বিশ্বাসের মূল্য

বিশ্বাসের মূল্য

প্রথম দৃশ্য।

স্থান-বাগদাদ নগরের রাজপথ।

খলীফা হারুনুর রশীদ আজ খোশবাগে যাইতেছেন। সঙ্গে বেগম যোবেদা খাতুন। উভয় পার্শ্বে খোলা তলোয়ার হাতে খোজাগণ। রাজপথের দুই ধারে রাজপ্রাসাদ হইতে উপবন পর্যন্ত বসোনার সপুষ্প গোলাপ তরু সারি সারি সজ্জিত। গোলাপ বর্ণ মখমলে সমস্ত পথ মন্ডিত। দক্ষিণ বামে গৃহে প্রাচীরসমূহ গোলাপী রঙ্গে রঞ্জিত।

অগ্রে আরব্য ঘোটক পৃষ্ঠে খলীফা, পশ্চাৎ মহিষী। রাজাজ্ঞায় পথ জন-প্রাণি-শূন্য। কোথা হইতে পাগল বহলূল আসিল। বহলূল ধীরে ধীরে খলীফার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল।

কেহ বলে বহলূল পাগল। কেহ বলে কামেল -পীর। বিশেষতঃ রাজ-অন্তঃপুরে তাহার অব্যাহত গতি। কেহ বাধা দিল না। প্রধান শরীর-রক্ষক একবার খলীফার মুখের দিকে তাকাইল। খলীফা বলিলেন,“আসিতে দেও।”

বহলূল অগ্রসর হইয়া বলিল, “ওগো! বেহেশত কিনিবে?

“কত দাম?”

“লাখ টাকা।”

“কই তোমার বেহেশত?”

বহল ল কম্বলের ভিতর হইতে হিজিবিজি আঁকা একখানি মলিন কাগজ বাহির করিল।

খলীফা অবজ্ঞার হাসি হাসিয়া বলিলেন, “যাও পাগল ! এ তোমার পাগলামি করিবার সময় নয়।”

বহলূল সরিয়া গেল। কাগজখানি লইয়া বেগমের কাছে ধরিল। বেগম দ্বিরুক্তি না করিয়া গলা হইতে হীরার হার খুলিয়া বহলূলের হাতে দিলেন। বহলূল চলিয়া গেল।

দ্বিতীয় দৃশ্য।

স্থান—বাগদাদের আদালত গৃহ।

সময়—সেইদিন মধ্যাহ্ন।

বাগদাদের আদালতে আর কখন বুঝি এত লোক জমে নাই। সকলেই প্রায় কাঙ্গাল গরীব। তাহারা এখানে কেন? এতক্ষণ ভিক্ষা করিলে তাহাদের দু’পয়সা রোজগার হইত। কিজন্য সকলে সজল নেত্রে বসিয়া আছে ? আজ ‘আলী হসন সওদাগরের বিচারের রায় প্রকাশিত হইবে। এমন দিন ছিল যখন প্রত্যেক বেলায় ‘আ’লী হসনের দস্তরখানে হাজার লোক বসিত। দানের জন্য আজ ‘আলী হসন ঋণী। দেনাও কম নয়, লাখ টাকা। শহরে এমন আমীর ওমরা, এমন গরীব দুঃখী ছিল না, যে একবার ‘আলী হসনের পোলাও-কোৰ্ম্মার আস্বাদ গ্রহণ করে নাই। আলী হসনের ধনী বন্ধুগণ আজ কোথায় ? অমন একটা অপব্যয়ী দেনাদার দেউলিয়ার সহিত সম্পর্ক রাখাটা লজ্জার কথা! তাই তাহারা কেহ আসে নাই। আসিয়াছে কেবল কতকগুলি লোক–যাহাদের হৃদয় ব্যতীত আর কোনও ধন নাই। তাহারা কি দিবে? দু’ফোঁটা চোখের জল বইত নয় ! দুনিয়ায় তাহার মূল্য কি? কাযিয়ুল কোয্যাত রায় প্রকাশ করিলেন। দেনার দায়ে ‘আলী হসনের কারাদণ্ড। গরীব দুঃখী হাহাকার করিয়া উঠিল।

জনতার মধ্য হইতে কে চীৎকার করিয়া বলিল, “দোহাই আল্লার! দন্ড মাফ –আমি টাকা দিব।” সকলের নজর সেই দিকে গেল। এ যে বহলূল পাগল ! ‘আলী হসন খালাস।

তৃতীয় দৃশ্য।

স্থান-বাগদাদের রাজ অন্তঃপুরের একটি প্রকোষ্ঠ।

সময়—সেই দিন রাত্রি।

রাজপুরী কোলাহল-শূন্য। শয়ন-প্রকোষ্ঠে খলীফা ও মহিষী। অন্য কেহ নাই। স্বর্ণনির্মিত শামা’দানে একটী কপূরের বাতি স্থির আলোক দিতেছে। এক কোণে একটী ভারতবর্ষজাত আগরের বাতি সুগন্ধ ছড়াইতেছে। খলীফা বলিতেছেন, “বেগম, তোমার মত নির্ব্বোধ ত দেখি নাই। কি বলিয়া তুমি লাখ টাকার হীরার হার দিয়া একটা পচা কাগজ কিনিলে !”

বেগম। জাহাঁপনা, আমি কাগজ কিনি নাই, বেহেশত কিনিয়াছি।

খলীফা। বলল একটা পাগল! আর তুমি তারও বাড়া।

বেগম। হইতে পারে। আমি কিন্তু বহলূলকে সত্যবাদী বলিয়া জানি।

খলীফা। সে একটা মস্ত জুয়াচোর।

বেগম। সে যাহা হউক, আমি কিন্তু সরল বিশ্বাসে তাহাকে হার দিয়াছি। আল্লাহ আমার দিল্ দেখিবেন।

খলীফা। তোমাদের মেয়ে লোকের বুদ্ধিই এই প্রকার। আমি আর তোমার সহিত বৃথা বাক্য ব্যয় করিতে চাহি না।

কথোপকথন থামিল।

রাজপুরীতে হাহাকার পড়িয়া গিয়াছে। রাজ্ঞী যোবেদা খাতুন আর নাই। খলীফাও কঁদিতেছেন। তাহাকে সান্ত্বনা করে কে? মৃত দেহ সমাধিস্থ হইল। খলীফা বলিলেন, “কবর খোড়। আমি একবার রাণীর মুখখানি দেখিয়া লই।”

খলীফার আদেশ। কবর খোঁড়া হইল।

খলীফা করে নামিলেন। কিন্তু লাশ নাই। কবরে বড় এক সুড়ঙ্গ। তিনি সুড়ঙ্গ পথে চলিলেন।

কোথায় সুড়ঙ্গ? এ যে প্রশস্ত মাঠ! সেখানে অসংখ্য ফুলের গাছ। পাখীর মধুর কাকলীতে ঘাসগুলি পৰ্যন্ত যেন আনন্দ-হিল্লোলে নাচিতেছে। তাহার উপর আবার মৃদু মধুর সমীরণ। এমন ফুলগাছ, এমন বাতাস তিনি ত কখন দেখেন নাই, শুনেন নাই, অনুভব করেন নাই। কিন্তু তাহার চিত্তে আনন্দ কোথায় ? যোবেদা যে নাই।

ক্রমে একটা বালাখানা। পৃথিবীর রাজা তিনি, তবুও সেই বালাখানার শোভা দাড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন।

ঐ যে যোবেদা ! ঐ যে প্রাণের যোবেদা! জানালার নীচে দাড়াইয়া তাহার দিকে চাহিয়া আছেন।

খলীফা আনন্দে দৌড়িয়া ভিতরে প্রবেশ করিতে গেলেন। দরোয়ান বাধা দিল। খলীফার রাগ হইল। কিন্তু তিনি এখানে কে? অনুনয় করিয়া বলিলেন, “আমার সমস্ত রাজত্ব তোমাকে দিব, আমার বেগমের নিকটে আমাকে যাইতে দাও।” নিষ্ঠুর সে। তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিল না। খলীফা কাঁদিয়া বলিলেন, “রাণী, তুমি আমায় ভিতরে লইয়া যাও।”

উত্তর হইল, “জাহাপনা! এই সেই আমার স্বর্গ, যাহা আমি হারের বদলে কিনিয়াছি। এখানে অন্যের আসিবার অধিকার নাই।”

খলীফা কাতর ভাবে কাঁদিয়া উঠিলেন। ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। পার্শ্বে রাণী নিদ্রা যাইতেছেন। মাথার বালিশ চোখের জলে ভিজিয়া গিয়াছে। খলীফা বলিয়া উঠিলেন, “লা-হওলা ওলা কুউওতা ইল্লা বিল্লাহি ‘আলিয়িল ‘আয্বীম, !”[1]

তখন ভোর হইয়াছে। সিংহদরজায় নহবৎ বাজিতেছে। চারিদিকে সুস্বর পাখী গান করিতেছে। কর্পূরের বাতি নিভিয়া গিয়াছে। আগরের বাতি পুড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু তখনও একটা সুগন্ধ ঘরময় ভাসিয়া বেড়াইতেছে।

খলীফা ডাকিলেন, “মসরূর।”

“জাহাপনা! গোলাম হাজির।”

“যাও। বহলূলকে রাজসভায় লইয়া আইস।”

চতুর্থ দৃশ্য।

স্থান—খলীফার দরকার।

সময়-পরদিন প্রাতঃকাল।

খলীফা সিংহাসনে বসিয়া আছেন। চারিদিকে উষীর নাষির উপবিষ্ট।

এমন সময় বলল আসিয়া উপস্থিত। খলীফা বলিলেন, “এস বহলূল, এস, এখানে বস।”

বহলূল। কি গো ! কি জন্য ডাকিয়াছ। গর্দান লইবে নাকি? তোমাদের ত ঐ কাজ। হি-হি-হি।

খলীফা। না, বহলূল ! তুমি বেহেশত বিক্রয় করিবে ? বলল। না, গো না! তোমার বাদশাহী দিলেও না

খলীফা। তবে কিসে পাওয়া যায় ?

বহলূল। সরল বিশ্বাসে। আমি যাই।

(বহলূলের প্রস্থান)

________________________


[1] আরবী-“উন্নত মহান ঈশ্বর ব্যতীত কাহারও কোন অধিকার, কোন শক্তি নাই।” মুসলমানগণ দুঃস্বপ্ন দেখিলে কিংবা কোন অমঙ্গল ব্যাপার উপস্থিত হইলে ইহা বলিয়া থাকেন। হাই তুলিবার সময়েও ইহা উক্ত হইয়া থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *