৫৭. সংস্কৃতির সেতু নির্মাণ

সংস্কৃতির সেতু নির্মাণ – সন্‌জীদা খাতুন

ব্রিটিশ আমল থেকে পল্লির শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক জমিদাররা নগরবাসী হয়ে উঠবার ফলে দিনে দিনে পল্লির আচার-সংস্কৃতি এবং নাগরিক আচার আচরণে ব্যবধান ক্রমবর্ধমান হয়ে ওঠে। দেশকাল-সমাজসংস্কৃতি সচেতন কথা সাহিত্যিকরা তাদের সাহিত্যসৃষ্টিতে গ্রামীন মানুষের জীবন রূপায়িত করলে শহরবাসীর কাছে দেশের বাস্তব ছবি ফুটে ওঠে। এভাবে দুই সংস্কৃতির ভিতরে সেতুবন্ধন ঘটান তাঁরা। সুধাংশু শেখর বিশ্বাস এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নমশূদ্রদের নিয়ে ‘নমসপুত্র’ উপন্যাসটি লিখেছেন। পড়ে ভাল লাগল।

‘প্রসঙ্গ কথা’-তে বলা হয়েছে—”ফরিদপুর জেলার মধুখালী এবং রাজবাড়ি জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার দশ বারোটি গ্রাম নিয়ে বিল সিংহনাথ মৌজা… । বিস্তীর্ণ বিল সিংহনাথ মৌজার নমশূদ্রদের জীবনধারাকে আবর্তন করেই রচিত হয়েছে ‘নমসপুত্র’ উপন্যাসটি।” নমশূদ্রের জীবন সংগ্রাম আর তাদের প্রতি উচ্চবর্ণের অবহেলা, অত্যাচারের চিত্র পাঠকের মর্ম স্পর্শ করবে।

নমশূদ্র–সন্তানের শিক্ষালাভের আকাঙ্খা-উৎসাহ কী ভাবে পীড়িত হয়েছে, গল্পের প্রধান চরিত্র ‘হাজারি’-র জীবনেও সেই বিবরণী পাওয়া যাচ্ছে। প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে স্থানীয় জমিদার রক্তচক্ষু হয়ে ধমক দেন– “কিরম্ করে এট্টা নমশুদ্দুরের ছাওয়াল কিলাসে ফাস্ট হয়?… ইডা কোনোদিন মানা যাবিনে।” চাকুরি হারাবার ভয়ে হেডমাস্টার অগত্যা হাজারির রোল নম্বর এক থেকে নামিয়ে তের করে দেন। আর দরিদ্র প্রজাদের জমিজমা, ঘরবাড়ি বন্যায় ডুবে গেলে কিংবা খরাতে ফসল পুড়ে গেলে নিরুপায় হয়ে জমিদারের কাছ থেকে চড়া সুদে ধার নিতে ছুটতে হয় এদের। আর, জমিদারের মতে নমশূদ্ররা হলো “কুকুরের জাত” এবং “ওদের সারাদিন খাটাতি হবি। পদে পদে বুঝেয়ে দিতি হবি যে, ওরা জাতে নমশুদ্র। আহ্লাদ পালিই মাথায় চড়ে বসপি। তাই ধার আনতে গিয়ে দিনভর বেগার দিয়ে তারপর ফিরতে পারে তারা। রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ গল্পে ‘চন্দরা’র স্বামী আর ভাশুরকে যেমন বেগার দিতে দেখেছি আমরা।

বঞ্চনা-নিপীড়নের ফাঁকে ফাঁকে আবার নমশূদ্র গ্রামের কৃষিকর্মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিবিধ উৎসবের যৌথ আয়োজনের আনন্দও আস্বাদ করা গেল উপন্যাসে। সকলে মিলে রান্না-খাওয়া, ব্রত-আচার পালন, গান-বাজনা মিলে কৃষক জীবনের সাংস্কৃতিক আনন্দের বার্তা পাওয়া যায়। যেমন–পয়লা বৈশাখে লক্ষ্মীর আবাহনের জন্যে কৃষিকাজের যাবতীয় যন্ত্র–লাঙল-কাস্তে কোদাল ইত্যাদি ভালোমতো ধুয়ে এনে সিঁদুর মাখানো হবে। নতুন কাপড় না থাকলে ভাল-করে-কাঁচা কাপড় পরে সবাই যাবে পুন্যাহ পালন করতে। সেখানে খাজনা বাবদ নতুন খাতাতে যে-যার সাধ্যমতো দু-চার আনা জমা দিয়ে, ছোঁয়া বাঁচিয়ে উঠোনে নেমে বসবে। এইদিন জমিদার গৃহে পাত পেড়ে ভরপেট আহারের সুযোগ ওদের। সন্ধ্যায় গ্রামে ফিরে কখনো মনসামঙ্গল, কখনো ‘নিধুবনে কৃষ্ণকলি’ কখনো-বা ‘রাধিকার মান ভঞ্জন’ পালা শুনতে শুনতে ‘দশা’ ধরে যাবে ওদের।

কার্তিক মাসে ধান-কাটা উপলক্ষে কার্তিক পূজার বড় অঙ্গ ‘ভূত দাবড়ানো। ছড়ার ছন্দে ভূত তাড়ানোর মন্ত্রে দলবদ্ধ আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে পল্লির কুসংস্কারের পরিচয়ও পাওয়া যাবে। এরপর পৌষ মাসে ‘সোনাহারের বিয়ে কিংবা রাধাকৃষ্ণলীলার কাহিনি অথবা ‘নিমাই সন্ন্যাসে’র গান নিয়ে খোল-করতাল-হার্মোনিয়ম যোগে দলেবলে সকলে ‘মাঙনে’ যাবে বাড়ি বাড়ি। ছেলেরা আগের দিন সার বেঁধে ‘পলো’ নিয়ে বিলে নেমে বড় শোল-বোয়াল ধরে আনলে, মেয়েরা আঁশ বটি নিয়ে বসে যাবে মাছ কুটতে। পরদিন রান্নার জন্য মাছ সাঁতলে রেখে, মেয়েরা বসবে নানারকম পিঠে তৈরিতে। মিলিত শ্রমের আনন্দে ক্লান্তি ভুলে যাবে তারা। সকাল বেলা সমগ্র গ্রামবাসীর পিঠে ভোগের পরে ভোরে রান্না করা মাছ দিয়ে ‘ঝালমুখ’ হবে সকলের। সম্মিলিত আনন্দের তুলনা কোথায়!

মাঘ মাসে কুমারী মেয়েরা একত্র হয়ে ভিটে কুমারী’র বেদি ঘিরে গাইবে–

ভিটে কুমোরীর মা লো ভিটে বেঁধে দে
তোর ছাওয়ালে করবি বিয়ে সাজনা এনে দে…।

বেদিতে গান গাওয়া হলে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে সকলের ঘরে ঘরে গান গেয়ে বেড়াবে সারা সন্ধ্যা। সবশেষে বেদি তুলে নিয়ে মাঠের মাঝখানে বড়ো গাছের নীচে রেখে আসবে। আর ফাল্গনে পল্লির কিশোর-কিশোরীরা একজোট হয়ে সেই গাছতলায় বনভোজন করবে। মাঠের রাখালদেরও ডেকে এনে খাওয়ানো হবে। এমনি করে “ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রাণের টানে গড়ে উঠবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, ভাই-বোনের সম্পর্ক, গড়ে উঠবে আত্মীয়তা।”

তারপরে চৈত্রসংক্রান্তির পুজো অর্থাৎ গাজন। গায়ে মুখে ছাই মেখে বেরোবে ‘গাজনের সঙ’। ঢাকীর বাদ্যের সঙ্গে কাঁসির শব্দের সঙ্গে বাজবে হামোনিয়ম, চলবে গাজনের গান। পার্বতী-সাজা পুরুষের বিপদের কথাও লিখেছেন সুধাংশু শেখর রঙ্গ করে।–-“তার ঘনঘন বিড়ি খাওয়ার অভ্যেস।… কিন্তু মুশকিল হলো, সে বিড়ি ধরালেই সব ছেলেমেয়ে তার পেছনে লাগে। হিঃ হিঃ করে হাসতে শুরু করে আর চারপাশ ঘিরে বলতে থাকে –এ মা, এ দিকি বিড়ি খাওয়া পাব্বতী গো…। মা দুগগা বিড়ি খায় হিঃ হিঃ হিঃ…।” গাজনের সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব দেয় ‘বালাঠাকুর’, যার মন্ত্রেও ছড়াতে থাকে বীভৎস রস।

ক্ষান্তি নেই, গাজনের পরে আসবে ‘ভাসান পুজো। চৈত্র সংক্রান্তির মেলাতে নিত্য প্রয়োজনীয় বেসাতির সঙ্গে আসে মাটির হাঁড়িকুড়ি, মাটির পুতুল। কার্তিক থেকে চৈত্র পর্যন্ত এসব আমোদর পরে গ্রামে যাত্রাপালা, থিয়েটার, রামায়ন গান ইত্যাদিও রয়েছে।

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আনন্দের পাশাপাশি আরো নানাকিছু আছে। আছে কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার কথা, পণপ্রথার দুঃসহ দুঃখ, কন্যা সন্তান জন্ম দেবার ‘দোষে’ বধূ নির্যাতন, অর্থলোভে সৎ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার অন্যায়, রান্নার বিলম্বের দরুন স্ত্রীকে নির্দয় প্রহার, দুশ্চরিত্র যুবকের সঙ্গে গুপ্ত প্রণয়ে প্রলুব্ধ হয়ে গর্ভধারণের অপরাধে সালিশ-বিচারে নারীর শাস্তি হলেও সংশ্লিষ্ট পুরুষের বেকসুর খালাস…। ‘বিধবে রাখা’ নামে সমাজে স্বীকৃত একটি প্রথার কথাও আছে। স্ত্রীর মৃত্যু হলে দ্বিতীয় বিবাহ না করে পতিহারা নারীকে রক্ষিতা রাখাই ‘বিধবে রাখা’। সম্পত্তিতে দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তানদের অধিকার জন্মায় পাছে, তাই বড়ো বড়ো ছেলেমেয়েরা ওই ‘বিধবে রাখা’র পক্ষপাতী! শুধু নমশূদ্র নয় মুসলমানদের প্রতি ঘৃণাবোধও রয়েছে হিন্দুদের ভিতরে। রয়েছে দুর্ভিক্ষ, কলেরা-মহামারির কথা, চর দখলের রক্তারক্তি আর প্রাণহানি ঠেকাতে ছুটে-আসা ‘ভৈরব ডাক্তারের মতো মহৎ ব্যক্তিও রয়েছেন এলাকার নমশূদ্রদের ভিতরে। এই ডাক্তারের মন অপরাধীর জন্যেও অশ্রুশিক্ত হয়। ইনি দুর্ভিক্ষে, মহামারিতে ছুটে যান দুঃস্থদের কাছে। সমাজ সেবার জন্যে অকাতরে অর্থ ব্যয় করেন। দুর্ভাগ্য এই, এঁর দুই পুত্র গোপনে পিতার ক্যাশ ভেঙ্গে, ব্যাংকের টাকা তুলে নিয়ে, যথেচ্ছ জমি বেচে অসহায় দশায় ঠেলে দেয় ডাক্তারকে। অর্থাভাবের দরুণ শেষ বয়সে মূল আয়ের উৎস পদ্মার বাঁক ইজারা নিতে না পেরে ইলিশ মাছের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। এদিকে সকল বাঁধা জয় করে বি. এ. পাশ করা, সচ্চরিত্র ‘হাজারি’কে কন্যাদান করেছিলেন ডাক্তার। মৃত্যুকালে ছেলেদের অজানা কিছু সম্পত্তির দায়িত্ব এবং সঙ্গে সঙ্গে পল্লির নমশুদ্র সমাজের দেখভালের দায়িত্ব জামাতাকে দিয়ে চোখ বোজেন তিনি।

বংশ বা বর্ণ-পরিচয়ের ভাবনা আমাদের কাছে অর্থহীন মনে হলেও, দুঃসহ অপমান-লাঞ্ছনার দরুণ, নমশূদ্রের কাছে সে ভাবনা নিরর্থক মনে হয় না। বইটি পড়তে পড়তে তাদের দুঃখের তীব্রতা অনুভব করা যায়। হাজারির বাল্যের পাঠশালার পন্ডিত মশাই একবার নমশূদ্রদের বৈঠকে বলেছিলেন, নমশূদ্ররা প্রাচীনকালের এক জ্ঞানী রাজপুরোহিত নমস মুনির বংশধর। বি.এ. ক্লাসে পড়বার সময়ে উঁচু ক্লাসের মৃন্ময়ী দিদি হাজারিকে জানান, নমস মুনি হচ্ছেন ব্রাহ্মন কশ্যপ মুনির সন্তান। এজন্যেই ওদের গোত্রকে কাশ্যপ গোত্র বলা হয়। হাজারি কলেজ লাইব্রেরি থেকে একটি বই খুঁজে পেয়ে নমস্ মুনির বংশবৃত্তান্ত পড়ে মনে শান্তি লাভ করে।

এইজন্যেই উপন্যাসটির নাম দেওয়া হয়েছে “নমস পুত্র।

‘নমস পুত্র’– সুধাংশু শেখর বিশ্বাস, শিল্পঘর প্রকাশন, ঠাকুরগাঁও, ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ফারুন ১৪২০

সুধাংশু শেখর বিশ্বাস এর নমসপুত্র
অনির্বাণ রায়–কোলকাতা

সাধারণ বর্ণনা গদ্যে দেখানো হয়েছে ‘নমসপুত্র’র উত্থান। প্রথম ভূমিষ্ট হওয়া শিশুর খাড়া হয়ে দাঁড়াতে চাওয়ার মতোন নমসপুত্ররা শিক্ষা চেতনার আলোয় এসে দাঁড়াবার সাধে আকুলিত হয়, “নমসপুত্র” উপন্যাসে।

অসমাপ্ত আঁধার আরোপ করেছিরেন ঋষি মনু। একইরকম লাল রক্তের মানব শরীর, মানব মন, তথাপি তারা মানুষ নয়, শুদ্র গর্ভিনী মাতার পায়ের তালুতে আর এক গর্ভ না-কি আছে, সেই গর্ভ থেকে জন্ম। তাই ওরা শূদ্র, সুতরাং দাস। ভারত জগতের লোক বুঝে ফেলল এই তত্ত্ব, সত্য বলে গ্রহণও করল এই বিধান।

ঋষি মনু কয়েছেন, এ নির্ভুল সত্য। এরকমই এক দৃঢ় প্রতীতি।

তারপর করুণতম কষ্ট সংঘটিত হয়ে যায়। ধরিত্রির কোলে একদল পুত্রকন্যা মানুষরূপে জন্মলাভ করেও চির দাসত্বের চাদরে ঢাকা পড়ে গেল।

মনে হয় পাঁচ হাজার বছর ধারাবাহিক নিপীড়ন চালালো বর্ণবাদীরা। পশুসম এই দীর্ঘ নির্যাতনকালের মধ্যেই দু’একটি শূদ্রের সুপানোভা ঘটেছে। রোধ করতে পারে নি। লেখকের লক্ষ্য, এই কালান্তক জাতিভেদের অন্ধকারের ভিতরে যারা শিক্ষার আলোয় আধুনিক সভ্য মানুষরূপে সমাজে দাঁড়াতে চায়, তাদেরকেই খুঁজে খুঁজে দেখানো।

চমৎকৃত গদ্যে কাহিনি বলা নয়, সাধারণ বধুর চুলে বিলি কেটে জট ছাড়ানোর মতো করে বর্ণনা বিন্যাস। উপন্যাসের অবয়বে শিল্পরেখা খুঁজলে বহুশ্রুটি বেরোবে ঠিকই, তবে তার দরকার কতটা জরুরী যে আমি যদি সহজেই বুঝতে পারলাম বিভেদবৃত্ত ছিঁড়ে বেরিয়ে আলোয় এসে দাঁড়ানোর জীবন সংগ্রামচিত্র?

এই উপন্যাসে জ্ঞানেন্দ্রনাথ আধুনিক শিক্ষা সভ্যের সচেষ্ট উদ্ভাবক একজন। তিনি একটি এলাকার কেন্দ্রীভূত মুখ হয়ে সূচনা করলেন শিক্ষা অর্জনের উদ্যোগ। তিনি অতি দীন পরিকাঠামো সহায়ে যাত্রা শুরু করেন। পুকুর চালায় বসে কঞ্চির কলম দিয়ে তালপাতায় লেখা, সেই আরম্ভে জ্ঞানেন্দ্র নাথের বিদ্যালয়ে অল্প কয়েকজন দুরন্ত ছেলে শিক্ষার্থীর মধ্যে একজনকে দেখা গেল, এবং বোঝা গেল, পারবে, সে হাজারি। তার ভাল নাম হিমাংশু শেখর বিশ্বাস।

লেখক এই হাজারিকে কেন্দ্রমনি করেই আমাদের দেখাচ্ছেন, অতল শিক্ষা বর্জিত বিপুল আয়তন জনসমাজের দুরূহ শিক্ষালাভ অভিযান। এবং মোটেও কল্পনা কথা নয় তা, সত্য ঘটনা। যাদের কেউ কেউ জীবিত রয়েছেন আজও। এই হাজারি ও খনা যুগলকে আমি স্বচক্ষে দেখেছি।

নিত্য খরা বন্যা কবলিত বিল সিংহনাথ অঞ্চলের মধুপুর গ্রামে একটি দরিদ্র পরিবার হাজারির ঠিকানা। অভাবের পীড়ন আছে সর্বদা। আবার বামুন জমিদার ও তার বর্ণবাদী গোষ্ঠীর কুমতলবের খড়গ আছে মাথার উপর। এই দুর্বার হিংস্রতার নিচে হাজারি রোজ পাঁচ মাইল পথ পায়ে হেঁটে বালিয়াকান্দি হাইস্কুলে লেখাপড়া শিখতে যায়। এক এক সময় অনিশ্চিত ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করে। তখন একলা-যাত্রী যুবক হাজারি বিলের কোনায় ডুমুরমূলে বসে বহুদূর দেখে, নির্জন অপরাহ্ন।

একটু দূর দিয়ে বহমান মধুমতি নদী স্কুল বিচ্ছেদ সংশয়ে বুক কেঁপে ওঠে তার, সে যে সম্বলহীন। কোন শৈশবে বাবা-মা চলে গেছেন চিরতরে। আপন জ্ঞাতিভ্রাতা দাদা-বৌদিদের বিমূর্ত চারুসেহে হৃদয় সাধনা উজ্জীবিত হয় ঠিকই, কিন্তু সকলেই যে গরীব। জীবনপ্রার্থী এক যুবকের অন্তর কান্না দিগন্তে গিয়ে কাঁপে। আকাশ বুঝেছিল ছেলেটির বুকের খরা, তাই তো বিমুখ করে নি। যত্নে শিশির ঝরল মুকুলে। সে কুঁড়ি ফুল হয়ে ফুটলো। দোদুল্যমানতা শেষ হলে হাজারি চব্বিশ মাইল অর্থান্তরে ছত্রিশ কিলোমিটার পথ, হেঁটে, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয় স্নাতিক হবার জন্য। তক হবার পূর্বকালে ঝড় আসে সবেগে ফের, শক্তিমান অভাব নামের কালবৈশাখী, এবার উড়ে গেল তার সকল সাধনা প্রয়াস। পুরনোর ক্ষত টিনবাক্স ও বিছানা বেঁধে অনন্যোপায় হাজারি বিসর্জনে যাচ্ছে নিজের গায়ে, ভূমিষ্টকোল মধুপুর।

ঠিক তখন ভরসা হয়ে সামনে দাঁড়ালেন কলেজের জ্যোতিশংকর স্যার এবং তারপর পরম স্নেহশীলা মৃন্ময়ী দিদি। সহায় এভাবে সুগঠিত হলো হাজারির জীবন পতন রোধে, এবং সংকটমোচন, তারপর সে স্নাতক হলো। বিলসিংহনাথ অঞ্চলে আর এক নমস পুত্র সাতক।

এই লক্ষ্যতীর্থে পৌঁছানোর পরিক্রমায় হাজারি ‘নমশুদুরির ছাওয়াল’ বলে বামুনের কাটায় বিদ্ধ হয়েছে। মেগচামি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থানে উত্তীর্ণ হলে জমিদার সনাতক পাঠক প্রধান শিক্ষক ভবানী স্যান্যালকে ডেকে নির্দেশ দেন, নমশুদুরের ছেলে কিছুতেই প্রথম হবে না। তার স্থান সবার শেষে। অনন্যোপায় প্রধান শিক্ষক কান্না লুকিয়ে নিয়ম ভাঙতে বাধ্য হন। বালক হাজারি কারণ ভেদ করতে পারে না। প্রধান শিক্ষক এবং প্রথম শিক্ষাগুরু জ্ঞানেন্দ্র নাথ তাকে প্রাণভরা আশীর্বাদ দিয়ে সন্তুষ্ট করেন।

কূট প্রয়োগে অবশ হয় নি হাজারি, পায়ে পায়ে মাধ্যমিক সিঁড়ি পেরিয়ে যেতে পারে যথাসময়ে। তাহলে হাজারিকে মানবপুত্র মানতে শাস্ত্রেও দ্বিধা থাকে আর? তবু শাস্ত্ৰবিচারে হাজারিদের মানুষ বিবেচনা করতে পারে না কখনো।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ আমাদের এক আশ্চর্য শিক্ষক। তিনি কিভাবে লেখাপড়া অর্জন করলেন তার নিশ্চিত সন্ধান পাওয়া যায় নি। অথচ তিনি হিন্দু হৃদয়ের মনি রামায়ন মহাভারত ভাগবতাদি বেশ যোগ্যসুরে স্বরে পাঠ করতে পারেন, ব্যাখ্যাও করেন মধুর ভাষনে। এসব গ্রন্থ থেকে জীবনধর্মের কথা জেনে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ হয়, আর কতদিনে মানুষ শূদ্র আঁধার পায়ে দলেপিষে ‘জাত’ করবে। দুর্মর আকাঙ্খা তার এবং উৎসাহিত করার লক্ষ্যে জনসমষ্ঠির নিকট ব্যক্ত করেন। তাঁর স্বপ্ন ধাবিত হয় হাজারির সম্ভাবনার কাছে। অভাবী সংসারের কোন তাড়না তাঁর শিক্ষাকতাত থেকে চমুত করতে পারে নি।

অন্যপাশে আর একজন ভূক্তভোগী মানুষকে পাই, হিন্দুধর্ম দর্শনের বিচারে তিনিও শূদ্র, গোয়ালন্দ অঞ্চলের মস্ত ধনী ভৈরব ডাক্তার। তাঁর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠজমি, নানাদিকে বৃহৎ ব্যবসা আর চিকিৎসা পেশা। মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার তিনি নন, অন্যের অধীনে থেকে আয়ত্ব করা। রোগী অর্ধেক ভাল হয়ে যায় তাঁকে দর্শন মাত্রে, এমন জ্যোতির্ময় পুরুষ তিনি। আরবীয় তেজস্বী ঘোড়ার পিঠে চড়ে গমনাগমন করেন মুকুটধারী পুরুষের মতো। সর্বার্থে হিতাকাঙ্খী, বিপন্ন মানুষের সহযোগী, স্ত্রী সন্তান ঘর প্রিয়, জাতির শুভচিন্তক, দেশ কাল দুরদি একজন পূর্ণ মানুষ। কে তাঁকে চেনে না।

কিন্তু হিন্দু ঋষির ধর্ম দর্শনের অপজাত বৰ্ণভাগ তাঁকে বলে শূদ্রের উত্তরাধিকারী শূদ্র, বামুন কায়েত বৈদ্য তাঁকে বলে নিকৃষ্ট চন্ডাল। এই যাতনায় তিনি উদ্বেলিত হন সকল সময়। চেষ্টা করে চলেন স্থবিরদেরকে অন্ধকার স্তূপ থেকে জাগরণের। আপন পুত্রকন্যা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোক, অন্ধকারাচ্ছন্ন চারিপাশের মানুষকে জাগাক, জগদধর্ম বুঝুক। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। নিজের জ্যেষ্ঠপুত্র ভবানীশংকর মদ্যপায়ী, নারীবিলাসী, আত্মগৃহে বিবেচক সিঁদেল। বিপন্ন মানুষের সহযোগি হওয়ার গুণটি ধারণ করেও অপার কুহকে আবিষ্ট থেকে সে সংগোপনে ক্রমধারায় ধ্বংস করে ফেলে প্রিয়মান্য ভৈরব ডাক্তারের সর্বস্ব। শেষ নিঃশ্বাসের কালে তার অন্তর্লীন বেদনা কেঁদেছে। তখন উপশমের জন্য উপলব্ধ বিশ্বাসে মানবদরদি মৃন্ময়ী এবং স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী জামাতা হাজারিকে কাছে ডেকে অর্পণ করে গেছেন তার অসমাপ্ত স্বল্পকর্মের ভার। তার প্রত্যাশা এমন বিশ্বাসী যে, এই দুজন বিশ্বস্ত সযত্নে অগ্রসর করে যাবে স্বপ্নের কর্মব্রত।

মহাত্মা জীবন জোদ্দার ইংরেজ প্রশাসক প্রতিকূল ভূ-প্রকৃতির সম্মুখে বিচলিত হয়ে রাস্তা নির্মান কাজ যেখানে বন্ধ করে রাখলেন, বহুমুখীসাধন একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ, জীবন জোদ্দার নিজব্যয়ে সেই দীর্ঘ সড়কটি বীরবিক্রমে তৈরি করে দিলেন মানবকল্যাণের জন্য। খুশিমনে ইংরেজ কমিশনার জীবন জোদ্দারকে ডেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং ব্যয়িত অর্থ ফেরত প্রদান করতে চান। জনকল্যাণে উৎসর্গ কাজের দাম তিনি নিলেন না। এই মহানুভবতায় আরো মুগ্ধ ইংরেজ কমিশনার জীবন জোদ্দারকে খুলনার ডেভেলপমেন্ট কমিটির সদস্য নির্বাচিত করে নিলেন। সেখানে অন্য ভারতীয় সদস্যবর্গ সবাই বামুন কায়েত বৈদ্য। যথারীতি কমিটির আহুত সভার আলোচনায় যোগদান করলে পর নাক উঁচু বামনি কায়েত বৈদ্যরা তাঁকে সহ্য করতে পারল না। শেয়ালীচমকে তারা ছলনার গেরো আঁটে, নিকৃষ্ট চন্ডালকে কমিটির সম্মানজনক পদ থেকে উপড়ে ফেলতে হবে।

জাতবাদীরা সভায় উপস্থিত জীবন বাবুর বিরুদ্ধে কমিশনারের নিকট লিখিত অভিযোগ জানালো। জীবন জোদ্দার জাতিতে নমশূদ্র, ধর্মহীন, নিকৃষ্ট, চন্ডাল। এমন জাতের লোকের সাথে সমশ্রেণীতে বসলে উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ্য মর্যাদার চুড়ান্তহানি হয়। দ্রুত ব্রাহ্মণ্যমর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থা করা হোক। চারুমিথ্যা জর্জরিত বামনিকায়েতবৈদ্যর কী নিবোধ হিংস্রতা।

পরমজ্ঞানী ঋষি মনু কী রাক্ষুসে শ্লোককাঠি দিয়ে গেছেন মানুষ খাদক শাস্ত্রের গর্ভে? আবার চেয়ারে আসীন একজন মানুষ পদদলিত হলো। চরম লাঞ্ছনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান ধরিত্রী-মায়ের অমৃতপুত্র। হিন্দুধর্ম দর্শণের আবিষ্কারক ঋষি মানব জনের মূল সম্পদ ‘ভালবাসা খন্ডবিখন্ড করে রেখে গেছেন, তাতে ছড়ালো শুধুই ঘৃণা আর ধ্বংস। এই চরম ভুল চেতনার অবলোপ কখনো ঘটলো না। নিশ্চয়ই সেদিন ইংরেজ সাহেব ভারতীয় হিন্দু মানসিকতায় আশ্চর্য হয়েছিলেন। এরা কর্মীর অবমূল্যায়ন করে।

কমিশনার সাহেব জীবন বাবুর স্বপক্ষ বক্তব্য জানতে চান। তখন জীবন বাবু অভিযোগের উত্তর পরম বিক্রমে দেওয়ার জন্য ছয়মাস কালের সময় চেয়ে নেন।

শুরু হয় শুদ্ৰজাতির জন্মমূল অনুসন্ধান, জ্ঞানীগুনী মহতের সমবেত প্রয়াসে। সন্ধান পরিক্রমায় অবশেষে তাঁরা ওড়াকান্দি তীর্থে পূর্ণ মানুষ শ্ৰীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের পদমূলে স্থির হন। তিনি মানুষের অন্তরের কান্না বোঝেন। বলে দেন সেই শাস্ত্রের সন্ধান। তথ্য সংগ্রহ করে যথাকালে জীবন বাবু সহধর্মী সহচরদের সাথে উত্তরদান সভায় উপস্থিত হন। সেই সভাতে কমিশনার সাহেবের অনুমতি নিয়ে জীবন জোদ্দারের প্রতিনিধিরূপে সাচিয়াদহ গ্রামের বীরপুত্র শ্রী উমাচরণ নম জাতির পরিচয় ব্যাখ্যা করে বলেন এবং সগর্বে ঘোষণা করেন–

‘আমরা নম জাতি মহামুনি নমস এর বংশধর। মহামুনি নমস এর পিতা মহামুনি কশ্যপ। তাই শাস্ত্রমতে আমাদের গোত্রের নাম কাশ্যপ গোত্র।

এরপর উমাচরণ বাবু তাঁর বক্তব্যের মূলসূত্র প্রমান স্বরূপ পন্ডিত শ্যামাচরণ তর্কালঙ্কারকে দিয়ে কৃত ‘শক্তিসংগম তন্ত্র’ গ্রন্থের প্রানতোষী অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদখানি সর্বসমক্ষে উপস্থাপন করেন।

আত্মমর্যাদা রক্ষায় অলঙ্নীয় যুক্তি প্রদান।

বৃহৎ এক মানবগোষ্ঠীকে নিকৃষ্ট প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে ছোঁড়া বামুনে ক্ষেপনাস্ত্র এই প্রত্যাঘাতে শুন্যেই বিলীন হয়ে গেল।

জাতিভেদ হিংসায় লাঞ্ছিত জীবন জোদ্দার শূদ্ৰজাতির জনের আদিকথা উন্মোচন করে দিলেন সর্বসমক্ষে। একাগ্র অনুসন্ধানে নিজেকে নিবেদিত রেখে খুঁজে এনে তিনি দেখাতে পারলেন জাতির পরিচয়। অপমান একজন মানুষকে কতখানি সক্রিয় সজীব করে তোলে মহাত্মা জীবন জোদ্দারের মধ্যে সেই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা গেল। তার উদ্যোগ প্রচেষ্টা সর্বার্থে প্রতিযোগ্য।

.

একজন চরিত্রহীন বজ্জাত একজন শুদ্ধচেতনা লালনকারীকে খামোকা কটাক্ষপাতে বিধে নিজের শক্তিমত্তা জাহির করে। পিটপিট করে এর আগুন, সেই ছোবলে পুড়ে নিঃস্ব হয় প্রকৃত সম্ভাবনা। জগতে এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বজ্জাতি পৃষ্ঠপোষকতা করেন, জ্ঞানী ঋষি। উত্তরপুরুষে সেই অন্যায় পরিষ্কার বুঝলেও প্রতিকার হয় না। শুদ্ধ সরল মানব দর্শনের জন্ম হয় না। এইভাবে অপজাত নোংরামি মানব জীবন বিকলাঙ্গ করে চলেছে।

বীরপুত্র উমাচরন এর ব্যাখ্যার মধ্যে শূদ্রজাতির পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথে আর একটি শাখা জাতির জন্মকথা জানতে পারছি। তা হলো ‘চন্ডাল। ব্রাহ্মণ পিতার ঔরসে শূদ্রমাতার গর্ভে জন্ম যার শাস্ত্ৰবিচারে সে শূদ্র, প্রকৃত প্রস্তাবে সে ব্রাহ্মণ। আর শূদ্রপিতার ঔরসে ব্রাহ্মণমতার গর্ভে জন্ম যার শাস্ত্র রায় দিয়েছে, সে ‘চণ্ডাল’। নিকৃষ্ট জাত।

সর্বপ্রকার উচ্ছিষ্ট জঞ্জাল বর্জ্য পরিষ্কার ও রাজ আদেশে নানাবিধ নিধন কর্ম আর শবদাহ করা তার জাত পেশা।

এখানে লেখকের বক্তব্য কি? পঙ্কিারভাবে বুঝতে পারলাম না। লেখক যেন মরিয়া হয়ে জানাতে চাইছেন ‘শূদ্র জাতি আসলে মূল্যগতভাবে ব্রাহ্মণ। কালের ফেরে নরপশুদের চক্রান্তে হয়ে গেছে নিকৃষ্টতম শূদ্র। যথাযোগ্য প্রমান ও সুযোগ ছিল এই ঘটনাপ্রবাহে প্রকৃত মানব সত্যের পক্ষে কথা বলার, লেখক তা করেন নি।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ লিখলেন, যা ছিল তাঁর প্রথম লেখা। সমগ্র বাংলা সাহিত্যে একখানা ‘ক্লাসিক’ হয়ে রয়েছে। ‘নমসপুত্র’ একটি বলিষ্ঠ সত্যকাহিনি হয়েও আমাদের হৃদয় গর্বিত হয় না। কত কি যেন বাকী রয়ে গেল সেখানে।

সুধাংশু শেখর বিশ্বাস-এর নমস পুত্র
মোহাইমেন আমিন

১.

‘নমস পুত্র’ পড়া শুরু করলাম। কিছু উপন্যাস আছে যেগুলো পড়তে গেলে নানা রকম চিন্তার পোকা মাথায় ঢুকে উৎপাত শুরু করে। ‘নমস পুত্র’ মনে হচ্ছে সেই গোত্রের। সেই পোকাগুলো বের করে না এনে শান্তি পাওয়া যাচ্ছে না।

উপন্যাসটির শুরু হয়েছে গ্রামের শীতের একটি চিরচেনা সকালের দৃশ্য দিয়ে। তাদের দু-একজনের গায়ে রংচটা চাদর আছে বটে তবে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের গায়ে জড়ানো তাদের মায়ের পুরনো কাপড়। ভাঁজ করে পেঁচানো সেই কাপড়ের দু’প্রান্ত গলার কাছে গিট্ট দিয়ে বাঁধা। চাদরের চেয়েও বেশি ওম এই কাপড়ে ..

এই অংশটুকু পড়ে ইট-কাঠের শহরে বন্দি মধ্যবয়সী মন হুহু করে ওঠে গ্রামের শৈশবের জন্য–’দু-প্রান্ত গলার কাছে গিটু দিয়ে বাঁধা মায়ের ওম দিয়ে জড়ানো যে শৈশব।

যে অঞ্চলের পটভূমিতে উপন্যাসটি লেখা সেখানে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠার কারণে কিনা জানিনা, পড়তে গিয়ে শব্দ ছবিগুলো খুবই জীবন্ত হয়ে হাতছানি দিচ্ছে। যেমন,

‘এ অঞ্চল ফলে ফসলে, বক্ষ কাননে বিন্যস্ত খোঁপার মতো সুশোভিত। উঠোনের পাশ ঘেঁষে গ্রীবাটান উটের মত দাঁড়িয়ে থাকে ধান, খড় আর চৈতালির পালা ..’

‘এই বিলে পদ্মফুল হেসে হেসে দোল খায়। বাতাসের তালে তালে নেচে বেড়ায় শাপলা… নতুন জলে খলবল করে ছুটে বেড়ায় চ্যালা, পুঁটি, ট্যাংরা, রয়না, খয়রা, টাকি, সরপুটি..’

তবে বর্ণনাগুলোর কোথাও বাহুল্য নেই, বর্ণনার কারণে কোথায় গতি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে না।

কাহিনির শুরু জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাইন নামের এক দরিদ্র মাস্টারমশাই এর বিনি পয়সার ঘরদোর হীন পাঠশালায়। সেখানে দাবিয়ে রাখা নমশূদ্র সম্প্রদায়ের কয়েকটা শিশু পড়তে আসে। তাদের মধ্যে রয়েছে হাজারি নামের মেধাবি একটি ছেলে। জ্ঞানেন্দ্রনাথের আদর্শ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি এই সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালানোর, তাদের পায়ে লাগানো সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দৈন্যের শৃঙ্খল ভাঙার স্বপ্ন দেখেন। এই সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি জমিদার এবং উঁচু জাতের ঘণার বিষয়টি বেশ স্পষ্ট। কিন্তু পরিমিতভাবে ফুটে উঠেছে, আশে-পাশের মুসলমানদের সাথে তবু ওঠাবসা চলে, কিন্তু নমশূদ্রের ছায়া মাড়ানোও পাপ। সনাতন পাঠক (জমিদার) সকলের সামনে নির্ধিদ্বায় বলেন, নমশূদ্ররা হলো কুকুরের জাত… ব্রাক্ষ্মণের পদসেবার জন্য নমশূদ্রের জন্ম।

শুধু ঘৃণা নয়, নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতি অকারণ অত্যাচারও কম করা হয় না। জমিদারের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ আনতে গেলে সারাদিন খাঁটিয়ে নেয়। শুধুমাত্র নমশূদ্র সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার পরও হাজারির তোল ১৩ হয়ে যায়।

ধর্মীয় বর্ণবাদকে লেখক যেভাবে মোকাবেলা করতে চেয়েছেন সেটি বেশ ব্যতিক্রমী। কমিউনিস্ট চিন্তাধারায় আলোকিত হলেও তিনি ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমেই ধর্মীয় অপ-রীতির অবসান খুঁজেছেন। জ্ঞানেন্দ্র মাস্টারমশাই প্রচার করেন এই সম্প্রদায়ের অপ্রচলিত একটি ইতিহাস। জানান যে তাদেরকে আজ বিলে-জঙ্গলে সভ্যতার সুযোগ বঞ্চিত হয়ে কাটাতে হচ্ছে। তার কারণ তাদের পূর্বপুরুষ নমস মুনির সত্যের প্রতি অবিচল আপোষহীনতা। জানান যে, নমস মুনি ছিলেন রাজসভার প্রধান পুরোহিত। শুলে চড়ানোর ভয় অগ্রাহ্য করে তিনি রাজার দাসীর গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে ফতোয়া দিতে অস্বীকার করেন। এক পর্যায়ে প্রজাদের চাপে নমস মুনিকে ছেড়ে দেয়া হলো বটে কিন্তু বলা হলো তাকে পরবর্তীতে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যা করা হবে। সেই থেকে সপরিবারে তিনি পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন শ্বাপদ শংকুল গহীন অরণ্যে, জনমনুষ্যহীন বিল জলাভূমিতে…

২.

নমস পুত্রের জমিন তৈরি করা হয়েছে খুবই মুন্সিয়ানার সাথে। বিল এলাকার শব্দ দিয়ে, সেই স্থানের মাটি ও মানুষের ছবি আঁকা হয়েছে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। যেমন,

‘আর পদ্মার বিস্তীর্ণ চর জুড়ে আবাদ হয় মাষকলাইয়ের। বিল সিংহনাথের আঁঠালো মাটিতে এটা জন্মায় না।’

‘বৃষ্টিতে আঠালো মাটি দইয়ের মতো হাঁটু পর্যন্ত কাদায় কাদাময় হয়ে যায়।’

‘বর্ষার সাথে সাথে মাঠে জো আসে’

‘আমন ধান কাটা, উঠোনে মলন মলা, ধান শুকিয়ে ভোলে তোলা …’

‘জো আসা’, ‘মলন মলা’ জাতীয় স্থানীয় শব্দের ব্যবহার উপন্যাসটিকে একটি ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।

গ্রামীণ প্রকৃতিকে যেমন তিনি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি গ্রামের সামাজিক জীবন–তার সরলতা ও জটিলতা–উভয় দিকই আঁকা হয়েছে সততার সাথে। বিবাদমান দুই পক্ষের কাছ থেকে একই স্বাক্ষীর টাকা নেয়া, অবস্থাপন্ন জগা কর্তক দরিদ্র রাধা সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়লে যে সালিশ বসানো হয়, তার বর্ণনাতে ভিলেজ পলিটিক্স ফুটে উঠেছে অত্যন্ত পরিস্কারভাবে। বিচারকর্তা মোড়ল প্রথমে রাধার বক্তব্য শোনেন, তাকে সমর্থন করেন এবং জগাকে দোষী সাব্যস্ত করেন। এ পর্যায়ে সকল পক্ষেরই সমর্থন পান তিনি। তারপর তিনি কষেণ মোক্ষম পাঁচটি। রাধার হাতে সুতো দিয়ে নিজে একটি সুই নেন এবং তাতে রাধাকে সুতো পরাতে বলেন। রাধা যতই চেষ্টা করে, তিনি ততই সুইটা নড়াতে থাকেন। এভাবে তিনি ভরা মজলিশকে দেখিয়ে দেন যে, ঘটনা দুই পক্ষের সম্মতিতেই ঘটেছে এবং দোষ হলে দুইজনেরই হয়েছে। মোড়ল এই পক্ষপাতদুষ্ট বিচার করেন তার কুদর্শন মেয়েকে জগার বাবার ভাগ্নের সাথে বিয়ে দেয়া এবং তার নামে পাঁচ পাখি জমি লিখে দেয়ার শর্তে।

৩.

নমস পুত্র পড়া শেষ করে ফেললাম, কিন্তু নায়িকার দেখা নেই। নায়কের উপস্থিতিও তেমন প্রকট নয়। নায়ক হচ্ছে পিতা-মাতাহীন হাজরা, তবে তাকে কেন্দ্র করে ঘটনাগুলো ঘটছে না বরং সে ঘটনাগুলো একটা অংশ। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মনে হলো এটি পোর্ট্রেট নয়, বরং ল্যান্ডস্কেপ। লেখক অনেক বড় ক্যানভাসে একটি সমাজের, একটি সময়ের সচল ছবি এঁকেছেন। বিশাল রঙ্গমঞ্চ ভর্তি পাত্র-পাত্রীদের একেক জনের উপর একেক সময় লেখক তার জাদুর আলোটি ফেলছেন আর তাদের জীবন ছবি দৃশ্যমান করছেন। এ ধরণের বড় ক্যানভাসের উপন্যাসে পাঠককে শেষ পর্যন্ত আঁকে রাখা খুব কঠিন। টানটান উত্তেজনা থাকে না, অটুট সাসপেন্স থাকে না, আঁটোসাঁটো গতি বজায় রাখা যায় না। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, উপন্যাসটি আমি পড়েছি অনেকটা এক টানেই। এক কেন্দ্রিক কাহিনি ছাড়াও পাঠক আঁকে রাখা গেছে হয়েছে সম্ভবত: বর্ণনাভঙ্গীর কারণে। ঝরঝরে বর্ণনায় জীবনের নানা দিক হালকা রসে ভিজিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু অন্তরালে দেয়া হয়েছে তীক্ষ্ণ খোঁচা। যেমন হাজরার কলেজের কৃষ্ণবর্ণের ছাত্রী মন্ময়ীর কথা ধরা যাক। কয়েকজন বখাটে ছেলে তাকে দেখে ‘জয় মা কালি’ বলে উত্ত্যক্ত করলে মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে দেবীর মত হাত উঁচু করে তাদেরকে আশীর্বাদ করে করে বলে ‘সুখী হও বৎস’। সে সময় গ্রামে বিগত যৌবন বৃদ্ধদের তরুণী বিয়ে করার চল ছিল। এই মেয়েরা অনেকেই যৌবনের স্বাভাবিক চাহিদার কারণে আশ-পাশের কোন তরুণের সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়তো। ব্যাপারটা স্বামী বুঝতে পারলেও কিছু বলতে পারতেন না লোক-লজ্জার ভয়ে। তারা প্রতিক্রিয়া দেখাতেন অন্য ভাবে। কোন এক অজুহাতে স্ত্রীকে অহরত পিটাতেন। এরকম এক তরুণী করুণা বান্ধবীর বুদ্ধিতে ভুত-গ্ৰস্থা সাজে স্বামীকে পাল্টা মার দেয়ার জন্য। ভুত তাড়ানোর জন্য যে ওঝা ঠিক করা হয়, তার সাথেও চুক্তিতে যায় তার প্রেমিক, যাতে ওঝা তাকে ঝাঁটাপেটা না করে।

দরিদ্র-এতিম হাজরা মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হলো বড় শহর ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে। সে গুডবয় টাইপের ছেলে। তাস খেলে না, তামাক খায় না। সেখানে মৃন্ময়ী নামে উপরের ক্লাসের একজন ছাত্রীর সাথে পরিচয় হয় তার। মন্ময়ী কলেজের নামকরা ছাত্রী, ম্যাজিস্ট্রেটের বোন।

বিলের ধান ডুবে যাওয়ায় অর্থাভাবে হাজরা যখন লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখে গ্রামের ছেলে গ্রামে ফিরে যাবার পথে তখন তার একজন শিক্ষক তাকে ঠাঁই দিলেন নিজের বাড়ি। মন্ময়ী যোগাড় করে দিলো পরীক্ষার ফিস।

নমসপুত্র সম্ভবত: বর্ণনাপ্রধান উপন্যাসের জেনরিতে পড়ে। ঘটনার ফাঁকে ফাঁকে, কাহিনির মোড়কে নমশূদ্র সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পালা-পৰ্বন, আচার–ইত্যাদির বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বর্ণনাগুলো জীবন্ত ও ঝরঝরে হওয়ার কারণে কখনোই অতিরিক্ত মনে হয়নি, শুধু নমশূদ্র সম্প্রদায়ের ইতিহাস নিয়ে যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে, সেটুকু ছাড়া। বর্ণনার কারণে বইটি রেফারেন্স হিসাবেও ভূমিকা রাখবে।

বিএ পাশ করে হাজরা স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে। তার বিয়ে হয় এলাকার একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ভৈরব ডাক্তারের মেয়ে খনার সাথে। ভৈরব ডাক্তার শুধু বিত্তশালীই নন, তিনি একজন জনহিতৈষী ব্যক্তিও। অভাবের সময় নিজ অর্থে লঙ্গরখানা খোলেন, দুহাতে খরচ করেন মানুষের জন্য। রাজনীতির সাথেও তিনি জড়িত। তার জীবনের বেশ কিছু ঘটনাও উপন্যাসে এসেছে। এসেছে ভারত বিভাগ, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা। ভৈরব ডাক্তারের মৃত্যু এবং তাঁর শেষ চিঠির মাধ্যমেই উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। তিনি তার জামাই হাজরাকে একটা গোপন চিঠি লিখে যান, যাতে নমশূদ্র সম্প্রদায়ের কল্যাণের জন্য তাঁর অসমাপ্ত স্বপ্ন ও পরিকল্পনার কথা লেখা ছিল। হাজরা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতিজ্ঞা করেন।

পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল হাজরার কাছে যা চাচ্ছি তা যেন পাচ্ছি না। লেখকের সৃষ্টির উপর নিজের প্রত্যাশা আরোপ করা সমীচীন না হলেও কেন্দ্রীয় চরিত্রের সাথে পাঠকের একাত্ম হবার প্রয়োজন রয়েছে। হাজরার চরিত্রে আরেকটু রক্ত-মাংস থাকলে ভালো হতো। তার মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ, আকাঙ্খ–কোনটারই আধিক্য দেখা যায়নি। শুধু একবারই সে জ্বলে উঠেছে–দীনবন্ধু নিজের স্ত্রীকে অমানুষিকভাবে পেটানোর সময় যখন হাজরা লাঠিটা কেড়ে নিয়ে উল্টো দীনবন্ধুকে পেটানো শুরু করে। হাজরার চেয়ে ভবানীর চরিত্রটি বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে।

নমসপুত্রের মত এতো বর্ণিল এবং প্রাণময় উপন্যাসের প্রচ্ছদ আরেকটু আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন হলে ভালো হতো।

‘আগে দর্শনারী,পরে গুণ বিচারী’ কথাটা এই বইয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও প্রযোজ্য।

লেখকের পরবর্তী লেখা পড়ার প্রতীক্ষায় রইলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *