বেহেশতের পত্র

বেহেশতের পত্র

(১)

রহীম বখশ খাঁ পঞ্জাবী পাঠান। যুদ্ধই তাহার পৈতৃক পেশা। এবার তিন মাসের ছুটি পাইয়া সে বাড়ীতে আছে। কত শীঘ্র ছুটির দিনগুলি চলিয়া যাইতেছে। দিনগুলির কি ডানা আছে, না ছুটির সময়ে ঘড়ির কাটা ঘোড়ার মত ছুটিয়া যায়? তাই সে মধ্যে মধ্যে ভাবে।

ছুটির তখনও চারি সপ্তাহ বাকি। হঠাৎ সরকার হইতে জরুরি তার আসিল, তাহাকে সেই দিনই রওয়ানা হইতে হইবে। সে বুঝিল কোথায় লড়াই বাধিয়াছে, তাই এমন খাড়া তলব।

সে কতবার লড়াইতে গিয়াছে। দুএকবার জখমও হইয়াছে। এবারও লড়াইতে যাইবে—তাহাতে আর দুঃখ কি ? কিন্তু তার ছয় বছরের মেয়েটী আজ কিছুতেই তার কাছ ছাড়া হইতেছে না। পাঁচ ক্রোশ পথ হাঁটিয়া রেলওয়ে স্টশনে যাইতে হইবে, তিন ঘণ্টা মাত্র সময় আছে। তবুও মেয়েটা বাপকে ছাড়িতে চায় না। সে তাহার ছোট হাতের মুঠায় বাপের আঙ্গুল প্রাণপণে চাপিয়া ধরিয়া দাড়াইয়া আছে। কাল সে বাপকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “আব্বাজান, তোমার আর কত দিন ছুটি আছে ?” বাপ তাহার হাত পায়ের আঙ্গুল গণিয়া কের আবার এক হাতের আঙ্গুল গণিয়া তাপর হাতের মাঝখানের আঙ্গুল ধরিয়া বলিয়া ছিল, “এত দিন।” আজ আবার বাপ কেন যাইবে—রহীম মেয়েকে বুঝাইতে পারিল না। সে কতবার সম্মুখ যুদ্ধে সঙ্গীনের খোঁচায় শত্রুকে হটাইয়া দিয়াছে। কিন্তু আজ মেয়ের মুঠা হইতে সে তাহার আঙ্গুল টানিয়া লইতে পারিল না। সে আজ হার মানিয়াছে।

লড়াইয়ে সে কতবার শত্রুর লাইন ভেদ করিয়া চলিয়া আসিয়াছে। কখনও সে যুদ্ধে বুদ্ধিহারা হয় নাই। এখন কিন্তু সে কি করিবে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। তাহার মাথাটা আজ বড়ই গুলাইয়া যাইতে ছিল। এমন সময়ে তাহার স্ত্রী মেয়েকে জোর করিয়া কোলে তুলিয়া লইল। মেয়েটী রাগে কাঁদিতে লাগিল। রহীম তাহাকে বুঝাইল, শীঘ্রই সে লড়াই হইতে ঘরে ফিরিবে এবং রোজ রোজ তার নামে একখানি চিঠী দিবে।

আর দাঁড়াইবার সময় ছিল না। রহীম বাহির হইয়া পড়িল। মেয়ে চেঁচাইয়া বলিল, “তবে আব্বাজান, জলদি বাড়ী ফিরিবে ত?” রহীম শুধু বলিল, “হুঁ”। পিছন ফিরাইয়া তাকাইতে তাহার সাহস হইল না।

(২)

মেয়েটী বাড়ীর কাছের ডাকঘরে রোজই যায়, যদি তাহার বাপের পত্র আসিয়া থাকে। কোন দিন সে পত্র পায়, কোন দিন পায় না। যে দিন সে তাহার আব্বাজানের চিঠী পায়, সে দিন তার কি খুশী! সে তাহার বাপের চিঠী কিছুতেই কাছ ছাড়া করে না। শুইবার সময় বালিশের নীচে রাখিয়া শোয়। যে দিন ডাকঘরের মুনশীজী বলেন, “না, তোমার বাপের চিঠী নাই।” সে দিন বেচারী মুখখানি কাল করিয়া ঘরে ফিরিয়া আসে। সে খালি তার মাকে জিজ্ঞাসা করে, “আম্মাজান, বাপ রোজ চিঠী পাঠায় না কেন ?” সে কি জানিবে যুদ্ধক্ষেত্রে সিপাহীকে কি রকম কাজ করিতে হয়।

দুই মাস কাটিয়া গিয়াছে। এবার এক সপ্তাহ রহীমের আর কোন চিঠী পত্র নাই। মেয়েটা রোজ রোজ ডাকঘরে গিয়া হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসে। তাহার সদা প্রফুল্ল মুখখানি বাদলার আকাশের মত মলিন গম্ভার। এক সপ্তাহ পরে একখানি পত্র আসিল-রহীমের স্ত্রীর নামে। এত দিন পরে বাপের চিঠী ! এ যেন রোজার পরে ঈদের নূতন চাঁদ। মেয়েটা হাসিতে হাসিতে দৌড়িয়া মায়ের কাছে আসিল। রহীমের স্ত্রী ত্রস্ত হইয়া পত্রখানি হাতে লইল। শিরোনামায় অন্যের হাতের লেখা দেখিয়া একটা অজানা ভয়ে তাহার বুকখানা কাঁপিয়া উঠিল। স্বামী ছাড়া কেহ কখনও তাহাকে পত্র লেখে না। এ কাহার চিঠী ? ইহাতে কিসের খবর ? কম্পিত হস্তে লেফাফাখানা খুলিয়া সে যাহা পড়িল, তাহাতে যেন তাহার মাথায় বাজ পড়িল। সিপাহীর স্ত্রী হইলেও সে এত শীঘ্র ইহার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে মাটির উপর বসিয়া পড়িল। তাহার মাথা ঘুরিতে লাগিল। সমস্ত সংসার যেন তাহার চক্ষের সম্মুখ হইতে মুছিয়া গিয়াছে। মেয়েটা কিছুই বুঝিতে না পারিয়া হতবুদ্ধি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সে ভাবিয়া উঠিতে পারিল না, পত্রে কি লেখা আছে। একটু পরে রহীমের স্ত্রী মেয়েকে বুকে টানিয়া লইয়া তাহাকে গাঢ়ভাবে বুকে চাপিয়া ধরিল। এতক্ষণ মেয়েটী সাহস করিয়া মাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পারে নাই। এখন বলিল, “আম্মাজান, তুমি অমন কর কেন? আব্বাজান কবে বাড়ী আসিবে?” রহীমের স্ত্রীর কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল। সে কিছু বলিতে পারিল না। কেবল মেয়ের কপালে চুমা দিয়া একটী দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিল।

(৩)

মেয়েটী তবুও রোজ ডাকঘরে যায়। আর রোজই মলিন মুখে খালি হাতে ফিরিয়া আসে। একদিন সে তার নামে একখানি চিঠী পাইল। আজ সে কত খুশী। হাসিতে হাসিতে মাকে বলিল, “আম্মাজান, আবা আমাকে চিঠী লিখিয়াছে। আচ্ছা আম্মাজান, আব্বা এত দেরী করিয়া চিঠী লেখে কেন ? এবার আব্বা বাড়ী আসিলে আমি আর আব্বার কাছে যাইব না, রাগ করিয়া থাকিব।” মা পত্রখানি ধীরভাবে হাতে লইল। সে জানিত পত্রখানি কাহার লেখা। পত্রখানি মেয়েকে পড়িয়া শুনাইল

বেহেশত হইতে

জানের পেয়ারী,                                                                তারিখ—-

তোমরা আমার বহুত বহুত দোআ জানিবে। আমি দুনিয়া ছাড়িয়া এখানে আসিয়াছি। আমার লড়াই শেষ হইয়া গিয়াছে। এখানে আমার এক দোস্ত আছেন। তিনি আমাকে কত ভালবাসেন। তিনি আমাকে ছাড়িয়া দিতে চান না। আমি তোমাদের ওখানে গিয়া বা কি করিব ? সেখানে কত কষ্ট, কত দুঃখ! এখানে কত সুখ, কত আনন্দ! পেয়ারী, এই আমার শেষ চিঠী। যদি তোমরা নেকবখত হও, একদিন আমার কাছে আসিবে। এখানে আসিলে আর আমাদের ছাড়াছাড়ি হইবে না। আমরা সকলে গলায় গলায় আমাদের এই দোস্তের বাড়ীতে থাকিব। আমাদের কোনও ভাবনা চিন্তা দুঃখ কষ্ট থাকিবে না। আমি আরামে আছি। তোমাদের কোনও চিঠী লিখিবার দরকার নাই। আমি এখান হইতে তোমাদের সকল খবর পাইতেছি। ইতি

আশীর্বাদক

রহীম বখশ খাঁ মরহুম মগফূর।

মেয়ে সকল কথা বুঝিতে পারিল না। মা বুঝাইয়া দিল। মেয়ে যখন জানিল বাপ আর আসিবে না, তখন সে মায়ের চিবুকখানি ধরিয়া বলিল, “আম্মাজান, আব্বাজানকে আসিতে বল, আমি আর রাগ করিয়া থাকিব না।” মা অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া চোখে হাত দিয়া রহিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *