১৩. পরিশিষ্ট : নমশূদ্রদের পূর্ব ইতিহাস

পরিশিষ্ট-১ : নমশূদ্রদের পূর্ব ইতিহাস

সনাতন ধর্মে জন্মের ভিত্তিতে নয়, কর্ম তথা পেশার ভিত্তিতে মানুষকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র। যারা বিদ্যাচর্চা করে ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট এবং বিদ্যাদানে নিয়োজিত তারা ব্রাহ্মণ। যারা যুদ্ধ করে দেশ ও রাজাকে রক্ষার কাজে নিয়োজিত তারা ক্ষত্রিয়। যারা ব্যবসা বাণিজ্য এবং ফসল উৎপাদন করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে, তারা বৈশ্য। আর যাদের মেধা অতি নিম্ন পর্যায়ের, নিজ বুদ্ধিতে কোনো কিছু করার যোগ্যতা বা ক্ষমতা রাখে না, হুকুমের দাস হিসেবে দৈহিক পরিশ্রমের কাজ করে তারা শূদ্র।

ছোটবেলা থেকে মনে প্রশ্ন জাগত, শাস্ত্রমতে ‘শূদ্র’ আছে বটে। কিন্তু ‘নমশূদ্র’ তো নেই! তাহলে ‘ম’র পরে ‘শূদ্র’ অথবা ‘শূদ্র’র আগে ‘নম’ শব্দটি কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল? কারা এই নমশূদ্র? কোথা থেকে এসেছে তারা? তাদের পেশা কেন কৃষিকাজ? কৃষিকাজ তো করার কথা শাস্ত্রমতে বৈশ্যদের।

প্রত্যন্ত বিলের নমশূদ্র পল্লিতে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। সেই বিলের মধ্যে গ্রামের পর গ্রামজুড়ে শুধুই নমশূদ্রদের বাস। এ রকম শতাধিক গ্রাম নিয়ে আমাদের বিল বিস্তৃত গড়াই বা মধুমতি নদীর দুই পাড়ের অববাহিকার ফরিদপুর, রাজবাড়ি, কুষ্টিয়া, মাগুরা, ঝিনেদা জেলাজুড়ে। খুলনা, যশোর, নড়াইলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আছে এরকম পরপর ৯৬টি গ্রাম। এ কারণে ওই এলাকার নাম ছিয়ানব্বই খান। এসব গ্রামে মুসলমান তো দূরের কথা, হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সাহা, কুণ্ডু বা অন্য কারো বাস ছিল না।

আমাদের বাড়ি ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার মধুপুর গ্রামে। বাবা এবং আমার কর্মসূত্রে দেশের সব জেলায় ঘোরার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরিশাল, সিলেট, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইল প্রভৃতি জেলায়ও বিল এলাকাজুড়ে আছে গ্রামের পর গ্রাম নমশূদ্রদের বাস।

ছোটবেলা থেকেই মনে হতো, নমশূদ্রদের বসবাস সর্বত্রই বিলের মধ্যে কেন? সহজেই অনুমান করা যায়, এইসব বিল শত বছর, হাজার বছর আগে ছিল নিঃসন্দেহে শ্বাপদসংকুল গহিন অরণ্য এবং বসবাসের অযোগ্য জলাভূমি সেইসব জঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদের সূচনা করেছিল আমাদের পূর্বপুরুষরা। কেন তাদেরকে জনপদ ছেড়ে সেই গহিন জঙ্গল-জলাভূমিতে চলে যেতে হয়েছিল? শখ করে নিশ্চয়ই নয়। তাহলে কেন? কী কারণে জঙ্গলে পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে হয়েছিল তাদের।

ঘাটাঘাটি শুরু করি। উদ্ধার করার চেষ্টা করি, কারা এই নমশূদ্র? কোথা থেকে এসেছে তারা? তাদের পেশা কেন কৃষি? কৃষিকাজ তো করার কথা শাস্ত্রমতে বৈশ্যদের। পড়াশুনা করে যেটুকু পাওয়া গেল, তা সংক্ষেপে এ রকম–

নমশূদ্ররা একদা পরিচিত ছিল নমজাতি হিসেবে। নমশূদ্র হিসাবে নয়। কিন্তু প্রচলিত শাস্ত্রাদির মধ্যে নমজাতির কোনো কথা খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক অনুসন্ধানের পরে ‘শক্তিসংগম তন্ত্র’ নামে একখানা অতি প্রাচীন সংস্কৃত তন্ত্র গ্রন্থের মধ্যে হর-গৌরীর কথোপকথনের মাধ্যমে নমজাতির উৎপত্তি এবং তাদের বংশ বিস্তারের বিবরণ কাহিনির মতো করে পাওয়া গেছে।

কি সেই কাহিনি?

নমস নামে একজন মুনি ছিলেন। জ্ঞানচর্চায় উৎসর্গিত ছিল তার জীবন। তার স্ত্রীর নাম সুলোচনা দেবী। তিনি ছিলেন পরমাসুন্দরী। সুলোচনা দেবী যখন সন্তানসম্ভবা, তখন নমস মুনি তপস্যার উদ্দেশে গৃহত্যাগ করেন এবং চৌদ্দ বছরের মধ্যে আর গৃহে ফিরে আসেন না। সুলোচনা দেবী যথাসময়ে দুটি যমজ পুত্র সন্তান প্রসব করেন। পুত্রদের নাম রাখা হয় কীর্তিবান ও উরুবান। পুত্রদের বয়স ছয় মাস না হতেই সুলোচনা দেবী মারা যান।

মাতৃহীন শিশু দুটো আল্লার ও নৈধুব নামক নমস মুনির দুই যজ্ঞসঙ্গীর। তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকে। তপস্যা শেষ করে চৌদ্দ বছরেরও বেশ কিছু পরে নমস মুনি একদিন ফিরে আসেন এবং সুদর্শন দুই পুত্রকে দেখে মুনিবর অত্যন্ত প্রীত হন। তিনি পুত্রদের উপনয়ন সংস্কারের উদ্যোগ নেন। সকলের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন। কিন্তু পুত্রদের বয়স চৌদ্দ বছর পার হয়ে যাওয়ায় কোনো ব্রাহ্মণ তাদের উপনয়ন করাতে সম্মত হন না। ফলে কীর্তিবান ও উরুবান তার পিতার সমাজে অপাঙক্তেয় হয়ে পড়েন। ছেলেদের উপনয়ন সংস্কারে ব্যর্থ হয়ে মনের দুঃখে নমস মুনি সন্তানদের সদগতি কামনায় তপস্যার উদ্দেশ্যে আবার গৃহত্যাগ করে চলে যান।

দিনের পর দিন পার হয়। পিতা ঘরে ফিরে আসেন না। তখন দুই ভাই কীর্তিবান ও উরুবান পিতার অন্বেষণে বের হয়ে পড়েন। ঘুরতে ঘুরতে তারা সীমন্ত নামক এক শূদ্র রাজার রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হন। রাজা সীমন্তর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। অতি সুদর্শন এই যুবক দুটিকে দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং পরম আদরে নিজ পুরীতে নিয়ে যান। তারপর নিজের দুই অতি সুন্দরী কন্যা শিপিকাকে কীর্তিবানের সাথে এবং সপত্রিকাকে উরুবানের সাথে বিয়ে দেন। একসময় তারাই রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

নমস মুনির পুত্রদের ঔরসে এবং শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভে যেসব সন্তান জন্মগ্রহণ করেন, তারাই নমস মুনির স্মরণে ও শূদ্রা মাতার কারণে কালের প্রবাহে ‘নমশূদ্র’ নামে খ্যাত হয়।

‘শক্তিসংগম তন্ত্র’ নামক সংস্কৃত তন্ত্র গ্রন্থটি কীভাবে উদ্ধার হল, কীভাবে তার বাংলা অনুবাদ করা হল, সে কাহিনিও পাওয়া যায়। সেই ইতিহাস উদঘাটন নমশুদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য অতি গৌরবের এবং তা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণও বটে।

১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা সদর মহকুমা নিয়ে খুলনা জেলা গঠিত হয়। তার পূর্বে খুলনা ছিল যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি মহকুমা। তখন প্রেসিডেন্সী-১ বিভাগের কমিশনার ছিলেন একজন ইংরেজ। তিনি কলকাতায় অবস্থান করতেন। খুলনা জেলায় পরিণত হলে খুলনার অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ তথা উন্নয়নমূলক কাজ তত্ত্বাবধান করার জন্যে কমিশনার সাহেব মাঝে মাঝে খুলনা আসতেন। ঐ সময়ে খুলনা থেকে দৌলতপুর হয়ে সাতক্ষীরা পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা হয়; যেটি পরবর্তীতে কলকাতার রাস্তার সাথে যুক্ত হবার কথা। এতে খুলনা-কলকাতার দূরত্ব অনেক কমে যাবে। যশোর ঘুরে আর কলকাতা যেতে হবে না।

রাস্তার জন্যে মাটি কাটার কাজও শুরু হল। দৌলতপুরের নিকটবর্তী রংপুর নামক অঞ্চলটি ছিল নিচু, জল ও জঙ্গলা। সেজন্যে রাস্তার কাজের অগ্রগতি রংপুর অঞ্চলে এসে স্থবির হয়ে যায়। ঐ সময়ে শ্রী জীবন জোদ্দার নামে একজন ধনাঢ্য ও পরোপকারী ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিজ ব্যয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে মাটি কেটে নিচু এলাকা ভরাট করে সরকারের পরিকল্পিত রাস্তা ১৮৮৭ সালে নির্মাণ করে দেন। খুলনা-দৌলতপুর-সাতক্ষীরা রাস্তার উক্ত অংশটুকু আজও জীবন বাবুর রাস্তা নামেই পরিচিত। জীবন জোদ্দার ছিলেন নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ।

উদ্যোগী হয়ে নিজ ব্যয়ে সরকারি কাজ করে দেয়ায় কমিশনার মহোদয় জীবন বাবুকে ডেকে ধন্যবাদ জানান এবং ব্যয়িত অর্থ ফেরত নিতে তাকে অনুরোধ করেন। কিন্তু জীবন বাবু টাকা ফেরত নিতে রাজি হন না। এতে আরও খুশি হয়ে কমিশনার সাহেব খুলনার উন্নয়নমূলক কাজ তত্ত্বাবধানের জন্যে গঠিত ‘ডেভেলপমেন্ট কমিটি’তে জীবন বাবুকে সদস্য হিসেবে মনোনয়ন প্রদান করেন। কমিটির পরবর্তী মিটিঙে জীবন বাবু অংশ নেন।

তখন ছিল বর্ণ হিন্দুদের আধিপত্যের যুগ। ডেভেলপমেন্ট কমিটির সকল সদস্যই ছিলেন ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য। নমশূদ্রদের তখন নিকৃষ্ট এবং চণ্ডাল মনে করা হতো। তাই এ রকম সম্মানজনক কমিটির সদস্য পদে একজন নমশূদ্রের অন্তর্ভুক্তি এবং সমমর্যাদায় তার সাথে একই সারিতে চেয়ারে উপবেশন অন্য সদস্যদের গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মিটিং শেষে কমিশনার সাহেব কলকাতায় চলে যান। আর খুলনার বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ-কায়স্থরা ক্ষুব্ধ হয়ে জীবন বাবুকে জব্দ করার ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকেন।

পরবর্তী সভায় জীবন বাবুর উপস্থিতিতে বর্ণ হিন্দুরা কমিশনার সাহেবের নিকট একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে বলা হয়, জীবন জোদ্দার জাতিতে নমশূদ্র। তিনি ধর্মহীন, নিকৃষ্ট ও চণ্ডাল। তাদের কোনো অশুচি নেই, নাপিত-ধোপা নেই, পুরোহিত নেই, বিবাহ বা শ্রাদ্ধের কোনো নিয়ম নেই। তাদের নির্দিষ্ট কোনো পেশাও নেই। এমন জাতের লোকের সাথে সমশ্রেণিতে বসা যায় না। এতে আমাদের সম্মানের হানি হয়। শীঘ্রই এর প্রতিবিধান করা হোক।

এর প্রেক্ষিতে কমিশনার সাহেব জীবন বাবুর বক্তব্য জানতে চান। অভিযোগগুলোর উত্তর জীবন বাবুর জানা ছিল না। তাই তিনি ছয় মাস সময় চেয়ে নেন।

অপমানিত জীবন বাবু উপযুক্ত উত্তরের অন্বেষণে দেশের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের কাছে ঘুরতে থাকেন। ঐ সময়ে গোপালগঞ্জের অন্তর্গত রাউখামার গ্রামের শ্রী রামলোচন বিশ্বাসের মাতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে বিরাট স্বজাতি ভোজনের আয়োজন করা হয়। সেই সভায় যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর জেলার জ্ঞানী-গুণী ও বিশিষ্ট নমশূদ্রগণ একত্রে মিলিত হওয়ার সুযোগ পান। জীবন জোদ্দার সেখানে উপস্থিত হয়ে বিষয়টি সভায় তুলে ধরেন। এহেন অপমানজনক অভিযোগ সভাস্থ নমশূদ্রদের আত্মসম্মানে আঘাত হানে। এর প্রতিকারে প্রয়োজনীয় শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করে সদুত্তর প্রদানের উদ্দেশ্যে জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি সময়ে তারা একটি কমিটি গঠন করেন।

কমিটির সদস্যবৃন্দ নম জাতির শাস্ত্রীয় ইতিহাস অন্বেষণ শুরু করেন। চার মাস পার হয়ে যায়। কিন্তু প্রচলিত কোনো শাস্ত্রের মধ্যে তারা নমশূদ্রদের কোনো কথা খুঁজে পান না। অনন্যোপায় হয়ে তখন তারা গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দী গ্রামের মহামানব শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের (১৮৪৬-১৯৩৬) শরণাপন্ন হন। ঠাকুরের বয়স তখন ৪২ বছর।

প্রচলিত শাস্ত্রাদিতে নম জাতির কথা না থাকার কারণ কী?

এর উত্তর গুরুচাঁদ ঠাকুর জানতেন। তিনি জানতেন, কোথায় কোন গ্রন্থে এই তত্ত্ব লিখিত আছে। শাস্ত্রীয় পরিচয় জেনে নমশূদ্ররা তার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করুক এটা ছিল তার অন্তরের অভিলাষ। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। খুশি হয়ে তিনি প্রচলিত শাস্ত্রাদিতে নম জাতির কথা লিখিত নাই কেন, কেন তাদের চণ্ডাল খেতাব হয়েছে, এতে রাজা বল্লাল সেনের ভূমিকা কী-ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে তাদেরকে জানান।

গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে তখন কমিটির সদস্যরা ফরিদপুরের অন্তর্গত মল্লিকপুর নিবাসী সংস্কৃতজ্ঞ সুপণ্ডিত শ্রী শ্যামাচরণ তর্কালঙ্কারের নিকট যান। তিনি ‘শক্তিসংগম তন্ত্র’ নামক একখানা অতি পুরাতন সংস্কৃত তন্ত্রগ্রন্থ বের করে তাদের দেখান। গ্রন্থখানি ৬৪ অধ্যায়ে বিভক্ত। তার মধ্যে ‘প্রাণতোষী’ নামক অধ্যায়ে ‘হর-পার্বতী সংবাদ’-এ শিব (হর) ও পার্বতীর কথপোকথনের মাধ্যমে নম জাতির উৎপত্তি ও বংশ বিস্তারের বিবরণ আছে। গ্রন্থখানি এত পুরাতন ছিল যে, তার পাতাগুলি তখন পচে খসে পড়তে শুরু করেছে। পণ্ডিত শ্রী শ্যামাচরণ তর্কালঙ্কার অতি যত্নের সাথে ঐ পুরাতন গ্রন্থ থেকে সংশ্লিষ্ট অংশ বঙ্গানুবাদ করে তাদেরকে দেন। আনন্দচিত্তে তারা স্বজাতির উৎপত্তি-তত্ত্ব নিয়ে শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের নিকট অর্পণ করেন।

ছয় মাস পর কমিশনার মহোদয় উন্নয়ন কমিটির সভা ডাকেন। জীবন বাবু দেশের বিশিষ্ট নমশূদ্রদের সাথে নিয়ে সভায় উপস্থিত হন। সেদিন আরও অনেক কৌতূহলী মানুষ সভায় এসে ভিড় করেছিলেন। কমিশনার মহোদয়ের অনুমতি নিয়ে জীবন জোর্দ্দার-এর পরিবর্তে খুলনার সাচিয়াদহ গ্রামের শ্রী উমাচরণ বিশ্বাস উপস্থিত সকলকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে অভিযোগের উত্তরে সেদিন বলেছিলেন–

“আমরা নম জাতি। মহামুনি নমস মুনির বংশধর। নমস মুনি ছিলেন ব্রহ্মজ্ঞাণী ব্রাহ্মণ। নমস মুনির সন্তানেরা শূদ্রকন্যা বিবাহ করে তাতে যে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন, নমস মুনির স্মরণে ও শূদ্রা মাতার কারণে তারা নমশূদ্র নামে খ্যাত হয়। শূদ্ৰাজাত হলেও পিতৃসূত্রে আমরা ব্রাহ্মণ। মহামুনি নমস-এর পিতা ছিলেন কশ্যপ। তাই আমাদের গোত্রের নামও কাশ্যপ গোত্র। ব্রাহ্মণের ঔরসে শূদ্ৰাজাত সম্প্রদায়ও শাস্ত্রমতে ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচিত। সেজন্যে শৌচ-অশৌচ, শ্রদ্ধ-বিবাহ, পূজা-পার্বণ ইত্যাদি সর্বপ্রকার বৈদিক ক্রিয়াকর্মে আমাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ-আচার বিদ্যমান আছে। ১০ দিনে আমাদের অশৌচান্ত, এটা ব্রাহ্মণের রীতি। আমরা সামবেদী।

নমশূদ্র জাতখ্যাতঃ সম্প্রদায় সামবেদাধিকারী।
দশদিশাবধ্য শৌচ পালনং পুরুষানুক্রমেণ আচাৰ্যতে।
তীর্থে প্রবাসে গৃহবাসে চ শ্রাদ্ধাদি কার্যার্থে।
তেন পক্কান্ন পিণ্ডদানং বিধি দৃশ্যতে।
(দোহাকোষ পঞ্জিকা)

বৈদিক বিধি অনুযায়ী আমরা শ্রাদ্ধকার্য সুসম্পন্ন করি এবং গয়াক্ষেত্রে অন্নের পিণ্ড দান করি। এগুলোও ব্রাহ্মণের রীতি। বিবাহে আমরা প্রজাপত্য রীতি অনুসরণ করি এবং কুশণ্ডিকা করি, এ-ও ব্রাহ্মণের রীতি।

পূর্বকালে আমাদের পূজা-পার্বণ আমরা নিজেরাই করতাম। বর্তমানে চক্রবর্তীরা এবং কিছু কিছু মুখোপাধ্যায়ও পুরোহিত হিসেবে আমাদের এসব ‘ কার্য সম্পাদন করে থাকেন। আমাদের ধোপা লাগে না, আমরা নিজেরাই আমাদের বস্ত্র পরিষ্কার করি। নিজেদের মধ্যে হতে আমরা নাপিত শ্রেণি সৃষ্টি করে নিয়েছি।

আমাদের প্রধান জীবিকা কৃষি। তবে বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় যাবতীয় কর্মে আমরা সমর্থক। চাকরিকে আমরা চাকরিগিরি মনে করি। কারণ ঐ কাজে অন্যের দাসত্ব স্বীকার করতে হয়।

আমরা চণ্ডাল নই। জন্ম বা কর্ম কোনো সূত্রেই চণ্ডাল নই। শূদ্র পিতার ঔরসে ব্রাহ্মণী মাতার গর্ভে যারা জন্মগ্রহণ করেন শাস্ত্রমতে তাদেরকে চণ্ডাল বলা হয়। নম জাতির জন্ম তার বিপরীত। নম জাতির জন্ম ব্রাহ্মণ পিতার ঔরসে শুদ্র মাতার গর্ভে। চণ্ডালের জীবিকা রাজাদেশে বধ্য ব্যক্তির বধ সাধন এবং শবদাহকরণ। আর নমদের জীবিকা কৃষিকর্ম, যা মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়রূপে সর্বজনস্বীকৃত।

বঙ্গের রাজা বল্লাল সেন মজাতির উপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাদেরকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যে তাদের উপর চণ্ডাল অপবাদ আরোপ করেছিলেন এবং শাস্ত্রাদি হতে তাদের নাম তুলে দিয়ে শাস্ত্রাদির নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন। যার ফলে প্রচলিত গ্রন্থাদির মধ্যে নমজাতির কথা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। নমজাতিকে তাই আজও কেউ কেউ চণ্ডাল মনে করে থাকেন। কিন্তু এরূপ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এবং অজ্ঞতাপ্রসূত। শক্তিসংগম তন্ত্র’ গ্রন্থে হর ও পার্বতীর কথপোকথনের মধ্যে দিয়ে নমজাতির উক্তরূপ উৎপত্তির কথা বর্ণিত আছে। ফরিদপুরের পণ্ডিত শ্রী শ্যামাচরণ তর্কালংকারের নিকট আমরা এই গ্রন্থ প্রাপ্ত হয়েছি এবং ঐ পণ্ডিতের দ্বারা আমরা ঐ গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ করিয়ে এনেছি। এই দেখুন সেই বঙ্গানুবাদ।”

এই কথা বলে শ্রী উমাচরণ বিশ্বাস পকেট হতে বঙ্গানুবাদ বের করে সভায় তুলে ধরেন। এবং তা থেকে কিয়দংশ সকলকে পাঠ করে শোনান। শ্যামাচরণ তর্কালঙ্কার ছিলেন ঐ সময়ের বাংলার অন্যতম বিখ্যাত পণ্ডিত। তাই শ্যামাচরণ পণ্ডিতের ঐ বঙ্গানুবাদ দেখে তারা আর কোনো আপত্তি তোলার সুযোগ পাননি। জীবন বাবুর সম্মানও বজায় থাকে।

জীবন বাবুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহাত্মা শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের আশীর্বাদে এমনিভাবে নমজাতির শাস্ত্রীয় ইতিহাস উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

হর-পার্বতীর কথোপকথন অংশটুকু নিম্নরূপ :

পার্বতী : হে দেব, ঐ যে দুইজন কদাকার ব্যক্তি তোমার সঙ্গে শ্মশানে মশানে ঘুরিয়া বেড়ায় ও তোমার পরিচর্যা করে, উহারা কাহারা? ঐরূপ হীণ ব্যক্তিদের তুমি এত প্রশ্রয় দাও কেন?

শিব : দেবী! উহারা হীন নহে। উহারা পরহিত-তে উৎসাহী দুইজন গৃহত্যাগী ব্রাহ্মণ, নাম আম্মার ও নৈধুব। আমি উহাদের বড় ভালোবাসি। উহারা বহু ক্লেশ ও শ্রম স্বীকার করিয়া দুইটি ব্রাহ্মণ শিশুকে বাঁচাইয়া তুলিয়াছে।

পার্বতী : হে দেব! কোন্ ব্রাহ্মণ শিশুদ্বয়কে উহারা বাঁচাইয়া তুলিয়াছে?

শিব : মহামুনি কশ্যপ, যিনি ব্রহ্মা-নন্দন মরীচির পুত্র, তাহার ঔরসে প্রধা নামক স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন মুনিবর নমস। বাল্যকাল হইতেই নমস ছিলেন ধ্যান-যোগাদিতে মগ্ন। আন্সার ও নৈধুব যাহাদের আমি আমার নিকট আশ্রয় দিয়াছি, তাহারা ঐ কশ্যপ মুনির প্রিয় শিষ্য এবং মুনিবর নমস-এর যজ্ঞসঙ্গী। কালক্রমে ব্ৰহ্মার মানস পত্র রুচির পরমাসুন্দরী নন্দিনী সলোচনা সতাঁকে বিবাহ করিয়া মুনিবর নমস তাহার যজ্ঞসঙ্গী আপ্সার ও নৈধুব-সহযোগে পরম সুখে মথুরায় বসবাস করিতে থাকেন। কিন্তু সংসারের আকর্ষণ মুনিবর নমসকে বেশিদিন বাঁধিয়া রাখিতে পারে না। সুলোচনা সতী যখন ছয় মাসের সন্তানসম্ভবা, তখন যজ্ঞসঙ্গী আন্সার ও নৈধুবর উপর সুলোচনার দেখাশুনার দায়িত্ব অর্পণ করিয়া নমস মুনি তপস্যার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগী হন এবং চতুর্দশ বৎসরের মধ্যে আর স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন না।

পার্বতী : তারপর কী হইল, দেব?

শিব : অতঃপর সুলোচনা সতী যথাকালে দুইটি যমজ পুত্র কীর্তিবান ও উরুবানকে প্রসব করিয়া মাত্র ছয় মাস পরে মৃত্যুবরণ করেন। তখন ঐ মাতৃহারা শিশুদ্বয়কে লইয়া আল্লারা ও নৈব নিদারুণ দায়ে পড়ে এবং অতি যত্নে তাহাদের প্রতিপালন করিতে থাকে।

পার্বতী : অতি চমৎকার কথা। কিন্তু ঐরূপ দুগ্ধপোষ্য শিশুদের তাহারা কেমন করিয়া বাঁচাইয়া রাখিল, দেব?

শিব : সেই জন্যই তো দেবী, আর ও নৈধুব আমার নিকট এত প্রিয়। তাহারা অতি দরিদ্র, মুনিপুত্র প্রতিপালন করিবার মতো সঙ্গতি তাহাদের ছিল না। তাই কভু সর্প খেলা দেখাইয়া, কভু ভিক্ষাবৃত্তি করিয়া অর্জিত অর্থে বহু ক্লেশে তাহারা শিশুদ্বয়কে বাঁচাইয়া রাখে। এতদ্ভিন্ন তাহাদের নানা জ্ঞানে জ্ঞানবান করিয়া তোলে।

পার্বতী; কিন্তু দেব! কীর্তিবান ও উরুবানকে পরিত্যাগ করিয়া তাহারা তোমার কাছে আশ্রয় লইল কেন?

শিব : বিধির নিবন্ধ, খণ্ডাইবে কে! তপস্যার তরে নমস মুনি সেই যে গৃহত্যাগী হন, চতুর্দশ বৎসরের মধ্যে আর তিনি প্রত্যাবর্তন করেন না। অতঃপর চতুর্দশ বৎসর অতিক্রান্ত হইয়া গেলে অকস্মাৎ কোনো একদিন মুনিবর স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া সুদর্শন সদাচারী পুত্রদ্বয়কে দেখিয়া অত্যন্ত প্রীত হন। পুত্রদ্বয়ের বয়স তখন কিঞ্চিদধিক চতুর্দশ বছর, অথচ তখনও তাহাদের উপনয়ন হয় নাই। নমস মুনি তখন পুত্রদের উপনয়ন সংস্কারের জন্যে ব্রাহ্মণের দ্বারস্থ হন। কিন্তু বয়ঃসীমা চতুর্দশ বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ায় কেহই উপনয়ন সংস্কারে স্বীকৃত হন না। পুত্রদের উপনয়ন সংস্কারে ব্যর্থ হইয়া মুনিবর নমস মনে অত্যন্ত দুঃখ পান এবং পুত্রদের সদগতি কামনায় নির্জন পর্বত-কন্দরে শ্রীহরির আরাধনায় নিমগ্ন থাকিতে পুনরায় গৃহত্যাগী হন। পিতৃদেবের এই অকস্মাৎ অন্তর্ধানে পুত্ররা অত্যন্ত বিচলিত হইয়া ওঠে এবং শীঘ্রই পিতৃদেবের প্রত্যাগমন না হওয়ায় পিতার সন্ধান অভিলাষে পুত্ররাও গৃহত্যাগী হয়। মথুরার শূন্য গৃহ তখন আপ্সার ও নৈধুবর নিকট দুঃসহ হইয়া ওঠে। মনের দুঃখ নিবারণের জন্য তখন তাহারা আমার নিকট আসিয়া আশ্রয় লয় এবং তদবধি তাহারা আমার নিকটেই আছে।

পার্বতী : কীর্তিবান ও উরুবান কোথায় গেল, দেব?

শিব : পিতার সন্ধান অভিলাষে গৃহত্যাগী হইয়া বহু জনপদ পরিভ্রমন করিতে করিতে পরিশেষে শিলিগুড়ি অঞ্চলে গিয়া সীমন্ত নামক জনৈক শুদ্র রাজার রাজ্যে তাহারা উপনীত হয়। রাজা সীমন্ত এই সুদর্শন যুবকদ্বয়কে দেখিয়া অতি সমাদরে তাহাদের আশ্রয় দেন এবং আপন কন্যা পরমা সুন্দরী শিপিকা ও সপত্রিকাকে তাহাদের সহিত বিবাহ দেন।

পার্বতী : অত্যন্ত আনন্দের কথা, তাহার পর কী হইল?

শিব : জ্যেষ্ঠপুত্র কীর্তিবানের স্ত্রী হয় জ্যেষ্ঠাকন্যা শিপিকা এবং উরুবানের স্ত্রী হয় সপত্রিকা। সীমন্ত রাজার জামাতা হইয়া, রাজ্যের বিস্তৃত ভূ-খণ্ডের অধিকারপ্রাপ্ত হইয়া এবং সুপবিত্র কৃষিকাজকে জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করিয়া কীর্তিবান ও উরুবান অতি আনন্দে সেই রাজ্যে বসবাস করিতে থাকেন।

পার্বতী : তাহাদের সন্তানাদির নাম কী, দেব?

শিব : কীর্তিবানের তিন পুত্র-অভিরাম, নন্দরাম ও লালচাঁদ এবং দুই কন্যা–অমলা ও বিমলা। উরুবানের দুই পুত্র-ধনঞ্জয় ও বীরলাল এবং এক কন্যা-মালাবতী। কালক্রমে তাহাদের সন্তানেরা বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে অসমঞ্জের পুত্রকন্যাদের সহিত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং ক্রমান্বয়ে তাহাদের বংশ বিস্তার লাভ করিতে থাকে।

পার্বতী : অসমঞ্জ কে, প্রভু?

শিব : অযোধ্যার সূর্য বংশের সুবিখ্যাত রাজা সাগরের জ্যেষ্ঠপুত্ৰ অসমঞ্জ। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ এবং ভগবদ ভক্ত। রাজপুত্র হওয়া সত্ত্বেও রাজকার্যের প্রতি কোনোরূপ আকর্ষণ তাহার ছিল না। ফলে রাজা সাগর তাহাকে রাজপুরী হইতে বহিষ্কার করিয়া দেন। পিত বিতাড়িত অসমঞ্জ সস্ত্রীক গৃহত্যাগী হইয়া ক্রমে সীমন্ত রাজার রাজ্যে গিয়া পুনরায় গৃহবাস শুরু করেন। তাহাদের গৃহে ক্রমে পাঁচ কন্যা ও তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করে। কন্যাদের নাম: শ্যামা, রমা, বামা, চিত্রা ও রাসেশ্বরী। পুত্রদের নাম: বেত্র, পদ্ম ও বীরধ্বজ। পুত্র-কন্যাদের পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করাইবার পর কীর্তিবান, উরুবান ও অসম পরস্পরের সন্নিকটে অবস্থিতি করিয়া সানন্দে নিজ নিজ সংসার ধর্ম প্রতিপালন করিতে থাকেন।

পার্বতী : হে দেব! সন্তানদের সদগতি কামনায় নমস মুনি সেই যে তপস্যা করিতে বাহির হন, তাহার সেই তপস্যার সুফল কি হয়?

শিব : হ্যাঁ দেবী! নমসের আরাধনায় সুফল হয়। সন্তানদের শুভ কামনায় একাগ্র চিত্তে তিনি পরমব্রহ্মের যে একনিষ্ঠ আরাধনা করেন, তাহাতে তুষ্ট হইয়া পরমদেব নারায়ণ একদিন ভক্তবর নমসের সামনে আবির্ভূত হন এবং ভক্তকে বর প্রার্থনা করিতে বলেন। ভক্ত নমস তখন তাঁর নিকট একে একে তিনটি বর প্রার্থনা করেন।

পার্বতী : কী কী বর প্রার্থনা করেন?

শিব : নমসের প্রথম প্রার্থনা : আমার পুত্রদের বংশ যেন প্রকৃত ব্রাহ্মণ সম হয়। দ্বিতীয় প্রার্থনা : আমার পুত্রদের বংশ যেন আমার নামেই খ্যাত হয়। তৃতীয় প্রার্থনাঃ আমার নাম যেন কালজয়ী হয়।

পার্বতী: নমসের প্রার্থনা কি পূর্ণ হয়, দেব?

শিব : হ্যাঁ দেবী! দেবোত্তম নারায়ণ বাঞ্ছাকল্পতরু। ব্রহ্মোপাসক নমসের সাধনায় প্রীত হইয়া তাহাকে আশীর্বাদ করিয়া তিনি কহিলেন–তথাস্তু।

প্রথম বর: তোমার সন্তানদের জন্যে তুমি অকারণ দুঃখ করিও না। উপনয়ন ব্রাহ্মনত্বের হেতু নয়। ব্রহ্মকে জানিয়া ব্রাহ্মণ হইতে হয়। তোমার বংশ প্রকৃত ব্রাহ্মণ-সম থাকিবে। সর্ব প্রকার বেদাচার ও ব্রাহ্মণাচারে তাহারা অধিকারী। সর্বপ্রকার হোম, যজ্ঞ, পূজার্চনা নিজেরাই করিতে পারিবে এবং এই বংশেই কালে অনেকেই প্রকৃত ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করিবে।

দ্বিতীয় বর : তোমার বংশ তোমার নামেই খ্যাত হইবে। তোমার সন্তানেরা শূদ্রা বিবাহ করিয়াছে, তজ্জন্যে তোমার নমস নামে শূদ্র যুক্ত হইয়া এই বংশ নমশূদ্র নামে খ্যাত হইবে।

তৃতীয় বর : তোমার নাম কালজয়ী হইবে। তোমার ভবিষ্যৎ বংশধরদের চরিত্ৰ-মহিমা ও কীর্তি-গৌরবে তোমার নামের মহিমা জগতে ক্রোমোজ্জল হইবে।

এইরূপ তিনটি বরে নমসের মনষ্কামনা পূর্ণ করিয়া নারায়ণ অন্তর্হিত হইলেন।

পার্বতী : হে দেব! সন্তানদের সাথে নমসের কি আর সাক্ষাৎ হয়?

শিব : হ্যাঁ দেবী! মুনিবর ধ্যানস্থ হইয়া সন্তানদের অবস্থান জানিতে পারেন এবং সীমন্ত রাজার রাজ্যে গিয়া তাহাদের সহিত মিলিত হন এবং সেখানে স্ত্রী-পুত্রসহ তাহাদের সুখে বসবাস করিতে দেখিয়া অত্যন্ত প্রীত হন।

পার্বতী : হে দেব! বর প্রাপ্তির সংবাদ তিনি কি তাহার সন্তানদের অবহিত করান?

শিব : হ্যাঁ দেবী! সেই কথা বলিবার জন্যই তো মুনিবর নমস তাহার সন্তানদের কাছে ছুটিয়া যান। মুনিবর সকলকে ডাকিয়া সস্নেহে আশীর্বাদ করিয়া বর প্রাপ্তির সকল কথা তাহাদের নিকট ব্যক্ত করেন। আরও বলেন যে, কেবল সংসার লইয়াই মত্ত থাকিও না। পাপ, দোষ, হীনতাদি বর্জন করিয়া উচ্চ আদর্শকে জীবনে গ্রহণ করিও। সংসার ধর্ম প্রতিপালনের মধ্য দিয়া সর্বদা ব্রহ্মের উপাসনা করিও। তবেই শান্তি লাভ করিবে।

পার্বতী : তাহার পর কী হইল, দেব?

শিব : জ্যেষ্ঠপুত্র কীর্তিবানের আলয়ে ছিল শেফালি ফুলের প্রাচুর্য আর কনিষ্ঠ পুত্র উরুবানের আবাসে ছিল ধান্যাদির প্রাচুর্য। তাহা দেখিয়া নমস মুনি জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্রকে যথাক্রমে শেফালি ও ধানী আখ্যা প্রদান করেন।

পার্বতী : হে দেব! অসমঞ্জের বংশে এইরূপ কোনো খ্যাতি হয় কি?

শিব : হ্যাঁ দেবী, হয়। অসমঞ্জের মধ্যম পুত্র পদ্মকান্তি ছিলেন যশস্বী ও খ্যাতিমান। এই পদ্মের বংশধরেরা পরে পোদ্দ বা পোদ খ্যাতিপ্রাপ্ত হয়। অসমঞ্জের জ্যেষ্ঠ পুত্র বেত্রধরের বংশধরেরা ‘বেত্র-ক্ষত্রিয়’ বা বেত্র-ক্ষত্র নামে খ্যাত হয়। বেত্ৰক্ষত্র ও পোদ জাতি একই বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয় জাতি, সূর্য বংশীয় রাজপুত্র অসমঞ্জের বংশধর।

পার্বতী : হে দেব! জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি নমস মুনি কি তাহার সন্তানদের নিকটেই অতিবাহিত করেন?

শিব : না। মুনিবর নমস ছিলেন নির্জন সাধনায় অভ্যস্ত। সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশ্বস্ত হওয়ার পর জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি নির্জন পর্বত-কন্দরে অবস্থিতি করিয়া ঈশ্বরোপসনায় অতিবাহিত করিবার অভিলাষে মুনিবর নমস্ একদিন পুত্র-প্রপৌত্রগণকে সস্নেহে আশীর্বাদ করিয়া হরিগুণগান কীর্তন করিতে করিতে পুনরায় বনে গমন করেন।

পরিশিষ্ট-২ : নমশূদ্ৰ না নম জাতি!

স্বয়ং ব্রহ্মার মানস-নন্দন মরীচি। তাঁর পুত্র মহামুনি কশ্যপ। তার পুত্র মুনিবর নমস। নমস মুনির নামে পরিচিত ছিল তার বংশধর নম জাতি হিসেবে।

নমস মুনি ছিলেন ব্রহ্মজ্ঞাণী ব্রাহ্মণ। অতি পুরাতন সংস্কৃত তন্ত্রগ্রন্থ ‘শক্তিসংগম তন্ত্র’-এর ‘প্রাণতোষী’ নামক অধ্যায়ের বক্তব্য অনুযায়ী নমস মুনির সন্তানেরা শুদ্রকন্যা বিবাহ করেছিলেন। তাদের সন্তান-সন্ততিরা নমস মুনির স্মরণে ও শুদ্ৰা মাতার কারণে নমশুদ্র নামে খ্যাত হয়।

শাস্ত্রমতে বংশধারা রক্ষিত হয় পুরুষানুক্রমে পিতার পরিচয়ে। সে হিসাবে নমশূদ্ররা পিতৃসূত্রে ব্রাহ্মণ। মহামুনি নমস-এর পিতা ছিলেন কশ্যপ। তাই নমশূদ্রদের গোত্রের নাম কাশ্যপ গোত্র। ব্রাহ্মণদের একটি বড় অংশের গোত্রের নামও কাশ্যপ গোত্র। শুধু তা-ই নয়, শৌচ-অশৌচ, শ্রাদ্ধ-বিবাহ, পূজা-পার্বণ ইত্যাদি সর্বপ্রকার বৈদিক ক্রিয়াকর্মে নমশূদ্র এবং ব্রাহ্মণরা একই আচার অনুষ্ঠান অনুসরণ করে থাকে। যেমন–দশ দিনে অশৌচান্ত শুধুমাত্র নমশূদ্র এবং ব্রাহ্মণরা পালন করে। অন্যরা কেউ এক মাস, কেউ একুশ দিন। কেউবা পনেরো দিন। নমশুদ্ররা সামবেদী। ব্রাহ্মণরাও তাই।

বৈদিক বিধি অনুযায়ী নমশূদ্ররা শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন করে এবং গয়াক্ষেত্রে অন্নের পিণ্ড দান করে। ব্রাহ্মণরাও তাই করে। ব্রাহ্মণ রীতি অনুযায়ী নমশূদ্ররা বিবাহে প্রজাপত্য রীতি অনুসরণ করে এবং কুশণ্ডিকা করে।

পূর্বকালে নমশূদ্ররা নিজেদের পূজা-পার্বণ নিজেরাই করত। তাদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। যা ছিল তখন মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে সর্বজনস্বীকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। তবে রাজ দরবারের দাপ্তরিক কাজে নিয়োজিত ছিল অনেকে। একটি বড় অংশ লেখাপড়ার কাজেও যুক্ত ছিল।

নমস মুনির নিবাস ছিল মথুরা। মথুরা থেকে শিলিগুড়িতে সীমন্ত রাজার রাজ্য পর্যন্ত নমস মুনির সন্তানদের আগমনের যোগসূত্র পাওয়া যায়। পিতার খোঁজে বের হয়ে নমস মুনির দুই পুত্র কীর্তিবান ও উরুবান ঘুরতে ঘুরতে একদিন শিলিগুড়িতে সীমন্ত নামক শূদ্র রাজার রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হন। সীমন্ত রাজার কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। রাজার দুই কন্যাকে দুই-ভাই বিয়ে করে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

নমস মুনির পুত্রদের ঔরসে এবং শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভে যেসব সন্তান জন্মগ্রহণ করেন, তারাই কালের প্রবাহে ‘নমশুদ্র’ নামে খ্যাত হয়ে শিলিগুড়ি এলাকায় বংশ বিস্তার করতে থাকে।

কিন্তু শিলিগুড়ি থেকে এই ব-দ্বীপ বঙ্গে নমজাতির আগমন কীভাবে সে ইতিহাস জানা যায় না। তবে অনুমান করা যায়, সময়ের সাথে সাথে জনসংখ্যা বেড়ে যাবার কারণে জীবিকার অন্বেষণে নমস মুনির বংশধররা শিলিগুড়ি থেকে এগোতে এগোতে চলে আসে বরেন্দ্র অঞ্চলে। সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে এসে থিতু হয় উর্বর নরম পলিমাটির দেশে। শিক্ষা এবং যোগ্যতাবলে তারা এই বাংলার বিভিন্ন রাজার দরবারে লেখাপড়ার কাজ জুটিয়ে নিতে সক্ষম হয়।

মজাতির নমশূদ্র হিসাবে পরিচিত হবার কারণ, শাস্ত্রের বর্ণনার সাথে ইতিহাসের বর্ণনা মেলে না।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই বঙ্গের রাজা বল্লাল সেন অত্যাচারী ও ব্যভিচারী দুটোই ছিলেন। তার রাজত্বকালে (খ্রি. ১১৫৬-১১৭৮) এক ডোমকন্যাকে (মতান্তরে বেশ্যা) বিয়ে করেন তিনি। সে সময়ে অসবর্ণ বিয়ে গ্রহণযোগ্য ছিল না। রাজার ভয়ে সবাই সেই বিয়েকে শাস্ত্রসম্মত বলে মত দেন। কিন্তু নম জাতি তার বিরোধিতা করে। অন্য এক সূত্রে জানা যায়, রাজা বল্লাল সেনের ঔরসে দাসীর গর্ভে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সে সময়ে শত দাসী ভোগ করায় এবং দাসীর গর্ভে সন্তান উৎপাদনে দোষ ছিল না। কিন্তু শাস্ত্রমতে সেই সন্তান পিতার উত্তরাধিকারী হতে পারত না। কিন্তু বল্লাল সেন সেই সন্তানকে তার উত্তরাধিকারী করার পক্ষে সম্মতি আদায়ের জন্য সবাইকে এক ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু নম ও পারশবরা সেই সভায় যোগদান করেন না। অন্যদিকে, বল্লাল সেন তার সকল কর্মে সমর্থনলাভের উদ্দেশ্যে কৌলীন্য প্রদানের নামে একটি তোষামোদকারী কায়স্থ শ্রেণি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। কুল গ্রহণের সেই অনুষ্ঠানও নমরা বয়কট করে।

ক্ষিপ্ত হয়ে বল্লাল সেন নমজাতিকে অবাধ্য, নিকৃষ্ট ও চণ্ডালতুল্য জাতি হিসেবে ঘোষণা করেন। সরকারি চাকরিতে তাদের নিয়োগ বন্ধ করে দেন। নগর-বন্দর থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করেন। ঘোষণা দেন, জনপদে যেখানে নমদের পাওয়া যাবে, সেখানেই সৈন্যরা তাদের কোতল করবে। এতেও রাজরোষ মেটে না। যেসব শাস্ত্রে নমজাতির কথা লিখিত আছে, সেসব শাস্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়। শুদ্ৰ গণ্য করে ভদ্রসমাজে তাদের ওঠাবসা, শিক্ষা-দীক্ষা বন্ধ করে দেয়া হয়। অত্যাচারে জর্জরিত নমজাতি লোকালয় থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং বন-জঙ্গল, হাওড়-বিল, জলাভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পেটের তাগিদে বন-জঙ্গলের ভিতরে জলাভূমির কিনারে আবাদ শুরু করে। গড়ে তোলে বসতি। হয়ে যায় পুরোপুরি কৃষক। সময়ের সাথে সাথে বংশ বিস্তার হয়। বিস্তৃত হতে থাকে বসতি। এ কারণেই নমশূদ্রদের বাস প্রত্যন্ত বিল এলাকাজুড়ে গ্রামের পর গ্রাম।

সেই থেকে নমজাতি এই বাংলায় পরিচিত হয়ে আসছে ঘণ্য, অস্পৃশ্য শূদ্র হিসাবে।

পরিশিষ্ট-৩ : যুক্তির নিরিখে নমশূদ্র-ইতিহাস

স্বয়ং ব্রহ্মার মানস-নন্দন মরীচির পুত্র মহামুনি কশ্যপ। তার পুত্র মুনিবর নমস। নমস মুনির বংশধর নমশূদ্ররা।

নমস মুনির পিতৃদেবের নাম অনুযায়ী নমশূদ্রদের গোত্রের নাম কাশ্যপ। তার দুই যমজ পুত্র কীর্তিবান ও উরুবান। তাদের বাস ছিল মথুরায়। এ পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই। মা সুলোচনা দেবী সন্তান প্রসবের ছয় মাসের মাথায় মারা গেলেন। মাতৃহারা শিশুদের প্রতিপালন করে আল্লারা ও নৈব নামে দুইজন ব্রাহ্মণ। যারা ছিলেন কশ্যপ মুনির প্রিয় শিষ্য এবং মুনিবর নমস-এর যজ্ঞসঙ্গী।

কিন্তু প্রশ্ন হল–

১. আপ্সারা ও নৈধ্রুব দুইজনই ব্রাহ্মণ এবং নমস মুনির যজ্ঞসঙ্গী ছিলেন। তারা কীর্তিবান ও উরুবানকে লেখাপড়া শেখাল, জ্ঞানবান করল, কিন্তু তাদের উপনয়ন সংস্কার করাল না। আল্লারা ও নৈব ব্রাহ্মণ হয়েও জানত না যে, চৌদ্দ বছর বয়স পার হওয়ার আগেই ব্রাহ্মণ সন্তানের উপনয়ন করাতে হয়– এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

যুক্তিসঙ্গত হতে পারত যদি ঘটনাটি এমন হয়–

আপ্সারা ও নৈধ্রুব প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ ছিল না। ছিল শুদ্র। কারণ, ব্রাহ্মণ হলে সেই সময়ে শিশু দুটির ভরণপোষণের জন্য তারা সাপ খেলা দেখানো বা ভিক্ষাবৃত্তি করত না। ব্রাহ্মণের স্বাভাবিক পেশা পুজা-অর্চনা বা শিক্ষকতা, এসবের মধ্যেই থাকত। শিশু দুটির উপনয়ন সংস্কারের কথাও তাদের মনে থাকত। শূদ্র ছিল বলেই যথাসময়ে উপনয়নের কথা তাদের মাথায় আসেনি। ছেলে দুটি শূদ্রের হাতে খেয়েছে, শূদ্রের কাছে মানুষ হয়েছে, সে কারণে সমাজের ব্রাহ্মণরা তাদের উপনয়ন সংস্কার করাতে রাজি হননি।

প্রশ্ন-২. তারপর কীর্তিবান ও উরুবান পিতার সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে শিলিগুড়িতে সীমন্ত রাজার কাছে আশ্রয় পেলেন। রাজার দুই মেয়েকে বিয়ে করে সুখে সংসার করতে লাগলেন। তাদের সন্তান-সন্ততি হল। সীমন্ত রাজা ছিলেন শূদ্র।

এখানে প্রশ্ন ওঠে, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে কোনো শূদ্রের পক্ষে রাজা হওয়া বা রাজকার্য পরিচালনা করা সম্ভব ছিল কি না? অন্যদিকে কীর্তিবান ও উরুবান এর স্ত্রী শিপিকা ও সপত্রিকা দুজনই ছিলেন পরমা সুন্দরী। শাস্ত্রে তৎকালীন শূদ্রের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে শূদ্রা নারীদের পরমাসুন্দরী হওয়ার কথা নয়।

।যুক্তিসঙ্গত হতে পারত যদি ঘটনাটা এমন হয়–

সীমন্ত রাজা শুদ্র ছিলেন না। তখন যোদ্ধা জাতি হিসেবে ক্ষত্রিয়রা রাজ্য শাসন করতেন। সীমন্তও ছিলেন সেরকম একজন ক্ষত্রিয় রাজা। তা যদি না হতো, ক্ষত্রিয় রাজা সাগর-পুত্র অসমঞ্জ এখানে কোনোভাবেই আশ্রয় নিতে পারতেন না। ছেলের কর্মকাণ্ড পছন্দ না করলেও প্রতাপশালী রাজা সাগর সামাজিক কারণে কিছুতেই ছেলেকে শূদ্রের আশ্রয়ে থাকতে দিতেন না। সুতরাং শূদ্রা কন্যা বিয়ে করে নয়, নমস মুনির ছেলেরা সমাজে পতিত হয়েছিলেন . তাদের উপনয়ন সংস্কার না হওয়াতে।

কারণ, ব্রাহ্মণের মূল স্রোত থেকে বিচ্যুত হয়ে তাদের পরিচিতি হয়েছিল দেবল ব্রাহ্মণ হিসেবে। নমস মুনি এটা মেনে নিতে পারেননি। তাই যৌক্তিক হয়, পিতার দায়িত্ব পালনে সন্তানদের ফেলে তপস্যা করতে নয়। মনের দুঃখে দুই সন্তানসহ নমস মুনি দেশ ত্যাগ করে শিলিগুড়িতে চলে গিয়েছিলেন এবং সীমন্ত রাজার দেশে গিয়ে স্থিতি হয়েছিলেন।

উপনয়ন না হওয়াতে কোনো ব্রাহ্মণ পরিবারই নমস মুনির ছেলেদের সাথে তাদের কন্যা বিয়ে দিতে রাজি হননি। সে কারণেই ক্ষত্রিয় সীমন্ত রাজার দুই কন্যাকে বিয়ে করেন তারা। একইভাবে তাদের সন্তানদের বিয়ে হয় ক্ষত্রিয় অসমঞ্জ-এর কন্যাদের সাথে।

তাহলে শূদ্র শব্দের যোগসূত্র কী?

একটা হতে পারে, শুদ্রদের কাছে নমস মুনির সন্তানরা প্রতিপালিত হয়েছে সে কারণে অথবা শূদ্ররা তার সন্তানদের মানুষ করেছে বলে কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে নমস মুনি শূদ্রদের জীবনধারা সংস্কারে ব্রতী হন। সেটাই হয় তাঁর তপস্যা। নমস-এর সাথে সবাই তাই শূদ্রকে পরিপূরক হিসেবে ধরে নমস মুনির বংশধরদের নমশূদ্র বলে অভিহিত করতে থাকেন।

অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, নমশূদ্রদের শ্রাদ্ধ, বিবাহ, আচার অনুষ্ঠান সবই ব্রাহ্মণদের অনুরূপ। এতে বোঝা যায়, ব্রাহ্মণদের জীবনধারাই তারা অনুসরণ করে আসছিলেন। তবে নমস মুনির বংশধর হিসেবে নম নামেও তাদের পরিচিতি ছিল।

মথুরা থেকে শিলিগুড়িতে সীমন্ত রাজার রাজ্য পর্যন্ত নমস মুনির সন্তানদের আগমনের ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্তু শিলিগুড়ি থেকে এই ব-দ্বীপ বঙ্গে নমজাতির আগমনের যোগসূত্র বের করা সম্ভব হলে জনপদের বাইরে শ্বাপদ শংকুল বন-জঙ্গলে, বসবাসের অযোগ্য জলাভূমিতে বসতি স্থাপনের কারণ খুঁজে বের করা সহজ হতো।

ধরে নেয়া যায়, সময়ের সাথে সাথে জনসংখ্যা বেড়ে যাবার কারণে জীবিকার অন্বেষণে নমস মুনির বংশধররা শিলিগুড়ি থেকে বরেন্দ্র এলাকা হয়ে কালক্রমে নরম পলির দেশে এসে থিতু হয়। নিজ যোগ্যতায় তারা এই বাংলার বিভিন্ন রাজার দরবারে লেখাপড়ার কাজে নিয়োজিত ছিল।

ইতিহাস অনুযায়ী, অত্যাচারী রাজা বল্লাল সেন কুপিত হয়ে প্রতিশোধ নেবার মানসে নমজাতিকে অবাধ্য, নিকৃষ্ট ও চণ্ডালতুল্য জাতি হিসেবে ঘোষণা করেন। দেশ থেকে বিতাড়িত করেন। সমস্ত শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে নমজাতির নাম মুছে ফেলেন। শূদ্ৰ গণ্য করে সমাজে তাদের ওঠাবসা, শিক্ষা-দীক্ষা বন্ধ। করে দেয়া হয়। অত্যাচারে জর্জরিত নমজাতি লোকালয় থেকে পালিয়ে বন, জঙ্গল, জলাভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। রাজরোষে এবং রাজদণ্ডে নমজাতির পরিচিতি নতুন করে শুরু হয় নমশূদ্র হিসাবে ১১ শতক থেকে। ইতিহাস আশ্রয়ী বিধায় এই যুক্তির গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি।

প্রশ্ন-৩ : প্রশ্ন হল, রাজা যদি বিয়ে করে, তাহলে কেউ মানুক বা না মানুক ডোমকন্যা বা বেশ্যা হলেও সে রানি। তার জন্য কারো সমর্থন আদায়ের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তখনকার সময়ে অসবর্ণ বিয়ে সমাজে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ফলে রাজার পতিত হয়ে যাবার কথা। শত দাসী ভোগে দোষ ছিল না বিধায় ডোম কন্যা বা বেশ্যাকে বিয়ে না করারই কথা।

বিষয়টা এরকম হলে যৌক্তিক হয়–

দাসীর গর্ভে সন্তান জন্ম দেয়া তখন কোনো দোষণীয় কিছু ছিল না। কিন্তু সেই সন্তান সম্পত্তি বা রাজত্বের উত্তরাধিকারী হতে পারত না। অবৈধ দাসীপুত্রকে শাস্ত্রসম্মতভাবে বৈধ উত্তরাধিকারী করার জন্য রাজা বল্লাল সেন ভোজসভার আয়োজন করেন। নামজাতি তার অন্তরায় হওয়াতে তারা রাজার রোষানলে পড়ে।

ক্ষিপ্ত বল্লাল সেন নমজাতিকে দেশছাড়া করে। ঘোষণা দেয়, নমদের যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানেই তাদেরকে হত্যা করা হবে। তাদের শিক্ষা দীক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়। সব শাস্ত্র থেকে নমজাতির নাম মুছে ফেলা হয়। তাদেরকে শূদ্র গণ্য করে নতুন শাস্ত্র রচনা করে। অত্যাচারে জর্জরিত নমরা বন-জঙ্গল, হাওড়-বিল, জলাভূমিতে পালিয়ে বেড়াতে থাকে। বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে ক্রমে সেখানেই তারা বসতি গড়ে তোলে। জীবন-জীবিকার তাগিদে চাষাবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জ্ঞানার্জনের সময় আর থাকে না তাদের। কালের বিবর্তনে একদিন তাই অশিক্ষিত জাতিতে পরিণত হয় নমজাতি বা নমশূদ্ররা…

পরিশিষ্ট-৪ : ‘শিডিউলড কাস্ট’ কী? এর অর্থ কি নমশূদ্র!

অনেকের ধারণা ‘শিডিউলড কাস্ট’-এর বাংলা অর্থ হলো নমশুদ্র। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘শিডিউলড কাষ্ট’ বলে কিছু নেই। আর এর মানে নমশূদ্রও নয়। শিডিউল বাংলা অর্থ হলো তালিকা।

ইংরেজ শাসনামলে ভারতের অধিকারবঞ্চিত হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ড. বি আম্বেদকরের নেতৃত্বে সেই আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। আন্দোলনের ফলে সাম্প্রদায়িক বিভক্তির কারণে পশ্চাৎপদ হিন্দুদের জন্য ভারতের আইন সভায় আসন সংরক্ষণ নীতির প্রচলন হয়। ইংরেজ সরকার রাজনীতিক ও ক্যুনাল এওয়ার্ড হিসেবে প্রতিনিধি নির্বাচনের লক্ষে ভারতের অধিবাসীদের তিনটি গ্রুপে বিভক্ত করে। গ্রুপ তিনটি হল–১. হিন্দু, ২. অনগ্রসর হিন্দু ও ৩. মুসলমান।

১ এবং ৩ নং গ্রুপে অগ্রসর হিন্দু এবং মুসলমানের তালিকায় কারা থাকবে তা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ২ নং গ্রুপের ‘অনগ্রসর হিন্দু’এর তালিকায় কারা অন্তর্ভুক্ত থাকবে সেটি নির্ধারণ করা যাচ্ছিল না। সারা ভারতবর্ষ অনুসন্ধান করে ১৯৩২ সালে ব্রিটিশরা ভারতের অনগ্রসর হিন্দুদের একটি তালিকা বা শিডিউল তৈরি করে। তালিকায় অনগ্রসর হিন্দু হিসাবে মোট ৭৪টি সম্প্রদায়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরাই তপসিলি সম্প্রদায় বা তপসিলি জাতি হিসেবে পরিচিত।

মূলত অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ হিন্দুদের আর্থ-সামাজিক কল্যাণে তপসিলি সম্প্রদায়ের উদ্ভব। লোয়ার কাস্ট বা নিবর্ণ হিসেবে আলাদা করার জন্য নয়। যেসব অনগ্রসর গোষ্ঠীকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল তারা হলো : ১. আগারিয়া ২, ওরাওন, ৩. কনওয়ার ৪. কনাই ৫. কানুরা ৬, কান ৭. কান্ধ ৮, কাওরা ৯, কারেঙ্গ ১০. কাস্থ ১১. কাইরা (খাইরা) ১২. কাউর ১৩. কোরা ১৪. কোটাল ১৫. কোচ ১৬. খাঁটিকা ১৭. খাসি ১৮. গনডি ১৯, গারো ২০. চামার ২১. জালিয়া কৈবর্ত ২২. ঝালোমালো (মালাকাদর) ২৩. ডোম ২৪. তিয়ার ২৫. তুড়ি ২৬. দশাদ ২৭. ধেনুয়ার ২৮. ধোপা ২৯, নমশূদ্র ৩০. নট ৩১, নুনিয়া, ৩২. নাগেরিয়া ৩৩. পাণী ৩৪. পান ৩৫, পালিয়া ৩৬. পাসি ৩৭. পোদ ৩৮, বাইতি ৩৯, বাউড়িয়া ৪০. বাগদী ৪১. বাহেলিয়া ৪২. বাজওয়ারা ৪৩. বিন্দ ৪৪. বেলদার ৪৫. বেরুয়া ৪৬. বেনসিয়া ৪৭. বেদিয়া (বেদে) ৪৮, ঘাটিকা ৪৯. ভূঁইয়া ৫০, ভূমিজ ৫১. ভূঁইমালী ৫২. ভোয়াই ৫৩. মাহার ৫৪. মাহলী ৫৫. মাল ৫৬. মাল-পাহাড়িয়া ৫৭. মুচি ৫৮. মুণ্ডা ৫৯, মুসাহার ৬০. মেথর ৬১. মেচ ৬২. মোল্লা ৬৩. রাভা ৬৪. রাজবংশী ৬৫. লালবেগী ৬৬. লোধা ৬৭. লোহার ৬৮. হাজং ৬৯. হাড়ি ৭০. হালালখোর ৭১. হাড়ি ৭২. হ্যো ৭৩. শুড়ি ৭৪, সাঁওতাল।

এরা সবাই আজও তপসিলি সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত।

এই তালিকার ২৯ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত আছে ‘নমশূদ্র’। অর্থাৎ তপসিলভুক্ত ৭৪টি অনগ্রসর গোষ্ঠীর মধ্যে নমশূদ্ররা একটি গোষ্ঠীমাত্র। প্রকৃত অর্থে শব্দটি ‘শিডিউলড’ বা তালিকাভুক্ত। ‘শিডিউলড কাস্ট’ নয় এবং তার বাংলা অর্থ নমশুদ্রও নয়। শিডিউলড বলতে বোঝায় তালিকাভুক্ত অনগ্রসর হিন্দুদের ৭৪টি গোষ্ঠীর মানুষ।

সময়ের বিবর্তনে এদের মধ্যে অনেক গোষ্ঠীর মানুষই এখন আর অনগ্রসর নয়। লেখাপড়া শিখে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করে আজ তারা অনেক এগিয়ে গেছে। উন্নত জীবনযাপন করছে। ছড়িয়ে পড়েছে তারা দেশে বিদেশে। নমশূদ্র সম্প্রদায় তার অনন্য উদাহরণ।

নমশূদ্ররা আজ শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত হয়ে ছাপিয়ে গেছে সেই সময়ের অনেক উন্নত এবং অগ্রসর গোষ্ঠীর মানুষকে। যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যাবে, বর্তমানে বাংলাদেশে হিন্দুদের মধ্যে মেধা মননে, শিক্ষা-দীক্ষায় এবং চাকরি-বাকরিতে সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে নমশূদ্র সম্প্রদায়। শুধু তা-ই নয়, সরকারি বা বেসরকারি উচ্চপদে আসীন হিন্দু কর্মকর্তাদের শতকরা নব্বই ভাগই নমশূদ্র।

পরিশিষ্ট-৫ : নমশূদ্রের নবজাগরণ : মতুয়া ধর্ম

নমশূদ্রদের নবজাগরণের অঙ্কুর স্থাপন করেন মূলত শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর। তিনিই ছিলেন নম নবজাগরণের অগ্রদূত। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর পূর্ববঙ্গের একজন সমাজসংস্কারক। তিনি দলিত সমাজের উন্নয়নে কাজ করেছেন। অবদান রেখেছেন বিস্তর। তবে নমশূদ্রদের নবজাগরণের চাকাকে আরও গতিশীল করেছেন শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের সুযোগ্য পুত্র শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর। তিনি নমশূদ্র কল্যাণ সংঘ গড়ে তোলেন। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নম রেনেসাঁকে বেগবান করেন। ফলস্বরূপ, পরবর্তীতে নমশূদ্ররা শিক্ষকতা, ডাক্তারি, ওকালতি, ইঞ্জিনিয়রিং ইত্যাদি পেশায় আসতে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উচ্চপদ অধিকার করতে থাকে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে নমশুদ্রদের নবজাগরণের যে অধ্যায় সূচিত হয়, সেই নম রেনেসাঁ দেশ এবং জাতিকে উপহার দিয়েছে অসংখ্য শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, জজ, ব্যারিস্টার, প্রশাসক, সমাজসেবী, শিল্পপতি ইত্যাদি। সেই ধারা অব্যাহত রেখে নমশূদ্ররা আজ বাংলাদেশে শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের মধ্যে সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে।

১৮১২ সালের ১১ মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার) ওড়াকান্দী গ্রামে নমশূদ্র কৃষক পরিবারে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম নাম হরিচাঁদ বিশ্বাস। তিনি ছিলেন আত্মদর্শী এক মহাপুরুষ। তিনি মতুয়া মহাসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। মতুয়া মতবাদ অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং জননন্দিত ধর্মীয় মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

মতুয়া ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পঁচানব্বই ভাগই নমশূদ্র সম্প্রদায়। বাকি পাঁচ ভাগের মধ্যে আছে পোঁদ, কাঁপালী, কুমার, কামার, জেলে, ঋষি প্রভৃতি। অল্পকিছু মুসলমান কৃষকও আছে মতুয়া ধর্মের মুরিদ। মতুয়া ধর্ম শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। তথাতথিত উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা মতুয়াবাদের প্রতি তেমন আকৃষ্ট হননি।

‘মনু সংহিতা’য় বলা আছে, যে সমাজ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত অজ্ঞ, অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য তারা ইতর প্রাণী। এদের সাথে ওঠাবসা তো দূরের কথা, একই ছাদের নিচে বসবাসও ব্রাহ্মণদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি এইসব ইতর প্রাণীদের সাথে একই গাছের নিচে দাঁড়াতেও ব্রাহ্মণদের নিষেধ করা হয়েছে।

পরবর্তীতে ‘পরাশর সংহিতা’তেও প্রায় একইরকম অনুশাসন দেয়া হয়েছে। বলা আছে, কোনো চণ্ডালকে মেরে ফেলা বা খুন করা কোনো ব্রাহ্মণের জন্য তেমন কোনো অপরাধ বলে গণ্য হয় না। খুন করার পর সেই ব্রাহ্মণ এক দিন এবং এক রাত্রি উপোস থেকে ধ্যান করলেই তার পাপমোচন হয়। পরাশর সংহিতা অনুযায়ী, চণ্ডাল বা শূদ্রের রান্না করা ভাত ব্রাহ্মণদের কাছে গো মাংসসম অপবিত্র।

‘বশিষ্ঠ পুরাণ’-এ বলা আছে, শূদ্রের অন্ন খেয়ে কোনো ব্রাহ্মণ মারা গেলে, পরজন্মে সে শূকর রূপে জন্মগ্রহণ করে।

এসব থেকে সেই সময়ের সমাজে অস্পৃশ্যতার ভয়াবহতা এবং পশ্চাৎপদ শ্রেণির মানুষের উপর তথাকথিত উচ্চবর্ণের নিগ্রহ, নির্যাতন, নিষ্পেষণ সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শত শত বছর ধরে নির্যাতন, বঞ্চনা এবং অস্পৃশ্যতার যাঁতাকলে পিষ্ট শ্রমজীবী অনগ্রসর মানুষেরা মুক্তির উপায় খুঁজছিল। তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষের প্রতি অসীম ঘৃণা এবং ক্রোধের কারণে তারা ধর্মীয় জীবন পরিবর্তনে আকৃষ্ট হয়। এই বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম আবির্ভাবের সাথে সাথে তারা দলে দলে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে হাজার বছরের ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে দ্রোহের সূচনা করে। পরবর্তীতে একইভাবে ইসলাম ধর্মের আগমনেও তারা তাদের জীবনপথ পরিবর্তন করে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন শুরু হলে বিভিন্ন স্থানে মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ সেবার নামে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে থাকে। তখনও নমশুদ্রসহ অত্যাচারে জর্জরিত অনেক সম্প্রদায়ের মানুষ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু উচ্চবর্ণের মানুষের উন্নাসিকতা ও অত্যাচারী মনোভাব এবং তাদের প্রতি নিষদের ক্রোধ এবং ঘৃণা পাশাপাশি প্রবহমান থেকে যায়। বিধি-নিষেধের সেই পিঞ্জর ভেঙে দলিত শ্রেণির মানুষদের মধ্যে ধর্মান্তরিত হয়ে মুক্তির পথ বেছে নেবার ধারাও অব্যাহত থাকে।

এমন একটি আর্থ-সামাজিক অবস্থায় আবির্ভাব হয় পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের। উদ্ভব হয় মতুয়া ধর্মের। মতুয়া শব্দের অর্থ, কোনো বিশেষ মতাদর্শে বা ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ একটি জনগোষ্ঠী। আদি অস্ট্রেলীয় মাউড়ী জনগোষ্ঠীর ভাষায়, মতুয়া শব্দের অর্থ, ‘বন্ধুসংঘ’।

মতুয়া ধর্ম হিন্দু লোকধর্মের একটি শাখা। কায়িক শ্রমজীবী মানুষের কাছে। এই ধর্ম ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই ধর্মে পুরনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কঠোর শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধ নেই। কঠিন কোনো নিয়মেরও বালাই নেই। চলমান জীবন, সংসার, কাজ, সবকিছু অক্ষুণ্ণ রেখে অতি সহজেই পালন করা যায় এই ধর্ম। বলা যেতে পারে-মতুয়া ধর্ম হল, মা-মাটি-মানুষের ধর্ম।

প্রথাগত প্রতিষ্ঠিত ধর্মের মতো মতুয়া ধর্মেও জীবনাচারের অনুশাসন আছে। মোট বারোটি সহজবোধ অনুশাসন বা আজ্ঞা–

১. সদা সত্য কথা বলিবে

২. পরস্ত্রীকে মাতৃজ্ঞান করিবে

৩. প্রেমদান করো বিশ্বে যত প্রাণী মেনে চলো মতুয়ার এই মহাবাণী।

৪. জাতিভেদ করিও না পবিত্র চরিত্রে

৫. ভক্তি করো মাতা-পিতা একনিষ্ঠ চিত্তে

৬. ষড়রিপু হতে থাকো সদা সাবধান

৭. পরধর্মে নিন্দা তুমি করো পাপজ্ঞান

৮. পরিত্যাগ করো বাহ্য-অঙ্গ সাধু সাজ

৯. বলো মুখে হরিবোল, হাতে করো কাজ

১০. প্রতিষ্ঠিত করা গৃহে শ্রীহরি মন্দির

১১. দৈনিক প্রার্থনা করো নোয়াইয়া শির

১২. শ্রীহরিতে আত্মদান করো হে মানব

মানিলে দ্বাদশ আজ্ঞা সকলই সম্ভব ॥

শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর বাল্য বয়সেই আত্মদর্শনপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীকালে এই দর্শনের মাধ্যমেই প্রাপ্ত দ্বাদশ অনুশাসন বা আজ্ঞা মানুষের মাঝে প্রচার করেন। এটি মানবজাতির জন্য বিশেষ নির্দেশনা বা শিক্ষা, যা প্রতিটি মানুষকে ন্যায় পবিত্রতা, সত্য ও আলোর পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর প্রবর্তিত মতুয়া ধর্মকে প্রচার ও প্রসার করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘মতুয়া মহাসংঘ’। একে ধর্মসংস্কারমূলক একটি আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করলেও অত্যুক্তি হবে না। এর উৎপত্তি গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি গ্রাম থেকে।

মতুয়া সংঘ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি সত্য, ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা, লিঙ্গ সাম্যতা, বর্ণবৈষম্যহীন একটি সমাজ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যান। দেশভাগের পর হাজার হাজার মতুয়া ভক্ত পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমায়। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের দৌহিত্র শ্রী প্রমথরঞ্জন ঠাকুর উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ঠাকুরনগরে মতুয়া সংঘের সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে গোটা ভারতবর্ষে মতুয়া ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন।

মতুয়া মহাসংঘ আত্মদীক্ষাকরণ মতবাদে বিশ্বাস করে। যে কোনো নর নারী, যার শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের দর্শনের উপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে, তিনিই মতুয়া মহাসংঘের অন্তর্ভুক্ত। তারা কোনো গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিতেও পারে আবার নাও নিতে পারে। তবে মতুয়াগণ হরিচাঁদ ঠাকুরের সুযোগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরকে গুরু বলে স্বীকার করেন। তাঁরা মনে করেন, গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রতি ভক্তি না থাকলে, সাধনভজন সবই বৃথা তাদের। সাধনভজনের ক্ষেত্রে মতুয়ারা গুরুচাঁদ ঠাকুরকেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। শত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও মতুয়ারা শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ভজনা করে। ভজনায় কোনো কারণে ছেদ পড়লে তাঁরা গুরুষ্টাদ ঠাকুরের বাণী স্মরণ করেন এবং হরিচাঁদ ঠাকুর তাতে কৃপাবর্ষণ করেন বলে তাদের বিশ্বাস। এ জন্যেই মতুয়া সংগীতে বলা হয়েছে–

‘কর্মসূত্রে হরি হলে বাম
গুরু রাখলে রাখতে পারে যায় না পরিণাম।
গুরুগোসাই হইলে বাম, হরিচাঁদ রাখতে পারে না।
গুরু বলতে দুটি অর্থ হয়,
গু বলিতে চিত্তগুহতম রাশিময়,
রু বলিতে রবি উদয় হলে আর আঁধার থাকে না।’

গুরুচাঁদ ঠাকুর ছাড়াও অন্য গুরুকে দীক্ষাগুরু হিসাবে হিসাবে গ্রহণের রীতি আছে। তবে সেই গুরুকে গুরুতত্ত্ব জানতে হবে অবশ্যই। তাকে হতে হবে গুহ্যতত্ত্বসম্পন্ন কপটতামুক্ত। মতুয়াদের মতে, গুরু হবেন জীবনের সকল পঙ্কিলতা, মলিনতা ও সঙ্কীর্ণতামুক্ত এবং সূর্যের আলোয় ভাস্বর।

মতুয়ারা গুরুভক্তি করলেও তারা একান্তভাবে গুরুবাদী নয়। গুরুই একমাত্র ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথ দেখাতে পারেন, এমন মতবাদে তারা বিশ্বাস করেন না। গুরুর নিকট থেকে দীক্ষা গ্রহণের বাধ্যবাধকতাও তাই নেই। জন্মসূত্রে মতুয়ারা পারিবারিকভাবে মতুয়া ধর্ম পালন করে থাকেন। তবে মতুয়াদের মধ্যে গুরুর আসনে নারীরা সমাসীন হতে পারে, যা মতুয়া ধমের অনন্য এক বৈশিষ্ট্য।

মতুয়ারা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করে। অবতার তত্ত্বেও তাদের বিশ্বাস আছে। নারীকে আদ্যাশক্তিরূপী জগতের সকল সৃষ্টির আধার এবং কারণ বলে মনে করে। সে হিসাবে মায়াবাদী দর্শন তাদের বিশ্বাসে ফুটে ওঠে। তারা বিশ্বাস করে, আদ্যাশক্তি হতে জীবনের সৃষ্টি। প্রতিটি জীবের মধ্যেই এই শক্তির অস্তিত্ব বর্তমান। সেই শক্তি হলো মহামায়া। তিনি জগতের জীবকুলকে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছেন।

মতুয়াদের কাছে শ্রী হরিঠাকুর যেমনভাবে পূজ্য, ঠিক তেমনই তার সহধর্মিণী শান্তিদেবীও সমভাবে পূজ্য। পৌরাণিক দেব-দেবী লক্ষ্মী-নারায়ণ যেমন তাদের মানসলোকে বিরাজমান, তেমনই মনে করে হরিচাঁদ ঠাকুর শান্তিদেবী যুগলকে।

মতুয়ারা নারী-পুরুষের যৌথ সাধনার ধারার প্রবর্তক। তাদের সাধনা গার্হস্থ্য জীবনকেন্দ্রিক। কৃষি জীবনের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা বেশি বলে, কৃষক পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েন, তাদের সুখ-দুঃখ, আশা নিরাশার দোলাচলে দোলায়মান জীবনধারা, সংসার মায়াজালে মোহাবিষ্ট ত্যক্ত-বিরক্ত জীবনের বৈশিষ্ট্যময় রূপগুলো তাদের চেতনায় প্রকাশ পায়।

মতুয়ারা সন্ন্যাস গ্রহণে উৎসাহী নয়। তারা নির্জন, নিরাভরণ, নিঃসীম সাধনলোকে বিচরণ করতে চায় না। তাদের মতে–

গৃহে থাকি প্রেম ভক্তি সেই হয় শ্রেষ্ঠ
অনুরাগ বিরাগেতে প্রেম ইষ্ট নিষ্ঠ।
গৃহেতে থাকিয়া যার ভাবোদয় হয়
সেই সে পরম সাধু জানিবে নিশ্চয় ॥

মতুয়াদের দর্শন—’মুখে বলো হরিনাম, হাতে করো কাজ’। তবে অতিরিক্ত বিষয়-বাসনাকে তারা বলেছে বিষময়। সংসারে থাকতে হবে সংসারের মায়া ত্যাগ করে। সংসারে থেকেই করতে হবে বৈরাগ্য সাধন। বনে জঙ্গলে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই। হরিনামের ভেলায় ভেসে পাড়ি দিতে হবে সংসার সাগর। দূর করতে হবে অহঙ্কার। মনের সব কালিমা। নিরবচ্ছিন্ন কর্মসাধনার মধ্য দিয়ে অনুভব করতে হবে ভব সংসারের অনিত্যতা। তবেই হবে মানবজীবনের পরম সত্যেপলব্ধি। মতুয়াদের জীবনের মর্মকথা এটাই।

প্রেম, ভক্তি, পবিত্রতা
এই তিনে মতুয়াত্মা।

মতুয়াদের ভাবধারায় দ্বৈতপ্রেমের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। একটি মানবীয় সকাম প্রেম। যা সংসার জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মিলনাকাঙ্ক্ষা থেকে উৎসারিত এবং অন্যটি নিষ্কাম প্রেম, যা পরম প্রেমময় শ্রীশ্রী হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের পাদপদ্মে সমর্পিত। এ কারণে তারা নিয়ন্ত্রিত যৌনাচারে বিশ্বাসী।

মতুয়ারা সহজ, সরল, সাভাবিক সাংসারিক জীবনযাপন করে। তাদের জীবন শ্রমনির্ভর। বেশিরভাগ মতুয়া কৃষিজীবী। সংসার ত্যাগ করে নয়, বরং বিবাহ করে সন্তান-সন্ততি নিয়ে গার্হস্থ্য ধর্ম পালনে অভ্যস্ত তারা। সন্তান সন্ততিপূর্ণ কৃষিকার্যমণ্ডিত সংসারে তারা পরম পরিতৃপ্তি অনুভব করে। তারা বিবাহবিহীন পরনারী ও পরপুরুষ আসক্তিকে ঘৃণার চোখে দেখে। বৈবাহিক

জীবনেও অনিয়মিত যৌনাচারকে ভ্রষ্টাচার বলে মনে করে।

মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করে মতুয়ারা।

মতুয়াদের মতবাদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে লালন সাঁই এর ভাবধারা। আছে সুফিবাদের প্রেমতত্ত্ব, আছে বৈষ্ণব মতবাদ। সর্বান্তঃকরণে মতুয়ারা বিশ্বাস করে–

‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’

পরিশিষ্ট-৬ : নমশূদ্রের নবজাগরণ : ছিয়ানব্বই খান ও এগারোখান

নমশূদ্র সমাজের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে অবশ্যম্ভাবীভাবে এসে পড়ে যশোর ও খুলনা জেলার অন্তর্গত নমশূদ্র অধ্যুষিত ছিয়ানব্বই খান এবং এগারো খানের কথা। ছিয়ানব্বই খান বলতে বোঝায় পর পর ছিয়ানব্বইটি নমশূদ্র গ্রাম এবং এগারো খান বলতে একইভাবে একই সাথে এগারোটি নমশূদ্র গ্রাম বোঝায়।

ছিয়ানব্বই খান

বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলার যেসব অঞ্চলজুড়ে এই ছিয়ানব্বইটি গ্রাম, সেগুলোর অবস্থান হচ্ছে–যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলাতে ৪০টি গ্রাম, অভয়নগর উপজেলায় ৩২টি, কেশবপুর উপজেলায় ৬টি এবং যশোর সদর উপজেলায় ৪টি মোট ৮২টি গ্রাম। আর খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলায় ৪টি এবং ডুমুরিয়া উপজেলায় ১০টি–মোট ১৪টি গ্রাম। দুই জেলা মিলে সর্বমোট ৯৬টি গ্রাম। গোটা এই এলাকার নাম তাই ছিয়ানব্বই খান। লেখাপড়া ছিল না এইসব গ্রামের নমশূদ্রদের মধ্যে অশিক্ষার অন্ধকারে ঢাকা ছিল তারা। তাদের পেশা ছিল মূলত কৃষিকাজ। অন্যান্য কায়িক পরিশ্রমের কাজও করত কেউ কেউ।

উনিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত এই এলাকায় ব্রাহ্মণ, কায়স্থদের উদ্যোগে দু-চারটি স্কুল স্থাপিত হয়েছিল। পাঁজিয়া, রাজঘাট, ফুলতলা ইত্যাদি নামকরা স্কুলগুলোতে নমশূদ্রদের পড়াশুনা করার সুযোগ ছিল না। অভয়নগর, মনিরামপুর, ডুমুরিয়া, ফুলতলা অঞ্চলের নমশূদ্র ছেলেমেয়েরা পড়তে আসত নেহালপুর বিদ্যালয়ে। স্কুলের প্রায় সব শিক্ষক এবং অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ছিল ব্রাহ্মণ-কায়স্থ। তারা নমশূদ্রদের ঘৃণা করত এবং অত্যন্ত অবহেলার চোখে দেখত। শুধু তা-ই নয়, নানাভাবে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করত। তার কোনো বিচার পাওয়া যেত না। নির্যাতনের মাত্রা যখন অতিরিক্ত বেড়ে গেল, তখন এলাকার নমশূদ্র ছেলেমেয়েদের নেহালপুর বিদ্যালয়ে যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গেল।

কিন্তু ভেঙে পড়েন না নমশূদ্র সমাজপতিরা। সমস্যা সমাধানের উপায় বের করার চেষ্টায় ব্রতী হন তারা। তৎকালীন নমশূদ্র সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা পোড়াডাঙ্গা গ্রামের বাবু রাইচরণ মজুমদার ১৯১৭ সালে মশিয়াহাটিসহ পার্শ্ববর্তী ৯টি গ্রামের লোকজন নিয়ে একটি মিটিং করেন। মিটিঙে নমশূদ্রসহ তপসিলি সম্প্রদায়ের সকল ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করার জন্য একটি স্কুল স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯১৮ সালে কুলটিয়া গ্রামের ঠাকুরতলা পূজাঙ্গনে ‘ইংরেজি বিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গড়ে ওঠে নতুন ইতিহাস। ঘটে নমশূদ্রদের মধ্যে নব-জাগরণ।

জায়গার সংস্থান এবং স্থাপনা নির্মাণ করে পরবর্তীতে স্কুলটি অভয়নগরের মশিয়াহাটি গ্রামে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। স্কুল পরিচালনা এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে ঐ বছরেই মশিয়াহাটিতে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই জনসভায় ছিয়ানব্বই গ্রাম থেকে পাঁচ হাজারের অধিক নমশূদ্র যোগদান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত নেতা খুলনার গ্রামের বাৰু যোগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। প্রধান বক্তা ছিলেন বাবু রাইচরণ মজুমদার। আবেগময় কণ্ঠে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, আজ থেকে মশিয়াহাটি বিদ্যালয় ছিয়ানব্বই গ্রামের বিদ্যালয়। ধরে নেয়া যায়, সেই ঘোষণা থেকেই ছিয়ানব্বই গ্রাম বা ছিয়ানব্বই খানার উদ্ভব।

১৯১৯ সালে মশিয়াহাটি গ্রামে নবপ্রতিষ্ঠিত ভবনে মশিয়াহাটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় নামে স্কুলটি নতুনভাবে কার্যক্রম শুরু করে। ছিয়ানব্বই গ্রামের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত নমশুদ্র ছেলেমেয়েদের আজ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়া এবং নমশূদ্র সমাজের অগ্রযাত্রায় এই স্কুল মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। মশিয়াহাটি স্কুল অন্য জেলার নমশূদ্রদেরও নিজ নিজ এলাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা যুগিয়েছিল। তার ফলশ্রুতিতে আজ গোটা বাংলাদেশে শিক্ষা-দীক্ষায় নমশূদ্রদের জয়-জয়কার পরিলক্ষিত হয়।

এগারো খান

ছিয়ানব্বই গ্রামের পর বৃহত্তর যশোর জেলার এগারো গ্রামের নমশূদ্রদের উত্থান ছিল বিস্ময়কর। শহর থেকে দূরে জলা, ডোবা নিচু নিভৃত অঞ্চলে এই এগারোটি গ্রামের অবস্থান। নামগুলো হল-১. বাকড়ী ২. হাতিয়ারা, ৩. গুয়াখোলা ৪. মালীয়াট ৫. বেনাহাটি ৬. কমলাপুর ৭. দোগাছি ৮. ঘোড়াগাছ ৯. বাকলী ১০. কিসমত বাকড়ী ১১. মান্দীয়া।

পশ্চাৎপদ, অবহেলিত প্রত্যন্ত এলাকার এই এগারোটি গ্রাম আজ নমশূদ্রদের গর্ব। শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত এগারো খানের শিক্ষিতের হার বর্তমানে প্রায় শতভাগ। আজ তাদের ঘরে ঘরে উচ্চ শিক্ষিত ছেলেমেয়ে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উচ্চপদে চাকরিরত তারা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তারা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকায় পড়াশুনা করছে, উচ্চ পদে চাকরি-বাকরি করছে। মুখ উজ্জ্বল করছে বাংলাদেশের।

.

অপরিসীম কৃতজ্ঞতা আমার যাদের কাছে

বিভিন্ন তথ্য, গ্রাম্য গান, ছড়া, মন্ত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে এই গ্রন্থ রচনায় সহযোগিতা করেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন–

১, লেখক-কবি অসিত বিশ্বাস (আমলসার, শ্রীপুর, মাগুরা)–এই গবেষণা গ্রন্থে ব্যবহৃত তথ্যের প্রায় পঁচাত্তর ভাগ তার সংগ্রহ থেকে নেয়া। তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে বহু বছর ধরে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন।

২. খনা দেবী বিশ্বাস (আমার মা)–কয়েকটি দেহতত্ত্ব গান তাঁর স্মৃতি থেকে সংগ্রহ করা।

৩. ঊর্মিলা বিশ্বাস, সুরবালা বিশ্বাস, অমলা বিশ্বাস, গীতা বিশ্বাস (গোয়ালন্দ, রাজবাড়ি)–বেশ কিছু ব্ৰতকাহিনি এবং গীত তাদের কাছ থেকে নেয়া।

৪. কণিকা দে, প্রতিমা বিশ্বাস, অনিন্দিতা রায় (ঢাকা)–সংগৃহীত তথ্য যাচাই-বাছাই ও শ্রেণিবিন্যাসে তারা সহায়তা দিয়েছেন।

৫. অশোক বিশ্বাস এবং অপূর্ব বিশ্বাস (গোয়ালন্দ, রাজবাড়ি)–সোনাহারের গানসহ বেশ কিছু মন্ত্র ও গীত তারা সংগ্রহ করেছেন।

৬. সেবানন্দ বিশ্বাস (ফরিদপুর)–বিলের মানুষের সারা বছরের জীবনযাত্রার বর্ণনা এবং ক্রমবিন্যাসে রয়েছে তার সহায়তা।

৭. নিরোদ কুমার বিশ্বাস (গণপত্যা, রাজবাড়ি)–নীল পূজা, চড়ক পূজার মন্ত্র এবং অরণ্য ষষ্ঠীর ব্রত কাহিনি তাঁর কাছ থেকে নেয়া।

৮. বিভূতিভূষণ বিশ্বাস, ভবেশ চন্দ্র বিশ্বাস, ভবতোষ বিশ্বাস কুমারেশ মণ্ডল (মধুপুর, মধুখালী, ফরিদপুর)–কার্তিক পূজা, ভূত তাড়ানো, মশা তাড়ানো ইত্যাদি তারা সংগ্রহ করে দিয়েছেন।

৯. নিশিকান্ত বিশ্বাস, রামপ্রসাদ বিশ্বাস (বনগ্রাম, মধুখালী, ফরিদপুর)–ত্রিনাথের মেলার গান এবং গোমাতার প্রথম দুগ্ধ গোহন অনুষ্ঠানের তথ্য তাদের কাছ থেকে নেয়া।

১০. দীপু বিশ্বাস (গোয়ালদহ, শ্রীপুর, মাগুরা)–দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদ, আধ্যাত্মিক অনেক গান তাঁর সংগ্রহ থেকে নেয়া।

১১. দ্বিজেন্দ্রনাথ সরকার (গোপীনাথপুর, মধুখালী, ফরিদপুর)–শীতলা পূজা এবং ভাসান পূজার তথ্যাদি তিনি সংগ্রহ করেছেন।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

একখণ্ড মনুসংহিতা–অসিত বিশ্বাস

ঘেঁড়াছুটো হাড় মাংশের বেহুলা লক্ষ্মীন্দর–অসিত বিশ্বাস

নমশূদ্রের ইতিহাস–বিপুল কুমার রায়

বিল বাঘিয়ার প্রান্তরে–গোপালকৃষ্ণ বাগচী

বাংলাদেশের ইতিহাস–ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার

বাংলার ভাবান্দোলন ও মতুয়া ধর্ম–অনুপম হীরা মণ্ডল

যশোহর ও খুলনা জেলার ইতিহাস–শ্রী সতীশচন্দ্র মিত্র

শ্রী শ্রী হরি-গুরুচাঁদ আগমন বার্তা–গোপালকৃষ্ণ মণ্ডল

দীপ্ত চেতনা (সংকলন)–বাংলাদেশ নমঃশূদ্র কল্যাণ পরিষদ, সিলেট বিভাগীয় সম্মেলন ও নমঃশূদ্র কনভেনশন উপলক্ষে ২০১১ সালে প্রকাশিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *