বল্লে, “আঃ। আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছ কেন? আমি ত মিঠাই চুরি করি নি।” গোপাল কিন্তু নরেনকে টেনে নিয়েই চল্ল। পথে নরেন বলে “তোমার মিঠায়ের দাম, বড় জোর, দু পয়সা। এই নেও, দু পয়সা ; ছেড়ে দাও।” দোকানদার তার হাত ছেড়ে দিলে। নরেন পকেটে হাত দিয়ে পয়সা খুঁজতে লাগল। তারপর দোকানদারকে একটু অন্যমনস্ক দেখে একেবারে তীরের মত ছুট। গোপাল মোটা মানুষ। তার সঙ্গে দৌড়ে পারবে কেন? কিছু দূর গিয়ে হাপাতে হাপাতে দোকানে ফিরে এল।

পরদিন গোপাল স্কুলে গিয়ে হেড মাষ্টারের কাছে নালিশ করলে। তিনি নরেনকে খুঁজে বার করলেন। নরেন পাঁচুর ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইলে। কিন্তু হেড, মাষ্টার সূক্ষ্ন বিচার করে ঠিক করলেন নরেনই দোষী। সে মিছামিছি পাঁচুর দোষ দিচ্ছে। তখন তিনি তাকে গাধার টুপি মাথায় পরিয়ে সমস্ত ক্লাস ঘুরিয়ে কয়েক গা বেত দিয়ে ছেড়ে দিলেন।

সহকারী সম্পাদক। আপনার গল্প শেষ হ’ল না কি ?

আমি। হাঁ, এই শেষ।

সহঃ সম্পাদক একটু ঠোট বাঁকিয়ে বলেন, “এ গল্প চলবে না। আজ কাল দু’জন নায়ক আর একটা নায়িকা না হলে গল্প পছন্দসই হয় না।”

আমি। গল্প ত কল্পনা বই আর কিছু নয়। তা মনে করুন গোপালের রসগোল্লা নিয়ে দুটো ছোকরার কাড়াকাড়ির বদলে গোপালের ষোল বছরের সুন্দরী রসিকা মেয়ে নিয়ে এই রকম একটা কিছু হলে—

সহঃ সম্পাদক। প্লটটা মন্দ হবে না; চলতে পারে। আপনি একটু কেটে কুটে রসগোল্লার জায়গায় সুশীলা নাম দিয়ে,–ভাল কথা! পাঁচু নামটাও বদলাতে হবে-একটু নতুন করে লিখে দিন না। বেশ বদলাতে হবে না। আমাদের পত্রিকার শেষ আড়াই পেজের ম্যাটার কম পড়ে গেছে। বেশ চলে যাবে।

আমি। মশায়, আমার ত অত সময় নেই। আপনি ইচ্ছা মত পরিবর্তন করে কাগজে বার করতে পারেন।

সহঃ সম্পাদক। আচ্ছা! তাই হবে। কাগজ চালাতে গেলে এমন অনেক কিছু করতে হয়।

———————

তারপর আমার গল্পটা যে আকারে পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল, তা আপনারা অবশ্য দেখেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *