• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৪. কবিতা এবং মুক্তিযুদ্ধ

লাইব্রেরি » মুহম্মদ জাফর ইকবাল » আমি তপু (২০০৫) » ০৪. কবিতা এবং মুক্তিযুদ্ধ

০৪. কবিতা এবং মুক্তিযুদ্ধ

জ্যামিতির ক্লাস টেস্টে মামুন পেলো আশি, জয়ন্ত সত্ত্বর অন্যেরা তার থেকে অনেক কম। পরীক্ষাটি ছিল একেবারে পানির মতো সোজা আমি নিখুঁতভাবে প্রত্যেকটার উত্তর লিখেছি কিন্তু আমি পেয়েছি শূন্য। ক্লাস টেস্টের খাতা দেয়ার সময় স্যার বলেছেন আমাকে কেন শূন্য দিয়েছেন, আমি অন্যের খাতা দেখে লেখেছি বলে কোন নম্বর দেন নি। খাতা দেওয়ার সময় জ্যামিতি স্যার ন্যায় এবং সততার উপরে বড় একটা লেকচার দিলেন। অন্যের খাতা দেখে লিখলে কিছু যে শেখা যায় না উল্টো একজন অপরাধী হিসেবে বড় হতে হয়, চরিত্রের মাঝে হীনম্মন্যতা ঢুকে যায়–স্যার সেটাও খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা করে দিলেন।

সবই ঠিক আছে, কিন্তু একটিমাত্র সমস্যা–আমি কারো খাতা দেখে লিখি নি। জ্যামিতির উপপাদ্য আর সম্পাদ্যগুলো আমি নিজেই করেছি, স্যারকে আর সেটা বলার চেষ্টা করলাম না। তাহলে অন্যের খাতা দেখে লেখার সাথে সাথে মিথ্যা কথা বলার অপরাধটাও যোগ হবে! এমনিতেই নানারকম ঝামেলার মাঝে আছি তার মাঝে এই নতুন ঝামেলা শুরু করার কোন ইচ্ছে নেই। স্যার ক্লাসে উপপাদ্য এবং সম্পাদ্যগুলো বুঝিয়ে দিলেন, কয়েকটা আরো অনেক সহজভাবে করা যায়, স্যার সেটা জানেন না।

ক্লাসের শেষে প্রিয়াংকা আমার কাছে এলো, বলল, তপু।

আমি বললাম, কী?

তোমার ক্লাস টেস্টের খাতাটা আমাকে দেখাবে?

কেন?

কারণ আছে।

আমি বললাম, আমি শূন্য পেয়েছি। আমার খাতা দেখে কোন লাভ নাই। মামুন না হলে জয়ন্তের খাতাটা দেখো।

প্রিয়াংকা বলল, আমি তোমারটাই দেখতে চাই।

আমি আমার খাতাটা বের করে দিলাম। প্রিয়াংকা খানিকক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখে খাতাটা আমাকে ফেরত দিয়ে বলল, তোমার সবগুলো ঠিক হয়েছে।

আমি মাথা নাড়লাম বললাম, হ্যাঁ।

স্যার বলেছেন তুমি অন্যের থেকে দেখে লেখেছ তাই তোমাকে শূন্য দিয়েছেন।

আমি আবার মাথা নাড়লাম, বললাম, হ্যাঁ।

ক্লাস টেস্টের দিনে আমি তোমার পিছনে বসেছিলাম আমি দেখেছি তুমি কারো খাতা দেখে লিখ নি। তুমি নিজে নিজে লিখেছ।

আমি এইবার একটু হাসলাম, বললাম, হ্যাঁ।

তুমি কেন সেটা স্যারকে বললে না?

আমি যদি বলতাম স্যার সেইটা বিশ্বাস করতো না। কোন ভাল জিনিসের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই–তুমি সেটা জানো না?

প্রিয়াংকা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, তুমি এতো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছ কেন?

আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

আমি ক্লাস টেস্টের খাতাটা ব্যাগের ভিতরে ঢুকিয়ে বললাম, এর মাঝে বোঝার কিছু নাই।

প্রিয়াংকা বলল, তুমি খুব ভাল অঙ্ক জানো তাই না?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, উঁহু।

তোমার কী অঙ্ক ভাল লাগে?

আমি আমার সিটে হেলান দিয়ে বললাম, আমার কিছু ভাল লাগে না।

প্রিয়াংকা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের জায়গায় ফিরে গেলো।

 

থার্ড পিরিয়ডে বাংলা ক্লাসে রাজাকার স্যার আসবেন, আমি ভিতরে ভিতরে একটা কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছি, স্যার ক্লাসে এসে আজকে কী করেন দেখতে চাই। আজকেও জয়ন্ত দীলিপ আর সলীলকে পেটান কী না, নীলিমা আর মাধুরীকে খামোখা যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগাল করেন কী না দেখার জন্যে খুব কৌতূহল হচ্ছে।

কিন্তু আজ একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটলো, ক্লাসে রাজাকার স্যারের বদলে এলেন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম। আমরা সবাই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হাত দিয়ে আমাদের বসার জন্যে ইঙ্গিত করে বললেন বসো। বসো।

আমরা নিজেদের জায়গায় বসেছি। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম পুরো ক্লাসে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, আমি অনেক দিন থেকে ভাবছি নিয়মিত কোন একটা ক্লাস নিই, কিন্তু এমন ঝামেলার মাঝে থাকি ক্লাস নেবো কেমন করে অফিস থেকেই বের হতে পারি না! | প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কথা শেষ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন আর সাথে সাথে আমরা সবাই আবার বুঝতে পারলাম, প্রিন্সিপাল ম্যাডামের চেহারা খুব সুন্দর, তিনি শুধু সেটা কাউকে জানতে দিতে চান না। প্রিন্সিপাল ম্যাডামের হাসিটি পুরো ক্লাসের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল এবং আমরা সবাই কোন কারণ ছাড়াই হাসলাম।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ক্লাসের সামনে দাড়িয়ে আমাদের একটু খোজখবর নিলেন, কার নাম কী, বাসা কোথায়–এসব ব্যাপার নিয়েও দুই-চারজনের সাথে কথা বললেন। পড়াশােনা কেমন হচ্ছে জানতে চাইলেন, তারপর হালকা পায়ে একটু হেঁটে ক্লাসরুমের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে বললেন, এটা তোমাদের বাংলা ক্লাস, তাই বাংলা নিয়ে একটু কথাবার্তা বলা দরকার, কী বলো?

আমরা সবাই মাথা নাড়লাম। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা বল দেখি বাংলা ভাষাটাকে একটা নতুন মাত্রা দেয়ার জন্যে যদি শুধুমাত্র একজন মানুষের নাম বলতে হয় সেই মানুষটা কে হবে?

ক্লাসের অনেকে উত্তর বলার জন্যে হাত তুললো এবং যাদের উৎসাহ বেশি তারা চিৎকার করে বলল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, বললেন, ভেরি গুড়। তারপর আর দুই পা এগিয়ে এসে বললেন, এই বুড়ো মানুষটি বাংলা ভাষাকে যতটুকু সমৃদ্ধ করেছেন পৃথিবীর আর কোন মানুষ একা তাদের ভাষাকে ততটুকু সমৃদ্ধ করতে পারে নি।

সত্যি কথা বলতে কী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন না অনেকে মিলে করেছেন সেটা নিয়ে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের খুব একটা মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না। তবে ম্যাডাম এতো সুন্দর করে কথা বলেন যে সবাই ভাব করতে লাগল ব্যাপারটা খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আরেকটু এগিয়ে এসে বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন সেটা কীভাবে বোঝা যায় বলো দেখি?

এবারে সবাই মুখ গম্ভীর করে চিন্তা করতে লাগল কী বলা যায়। কেউ কিছু বলার আগেই ম্যাডাম নিজে থেকে বললেন, সেটা বোঝার জন্যে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য নিয়েও গবেষণা করতে হয় –তার যে কোন একটা কবিতা পড়লেই সেটা বুঝে ফেলা যায়।

কথা শেষ করে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এমনভাবে আমাদের দিকে তাকালেন যে আমরা সবাই তার কথা বিশ্বাস করে ফেললাম। ম্যাডাম এবার একেবারে সামনের বেঞ্চে হাত রেখে আস্তে আস্তে বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই কখনো না কখনো রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েছ। আমি বাজি ধরে বলতে পারি তোমাদের অনেকের রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ আছে। কে আমাদের একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতে পারবে?

আমি যখন ছোট ছিলাম তখন রবীন্দ্রনাথের বীরপুরুষ কবিতাটি আবৃত্তি করতাম, অনেক দিন সেটা প্র্যাকটিস করি নি কিন্তু আমার নিশ্চয়ই এখনো মনে আছে, কিন্তু আমি আবৃত্তি করার কোন আগ্রহ দেখলাম না। আমি যদি এখন এই কবিতাটি আবৃত্তি করার চেষ্টা করি সেটা এতো বেখাপ্পা শোনাবে যে বলার মতো নয়। আমি এখন একটা দুষ্টু ও পাজী ছেলে–দুষ্টু এবং পাজী ছেলেরা কখনো কবিতা আবৃত্তি করে না।

জয়ন্ত প্রথমে সোনার তরী কবিতাটি শোনালো–ঠিক আবৃত্তি নয় মুখস্ত বলে গেলো। তারপর আমাদের ক্লাসের শিল্পী মৌটুসী আজি হতে শতবর্ষ পরে। কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালো। মৌটুসীর গলা খুব ভাল, উচ্চারণও সুন্দর, তাই খুব সুন্দর শোনালো কবিতাটি। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম খুব খুশি হলেন শুনে। তখন প্রিয়াংকা হাত তুললো কিছু একটা বলার জন্যে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন তুমি কোন কবিতাটা আবৃত্তি করতে চাও?

প্রিয়াংকা বলল, আমি আবৃত্তি করতে চাই না ম্যাডাম।

তাহলে?

আপনি আমাদের একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনান।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, আমি?

হ্যাঁ ম্যাডাম। প্রিয়াংকা খুব সহজ গলায় বলল, আপনার সবচেয়ে প্রিয় কবিতাটা একটু আবৃত্তি করে শোনাবেন প্লিজ!

প্রিয়াংকা মেয়েটা একটু অন্যরকম। এমনভাবে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সাথে কথা বলছে যেন তার সাথে তার কতো দিনের পরিচয়, যেন ম্যাডাম আমাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল নন, যেন আমাদের ক্লাসেরই আরেকজন। প্রিয়াংকা না হয়ে অন্য কোন একজন এই কথা বললে সেটা কিন্তু মোটেই এতো স্বাভাবিক শোনাতো না।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবলেন, ভেবে বললেন, আমার প্রিয় কবিতা তো একটা নয়, অনেকগুলো।

প্রিয়াংকা বলল, তার মাঝে যে কোন একটা আবৃত্তি করেন, প্লিজ।

আমার ধারণা ছিল ম্যাডাম হয়তো রাজি হবেন না, কিন্তু একটু অবাক হয়ে দেখলাম বেশ সহজেই রাজি হয়ে গেলেন, কেশে গলাটা একটু পরিষ্কার করে সরাসরি আবৃত্তি শুরু করে দিলেন,

আমরা দুজন একই গাঁয়ে থাকি,
সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ।
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখী
তাহার গানে আমার নাচে বুক।

ম্যাডাম এতো সুন্দর করে কবিতাটা শোনাতে লাগলেন যে খঞ্জনা নামের সেই গ্রামের পুরো দৃশ্যটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম এই গ্রামটির ভেতর দিয়ে অঞ্জনা নামের নদীটি বয়ে যাচ্ছে আর সেই নদীর তীরে রঞ্জনা নামে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যি কথা বলতে কী গান কবিতা এইসব জিনিসকে সব সময় আমার কাছে ন্যাকামি টাইপের জিনিস বলে মনে হতো–যারা এগুলো করে তাদেরকে মনে হতো হাস্যকর একধরনের মানুষ। কিন্তু প্রিন্সিপাল ম্যাডামের মুখে কবিতাটা শুনে আমার সমস্ত ধারণাটাই পাল্টে গেলো, আমার মনে হতে লাগলো কবিতার মতো সুন্দর জিনিস পৃথবীতে আর কিছু নেই। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম যে খুব সুন্দর করে আবৃত্তি করেন তা নয় কিন্তু কবিতার মাঝে এমনভাবে তার সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন যে কবিতাটা একেবারে অন্যরকম কিছু একটা হয়ে গেলো। কবিতাটা শেষ হবার পরও আমরা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসে থাকলাম, আমাদের মনে হতে লাগল আমরা যদি কথা বলি তাহলে কিছু একটা নষ্ট হয়ে যাবে–সেই কিছু একটা যে কী আমরা কেউই সেটা ঠিক ধরতে পারছিলাম না।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, অনেক দিন পর আজকে একটা কবিতা বললাম।

শিউলি বলল, আপনি এতো সুন্দর করে কবিতা বলেন ম্যাডাম!

শিউলি আমাদের ক্লাশের সবচেয়ে চুপচাপ মেয়ে, সে যে এভাবে নিজে থেকে কিছু বলবে আমরা বুঝতেই পারি নি, কিন্তু কথাটাকে একটুও অস্বাভাবিক মনে হলো না। আমরা সবাই শিউলির কথার সাথে সাথে মাথা নাড়লাম। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, আসলে আমি সুন্দর করে কবিতা বলি নি, কবিতাটাই খুব সুন্দর।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হালকা পায়ে হেঁটে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে একবার বাইরে তাকিয়ে আবার ক্লাসের মাঝামাঝি এসে বললেন, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা পৃথিবীর সকল কবি সাহিত্যিক গীতিকার থেকে একটি বিষয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে আছেন, সেটা কী কে বলতে পারবে?

মামুন হাত তুলে বলল, সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন?

উঁহু। ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, নোবেল প্রাইজ তো অনেকেই পেয়েছেন–সেটি নয়। অন্য কিছু আছে।

ক্লাসের সবাই মাথা চুলকাতে লাগলো তখন ম্যাডাম নিজেই বললেন, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একমাত্র মানুষ যার লেখা গান দুটি ভিন্ন ভিন্ন দেশের জাতীয় সঙ্গীত। একটি আমাদের বাংলাদেশের, আরেকটা ভারতবর্ষের।

আমি এটা জানতাম না, শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলাম।

ম্যাডাম একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি এটা এতো মধুর একটা গান, কিন্তু যতবার এই গানটা আমি শুনি ততবার চোখে পানি এসে যায়।

মৌটুসি জিজ্ঞেস করল, কেন ম্যাডাম?

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, জানি না কেন, মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছোট ছিলাম, প্রতিদিন এই গানটা শুনতাম আর ভাবতাম কবে আমাদের দেশটা স্বাধীন হবে, সেইজন্যে এই গানটার জন্যে আমাদের মতো মানুষের অন্য রকম একটা মায়া।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দেশে কী হয়েছিল তোমরা জানো?

অনেকে বলল, জানি। কয়েকজন বলল, না জানি না। বাকিরা চুপ করে রইল। আমাদের পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে কথাবার্তা লেখা আছে তার অনেকগুলো নাকী ভুয়া। প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে সেটা জিজ্ঞেস করলে ইতো কিন্তু আমি ক্লাসে কখনো কোন স্যার-ম্যাডামকে কিছু জিজ্ঞেস করি না। খারাপ ছেলে হিসেবে একবার পরিচয় হয়ে যাবার পর আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দেশে অনেক কিছু হয়েছিল, কিন্তু কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে কোন বিষয়টি সবচেয়ে বেশি হয়েছিল আমি কী বলব জানো?

ক্লাসের প্রায় সবাই জিজ্ঞেস করল, কী ম্যাডাম?

দুঃখ। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তখন এই দেশে এমন একটি পরিবার ছিল না যাদের কোন না কোন আপনজন মারা যায় নি। এই দেশের প্রত্যেকটা পরিবার, প্রত্যেকটা মানুষকে সেই মুক্তিযুদ্ধ স্পর্শ করেছিল।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ঘুরে ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি একজন মাকে জানি যার ছেলেকে পাকিস্তান মিলিটারিরা মেরে ফেলেছিল। সেই মা তারপর থেকে যতদিন বেঁচে ছিল কোন দিন ভাত খায় নি, মৃত্যুর আগে ছেলেটা ভাত খেতে চেয়েছিল, তার জন্যে রান্না করে তার মা ভাত পাঠিয়েছিলেন, সেই ছেলেটা সেই ভাত খেতে পারে নি, সেজন্যে।

ঠিক কী কারণ জানি না আমার তখন হঠাৎ আমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। এখন যদি মুক্তিযুদ্ধের সময় হতো আর আমি যদি মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তান মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে যেতাম আর পাকিস্তান মিলিটারি যদি আমাকে টর্চার করতো সেই খবরটা শুনে আম্মু কী করতেন? খুশি হতেন?

বিষয়টা চিন্তা করতে করতে আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। হঠাৎ শুনলাম জহুরুল দাড়িয়ে বলছে, আমার বড় চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখন রিটায়ার করেছেন। তারপর ইশতিয়াক দাঁড়াল, সে বলল, আমাদের পাশের বাসায় একজন মুক্তিযোদ্ধা থাকেন। নাঈমা বলল, আমার আগের স্কুলের অঙ্ক স্যার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নিশ্চয়ই সবার কাছে জানতে চাইছেন ক্লাসের ছেলে মেয়েদের পরিচিত কেউ মুক্তিযোদ্ধা আছে কীনা। অনেকেই বলল, আমিও ভাবলাম আমিও বলি যে আমার আব্বু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, কিন্তু আমি কিছু বললাম না। কেউ প্রশ্ন না করলে নিজে থেকে কিছু বলার বিষয়টি আমি ভুলেই গিয়েছি।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে যারা বেঁচে আছে এখন যদি তাদের দেখো দেখবে তাদের চুল পেকে গেছে। তাদের বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মারা গেছে তাদের কারো বয়স হয়নি, তাদের বয়সটা সতেরো আঠারো উনিশ বছরে আটকে গেছে। তারা আর কোন দিন বুড়ো হবে না, তারা অনন্তকাল কিশোর থাকবে। তরুণ থাকবে। কী আশ্চর্যের একটা ব্যাপার, তাই না?

আমরা কেউই ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করি নাই। সত্যিই তো একজন মানুষ যখন কম বয়সে মারা যায় তখন তার তো আর বয়স বাড়ে না। সে তো সারাজীবনই কম বয়সী থেকে যায়! মানুষটি বেঁচে থাকে না কিন্তু তার স্মৃতিটা বেঁচে থাকে। কী সাধারণ একটা ব্যাপারকে ইচ্ছে করলেই কী অসাধারণ ভাবে দেখা যায়। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কেমন জানি অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, মনে হতে লাগলো আমাদেরকে দেখেও দেখছেন না। মনে হতে লাগলো অনেক দূরে কোথাও তাকিয়ে আছেন। খানিকক্ষণ সেভাবে তাকিয়ে থেকে আমাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, তোমাদেরকে একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প বলি। সত্যি গল্প।

একাত্তুর সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন ছেলেটা পড়ে ক্লাস টেনে। স্কুলের ছাত্র, তোমাদের থেকে দুই এক বছর বেশি বয়স হবে। এত ছোট ছেলের তো যুদ্ধে যাবার কথা না কিন্তু তবু সে বাসা থেকে পালিয়ে চলে গেলো যুদ্ধে।

তার একটি ছোট বোন ছিলো, পিঠাপিঠি ভাই-বোন তাই দুজনে শুধু ঝগড়া করতো। সত্যিকারের ঝগড়া না, পিঠাপিঠি ভাইবোনের ঝগড়া। কে মশারি টানাবে সেটা নিয়ে ঝগড়া। বইয়ের মলাট কে ছিঁড়ে ফেলল সেটা নিয়ে ঝগড়া, গল্প বই কে আগে পড়বে সেটা নিয়ে ঝগড়া।

ভাইটি যে রাতে বাসা থেকে পালিয়ে যুদ্ধে চলে গেলো সেদিনও বোন তার সাথে ঝগড়া করেছিল, একেবারে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া। তার প্রিয় কলমের নিব ভোঁতা করে ফেলা নিয়ে ঝগড়া। বোনটা তো আর জানতো না যে তার ভাই সেই রাতে যুদ্ধে চলে যাবে, তাহলে নিশ্চয়ই সে রাতে আর ঝগড়া করতো না!

যাই হোক, ছোট ছেলে অনেক কষ্ট করে বর্ডার পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়েছে। এত ছোট ছেলে, কেউ তাকে যুদ্ধে নিতে চায় না, অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দলে ঢুকে পড়ল। তাদের সাথে ট্রেনিং নিয়ে সে দেশের ভেতরে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে।

আস্তে আস্তে দিন পার হতে থাকে। প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল পাকিস্তান মিলিটারিদের বুঝি কেউ হারাতে পারবে না, কিন্তু যতই দিন যেতে শুরু করেছে ততই বোঝা যেতে শুরু করেছে এই দেশে তাদের দিন একেবারে হাতেগোনা। আগে যেখানে পাকিস্তান মিলিটারির ভয়ে কেউ ঘর থেকে বের হতো না, সেসব জায়গাতেও রাত্রি বেলা গেরিলা বাহিনী এসে আক্রমণ করে বসে।

এ রকম সময় সেই ছেলেটা তার দলের সাথে কাছাকাছি একটা এলাকায় এসেছে। কয়েকটা গেরিলা অপারেশান করে দলটি যখন ফিরে যাবে তখন ছেলেটা তার দলের কমান্ডারের কাছে বলল সে এক রাতের জন্যে তার বাসায় গিয়ে মা আর বোনের সাথে দেখা করতে চায়। কমান্ডার প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না, শেষে ছোট ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মায়া হলো, তিনি অনুমতি দিলেন।

গভীর রাতে ছেলেটা তার বাসায় এসেছে। দরজায় টুকটুক শব্দ করছে, ঘুম ভেঙে মা অবাক হয়ে ভাবলেন, এতো রাতে অসময়ে কে এসেছে? দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বললেন, কে?

ছেলেটা ফিসফিস করে বলল, আমি, মা। মা দরজা খুলে ছেলেটাকে ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে সে কী কান্না। শুধু শরীরে হাত বুলান আর ফিসফিস করে বলেন, তোর শরীরে কোথাও গুলি লাগে নি? কোথাও গুলি লাগে নি?

ছেলেটা হাসে আর বলে, মা, গুলি লাগলে আমি তোমার কাছে এলাম কেমন করে?

এতো রাতে কথাবার্তা শুনে বোনটিও জেগে উঠেছে। ভাইকে দেখে কী অবাক। তার এইটুকুন ভাই, এখন তার আঁকড়া ঝাকড়া উষ্কখুষ্ক চুল, রোদে পোড়া চেহারা, পিঠে ছোট স্টেনগান, একেবারে সত্যিকারের যোদ্ধা! ভাই বোনকে জিজ্ঞেস করল, তুই কী এখনো আমার ওপর রাগ করে আছিস? দেশ স্বাধীন হোক তখন আমি তোকে এক ডজন কলম কিনে দেব!

তার কথা শুনে বোনটি ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। ভাইটি তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল, ধুর বোকা মেয়ে কাদিস না। দেখিস, দেখতে দেখতে দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে–পাকিস্তানিরা পালিয়ে যাবার জায়গা পাবে না। বোনটা তখন লাজুক মুখে বলল, ভাইয়া আমি আমার সোনার বাংলা গানটা তুলতে পারি–হারমোনিয়ামে তোমাকে বাজিয়ে শোনাব? ভাইটি বলল, এতো রাতে সেটা বাজালে আশেপাশে সন্দেহ করতে পারে–যখন দেশ স্বাধীন হবে তখন তুই বাজিয়ে শোনাবি। ঠিক আছে?

এদিকে মা দৌড়াদৌড়ি করে রান্না বসিয়েছেন। ছেলের জন্যে গরম ভাত আর শিং মাছের ঝোল। ছেলের খুব প্রিয় খাবার শিং মাছ। রান্না যখন শেষের দিকে তখন হঠাৎ বাসার চারপাশে ধূপধাপ শব্দ, মানুষজন দৌড়াদৌড়ি করছে। ছেলেটি হাতের স্টেনগান হাতে নিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, মা, আমাকে যেতে হবে।

মা ভয় পাওয়া গলায় বললেন, কেন বাবা কী হয়েছে?

ছেলে বলল, রাজাকাররা বাসা ঘিরে ফেলেছে। আমাকে যদি বাসার ভেতরে পায় তোমাদের খুব বড় বিপদ হবে মা। মা ফিসফিস করে খোদাকে ডেকে বললেন, ইয়া মাবুদ ইয়া পরওয়ার দিগার, আমার ছেলেকে তোমার। হাতে দিলাম, তুমি তাকে রক্ষা করো–

ছেলে মাকে কদমবুসি করে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে স্টেনগান হাতে রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।

প্রথমে কোন শব্দ নেই, তারপর হঠাৎ কয়েকজন মানুষের চিঙ্কার শোনা গেলো তারপর গুলির শব্দ। রাইফেল আর স্টেনগানের গুলি তারপর কোন শব্দ নেই। মা আর বোন জানালার পর্দা তুলে বাইরে তাকাল, দেখলো রাস্তার মাঝখানে কে যেন পড়ে আছে।

কিছু বোঝার আগে ছোট বোনটি দরজা খুলে অন্ধকারে ছুটে গেলো, গিয়ে দেখলো রাস্তার মাঝখানে উপুড় হয়ে পড়ে আছে তার ভাই। বোনটি খুব ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে ভাইটির মাথাটি বুকে তুলে নিয়ে ফিসফিস করে ডাকল, ভাই।

ভাইটি তখন চোখ খুলে তাকালো। রাত্রের আবছা অন্ধকারে দুই ভাইবোন তখন একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাইটি তখন ফিসফিস করে কিছু একটা বলল, বোনটি শুনতে পেলো না। তাই সে মাথাটা আরো নিচু করে নিলো, শুনলো ভাই ফিসফিস করে বলছে, তুই আমাকে সোনার বাংলা গানটা শুনাবি?

বোন তখন তার চোখ মুছে তার ভাইয়ের মাথাটা কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে আমার সোনার বাংলা গানটি গাইতে লাগলো। আস্তে আস্তে চারিদিক থেকে রাজাকাররা তাকে ঘিরে ফেলছিল কিন্তু সে তবু গানটি বন্ধ করল না। বোনটি গাইতেই লাগলো–গাইতেই লাগলো!

প্রিন্সিপাল ম্যাডামের গলা ধরে এলো। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মেয়েটির যখন গানটি শেষ হয়েছে তখন তার ভাইটি আর বেঁচে নেই। রাজাকাররা তাদের দুজনকে ঘিরে রেখেছিল কিন্তু কাছে আসতে সাহস পাচ্ছিল না। বোনটি তার ভাইয়ের মাথাটা কোলে নিয়ে বসেই রইল। বসেই রইল।

আমাদের কেউ বলে দেয় নি কিন্তু আমরা সবাই জানি সেই বোনটি হচ্ছে আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম। আমরা তার দিকে তাকিয়ে সেই ছোট মেয়েটিকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম।

Category: আমি তপু (২০০৫)
পূর্ববর্তী:
« ০৩. প্রিন্সিপাল ম্যাডাম
পরবর্তী:
০৫. চোর »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑