নিম্নবর্গের ইতিহাস – রণজিৎ গুহ

নিম্নবর্গের ইতিহাস – রণজিৎ গুহ

১ ইতিহাসবিদ্যার সংকট ও উচ্চবর্গের ইতিহাস

আমরা ইতিহাসবিদ্যার একটা সংকটের মধ্যে আছি। আমার নিজের পড়াশুনার মূল বিষয় ইংরেজ আমলের ভারতবর্ষ। তাই ইতিহাসবিদ্যা বলতে আমি বোঝাব সেই স্মৃতি বা প্রতীতির কথা যার বিশদ প্রকাশ ওই যুগ প্রসঙ্গে আমাদের মৌখিক বা লিখিত বক্তব্যে। এই ইতিহাসবিদ্যার যে কর্তা তার চৈতন্যের বিশিষ্ট রূপটির নাম হিসেবে ইতিহাসচেতনা শব্দটাও কখনও কখনও ব্যবহার করব। আর সংকট বলতে বোঝাতে চাই সেই বিশেষ অবস্থা যখন যে-কোনও জ্ঞানমার্গে অগ্রগতির তাগিদ—যার উৎস সমাজের প্রয়োজনে বা ব্যক্তির প্রতিভায় বা উভয়ের সমন্বয়ে—যখন সেই তাগিদ ওই জ্ঞানমার্গের তত্ত্ব বা অভ্যাসের পুঁজি দিয়ে আর মেটানো যাচ্ছে না। এই অর্থেই ইতিহাসবিদ্যার একটা সংকটের মধ্যে আমরা আছি।

এই সংকটের একটি প্রধান লক্ষণ আমার আলোচনার বিষয়। কিন্তু সেই বিচারের ভূমিকা হিসেবে এই ইতিহাসবিদ্যার ইতিহাস সম্পর্কে দু-একটি কথা আবার মনে করিয়ে দিতে চাই। আমরা যে ইতিহাস লিখি, পড়ি ও পড়াই, তার উৎপত্তি ইংরেজের ক্ষমতালিপ্সায়। পলাশির যুদ্ধের আগেও আমাদের ইতিহাস লেখা হত। কিন্তু সে ইতিহাসের ধাঁচ ছিল পৌরাণিক, অর্থাৎ যেখানে ঐহিক ঘটনা ও সম্পর্কগুলিকে দেখা হত পারত্রিক ঘটনা ও সম্পর্কের ক্ষণিক ও একান্তই গৌণ প্রতিভাস হিসেবে। যেমন ধরুন, কালকেতু ব্যাধের জীবন একান্ত বাস্তব হওয়া সত্ত্বেও তার স্বাতন্ত্র নেই। তার জীবন নীলাম্বরের স্বর্গচ্যুতির ইতিহাসের এবং তাও আবার পার্বতীর অলৌকিক জীবনী এবং তাঁর পূজার ইতিহাসের একটি অধ্যায় মাত্র—যেন বন্ধনীর মধ্যে বন্ধনী, বৃত্তের মধ্যে বৃত্ত। অবশ্য ঐহিক ইতিহাসের একটি ধারাও ব্রিটিশ রাজত্বের আগে চালু ছিল। আরবি-ফারসি ইতিহাসবিদ্যার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এবং মুঘল বাদশাহের বা তাঁদেরই সমকালীন ছোট-বড়-মাঝারি নানা সামন্ত ভূস্বামীদের আশ্রিত এই ধারাটির উপজীব্য ছিল, এক কথায় যাকে বলা যায় রাজকাহিনী। কাহিনীর নায়করা কখনও দিল্লীশ্বর, কখনও বা কোনও আঞ্চলিক ক্ষুদে ঈশ্বর— কিন্তু ঐতিহাসিকের কাছে তারা সকলেই জগদীশ্বর। তাদের বংশাবলী, দিগ্বিজয় ইত্যাদি ছাড়াও শাসনব্যবস্থা, রাজস্বের হার, ভৌগোলিক তথ্য এবং ওই ধরনের আরও কিছু সাম্প্রতিকতার ছাপ এই জাতীয় ইতিহাসে বিরল নয়। কিন্তু প্রভুর জীবনই যেহেতু প্রজা ও রাষ্ট্রের জীবনের একমাত্র প্রতিভূ, তাঁর প্রতিভা ও কীর্তির ছটায় উজ্জ্বল অথচ সংকীর্ণ ক্ষেত্রটির বাইরে সবটাই অন্ধকার ছিল। তা ছাড়া আরও একটা কথা ভাবতে হবে। রাজরাজড়ার নামাংকিত এই রচনাগুলিকে কি সত্যিই ইতিহাস বলা যায়? এগুলি সমসাময়িক ও আঞ্চলিক তথ্যের আকর সন্দেহ নেই। কিন্তু অতীতকাল সম্পর্কে পরিপ্রেক্ষিতের যে গভীরতা ইতিহাসবিদ্যার প্রধান লক্ষণ তার অভাব এ রচনায় তো খুবই স্পষ্ট। আসলে লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে এই সব রচনা যখনই নেহাৎ সাম্প্রতিকতা বা বর্তমানেরই একান্ত গা-ঘেঁষা অদূরবর্তী অতীতের আওতা ছাড়িয়ে যায়, তখনই তার মধ্যে হয় পৌরাণিক ধরনের অলৌকিকতা এসে পড়ে কিংবা সেই অতীতের গভীরতা কেবলমাত্র সন-তারিখের দ্বারা চিহ্নিত হয়ে ইতিহাসকে পরিণত করে বর্ষপঞ্জীতে।

কিন্তু যে ইতিহাসচেতনায় অতীতকাল শুধু চক্রাকারে ঘোরে কিংবা যার বহতা শুধু সামন্ত শাসকদের অগভীর জীবনযাত্রার খাতেই সীমাবদ্ধ, তা দিয়ে বাণিজ্য-ধনবাদ থেকে শিল্পাশ্রয়ী ধনতন্ত্রে উত্তরণের যুগে কিংবা আরও পরিণত ধনতন্ত্রের যুগে ঔপনিবেশিক রাজ্য শাসনের কাজ চালানো যায় না। কারণ সেই শাসনের বাস্তব ভিত্তি ভারত ভূখণ্ডের যে পণ্য বা কাঁচামাল রপ্তানি করা ও যন্ত্রস্থ করা তার শর্তই হল আর এক ধরনের সময়— যে-সময় সরল রেখায় চলে, যা দিয়ে সদাগরি হাওয়ার সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্যের ছন্দ মেলানো হয় ঔপনিবেশিক যুগের আদিপর্বে, যে-সময়ের কাঁটায় কাঁটায় ল্যাংকাশায়ারের সূতাকলের বাঁশি বাজে, মেশিন চলে, এবং দুনিয়ার প্রথম যন্ত্রসভ্যতায় যে-সময়ের সঙ্গে শিল্প, পুঁজি ও শ্রমের সংগম থেকেই সৃষ্টি হয় এক নতুন ধরনের সময়-কল্পনা যার নাম মেহনতি-সময়।

সময়ের এই নতুন ধারণা যে-ইতিহাসবিদ্যার প্রাণশক্তি, ইংরেজ এদেশে আসার ফলে তা আমাদের চিন্তায় প্রতিষ্ঠিত হল। তবে এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে ভারতে আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার শুরু ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন থেকে নয়, ইংরেজ শাসনব্যবস্থা থেকে—এবং সেই শাসনব্যবস্থা, বলাই বাহুল্য, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের চেয়েও পুরনো। কথাটা একটু জোর দিয়ে বলতে চাই, কারণ একটা কুসংস্কার এক সময় চালু ছিল এবং এখনও হয়তো আছে এই মর্মে যে ইংরেজরা পাশ্চাত্য সভ্যতার আদর্শে আমাদের দীক্ষিত করার জন্যে যে-সব বিদ্যায় উৎসাহ দিয়েছিল ইতিহাসবিদ্যাটাও তার অন্যতম। কথাটা যে একেবারেই ভুল তা কোম্পানির আদিপর্বের নথিপত্র ঘাঁটলেই বোঝা যায়। কারণ পলাশির যুদ্ধের কিছু পরেই যখন বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হবার সম্ভাবনা দেখা দিল—সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটা হয়তো ১৭৬৫ সাল যখন কোম্পানি দেওয়ানি হাতে পেল কিংবা তারও কিছু আগে যখন নবাব তিনটে জেলা (‘সিডেড ডিস্ট্রিকট্‌স’) তাদের দিয়ে দিলেন—তখন থেকেই ভারতবর্ষের ইতিহাস ইংরেজ শাসনের হাতিয়ার হল। কারণ লুঠপাটই যেখানে দেশজয়ের উদ্দেশ্য সেখানে ইতিহাস অবান্তর। গোয়া বা দিল্লির অতীত (বা ভবিষ্যৎ) নিয়ে আলবুকার্ক বা নাদির শার মাথা ঘামানোর দরকার ছিল না। লুঠেরার কাছে বর্তমানটাই একমাত্র সত্য। কিন্তু জয় যখন বিজিত দেশে ক্ষমতা কায়েম করার আকাঙক্ষায় পরিণত হয়, বিজেতাকে তখন ইতিহাসচেতনা ব্যবহার করতে হয় প্রভু সংস্কৃতির একটি প্রধান উপাদান হিসেবে। সব বিজেতার পক্ষেই একথা খাটে, তবে অবস্থা ভেদে ওই চেতনার বিশিষ্ট রূপটি ধরা পড়ে মৌখিক বা লিখিত বক্তব্যে।

অন্যান্য দেশের মতো ভারতবর্ষেও উপনিবেশের পত্তন হয়েছিল পাশ্চাত্য শক্তির অস্ত্রবলের সাহায্যে। কিন্তু ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই এদেশের সেই শিশুরাষ্ট্র তার স্বকীয় ভঙ্গিতে বেড়ে ওঠে। এই স্বকীয়তার নানা দিক ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়েই সেই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস যার অনেকখানিই এখনও গবেষণার বিষয় বলে গণ্য হতে বাকি। বর্তমান প্রসঙ্গে তার শুধু একটি দিকই লক্ষ করতে বলি। তা হল এই যে কোম্পানি আমলের প্রথম পর্বে তার সেনাবলের কথা বাদ দিলে বলা যায় যে ভূমিরাজস্ব এবং দেওয়ানি বিচার সংক্রান্ত শাসনব্যবস্থা ও আমলাতন্ত্রই এদেশে ঔপনিবেশক রাষ্ট্রের মুখ্য অবয়ব হিসেবে গড়ে উঠেছিল। এই অবয়বটি যেমন ইংরেজ রাজশক্তির বিকাশকে ত্বরান্বিত করে তেমনি আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার সূচনা এরই মাধ্যমে। কারণ আগেই বলেছি যে এদেশে পাশ্চাত্য ইতিহাসচেতনাকে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল ‘লিবারল’ আদর্শের উৎসাহে নয়, রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে ও তাগিদে। দেওয়ানি হাতে নিয়েই ইংরেজ টের পায় যে এ দেশের কৃষিব্যবস্থা অতি প্রাচীন, জমির সঙ্গে রাজা ও প্রজার সম্পর্ক এখানে নানা সনাতন প্রথায় নিয়ন্ত্রিত, এবং জমির মালিকানা, ফসলবোনার কায়দা ইত্যাদি সব কিছুই এক সাবেক সংস্কারের অঙ্গ। অতীতকে উপেক্ষা করে এখানে রাজস্ব সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। তাই সে যুগের সরকারি কাগজপত্রে ঐতিহাসিক বিবৃতির অভাব নেই। যাঁরা লালদিঘি ও গোলদিঘি পাড়ায় নথিখানার ধুলো ঘেঁটেছেন তাঁরা সকলেই জানেন এইসব বিবৃতি কত অমূল্য তথ্যে ভরা, কত বিচিত্র বিষয়ে সমৃদ্ধ। প্রাক-ব্রিটিশ, বিশেষ করে মুঘল আমলের রাজ্যশাসন, ভূসম্পত্তির অধিকার, কৃষিব্যবস্থা, বাণিজ্য-ব্যাপার ইত্যাদি, সংক্ষেপে বলতে গেলে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বহু প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা এইসব সরকারি কাগজপত্রে হামেশাই পাওয়া যায়। কেউ যদি বলেন যে এগুলি ঐতিহাসিক তথ্যের আকরমাত্র কিন্তু সত্যিকারের ইতিহাস নয়, তা হলে অবিচার হবে। কারণ যদিও সদ্য প্রকাশিত সবচেয়ে আনকোরা বইটি বা প্রবন্ধটির তুলনায় হয়তো একটু কম পরিপাটি মনে হতে পারে, তবু একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে আঠারো শতকের শেষে বা উনিশ শতকের গোড়ায় লেখা এইসব রচনায় তথ্য ও যুক্তির সমন্বয় এবং কার্যকারণ সূত্রে সাজানো বিশ্লেষণ পদ্ধতির মধ্যে আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার প্রধান গুণগুলি সবই বর্তমান। তবে যে বিশেষ অবস্থায় এই ইতিহাসবিদ্যার উৎপত্তি হয়েছিল তার ফলে এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ—বলা যায় জন্মলক্ষণ—প্রথম থেকেই চোখে পড়ে। তার মধ্যে গুটিদুয়েক বর্তমান প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

প্রথম লক্ষণটি এই যে, এই ইতিহাসবিদ্যার জন্ম এ দেশে ইংরেজ রাজশক্তির ঔরসে এবং ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই তা ঔপনিবেশিক শাসনদণ্ডকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে। যাঁরা এই ধারায় প্রথম ইতিহাস লেখেন তাঁরা সকলেই হয় সরকারি কর্মচারী কিংবা সরকারের প্রসাদপুষ্ট ও ইংরেজ শাসনের সমর্থক বেসরকারি সাহেব মেমসাহেব। তাঁরা যে ইতিহাস লেখেন তার উদ্দেশ্য হয় একেবারে সরাসরি শাসনব্যবস্থার প্রয়োজন সিদ্ধ করা কিংবা বেসরকারি রচনা হলেও কার্যত তার সাহায্যে ব্রিটিশ প্রভুশক্তি ও প্রভুসংস্কৃতিকে আরও জোরদার করা। এমন কী এইসব লেখকরা যখন অতীত বিষয়ক বক্তব্যগুলি রিপোর্ট, মিনিট বা ওই জাতীয় সরকারি নথি হিসেবে না লিখে নিছক ইতিহাস হিসেবেই লেখেন তখনও বিজেতা ও শাসকের দৃষ্টির কাছে ঐতিহাসিকের পরিপ্রেক্ষিত সংকুচিত হয়। উইলিয়াম হান্টারের মতো প্রতিভাবান এবং উদারচেতা ব্যক্তিও এইরকম সংকীর্ণতার উর্ধ্বে নন।

ইতিহাসচেতনায় ঔপনিবেশিক মানসিকতার এই প্রভাব ইতিহাসবিদ্যার চরিত্রে একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। ইউরোপে বুর্জোয়াদের অভ্যুদয়ের সময় এই বিদ্যা তদানীন্তন সমাজে সামন্তশ্রেণীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভুত্বের নির্মম সমালোচনায় ব্যাপৃত ছিল। আঠারো শতকের প্রথমার্ধে আলোকপ্রাপ্তির যুগ থেকে সেই সমালোচনা সামন্তশক্তির তিন প্রধান অর্থাৎ রাজা, জমিদার ও পুরোহিতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং নিরন্তর আক্রমণ চালিয়ে ১৭৮৯ সালের ঐতিহাসিক জয়ের পথ প্রশস্ত করে। অথচ দেখুন, এই ইতিহাসবিদ্যাই যখন একটি পাশ্চাত্য বুর্জোয়া শক্তির মাধ্যমে এদেশে উপনিবেশ গড়ার কাজে ব্যবহৃত হল তখনই তার ভূমিকা পালটে গেল, এমন কী বলা যায় উলটে গেল। কারণ যদিও তা ফরাসি বিপ্লবের বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং তারই পরিণতি জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ ও জাতিভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে প্রেরণা দিয়েছিল পশ্চিম ইউরোপে, ভারতবর্ষের বিশেষ পরিস্থিতিতে তাই হয়ে দাঁড়াল জাতীয় স্বাধীনতার প্রধান অন্তরায় ইংরেজ শাসনের অনুকূল। অর্থাৎ সে। আর তখন প্রভুশক্তির সমালোচক নয়, নতুন ভূমিকায় সে প্রভুশক্তির স্তাবক।

এই ইতিহাসবিদ্যার আর-একটি জন্মলক্ষণ হচ্ছে উচ্চবর্গের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। এই পক্ষপাতিত্ব শাসকদেরই মনোভাবের প্রতিফলন। কারণ ইংরেজদের রাজত্ব যখন শুরু হয় তখন আমাদের সমাজ রীতিনীতি ভাষা ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ে সাড়ে পনেরো আনাই তাদের অজানা ছিল। এরকম একটা অপরিচিত দেশে তার কৃষিব্যবস্থা ও মালিকানার সনাতন ও জটিল রহস্য ভেদ করে সেখান থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করাও সেই বিদেশি রাজশক্তির পক্ষে তখন শক্ত কাজ। তবে আঠারো শতকের ব্রিটিশ সমাজের আদর্শ অনুযায়ী কোম্পানির কর্তৃপক্ষের ধারণা হয় যে, এদেশেও সমাজের প্রধান স্তম্ভ সেইসব সম্রান্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যারা বেশ বড় বড় ভূসম্পত্তির মালিক, এবং তাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হলেই রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনের সমস্যা মিটে যাবে। এইসব তথাকথিত ‘ন্যাচার-লিডার্স’ বা স্বভাবনেতাদের খুঁজে বের করা, তাদের স্বত্ব অধিকার ইত্যাদির সংজ্ঞা ও সীমা নির্ণয়, এবং তাদের পাওনাগণ্ডার হিসেব নিয়ে ঐতিহাসিক আলোচনা সরকারি কাগজপত্রে অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে। এরই ফলে এতদ্দেশীয় উচ্চবর্গের স্বার্থ ও সুবিধা একই সঙ্গে স্বীকৃতি পায় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রনীতিতে এবং ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদ্যায়। ইতিহাসের মুখ্য বিষয় হিসেবে এই উচ্চবর্গের স্থান তখন ইংরেজদের ঠিক পরেই। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল অপেক্ষাকৃত প্রাচীন সামন্তবংশের উত্তরাধিকারী, অনেকে আবার জমিদারি বা অন্য নামে হলেও কার্যত জমিদারি বন্দোবস্তের কল্যাণে কায়েম নয়া-সামন্তশ্রেণীর প্রতিভূ। এরাই স্বভাবনেতার মর্যাদা পেল ভূসম্পত্তি সংক্রান্ত নতুন আইনকানুনের ফলে। আর ঠিক এইভাবেই পাশ্চাত্যে যে ইতিহাসবিদ্যা সামন্তবাদের বিরোধিতায় সক্রিয় ছিল, ঔপনিবেশিক অবস্থায় সে তার মূল চরিত্র পালটে পরিণত হল পরিশ্রমলব্ধ ফসলের উদ্বৃত্তে পুষ্ট এক নয়া-সামন্তশ্রেণীর অনুকূল জ্ঞানকাণ্ডে। ইতিহাসকে এই শ্রেণীর সপক্ষে ওকালতির ভূমিকায় নামাবার জন্যে কতদূর যাওয়া সম্ভব তা যাঁরা ফ্রান্সিস, শোর ও কর্নওয়ালিসের মিনিটগুলির সঙ্গে পরিচিত তাঁরা সকলেই জানেন।

যে দুটি জন্মলক্ষণ বর্ণনা করা হল তা একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে যে আঠারো শতকের যে ইতিহাসবিদ্যা ইংরেজের ক্ষমতালিপ্সার ফলে একটা ঔপনিবেশিক বিদ্যায় পরিণত হয়েছিল, ভারতের বিশেষ অবস্থায়, ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই তার ঝোঁক ছিল উচ্চবর্গের সপক্ষে। আমরা যে ইতিহাস লিখি, পড়ি, পড়াই বা অন্যথা চর্চা করে থাকি তার প্রেরণা সবটাই সেই ইতিহাসবিদ্যার আদিকল্প থেকে পাওয়া। টমাস কুন্‌ দেখিয়েছেন যে এক-একটি ঐতিহাসিক অবস্থায় জীববিদ্যা রসায়নবিদ্যা পদার্থবিদ্যা প্রভৃতি নানা বিষয়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটে এক-একটি আদিকল্পকে আশ্রয় করে। তারই ভিত্তিতে এক-একটি বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠী বা ঘরানা গড়ে ওঠে, তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক চিন্তা ও পরীক্ষা চলে তার আদর্শে রচিত নানা মডেল বা প্রতিকল্পকে কেন্দ্র করে, সেইসব চিন্তা ও পরীক্ষার ফল আবার বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলির (যথা ইনস্টিটিউট, ল্যাবরেটরি, ইউনিভার্সিটি ডিপার্টমেন্ট ইত্যাদির) উদ্যোগে এবং পত্রপত্রিকা, পাঠ্যবই, নানা ধরনের তালিমি-কেতাবের মারফত ওই আদিকল্পটিকেই প্রচার করে বিজ্ঞানের নানা শাখায় বিশেষজ্ঞ ও বিদ্যার্থীদের মধ্যে। তারপর কিন্তু একটা সময় আসে যখন তত্ত্বে ও প্রয়োগে এইসব আন্দোলনের ফলেই সেই একই বিদ্যার ক্ষেত্রে এমন সব নতুন প্রশ্ন ওঠে বা সমস্যা আবিষ্কৃত হয় যার উত্তর বা সমাধান আর প্রতিষ্ঠিত, সর্বসম্মত আদিকল্পটি থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। তখনই সেই পুরনো আদিকল্পে সংকট ঘটে; প্রগতির দাবি মেটাতে পারে না বলেই তার প্রভাব ক্রমে-ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে এবং শেষ পর্যন্ত নতুন প্রশ্নগুলির উত্তর বা উত্তর-খোঁজার পক্ষে অনুকূল আর এক শক্তিশালী নতুন আদিকল্প তার অগ্রজকে হঠিয়ে দিয়ে নেতৃত্বের ভূমিকাকে নামে বিজ্ঞানের সেই বিশেষ শাখায়।

বিজ্ঞানে শুধু নয়, যে কোনও জ্ঞানকাণ্ডেরই অগ্রগতির পথ এইভাবে তার আদিকল্পগুলির আয়ুষ্কাল দিয়ে মাপা যায়। ইতিহাসবিদ্যার ক্ষেত্রেও একথা সত্য। যে-ইতিহাসবিদ্যার সাহায্যে আমরা ঔপনিবেশিক যুগের অতীতকে বুঝতে বা বোঝাতে অভ্যস্ত তারও প্রেরণা আঠারো শতকের ইউরোপ থেকে নেওয়া এবং পরাধীন ভারতের বিশেষ অবস্থায় ঢেলে-সাজা একটা প্রৌঢ় আদিকল্প। ইতিহাসবিদ্যার সংকট বলতে আমি সেই আদিকল্পের সংকটের কথাই বোঝাচ্ছি।

আগেই বলেছি যে এই আদিকল্পটি প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলে ইতিহাসবিদ্যার চালিকা শক্তি আর এক আদিকল্পকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গা দখল করেছিল, আর তখন থেকেই ইতিহাসচেতনা পৌরাণিক কল্পনার স্বর্গ ছেড়ে মাটির পৃথিবীতে নেমে আসে এবং অলৌকিক সময়ের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে ঐহিক সময়ের সহজ রাস্তায় পা চালাবার সুযোগ পায়। ফলেই অতীত ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি ও বাস্তব জীবনের নানা অজানা দিক তখন উদ্ভাসিত হয়েছিল ইতিহাসের আলোকে। এটা যে একটা মস্ত বড় লাভ তা অস্বীকার করার কোনও মানে হয় না। কিন্তু সেই সঙ্গে একথাও মনে রাখা দরকার যে উচ্চবর্গের ইতিহাস সম্পর্কে যে পক্ষপাতিত্ব প্রাক্তন আদিকল্পটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, নতুনটিতে তার কোনও ব্যতিক্রম হল না। শুধু আগে যেখানে ঠাকুরদেবতা ও রাজরাজড়ার লীলাকেই ইতিহাসের মূল বিষয়বস্তু বলে মনে করা হত, এখন তারই বদলে ইতিহাসের পাতা জুড়ে বসল ইংরেজের মাহাত্ম্য ও ইংরেজশাসিত সমাজে যাদের টাকা জমি জাত পেশা বা চাকরির জোর বেশি তাদেরই মাহাত্ম্য। এই মুষ্টিমেয়র ইতিহাসকেই চালানো হল এবং এখনও চালানো হচ্ছে ভারতর্ষের ইতিহাস বলে।

উচ্চবর্গের পক্ষপাতী এই আদিকল্পের প্রভাব ঔপনিবেশিক যুগের ইতিহাস প্রসঙ্গে চিন্তায় ও লেখায় এতই পরিষ্কার যে সে বিষয়ে কিছু বলা বাহুল্য নয় শুধু এই জন্যেই যে, ঝোঁকটা প্রায় সর্বব্যাপী, সুতরাং অতিরেকের বশে সচরাচর চোখে পড়ে না বলেই ধরে নেওয়া হয় ওটা যেন অবিসংবাদী সত্য, যেন তা অতীতের সেই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাটির ধ্রুবগুণগুলির অন্যতম। অথচ ঝোঁকটা ঠিক এইরকম হবার ফলেই ওই অভিজ্ঞতা তার জোর, জটিলতা ও ঘনত্ব অনেকখানি হারিয়ে ফেলেছে ইতিহাসের পৃষ্ঠায়। ইংরেজ আমলের রাজনৈতিক জীবন, বিশেষ করে জাতীয় আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদের সমস্যা নিয়ে যে বিরাট সাহিত্য গড়ে উঠেছে, উদাহরণস্বরূপ তার কথা আলোচনা করলেই আমার বক্তব্য স্পষ্ট হবে।

এই সাহিত্যের প্রায় সবটাই দুটি প্রতিকল্পকে আশ্রয় করে লেখা। দুটিই উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গির বাহন। উভয়েরই প্রতিপাদ্য এই যে সে যুগের রাজনীতি বলতে প্রধানত, এমন কী কেবলমাত্র উচ্চবর্গের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, আদর্শ ও কর্মকাণ্ডকেই বোঝায়, এবং জাতীয়তাবাদ সেই রাজনীতিরই অন্যতম, এমন কী মুখ্য প্রকাশ। তবে মৌলিক সাদৃশ্য সত্ত্বেও এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে অভিন্ন নয়। কারণ উচ্চবর্গের যে অগ্রণী শক্তিগুলির তারা প্রবক্তা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও উপায়ে পার্থক্য, এমন কী অবস্থা বিশেষে দ্বন্দ্বও কখনও কখনও দেখা দিত। এই মৌলিক সাদৃশ্য এবং গৌণার্থে কিছু কিছু বিরোধিতার সমন্বয়ের জন্যেই উচ্চবর্গের পক্ষপাতী চিন্তাধারা দুটি ইতিহাসবিদ্যার ক্ষেত্রে একত্রিত হয়েও তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করে।

প্রথম ধারাটির বৈশিষ্ট্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রশক্তি এবং তারই সহায় ও ফলগত ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির আলোকে ভারতবর্ষের ইতিহাস বিচার করা। এই ধরনের ইতিহাসের চর্চা ও প্রচার হত এবং এখনও হয়ে থাকে ব্রিটিশ লেখক ও বিদ্যাস্থানগুলিরই মাধ্যমে। তবে অন্যান্য দেশে, এমন কী এদেশেও তার অনুকারীর সংখ্যা কম নয়।

এই ধারাটির মূল কথা হচ্ছে এই যে ভারতবাসীর একজাতীয়তা বলতে যা বোঝায় তার বাস্তব সংগঠন ও চৈতন্যরূপ ইংরেজ শাসন, তৎসংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক আদর্শ এবং ব্যক্তিগতভাবে কোনও কোনও শাসকের ও সমষ্টিগতভাবে শাসকগোষ্ঠীরই প্রতিভার ফল। এক ধরনের সংকীর্ণ ব্যবহারবাদী চিন্তায় যেমন সব কিছুই ব্যাখ্যা করা হয় প্রেরণা ও প্রতিক্রিয়ার খেলা হিসেবে, ইতিহাসবিদ্যার এই ধারাটিতেও জাতীয়তাবাদকে ব্যাখ্যা করা হয় এই বলে যে তা শুধু রাজশক্তির প্রয়োজনে সৃষ্ট সুযোগসুবিধা শিক্ষাদীক্ষা আইনকানুন ইস্কুল-আদালত ইত্যাদির প্রেরণায় উৎসাহিত ভারতীয় উচ্চবর্গের আচরণ ও মনোভাবের সমষ্টিমাত্র। এই ব্যাখ্যাটির এক সাবেক সংস্করণে ইংরেজের আমদানি ‘লিবারল’ সংস্কৃতিকেই জাতীয়তাবাদের প্রধান কারণ বলে গণ্য করা হত। তবে এখন সেই দা-কাটা বক্তব্যকে আরও একটু পালিশ করে দেখানো হচ্ছে যে কজনকে বি এ ডিগ্রি দেওয়া হল শুধু তারই ওপর জাতীয়তার প্রসার নির্ভর করে না, ওটা আর এক রকম শিক্ষাপ্রণালী বা লার্নিং প্রসেস-এর ফল। এই প্রণালীটি সম্পর্কে ব্যবহারবাদীরা পরীক্ষানিরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে খাবারের লোভ দেখালে ইঁদুরের মতো জন্তুকেও শিক্ষিত করে তোলা যায়। একটা খাঁচার মধ্যে জটিল ধাঁধার মতো চলাচলের পথ বানিয়ে তার কোনও দুর্গম অংশে একখণ্ড পনীর রেখে দিন। তারপর একটা শাদা ইঁদুর ছেড়ে দিন খাঁচার মধ্যে। কৃষ্ণের জীবটি অবশ্য দু-একবার রাস্তা হারিয়ে ফেলবে, ভুল করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখবেন গোলোকধাঁধার প্যাঁচগুলি বহু চেষ্টায় রপ্ত করে সে ঠিক বুঝে নিয়েছে কেমনভাবে ওই খাদ্যবস্তুর কাছে পৌঁছনো যায়। ইঁদুরের পক্ষে যা সম্ভব তা ভারতবাসীর অসাধ্য হবে কেন? কারণ এই ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী দেখতে গেলে ইংরেজ আসার আগে ক্ষমতা বা রাজশক্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণাচিন্তা যা ছিল তার মধ্যে পলিটিকসের লেশমাত্র নেই, এগুলি নেহাৎ সনাতন সংস্কার মাত্র। তারা এসে তাদের শাসনকে রূপায়িত করল নানা ঔপনিবেশিক সংস্থায়, তা পরিচালনার জন্যে নিয়ম বেঁধে দিল। নিয়ম ভাঙলে কী সাজা হবে তাও ঠিক করে দিল আইনকানুন দিয়ে এবং ওইসব কিছু যাতে উচ্চবর্গের বোধগম্য হয় তার জন্যে একটা সংস্কৃতিকেও চালু করে দিল রাষ্ট্রক্ষমতা কায়েম ও বিস্তার করার উদ্দেশ্যে। এইসব সংস্থা ও তৎসংক্রান্ত সংস্কৃতি যে রাষ্ট্রীয় চিন্তা ও কর্মের উপলক্ষ ও বিষয় তারই নাম পলিটিকস এবং আলোচ্য ধারাটি অনুযায়ী সেই পলিটিকসে উচ্চবর্গের দীক্ষিত হওয়ার প্রণালীটির—‘লার্নিং প্রসেস’টিরই—নাম জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদের এই ব্যাখ্যায় আদর্শনিষ্ঠা ও নিঃস্বার্থ জনসেবার স্থান নেই, আছে শুধু ঔপনিবেশিকতার বরে পাওয়া অর্থ যশ ও ক্ষমতার লোেভ আর সেই লোভের লক্ষ্যগুলিতে পৌঁছনোর জন্যে ইংরেজ ও ভারতীয় উচ্চবর্গের মধ্যে এবং শেষোক্তদের নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা ও সংঘাতের কাহিনীই, এই মতে, জাতীয় আন্দোলনের মূল কথা।

অপরপক্ষে দ্বিতীয় প্রতিকল্পটির ছাঁচে সাজানো ইতিহাসবিদ্যায় জাতীয় আন্দোলনকে উচ্চবর্গের নেতৃত্বে উদ্বুদ্ধ ও চালিত নির্ভেজাল আদর্শবাদী সংগ্রামের চেহারা দেওয়া হয়। এই ধরনের ব্যাখ্যা প্রধানত ভারতীয় ঐতিহাসিকদেরই কাজ, তবে বিদেশে ‘লিবারল’ চিন্তাধারায়ও এর প্রকাশ বিরল নয়। এই ব্যাখ্যায়ও তারতম্য ঘটে। জাতীয় সংগ্রামের নায়ক রূপে উচ্চবর্গের অবদান এতে সর্বস্বীকৃত হলেও সব ব্যক্তি, সংস্থা, নীতি ও তার বিশেষ বিশেষ প্রয়োগ সম্পর্কে মূল্যায়ন সকলের এক রকম নয়। তবে মোদ্দা কথাটা সম্পর্কে দ্বিমত নেই। সে কথাটা হচ্ছে এই যে আমাদের জাতীয় সংগ্রাম উচ্চবর্গের মাহাত্ম্য ও আদর্শনিষ্ঠার কাহিনীমাত্র, এবং এই প্রতিপাদ্যটিকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে ইংরেজের সঙ্গে তাদের সহযোগিতার চেয়ে বিরোধিতার দিকটাই বাড়িয়ে দেখা হয়, শোষক ও উৎপীড়ক হিসেবে তাদের সামাজিক ভূমিকা প্রায় অস্বীকার করেই জনসেবায় তাদের অগ্রণী ভূমিকার কথা বলা হয়, জাতীয় আন্দোলনের রাজনীতি ব্যবহার করে তারা যে রাজদত্ত ক্ষমতা ও সুযোগসুবিধার গৌণ ভাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি মারামারিতে লিপ্ত ছিল সেকথ্য চেপে গিয়ে শোনানো হয় স্বার্থলেশহীন আত্মত্যাগের অলীক রূপকথা। এইভাবেই বুর্জোয়া-জাতীয়তাবাদী ইতিহাসে জনগণের বিশাল আন্দোলনগুলি পরিণত হয়েছে উচ্চবর্গের সংকীর্ণ জীবনবৃত্তান্তে।

এই পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস থেকে অবশ্য অনেক কিছুই শেখার আছে। দেশি ও বিদেশি উচ্চবর্গের নানা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাজকর্ম ও চিন্তাধারা, তাদের ঐক্য অনৈক্য, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি তার চালক ও সহায়কদের মনোভাব, গণজীবন ও গণমত সম্পর্কে তাদের ধারণা ইত্যাদি অনেক তথ্যের আকর এই ভাষ্য। তবে এই ইতিহাস থেকে যা সবচেয়ে শেখার কথা তা হচ্ছে এই যে ইতিহাসচেতনা কখনও শ্ৰেণীচৈতন্যের সীমা অতিক্রম করতে পারে না।

কিন্তু এই ধরনের ঐতিহাসিক চিন্তা ও রচনার মধ্যে যা শিক্ষাপ্রদ তা অস্বীকার না করেও বলা যায় যে তার সাহায্যে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় আন্দোলনের অভিজ্ঞতাকে সমগ্রভাবে বোঝা সম্ভব নয়। কারণ সেই অভিজ্ঞতার অন্যতম এবং মুখ্য উপাদান জনসমাবেশ, যা বলতে আমি বোঝাতে চাই সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও তাদের সমবেত কার্যকলাপের সমন্বয়। এই অর্থে জনসমাবেশ যে কদাচিৎ এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে উচ্চবর্গের প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তি ও সংগঠনের মাধ্যমেই সম্ভবপর হয়েছিল তা যেমন সত্যি, তেমনই একথাও সত্যি যে সেই সমাবেশ অনেকবার এবং বহু ক্ষেত্রেই গড়ে উঠেছিল জনসাধারণের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র উদ্যোগে, এমন কী সচেতনভাবেই ওইসব ব্যক্তি ও সংগঠনের তোয়াক্কা না রেখে, বরং তাদের বিরোধিতা করেই। সেই উদ্যোগের ফলস্বরূপ যে অজস্র জমায়েতের কথা জানা যায় ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধীর আবির্ভাবের আগেই, তার দৃষ্টান্তগুলি না হয় বাদ দিচ্ছি, কারণ অনেকে হয়তো বলবেন যে তার মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রকট ছিল না, যদিও ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ বা ১৮৯৯-১৯০০ সালের বিরসাপন্থী বিদ্রোহের মধ্যে জাতীয়তার অংকুর বা পূর্বাভাস যাঁদের চোখ পড়ে না অথচ সরকারি চাকরির অধিকার নিয়ে উনিশ শতকে উচ্চশিক্ষিতের বিক্ষোভ বা কংগ্রেসের প্রথম দশ বছরের কার্যকলাপে যাঁরা জাতীয়তাবাদের প্রকাশ দেখতে পান, তাঁদের মনশ্চক্ষুতে চাল্‌শে ধরেছে বলতে হবে। তবু এসব কথা আপাতত বাদ দিয়ে যদি ঔপনিবেশিক আমলের সেই পর্বটির কথাই শুধু ধরা যায় যখন জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব একেবারেই সন্দেহের অতীত, তখনও বহু বিরাট আন্দোলন ঘটেছে যার সবটাই বা অনেকখানিই জনসাধারণের স্বতন্ত্র উদ্যোগের দৃষ্টান্ত, যেমন অসহযোগ যুগের কোনও কোনও সমাবেশ, ১৯৪২-এর অগাস্ট সংগ্রাম, কিংবা দেশভাগের পূর্বাহ্নে নৌবিদ্রোহকে উপলক্ষ করে শ্রমজীবী জনতার অভ্যুত্থান।

উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গির বাহন ইতিহাসবিদ্যার সাধ্য নেই যে জাতীয়তাবাদের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটা স্বীকার করে কিংবা ব্যাখ্যা করে। কারণ তা হলেই মেনে নিতে হয় যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু উচ্চবর্গের কৃতিত্ব নয়, এবং সেই অস্বস্তিকর সত্যটা তাদের স্বার্থ ও আদর্শের—ইডিয়োলজির—বলগায় বাঁধা ইতিহাসের সঙ্গে খাপ খায় না। অথচ ওই ধরনের সমাবেশের ব্যাপক ও সংগ্রামী ভূমিকা এতই স্বতঃপ্রকাশ যে তা উপেক্ষা করা চলে না। সুতরাং ওই ইতিহাসে সাক্ষ্যপ্রমাণ সব উড়িয়ে দিয়ে জনসাধারণের যা স্বতন্ত্র সৃজনী প্রতিভার ফল, উচ্চবর্গ তাকে আত্মসাৎ করে চালিয়ে দিচ্ছে নিজেরই চিন্তা ও কাজ বলে। এক কথায়, এই বিদ্যা ভারতবাসীর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার বিস্তার, গভীরতা ও জটিলতাকে উচ্চবর্গের পক্ষপাতী একটা অপ্রশস্ত, অগভীর, অতি সরল কীর্তিগাথায় পরিণত করেছে।

অথচ যে আদিকল্প থেকে এই ধরনের ব্যাখ্যার উদ্ভব হয়েছে, একদা ইতিহাসবিদ্যার প্রগতি ঘটেছিল তারই জোরে। একথা আমি আগেই বলেছি। তারই জোরে তখন ইতিহাসচেতনায় দেবলীলার পরিবর্তে মানুষের ঐহিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং— জের টেনে—শেষ পর্যন্ত একথাও স্বীকৃতি পেয়েছিল যে ভারতের ইতিহাসে কেবল ইংরেজেরই নয়, ভারতবাসীর (যদিও উচ্চবর্গের অন্তর্ভুক্ত মুষ্টিমেয় ভারতবাসীর) অবদানও আছে। সেই ধাক্কার জোরেই তখন অতীতের কত নতুন দরজা খুলে গিয়েছিল, নতুন তথ্যের খনি আবিষ্কৃত হয়েছিল, রাষ্ট্র সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কত নতুন সম্পর্ক উদ্ভাসিত করেছিল আগলভাঙা হঠাৎ আলো। কিন্তু সেই আদিকল্পটি আজ বৃদ্ধ, সে তার সৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা মোটেই নতুন ব্যাপার নয়। এক সময় জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা হত ভূকেন্দ্রিক আদিকল্পকে আশ্রয় করে। কোপারনিকাস তারই ভিত্তিতে এমন সব প্রশ্ন করে বসলেন যে ওই টলেমীয় বিদ্যার সাহায্যে তার উত্তর মেলে না। এইসব নতুন প্রশ্নের চাপেই শেষ পর্যন্ত সেই পুরনো আদিকল্প ভেঙে পড়ল, তার জায়গা জুড়ে বসল সূর্যকেন্দ্রিক আদিকল্প, এবং জ্যোতির্বিদ্যায় মধ্যযুগীয় চিন্তার রাজত্ব শেষ হল। আলেকজন্দর কোয়ারে, টমাস কুন প্রমুখ ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন যে এইভাবেই বিজ্ঞানের এক একটি শাখায় সংকট ঘটেছে যখন প্রতিষ্ঠিত আদিকল্পগুলির নিজ প্রতিভাবলেই এমন সব সমস্যা তৈরি হয়েছে যার সমাধান তাদের তত্ত্ব ও অভ্যাসের অধীন নয়, আর তখনই নতুন কোনও আদিকল্প এসে সেই সংকট সমাধান করেছে।

আমরাও ইতিহাসবিদ্যার একটা সংকটের মধ্যে আছি। কারণ তারই অভ্যাস থেকে এমন সব প্রশ্ন উঠেছে যার উত্তর পুরনো আদিকল্পটি থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। এই প্রশ্নগুলির একটা সম্পূর্ণ তালিকা তৈরি করে শোনাতে গেলে আপনাদের সময় নষ্ট হবে, কারণ তা অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। গবেষকদের জিজ্ঞাস্যের পার্থক্য এবং বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নতুন নতুন প্রশ্ন বা পুরনো প্রশ্নই নতুনভাবে উঠছে ও উঠবে। তবে তাদের প্রবণতায় মোটামুটি মিল আছে। সেই মিলের কথা মনে রেখে তাদের বিষয়বস্তুটির একটি সাধারণ বর্ণনা তৈরি করা যায়। প্রশ্নগুলি প্রায় সবই গড়ে উঠেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসাকে ঘিরে। জিজ্ঞাসাটা এই: আমাদের জাতীয়তার আন্দোলনে রাজনৈতিক সমাবেশের চরিত্রটা কী ছিল? বিষয়টা নতুন নয়, কারণ প্রচলিত ইতিহাসবিদ্যার পক্ষেও তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যা একেবারেই নতুন তা হচ্ছে প্রচলিত উত্তরগুলি সম্পর্কে সাম্প্রতিক ইতিহাসচেতনার অসন্তোষ এবং সেই অসন্তোষেরই পরিণতি হিসেবে একদা-অপাংক্তেয় তথ্যকে সম্মানিত করা ঐতিহাসিক বক্তব্যের মধ্যে, ওই কারণেই এতদিন যা বিশ্লেষণের নিঃসংশয়িত পদ্ধতি বলে গণ্য হত তাকে আবার যাচাই করে নেবার চেষ্টা, আর সবচেয়ে বড় কথা—ঔপনিবেশিক যুগের ইতিহাসকে বিচার করা নতুন তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে।

দু-একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে কথাটা হয়তো আরও পরিষ্কার করে বলা যায়। যেমন একথা যদি সত্যি হয় যে ভারতবাসীর রাজনৈতিক চেতনার উৎপত্তি হয়েছিল ইংরেজের শাসনব্যবস্থা থেকেই এবং তার বিকাশ ঘটে ওইগুলিকে আশ্রয় করেই, তাহলে দেশীয় রাজ্যে প্রজা-আন্দোলন হয়েছিল কোন প্রেরণায়? সেখানে তো অভ্যন্তরীণ, বিশেষ করে গ্রামীণ, শাসনসংস্থায় ইংরেজরা হাত দেয়নি। কিংবা যদি উচ্চবর্গের প্রতিভাই জাতীয়তাবোধ ও জাতীয় আন্দোলনের একমাত্র কারণ হয়ে থাকে তাহলে তাদের প্রতিনিধিস্থানীয় সংগঠন বা ব্যক্তির সর্দারি ছাড়াও, এবং তাদের নেতৃত্ব ও পরামর্শ উপেক্ষা করেই যে সব ঐতিহাসিক গণসমাবেশ ঘটেছিল তার ব্যাখ্যা কেমন করে হয়? উচ্চবর্গের উদ্যোগসিদ্ধ খাড়াখাড়ি সমাবেশই যদি গণ-আন্দোলনের একমাত্র বাহন হয়ে থাকে, তা হলে নিম্নবর্গের মধ্যে ক্ষমতা ও মর্যাদায় সমকক্ষ শ্রেণী গোষ্ঠী জাতি বা সমূহ যে নিজেদেরই উদ্যোগে বারবার সামিল হয়েছে আড়াআড়ি সমাবেশে তার তাৎপর্য বোঝার উপায় কী? এই যে লাখলাখ লোক জেল পুলিশ কালাপানি ফাঁসি নিদেনপক্ষে বেকারি ও অন্নাভাবের অনিবার্য সম্ভাবনা সত্ত্বেও সাড়া দিয়েছিল দেশের ডাকে, আসলে কি তারা সকলেই বা অধিকাংশই নেমিয়ার-বর্ণিত পিঁপড়ের মতো রাজদত্ত সুযোগ-সুবিধার মধুভাণ্ডের দ্বারাই শুধু আকৃষ্ট হয়েছিল? নিঃস্বার্থ আদর্শের কণামাত্রও কি নেই তাদের চৈতন্যে? তাদের সেই চৈতন্য কি নিষ্প্রাণ ও স্থূল জড়পিণ্ড মাত্র যার আলো সবটাই ধার করা উচ্চবর্গের জীবন্ত ও প্রখর চৈতন্য থেকে, পৃথিবীর আলো যেমন ধার করা সূর্য থেকে? যদি তা সত্য না হয়, যদি নিম্নবর্গের চৈতন্যকে একটি স্বতন্ত্র সত্তা বলে স্বীকার করা হয়, তাহলে তার বৈশিষ্ট্য কী এবং উচ্চবর্গের চিন্তাভাবনা, আদর্শ ও মানসিকতার সঙ্গে তার সংঘাত ও সমঝোতা—এক কথায়, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক—বুঝব কোন তত্ত্ব বা বিশ্লেষণ পদ্ধতির সাহায্যে?

এইসব প্রশ্ন উঠছে প্রচলিত আদিকল্পটির অভ্যাস থেকেই, অথচ তার সাধ্য নেই এগুলির উত্তর দেয়। এইটাই সেই আদিকল্পের সংকট। এই সংকটের নানা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে ইতিহাসবিদ্যায়। লক্ষণ শুধু এই নয় যে নতুন সমস্যাগুলির মুখোমুখি হয়েও তা সমাধান করতে পারছেন না বলেই উচ্চবর্গের মুখপাত্ররা আগের চেয়েও বেশি তারস্বরে বলার চেষ্টা করেছেন যে ঔপনিবেশিক যুগের রাজনীতি ও জমায়েতের অভিজ্ঞতা সবটাই দেশি বা বিলিতি বুর্জোয়াদের কৃতিত্ব। লক্ষণ আরও এই যে এমন কী যাঁরা জাতীয়তাবাদে ও জাতীয় আন্দোলনে নিম্নবর্গের ভূমিকা সত্যিই বুঝতে ও বর্ণনা করতে চান, সেই সব লেখক ও গবেষকও অনন্যোপায় হয়ে উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গিতেই শরণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন এবং সমাজের নীচের তলার স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সমাবেশগুলিকেও দলাদলি বা খাড়াখাড়ি জমায়েতের গতানুগতিক ছকে সাজাবার চেষ্টা করছেন। প্রচলিত আদিকল্পটি দেউলে হয়ে গেছে বলেই নিম্নবর্গের চৈতন্যের সুস্থ প্রকাশ বিদ্রোহী সমাবেশগুলি যেমন ঐতিহাসিক বক্তব্যের মধ্যে তাদের স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না, তেমনি জাতপাতের ঝগড়া ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তার অসুস্থ প্রকাশকেও গণসমাবেশেরই আর একটি চেহারা বলে স্বীকার না করে চালানো হচ্ছে কেবলমাত্র ইংরেজেরই ভেদনীতির কুফল বলে। তার্থাৎ আবার সেই একই কথা—নিম্নবর্গের মানুষের চেতনায় স্বকীয়তা বলে কিছু নেই: তার মধ্যে যেটুকু ভাল মন্দ তার সবটাই যথাক্রমে দেশি ও বিদেশি উচ্চবর্গের কাছ থেকে পাওয়া।

উচ্চবর্গের পক্ষপাতী এই ইতিহাসবিদ্যার সংকট থেকে বেরোতে হলে সমালোচনা দিয়েই শুরু করতে হবে। সমালোচনাই নতুন পথ খোঁজার উপায়। আমি খোঁজার কথাই বলছি, পৌঁছনোর কথা নয়। কারণ পৌঁছে যাব শুধু তখনই যখন একেবারে নতুন কোনও আদিকল্পকে বসানো যাবে পুরনোটির জায়গায়। এই ধরনের পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ শুধু নয়, অনেক এগনো-পেছনো, হারিয়ে যাওয়া, হোঁচট খাওয়া তার স্বভাবসিদ্ধ, এবং সেজন্যেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে আকস্মিকতার অভাব নেই। সুতরাং এই পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ একেবারে নির্ভুলভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা অবান্তর হবে। তবে যে-সংকটের কথা এতক্ষণ আলোচনা হল তার লক্ষণগুলি মনে রেখে বলা যায় যে ইতিহাসবিদ্যাকে ঢেলে সাজাতে হলে নিম্নবর্গের দিকে চোখ ফেরাতে হবে, ঔপনিবেশিক ভারতের সমাজ সংস্কৃতি অর্থনীতি এবং সব কিছুরই ওপরে রাজনীতিতে তাদের বিশিষ্ট ভূমিকা কী ছিল তা নির্ণয় করতে হবে, সেই উদ্দেশ্যেই নতুন তথ্য খুঁজতে ও পুরনো তথ্যকে নতুনভাবে পড়তে হবে, দরকার হলে বিশ্লেষণের পুরনো কায়দা ছেড়ে নতুন কায়দা তৈরি করে নিতে হবে, আর এই সব কিছুকে সম্ভব করার জন্যেই তথ্যাশিত অভ্যাসের সঙ্গে মেলাতে হবে তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি।

২ নিম্নবর্গের রাজনীতি ও ইতিহাসবিদ্যার দায়িত্ব।

উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গ বলতে কী বোঝায়, এ-পর্যন্ত তার কোনও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করিনি। তবু এই শব্দ দুটি যে ঔপনিবেশিক সমাজের মধ্যে একটা মৌলিক ভেদের স্থূল সংকেত হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে, সে বিষয়ে কারও ভুল হবার কথা নয়। আমার বাকি বক্তব্যের প্রস্তাবনা করছি ওই দুটি শব্দের সংজ্ঞা দিয়ে।

উচ্চবর্গ বলতে আমি বোঝাতে চাই তাদেরই, ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে যারা প্রভুশক্তির অধিকারী ছিল। প্রভুস্থানীয়দের দু-ভাগে ভাগ করা যায়—বিদেশি ও দেশি। বিদেশি প্রভূগোষ্ঠীর মধ্যে যারা এই সংজ্ঞাসম্মত তারাও দু-ধরনের—সরকারি ও বেসরকারি। সরকারি বলতে গণ্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অভারতীয় কর্মচারী ও ভৃত্য সকলেই; আর বেসরকারি বলতে গণ্য বিদেশিদের মধ্যে যারা শিল্পপতি, বণিক, অর্থব্যবসায়ী, খনির মালিক, জমিদার, নীলকুঠি চা-বাগান কফিক্ষেত বা ওই জাতীয় যে সব সম্পত্তি প্লান্‌টেশন প্রণালীতে চাষ করা হয় তার মালিক ও কর্মচারী, খ্রিস্টান মিশনারি, যাজক, পরিব্রাজক ইত্যাদি।

দেশি প্রভুগোষ্ঠীর মধ্যেও একটা মোটা ভাগ ছিল সর্বভারতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থের পার্থক্য অনুযায়ী। সর্বভারতীয়দের গণ্য বৃহত্তম সামন্ত প্রভুরা, শিল্পে ও বাণিজ্যে লিপ্ত সবচেয়ে শক্তিমান বুর্জোয়ারা এবং ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রে বা শাসনযন্ত্রের অন্যত্র যারা ছিল সবচেয়ে উচ্চপদের অধিকারী।

দেশি প্রভুগোষ্ঠীর আঞ্চলিক বা স্থানীয় প্রতিনিধিরাও আবার দু-রকমের। এক রকম হচ্ছে তারাই যারা আসলে সর্বভারতীয় প্রভুগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ বিশেষ অবস্থায় ক্ষমতবিন্যাসের আঞ্চলিক বা স্থানীয় উপাদান হিসেবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এক রকম হচ্ছে তারা যাদের প্রভুত্ব ষোলো আনাই আঞ্চলিক বা স্থানীয়, কিংবা যারা অন্য সব অর্থে প্রভুগোষ্ঠীর মধ্যে গণ্য না হলেও আঞ্চলিক বা স্থানীয় অবস্থায় প্রভুগোষ্ঠীর স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কাজ করে, নিজেদের সামাজিক সত্তার ধর্ম অনুযায়ী কাজ করে না।

এই শেষোক্তদের, অর্থাৎ দেশীয় প্রভুগোষ্ঠীর স্থানীয় বা আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের সম্পর্কে একটা কথা কিন্তু খুব স্পষ্টভাবে মনে রাখা দরকার। কথাটা এই যে সামগ্রিক ও শুদ্ধ অর্থে উচ্চবর্গের এই অংশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার অসমতা, এবং সেই অসমতার কারণ দ্বিবিধ: এক—সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের আঞ্চলিক বৈষম্য; আর দুই—এই অংশটির সামাজিক গড়নের সাংকর্য, অর্থাৎ তার অন্তর্ভুক্ত উপাদানগুলির মধ্যে গুণগত পার্থক্য। এই দ্বিবিধ অসমতার ফলেই যে-শ্রেণী বা সমূহ এক অঞ্চলে প্রভুস্থানীয় বলে গণ্য তারাই আবার অন্যত্র আর এক প্রভুগোষ্ঠীর অধীন। একাধারে প্রভুত্ব ও অধীনতার প্রতীক বলেই তাদের মানসিকতা, রাজনৈতিক আদর্শ ও আচরণ, সখ্য ও শত্রুতার ঝোঁক বা তাৎপর্য সবক্ষেত্রেই এক নয়, বরং অর্থ ও উদ্দেশ্যের নানারকম স্ববিরোধিতায় তা প্রায়শই অস্পষ্ট ও জটিল হয়ে দেখা দেয়। ঔপনিবেশিক যুগে ভূস্বামীদের মধ্যে যারা নিঃস্ব হয়ে পড়ে, গ্রামভদ্রদের মধ্যে যারা আর্থিক বা সামাজিক ক্ষমতায় একটু খাটো, মাঝারি কৃষকদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত ওপরের দিকে এবং ধনী কৃষকশ্রেণী—এরা সকলেই আমার সংজ্ঞার শুদ্ধ অর্থে নিম্নবর্গের অন্তর্গত হলেও বহুক্ষেত্রেই অবস্থার চাপে ও চৈতন্যের অন্তর্দ্বন্দ্বে উচ্চবর্গের সপক্ষে কাজ করে। আদর্শের বিশুদ্ধতা থেকে বাস্তবের এই বিচ্যুতি ও তারই পরিণামে যে ঐতিহাসিক জটিলতার সৃষ্টি হয় তার সন্ধান, বিশ্লেষণ ও বর্ণনাই গবেষণার দায়িত্ব।

ঔপনিবেশিক ভারতে যারা এই সংজ্ঞা অনুযায়ী উচ্চবর্গের অন্তর্গত, সমগ্র জনসংখ্যা থেকে তাদের বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে তারাই নিম্নবর্গ। এর মধ্যে শহরের শ্রমিক ও গরিব, সর্বোচ্চ পদের আমলাদের বাদ দিয়ে মধ্যবিত্তের বাকি অংশ, গ্রামের ক্ষেতমজুর, গরিব চাষি ও প্রায়-গরিব মাঝারি নিম্নবর্গের মধ্যে গণ্য। তা ছাড়াও এই সংজ্ঞার শুদ্ধ অর্থে গণ্য হবে নির্বিত্ত ভূস্বামী, অপেক্ষাকৃত হীনবল গ্রামভদ্র, অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন মাঝারি কৃষক এবং ধনী কৃষকরাও—যদিও, একটু আগেই যেমন বলেছি, এদের ভূমিকা স্পষ্ট নয় বরং দোটানায় জটিল এবং বাস্তবে এরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের সামাজিক সত্তার নিয়ম অনুযায়ী কাজ না করে উচ্চবর্গের স্বার্থ অনুযায়ী চলে।

আমার বক্তব্য থেকে একথা হয়তো এতক্ষণে পরিষ্কার হল যে উচ্চবর্গ নিম্নবর্গের বৈপরীত্য ব্যবহার করে ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষে ক্ষমতাবিন্যাসের মূল সূত্রটি সম্পর্কে একটি বিশেষ ধারণায় আমি পৌঁছতে চাই। এই বৈপরীত্যের ওপর জোর দিয়ে ঔপনিবেশিক যুগের ইতিহাস ব্যাখা করার চেষ্টা প্রয়োজন মনে করি এই জন্যে যে প্রচলিত বিশ্লেষণ-পদ্ধতিগুলির সাহায্যে তখনকার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে সমগ্রভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়, এবং সম্ভব নয় বলেই নিম্নবর্গের ভূমিকা উপেক্ষিত হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিগুলি দু-ধরনের: তাদের মধ্যে একটিকে বলা যায়। মোটা কায়দা, অন্যটিকে মিহি কায়দা।

মোটা কায়দার বিশ্লেষণে শুধু ইংরেজ ও ভারতীয়দের সম্পর্কটাই রাজনীতির বিষয় বলে স্বীকৃত হয়। ফলে ঐতিহাসিক যদি বিদেশি উচ্চবর্গের পক্ষপাতী হন তা হলে ওই যুগের অভিজ্ঞতা শাসকদের অভিজ্ঞতায় আত্তীকৃত হবে, আর তিনি যদি দেশি উচ্চবর্গের পক্ষপাতী হন তা হলে তা আত্তীকৃত হবে জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের চিন্তায় ও কাজে। উভয়তই নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক চেতনা ও কর্মের কোনও স্বীকৃতি নেই।

মিহি কায়দার বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য জাতি ও শ্রেণীগত সম্পর্ক বিচার করা। সমাজের নীচের তলার বাস্তব অবস্থা বোঝার পক্ষে মোটা কায়দার চেয়ে এটি অনেক বেশি কার্যকর। কিন্তু ঔপনিবেশিক যুগের রাজনীতি সম্পর্কে কোনও সামগ্রিক ধারণা তৈরি করা সম্ভব নয় কেবলমাত্র জাতভেদ ও শ্রেণীভেদের ভিত্তিতে। কারণ বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের ফলে জাতে-জাতে ও শ্রেণীতে-শ্রেণীতে পারম্পরিক সম্পর্কের চেহারাটা সর্বত্রই এক রকমের নয়। এই অবস্থায় বিশ্লেষণের কাজ যদি ক্ষমতাবিন্যাসের একটি সাধারণ সূত্র আশ্রয় না করে এগোয় তা হলে জাতনির্ণয় ও শ্ৰেণীনির্ণয় যতই সূক্ষ্ম ও চুলচেরা হবে, ঐতিহাসিক বিবৃতি ততই বিব্রত হবে অনাবশ্যক তথ্যের বহুলতায় এবং শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি হবেই একরকম অনেকত্ববাদী বা প্লুরালিস্ট বর্ণনায় যা আসলে অতীতকে সম্যক বোঝার দায়িত্ব এড়াবার নামান্তর মাত্র।

সুতরাং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির উপায় হিসেবে এমন একটা মৌলিক ও কেন্দ্রীয় ধারণা তৈরি করে এগোতে হবে যা দিয়ে ক্ষমতাসূচক সব সম্পর্কই বোঝা বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব, যা শ্ৰেণীসম্পর্ক-জাত সম্পর্ক, শাসকশাসিতের সম্পর্ক ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ সম্পর্ক থেকে ভিন্ন প্রকৃতির অথচ ওই সম্পর্কগুলি সবই যার অন্তর্নিবিষ্ট। উচ্চবর্গ নিম্নবর্গের বৈপরীত্য এই রকমই একটা কেন্দ্রীয় ধারণা। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ও সমাজে এমন কোনও অভিব্যক্তি নেই যা এই দ্ব্যণুক সম্বন্ধ দিয়ে বোঝা বা বোঝানো যায় না। জাত শ্রেণী সম্প্রদায় ও অন্যান্য সমূহের নানা অংশের মধ্যে, রাজাপ্রজা স্ত্রীপুরুষ জ্যেষ্ঠকনিষ্ঠ প্রভৃতির মধ্যে, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের সর্বত্র ক্ষমতাবৈষম্য সেই বৈপরীত্যের বিশেষ বিশেষ প্রকাশ। এবং তা যেমন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রকট, আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও তেমনি। এক কথায়, যুক্তিসিদ্ধ এবং প্রয়োগে নমনীয় বলেই, অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্য ও সামান্যতা উভয়কেই বোধগম্য করতে পারে বলেই এই ধারণাটি এত শক্তিশালী।

এই বৈপরীত্যের কথা মনে রাখলে ঔপনিবেশিক আমলের রাজনীতি সম্পর্কে একটা প্রচলিত এবং প্রায় স্বতঃসিদ্ধ বলে স্বীকৃত বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে। বিশ্বাসটা এই যে ভারতের রাজনৈতিক জীবনের সবটাই একটিমাত্র উপাদানে তৈরি, সেই উপাদান ইংরেজ-প্রবর্তিত উদারনৈতিক শিক্ষাসংস্কৃতি থেকে নেওয়া বা তারই প্রত্যক্ষ ফল, এবং ওই রাজনীতির ক্ষেত্রটি অখণ্ড। ইতিহাসের সব ব্যাখ্যাতেই—তা ঔপনিবেশিকতার পক্ষপাতী হোক কিংবা জাতীয়তাবাদের পক্ষপাতী হোক—সব ব্যাখ্যাতেই এই কথাটা অবিসংবাদী বলে অনুমিত হয় এবং এটাকে সত্য বলে ধরে নিয়েই বক্তব্য সাজানো হয়ে থাকে।

কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা যাবে যে বিশ্বাসটা অমূলক। কারণ ইংরেজ আমলের ইতিহাস উচ্চবর্গের রাজনীতির পাশাপাশি আর একটি রাজনীতির অস্তিত্ব এতই স্পষ্ট যে সে বিষয়ে ভুল হবার উপায় নেই। সেই রাজনীতির ক্ষেত্রে নিম্নবর্গই নায়ক, উচ্চবর্গ নয়; নিম্নবর্গের প্রতিভাই সেই রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত সব চিন্তা ও কাজের চালিকা শক্তি। এক কথায়, তা রাজনীতির একটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্র। ক্ষেত্রটির বৈশিষ্ট্য, তার ঐতিহাসিক উৎপত্তি, সমাবেশের চরিত্র, আদর্শরূপ ও বাস্তব ভিত্তি অনুযায়ী সংক্ষেপে বর্ণনা করছি।

প্রথম বৈশিষ্ট্য এই যে এই রাজনীতির মূল উপাদানগুলি ইংরেজ রাজত্ব শুরু হবার আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, কিন্তু সেই অর্থে সনাতন হলেও প্রাকব্রিটিশ যুগের উচ্চবর্গীয় রাজনীতির মতো তা ঔপনিবেশিক অবস্থার চাপে নষ্ট বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। বরং নতুন অবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে এবং তারই মধ্যে চেতনা ও ব্যবহারের নানা দ্বন্দ্বের ফলে আকারে ও গুণে কিছু নতুনত্ব নিয়ে তা ঔপনিবেশিক আমলের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করে গেছে—এবং এখনও বোধ হয় কাজ করে যাচ্ছে (যদিও স্বাধীন ভারতের কথা আমি বর্তমান আলোচনার বাইরে রাখতে চাই)। মোটামুটি বলা চলে যে, ঐতিহাসিক উৎপত্তি ও বিকাশের দিক থেকে বিচার করলে নিম্নবর্গের রাজনীতির ক্ষেত্রটি পুরনো হয়েও আধুনিক এবং উচ্চবর্গের রাজনীতির তুলনায় তার পরিপ্রেক্ষিতের গভীরতা ও তার সত্তার ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি।

এই রাজনীতির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য নিম্নবর্গের সমাবেশের কায়দায় ও চরিত্রে। উচ্চবর্গের উদ্যোগজাত সমাবেশকে যদি খাড়াখাড়ি বলে বর্ণনা করা যায় তাহলে নিম্নবর্গের উদ্যোগজাত সমাবেশকে আড়াআড়ি বলে বর্ণনা করা চলে। ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার জন্য ইংরেজরা যেসব সংস্থা এদেশে চালু করেছিল এবং প্রাক্‌-ঔপনিবেশিক আমলে সামন্তশাসনের সহায়ক যেসব সংস্থা তখনও একান্ত অকেজো হয়ে যায়নি, সেগুলিই ছিল খাড়াখাড়ি সমাবেশের উপায়। কিন্তু আড়াআড়ি সমাবেশের প্রধান উপায় নিম্নবর্গের সমাজে কুটুম্বিতা ও আঞ্চলিকতার প্রত্ন বিধিব্যবস্থা কিংবা শ্রেণীসংস্থা বা এই দুই-এর নানারকম সমন্বয়। উচ্চবর্গের জমায়েতের ঝোঁক প্রধানত ছিল আইনের মধ্যে থেকে বরং আইনকে আশ্রয় করেই কাজ চালানো, আইনভঙ্গের মধ্যে যথাসাধ্য লিপ্ত না হওয়া; নিম্নবর্গের জমায়েত যথাসম্ভব আইনসংগত রাস্তা ধরে এগোত ঠিকই, কিন্তু প্রয়োজন হলে তা বেআইনি এমনকি হিংসাত্মক হয়ে উঠত অপেক্ষাকৃত সহজে এবং আরও তাড়াতাড়ি—তাই এই জমায়েত উচ্চবর্গের কাছে অনেক সময়েই খুব অপ্রত্যাশিত ও স্বতঃস্ফুর্ত মনে হত। ঔপনিবেশিক যুগে নিম্নবর্গের এই জমায়েতের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও শক্তিশালী রূপ দেখা যায় তৎকালীন কৃষকবিদ্রোহগুলিতেই। শহুরে মধ্যবিত্ত, শ্রমিক বা অন্যান্য গরিব জনতার সমাবেশেও তখন ওই প্রকার বিদ্রোহী কৃষক জমায়েতের আদিকল্পটির বহু লক্ষণ স্পষ্টই চোখে পড়ে। উচ্চবর্গের পক্ষপাতী ইতিহাসবিদ্যার পক্ষে নিম্নবর্গের জমায়েতের এই বৈশিষ্ট্যগুলি স্বীকার করা সম্ভব নয়, কারণ করলেই যে-আদিকল্পটি সেই ইতিহাসবিদ্যার ভিত্তি তাকে অস্বীকার করতে হয়।

এই রাজনীতির তৃতীয় বৈশিষ্ট্য আদর্শগত। নিম্নবর্গের সামাজিক সত্তা যে সব উপাদানে তৈরি তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা, চৈতন্যের স্তর ও রাজনৈতিক লক্ষ্য সব ক্ষেত্রে সমান নয়। তাই তাদের আদর্শগুলির মধ্যে অমিল, এমন কি পরস্পরবিরোধিতাও ছিল, এবং তারই ফলে সেই রাজনীতির সামগ্রিক আদর্শের চেহারাটা অবস্থাভেদে এক-এক রকমের হয়ে দেখা দিত। মোটামুটি বলা চলে যে, কোনও পরিস্থিতি বা ঘটনার মধ্যে এই রাজনীতির এক বা একাধিক উপাদান যখন অন্য উপাদানগুলির চেয়ে বড় হয়ে উঠত তখন তারই প্রভাবে অন্তত সাময়িকভাবে সেই রাজনীতির আদর্শগত গুণ ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হত। ফলেই অবস্থাভেদে এই আদর্শের নানান ধারার মধ্যে কিছু কিছু প্রকারভেদ ও অসমতা লক্ষ করা যায়। তবে অসমতা সত্ত্বেও যা সর্বত্র প্রকট তা হচ্ছে উচ্চবর্গের প্রতি আনুগত্য ও বিরোধিতার সমন্বয়। এই দুটির আপেক্ষিক গুরুত্বেও আবার তারতম্য ছিল, কিন্তু বিরোধিতা যখন আনুগত্যকে ছাড়িয়ে যেত তখনই নিম্নবর্গের রাজনীতির মৌলিকতা এবং উচ্চবর্গের রাজনীতি থেকে তার পার্থক্য সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠত।

এই রাজনীতির চতুর্থ বৈশিষ্ট্যটির মূলাধার প্রকৃতির দেওয়া ও মানুষের তৈরি সেই বাস্তব অবস্থা যা দিয়ে নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা, তাদের কায়িক ও মানসিক শ্রমের সংগঠন, এবং সর্বোপরি জীবিকা ও শ্রমের শর্তস্বরূপ শোষকশোষিতের ক্ষমতাগত সম্পর্কগুলি নির্ধারিত হয়। উচ্চবর্গের ইতিহাসবিদ্যায় এই সবকিছুই একটা সংকীর্ণ অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতায় পর্যবসিত হয়েছে। তার পক্ষে কিছুতেই স্বীকার করা সম্ভব নয় যে সেই অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতা আসলে প্রভুত্ব ও অধীনতার সূত্রে নিয়ন্ত্রিত এবং এই দুটির টানাপোড়েনেই নিম্নবর্গের রাজনীতির অনেক নকশা বোনা হয়ে থাকে।

নিম্নবর্গের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে এতক্ষণ যা বলেছি সে বিষয়ে দুটি কথা অবশ্যই মনে রাখা দরকার, নইলে অনেক বাজে তর্কে সময় নষ্ট হবে। প্রথম কথাটি হচ্ছে এই যে বৈশিষ্ট্যগুলি আমি যেভাবে বর্ণনা করলাম তা তাদের শুদ্ধ রূপ। বলাই বাহুল্য যে ঔপনিবেশিক যুগের বাস্তব রাজনীতির অভিজ্ঞতার মধ্যে বৈশিষ্ট্যগুলিকে অবিকল এই রূপেই দেখার চেষ্টা নিরর্থক। স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে এই বৈশিষ্ট্যগুলি তাদের সাধারণ চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখেই এক-এক অবস্থায় এক-এক ভঙ্গিতে কাজ করবে। আমি তাদের শুদ্ধ রূপটিকেই তুলে ধরেছি শুধু এই জন্যেই যে, আমার উদ্দেশ্য একটি তাত্ত্বিক প্রস্তাবের মূলসূত্রগুলি এখানে উল্লেখ করা। কিন্তু আমিই যখন আবার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করতে বসব তখন আমার কাজ হবে সেই তত্ত্বের আলোকে ওই অভিজ্ঞতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলির মিশ্ররূপকে পূর্বোক্ত শুদ্ধরূপের সঙ্গে তুলনা করা এবং তুলনার ফলে যে পার্থক্য ধরা পড়বে তা দিয়েই সেই ঐতিহাসিক বিষয়টার অনন্যতা বর্ণনা করা।

এ প্রসঙ্গে আমার দ্বিতীয় কথাটি হচ্ছে এই যে, বৈশিষ্ট্যগুলির একটা পাকা ফর্দ বানিয়ে পেশ করা আমার উদ্দেশ্য নয় এবং তা করাও সম্ভব নয়। ঔপনিবেশিক আমলের ইতিহাস নিয়ে এখন পর্যন্ত, যা কাজ হয়েছে তারই ভিত্তিতে একটা সাধারণ ধারণাকে মোটা কথায় সাজিয়ে বলা গেল। গবেষণা যতই এগোবে এবং নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে চিন্তায় ও লেখায় আমাদের চেষ্টা যতই ব্যাপক ও নিপুণ হবে, বৈশিষ্ট্যগুলির চেহারা ততই বিশদ হয়ে উঠবে। তবে একান্ত সঙ্গত কারণেই অসমাপ্ত এই বর্ণনা থেকে একথাটা হয়তো পরিষ্কার হয়ে থাকবে যে প্রচলিত আদিকল্পটিকে আশ্রয় করে ঔপনিবেশিক আমলের রাজনীতি সম্পর্কে যে অদ্বৈতবাদী ধারণা ইতিহাসবিদ্যায় স্বতঃসিদ্ধ বলে মান্য, তা দিয়ে ওই যুগের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে সমগ্রভাবে বোঝা বা ব্যাখ্যা করা যায় না, বরং সেই অদ্বৈতবাদী ধারণাটিই আসলে ওই অভিজ্ঞতার বর্ণনায় উচ্চবর্গের প্রাধান্য কায়েম রাখার ও নিম্নবর্গের ভূমিকা অস্বীকার করার মূল শর্ত।

এই বৈশিষ্ট্যবিচারের ভিত্তিতে তা হলে নিঃসন্দেহেই বলা চলে যে ঔপনিবেশিক যুগের রাজনীতির ক্ষেত্রটি দ্বিধাবিভক্ত। কিংবা অন্য উপায় বলা যায় যে উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের চৈতন্য ও কর্মের বাহন দুটি স্বতন্ত্র ধারা বয়ে চলেছে ওই রাজনীতির মধ্যে। তবে সেই সঙ্গে একথাও বেশ জোর দিয়েই বলা দরকার যে স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও ওই ধারা দুটি পরস্পর নিরপেক্ষ নয়। নিরপেক্ষ নয় তাদের বৈপরীত্যের জন্যেই। বিপরীত বলেই যে কোনও দ্ব্যণুক সম্বন্ধের রাশি দুটির মতো তাদের একটি অপরটির অস্তিত্ব সূচনা করে, ঘোষণা করে।

কিন্তু এই সাধারণ অর্থ ছাড়াও একটি বিশেষ অর্থে তার সম্পৃক্ত। সম্পৃক্ত এই কারণে যে উচ্চবর্গের কোনও কোনও অংশ কখনও কখনও এই দুটি ধারাকে তাদের নিজেদের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে মেলাতে চেষ্টা করেছে উভয়বর্গের একত্রিত সমাবেশে। বিশেষ করে বুর্জোয়াদের চেষ্টায় এই ধরনের সমাবেশ কয়েকটি বিরাট সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের উপলক্ষ ও হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, যদিও তা সব ক্ষেত্রেই নেতাদের অভিপ্রেত ছিল এমন নয়, বরং তাদের মধ্যে আপসের মনোবৃত্তি, জঙ্গি গণ-আন্দোলনের তেজ সম্পর্কে তাদের ভয় এবং নিম্নবর্গের চৈতন্যের নানা দুর্বলতার ফলে এইসব লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তাদের প্রতিশ্রুতিও পূর্ণ হয়নি। আন্দোলনে ভাঁটা এসেছে যখন, তখনই আবার বেণীবন্ধ শিথিল হয়ে পড়েছে এবং রাজনীতির স্বতন্ত্র ধারা দুটি তাদের নিজ নিজ খাতে ফিরে গেছে। উচ্চবর্গের নেতৃত্বেই এই দুটি ধারা কখনও আবার মিলিত হয়েছে এমন সব জমায়েতে যা সাম্রাজ্যবাদকে আঘাত করা দূরে থাকুক কার্যত তাকেই সাহায্য করেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা সামন্তশ্রেণীর অন্তর্ঘাতী হিংস্রতার অস্ত্র হিসেবে নিম্নবর্গকে ব্যবহার করে। তবে সমাবেশের উদ্দেশ্য প্রগতির অনুকূলেই হোক বা প্রতিক্রিয়ার অনুকূলে, একথা লক্ষ করার মতো যে এই দুটি ধারা বা ক্ষেত্রের প্রতিচ্ছেদে বিস্ফোরণ ঘটেছে বারেবারেই, কারণ ঠিক তখনই উচ্চবর্গের নিয়ন্ত্রণ উপেক্ষা করে তারই উদ্যোগজাত আন্দোলনের মধ্যে নিম্নবর্গের রাজনীতি তার বৈশিষ্ট্যগুলিকে মুদ্রিত করেছে।

এই প্রতিচ্ছেদের বহু দৃষ্টান্ত আছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে। কিন্তু উচ্চবর্গের অগ্রণী শ্রেণী বুর্জোয়াদের নেতৃত্ব সেই সব আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে নিতে পারেনি, তাকে পরিণত করতে পারেনি জাতির মুক্তিযুদ্ধে এবং বুর্জোয়াশ্রেণীর সর্বেশ্বরতা প্রতিষ্ঠা করে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাবার দায়িত্বও পুর্ণ করতে পারেনি।

অপরদিকে নিম্নবর্গের রাজনীতির ক্ষেত্রে নানা স্বতন্ত্র উদ্যোগ গড়ে উঠেছে ঠিকই, তবু তাও জাতীয় আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধে পরিণত করতে পারেনি। তার প্রধান কারণ হয়তো ইংরেজশাসিত ভারতে শ্রমিকশ্রেণীর অপরিণত অবস্থা তার বাস্তব জীবনে ও চৈতন্যে। ফলে শ্রমিক কৃষকের সংগ্রামী ঐক্য গড়ে ওঠেনি, তাদের সর্বেশ্বরতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এবং নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাবার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি নিম্নবর্গের মধ্যে অগ্রণী যারা তারাও।

এই দ্বিবিধ ব্যর্থতাই ঔপনিবেশিক যুগের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মর্মবস্তু। আমাদের চিন্তায় ও বক্তব্যে এই বিষয়টিকে যদি সম্যক গুরুত্ব দিতে হয় তাহলে ইতিহাসবিদ্যায় উচ্চবর্গের পক্ষপাতী আদিকল্পটির বিরুদ্ধে সচেতনভাবেই বিদ্রোহ করতে হবে, আমাদের সাধনাকে নতুন তাত্ত্বিকতা, নতুন তথ্য ও নতুন পদ্ধতি দিয়ে সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে, উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের রাজনীতির বৈপরীত্য ও তাদের সম্পৃক্তি যথাযথভাবে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা করতে হবে, এবং সেজন্যই নিম্নবর্গের ভূমিকাটিকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে।

এই প্রস্তাবসম্মত কাজ অর্থাৎ গবেষণা ও লেখা ঠিক কীভাবে এগোবে তার খুঁটিনাটি আগে থেকে বর্ণনা করার চেষ্টা নিরর্থক। যে কোনও সৃষ্টিশীল প্রয়াসের মতো ইতিহাস রচনার মধ্যেও আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিতের চমক হামেশাই দেখা যায়। এই আকস্মিকতা একদিকে যেমন নতুন তথ্য আবিষ্কার ও পুরনো তথ্যকে নতুন ভাবে দেখার অবশ্যম্ভাবী ফল, অপরদিকে অতীত অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঐতিহাসিকের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার লীলাই তার কারণ। সুতরাং নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ্যার প্রগতি কোনও ফতোয়া বা ভবিষ্য-বাণী দিয়ে নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয়। তবে তার মূল লক্ষের দিকে চোখ রেখে দু-একটি কথা বলতে চাই যা হয়তো এই অভ্যাসের একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে কাজে লাগাতে পারে।

এই কাজে যাঁরা নামতে চান তাঁদের প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে নিম্নবর্গের ইতিহাস নিছক তথ্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্গলিত হবে না। তথ্য ছাড়া ইতিহাস হয় না ঠিকই, কিন্তু তা নিছক তথ্য নয়। নিছক তথ্য আভিধানিক শব্দের মতো। ওই শব্দগুলিকে অভিধান থেকে বাছাই করে তুলে যদি বাক্যবন্ধে সাজানো যায় তবেই পারস্পরিক সম্পর্কের আলোকে তারা তাদের বিশিষ্ট অর্থে ব্যক্ত হবে। শব্দ বাছাই করা ও সাজানো যেমন বক্তার চৈতন্যের অভিব্যক্তি ভাষায়, তথ্য বাছাই করা ও সাজানো তেমনি ঐতিহাসিকের চৈতন্যের অভিব্যক্তি ইতিহাসবিদ্যায়। তথ্য বাছাই ও সাজানোর জন্যে তাই একান্ত সচেতনভাবে দুটি মূল ধরে এগোলে দিগ্‌ভ্রান্তির সম্ভাবনা কম। সূত্র দুটি সম্পর্কে আগেই বিস্তারিত বলা হয়েছে, তাই এখানে শুধু উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে। এক নম্বর সূত্র:

ঔপনিবেশিক ভারতে রাজনীতির ক্ষেত্রটি অখণ্ড নয়, দ্বিধাবিভক্ত। তার মধ্যে দুটি স্বতন্ত্র ধারা—উচ্চবর্গের রাজনীতির ধারা ও নিম্নবর্গের রাজনীতির ধারা। স্বতন্ত্র হলেও এই ধারা দুটি পরস্পর নিরপেক্ষ নয়। তারা বৈপরীত্যে বাঁধা এবং বেণীবন্ধের মতো কখনও কখনও তারা ঐতিহাসিক প্রতিচ্ছেদে যুক্ত হয়, কখনও আবার নিজ নিজ খাতে বয়ে চলে। দুই নম্বর সূত্র:

নিম্নবর্গের ইতিহাস শুধু ঘটনার পারম্পর্য আশ্রয় করে বোঝা বা লেখা যাবে না। ঘটনা বা সাধারণভাবে বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে উচ্চবর্গের সঙ্গে নিম্নবর্গের সম্পর্ক পরিষ্কার করে বিশ্লেষণ করতে হবে। এই সম্পর্ক আসলে প্রভুত্ব ও অধীনতার সম্পর্ক, বৈপরীত্যের দ্ব্যণুক সম্পর্ক।

এই দুটি সূত্র ধরে গবেষণা, আলোচনা ও রচনার বিষয়বস্তু এবং বিশ্লেষণপ্রণালী সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত প্রস্তাব আমি রাখতে চাই। এই প্রস্তাবটি কোনও পাকা ‘প্রোগ্রাম’ নয়। এই সবটাই আমার ব্যক্তিগত চিন্তা অভ্যাস অভিজ্ঞতা ও রুচির অপরিণত এবং ইদানীন্তন নিদর্শন মাত্র। কাজ যত এগোবে ততই এই প্রস্তাব আরও পরিশীলিত হবে, এবং আশা করি সকলেই নিজ নিজ চিন্তা ও অভ্যাসের সাহায্যে এটিকে বদলে ও শুধরে নেবেন।

এই প্রসঙ্গে আমার প্রথম মন্তব্য এই যে নিম্নবর্গের অন্তর্ভুক্ত সকল শ্রেণী গোষ্ঠী ব্যক্তি ও সমূহকে ঐতিহাসিক গবেষণা ও বক্তব্যের বিষয় বলে স্বীকার করতে হবে সচেতনভাবে। এদের মধ্যে শ্রমিক, কৃষক, নিম্নমধ্যবিত্ত, গ্রাম ও শহরের গরিব জনতা ইত্যাদি গণ্য তো বটেই। কিন্তু ঔপনিবেশিক সমাজে প্রভু ও অধীনের সম্পর্কটা যাদের জীবনে খুবই প্রকট অথচ যারা আমাদের ইতিহাসচিন্তায় এখনও প্রায় অনুপস্থিত সেই আদিবাসী, নিম্নবর্ণ ও নারীদের ভূমিকা নিয়ে বিশেষ করে ভাবতে ও লিখতে হবে। এইদিকে এগোতে গেলেই পরিষ্কার বোঝা যাবে যে উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গি ও তার বাহন প্রচলিত আদিকল্পটি আমাদের পথ জুড়ে আছে। তাই ১৯১৮ সালের আমেদাবাদ সুতাকলে ধর্মঘটের ইতিহাস যখন লিখতে বসব তখন যেন মনে রাখি যে সেই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা মহাত্মা গান্ধী, শংকরলাল ব্যাংকার ও অনসূয়া সারাভাইয়ের জীবনীর অধ্যায় মাত্র নয়, তার মধ্যে ধর্মঘটীদের চৈতন্যের—শ্রেণীচেতনা যার অন্যতম উপাদান—তার একটি মূল্যবান ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস মহাদেব দেশাই বা তেন্ডুলকরের পক্ষে লেখা সম্ভব হয়নি, তা আমাদেরই লিখতে হবে একেবারে আর-এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আর একটি আদিকল্পের প্রেরণায়। এ কাজে হাত দিলে দেখা যাবে যে উনিশ শতকের কৃষকবিদ্রোহগুলিকে নেহাৎ উদ্দেশ্যবাদী কায়দায় বিংশ শতাব্দীর জাতীয়তা ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে অঙ্গীভূত না করে তাদের স্বমহিমায় দেখতে গেলে বিদ্রোহী চৈতন্যের একটি প্রধান লক্ষণ যে ধর্মচেতনা তাকে উড়িয়ে দেওয়া তো যায়ই না যেমন একজন বামপন্থী লেখক তাঁর বহুল প্রচারিত রচনায় করেছেন, বরং ধর্মবিশ্বাসকে সেই চৈতন্যের একটি ধ্রুবগুণ বলে স্বীকার করতে হয়। এ কাজে হাত দিলেই দেখা যাবে যে রাজনৈতিক জীবনী-সাহিত্য পুরনো ইতিহাসবিদ্যার প্রভাবে শুধু উচ্চবর্গের গুণকীর্তনে মুখর; আমরা চাই যে তার মধ্যে তিতুমীর, সিদো, কানহু, মাদারি পাসীর কীর্তি উচ্চারিত হোক। আমরা এমন ইতিহাস চাই যার মধ্যে মেয়েরা অতীত সমাজের তথ্যকণিকা মাত্র নয়, যার মধ্যে তারা ঐতিহাসিক সত্য বলে স্বীকৃত; যার মধ্যে আদিবাসীরা কৃষকদের জীবন ও আন্দোলনের সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে ব্যতিক্রম বলে বিবেচিত হবে না, কৃষক সমাজের সবচেয়ে নিঃস্ব ও সংগ্রামী অংশ বলেই বিবেচিত হবে; যার মধ্যে বর্ণানুক্রমে নিম্নতম বলে গণ্য যারা তাদের আন্দোলনগুলিকে উচ্চবর্গের অনুকারী তথাকথিত সংস্কৃতায়নের সিঁড়ি বলেই শুধু বর্ণনা করা হবে না, বরং অনুকরণের পাশাপাশি এমনকী তার চেয়েও বেশি যে আক্রোশ ও তজ্জনিত প্রতিবাদ ওই সব আন্দোলনের স্বভাবসিদ্ধ তাও বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার বিষয় বলে মানা হবে।

আমার দ্বিতীয় মন্তব্য এই যে নিম্নবর্গের ইতিহাসে গণসমাবেশের প্রসঙ্গটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ প্রচলিত আদিকল্পটির চাপে ইতিহাসবিদ্যার ঠিক এইখানটাতেই অনেক বিকৃতি ও অসত্যকে একেবারে স্বতঃসিদ্ধের আসনে বসানো হয়েছে। গণসমাবেশের প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতাকে তাই নতুন করে বিচার করার, নতুনভাবে তার মূল্যায়নের সময় এসেছে। যাঁরা নিম্নবর্গের ইতিহাসের এই দিকটা নিয়ে কাজ করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্যে দু-একটি কথা বিশেষ জোর দিয়ে বলতে চাই।

(১) মনে রাখবেন যে পুরনো আদিকল্পটির প্রভাবে ইতিহাসবিদ্যায় সাধারণত সব গণসমাবেশকেই, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংক্রান্ত সমাবেশগুলিকে শুধু খাড়াখাড়ি জমায়েত বলেই ধরে নেওয়া হয়। কারণ, এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী উচ্চবর্গের প্রেরণা ছাড়া জনগণ কিছুতেই রাজনীতির ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে পারে না। নিম্নবর্গের ইতিহাস লিখতে গেলে এই একদেশদর্শিতা প্রথমেই বর্জন করা দরকার। জমায়েতের মধ্যে খাড়াখাড়ি ও আড়াআড়ি এই দুটো কায়দাই কাজ করছে এই অনুমান আশ্রয় করেই গবেষণার প্রকল্প তৈরি করতে হবে। তা যদি না করেন তাহলে আড়াআড়ি জমায়েতের সাক্ষ্য চোখেই পড়বে না, বা পড়লেও তাকে খাড়াকাড়ি জমায়েতের সাক্ষ্য বলে ভুল হবে নির্ঘাৎ।

(২) উচ্চবর্গের দৃষ্টিতে জনসমাবেশের অন্তর্নিহিত পার্থক্যগুলি সহজে ধরা পড়ে না, পড়লেও তার তাৎপর্য বোঝা বা ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। কারণ, ধরে নেওয়া হয় যে সেই সমাবেশ উচ্চবর্গের চৈতন্যের আধার মাত্র, সুতরাং তার নিজস্বতা নেই, আর সেই নিজস্বতার প্রকাশ যে দ্বন্দ্বে ও বৈষম্যে তাও আলোচনার মধ্যে আসে না। নিম্নবর্গের ইতিহাস কিন্তু সেই জমায়েতে রাজনীতির পালটা ও স্বতন্ত্র ধারাটির খোঁজ করবে, আর খোঁজ পেলে—অর্থাৎ তা যদি তথ্যসম্মত হয়—তার মধ্যে নিম্নবর্গের চৈতন্যের অসমতা, স্তরভেদ, উপাদান-ও-অবস্থাভেদে তার বিভিন্ন প্রকাশ ইত্যাদির বিশ্লেষণ করে সেই বিশেষ জমায়েতটির অনন্যতাকে বর্ণনা করবে। এখানে মনে রাখা উচিত যে জমায়েতের পাত্রস্থানীয় শ্রেণী, গোষ্ঠী বা সমূহের বাস্তব জীবন ও সংস্কৃতিগত পার্থক্যই এই অনন্যতার একমাত্র কারণ নয়। একই স্থানে একই পাত্রের চৈতন্যে একই সমাবেশের মধ্যে কালভেদে গুণগত পরিবর্তনের অনেক উদাহরণ আমাদের ইতিহাসে, বস্তুত সব দেশের ইতিহাসেই পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীর জার্মান কৃষকবিদ্রোহে, ফরাসি বিপ্লবের সমকালীন মহাত্রাসের (লা গ্রাঁদ্‌ প্যর্‌) মধ্যে, জার্মান ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে পূর্ব আফ্রিকার মাজি-মাজি অভ্যুত্থানে, আমাদের নিজস্ব নীলবিদ্রোহে, যুক্তপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে ১৮৫৭-৫৮ সালের কৃষকবিদ্রোহগুলিতে, উত্তরবঙ্গে দেবী সিং-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্যে—অর্থাৎ যেখানেই জমায়েতের মেজাজ জঙ্গি ও আয়ুষ্কাল অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ, সেখানেই চৈতন্যের এই গুণগত পরিবর্তন দেখা যায়। অন্যত্র আমি এই পরিবর্তনকে ইংরেজিতে ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ বলে বর্ণনা করেছি। উপমাটা একটু বদলে বাংলায় এর নাম দেব ‘দ্বিতীয় ধাক্কা’, কারণ সত্যিই এই দ্বিতীয় পর্যায়ে সমাবেশের মধ্যে আপসের চেয়ে আঘাতের প্রবণতা হঠাৎ অনেক বেশি তীব্র হয়ে ওঠে, তিক্ততা ও হিংস্রতা ভীষণ বেড়ে যায়, শ্রেণীসংগ্রামে দীর্ণ হয়ে সমাজ গৃহযুদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এই ধাক্কা সামলাতে উচ্চবর্গকে হিমশিম খেতে হয়।

(৩) একথা যদিও সত্য যে স্থানকালপাত্র ভেদে এক-একটি সমাবেশে তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য সক্রিয় হয়ে ওঠে, তবুও তাদের মধ্যে, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত জঙ্গি জমায়েতগুলির আকৃতিগত মিল আছে অনেক। গ্রামাঞ্চলে প্রজাবিদ্রোহ, শহরের গরিব জনতার অভ্যুত্থান (যেমন ধরুন, রাওলাট সত্যাগ্রহের সময় দিল্লিতে), গ্রামে ও শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদির মধ্যে আঞ্চলিকতায়, উদ্দেশ্যে এবং সামাজিক পরিচয়ের নানা পার্থক্য সত্ত্বেও দেখা যাবে যে প্রায় একই রকমের কিছু কিছু উপায় ও সংকেতের সাহায্যে নিম্নবর্গের প্রতিনিধিরা তাদের মিত্রপক্ষকে একত্র করতে ও শত্রুপক্ষকে আঘাত করতে চেষ্টা করেছে সব ক্ষেত্রেই। এই সাদৃশ্যের মূল কারণ উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের মধ্যে প্রভুত্ব ও অধীনতার অতি প্রাচীন সম্পর্ক এবং প্রভুর বিরুদ্ধে অধীনের বহুকালব্যাপী, যদিও ব্যর্থ, প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদের চূড়ান্ত, সর্বাঙ্গীণ, সনাতন ও সার্বত্রিক রূপ কৃষকবিদ্রোহ। তারই ঐতিহ্য নিম্নবর্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি ধ্রুব উপাদান, এবং ঠিক সেই জন্যেই ঔপনিবেশিক যুগে নিম্নবর্গের সব রকম জঙ্গি জমায়েতেই কৃষকবিদ্রোহের কিছু কিছু লক্ষণ আদর্শে না হোক আকারে দেখা যাবেই। তাই আমার মনে হয় নিম্নবর্গের সমাবেশের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা কাজ করতে চান, এমন কি যাঁরা গ্রামসমাজের বাইরে অকৃষক জনতার সমাবেশ নিয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের পক্ষেও কৃষকবিদ্রোহের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

এবার আমার প্রস্তাবটি সম্পর্কে তৃতীয় মন্তব্যে আসি। একথা বলাই বাহুল্য যে নিম্নবর্গের ইতিহাসে তাদের অর্থনৈতিক জীবনকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনীতি নিয়ে কাজ ইংরেজ রাজত্বের মধ্যেই আরম্ভ হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে কাজ পরিমাণে যেমন বেড়েছে, গুণেও তেমনি উন্নত হয়েছে। নিম্নবর্গের ইতিহাস লিখতে হলে এই কাজ থেকে অনেক কিছুই শিখতে হবে। তবে বিষয় নির্বাচন ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে দুটি কথা মনে রাখা দরকার।

প্রথম কথাটি এই যে ঔপনিবেশিক সমাজের অর্থনৈতিক জীবনে উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের মধ্যে প্রভু ও অধীনের সম্পর্কটি যে বিশিষ্টরূপে প্রকট হয় তা শোষক শোষিতের সম্পর্ক। তাই অর্থনীতির যে-কাঠামোটা আশ্রয় করে সেই সম্পর্ক প্রধানত গড়ে ওঠে—অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থা; অর্থনীতিকে সক্রিয় রাখার জন্য আবশ্যক লেনদেনগুলির মধ্যে যা কিছুই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শোষক-শাসিতের সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে—যথা, মজুরি, খাজনা, ঋণ ইত্যাদি; এই সম্পর্কের অবশ্যম্ভাবী যে দারিদ্র্য, বেকারি, দুর্ভিক্ষ, জমি হারানো, ফসলের ন্যায্য ভাগ থেকে বঞ্চিত হওয়া, আবার অপরপক্ষে শোষকদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে শোষিতের সামান্য একটি অংশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে অধিকাংশকেই দরিদ্রতর করে তোলা—এই ধরনের সমস্যাকেই আমার মনে হয় নিম্নবর্গের ইতিহাসে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কারণ, এইসব বিষয়ে কাজ করতে গেলেই যে তথ্য আবিষ্কৃত হবে, যে প্রশ্ন উঠবে, সমাধানের জন্য যে নতুন কৌশল ও তত্ব আশ্রয় করে এগোতে হবে, তা থেকে বারবারই একথা পরিষ্কার হয়ে উঠবে যে শোষক-শোষিতের সম্পর্কটি অর্থনৈতিক জীবনে প্রভুত্ব-অধীনতার সম্পর্কের বিশিষ্ট প্রয়োগ মাত্র।

এই প্রসঙ্গেই আমার দ্বিতীয় কথা—দৃষ্টিভঙ্গির কথাটা এসে পড়ে। ঔপনিবেশিক সমাজে নিম্নবর্গের ইতিহাসে নিছক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বলে কিছু নেই। ধনতন্ত্রের পূর্ববর্তী অন্য যে কোনও সমাজের মতো সেখানেও অর্থনীতির অন্তর্গত সব সম্পর্কই আসলে ক্ষমতার সম্পর্ক বা আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, রাজনীতির সম্পর্ক দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। মজুরির হার, খাজনার হার, সুদের হার, সেখানে অবাধ কেনাবেচা চাহিদা-জোগানের নিয়ম মেনে চলে না, চলে শেষপর্যন্ত স্থানীয় সমাজে মালিক জমিদার মহাজনের প্রতিপত্তি ও শাসনের নিয়ম অনুযায়ী এবং উচ্চবর্গের এইসব আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের উপরওয়ালা, তাদের সকলেরই পোশাক রাজশক্তির শাসন অনুযায়ী। তাই নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক জীবনের সব বর্ণনার মধ্যেই ক্ষমতার এই সম্পর্কটিকে, অর্থাৎ প্রভু ও অধীনের সম্পর্কটিকে প্রাধান্য দিতে হবে। এই জন্যেই ঔপনিবেশিক যুগের যন্ত্রশিল্পের ইতিহাস শুধু যদি কলকারখানার বর্ণনা, মজুরি ও মুনাফার হার ও পরিমাণ, এমন কি লভ্যাংশের বখরা নিয়ে মালিক-মজুরের মধ্যে কড়াগণ্ডার লড়াই বলেই দেখা ও লেখা হয়, তা হলে ক্ষমতার সম্পর্কটি তার মধ্যে হয় ধরা পড়বেই না, বা পড়লেও গৌণভাবে। তাই কারখানার মালিকানার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রভুত্বের সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ও যান্ত্রিক নিয়মের বহির্ভূত শাসনের চাপে উৎপাদন পদ্ধতিকে প্রভাবিত করার জন্য কাজের সময় শ্রমিক ও যন্ত্রের মধ্যে মালিক বা তার প্রতিনিধিদের কর্তৃত্বসূচক হস্তক্ষেপ, কলকারখানার বিষয়ে সরকারি আইনকানুনের ভূমিকা, কারখানার বাইরে বস্তি, লাইন, চল বা মহল্লায় মালিক মহাজন প্রভৃতির সঙ্গে শ্রমিকের সম্পর্ক, ইউনিয়ন বা ওই জাতীয় সংস্থায় অশ্রমিক নেতা বা কর্মী ও শ্রমিকের মধ্যে ক্ষমতাবৈষম্যের খেলা, কারখানার জন্য শ্রমশক্তি জোগান দেওয়ার ব্যাপারে সর্দারি প্রথা ও সেই সূত্রে গ্রামসমাজের সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রভাব শহরের শ্রমিক জীবনে—এই সব কিছুই যন্ত্রশিল্পের অর্থনৈতিক দিকগুলির সঙ্গে মিলিয়ে বিচার করতে হবে। তেমনিই আবার বলা যায় যে কৃষকের কত জমি আছে, কত খাজনা বা কর তাকে দিতে হয়, সুদে আসলে তার কাছে মহাজনের কত পাওনা, ফসলের দর ও লাভ-লোকসানের হিসেব— এই সব দিয়েই শুধু অর্থনৈতিক ইতিহাস যদি লেখা হয়, তা হলে তা তথ্যসমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কৃষকজীবনের একপেশে সুতরাং বিকৃত বর্ণনায় পর্যবসিত হবে। কারণ কৃষকজীবনের সত্য ওই তথ্যগুলির মধ্যে বিদ্যমান নয়। প্রভুত্ব ও অধীনতার যে বিশিষ্ট সম্পর্ক ওই সব তথ্যের ধারক তারই মধ্যে কৃষকজীবনের সত্যকে সন্ধান করতে হবে, সেই সত্যের আলোকেই ওই সব তথ্য অর্থময় হয়ে উঠবে। ঔপনিবেশিক ভারতের গ্রামজীবনে সেই সম্পর্কের মূল কথা জমিদার, মহাজন ও সরকার—এই ত্রিশক্তির সঙ্গে কৃষকের ক্ষমতগত সম্পর্ক। সেই সম্পর্কই অর্থাৎ রাজনীতিই ঔপনিবেশিক আমলের অর্থনীতির প্রধান ধ্রুবগুণ। নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক ইতিহাসকে তাই ব্যাপক অর্থে যা রাজনৈতিক ইতিহাস নামে পরিচিত তারই শাখা বলে ভাবা যায়, যদিও নিঃসন্দেহেই তা সেই জ্ঞানকাণ্ডের একটি প্রৌঢ় ও বহু পল্লবিত শাখা।

নিম্নবর্গের ইতিহাস বিষয়ক প্রস্তাবটি সম্পর্কে আমার চতুর্থ মন্তব্যে চৈতন্যের দুটি লক্ষণের কথা বলতে চাই। এ যাবৎ আমার সব বক্তব্যের মধ্যে আমি প্রভুত্ব-অধীনতার সম্পর্কটিকে রাজনীতির মর্মস্থলে রেখেছি, বলেছি যে এই সম্পর্কটিই একাধারে রাজনীতির মুখ্য উপাদান ও তার নিয়ন্ত্রক। প্রভুত্ব ও অধীনতা যথাক্রমে সেই সম্পর্কের অন্তর্ভুক্ত বর্গদুটির—অর্থাৎ উচ্চের ও নীচের—চৈতন্যের সাধারণ গুণ। নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাই অধীনতার চরিত্রটি পরিষ্কার করে বোঝা দরকার। এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে প্রভুত্ব ও অধীনতা যেমন দ্ব্যণুক বৈপরীত্যের সূত্রে বাঁধা, অধীনতাও তেমনি একটি দ্ব্যণুক সত্তা যা নিজেই আবার দুটি রাশির বৈপরীত্য দিয়ে গড়া। সেই রাশি দুটি হচ্ছে সহকারিতা ও প্রতিরোধ। নিম্নবর্গের ইতিহাসে দুটি রাশিই সক্রিয়ভাবে উপস্থিত, যদিও অবস্থাভেদে একটি অপরটির চেয়ে জোরদার হয়ে ওঠে এবং অধীনদের চৈতন্যে হয় একটি বা অন্যটি তার প্রাধান্য কায়েম করে সাময়িকভাবে। তাই একথা মনে করা ভুল হবে যে প্রতিরোধই নিম্নবর্গের চৈতন্যের একমাত্র উপাদান। বরং অসাম্য সত্ত্বেও যেহেতু সমাজ সাধারণত স্থিতিশীল তাই অত্যুক্তি না করেই বলা চলে যে সহকারিতাই প্রতিরোধের চেয়ে সাধারণত বেশি শক্তিমান। তবে একথাও সত্যি যে প্রতিরোধ বিদ্রোহের পর্যায়ে না পৌঁছলেও সহকারিতার পাশাপাশি তার একটি ধারা যতই ক্ষীণ হোক তা সব ঐতিহাসিক অবস্থায়, এমন কি দৈনন্দিন জীবনেও, সব সময়েই বয়ে চলেছে। যেমন অপরপক্ষে বলা যায় যে প্রতিরোধের চূড়ান্ত রূপ বিদ্রোহের এমন কোনও নজির ইতিহাসে নেই যার মধ্যে সহকারিতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

নিম্নবর্গের চৈতন্যের অপর যে লক্ষণটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে ধর্মভাব। ধর্মভাব বলতে আমি শুধু ধর্মীয় সংস্থার প্রতি আনুগত্য বোঝাচ্ছি না, বোঝাচ্ছি চেতনার সেই ঐতরিক বা ‘এলিয়েনেটেড’ অবস্থার কথা যার প্রভাবে জড়জগৎ বা জীবজগতের কোনও সত্তাকে, বাস্তবের বা ভাবনার অন্তর্গত কোনও বিষয়কে তা যথার্থভাবে ধারণার মধ্যে আনতে পারে না, এবং এক বিষয়ের উপর আর এক বিষয়ের গুণ আরোপ করে। ফলে যা ঐহিক তাকে অলৌকিক বলে মনে হয়, যা একান্তই মানবিক তাকে দৈব বলে ভুল হয়। ঐতরিকতার আতিশয্যেই কর্তা কখনও কখনও নিজের সৃষ্টিকেই সঠিকভাবে চিনতে পারে না। যা তার নিজের প্রতিভাজাত তাকে সে অন্যের কৃতিত্ব বলে বর্ণনা করে। তাই মঙ্গলকাব্যের কোনও মহৎ কবির পক্ষে বলা সম্ভব যে তাঁর রচনা তাঁর নিজের নয়, আরাধ্যা দেবী তাঁকে দিয়ে লেখাচ্ছেন: কবি যন্ত্র, দেবী যন্ত্রী। তাই সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা সিদো ও কান্‌হুর পক্ষে বলা সম্ভব হয় যে ইংরেজ শাসকরা যদি তাঁদের পরোয়ানা শিরোধার্য করে গঙ্গার ওপারে চলে না যায় তা হলে লড়াই বাধবে, কিন্তু তা ইংরেজের সঙ্গে সাঁওতালের লড়াই নয়, ইংরেজের সঙ্গে ঠাকুরের লড়াই। অর্থাৎ বিদ্রোহের ঠিক পূর্ব মুহূর্তেও বিদ্রোহী নেতারা তাঁদের যত্নসাধ্য বিশাল কর্মকাণ্ডটিকে নিজেদের সৃষ্টি বলে চিনতে পারছেন না, ঐশ্বরিক বলে কল্পনা করছেন।

এই ধরনের ধর্মভাব নিম্নবর্গের রাজনীতির একটি প্রধান উপাদান। উচ্চবর্গের ইতিহাসবিদ্যায়—ইংরেজ শাসকদের লেখায় বা আমাদের স্বদেশীয়দের মধ্যে অনেক ‘লিবারেল’ ঐতিহাসিকের লেখায়ও—এই চেতনাকে শুধু ধর্মোন্মাদ বলেই দায় সারা হয়, যেন ‘আসল’ রাজনীতি বলতে তাঁরা যা বোঝেন তা একেবারেই আলাদা জিনিস। অপরপক্ষে, নিম্নবর্গের প্রতি যাঁদের সহানুভূতি আছে তাঁরাও অনেক সময় এই ধর্মচেতনার সাক্ষ্য নিয়ে একটু বিব্রত বোধ করেন এবং ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার মধ্যে সেই সাক্ষ্য হয় একেবারেই চেপে যান কিংবা উড়িয়ে দেন এই বলে যে ওটা আসল কথা নয়, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাটাই আসল কথা, এবং সিদো কানহু বিরসা প্রমুখ বিদ্রোহী নেতারা নিজেরা ধর্মে বিশ্বাস করতেন না, শুধু কুসংস্কারগ্রস্ত কৃষকজনতাকে জমায়েত করার উদ্দেশ্যেই তাঁরা ধর্মের জিগির তুলেছিলেন। এক কথায়, উভয়পক্ষই ‘আসল’ রাজনীতি বলতে ধর্মভাবরহিত চৈতন্যের একটি বিশেষ রূপকে বোঝেন।

এটা একটা মারাত্মক ভুল এবং এ বিষয়ে সতর্ক না হলে নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখা দুষ্কর। ঐতিহাসিককে মনে রাখতে হবে যে প্রত্যেক দেশেই ধনতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশের আগে, জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে ওঠার আগে, এমন কী তার পরেও বহুদিন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের চোখে, বিশেষ করে রাজধানী ও শহর থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে গ্রাম ও মফঃস্বলে যারা থাকে তাদের চোখে রাষ্ট্রের সামগ্রিক চেহারাটা সহজে ধরা পড়ে না। তারা রাষ্ট্রশক্তিকে দেখে তার স্থানীয় প্রতিনিধিদের ক্ষমতার গোষ্পদে। আর তাদের ধারণায় রাষ্ট্রের সামগ্রিক ও স্থানীয় রূপের মধ্যে যে ফাঁকা জায়গাটা থাকে তা তারা ভরে দেয় ক্ষমতার প্রকৃতি ও প্রয়োগ সম্পর্কে নানারকম অলৌকিক বিশ্বাস দিয়ে। এইজন্যেই ক্ষমতার পিরামিডের তলায় যারা একেবারেই মাটির কাছাকাছি সেই নিম্নবর্গের কাছে পিরামিডের শীর্ষস্থ রাজশক্তিকে দেবশক্তি বলে মনে হয়। তাই জারের অধীন রাশিয়ায় জারেরই কসাক বাহিনীর হামলায় পর্যুদস্ত জনতা জারের কাছেই সুবিচার প্রার্থনা করে, এমন কী বিদ্রোহ করে জারের নাম নিয়েই। কারণ যে রাষ্ট্রকে তারা জানে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মারফৎ, কসাক বাহিনীই তার প্রতিভূ তাদের কাছে; কিন্তু স্বয়ং জার আর একটি, আরও শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রতিভূ। এই দ্বিতীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বাস্তবে নয়, কল্পনায়; তাকে যা চালায় তা মানুষের ইচ্ছাশক্তি নয়, দৈবশক্তি; ক্ষমতার যে নিয়মের দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে তা নাগরিক অধিকার ও দায়িত্বের সংজ্ঞায় সাজানো কোনও সংবিধান নয়, তা নিয়ন্ত্রিত হয় ধর্মচিন্তার দ্বারা। এক কথায় বলা যায় যে সেই রাষ্ট্র একটি অলীক রাষ্ট্র।

এই অলীক রাষ্ট্র নিম্নবর্গের ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকে যে বারবার প্রভাবিত করেছে এ কথা সকলেই জানেন। উদাহরণগুলি সুপরিচিত: যেমন, আঠারো শতকে দেবী সিং-এর বিরুদ্ধে উদ্যত সশস্ত্র কৃষকজনতা কোম্পানির দোহাই দিয়েই কোম্পানির ফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়; উনিশ শতকের শেষভাগে বাঙালি ও মারাঠি কৃষক মহারানির নাম করেই মহারানির সাম্রাজ্যের স্থানীয় প্রতিনিধি ও তাদের পোষ্য উচ্চবর্গের বিরুদ্ধে লড়াই করে, ইত্যাদি। জানা কথা: অলমিতিবিস্তরেণ। শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে এই ধরনের দৃষ্টান্তে কোম্পানি ও মহারানি বা একই বিশ্বাসের প্রকারান্তরে লাটসাহেব, মেজিস্টর সাহেব, জজ সাহেব প্রমুখ ধর্মাবতারের স্থান নিম্নবর্গের চেতনায় দেবদেবীর সঙ্গেই।

এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য মনে করি। অলীক রাষ্ট্রবাদের ঐতিহাসিক রূপ সম্পর্কে মার্কস বলেছেন যে এই প্রকার চিন্তা সেই সব শ্রেণীরই চৈতন্যের বৈশিষ্ট্য যারা উঠতির মুখে, যাদের মধ্যে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা দেখা দিয়েছে কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবিক করার জন্য আবশ্যক উপাদান ও অবস্থা সমাজে তখনও তৈরি হয়নি। সেই বাস্তব ভিত্তির অভাবেই ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্রশক্তি সম্পর্কে যুক্তিসিদ্ধ ও সুসংগত কোনও ধারণাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠতে পারে না, আর সেজন্যেই তা মগ্ন হয়ে থাকে অলীক রাষ্ট্রবাদের দিবাস্বপ্নে।

আমি মার্কসের এই কথাটিকে তাঁর অসামান্য চিন্তার মধ্যেও একটি অসামান্য রত্ন বলে মনে করি। অলীক রাষ্ট্রের ধারণাটি যদিও প্রাচীন এবং তার কাল্পনিক আকৃতি পুরাকাল থেকেই বার-বার চিত্রিত হয়েছে সাহিত্যে ও লোকগাথায়, তবু কেবল প্লেটো ও রুসোর কথা বাদ দিলে মার্কসের পূর্বসূরীদের মধ্যে যাঁদের চিন্তা দিয়ে রাষ্ট্রদর্শনের তাত্ত্বিক বনিয়াদ রচিত হয়েছে তাঁরা প্রায় সকলেই শুধু রাষ্ট্রের সুপরিণত ও সর্বাঙ্গে সম্পূর্ণ আদর্শ রূপটি সামনে রেখে তাঁদের বক্তব্য তৈরি করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র তো সমুদ্রফেন থেকে সদ্যোত্থিতা আফ্রোদিতির মতো হঠাৎ নিখুঁত ইতিহাস নিরপেক্ষ মূর্তিতে আবির্ভূত হয় না। তার জন্মের ইতিহাস এক-একটি শ্রেণীর বা সমূহের সামাজিক সত্তা ও চেতনার উন্মেষ ও বিকাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই পরিণত রাষ্ট্রশক্তি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলির সঙ্গে পরিচয় ছাড়া যেমন কোনও সমাজের রাজনৈতিক চেতনাকে বোঝা বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, তেমনি অপরিণত রাষ্ট্রশক্তি সম্পর্কে ধারণা অর্থাৎ সেই সমাজে প্রচলিত অলীক রাষ্ট্রবাদী চিন্তার সঙ্গে পরিচিত না হলে তার রাজনৈতিক ইতিহাসকে সমগ্রভাবে বোঝা বা ব্যাখ্যা করা যায় না। এই জন্যেই টমাস মোর, সাঁ সিমঁ, ফুরিএ, কাবে, ওয়েন প্রভৃতির চিন্তাকে পাশ্চাত্যের বুর্জোয়া ও শ্রমিকশ্রেণীর জন্ম ও বয়ঃপ্রাপ্তির ইতিহাসে উপক্রমণিকার মর্যাদা দেওয়া হয়।

ঔপনিবেশিক যুগে ভারতের ইতিহাসেও নানা শ্রেণী ও সমূহের অপরিণত রাষ্ট্রচিন্তার—অলীক রাষ্ট্রবাদী চিন্তার—নিদর্শন অনেক আছে। অন্যত্র যেমন আমাদের দেশেও তেমনি বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর বা সমূহের ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা এই চিন্তার মাধ্যমেই ব্যক্ত হয়েছে। সমাজে ও বাস্তব জীবনে সেই আকাঙ্ক্ষাকে সফল করার জন্য আবশ্যক বনিয়াদ তখনও তৈরি হয়নি। ফলে অলীক রাষ্ট্রবাদের মধ্যে ওই সব শ্রেণীর বা সমূহের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যেমন সূচিত হয়েছে, তেমনি সূচিত হয়েছে সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির অন্তরায় ইংরেজ রাজশক্তিকে হঠিয়ে দিয়ে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষাকে ক্ষমতায় পরিণত করার অক্ষমতা। ওই যুগের উচ্চনীচ উভয়বর্গের অলীক রাষ্ট্রবাদেই আকাঙ্ক্ষা ও অক্ষমতার এই দোটানা বেশ স্পষ্ট। এই জন্যেই উচ্চবর্গের রাজনীতি সম্যক বোঝা সম্ভব নয় বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের স্বপ্ললব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস, মহাত্মা গান্ধীর হিন্দ স্বরাজ-এর সাহায্য ছাড়া। কারণ ভারতীয় উচ্চবর্গের অগ্রণী যে বুর্জোয়াশ্রেণী সর্বেশ্বরতা কামনা করেও তা আয়ত্তে আনতে পারেনি, ওই সাহিত্য আসলে তাদেরই সেই ব্যর্থতার সাক্ষী। এ বিষয়ে এখানে বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই। শুধু এ কথাটাই বলে রাখি যে ভারতবর্ষে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী চৈতন্যের মধ্যে একটা অলীকরাষ্ট্রবাদী উপাদানের অস্তিত্ব আমার কাছে খুবই পরিষ্কার। এই উপাদানটি বিশদভাবে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা না করলে জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আশা করি কোনও কোনও তরুণ ঐতিহাসিক এই জটিল, দ্ব্যর্থময় ও একান্তই গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার ক্ষেত্রটি তাঁদের প্রতিভায় উজ্জ্বল করে তুলবেন অদূর ভবিষ্যতে।

নিম্নবর্গের চিন্তায়ও অলীক রাষ্ট্রবাদ ওইরকম দোটানায় এবং পরস্পরবিরোধী অর্থের দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ। এক দিকে আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে বাস্তবে ও চৈতন্যে সেই আকাঙ্ক্ষা সফল করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের অভাব ও তজ্জনিত দুর্বলতা। একদিকে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, সিদো কানহুর হাতে-গড়া সাঁওতাল ফৌজ, ভারতের নানা স্থানে সারা ঔপনিবেশিক যুগ ধরে হঠাৎ এক একটি জঙ্গি সমাবেশকে উপলক্ষ করে কয়েকদিনের জন্য বিদ্রোহীদের স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা—এক দিকে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষার এই নির্ভীক আত্মঘোষণা ও অপর দিকে ব্যর্থতা, পরাজয়, পলায়ন, হতাশা। আকাঙ্ক্ষা ও অসাধ্যতার ভাবমূর্তি হিসেবে তাই বিদ্রোহীদের অসম্পূর্ণ রাষ্ট্রদর্শন কখনও কখনও তাঁদের পরোয়ানা, জবানবন্দি, গোয়েন্দা পুলিশ বা মিলিটারি রিপোর্টে তাঁদের কথার টুকরো টুকরো উদ্ধৃতি মারফত আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব। তাঁরা নিরক্ষর, কোনও বঙ্কিম ভূদেব গান্ধী তাঁদের হয়ে কলম ধরেননি, সুতরাং তাঁদের বক্তব্য কখনও তাঁদের নিজের ভাষায় শোনা যায় না। কিন্তু তাঁদের শত্রুপক্ষীয় সরকার-সাহুকার-জমিদারদের লেখা নানা বিবরণে ওই রাষ্ট্রচিন্তার রূপটিকে বারে-বারেই বর্ণনা করা হয়েছে, কারণ নিম্নবর্গ যখন ক্ষমতার লড়াই-এ লিপ্ত হয় তখন যারা ক্ষমতাবান তাদের শুনতে হয় নিম্নবর্গ কী বলতে চাইছে, তা লিখে রাখতে হয় সরকারি বেসরকারি কাগজপত্রে।

এই সব সাক্ষ্য থেকে এ কথাটা বেশ পরিষ্কার হয় ওঠে যে নিম্নবর্গের আকাঙ্ক্ষা ও অসাধ্যতার এই দ্বন্দ্বই তাঁদের চিন্তায় ধর্মভাবকে কায়েম করে রেখেছে। তাই সাঁওতাল হুলের একটি বিখ্যাত যুদ্ধের মধ্যেই সিদো কানহু পুজায় বসেন এবং বন্দুকের টোটা ঠাকুরের দয়ায় গলে জল হয়ে যাবে এই বিশ্বাসের ফলে তাঁদের পরাজয় ঘটে। এইভাবেই অলীক রাষ্ট্রবাদের যে দিকটা আকাঙ্ক্ষার তা নিম্নবর্গকে উৎসাহিত করেছে তার রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ও মৌলিকতা নিয়ে জমায়েত হতে, আর যে দিকটা অসাধ্যতার তা তাকে বাধ্য করেছে দৈব ও পারলৌকিকতার আশ্রয় নিতে। নিম্নবর্গের চৈতন্যকে যখন আমরা ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উদ্যোগী হব তখন যেন তার এই ধর্মাশ্রয়ী দোটানা চরিত্রের গুরুত্ব ও জটিলতা স্বীকৃতি পায় আমাদের গবেষণায়, আমাদের রচনায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *