১০. ম্যাট্রিকুলেশন পাস

১০

সত্যি সত্যি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ফেলেছে হাজারি।

শুধু পাসই নয়, সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে সে। অবাকই হয়েছে হাজারি। আদৌ পাস করবে কি না, সেটা নিয়েই মনের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় ছিল তার। একটু পড়া দেখিয়ে দেবার মতো কেউ নেই এ তল্লাটে। তারপর স্কুল সেই পাঁচ মাইল দূরে। পায়ে হেঁটে দশ মাইল রাস্তা আসা-যাওয়া করতেই তার দিন পার হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়ে সে। খিদেয় পেট চো চো করতে থাকে। কোনোমতে বই-খাতা ফেলে রেখে হাত-পা ধুয়ে ভাত খেতে বসে। তারপরই ছেড়ে দেয় শরীরটা। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করে তার দুচোখে। পড়াশুনা করবে কখন?

এছাড়া আছে ফসলের মৌসুম। তখন সারাদিন মাঠে থাকতে হয়। ধান কাটতে হয়, পাট কাটতে হয়। বোঝা মাথায় করে বাড়ির উঠোনে এনে ফেলতে হয়, মলন মলতে হয়। আছে নিত্যদিনের কাজ। মাঠে ভাত নিয়ে যাওয়া। জলটা-কোটা এগিয়ে দিয়ে আসা। বিলে মাছ ধরা। সন্ধ্যায় গরু নিয়ে বাড়ি ফেরা।

এভাবেই কেটে যায় সারা বছর। পড়াশুনাটা মুখ্য নয় তার। সব কাজ শেষে সময় থাকলে পড়াশুনা করো।

গরিবের ছেলের আবার ঘোড়া রোগ! কী হবে এত লেখাপড়া করে।

ফরিদপুর থেকে রেজাল্ট নিয়ে এসেছেন হেডমাস্টার বাবু। মোট তিনজন পাস করেছে বালিয়াকান্দি হাই স্কুল থেকে। ভীষণ ভালো রেজাল্ট। গর্বে হেডমাস্টারের বুক ভরে গেছে। এই প্রথম তার স্কুল থেকে কেউ সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করল। বাকি দুইজন থার্ড ডিভিশন। হেডমাস্টার নিজেই সাইকেল চালিয়ে মধুপুর এসেছেন হাজারির পাসের খবর নিয়ে। সাথে এনেছেন এক সের দানাদার। সেই দানাদার সবাইকে বিলি করা হলো।

পানটা মুখে পুরে হেডমাস্টার বললেন–তা হাজারি তুমার কলেজে ভর্তি হওয়ার লউ হবি?

জানি না স্যার। দেখি বড়দা যা কয় তাই হবি। হাজারি দাদার মুখের দিকে তাকায়।

আমার তো ইচ্ছে, হাজরা আরো পড়ুক। তয় সব ওই ভগমানের দয়া। তার কিপা যদি হয়, নিশ্চয়ই হাজারি পড়বি। কলেজে যাবি। খরচ য্যাম্বা পারি জোগাড় করব।

কলেজ তো সেই ফরেদপুরির রাজেন্দ্র কলেজ। চব্বিশ মাইল পথ হাঁটে যাওয়া-আসা করতি হবি। পারবি তো? হেডমাস্টার জিজ্ঞেস করলেন।

পারতিই হবি স্যার। কিন্তু ফরেদপুর যায়ে থাকপানে কুন জাগায়? চিনা জানা তো কেউ নাই।

ক্যান, হোস্টেলে থাকপি। নালি মেসে।

কিন্তুক সিতা তো ম্যালা খরচের কাম। এত টাকা কনে পাবানে। আমাগের বাড়ির অবস্থার কতা তো স্যার আপনার সবই জানা।

ভগমানের উপর ভরসা রাখ। পড়াশুনা তোর ঠেকে থাকপি নে। তয় মেসের ব্যবস্থা করতি পারলি খরচ একটু কম লাগবি। ভাবিস নে, মেসের ব্যবস্থাই এট্টা করে ফেলবানে। ভরসা দেন হেডমাস্টার।

যাই তালি। বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

হাজারি গড় হয়ে প্রণাম করে বলল–আশীৰ্বাদ করবেন স্যার। আপনাগের মনোবাঞ্ছা যেন পূরণ করতি পারি।

নিশ্চয়ই পারবি। আশীৰ্ব্বাদ করি আইএ পাস করবি, বিএ পাস করবি। মানুষের মোন মানুষ হবি। বলে সাইকেলটা ঠেলে উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন হেডমাস্টার।

হাজারির মনের মধ্যে অস্থিরতা। বুক দুরুদুরু করে তার। ফরিদপুর শহরে গিয়ে সে থাকতে পারবে তো? না জানি কেমন ওখানকার জীবন। পড়ার খরচই বা কেমন? আশা দিলেও খরচ জোগাড়ের ব্যাপারে দাদার উপরে ভরসা রাখা যাচ্ছে না তেমন। বাড়ির অবস্থা সে জানে। বন্যায় একবার ফসল ডুবে গেলেই সর্বনাশ। পড়াশুনা তো দূরের কথা, খাওয়াই জুটবে না তখন।

সন্দেহের দোলাচলে দুলতে দুলতে এক সকালে হাজারি টিনের বাক্সে বইপত্র আর কাথায় মুড়োনো বিছানা-বালিশ মাথায় নিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। চব্বিশ মাইল পথ তাকে হেঁটে যেতে হবে। রাস্তাও চেনে না ঠিকমতো! জিজ্ঞেস করে করে এগোতে হবে। আশা করা যায়, সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাবে সে ফরিদপুরে।

হেড স্যার মেস জোগাড় করে দিয়েছেন। কমলাপুর রেল স্টেশনের পাশে টিনের চালা আর চাটাই ঘেরা স্কুল বাড়ির মতো লম্বা মেস ঘর। ঠিকানাটা ভালো করে কাগজে লিখে নিয়েছে।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাজারি আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে আড়ার রাস্তা ধরে। একা, নিঃসঙ্গ। অনিশ্চিত যাত্ৰায় চলেছে সে। কালিরামের ভিটের পাশ দিয়ে মেঠো আইল বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে। খোলা মাঠ, বিল, সবুজ প্রান্তর ছেড়ে। এতদিনের সুখ-দুঃখের সব সাথিদের ছেড়ে। হাঁটতে হাঁটতে হালটের রাস্তায় গিয়ে পড়ে হাজারি।

চোখ বেয়ে নেমেছে জলের ধারা। কিন্তু, থামবে না সে। এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের উঁচু মাটির রাস্তায় উঠে আসে হাজারি।

এই চলা তার জীবনের অন্য এক চলা। নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

১১

বিল সিংহনাথের নমশূদ্রদের জীবন আর ভাগ্য প্রকৃতির সাথে একসূত্রে গাঁথা। সুখে-দুঃখে মিলেমিশে বয়ে চলে নিরন্তর।

সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই তারা রাতের খাবার খেয়ে নেয়। তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে ওঠে আবার সেই রাত থাকতেই। ভোর হওয়ার অনেক আগে। পাখিদের কিচিরমিচির যখন শুরু হয়।

ধান ভেজানো থাকে মাটির কোলায়। সেই ধান না ভানলে সকালের ভাত রান্না হবে না। ভোররাত থেকে টেকির পাড়ের ছন্দময় শব্দ ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। ছেলেরা লাঙল-বলদ নিয়ে মাঠে যায়। রোদ ফোঁটার আগেই মেয়েরা গোবর দিয়ে সারা উঠোন লেপে ফেলে। তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমুতে গেলে আর আলো জ্বালাতে হয় না। কেরোসিন তেলের খরচটা বাঁচে। পরদিন ভোরের আগে ঘুম থেকে ওঠাও সহজ হয়।

কিন্তু আজ ব্যতিক্রম। রাতের খাবার খেয়েই একে একে গ্রামের মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে মণ্ডলদের উঠোনে। বিচারসভা বসবে আজ। জগা আর রাধার বিচার হবে। উঠোনজুড়ে খেজুর পাতার পাটি পাতা হয়েছে। পান তামাকের ব্যবস্থাও আছে। একে একে এসে বসছে সবাই উঠোনে পাতা পাটিতে।

নিবারণ মণ্ডল বসলেন মাঝখানে রাখা বড় টুলটার উপর। তিনি এই গ্রামের বড় মাতুব্বর। সাথে আছে বিশ্বাস গোষ্ঠীর একজন আর বাইন গোষ্ঠীর একজন। তারা ছোট মাতুব্বর। বাদী রাধার বাবা কালিপদ।

কও কালিপদ, তুমার কী কওয়ার আছে।

অন্য সময় হলে বড় মন্ডল কালিপদকে কালে বলে সম্বোধন করতেন। তুই তোকারি করতেন। কিন্তু আজ বিচার সভা। সভা গাম্ভীর্যপূর্ণ থাকা দরকার। তাই কালিপদকে তিনি পূর্ণনামে ডাকলেন। তুমি বলে সম্বোধন করলেন।

কও, নির্ভয়ে কয়ে ফ্যালাও কালিপদ। যা সত্যি সিডাই কবা। ছোট মোড়ল অভয় দেন তাকে।

কালিপদ ইতস্তত করছিল। কীভাবে শুরু করবে, ভেবে পাচ্ছে না। দুচোখ তার জলে ভরে এসেছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে ভাঙা গলায় বলতে শুরু করে–আমি গরিব মানুষ। ঠিকমতোন দুই বেলা ছাওয়ালপালের মুখি এক মুঠো ভাত উটো দিবার পারিনে। রাধা আমার মা-মরা মিয়া। জগার বাপ বড়লোক হতি পারে। কিন্তু, তার ছাওয়াল যে এট্টা দুশ্চরিত্র, এ কতা গিরামের কিডা না জানে। বড়লোকের ছাওয়াল আমার রাধারে লোভ দেকাইচে। ভালোবাসা করিছে। বিয়ের কতা কয়ে, ইডা সিডা বুঝেয়ে তার সাথে খারাপ কাম করিচে। আমার সরল-সুজা মিয়াড়া পোয়াতি হয়ে গেছে। আর এহন সে রাধারে চেনে না। বিয়ে করতি অস্বীকার তো করিইছে, তার উপর মারে দেহ আমারে কী করিচে জগা।

ফুলে ওঠা বা হাতখানা উঁচু করে সবাইকে দেখায় কালিপদ।

আমার মিয়ার এহন গলায় ফাঁস নুয়া ছাড়া আর কোনো গতিক নাই। আমি আর কী কব। তুমরা সগলেই আছো। ন্যায্য বিচারডা এহন ঠিকমতো করে দ্যাও। এর বেশি আর কিছু চাই নে আমি। চোখ মুছতে থাকে কালিপদ।

জগা কনে? শুনিছো তো তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ? এখন কও, তোমার কী কওয়ার আছে? বড় মন্ডল গম্ভীর হয়ে বললেন।

ইসবের এট্টা কতাও সত্যি না। সব মিত্যে, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। রাধারে আমি নিজির মার পেটের বুনির চে কোনো অংশে কম করে দেহি নে। তার সাথে আমার খারাপ সম্পর্ক থাকপি ক্যাম্বা?

চোক কান বুজে এরম নির্জলা মিত্যে কতি পারলি? ধম্মে সবি নে রে জগা! তোর মুহি পুকা পড়বি। কালিপদ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল।

কালে কাহা, তুমি হচ্ছ গে আমার গুরুজন। তুমার মুহির পর কোনো চোপা আমি করব না। তয় যা কবো, সত্যি কবো। বুক ঠুহে কবো।

সত্যি সত্যি বুকে টোকা দিয়ে জগা বলে–মানুষ আমি খারাপ হতি পারি। কিন্তু কোনো শালার বাচ্চা কতি পারবি নে যে, জগা মিত্যে কতা কয়। বাপ মা সে শিক্যে দ্যায় নাই। মারে ফ্যালাও আর যাই করো আমার এক কর্তা। মিত্যে আমি কতি পারব না। এই কিরে কাটে কতেচি, রাধার দিক কুনুদিন আমি কুনজরে তাকাই নেই পর্যন্ত। সে আমার ছোট বুনির মতোন। কিরে পটলা, কথা কোস নে ক্যা? ক, যা আমি কলাম, সব সত্যি কি না?

সত্যি মানে, লক্ষ কুটিবার সত্যি। জগা তো রাধার দিক ফিরেও তাকায় নাই কুনুদিন। বুনির দিক নজর দিবি ক্যা? জগা দার দুন্নাম থাকতি পারে, কিন্তুক নিজির গাঁর মায়েগের নষ্ট করবি, সেরম চরিত্তির জগাদার না। কালে কাহার কথা সম্পুন্ন মিত্যে।

জগার অপকর্মের প্রধান সাগরেদ পটলা গটগট করে বলে বিজয়ীর ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকায়।

রাধা রে ডাকো কালিপদ। তার কথা শুনা দরকার। গম্ভীর হয়ে বললেন বড় মন্ডল।

রাধা এসে দাঁড়ায় সবার সামনে। মুখে কোনো কথা নাই তার। ফুলে ফুলে কেঁদে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে চোখ মুছছে আঁচলে। কান্নার দমকে কোনো কথা বলতে পারে না সে।

শুদু কানলি তো হবি নে। কতা কতি হবি রাধা।

ছোট বাইন মোড়ল সুযোগ পেয়ে এতক্ষণে মুখ খুলল। কাঁদতে কাঁদতেই রাধা বর্ণনা করল জগার কুকর্মের কথা।

কোনো পেরমান দিতি পারবা গো মা? বড় মোড়ল সহানুভূতির সাথে বলল।

পেরমান ক্যাম্বা দেব। ইতা তো মানুষজন ডাহে সামনে রাহে করার কাম না। গোপনে করার কাম। তয় পটলারা সব জানে। কিন্তুক এহন উরা মিত্যে কতা কতেছে।

এ ব্যাপারে আর কারো কোনো কতা আছে?

মাথা নিচু করে থাকে সবাই। শুধু কালিপদ চোখ মুছতে মুছতে বলল–মাতার পর ভগমান সাক্ষী। ল্যায্য বিচার চাই আমি।

তোমার কতাই সত্যি। শোনো তোমরা, মন দিয়ে আমার কতা শোনো। এরম মামলায় দেশের আইন হচ্ছে, মিয়া মানুষ যি কবি সিডাই সত্যি। পুষ্যে মানষির কতার কোনো দাম নাই। তালি আইন অনুযায়ী জগা তুমার কতা এ জাগায় টিকপি নে। কার্যকর হবি রাধা যিডা কবি সিডাই। তাছাড়া প্যাট তো আর রাধার এমনি এমনি বাঁধে নাই। কেউ না কেউ তো আছেই এর পিছনে। আর সিডা পুরষে মানুষই হতি হবি। জগার যা স্বভাব-চরিত্তির, তাতে ধরে নুয়া যায় যে, এই কার্যের পিছনের কারণ হলো সে-ই। তাই রাধার কতাই আমি সত্যি বুলে মনে করতি চাই। না কি কও তোমরা?

আমাগেরও সেই মত। বলে অন্য মাতুব্বররা। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। উপস্থিত সবাই।

তালি জগার বাপ, তোমার কি কওয়ার আচে সগলের সামনে কও।

আমার আর কওয়ার কিছু নাই। ছাওয়ালের স্বভাব চরিত্তির ভালো না। সিতা সগলেই যেমুন জানে, আমিই সেই জানি। নতুন করে কওয়ার কিছু নাই। বিচারসভা যে রায় দিবি, আমি তাই মাতা পাতে মানে নেব। গিরামের মাতুব্বরির উপর আমার কোনো কতা নাই।

বেশ, তালি এই সাব্যস্ত হলো যে, জগা দোষী। না কি কও তোমরা?

হ, জগা দোষী। তার বিচার ঠিকমতোন হতি হবি?

বিশ্বাস গোষ্ঠীর মোড়ল উচ্ছ্বসিত হয়ে তার মত প্রকাশ করল। বাইন গোষ্ঠীর মোড়লও তাতে সায় দিল। দুজনেই মনে মনে খুশি। জগা তাদের গোষ্ঠীর না, মন্ডল গোষ্ঠীর। মন্ডল গোষ্ঠীর কেউ শাস্তি পেলে অকারণেই আনন্দ হয় তাদের।

বেশ, জগার বিচার ঠিকমতোনই হবি। তয় অল্প এট্টু কতা আছে।

থামেন বড় মন্ডল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাকান রাধার দিকে। আদরের সুরে বলেন–রাধা মা, তুমি কি সুই তি সুতো পরাতি পারো?

ইডা কি কলে জ্যাঠা। সুতো পরাতি পারব না ক্যা? সিলাইয়ের কাম ভালো করেই শিকিচি। উৎসাহের সাথে বলে রাধা।

তালি ঘরের তে নিয়ে আসো তো মা সুঁই-সুতো।

রাধাকে গিয়ে আনতে হলো না। এ সময়ে সাহায্য করার লোকের অভাব হয় না। বাড়ির মেয়েরাই সুই-সুতো নিয়ে এসে বড় মোড়লের হাতে দিল। বড় মোড়ল সুতোটা দিল রাধার হাতে। আর সুইটা রাখল নিজের কাছে। তারপর বলল–পরাও তো মা সুইতি সুতোড়া।

রাধা সুতোটা মুখের মধ্যে নিয়ে থুথু দিয়ে ভিজিয়ে সুচলো করে নিল। তারপর একটা চোখ ছোট করে অনেক যত্নে সুতোটা ধরে রাখা সুইয়ের ছিদ্রতে ঢোকানোর চেষ্টা করতে লাগল। যখন সে প্রায় সফল হতে যাচ্ছে, তখন মোড়ল একটা মোচড় দিয়ে সুইটা ঘুরিয়ে দিল।

কয়েকবার এরকম করার পর মোড়ল বলল–কী হোলো মা, সুতো তো পরাতি পারতেছো না?

কিরম করে পরাবো। তুমি তো জ্যাঠা বারবার মোচড় দিয়ে সুইডা ঘুরো নিতেচো। পরাতি তো দেচ্চো না।

ওই তো রে মা, তুমি যদি আসল সময় এরম এট্টু মোচড় দিতে, তালি কি জগা শত চিষ্টা করেও তোমারে কিছু করতি পারতো? কও, সগলের সামনে জোর গলায় কও, পারতো তোমারে নষ্ট করতি?

ক্রমশ তার গলা কঠিন হয়ে ওঠে। গুরুগম্ভীর হয়ে যায় পরিবেশ। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন বড় মণ্ডল। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। তারপর হঠাৎই সোজা হয়ে বসেন। গলাটা আরো কঠিন করে উচ্চগ্রামে বলেন–শাস্তি কি তালি জগা একা পাবি? তোমার কি মা কোনো দোষ নাই?

একটু থেমে ডাইনে-বায়ে তাকান বড় মন্ডল। তারপর দম নিয়ে বলেন–তুমারও যে ইচ্ছের কুমতি ছিল তা কিরম করে বুঝি। কোনোদিন নালিশ তো দ্যাও নাই আমাগের কাছে। জগা তুমারে জোর করিছে এমন পেরমান তো আমরা পাই নে। তালি ধরে নিতি হবি যে, যা করিচো দুইজনে মিলতাল করেই করিচো। কি কও তুমরা?

সবার দিকে বিজয়ের ভঙ্গিতে তাকান বড় মোড়ল। গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে সকলের মধ্যে।

এহন তোমরাই সাব্যস্ত করো, কী হওয়া উচিত। জগার শাস্তি তো হতিই হবি। কিন্তুক সমাজ ঠিক রাকতি গেলি, এট্টু হলিউ তো রাধার শাস্তি পাওনা হয়। না কি কও! তোমরা সগগোলে মিলে যা কবা, তাই হবি। একা আমি কোনোকিছু সাব্যস্ত করব না। তোমরাই কও, রায় তাহলি কী হবি?

রাধাও দোষী। রাধারও শাস্তি হতি হবি। সমস্বরে বলল সবাই।

বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল হাজারি। কথার মারপ্যাঁচে কীভাবে মোড়ল ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেল। তার কী করণীয় এখন! প্রতিবাদ করবে কি! কিন্তু লাভ হবে না কোন। যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তাতে রাধাকে বাঁচানোর উপায় আর নেই।

জগার চরিত্র খারাপ, এলাকার সবাই জানে। শুধু রাধাই জানত না, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু ন্যায়বিচার যে হলো না, সেটাও তো সত্য। সুক্ষ কথার মারপ্যাঁচে গরিব বলে রাধার উপর অবিচার করল মোড়ল। মাঝখান থেকে জগার শাস্তির কথা ভুলে গেল সবাই।

এ বিচারসভা যে পূর্ব পরিকল্পিত, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই হাজারির। মনোকষ্ট আরো বেড়ে গেল তাতে। গ্রামের মেয়েগুলো বড় অসহায়। বউ-ঝিদের উপর অনেক অত্যাচার হতে দেখে সে।

কিছু বলতে গেলেই শুনতে হয়–দুই পাতা ন্যাকাপড়া করেই সব বুঝে গিলি তো চলবি নে বাবা। সমাজের নিয়ম-কানুন বজায় রাখেই চলতি হবি আমাগের।

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল হাজারি। ভগবান যদি কোনোদিন সুযোগ দেয়, এই গ্রামে সত্য প্রতিষ্ঠা করবে সে। এলাকার নারী সমাজের পেছনে দাঁড়াবে। প্রতিবাদ করবে। তাদের উপরে অন্যায়-অবিচার হতে দেবে না কিছুতেই।

সবার অলক্ষ্যে জগার বাপের মুখে বাকা হাসি খেলে গেল। কাজ হয়েছে, কথা রেখেছে মোড়ল। এইডারে কয় ভিলেজ পুলিটিস। বড় মোড়লের চাতুর্যে মুগ্ধ হলো সে। এই না হলি মোড়ল! ছাওয়ালড়া তার ইবারও বাঁচে গেল। কিন্তু আর কতবার?

জগার বিয়ে দিয়ে দিতে হবে এই ফাল্‌গুনেই। আর শর্ত মতোন মোড়লের ছোট মিয়ার সম্বন্ধ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে দিতি হবি তার ভাগনের সাথে। হোক না মোড়লের মিয়ার গায়ের রঙ কালো। না হোক চেহারা সুবিদের। তাও বুনডারে কয়ে-বুলে রাজি করায়ে ফেলাতি হবি। কতায় কয়, টাকা কেলি কাঠের পুতুলও হাঁ করে। এ তো মানুষ। তার উপরে গরিব।

বিয়ের সব খরচ সে দেবে। সাথে লিখে দেবে ভাগনের নামে পাঁচ পাখি জমি। মোড়লের সাথে কথার দুই করা যাবি নে।

১২

কী খবর হিমাংশু, বাড়ি থেকে কবে এলে? ঢ্যাঙা নটবর জিজ্ঞেস করে। কলেজের খাতায় হাজারির নাম হিমাংশু। তবে হাজারি নামটিই তার পছন্দের।

এই নামের মধ্যে তার নিজস্বতা লুকিয়ে আছে।

এই তো কালকে আইচি। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে উত্তর দেয় হাজারি। তারপর জিজ্ঞেস করে-কিলাস কুন সুমায় শুরু হবি?

হবে রে ভাই হবে। ক্লাস তো শুরু হবেই। তার আগে চলো যাই এক ছিলিম তামাকু সেবন করে আসি।

না, ভাই। নেশাফেশা আমারে দিয়ে হবি নে।

কী যে বলো ভায়া, জীবনটা একেবারে নিরামিষ বানায়ে রাখলে?

নিরামিষ হবি ক্যান ভাই? তুমরা বড় মানুষ। তুমাগের ইসব মানায়। আমি গরিব চাষার ছাওয়াল। বিলির তে উঠে এই ফরিদপুরি আইচি। তামাকু অভ্যাস করার মোন পয়সা পাবো কনে? কোনোমতে লেখাপড়া শেষ করে এট্টা চাকরি বাকরির মদ্যি ঢুকতি পারলি বাঁচে যাই। তুমি ভাই যাও, তামাকু সারে ধীরে সুস্থে আসো। আমি কিলাসের দিক আগেই। হাজারি এগিয়ে যায়। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়েছে সে। আইএ প্রথম বর্ষ।

আজ মাত্র দুটো ক্লাস। ক্লাস শেষ করে হাজারি হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে এসে বসল। ছোট্ট কুমার নদী, এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে ফরিদপুর শহরের ভিতর দিয়ে। খানিকটা দূরেই বাঁশের সাঁকো। সাঁকোর উপর দিয়ে লোকজন আসা যাওয়া করছে।

কদম গাছটায় হেলান দিয়ে তাকাল সামনের দিকে। নদীর স্বচ্ছ জলে সামান্য ঢেউ খেলে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সূর্যটা হেলে পড়ছে ক্রমেই পশ্চিমে। পড়ন্ত বিকেলের আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে বিচিত্র সব রঙ। সেই রঙের প্রতিফলন কুমার নদীর জলে। হাজারি মুগ্ধ হয়ে সেই রঙের খেলা দেখে। পাল তুলে চলে যাওয়া নৌকা দেখে দেখে নদীর ওপারে বিস্তৃত সবুজ বনবীথি।

একটু একটু করে সূর্য আরো ঢলে পড়ে। বিচিত্র রঙও পরিবর্তন হতে হতে আরও বিচিত্রতর হয়। মনে হয়, যেন এ দৃশ্য বাস্তবের নয়, পরাবাস্তব কোনো কিছু। যেন কোনো স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করছে সে।

ভাবতে থাকে হাজারি। বিল সিংহনাথ মৌজার মধুপুরের বিল থেকে ফরিদপুর শহরে এসে পড়াশুনা করবে, কোনোদিন কী ভাবতে পেরেছিল সে? আজ সে জেলা শহরে নদীর পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখছে। কী অপূর্ব মনোমুগ্ধকর সেসব দৃশ্য! গ্রামে তার কোনো চিন্তা ছিল না, ভাবনা ছিল না। দু চোখ ভরা ছিল শুধু স্বপ্ন। বাস করত কল্পনার জগতে। ভাগ্য আজ তাকে সকলের থেকে আলাদা করে টেনে নিয়ে এসেছে ইট-কাঠের এই বাস্তব জীবনে।

রোদ কখন পুরোপুরি পড়ে গেছে। ছায়া নেমে এসেছে সারা প্রকৃতিজুড়ে। নিঝুম সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে হাজারির মনে হলো, একেই বলে বুঝি গোধুলি লগ্ন। এমন সময়েই ধুলা উড়িয়ে গরুর পাল নিয়ে ঘরে ফেরে রাখাল। নিজেও সে কতদিন এমনি গরু নিয়ে মাঠ থেকে বাড়ি ফিরেছে। তখন এই লগ্নের মাধুর্য ধরা পড়েনি চোখে। অবশ্য পড়ার কথাও নয়। খেলা ভঙ্গের কষ্ট থাকত তখন বুকের মধ্যে। বেলা থাকলে আর একটু বেশি সময় ধরে তারা দাড়িয়াবান্ধা, হা-ডু-ডু খেলতে পারত। প্রকৃতির রূপ-রস আস্বাদনের সময় তো তখন তাদের নয়!

শহরে এলেই না গ্রামের প্রকৃত রূপ হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। আহা কী মধুর ছিল সেই দিনগুলো! খোলা মাঠ, উন্মুক্ত প্রান্তর, সবুজ বনবীথি–গোটা গ্রাম তারা চষে বেড়াত। বটের ডালে দোল খেত, গাছে উঠে দেখত পাখির বাসায় ডিম ফুটে বাচ্চা হয়েছে কিনা। আখ ক্ষেতের মাঝখানে পরিষ্কার করে ওরা একটা জায়গা তৈরি করেছিল। সেখানে বসে সবার অগোচরে টোয়েন্টি নাইন খেলত বন্ধুরা মিলে। চুরি করে আখ খেত, খেজুরের রস খেত। কখনও বা দলবেঁধে মাছ মারতে যেত বিলের মধ্যে।

হাজারির বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আরও কত বছর তার সামনে। আইএ পাস করতে হবে, তারপর বিএ। দেখতে দেখতেই পার হয়ে যাবে চারটি বছর। তারপর সে ফিরে যাবে এই ইট, কাঠের নিষ্প্রাণ কঠিন শহর ছেড়ে সবুজ, শ্যামলিমায় ঢাকা মধুপুরে। তার নিজের গ্রামে।

১৩

জয় মা কালী…

নৃপেন, শৈলেন, কপিল, মাধবদের দল সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। তারপর হো হো করে বিদ্রুপের হাসি।

এরা কলেজে বখাটে ছাত্র হিসেবে পরিচিত। সেই টিটকারি অন্য ছাত্ররা রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করছে। সবকিছু উপেক্ষা করে একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকে থার্ড ইয়ারের ছাত্রী মূনায়ী।

মৃন্ময়ীর দাদা ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু কোনো অহংকার নেই তার। দারোয়ান, মালী, আয়াদের আপদে-বিপদে সাহায্য করে। তাদের খোঁজ খবর নেয়, কুশল জিজ্ঞেস করে।

দাদা রাগ করেন, তা সত্ত্বেও গাড়িতে করে নয়, পায়ে হেঁটে কলেজে আসা-যাওয়া করে।

কলেজের সবচেয়ে নামকরা ছাত্রী মৃন্ময়ী। কোকিল কালো তার গায়ের রঙ। সেই কালোর মধ্যে অপূর্ব এক উজ্জ্বলতা জ্বলজ্বল করে। গোলপানা মুখ, খাড়া নাক। সাধারণ মেয়েদের তুলনায় বেশ খানিকটা লম্বা। ঠিক মোটা তাকে বলা যায় না। আবার ছিপছিপেও নয়। ব্যক্তিত্বের ধার পূর্ণ অবয়বে।

তাকে সমীহ করে চলে সবাই। এমনকি শিক্ষকরাও। গায়ের রং নিয়ে পেছনে হাসাহাসি করে অনেকেই। কিন্তু সামনে কেউ কিছু বলার সাহস দেখায় না। শুধু এই বখাটেরাই মুখ লুকিয়ে মাঝে-মাঝে পেছন থেকে ‘জয় মা কালী বলে চিৎকার করে ওঠে। তারপর দৌড়ে পালায়। মৃন্ময়ী বিরক্ত হয়, কিন্তু কিছু বলে না। কেয়ার করে না এসব। টানটান গ্রীবায় সোজা হেঁটে চলে যায়, পেছন ফিরেও তাকায় না। নৃপেনদের দলের সদস্যদের সাহসটা এখানেই। সাহসটা দিন-দিন একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছিল। আর একবার “জয় মা কালী” বলে হাঁক দেবার প্রস্তুতির ফাঁকেই মৃন্ময়ী সিঁড়ি ভেঙে দোতলার একেবারে উপরের ধাপে উঠে গেল। এর মধ্যেই আবার সমস্বরে চিৎকার–জয় মা কালী। জ… য়…

ধ্বনির বাকিটুকু তাদের মুখেই রয়ে গেল। তার আগেই নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াল মৃন্ময়ী। সবাই থমকে চুপ মেরে গেল। কোনো কথা নেই কারো মুখে। নৈঃশব্দের স্তব্ধতা বিরাজ করতে থাকে সারা প্রাঙ্গণ জুড়ে। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ডান হাতটা আস্তে আস্তে উপরে তোলে মৃন্ময়ী। রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার চোখে-মুখে। মৃদু গম্ভীর কিন্তু সুললিত গলায় টেনেটেনে বললেন–সুখী হও বৎস্য,…

তারপর ঘুরে দোতলার বারান্দা ধরে কোনোদিকে না তাকিয়ে ধীরপায়ে চলে গেল মৃন্ময়ী। রয়ে গেল শুধু সেই তিনটি শব্দ

‘সুখী হও বৎস্য’। সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে কেঁপে কেঁপে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক সবাই। নির্বাক, নিশ্চুপ। নিস্তব্ধ নীরবতায় ঢেকে আছে চারিদিক।

যেন সত্যি সত্যি দেবী স্বর্গ থেকে নেমে এসে আশীর্বাদ করে আবার স্বর্গে ফিরে গেলেন।

ঘোর কেটে যায় একসময়। দর্শনের প্রফেসর হিরন্ময় সেন পুরো দৃশ্যটাই দেখেছেন। তিনি এগিয়ে গিয়ে নৃপেন-এর কান ধরলেন। অন্য ছাত্ররা তার সাগরেদদের আকে ফেলল। সবাইকে নিয়ে প্রফেসর চললেন প্রিন্সিপাল-এর অফিস কক্ষের দিকে। নির্ঘাৎ আজ রাসটিকেট জুটবে নৃপেন গংদের কপালে।

কিন্তু না! কিছুই হলো না নৃপেনদের। মৃন্ময়ী জানিয়ে দিল, নৃপেনদের বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই। বরং স্পষ্ট করে বলল–ওরা ভালো ছেলে। ওদেরকে আমি সন্তান জ্ঞানে সেহ করি। আমার সন্তানদের কোনো ক্ষতি হোক, আমি তা চাই না।

বড় আনন্দ হয়েছে হাজারির। মনে মনে হাসছে সে। কী জবাব, কী উপস্থাপনা! শিক্ষকরাও বিস্ময়ে হতবাক।

শুধু হিরন্ময় বাবু বললেন–সাধু সাধু। সত্যিই তুমি জগজ্জননী মা। বড় ভালো লাগল, মনটা ভরে গেল মা।

আর নৃপেন গংদের অবস্থা! পারলে মৃন্ময়ীর পা ধরে সত্যি সত্যি প্রণাম করে তারা। হাজারি ভাবে, প্রিন্সিপালের সামনে এমন বুক টান করে কোনো ছেলেও কখনও কথা বলার সাহস পাবে না।

আর মনটা! বিশাল, আকাশের মতো। মৃন্ময়ীর প্রতি শ্রদ্ধা তার শতগুণে বেড়ে গেল। মনে মনে ভাবে, সুযোগ হলে একদিন এই দিদির সাথে কথা বলতে হবে। ধন্যবাদ জানাতে হবে তাকে।

১৪

দেখতে দেখতে কার্তিক মাস এসে গেছে। হঠাৎই যেন কুম্ভকর্ণের নিদ্রা থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে গোটা নমশূদ্র এলাকার মানুষগুলো। আমন ধান কাটার ধুম পড়ে গেছে বিল সিংহনাথজুড়ে। সারা বর্ষা আর শরৎ কালে তারা আত্মীয় বাড়ি বেড়ানো, জাল বোনা, মাছ ধরা, বাঘবন্দি খেলা আর গালগপ্পের আসরে রাজা-উজির মেরে কাটিয়ে দিয়েছে। এখন তাদের দম ফেলার ফুরসত নাই।

নমশূদ্র গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দিনরাত এখন কাজে ব্যস্ত। ধান কাটা, উঠোনে মলন মলা, ঝাড়াই-মাড়াই করা, ধান শুকিয়ে ডোলে তোলা। বিশাল সে কর্মযজ্ঞ। অমানুষিক সে পরিশ্রম। দেখলে বিশ্বাস হয় না, যে মাত্র কয়েকদিন আগেই এরা বাঘবন্দি খেলে আর রাজা-উজির মেরে অলস দিন কাটাত। নতুন এই ধান বাজারে গেলে হাতে আসবে কাঁচা পয়সা। সে পয়সায় হবে আনন্দ, হবে ফুর্তি। হবে সারা বছরের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান।

সামনে কার্তিক পুজো। ধান কাটা আর কার্তিক পুজো উপলক্ষে হাজারি বাড়ি এসেছে। সে ডিগ্রি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। সবার সাথেই সারাটা দিন মাঠে ধান কাটে। মলন মলে রাতভর। গোটা কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে চলবে এই কর্মযজ্ঞ। পরাঙ্গী, শ্যামলিমা, লক্ষ্মীপ্রিয়া, লক্ষ্মীলতা, নাজির শাইল, লতা শাইল, শালকুড়ো, শিশুমতি, শিবজটা, কইজুরি, জাগোলি, বাঁশিরাজ, দেবমণি, দলকচু, দিঘা, হজ্জামুড়ি-আরো কত সব নয়া ধানে ঝকঝক করবে উঠোন। নতুন ধানের পিঠে-পায়েসের ঘ্রাণে মৌ মৌ করবে সারা গ্রাম। পাড়ায় পাড়ায় জমে উঠবে লাঠি খেলার আসর।

কার্তিক পূজা বিল সিংহনাথ এলাকার নমশূদ্রদের সবচেয়ে বড় উৎসব। সারা বছর ধরে তারা এই পূজার অপেক্ষায় থাকে। দূর্গাপূজা বা লক্ষ্মীপূজা এখানে তেমন জমে না। সারা হয় কোনোমতে নমঃ নমঃ করে। ধুমধাম হয় কার্তিক পূজায়। এই পূজার সময় মেয়েদের পরনে ওঠে নতুন কাপড়। বাচ্চারা পায় নতুন জামা-প্যান্ট। ছেলেরা কেনে ধুতি-গামছা। হাট থেকে ইলিশ কিনে হাতে ঝুলিয়ে ঘরে ফেরে তারা। সাথে থাকে শিঙে, খাজা, জিলাপি, দানাদার, বাতাসা আরো কত রকমের সব খাবার-দাবার।

কলেজের বন্ধুদের কাছে হাজারি শুনেছে, এমন ঘটা করে কার্তিক পূজা আর কোথাও নাকি হয় না। তাহলে শুধুমাত্র এই এলাকায় কেন? এ প্রশ্ন হাজারির মনে দীর্ঘদিনের। অনেকের কাছে জিজ্ঞাসা করেছে। কিন্তু কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর পায়নি। অনেক চিন্তাভাবনা করে নিজে নিজে একটা যুক্তি দাঁড় করিয়েছে এবং ঘষামাজা করে সে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে যে, এর মূলে আর্থিক কারণ।

বিল সিংহনাথের মানুষের ঘরে যখন ফসল ওঠে, হাতে যখন টাকা-পয়সা আসে তখন দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপুজা, কালীপূজা সব শেষ। সবার সামনে আনন্দ করার মতো অনুষ্ঠান থাকে শুধু একটাই-সেটা হলো কার্তিক পূজা। অনেক আগে তাদের কোনো পূর্বপুরুষ হয়তো কোনো এক বিশেষ পরিস্থিতিতে এই পুজা চালু করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজও মহা সমারোহে এই এলাকায় কার্তিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

আজ রাতে কার্তিক পূজা। সন্ধ্যা থেকেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আনন্দ করছে, বাজি পোড়াচ্ছে। ছুটোছুটি করছে পাড়াময়। ও পাড়ার রতন ভীষণ দুষ্টু। সে কুকুরের লেজে তারাবাজি বেঁধে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ছরছর শব্দে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ছে। কুকুরটা ছুটে বেড়াচ্ছে প্রাণভয়ে। তাই দেখে বাচ্চারা নিষ্ঠুর আনন্দে মেতে উঠেছে। রতনকে কষে একটা ধমক দিয়ে হাজারি বলল–পুজোর দিন তুই এরম একটা পাপ কাজ করতেছিস? কুকুর অবলা প্রাণী। তাগের সাথে এরম কেউ করে?

ঠাকুর আসবে সেই বামুন্দি থেকে। তিনি গ্রামের এক মাথা থেকে শুরু করবেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুজো সারবেন। তাই মেয়েরা শেষবারের মতো তদারকি করে দেখে নিচ্ছে, আয়োজনের আর কিছু বাকি রয়ে গেল কি না!

হাজারি ছেলেদের নিয়ে হ্যাঁজাক বাতি জ্বালানোর বিশাল আয়োজনে বসে গেল।

ধান কাটা শেষ। কার্তিক পুজো শেষ। হাজারির কাজও শেষ। ফিরে যেতে হবে ফরিদপুর। কিন্তু বন্ধুরা কিছুতেই তাকে যেতে দিচ্ছে না। দুদিন পরেই ভূত দাবড়াননা অনুষ্ঠান। ভূতকে গা ছাড়া না করে হাজারি যেতে পারবে না।

ক্লাস কামাই হলেও হাজারির মনের ইচ্ছে থেকে যাওয়া। বরাবর ভূত দাবড়ানো প্রতিযোগিতায় সে ফার্স্ট হয়। কার্তিক মাসের শেষ দিনে হবে এই অনুষ্ঠান।

একটু আগে ভুত দাবড়ানো হয়ে গেছে। দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাচ্ছে সবাই। সামনের এক বছর গ্রামের ত্রিসীমানায় আর ভূত আসবে না। এবারও ভূত দাবড়ানোর পাল্লায় যথারীতি ফার্স্ট হয়েছে হাজারি। তাকে ঘিরে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা সবার মুখে মুখে। এলাকার নমশুদ্রদের বিশ্বাস, ভূত তাড়ানোর সময় যত দ্রুত দৌড়ানো যাবে ভূতও ভয় পেয়ে তত বেশি দূরে পালিয়ে যাবে। সেজন্যেই এই প্রতিযোগিতা। সামনের এক বছর এর জন্যে হাজারি এই সম্মানে ভূষিত থাকবে।

পাটকাঠি দিয়ে তৈরি হয় ভূত। মোটামোটা চারটে কাঠি মাপমতো দড়ি দিয়ে বেঁধে বানানো হয় বর্গক্ষেত্রের মতো ভূতের শরীর। মাঝখান দিয়ে একটা বড় বাঁশের চটা লম্বালম্বিভাবে বেঁধে তার উপরে কাঁচা নরম কঞ্চি গোল করে বসানো হয় ভূতের মাথা। তার নিচে দুটো পাটকাঠি বেঁধে তৈরি হয় দুটো হাত। নিচের দিকে শরীরের ফ্রেমের সাথে আরো দুটো পাটকাঠি জুড়ে দিয়ে বানানো হয় দুই পা।

কচুপাতার মধ্যে খলসে, পুঁটি, টাকি, চাঁদা ইত্যাদি ছোটমাছ বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হয় ভূতের দুই হাতের সাথে। ভূতের মাথায় বাঁধা হয় কেরোসিন তেলে ভেজানো ন্যাকড়া। তারপর আওড়ানো হয় ভূত তাড়ানো মন্ত্রঃ

ইটের গুঁড়ো, খলসের গুঁড়ো,
ভূত দাবড়াই দক্ষিণ মুড়ো।
ভূত পেত্নি দূরে গেল,
রাম লক্ষণ কাছে আইলো।
মশা মাছি যাক দূর,
লক্ষ্মী আসে ঘর ভর ॥

সেই মন্ত্র সমস্বরে কোরাস গানের মতো গেয়ে প্রাণপণে ছোটে সবাই দলবেঁধে।

ভূত আগুনকে ভয় পায়। তাই ভূতের মাথায় বাঁধা ন্যাকড়ায় আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। ভূতকে দাবড়িয়ে গা ছাড়া করে, এলাকাছাড়া করে বাড়ি ফেরে ছেলের দল।

১৫

সকালের রোদে তখনও নরম আভা। শান্ত-সিগ্ধ পরিবেশ।

ঢাকের বাজনার শব্দে সারা গাঁ হঠাৎ সরগরম হয়ে উঠল। বাচ্চারা সেই শব্দ অনুসরণ করে দৌড়ে হাজির হলো পঞ্চা বুড়োর উঠোনে। গ্রামের লোকজনও এসে দাঁড়ায় ভিড় করে।

ভূতে ধরেছে পঞ্চার বৌটাকে। প্রৌঢ় পঞ্চার দ্বিতীয় পক্ষ এটা। তিন তিনটা বড় বড় ছেলেমেয়ে রেখে তার প্রথম পক্ষ মারা গেছে। বছর দুয়েক আগে পাশের গাঁ শিবপুর থেকে কাঁচা বয়সের একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে সে। কত বয়স হবে তার? বড়জোর চৌদ্দ, না হয় পনেরো।

এমন অসম বিয়ে এই অঞ্চলের নমশূদ্র সমাজে বিরল নয়। পঞ্চাকে বরং প্রশংসাই করেছে সবাই। কন্যাদায়গ্রস্ত এক গরিব পিতার মেয়েকে উদ্ধার করেছে সে। পুরুষ মানুষ হলো সোনার আংটি। সোনার আংটির আবার বাকা কী?

নমঃশূদ্র সমাজে তাই পুরুষ মানুষের বয়স নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিতান্তই আহাম্মকি। মেয়ে মানুষের আবার চাওয়া-পাওয়া কীসের! সিথেয় সিঁদুর উঠলেই জীবন তার ধন্য। স্বামী সেবাতেই পুণ্য, অক্ষয় স্বর্গলাভ।

নাথুরাম ওঝা এসেছে ঝাড়-ফুক করে ভূত ছাড়াতে। বিশাল তার আয়োজন। কলা গাছের খোলা কেটে তার মধ্যে নানারকম নৈবেদ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। নারকেল খোসা দিয়ে ধুপ ধুনো জ্বালানো হয়েছে। সেই ধোঁয়া সারা উঠোন জুড়ে ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে।

পঞ্চা বৌকে প্রায়ই মারধোর করে। কারণটা সে কাউকে বলে না। আসলে বলতে পারে না। বললে নিজের পরিবারের গায়ে থু থু পড়ে। তাই মনে মনে গজরায় সে। বন্ধুর ব্যাটা রাজেসকে যদি একবার বাগে পায়, তাহলে দেখে নেবে।

রাজেসকে সে সন্দেহ করে অনেক দিন ধরেই। শুধু সন্দেহ নয়। সে নিশ্চিত যে, তার বৌ-এর সাথে রাজেসের অবৈধ সম্পর্ক আছে। কিন্তু হাতেনাতে কোনোদিন ধরতে পারেনি। মনের মধ্যে পুষে রাখা রাগ তাই ঝাড়ে বৌ-এর উপরে। চুলের মুঠি ধরে তাকে ইচ্ছামতো পেটায়। খানকি মাগি, বেশ্যা মাগি বলে গালাগালি দেয়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে–তোরে আজ মারেই ফ্যালাব। দেহি কুন ভাতার আসে ঠ্যাহায় তোরে।

গ্রামের মানুষ সবকিছু দেখে, কিন্তু বৌটাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে না। তার বৌকে সে মারবে, শাসন করবে, যা ইচ্ছে তাই করবে। এতে কার কী বলার থাকতে পারে। কেউ দয়াপরবশ হয়ে কখনও যদি বলে–থাক, আর কত মারবা। মরে গেলি তো শ্যাষে জেলে যাওয়া লাগবে নে।

তাই যাব, দরকার হলি ফাঁসি যাব। তাও এর পেতিকার না করে মুখি অন্ন তোলব না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে পঞ্চা।

পঞ্চার বৌ করুণাকে বুদ্ধিটা দিয়েছিল ও পাড়ার মালা। গ্রাম সম্পর্কে করুণা মালার কাকিমা। মালার বিয়ে হয়েছে তিন গা পরে আকশুকনা গ্রামে। কিন্তু সমবয়সী হওয়ায় মুখে খুড়ি বলে ডাকলেও আলাপ-ব্যবহার তাদের বন্ধুর মতোই। মালা বলেছিল–খুড়ি, তুই পড়ে পড়ে মার খাস ক্যা? উল্টে দু-এক ঘা মারে দিতি পারিস নে?

ক্যাম্বা দেব। মিয়া মানুষ হয়ে জন্মাইচি। এমনিই টিকতি পারি নে। তারপর যুদি পুষ্যে মানসির গায় হাত উটোই, তালি সমাজ কি আর আমারে আস্ত রাকপেনে?

বুদ্দি এককান আছে, নিবি? তয় কামখান করতি কিন্তুক ম্যালা সাহস লাগবি। পারবি?

মালা সন্তর্পণে এদিক-ওদিক দেখে। তারপর জিজ্ঞাসুনেত্রে করুণার মুখের দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ রহস্যময় হাসি হাসতে থাকে।

পারব। ক তো দেহি, কী করতি হবি। এহন আমার বাঁচা-মরার প্রশ্ন। বাঁচার জন্যি সব করতি পারব আমি। দৃঢ়কণ্ঠে বলে করুণা।

শোন তালি, আমার শ্বশুরবাড়ির গিরামের জবার অবস্তা অইচিল তোর লাহান। বুড়ো ভাতার, রাত্তিরি কিচুই করতি পারে না, সে খেমতাই তার নাই। জবার তো ভরা যৈবন। তার চলবি ক্যাম্বা? ভাতার যেদিন বাড়ি না থাহে সেদিন সে তার ছোট দ্যাওর-এর সাথে যা করার করে নিতো। ভালোই চলতেছিল। ধরাও কোনোদিন পড়ে নাই। কিন্তুক সন্দেহ তো হবিই। আগুন জ্বলবি আর ধুমো উটপিনে তাই কি হয়? সন্দেহের বশে তাই জবার উপরে শুরু হলো অত্যাচার। জবা তহন কি করিছিল জানিস?

আমি জানবো ক্যাম্বা?

জবা তহন পাগলের ভং ধরিচিলো। বর কিছু কতি গিলিই সে রুহে উঠতো। মুক খিস্তি করে গাল দিতো, খামচায়ে দিতো। দরকার পড়লি ঝাটা হাতে দাবড় দিতো। দু-এক ঘা বসায়েও দিতো। পাগল হয়ে গেছে জবা। বেচাল কিচু করলিও দোষ নাই। বুড়ো বর আর কিছু কতি পারে না। উল্টে ভয়ে ভয়ে থাকে। জবারে মান্যি করে চলে। হিঃ হিঃ হিঃ…

হাসতে হাসতে মালা চোখ টেপে। বলে–একসুমায় সবকিছু ঠিক হয়ে গ্যালো। জবা এখন তিন ছাওয়ালের মা। তিনডেই দেওরের। বর কিছু কতি পারে না। মানষি জানে ফেলাবি যে, তার খ্যামতা নাই।

আবার হাসতে শুরু করে মালা। তয় মজার কতা কি জানিস? এহন বুড়ো খুশি। বাপ ডাক শুনতি পারতিচে। বংশ রক্ষা অইচে তার। ছাওয়ালপালের গায় তো আর বাপের নাম ল্যাহা নাই।

একটু দম নিয়ে মালা টেনেটেনে দার্শনিকের মতো বলে বুজলি খুড়ি, এই জগতে মিয়া মানষির চার পয়সার দামও নাই রে। বাচতি গিলি বুদ্ধি করেই চলতি হবি। এহন তুই চিন্তা করে দ্যাহেক, ভং ধরবি কি না। তয় যা করবি বুজেশুনে। বেচাল যিন কিছু না হয়। কামে একবার নামে পড়লি কিন্তুক ফিরার পত নাই আর।

আমি করব। ভাবা হয়ে গেছে আমার। শালার বুড়ো আমার গায় যতবার হাত দেচে, আমি তার সব এট্টা এট্টা করে ফেরত দেবো, পেতিােেদ আমি নিয়েই ছাড়বো।

তো এই হলো ব্যাপার। করুণা পঞ্চা বুড়োকে শায়েস্তা করেছে বেশ কায়দা করেই। সারা এলাকায় রটে গেছে, পঞ্চার বৌরে ভূতে ধরেছে। কিন্তু বিপদ দেখা দিল অন্যদিক থেকে। ভূত ছাড়ানোর জন্য নাথুরাম ওঝাকে আনার কথা হলো। এটা তো হিসাবের মধ্যে ছিল না। এখন কী করা!

করুণার একমাত্র ভরসা হলো মালা। কিন্তু মালা তো চলে গেছে শ্বশুরবাড়িতে। করুণা রাজেসকে পাঠাল মালার কাছে। সাথে গেল তার প্রিয় দেবর প্রকাশ। প্রকাশের বয়স তার কাছাকাছিই। মালার বুদ্ধিতেই রাজেস আর প্রকাশ গোপনে নাথুরাম ওঝার সাথে দেখা করে সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে। ভূত তাড়ানোর সময় করুণার গায়ে ঝাটার বাড়ি সে মারবে বটে, কিন্তু ব্যথা দিতে পারবে না। আর বলতে হবে, ভূতটা ভালো ভূত। এই ভূত কারো ক্ষতি করে না।

স্থির থাকতে পারছে না করুণা। নাথুরামকে টাকা-পয়সা ভালোই দেয়া হয়েছে। এখন কথা রাখলে হয়। নইলে, ভালো করেই জানে সে, ঝাটার বাড়ির চোটে পিঠের ছাল-চামড়া উঠে যাবে। গোবর গোলা খাওয়ানো হবে, তাতেও না হলে মানুষের মল তেঁতুল জলে গুলে জোর করে গিলিয়ে দেয়া হবে।

ঘরবার করছে প্রকাশ। মাঝখানে একবার সে নাথুরামের সামনে গিয়ে চোখের ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেছে, সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না। নাথুরাম তাকে পাত্তাই দেয়নি। তাই সেও চিন্তিত।

নাথুরাম-এর সাগরেদ সব আয়োজন সম্পন্ন করে বলল–শুরু করেন ওস্তাদ।

নাথু বিজ্ঞের মতো দেখে সবকিছু। তারপর ডাইনে-বায়ে, সামনে-পেছনে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে শুরু করে। আস্তে আস্তে মন্ত্রের জোর বাড়তে থাকে। অগ্নিহোমে ঘি ঢেলে দেয়, কখনও বা জোরে জোরে ধূপ ছুঁড়ে মারে ধুনুচির মধ্যে। ঢাকি নেচেনেচে ঢোল বাজিয়ে যাচ্ছে মন্ত্রের গতির সাথে তাল মিলিয়ে।

হঠাৎ দুই হাত উঁচু করে বলে নাথুরাম–থামো।

এর অর্থ মালিকের সাথে তার যোগাযোগ স্থাপন হয়ে গেছে। এরপর হুকুম আসতে শুরু করবে। নিজের মাথায় টোকা দিয়ে নাথুরাম বারবার বলতে থাকে–হুকুম করো মালিক, হুকুম করো। বিড়বিড় করে আরেক দফা মন্ত্র জপ শুরু করে। তাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৌতূহলী মানুষের দল। তাদের মুখে কোনো কথা নাই। বসে আছে শোনার অপেক্ষায়। মালিকের কাছ থেকে কি হুকুমনামা আসে নাথুরাম ওঝার কাছে।

কোনো চিন্তা নাই। একটু থে মে চোখ বুজেই বলে নাথুরাম। তারপর বিড়বিড় করতে করতে একসময় স্পষ্ট করে বলতে শুরু করে–ভালো। এই ভূতটা ভালো। ইডার নাম হলো গে রক্ষা ভূত। এই ভূত কারুর কোনো ক্ষেতি করে না। সে শুধু রক্ষা করে, কারুর উপর কোনো অবিচার হলি তারে ঠেকাতি আসে।

আবার মন্ত্র পড়তে শুরু করে ওঝা।

মনে হচ্ছে, মা জননীর পতি অবিচার হইছে। তারে রক্ষে করার জন্যি এই ভূতটা আসে তার ঘাড়ের পরে চাপিছে। বলে সে পঞ্চার দিকে কঠিন চোখে তাকায়। পঞ্চার মুখ শুকিয়ে যায়।

মা জননীর উপর তুমি অন্যায় করিচো, মনে হয়। নালি তো এই ভূত আসে না! তয় জানে রাখো, এই ভূত কিন্তুক পেতিশোদ নেয়। ঠিক করে কও, কী করিচো?

পঞ্চাকে কিছুই বলতে হলো না। উপস্থিত সকলে একবাক্যে সাক্ষ্য দিল। বৌটা ভালো। পঞ্চা অন্যায়ভাবে তাকে পেটায়।

ভগবান সেজন্য এই ভালো ভূতটারে পাঠায়ে দেছে। সবাই একসাথে ধ্বনি দ্যাও, কও-জয়, ভূত বাবাজির জয়। আমাগের রক্ষা করো বাবা।

উপস্থিত সবাই ধ্বনি দিতে লাগল। তারপর গড় হয়ে অদৃশ্য ভূত বাবার উদ্দেশ্যে প্রণাম করতে লাগল। নাথুরাম এবার বেশ জোরের সাথে মন্ত্র পড়তে শুরু করে। ঢাকের শব্দে সরগরম হয়ে ওঠে গোটা গ্রাম।

খবরদার! মা জননীর গায় কুনোদিন আর হাত তুলবি নে। তুলবি? ক, তাড়াতাড়ি ক। সগলের সামনে ক। মা কালীর কিরে কাটে ক। যদি না কোস, বাবার কৃপা যদি না পাস, তালি নিধ্বংশ হবি তুই।

সবাই চেপে ধরে পঞ্চাকে।

রক্ষে করো বাবা। রিহাই দ্যাও। আমি মহাপাতক। ভুল করিচি বাবা, আমারে মাপ করে দাও। আমি খালি খালি সন্দেহ করিচি। এই কানে ধরে কচ্চি, মা কালীর দিব্যি কাটে কচ্চি, বৌরে আর আমি শুদু শুদু সন্দেহ করবো না। যত্ন করে রাকপো। আর কোনো অনাদর করব না। ইবারের মতোন মাপ দ্যাও, বাবা।

হাত জোড় করে পঞ্চা বুড়ো উঠোনময় গড়াগড়ি খেতে লাগল।

নতুন উদ্যমে ঢোলে বাড়ি পড়ে। মহা উৎসাহে ঢুলি নেচে নেচে ঢোল বাজিয়ে যায়। শব্দ ক্রমশ বাড়তে থাকে।

ভালো ভূতের খবর ছড়িয়ে পড়ে মধুপুর পেরিয়ে আশপাশের গ্রামে গ্রামে। চাউর হয়ে যায় গোটা এলাকা।

ভূতটা ছেড়ে গেছে করুণাকে অনেকক্ষণ আগে। প্রমাণও রেখে গেছে। পালানের নিচে হিজল গাছের তরতাজা ডালটা ভেঙে রেখে গেছে। পড়ে থাকা সেই ডালের সাদা কষ মাটিতে গড়িয়ে পড়ে জমে যেতে শুরু করেছে।

হাজারি গত পরশু বাড়ি এসেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত সে। বিষয়টা কী! হিসাবটা যেন ঠিক মিলছে না।

ঘটনা যা-ই হোক, ভীষণ খুশি হয়েছে সে। দারুণ একটা শিক্ষা দেয়া গেল পঞ্চা বুড়োকে। শুধু পঞ্চাকেই বা কেন, পরোক্ষভাবে গোটা সমাজকেও।

কিন্তু বুদ্ধিটা কার? রহস্যটা বের করতে হবে। খুশিমনে আড়ার দিকে রওনা দেয় হাজারি।

১৬

এই ছেলে শোনো তো!

মহিলা কণ্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকাল হাজারি। দেখে মৃন্ময়ী দাঁড়িয়ে। কাকে ডাকছেন তিনি-বোঝার জন্যে সে এপাশে-ওপাশে তাকায়। কেউ তো নাই।

এদিক-ওদিক কী দেখছো? তোমাকেই ডাকছি আমি। নাম কী তোমার?

আজ্ঞে হিমাংশু।

কোন ইয়ারে পড়?

ডিগ্রি ফার্স্ট ইয়ারে দিদি। একটু জড়সড় হয়ে বলে সে।

তুমি কি এখন ব্যস্ত?

না, দিদি। ক্যান?

আমার সাথে একটু যেতে পারবে?

হ দিদি, পারব। বলেন, কনে যাতি হবি!

বর্তে যাওয়া গদগদ কণ্ঠে বলে হাজারি। এ যে মেঘ না চাইতেই জল। এই দিদির সাথে আলাপ করার কতদিনের সাধ তার। কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। আর আজ কিনা নিজেই তিনি ডাকছেন হাজারিকে! সত্যি, না স্বপ্ন! বিশ্বাস হতে চায় না ঠিক।

চলো, যেতে যেতে কথা বলি। মৃন্ময়ী হাঁটতে শুরু করে।

নাম তো হিমাংশু। বাড়ি কোথায়?

আজ্ঞে থানা বালিয়াকান্দি, গিরামের নাম মধুপুর। কালুখালি-ভাটিয়াপাড়া লাইন ধরে যাতি হয়। নলিয়াগ্রাম ইসটিশনে নামে হাঁটাপথে মাইল দুয়েক হবি। আর যদি সুজা চলে যাই, তালি ইখানের তে চব্বিশ মাইল পথ। আমি হাটেই আসা-যাওয়া করি দিদি।

বলো কী? এতটা পথ পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করো? ব্যাগ, বইপত্র এসব নিয়ে?

হ, খালি ব্যাগ ক্যান, বিছেন-পত্তর, চাল-ডালও বাড়ির তে মাথায় করে নিয়ে চলে আসি। আমরা হলাম গে দিদি গ্রামের ছাওয়াল। বোঝা বওয়ার অভ্যেস আমাগের ছোটবেলারতেই। এই এত্ত বড় বড় ধানের বস্তা, পাটের বোঝা মাথায় নিয়ে হাটে যাই। দুই হাত যতটা সম্ভব প্রসারিত করে দেখায় হাজারি।

তাই নাকি? তোমাদের গ্রামটা নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর! নদী আছে তোমাদের গ্রামে! সরষে খেত? পাখি ডাকে?

হ দিদি, ওসব তো আছেই। এছাড়াও আরো কত কিছু আছে। তয় নদীড়া আমাগের গিরামের তে মাইল তিনিক দুরি, নাম গড়াই নদী। নদীডার আরেট্টা নাম হলো গে মধুমতি। আমাগের বাড়ি বিলির মদ্যিখানে। বর্ষাকালে বিলি জল থৈ থৈ করে, পদ্ম ফোটে, শাপলা ফোটে। নৌকো ছাড়া কুনোদিক যাওয়া যায় না। কতরকমের পাখি আসে পড়ে বিলির মদ্যি। কাচিকাটা, শামুকভাঙা, পানকৌড়ি, ডাহুক, বক। কত পদের পাখি। শালিক, চড়ই, টিয়ে, দোয়েল এসব তো আছেই। যাবেন দিদি একবার আমাগের গিরামে?

উৎসাহের আতিশায্যে বলে ফেলে সে। মৃন্ময়ী কোনো জবাব দেয় না। তখনও সে ঘুরে বেড়াচ্ছে কল্পনার জগতে।

হাজারি আশাহত হয়। অজপাড়াগাঁয়ে তিনি যাবেন কোন দুঃখে! তাই তাড়াতাড়ি আবার বলে–না, ঠিক আছে দিদি। আমি এমনিই কয়ে ফেলাইচি। আপনি শহরের মানুষ, কত্ত বড় ঘরের মেয়ে। আমাগের অজপাড়াগায় আপনি যাবেন কুন দুঃখি? আমরা গিরামের গরিব মানুষ, আপনার উপযুক্ত সম্মানই বা করবো কিরম করে!

কী যে বলো, পাগল ছেলে। সুযোগ হলে নিশ্চয়ই যাব তোমাদের গ্রামে। গ্রাম আমার খুব ভালো লাগে। সবুজ গাছপালা, ছায়াঘেরা বাড়ি, পাখির ডাক, নদীর পাড়ে কাশবন, সরষে খেত, বিলে ফোঁটা পদ্ম, শাপলা–এসব ভীষণ টানে আমাকে।

তালি দিদি, চলেন একদিন। আপনারে ঘুরোয়ে ঘুরোয়ে সব দেখাব। যাবেন তো! উত্তেজিত হয়ে বলে হাজারি।

হাসে মৃন্ময়ী। বড় সিগ্ধ, বড় মধুর সে হাসি। সেই হাসিতে তার সারা মুখে অপার সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে। কালো মুখখানা তার অন্তরের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মুগ্ধ নয়নে সেদিকে তাকিয়ে থাকে হাজারি।

আপনি খুবই সুন্দর, দিদি। আপন মনেই হঠাৎ বলে ফেলে।

তাই নাকি? আমার এই কালো কুৎসিত মুখে সুন্দর কোথায় দেখলে তুমি!

কালোই হলো গে জগতের আলো। কালো যদি না হয় ভালো, কেশ পাকিলে কান্দো কেনে–তারাশঙ্কর কইচেন তার কবি’ উপন্যাসে।

বাঃ ভালো বলেছো তো! অনেক বই পড়ো তুমি মনে হচ্ছে।

দিদি, সিরম এট্টা না। এই বইডা হাতে পাইচিলাম, পড়ে ফেলাইচি। বড় ভালো লাগিছিল। বই কেনার এত পয়সা কনে পাবো?

বই কিনতে পয়সা লাগে, এটা সত্য। তবে পড়তে পয়সা লাগে না, লাগে শুধু ইচ্ছে। তোমার আগ্রহ থাকলে পাবলিক লাইব্রেরিতে চলে এসো। সদস্য বানিয়ে দেব। শুধু ক্লাসের বই পড়লেই জ্ঞান অর্জন হয় না। অনেক বই পড়তে হবে। জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হলে বেশি বেশি করে বই পড়তে হবে। সময় করে নিয়মিত লাইব্রেরিতে আসবে।

অবশ্যই আসবো দিদি। বড় আনন্দ পালাম আপনার সাথে কথা কয়ে। আমি পড়তি চাই, ম্যালা বই পড়তি চাই।

শুধু বই পড়লেই হবে না। কথাও বলতে হবে শুদ্ধ করে। বুঝতে পেরেছো?

পারিচি দিদি। লজ্জায় লাল হয়ে যায় হাজারি।

পারিচি নয়, পেরেছি। এখন থেকেই বই পড়া আর শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা অভ্যাস করবে। তোমরা তো নমশুদ্র তাই না?

হ দিদি।

আবার হ। হ্যাঁ বলবে। তা নমশূদ্রের জন্ম বৃত্তান্ত কিছু জানো? অনেক গৌরবের ইতিহাস সেটা।

হ্যাঁ দিদি। ছোটবেলায় শুনিচি। বলেই জিভ কাটে হাজারি। লজ্জা পেয়ে টেনে টেনে বলে–শু…নে…চি…।

না, লজ্জার কিছু নেই। এক দিনেই তো পারবে না। সময় লাগবে। তবে চেষ্টাটাই হলো আসল। তা কি শুনেছো নমশূদ্র জাতির অতীত সম্পর্কে?

জ্ঞানেন্দ্র মাস্টারমশাইয়ের কাছে যেটুকু শুনেছিল তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করে গেল হাজারি। দিদি এত মন দিয়ে শুনছে দেখে অবাক হয়ে যায় হাজারি। ভাবতে থাকে, দিদি নিশ্চয়ই উচ্চবর্ণের মানুষ। তবু এই সামান্য গল্পটা কত গুরুত্ব দিয়ে শুনছেন।

তবে, মাস্টারমশাই বলিছিলেন যে, ইডা শুনা কথা। সত্যি-মিথ্যে তিনি জানেন না। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় যোগ করল হাজারি।

গল্প হলেও অনেকাংশে সত্যি। যেমন নমস মুনির বংশধর তোমরা এটা শাস্ত্রে পাওয়া গেছে। তবে যে রাজার কথা বললে সেটা বল্লাল সেন। কিন্তু কাহিনিটা ঠিক মিলছে না। তাতে অসুবিধা কিছু নেই। তোমাদের গোত্র কি জানো?

জানি দিদি। কাশ্যপ গোত্র।

এই কাশ্যপ কে তা জানো?

বা দিদি।

মহামুনি কশ্যপ হলেন নমস মুনির বাবা। তার নামে তোমাদের গোত্রের নাম। তাতে বোঝা যায়, কশ্যপ এবং নমস মুনির বংশধর তোমরা তার মানে কী হলো বলো তো?

মানে হিন্দুধর্মে কর্মের ভিত্তিতে যে চার শ্রেণির মানুষ তার মধ্যে যে শূদ্রের কথা বলা হয়েছে, নমশূদ্ররা সেই শূদ্র না। এরা পিতৃসূত্রে ব্রাহ্মণ।

ঠিক বলেছো। তবে এতে গর্বিত হওয়ার কিছু নেই। সবসময় মনে রাখবে–সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। চলো ঐ গাছতলাটায় বসি। তারপর বলি শাস্ত্রে সামান্য যেটুকু তোমাদের সম্পর্কে পাওয়া যায় তার সার কাহিনি।

চমৎকৃত হাজারি দিদির পেছন পেছন নদীর পাড়ে গাছতলায় গিয়ে বসে। তিরতির করে ছোট ঢেউ বয়ে যাচ্ছে নদীর জলে। বড় একটা নৌকা যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ভেসে আসছে দাঁড়টানার ক্যাচক্যাচ শব্দ। তার ভিতরেই দিদি বলতে শুরু করলেন।

নম জাতি হলো এই বঙ্গের অন্যতম সংখ্যাগরিষ্ঠর জাতি। কিন্তু প্রচলিত শাস্ত্রাদির মধ্যে নম জাতির কথা খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক অনুসন্ধানের পরে ‘শক্তিসংগম তন্ত্র’ নামে একখানা অতি প্রাচীন সংস্কৃত তন্ত্র গ্রন্থের মধ্যে হর-গৌরীর কথোপকথনের মাধ্যমে নম জাতির উৎপত্তি এবং তাদের বংশ বিস্তারের বিবরণ কাহিনির মতো করে পাওয়া গেছে।

কী সেই কাহিনি!

নমস নামে একজন মুনি ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম সুলোচনা দেবী। তিনি ছিলেন পরমাসুন্দরী। সুলোচনা দেবী যখন সন্তানসম্ভবা, তখন নমস মুনি তপস্যার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করেন এবং চৌদ্দ বছরের মধ্যে আর গৃহে ফিরে আসেন না। সুলোচনা দেবী যথাসময়ে দুটি যমজ পুত্র সন্তান প্রসব করেন। পুত্রদের নাম রাখা হয় কীর্তিবান ও উরুবান। পুত্রদের বয়স ছয় মাস না হতেই সুলোচনা দেবী মারা যান।

তাহলে ওরা মানুষ হলো কীভাবে?

মাতৃহীন শিশু দুটো আপ্সার ও নৈধ্রুব নামক নমস মুনির দুই যজ্ঞসঙ্গীর তত্ত্ববধানে বড় হতে থাকে। তপস্যা শেষ করে চৌদ্দ বছরেরও বেশ কিছু পরে নমস মুনি একদিন ফিরে আসেন এবং সুদর্শন দুই পুত্রকে দেখে অত্যন্ত প্রীত হন। তিনি পুত্রদের উপনয়ন সংস্কারের উদ্যোগ নেন। সকলের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন। কিন্তু পুত্রদের বয়স চৌদ্দ বছর পার হয়ে যাওয়ায় কোনো ব্রাহ্মণ তাদের উপনয়ন করাতে সম্মত হন না। ফলে কীর্তিবান ও উরুবান তার পিতার সমাজে অপাঙক্তেয় হয়ে পড়েন। ছেলেদের উপনয়ন সংস্কারে ব্যর্থ হয়ে মনের দুঃখে নমস মুনি সন্তানদের সদগতি কামনায় তপস্যার উদ্দেশ্যে আবার গৃহত্যাগ করে চলে যান।

তারপর? বিস্মিত হাজারি জিজ্ঞেস করে।

দিনের পর দিন পার হয়ে যায়। পিতা ঘরে ফিরে আসেন না। তখন দুই ভাই কীর্তিবান ও উরুবান পিতার অন্বেষণে বের হয়ে পড়েন। ঘুরতে ঘুরতে তারা সীমন্ত নামক জনৈক শুদ্র রাজার রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হন। রাজা সীমন্তর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। অতি সুদর্শন এই যুবক দুটিকে দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং পরম আদরে নিজ পুরীতে নিয়ে যান। তারপর নিজের দুই অতি সুন্দরী কন্যা শিপিকাকে কীর্তিবানের সাথে এবং সপত্রিকাকে উরুবানের সাথে বিয়ে দেন। একসময় তারাই রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

তারপর?

তারপর আর কি? নমস্ মুনির পুত্রদের ঔরসে এবং শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভে যেসব সন্তান জন্মগ্রহণ করেন, তারাই নমস মুনির স্মরণে ও শূদ্রা মাতার কারণে কালের প্রবাহে ‘নমশূদ্র’ নামে খ্যাত হয়।

কিন্তু দিদি কিছু খটকা যে থাকে গেল। যেমন ধরেন, যে অর্থে আমাদের শাস্ত্রে শূদ্রকে বর্ণনা করা হয়েছে তাতে শূদ্রদের তো চাকরবাকর থাকার কথা। তাহলে শুদ্র হয়েও সীমন্ত রাজা হলেন কীভাবে? দ্বিতীয়ত কীর্তিবান ও উরুবান দুজনেই রাজা হলেন। রাজার সন্তানরা লেখাপড়া করবে, বিদ্যাশিক্ষা অর্জন করে বিদ্যান হবে। তাদের বংশধর হয়ে আমরা বিল, জলাভূমি, জঙ্গলে বাস করি কেন? অশিক্ষিত মূর্খই বা হয়ে গেলাম কেমন করে?

গুড। তোমার আগ্রহ আর যুক্তি খুবই ভালো লাগল। তবে আজ আর সময় নেই। পাবলিক লাইব্রেরিতে ‘শক্তিসঙ্গম তন্ত্র গ্রন্থটির একটি বাংলা অনুবাদ আছে। কীভাবে বইখানা পাওয়া গেল তারও বর্ণনা আছে বইটিতে। কাল বিকেলে এসো। বইটি ইস্যু করে তোমাকে পড়তে দেব। ভালোই হবে। নিজের বংশ পরিচয় আগে জানো। তারপর জানবে জগৎটাকে। আর যেটা পড়বে, সেটা যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবে। চলি কেমন!

দিদি চলে গেলেন। রেখে গেলেন হাজারির জন্য নতুন এক জীবনের পদচিহ্ন। শুদ্ধ করে কথা বলতে হবে, অনেক অনেক বই পড়তে হবে। বই পড়তে পড়তে একদিন নিশ্চয়ই সে নয়ী দিদির মতো জ্ঞানী হয়ে যাবে।

১৭

উত্তেজনায় হাজারির ঘুম আসে না। সারারাত ছটফট করে। কখন সকাল হবে, সকাল গড়িয়ে বিকেল হবে। দিদির সাথে লাইব্রেরিতে গিয়ে আগে সে সদস্য হবে। আর প্রথম যে বইটা তার নামে ইস্যু করাবে সেটা হলো ‘শক্তিসংগম তন্ত্র’। এতে বর্ণিত আছে তাদের বংশের ইতিবৃত্ত, আদি ইতিহাস।

নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হয় তার। নাহলে এমন একজন বিদুষী দিদির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ কি হত তার! হাজারির চোখ জলে ভরে আসে।

স্বপ্নের ঘোরে পুরোটা দিন কেটে যায় তার। দিদির সাথে লাইব্রেরিতে যায়। দিদির সুপারিশে লাইব্রেরির সদস্য হয় এবং অনেক খুঁজে গলদঘর্ম হয়ে ‘শক্তিসংগম তন্ত্র’-এর আংশিক বাংলা অনুবাদ সে বের করে ফেলে।

মেসে ফিরে বইখানা নিয়ে মুখ গুঁজে বসে সে। প্রথমে পড়তে শুরু করে, বইটি পাওয়া গেল কীভাবে তার ঘটনা। সেটিও নমশূদ্র সম্প্রদায়ের জন্য কম গৌরবের নয়। গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই। হাজারি পড়তে শুরু করে…

১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা সদর মহকুমা নিয়ে খুলনা জেলা গঠিত হয়। তার পূর্বে খুলনা ছিল যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি মহকুমা। তখন প্রেসিডেন্সী-১ বিভাগের কমিশনার ছিলেন একজন ইংরেজ। তিনি কলকাতায় অবস্থান করতেন। খুলনা জেলায় পরিণত হলে খুলনার অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ তথা উন্নয়নমূলক কাজ তত্ত্বাবধান করার জন্যে কমিশনার সাহেব মাঝে মাঝে খুলনা আসতেন। ঐ সময়ে খুলনা থেকে দৌলতপুর হয়ে সাতক্ষীরা পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। যেটি কলকাতার রাস্তার সাথে পরবর্তীতে যুক্ত হবে। এতে খুলনা-কলকাতার দূরত্ব অনেক কমে যাবে। যশোর ঘুরে আর কলকাতা যেতে হবে না।

রাস্তার জন্যে মাটি কাটার কাজও শুরু হলো। দৌলতপুরের নিকটবর্তী রংপুর নামক অঞ্চলটি ছিল নিচু, জলা ও জঙ্গলা। সেজন্যে রাস্তার কাজের অগ্রগতি এই অঞ্চলে এসে স্থবির হয়ে যায়। ঐ সময়ে শ্রী জীবন জোদ্দার নামে একজন ধনাঢ্য ও পরোপকারী ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিজ ব্যয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে মাটি কেটে নিচু এলাকা ভরাট করে সরকারের পরিকল্পিত রাস্তা ১৮৮৭ সালে নির্মাণ করে দেন। খুলনা-দৌলতপুর-সাতক্ষীরা রাস্তার ওই অংশটুকু আজও জীবন বাবুর রাস্তা নামেই পরিচিত। জীবন জোদ্দার ছিলেন নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ।

উদ্যোগী হয়ে নিজব্যয়ে সরকারি কাজ করে দেয়ায় কমিশনার মহোদয় জীবন বাবুকে ডেকে ধন্যবাদ জানান এবং ব্যয়িত অর্থ ফেরত নিতে তাকে অনুরোধ করেন। কিন্তু জীবন বাবু টাকা ফেরত নিতে রাজি হলেন না। এতে আরো খুশি হয়ে কমিশনার সাহেব খুলনার উন্নয়নমূলক কাজ তত্ত্বাবধানের জন্যে গঠিত ‘ডেভেলপমেন্ট কমিটি’-তে জীবন বাবুকে সদস্য হিসেবে মনোনয়ন প্রদান করেন। কমিটির পরবর্তী মিটিঙে জীবন বাবু অংশ নেন।

তখন ছিল বর্ণ হিন্দুদের আধিপত্যের যুগ। ডেভেলপমেন্ট কমিটির সকল সদস্যই ছিলেন ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য। নমশূদ্রদের তখন নিকৃষ্ট এবং চণ্ডাল মনে করা হত। তাই এ রকম সম্মানজনক কমিটির সদস্য পদে একজন নমশূদ্রের অন্তর্ভুক্তি এবং সমমর্যাদায় তাদের সাথে একই সারিতে চেয়ারে উপবেশন তাদের গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মিটিং শেষে কমিশনার সাহেব কলকাতায় চলে যান। আর খুলনার বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ-কায়স্থরা ক্ষুব্ধ হয়ে জীবন বাবুকে জব্দ করার ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকেন।

পরবর্তী সভায় জীবন বাবুর উপস্থিতিতে বর্ণহিন্দুরা কমিশনার সাহেবের নিকট একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে বলা হয়, জীবন জোদ্দার মহাশয় জাতিতে নমশূদ্র। তিনি ধর্মহীন, নিকৃষ্ট ও চণ্ডাল। তাদের কোনো অশুচি নেই, নাপিত-ধোপা নেই, পুরোহিত নেই, বিবাহ বা শ্রাদ্ধের কোনো নিয়ম নেই। তাদের নির্দিষ্ট কোনো পেশাও নেই। এমন জাতের লোকের সাথে সমশ্রেণিতে বসা যায় না। এতে আমাদের সম্মানের হানি হয়। শীঘ্রই এর প্রতিবিধান করা হোক।

এর প্রেক্ষিতে কমিশনার সাহেব জীবন বাবুর বক্তব্য জানতে চান। অভিযোগগুলোর উত্তর জীবন বাবুর জানা ছিল না। তাই তিনি ছয় মাস সময় চেয়ে নেন।

অপমানিত জীবন বাবু উপযুক্ত উত্তরের অন্বেষণে দেশের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের কাছে ঘুরতে থাকেন। ঐ সময়ে গোপালগঞ্জের অন্তর্গত রাউখামার গ্রামের শ্রী রামলোচন বিশ্বাসের মাতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে বিরাট স্বজাতি ভোজনের আয়োজন করা হয়। সেই সভায় যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর জেলার জ্ঞানী-গুণী ও বিশিষ্ট নমঃশূদ্রগণ একত্রে মিলিত হওয়ার সুযোগ পান। জীবন জোদ্দার সেখানে উপস্থিত হয়ে বিষয়টি সভায় তুলে ধরেন। এহেন অপমানজনক অভিযোগ সভাস্থ নমশূদ্রদের আত্মসম্মানে আঘাত হানে। এর প্রতিকারে প্রয়োজনীয় শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করে সদুত্তর প্রদানের উদ্দেশ্যে জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি সমন্বয়ে তারা একটি কমিটি গঠন করেন।

কমিটির সদস্যবৃন্দ নম জাতির শাস্ত্রীয় ইতিহাস অন্বেষণ শুরু করেন। চার পাঁচ মাস পার হয়ে যায়। কিন্তু প্রচলিত কোনো শাস্ত্রের মধ্যে তারা নমশূদ্রদের কোনো কথা খুঁজে পান না। অনন্যোপায় হয়ে তখন তারা গোপালগঞ্জ-এর ওড়াকান্দী গ্রামের মহামানব শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের (১৮৪৬-১৯৩৬) শরণাপন্ন হন। ঠাকুরের বয়স তখন ৪২ বছর।

প্রচলিত শাস্ত্রাদিতে নম জাতির কথা না থাকার কারণ কী?

এর উত্তর গুরুচাঁদ ঠাকুর জানতেন। তিনি জানতেন, কোথায় কোন গ্রন্থে এই তত্ত্ব লিখিত আছে। শাস্ত্রীয় পরিচয় জেনে নমশূদ্ররা তার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করুক এটা ছিল তার অন্তরের অভিলাষ। তিনি প্রচলিত শাস্ত্রাদিতে নম জাতির কথা লিখিত নাই কেন, কেন তাদের চণ্ডাল খেতাব হয়েছে, এতে রাজা বল্লাল সেনের ভূমিকা কী-ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে তাদেরকে জানান।

গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে তখন কমিটির সদস্যরা ফরিদপুরের অন্তর্গত মল্লিকপুর নিবাসী সংস্কৃতজ্ঞ সুপণ্ডিত শ্রী শ্যামাচরন তর্কালঙ্কারের নিকট যান। তিনি ‘শক্তিসংগম তন্ত্র’ নামক একখানা অতি পুরাতন সংস্কৃত তন্ত্রগ্রন্থ বের করে তাদের দেখান। গ্রন্থখানি ৬৪ অধ্যায়ে বিভক্ত। তারমধ্যে ‘প্রাণতোষী’ নামক অধ্যায়ে ‘হর-পার্বতী সংবাদ’-এ শিব (হর) ও পার্বতীর কথোপকথনের মাধ্যমে নম জাতির উৎপত্তি ও বংশ বিস্তারের বিবরণ আছে। গ্রন্থখানি এত পুরাতন ছিল যে, তার পাতাগুলি তখন পচে খসে পড়তে শুরু করেছে। পণ্ডিত শ্রী শ্যামাচরণ তর্কালঙ্কার অতি যত্বের সাথে ঐ পুরাতন গ্রন্থ থেকে সংশ্লিষ্ট অংশ বঙ্গানুবাদ করে তাদেরকে দেন। আনন্দচিত্তে তারা স্বজাতির উৎপত্তি-তত্ত্ব নিয়ে শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের নিকট অর্পণ করেন।

ছয় মাস পর কমিশনার মহোদয় উন্নয়ন কমিটির সভা ডাকেন। জীবন বাবু দেশের বিশিষ্ট নমশূদ্রদের সাথে নিয়ে সভায় উপস্থিত হন। সেদিন আরো অনেক কৌতূহলী মানুষ সভায় এসে ভিড় করেছিলেন। কমিশনার মহোদয়ের অনুমতি নিয়ে জীবন জোদ্দার এর পরিবর্তে খুলনার সাচিয়াদহ গ্রামের শ্রী উমাচরণ বিশ্বাস উপস্থিত সকলকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে অভিযোগের উত্তরে সেদিন বলেছিলেন :

‘‘আমরা নম জাতি মহামুনি নমস মুনির বংশধর। নমস মুনি ছিলেন ব্রহ্মজ্ঞাণী ব্রাহ্মণ। নমস মুনির সন্তানেরা শুদ্রকন্যা বিবাহ করে তাতে যে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন, নমস মুনির স্মরণে ও শূদ্রা মাতার কারণে তারা নমশূদ্র নামে খ্যাত হয়। শূদ্ৰাজাত হলেও পিতৃসূত্রে আমরা ব্রাহ্মণ। মহামুনি নমস-এর পিতা ছিলেন কশ্যপ মুনি। তাই আমাদের গোত্রের নাম কাশ্যপ গোত্র। ব্রাহ্মণের ঔরসে শুদ্ৰাজাত সম্প্রদায়ও শাস্ত্রমতে ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচিত। সেজন্যে শৌচ-অশৌচ, শ্রাদ্ধ-বিবাহ, পূজা-পার্বণ ইত্যাদি সর্বপ্রকার বৈদিক ক্রিয়াকর্মে আমাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ-আচার বিদ্যমান আছে। ১০ দিনে আমাদের অশৌচান্ত, এটা ব্রাহ্মণের রীতি। আমরা সামবেদী।

“নমশূদ্র জাতখ্যাত : সম্প্রদায় সামবেদাধিকারী।
দশদিশাবধ্য শৌচ্য পালনং পুরুষাণুক্রমেণ আচাৰ্যতে।
তীর্থে প্রবাসে গৃহবাসে চ শ্রাদ্ধাদি কার্য্যে।
তেন পান্ন পিণ্ডদানং বিধি দৃশ্যতে।” –(দোহাকোষ পঞ্জিকা)।

বৈদিক বিধি অনুযায়ী আমরা শ্রাদ্ধকাৰ্য সুসম্পন্ন করি এবং গয়াক্ষেত্রে অন্নের পিণ্ড দান করি। এগুলোও ব্রাহ্মণের রীতি। বিবাহে আমরা প্রজাপত্য রীতি অনুসরণ করি এবং কুশণ্ডিকা করি, এ-ও ব্রাহ্মণের রীতি।

পূর্বকালে আমাদের পূজা-পার্বণ আমরা নিজেরাই করতাম। বর্তমানে চক্রবর্তীরা এবং কিছু কিছু মুখোপাধ্যায়ও পুরোহিত হিসেবে আমাদের এসব কার্য সম্পাদন করে থাকেন। আমাদের ধোপা লাগে না, আমরা নিজেরাই আমাদের বস্ত্র পরিষ্কার করি। নিজেদের মধ্যে হতে আমরা নাপিত শ্রেণি সৃষ্টি করে নিয়েছি।

আমাদের প্রধান জীবিকা কৃষি। তবে বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় যাবতীয় কর্মে আমরা সমর্থক। চাকরিকে আমরা চাকরিগিরি মনে করি। কারণ ঐ কাজে অন্যের দাসত্ব স্বীকার করতে হয়।

আমরা চণ্ডাল নই। জন্ম বা কর্ম কোনো সূত্রেই চণ্ডাল নই। শূদ্র পিতার ঔরসে ব্রাহ্মণী মাতার গর্ভে যারা জন্মগ্রহণ করেন শাস্ত্রমতে তাদেরকে চণ্ডাল বলা হয়। নম জাতির জন্ম ঠিক তার বিপরীত। নম জাতির জন্ম ব্রাহ্মণ পিতার ঔরসে শূদ্র মাতার গর্ভে। চণ্ডালের জীবিকা রাজাদেশে বধ্য ব্যক্তির বধসাধন এবং শবদাহকরণ। আর নমদের জীবিকা কৃষিকর্ম, যা মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়রূপে সর্বজনস্বীকৃত।

বঙ্গের রাজা বল্লাল সেন নম জাতির উপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাদেরকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যে তাদের উপর চণ্ডাল অপবাদ আরোপ করেছিলেন এবং শাস্ত্রাদি হতে তাদের নাম তুলে দিয়ে শাস্ত্রাদির নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন। যার ফলে প্রচলিত গ্রন্থাদির মধ্যে নম জাতির কথা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। নম জাতিকে তাই আজও কেউ কেউ চণ্ডাল মনে করে থাকেন। কিন্তু এরূপ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এবং অজ্ঞতাপ্রসূত। “শক্তিসংগম তন্ত্র গ্রন্থে হর ও পার্বতীর কথপোকথনের মধ্যে দিয়ে নম জাতির উক্তরূপ উৎপত্তির কথা বর্ণিত আছে। ফরিদপুরের পণ্ডিত শ্রী শ্যামাচরণ তর্কালংকারের নিকট আমরা এই গ্রন্থ প্রাপ্ত হয়েছি এবং ঐ পণ্ডিতের দ্বারা আমরা ঐ গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ করিয়ে এনেছি। এই দেখুন সেই বঙ্গানুবাদ।”

এই কথা বলে শ্ৰী উমাচরণ বিশ্বাস পকেট হতে বঙ্গানুবাদ বের করে সভায়। তুলে ধরেন। এবং তা থেকে কিয়দংশ সকলকে পাঠ করে শোনান। শ্যামাচরণ তর্কালঙ্কার ছিলেন ঐ সময়ের বাংলার অন্যতম বিখ্যাত পণ্ডিত। তাই শ্যামাচরণ পণ্ডিতের ঐ বঙ্গানুবাদ দেখে তারা আর কোনো আপত্তি তোলার সুযোগ পাননি। জীবন বাবুর সম্মানও বজায় থাকে।

জীবন বাবুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহাত্মা শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের আশীর্বাদে এমনিভাবে নম জাতির শাস্ত্রীয় ইতিহাস উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

হাজারির মনের মধ্যে একধরনের আত্মপ্রসাদ গুনগুন করে ঘুরে বেড়ায়। উপযুক্ত জবাব দিয়ে জীবন বাবুর মান রক্ষা হয়েছে। আর গোটা নমশুদ্র সমাজের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। ভালোলাগার এই রেশ থাকতে থাকতেই হাজারি হর-পার্বতীর কথোপকথন অংশ পড়তে শুরু করল

পার্বতী – হে দেব, ঐ যে দুইজন কদাকার ব্যক্তি তোমার সংগে শ্মশানে-মশানে ঘুরিয়া বেড়ায় ও তোমার পরিচর্যা করে, উহারা কাহারা? ঐরূপ হীন ব্যক্তিদের তুমি এত প্রশ্রয় দাও কেন?

শিব – দেবী! উহারা হীন নহে। উহারা পরহিতব্রতে উৎসাহী দুইজন গৃহত্যাগী ব্রাহ্মণ, নাম আপ্সার ও নৈব। আমি উহাদের বড় ভালোবাসি। উহারা বহু ক্রেশ ও শ্রম স্বীকার করিয়া দুইটি ব্রাহ্মণ শিশুকে বাঁচাইয়া তুলিয়াছে।

পার্বতী – হে দেব! কোন্ ব্রাহ্মণ শিশুদ্বয়কে উহারা বাঁচাইয়া তুলিয়াছে?

শিব – মহামুনি কশ্যপ, যিনি ব্রহ্মা-নন্দন মরীচির পুত্র, তাহার ঔরসে প্রধা নামক স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন মুনিবর নমস্। বাল্যকাল হইতেই নমস্ ছিলেন ধ্যান-যোগাদিতে মগ্ন। আপ্সার ও নৈধ্রুব যাহাদের আমি আমার নিকট আশ্রয় দিয়াছি, তাহার ঐ কশ্যপ মুনির প্রিয় শিষ্য এবং মুনিবর নমস্-এর যজ্ঞসঙ্গী। কালক্রমে ব্রহ্মার মানস-পুত্র রুচির পরমাসুন্দরী নন্দিনী সুলোচনা সতাঁকে বিবাহ করিয়া মুনিবর নমস তাহার যজ্ঞসঙ্গী আপ্সার ও নৈধ্রুব সহযোগে পরম সুখে মথুরায় বসবাস করিতে থাকেন। কিন্তু সংসারের আকর্ষণ মুনিবর নমসকে বেশিদিন বাঁধিয়া রাখিতে পারে না। সুলোচনা সতী যখন ছয় মাসের সন্তানসম্ভবা, তখন যজ্ঞসঙ্গী আপ্সার ও নৈবর উপর সুলোচনার দেখাশুনার দায়িত্ব অর্পণ করিয়া নমস্ মুনি তপস্যার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগী হন এবং চতুর্দশ বৎসরের মধ্যে আর স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন না।

পার্বতী – তারপর কী হইল, দেব?

শিব – অতঃপর সুলোচনা সতী যথাকালে দুইটি যমজ পুত্র কীতিবান ও উরুবানকে প্রসব করিয়া মাত্র ছয় মাস পরে মৃত্যুবরণ করেন। তখন ঐ মাতৃহারা শিশুদ্বয়কে লইয়া আরা ও বৈ নিদারুণ দায়ে পড়ে এবং অতি যত্নে তাহাদের প্রতিপালন করিতে থাকে।

পার্বতী – অতি চমৎকার কথা। কিন্তু ঐরূপ দুগ্ধপোষ্য শিশুদের তাহারা কেমন করিয়া বাঁচাইয়া রাখিল, দেব?

শিব – সেই জন্যই তো দেবি, আর ও বৈ আমার নিকট এত প্রিয়। তাহারা অতি দরিদ্র, মুনিপুত্র প্রতিপালন করিবার মতো সঙ্গতি তাহাদের ছিল না। তাই কভু সর্প খেলা দেখাইয়া, কভু ভিক্ষাবৃত্তি করিয়া অর্জিত অর্থে বহু ক্লেশে তাহারা শিশুদ্বয়কে বাঁচাইয়া রাখে। এতদ্ভিন্ন তাহাদের নানা জ্ঞানে জ্ঞানবান করিয়া তোলে।

পার্বতী – কিন্তু দেব! কীর্তিবান ও উরুবানকে পরিত্যাগ করিয়া তাহারা তোমার কাছে আশ্রয় লইল কেন?

শিব – বিধির নির্বন্ধ, খণ্ডাইবে কে! তপস্যার তরে নমস্ মুনি সেই যে গৃহত্যাগী হন, চতুর্দশ বৎসরের মধ্যে আর তিনি প্রত্যাবর্তন করেন না। অতঃপর চতুর্দশ বৎসর অতিক্রান্ত হইয়া গেলে অকস্মাৎ কোনো একদিন মুনিবর স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া সুদর্শন সদাচারী পুত্রদ্বয়কে দেখিয়া অত্যন্ত প্রীত হন। পুত্রদ্বয়ের বয়স তখন কিঞ্চিদধিক চতুর্দশ বছর, অথচ তখনও তাহাদের উপনয়ন হয় নাই। নমস্ মুনি তখন পুত্রদের উপনয়ন সংস্কারের জন্যে ব্রাহ্মণের দ্বারস্থ হন। কিন্তু বয়ঃসীমা চতুর্দশ বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ায় কেহই উপনয়ন সংস্কারে স্বীকৃত হন না। পুত্রদের উপনয়ন সংস্কারে ব্যর্থ হইয়া মুনিবর নমস্ মনে অত্যন্ত দুঃখ পান এবং পুত্রদের সদ্গতি কামনায় নির্জন পর্বত-কন্দরে শ্রীহরির আরাধনায় নিমগ্ন থাকিতে পুনরায় গৃহত্যাগী হন। পিতৃদেবের এই অকস্মাৎ অন্তর্ধানে পুত্ররা অত্যন্ত বিচলিত হইয়া ওঠে এবং শীঘ্রই পিতৃদেবের প্রত্যাগমন না হওয়ায় পিতার সন্ধান অভিলাষে পুত্ররাও গৃহত্যাগী হয়। মথুরার শূন্য গৃহ তখন আপ্সার ও নৈবর নিকট দুঃসহ হইয়া ওঠে। মনের দুঃখ নিবারণের জন্য তখন তাহারা আমার নিকট আসিয়া আশ্রয় লয় এবং তদবধি তাহারা আমার নিকটেই আছে।

পার্বতী – কীর্তিবান ও উরুবান কোথায় গেল, দেব?

শিব – পিতার সন্ধান অভিলাষে গৃহত্যাগী হইয়া বহু জনপদ পরিভ্রমণ করিতে করিতে পরিশেষে শিলিগুড়ি অঞ্চলে গিয়া সীমন্ত নামক জনৈক শূদ্র রাজার রাজ্যে তাহারা উপনীত হয়। রাজা সীমন্ত এই সুদর্শন যুবকদ্বয়কে দেখিয়া অতি সমাদরে তাহাদের আশ্রয় দেন এবং আপন কন্যা পরমা সুন্দরী শিপিকা ও সপত্রিকাকে তাহাদের সহিত বিবাহ দেন।

পার্বতী – অত্যন্ত আনন্দের কথা, তাহার পর কী হইল?

শিব – জ্যেষ্ঠ্যপুত্র কীর্তিবানের স্ত্রী হয় জ্যেষ্ঠ্যাকন্যা শিপিকা এবং উরুবানের স্ত্রী হয় সপত্রিকা। সীমন্ত রাজার জামাতা হইয়া, রাজ্যের বিস্তৃত ভূখণ্ডের অধিকারপ্রাপ্ত হইয়া এবং সুপবিত্র কৃষিকাজকে জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করিয়া কীর্তিবান ও উরুবান অতি আনন্দে সেই রাজ্যে বসবাস করিতে থাকেন।

পার্বতী – তাহাদের সন্তানাদির নাম কী, দেব?

শিব – কীর্তিবানের তিন পুত্র: অভিরাম, নন্দরাম ও লালচাঁদ এবং দুই কন্যা: অমলা ও বিমলা। উরুবানের দুই পুত্র: ধনঞ্জয় ও বীরলাল এবং এক কন্যা: মালাবতী। কালক্রমে তাহাদের সন্তানেরা বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে অসমঞ্জের পুত্রকন্যাদের সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং ক্রমান্বয়ে তাহাদের বংশ বিস্তার লাভ করিতে থাকে।

পার্বতী – অসম কে, প্রভু?

শিব – অযোধ্যার সূর্য বংশের সুবিখ্যাত রাজা সাগরের জ্যেষ্ঠ্যপুত্র অসমঞ্জ। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ এবং ভগবদ ভক্ত। রাজপুত্র হওয়া সত্ত্বেও রাজকার্যের প্রতি কোনোরূপ আকর্ষণ তাহার ছিল না। ফলে রাজা সাগর তাহাকে রাজপুরী হইতে বহিষ্কার করিয়া দেন। পিতৃ-বিতাড়িত অসমঞ্জ সস্ত্রীক গৃহত্যাগী হইয়া ক্রমে সীমন্ত রাজার রাজ্যে গিয়া পুনরায় গৃহবাস শুরু করেন। তাহাদের গৃহে ক্রমে পাঁচ কন্যা ও তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করে। কন্যাদের নামঃ শ্যামা, রমা, বামা, চিত্রা ও রাসেশ্বরী। পুত্রদের নাম: বেত্র, পদ্ম ও বীরধ্বজ। পুত্র-কন্যাদের পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করাইবার পর কীর্তিবান, উরুবান ও অসমঞ্জ পরস্পরের সন্নিকটে অবস্থিতি করিয়া সানন্দে নিজ নিজ সংসার ধর্ম প্রতিপালন করিতে থাকেন।

পার্বতী – হে দেব! সন্তানদের সদ্গতি কামনায় নমস্ মুনি সেই যে তপস্যা করিতে বাহির হন, তাহার সেই তপস্যার সুফল কি হয়?

শিব – হ্যাঁ দেবী! নমসের আরাধনায় সুফল হয়। সন্তানদের শুভ কামনায় একাগ্র চিত্তে তিনি পরমব্রহ্মের যে একনিষ্ঠ আরাধনা করেন, তাহাতে তুষ্ট হইয়া পরমদেব নারায়ণ একদিন ভক্তর নমসের সামনে আবির্ভূত হন এবং ভক্তকে বর প্রার্থনা করিতে বলেন। ভক্ত নমস্ তখন তার নিকট একে একে তিনটি বর প্রার্থনা করেন।

পার্বর্তী – কী কী বর প্রার্থনা করেন?

শিব – নমসের প্রথম প্রার্থনা : আমার পুত্রদের বংশ যেন প্রকৃত ব্রাহ্মণ-সম হয়। দ্বিতীয় প্রার্থনাঃ আমার পুত্রদের বংশ যেন আমার নামেই খ্যাত হয়। তৃতীয় প্রার্থনা: আমার নাম যেন কালজয়ী হয়।

পার্বতী – নমসের প্রার্থনা কি পূর্ণ হয়, দেব?

শিব – হ্যাঁ দেবী! দেবোত্তম নারায়ণ বাঞ্ছাকল্পতরু। ব্রহ্মোপাসক নমসের সাধনায় প্রীত হইয়া তাহাকে আশীর্বাদ করিয়া তিনি কহিলেন-তথাস্তু। নারায়ণের প্রথম বরং তোমার সন্তানদের জন্যে তুমি অকারণ দুঃখ করিও না। উপনয়ন ব্রাহ্মণত্বের হেতু নয়। ব্রহ্মকে জানিয়া ব্রাহ্মণ হইতে হয়। তোমার বংশ প্রকৃত ব্রাহ্মণ-সম থাকিবে। সর্বপ্রকার বেদাচার ও ব্রাহ্মণাচারে তাহারা অধিকারী। সর্বপ্রকার হোম, যজ্ঞ, পূজার্চনা নিজেরাই করিতে পারিবে এবং এই বংশেই কালে অনেকেই প্রকৃত ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করিবে। দ্বিতীয় বর: তোমার বংশ তোমার নামেই খ্যাত হইবে। তোমার সন্তানেরা শূদ্রা বিবাহ করিয়াছে, তজ্জন্যে তোমার নমস্ নামে শূদ্র যুক্ত হইয়া এই বংশ নমঃশূদ্র নামে খ্যাত হইবে। তৃতীয় বর: তোমার নাম কালজয়ী হইবে। তোমার ভবিষ্যৎ বংশধরদের চরিত্র-মহিমা ও কীর্তি গৌরবে তোমার নামের মহিমা জগতে ক্রোমোজ্জল হইবে। এইরূপ তিনটি বরে নমসের মনস্কামনা পূর্ণ করিয়া নারায়ণ অন্তর্হিত হইলেন।

পার্বতী – হে দেব! সন্তানদের সাথে নমসের কি আর সাক্ষাৎ হয়?

শিব – হ্যাঁ দেবী! মুনিবর ধ্যানস্থ হইয়া সন্তানদের অবস্থান জানিতে পারেন এবং সীমন্ত রাজার রাজ্যে গিয়া তাহাদের সহিত মিলিত হন এবং সেখানে স্ত্রী-পুত্রসহ তাহাদের সুখে বসবাস করিতে দেখিয়া অত্যন্ত প্রীত হন।

পার্বতী – হে দেব! বর প্রাপ্তির সংবাদ তিনি কি তাহার সন্তানদের অবহিত করান?

শিব – হ্যাঁ দেবী! সেই কথা বলিবার জন্যই তো মুনিবর নমস্ তাহার সন্তানদের কাছে ছুটিয়া যান। মুনিবর সকলকে ডাকিয়া সস্নেহে আশীর্বাদ করিয়া বর প্রাপ্তির সকল কথা তাহাদের নিকট ব্যক্ত করেন। আরও বলেন যে, কেবল সংসার লইয়াই মত্ত থাকিও না। পাপ, দোষ, হীনতাদি বর্জন করিয়া উচ্চ আদর্শকে জীবনে গ্রহণ করিও। সংসার ধর্ম প্রতিপালনের মধ্য দিয়া সর্বদা ব্রহ্মের উপাসনা করিও। তবেই শান্তি লাভ করিবে।

পার্বতী – তাহার পর কী হইল, দেব?

শিব – জ্যেষ্ঠপুত্র কীতিবানের আলয়ে ছিল শেফালি ফুলের প্রাচুর্য আর কনিষ্ঠ পুত্র উরুবানের আবাসে ছিল ন্যাদির প্রাচুর্য। তাহা দেখিয়া নমস মুনি জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্রকে যথাক্রমে শেফালি ও ধানী আখ্যা প্রদান করেন।

পার্বতী – হে দেব! অসমঞ্জের বংশে এইরূপ কোনো খ্যাতি হয় কি?

শিব – হ্যাঁ দেবী, হয়। অসমঞ্জের মধ্যম পুত্র ‘পদ্মকান্তি’ ছিলেন যশস্বী ও খ্যাতিমান। এই পদ্মের বংশধরেরা পরে পোদ্দ বা পোদ খ্যাতিপ্রাপ্ত হয়। অসমঞ্জের জ্যেষ্ঠ পুত্র বেত্রধরের বংশধরেরা ‘বেত্র-ক্ষত্রিয়’ বা বেত্র-ক্ষত্র নামে খ্যাত হয়। বেত্ৰক্ষত্র ও পোদ জাতি একই বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয় জাতি, সূর্য বংশীয় রাজপুত্র অসমঞ্জের বংশধর।

 পার্বতী – হে দেব! জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি নমস্ মুনি কি তাহার সন্তানদের নিকটেই অতিবাহিত করেন?

শিব – না। মুনিবর নমস্ ছিলেন নির্জন সাধনায় অভ্যস্ত। সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশ্বস্ত হওয়ার পর জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি নির্জন পর্বত করে অবস্থিতি করিয়া ঈশ্বরোপসনায় অতিবাহিত করিবার অভিলাষে মুনিবর নমস্ একদিন পুত্র-প্রপৌত্রগণকে সস্নেহে আশীর্বাদ করিয়া হরিগুণগান কীর্তন করিতে করিতে পুনরায় বনে গমন করেন।

.

অন্য রকম এক আত্মপ্রসাদে হাজারির মন ভরে যায়। আর তার অস্থিরতা নেই। দু চোখ ভরে নেমে আসছে রাজ্যের ঘুম। তার পূর্বপুরুক্ষরা এত জ্ঞানী গুণী ছিলেন। ভালোলাগার রেশ ছড়িয়ে পড়ে হৃদয়ে, মনে।

ঠিক করে ফেলে, পুরো বইখানা পড়া হলে দিদির সাথে আলোচনায় বসবে। এ বিষয়ে আরো অনেক পড়াশুনা করবে। একে একে বিভিন্ন জাতির জন্ম ইতিহাস জানার চেষ্টা করবে সে।

১৮

রসিকলালের নাতনি হয়েছে।

সেই উপলক্ষে হরিলুটের আয়োজন। রসিকলের আর্থিক অবস্থা এত খারাপ নয় যে নাতনি জন্মানোর সুখবরটা শুধু হরিলুটের মাধ্যমে গ্রামবাসীকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে হবে। হরিলুট দিতে লাগে সামান্য কিছু বাতাসা, ধান-দূর্বা আর সিঁদুর। খরচ নাইই বলা চলে।

রসিকলের বড় আশা ছিল, নাতি হবে তার। কিন্তু হয়েছে নাতনি। এই নিয়ে পরপর তিনটা মেয়ে সন্তান প্রসব করল তার পুত্রবধূ। ছেলের জন্ম দিতে পারে না যে বৌ, তাকে ঘরে রাখার দরকারটা কি? অলক্ষ্মী বিদায় করাই ভালো। ছেলে কালাচাঁদকে ঠারেঠোরে বহুবার বলেছে রসিকলাল। কাজ হয় নি কোন।

ছেলে তার আস্ত গাধা একটা। বৌ-এর ভাঁড়। আঁচলের তলে বিড়ালের মতো মিউমিউ করে। চরম বিরক্তিতে একদলা থুথু ফেলে মাটিতে।

রসিকলাল তার ভবিষ্যৎ বংশধারা নিয়ে বড়ই চিন্তিত। আবারো নাতনি হওয়ায় রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে সে শুধু নিয়ম রক্ষার তাগিদে হরিলুট দিয়েছে। সামাজিকতা না মানলে আবার একঘরে হয়ে থাকতে হবে।

কামডা কি ভালো করলে কাহা? হুঁকো টানতে টানতে পরিতোষ বলল।

কী কাম? বিরক্ত কণ্ঠে উত্তর দেয় রসিকলাল।

এই যে শুধু হরিলুটের উপর দে নাতি জন্মানের কাজ সারে নিলে।

তয় কী করবো! দুই হাত উপরে তুলে আনন্দে ধেই ধেই করে নেত্য করব? তিন তিনটা মিয়া হোলো, একটা ছাওয়াল জন্মাতি পারে না! ও বৌ আর রাকপো না। ঘাড় ধরে বাড়ির তে বার করে দেব।

হাজারি বসে ছিল এক পাশে। সে হুঁকো খায় না। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের তামাক সেবন নিবারণ কমিটির সদস্য হয়েছে সম্প্রতি। তাই তামাকের গন্ধ থেকে নাক বাঁচানোর জন্য একটু দূরেই বসেছে। তার কানে খট করে কথাটা বিঁধল। থাকতে না পেরে বলল–সন্তান ছেলে হৰি না মেয়ে হবি, তা নির্ধারণ করেন স্বয়ং ভগবান। এতে কাকা তোমার যেরম কোনো হাত নাই, সেরম তুমার বৌমারও কোনো হাত নাই। তালি তুমি শুধু শুধু মন খারাপ করতেছো ক্যান?

হাজারি ঠিকই কইচে। শুদু শুদু বৌডার পর দোষ চাপাচ্ছো ক্যান? পরশ আগ বাড়িয়ে বলল।

সে হাজারির বিশেষ ভক্ত। হাজারির কথাবার্তা তার খুব ভালো লাগে। মনের মধ্যে তারও অনেক প্রশ্ন ঘোরাফেরা করে। কিন্তু গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারে না। অথচ হাজারি কী সুন্দর করে বলে ফেলে পরশের মনের কথাগুলো। এজন্যই তো লেখাপড়া জানা দরকার। সে নিজে পড়াশুনা করতে পারে নাই। কিন্তু তাতে কী? ঠিক করেছে, হাজারির সব কাজের সাথেই থাকবে সে।

থামেক তো তুই। আর জ্ঞান দুওয়া লাগবেন না। আমি মরতেচি নিজির জ্বালায়। আর তুই আইচিস কাটা ঘায়ে নুনির ছিটে দিতি।

না জ্যাঠা। কথা ঠিক কলে না। সন্তানের জন্মদাতা পিতা কিডা? না তোমার ছেলে। মেয়ে জন্মানো যদি দোষের হয়, তালি সে দোষ আগে ধরতি হৰি তোমার ছেলের। তারপর না তোমার বৌমার উপর গড়াবি। তালি বৌমারে বাড়ির তে বার করে দিবা কিসির জন্যি? আগে বার করে নিজের ছেলেকে। কিন্তু তা তো করবা না। নিজের ছেলে যে। মেয়ে পরের ঘরের, তাই যত চোটপাট তার সাথে–একদমে বলে ফেলে হাজারি।

এবার মোক্ষম কথাটা বলে ফেলল পরিতোষ-তুমার নিজির মিয়াও তো চার চারডে মিয়া বিয়োইছে। তার শ্বশুরও যদি তুমার মিয়াডারে ঘাড় ধরে বাড়ির তে বার করে দ্যায়, তহন কিরম লাগবে নে তুমার?

কথাটা সত্য এবং এতটাই সত্য যে রসিকোল তার কোনো উত্তর দিতে পারে না। মুখ গুঁজে সে বসে রইল বটে, কিন্তু রাগ তার বেড়ে যায় আরো। রাগের চোটে মুখের মধ্যে জমে থাকা বড় একদলা থুথু সে জোরের সাথে মাটিতে নিক্ষেপ করে।

এর মধ্যেই বেজে ওঠে খোল-করতাল। ধ্বনি দিতে লাগল সকলে মিলে–জয় জয়–হরিধ্বনি বোলো।

সুনাই খোলে বোল তুলল। নিখিল তুলল সুর। সেই সুর কেঁপে কেঁপে ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারিদিকে।

১৯

টিনের পুরনো বাক্স, তার উপরে সতরঞ্চি বাধা বিছানাপত্র মাথায় নিয়ে ফরিদপুর শহরের রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছে হাজারি। গন্তব্য তার বিল সিংহনাথের মধুপুর গ্রাম। পাক্কা চব্বিশ মাইল রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। তাই সকাল সকাল রওনা দিয়েছে, যাতে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি গিয়ে পৌঁছে যেতে পারে। ট্রেনে গেলে ফরিদপুর থেকে লোকালে পাঁচুরিয়া, সেখান থেকে খুলনা মেইলে কালুখালি জংশন, কালুখালি থেকে ভাটিয়াপাড়া লাইনে নলিয়াগ্রাম স্টেশন। তারপর হাঁটা পথ আরো মাইল দুয়েক।

বারবার ট্রেন বদল, স্টেশনে অপেক্ষা করা সব মিলিয়ে সেই সারাদিনই লেগে যায়। খরচ যেমন, ঝঞ্ঝাটও তেমনি। বিলের মানুষের কাছে হাঁটাই সবচেয়ে উত্তম উপায়। মাত্র তো চব্বিশ মাইল। ও তো সকাল সকাল রওনা দিলে বিকেল গড়ানোর আগেই চলে যাওয়া যায়।

হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছছে হাজারি। সব আশা-স্বপ্ন তার ধূলিসাৎ হয়ে গেল। বিএ পরীক্ষাটা আর তার দেয়া হলো না। বাড়ি থেকে বড়দা জানিয়ে দিয়েছে, বন্যায় বিলের ধান ডুবে গেছে। জমিদার পাঠক ঠাকুরও সুদে টাকা দিতে রাজি হয়নি। বলেছেনমশূদুরির ছাওয়ালের আবার এত ল্যাকাপড়া কিসির। অরে কি তোরা জজ-বারিস্টার বানাবি? তারচে বাড়ি আনে মাঠের কামে লাগায়ে দে। ফর্ম ফিলাপের টাকা তাই জোগাড় হয়নি। মেসের টাকাও শোধ করতে পারেনি। হুকুম এসেছে, বাড়ি চলে আস।

হাজারি তাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। তার এত কষ্ট, এত সাধনা সব বিফলে গেল।

হাঁটছে আর বারে বারে চোখ মুছছে হাজারি। ফরিদপুর শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে সে। হয়তো আসা হবে না আর কোনোদিনও। এই চেনা রাস্তাঘাট, দোকানপাট, লাইটপোস্ট, সাইনবোর্ড সব অচেনা হয়ে যাবে। তার বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করতে লাগল। এত বড় শহরে তার জন্য কোথাও কি এতটুকু জায়গা নেই? বিএ পাস করা হবে না তার? মনে পড়েছিল মৃন্ময়ী দিদির কথা। কিন্তু লজ্জায় এসব কথা দিদিকে বলতে পারেনি। থাক সে বাড়িই ফিরে যাবে। ভাগ্যে থাকলে সামনের বার পরীক্ষা দেবে।

হিমাংশু না?

মুখ তোলে হাজারি। যতি শংকর স্যার সামনে দাঁড়িয়ে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় সে।

কাঁদছো কেন? যাচ্ছোই বা কোথায়!

বাড়ি চলে যাচ্ছি স্যার। আমার আর পড়াশুনা করা হবে না। চোখ মুছতে মুছতে বলে হাজারি।

কেন! পড়াশুনা হবে না কেন?

বন্যায় স্যার আমাদের বিলের ধান তলায়ে গেছে। তাই বাড়ি থেকে বলে দেছে, আর টাকা পাঠাতি পারবে না।

সামনেই তোমার পরীক্ষা। বাড়ি চলে গেলে পরীক্ষা দেবে কীভাবে?

পরীক্ষা আর দিতি পারব না স্যার। বলেই হু হু করে কেঁদে ফেলে হাজারি।

কেঁদো না, কেঁদো না। দাঁড়াও, ভাবতে দাও। ভালো সমস্যায়ই তো পড়া গেল। কী করা যায়, কী করা যায়… নিজের মাথায় হাত বোলাতে থাকেন যতি শংকর বাবু।

ইউরেকা। পেয়েছি। উফুল্ল হয়ে বলেন যতি শংকর। কিন্তু পরক্ষণেই চুপসে যান।

ইতস্তত করে আস্তে আস্তে বলেন–উপায় তো একটা আছে। কিন্তু তুমি কি পারবে?

কিছুই বুঝতে না পেরে হাজারি স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

বুঝলে না? মাসিমার গঞ্জনা কি সইতে পারবে? এবারও কিছু বোঝে না সে।

আরে চলো, আমার বাড়িতেই চলো। থাকবে, বাচ্চাদের পড়াবে, গাইটার যত্ন-আত্তি করবে আর সংসারের টুকিটাকি কাজ করে তোমার মাসিমার মন জয় করবে। পারবে না?

হাজারির চোখে আনন্দের ঝিলিক বয়ে যায়। এটা তো স্বপ্নেও ভাবেনি। তাড়াতাড়ি বলল–পারব স্যার। আমি সব কাজই করতি পারি। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।

এত আনন্দিত হয়ো না, বাছা। তোমার মাসিমা বড় কঠিন জিনিস। তাকে সন্তুষ্ট করা এত সহজ না। কথায় কথায় তোমার গুষ্টি উদ্ধার করবে। কিন্তু সবকিছু সহ্য করে টিকে থাকতে হবে। অন্তত পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত। কী বলো, পারবে না?

পারব স্যার। পারতে আমাকে হবেই। মাসিমার মন জয় করার জন্যে যা করা দরকার, সবই করবো আমি স্যার।

তাহলে চলো। দেখি কপালে কী আছে। দুর্গা দুর্গা বলে রওনা দিই। এখন দরকার শুধু ফর্ম ফিল-আপের টাকাটা। আচ্ছা হবে, নিশ্চয়ই জোগাড় হয়ে যাবে একভাবে। চলো দেখি।

যতি শংকর বাবু ছাতা মাথায় আগে আগে চললেন। তার পেছনে চোখ মুছতে মুছতে হাজারি। পোড়া চোখ শুধু জলে ভরে আসে।

এই কান্না তার দুঃখের নয়, সুখের। চলতে চলতে ভাবে হাজারি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *