শরীর, সমাজ ও রাষ্ট্র : ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জনসংস্কৃতি – দীপেশ চক্রবর্তী

শরীর, সমাজ ও রাষ্ট্র : ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জনসংস্কৃতি – দীপেশ চক্রবর্তী

গৌরচন্দ্রিকা

সাম্প্রতিককালে ভারত-বিশেষজ্ঞ কয়েকজন মহামারি, মড়ক, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির সামাজিক ইতিহাস রচনায় মন দিয়েছেন। বিষয়টির গুরুত্ব এঁদের রচনায় ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য এঁদের গবেষণালদ্ধ তথ্যসমূহের পুনর্বিবেচনা করা। আমার বৃহত্তর উদ্দেশ্য ভারতবর্ষে তথা সাধারণভাবে আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র ও ক্ষমতার কয়েকটি দিক তুলে ধরা। এই চেষ্টার সপক্ষে দু-একটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করি।

আধুনিক রাষ্ট্র যেভাবে অন্যান্য সামাজিক বন্ধনকে আত্মসাৎ, দমন বা শিথিল করে বা প্রয়োজনবোধে হটিয়ে দিয়ে—নাগরিকের ওপর নিজের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেও অগ্রাধিকার দেয়—ভারতীয় ইতিহাস রচনায় সে আলোচনা শুরু হয়নি বললেই চলে। ‘শান্তি বজায় রাখা’ বা ‘আইন-শৃঙ্খলা’ রক্ষা করা, ‘আর্থিক উন্নতি’ ও ‘জনস্বাস্থ্য’ রক্ষা করা রাষ্ট্রব্যবস্থার মুখ্য কর্তব্য বলে ধরা হয়। এগুলো যেমন রাষ্ট্রের কর্তব্য, তেমনি তার মতাদর্শগত হাতিয়ারও বটে। এই রাষ্ট্রিক মতাদর্শের একটি ভান থাকে—যা সংবাদপত্র থেকে ইস্কুলের পাঠ্যপুস্তক পর্যন্ত ছড়ানো—যেন রাষ্ট্রের স্বনির্বাচিত কর্তব্যগুলি ইতিহাস-বহির্ভূত কোনও ‘প্রাকৃতিক’ বিধানের অংশ, যেন রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যের মূল মতাদর্শগত সূত্রগুলি (যেমন, প্রগতি, উন্নতি, স্বাস্থ্য) মানুষের স্বাভাবিক ও আদিমতম আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। যদি কোনও প্রতিষ্ঠান ও মানুষ মৌলিকভাবে ‘প্রগতি’, ‘উন্নতি’ ইত্যাদির মূলমন্ত্রের বিরোধিতা করে, তাঁদেরই বর্ণনা করা হবে ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ বা ‘মূর্খতার অন্ধকারে’ নিমজ্জিত বলে। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে সম্প্রতি এমন কথাও পড়েছি যে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মৌলিক সমালোচনা হয় এমন ইতিহাস রচনা করা নাকি দেশদ্রোহিতারই নামান্তর।

এ-প্রবন্ধের কেন্দ্রে আছে শরীর, সমাজ ও ব্যাধি। মহামারি বিষয়ক কতগুলো ধারণা ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। শরীরের সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রের সম্পর্ক কী? একটু ভাবলেই বোঝা যাবে সম্পর্কটি জটিল ও গভীর। পরিবার-পরিকল্পনা থেকে শুরু করে মহামারি নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত সর্বত্রই দেখা যায় আমাদের এই তথাকথিত নিতান্ত ‘ব্যক্তিগত’ বস্তুটির সঙ্গে সরকারের সম্বন্ধের নজির। বুর্জোয়া সভ্যতা মানুষের শরীরকে যেভাবে ব্যবহার করে ও যে তাৎপর্য দেয়, তা প্রাক-ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শরীরের যে অবস্থান থাকে তার থেকে আলাদা। ‘কৃষ, শরীর’, ‘আদিবাসী-শরীর’কে ভেঙে-চুরে, দুমড়ে-মুচড়ে, নতুন অভ্যাসের ফাঁদে ফেলে, নতুন রুটিনের ছাঁচে ঢেলে তবে তো তৈরি হয় শ্রমিকের শরীর, বিপণন সমাজের অসংখ্য ভোগ্যবস্তুর ক্রেতার শরীর, ফ্যাশন-ম্যাগাজিনের স্বাস্থ্য-পত্রিকার শরীর।

এই পরিবর্তন এক দিনে হয় না। পুরোপুরিও ঘটে না কোনও সময়। পরিবর্তনের পথটিও সর্বত্র মসৃণ নয়। স্থান-কালভেদে জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের সংঘর্য দেখা যায়। যেমন জরুরি অবস্থা চলাকালীন সাধারণ মানুষের ‘নাসবন্দি’-বিরোধিতা। এই অসম ও বন্ধুর পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার ইতিহাসে রাষ্ট্রের হাতে ‘অস্ত্র’ থাকে নানা ধরনের—আইনব্যবস্থা, সেনাবাহিনী, আর্থনীতিক ব্যবস্থা। কিন্তু একটি বিরাট ‘অস্ত্র’ আধুনিক শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসাবিজ্ঞান-ভিত্তিক ‘জনস্বাস্থ্য’ নীতি।

আমাদের দেশে উনিশ শতকের শেষ দিকে বোম্বাই ও অন্যান্য শহরে সরকারের প্লেগ-নীতির বিরুদ্ধে দাঙ্গা হয়, এ খবর অনেকেরই জানা আছে। এ ছাড়া বসন্ত, কলেরা ইত্যাদি মহামারি নিয়ন্ত্রণ-বিষয়ে অনেক সময়ই সরকার, জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব ও সাধারণ মানুষ যে একমত হননি এ-ও সুবিদিত। হাসপাতাল সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের ভীতি, ‘সুঁই’ নিতে অনিচ্ছা, এ সব হয়তো আমাদের মধ্যবিত্ত অনেকেরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অংশ। এ বিষয়ে কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্য আমরা প্রবন্ধের পরবর্তী অংশগুলিতে আলোচনা করব। তা থেকেই বেরিয়ে আসবে শাসনের সঙ্গে শরীরের, রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের ইতিহাস। আলোচনার বৃহত্তর পটভূমিতে আমরা আবার ফিরে আসব বর্তমান নিবন্ধের শেষে।

জনস্বাস্থ্য ও ভারতশাসন

জনস্বাস্থ্য, সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ইত্যাদি ‘আধুনিক’ ধারণা এদেশে আমদানি করে ইংরেজ। জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নটির সঙ্গে ঔপনিবেশিক ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দেশশাসনের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সাম্রাজ্যবাদের গর্ভে যেমন নৃতত্ত্ববিদ্যার জন্ম ঘটে, চিকিৎসাশাস্ত্রেরও অনেক শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত হয়েছে উপনিবেশের কাণ্ডটিকে বেষ্টন করে।

এর একটা ভাল উদাহরণ ‘ট্রপিক্যাল মেডিসিন’ বিষয়টি। ১৮৯০-এর দশকে এটি একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। লন্ডন স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন স্থাপিত হয় ১৮৯৯ সালে। সেই বছরই প্রথম প্রকাশিত হয় জার্নাল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন। একটি সাম্প্রতিক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে দেখতে পাই যে, যে-আলোচনা-বিতর্ক ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এই বিষয়টির জন্ম, তার মূল ছিল একটি নিতান্তই সাম্রাজ্যবাদী ও রাজনীতিক প্রশ্নে: শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা কি গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলিতে উপনিবেশ গড়তে পারবেন? অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদরা অনেক রোগের ব্যাখা দিতেন ‘মায়াস্‌মা’ বা ‘পূতিবাষ্প’র তত্ত্বের মাধ্যমে। ওয়রবয়স দেখাচ্ছেন যে, উনিশ শতকের প্রথমার্ধেও এই ধারণা খুব চালু ছিল—জে, লিন্ড রচিত ১৭৬৮ সালের বই এসে অন ডিসিসেস ইন্সিডেন্ট অফ ইউরোপিয়ানস ইন হট ক্লাইমেটস-এর ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে গত শতাব্দীর গোড়ায়, ১৮০৮ সালে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেডিকাল সার্ভিস চালু হয় ১৭৬৪ সালে। ১৮১৯ সালেও তাদের ভারতগামী কর্মচারীদের ‘ডিসিসেস অফ হট ক্লাইমেটস’ বিষয় অধ্যয়ন করতে হত। পৃতিবাষ্পের তত্ত্বে বিশ্বাসীরা বলতেন, গরম দেশগুলি স্বভাবতই শ্বেতাঙ্গ মানুষদের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর, তাই সেখানে দীর্ঘস্থায়ী রাজত্ব বা উপনিবেশ চালানো মুশকিল। এই তত্ত্বের বিরোধী যে গবেষণা চলে চিকিৎসাবিদ্যায় তারই ফল ট্রপিক্যাল মেডিসিন। ১৮৬০-এর পর থেকে পাস্তুর প্রমুখের গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত হয় জীবাণু তত্ত্ব। বিভিন্ন রোগের মূল বিভিন্ন জীবাণুতে, এবং এই জীবাণু সনাক্ত করা ও তদনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়াটাই চিকিৎসাশাস্ত্রের মূল দায়িত্ব—এটাই ছিল এই তত্ত্বের মূলকথা। এর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক যে কত ঘনিষ্ঠ তা বোঝাতে গিয়ে এক উদ্ধৃতি দিয়েছেন ওয়রবয়স। উদ্ধৃতিটির উৎস ১৮৯৮ সালের ব্রিটিশ মেডিকাল জার্নাল, এবং উক্তিটি করেছিলেন প্যাট্রিক ম্যানসন যাঁকে ট্রপিক্যাল মেডিসিনের জনক বলে অনেক সময় ভাবা হয়। ম্যানসন বলেছিলেন:

আমি এখন এ বিষয়ে স্থিরনিশ্চিত যে, শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলিতে উপনিবেশ স্থাপনা করা সম্ভব। শুধু তাপ বা বাষ্পই যে গরম দেশে সমস্ত অসুখের উৎস, তা নয়। এইসব অসুখের শতকরা নিরানব্বই ভাগের কারণ হল বিভিন্ন ধরনের জীবাণু।…তাদের বিনাশ করা হল জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানের প্রয়োগের প্রশ্ন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিতর্কে যার অস্তিত্ব প্রতিফলিত, সেই সাম্রাজ্যবাদ তো আর সঠিক স্বাস্থ্যতত্ত্বের আশায় বসে থাকেনি। ট্রপিক্যাল মেডিসিন যতদিনে একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে তার আগেই ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও নতুন রাষ্ট্র কায়েম হয়ে বসেছে। পাঠককে মনে করিয়ে দিতে হবে না যে এই নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হিংসার ভেতর দিয়ে। পরে ‘শান্তি স্থাপনা’র নাম করে যতই বাহাদুরি নিতে চান না কেন ইংরেজ, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে একশো বছর ধরে ছোট-বড় লড়াই চালিয়েছে কোম্পানি। এই নতুন রাষ্ট্রের ক্ষমতার অন্যতম উপাদানই ছিল এর শৃঙ্খলাবদ্ধ, নিয়মাশ্রিত সেনাবাহিনী। একচেটিয়া সামরিক শক্তি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের একটি প্রাথমিক শর্ত।

সাম্প্রতিক গবেষণায় এটি পরিষ্কার যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসের গোড়ার দিকে (এবং পরেও) ‘জনস্বাস্থ্য’-বিষয়ক সমস্ত ভাবনাচিন্তাই উৎপন্ন হচ্ছে সেনাবাহিনীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে। কোম্পানির সৈন্যদের যুদ্ধপ্রস্তুতি ও ক্ষমতার একটি প্রধান অন্তরায় ছিল সংক্রামক ব্যাধি বা মহামারি। বিশেষত যে সেনাবাহিনীকে ভারতের নানা অঞ্চলে ঝটিকার মতো ঘুরে বেড়াতে হবে, তার পক্ষে সৈন্যদের অসুস্থতা ছিল এক মারাত্মক প্রতিবন্ধক। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে বুন্দেলখণ্ডে পিন্ডারি ও মারাঠা শক্তির বিরুদ্ধে জমায়েত করা সৈন্যরা অনেকেই কলেরার কবলে পতিত হন। এক সপ্তাহে ৭৬৪ জন সৈন্যের পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে। সমসাময়িক রিপোর্টে বলা হয়: ‘প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে (অসুস্থ) সৈন্য ভূপতিত হচ্ছিল ও মৃত ও মুমূর্ষু মানুষে রাস্তা ঢেকে যাচ্ছিল’। কলেরার আক্রমণ এ-যাত্রা চলে ১৮২১ সাল পর্যন্ত। একটি হিসেবে দেখতে পাচ্ছি ১৮১৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত কোম্পানির অধীনে যত ইউরোপীয় সৈন্য ও অফিসার ছিলেন, তাঁদের মৃত্যুর মাত্র ছয় শতাংশের কারণ ছিল সরাসরি যুদ্ধকাৰ্য। বাকিদের গ্রাস করে নানাবিধ অসুখ; জ্বর (ম্যালেরিয়া-জাতীয়) রক্ত-আমাশা, উদরাময়, যকৃতের অসুখ ও কলেরা। এর মধ্যে কলেরার প্রকোপ ছিল ভয়ানক।

সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের কাছে সমস্যাটি নগণ্য ছিল না। সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতে শ্বেতাঙ্গ সৈন্যের সংখ্যা প্রভূতভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের সৈন্যবাহিনীর মোট ২২৭,০০৫ জনের মধ্যে ব্রিটিশ অফিসার ও সৈন্যের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৮২,১৫৬। অসুস্থতা ও মৃত্যুর দরুণ যে পরিমাণ সৈন্য ও অফিসার অসমর্থ বা বাতিল হয়ে যেতেন, তাদের বদলি সরবরাহ করতে গেলে প্রতি বৎসর দশ হাজার করে নতুন লোক আমদানি করতে হত। কোম্পানির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্যের প্রশ্নটি একটি খুবই গুরুত্ব প্রশ্ন ছিল।

ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্যনীতির সূত্রপাত এই ইতিহাসে। সংক্রামক ব্যাধির উৎস অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস ও অভ্যাস-সৃষ্ট পরিবেশে, এমন একটা মতবাদ উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংল্যান্ডের শহরগুলিতে জন্ম নিচ্ছিল। শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠা শ্রমিক বসতিগুলোই অস্বাস্থ্য, অসুস্থতা ও এমন কি ‘অমানবিকতা’রও ডিপো—এই ধারণা এঙ্গেলসের অল্প-বয়সের রচনা ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা(১৮৪৪) ও আরও অনেক সমসাময়িক পুস্তিকা ও সরকারি রিপোর্টে পাওয়া যাবে। এর ফলে ভারতের যেসব জায়গায় জনসমাগম হত তাকে খুব ভয় পেতেন ব্রিটিশ সরকার। বাজার, গঞ্জ, মেলা, তীর্থক্ষেত্র—তাদের চোখে এই সব জায়গাগুলোই ছিল রোগ ছড়ানোর কেন্দ্র। ডেভিড আর্নল্ড দেখিয়েছেন কেমন করে হরিদ্বারের কুম্ভমেলা, এলাহাবাদের প্রয়াগের মেলা, পুরীর জগন্নাথধাম, মহারাষ্ট্রের নাসিক ও পান্ধারপুরের তীর্থস্থান, অন্ধ্রের তিরুপতি, তামিলদেশে কাঞ্চিপুরম—এই সমস্ত ক্ষেত্রে নজর পড়ে রোগভয়ে ভীত বিদেশি সরকারের। ১৮৬১ সালে কনস্ট্যানটিনোপলে অনুষ্ঠিত ‘স্বাস্থ্যকর পরিবেশ’ বিষয়ক প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মিলনে আলোচনার একটি প্রধান বিষয় ছিল ‘ভারত’। ভারতে তীর্থযাত্রীদের ভিড় ও দলবেঁধে ভ্রমণ করার রীতি এখানে বর্ণনা করা হয় ‘কলেরা সংক্রমণের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী কারণ’ হিসেবে। এই মনোভাব থেকে ব্রিটিশ সরকার মেলা-পরিচালনার বিশাল আয়োজন গড়ে তোলেন। পুলিশ, ডাক্তার, ওষুধ, পানীয় জল, মলমূত্রত্যাগের ব্যবস্থা, বাঁশের বেড়া ইত্যাদি দিয়ে ‘ভিড়’কে কীভাবে সুশৃঙ্খল ও সংযত করা যাবে, এ বিষয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা খরচ করেন সরকার। হাতের কাছে বইটি নেই, তাই নাম উল্লেখ করতে পারছি না এক্ষুণি, কিন্তু বিশ শতকের গোড়ায় পুলিশ প্রকাশিত মেলা ম্যানেজমেন্টের ম্যানুয়াল দেখেছি। যাতে বিভিন্ন সাবধানবাণী ছাড়াও জনপ্রতি কতখানি বাঁশ, দড়ি, জল, পায়খানা, ডাক্তার ও পুলিশ প্রয়োজন, তার একটা বাঁধা হিসেব দেওয়া ছিল।১০

কোম্পানির প্রথম দায়িত্বই ছিল ভারতবর্ষে চাকুরিরত ইংরেজ অফিসার ও সৈন্যদের এখানকার ‘দূষিত’ আবহাওয়া ও জায়গা থেকে যথাসম্ভব বাঁচিয়ে রাখা। ইংরেজ-অধ্যুযিত অঞ্চলগুলি খোলামেলা হবে, অফিসারদের বাংলো হবে আলোবাতাস ভরা সুবিশাল কাঠামো, শ্বেতাঙ্গ-পাড়ার সড়ক, নালা ইত্যাদির স্বাস্থ্যকরতার প্রতি রাখা হবে কড়া নজর। ১৮৬৪ সালে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টস্ অ্যাক্ট রচিত হল এই উদ্দেশ্যে। ১৯০৯ সালে ক্যান্টনমেন্টস্ ম্যানুয়াল-এ লেখা হল: ‘এ কথা আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে… ক্যান্টনমেন্টগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সৈন্যের স্বাস্থ্যরক্ষা…। অন্য সবকিছুরই স্থান তার নীচে’।১১ এই নীতি অনুসারে জন্ম হল ভারতের নানান শহরে ক্যান্টনমেন্ট, সিভিল লাইন, হিল স্টেশন ইত্যাদি। সাম্রাজ্যবাদী জনস্বাস্থ্যের মূল কথাই ছিল জাতিবৈষম্যকে বাঁচিয়ে রাখা।১২

এর ‘কারণ’ ছিল বিবিধ। একটি নিশ্চয়ই খরচা-সম্পর্কিত। ভারতীয় রীতিনীতিতে হস্তক্ষেপের ভয়ও ছিল। তা ছাড়া ছিল এই বদ্ধমূল বিশ্বাস যে, ব্রিটিশজীবন ভারতীয় সাধারণ মানুষের জীবনের চাইতে মূল্যবান। এই বিশ্বাস ব্রিটিশের ভারতে অনুসৃত ‘জনস্বাস্থ্য’ নীতিকে শহরমুখীও করে তোলে। এমনকী বিশ শতকেও গ্রামাঞ্চলে ম্যালেরিয়া-বিষয়ক যে অনীহা ছিল, তা সম্প্রতি গবেষণা করে দেখিয়েছেন তামিলনাড়ুর ঐতিহাসিক ডি. আর. মুরলীধরণ।১৩

মোট কথা, ঔপনিবেশিক সরকার আধুনিক রাষ্ট্রের একটি শর্তপালনে অক্ষম ছিল। সব শরীরই এক, সকলে ব্যক্তিগতভাবে ‘স্বাস্থ্যকর’ ব্যবস্থা নিলে তবেই ‘জনস্বাস্থ্য’র বিকাশ হবে, সকল গৃহেরই পরিমার্জনা প্রয়োজন—ব্যক্তিগত শরীর-গৃহ-জনস্বাস্থ্য এই তিনের সমীকরণের যে-নীতির বিকাশ আমরা ইংল্যান্ডে দেখতে পাই, তা ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষে পুরোদস্তুর পালন করেনি। এককভাবে ভারতীয় শরীরগুলো দুর্বল হোক, অল্পায়ু হোক, তাতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বা পুঁজির কিছু এসে যেত না তেমন। এমন কী শিল্পায়নও এমনও ধরনের হয়েছিল যে শ্রমিক-শরীরের ব্যক্তিগত পুষ্টির প্রতি নজর দেবার বিশেষ প্রয়োজন বোধ হত না। বাংলা পাটশিল্পের আলোচনায় আমি অন্যত্র দেখাবার প্রয়াস পেয়েছি যে ‘সংক্রামক ব্যাধি’ নিয়ন্ত্রণই ছিল চটকলগুলোর স্বাস্থ্যনীতির মূল উদ্দেশ্য।১৪ ভয়ের কারণ ছিল ভারতীয় শরীরের একত্রীকরণ। তার সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চললেই ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় শরীর ‘নীরোগ’ থাকবে—এই নীতির ব্যতিক্রম কিন্তু সময় সময় বড় শহরগুলোতে করতেই হত। যদিচ শ্বেতাঙ্গপাড়া ও নেটিপাড়া আলাদা করা ছিল, সংক্রামক ব্যাধি এলে তা কেবল গরিব, শ্রমজীবী মানুষের বস্তিতেই আটকে থাকবে এমন তো কোনও কথা ছিল না। ১৮৯৮ সালে বোম্বাই নগরীতে সরকারের প্লেগ-দমননীতির বিরুদ্ধে যেসব দাঙ্গা হয়, তার ইতিহাসে কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের দোমনা ভাবটিই বেরিয়ে আসে। এক দিকে তখন শহরের শ্রমিক-অঞ্চলে রাষ্ট্রের জোরাল অনুপ্রবেশ ছাড়া উপায় নেই। ‘ভারতীয়’ শরীরকে চিকিৎসাধীন না করতে পারলে ‘ইউরোপীয়’ জীবনের আশঙ্কা বাড়বে। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক সরকারের ভয় ‘ধর্ম’ নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে যদি আবার ১৮৫৭ ফিরে আসে!

জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব সরকারি সমালোচনা করেছিলেন—সে প্রসঙ্গে আমরা পরে ফিরে আসব। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার: ‘জনস্বাস্থ্য’ বা ‘পরিবেশ’-এর প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদীর রাষ্ট্রের নীতি ছিল ‘মিনিমালিস্ট’, রাষ্ট্রশক্তির নিজস্ব বাঁচার প্রয়োজনে ন্যূনতম যা করার ছিল তা-ই তাঁরা করতেন। ভারতের আধুনিক রাষ্ট্রের জন্মলগ্নের এটাই ইতিহাস। এই ইতিহাসে ষদি স্বাস্থ্য ও শাসনের প্রশ্ন দুটিকে পরস্পর সম্পৃক্ত অবস্থায় দেখি, তাকে আকস্মিক বা সন্নিপাতিক বলে ধরে নেবার কোনও কারণ নেই। ইতিহাসের পাঠকমাত্রেই জানেন যে অনেক সম্পর্কই তার জন্মলগ্নের ইতিহাসে উলঙ্গভাবে ধরা পড়ে, কালক্রমে অভ্যাসের আস্তরণ পড়ে মূলসূত্রটিই অনেক সময় লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। মিশেল ফুকোর কথাই ভাবুন। বর্তমান সমাজে ক্ষমতার বন্টন ও ব্যবহার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাঁকে রচনা করতে হয় কয়েদখানা, পাগলাগারদ বা চিকিৎসাগারের ‘জন্ম’বৃত্তান্ত। সেই রকম ভারতের স্বাধীন রাষ্ট্র ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অনেক ফারাক থাকলেও, আমাদের দেশে আধুনিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঔপনিবেশিক সময়ে, তাই বর্তমান শাসনব্যবস্থার অনেক অনুচ্চারিত সত্য তার জন্মের ইতিহাসে—অর্থাৎ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ইতিহাসে—অনেক নির্লজ্জভাবে প্রকাশিত।

রাষ্ট্র, সমাজ, মহামারি ও জনমানস

অসুস্থতা, ব্যাধি, সংক্রামকব্যাধি—এরা মনুষ্য-সভ্যতার চিরন্তন সঙ্গী। সব সমাজেই এরা আছে, সব সমাজকেই এদের নিয়ে ভাবতে হয়, কিন্তু সব সমাজে বা ইতিহাসে ভাবনার ‘ক্যাটিগরি’ এক নয়। আমাদের গত দুশো বছরের ইতিহাসে দেখছি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা যেভাবে ভেবেছেন, সাধারণ মানুষ সেভাবে সবসময় ভাবেননি। প্রাক-ব্রিটিশ যুগে হাকিম-বৈদ্যদের দর্শনও ছিল অন্যরকম। রাষ্ট্রের ভাবনা ও আমাদের সমাজের অন্তর্গত ভাবনায় বিরোধ ছিল, সে-বিরোধ স্থানে স্থানে খোলাখুলি সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে। এর সবচেয়ে নাটকীয় নিদর্শন ১৮৯৭-৯৮-তে বোম্বাই শহরে সরকারি প্লেগ-নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ, যা নিয়ে ভাল গবেষণা করেছেন ডেভিড আর্নল্ড ও ইয়েন ক্যাটান্যাক।১৫

বোম্বাই নগরে প্লেগ-জনিত প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১৮৯৬ সালের আগস্ট মাসে। সে-বছর অক্টোবর মাস থেকে সরকার ব্যাপক ও জোরদার ব্যবস্থা নেন প্লেগ প্রতিরোধের জন্য। আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়— প্রয়োজন হলে জোর খাটিয়ে প্লেগ রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করার, মেলা তীর্থযাত্রা (বিশেষত হজ-যাত্রা) বন্ধ করার, রেলযাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার, এমনকী প্লেগ-সন্দেহে মানুষকে আলাদা করে পরীক্ষা করার। সরকারি নীতির বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ জমতে থাকে ও প্রকাশ পায়। ১৮৯৬র ২০ অক্টোবর প্রায় এক হাজার মিলশ্রমিক আক্রমণ করেন বম্বের আর্থার রোড হাসপাতাল। গুজব রটেছিল যে, এক মহিলাকে জোর করে ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। ৯ মার্চ ১৮৯৮ একটি বারো বছরের বালিকাকে হাসপাতালে ভর্তি করার সরকারি চেষ্টাকে শহরের জোলা-সম্প্রদায়ভুক্ত তাঁতিরা একজোট হয়ে ব্যর্থ করে দেন। প্লেগ-কানুনবিরোধী আন্দোলন চলে উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে, কলকাতায়ও তার প্রভাব পড়ে। এই বিক্ষোভের কারণেই পুণার প্লেগ-কমিশনার ডব্লিউ. সি. র‍্যান্ড খুন হন ১৮৯৭ সালের জুন মাসে।১৬

বসন্ত, কলেরা বা ম্যালেরিয়া নিয়ে এমন সাংঘাতিক সরকার-বিরোধী বিক্ষোভের নজির নেই। কিন্তু প্লেগসহ অন্যান্য মহামারি বা মড়ক, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি নিয়ে ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্ববিদরা যে আলোচনা ও তথ্যসংযোজন করেছেন, তার ভিত্তিতে একটি সাধারণ সূত্রের নির্দেশ করা যায়—তা হল রাষ্ট্র বনাম সমাজ বা গোষ্ঠীর সংঘর্ষের কথা। এই সংঘর্যের ব্যাপ্তি আমাদের গণ-ইতিহাসের নানা স্তরে। মহামারির ইতিহাস ঘাঁটলে একথাই মনে হয় যে ‘সমাজ’-এর চোখে রাষ্ট্র অনেক সময়ই একটি বাইরের অনুপ্রবেশকারী শক্তি। তাই জনমানসের মহামারি-চিন্তায় একটি রাজনীতিক বিষয় থাকে যার প্রকাশ অনায়াসেই রাষ্ট্রবিরোধিতা হতে পারে। দ্বিতীয়ত দেখা যায় মহামারিকে ঘিরে ‘সমাজ’-এর আত্মসংবদ্ধ হবার প্রয়াস। দুটি বিষয় নীচে একটু বিশদ আলোচনা করছি।

মহামারি ও রাজনীতিক চেতনা

সাম্প্রতিক ইতিহাস-আলোচনার ক্ষেত্রে পাঠক লক্ষ করে থাকবেন যে, একটি বক্তব্য বহুবারই উত্থাপিত হয়েছে। তা হল এই যে, নিম্নবর্গের ও সাধারণভাবে প্রাক-ব্রিটিশ রাজনীতিক চেতনায় মহামারি, মড়ক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি বিশেষ স্থান আছে; আমাদের জনসংস্কৃতিতে মহামারি, মড়ক, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প ইত্যাদি অনেক সময়েই রাজধর্মের ব্যত্যয় সূচিত করে। পশ্চিমবঙ্গে শীতলা পুজা নিয়ে তাঁর রচনায় র‍্যালফ নিকোলসও এই সূত্রটির নির্দেশ দিয়েছেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পাঁচটি দৈব-দুর্বিপাকের কথা বলা আছে, যা রাজা ও রাজ্যের বিনাশকারী: অগ্নিকাণ্ড, বন্যা, ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ ও মড়ক। নিকোলাসের মতে এটি কাকতালীয় কোনও ঘটনা নয় যে, বাংলার অষ্টাদশ শতকের মারাঠা আক্রমণ ও অরাজকতার মুখেই ছড়িয়ে পড়ে শীতলার পালাগান:

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি শীতলা বিষয়ক রচনার প্রচার দেখে মনে হয়…বসন্ত রোগের অভিজ্ঞতা যেন একটি নতুন তাৎপর্য গ্রহণ করেছিল তখন। এই পালাগানের জনপ্রিয়তা ও মুঘল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ গোলমাল সমসাময়িক ঘটনা। তাছাড়া যে অঞ্চলে এগুলোয় উদ্ভব হয় সেই অঞ্চলগুলিই মারাঠা আক্রমণের শিকার হয়েছিল।১৭

‘রাজত্ব’ আর ‘ধর্ম’—এই দুটি ধারণা একসূত্রে গাঁথা।১৮ তাই দৈবদুর্বিপাক নীতির স্খলন, অধর্মের সূচনা ও (ধর্ম) রাজত্বের বিনাশের ইঙ্গিত দেয়। এই ভাবনার আনুষঙ্গিকভাবে উনিশ শতকে মহামারি উপলক্ষে জনমানসে যা প্রতিফলিত হয়েছে তাকে ব্রিটিশ শাসনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমালোচনাই বলা চলে। আর্নন্ড ক্যাটান্যাক-প্রমুখেরা এর অজস্র উদাহরণ দিয়েছেন। বুন্দেলখণ্ডে হেস্টিংসের সেনাবাহিনী যখন কলেরা-আক্রান্ত হয়, তখন তার ভিন্নরকম অর্থ করেছিলেন সাধারণ মানুষ। স্থানীয় রাজা হর্দুকোনের স্মৃতিতে পবিত্র কোনও স্থানে শ্বেতাঙ্গ সৈনিকেরা জনৈক ব্রাহ্মণের নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করে গোমাংস খেয়েছিল—এই অর্ধমাচরণেরই ফল কলেরা।১৯ আর রাজা, যাঁর ধর্মকে পালন করার কথা, অধার্মিকতাকে প্রশ্রয় দিলে বা নিজে অধার্মিক হলে তাঁর পতনও অনিবার্য হয় জনমানসের কল্পনায়।

এ-কথা অনেক ঐতিহাসিকই লক্ষ করেছেন যে, জাতীয়তাবাদী কৃষক বা গণ আন্দোলনের উত্তাল মুহূর্তগুলোতে অনেক সময়ই এই গুজব স্বতঃস্ফূর্তভাবে রটেছে যে, ইংরেজ শাসন শেষ প্রায়। তার নিজের অধর্ম-ই তাকে ভেতর থেকে জীর্ণ করে ফেলেছে, পচা-গলা সরকার শীঘ্রই ধরাশায়ী হবে।

এটা লক্ষণীয় যে, প্লেগ-বিরোধী জনবিক্ষোভ ও দাঙ্গার সময় ঠিক এই ধরনেরই গুজব ছড়িয়েছিল। কলকাতায় মুসলমানদের মধ্যে বলা হয়েছিল, ইংরেজের দিন শেষ, তুর্কী সুলতান সৈন্য পাঠাচ্ছেন কলকাতায় ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করতে। হজ-যাত্রা বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে একজন সাংবাদিক লিখেছে যে, শহরে সাধারণ মুসলমানের বিশ্বাস, এই সব হজ-বিরোধী নিয়মাবলীর জন্য ‘প্লেগ’ একটা অজুহাতমাত্র। আসলে সরকার চান না যে, মুসলমানেরা মক্কায় যান, কারণ ব্রিটিশের ভয় যে মক্কাগামী মুসলমানেরা ফিরে আসবেন সুলতানের সৈন্যবাহিনী সমেত, আর তাহলেই তো ব্রিটিশ-রাজের খেল খতম!২০

গুজরাটের খেড়া পরগনার চাকালাসি গ্রামে ১৮৯৮ সনে দাঙ্গা হয় এই গুজবের ভিত্তিতে যে, ‘মহীনদীর দক্ষিণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে…আর প্লেগসংক্রান্ত সতর্কতা ও বিচ্ছিন্নতা-নীতির উদ্দেশ্য একটিই—যাতে এই খবরটি নদীর উত্তরে না পৌঁছয়।’২১ উত্তর-ভারতে রটনা হয়েছিল ইংরেজ ইচ্ছে করেই মারাত্মক ব্যাধি এনেছেন দেশে, যাতে রুশরা ভারত আক্রমণ না করেন।২২ কলকাতায় রটেছিল যে হিমালয়বাসী এক সাধুর উপদেশে ও ইংরেজ রক্ষার্থে সরকার স্থির করেছেন যে মা-কালীর কাছে দুলক্ষ প্রাণ বলিদান করা হবে। তাই ওষুধ, টিকা আমদানি করে নরমেধযজ্ঞ!২৩

ইংরেজ-বিরোধিতা ও সরকার বা রাষ্ট্র-বিরোধিতা মিলেমিশে আছে এই মনোভাবে। সরকার প্রজাবিরোধী, তাই খাবারে, কুয়োর জলে, রুটিতে, হাসপাতালের ওষুধে বিষ মেশানো হচ্ছে—এই রকম প্রচুর রটনার খবর দিয়েছেন ক্যাটান্যাক ও আর্নল্ড। মারকুটে সরকার সম্বন্ধে এ-ও রটেছিল মোরাদাবাদ, কানপুর, গুজারাটের অংশে, যে হাসপাতালে রোগীদের শরীর থেকে তেল নিষ্কাশন করে মলম তৈরি হচ্ছে ও সেই মলম পাঠানো হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায় বুয়র যুদ্ধে রত শ্বেতাঙ্গ সৈনিকদের কাছে। হ্যাফ্কিন-প্রবর্তিত টিকা-বিষয়ে পঞ্জাবে বলা হয় তার সূচের সাইজ লম্বায় এক গজ, শরীরে ফোটালেই হয় মৃত্যু নয় বন্ধ্যাত্ব, ডেপুটি কমিশনার সাহেব এতেই মারা গেছেন (আধঘণ্টা অসহ্য যন্ত্রণাভোগের পর), ইত্যাদি।২৪ বসন্ত-টিকার প্রসঙ্গেও আর্নল্ড দেখিয়েছেন যে, অনুরূপ রটনা হয়েছিল—টিকার উদ্দেশ্য জাত-ভাঙানো, ধর্মনাশ করা, নতুন করে বসানো বা জোর করে কুলি হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।২৫

রাষ্ট্রের জুলুম—এই গুজবগুলির একটি অন্যতম বিষয়। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অধার্মিক ইংরেজের অনাচারের কথা। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে কীভাবে মানুষ বুঝতেন আধি-ব্যাধির অভিজ্ঞতাকে? ঔপনিবেশিক ও আধুনিক রাষ্ট্র সংক্রামক-ব্যাধির যে মানে করতেন, তার বাইরে নিম্নবর্গের জীবনে কী ‘মানে’ হত দুর্দৈবের?

দুর্দৈব ও সমাজ

শীতলাপুজোর ব্যাখ্যায় একটি অনুধাবন-যোগ্য কথা বলেছেন নিকোলাস—‘ক্যালামিটি’ থেকে ‘কমিউনিটি’। কমিউনিটি’র বাংলা যদি ‘গোষ্ঠী’ বা ‘সমাজ’ করি (অর্থাৎ ‘সমাজ’ কথাটির যে-অর্থে আমরা বাংলায় ‘সমাজচ্যুত’ কথাটা ব্যবহার করি), তাহলে বলা যায় শীতলাপুজোয়, ওলাবিবির বা ওলাইচণ্ডীর উপাখ্যানে বা দক্ষিণাংশে মারিআম্মার কাহিনীতে এমন একটি মানসিকতার সাক্ষাৎ পাচ্ছি, যা কোনও দুর্দৈবকে সমস্ত সমাজের সমস্যা বলে গণ্য করে। ফলে এইসব দেবীদের পুজো-আর্চায় এমন সব পদ্ধতি ও আচার অন্তর্ভুক্ত হত যা সামাজিক বন্ধনেরই পরিচয় দেয়, ও যা পালন করতে গিয়ে একটি গোষ্ঠী তার অন্তির্নিহিত যূথবদ্ধ চরিত্রই আবার নতুন করে অনুভব করত, একেই নিকোলাস বলেছেন ‘দুর্দৈবকে সমাজে পরিণত করা’। অসুখ কারুর একার নয়, কারণ ব্যক্তির তার শরীরের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানাস্বত্ব নেই, আমার শরীরের বসন্তগুটিকায় লেখা আছে আমার সমাজ বা গোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ, সেই অর্থে ব্যক্তির শরীরও সামাজিক বা গোষ্ঠীগত—এই রকম একটা মনোভাব।

উদাহরণ অজস্র। বোম্বাই-এর প্লেগের সময় আবির্ভাব হয়েছিল এক প্লেগমাতার। তার নাম ছিল ‘বোম্বাই কি মায়ান’ ও তাঁর পুজো হত শীতলা মন্দিরে।২৬ পঞ্জাবের গ্রামে প্লেগের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে একটি সরকারি রিপোর্ট উদ্ধৃত করেছেন ক্যাটান্যাক, তার অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি:

যখনই প্লেগের আশংকা করা হয়, তখনই ধার্মিক অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু হয়। একজন গ্রন্থীকে নিয়োজিত করা হয়…গ্রন্থ-পড়ার জন্য; ‘হওয়ন’-এর ব্যবস্থা করা হয় উন্মুক্তভাবে। গ্রামের মসজিদে সাধারণভাবে প্রার্থনা করা হয়; কঠোর পরিশ্রমে খোঁড়া হয় পুষ্করিণী; দরিদ্র-ভভাজনের আয়োজন করা হয়; নিম্নস্তরের দেবতা-দানোরাও বাদ যান না; ফকিরদের ডেকে ভূরি-ভোজন করানো হয় তাদের কেরামতির আশায়; আর গোটা গ্রামের চারপাশে বেড়া পড়ে, তার ওপরে খোদাই করা থাকে দানোদের মুণ্ডু, গ্রামের অতিপ্রাকৃত পাহারাদার হিসেবে।২৭

হেনরি হোয়াইটহেড-রচিত দক্ষিণ ভারতের গ্রামীণ দেবদেবী বিষয়ক যে বইটি আছে, তাতেও মড়ক-মহামারির মোকাবিলায় এই গ্রামীণ সমাজ বা গোষ্ঠী-ভাবনার প্রকাশ খুবই চোখে পড়ে। তামিল দেশের বসন্ত রোগের দেবী মারিআম্মার (বা দক্ষিণ আরকটের ক্ষেত্রে কান্নিআম্মার) পুজোয় এর প্রমাণ আছে। ত্রিচির কলেরা-দেবীর পূজায় গ্রামের সমস্ত পরিবার অংশগ্রহণ করেন ও পূজার পর পূজার উপকরণাদি একটি ঘটে ভরে গ্রামের সীমান্তে রেখে দিয়ে মনে করা হয় রোগ এখন গ্রামের বাইরে চালা হল।২৮ এইভাবে নানাগ্রামে ঘুরতে ঘুরতে দেবীর প্রকোপ দুরে সরে যায়। তেলেগুদেশে মাসুলিপটমের নিকটবর্তী গুটিভড়া গ্রামেও হোয়াইটহেড সাহেব অনুরূপ গ্রামীণ আচারের বর্ণনা দিয়েছেন। কর্ণাটকের বেল্লারি পরগনায় কলেরা প্রাদুর্ভাবে যে পূজা ও অন্যান্য আচারের বর্ণনা পাই, তাতেও গ্রামীণ সমাজের ‘গোষ্ঠী’গত মনোভাব ও গ্রামভেদের ছবিই পাওয়া যায়।২৯ সম্প্রতি ডেভিড হার্ডিম্যানের গ্রন্থে গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে কোঙ্কনস্থ অঞ্চলে ১৯২০-২১ সালে বসন্ত রোগের আবির্ভাব ও সেই প্রসঙ্গে বসন্তদেবী ‘বায়া’ মাতা-পুজার বর্ণনা আছে। তাতেও রোগ চালাবার কথা পাই গ্রামের সীমান্ত ধরে ধরে।৩০

বলাবাহুল্য, এই যে ‘গোষ্ঠী বা ‘সমাজ’ যার পুনর্জন্ম হয় দুর্দৈবের মুখোমুখি, তার ভৌগোলিক প্রসার অনেক সময়ই খুব বিস্তৃত নয়। প্রায়শঃই দেখা যাচ্ছে একটি গ্রামের সীমা দ্বারাই এই ‘সামাজিকতা’ সীমিত। অতি সাম্প্রতিককালে এর সাক্ষ্য পাই নিকোলাসের গবেষণায়। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন:

সমুদ্র-উপকূলবর্তী দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গে আজ শীতলাই সর্বাধিক প্রচলিত গ্রামদেবতা। প্রায়শই মনসার পাশে তাঁকে পাওয়া যায়, কিন্তু যেখানে দুজনকেই একসাথে পেয়েছি, সেখানে আমার অভিজ্ঞতায়—শীতলারই প্রাধান্য।…শীতলা পূজার বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই ধারণাটি পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত হয় যে কোনও একটি বিশেষ গ্রামই তাঁর পূজার ফলাফলের অধিকারী। এটা কখনও দেখানো হয় পূজারীদের একটি মিছিল নিয়ে সারা গ্রামটিকে প্রদক্ষিণ করে, বা গ্রামের সীমান্তপথ ধরে নিয়ে নিশানা পুঁতে পুঁতে, অথবা পুজোর শুরুতেই অন্যে কোনও পদ্ধতি দ্বারা গ্রামটিকে [প্রতীকীভাবে] ঘিরে ফেলে।…পূর্ব মেদিনীপুরে কোনও বিশেষ গ্রামের শীতলাকে সাধারণত ‘অমুক গ্রামের মা’ বলেই অভিহিত করা হয়। ‘শীতলা’ নামটি চালু হয় পুজোর সময়টুকুতেই।৩১

এই গোষ্ঠীগত মনোভাবের কথা বলা মানে এই নয় যে গ্রামের দলাদলি ও অন্যান্য কলহ-দ্বন্দ্বের কথা ভুলে যাওয়া। বসন্ত-মহামারি বা শীতলাপূজা উপলক্ষে কীভাবে ‘সমাজ’ তার সামাজিকতা পুনরানুভব করে তারও সুন্দর বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করছেন। নিকোলস। শীতলাপূজায় শীতলার পালা অভিনয় হয়, তার খরচা দেন গ্রামের সমস্ত পরিবার। অন্তত গ্রামের মানুষদের ধারণা এই চাঁদা দেবার সদিচ্ছা বা অনিচ্ছার সঙ্গে গ্রামের জাগতিক ও নৈতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের একটি নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। দলাদলি ও নানা দৈনন্দিন কোন্দলবিধ্বস্ত এই গ্রামীণ সমাজে নৈতিক সমৃদ্ধির অর্থ দলাদলিমুক্ত মনোভাব, যা প্রাত্যহিকে অবশ্যই অনুপস্থিত। নিকোলাস লিখেছেন:

মা যেমন তার বিবাদরত সন্তানদের [সময়ে সময়ে] একত্র করে মনে করিয়ে দেন যে তারা সকলেই সমানভাবে তাঁর দেহের অংশ, তেমনই যেন শীতলা মাতা বৎসরে একবার শান্তভাবে কিন্তু দৃঢ় হস্তে গাঁয়ে তাঁর ছেলেদের এক জায়গায় এনে, তাদের সাহায্য করেন [দলীয়] রাজনীতি ও স্বার্থানুসন্ধানের কথা—অল্প সময়ের জন্য হলেও—ভুলে থাকতে।৩২

এই মানসিকতায় শরীরকে যে-দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে, তা বুর্জোয়া-চিন্তায় শরীর ভাবনা থেকে খুবই আলাদা। এখানে শরীরের তাৎপর্য সামাজিক বা গোষ্ঠীগত। কল্পনায় এই শরীরকে আমরা ‘সামাজিক শরীর’ নাম দিতে পারি। বলা যেতে পারে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী চিন্তায় শরীরের অবস্থান এর বিপরীত মেরুতে। সপ্তদশ শতকের বুর্জোয়া চিন্তাধারায়, যাকে সি. বি. ম্যাকফারসন ‘পসেসিভ ইন্ডিভিজুয়ালিস্‌ম বলেছেন, তাতে শরীরকে ভাবা হচ্ছে ব্যক্তিগত মালিকানাস্বত্বের তত্ত্বকে আশ্রয় করে। ‘নিজের শরীরে নিজের অধিকার’ এই চিন্তা বুর্জোয়া ‘স্বাধীনতা’র ও ব্যক্তিগতস্বাতন্ত্র্যবাদের একটি প্রধান ও প্রাথমিক শর্ত।৩৩ আজ যখন পাশ্চাত্যের নারীবাদী আন্দোলন ওম্যান্‌স বডি: অ্যান ওনার্স ম্যানুয়াল গোছের বই দেখি তখন বোঝা যায় এই চিন্তার প্রভাব কত গভীর ও সুদূরপ্রসারিত।

‘বসন্ত’, ‘কলেরা’, ‘প্লেগ’ ইত্যাদি মহামারির যে অভিজ্ঞতা হয়, ‘সামাজিক শরীরে’ তাকে কেবল ‘অসুখ’ বলে বর্ণনা করলে এই অভিজ্ঞতার সামাজিক, নৈতিক, রাজনীতিক ও ধার্মিক দিকগুলোকে অবহেলা করা হয়। এই ‘শরীর’-এর লক্ষণ ও ব্যঞ্জনাশক্তিতে যে-ভাষার প্রকাশ, তা জটিল ও বিচিত্র। সমাজ নিজেকে ‘সমাজ’ হিসেবে প্রত্যক্ষ করে এই দুর্দৈবের মাধ্যমে, তা তো আগেই বলেছি। পরন্তু দেখা যায় ‘অসুখের’ দেবদেবীবিষয়ক উপাখ্যানগুলির ও পূজা-পদ্ধতিরও অঞ্চলভেদে প্রভেদ হয়, তা-ও এই অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যের প্রতি ইঙ্গিত করে।৩৪ সম্প্রতি এক গবেষক মাদ্রাজে গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, মানুষের অভিজ্ঞতায় ‘মারিআম্মা’ অর্থ কেবল অসুস্থতা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রেণীর, জাতের ও পরিবারের অভিজ্ঞতা।৩৫ শীতলার উপ্যাখ্যানও কেবল ‘অসুখে’র কথা নয়। এতে আছে ধর্মের কথা, রাজত্বের কথা, এমনকী নারীর সতীত্বের কথা:

স্বামী আত্মা স্বামী প্রাণ স্বামী ত জীবন।

স্বামী বিনে স্ত্রীলোকের বিফল জীবন॥৩৬

তাছাড়া এই পালাগানে শীতলা কেবল বসন্তের দেবীই নন, অন্য সমস্ত রোগও তাঁর বশানুগ, আর শীতলার প্রকোপের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে বিরাট রাজার ধার্মিকতার কাহিনী।৩৭

এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই সমস্ত পুজো পালাগান ইত্যাদির মধ্যে সবসময়ই রয়েছে একটা অভিনয়কার্য। মানুষের ওলাবিবি, শীতলাদেবী বা ‘বায়া’ দেবী সাজার খবর আর্নল্ড ও হার্ডিম্যান দুজনেই দিয়েছেন।৩৮ এতে প্রাক-আধুনিক মানসিকতার একটি প্রায় সার্বজনীন চরিত্র প্রকাশ পায়। এই মানসিকতায় ঐহিক ও পারত্রিক জগত মিলেমিশে যায়, একই গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়েন মর্তবাসী মানুষ ও অর্মত্যবাসী সব চরিত্র, তাই গল্পে মানুষের ভূমিকায় আসেন দেবতা, আর কখনও পৃথিবীর মানুষ অভিনয় করে দেবচরিত্রে। এখানে ‘অভিনয়’ কথাটিও আসলে ঠিক নয়, কারণ ‘অভিনয়’ ও ‘অভিনেতার’র মধ্যে তফাৎ থাকে না এই অভিজ্ঞতায়। অন্য এক সময়ের গণ্ডিতে, অপার্থিব এক জগতে অংশ নেন দর্শক, শ্রোতা, পাঠক, অভিনেতা সকলেই।৩৯

শরীর চেতনা ও মানসিকতার সংঘাত

শরীরের এই যে ‘সামাজিক’ অবস্থান তাকে পরিবর্তন না করে ধনতান্ত্রিক শিল্পায়ন দুষ্কর। ‘সামাজিক’ শরীর সম্পূর্ণ অবলুপ্ত না হোক তাকে হার মানতে হবে অন্য এক শরীর-চেতনার কাছে—যেখানে শরীরের সঙ্গে শরীরের মালিকের সম্পর্ক ব্যক্তিগত, যেখানে সংক্রামক ব্যাধি কোনও সামাজিক, রাজনীতিক বা ধার্মিক সংকেত বয়ে আনে না, ‘কলেরা’ ‘বসন্ত’র অর্থ যেখানে হ্রস্ব হয়ে এসেছে ‘জীবাণু’তে, স্বাস্থ্যের প্রশ্নে যেখানে কোনও রাষ্ট্র-বিরোধিতার বীজ নেই। তখনই সম্পূর্ণ হবে শিল্পায়নের স্বার্থে শ্রমজীবী মানুষের সরবরাহের আয়োজন, আর উৎপাদন-ক্ষমতা তো খানিক পরিমাণে ‘সুস্বাস্থ্য’-র ওপর নির্ভরশীল। এমনিভাবেই একদিন তৈরি হবে সুদূর গ্রামাঞ্চলে ও হাসপাতাল-গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র-পরিকল্পনা কেন্দ্রের শাসনব্যবস্থা।

প্রশ্নটা মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের, এবং এটা কেবল পিটিয়ে হয় না। উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীকে উদ্দেশ্য ও উপলক্ষ্য করে যে ‘স্বাস্থ্যকর পরিবেশ’ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে রাষ্ট্র ও এলিটশ্রেণী পরস্পরকে মদত যুগিয়েছিল।৪০ এদের যৌথ প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল এইরকম একটি ধারণা যে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, পরিচ্ছন্ন গৃহ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ—এই তিনটি গুণনীয়কের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে জনস্বাস্থ্য। উনিশ শতকের শেষে এই ধারণার কতটা প্রসার ঘটেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যাবে সাধারণ একটি সাক্ষ্যে—একটি সাবানের বিজ্ঞাপনে। ১৮৯১ সালের দি গ্রাফিক পত্রিকায় বেরিয়েছিল এই বিজ্ঞাপন।৪১

PUBLIC HEALTH!

THE SANITARY WASHING OF LINEN

Dirt Harbours Germs of Disease

HUDSON’S

EXTRACT OF SOAP

Dirt cannot exist where Hudson’s soap is used

Home, Sweet Home! The Sweetest, Healthiest

Homes are those where Hudson’s Extract of SOAP

is in Daily Use.

পাঠক অনায়াসেই লক্ষ করে থাকবেন, কীভাবে ‘গৃহ’, ‘স্বাস্থ্য’ ও ‘জনস্বাস্থ্যে’র ধারণা—যার গোড়ায় রয়েছে জীবাণু তত্ত্ব—মিলেমিশে আছে একটি সাধারণ, নিত্যব্যবহার্য বস্তুর বর্ণনায় ও বিজ্ঞাপনে।

এই মনোভাব ভারতের মাটিতে প্রোথিত করার মতো ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনওটাই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ছিল না। একদিকে তার ছিল ভারতীয় শরীরবিষয়ে ছুতমার্গ (যার আলোচনা আগেই করেছি)। অন্যদিকে বিদ্রোহের ভয় ভারতীয় অনেক প্রথাকে ‘কুসংস্কার’ বলে চিহ্নিত করলেও, তাতে হস্তক্ষেপ নিতান্ত প্রয়োজন না হলে করতে চাইতেন না সরকার। প্লেগ-বিষয়ে প্রথমদিকে কড়াকড়ি চললেও, পরে অনেক নরম নীতি নেওয়া হয়েছিল দাঙ্গা এড়াবার জন্য। এর অনেক আগে ১৮৭০-এর দশকে প্রকাশিত টিকাদারদের প্রতি উপদেশ-এ দেখছি সরকারের সাবধানী ভাব। ওই পুস্তিকার ‘ব্যক্তিদিগের প্রতি ব্যবহার’-বিষয়ক পরিচ্ছেদে বলা হচ্ছে টিকাদারেরা যেন অত্যাচার না করেন বা অপ্রিয় কথা না বলেন, অন্যথায় ‘পর বৎসর সেই স্থানে টিকা দেওয়া কষ্টকর হইবে’। আরও বলা হচ্ছে:

জুর, উদরাময়, কাশী, কি হাম যাহার ইংরাজী টিকার সহিত কোন সম্বন্ধ নাই এরূপ প্রকার পীড়া উপস্থিত হইলে ইংরাজী টিকা দেওয়া প্রযুক্ত উহার উপপত্তি হয়ে নাই এই বিষয়টি ব্যক্তিগণকে বুঝাইয়া দিতে বিশেষ কষ্ট স্বীকার করিবে।৪২

আমরা আগেই দেখেছি—স্বাস্থ্যশিক্ষা বিষয়েও বস্তুত বিশেষ নজর দেননি ইংরেজ সরকার। গা বাঁচিয়ে চলাই ছিল তার নীতি। বলা যেতে পারে, সামাজিক যে বন্ধনের সঙ্গে আশ্লিষ্ট ছিল মড়ক-মহামারির ধারণা ও অভিজ্ঞতা, সেই বন্ধনগুলিকে প্রচণ্ড আঘাত করার মতো ক্ষমতা ছিল না ওই সরকারের। সাম্রাজ্যবাদের তা প্রয়োজনও ছিল না। ‘আধুনিকতা’র প্রয়োজনীয় সব আয়োজন ‘আমাদের’ মনের মতো করে করেননি, এ তো জাতীয়তাবাদের পুরনো অভিযোগ।

বরঞ্চ জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের ও মধ্যবিত্তশ্রেণীরই আকাঙ্ক্ষা ছিল যে দেশে ‘আধুনিক’ ও ‘স্বাস্থ্যসম্মত’ বিধিব্যবস্থা নেওয়া হোক ও সাধারণ মানুষের ‘কুসংস্কার’ দূর করার জন্য স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক শিক্ষার ব্যাপক প্রচার হোক।৪৩ প্লেগের সময় তিলকের মারাঠা পত্রিকায় বলা হয়েছিল যে শিক্ষিত ভারতীয়ের কর্তব্যই হল গরিব মানুষের ‘ভুল’ ধারণা ও ‘কুসংস্কার’ দূর করতে চেষ্টা করা। মারাঠা আরও বলেছিল:

এটা সত্যি যে জনসাধারণ প্লেগকে দৈবপ্রেরিত মনে করেন ও আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের উপায়গুলির কার্যকারিতা সম্বন্ধে তাঁদের খুব একটা বিশ্বাস নেই। কিন্তু জনগণ মূর্খ বলেই এটা ধরে নেওয়া উচিত হবে না যে শীর্ষস্থানীয় ও বিশেষত শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষেরা আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিগুলোর গুরুত্ব বোঝেন না।৪৪

আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের ও চিকিৎসাবিদ্যার প্রচার চাইলেও, তিলকের চিন্তায় দ্বিধা ছিল। আর্নল্ড লিখেছেন তিলকের ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ তাঁকে আয়ুর্বেদের পুনর্জাগরণের প্রতিও আকৃষ্ট করত ও মারাঠা-র পাতায় তিনি পাশ্চাত্য-চিকিৎসা-বিদ্যা ও আয়ুর্বেদের চিন্তাধারা দুটির একটি ‘সুচিন্তিত সংমিশ্রণ’কেই কাম্য বলে প্রচার করতেন।৪৫

এখানে কথাটা বলে নেওয়া প্রয়োজন। পাশ্চাত্য তথা আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে যে বিমূর্ত ব্যক্তিশরীরের ভাবনা আছে তা যতদূর জানি আয়ুর্বেদে নেই। চরক-সংহিতা-য় ব্যক্তিবিশেষের শরীর তার জাত-কুলসাপেক্ষ। তাছাড়া মানুষের সমস্ত কার্যাবলীর গোড়ায় জীবনের একটি ছক ধরে নেওয়া হয়। সেই ছকের উৎস তিন প্রকার আকাঙ্ক্ষায়: (১) জীবনধারণের আকাঙ্ক্ষা, (২) অর্থ ও কামের আকাঙ্ক্ষা ও (৩) মোক্ষের আকাঙ্ক্ষা।৪৬ এখানে ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার পুরুষার্থের কথা স্পষ্টতই মনে পড়বে। অর্থাৎ শরীর-চিন্তাকে ধরে আছে একটি সামাজিক, নৈতিক ও ধার্মিক ভাবনা। গীতায় ‘শরীর’ বিষয়ে যা কথা পাওয়া যায়, তাতে তো দেখা যায় ‘আহার’ও একটি নীতির তত্ত্বে ধরা আছে—শ্রীকৃষ্ণ বলছেন ত্রিগুণভেদে আহাৰ্য্যদ্রব্যের প্রকারভেদের কথা—সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক আহার।৪৭ এই সব কথাগুলোই সরাসরি সমাজের নীচের তলার মানুষের চেতনায় এসেছে এমন দাবি করি না। কিন্তু আমাদের ইতিহাসে যে মার্গসংস্কৃতি ও জনসংস্কৃতির বহু আদানপ্রদান ঘটেছে, এ নিয়ে হয়তো তর্ক হবে না।

জাতীয়তাবাদী মধ্যবিত্তশ্রেণী ও তাদের নেতৃত্ব এই ধরনের ধার্মিক-সামাজিক-নৈতিক শরীর-দর্শনের সঙ্গে আধুনিক চিকিৎসা-শাস্ত্রের যে শরীর তার একটা ‘সমন্বয়’ ঘটাতে চেয়েছিলেন। এটা আমাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তার স্ববিরোধী চরিত্রের একটি লক্ষণ (এমন আরও অনেক লক্ষণ আছে)। ইংরেজ যতদিন সরকারি প্রভুর জায়গায় ছিল, ততদিন এই স্ববিরোধ ছিল অবশ্যম্ভাবী। একদিকে যেমন ইংরেজ-আনীত ‘আধুনিকতা’, ‘দেশীয় উন্নতি’, ‘প্রগতি’ প্রভৃতির প্রতি আকৃষ্ট হতেন শিক্ষিতশ্রেণীর মানুষেরা, তেমনি অন্যদিকে ভয় ছিল যে এই সকল আইডিয়ার বল্গাহীন চর্চায় ‘ভারতীয়ত্ব’ই না লোপ পায়। আসলে ইংরেজ আমলে জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ‘ভারতীয়ত্ব’ই ছিল আত্মসম্মানের জায়গা। আমরা পাশ্চাত্যভাবের ‘হনুকরণ’ (রাজশেখর বসুর ভাষায়) করি না। ভারতীয়ত্ব বজায় রেখে এক ধরনের ‘স্বীকরণ’ করি—জাতীয়তাবাদী মনোভাবের এইটেই ছিল ভঙ্গি। অথচ কোনটা ‘হনুকরণ’ আর কোনটা ‘স্বীকরণ’ এর তো কোনও সর্ববাদিসম্মত সংজ্ঞা ছিল না—হওয়া সম্ভবও ছিল না—ফলে তর্ক হত বিস্তর। উত্তর যাই হোক, ‘ভারতীয়ত্ব’-বিষয়ক প্রশ্নটা তোলাই ছিল জাতীয়তাবাদী মানসিকতার লক্ষণ।

উনিশ শতকে ‘স্বাস্থ্য’, ‘পরিচ্ছন্ন পরিবেশ’ বা ‘চিকিৎসা-বিষয়ে বাংলাভাষায় প্রকাশিত যে-সব পুস্তক-পুস্তিকা দেখেছি, তাতেও জাতীয়বাদের শরীর-ভাবনায় স্ববিরোধী চরিত্র স্পষ্ট। এক দিকে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার ‘স্যানিটেশন’ আন্দোলনের প্রভাবে নানাবিধ মত প্রকাশ পাচ্ছিল, যেমন:

‘শরীরকে সম্পূর্ণরূপে রোগশূন্য করার নাম স্বাস্থ্য।’৪৮

বা:

‘বাটী পরিষ্কার রাখার ভার গৃহস্থের উপর নির্ভর করে, এবং দেশ পরিষ্কারের ভার মিউনিসিপ্যালিটির উপর নির্ভর করে। যখন উভয়ে নিয়মিত যত্ন ও ব্যয় স্বীকার করিয়া নিজ নিজ সীমা পরিচ্ছন্ন রাখিতে পারে, তখন সে-দেশে অপরিচ্ছন্নতাহেতু অনেক রোগও উপস্থিত হইতে পারে না।৪৯

এই মনোভাবে ‘অসুখ’ ‘স্বাস্থ্য’ ইত্যাদি বিষয়ে প্রথাগত চিন্তা ‘কুসংস্কার’ হিসেবে প্রতিভাত হত। যেমন একটি পুস্তিকায় বলা হচ্ছে, যাঁরা মনে করেন

পুরাতন জ্বর, প্লীহা, পাত অর্থাৎ যকৃত, এ সমুদায়ের প্রাদুর্ভাব এক্ষণে যেরূপ দৃষ্ট হয়, পূর্বে সেইরূপ হইত না…কুইনাইনই এই সকল আপদের মূল’, তাঁরা ‘অশিক্ষিত কুসংস্কারাবিষ্ট ব্যক্তি।৫০

অথবা অন্য একটি পুস্তিকায় বলা হল:

কতক লোকে মনে করে অদৃষ্ট দোষে, বা দৈববশত পীড়া হইয়া থাকে, কাজেই নিরুপায়।…অদৃষ্ট বা দৈব টেব কিছু নাই। যখন পীড়া হইবে তখন জানিবে যে কোনো কারণবশত হইয়াছে।৫১

এই সমস্ত রচনায়—যৌক্তিকভাবেই—অনেক দেশাচারের সমালোচনা করা হত। সবটাই ‘জাতীয় উন্নতি’র কথা চিন্তা করে, সন্দেহ নেই। অথচ ‘ইংরাজ জাতির অনুকরণ’ অতিমাত্রিক না হয়, এ-ও ছিল এক দুশ্চিন্তা। ফলত অনেক রচনাতেই চেষ্টা চলেছে। পাশ্চাত্যের চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে আয়ুর্বেদ মেলানোর।৫২

তবে জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ইংরেজ-বিরোধিতার যে-দিক সেটা—স্বাস্থ্যের ও শরীরের প্রশ্নে—স্বভাবতই অনেক বেশি প্রকট হত যাঁদের আমাদের দেশের ‘ট্র্যাডিশনাল ইন্টেলিজেন্টসিয়া’ বলা যায় সেই হাকিম-বৈদ্য-জ্যোতিষীদের রচনায়।৫৩ এঁদের রচনায়ই বারবার ঘুরে ঘুরে এসেছে ‘দেশ কালে’র কথা, ইংরেজের অনুকরণশীলতার বিপদের কথা।৫৪ উনিশ শতকের জাতির ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এঁরাই পাশ্চাত্য-শিক্ষার বিরোধিতা করেছেন, যে-শিক্ষার ‘দেশীয় আহার-বিহারের বিরুদ্ধে অনেক কথা উপদিষ্ট হইয়া থাকে।’ স্বাস্থ্যভঙ্গের বিচারে বলা হয়েছে ‘দেশীয় ভাব, দেশীয় রুচি, দেশীয় প্রকৃতি, দেশীয় আহার, দেশীয় বিহার হারাইয়াছি’, এমনকী ইংরেজ সভ্যতার জীবাণুনাশক যে ‘সাবান’ তার ব্যবহারের সম্বন্ধেও সাবধান করে বলা হয়েছে, যে ‘দেশের অর্থ ভিন্ন দেশে দিতেছি’ ও ‘সাবান তত পবিত্র পদার্থ নহে’।৫৫

প্লেগ-মহামারির যে-ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এক বাঙালি জ্যোতিষী, তাতেও ধর্মচেতনা ও ইংরেজ-বিরোধিতা প্রবল। ‘ভারতবর্ষে মহামারী বা প্লেগ আসিবার কারণ’ সভ্যতা তথা আধুনিক সভ্যতার প্রভাব; বোম্বাই, করাচিতে এর আধিক্য, কারণ’ ‘সমুদ্র’ উপকূলে বৈদেশিক সংমিশ্রণাধিক্যদোষ বর্তমান’।৫৬ প্লেগের টীকা সঙ্গত কিনা’ এই আলোচনায় সরকারের সমালোচনা করে বলা হয়েছে:

টীকা হইলেও যখন সংক্রামক ব্যাধির সংক্রামতা নিবারণ সম্বন্ধে সন্দেহ আছে, বিষ প্রবেশ করাইয়াও যখন সময়, ঋতু, কাল, স্থান ও আত্মদোযহেতু বিষের স্রোত রোধ করা যায় না, তখন টীকা দিয়া নির্দোষ দেহে দোষ সংক্রামণ করা কোন প্রকারেই। যুক্তিসঙ্গত হইতে পারে না।…তোমার প্লেগ, কলেরা প্রভৃতি সংক্রামক ব্যাধির নিশ্চয়াত্মক ঔষধী এ পর্যন্ত ঠিক হইল না, অগ্রেই তুমি তাহার বীজ লইয়া মানবশরীরে বপন করিতে অগ্রসর হইয়াছ!৫৭

এই বিশ্লেষণে মহামারি ভারতবর্ষের ধার্মিক, সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতনের লক্ষণমাত্র, আর এর মূলে বিদেশি শাসনব্যবস্থা:

ভারতবর্ষ এখন আর সেই পূর্বতন ঋষি নির্বাচিত ভারতবর্ষ নাই, ভারতবর্ষ এখন পাপ ও ক্লেদকণায় পরিপূর্ণ হইয়াছে।…বৈদেশিক সংমিশ্রণ দোষ, বেজাতীয় আচার নিয়মানুষ্ঠান, ব্যবহার পরিচ্ছেদের স্বতন্ত্রতা, আহারবিহারাদির অনুচিত ও অস্বাভাবিক সংঘটন, রাজপূজা ও দেশসেবার অভাব, স্বদেশানুকূল আচারনীতির ব্যাঘাত, সভ্যতার অতিচার, সভ্য ভব্যের স্বেচ্ছাচার, দরিদ্রতার প্রাণশোষক আতঙ্ক, আইনকানুনের খর প্রস্রবণের প্রখরভাব, জল বায়ু ও দেশ কাল পাতানুকূল ঔষধী ভাষা ও ক্রিয়াকলাপের পরিত্যজ্যতা, বৈদেশিক লবণ ও চিনির অতি প্রচলন, সাত্ত্বিক। নিরামিষাশী ফলমূলাহারী মনুষ্যের স্বল্পতা, গো-খাদক ও অপশুরভক্ষকজীবীর প্রাধান্য, বৈদেশিক অপ বা ভিন্নযোনিসংসর্গজনিত বর্ণসঙ্করাধিক্য, ভূগর্ভজাত বিষ-তৈল (কেরোসিন), বিষ-কাষ্ঠ (পাথুরিয়া কয়লা) ইত্যাদির অতি প্রচলন; এই সমস্ত বিষম…ক্রিয়া বা বস্তু হইতে ভারতবর্ষের মূল ধ্বংসপ্রায় হইয়াছে। এক্ষণে ভারতবাসী নামে জীবিত মাত্র, বংশে গৌরব মাত্র, স্থানে স্থিতিমাত্র, অস্থিকঙ্কালসদৃশ দণ্ডায়মান রহিয়াছে। কার্যে আর সে পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ নাই—তাই শোক, দুঃখ, অসহনীয় মর্মবেদনা, মহামারী, প্লেগ বা ভুকম্পজনিত অকালমৃত্যুর আধিক্য, ভয় বিভীষিকায় চতুঃদিক আচ্ছন্ন, ভীষণ দুর্ভিক্ষ রাক্ষস তাড়নায় অন্নাভাবে জীর্ণ…।৫৮

এই ‘পাঠটির জাতীয়তাবাদ অনস্বীকার্য, যদিও এতে ব্যক্ত মনোভাব বহুলাংশে ‘আধুনিকতা’র পরিপন্থী। বরং জনসংস্কৃতির আলোচনায় আমরা সংক্রামক ব্যাধি সম্বন্ধে ধারণার নিদর্শন পেয়েছিলাম, এই মনোভাব তার কাছাকাছি (যদিও নিম্নবর্গের কল্পনায় বিমূর্ত ‘ভারত’ চেতনার এত স্পষ্ট অভিব্যক্তি না থাকাই স্বাভাবিক)।

এই সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ও পূর্বের আলোচনার ভিত্তিতে আমার বক্তব্য একটাই। ঔপনিবেশিক ভারতে যে ‘সামাজিক শরীর’ রাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের দ্বারা ‘কুসংস্কারপ্রসূত’ বলে চিহ্নিত হচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে লড়াই করার ও তার পরিবর্তে বুর্জোয়া শরীরবোধকে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ ঔপনিবেশিক ভারতে ছিল না। প্রথমত ‘সামাজিক’ জীবনে রাষ্ট্রের অনুপ্রবেশ-নীতি ছিল মিনিমালিস্ট—পরার্থে নয়, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থচেতনাই ছিল এর সঙ্গে জড়িত।

অপরপক্ষে জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ছিল স্ববিরোধ। ‘আধুনিকতা’র লাগামহীন সাধনাকে মনে হত ‘ইংরেজিয়ানা’র নামান্তর। ইংরেজ শাসনের অপমান যতদিন ছিল, ‘ইংরেজিয়ানা’ ছিল আত্ম-অবমাননার সামিল। সব কিছুতে একটা ‘ভারতীয়’ ভাব বজায় রাখতে পারলে তবেই আত্মসম্মান বাঁচত। ‘পশ্চিমের আমরা অন্ধ অনুকরণ করি না’—এই কথাটা সোচ্চারে ঘোষণা করতে হত নিজেদের কাছে। ‘ভারতীয়ত্ব’ খোঁজার পথ কিন্তু হাজির করত এক ধরনের ‘হিন্দুত্বের দরবারে। ফলে মনের একটা দিক যাকে ‘কুসংস্কার’ বলে খারিজ করেছে, মনের আরেক দিকের প্রয়োজন ছিল তাকেই সাজিয়ে গুছিয়ে, কিছু সংস্কার করে ‘আধুনিকতা’র কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার। আর এ-কথাও মনে রাখা দরকার যে, ইংরেজ-বিরোধী মনোভাবের জন্মের উর্বরক্ষেত্র ছিল তথাকথিত পিছিয়ে পড়া, রক্ষণশীল মতাদর্শগুলোই। এক অর্থে জাতীয়তাবাদী চিন্তাও এই সব জীবনদর্শনের কাছে গভীরভাবে ঋণী।

ফলকথা, ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতি’, ‘উন্নতি’র (অর্থাৎ, বর্তমানে যা ভারতবর্ষে ধনতান্ত্রিক বিকাশের রূপ নিয়েছে) সর্বাঙ্গীণ প্রয়াসের মানসিক ও সামাজিক ক্ষেত্র তৈরি হবার একটি পূর্বশর্ত ছিল। তা হল এলিটের পক্ষে ইংরেজের হাত থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে ছিনিয়ে নেওয়া। একবার ইংরেজ সরাসরি প্রভুত্ব থেকে হটে গেলে তো আর ‘ইংরেজিয়ানা’য় কোনও অপমান নেই—কারণ ওটা আর তখন ‘নকল-নবিশী’ নয়, ওটা বিশুদ্ধ ‘প্রগতি’। ‘ভারতীয়ত্বের’ প্রশ্নটি তাই আর স্বাধীন ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণীর কাছে অত জরুরি নয়। তাছাড়াও ধনতান্ত্রিক বিকাশে ও সেই সূত্রে ‘আধুনিকতা’র শর্তপালনে এই রাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘উন্নতি’র জন্য প্রয়োজন যে জনসংখ্যার ম্যানেজমেন্ট, তা-ও তো রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। তাই ‘স্বাস্থ্য’, ‘শরীর’ ইত্যাদি প্রশ্নে স্বাধীন রাষ্ট্র আর ঔপনিবেশিক সরকারের মতো মিনিমালিস্ট নীতি চলে না। আজ সুদূর গ্রামাঞ্চলেও স্বাস্থ্য-কেন্দ্র, পরিবার পরিকল্পনা-কেন্দ্র, স্বাস্থ্যকর্মীদের দৌলতে কৃষকের চেতনায় আধুনিক শারীরবিদ্যা পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। এই শরীরভাবনাকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে।

অর্থাৎ ‘সামাজিক’ শরীরকে বদলে বুর্জোয়া ‘শরীর’ করার যে ঐতিহাসিক যজ্ঞ, আধুনিক রাষ্ট্রই তার প্রধান হোতা ও ‘আধুনিকতা’র মতাশ্রয়ী শিক্ষিত মানুষেরা তার পুরোহিতশ্রেণী। এর মানে এই নয় যে, ‘সমাজ’-এর যুথবদ্ধতার মতাদর্শ সম্পূর্ণ হটে যাবে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং ‘ফর্ম’-এর সঙ্গে নানান ঐতিহাসিক সমঝোতায় আসবে সে। এ-প্রসঙ্গের বিশদ আলোচনার অবকাশ বর্তমান প্রবন্ধে নেই। তবে আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য পরিষ্কার—‘সমাজ’কে পোষ মানাননা, এবং ‘শরীর’-এর প্রশ্নটিকে ‘সামাজিক’ রাজনীতি বা রাষ্ট্রবিরোধী চিন্তার বাইরে নিয়ে আসা। এ-লড়াই এখনও চলছে। অবশ্য তৃতীয় দুনিয়ায় রাষ্ট্রের নানান গাঁটছড়া বাঁধা থাকে সামন্তশক্তির সঙ্গে, যা স্বভাবতই তার ‘আধুনিকীকরণে’র ক্ষমতাকে অনেকটা দুর্বল করে দেয়। আমাদের পরিবার পরিকল্পনা প্রোগ্রামের ব্যর্থতার দিকগুলিতে ‘শরীর’ নিয়ে এই লড়াইতে রাষ্ট্রের বহুলাংশিক পরাজয়ের ইতিহাস লেখা আছে।

উপসংহার

‘সমাজ’ বস্তুটিকে কোনও রোমান্টিক দৃষ্টিতে উপস্থাপিত করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। ‘সমাজ’-এরও নিপীড়ন ক্ষমতা আছে, যদিও তার পদ্ধতি রাষ্ট্রের নিপীড়নপদ্ধতি থেকে আলাদা। স্মর্তব্য এ-ও যে, এই ‘সামাজিক’ শরীরকে একভাবে ব্যবহার করেই সামন্ততান্ত্রিক শাসন গড়ে উঠেছে। ‘সামাজিক শরীর’-এর যাঁরা তাত্ত্বিক সেই পুরোহিত-জ্যোতিষী-কবিরাজ শ্ৰেণীও সামন্তপ্রভুদের পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত। তাছাড়া মানুষের সভ্যতায় বিজ্ঞানের ও বৈজ্ঞানিক মনের দানও অনস্বীকার্য। আজ নিশ্চয়ই ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে কেউ বসন্ত-কলেরা-প্লেগ-ম্যালেরিয়ার মহামারিতে বেঘোরে মারা পড়তে চাইবেন না। সেটা কাম্যও নয়। তাই ‘সমাজ’কে পুজো করা আমার উদ্দেশ্য নয়।

আমার উদ্দেশ্য ‘স্বাস্থ্য’ ও ‘শরীর’-এর প্রশ্নকে ঘিরে আধুনিক রাষ্ট্র কীভাবে ও কী কারণে তার ক্ষমতার বিস্তার ও ব্যবহার করে, কী ধরনের বিরোধী-শক্তির মোকাবিলা তাকে করতে হয়—তা আলোচনা ও বোঝার চেষ্টা করা। বিজ্ঞানের শক্তি অস্বীকার করা আমার উদ্দেশ্য না হলেও, বিজ্ঞানকে চিরদিন রাষ্ট্রিক এবং/অথবা ধনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বাহন হয়ে থাকতেই হবে, ইতিহাসের এমন কোনও অমোঘ নিয়ম আছে বলে আমার বিশ্বাস নেই। তা ছাড়া রাষ্ট্র ও ধনতন্ত্রের কবল থেকে বিজ্ঞানকে উদ্ধার না করতে পারলে প্রযুক্তির চেহারাটাও বদলাবে না।

রাষ্ট্রের ভিত্তি—লেনিন যেমন বলেছিলেন—সংগঠিত হিংসায়। হিংসার মাধ্যমেই তার জন্ম। নিজেকে বৈধ প্রমাণ করতে তার কতগুলো ‘কল্যাণকর’ মতাদর্শের সাহায্য নিতে হয়। আবার এগুলোই তার হাতে অস্ত্রবিশেষ। অথচ গান্ধীবাদী ভাবেই ভাবুন বা মার্কসবাদী ভাবেই ভাবুন, শেষ বিচারে মানুষের মুক্তি রাষ্ট্রের অবলুপ্তিতে ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে, তাই রাষ্ট্রের ক্ষমতার চরিত্র বোঝা দরকার। এবং তেমনি বোঝা প্রয়োজন ইতিহাসে রাষ্ট্র-বিরোধিতার সূত্রগুলো কোথায়, কারণ একদিন আবার মানুষের মুক্তির কাহিনীর সূত্রপাত সেই সব জায়গা থেকে করতে হবে।

সব শেষে, একটা ইতিহাস লেখার দৃষ্টিভঙ্গির কথা এসে যায়। ১৮৯৭ সালে বোম্বাই-এর সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ সরকারের প্লেগ-নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তার ইতিহাস আজ কেন লিখব? নিছক নিম্নবর্গের বিরোধিতার ইতিহাস লিখতে চাই বলে? সেটা তো পপিউলিজম। মানুষ হাজারো বাধার মধ্যেও তার সংগ্রামী সত্তাকে জিইয়ে রাখে, এই কথাটার পুনঃপ্রচার করতে চাই বলে? সেটা তো হিউম্যানিজম। এর বাইরেও তো একটি ইতিহাস আছে, সেটা শরীর, রাষ্ট্র, ও ‘সমাজ’-এর সংঘর্ষের ইতিহাস। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এই প্রশ্নটিকে নিয়ে আরও একটু ভাবনাচিন্তা করাই এই আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য।

টীকা

Michael Worboys, ‘The Emergence of Tropical Medicine: a Study in the Establishment of a Scientific Speciality’ in Gerard Lemaine et al, eds., Perspectives on the Emergence of Scientific Disciplines (The Hague, 1976), pp. 79-80.

Radhika Ramasubban, Public Health and Medical Research in India: Their Origins under the Impact of British Colonial Policy (Stockholm, 1982).p. 11.

Worboys, ‘Tropical Medicine’,p. 79.

ঐ, পৃ. ৮৫।

David Arnold, ‘Cholera and Colonialism in British India’, Past and Present, No. 113, Nov.1896,p. 127.

Ramasubban, Public Health. pp. 13. 20.

ঐ, পৃ. ১২-১৩।

Arnold, ‘Cholera’, p. 139.

Ramasubban, Public Health, p. 19.

১০ বিষয়টি গবেষণাসাপেক্ষ, ও এ পর্যন্ত কোনও কাজ বিশেষ চোখে পড়েনি। এই প্রসঙ্গে আর একটি প্রশ্নও মনে আসে: ‘ভিড়’ সামলানোর অনেক ‘টেকনিক’ আজ রাজনীতিক গণসভা থেকে পাড়ার পুজো প্যান্ডাল সর্বত্রই ব্যবহৃত হয়; এই ট্রাডিশনের শুরু কি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র- কর্তৃক মেলা-সামলানোর চেষ্টায়? আমরা কি দৈনন্দিনে রাষ্ট্রেরই কতগুলো নিয়ম প্রতিফলিত করি?

১১ Ramasubban, Public Health. pp. 15-16.

১২ দ্রষ্টব্য—David Arnold. ‘Smallpox and Colonial Medicine in Nineteenth-Century India’ প্রবন্ধটি Arnold ed. Imperial Medicine and Indigenous Societies (Manchester 1988) গ্রন্থে প্রকাশিত হয়ছে।

১৩ V.R. Muraleedharan, ‘Some Observations on the Colonial Government’s Response to Changing Medical Views: The Case of Malaria in the Madras Presidency during the Early 1900s’. (Paper pre-sented at a conference on Science under the Raj: India and limperial Expectations 1800-1947. organized by the National Institute of Science, Technology and Development Studies, at Delhi. 9-10 May 1998.

১৪ Dipesh Chakraborty, Rethinking Working-Class History: Bengal 1890-1940 (Princeton, 1986) তৃতীয় পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

১৫ David Arnold, ‘Touching the Body: Perspectives on the Indian Plague, 1896-1900’ in Ranajit Gula ed. Subaltern Sudies. V .(Delhi, 1987) pp.55-90; 1J. Catanach, ‘Plague and the Indian Village, 1896-1914’ in Peter Robb ed…Rural India: Land. Power and Society under British Rule (Delhi, 1986). Pp. 216-43.

১৬ দ্রষ্টব্য Arnold, ‘Touching the Body.’

১৭ Ralph W. Nicholas, The Goddess Sitala and Epidemic Smallpox in Bengal’, Journal of Asian Studies, Vol. XLI, No. 1, Nov. 1981. p. 34.

১৮ প্রসঙ্গত দ্রষ্টব্য—গৌতম ভদ্র, ‘একটি আনুগত্যের দলিল: “কান্তনামা বা রাজধর্ম” ’, আনুষ্টপ,শারদীয় সংখ্যা, ১৯৮৭, পৃ. ২০৫-৩১১।

১৯ Arnold, ‘Cholera’.p 128.

২০ Amrita Bazar Patrika, 2 July 1897.

২১ Arnold, ‘Touching the Body’.P.73.

২২ ঐ।

২৩ ঐ।

২৪ Arnold, ‘Touching the Body’. Pp. 71-3: Caranach, ‘Plague’. pp. 224-5 দ্রষ্টব্য।

২৫ Arnold, ‘Smallpox’, p. 22.

২৬ Catanach, ‘Plague’. p. 229.

২৭ ঐ, পৃ. ২২৮।

২৮ Henry Whitehead, The Village Gods of South India (Calcutta, 1921), pp. 32.38-9.

২৯ ঐ, পৃ. ৫৫-৬১, ৭২-৭৪।

৩০ David Hardiman, The Coming of the Devi: Adivasi Assertion in Western India (Delhi, 1987). pp. 22, 25-6, Arnold, ‘Cholera’. p. 133:Catanach ‘Plague’.P. 229-ও অন্যান্য দ্রষ্টব্য।

৩১ Nicholas, ‘The Goddess Sitala’, p. 37.

৩২ ঐ, পৃ. ৩৯।

৩৩ C.B. Macpherson. The Political Theory of Possessive Individualism: Hobbes to Locke (Oxford, 1985), PP. 137-42.

৩৪ Whitehead, Village Gods, p. 115.

৩৫ Margaret Trawick Egnor. ‘The Changed Mother or what the Smallpox Goddess did when there was more small pox’, Contributions to Asian Studies, vol. 18. 1984, pp. 24-45.

৩৬ দ্বিজ নিত্যানন্দ-প্রণীত গীতছন্দে শীতলার জাগরণ পাল (কলকাতা, ১৮৭৯), পৃ. ৫৪।

৩৭ ঐ, পৃ ৫-৮, ১৪-১৫ দ্রষ্টব্য।

৩৮ Arnold, ‘Cholera’, p. 131; Hardiman, Devi, p. 25.

৩৯ মেদিনীপুরের ১৯৭৮ সালের বন্যার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ে সুন্দর আলোচনা করেছেন। অদিতিনাথ সরকার, ‘The Scroll of the Flood’-নামক একটি এ যাবৎ অপ্রকাশিত প্রবন্ধে।

৪০ এ বিষয়ে সম্প্রতি মনোগ্রাহী আলোচনা করেছেন Peter Stallybrass ও Allan White তাঁদের বই The Politics and Poetics of Transgression (London. 1986). ‘The City: the Sewer, the Gaze and the Contaminating Touch’ শীর্ষক পরিচ্ছেদটিতে।

৪১ ঐ, পৃ. ১২৭।

৪২ গোপালচন্দ্র মজুমদার-সঙ্কলিত ও অনুবাদিত, ইংরাজি টীকাদারগণের প্রতি উপদেশ (কলকাতা, ১৮৭২), পৃ. ৭-৮ পুস্তিকাটির গোড়ায় গোপালবাবু নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘ইংরাজি টিকার সুপারিনটেন্ডন্ট সাহেবের আফিলের প্রধান কর্মচারী’ বলে।

৪৩ এ বিষয়ে আর্নল্ড (‘Touchin the Body’. p. 85-97) ও সুমিত সরকার মন্তব্য করেছেন যে, চিকিৎসা-বিষয়ে গান্ধীর চিন্তা আমাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তার একটি ব্যতিক্রম। প্রণিধানযোগ্য কথা।

৪৪ দ্রষ্টবা—Arnold. ‘Touching the Body’, pp 85-6.

৪৫ ঐ।

৪৬ ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে লেখাজোখা প্রচুর। আমি উপকৃত হয়েছি শ্ৰীমতী অনুরাধা খান্নার সঙ্গে আলোচনায় ও তাঁর দুটি অপ্রকাশিত প্রবন্ধ পড়ে—’Health and Disease. An Interpretation from Ancient Indian Medicine’. ও Theoretical Foundations of Ancient Indian Medicine (with special reference to Charaka Samhita)’। প্রবন্ধ দুটি পড়তে ও ব্যবহার করতে দেবার জন্য আমি শ্রীমতী খান্নার কাছে কৃতজ্ঞ।

৪৭ জগদীশচন্দ্র ঘোষ সম্পা: শ্রীমদ্ভগবদগীতা (কলকাতা, ১৯৬৬), সপ্তদশ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

৪৮ অমৃতলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বাস্থ্যবিধান (হুগলী, ১৮৮৮) পৃ. ১।

৪৯ ঐ, পৃ. ২৫।

৫০ জদুনাথ মুখোপাধ্যায়, বিষমজ্বরে কুইনাইন প্রয়োগ-প্রণালী (কলকাতা, ১৮৭৩), পৃ. ১-২।

৫১ আমার আশ্চর্য বাসগৃহ (কলকাতা, ১৯০২)। শারীরবিদ্যাবিষয়ক এই বইটি ক্রিশ্চিয়ান লিটারারি সোসাইটি-কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল।

৫২ কৌতূহলী পাঠক উদাহরন হিসেবে দেখতে পারেন রাধানাথ বসাক রচিত শরীরতত্বসার (কলকাতা ১৮৬৪) ও রাধিকাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের স্বাস্থ্য-রক্ষা (কলকাতা, ১৮৭০) বই দুটি। তবে এমন বই আরও আছে।

৫৩ অনেকে এদের ইংরেজ-বিরোধিতার মধ্যে শ্রেণীস্বার্থর গন্ধ পান। কথাটা এক অর্থে ঠিক, এবং বলাই বাহুল্য যে ‘আধুনিকতা’ তথা ‘প্রগতি’র প্রকোপের সামনে এঁরা ছিলেন একটি বিপন্ন শ্রেণী। কিন্তু এঁদের স্বার্থের আলোচনা বর্তমান ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। তাছাড়া, মুঘল সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে সিপাহিদের যে ইংরেজ-বিরোধিতা, তা যদি আমাদের জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্যের অংশ হয়, তাহলে হাকিম-বৈদ্যদের তথাকথিত ‘রক্ষণশীল’ কিন্তু ‘পশ্চিম-বিরোধী’ মনোভাবই বা আমাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তার অংশ হবে না কেন?

৫৪ পাঠক দেখতে পারেন, গৌরীনাথ সেন কবিরঞ্জন রচিত শারীরিক স্বাস্থ্যবিধান (কলকাতা, ১৮৬৩) পুস্তিকাটি।

৫৫ গিরীশচন্দ্র সেন কবিরত্ন, স্বাস্থ্য সহায় (কলকাতা, ১৯০৩), পৃ. ৫, ৬, দ্রষ্টব্য।

৫৬ তারিণীপ্রসাদ জ্যোতিষী, প্লেগ-সংহিতা বা আর্য-স্বাস্থ্যবিধান (কলকাতা, [১৮৯৯?]), পৃ. ৪২।

৫৭ ঐ, পৃ. ৪৭-৯।

৫৮ ঐ, পৃ. ৪০।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *