০১. শীতের সকাল

নমসপুত্র – সুধাংশু শেখর বিশ্বাস

প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৫

উৎসর্গ

নমশূদ্র সম্প্রদায়ের সেইসব মানুষকে
যারা অবিরত পূরণ করে যাচ্ছে–

জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাইন, ভৈরব ডাক্তার আর হাজারির লালিত স্বপ্ন।

দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা

‘নমসপুত্র’ আমার জীবনের প্রথম রচনা। উপন্যাসটি লিখেছিলাম অন্তরের তাগিদে। আমার দায়িত্ববোধ থেকে। লিখেছিলাম আমার নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-স্বপ্নের কথা তুলে ধরতে।

একদা অশিক্ষা আর কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু তাদের জীবনধারা ছিল অসাধারণ। ছিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বারো মাসজুড়ে তারা পালন করত নানা পার্বণ। গানে গানে কাটতো তাদের জীবন। সন্ধ্যায় তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলত। উলুধ্বনিতে মুখরিত হত গ্রাম। রাতে খোল-করতালের সাথে চলত কীর্তন, দেহতত্ত্ব, আধ্যাত্মিক গান।

ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে দু’চারজন স্কুলে যাওয়া শুরু করে। সুখকর ছিল না সেই যাত্রা। অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করে, অনেক উপেক্ষা, কষ্ট অতিক্রম করে আজ নমশূদ্ররা শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান গরিমায় উন্নতির শিখরে।

ব্রিটিশ আমলের শেষদিক থেকে পাকিস্তান আমলের শেষদিক পর্যন্ত বিস্তৃত নমশূদ্রদের আলোর পথে অভিযাত্রার সেই সময়কালকে ফ্রেমবন্দি করে ‘নমসপুত্র’ উপন্যাসে ধরে রাখতে চেষ্টা করেছি।

‘নমসপুত্র’ উপন্যাসটি বই আকারে প্রথম প্রকাশ হয় ২০১৪ সালে। সাড়া পড়ে পাঠকদের মধ্যে। কলকাতা বইমেলাতেও সমাদৃত হয় উপন্যাসটি সমানভাবে। অর্জন করে ‘অফিসার্স ক্লাব ২০১৫ সাহিত্য পদক’।

দেখতে দেখতে নিঃশেষ হয়ে গেছে ‘নমসপুত্র’ এর প্রথম সংস্করণের পাঁচ হাজার কপি। সে কারণেই ভাবছিলাম, এর পুনঃমুদ্রণ করা জরুরি।

‘নালন্দা’-এর স্বত্বাধিকারী রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট শুনেই দ্রুত পাণ্ডুলিপি দেবার জন্য আমাকে তাগিদ দেন। অবশেষে প্রকাশ হলো, ‘নমসপুত্র’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ। অশেষ কৃতজ্ঞতা আমার জুয়েলের কাছে।

দ্বিতীয় মুদ্রণের সুযোগে উপন্যাসটি আরো পরিমার্জন করা হলো। মুদ্রণজনিত ত্রুটি এবং ভুলগুলোও সংশোধন করা হলো। প্রচ্ছদটিও নতুন করে করা হলো।

আশা করছি এতে আরও সমৃদ্ধ হলো ‘নমসপুত্র’ উপন্যাসটি।

সুধাংশু শেখর বিশ্বাস

কৃতজ্ঞ যাদের কাছে

অসিত বিশ্বাসের ‘ছেঁড়াছুটো হাড়-মাংশের বেহুলা লক্ষিন্দর’ উপন্যাসটি আমাকে ‘নমসপুত্র’ রচনায় অনুপ্রাণিত করেছে। সেখান থেকে কিছু মন্ত্র, গান, উপমা, বর্ণনা এই উপন্যাসে ব্যবহার করা হয়েছে। অনুমতি দেবার জন্যে অসিত বিশ্বাসের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।

বাংলাদেশ নমঃশূদ্র কল্যাণ পরিষদ, সিলেট বিভাগীয় সম্মেলন ও নমঃশূদ্র কনভেনশন উপলক্ষে ২০১১ সালে প্রকাশিত “দীপ্ত চেতনা সংকলনটিতে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো থেকে নমঃশুদ্র জাতির আদি ইতিহাস সংবলিত তথ্যাবলি এই উপন্যাসে ব্যবহার করেছি। প্রবন্ধ লেখকগণ এবং সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

বিভিন্ন তথ্য, গ্রাম্য গান, ছড়া, মন্ত্র ইত্যাদি সংগ্রহে সহযোগিতা করেছেন ‘বিল সিংহনাথ’ এলাকার অনেক মানুষ। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন, গোয়ালন্দর অশোক বিশ্বাস ও অপূর্ব বিশ্বাস। গণপত্যা গ্রামের নিরোদ কুমার বিশ্বাস। মধুপুরের বিভূতিভূষণ বিশ্বাস, ভবেশচন্দ্র বিশ্বাস, ভবতোষ বিশ্বাস। গোপীনাথপুরের দ্বিজেন্দ্রনাথ সরকার। বনগ্রামের নিশিকান্ত বিশ্বাস, রামপ্রসাদ বিশ্বাস। ফরিদপুরের সেবানন্দ বিশ্বাস। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

‘নমসপুত্র’ উপন্যাসটি ফেব্রুয়ারি ২০১৩ মাসে সাহিত্য পত্রিকা ‘চালচিত্র’-এর ২০তম সংখ্যায় প্রকাশ হয়েছিল। বই আকারে বের হতে যাচ্ছে প্রকাশনা সংস্থা ‘শিল্পঘর’ থেকে। স্বনামধন্য পত্রিকায় নতুন একটি লেখা ছাপার সাহস দেখানো এবং বই আকারে ‘নমসপুত্র’ প্রকাশ করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবার জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা আমার চালচিত্র সম্পাদক এবং প্রকাশনা সংস্থা ‘শিল্পঘর’-এর স্বত্বাধিকারী রাজা সহিদুল আসলামের কাছে।

প্রসঙ্গ কথা

বাংলাদেশে হিন্দু সমাজের প্রায় আশি ভাগই নমশূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা এখন শিক্ষিত, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন উচ্চপদে কর্মরত, তাদের অধিকাংশই নমশূদ্র। সম্প্রদায়ের। আজ তারা ছড়িয়ে পড়েছে দেশে-বিদেশে।

কিন্তু ব্রিটিশ আমলে বা পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ এর বিপরীত। তখন নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে লেখাপড়ার কোনো বালাই ছিল না। অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর কুসংস্কারের গহিন অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল তারা।

সারাদেশেই নমশূদ্ররা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তবে ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ি, যশোর, খুলনা, নড়াইল, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, ঝিনাইদহ, বরিশাল, পিরোজপুর, বাগেরহাট, সিলেট ইত্যাদি জেলাগুলোর বিস্তীর্ণ বন-বাদার আর দুর্গম বিল এলাকাজুড়ে গ্রামের পর গ্রাম শুধুই নমশূদ্রদের বাস। এসব এলাকাতে একসময় মুসলমান তো দূরের কথা কোনো ব্রাহ্মণ, কায়স্থ বা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের হিন্দু বসতিও ছিল না। খুলনা এবং যশোর জেলা মিলে একটি এলাকায় এরকম ছিয়ানব্বইটি গ্রাম পরপর নমশূদ্র অধ্যুষিত। এজন্যে এলাকাটির নামই ছিয়ানব্বই খান। ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, মাগুরা, ঝিনাইদহ, রাজবাড়ি, নড়াইল, গোপালগঞ্জ এলাকায় আছে এরকমের কয়েকশ গ্রাম।

ফরিদপুর জেলার মধুখালী এবং রাজবাড়ি জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার পনেরো-ষোলটি গ্রাম নিয়ে বিল সিংহনাথ মৌজার অবস্থান। বিল সিংহনাথ মৌজার বিস্তীর্ণ এই এলাকার নমশূদ্রদের জীবনধারাকে আবর্তন করেই রচিত হয়েছে ‘নমসপুত্র’ উপন্যাসটি।

বিল সিংহনাথের নমশূদ্রদের মধ্যে তখন লেখাপড়ার চল ছিল না। কুসংস্কারের গহীন অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল তারা। সামান্য বিষয় নিয়ে স্বার্থপরতার চূড়ান্ত করে ফেলত। মারামারি করত, ঝগড়াঝাটি করত। আবার এরাই অন্যের বিপদে দলবেঁধে নিঃস্বার্থভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত। অভাব-অনটন ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু সে সব তাদেরকে খুব একটা স্পর্শ করত না। অফুরন্ত আমোদফুর্তির মধ্যেই কাটত তাদের দিন। তারা চাষ করত, ফসল ফলাত, জাল বুনত, বিলে মাছ ধরত। ভরা বর্ষায় নৌকা বাইত, গলায় তুলত ভাটিয়ালীর সুর। সন্ধ্যায় তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বলত, খোল করতালের সাথে রাতভর চলত কীর্তন, দেহতত্ত্ব, কবিগান, যাত্রাপালা। এতসব বৈপরীত্য নিয়েই তখন কাটত বিল সিংহনাথের নমশূদ্রদের জীবন।

সে সময়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে দু-একজন লেখাপড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। প্রত্যন্ত এই বিল থেকে হাজারি নামের একজন মানুষ তখন প্রাইমারি শেষ করে প্রতিদিন একা একা দশ মাইল হেঁটে হাইস্কুলে আসা যাওয়া করত। টিনের বাক্সে বই আর সতরঞ্জি মোড়ানো বিছানাপত্র মাথায় করে চব্বিশ মাইল পথ হেঁটে লজিং বাড়িতে উঠত। পড়ত ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে।

তারপর কত বছর, কত যুগ পার হয়ে গেছে। সাগরে গড়িয়ে গেছে কত জল। বিল সিংহনাথের অনেক ছেলেমেয়ে কালের পরিক্রমায় শিক্ষিত হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক হয়েছে। কিন্তু তাদের সামাজিক উন্নতি হয়নি তেমন। আজও বিল সিংহনাথের নমশূদ্ররা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, আছে স্বার্থের হানাহানি, আছে পরচর্চা, পরনিন্দা। এসব লেখককে তাড়িত করে, বিচলিত করে। সেই তাড়না থেকেই রচিত হয়েছে উপন্যাস ‘নমসপুত্র’। নমশূদ্র সম্প্রদায়ের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কাব্যগাথা।

এই উপন্যাসের মূল চরিত্র হাজারি। হাজারি নামের একজন মানুষ তখন সত্যি সত্যি মধুপুর গ্রামে ছিলেন। অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে, অনেক প্রতিকুলতা অতিক্রম করে তিনি বিএ পাস করেছিলেন। শিক্ষকতা করেছেন, সরকারি চাকরি করেছেন খাদ্য বিভাগে। তিনি চেষ্টা করেছিলেন এলাকার ছেলেমেয়েদেরকে শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত করতে, লড়েছিলেন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। সেগুলোর কিছু গল্প শুনে, কিছু অনুভব করে তার উপর কল্পনার রঙ চড়িয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে হাজারি চরিত্রটি।

ভৈরব ডাক্তার নামের বিস্ময়কর চরিত্রের এই মানুষটিও তখন গোয়ালন্দে ছিলেন। নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন মানবতার সেবায়। এলাকায় যখন মহামারী দেখা দিত, বসন্ত-কলেরায় উজাড় হয়ে যেত গ্রামের পর গ্রাম, ভৈরব ডাক্তারের ঘোড়া তখন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে বেড়াত। রাতের পর রাত জেগে আর্তের সেবা করতেন, শিয়রে বসে রোগীদের ওষুধ দিতেন। তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক। ভৈরব ডাক্তার ছিলেন এলাকার জীবন্ত এক কিংবদন্তি। তার সম্পর্কে নানা মহতি গল্প আজও মানুষের মুখে-মুখে ফেরে। এক জীবনে তিনি কপর্দকহীন অবস্থা থেকে সম্পদশালী হয়েছিলেন, উঠেছিলেন সমাজের শীর্ষে। আবার বেঁচে থাকতেই তিলতিল করে গড়ে তোলা সেই সাম্রাজ্য তার নিঃশেষ হয়ে যায়। বড় কষ্ট নিয়ে তিনি মারা যান। কিন্তু ভৈরব ডাক্তার বেঁচে আছেন বংশপরম্পরায় মানুষের অন্তরে। তাঁর সম্পর্কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা গল্প শুনে তার সাথে কল্পনা মিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে ভৈরব ডাক্তার চরিত্রটি। প্রধান এই দুটি চরিত্রকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে ‘নমসপুত্র’-এর কাহিনি।

কাহিনির সময়কাল ব্রিটিশ আমলের শেষভাগ হতে পাকিস্তান আমলের প্রায় শেষ পর্যন্ত।

‘নমসপুত্র’ একটি উপন্যাস। এটি জীবনী গ্রন্থ বা ইতিহাস নয়। উপন্যাসের চরিত্র, কাহিনি হয় কাল্পনিক। তাই কাহিনি বা ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের কোনো প্রয়োজন নেই।

সুধাংশু শেখর বিশ্বাস

শীতের সকাল। ঘাসের ডগায় আর ঝরে পড়া শুকনো পাতায় বিন্দু বিন্দু শিশির জমে আছে। বাইনদের বাড়ির পেছনে পুকুর চালায় গাছের ফাঁক গলে সূর্যের নরম রোদ এসে পড়েছে। সেই রোদে চিকচিক করছে শিশির বিন্দুগুলো। চাটাই পেতে এলোমেলো বসে আছে সাত-আঁজন পড়ুয়া ছেলেমেয়ে। দু একজনের গায়ে রংচটা চাদর আছে বটে। তবে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের গায়ে জড়ানো তাদের মায়ের পুরনো কাপড়। ভাঁজ করে পেঁচানো সেই কাপড়ের দুই প্রান্ত গলার কাছে গিটু দিয়ে বাঁধা। চাদরের চেয়েও বেশি ওম এই কাপড়ে। মায়ের হৃদয়ের উষ্ণতা এতে মিশে আছে বলেই হয়তো।

সামনে তাদের জীর্ণ ছেঁড়া দু-একখানা বই আর হাতের লেখার জন্য শুকিয়ে তৈরি করা তালপাতা। সাথে দোয়াতের মধ্যে হাঁড়ির তলার ভুষো গোলানো কালি আর বাঁশের কঞ্চি কেটে বানানো কলম। দোয়াতের মধ্যে ডুবিয়ে সেই কলম দিয়ে তালপাতার উপরে চলে পড়ুয়াদের লেখালেখি। লেখা মোছার জন্যে আছে ভেজা ত্যানা।

এটাই জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাইনের বিনি পয়সার পাঠশালা।

আশেপাশের দুই-চার-দশ গ্রামের মধ্যে শুধু এই মধুপুর গ্রামেই আছে পাঠশালা। তাও চলে কোনোমতে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে। এই পাঠশালার মা বাপও জ্ঞানেন্দ্রনাথ, মাস্টারমশাইও তিনি।

প্রাণপ্রণে সমস্বরে চিৎকার করছে ছাত্রছাত্রীরা। যেন প্রতিযোগিতা, কার গলায় কত জোর।

তিন অক্কে তি…ন, তিন দুগুণে ছ…য়, তিন তিরিক্কে ন…য়, তিন চারে বা…র….

মাস্টারমশাই তিন ঘরের নামতা পড়া দিয়ে বাড়ির ভিতরে গেছেন দুটো পান্তা অন্ন সেবা নেয়ার জন্যে। ফিরে এসে পড়া ধরবেন।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু উচ্চারণের কারণে তা শুদ্ধ হতে হতেও কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় খানিকটা। তিনি বলেন–আমি নিজিই যদি শুদু করে কথা বোলতি না পারি, তালি ছাত্ররা আমার কাছের তে শিকপি কিরম কোরে?

মাস্টারমশাই ভাতকে বলেন অন্ন, খাওয়া-দাওয়াকে বলেন সেবা নেয়া। এরকম আরো অনেক শক্ত শক্ত শব্দ ব্যবহার করেন তিনি। চারুপাঠ, বাল্যশিক্ষা, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের চটি বই পড়ে এসব শিখেছেন। তিনি কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়েছেন, পড়েছেন কাশীদাসী মহাভারত, শ্রীমদ্ভগবত গীতা। এসব বই লাল শালু কাপড়ে মুড়ে পরম যত্নে তার একমাত্র ভাঙা টিনের বাক্সে তুলে রাখেন। বইগুলো বের করে পড়ার সময় দু হাত উপরে তুলে ভক্তিভরে প্রণাম করেন মাস্টারমশাই।

কিন্তু তিনি নিজে কার কাছে লিখতে-পড়তে শিখেছিলেন তা কেউ জানে। সেটা রহস্যই, সবার কাছে। জিজ্ঞেস করলে মাস্টারমশাই বলেন না কিছুই, শুধু হাসেন। একটু চেপে ধরলে সময় নিয়ে টেনে টেনে বলেন–অধ্যবসায়… বুঝলি… কঠিন অধ্যবসায়… চিষ্টা থাকলি কি না হয়!

তারপর দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে আস্তে আস্তে বলেন–তয় শিকতি আর পারলাম কৈ… রে… সাগর বেলায় বালুকাবিন্দু কুড়োনো বৈ তো নয়। দেখি, দুই একজনরেও যদি এটু-আধটু লিখাপড়া শিকোয়ে যাতি পারি….

জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসে বসে ভাবেন। ব্রিটিশরা স্কুল বানিয়েছে, কলেজ বানিয়েছে। লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু অশিক্ষা আর অজ্ঞানতার গহিন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে নমশূদ্র সমাজ। বিশেষ করে এই বিল সিংহনাথ মৌজার নমশূদ্ররা। এজন্যে তার অন্তর কাঁদে। শিক্ষার সামান্য আলোও যদি জ্বেলে দিতে পারেন তিনি এদের মধ্যে! এই তার ছোট্ট চাওয়া। তিনি শুরু করলেন এই বিল সিংহনাথ এলাকায়; কেউ না কেউ নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে অন্য এলাকাগুলোতেও। এই বিশ্বাস তার বুকের মধ্যে অহরহ সাঁতার কাটে। তিনি স্বপ্ন দেখেন, নমশূদ্রদের ঘরে ঘরে বিএ পাস, এমএ পাস ছেলেমেয়ে। তারা বড় বড় চাকরি করছে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র হয়েছে। সবাই তাদের সাথে সমীহ করে কথা বলছে। সমাজে মাথা উঁচু করে চলাফেরা করছে নমশূদ্ররা।

জ্ঞানেন্দ্রনাথের আদর্শ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। শিক্ষার প্রসারে তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের কথা মনে হলেই ভক্তিতে গদগদ হয়ে পড়েন তিনি। চোখে জল চলে আসে। বাল্যশিক্ষা, চারুপাঠ, বর্ণমালা দ্বিতীয় ভাগ তার মুখস্থ। গড়গড় করে তিনি গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত বলে যেতে পারেন। তাই শুধু এ গায়ে নয়, গোটা এলাকার মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে।

সম্মান করে ডাকে ‘গ্যানা মাস্টের’। ‘গ্যানা’ শব্দটা যে সম্মানজনক নয়, এটাও তারা বোঝে না।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ রাগ করেন না। হাসেন আর ভাবেন–মূঢ় এরা, অবুঝ। তিনি জ্ঞানেন্দ্র, জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাইন। এদের মধ্যে জ্ঞানের আলো জ্বেলে দেবার ব্রতই তো নিয়েছেন তিনি। তার রাগ করলে চলবে কেন!

ঢেঁকিছাঁটা নতুন আউশের পান্তা সেবা সেরে মাস্টারমশাই এসে বসলেন মাঝখানের কাঠের চৌকিটার উপর। মোটা চালের লাল লাল এই ভাতটা তার অতি প্রিয়। কেমন মিষ্টি গন্ধ.. কী চমৎকার স্বাদ.. একেবারে মুখে লেগে থাকে। সাথে ছিল রাতের পোড়া খেসারি ডাল। ভরপেটই হয়ে গেছে তাই।

আয়েশের সাথে বড় একটা ঢেঁকুর তুললেন মাস্টারমশাই। হাতে একখানা পাকা বেতের লাঠি। সেটাকে এদিক-ওদিক দুলিয়ে নিলেন বার কয়েক।

ছাত্রদের পড়াশুনায় মন নেই। নিয়মিত পাঠশালায় আসে না তারা। নেহায়েত তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেন। তাই চক্ষুলজ্জার খাতিরে দু’চারজন তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠায় এখানে। পড়ায় আগ্রহ না থাকলেও সুর করে নামতাটা অবশ্য ছাত্ররা মনপ্রাণ ঢেলে আনন্দের সাথেই করে। তাই ওদেরকে নামতা পড়া দিয়ে তিনি সংসারের এটা-সেটা কাজের তদারকিতে চলে যান।

নেহায়েত দরিদ্র মানুষ জ্ঞানেন্দ্রনাথ। সহায়-সম্পত্তি তেমন কিছু নেই। আছে শুধু এই বসতভিটেটুকু। পালানে সামান্য একটু জায়গা। আর বিলে আছে পাখি তিনেক ধানি জমি। চারটি মেয়ে আর একটি ছেলে নিয়ে সংসার। বড় মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন অতি কষ্টে। ইচ্ছে ছিল উপযুক্ত পাত্রের হাতে তুলে দেবেন মেয়েটাকে। সে সাধ তার পূর্ণ হয়নি। সংসারে এতগুলো মুখ, আহার যোগাতেই হিমশিম অবস্থা। তার উপরে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ছাত্র পড়িয়ে সময় নষ্ট করা। এজন্যে বৌ-এর মুখঝামটা শুনতে হয় অনেক। কিন্তু ভেঙে পড়েন না জ্ঞানেন্দ্রনাথ। জরাজীর্ণ এই পাঠশালার সাথে মিশে আছে তার সারা জীবনের স্বপ্ন। একটা ছাত্রও যদি স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারে কোনোদিন…

কিন্তু না, নৈরাশ্যে ভরে ওঠে মন। নিরেট গর্দভ সব। কিছুই হবে না এদের দিয়ে।

বসে বসে ভাবেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ। নিষ্ফল হবে তার সকল চেষ্টা! একটা ছেলেই শুধু ব্যতিক্রম। সে হাজারি। হাজরা বলেই ডাকে সবাই।

হাজারির হাত ধরে বড়দা একদিন এই পাঠশালায় এনে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে কোনোদিন কামাই করেনি সে। ঠিক সময়ে পাঠশালায় এসে হাজির হয় ছোট্ট চাটাই আর বই-শ্লেট নিয়ে। আপনমনে পড়ে সে, শ্লেটে-তালপাতায় লেখালেখি করে। ভেজা ত্যানা দিয়ে যত্নের সাথে মোছে। আবার লেখে। বারবার লেখে।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। কল্পনায় দেখেন, এই ছেলে বড় হয়ে স্কুলে যাচ্ছে, কলেজে পড়ছে, কলকাতায় বড় চাকরি করছে। ছুটিতে বাড়ি এসে প্রণাম করে বলছে-মাস্টেরমশাই শুদুমাত্তর আপনার জন্যি আজ আমি এত্ত বড় হতি পারিচি…

জ্ঞানেন্দ্রনাথ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবেন-তোর জাগা আমার পায় না রে পাগল, তুই আমার বুকির মদ্যি আয়। আমার এতদিনের লালিত স্বপ্ন পূর্ণ করিচিস তুই।

‘গোপাল বড় ভালো ছেলে’ লেখো তো সবাই, পাঁচবার করে লেখো। বলে বাড়ির ভিতর গেলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ। ফিরে এসে তিনি লেখা জমা নিলেন। একমনে তখনও লিখে চলেছে হাজারি।

কি রে, কী লিখিস এত! এইটুক লিকতি কি এত সময় লাগে?

অবাক বিস্ময়ে মাস্টারমশাই তাকিয়ে থাকেন শ্লেটের দিকে। কার লেখা এ, কে লিখেছে!

তুই নিজি লিখিছিস? মনের অজান্তেই প্রশ্ন করে মাস্টারমশাই।

হ। ভুল অইছে মাস্টের মশাই? ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে জানতে চায় হাজারি।

না রে পাগল। এত সুন্দর হাতের লেখা তোর! কন তে শিকলি? কিডা শিকাইছে তোরে?

কেউ শিকায় নাই মাস্টেরমশাই। আমি নিজি নিজিই লিকিছি।

হবি রে হাজারি, তোর হবি। আমি আশীর্বাদ করি, তুই আমাগের নমশূদ্দুর সমাজের মুখ উজ্জ্বল করবি।

বড় আনন্দ হলো জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাইনের। মনটা ভরে উঠল আত্মপ্রসাদে।

এই অঞ্চল পুরোপুরি নমশূদ্র অধ্যষিত। মধুপুর গ্রামের আশেপাশে শিবপুর, গোপিনাথপুর, নরকোনা, বনগ্রাম, পারুলিয়া, ঢোলজানি, বামুন্দি, মেগচামী। আর একটু দূরে গেলে আকশুকনা, ঘুরঘুরিয়া, জঙ্গল, সমাধিনগর, তারাপুর, ঝাননগর ইত্যাদি একের পর এক নমশূদ্র গ্রাম। ফরিদপুর ছাড়িয়ে কুষ্টিয়া, যশোর জেলা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। এই সব গ্রাম শত হাসি-কান্না, মান-অভিমান, ক্ষোভ-ক্রোধের মাঝেও মুখরিত থাকে বারো মাসে তেরো পার্বণের উৎসবে। এ অঞ্চল ফলে-ফসলে, বৃক্ষ-কাননে বিন্যস্ত খোঁপার মতো সুশোভিত। উঠোনের পাশ ঘেঁষে গ্রীবাটান উটের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ধান, খড় আর চৈতালির পালা। গ্রামের পাশ ঘেঁষে মাঠ। যত দূরে চোখ যায় মাঠ আর মাঠ। বর্ষাকালে এই মাঠই হয়ে যায় সমুদ্রের মতো বিস্তৃত বিশাল বিল। থৈ থৈ করে অথৈ জলরাশি।

এর নাম বিল সিংহনাথ। শুধু বিলের নামই নয়, মৌজার নামও বিল সিংহনাথ।

বিল সিংহনাথ নামটি কখন, কীভাবে হয়েছে তার কোনো হদিস পাওয়া যায় না। নামের সে ইতিহাস অবশ্য জানা বা না-জানা নিয়ে এলাকার নমশূদ্রদের কোনো মাথাব্যথাও নেই।

এই বিলে পদ্মফুল হেসে হেসে দোল খায়। বাতাসের তালে তালে নেচে বেড়ায় শাপলা। সারা বিলজুড়ে সবুজ ধানের সমারোহ। উপরে ডাঙ্গার দিকে হয় পাট, আখ। শীতকালে তরি-তরকারি। আর নামার দিকে শুধুই ধান। আমন আর আউশ। বর্ষার সাথে সাথে বিলে জল আসতে শুরু করে। নতুন জলে খলবল করে ছুটে বেড়ায় চ্যালা, পুঁটি, ট্যাংরা, রয়না, খয়রা, টাকি, সরপুঁটি আরও কত রকমের ছোট মাছ। জলের আর একটু গভীরে দাপাদাপি করে বেড়ায় শোল, গজার, নওলা, কাতল, মৃগেল, বোয়াল।

এরকম সময়েই কাটা হয়ে যায় আউশ ধান। থেকে যায় আমন। একটু একটু করে বাড়তে থাকে বিলের জল। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠে আমন ধানের গাছ। যেন জলের উপরে নাক উঁচু করে গাছগুলো সাঁতার কেটে চলে অবিরত। এক একটা ধানগাছ পনেরো-বিশ হাত পর্যন্ত লম্বা। ভালোয় ভালোয় এই ধান ঘরে তুলতে পারলে এলাকার নমশূদ্রদের মুখে হাসি ধরে না।

কিন্তু জীবন তাদের পুরোপুরি প্রকৃতিনির্ভর। বন্যা-খরা এই বিলের মানুষের নিত্যসঙ্গী। রাতের মধ্যেই বানের জল ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবকিছু। ডুবে যায় ঘরবাড়ি। ডুবে যায় ফসল। শেষ হয়ে যায় এলাকার মানুষের সংবৎসরের আহারের সংস্থান। বানভাসি মানুষগুলোর কপালে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। অনাহার-অর্ধাহারে কাটে তাদের দিন। আবার কোনো বছর খরার প্রচণ্ড দাবদাহে চৈতালি ফসলও পুড়ে খাক হয়ে যায়। পেট বাঁচানোর তাগিদে তখন ছুটতে হয় পাঠকদের বাড়িতে অথবা অন্য কোন মহাজনের কাছে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে।

এই এলাকার জমিদার সনাতন পাঠক। জমিদার বাড়ি মধুপুর থেকে মাইল দেড়েক দূরে ডাঙ্গার উপরে মেগচামি গ্রামে। এই গ্রামে বাস করে মূলত ব্রাহ্মণ, কায়স্থরা। আর আছে কয়েক ঘর মুসলমান। পাঠকদের বিশাল বাগান, দিঘি আর পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। অত্যাচারী জমিদার বলতে যা বোঝায় প্রকৃতপক্ষে পাঠকরা তা নয়। তবে নমশূদ্রদের প্রতি আছে তাদের অপরিসীম ঘৃণা। আশেপাশের মুসলমানদের সাথে তবু ওঠাবসা চলে, কিন্তু নমশূদ্রের ছায়া মাড়ানোও পাপ।

সনাতন পাঠক সকলের সামনে নির্দ্বিধায় বলেন–নমশূদ্ররা হলো কুকুরের জাত। শাস্ত্রে আছে শূদ্র আর নারী সারমেয়সম। শূদ্রের জন্ম ব্রাহ্মণের পদসেবার নিমিত্ত।

জমিদারের কাছে গেলে সারাদিনের জন্য ফেঁসে যেতে হয়। তার লোকজনের অভাব নেই। তবুও নমশূদ্রদের কেউ এলে পাঠকরা বিনা পয়সায় তাদেরকে খাটায়। সারাদিন কাজ করিয়ে নেয়। সন্ধ্যায় পাওয়া যায় চড়া সুদে কর্জের টাকা।

পুকুর থেকে মাছ ধরা, কাঠ ফাড়া, গাছ থেকে নারকেল-সুপারি পেড়ে দেয়া-শতেক রকমের কাজ। এটা জমিদার বাবুর একধরনের খেলা। বলা যায়, বিকৃত আনন্দ। তিনি বলেন–সারাদিন খাটাতি হবি ওগের। পদে পদে বুঝেয়ে দিতি হবি যে, ওরা জাতে নমশূদ্র। আহ্লাদ দিলিই মাথায় চড়ে বসপি।

হালটের পাশে বিশাল বটগাছের নুয়ে পড়া ডালের উপরে পা ছড়িয়ে বসে আছে হাজারি। সাথে শিবপুরের মহাদেব আর গোপিনাথপুরের নকুল। পাশের কালিপদর ভিটেয় দেবদারু গাছের মাথায় পাখির বাসাটা এইমাত্র পরীক্ষা করে এসেছে। গতকাল পর্যন্ত বাসায় ছিল চারটা ডিম। আজ সেখানে তিনটে নরম তুলতুলে বাচ্চা। একটা ডিম মনে হয় নষ্ট হয়ে গেছে। বাচ্চা ফুটতে দেখে বড়ই আনন্দ হয়েছে নকুলের মনে। সেই আনন্দ স্পর্শ করেছে হাজারি আর মহাদেবকেও।

বাচ্চাগুলার গার রং কিরম রে?

হালকা হলদে মতোন। তয় এহনই তো আসল রঙ বোঝা যাবি নে। সুমায় লাগবি।

কতদিন লাগবি রে!

এই ধর কুড়ি দিন, নালি এক মাস।

ধূর, এতদিন লাগবি ক্যা? লাগবি, লাগবি।

অনেক অইচে। পাখির বাচ্চা নিয়ে বসে থাকলিই চলবি! ইসকুলি যাওয়া লাগবি নে? তাড়াতাড়ি চলেক। বাড়ির পড়া সব করিছিস? জানতে চায় হাজারি।

রাহে দে তোর লেহাপড়া। ভবানী স্যান্যাল রে আজ স্যান্ডেল বানায়ে ছাড়ে দিবানে। নকুল বলে।

মাস্টেরমশাইগের নিয়ে এরম তামাশা করতি নাই। পাপ হোবে নে। সাবধান করে হাজারি।

পাপ হলি আমার হৰি। তোর কী অইচে তাতে?

আমার কিচুই অয় নাই। মাস্টেরমশাইগের ছোয়োদ্দা না করলি ল্যাহাপড়া ক্যাম্বা হবি?

হিঃ হিঃ হিঃ… অত ল্যাহাপড়া দে কী হবি? ভাতের মদ্যি ডলে খাবো? তুই ম্যালা ল্যাহাপড়া করবি, তুই যায়ে ভকতি-ছেরো দেহা গে।

না রে, ওরম করে কোস ক্যা! ল্যাখাপড়া না করলি মানুষ হবি ক্যাম্বা। চলেক ইসকুলি যাই। বলল হাজারি।

চৌদ্দটা ছেলে আর তিনটা মেয়ে পড়ে হাজারিদের ক্লাসে। এদের মধ্যে প্রায় সবাই মেগচামির ব্রাহ্মণ আর কায়স্থ পাড়ার। একজন মুসলমান আর বাকি তিনজন বিল সিংহনাথ মৌজার নমশুদ্র।

হাজারি মেগচামি প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ভবানী চরণ স্যান্যালকে ভালোই বিপদে ফেলে দিয়েছে। এবারের ফাইনাল পরীক্ষায় সে ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে। জমিদার বাড়িতে ডাক পড়েছে হেডমাস্টারের।

কীরম করে নমশূদুরির ছাওয়াল কিলাসে ফাসটো হয়? জমিদারের রক্তচক্ষুর মুখোমুখি হেডমাস্টার।

ছেলেডা বিজায় মিধাবী। শুধু এই কিলাসেই না, সব কিলাসেই সে ফাসটো হবি। লাগে থাকতি পারলি কলেজে যাবি। বিএ, এমএ পাস করবি। সব বিষয়ে বেশি নম্বর পালি, ফাসটো না বানায়ে কী করব তারে? মিনমিন করে উত্তর দেন ভবানী স্যান্যাল।

তাই বলে নমশূদুরির ছাওয়াল? মোচলমান হলিউ না হয় কতা ছিল। ইডা কোনোদিন মানা যাবি নে। কভি নেহি।

কড়া ধমক খেয়েছেন হেডমাস্টার। জমিদার বাবুর এক কথা, না পারলি চাকরি ছাড়ে দে বাড়ি চলে যাও।

কী করবেন ভবানী স্যান্যাল! জায়গা-জমি নাই, পুজো-আর্চার কাজও জানেন না ঠিকমতে। চাকরি চলে গেলে বৌ-ছেলেমেয়েকে খাওয়াবেন কী!

কিন্তু হাজারিকেই বা কী বলবেন তিনি! কেমন করে বলবেন!

ডেকে পাঠালেন তিনি ছেলেটাকে। অনেকক্ষন চুপ থেকে লম্বা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে ব্যথিত কণ্ঠে আস্তে আস্তে বললেন–তুই অনেক বড় হবি রে হাজারি। মন দিয়ে ল্যাকাপড়া করিস বাবা। তুই হাই ইসকুলি, কলেজে সব কিলাসে ফাসটো হবি। তোরে আমি এই আশীৰ্ব্বাদ করি। কিন্তু এই মেগচামি প্রাইমারি স্কুলি না রে… তোর রোল তেরো, বুঝলি? আনলাকি থারটিন। এক না।

ক্যান ছার! কী হইছে?

হইচে অনেক কিছু রে ব্যাটা। জানতি চায়ে আমারে আর লজ্জার মদ্যি ফ্যালাস নে। একদিন বুজবি, বড় হলি ঠিক বুজতি পারবি। এখন যা। বলে মাথা নিচু করে বসে রইলেন ভবানী চরণ স্যান্যাল। তার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

হাজারি বেরিয়ে আসে হেডমাস্টারের রুম থেকে। তারও দু চোখে জলের ধারা। নিজেকে সে কোনোভাবেই সামলাতে পারছে না। সে বুঝে ফেলেছে, শুধুমাত্র নমশুদ্র হওয়ার কারণে ফাস্ট হলেও তার রোল নম্বর এক হবে না। হবে তেরো।

জ্ঞানেন্দ্র মাস্টারমশাই বিজ্ঞের মতো বললেন–ভাবিস নে। মাথার উপর ভগমান আছে। তিনিই এর বিচার করবেন। তয়, ওই পাঠকগের খোতা মুখ ভোঁতা করে দিতি হবি। প্রাইমারি ইসকুলি ফাসট হোস নেই তো কী হইছে? হেডমাস্টার ঠিকই কইচে, তুই হাই স্কুলি ফাসটো হবি, কলেজে যায়ে ফাসটো হবি। বড় চাকরি করে দেখায়ে দিবি, নমশূদ্দুররাও পারে।

টিমটিম করে জ্বলছে কেরোসিনের ল্যাম্প। তার ম্লান আলোয় গোল হয়ে বসে থাকা নির্বাক মানুষগুলোর লম্বা ছায়া পড়েছে কাচারিঘরের পাটখড়ির বেড়ায়।

অপমান! কী নিদারুণ অপমান!

কারো মুখে কোনো কথা নেই। যেন তাদের খুঁসে ওঠা রাগ নীরব প্রতিবাদে গুমরে গুমরে মরছে। তামাকের ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারপাশ। ঘন অন্ধকারে কুয়াশার সাথে মিশে সেই আেঁয়ায় তৈরি হয়েছে। রহস্যময় এক পরিবেশ। শুধু শোনা যায়, হুক্কার একটানা কুড়ৎ। তরঙ্গের মতো সে শব্দ ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে।

নিস্তব্ধতা ভেঙে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বললেন–মন খারাপ করিস নে। শোন তালি, নমশূদ্দুরগের আদি ইতিহাস।

কি আবার শুনোবি মাস্টের! তবু নড়েচড়ে বসে সবাই। তাকায় জ্ঞানেন্দ্রনাথের মুখের দিকে।

যশোর জেলার ছিয়ানব্বই খান-এর নাম শুনিছিস? যশোর, খুলনা এলাকার ছিয়ানব্বইডা গ্রামজুড়ে নমশূদ্রগের বাস। সেই জাগার এট্টা ধর্মসভায় শুনিছিলাম এই গল্প। সত্যি-মিথ্যে জানি নে। তয় সেই সাধু বলিছিলেন বড় সুন্দর করে। আমরা নমশূদ্ররা কনের তে আলাম, কিরম করে আলাম, কিড আমাগের আদি পিতা… এইসব আর কি! শুনে মনডা আমার ভরে গিছিলো।

তাই নাকি! কও তো দেহি, শুনি। কালিপদ আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে।

আমরা হলাম গে নমস মুনির বংশধর। তার নামে আমাগের বংশের নাম নমজাতি।

সিডা না অয় বুজলাম। কিন্তুক এই নমস মুনি বিটাডা কিডা? রবির বাপ আগ্রহ ভরে জানতে চায়।

নমস মুনি ছেলেন সে সুময়ের সবচেয়ে নামকরা ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। যিরম তার জ্ঞান, সেইরম তার তেজ। ধর্মজ্ঞানে তার তুল্য মানুষ সে সুমায় কেউ আর ছিল না।

ব্রাহ্মণ? তার বংশধর হলি তো আমাগেরও ব্রাহ্মণ থাহার কতা। তালি আমরা নমশূদ্দুর হলাম ক্যাম্বা?

এই জাগায়ই তো কথা রে… সনাতন ধর্মে জন্মের নয়, কর্মের ভিত্তিতে মানুষরে চার শ্রেণিতে ভাগ করা হইচে। সেই চার ভাগ কি কি? না ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র। যারা জ্ঞানচর্চা করে তার হলো গে ব্রাহ্মণ, যারা যুদ্ধ করে দেশ রক্ষা করে তারা ক্ষত্রিয়, যারা ব্যবসা-বাণিজ্য-চাষাবাদ করে দেশের অর্থনীতি চালায়ে রাখে তারা হলো বৈশ্য। আর যাগের জ্ঞান-বুদ্ধি বুলতি কিছু নাই, গায়ে খাটে, চাকর-বাকরের কাজ করে তারা হলো গে শূদ্র। নাম দেখে ভ্রম হয়, আমরা হলাম সেই শূদ্রের বংশধর। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা না। শূদ্দুর হলি তো আমরা কৃষিকাজ করতাম না। কৃষিকাজ হলো গে বৈশ্য শ্রেণির কাজ। আর শূদ্র হলি তো শুধু শূদ্রই থাকতাম, তার আগে আসে নম যোগ হবি ক্যা? আসল কতা হলো গে, আমরা নমস মুনির বংশধর। তাই আমরা নমজাতি। এহন জিজ্ঞেস করতি পারো, শূদ্র না হয়েও তালি আমরা নমশূদ্র হয়ে গেলাম কিরম করে?

কিরম করে? বলে উঠে বিশুর বাপ। বিস্ময়ে হতবাক সবাই। সবার মনের মধ্যে তখন একই প্রশ্ন।

সে এক বিরাট কাহিনি। তয় জানে রাখিস, ব্রাহ্মণ যদি কতি হয়, তালি আসল ব্রাহ্মণ হলাম গে আমরা। এই নমরা। বুক ঠুকে চোয়াল শক্ত করে বলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ। অথচ দ্যাক, আমাগের ভাগ্যের ফের। শালার পাটক ঠাউর এতবড় কতা কওয়ার সাহস পায়! নমশূদুরির ছাওয়াল বোলে কিলাসে ফাসটো হতি পারবি নে। তালি ফাসটো হবি কিডা, তুই? শালার বিটা, শালা…

আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাইন। গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে সবার মধ্যে।

কিন্তক কাহিনিডা কী? সিডা এট্টু শুনতি পারলি মন ভরে যাতে।

শোন তালি। রাজসভার প্রধান পুরোহিত ছেলেন নমস মুনি। যেরম তার শাস্ত্রজ্ঞান, সেরম তার নীতি। কর্তব্যজ্ঞানে তার সমতুল্য কেউ ছিল না সে সুমায়। এজন্যি রাজা পর্যন্ত তারে মান্যি করে চলে। রাজামশাই নিঃসন্তান। কোনো রানি তারে সন্তান উপহার দিতি পারি নেই। শেষমেশ রাজার একটা ছেলে জন্মালো। কোনো রানির গর্ভে না, এক ডোমের মেয়ের গর্ভে। শাস্ত্রমতে জারজ সন্তান সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতি পারে না। কিন্তুক রাজা চায়, তার আঁটকুড়ে নাম ঘুচোতি। তাই ঠিক করলেন, ডোমকন্যার গর্ভের সন্তানরেই রাজপুত্তুর হিসাবে প্রজাগের সামনে ঘোষণা দিবি। সে হবি পরবর্তী রাজী। কিন্তু বাদ সাধল রাজ্যের পণ্ডিতরা। তাগের এক কথা, ইড়া শাস্ত্রসম্মত না। রাজা তখন কি করলেন?

কী?

রাজা তখন সব ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগের রাজপ্রাসাদে নেমন্তন্ন করলেন। চৰ্য্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় আহার করালেন। সাথে উপহার দেলেন একটা করে সোনার বাটি আর প্রণামী একশত করে স্বর্ণমুদ্রা। সাথে ঘোষণা দিয়া হলো, যিডা রাজার বিরুদ্ধে যাবি, সিডার গর্দান নিয়া হবি। পণ্ডিতরা সব ভয়ে আর লোভে বলে দিল–স্ত্রীর গর্ভে সন্তান না হলি দাসীর গর্ভের সন্তান বৈধ বলে গণ্য হবি।

কও কি! তারপর কী হোলো!

কী আর হবি! একজনই থাকলো অনড়, অটল। লোভ, লালসায় টলে না সে। সমস্ত ভয় উপেক্ষা করে নমস মুনি বললেন, শাস্ত্রমতে জারজ সন্তান কখনই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতি পারে না। রাজা রুষ্ট হয়ে নমস মুনিরে শূলে চড়ানোর আদেশ দিলেন।

তারপর! উদগ্রীব প্রশ্ন ভেসে আসে।

নমস মুনি তো আর যে-সে মানুষ না! তার তেজই আলাদা। সেই তেজি মুনিরে শূলে চড়ালি প্রজারা বিদ্রোহ করতি পারে। তাছাড়া ব্রাহ্মণ হত্যা মহাপাপ। রাজা সেই পাপে পাপী হতে চান না। তাই মত পাল্টালেন। দিলেন দেশান্তরের শাস্তি। রাজ্য ছাড়ে চলে যাতি হবি নমস মুনিরে। তিন দিন পর রাজ্যের মধ্যি যে জাগায় পাওয়া যাবি, সে জাগায়ই তারে মারে ফেলাবি রাজার সৈন্যরা। তখন অপরাধ হবি, রাজার আদেশ অমান্য করা।

অনুসারীরা পরামর্শ দিলো, দেশ ছাড়ে চলে যাতি। কিন্তু নমস মুনি দেশত্যাগ করবেন না। সপরিবারে পলায়ে বেড়াতি লাগলেন শ্বাপদসংকুল গহিন, দুর্গম বনে-জঙ্গলে। মনুষ্যহীন বিল-জলাভূমিতে। সাথে তার অনুসারী শিষ্যরা। দিনে দিনে বাড়তে থাকে শিষ্যের সংখ্যা। আত্মরক্ষার তাগিদে শিখল লাঠি খেলা চালাতি শিখল ঢাল, সড়কি, বল্লম, যুঁতি। গুরুরে রক্ষা করতি হবি যে কোনো মূল্যে।

একমায় সেইসব দুর্গম এলাকায় গড়ে উঠলো বসতি। জঙ্গল পরিষ্কার করে শুরু হলো চাষাবাদ। নমস মুনির বংশধররা জ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে পেটের দায়ে হয়ে গেল কৃষিজীবী। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করল তারা। সেই সত্যের বংশধর হলাম আমরা।

দম নিয়ে আবার বলতে থাকেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাইন–তাই তো দেকপি নমশূদুরির বাস সব প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকায়। বন-বাদার, বিল আর জলাভূমির মদ্যি। রাজরোষ মেটে না তাতেও। রাজা ঘোষণা দ্যান, নমস মুনির বংশধররা আজকের তে শূদ্র বুলে গণ্য হবি। নম-এর সাথে শূদ্র যোগ হয়ে নামজাতি হয়ে গেল নমশূদ্র।

নড়েচড়ে বসেন তিনি। তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বলতে থাকেন–কিন্তু আর না। নমস মুনির বংশধর আমরা। তার তেজ আর পাণ্ডিত্যের ধার উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুই কি পাই নেই আমরা? পাইচি, কিন্তু কাজে লাগাই নেই। আমাগের মদ্যি জং ধরে গেচে। শান দিয়ে ধার বাড়াতি হবি। জাগায়ে তুলতি হবি নমশূদ্রগের। হাজারিরে দিয়ে আমাগের যাত্রা শুরু। শুরু হোক আমাগের এই মধুপুর গ্রামের তে। আস্তে আস্তে সেই জ্ঞানের আলো ছড়ায়ে পড়বি সারা ইলাকায়।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সবাই শোনে নমস মুনির কাহিনি। পিনপতন নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে চারদিক। কথা বলতে ভুলে গেছে যেন তারা। নমস মুনির সাহস আর বিক্রমে মন ভরে আছে সবার। কখন যেন নিঃশব্দ চরণে এসে নমস মুনি ভর করেছে তাদের উপর। সবাই যেন এক একজন নমস মুনি। নমস মুনির সেই শৌর্য-বীর্য বুকে ধারণ করে একে একে উঠে তারা রওনা দেয় বাড়ির দিকে।

সকাল থেকেই সাজসাজ রব। জেগে উঠেছে গোটা মধুপুর গ্রাম। উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আজ পহেলা বৈশাখ। বৈশাখ মাস এদের লক্ষ্মী মাস। মা লক্ষ্মীর আবাহন হবে আজ।

উঠোনের মাঝখানে টুলের উপরে বসে আছে শরৎ আর টুকুলাল। লাঙল জোয়াল, কাস্তে-কোদাল, খোন্তাকুড়োল সব এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছে। বাড়ির ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ সবাই কাজে লেগে গেছে। হাজারিও তাদের সাথে হাত মেলাল। সামনের ডোবা থেকে ছেলেরা একে একে সব যন্ত্রপাতি ধুয়ে এনে উঠোনে জড়ো করেছে। সেগুলো মুছে মেয়েরা তেল-সিঁদুর লাগিয়ে একপাশে সাজিয়ে রাখছে। এরপর হাজারি অন্যদের সাথে গরু-বাছুর নিয়ে রওনা হলো চন্দনা নদীর দিকে। স্নান-শেষে তাদেরকেও সজ্জিত করা হবে তেল সিঁদুরে।

সবশেষে নিজেরা স্নান সেরে নতুন কাপড় পরবে। না থাকলে পুরনো কাঁচা কাপড়। পবিত্র সাজে সেজে দলবেঁধে গ্রামের পুরুষেরা রওনা হবে তাদের ভূস্বামী জমিদার মেগচামীর পাঠক বাড়ির দিকে। উদ্দেশ্য পুণ্যাহ পালন করা। জমিদার বাবু এই দিনে সিঁদুর রাঙানো কাঁচা টাকার ছাপ মারা নতুন সনের নতুন খাতা খুলবেন।

নমশুদ্ররা যে যা পারে দু আনা, চার আনা খাজনা খাতায় জমা দিয়ে পুণ্যাহ করে। তারপর সযতনে গা বাঁচিয়ে বাইরের উঠোনে চলে যায়। তাদের ছোঁয়ায় আবার বাওন-কায়েতদের জাত না চলে যায়। সবকিছু সেরে পাত পেড়ে পেটভর খেয়ে ঘরে ফেরে তারা।

শরৎ, টুকুলাল, হাজারিদের যৌথ পরিবার। তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তবু এ বাড়িতে আজ অন্যদিনের তুলনায় রান্নার আয়োজন ভালো। বছরের পয়লা দিন বলে কথা। পেছন বাড়ির রান্নাঘর থেকে ম ম গন্ধ ছুটে আসছে। সেই গন্ধে বলাইয়ের পেটের মধ্যে খিদে চো চো করতে লাগল।

বলাই আজ খায়ে-দায়ে বাড়ির পরই থাহে যা। উদার হয়ে বললেন শরৎ।

বলাইয়ের অন্তরের গহিন ভিতরে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেটাকে যেন টেনে বের করে এনেছে শরৎ। মনে মনে বর্তে যায় সে। কিন্তু মুখে এঁটে রাখে ভাঁজ করা ভদ্রতার আবরণ।

কী দরকার ছিল। বাড়ি যায়েই তো খাতি পারতাম। তয়, তুমি যহন কইচো, তহন না তো আর করতি পারব না। ঠোঁট উল্টে টেনেটেনে বলে বলাই।

ভরপেট খেয়ে বলাই এসে বসে কাচারি ঘরে। নিজের হাতে কলকেয় তামাক সেজে আয়েশের সাথে হুঁকোয় টান দেয়। এক টানেই কলকের তামাক সে অর্ধেকের নিচে নামিয়ে আনে।

বলাই এ বাড়িতে কাজ করে। স্থানীয় ভাষায় সে এ বাড়ির বাঁধা পরেত। বাড়ি পাশের গ্রামে। দূর সম্পর্কের লতায়-পাতায় আত্মীয়ও বটে। সম্পর্কে শরৎ-এর ভাগনে। অবশ্য গোটা এলাকাজুড়েই নমশূদ্ররা লতায়-পাতায় আত্মীয়। হয়তো খুবই আপন। নইলে তস্য, তার তস্য।

বাইরে এসে বলাই আকাশের দিকে তাকাল। মেঘের নামগন্ধ নেই। তাই সহসা বৃষ্টিরও সম্ভাবনা নাই।

নমশূদ্রদের জীবন প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার। আবহাওয়ার ভাব গতিক এদের জানা। শরৎ-এর কাছে বসে বলাই হাত কচলাতে কচলাতে মনের ইচ্ছেটা নিবেদন করে ফেলল।

মামা, মনে তো হয়, বিষ্টি নামতি ইবার দেরি হবি। এই ফাঁকে বুনডারে এট্টু দেহে আসতাম গোয়ালদার তে।

গোয়ালদহ গ্রামটি পড়েছে যশোর জেলার মধ্যে। সরাসরি বিল পাড়ি দিয়ে গেলে নয়-দশ মাইলের বেশি হবে না। তবে গড়াই নদী পার হয়ে যেতে হয়।

তা যাতি পারিস। তয় বৃষ্টির ভাব দেকলিই কিন্তুক চলে আসপি। আকাশের দিকে তাকিয়ে শরৎ বলে দিলেন।

এখন বিল সিংহনাথের মাঠজুড়ে লাঙল চেরা হালের মতো কড়কড়ে ঢ্যালা জমিন। নয়াবীজ খেতে ফেলার প্রস্তুতি নিয়ে বৈশাখী বৃষ্টির অপেক্ষায় এরা আকাশপানে চাতকের মতো চেয়ে বসে থাকবে। তৈরি হতে থাকবে বীজ-লাঙল জোয়াল নিয়ে। কৃষাণীরাও প্রহর গুনতে থাকবে মাঠে বীজ ফেলার সেই শুভক্ষণের অপেক্ষায়। বৈশাখে মাঠে বীজ ছড়িয়ে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রবণ ও ভাদ্রে প্রখর রোদে, ঝড়-বৃষ্টিতে দিনভর খেতের কাজে পুড়তে হবে, ভিজতে হবে।

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হুঁকো তাওয়ায় আগুন দিয়ে আসর করে বসে শুনবে মনসামঙ্গল, নিধুবনে কৃষ্ণকলি, রাধিকার মানভঞ্জন। ইত্যাদি পালা। মেয়েরাও আসরে গিয়ে বসে, তারাও গানের সাথে গলা মেলায়।

দেখতে দেখতে পরিবেশ আবেগঘন হয়ে ওঠে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একে অপরের হাত ধরে, কাঁধে মাথা রাখে কখনও বা জড়িয়ে ধরে অন্তরের উথলে-ওঠা কান্না প্রশমিত করে। স্থানীয়ভাবে একে বলে দশা ধরা। উলুধ্বনিতে তখন মুখরিত হয়ে ওঠে চারিদিক। পুরুষেরা সম্মিলিত কণ্ঠে দিতে থাকে হরিধ্বনি।

খুড়ো, কেমুন আছো?

ভালো। আয় বয়। পানুরাম বারান্দায় উঠে হারান খুড়োর পাশে টুলটা টেনে নিয়ে বসে।

হুঁকোড়া দ্যাও। শরীলডা জমে গেছে। দুড়ে টান দিয়ে গরম হই।

তা, এই সাত সহালে আলি কন তে? বিলির তে?

হ খুড়ো। দোপের বিলি জাল পাতিছিলাম। কৈ মাছ ভালোই আঁকাইচে।

কোস কি? এহন তো কৈ মাছের সুমায় না। কৈ পালি কনে?

কপাল, খুড়ো কপাল। ভাগ্যি থাকলি সবি অয়-বলে পানুরাম সোৎসাহে হুঁকো টানতে লাগল।

কুড়ুৎ কুডুৎ শব্দের সাথে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারিদিকে। একটু দম নিয়ে কষে টান দিয়ে হারান খুড়োর হাতে কোটা ফিরিয়ে দেয়।

তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে গলাটা একটু খাটো করে বলল–খুড়ো তুমার সাতে ছোট্ট এট্টু গলপো ছিল।

কী গলপো! কয়ে ফ্যালা।

তেমুন কিছু না। মানে আর কি, সেই মামলায় তোমারে এট্ট সাক্ষী দিতি হবি আমার হয়ে। ইতস্তত করে বলে পানু।

ক্যান, কিসির সাক্ষী?

আকাশ থেকে পড়ল হারান খুড়ো। যেন কিছুই জানে না সে। অভিনয়ের পুরোটুকুই বুঝল পানু। কিন্তু দায় তো তার।

গদগদ কণ্ঠে বলল–বুজলে না। সেই যে জমিড়া কিনিছিলাম তিন্নাতের কাছের তে ওর মিয়ার বিয়ের সুমায়। খুড়তুতো ভাই, নিজিগেরি মানুষ। সগগোলে মিলে আমারে কোলোপানু, খরার বছর, জমি আর কিডা নিবে নে, তুগার জমি তুরাই রাহে দে। বিশ্বাসের পর নিয়ে আজ দশ বছর জমিড়া করে খাচ্ছি। গায় খাটে পতিত জমি আবাদি করিচি। এহন দলাদলির মদ্যি পড়ে সে আমার নামে নালিশ দিল। আমি বোলে গার জোরে তার জমি দখল করে খাচ্ছি। ইডা কি এট্টা কতা হোলো খুড়ো, তুমিই কও?

কোস কি? তিন্নাথ তো কাজ ঠিক করলো না। বিশ্বাস যে সমাজের তে এহেবারে উঠে গেলো রে…।

সেই কতাই তো কচ্চি খুড়ো। অন্যায়ের পেতিকার করা লাগ্‌বি নে? তালি কি খুড়ো কতা দিলে?

দিলাম না মানে? একশবার কতা দিলাম। সত্যিডারে তো পেতিষ্টিত করতি হবি। ও কেস করলিই হয়ে যাবি? ক্যা, আমরা কি মরে গিছি? মাতার পর ভগমান নাই?

জানতাম খুড়ো। বুকির মদ্যি বল ফিরে পালাম। তুমার ভরসায়ই কিম্ভক রলাম আমি।

তাই তো থাকপি। আমি হলাম গে তোর নিজির মানুষ। বেশি দূরির তো না। তোর মা হোলো গে আমার পিসতুতো ভাইর শালির আপন ননদ। মানে আত্মীয়। আমার উপরই তো বল বাকপি।

বাঁচালে খুড়ো। তালি ওই কতাই রোলো। মামলার তারিক কিন্তুক মাঘের ২২ শে।

আচ্চা, ঠিক আছে। আর কওয়া লাগবেন না। তুই যা।

পানুরাম উঠে রওনা দিল। কিন্তু চিন্তার গভীর ভাঁজ তার কপালে। খুড়োর অতি-উৎসাহ রীতিমতো সন্দেহজনক। সে নিশ্চিন্ত যে, খুড়ো তার হয়ে সাক্ষী দেবে না।

ব্যাপারটা সে আঁচ করেছিল আগেই। সেটাই এখন সত্যি বলে মনে হতে লাগল।

না, নতুন সাক্ষী জুগাড় করতি হবি। কারে করা যায়, কিডা আচে সেরম? মনে মনে সেই খোঁজ করতে করতে উঠে রওনা দেয় পানুরাম।

হারান খুড়োর মুখে এক চিলতে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। হাসতে থাকে খিকখিক করে। মনে মনে বলতে থাকে-ওরে পানো তোর হাজতবাস এবার অনিবাজ্জো। আমি তোর উল্টো সাক্ষী দেবো রে… তিন্নাত আমারে দশ টাহা আগাম দিয়ে রাহিছে। তুই দে আরেটু বাড়ায়ে। থাকপানে না হলি তোর সাথেই। দিলাম না হয় তোর হয়েই সাক্ষী। হিঃ হিঃ হিঃ…

হেলে-পড়া সূর্যের নরম রোদ গা এলিয়ে দিয়েছে। বিচিত্র রঙের আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। চৈতালি ঘরে তোলার সময় এখন। খেসারি, মসুর, মটর, তিসি, রাই, সরিষা, মসনে ইত্যাদি পাকা ফসলে বিস্তীর্ন মাঠ বাদামি বর্ণ ধারণ করে আছে। এর মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে হনহন করে এগিয়ে চলেছে একা একটা ছেলে। বোগলে তার বই-খাতা। খাতাগুলো পুরনো, ন্যাতানো, বইগুলো ছেঁড়া।

মধুপুর থেকে পাঁচ মাইল দূরে বালিয়াকান্দি থানা। এই এলাকার মধ্যে একমাত্র হাই স্কুল বালিয়াকান্দিতে। পুব এলাকার মধুপুর, শিবপুর, গোপিনাথপুর, নরকোনা, বনগ্রাম, পারুলিয়া এসব গ্রামের মধ্যে হাই স্কুলে পড়তে যায় শুধুমাত্র এই ছেলেটাই। বারবার সে সূর্যের দিকে তাকাচ্ছে আর বোঝার চেষ্টা করছে সন্ধ্যা গড়ানোর আগেই বাড়ি পৌঁছুতে পারবে কি না!

বাবা তার মারা গেছে জন্মের আগেই। মাও গত হয়েছে সেই ছেলেবেলায়। যে মায়ের কথা কিছুই মনে নেই, সেই মায়ের কল্পিত মুখ বারবার মনের আয়নায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে সে। আসলে ভয় পাচ্ছে। আশেপাশে কোনো জনমানব নেই। বেলা যত পড়ে আসছে ততই মানুষজন কমে যাচ্ছে। আজ কেন যেন মাঠ, রাস্তা-ঘাট আরও বেশি ফাঁকা, সুনসান। মনের ভয় ভুলে থাকার জন্য মায়ের মুখ মনে করার চেষ্টা করছিল ছেলেটা।

সে জানে না, কে তার নাম রেখেছিল হাজারি। মা নাকি অন্য কেউ! তবে স্কুলের খাতায় একটা ওজনদার নাম আছে তার–হিমাংশু শেখর বিশ্বাস। এই নামটা দিয়েছিলেন বড়দা। বলেছিলেন, আগে নাকি তাদের পদবি ছিল বৈরাগী। ঠাকুরদার আমল থেকে কীভাবে কখন যে বৈরাগী পদবিটা বিশ্বাস হয়ে গেছে তা বড়দা নিজেও বলতে পারেন না।

জ্ঞান হবার পর থেকেই হাজারি বুঝে গেছে যে সে অনাথ। কেমন অসহায় লাগত নিজেকে। মনে হত তার কোনো আশ্রয় নেই। কারো উপর কোনো জোরও নেই তার অন্যদের মতো। তবে নিঃসন্তান দাদা-বৌদির স্নেহ সবটুকু পেয়েছে সে। কিন্তু একে অভাবের সংসার, তার উপর সারাদিন কাজের ব্যস্ততা। মেহ দেখানোর সময় কোথায়?

এর মধ্যেই একদিন হাজারি বায়না ধরল লেখাপড়া করবে। বড়দা তাকে হাতেধরে পাঠশালায় দিয়ে এসেছিলেন।

গ্রামের জ্ঞানেন্দ্র জ্যাঠার কাছেই শুরু হলো তার হাতেখড়ি। হাজরার লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখে দ্বিগুণ উৎসাহে পড়ানো শুরু করলেন। গ্রামময় বলে বেড়াতে লাগলেন–হাজরা শুধু মধুপুর গিরামেরই না, গোটা নমশূদ্র সমাজের মুখ একদিন উজ্জ্বল করবি।

আস্তে আস্তে হাজারির মনেও একসময় গেঁথে যায় যে, এলাকার নমশূদ্র সমাজের সম্মান নির্ভর করছে তার উপর। লেখাপড়া তাকে করতেই হবে ঠিকমতো।

বেলা পড়ে গেছে। রোদ নেই বললেই চলে। হাজারি চারদিকটা আরেকবার ভালো করে দেখে নেয়। আলো নিভে আসছে একটু একটু করে। ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যা। বাড়ির কাছাকাছিই প্রায় চলে এসেছে সে। আর মাত্র আধা মাইল টাক। চারিদিকে অন্ধকার ঘিরে ফেলার আগেই সে বাড়ি পৌঁছে যেতে চায়।

এটা দোপা বিল অঞ্চল। আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, বেত আর বাঁশ বাগানে ছাওয়া গ্রাম। মাঝে ফাঁকা মাঠ। জনশূন্য। কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে গেছে সব। ভয়ে হাজারির বুক শুকিয়ে আসছে। সে জানে, নির্জন আলো-আঁধারিতে একলা পেলে শিয়ালের দল তাকে ঘিরে ধরতে পারে। সে বড় ভয়ঙ্কর। ওই অভিজ্ঞতা সে দ্বিতীয়বার আর নিতে চায় না।

সেবারের কথা মনে পড়ে যায় হাজারির। বাড়ি পৌঁছোনোর আগেই আলো নিভে যেতে শুরু করল। কেমন যেন গা ছমছম করতে লাগল তার। হঠাৎ সে দেখল সামনে দু’তিনটে শিয়াল। মানুষ দেখলে শিয়াল দৌড়ে পালায়। কিন্তু তাকে দেখে শিয়ালগুলো পালাচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে কী যেন মতলব আঁটছে তারা। এরপর আরও কয়েকটা শিয়াল এসে হাজির হলো। ভয়ে হাজারির বুক শুকিয়ে গেল। শিয়ালগুলো তাকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলল। আস্তে আস্তে ঘের ছোট করে এগিয়ে আসছে। কী করবে সে! ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করল। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। তবু রক্ষা, যে ঐটুকু চিৎকারেই লোকজন ছুটে এসেছিল। আর তাতেই বেঁচে গিয়েছিল সেবার। আর ভাবতে চায় না সে এসব। তাড়াতাড়ি পা চালায় হাজারি।

অঞ্চলজুড়ে সমস্ত মাঠ যেন ফসলে ফসলে এবার এক বাগান। কৃষকের চোখে তাই খুশির ঝিলিক, কৃষাণীর চোখে-মুখে ব্যস্ততার চঞ্চল ছায়া। উঠোনে উঠোনে অনাগত ফসলের জন্য লেপা-মোছার ধুম। সেই সাথে অন্তরে অন্তরে ছড়িয়ে পড়ে নতুন স্বপ্নের লুকোচুরি।

হাজারি জানে এ বছর তাদের জন্য সুদিন। এবার আমন ভালো হয়েছে। চৈতালির ফলনও ভালো। কিন্তু ভালোলাগার রেশ ধরে রাখতে পারছে না কিছুতেই। ভয় আর শঙ্কায় কাতর সে।

দৌড়াতে শুরু করে হাজারি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি পৌঁছাতে চায়। সামনে খানিকটা দূরে একজনকে দেখা যাচ্ছে।

হাজারি প্রাণপণে ডাকতে শুরু করল–কাকা… কাকা…

কিডা রে… সাড়া দেয় সামনের লোকটাও?

জীবন হাতে ফিরে পায় হাজারি। ছুটতে থাকে। দ্রুত এগিয়ে দেখে কাকা নয়, রতি জ্যাঠা। এ অঞ্চলে বাবার চাইতে বয়সে বড় যারা, তাদেরকে জ্যাঠা বলে ডাকা হয়। ছোট হলে কাকা।

কন তে আলি, ইসকুলির তে? রতি জ্যাঠা স্নেহের সুরে বললেন।

হ, জ্যাডা।

ভালো, ভালো। ল্যাহাপড়া করে আমাগের মুক তুই উজ্জ্বল করবি। এই আশীৰ্বাদই করি।

কিন্তুক জ্যাডা, আমি কি পারবা নে?

পারবি নে ক্যা! লেখাপড়া তো তোর করতিই হবি। চল, বাড়ির দিক আগোই।

রতি জ্যাঠার পেছন পেছন পরম নিশ্চিন্তে হাঁটতে থাকে হাজারি।

এ গাঁয়েরই বকুলতলা, আমবাগান, বাঁশের ঝাড়, কালির ভিটে দিয়ে ঘুরে ফেরে হাজারি।

তিন-চার মাইল দূরে মধুমতি নদী। এলাকার মানুষ বলে গোছড়াই নদী। আসলে গড়াই। কুষ্টিয়ার কাছে মূল পদ্মা থেকে শাখা বের হয়ে কামারখালী পর্যন্ত বয়ে এসেছে গড়াই নামে। কামারখালীর পর থেকে মধুমতি নামে চলে গেছে গোপালগঞ্জ, নড়াইল হয়ে খুলনার দিকে। মিশেছে গিয়ে ভৈরব নদীতে।

অনেকটা দূরে উঁচু ডিস্ট্রিক বোর্ডের মাটির রাস্তা। আর মাঠের মধ্যিখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে অজগর সাপের মতো চওড়া কাঁচা রাস্তা, যার স্থানীয় নাম হালট। আসলে পায়ে-হাঁটা পথ। কিন্তু গরুর গাড়ি আর মোষের গাড়ি চলে বলে হালট মোটামুটি ভালোই চওড়া।

মাঝে মাঝে ভাদ্র কি আশ্বিন মাসে বিকালের দিকে বিলের কানায় লাটিম গাছের মোটা শেকড়ের উপর বসে থাকে হাজারি। আজও বসে আছে। তার দূরে…বহুদূরে…

সামনে থৈ থৈ ভরা বিল। ধানগাছগুলো মাথা উঁচু করে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। মৃদুমন্দ বাতাসে নড়ছে গাছের ডগা। মাঝে মাঝে ফুটে আছে শাপলা ফুল। দূরে চরের মাথায় ছন খেতে বাবলা গাছে হলুদ রঙের ফুল ঝুলে আছে। মোটা গুলঞ্চলতা-দুলানো পাশের শিমুল গাছটাকে দেখলে মনে হয় যেন কোন অনাদিকাল হতে এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে।

ঝোঁপের মধ্যে বসে বঁড়শি দিয়ে পুঁটি মাছ ধরছে ও পাড়ার সহাদেব দা। ছোট্ট একখানা ডিঙ্গি বেয়ে ভণ্ডুল দোয়ারি পাততে যাচ্ছে বিলের মধ্যে। আর পেছনে মাঠের মাঝে ঝাড়ঝাড় সোঁদালি ফুল বিকেলের ঝিরঝিরে বাতাসে দুলছে একটু একটু করে। বিলের মধ্যে দ্বীপের মতো ভেসে আছে সবুজ গ্রামগুলো। তার ফাঁক দিয়ে দূরে, আরো দূরে, বহু দূরে নীল আকাশটা এসে মিশেছে জলের দিগন্তরেখায়। যেন গ্রামের সবুজ বনবীথির পেছন দিয়ে আকাশটা নেমে এসেছে মাটির ধরায়। সেদিকে আনমনে চেয়ে থাকে হাজারি। মনটা কেমন কেমন করে-দূরে কোথায় দূরে, বহু দূরে হারিয়ে যায় সে। তার বুকের মাঝে করুণ সুরে বাজতে থাকে বাউলের একতারা। কেমন যেন শূন্যতা বিরাজ করে তার চারপাশে। সেসব বলে বোঝানো যায় না।

তার মন চলে যায় নলিয়া-জামালপুর রেল স্টেশন ধরে কালুখালী হয়ে গোয়ালন্দ। তারপর লাল রঙের ‘ঢাকা মেইল’-এ চড়ে কলকাতা। কখনও গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে ইস্টিমারে নারায়ণগঞ্জ। সেখান থেকে ঢাকা। ইচ্ছামতো কল্পনার জগতে বিচরণ করতে থাকে সে। কখনও ঢাকা, কখনও বা কলকাতা। বিলাত পর্যন্ত কি যাওয়া যায়, কোনোভাবে…।

না থাক, দরকার নাই। আগে স্কুলের পড়া তো শেষ করি। ক্লাস টেনে উঠবে সে সামনের বছর। তারপর ম্যাট্রিকুলেশন। সে পারবে তো ভালো করে ম্যাট্রিকটা পাস করতে? ভাবতেই ভয় লাগে। বুকের ভিতরটা কেমন শুকিয়ে আসে। ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যায়।

বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে হাজারি।

কোতো নাহিরে, যাস কনে? আয় হুঁকোয় দুডে টান দিয়ে যা–নিদে মন্ডল গলা বাড়িয়ে বলল।

যাতেছি কাহা গলন্দর দিক। অমাবতির সুমায়ডা পার করে আসি গে। এরপরে তো আর সুমায় পাবান না। বুনির বাড়ি বেড়ানোও হবি, ইলশে মাছও খাওয়া হবি। ইবার বোলে ম্যালা ইলশে পদ্দায় ধরা পোরতেছে। সেই সাতে মাষ কোলোইর ডাল দে চারডে ভাত আরাম কোরে মারে দিয়ে আসি গে।

কোতোর গায়ে হাতাওয়ালা ছেঁড়া গেঞ্জি। জামাটা কাঁধের উপরে ভাঁজ করে রাখা। বোগলের নিচে ছাতাটা। বলতে বলতে কোতো কাচারিঘরে উঠে টুলের উপর বসে পড়ে। ছাতা নামিয়ে রেখে হাত বাড়িয়ে হুঁকোটা নিয়ে আয়েশের সাথে টানতে থাকে সে। সূর্য এখনও মাথার উপরে উঠে পারেনি। বেলা অনেকটাই হাতে আছে। ব্যস্ততার কিছু নেই।

এই এলাকায় কার্তিক নাম সংক্ষেপ হয়ে কখন যে কোতো হয়ে যায়, নাদুরাম হয়ে যায় নিদে, তা কেউ হিসাবেই রাখে না। এটাই এখানকার রীতি। পদ্মা নদীতে এবার নাকি সত্যি সত্যি প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে। এ খবর চারিদিকে চাউর হয়ে গেছে। পদ্মার বিস্তীর্ণ চরজুড়ে আবাদ হয় মাষকলাইয়ের। বিল সিংহনাথের আঠালো মাটিতে এটা জন্মায় না। তাই এই এলাকার মানুষ সুযোগ পেলেই ইলিশ মাছ আর মাষকলাই ডালের লোভে গোয়ালন্দ বন্দরের আশেপাশের আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যায়। অমাবতির সাতদিন কোনো কাজ করা নিষেধ। তাই বেড়াতে বের হয় এ এলাকার মানুষ, দেখা-সাক্ষাৎ করে আত্মীয়-স্বজনের সাথে।

আষাঢ় মাস এসে গেছে। কালো মেঘে ঢেকে থাকে আকাশ। সারাদিন ঝরঝর করে পড়তে থাকে বৃষ্টি। ভরে ওঠে খাল, বিল, নদী, পুকুর, নালা। বৃষ্টিতে আঠালো মাটি দৈ-এর মতো হাঁটু পর্যন্ত কাদায় কাদাময় হয়ে যায়। তবে এবার এখনও বৃষ্টি সেভাবে নেমে পারেনি। নামবো নামবো করছে কেবল।

আষাঢ় মাস অমাবতির মাস। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নমশূদ্ররা সাত দিন অমাবতি পালন করে।

তাদের বিশ্বাস, অমাবতির সাত দিন ধরে মৃত্তিকা মা রজঃবতী থাকে। এই সাত দিন মাটিতে কোনো আঘাত লাগলে মা বসুন্ধরা ব্যথা পান, কষ্ট পান। কষ্ট পেলে তিনি রুষ্ট হতে পারেন। কুপিত হয়ে অভিশাপ দিতে পারেন। এই সময়ে তাই তারা দা-কাস্তে, খোন্তা-কোদাল, লাঙল-জোয়াল সব ধুয়ে-মুছে শূন্যে তুলে রাখে। পারতপক্ষে কোনো কাজ করে না। এমনকি মাটিকে বাঁচিয়ে পা ফেলার চেষ্টা করে। এদের বিশ্বাস ঋতুবতী মায়ের শরীরে পা স্পর্শ করলে তাকে অমর্যাদা করা হয়। এজন্যে তারা চেষ্টা করে মাটি মায়ের সংযমী পুত্র সেজে থাকতে। এই সময়টা এরা অন্য কাজে ব্যয় করে। মেয়েকে দেখতে জামাই বাড়ি যায়। বোনকে দেখতে ভগ্নিপতি বাড়ি যায়। অথবা বেড়াতে যায় অন্য কোনো কুটুম বাড়িতে।

হাজারি বেড়াতে এসেছে তিন গ্রাম পরে তার ছোড়দির বাড়ি বনগ্রামে। সংক্ষেপে এই গ্রামকে সবাই বলে বনগা। ভগ্নিপতি সামান্য কৃষক। মাঠে তার কয়েক পাখি জমি মাত্র। শ্যালকের জন্য বিশাল আয়োজন করার সামর্থ্য তার নেই। রান্নার বাহুল্য থাকলেও আছে যত্ন আর আন্তরিকতার ছোঁয়া।

ভাই তার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। এরপর কলেজে যাবে। এজন্যে গ্রামে তাদের মর্যাদা অনেকখানি বেড়ে গেছে। অনেকেই এসেছে হাজারির সাথে দুটো কথা বলার করার জন্য। দেশের অবস্থা নিয়ে আলাপ করার জন্য।

রান্নাঘরের বারান্দায় কাঠের পিঁড়িতে খেতে বসেছে হাজারি। ভাগ্নে সুবোধ আর নিশিকান্ত বসেছে মামার সাথে। দিদি একটা তালের হাতপাখা নিয়ে পাশে বসে বাতাস করতে লাগল। হাজারির হৃদয় জুড়িয়ে গেল, মনটা ভরে উঠল প্রশান্তিতে।

একটু একটু করে বাড়তে থাকে বিলের জল। গ্রামগুলো হয়ে যায় তখন এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। নৌকা ছাড়া চলাচলের আর কোনো উপায় থাকে না। এর মধ্যে আউশ ধান কাটা হয়ে যায়, রয়ে যায় আমন। জলের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আমন ধানের গাছ। এভাবেই চলে যায় শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন।

পুরো এই তিন মাস বিল সিংহনাথের মানুষের তেমন কোনো কাজ থাকে না। তারা বাঁশ দিয়ে পলো বানায়। দোয়াড়ি, হোঁচা বানায়। জাল বোনে, মাছ ধরে। কাচারি ঘরে দলে দলে ভাগ হয়ে টোয়েন্টি নাইন খেলে। বাঘবন্দি খেলে। হুঁকোর কুড়ুৎ কুড়ুৎ শব্দ ছড়িয়ে পড়ে। ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে চারদিক। বাকিরা গালগপ্প করে, রাজা-উজির মারে। সে গল্পের কোনো মাত্রাজ্ঞান থাকে না। বাস্তবে যা কখনোই সম্ভব নয়, এমন সব কথাও তারা অবলীলায় বিশ্বাস করে নেয়। আষাঢ় মাসের বিল এলাকার গালগপ্পের বহরের কারণেই মনে হয় ‘আষাঢ়ে গল্প’ কথাটি বাগধারা হিসেবে বইপত্রে স্থান পেয়েছে।

এ সময়ে মেয়েরা নাইয়র আসে। দুই-এক মাস বাপের বাড়িতে থাকে, এদিক-সেদিক বেড়ায়। কার্তিক মাস পরার আগেই ফিরে যায় শ্বশুরবাড়ি। কারণ শুরু হবে তখন বিশাল কর্মযজ্ঞ। আমন ধান কাটা, উঠোনে মলন মলা, ধান শুকিয়ে ডোলে ভোলা, বাছাই করে বীজধান আলাদা করা। কাজের অন্ত নাই। অলসতার খোলস ছেড়ে আড়মোড়া ভেঙে অজগর সাপের মতো বেরিয়ে আসে ঘুমন্ত মানুষগুলো, ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজে। তখন মনে হয় এরা যেন মানুষ নয়। রূপকথার গল্পের বই থেকে বেরিয়ে এসেছে দৈত্যকুল। কাঁচি হাতে নেমে পড়েছে মাঠে। নইলে অমানুষিক এই পরিশ্রম তারা কীভাবে করে? এত শক্তি পায় কোথায় তারা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *