লকখীছাড়া

লকখীছাড়া

শূন্য ঘরে রমযান চুপ করে ব’সে আছে। তার সঙ্গে কোলের সেতারখানাও চুপ হয়ে আছে। সাঁঝের বাতি জ্বেলেই সে সেতার নিয়ে বসেছে; এখন রাত ১২টা বাজে। কিন্তু রমযানের সেদিকে আর খেয়াল নেই। সেতারখানা কোলেই আছে; কিন্তু মনে স্ফুর্তি নেই, হাতে বল নেই। সে কয়েকবার তার একটা প্রিয় গান গাইতে চেষ্টা করলে; কিন্তু গলা ফুটল না। কেবল দু চোখ দিয়ে গরম জলের মৃদু ঝরণা বয়ে চলল।

গত জীবনের ছবিখানা একে একে তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তার বাপ তালুকদার ছিলেন। জমিজমা টাকা কড়ি তাঁর মন্দ ছিল না। সে ছিল তার বাপের একই ছেলে। ছোট বেলায় তার মা মারা গিয়েছিলেন। বাপ তার লেখাপড়ার জন্য খুব চেষ্টা করেছিলেন ; কিন্তু লেখাপড়ায় তার মন ছিল না। সে শিখেছিল গান বাজনা আর উর্দু, পারসী গযল। বাপের মরবার পর সে গান বাজনায় এমন ডুবে গিয়েছিল, যে সংসারের দিকে একটুও মন দিতে পারে নি। জমি জমা সমস্ত বাকি খাজনার নিলামে বিক্রি হয়ে গেছে ; নগদ টাকা কড়ি সবই খরচ হয়ে গেছে। কিছু লাখেরাজ জমি ছিল ; তাই কষ্টে সৃষ্টে সংসার চলছে। কিন্তু কিছুতেই তার স্ফূর্তি দমাতে পারে নি। বুদ্ধিমান্ লোকে তার নাম দিয়েছিল লকখীছাড়া।

ছোট বেলায় বাপ মা-মরা ছেলের বিয়ে দিয়ে পুতুলের মত একটা ছোট্ট বউ ঘরে এনে ছিলেন। রমযান তার দিকে কখনও ভাল নজরে তাকায় নি। জলের অভাবে যেমন লতা শুকিয়ে যায়, তেমনি ভালবাসার অভাবে বেচারীর দেহ মন ক্রমে ভেঙে পড়ছিল। সে দিকে কিন্তু রমযানের লক্ষ্যই ছিল না। গান বাজনাই ছিল তার সব।

আজ দুপ’রে সেই উপেক্ষিতা স্ত্রীকে পৈতৃক গোরস্থানে চিরতরে শুইয়ে রেখে, রমযান ঘরে ফিরেছে। স্ত্রীর মৃত্যুর সময় সে কাঁদে নি। কিন্তু খালি ঘরে ঢুকে তার কান্না যেন ছাপিয়ে উঠতে লাগল। কপোত কপোতীর বিরহে যে ছটফট করে, কে ব’বে সে ভালবাসার জন্য, কি সঙ্গহীনতার জন্য ?

ভাবতে ভাবতে কখন যে রমযান ঘুমিয়ে পড়েছিল, তা সে জানে না। যখন ঘুম ভাঙল, তখন অনেকটা বেলা হয়েছে। সেতারখানা তার পাশেই প’ড়ে আছে।

বিছানায় ব’সে ব’সে সে অনেক ক্ষণ ভাবলে। পরে উঠে কাপড় চোপড় গোছাতে লাগল। একটা ছোট চামড়ার ব্যাগে সেগুলি সে ভ’রলে। ক্যাশ বাক্স খুলে দেখলে কয়েকটা টাকা মাত্র আছে। সে গুলি সে পকেটে নিলে। তারপর সেতারখানা একটা কেসে পুরলে। ডান হাতে ব্যাগ, বাঁ হাতে সেতারের কেস আর বগলে একটা ছাতা নিয়ে রমযান বাড়ী থেকে বেরুল।

দোরে তালা চাবি দিয়ে রমযান একবার বাড়ীর চারিদিকে ঘুরল। তারপর গোরস্তানে গিয়ে বাপ মার কবরের কাছে দাঁড়িয়ে তাদের আশীর্বাদ চাইলে; স্ত্রীর কবরের কাছে এসে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলে। তারপর খোলা দুনিয়ায় সে বেরিয়ে পড়ল।

রমযানের মন সংসারে বিরক্ত হয়ে গেছে। সে কোন পীরের কাছে মুরীদ হতে ইচ্ছা করেছে। তাই পীর ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে সে কত জায়গায় বেড়িয়েছে। কিন্তু কই? মনের মত পীর পাওয়া গেল কোথায় ? তবুও পীর পাওয়াই চাই। ঘুরে ঘুরে শেষে সে ঢাকায় এসে উপস্থিত। সে শুনেছিল সেখানে একজন কামেল পীর আছেন।

সেই দিনই আসরের নমাযের পর সে পীর সাহেবের মসজিদে গেল। পীর সাহেব তখন সেখানে ছিলেন না। সন্ধান নিয়ে রমণার বনে গিয়ে সে তার সাক্ষাৎ পেলে। (রমণা তখন জঙ্গল ছিল। সে আজ অনেক দিনের কথা)। তখন তিনি অশ্বথ গাছের কচি পাতা ভেঙে কতকগুলি ছাগলের বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছিলেন। রমযানের সন্দেহ হ’ল ইনি কি পীর! সে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পীর সাহেব তাকে কাছে ডাকলেন।

পীর। বাবা, তুমি কি চাও ?

রমযান। আপনি কি পীর সাহেব ?

পীর। আমার নাম খাকছার আবদুল্লাহ।

রমযান। আমি আপনার কাছে এসেছি।

পীর। তবে চল, বাসায় ফিরে যাই।

তিনি ছাগল গুলি সঙ্গে নিয়ে মসজিদে ফিরলেন। মসজিদের নীচের কুঠরীতে ছাগলগুলিকে বন্ধ করে তিনি মসজিদের হুজরায় বলেন। রমযান তাঁর কাছে নিজের জীবনের ইতিহাস বলে শেষে বললে, সংসার আর তার ভাল লাগে না; সে তওবা করে মুরীদ হতে চায়।

পীর। বাবা, তুমি কখনও কাউকে ভালবেসেছ ?

রমযান নিরুত্তর। কিছুক্ষণ পরে সে বলে, “আমি ত মুরীদ হতে চাই।”

পীর। ঠিক। কিন্তু এই পথ ভালবাসার পথ । যে কখনও আল্লার সৃষ্টিকে ভালবাসে নি, সে আল্লাকে কেমন করে ভালবাসবে? দেখাকে না চিনলে কি অদেখাকে চেনা যায়?

রমযান ভাবতে লাগল। শেষে বললে, “তবে কি আমার ফকীরি করা চলবে না?”

পীর। কেন চলবে না। যে আলে বে পড়ে, সেও পড়ে ; যে কোরান শরীফ পড়ে, সেও পড়ে। সৃষ্টিকে ভালবাসতে আরম্ভ কর, এই হ’ল ফকরির আলেফ বে। তার পর অন্য সৰক নিও।’

রমযান তখনই বিদায় নিতে চাচ্ছিল। কিন্তু পীর সাহেব তাকে রাত্রির খানা না খাইয়ে ছেড়ে দিলেন না। সেরাত্রি বোধ হয় পীর সাহেবের খাওয়া হয় নি।

বিদায়ের সময় পীর সাহেব রমযানের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বাবা, শেখ সাদীর এই বয়েতটা মনে রেখ–

“তরীকৎ বজুয, খিদমতে খলক নীস্ত।

ব তসবীহ, ও সজ্জাদা ও দলক নীস্ত ॥

“সৃষ্টির সেবা ছাড়া সাধন পথ নেই।

সে পথ তসবীহ, জায় নমায ও ফকীরি কাঁথায় নেই।”

সে বৎসর মক্কাশরীফে শুক্রবারে হজ, হবার কথা। এই “আকবরী হজে” যোগ দিবার জন্য ইসলামী দুনিয়ার চারিদিক থেকে দলে দলে ভক্তেরা রওনা হয়েছে। ঢাকার পীর সাহেব অনেক দিন থেকে জীবনের শেষ কর্তব্য হজ, ব্রত পালনের ইচ্ছায় ছিলেন। কিন্তু কখনও টাকা কড়ির যোগাড় করে উঠতে পারেন নি। শুধু একবার তাঁর সমস্ত ছাগলের পাল বেচে কিছু টাকা সংগ্রহ ক’রেছিলেন। যাবার সমস্ত আয়োজন শেষ করেছিলেন।

কিন্তু সে বৎসর আকাল হওয়ায় তিনি সব টাকা খয়রাত করে দিয়েছিলেন। তার পর অনেক দিন থেকে তিনি হজের সংকল্প করছিলেন; কিন্তু তাঁর আর সম্বল হয়ে ওঠে না। এ বছর তিনি কয়েকজন মুরীদ নিয়ে হজে রওনা হয়েছেন। জীবন অস্তের দিকে চলেছে এবং সেবার আকবরী হজ। তিনি খুব ব্যগ্র হ’য়েই হজে বেরিয়েছেন।

গোয়ালন্দে স্টীমার থেকে নেমে ট্রেনে উঠতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ থেমে গেলেন। তার কানে এল কে যেন “আল্লাহ! আল্লাহ!” করে কাতরাচ্ছে। লক্ষ্য করে দেখলেন রেল লাইনের এক পাশে কে একজন কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। তিনি তার কাছে গিয়ে বলেন। তারপর বললেন, ‘বাবা! তুমি এমন করছ কেন ?” কয়েকবার জিজ্ঞাসার পর কথাটা যেন তার কানে গেল। সে ধীরে ধীরে বললে, “কে আপনি ? সরে যান। আমি কুষ্ঠরোগী।” তবুও পীর সাহেব সেখানে বসে রইলেন। তিসি বলেন “বাবা! আমি ফকীর লোক। আমার ভয় নেই। বল বাবা! আমি তোমার কি করতে পারি। রোগী বললে, “একটু পানি।” পীর সাহেব বদনার নল মুখের কাছে ধবৃতে রোগী মুখের কাপড় সরাল। মুখ খানা রোগে কি ভীষণ বিকৃত হয়ে গেছে! পীর সাহেব আস্তে আস্তে পানি তার মুখে ঢেলে দিলেন। রোগী একটু শান্ত হয়ে বললে, “এমন মেহেরবান, কে আপনি? আপনার গলার আওয়াজ যেন আমার চেনা।” পীর সাহেব বললেন, “আমি আব্দুল্লাহ।” রোগী বড় সংগ্রহে তার দিকে অতি কষ্টে মুখ ফিরিয়ে বললে, “আঃ! আপনি ঢাকার পীর সাহেব। আমি রমযান।” তারপর ধীরে ধীরে সে তার কথা বলে। সে ছোটনাগপুরের একটা ছোট গ্রামে এক কুষ্ঠ আশ্রম করে রোগীদের সেবা করেছে আর তাদের ধর্মের সান্ত্বনা দিয়েছে। তারপর তার কুষ্ঠ রোগ হওয়ায় সে পীর সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সেখান থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত এসেছে। রেলে ষ্টীমারে তাকে কেউ উঠতে দেয় নি ; তাই সে পায়ে হেঁটেই এসেছে। কিন্তু পদ্মা তার পথ বন্ধ করায় সে এক মাস ধরে গোয়ালন্দে পড়ে আছে। মধ্যে রোগটাও খুব বেড়ে গেছে। তার জীবন সার্থক যে পীর সাহেবের সঙ্গে তার শেষ দেখা হল।

এ দিকে ট্রেন ছাড়বার সময় হয়ে এসেছে। সঙ্গের শিষ্যেরা খুব ব্যস্ত হয়ে বললে, “হুজুর ; শীগ্গির চলুন। এ গাড়ী ফেল হ’লে আর জাহাজ পাওয়া যাবে না।” পীর সাহেব ম্লান হাসি হেসে বললেন, “বাবা! তোমরা যাও। আল্লাহ যদি আমার নসীবে হজ লিখে থাকেন, তা কখনও হবে।” এদিকে রেল ছাড়বার ঘণ্টা পড়ল । শিষ্যেরা দৌড়ে ট্রেনে গিয়ে উঠল। বেশী কথা বলবার সময় তখন ছিল না। কেবল পীর সাহেব আর তার একজন শিষ্য রোগীর সেবার জন্য সেখানেই ব’সে রইলেন।

রাত্রের শেষে পীর সাহেব একবার রমযানকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাবা! তোমার কেমন বোধ হচ্ছে ?” সে আস্তে আস্তে বললে,

“খবরম রসীদঃ ইমশব কে নিগার খাহী আমদ।

সরে মন ফিদাএ রাহে কে সওয়ার খাহী আমদ।”

(“আজ রাতে খবর এসেছে যে, বন্ধু, তুমি আসবে।

আমার মাথা তোমার পথে কুরবানী হ’ক যেন তুমি সওয়ার হয়ে আস।”)

পর দিন পদ্মার ধার থেকে কিছু দূরে একটা নির্জন জায়গায় রমযানকে কবর দিয়ে, পীর সাহেব স্নান করে একটা হোটেলে এসে বসলেন। সঙ্গের মুরীদটা মলিন মুখে বলে, “হুজুর ! তবে কি আমাদের আকবরী হজ এবার হ’ল না ?” পীর সাহেব চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন,

“দিল বদস্ত, আওর কে হজ্জে আকবরস্ত।

আয্ হযারাঁ কা’বা য়ক দিল্ বিহতরস্ত।।

কা’বা বুনগাহে খলীলে আযরস্ত।

দিল গুযরগাহে জলীলে আকবরস্ত।।”

“লোকের দিল্ খুশী কর। এই হচ্ছে আকবর।

হাজার কাবার চেয়ে এক দিল, ভাল। কাবা আযরের।

পুত্র হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লার (আল্লার বন্ধুর) তৈরী

ঘর। আর দিল, সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লার বেড়াবার জায়গা।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *