৪০. স্থানীয় ভাষায় কথা

৪০

কী খবর হাজরা, আছো কেমুন? সব কুশল তো!

হ জ্যাঠা। ভালো আছি। তা তুমরা ভালো তো! জেঠিমা? হাজারি এখন শুদ্ধ ভাষায়ই কথা বলে। তবে গ্রামের বা এলাকার মানুষের সাথে সে স্থানীয় ভাষায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

সগগলেই ভালো আছে। তা শুনলাম, বড় গাছে নাও বাঁধিছো।

ওঃ বিয়ের কথা কচ্চো। তা যদি কও, কতি পারো। এলাকার মদ্যি সবচে বড় ঘরেই বিয়ে করিছি আমি। ভৈরর ডাক্তারের মেয়ে যে আমার সাথে বিয়ে দিবি, তা তো জ্যাঠা আমি স্বপ্নেও ভাবতি পারি নেই।

তা তো ঠিকই। তয় তুমিই বা কম কিসি? বিয়ে পাস দিছো। সিডা কি এ তো সুজা কাম! কিডা আছে আর বিএ পাস এ তল্লাটে। ভৈরব বাবু ডাক্তার হতি পারে, জমিজমা, টাকা-পয়সা থাকতি পারে। কিন্তুক বিএ পাস তো আর করতি পারি নেই।

ও কথা কোয়ো না জ্যাঠা। আমার শ্বশুর বলে কচ্চিনে, নমশূদ্র সমাজের মদ্যি তাঁর মতো মানুষ পাবা কনে?

তা কতা ঠিকই কইছো। তয় দুওয়া-থুওয়া কীরম হলো?

কী কতি চাচ্ছো, জ্যাঠা? ঠিক বুঝতি পারলাম না।

বুঝলে না, মানে বিয়েতে কী কী পালে?

ও, তুমি যে হিসেবে কচ্ছো, সে হিসেবে কিছুই পাই নেই। কিন্তু আবার সবই পাইছি জ্যাঠা।

কীরম? ঠিক বুঝতি পাল্লাম না।

বিয়ের সুমায় একটা শর্ত দিছিলাম। সিডা হলো, বিয়ে হতি হবি দিনা পাওনা ছাড়া। কোনো যৌতুক দুয়া যাবি নে। শুনে ভৈরব ডাক্তার আমারে বুকির মদ্যি জড়ায়ে ধরিছিলেন। বলিছিলেন-সাধু সাধু। এরম ছাওয়াল যদি ঘরে ঘরে থাকে, তালি নমশূদ্র সমাজের উন্নতি হতি দেরি হবি নে।

অঃ, তালি জিনিসপত্তর কিছুই পাও নাই?

পাইছি জ্যাঠা। যা পাইছি তা অমূল্য, পয়সা দিয়ে কিনা যাবি নে। এই ঘরে বিয়ে না হলি তা কোনোদিন ভাবতিউ পারতাম না।

কীরম?

তুমি কি শুনিছো, স্টেশন ছাড়া কোনোদিন রেলগাড়ি দাঁড়ায়?

না, তা দাঁড়াবি ক্যা?

কিন্তুক দাঁড়ায় জ্যাঠা। ভৈরব ডাক্তারের জামাই হলি, তার জন্যি দাঁড়ায়। ইবার বুঝিছো জ্যাঠা, কি পাইছি আমি? মধুপুরির এই তোমাগের হাজরার মতো এট্টা মানষির জন্যি আমার শ্বশুরবাড়ির সামনে মাঠের মধ্যি ট্রেন দাঁড়ায়ে গেল। এর উপরে কি আর পাওয়ার কিছু আছে? আর জিনিসির কতা কচ্চো, জিনিস দিয়ে আমি কী করবো? ও তো টাকা হলিই কিনা যায়। আমিউ কিনতি পারি, তুমিউ কিনতি পারো। কিন্তুক সম্মান! সিডা তো আর টাকা দিয়ে কিনা যাবি নে। ভৈরব ডাক্তার সিডা অর্জন করিছেন। নাকি কোনো সন্দেহ আছে?

না, সন্দো থাকপি ক্যা? ভৈরব ডাক্তার আমাগের গর্ব, সিডা সগগোলেরই এক বাক্যে সিকার করে নিতি হবি। কিন্তুক যৌতুক ছাড়া আমার মিয়ার বিয়ে দেবো ক্যাম্বা? কোনো পাত্তর আসে যদি কোতো তুমার মিয়া নিলাম। কিছু দিতি-থুতি হবি নে। তালি আমিউ তো তারে বুকির মদ্যি জড়ায়ে ধরতি পারতাম। নাকি কও?

চিন্তা কোরে না জ্যাঠা, নমশূদ্দুর সমাজ জাগে উটতেছে। এখন না হলিউ, একদিন হবি। নিশ্চয়ই হবি। ঘরে ঘরে যৌতুক ছাড়াই মেয়ে বিয়ে হবি। যদি বাঁচে থাকো তালি দেকতি পারবা।

যেন স্বপ্নের ঘোরে কথাগুলো বলে গেল হাজারি।

হলি ভালো। তয় এহন হলি এট্টু বেশি ভালো হোতো। নিজির মিয়া দুডোরে যৌতুক ছাড়া বিয়ে দিয়ে যাতি পারতাম।

চিন্তা কোরো না জ্যাঠা, তোমার দুই মেয়েরই ভালো বিয়ে হবি। আমরা আছি না!

৪১

বড় ঘরের বারান্দায় বিশাল কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ির উপরে বসে আছে অজিত শঙ্কর। তার ডাকনাম ছবি। সে ভৈরব ডাক্তারের ছোট ছেলে। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিতে আজ সে ফরিদপুরে যাচ্ছে। সেখানে মন্টু মন্ডলের বাড়িতে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ধান-দূর্বা আর প্রদীপ নিয়ে মা এলেন। সাথে দৈয়ের বাটি। প্রথমে ধান-দূর্বা দিয়ে একে একে সবাই আশীর্বাদ করবে। তারপর ছবির কপালে দৈ-এর ফোঁটা দেয়া হবে। এর মধ্যে মঙ্গল নিহিত আছে।

সবাই আশীর্বাদ করে ফেলেছে। বাকি শুধু বাবা ভৈরব ডাক্তার। সেই কোন অন্ধকার থাকতে তিনি আড়তে গেছেন গোয়ালন্দ বাজারে। ফিরবেন এখুনি। তার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ছবি বিরক্ত হয়ে উঠে পড়তে চাইছে।

বাবা, আমার লক্ষ্মীসোনা উঠিস নে। এরম অবস্থায় উঠতি হয় না। তোর বাবা এখনই আসে পোড়বে নে। আরেকটু ধৈর্য ধরে বয় বাবা। মা কাকুতি মিনতি করে বললেন।

ধুর। এরম করে এতক্ষণ বসে থাকা যায়? একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ে ছবির মুখ দিয়ে।

আর বসে থাকতি হৰি নে। এই যে আমি আসে পড়িছি। বড় আনন্দের দিন আজ। আমার ছেলে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতি যাচ্চে।

হাঁপাতে হাঁপাতে ভৈরব ডাক্তার এসে ধান-দূর্বা দিয়ে ছোট ছেলেকে আশীর্বাদ করলেন। বিকেলে ঢাকা যেতে হবে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু গুছিয়ে আসতে তার দেরি হয়ে গেছে।

শেখ মুজিব ছয় দফা দাবিনামা পেশ করবে। তার খসড়া প্রস্তাবনা তৈরি হয়েছে। তাই বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার জন্যে জরুরি ভিত্তিতে সাধারণ সভা ডাকা হয়েছে। বেশ লাগে তার এই সুদর্শন ছেলেটিকে। যেমন তেজী, তেমনি সাহসী। আর বক্তৃতা? কানে ঝনঝন করে বাজতে থাকে। উদাত্ত কণ্ঠে গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে মুজিব যখন বক্তৃতা করে, মুগ্ধ হয়ে ভৈরব ডাক্তার তা শোনেন। সুযোগ পেলেই সবাইকে জোর গলায় বলেন–বুঝলে? এই ছেলেটা অনেক দূর যাবে। একদিন হাল ধরবে দেশের।

বড় এবং মেজো ছেলে দুজনই দাঁড়িয়ে ছিল পাশে। ভবানী সাথে করে নিয়ে যাবে ছবিকে। তাই বারবার তাগিদ দিচ্ছে। দশটার ট্রেন ধরতে না পারলে আবার সেই রাত নয়টায়।

খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতোন করবা, আর ভালো করে পরীক্ষা দিবা।

একটুক্ষণ থেমে নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার ভৈরব ডাক্তার বললেন–কত আশা ছিল ভানে, অবে পড়াশুনা করবি। বিএ, এমএ পাস করবি, মানষির মতোন মানুষ হবি। তা তো আর হোলো না। তুই অন্তত বাপ-মার মুখ রক্ষে করিস।

চোখ মুছতে লাগলেন ভৈরব ডাক্তার।

ভবানী, অবনী দুজনই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলার মুখ তাদের নেই। বাবা তাদের পড়াশুনার জন্যে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি। কিন্তু পড়াশুনাটা বাদে আর সব কাজেই তাদের অতি আগ্রহ। অবনী আছে তার গানবাজনার আসর নিয়ে। তার সারাক্ষণের চিন্তা কোথায় কোন জলসা হবে, কে গাইবে, কে তবলা বাজাবে–এইসব।

আর ভবানী তার দলবল নিয়ে এলাকা চষে বেড়ায়। কোন অন্যায়ের প্রতিকার করতে হবে, কাকে ধরে শাস্তি দিতে হবে, কার উপকারে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে–তার মাথায় সারাক্ষণ ঘুরতে থাকে। আর রাতে দুই ভাই মিলেই মেতে ওঠে আমোদ-ফুর্তিতে।

এসবের পেছনে তারা দেদারছে টাকা ওড়ায়। বাবার পকেট মারে, আড়তের ক্যাশ ভাঙে, জমি বন্ধক রাখে, বিক্রি করে। ভৈরব ডাক্তারের হাজার পাখি জমি। তার অবশেষ কতটুকু যে আর আছে কে জানে? এদিকে ব্যবসায়ও ভাটার টান লেগেছে। দুই ছেলে যদি পাল্লা দিয়ে টাকার শ্রাদ্ধ করে তাহলে আর কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবেন তিনি।

ছেলেদেরকে বারবার বলেন–আমি মরে গেলি তোরা কী করবি? ছেলেমেয়েগের কী খাওয়াবি, কী পড়াবি?

কিন্তু লাভ হয় না কোনো। এখন এই ছোট ছেলেই ভরসা। কিন্তু ছবেটাও কেমন যেন উদাসীন, বিষয়-আশয়ের দিকে নজর নাই। সে আবার রামপ্রসাদী গানের ভক্ত। কিছু বলতে গেলেই সে সুর করে গেয়ে ওঠেকাজ কি মা সামান্য ধনে…

হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ভৈরব ডাক্তারের বুক চিরে।

বাবা মন খারাপ কোরে না। দেকপা সব ঠিক হয়ে যাবি। বড় মেয়ে বীণা বাবার কাঁধে হাত রেখে বলে।

ভৈরব ডাক্তার তার বড় মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার ছেলের সাথে। জামাই ছিল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। এজন্যে মনে মনে তার বেশ অহংকার ছিল। তিনি নিজেও জজকোর্টের জুরি বোর্ডের সদস্য। কিন্তু সে অহংকার তার ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। মেয়েটা সুখী হলো না। এত লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে তার বীণা, সেই বীণার কপাল ভাঙল।

জামাই-এর পোস্টিং ছিল দার্জিলিং। একবার অসুস্থ হয়ে সে ভর্তি হলো হাসপাতালে। বীণা তখন পুজোয় বাপের বাড়িতে এসেছে। ভৈরব ডাক্তার খবর পেয়ে মেয়েকে নিয়ে ছুটে গেলেন। জামাই ততদিনে সুস্থ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার, হয়ে গেছে তার আগেই। হাসপাতালে তাকে সেবা করেছিল খর্বকায় এক নার্স, তাকে বিয়ে করে নিয়ে চলে এসেছে সে।

প্রকৃত ঘটনাটা কী ছিল, তা আর জানার প্রবৃত্তি ভৈরব ডাক্তারের হয়নি। অধিক শোকে তিনি পাথর হয়ে গিয়েছিলেন।

জামাইকে শুধু বলেছিলেন–ভালোই করেছো। তোমার উপযুক্ত কাজই তুমি করেছ। বীণা মাকে আমি নিয়ে গেলাম। ওর প্রয়োজন তত তোমার ফুরিয়েছে। এখানে থেকে আর কী করবে?

জামাই যোগেশ সরকার মাথা নিচু করে বসে ছিল। একটাও কথা বলতে পারেনি।

ছয় বছরের মাথায় মারা গেল জামাই। ততদিনে নার্স বৌ-এর গর্ভে তার দুটি ছেলের জন্ম হয়েছে। যোগেশ সরকার মিতব্যয়ী ছিল না কোনোদিনই। মদপানের অভ্যাস আগেও একটু-আধটু ছিল। নার্সটাকে বিয়ে করার পর থেকে তার মদপান আসক্তি অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে যায়। আবার একদিন অসুস্থ হয়ে সে হাসপাতালে গেল। ততদিনে সে নিঃস্ব, কপর্দকহীন। চিকিৎসা করানোর সামর্থ্যও তার নেই। নার্স স্ত্রীটাও সন্তান দুটিকে রেখে পালিয়ে চলে গেছে।

টেলিগ্রাম পেয়ে ভৈরব ডাক্তার বীণাকে নিয়ে গিয়েছিলেন দার্জিলিং। তখন যোগেশ সরকারের একেবারে শেষ সময়। ক্ষমা চাইবার জন্যেই বোধকরি বিছানা থেকে নুইয়ে পড়ে পা ধরার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে শক্তি তখন আর নেই। তার আগেই ভৈরব ডাক্তার ধরে ফেললেন তাকে। বললেন–থাক। নড়াচড়া কোরো না। শরীর খারাপ করবে।

যোগেশ সরকারের দু চোখ জলে ভরে এলো।

অতি কষ্টে ধরা গলায় বলল–মাফ চাওয়ার মুখ আমার নাই। আর মাফ চাইবও না আপনার কাছে। আপনাকেই আমি বাবা বলে জানি, পিতৃজ্ঞানে পূজা করি। সবাই আমায় পরিত্যাগ করেছে। মহা পাতকী আমি। কিন্তু আমি জানি, এই বিশ্ব চরাচরে শুধু একজনই আছেন, যিনি আমাকে ত্যাগ করতে পারবেন না। ঠিকই ছুটে আসবেন। বাবা, সে হলো আপনি। তাই শেষ অনুরোধ করে যেতে চাই আপনাকে।

বলো বাবা, কী তোমার শেষ অনুরোধ? চোখ মুছতে মুছতে বললেন ভৈরব ডাক্তার।

নিরপরাধ এই নাবালক বাচ্চা দুটোকে আপনার হাতে দিয়ে গেলাম। এদের আপনি দেখবেন। এই আমার শেষ অনুরোধ।

হু হু করে কাঁদতে লাগল ডাকসাইটে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট যোগেশচন্দ্র সরকার।

কী করবেন ভৈরব ডাক্তার? জীবনে এত অসহায় তিনি এর আগে কখনও বোধ করেননি।

একদিকে এক মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ অনুরোধ, অন্যদিকে তার সর্বস্ব হারানো প্রিয় কন্যার মুখ। কোন দিকে যাবেন তিনি! কী করবেন? যে মানুষটা তার ফুলের মতো ফুটফুটে মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিল, চরম বিশ্বাসঘাতকতা করল তার সাথে। সেই সতিনের ঘরের সন্তানদের দায়িত্ব নেবার এমন নির্লজ্জ অনুরোধ কেউ করতে পারে, ভৈরব ডাক্তার তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।

রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে তার চোখে জল এসে গেল। সবাই অন্যায় করবে। আর তার বোঝা বয়ে বেড়াবেন তিনি!

চোখ বুজে মনে মনে বললেন–ভগবান। এ তুমি কোন পরীক্ষায় ফেললে আমাকে? সারা জীবন ধরে অন্যের বোঝা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে আজ আমি ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন।

অসহায় দৃষ্টিতে ভৈরব ডাক্তার মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। বীণা বুঝল বাবার মনের অবস্থা।

আস্তে আস্তে বলল–বাবা আমি উনারে ক্ষমা করে দিছি। আমার মেয়েডাও কোল খালি করে চলে গেল। বলে সে চোখ মুছতে লাগল।

বীণার গর্ভের সন্তান ছিল একমাত্র মেয়ে কালি। হঠাৎ করেই কালাজ্বরে মারা গেছে সে।

ভৈরব ডাক্তার বিস্মিত হলেন। মেয়ের ধৈর্য আর সহনশীলতায় মুগ্ধ হলেন। মেয়েটা হয়েছে তারই মতো। বড় বেশি মায়া আর মমতা তার মনের মধ্যে।

এ জগতে যে যত ভালো, কষ্ট যেন তার তত বেশি। মেয়েটাও তার সারাজীবন কষ্টেই কাটাল।

মেয়ের চাওয়া তিনি বুঝলেন।

কিন্তু কাজটা করা কি ঠিক হবে? সমাজ, আত্মীয়-স্বজন তারাই বা কী বলবে? দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলাচলে দুলতে দুলতে শেষমেশ মেয়ের ইচ্ছের কাছেই আত্মসমর্পণ করলেন তিনি। তার একসময়ের অতি প্রিয় মানুষটির অনুরোধ তিনি ফেলতে পারলেন না। জামাই মারা যাবার পর বাচ্চা দুটোকে সাথে করে গোয়ালন্দ নিয়ে এলেন।

শান্তিতে নেই ভৈরব ডাক্তার। মনে বড় কষ্ট তাঁর। এবার তিনি পদ্মার বাঁক ইজারা নিতে পারেননি টাকার অভাবে। তার পতন যে শুরু হয়ে গেছে, তা তিনি টের পাচ্ছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই। কিন্তু সেটা যে ব্যাংকের একাউন্ট পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, তা বুঝতে পারেননি।

ইজারার টাকাটা তিনি ব্যাংকে আলাদা করে রেখে দিয়েছিলেন। তুলতে গিয়ে দেখেন একাউন্ট ফাঁকা, একটা টাকাও নেই। ভবানী কোন ফাঁকে কী বলে যে চেকে সই করিয়ে নিয়েছে, তা তিনি কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। তবে অনুমান করলেন, সেবার ঢাকা যাওয়ার তাড়া ছিল। স্টিমারে উঠে কেবিনে বসেছেন। ভো বাজিয়ে জেটি ছেড়ে স্টিমার বেরিয়ে যাওয়ার মুখে কি একটা পেমেন্টের জন্য দেড়শো টাকা দরকার বলে ভবানী চেকবই বাবার সামনে ধরেছিল। তাড়াহুড়ায় সম্ভবত ব্লাঙ্ক চেকেই সই করে দিয়েছিলেন।

এখন বুঝতে পারেন, ভবানী প্ল্যান করেই কাজটা করেছিল। ইজারার টাকা জমা দিতে না পেরে একা একা অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন ভৈরব ডাক্তার। বুকটা ভেঙে গেছে তার। কিন্তু এই লজ্জার কথা কাউকে বলতে পারেননি। বরং সবাইকে শুনিয়েছেন, রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। এ বছর আর ব্যবসা নয়। বলেছেন, ব্যবসার চাইতে সমাজ বড়, সমাজের চাইতে দেশ বড়।

সেদিন থেকে নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হয় ভৈরব ডাক্তারের। জীবনের প্রতি তার অনীহা এসে গেছে। কাজেকর্মে আগ্রহ খুঁজে পান না। একটু একটু করে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন সবকিছু থেকে। সেই সুযোগে রোগ-ব্যাধি শরীরের মধ্যে ঢুকে বাসা বাঁধার চেষ্টা করছে।

তিনি ভেবেছিলেন, একসময়ে নিশ্চয়ই তার ছেলেরা পথে আসবে। ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। কিন্তু কিছুই ঠিক হয়নি। ভুল করেছেন তিনি। পুত্রস্নেহে অন্ধ ছিলেন। সময়মতো রাশ টেনে ধরতে পারেননি তাদের। এই ভুলের কোনো ক্ষমা নেই।

এখন আশা, ছোট ছেলে ছবি যদি মানুষ হয়।

দুই হাত উপরে তুলে প্রণাম করে বললেন–ছবিকে শক্তি দিও ভগবান। ও যেন দাদাদের মতো বিপথগামী না হয়।

ভৈরব ডাক্তারের ভরসার একটা মাত্র জায়গাই এখন আছে। সে হলো খনা। উপযুক্ত ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন তাকে। হাজারি জজ-ব্যারিস্টার নয়, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারও নয়। গরিব ঘরের সামান্য বিএ পাস ছেলে। কিন্তু ছেলেটির মধ্যে তিনি তার স্বপ্নের মানুষটিকে খুঁজে পান। যে তার অনুপস্থিতিতে এই নমশূদ্র সমাজের জন্য ভাববে, নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নেবে, যে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।

একসময় তিনি ভবানীর মধ্যে তার স্বপ্নের মানুষকে দেখতেন।

সে যোগ্যতা তার পুরোপুরিই ছিল, কিন্তু কাজে লাগাল না। তার আছে নেতৃত্ব দেবার সহজাত ক্ষমতা, আছে মানুষের প্রতি অসীম মমতা। আছে সাহস, আছে তার প্রখর উপস্থিত বুদ্ধি। যে কোনো সমস্যার সমাধান তার কাছে জলবৎ-তরলং। কোনো সালিশ-দরবারে সে যখন যুক্তি দিয়ে তার বক্তব্য উপস্থাপন করে, তখন মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়।

কিন্তু সে চলে গেল বিপথে। ব্যবসা, জমিজমা, ডাক্তারি, রাজনীতি এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে নজর দিতে পারেননি নিজের ছেলেমেয়ের দিকে। ভেবেছিলেন, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজে সারাজীবন সৎ থেকেছেন, কারো ক্ষতি করেননি। ভগবান নিশ্চয়ই তার সহায় থাকবেন।

কিন্তু এখন তিনি নিশ্চিত, ভবানীকে ফেরানোর আর পথ নেই। অনেক দেরি হয়ে গেছে। এজন্যে নিজেকেই দোষী মনে করেন তিনি।

ভৈরব ডাক্তার ঠিক করলেন, হাজারির সাথে একটু সময় নিয়ে বসবেন তিনি। কিছু কথা তাকে বলে যেতে হবে। তিনি যে ধীরে ধীরে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন, তার কষ্টের কথা, দুঃখের কথা শুধু হাজারিকেই বলবেন তিনি। বলার মতো আর কেউ নাই তার।

নাহ, আর দেরি করা ঠিক হবে না। দুগগা, দুগগা, বলে ছবিকে রওনা করিয়ে দিলেন ভৈরব ডাক্তার।

৪২

কুষ্টিয়ার থানা পাড়ায় বাসা নিয়েছে হাজারি। শুরু করেছে নতুন জীবন।

রেললাইনের পাশেই পুরনো একটা দোতলা বাড়ি। দোতলায় বাড়িওয়ালা নিজেই থাকে। নিচতলাটা তিন পরিবারের কাছে ভাড়া দিয়েছে। কয়েক দিন হলো সমাধিনগর হাই স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে এখানে ফুড ইন্সপেক্টর পদে জয়েন করেছে সে।

বেশ কষ্ট হয়েছিল স্কুলের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার সময়। কেঁদে ফেলেছিল সে। জ্ঞানেন্দ্র মাস্টারমশাই বলেছিলেন–বড় কিছু পাতি গিলি, ছোট অনেক কিছু ত্যাগ করতি হয়। তুই হলি আমাদের এই ইলাকার নমশূদ্দুরগের মদ্যি পেরতম সরকারি অপিচার। তোর এখন বড় জগতে পা ফেলাতি হবি। এই বিলির মদ্যি পড়ে থাকলি তো হবি নে।

চাকরিটি তাকে দিয়েছেন শ্বশুরমশায়।

বলতে গেলে এককথায়। বিয়ের পর প্রথম ভৈরব ডাক্তার মধুপুর এলেন। সাথে এনেছেন বড় এক নৌকা বোঝাই ইলিশ মাছ। সারা পড়ে গেল মধুপুর গ্রামে, ধন্য ধন্য পড়ে গেল আশেপাশের শিবপুর, গোপিনাথপুর, বনগ্রাম, পারুলিয়া, নরকোনা, বামুন্দি সব গ্রামেই। একসাথে এত ইলিশ এরা কেউ কোনোদিন দেখে নাই। মধুপুর গ্রামের সব বাড়িতে এক হালি করে পাঠানো হলো। সব আত্মীয় বাড়িতে এক জোড়া করে, আর আশেপাশের গ্রামের সব বাড়িতে একটা করে।

নমশূদ্ররা এই এলাকায় লতাপাতায় সবাই কোনো-না-কোনোভাবে আত্মীয়। তাই এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল ইলিশ ইলিশের গন্ধ। গদগদ হয়ে রতি জ্যাঠা বললেন–এই না হলি ভৈরব ডাক্তার। আমরা সবাই খুবই আনন্দিত হইচি যে, আমাগের গ্রামে আপনি মিয়া বিয়ে দেছেন। আমাগের সাথে সম্পর্ক গড়িচেন। কিন্তু ডাক্তার বাবু, জামাইরে নিয়ে আর এট্টু আগোয়ে চিন্তা-ভাবনা করলি ভালো হত না?

কী রকম?

এই ধরেন মাস্টারি তো সে করতেছেই। এটা সরকারি চাকরি-বাকরি হলি আরেটু ভালো হত। আমাগের ইলাকার সম্মান আর এট্টু বাড়ে যাতো।

বাঃ বেশ বলিছেন তো আপনি! হিমাংশু তোমার কী ইচ্ছে? আমি কারো উপরে জোর করে কোনোকিছু চাপায়ে দিতি চাই নে।

আমার কোনো আপত্তি নাই। হাজারি মাথা নিচু করে উত্তর দিল।

ঠিক আছে। সংক্ষেপেই দেখি তোমার কী ব্যবস্থা করা যায়।

তো সেই থেকে ঠিক তিন মাসের মাথায় হাজারি ফুড ইন্সপেক্টর পদে চাকরিতে যোগদান করল। শুধু বিল সিংহনাথই নয়। হাজারি হলো গোটা ভর এলাকার প্রথম সরকারি অফিসার।

চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে শ্বশুরমশাইয়ের উপর ভক্তি তার বেড়ে গেল আরও দশগুণ। ঢাকায় খাদ্য বিভাগের হেড অফিসে যেতে হয়েছিল তাকে। দুরুদুরু বক্ষে ঢুকেছিল বড় অফিসারের রুমে। কাগজপত্র দেখে শুধু একটা কথাই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সেই অফিসার।

আপনি ভৈরব বাবুর জামাই?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

এক চান্সেই বিএ পাস করেছেন দেখছি। বাঃ বেশ ভালো। মিনিস্টার স্যারও সুপারিশ করেছেন। তাই কী আর জিজ্ঞেস করব। তার চেয়ে বলেন, কোন এলাকায় পোস্টিং হলে ভালো হয় আপনার?

আমার কোনো পছন্দ নাই স্যার। যেখানে দিবেন সেখানেই যাব আমি।

গুড, এরকমই তো দরকার। খানিক পরে এসে এপয়েন্টমেন্ট কার্ড নিয়ে যাবেন। গিয়ে জয়েন করবেন কুষ্টিয়া অফিসে।

এত সহজে চাকরি পাওয়া যায়? কিছুতেই যেন বিশ্বাস হতে চায় না তার। সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন।

কুষ্টিয়া শহরটি ছোট, কিন্তু বেশ ছিমছাম। শহরের প্রাণ বলতে মোহিনী কটন মিল। মিলের ভোঁ শব্দে ঘুম ভাঙে শহরবাসীর। তারপর প্রতিবার শ্রমিকদের শিফট চেঞ্জের সময় সাইরেনের মতো ভোঁ বাজে। শহরের এক প্রান্তে বড় এক রুমের বাসা তার। স্বামী-স্ত্রীর সংসার। তাই এক রুমই যথেষ্ট। খনা সারাদিন সংসার গোছায়। কাঠের পাটিশন দিয়ে আলাদা একটু জায়গা বের করে সেখানে একটা চৌকি আর টেবিল চেয়ার পেতে দিয়েছে। যাতে মাঝে মাঝে পড়াশুনা করতে পারে।

বাড়ির সামনে দিয়ে রেললাইন চলে গেছে শহরের ভিতরে। সেখান থেকে দর্শনা হয়ে কলকাতা, শিয়ালদহ স্টেশন। আরেকটা লাইন যশোর হয়ে খুলনা। পেছন দিকে গেলে পাংশা হয়ে গোয়ালন্দ ঘাট। আরেকটা চলে গেল পদ্মানদীর উপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হয়ে পাকশি, ঈশ্বরদী হয়ে রাজশাহী, পার্বতীপুর, চিলাহাটি। আরেকটা ব্রাঞ্চ চলে গেল জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হয়ে ঢাকার দিকে।

দিনে বেশ কয়েকখানা ট্রেন চলে। খনার ট্রেন শিডিউল মোটামুটি মুখস্থ। তাকে আর আলাদা করে ঘড়ি দেখতে হয় না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ট্রেনের আসা-যাওয়ার শব্দকেই সে ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিয়েছে। তার ঘুম ভাঙে গোয়ালন্দ লোকালের শব্দে। রাজশাহী মেল যাওয়ার আগেই জল খাবার তৈরি করে ফেলতে হয় তাকে। স্বামী খেয়ে অফিসে রওনা হয়ে যায়। এরপর বেশ কিছুটা সময় হাতে থাকে তার। সে অপেক্ষা করে কখন ঢাকা মেইল আসবে। আয়েশ করে একটু গড়িয়ে নিতে না নিতেই হুইসেল বাজে ঢাকা মেইলের। গোয়ালন্দ থেকে ছেড়ে এসেছে সকাল আঁটায়। লাল রঙের গাড়িটা দ্রুত তাদের বাড়িটা অতিক্রম করে চলে যায় কলকাতার দিকে রাজহংসের মতো ভেসে ভেসে। এ সময় সে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেয়। এই ট্রেনটাই সবচেয়ে সুন্দর। বড় ভালো লাগে তার জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে এই ট্রেনটাকে দেখতে। তার সারা জীবনের স্বপ্নের সাথে এই ট্রেনটা যেন কীভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। কিন্তু যোগসূত্রটা কোথায়, কীভাবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না খনা।

ট্রেনটা চলে যাবার পর সে আস্তে আস্তে ওঠে, উনুন ধরায়, কল থেকে জল আনে, তরকারি কোটে, ভাত চড়ায়, মাছ রান্না করে। আর গুনগুন করে আপন মনে গান গায় সে। কোনো ওস্তাদের কাছে গান শেখার সুযোগ হয়নি তার। গ্রামে গানের শিক্ষক পাবেই বা কোথায়! স্বামী আসবে দুপুর দুইটায়। তার আগেই রান্না শেষ করে স্নান সেরে ফেলতে হবে।

খনা গাইতে থাকে-যদি ভালো না লাগে তো দিও না মন…

কেমন ধাক্কা দিয়ে দিয়ে তালের উপরে বেশ গেয়েছেন গানটি কানন দেবী। খনার বড় প্রিয় এই নায়িকা-গায়িকা। আহা, দেখতে যেমন, তেমনই তার গলা। ভগবান যেন তারে নিজির হাতে গড়িছেন।

সিনেমাটি সে ছোটবেলায় দুইবার দেখেছে। একবার কলকাতা বেড়াতে গিয়ে বাবার সাথে, দ্বিতীয়বার রাজবাড়িতে পরিবারের সকলে মিলে।

কানন দেবীর ‘আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে’ গানটিও বেশ লাগে তার।

এই গানটি গাইতে গেলেই মনের মধ্যে কেমন একটা নাচের ভাব আপনা আপনিই এসে যায় খনার মধ্যে। কোনো কোনো সময় তার দুই হাত নাচের মুদ্রার মতো উপরে উঠে যায়। নৃত্যের ভঙ্গিমায় সে দাঁড়িয়ে পড়ে। সম্বিত ফিরলে নিজেই লজ্জা পেয়ে এদিক-ওদিক তাকায়, কেউ আবার দেখে ফেলল কি না।

বিকালে খুলনা মেইল চলে যায়, সন্ধ্যায় ঈশ্বরদী লোকাল আসে। এভাবেই দিন কাটে খনার।

নিজের পড়াশুনা ক্লাস সিক্স অবধি। ভৈরব ডাক্তারের খুব ইচ্ছা ছিল মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবেন। কিন্তু হাই স্কুল সেই ছয় মাইল দূরে। কাছাকাছি কোথাও নেই। তাই স্বপ্ন তার স্বপ্নই রয়ে গেল। কিছুদিন অবশ্য রাজবাড়ীতে গিয়ে খনা পড়াশুনা করেছে। কিন্তু কার সাথে যাবে, কীভাবে আসবে? বাবা ভীষণ ব্যস্ত, দাদারাও। একসময় তাই আপনাআপনিই তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেল।

ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষায় খনা জলপানি পেয়েছিল। ভৈরব ডাক্তার খুশিতে বাগবাগ হয়ে গর্বের সাথে বলেছিলেন–খনা মা আমার বড় হয়ে ডাক্তার হবি। আমার দায়িত্ব সে নিজির ঘাড়ে উঠোয়ে নিবি।

কিন্তু, পড়াশুনাটাই হলো না তার আর। খনা তাই স্বপ্ন দেখে ছেলেমেয়েরা অনেক লেখাপড়া করবে। আর একটা বিশেষ স্বপ্ন তার আছে। তার যদি মেয়ে হয়, তাকে সে নিশ্চয়ই ডাক্তার বানাবে। গান শেখাবে, নাচ শেখাবে। নিজের সাধ সে মেয়েকে দিয়ে পূরণ করবে।

ঢাকা মেইলে চড়ে মেয়ে তার কলকাতা যাবে। সবচেয়ে নামকরা মেডিক্যাল কলেজে পড়বে। কানন দেবীর কাছে সে গান শিখবে। নাচ শিখবে।

ঢাকা মেইলটা মনে হয় সেজন্যই তার এত প্রিয়।

৪৩

হাইস্কুলে পড়ার সুযোগ হয়নি খনার, সেই দুঃখ তার কোনোদিন যাবে না। তাই বলে পড়াশুনা থেমে থাকেনি। বাড়িতে সে রবি ঠাকুর, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম শেষ করে ফেলেছে। তাদের লেখা গোগ্রাসে গেলে। বড়দাকে বললেই রাজবাড়ি, ফরিদপুর, কলকাতা থেকে বই এনে দেয়। বাবারও সায় ছিল তাতে। সেসব বই দিয়ে খনা তার নিজের একটা ছোট্ট লাইব্রেরিও গড়ে তুলেছে।

সেদিন কলকাতা থেকে ফেরার পথে বড় দা কুষ্টিয়া স্টেশনে নেমে পড়েছিলেন। সাথে নিয়ে এসেছেন আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাস ‘সুবর্ণলতা’। এই লেখিকার বই সে আগে কখনও পড়েনি। পড়তে গিয়ে বারবার তার চোখ ভিজে আসে। এ যেন সে নিজেই, এসব তো তার নিজেরই স্বপ্ন। এই সংসারে খনা সেজ বৌ। কিন্তু তার মনে হয়, যেন সে মেজো বৌ সুবর্ণলতা। সংসারে থেকেও গতানুগতিক জীবনধারার বিরুদ্ধে অবিরত সংগ্রাম করে যাচ্ছে। সামান্য গৃহবধূ হয়েও লেখাপড়ার প্রতি তার অনুরাগ, স্বদেশি আন্দোলনে নিজেকে জড়ানো, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। পড়তে পড়তে খনা নিজেই সুবর্ণলতা হয়ে যায়। সেই কত বছর আগে সুবর্ণ যদি পেরে থাকে তাহলে সে কেন পারবে না! ছেলেমেয়েদের সে মানুষ করবে। অনেক লেখাপড়া শেখাবে। ওদের মধ্যে দিয়েই সে নিজের সাধ পূর্ণ করবে।

অবশ্য সুবর্ণর তুলনায় তার অবস্থান অনেক সুবিধাজনক। খনার বাপের বাড়ির পরিবার রক্ষণশীল নয়। সে রাজবাড়ী, ফরিদপুর, কলকাতায় ইচ্ছেমতো বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। রাজবাড়ী সিনেমা হলে ভালো ছবি লাগলে ভৈরব ডাক্তার বৌ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে সপরিবারে দেখে আসতেন। সুবর্ণর স্বামী শাশুড়ি ছিল তার বিপক্ষে। খনার শ্বশুর-শাশুড়ি নেই। বড় ভাশুর তো সাক্ষাৎ দেবতা। তাকে সবসময় মা লক্ষ্মী বলে সম্বোধন করেন। খনা যা করে সবই তার চোখে অনন্য।

স্বামীও রক্ষণশীল নন। নিপাট ভালো একজন মানুষ। তবে সীমাবদ্ধতা আছে তার মধ্যে। তিনি সিনেমা দেখা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়া, আড্ডা দেয়া পছন্দ করেন না। হাজারি তাস খেলে না। চা খায় না, সিগারেট খায় না। এমনকি গল্প-উপন্যাসও পড়ে না। এসব হলো তার কাছে নেশা। নেশার পেছনে অযথা সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তার মতে, সমাজের উন্নয়নের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা উচিত।

তবে সে কট্টর নয়। হবে, আস্তে আস্তে সবই হবে। খনা জোর করবে না। বরং কৌশলে একটু একটু করে এগোবে। আস্তে আস্তে হাজারিকে চা খাওয়া শেখাবে, আড্ডা দেয়া শেখাবে। শুধু কঠিন কঠিন বই নয়, গল্প-উপন্যাসও পড়াবে, সিনেমা দেখাবে, কালচারাল অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবে।

মনে মনে হাসে খনা। পারবে, সে ঠিক পারবে। নিজের উপর এ বিশ্বাস তার আছে।

খনা ঠিক করে ফেলে, বাচ্চাদের সে নিজে পড়াবে। যত্ন করে হাতের লেখা করাবে, অংক শেখাবে। সে অপেক্ষা করে কবে তার কোলজুড়ে আসবে ফুটফুটে সন্তান। ছেলে বা মেয়ে যা-ই হোক না কেন, কোনো আপত্তি নেই তার। ছেলে হলে তাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবে। আর মেয়ে হলে অবশ্যই ডাক্তার। ভৈরব ডাক্তার চেয়েছিলেন তার খনা মা ডাক্তার হোক। নিজে সে পারেনি। তাতে কী? মেয়েকে ডাক্তার বানাবে।

অতি প্রিয় বাবার স্বপ্ন সে সার্থক করবে।

৪৪

খবর এসেছে আঁ পাড়ার ওদিকে নলডুবি গ্রাম থেকে। নকুড় খুড়োর ভেদবমি শুরু হয়েছে। নকুড় খুড়োর চার কুলে কেউ নেই। বয়স হয়েছে, এখন আর কাজ করতে পারে না। ভিক্ষে করেই দিন কাটে তার। তার উপরে আছে হাঁপানির ব্যারাম।

ভৈরব ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন–খুড়ো এই বয়সে তোমার আর ঘোরাঘুরি করার দরকার নাই। চারডে ভাত তুমি পাত পাড়ে আমার বাড়িই তিন বেলা খায়ে যাবা।

কোনোদিন কিছু না জুটলে নকুড় অবশ্য তাই করত। ডাক্তারের বাড়ি এসে হক ছাড়ত–কই গো মা ঠাকরোন, চারডে ভাত দ্যাও। খায়ে পরান জুড়াই। আপনমনেই বকবক করত সে–পেটের জ্বালা বড় জ্বালা রে মা। তাই তো ঘুরে ঘুরে তুমাগের দোরে আসি। ডাক্তার কয়ে দেচে, খিদে লাগলিই চলে আসতি।

সেই খুড়োকে কলেরায় ধরেছে। সকালে সে নাকি গোয়ালন্দ বাজারে গিয়েছিল। কোন হোটেলের ফেলে দেয়া পচা বাসি ভাত খেয়ে তার এই অবস্থা।

সব শুনে গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন ভৈরব ডাক্তার। অজানা আশঙ্কায় তার বুক শুকিয়ে আসছে। হাত-পা কাঁপছে।

কী হবে, যদি ছড়িয়ে পড়ে ওলা-উঠা এলাকাজুড়ে!

উজাড় হয়ে যাবে গ্রামের পর গ্রাম। শাশান হয়ে যাবে সব। রাগে তার মুখ থমথম করছে।

নকুড় খুড়োকে তিনি বলে দিয়েছিলেন, তার বাড়িতেই তিন বেলা খাবার জন্যে। অথচ কী করল সে।

এই হলো নমশূদুরির জাত, নিজির ভালোড়াও বোঝে না। নিজি তো মরেই, সাথে আরো দশজনরে জড়ায়ে নিয়ে মরে।

দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠেন ভৈরব ডাক্তার। একে চৈত্রের খরা, খাল বিল পুকুর শুকিয়ে সব চৌচির। গোটা এলাকায় জলের জন্যে হাহাকার। এই সময়টাতে সাবধানে থাকার জন্যে পইপই করে সবাইকে বলে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কে শোনে কার কথা? এর জের কোন পর্যন্ত গিয়ে গড়াবে, কে জানে? রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে চুপ করে বসে রইলেন তিনি।

একসময় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ান ভৈরব ডাক্তার। এই অর্বাচীনদের উপর রাগ করেই বা কী লাভ!

যা করার শেষ পর্যন্ত তো তাকেই করতে হবে। বসে থেকে আর লাভ কী! বরং যত তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করা যায় ততই মঙ্গল। হোমিও ওষুধের বাক্সটা নিয়ে ঘর থেকে উঠোনে নেমে হাঁক দিলেন–কৈ রে তোরা। চল, বাবারা এইবেলা বেরিয়ে পড়ি।

পথেই খবর পেলেন কমলা মাসিরও ভেদবমি শুরু হয়ে গেছে। মাসির কুকুরটা নাকি নকুড় খুড়োর বাড়িতে গিয়ে উঠোনে ছড়িয়ে থাকা বমি খেয়ে এসেছিল। কী হবে এখন! রক্ষে করো ভগবান।

ভৈরব ডাক্তারের লাল ঘোড়াটা দৌড়ে বেড়াতে লাগল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তার চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল কলেরা। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেতে থাকে। দিনরাত ভৈরব ডাক্তার সেবা করে যাচ্ছেন তার দলবল নিয়ে। বাড়িতেও ফিরতে পারেন না কোনো কোনো দিন। ভবানী, অবনী দুই ভাই-ই বাবার সাথে কাজে নেমে পড়েছে। দলবল নিয়ে কলসি ভরে খাবার জল, ডাব, পেঁপে–এসব নিয়ে তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরছে।

‘বলো হরি, হরিবোল’ ধ্বনি দিয়ে মরদেহ শ্মাশানে নিয়ে যাচ্ছে, সৎকার করছে। এসব জনহিতকর কাজে তাদের কোনো ক্লান্তি নেই।

সুমিত্রা দেবী রাত জেগে বসে থাকেন। কখন স্বামী আসে, কখন ছেলেরা আসে। কী খায়, কী না খায়। শরীরটা তো ঠিক রাখতে হবে। তিনি পিড়ি পাতেন, বারবার ভাত-তরকারি গরম করেন। রাত বাড়তে বাড়তে একসময় পাখি ডাকতে শুরু করে। অন্ধকার কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটে ওঠে। কিন্তু স্বামী সন্তান বাড়ি ফেরে না। তবুও কষ্ট পান না সুমিত্রা দেবী। বরং গর্বে তার বুকটা ভরে ওঠে স্বামীর জন্য, ছেলেদের জন্য। নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হয়।

বড় মায়া তার স্বামী দেবতাটির জন্য। সারাটা জীবন শুধু পরের কথাই ভাবল, নিজের দিকে ফিরেও তাকাল না। তার ইচ্ছে করে, আঁচল দিয়ে স্বামীর মুখখানা মুছিয়ে দিতে, তার কষ্ট দূর করে দিতে। ভগবানের কাছে সুমিত্রা দেবীর একটিই শুধু চাওয়া, মানুষটা ভালো থাক। তার সেবা করতে করতে শাখা-সিঁদুর অক্ষয় রেখে যেন তিনি স্বর্গবাসী হতে পারেন।

চলে গেলেন নীলকমল সরকার। সারারাত তার শিয়রেই বসে ছিলেন ভৈরব ডাক্তার। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওষুধ দিয়েছেন। নিজের হাতে তার বমি পরিষ্কার করেছেন, পথ্য দিয়েছেন। স্বজনেরা কেউ পাশে নেই। সবাই তাকে ফেলে চলে গেছে। আছে শুধু একজন, সকলের অগতির গতি ভৈরব ডাক্তার।

নীলকমল তার আবাল্য বন্ধু। বিপদের দিনে বন্ধুর পাশে না থাকলে কি চলে!

ভৈরব ডাক্তারের কেন যেন বিশ্বাস ছিল, তিনি নীলকমলকে এবারের মতো রক্ষা করতে পারবেন। কিন্তু পারলেন আর কৈ! এ জগৎ, সংসার বড়ই বিচিত্র। সে সামান্য মানুষ। ঈশ্বরের লীলাখেলা বোঝার সাধ্য তার কতটুকু।

ক্লান্ত, শ্রান্ত দেহে অবসনের মতো শ্মশানঘাটে বসে আছেন ভৈরব ডাক্তার।

বারবার মনে পড়ছে নীলকমলের শেষ কথাগুলো সারা জীবন যাগের জন্যি খাটে গেলাম, কিসি তাগের মঙ্গল হয় ভাবে ভাবে জীবনডা পাত করে দিলাম। আজ তারা কেউ আমার পাশে নাই। আমারে একা ফেলে সগগোলেই চলে গেল। আর তুমি? তোমার সাথে কোনো রক্তের সম্পর্ক নাই। ছোটবেলার বন্ধু মাত্র। তাও নিজির জীবন বিপন্ন করে রাত জাগে আমার সিবা কোরতেচো। তুমিই আমার প্রকৃত আত্মীয়। আমার সব সম্পত্তি আমি তোমার হাতে দিয়ে গেলাম।

তুমার সম্পত্তি দিয়ে আমি কী করব?

যা ভালো মনে করো তাই কোরো। তুমি যে ভালো কাজে খাটাবা, আমার চে সিতা আর বেশি জানবি কিভা।

ভৈরব ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন নীলকমল।

ডাক্তার এতদিনি বুঝলাম, এ জগৎ অনিত্য। এই পিথিবীতি বৌ কও আর ছাওয়াল, মিয়া কও-কেউ কারুর না। তারচে ভালো হোতো, আগেই যদি মরে যাতাম ডাক্তার। তালি এই নিষ্ঠুর সত্যিভা নিজির পুড়া চোখে দেখে যাতি হত না।

ভাবে না নীল, সব ঠিক হয়ে যাবি। আমি বলতেছি, তুমি তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে উটপা।

না, ডাক্তার। আমি আর সুস্থ হতি চাই নে। জগৎ-সংসারের মোহ আমার কাটে গেছে।

আজকাল ভৈরব ডাক্তারের মনের মধ্যেও থেকে থেকে সেই সুর বেজে ওঠে।

এ জগৎ অনিত্য। এ জগতে কেউ কারো নয়। সবকিছু থেকে একটু একটু করে তার মনও উঠে যাচ্ছে।

ভাবনা পেয়ে বসেছে আজ তাকে। এই যে এত ধন-সম্পদের মালিক ছিল নীলকমল। কিন্তু মৃত্যুকালে কৈ, স্ত্রী-সন্তান কেউ তো তার পাশে থাকল না। শিয়রে একটি কোমল মুখ থাকল না। কপালে নরম হাতের পরশ পড়ল না। এক ফোঁটা জলও কেউ তার মুখে তুলে দিল। তাহলে এই জীবনের মূল্য কী!

তারও কি একদিন এই অবস্থা হবে? শিউরে ওঠেন তিনি।

না, না। তার ভবানী, অবনীর শত দোষ থাকতি পারে। কিন্তু মানুষ হিসেবে তাগের তুলনা হয় না। তিনি নিশ্চিত, তার স্ত্রী সুমিত্রা দেবী কোনোদিন তাকে ছেড়ে যাবে না। ছেড়ে যাবে না তার মেয়েরা। যাবে না ছেলেরাও। এদিক থেকে অবশ্যই তিনি ভাগ্যবান। এ সময়ে তার জামাইয়ের কথা মনে হলো।

মনে পড়ে গেল, হাজারিকে খবর পাঠাতে হবে। সময় কমে যাচ্ছে তার। অনেকগুলো কথা বলে যেতে হবে তাকে।

৪৫

খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানা।

বাজারের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা ভদ্রা নদী। ছোট্ট নদী, কিন্তু গভীরতা অনেক। নিয়মিত জোয়ার-ভাটা খেলে। ভরা বর্ষায় এ নদীর চেহারা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তীব্র স্রোতের ঘূর্ণিপাকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে কেমন যেন একটা অজানিত ভয় বুকের মধ্যে গুড়গুড় করতে থাকে। বাজারের মধ্যে নদীর উপরে কাঠের উঁচু ব্রিজ। এই ব্রিজের ওপারে খাদ্য গুদাম। হাজারি এই খাদ্য গুদামের ওসিএলএসডি।

বিলাতি কোম্পানির একখানা পুরনো র‍্যালি সাইকেল আছে তার। ডুমুরিয়া বাজারে ভালো কোনো বাড়ি না পেয়ে হাজারি মাইল দেড়েক দূরে সাজিয়ারা গ্রামে বাসা ভাড়া নিয়েছে। দোতলা বাড়ির নিচতলায় বড় একখানা ঘর। ভাড়া মাসে বারো টাকা।

গ্রামটি বর্ধিষ্ণু। পাকা দোতলা বাড়ি আছে গোটা চারেক। একতলা আছে তের-চৌদ্দটি। বাড়িগুলো অনেক পুরনো। বাড়ির সাথে বিশাল বিশাল বাগান। দুতিনটে করে পুকুর। শান বাঁধানো ঘাট।

এতদিন গ্রাম বলতে হাজারি জানতে খড়ের চাল, অভাব-অনটন, জলে ভেজা রোদে পোড়া ক্লিষ্ট চেহারার মানুষ। কিন্তু এই গ্রাম তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের উঁচু কাঁচা রাস্তা ধরে সে অফিসে যায়। থানার ফুড ইন্সপেক্টরের অতিরিক্ত দায়িত্বও তার। মাঝে মাঝে মফস্বলে যেতে হয়। গয়না নৌকায় স্টোভ, বিছানাপত্র নিয়ে সে দলবলসহ দুই-তিন দিনের জন্যে বেরিয়ে পড়ে। যোগাযোগের অন্য কোনো রাস্তা না থাকায় নদী পথেই বেশিরভাগ সময় চলাচল করতে হয়। তিন ছেলে তার। পিঠাপিঠিই জন্ম তাদের। ছেলেদের নাম রেখেছেন কানু, দুলাল আর লিন্টু।

একটা মেয়ের বড় শখ ছিল হাজারির। সেই কোন শৈশবে মা মারা গিয়েছিল। তার কথা হাজারির মনেও নেই। একটা মেয়ে হলে মা ডাকার সাধটা পূর্ণ হয়। সেই ডাকে ভগবান সাড়া দিয়েছেন। বড় আদর করে মেয়ের নাম রেখেছেন দুর্গা। মা দুর্গা। আহ্লাদ করে বুড়ু মা… বুড়ু মা… বলে ডাকতে ডাকতে ওর নাম হয়ে গেছে বুড়ি।

খনা সকাল-সন্ধ্যা বাচ্চাদের পড়াতে বসে। এই কাজে তার ভীষণ আগ্রহ। বড় ছেলে কানু কী যে সুন্দর দেখতে! কাঁচা হলুদের মতো তার গায়ের রঙ। মুখখানা একেবারে কার্তিক ঠাকুরের মতো। এক মাথা কোকড়া চুল। ওর দিকে তাকালে খনার বাবার কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে বড়দার কথা।

বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে কানু যখন পড়তে বসে, তখন খনা তাকিয়েই থাকে তার মুখের দিকে। চোখ ফেরাতে পারে না কিছুতেই। তার বিশ্বাস হতে চায় না, অসম্ভব সুন্দর এই দেবদূতটির জন্ম হয়েছে তারই গর্ভে।

ধীর, শান্ত কানু কথা বলে কম। কিন্তু পড়াশুনায় তার ভীষণ আগ্রহ। একমনে সে লেখে, পড়ে, অংক কষে। শ্লেটে লিখে মাকে এনে দেখায়। ছবি আকাজোখা করে। বর্ণমালা, দ্বিতীয় ভাগ, নামতা শেষ। ক্লাস ওয়ান, ক্লাস টু এর সব বইও তার পড়া শেষ। মাস তিনেকের বেশি লাগে না কানুর এক একটা ক্লাসের বই শেষ করতে। ক্লাস থ্রির বই তাকে এনে দিতে হয়েছে। এইটুকু ছেলে থ্রির বই পড়ছে, ভাবতেই খনার বুক গর্বে ভরে ওঠে।

হাজারি কানুকে নিয়ে সাজিয়ারা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে এসেছে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করাতে। সাইকেলের সামনে রডের উপরে দু পা আঁকড়ে বসেছিল কানু। তার পাঁচ বছর বয়স পূর্ণ হয়েছে মাত্র কয়েক দিন আগে। সাইকেলের রডের উপরে সে ঠিকমতো বসতেও পারে না। মৃদু কণ্ঠে খুনখুন করে একটু পরপরই সে বলে যাচ্ছে–বাবা আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ব, ওয়ানে পড়ব না।

কানুর দুর্বল রোগা শরীরটার দিকে তাকিয়ে হেডমাস্টার মশাই বললেন–ওয়ানে ভর্তির বয়সই তো হয়নি। থ্রিতে পড়বে কীভাবে?

দারুণ অপমানে কানু কাঁদতে শুরু করল।

বাবা চলো। এই ইসকুল পচা। এই ইসকুলি আমি পড়বো না। চোখ মুছতে মুছতে বলল সে।

ছেলের কান্নায় ব্যথিত হাজারি ভাবতে লাগল, কী করা যায়? অতি আদরের এই ছেলেটার মনে সে কষ্ট দেবে কীভাবে!

বিনীতভাবে হেডমাস্টারকে বলল–ওকে ক্লাস থ্রিতেই ভর্তি করে নেন মাস্টারমশাই। দরকার হলে সে দুই বছর এক ক্লাসেই পড়ুক। না পারলে নিচের ক্লাসে নামিয়ে দেবেন। কিন্তু ছেলেটার মনে আমি কষ্ট দিতে পারব না।

অগত্যা হেডমাস্টার রাজি হলেন। পাঁচ বছর এক মাস বয়সে কানু ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয়ে গেল। সে বই-খাতা ঠিকমতো বোগলে নিয়ে স্কুলে যেতে পারে না। ক্লাসে বেঞ্চের উপরে বসলে তার পা মাটি পর্যন্ত পৌঁছোয় না। কিন্তু যতক্ষণ স্কুল চলে, কানু গম্ভীর মুখে ক্লাসে বসে থাকে। পড়া জিজ্ঞেস করলে সবার আগে সে তার ছোট্ট হাতখানা উঁচু করে ধরে। তারপর গড়গড় করে পড়া বলে যায়।

মাস্টারমশাইরা অবাক হয়ে কচি এই বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভাবেন, কী করে সম্ভব এটা?

ধাড়িগুলো যা পারে না, অবলীলায় কানু সেসব করে ফেলে। নির্ভুলভাবে একের পর এক অংক কষে যায়। আর কী সুন্দর তার হাতের লেখা! মুক্তোর মতো ঝকঝক করে।

সব বিষয়ে একশ করে নম্বর পেয়ে কানু ফাস্ট হয়ে ক্লাস ফোরে উঠল। হেডমাস্টার নিজেই খবরটা বয়ে এলেন বাসায়। বড় একটা রাজভোগ মুখের মধ্যে পুরে বললেন–বুঝলেন ইন্সপেক্টর বাবু, আপনার ছেলে হলো হিরকখণ্ড। যাকে বলে খাঁটি রত্ন। বড় হয়ে বিশাল কেউকেটা একজন সে হবেই, এ আমি আগাম বলে রাখলাম।

বলতে বলতে গোটা চমচমটা একবারেই মুখের মধ্যে পুরে দেন তিনি।

তাহলে ক্লাস ফোরেই থাকুক। কী বলেন? ক্লাসের ফার্স্ট বয়কে প্রমোশন দিয়ে আর উপায় কী? হাঃ হাঃ হাঃ…

সবজি দিয়ে ফুলকো লুচি গলাধঃকরণ করে বললেন হেডমাস্টার।

থাক, তাই থাক। আপনি যখন বলছেন, তখন আর কী করা। দরকার হলে ফোরেই না হয় রেখে দেবেন দু বছর।

গভীর আত্মপ্রসাদ বিরাজ করে তাঁর হৃদয়ের গভীরে।

৪৬

দরদাম শেষে রফা হয়ে গেল একজোড়া মোরগ সোয়া পাঁচ টাকা।

বেশ বড় সাইজের। দুটো মিলিয়ে মাংস সের চারেক তো হবেই। বিল সিংহনাথ এলাকার মানুষ মোরগ বা মুরগি বলে না, বলে কুকড়ো। মোরগ দুটোর মালিক খলিল মিয়াকে টাকা গুনে বুঝিয়ে দিল হাজারি।

বলে গেল-খলিল ভাই ওরা থাকলো। মোরগ দুড়ে ধরে বাড়ি পাঠায়ে দিও। আমি হাটে চললাম, মসলাপাতি কিনতি হবি।

মধুপুরের মাঠ পাড়ি দিলেই মেগচামি গ্রাম। এই গ্রামে অনেক মুসলমানের বাস। তারা মুরগি পোষে। বিস্তীর্ণ বিল এলাকাজুড়ে নমশূদ্ররা কেউ কুকড়ো খায় না। তারা খায় কচ্ছপ, হাঁস, বক, ডাহুক, পানকৌড়ির মাংস। পাঁঠা বা খাসির মাংস কিনে খাবার সামর্থ্য তাদের নাই। শীতকালে বিদেশি পাখি এসে বিলে পড়ে। আকৃতি আর চেহারা ভেদে বিল সিংহনাথের মানুষরা এসব পাখির নাম দিয়েছে নামরকম। শামুকভাঙা, কাচিকাটা, ঠোঁটব্যাকা, বালি হাঁস, বিলাতি হাঁস ইত্যাদি হরেক রকমের নাম।

বিলে প্রায়ই শিকারি নামে। বন্দুকের ছররা গুলিতে আহত পাখি প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এদিক-সেদিক ছুটে পালানোর চেষ্টা করে। তাকে তাকে থাকে এলাকার মানুষ। সুযোগ পেলেই সেগুলো ধরে লুকিয়ে ফেলে। এতে দোষের কিছু দেখে না তারা। এছাড়া বিলে নানা ধরনের ফাঁদ পেতে রাখে। সেই ফাঁদে ধরা পড়া পাখির মাংস তারা খায়।

কিন্তু কুকড়ো! কোনোভাবেই না।

কুকড়ো হলো ম্লেচ্ছদের খাবার, নাড়েরা খায়। হিন্দুরা খেলে জাত চলে যায়, সমাজচ্যুত হতে হয় তাকে। তাই নমশূদ্র কোনো গ্রামে মুরগির মাংস খাওয়া তো দূরের কথা, পোষাও হয় না।

তবে হাজারির কথা আলাদা। সে সরকারি অফিসার। কোট প্যান্ট পরে সাহেব-সুবোদের সাথে ওঠাবসা করতে হয়। এক টেবিলে খাওয়া-দাওয়া করতে হয়। মুরগির মাংস না খেলে তার সম্মান রক্ষা হবে কী করে!

সমাজ না হয় সম্মানের খাতিরে তাকে কুকড়ো খাওয়ার অনুমতি দিল, কিন্তু তাই বলে কুকড়ো তো আর পাকের ঘরে উঠতে পারে না। বড়জোর বাড়ির বাইরের উঠোন পর্যন্ত।

তাই হোক। হাজারি জোর করে না, মনে মনে হাসে। শুরু তো হলো, উঠোন পেরিয়ে একদিন রান্নাঘরেই ঢুকবে মুরগি। একবারে নয়। এগোতে হবে একটু একটু করে। পালান থেকে যে উঠোন পর্যন্ত আসা গেছে এটাই বা কম

মোরগ দুটো ছাড়া অবস্থায় দিব্যি চড়ে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ তাড়া খেয়ে তারা বিস্মিত এবং বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই বুঝল বিপদ সন্নিকটে। পালাতে হবে। প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল তারা। তারা তো আর জানে না যে, এর মধ্যেই তাদের মালিকানা বদল হয়ে গেছে।

মধুপুর থেকে দলেবলে ছেলেরা এসেছে মোরগ ধরার জন্য। হাজারির মেজো ছেলে দুলাল তাদের নেতা। সে এক মহা আয়োজন। সবাই মিলে চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। বৃত্ত ছোট করতে করতে এগিয়ে আসছে তারা। মোরগগুলো সেই বৃত্ত ভেদ করে বেরিয়ে যাবার জন্যে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছে। একটা প্রায় উড়তে উড়তে আমগাছের মোটা ডালে গিয়ে বসল। আরেকটা দৌড়ে গিয়ে সাঁ করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। ছেলের দল হামলে গিয়ে পড়ল রান্নাঘরে। মাটির ভাতের হাঁড়ি, তরকারির কড়াই উল্টেপাল্টে একাকার হয়ে গেল। দুলাল সবার আগে। তার গায়ের উপর ভাত ছড়িয়ে পড়ল। এত কিছুর মধ্যেও সা করে মোরগটার পা ধরে ফেলল সে। প্রাণপণে ডানা ঝাঁপটাতে লাগল মোরগটা।

আনন্দ আর উল্লাসে মেতে ওঠে সবাই। ওদিকে বাইরের গাছের উপরেরটাও খলিল মিয়া ধরে ফেলেছে। দুটোরই পায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে ছেলেরা বিজয়ীর বেশে মধুপুরের দিকে রওনা হলো।

বেশ ছিল এতক্ষণ সবকিছু। কিন্তু গ্রামে পা দেবার সাথে সাথেই বদলে গেল দৃশ্যপট। পরিতোষ ঘটা করে সবাইকে জানিয়ে দিল, দুলাল কী গর্হিত অপরাধ করে এসেছে। নাড়েদের রান্নাঘরে ঢুকে ভাতের হাঁড়ি ছুঁয়ে এসেছে। দলের সবাই সমস্বরে তা সমর্থন করল।

ওরে মারে মা, কয় কী? কী অলুক্ষণে কতা! মাথায় হাত দিয়ে মেজো জেঠিমা বসে পড়লেন।

দুলাল বুঝতে পারে না, মুসলমানের ভাতের হাঁড়ি ছুঁলে সমস্যাটা কী?

জাত খুয়ায়ে আইচিস। প্রাচ্চিত্তির না করে ঘরে ঢুকতি পারবি নে। এই তোরা ওরে টিউকলের নিচি নিয়ে যা। ভালো করে কল চাপে চান করায়ে দে। জেঠিমা রায় দিয়ে দিলেন।

মহা উৎসাহে দুলালকে ধরে নিয়ে সবাই কলতলার দিকে এগোতে শুরু করল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল সে। সম্বিত ফিরে পেতেই এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল।

তারপর দৃঢ়কণ্ঠে বলল–খবরদার, আমারে ধরবি না কেউ। এই শীতির মদ্যি আমি চান করবো না।

কয় কী! সবাই অবাক। মুসলমানের ভাতের হাঁড়ি ছুঁয়ে এসেছে। আর স্নান করে তার প্রায়শ্চিত্ত করবে না? মামার বাড়ির আবদার নাকি! শহরে থাকে বলে কি সমাজ, ধর্ম সৰ বিসর্জন হয়ে যাবে?

দুলালকে বেশি ঘটানোর সাহস কারো নেই। সে এমনিতে ভালো। কিন্তু রেগে গেলে ভয়ঙ্কর। ছোট-বড় কাউকে তোয়াক্কা করে না। সামনে যা পায় তাই দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিতেও যেমন বাধে না, তেমনি দা-বঁটি হাতে পেয়ে গেলে কোপ দিতেও দ্বিধা করে না সে।

ধরেবেঁধে স্নান করানোর মজা ভঙ্গের কষ্ট নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবাই এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল।

এমন সময় না এসে হাজির। সে পুব পাড়ায় গিয়েছিল গল্প করতে।

সব শুনে বলল–না, না। শীতির এই অবেলায় আমার ছেলেরে চান করানো যাবি নে। শেষে জ্বরটর বাঁধে যাবি। তুলসী পাতার জল গায় ছিটোয়ে দিলিই হবি।

মাঝামাঝি পথে গেল খনা। কিন্তু দুলাল বসে থাকে গোঁ ধরে। তুলসী পাতার জলের ছিটা নিতেও সে রাজি নয়। তার কাছে এটাও অপমানজনক।

ছেলের মনোভাব বুঝল খনা। কিন্তু পাত্তা দিল না। নিজেই জল আর তুলসী পাতা এনে দুলালের গায়ে-মাথায় ছিটিয়ে দিল। তারপর দুলালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল–ইচ্ছে না থাকলিও অনেক কাজ করতি হয়, বাবা। সমাজের নিয়ম যেরম একদিনি তৈরি হয় নাই, সেরম একদিনি সিডা ভাঙ্গেও ফেলা যায় না। সবকিছুর জন্যিই সময় লাগে।

বড় ভাইপো বেণু ততক্ষণে বাইরের উঠোনে উনুন খুঁড়ে ফেলেছে। শুকনো খড়ি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। বেণু হলো এই বিশাল আয়োজনে হাজারির প্রধান সহকারী। কাকাবাবু এলেই মোরগ বলি দেয়া হবে। এক কোপে গলা নামিয়ে দিতে হবে।

এই কাজটা অতি গুরুত্বপূর্ণ। কুকড়ো খাওয়া না হয় মানা গেল, উঠোনে রান্নারও না হয় অনুমতি পাওয়া হলো। কিন্তু বলি যদি ঠিকমতো না হয়, তাহলে কোনো কিছু দিয়েই সেই দায় মোচন হবে না। তাই বালির শান দিয়ে ধার পরীক্ষা করে বড় সাইজের দা-খানা সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

হাজারি বসে আছে উনুনের সামনে টুলের উপরে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বেণু উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে দিয়েছে। হলুদ, মরিচ, মসলা বাটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। আলু কেটে বড় বড় খণ্ড করে পাত্রে রাখা হয়েছে। বড় গামলায় আছে ধুয়ে রাখা মাংস। তার উপরে পড়েছে সরষের তেল। মসলা বাটা হয়ে গেলেই তেল-মসলায় মাখানো হবে মাংস। ঢেলে দেয়া হবে হাঁড়িতে।

একগাদা উৎসুক মানুষ চারিদিকে গোল হয়ে বসে আছে। কৌতূহল উপচে পড়ছে তাদের চোখে-মুখে। দেখছে, কীভাবে কুকড়ো রান্না হয়। এত ব্যস্ততার মধ্যেও নানা প্রশ্নের উত্তর হাসিমুখেই দিয়ে যাচ্ছে হাজারি।

গরম মসলা আর মাংসের ম ম গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে উঠোনজুড়ে। উঠোনের চৌহদ্দি পেরিয়ে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে আশেপাশের বাড়িতেও। সেই গন্ধ ঠেকাতে ধনির মা বুড়ি নাকে কাপড় চেপে হাজারিকে কষে গালি দিতে লাগল।

শাপ-শাপান্ত করে বলতে লাগল–মরবি, নিব্বংশ হবি ভরাপরা। ঘিরানে যে অধেধক ভোজন, সে কতা জানিস নে তুই মিনশে? জানে শুনে তুই আমার জাত মারলি, অনাসৃষ্টি করলি। তোর ভালো হবি নে, নিব্বংশ হবি তুই…

হাজারি কিছু বলে না। মিটিমিটি হাসে। সে জানে, এসব ধনির মা বুড়ির রাগের কথা। হাজারিকে সে অতিশয় স্নেহ করে। সবসময় বাপধন বলে সম্বোধন করে তাকে।

এই শাপ-শাপান্তের মধ্যে তার অন্তরের বিষ মিশ্রিত নেই। তার শাপে কোনো ক্ষতি হবে না কারো।

৪৭

কি গো কাসেম মিয়া, খবর কী, সব কুশল তো?

জে। আল্লার রহমতে ভালোই আছি। বাকিটুক তুমাগের দুয়া।

তা খাড়ায়ে রলে ক্যা। আসো, বাড়ির পর আসে বোসো। এই কিডা আছিস, একখান টুল নিয়ে আয় তো। পেছন বাড়ির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন শরৎ বিশ্বাস।

দেহো না, চোতে রোদি মাঠ করম খা খা কোরতেচে। শরীলডার মদ্যি আগুন ধরে যাতেচে। মাঠে বসে কাম করা যায় না। তাই ভাবলাম এট্টু জিরোয়ে আসি, চোকমুক ধুয়ে এক ঢোঁক পানিও খায়ে আসি। তুমাগের বাড়ি ছাড়া তো আর এই তল্লাটে টিউকল নাই। ভাগ্যিস, তুমার ভাইডার বিয়ে দিছিলে ভৈরব ডাক্তারের মিয়ার সাথে। নালি তো আর তিনি কল পুঁতে দেতেন না। কাসেম মিয়া মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলল।

তা ঠিকই কইছো। তাঐ মশায় আমাগের বিরাট মানুষ। হাজরার চাকরির ব্যবস্থাও তো তিনিই করে দেচেন।

তাই নাহি? শুনে বিজায় আরাম পালাম। হাজারি আমাগের অত্র অঞ্চলের গব্ব। তা দাদা এট্টু হাত-মুক ধুতাম। তুমাগের বদনাড়া দিবা? কাসেম ইতস্তত করে বলল।

এই চ্যাংড়া, বদনা নিয়ে আয় তো। আর কলডা চাপে দে। কাসেম মিয়া জল খাবি। উঠোনে খেলায় রত ছেলেটাকে উদ্দেশ করে বললেন শরৎ।

এই অঞ্চলের মুসলমানদের অধিকাংশই অতি দরিদ্র। নিজেদের জাগা জিরেত তেমন নাই। অন্যের জমিতে পরেত দিয়ে সংসার চালায় তারা। কাসেম মিয়া সেই দলের একজন।

এখানে জাতের বিচার বড় কড়া। বর্ণ হিন্দুরা যেমন নমশূদ্রদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে, ঠিক তেমনি নমশূদ্ররাও এলাকার মুসলমানদের ছোঁয়া কোনো কিছু খায় না। এমনকি মুসলমানরা টিউবঅয়েল স্পর্শ করলেও তাদের জাত চলে যায়।

ছেলেটা টিউবঅয়েল চেপে দিতে লাগল আর কাসেম মিয়া বদনাটা ভালো করে ধুয়ে জল ভরে চোখ-মুখে দিল। তারপর পায়ের উপরে ভর দিয়ে বসে বদনাটা উঁচু করে মুখের মধ্যে জল ঢেলে ঢকঢক করে গিলে খেতে লাগল।

এরকম সময়ে হাজারি পালানের সরু রাস্তা বেয়ে বাড়ির উঠোনের উপরে উঠে এলো। কাসেম ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বিষম খেল।

আরে করো কি, করো কি কাসেম ভাই? বসো বসো। টুলড়ার উপরে বসে আরাম করে খাও।

হাজারি মুখে এই কথা বলল বটে। কিন্তু কাসেমের জল খাওয়ার দৃশ্যটা বড় প্রকট হয়ে তার চোখে ধরা পড়ল। মনে মনে ধাক্কা খেল সে। মানুষে মানুষে এ কি বৈষম্য!

কাসেম ভাই, তুমি বসো। আমি পানি আনে দেই। ব্যথিত হয়ে বলে সে। তারপর ঘর থেকে একটা ঘটি এনে কল থেকে জল ভরে কাসেম মিয়াকে টুলের উপরে বসিয়ে বলল–হাঁ করো, আমি চলে দেই।

না, না। তার আর কী দরকার। ব্যস্ত হয়ে বলে কাসেম মিয়া। দরকার আছে কাসেম ভাই। আমরা সবাই একই মানুষ। একই রক্ত আমাগের গায়। অথচ দ্যাখো, শুধু মোছলমান বলে তুমারে বদনায় করে পানি খাতি হচ্ছে। দেকতিও তত খারাপ লাগে। তয় বুঝি, একদিনিই তো সব আর ঠিক করে ফেলা যাবি নে। বদনার বদলে ঘটির চল শুরু করে দিলাম। আস্তে আস্তে একদিন আমরা একসাথে ওঠাবসা করব। একসাথে বসে খাওয়া-দাওয়া করব। ছোঁয়া-ছুঁইর কোনো বাছবিচার থাকপি নে আমাগের মদ্যি। কী কও?

শিক্ষিত মানুষের উপযুক্ত কতাই তুমি কইচো। দিলভায় বড় আরাম পালাম। কবি কয়ে গেছে, একই বিন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মোচলমান…। আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল কাসেম।

বাঃ বেশ ভাব আচে তো তোমার মনে। কাসেম ভাই, ল্যাখাপড়া করলি তো তুমি কবি হতি পারতে। তয় কতা কি, দিন বদলায়ে যাচ্ছে কাসেম ভাই। মোছলমানদের মদ্যিও লেখাপড়া শুরু হয়ে গেছে। কতায় আছে না, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। সেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হলি, মানুষি-মানুষি আর ভেদ থাকপে না। দেখো না, আমরা হিন্দু হলিউ বাওন, কায়েতরা আমাগের নমশূদ্দুরগের মানুষ বলেই গণ্য করে না। ইডা কি ঠিক?

না, তা ঠিক হবি ক্যাম্বা।

তাই তো কাসেম ভাই, তুমি বোঝ, আমি বুঝি। কিন্তুক সগগোলে মিলে

বুঝলি তো হবি নে। শুরু করতি হবি আমাদের, শেষ করবি আমাদের ছাওয়ালপালরা, কী কও?

চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে হাজারি তাকিয়ে থাকে সামনের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের দিকে।

৪৮

আই রিড বুক। এর প্রেজেন্ট পারফেক্ট কন্টিনিউয়াস টেন্স কী হবে?

আই হ্যাব পর্যন্ত কয়েকজনে পৌঁছুতে পেরেছে। হ্যাঁব বিন পর্যন্ত যেতে পারল ক্লাসের ফাস্ট গার্ল প্রীতিলতা। কিন্তু সে রিডের সাথে আইএনজি যোগ করাতে পারল না।

আমি কবো স্যার?

সবাই অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে। ছেলেটা নতুন, ভর্তি হয়েছে মাত্র কয়েক দিন। সে হলো দুলাল। এর মধ্যেই দুষ্টের শিরোমণি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে সে। এই তো সেদিন, ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছে মহেন্দ্রর। ভবিষ্যৎ যে তার একেবারে ঝরঝরে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই সামাদ স্যারের।

ক্লাসের ফার্স্ট গার্লই যখন পারল না, তখন আর কারো পারার প্রশ্নই ওঠে না। যেচে উত্তর দিতে চাওয়ায় অবাক হয়ে দুলালের দিকে তাকান সামাদ স্যার।

পারবি তুই?

হ্যাঁ স্যার, পারব।

হাতি-ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল। সারাদিন তো মারামারি করে বেড়াস। তুই পারবি কীভাবে! বল তো দেখি। অবজ্ঞা ঝরে পড়ে স্যারের কণ্ঠে।

গড়গড় করে বলে গেল দুলাল। মুগ্ধ হয়ে গেলেন সামাদ স্যার। ছোঁড়াটাকে চরম বখাটে বলেই জানেন তিনি। তার প্রিয় ছাত্রী হলো প্রীতি। গোটা শিক্ষকতা জীবনে তিনি প্রীতির মতো মেধাবী আর কাউকে পাননি। মনে মনে রেগে যান সামাদ স্যার। মাত্র দু’মাস আগে ক্লাসে টেন্স পড়িয়েছেন। প্রীতি পর্যন্ত সঠিক উত্তর দিতে পারল না। আর এই বখাটেটা কেমন ফট করে বলে দিল।

কার কাছে শিখেছিস? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন তিনি।

কারুর কাছের তে না স্যার। আমি আর দাদা একসাথে পড়তি বসি। ওর পড়া শুনে নিজিনিজিই শিকে ফেলিছি।

তাই নাকি, আর কী শিখেছিস?

অনেক কিছু শিখিছি, স্যার। কিলাসের সব পড়াই আমি পারি।

তাই নাকি? বল তো দেখি-একে একে অনেকগুলো ট্রানসেন ধরলেন, গ্রামারের নানা প্রশ্ন করলেন। গড়গড় করে সব কটার উত্তর সে দিয়ে দিল।

তয় পড়াশুনা করতি আমার ভালো লাগে না স্যার। ঠোঁট উল্টিয়ে অবহেলা ভরে বলল দুলাল।

তাহলে কী ভালো লাগে?

খেলা করতি স্যার খুব ভালো লাগে।

তাই। আর মারামারি?

চুপ করে রইল দুলাল। এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সমীচীন হবে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

যা, বড় দেখে একটা আষ্টেলের ডাল ভেঙে নিয়ে আয়। স্যার বললেন।

দুলাল বেঞ্চের ভিতর থেকে বের হবার উদ্যোগ নিতেই তার অপকর্মের প্রধান সাগরেদ কুদুস ফিসফিস করে বলল–ছোট দেখে আনিস দোস্ত। নইলে স্যার আজ মেরেই ফেলবে।

ঠিক আছে, চিন্তা করিস না।

স্কুলঘরের পেছনেই অনেক আষ্টেল গাছ। ছোট দেখে একটা গাছ টেনে তুলল দুলাল। পাতাগুলো ছাড়িয়ে শিকড়ের উপর থেকে ভেঙে ফেলল গাছটা। ছোটই হয়েছে। মেরে বেশি সুবিধা করতে পারবে না স্যার।

ডালটা টেবিলের উপরে রেখে দুলাল বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়াল। পেছন থেকে সপাং করে একটা শব্দ হলো। দুলালের মনে হলো। যেন লাঠিটা তার পিঠেই পড়েছে। সে ঘুরে দাঁড়াল। সাথে সাথেই আরেকটা বাড়ি। স্যার একের পর এক সেই আষ্টেলের ডাল দিয়ে নির্দয়ভাবে দুলালকে পেটাতে লাগলেন।

আমি কী করিছি স্যার। আমারে মারতেছেন ক্যান?

ততক্ষণে লাঠিটা ভেঙে গেছে। স্যার হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন–এত ছোট লাঠি এনেছিস কেন?’

এতক্ষণে বুঝল দুলাল, কেন সে মারটা খেল। একমাত্র সে-ই পড়াটা পারল। আবার মারও খেতে হলো। অভিমানে তার চোখে জল এসে যায়। প্রচণ্ড রাগ হলো তার সামাদ স্যারের উপর।

সে পড়বে না। এই স্কুলেই পড়বে না আর। চোখের পলকে বইগুলো বেঞ্চের উপর থেকে তুলে নিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল সে। সামাদ স্যার হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ছাত্ররা মার খায়, কান্নাকাটি করে, কিন্তু টু শব্দটি করে না। এ পর্যন্ত তাই-ই হয়ে এসেছে। ক্লাস থেকে কোনো ছাত্র বিনা অনুমতিতে বের হয়ে যাবার ঔদ্ধত্য দেখাতে যে পারে, তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।

এ্যাই, ধরে আন তো ওকে। সম্বিত ফিরে পেতেই স্যার ক্লাসের সবাইকে ঢালাও হুকুম দিয়ে দিলেন।

ততক্ষণে দুলাল রাস্তায় নেমে এসেছে। দশ-বারো জন হৈ হৈ করতে করতে ওর পেছন পেছন ছুটল। এতে রাগ আরও বেড়ে গেল তার। যাদের বাঁচাতে মার খেল সে, তারাই কিনা মহানন্দে ছুটে আসছে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য!

নিমকহারামের দল সব।

মাথা গরম হয়ে যায় দুলালের। রাস্তার পাশেই পড়ে থাকা বড় একখানা থান ইট তুলে নিল সে। ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে মারার ভঙ্গিতে বলল–সব শালার মাথা ফাটায়ে দেব।

থমকে দাঁড়িয়ে গেল সবাই। ওকে ভয় না করে উপায় নেই। সত্যি সত্যি মাথা ফাটিয়ে দিতে পারে। একে একে পিছটান দিল সবাই।

রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে দুলাল গজগজ করতে লাগল। তারপর ইটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হনহন করে বাড়ির দিকে রওনা দিল সে।

৪৯

নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজছিল হাজারি। কাল রাতে সে এই গ্রামে এসেছে গোপিনাথপুরের সুধীরের সাথে। সুধীর সম্পর্কে ভাগনে, কিন্তু প্রায় সমবয়সী হওয়ায় তারা বন্ধুর মতোই। এর আগে কখনও এ গ্রামে সে আসেনি। গতরাতে গোয়ালদহ যাবার জন্য তারা যশোর থেকে রওনা দিয়েছিল। মাগুরা পার হয়ে মাইল ছয়েক এসে ওয়াপদা মোড়ে নেমেছিল। কিন্তু রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় বেশ বিপদেই পড়ে গিয়েছিল ওরা।

সুধীর বলেছিল—কাছেপিঠেই কোথাও শিবপুরের একটি মেয়ের বিয়ে হয়েছে। সে লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে করে ঠিকই বাড়িটা খুঁজে বের করে ফেলল।

কাঁচা রাস্তার উপর সবুজ গাছগাছালিতে ছাওয়া গ্রামটি। সামনে একটা সবজি খেত। সবজি খেতের পাশে বসে আয়োজন করে দাঁত মাজছে হাজারি। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় তার। তখন ছাই নয়তো আষ্টেলের ডাল দিয়ে দাঁত মাজত। নিমের ডাল তিতা লাগত বলে এটা তারা ব্যবহার করত না। এতকাল পরে সুযোগ পেয়েছে বলে ইচ্ছে করেই সে নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতে বসেছে।

মামা চলো তো, গ্রামড়া এট্টু ঘুরে বেড়ায়ে আসি। সুধীর বেশ আগ্রহ নিয়েই কথাটা বলল। সুধীর নতুন নতুন জায়গা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে।

কতদিন পর আয়েশ করে দাঁতন করতি বসিছি, তা তোর সহ্য হচ্ছে না?

দাঁত মাজতি মাজতিই চলল। আসে যহন পড়িচি তখন গিরামড়া ভালো করে দেহেই যাই।

তোর যখন বাই উঠিছে, তখন কি আর না যায়ে উপায় আছে? আচ্ছা চল।

দুজনে মিলে চলল গ্রাম পরিদর্শনে। ঘুরতে ঘুরতে ওরা আখ মাড়াইয়ের জায়গায় গিয়ে হাজির হলো। গ্রাম্য ভাষায় বলে কুশোরের খোলা। এখানে গ্রামের মানুষ পালাক্রমে তাদের আখ মাড়াই করে, রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করে। খোলায় এসে ওরা পরিচিত হতে থাকল গ্রামের মানুষদের সাথে। তারপর শুরু হয়ে গেল গল্প। গল্পে গল্পে জানা গেল যে, মধুপুর গ্রামের একটা মেয়ে বিধবে হিসেবে আছে এ গ্রামে।

আমাদের গ্রামের মেয়ে, কিডা সে? একটু অবাকই হয় হাজারি।

এই এলাকায় যারা একটু সচ্ছল, তারা প্রৌঢ় বয়সে বৌ-এর পাশাপাশি দু-একজন রক্ষিতা রাখে। তাদেরকে গ্রাম্য ভাষায় বলে বিধবা রাখা বা বিধবে রাখা। সবাই এটা মেনে নেয়। এমনকি তার বৌও। পুরুষতান্ত্রিক সামন্তবাদী

এই সমাজব্যবস্থায় না মেনেই বা উপায় কী তাদের!

অবাক হয় হাজারি। বলে–চল তো দেখি কিডা সে। সরেজমিনে যাচাই করে আসি।

জানা গেল, তার নাম পাঁচী। তবে বিধবা হিসেবে থাকলেও সে ভাগ্যবতী। কারণ, লোকটার বৌ নাই। বৌ তার মারা গেছে বেশ কিছুদিন আগে। সে আর বিয়ে না করে পাঁচীকে বিধবে রেখেছে।

বিধবা কেন? বিয়ে করতি অসুবিধা কী?

বিদ্যাসাগর বিধবা বিয়ের আইন পাস করে গেছেন সেই কবে! তবু আজও আমাদের নমঃশূদ্র সমাজে বিধবা বিয়ে হয় না। কিন্তু রক্ষিতা রাখলে দোষ নাই। উত্তেজিত হয়ে পড়ে হাজারি।

পরেশ খুড়ো অন্য এট্টা মিয়ারে বিয়েই করতি চাইছিল। কিন্তুক ছাওয়াল মিয়ারা বাধা দুয়ায় আর বিয়ে আগোতি পারে নাই। গ্রামের একজন আগ বাড়িয়ে বলল।

ছেলেরা বাধা দিল ক্যানো? সমস্যাড়া কী?

সমস্যা আছে। অনেক বড় সমস্যা। তুমি বুজবা না, মামা। বলল সুধীর।

বললি বোজবো না ক্যান? বুঝোয়ে ক।

বিয়ে করলি স্ত্রীর গর্ভের সন্তান সম্পত্তির ভাগ পায়। কিন্তুক বিধবে রাকলি সে সমস্যা নাই। বিধবেরা শুধু পুরুষ মানষির খাই মিটোবি। পোয়াতি হতি পারবি নে। সেরম কিছু হয়ে গেলি, কোবরেজ আসে শিকড় বাটে খাওয়া দিবি। তারপরও যদি কোনো কারণে সন্তান জন্মায়ে পড়ে, তালিউ সে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতি পারবি নে। তাই এই ব্যবস্থায় পরেশের ছাওয়ালগের কোনো আপত্তি নাই।

এটা তো স্বার্থপরের মতোন হয়ে গেল। কিন্তু পাঁচী এতে রাজি হবে কেন? হাজারি প্রশ্ন করে।

রাজি হবি নে ক্যা? গরিব ঘরের মিয়া। বিয়ের পর স্বামী মরে গেল। স্বামীর বাড়ি জাগা হলো না। ভাইগেরও নুন আনতি পানতা ফুরোয়। তালি মিয়াডা যাবি কনে? পরেশের বাড়ি তাও তো সে চাড়ে খায়ে-পরে বাঁচতি পারতেছে। গ্রামেরই একজন যোগ করে।

তয় পরেশ দা মানুষ ভালো। মিয়ার উপর কোনো অত্যাচার করে না। তার ছাওয়ালরাও খারাপ ব্যবহার করে না। মা কয়ে না ডাকলিউ মার মতোনই দ্যাহে। তাই কতি হবি, সবকিছু মিলায়ে তুমাগের পাঁচী ভালোই আছে। গ্রামের আরেকজন বলল।

হাজারির মনটা খারাপ হয়ে গেল পাঁচীর জন্যে। বেশ হাসি-খুশি ছিল মেয়েটা। তার চাইতে বছর দশেকের ছোট হবে। পড়াশুনা, চাকরি সবকিছু মিলিয়ে সে গ্রামের বাইরে অনেকদিন ধরে। ছুটিছাটায় যখনই বাড়ি আসত, তখনই পাঁচী হাসিমুখে সামনে এসে সামনে দাঁড়াত। বলত–দাদা কেমুন আছো? সেই লাজুক মিষ্টি মুখখানা ভেসে ওঠে হাজারির চোখের সামনে।

চলো যাই মামা, দ্যাখা করে আসি। সুধীর বলল। খোলার উপস্থিত সবাই তাকে সমর্থন করে।

কিন্তু হাজারির মন চাইছে না। কোন মুখে সে পাঁচীর সামনে দাঁড়াবে। শুধুমাত্র খাওয়া-পরার বিনিময়ে পাচী আজ রক্ষিতা, পেটের দায়ে সে সামাজিক স্বীকৃত বেশ্যা।

না, কোন মুখি তার সামনে যায়ে দাঁড়াব? কাতর কণ্ঠে বলে হাজারি।

উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা বুঝতে পারে না, কেন এই কাতরতা!

কোনো সমস্যা হবি নে, চলো যাই। আমাগের সমাজে ইডাই বাস্তব। সুধীর বলে।

ওই তো রাঙাদি নিজিই আসে পড়িচে। একজন বলল।

সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল সেদিকে। দেখা গেল এক মহিলা সামনের রাস্তা ধরে দ্রুত এগিয়ে আসছে।

হ, ঠিকই তো। পরেশ দার বিধবেই তো আসতেচে। আরেকজন বলে উঠল।

অসীম শোনেক তো। বলে সেই মহিলা কাউকে ডাকল।

একটা ছেলে তাদের সামনে থেকে উঠে এগিয়ে গেল। হাজারি বুঝল সে ই অসীম।

শুনলাম মধুপুরইতে কিড়া বোলে আইচে, খোলার পর বসে রইচে। কিডা সে, জানিস কিচু?

অসীম সেখান থেকেই আঙুল দিয়ে হাজারিকে দেখিয়ে দিল। এগিয়ে আসে পাঁচী। হাসিখুশি সেই পাঁচী কেমন দেহাতি মতো সাদা কাপড় পরা। বয়সের ছাপ তার সারা মুখে, শরীরে।

তুমি! হাজরা দাদা। তুমি আমাগের গিরামের পর আইচো, আর আমি সিতা জানি নে? কন তে আলে, ক্যাদা আলে? বিস্ময় ফুটে ওঠে পাঁচীর কণ্ঠে, তার মুখে কথা সরে না। কীরম করে বিশ্বাস করব হাজারি দাদা, সত্যিই তুমি তো?

হ্যাঁ রে, পাগলি আমিই। বেড়াতি বেড়াতি চলে আইচি। তুই এই গ্রামে আছিস, তা তো আর জানতাম না।

আমিউ এট্টা মানুষ, চামচিকেও এট্টা পাখি। আমার নাগাল মানষির কথা তুমি ক্যাম্বা জাবা?

খানিকটা ইতঃস্তত করে বলে ফেলে সে-বাড়ির পর এট্টু যাবা না?

ক্যান যাবো না? চল।

তুমি যিরম মানুষ, তুমি যাবা তা আমি জানি। কিন্তুক আমিই বা কুন মুহি তোমারে আমার বাড়ির পর নেব!

ক্যান রে! তোর বাড়িতে যাব তার জন্যে এত লজ্জার কী আছে! চল।

সত্যিই যাবা তো?

অবশ্যই যাবো। ক্যান, তুই কি চাস নে যে আমি তোর বাড়িতে যাই।

পাঁচী এগিয়ে এসে হাত ধরে হাজারির। তারপর কাঁদতে থাকে হু হু করে। হাজারি বাধা দেয় না। কাঁদুক। কেঁদে কেঁদে হালকা হোক খানিকটা।

আবেগ অবদমিত হলে আঁচলে চোখ মুছে পাঁচী পেছন ফিরে তাকায়।

দাঁড়ায়ে দেকতেচো কী পুণ্যির বাপ? কিডা আইচে জানো? দাদা হোলো গে আমাগের গিরামের হাজারিবাবু, বিরাট অপিচার। আবার উদিক ভৈরব ডাক্তারের জামাই। কার মুক দেহে যে আজ উটিচি। আমাগের চোদ্দ পুরষির ভাগ্যি গো। তাড়াতাড়ি বাড়ির পর নিয়ে চল। জাল নামাও পুকুরি, পুণ্যিরে গাছে উটোয়ে দ্যাও।

কুশোরের খোলায় উপস্থিত সবার মধ্যেই একটা সাড়া পড়ে যায়।

সাদামাটা ভালো মানুষের মতো চেহারার লোকটা কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে হাজারির দিকে এগিয়ে এসে বিনয়ের সাথে বলে–চলেন দাদা, গরিব বুলে না করা যাবি নে। বাড়ির পর পদধূলি দুয়াই লাগবি।

বোঝা গেল এই লোকটাই পরেশ। সে বোধহয় পাঁচীর পেছন পেছন এসেছে।

না, না। তা কেন, চলেন। বলে সুধীরকে নিয়ে উঠে পড়ে হাজারি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *