১১. ফাগুন

ফাগুন

ফাল্‌গুন মাস। হাড় কাঁপানো শীতের পর উষ্ণতার পরশ।

ফাঁকা বিল থেকে ভেসে আসে ঝিরিঝিরি দখিনা হাওয়া। শরীর জুড়ায় সে বাতাসে। মন ভরে আবেশে।

গাছে গাছে বয়সী পাতায় বিষণ্ণ রং। কদিন পর এই পাতা ঝরে যাবে। গজাবে নতুন কুশিপাতা। সবুজে সবুজে ভরে উঠবে বৃক্ষরাজি। শাখা প্রশাখাগুলোতে লাগবে নবযৌবনের ছোঁয়া। সবুজের সমারোহে আসবে পাখি। কল-কূজনে মুখরিত হবে। জোড়া বেঁধে নতুন নীড় রচনা করবে তার। সারা প্রকৃতিজুড়ে লাগবে নবজীবনের পরশ।

মাঠে মাঠে চৈতালি ফসল। পাকা ফসলে গোটা মাঠে ছড়ানো বাদামি রং। কৃষক-কৃষাণীর চোখমুখে আনন্দ। প্রস্তুতি নেয় তারা নতুন ফসল তোলার।

একসময় ফসল তোলা শুরু হয়ে যেত মাঠে মাঠে। কৃষকের মুখে মুখে ফিরত মাটির গন্ধমাখা রসালো গীত–

আরে চোদ্দ পোয়া জমিন নিয়ে বেঁধেছে গোলমাল
জমিতে নল ধরিয়া জরিপ করে
ঠিক করিয়া বলো আমায়।
কত বা উঠিত ছিল কত বা পতিত ছিল
কত বা ছিল জলাকার ॥

শুনে আলাম সাধুর ধারে অন্যায় অবিচারে
দুই চরে এক পক্ষী ওড়ে
ওরে সেই পাখির নেই কোনো পয়ার।।

পাখা নেই সে উড়োন ছাড়ে
পদ নেই সে দোড়োয়ে ফেরে
মুখ নেই সে করতেছে আহার।।

এই গীত শেষ হতেই পাশের খেত থেকে গেয়ে উঠত–

পাগলা কানাই কয় ও নতুন সুর
তুই বিনে ব্রহ্মাকে আমার কেহ নাই
তোর জ্বালায় জ্বলে মরি, ডাঙায় পাইনে ঠাঁই।।
আমি ভাবি রাত্রি দিনি গাঙে হয় হাঁটু পানি
তুই আমার যা করিস তাই, আমি হাত নাড়া দে পথ চলি
ঘাড় নাড়ি আর মাথা ঘুরাই।।

পরেরটুকু ধরে শেষ করত পাশের খেত থেকে অন্যজন–

আমার মনে বলে ফকির হবো
জঙ্গলে জঙ্গলে রবো,
সুরির (সুরের) আঁটন সুরির ছাঁটন
সুরির একখান ঘর বানাব।।
আবার ধূয়ো দিয়ে ঘর ছাব
খুনজুরি (খঞ্জরি) থোব মটকার পর
আমার সব আত্ম কুটুম এরাই ॥

ফসল তোলার সাথে সাথে দখিনা বাতাসে এ রকম গীতের পর গীত ছড়িয়ে পড়ত সারা মাঠে। সুরে সুরে মেতে উঠত গোটা এলাকা। গায়ের বধূরাও কাজ করতে করতে কান পেতে শুনত সেই সব গান। আপন মনে তারাও কখনও কখনও সুরেলা কণ্ঠে গলা মেলাত গীতের সাথে।

এইসব গীত ছিল নমশূদ্র কৃষক-কৃষাণীর কর্মশক্তি, উদ্দীপনা। গীত না গাইলে কাজে মন লাগত না, উৎসাহ আসত না। সুরের সাথে তাদের হাত চলত, কাস্তে ঝিলিক দিয়ে উঠত; ফাল্গুন মাস শুধু ফসল তোলার মাসই নয়।

ফাল্গুন মাস বিয়ের মাস। খুশির মাস। নতুন জীবনে প্রবেশের মাস। মনের মানুষকে কাছে পাবার মাস।

এই মাসে নমশুদ্র গ্রামে গ্রামে বিয়ের আয়োজন লেগে থাকত। রাত-দিন বাতাসে ভেসে বেড়াত নারী কণ্ঠে বিয়ের গান।

মাঘ মাসে যত না বিয়ে, ফাল্গুন মাসে তার চেয়ে অনেক বেশি। শীতের প্রকোপ কমে প্রকৃতিতে উষ্ণতার আরাম ফিরে আসায় অনুষ্ঠানাদির জন্য তৈরি হয় অনুকূল পরিবেশ।

বিয়ের সম্বন্ধ হতো সাধারণত পাঁচ-সাত ক্রোশের মধ্যেই। নেহায়েত দায় না ঠেকলে বেশি দূরে মেয়ে বা ছেলে বিয়ে দিতে চাইত না নমশূদ্ররা।

ধনী-গরিব সব বাড়িতেই বিয়ের জন্য কনে বা মেয়ে দেখার অনুষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিকেলের নরম আলোয় কনে দেখার নিয়ম। একে বলত “কনে দেখা আলো’। সেই নরম মিষ্টি আলোয় কনের মুখমণ্ডলে সৌন্দর্যের আভা ছড়িয়ে পড়ে। প্রথামতো ছেলে বাড়ির লোকজন দুপুরের আগেই চলে আসত মেয়ের বাড়ি। ফলাহার শেষে তারা গ্রামের এবাড়ি-ওবাড়ি গিয়ে বসত। কায়দা করে মেয়ের সম্পর্কে খোঁজখবর নিত। অতিথি দূর থেকে এলে রাতে থেকে যেত মেয়ের বাড়িতে। সে ক্ষেত্রে কনে দেখা হতো পরের দিন উঠতি কাঁচা রোদে। মিষ্টি শুভ সোনা আলোর ছটায় কনের মুখচ্ছবি আরও উজ্জ্বল, আরও সুন্দর হয়ে উঠত।

তারপর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া। সাধ্যমতো সর্বোচ্চ আপ্যায়নের চেষ্টা চলত। খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠানে মাংস থাকত না। থাকত বড় মাছের আইটেম। বিশেষ করে রুই, কাতল। তবে ইলিশ মাছ মেন্যুতে থাকলে আলাদা মাত্রা যোগ হতো। তারা বিশ্বাস করত, মুখরোচক খাওয়া-দাওয়ায় বরপক্ষের লোকজনের মনটা ফুরফুরে থাকবে। তার প্রভাব পড়বে মেয়ে দেখার সময়। পছন্দের ক্ষেত্রে পাত্রপক্ষের মনে নমনীয়তা আসবে খানিকটা হলেও।

বিল এলাকার নমশূদ্রদের প্রথা ছিল, বারো বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মেয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়া।

তারা মনে করত, দশ-এগারোতে রজোঃপ্রাপ্তি। বারোতে পূর্ণতা। সাবালিকা হয়ে যায় কন্যা। গায়ে-গতরে সেয়ানা হয়ে ওঠার আগেই তাকে পাত্রস্থ করার জন্য অস্থির হয়ে পড়ত বাবা-মা। মুরব্বিরা বারবার তাগিদ দিতেন তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার জন্যে। নইলে মেয়ে আইবুড়ো থেকে যাবে। একবার যদি এলাকায় কোনোভাবে প্রচার হয়ে যেত যে, দ্বাদশ বর্ষ তো বটেই কন্যা আসলে আরও বয়স অতিক্রম করে হয়ে গেছে ষোড়শী। তাহলে তৈরি হতো সমস্যা। পাত্র মিলানো ভার হয়ে যেত।

এছাড়া ছিল গৌরি দান। আট বছর বয়সের মধ্যেই কন্যাদান করতে পারলে পুণ্যের ভাড় কানায় কানায় পূর্ণ হতো। সেটা অবশ্য নির্ভর করত ভালো সম্বন্ধ পাওয়ার উপর। এসব ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব রক্ষা বা পারিবারিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার তাগিদে অনেক সময় অভিভাবকদের মধ্য আগে থেকেই কথা হয়ে থাকত। এমনকি সন্তান জন্মের আগেই বাগদান সম্পন্ন হতো। কথা থাকত যে, একজনের যদি ছেলে হয় বা অন্যজনের মেয়ে, তাদের বিয়ে দিয়ে নিজেদের মধ্যে বেয়াই সম্পর্ক স্থাপন করে বন্ধন আরও জোরদার করবে তারা।

মেয়ে দেখার অনুষ্ঠানে হতো বাক-চাতুর্যের বহর প্রদর্শন। কথার মারপ্যাঁচে অপর পক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা। সে কারণে, গ্রামের বা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, কথাবার্তায় চৌকস যারা, তাদেরকে অনুষ্ঠানে হাজির রাখা হতো। দেনা-পাওনার পরিমাণ নির্ধারণের জন্য দর কষাকষি করা ছিল তাদের অন্যতম দায়িত্ব। এই হিসাব না মিললে মেয়ে সুশ্রী এবং খাওয়া দাওয়া, যত্ন-আত্তি সবকিছু ভালো হওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় বিয়ে পরিণতির দিকে গড়াত না।

ছেলেপক্ষের লোকজন এলে তাদেরকে এনে বসানো হতো, উঠোনের কোণে পাতা ছোট্ট জলচৌকির উপর। সামনে থাকত পিতলের বদনা আর বালতি ভরা জল। বাড়ির কেউ একজন তাদের পায়ে জল ঢেলে দিত। তারপর ঘাড়ের উপরে রাখা গামছা দিয়ে অতি যত্নে পা মুছিয়ে দিত। অতিথি নারায়ণ। নারায়ণের যথাযথ সমাদর করা ছিল গোটা গ্রামের মানসম্মানের বিষয়। সমাদরে ঘাটতি হলে গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে জবাবদিহি করতে হতো গৃহস্থকে।

এই অনুষ্ঠান ছিল গতানুগতিক। অনেকটা পাতানো খেলার মতো। খাওয়া-দাওয়া শেষে হবে কনে দেখা। সবাই জানে এটা। তারপরও ছেলেপক্ষ এসেই বলবে, অনেক ব্যস্ততা তাদের। মেয়ে দেখে বেলা থাকতে থাকতেই বাড়ির পথে রওনা হতে চায় তারা। আসলে যাবে না। কিন্তু একটু ভদ্রতা দেখানো হল, দামও বাড়াল খানিকটা, এই আর কি!

কন্যা পক্ষের মুখপাত্র হাতজোড় করে ফেলত। বিনয়ের সাথে বলত অনেক দূরির তে আইচেন আপনেরা। আপনেরা হলেন অতিথি, নারায়ণ। বেলা গড়ায়ে গেছে। আগে দুডে ডালভাত সেবা নিতি হবি। দয়া করে আমাগের অপরাধী বানাবেন না। মেয়ে তো দেখপেনই।

এরই মাঝে সুযোগ বুঝে কায়দা করে জানিয়ে দিত, মেয়ে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। রান্নাবান্না, হাতের কাজ, সেলাই সব জানে। মেয়ে সুন্দর। গায়ের রং ফর্সা, মুখের কাটিং ভালো।

গ্রামের মুরব্বি এবং মহিলারাও হাজির থাকত কনে দেখার সময়। থাকত যুবক শ্রেণি। বিষয়টির সাথে গোটা গ্রামের মানুষ একাত্ম হয়ে যেত। বাইরে থেকে এসে গ্রামের মেয়েকে অপছন্দ করে চলে যাবে কেউ, সেটা তো হতে দেয়া যায় না। গ্রামের মান থাকে না তাতে। সবচেয়ে ভালো যে রাধুনী, সে এসে রান্না করত। কোনো টাকা-পয়সা নিত না। গ্রামী হিসেবে এটা তার দায়িত্ব।

আনুষ্ঠানিকতার ভিতর দিয়েই চলত মেয়ে দেখা পর্ব। পাড়ার দুই-তিনজন মেয়ে বা কম বয়সী বউ তাকে ধরে নিয়ে আসত। মেয়েটির চোখে-মুখে লেপটে থাকত রাজ্যের লজ্জা। মেয়ের হাতে থাকত পানের থালা। সাথে মিষ্টি। সেটা সামনে রেখে সবার উদ্দেশে গড় হয়ে প্রণাম করত। তারপর বসত মাথা নিচু করে। পাত্রপক্ষের লোকজন শ্যেনদৃষ্টিতে মেয়ের মাথা থেকে পায়ের নখ অবধি পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করত। ইশারায় কথা হতো।

এটা হলো প্রথম পর্ব। সফলভাবেই এই পর্ব উতরানো গেলে শুরু হতো দ্বিতীয় পর্ব।

এবার কন্যার গুণের পরিচয়। শুরু হতো নাম দিয়ে। তারপর হাতের লেখা। পুরো নাম লিখতে পারলে কন্যা বিদুষী হিসেবে গণ্য হতো। এরপর রান্না-বান্না, সেলাই। হাতে কাজ করা রুমাল, বালিশের কথা প্রমাণস্বরূপ সামনে রাখা হতো। তাতে আঁকা থাকত পাখি, ফুল, লতাপাতা। লেখা থাকত ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ বা ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে জাতীয় ছন্দ মেলানো কথা। সেসব খুঁটিয়ে দেখে প্রশংসা করত বরপক্ষের লোকজন। তারপর শুরু হতো টুকটাক ছোটখাটো প্রশ্ন। মাথা নিচু করে অতি নমনীয় ভঙ্গিতে প্রশ্নের উত্তর দিত কনে।

এরপর হাঁটা পর্ব। জল আনা হতো। মাটিতে ঢেলে তার উপরে পা ফেলে হাঁটতে বলা হতো মেয়েকে। পায়ের ছাপ দেখেই তারা সাব্যস্ত করে ফেলত মেয়ে লক্ষ্মীমন্ত কি না। বেণী খুলে দেখাতে হতো, চুলের গোছা কেমন, চুল আসল কি না।

সবশেষে হতো বুদ্ধি পরীক্ষা।

কী প্রশ্ন হবে এটা মোটামুটি সব মেয়েরই জানা। তাই প্রশ্নের আগেই উত্তরটা কীভাবে দেবে তা মনে মনে ঝালিয়ে নিত।

পাত্রপক্ষের গুরুজন গম্ভীর গলায় টেনেটেনে প্রশ্ন করত–আচ্ছা মা, ধরো তোমারে আমরা নিলাম। বিয়ের পর তোমার বাবা গেছে তোমার বাড়ি। ওদিক তোমার স্বামীও আসে পড়িছে মাঠের তে। দুইজনেই একসাথে জল চালো তোমার কাছে। তখন তুমি কী করবা? কারে আগে জল আনে দিবা?

উত্তর মেয়ের জানা। কিন্তু তাড়াহুড়া করা চলবে না। মা-পিসিরা বারবার করে শিখিয়ে দিত, সাথে সাথে উত্তর না দিতে। একটু সময় নিতে হবে যাতে পাত্রপক্ষ বোঝে যে, অনেক ভেবে-চিন্তে সে এই কঠিন প্রশ্নের সমাধান বের করেছে।

মেয়েও তাই করত। বেশ খানিকটা কালক্ষেপন করে দক্ষ অভিনেত্রীর মতো উত্তর হাতড়ে ফিরত। তারপর ইতস্তত করে ধীরে ধীরে একসময় বলতে শুরু করত–স্বামীর জন্যিই আগে জল নিয়ে যাব। স্বামীর মন শীতল করে তার অনুমতি নিয়ে বাবার জন্যি জল নিয়ে যাব।

অপর পক্ষ থেকে সাথে সাথেই প্রশ্ন হতো–কিন্তু কেন? পিতা জন্মদাতা। তারে কেন আগে জল দিবা না?

হুবহু এই প্রশ্নই যে আসবে এবং তার উত্তর কী দিতে হবে তাও মেয়ের জানা। তবুও বেশ ধীরস্থিরভাবে সে উত্তর দিত–পিতা ধর্ম, পিতা সগগ। সে কথা সত্যি। কিন্তু আয্য নারীর বিয়ে হয়ে গিলি স্বামীই তার সবকিছু।

সাথে সাথে ছুটে আসত প্রশংসাবাণী–সাবাস মা। অনেক বুদ্ধি তোমার। আয়ুষ্মতি হও। এরপর মেয়ে ভিতরে চলে যাবার অনুমতি পেত।

স্বামীকে জল খাওয়ানোর এই প্রশ্ন বিল এলাকার নমশূদ্রদের মেয়ে দেখার অনুষ্ঠানে একেবারে কমন। তারপরও ছেলেপক্ষের লোকজন মনে করত, এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর যে মেয়ে দিতে পারে সে অতিশয় বুদ্ধিমতী।

সংসার তো স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই। একে জন্মদাতা পিতা, তার উপরে অতিথি। অতিথি যদি নারায়ণ হয়, তাহলে সেবা তো তারই আগে প্রাপ্য। কোনো নিয়মেই স্বামীর নয়। তাছাড়া বাবা-মা’র উপরে কারো স্থান কোনো যুক্তিতেই যে থাকা উচিত নয়। ভদ্র সমাজে এই নিয়ম থাকা উচিত কি উচিত না, সে প্রশ্ন নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। রীতির পরিবর্তন পছন্দ করত না তারা।

এরপর শেষ এবং সবচেয়ে কঠিন পর্ব। মেয়ে ঘরে চলে যাবার পর, পান মুখে সবাই খোশগল্পে ব্যস্ত হতো। চলত হাস্যরস। মেয়ে পক্ষ দম বন্ধ করে বসে থাকত অপেক্ষায়, কখন পাত্রপক্ষ দেনা-পাওনার প্রসঙ্গ তুলবে। মেয়েপক্ষ জানত, এসব গালগল্প, হাস্যরস ভূমিকা মাত্র। অবশেষে এসে পড়ত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ছেলের মামা বা কাকা-জ্যাঠা গলাখাঁকারি দিয়ে বলা শুরু করত–এট্টা বিষয়। কতি ভুলেই গিচিলাম। সব তো হল। মিয়াও আমাগের অপছন্দের না। তয় কতা হল, দেনা-পাওনার বিষয় এট্ট ঠিক করে নিলি ভালো হতো না? কি কন আপনেরা?

পাত্রীপক্ষের মুখপাত্র বলত–তা তো বটেই। তয় মেয়ের বাপের আর্থিক অবস্থার কতাও এটু বিবেচনায় নিতি হবি। গরিব মানুষ, জাগাজমি বেশি নাই। আপনেরা বিজ্ঞজন, সেই মতো বিবেচনা করবেন।

মেয়ের বাবা হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকত। বিয়ের আসরে কনের বাপের এটাই করণীয়। তার হয়ে কথা বলত গ্রামের মুরব্বিজন।

কথার পিঠে কথা যদি উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতো তাহলে তো মিটেই গেল। কিন্তু চাওয়া-পাওয়ার পার্থক্য যদি বেশি হতো এবং পাত্রপক্ষ যদি কোনো কারণেই নরম না হতো, তখন তাদেরকে জব্দ করার মতো ঠোঁটকাটা লোকও উপস্থিত থাকত অনুষ্ঠানে। সাধারণত সে মুখ খুলত না। কারণ, বিয়ের আসরে উচিত কথা চলে না।

এভাবেই দেখেশুনে, বুঝে, সবকিছু মিলিয়ে একমতে উপস্থিত হতে পারলে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে যেত। দিন-তারিখ ঠিক হতো। প্রজাপতির আশীর্বাদে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার আশা পূর্ণ হতে চলেছে। শুরু হতো কেনাকাটা, বিয়ের বাজার। শাখা-সিঁদুর, কাপড়-চোপড়, অলঙ্কার, প্রসাধনী, মুকুট আরও কত কী! আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করা, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা। দম ফেলার সময় থাকত না। একে একে হতো সোনাকাপড় অর্থাৎ আশীর্বাদ, পানচিনি, গায়ে হলুদ, বিয়ের অনুষ্ঠান।

নমশূদ্র কৃষকরা বিশ্বাস করত, বিয়ে হলো ধর্মের অংশ। বিয়ে মানে, শুধু একে অপরের জীবন-মরণের সাথিই নয়, পুরোপুরি ধর্ম পালন করা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক জন্ম-জন্মান্তরের। সাত জনমের। একমাত্র মরণ ছাড়া যার ছেদ নাই। তাই অনেক দেখেশুনে, সবকিছু যাচাই, বিচা করত তারা।

শুভলগ্নে একদিন সানাই বেজে উঠত। হতো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। তার আগে হতো আইবুড়ো ভাত বা ঢেঁকিবরণ। গায়ে হলুদ দেয়া হতো দেহ শুদ্ধির জন্য। নতুন কুলায় সাজানো হতো বরণডালা। ডালায় থাকত প্রদীপ, ঘট, হলুদ, ধান-দূর্বা, তিল, পান, সুপারি, মেথি, চন্দন ইত্যাদি। এসব সৌন্দর্য আর শুদ্ধতার প্রতীক।

উলুধ্বনি দিয়ে ছেলে বা মেয়ের কপালে ছোঁয়ানো হতো বরণডালা। ধান, তুলসী, দূর্বা মাথায় দিয়ে আশীর্বাদ করত সবাই। প্রথমে হলুদ লাগাত কপালে। তারপর গায়ে। মাথায় জল ঢেলে স্নান করিয়ে দিত কন্যাকে। উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত পাড়া। উপস্থিত সবাই হলুদ মাখাত এ-ওর গায়ে। আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠত গ্রাম।

‘গায়ে হলুদ’-এর হলুদ কুটতে আসত গাঁয়ের বধূরা। পাড় দিত টেকিতে। হলুদ কুটতে কুটতে গাইত তারা–

হলদি কোটো কোটো রে যতন করিয়া
সোনা আমার ঝলমল করবে রে হলুদ মাখিয়া
বাবা-মায়ের কষ্ট রে না বুঝিয়া
বালী আমার যাইবে রে সব ছাড়িয়া
রূপ বালীর ঝলমল করে রে
দেখো সব আসিয়া।।

হলুদ কোটা শেষ হলে সব নারী একসাথে মিলে হেসেখেলে কন্যার গায়ে হলুদ মাখত আর গাইত–

মাথায় হলুদ দ্যাও রে পঞ্চ রাই
মাথা দেখি বেলের মতো
কোন যে রানি জন্ম নিছে
চাঁদের মতো মুখখানি রে
বেলনের মতো হাত দুখানি
দেখ দেখ রে পঞ্চ রাই
কোন বা রাজা জন্ম নিছে কোন উদরে
এ বালীর কাছে চাঁদ রানিও হার মানে রে ॥

এই গীতের সাথে ইচ্ছেমতো কন্যার গায় হলুদ মাখাত তারা। মাখত নিজেরাও। সাথে হতো স্মৃতিচারণা। নিজেদের বিয়ের মধুময় সেই দিনগুলোের কথা মনে করে ছাড়ত বড় বড় দীর্ঘশ্বাস। ভাবত, কত দ্রুতই না চলে যায় সময়!

গীত গাইতে গাইতেই তারা বিয়ের কন্যাকে স্নান করাতো। এভাবেই চলত একটার পর একটা পর্ব। গাইত নতুন নতুন গীত। সবাই অংশ নিত সেই গানে।

বিয়ের দিন বাড়ির উঠোনে গোলামাটি, পিটুলি, রং দিয়ে আঁকত আলপনা। কলাগাছ পুঁতে রঙিন কাগজ দিয়ে উঠোনের মাঝখানে সাজানো হতো বিয়ের আসর। দেবদারু পাতা দিয়ে বাড়ির গেটে বানাত সুদৃশ্য তোড়ন। ছেলেকে আনতে যেত মেয়েপক্ষের বাড়ির লোক। ঘট-মঙ্গল করে বর রওনা দিত বরযাত্রীসহ মেয়ের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রাকালে মা ছেলেকে কোলের উপর বসিয়ে দুধ-চিনি খাওয়াত। ধান-দূর্বা মাথায় দিয়ে কপালে বরণডালা ছোঁয়াত। তারপর মাথায় পরিয়ে দিত টোপর। হাতে পরিয়ে দিত মঙ্গলসূত্র। সবাই মিলে দিত উলুধ্বনি। মাকে প্রণাম করে পাত্র বলত, তোমার জন্য দাসী আনতে চললাম মা। অনুমতি দাও।

মায়ের অনুমতি নিয়ে বরযাত্রীদের সাথে বর রওনা হতো গায়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে পায়ে হেঁটে। আর্থিক সামর্থ্যে কুলালে সখের বশে কেউ কেউ বরের জন্য ভাড়া করত পালকি। পালকির সাথে হাসি-তামাশার মধ্যে দিয়ে বরযাত্রীরা এগোত। সবারই চেষ্টা থাকত ভালো পোশাক পরার। নিজের না থাকলে অন্যেরটা ধার করত। পরনে ধুতি, বোগলে ছাতা। জামাটা থাকত কাঁধে। গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়ে গায়ে দিত।

বরযাত্রীসহ বরকে কনের বাড়ির সুসজ্জিত গেটে আটকে দিত শ্যালক শ্যালিকা শ্রেণির গ্রামের ছেলে, মেয়ে, বৌদিরা। তারপর চলত দরকষাকষি। তাদের দাবি মিটিয়ে মিষ্টিমুখ করে বরপক্ষ বাড়ির ভিতরে ঢুকত। বর দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ত গ্রামের বৌ-ঝিরা। রঙ্গরসে মেতে উঠত পাড়ার শ্যালক-শ্যালিকারা। বর আর বরপক্ষের লোকজনকে অপদস্ত করার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠত তারা। বরের জুতো সরিয়ে ফেলা, সরবতে চিনির পরিবর্তে লবণ বা ঝাল মিশিয়ে দেয়া, পানে বেশি চুন দিয়ে দেয়া ইত্যাদি নানা কৌশলের আশ্রয় নিত। বরপক্ষের লোকজনও থাকত সদা সতর্ক। তারপরও ঘটে যেত দু-একটা বোকামির ঘটনা। তাতে হাসির রোল পড়ে যেত।

মেয়েকে সাজানো হতো সুন্দর করে। গলায় থাকত মালা, কপালে চন্দনের ফোঁটা, তার উপরে ঝোলানো হতো টিকলি। মাথায় পরিয়ে দেয়া হতো শোলার মুকুট। পরনে থাকত লাল টিস্যুর শাড়ি। বেনারসি কেনার সামর্থ্য সাধারণ নমশূদ্র গৃহস্থের ছিল না। বাড়ির লোকজন পরম যত্নে কনেকে কোলে করে নিয়ে আসত বিয়ের আসরে। বসানো হতো আলপনা করা কাঠের পিঁড়িতে। উপহার সামগ্রী সাজিয়ে রাখা হতো বিয়ের আসরের পাশে। লেপ, তোষক, বালিশ, ছাতা, কাঁসার থালা-বাসন, পিতলের কলসি ইত্যাদি। বকনা বাছুরও থাকত কখনও কখনও দানসামগ্রীর তালিকায়।

নানা অনুষ্ঠানের পর বর-কনেকে বসানো হতো মুখোমুখি। বরের মাথায় থাকত শোলার টোপর, কপালে চন্দনের ফোঁটা। হাতে মঙ্গল সূত্র। শুরু হতো মন্ত্রপাঠ। কনের পিতা ঠাকুরের মুখঃনিসৃত মন্ত্র গভীর মনোযোগে শুনে পাঠ করে কন্যা সম্প্রদান করত। তারপরও চলতে থাকত নানা মন্ত্র। যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম..

হতো মালাবদল পরস্পরের। তারা বিশ্বাস করত মালাবদল হলে দুজনের মন এক হয়ে এক আদর্শে পরিচালিত হবে। তারপর বর-কনেকে কাপড় ঢাকা দিয়ে করানো হতো শুভদৃষ্টি বিনিময়। তারপর কনের সাতপাক ঘোরা। এর অর্থ কনে স্বামীর গৃহে স্নেহে হবে জননী, আদরে ভগিনী, সহানুভূতিতে মিত্র, উপদেশে গুরু, সেবায় দাসি, শয়নে বেশ্যা এবং সন্তান উৎপাদনে হবে ভার্যা। বর সিঁদুর পরিয়ে দেয় কনেকে। তারপর বর-কনের একসাথে যজ্ঞের চারদিকে সাতবার প্রদক্ষিণ। একে বলে সপ্তপদী। অর্থাৎ একসাথে সাত পা চললে বন্ধুত্ব হয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে বন্ধুত্ববোধ না থাকলে সংসারে পূর্ণতা আসে না।

নমশূদ্ররা বিশ্বাস করত, এমনিভাবেই প্রজাপতির নিবন্ধে তৈরি হয় দুজন মানব-মানবীর চির-অটুট বন্ধন। দুটি হৃদয় এক হয়ে অচ্ছেদ্য এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা। সাক্ষী থাকে তাদের পেছনের সাত পুরুষ। প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয় তারা পরবর্তী সাত জনমের।

এরপর থাকে লোকাঁচার। এলাকাভেদে পার্থক্য কিছুটা থাকলেও আচার অনুষ্ঠান মোটামুটি একইরকম। বিয়ে শেষে মেয়ে-জামাই আসর থেকে উঠে ঘরে যেত। মেয়ের মা আঁচল পেতে দিত দুয়ারে। সেই আঁচলে পা রেখে মেয়ে-জামাই ঘরে ঢুকতো। ঘরের ভিতর মেয়েরা আলপনা আঁকা মাটির সরায় চাল এবং পান-সুপারি রেখে পাশা খেলাত বর-কনেকে দিয়ে। পাশার দান দেবার ছলে তারা সুপারি গুনে ভবিষ্যদ্বাণী করত এই দম্পতির ছেলেমেয়ে কটি হবে। তৈরি হতো শান্তির জল। সেই জল ছিটিয়ে দিত প্রথমে বর-কনের মাথায়। তারপর উপস্থিত সবার মাথায়-গায়ে। সাথে হতো হাস্য রসিকতা।

পরদিন সকালে থাকত জামাইকে মিষ্টিমুখ করানো অনুষ্ঠান। তৈরি হতো পায়েস। জামাইকে পায়েস খাওয়ানো নিয়েও হতো নানা রঙ্গ-রসিকতা। গ্রামের লোকজনের সাথে হতো বরযাত্রীদের বাড়ত পরিচয়ের অন্তরঙ্গতা। বাড়ত ভাব বিনিময়। পাশাপাশি থাকত বরযাত্রীদের খাবার আয়োজনের ব্যস্ততা। খাওয়া দাওয়া শেষে বৌ নিয়ে চলে যাবে তারা।

দুপুরে হতো পাক পরশ। গ্রামের লোকজন, আত্মীয়-স্বজন এবং নিমন্ত্রিতরা উপস্থিত থাকে। সাধ্যমতো উপহার দিয়ে মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করে তারা। জামাই-এর জন্য পাথরের অথবা কাঁসার বড় থালায় সব রকমের খাবার সাজিয়ে বৌ নিজের হাতে নিয়ে আসে। তার থেকে জামাই কিছু অংশ নিজে খায়। বাকিটুকু কাপড়ে ঢেকে থালাসহ তুলে দেয় নববধূর হাতে। বলে–আজ থেকে তোমার ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব আমার। বউ সেই থালা কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করে তার সম্মতি জ্ঞাপন করে।

তারপর সকলের পক্ষ থেকে গ্রামের সমাজপতি মুরব্বি কেউ একজন মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করে বরযাত্রীসহ সকল অতিথিদের ভোজনের অনুমতি দেন। পাক স্পর্শে মাটির সরায় সজ্জিত অন্ন-ব্যঞ্জন নিয়ে নববধূ ঘুরে ঘুরে অতিথিদের পাতে সামান্য করে ভাত তুলে দেয়।

খাওয়া-দাওয়া শেষে কনে বিদায়ের পালা। পরিচিত আপনজন সবাইকে ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যাওয়া অচেনা-অজানা এক নতুন পরিবেশে। আজন্ম লালিত বাড়িঘর, উঠোন, উঠোনের পাশে বরইগাছ, গোয়ালে গরু, পোষা পায়রা সবই পড়ে থাকবে। তাদেরকে ছেড়ে যেতে বধূর প্রাণে নিদারুণ কষ্ট। বুক ফেটে বেরিয়ে আসে কান্না। কনের বাবা-মা, ভাই-বোন, খেলার সাথি, আত্মীয়-স্বজন সবার মনেই কষ্ট। প্রিয়জন হারানোর বেদনা। নাড়িছেঁড়া ধন চলে যাচ্ছে চিরকালের মতো পর হয়ে। মায়ের বুক চিরে বেরিয়ে আসে আর্ত-হাহাকার। সকলের কান্নাকাটিতে তৈরি হতো বেদনাবিধুর পরিবেশ। সানাইয়ের করুণ সুর সেই বিচ্ছেদ বেদনাকে বাড়িয়ে দেয় আরও বেশি করে।

কনে পালকিতে ওঠে। যত দূর পর্যন্ত সাথে সাথে যাওয়া যায়, প্রিয়জনেরা তত দূর পর্যন্ত এগিয়ে দেয় তাকে। চোখের জলে বিদায় জানায় আদরের মেয়েকে, স্নেহের বোনকে, প্রাণপ্রিয় খেলার সাথিকে। বিদায়ী বধূ পালকির দরজা খুলে বারবার পিছন ফিরে তাকায়। চেনা পথ, আড়ার পাশের আমগাছ, বাঁশঝাড়, আখের খেত সব পেছনে ফেলে পালকি এগিয়ে চলে দুলকি চালে। চলে অজানা নতুন আর এক ঠিকানার উদ্দেশে..

বাড়ির লোকেরা অভিজ্ঞ কেউ একজনকে মেয়ের সাথে দিয়ে দিত। তার ভালো-মন্দ দেখাশুনা করার জন্য। নতুন পরিবেশের সাথে কীভাবে মানিয়ে নেবে কন্যা তা শিখিয়ে-পড়িয়ে দেবে।

কিন্তু ছেলের বাড়ির চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। আনন্দের বন্যা সেখানে। বাড়িতে আসছে নতুন বউ। গ্রামের লোকজন এসে ভিড় করত বাড়ির উঠোনে। দূর থেকেই নজরে পড়ত বিয়ের চলন আসছে। বাদ্য বাজত বাড়ির উঠোনে। চলন বাড়িতে ওঠার পর সেই বাদ্যকারদের উৎসাহ বেড়ে যেত। দ্বিগুণ বেগে চলতে থাকত বাজনা। উঠোনের মাঝখানটায় পাতা হতে আলপনা আঁকা বড় দুটি কাঠের পিঁড়ি। বর-বউকে বসানো হতো সেই পিঁড়ির উপরে। উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত বাড়ি। বরণডালা কপালে চুঁইয়ে বর-কনেকে বরণ করে নিত সবাই। একে একে সবাই দেখত নতুন বউয়ের মুখ। টাকা বা অন্যবিধ সামগ্রী উপহার দিত তারা।

বাজনার তালে তালে গ্রামের বৌ-ঝিরা বরণ নাচ করত। নানাভাবে, নানা কায়দায় চলত নাচ। কখনও কলসি মাথায়, কখনও বা দুই হাতের তালুতে কাসার ছোট থালা নিয়ে। উঠোনের অনুষ্ঠান শেষে বউ নিয়ে বরের গৃহ প্রবেশ পালা। মা বসে দুয়ারে পা ছড়িয়ে। পেতে দেয় আঁচল। ছেলে মায়ের পাতা আঁচলে প্রণাম করে আঁচল সরিয়ে প্রথমে ডান পা রেখে বধূকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। পেছনে বড় ঘোমটায় ঢাকা বধূ অনুসরণ করে স্বামীকে। এ সময় বরের কনিষ্ঠ আঙুলের সাথে যুক্ত থাকে বন্ধুর কনিষ্ঠ আঙুল। বর-বধূ দুজনেই দুই পাশ থেকে মায়ের কোলে বসে কিছুক্ষণ। মা আশীর্বাদ করে বরণ করে ঘরে তোলে পুত্রবধূকে। ঘরের ভিতরেও থাকে কিছু অনুষ্ঠান। ধান দূর্বা, তেল, সিঁদুর দিয়ে জ্বলন্ত প্রদীপের সামনে আচার-অনুষ্ঠান সারে গ্রামের সধবা মহিলারা।

পরদিন হতো কাকশান এবং বাসি বিয়ে। ঠাকুর এসে মন্ত্রপাঠ যজ্ঞ করে। ঠাকুর মাথায় বাঁধে নতুন গামছা। যজ্ঞে খৈ পোড়ায় বর-বধূ। বাসি বিয়ে অনেক ক্ষেত্রে মেয়ের বাড়িতেও বিয়ের সময় একই সাথে সেরে নেয়া হতো। তারপর আংটি খেলা। উঠোনের এক পাশে মানের স্থানে গর্ত করে তাতে জল ভরে ছোট পুকুরের মতো বানানো হতো। পুকুরের দুই পাশে সিঁড়ি পেতে মুখোমুখি বসে বর-কনে। শুরু হয় লুকোচুরির আংটি খেলা। বাগদানের আংটি বা কড়ি বর সেই পুকুরে লুকিয়ে রাখে। বউ তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। তারপর হয় উল্টোটা। বউ লুকিয়ে রাখে, বর খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। খুঁজে পাওয়ার কায়দা, কত সময় ব্যয় হলো ইত্যাদি মিলিয়ে নির্ধারণ হতো হার জিত। সাথে উপস্থিত সবার হাস্য-রসিকতা, কথার বাক্যবাণে মজাদার হয়ে উঠত অনুষ্ঠান। সাথে চলে কাদা ছোঁড়াছুড়ি, গ্রামময় আনন্দ ছুটোছুটি। বিয়ের অনুষ্ঠানে আনন্দ-কর্মকাণ্ডল্লোড়ে মুরব্বিদের শাসনের নিষেধাজ্ঞায় শিথিলতা থাকত। মনে মনে হৈচৈ-আনন্দ উপভোগ করত তারাও।

বিয়ের দুদিন পর বাসর রাত। মেয়ের বাড়ি থেকে কাকী, বৌদিরা আল্পনা আঁকা হাঁড়িতে করে খৈ, মুড়ি, মিষ্টি নিয়ে আসে। সময়ের সাথে সাথে নতুন বৌ নতুন পরিবেশের সাথে সভয়ে-সলাজে চলাফেরা করতে করতে একসময় মানিয়ে নিত নিজেকে। কালে কালে এই নতুন বউই হয়ে উঠবে সংসারের কত্রী, মা, শাশুড়ি, ঠাকুমা, দিদিমা।

বিয়ের তৃতীয় দিনে বরের বাড়িতে আয়োজন হতো বৌভাত অনুষ্ঠানের। নববধূকে পাকস্পর্শ করানো হয়। বৌভাত অনুষ্ঠানে আসে নিমন্ত্রিত অতিথি, আতীয়-স্বজন, গ্রামবাসী, বাপের বাড়ির লোকজন। নতুন বউ অধীর হয়ে অপেক্ষা করে, কখন এসে পৌঁছাবে তার বাবা-মা, ভাই-বোন, অন্য স্বজনেরা আমন্ত্রিতরা সাধ্যমতো উপহার দিয়ে বর-কনেকে আশীর্বাদ করে। নববধূ সবরকমের খাদ্যদ্রব্য একসাথে মিশিয়ে একটু একটু করে আমন্ত্রিত অতিথিদের পাতে তুলে দেয়।

বৌভাতের পর মেয়ে-জামাই ফিরারিতে যায় মেয়ের বাবার বাড়ি। সাধারণত বিয়ের অষ্টম দিনে হয় এই যাওয়া। একে তাই বেশিরভাগ জায়গায় বলে অষ্টমঙ্গলা। এভাবে বিয়ের সাজেই দেখতে দেখতে কেটে যেত দশ দিন। বধূর কাপড়ের আঁচলে দশটা গিঁট বাঁধা থাকত এই দশ দিন পর্যন্ত। গিটে বাঁধা থাকে পান, সুপারি, হরীতকী, শাখা। তারপর দশম দিনে দেয়া হতো সেগুলোর বিসর্জন। গ্রামের ভাষায় দশোবার্জন।

শুধু যে আচার-অনুষ্ঠানই হতো বিয়েতে তা নয়। বিয়ের সাথে জড়িয়ে আছে গান, আছে গীত। বিয়ে বাড়িতে বরকে নিয়ে গাওয়া হতো নানা রকম রঙ্গ-রসিকতার গীত। বর যখন বিয়ে করতে কন্যার বাড়িতে পৌঁছাত তখন বরের সাথে যাদের রসিকতার সম্পর্ক তারা গাইত–

অমুকের (কনের ভাই বা বোনের নাম) দাদাবাবু আসিছে রে ভরা সভার মাঝে
ভরা সভার লোকগুলো তাই মুচকি মারে হাসে
তোর দাদাবাবু ক্যান ভাইবোন সাথে নিয়ে আসে নাই।।

বরের হয়ে বরপক্ষের লোকজন উত্তর দিত–

ভাই আছে জামা নাই
তাই শরমেতে আসে নাই।।

কন্যাপক্ষের লোকজন আবার প্রশ্ন রাখত–

তোর বাড়ি কি ছালা নাই
তাই পরে ক্যান আসে নাই!

বরপক্ষের লোকজন উত্তর দিত–

বোন আছে তার শাড়ি নাই
শরমেতে সে আসে নাই।

কন্যাপক্ষ আবার প্রশ্ন রাখত–

তোর বাড়ি কি চট নাই
তা পরে ক্যান আসে নাই।।

এরপর বিয়ে শেষে কন্যা যখন বাপের বাড়ি ছেড়ে পালকি বা গরুর গাড়িতে শ্বশুরবাড়ি রওনা হতো, তখন তারা গাইত–

ধীর চালাও গাড়ি রে গাড়িয়াল
আস্তে চালাও গাড়ি
আরেক নজর দেখিয়া নেই
আমার দয়াল বাপের বাড়ি রে
গাড়িয়াল ধীরে চালাও গাড়ি।।

নমশুদ্র সম্প্রদায়ের জীবন ছিল গীতের ছন্দে ছন্দময়। পেটে ভাত না থাকলেও চলে। কিন্তু জীবন থেকে সংগীতকে তারা আলাদা করতে পারত না। জীবন-সংগীত দিয়েই তারা জয় করত অভাব দূর করত কষ্ট। ভুলে থাকত পেটের খিদে। তাই নমশূদ্রদের জন্ম, কর্ম, বিয়ে, পার্বণ, ঋতু, প্রকৃতি সবকিছুই ছিল সংগীতময়।

এমনকি কষ্টকর মৃত্যুকেও তারা স্মরণীয় করে রাখত যুথবদ্ধ গীতিময় সুরে। স্বজন হারানোর বেদনাকে বুকে চেপে তারা তাদের কষ্ট গীতল ধারায় প্রকাশ করত–

ও আমার ফুলির বাপ, বাপ গো…
তুমি দই খাবার চাইছো, ভাজা মাছ চাইছো
তোমারে আমি কিছুই দিবার পারি নাই
ও ফুলির বাপ, বাপ গো…

তুমি যাবা ফুলির বাড়ি, গরুর দুধ নিয়া
আমি কইছি আর কয়দিন সবুর করো
তার আগেই তুমি কনে চলে গেলে
ও ফুলির বাপ, বাপ গো…

বিলাপের মতো করুণ সুর ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে। অন্যদেরকেও স্পর্শ করত সেই সুর। বাস্তবতার নিরিখে শুধু নামটা বদলে যেত। ফুলির জায়গায় যার বাবা মারা যায় তার নাম বসত। বাস্তবতার নিরিখে কথা বদলে যেত। বিলাপকারীর মনে উপস্থিত মতো যে স্মৃতি জাগরূক হয়ে উঠত, সেই কথাই বসে যেত।

ফাল্‌গুন মাস নমশূদ্রদের উল্লাস আর পাবণের মাস।

ফাল্‌গুন মাসে বড় এলাকা নিয়ে আয়োজন হতো ষাঁড়ের লড়াই। এদের ভাষায় এঁড়ে গরু নাড়াই। বিশাল প্রতিযোগিতা। এই ষাঁড়ের লড়াইকে কেন্দ্র করে বসত আড়ং। আবার বিশেষ কোনো আড়ং উপলক্ষে আয়োজন হতো এঁড়ে গরুর লড়াই। প্রতিযোগিতা উপলক্ষে বাজত ঢোল-কাসি, হতো আনন্দ-উল্লাস। ঘোষণা হতো পুরষ্কার। দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এঁড়ে গরু নিয়ে আসত মালিকরা। লড়াই দেখতে আসত হাজার হাজার উৎসুখ মানুষ উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে।

লড়াইয়ের ষাঁড় তৈরির প্রক্রিয়া বেশ লম্বা। নমশূদ্রদের মধ্যে যারা একটু সচ্ছল এবং সমাজে সম্ভ্রান্ত ‘মশায়’ হিসাবে পরিচিত তারাই পুষত এই এঁড়ে গরু। আপন সন্তানের মতো পরম যত্নে এদেরকে বড় করত। যত্ন করে খাওয়াত, নিয়মিত স্নান করাত, পরিচর্যা করত। যেন সুন্দর এবং স্বাস্থ্যবান হয় তার গরু। এদের ভাষায় ‘আগে দর্শনদারী, পরে গুণ বিচারি’।

যোদ্ধা গরু তৈরির প্রক্রিয়াও অভিনব। প্রথমে ঘাড়ে-গর্দানে মোটা পুরুষ বাছুর বেছে নেয়া হতো। অন্য গরু থেকে একেবারে আলাদা করে সেই বাছুরকে ছনের গোয়ালে আবদ্ধ করে রাখা হতো। ঘরের বেড়া গোবর-মাটি দিয়ে লেপে বেড়ার সমস্ত ছিদ্র বন্ধ করে দেয়া হতো। যাতে সূর্যের আলো ওই ঘরে প্রবেশ না করতে পারে। একে বলা হতো ‘আঁধারি’।

মাসের পর মাস বাছুরটি এই আঁধারির মধ্যে মেদহীন খাবার খেয়ে বড় হয়ে উঠত। এভাবে বাছুরটি যতই একা একা থাকত, ততই হিংস, রাগী আর তেজস্বী হয়ে বেড়ে উঠত। অন্য কোনো ষাঁড় বা এঁড়ে গরু দেখলেই ক্ষেপে উঠত। সেই সাথে চলত যুদ্ধের প্রশিক্ষণ।

লড়াইয়ের দিন তারা ষাঁড়ের পায়ে, শিং-এ ভালো করে তেল মাখাত। গলায় বাঁধতো লালসালু আর পিতলের ঘণ্টা। সেই ঘন্টা বাজিয়ে মালিক তার এঁড়ে নিয়ে যেত পাল্লার মাঠে। ঘণ্টার শব্দ শুনে সবাই ফিরে তাকাত। আকার, গায়ের রং এবং চেহারার উপর ভিত্তি করে দর্শকরা ষাঁড়ের ভক্ত বনে যেত। লড়াই চলাকালে তাদের পছন্দের ষাঁড়কে উৎসাহ দেবার জন্য উল্লাস করত ভক্তরা। চিৎকার করে সমর্থন জানাত।

খেলা শেষে বিজয়ী ষাঁড় প্রভুর মুখে ফুটে উঠত গর্বের হাসি। হাঁটাচলায় অহংকারের ভাব। গ্রীবা টান, সিংহভঙ্গিতে চলাফেরা করে বেড়াত সে সবার সামনে দিয়ে।

যে গ্রামে এই ষাঁড় পোষা হতো, সেই গ্রামের সবাই এর অংশ হয়ে যেত। অলিখিত দায়িত্ব এসে পড়ত তাদের উপরেও। ষাঁড়ের যত্ন-আত্তি ঠিকমতো হচ্ছে কি না, ঠিকঠাকমতো ট্রেনিং চলছে কি না প্রতিনিয়ত খোঁজখবর নিত তারা। গোটা গ্রামের মানুষের মান-সম্মান জড়িয়ে যেত এই ষাড়ের সাথে।

প্রতিটি ষাঁড়ের জন্য একজন বা একাধিক গুণিন ফকির ঠিক করা হতো। তারা মন্ত্র-তন্ত্র দিয়ে যাড়ের শরীর বন্ধন দিত। বাণ বা জাদুটোনা থেকে সুরক্ষিত থাকত ষড়। তারা বিশ্বাস করত, গুণিনদের নিয়মিত মন্ত্র ও ধুলো পড়ায় ষাঁড় দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। গুণিনরা খেলার মাঠেও ষাঁড়ের সাথে সাথে যেত মন্ত্র পড়তে পড়তে। যাতে কেউ খেলার মাঠে নামার আগ পর্যন্ত বাণ বা জাদুটোনা না করতে পারে। একে বলা হতো ‘সারন সারা। তবে সকল গুণিনের মন্ত্র এক নয়। এক একজন এক এক মন্ত্রের আশ্রয় নিত। কেউ পড়ত–

করাত করাত মহা করাত
আসতি কাটে যাতি কাটে
ভূত কাটে প্যাত কাটে
দানব কাটে দৈত্য কাটে
কার আজ্ঞে, কামরূপ কামাখ্যার আজ্ঞে
আমার এই মন্ত্র যদি নড়ে
ছত্রিশ কোটি দেবতার মুণ্ডু কাটে
ভূমিস্তলে পড়ে।।

অন্য গুণিন হয়তো আরেক মন্ত্র পড়ত–

কালী কালী মহাকালী
পায়ে নূপুর বাজে
ষোল’শ ডাকিনী নিয়ে
জয়কালী সাজে
দোহাই তোর ধর্মের লাগে
শিবের মাথা খসে
আমার এই সেবক ছাড়ে যদি
অন্যখানে যাস ॥

একমুষ্টি ধূলি হাতে নিয়ে মন্ত্র পড়ে সেই ধূলি তিনবার ষাঁড়ের লেজ থেকে মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে দিত।

শুরু হয়ে যেত লড়াই। সেই লড়াইয়ে যার মন্ত্রপূত ষাঁড় জয়লাভ করত, সেই গুনিনকে মাথায় তুলে পাগল হয়ে নাচত সমর্থকররা। মহা একটা ভাৰ নিয়ে গুনিন চলত-ফিরত। যেন শুধুমাত্র তার মন্ত্রগুণেই এই বিজয় লাভ।

কোনো কোনো বছর গুটি বসন্ত ছড়িয়ে পড়ত মহামারি আকারে। বসন্ত রোগের কোনো প্রতিষেধক ছিল না তখন। ছিল গুণিন আর কবিরাজ ভরসা। কবিরাজ, গুনিনদের আয়ত্তের বাইরে রোগ চলে গেলে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ত হাহাকার। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে যেত। বসন্ত ছোঁয়াচে হওয়ায় রোগ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই ছেলেমেয়ে, বউ নিয়ে মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেত। অনেক সময় রোগাক্রান্তদের ফেলে চলে তে তারা। মানবতা ধুলায় গড়াগড়ি যেত।

ফাল্‌গুনের শেষ দিনে হতো গরুর রক্ষাকর্তা গোরক্ষনাথ ঠাকুরের পূজা। গরুর সুস্বাস্থ্য এবং প্রজনন বৃদ্ধি কামনা করে আয়োজন করা হতো এই পুজোর। পুজোর উপাচার তেমন নেই। ধান-দূর্বা আর সিঁদুর। সকালবেলা সবগুলো গরুকে সান করানো হতো। রান্না হতে মিষ্টান্ন। গোয়ালে গিয়ে সেই মিষ্টান্ন মুখে বাঁ হাতে নিয়ে ছিটিয়ে দিত গরু গায়। আর আঁকড়া গাছের পাতাসুদ্ধ ডাল দিয়ে গরুর সারা গা ঝেড়ে দিত। নমশূদ্র কৃষকরা বিশ্বাস করত, এতে গরুর সমস্ত রোগ-ব্যাধি দূর হয়ে যাবে। তারপর কাচি দিয়ে গরুর লেজের মাথা থেকে ছোট্ট এক গোছা চুল কেটে বেঁধে রাখত গোয়ালের খুঁটিতে বা রেখে দিত গোয়ালের চাঙে। রাখার সময় সুর করে বলত–

সাত নাত কপালে চিৎ
দামড়া দিয়া দামইর দিস।

আগের সন্ধ্যায় গোয়ালে দিত ধোয়া। বিলের নমশূদ্ররা একে বলত সাজাল। গোয়ালের চারপাশে পুঁতে দিত কাঁটাওয়ালা ডাল। একে বলত তারা যমের দুয়ারে কাঁটা দেওয়া। গরু ছিল কৃষকদের কৃষিকাজের প্রধান হাতিয়ার। প্রকারান্তরে কৃষির মঙ্গল কামনাই ছিল এ পুজোর লক্ষ্য।

ফাল্গুন-চৈত্র মাসে নিয়মিত না হলেও মাঝে মাঝে আসত গাজি। তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের। পরনে ঢোলা পোশাক। কাঁধে ঝোলা। মাথায় লম্বা চুল। অনেকটা গেরুয়া বসনা পীর-ফকিরের মতো। তাদের হাতে থাকত লাঠি। লাঠির মাথায় থাকত ঘুঙুর ঝোলানো। সেই লাঠি সজোরে উঠানে গেড়ে দিত। ঘুঙুরের শব্দ ঝনঝন করে বেজে উঠত। সন্ন্যাসী জ্ঞানে ভক্তিভরে বাড়ির মানুষ এগিয়ে আসত। বিশেষ করে মহিলা ও ছোট ছেলেমেয়েরা। শুরু হতো গাজির গান। চারদিকে ভিড় করে শুনত সবাই সেই গান।

দম দম বলিয়া গাজি ছাড়িল জিকির
কালু ঘোষের মায়ে বলে নন্দ ঘোষের ঝি
বাড়ি আসছে গাজি ফকির ভিক্ষা দেবা কী?
বাটা ভরে চাল দেবো আর দেবো কী?
মাইঝা বৌ লো মা, গগনেতে অধিক বেলা উঠান কুড়াও না।
মাইঝা বৌ উইঠা বলে, আমি সবার দাসী?
এত লোক থাকতে আমি কেন উঠান কুড়াতে আসি।

রান্ধিয়া বাড়িয়া যে বা নারী স্বামীর আগে খায়
ভরণ কলসের জল ত্রাসে শুকায়।
দপদপাইয়া হাঁটে নারী চোখ পাকাইয়া চায়
ছয় মাসের মধ্যে নারীর শাখা-সিঁদুর ক্ষয়।
সতী নারীর পতি যদি সভার মাঝে যায়
যদি কথা মন্দ বলে তবুও ভালো কয়।
অসতীর পতি যদি সভার মাঝে যায়
যদি কথা ভালো বলে তবু মন্দ হয়।
নাইয়া ধুইয়া যেবা নারী মুখে দেয় পান
লক্ষ্মী মা উইঠা বলে সে নারী আমারই সমান।

সবাই মুগ্ধ হয়ে গান শুনত। আরও গান গাওয়ার অনুরোধও করত কেউ কেউ। গাজিও গাইত আগ্রহভরে। গানশেষে চাল দিত। সাথে থাকত আলু, বেগুন অথবা পটল। বিদায় নিয়ে গাজি অন্যবাড়ির পথ ধরত। তার পিছে পিছে ছেলেমেয়েরা চলত। অন্যবাড়িতে গিয়ে আবার শুনত গান।

বদর পীরকে মেনে চলত নমশূদ্ররা। হিন্দু-মুসলমান সবার কাছেই নদী এবং নৌকার অভিভাবক হিসেবে বদর পীর সম্মান পেত। পুঁজিত হতো নমশুদ্রদের নৌকাযাত্রাকালে। ভরা বিলে সব বাড়িতেই থাকত নৌকা। নৌকা ছাড়ার সময় জল হাতে নিয়ে নৌকার গলুইয়ের উপর ছিটিয়ে দিত। দুই হাত শ্রদ্ধাভরে কপালে ঠেকিয়ে বদর’ ‘বদর’ বলে ঠেলা দিয়ে নৌকায় উঠে যাত্রা করত তারা।

ফাল্‌গুনের শেষে মাঠে মাঠে চৈতালি ফসল তোলার ধুম। কৃষকরা ফসল তোলে, মলন মলে। কৃষাণীরা ফাগুনের দখিনা বাতাসে কুলোয় ওড়ায়, ঝড়ে, পরিষ্কার করে ধামায় ভরে। কাজের বিরাম থাকত না কারো। বাচ্চারা ধুলায় গড়াগড়ি যেত, খিদে পেটে মাটিতেই ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু দেখার অবসর থাকত না কৃষাণীর।

পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন মাসজুড়ে চলত বিয়ে, যাত্রাপালা, রামায়ণ গানের আসর। বসততা অষ্ট গান, পদাবলি কীর্তনের আসর।

রামায়ণ গান হতো গৃহস্থ বাড়ির উঠোনে। কোনোদিন রামের রাজ্যাভিষেক পালা, কোনোদিন সীতা হরণ। গায়ক তার গলায় সবটুকু দরদ ঢেলে বর্ণনা করত অশোক বনে বন্দি সীতার দুঃখের কাহিনি। গলার সুর কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে অনেক উঁচুগ্রামে নিয়ে ছেড়ে দিত গায়ক। নমশূদ্রদের ভাষায় গাতক। করুণ সেই সুর নিশুতি রাতের কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ত গ্রামের খোলা প্রান্তরে। আসরে বসা মেয়েরা বারবার আঁচলে চোখ মুছত। মন ভিজে যেত ছেলেদেরও। কিন্তু অলৌকিক কোনো কৌশলে তারা চোখের জল গোপন করে ফেলত। তাদের মতে, পুরুষ মানুষের চোখের জল এত সহজ হলে চলবে কেন? কথায় কথায় মেয়েরা কাঁদতে পারে, ব্যাটা মানুষের কি তা মানায়! এই ছিল তাদের সহজ দর্শন।

বাড়ির উঠোনে বসত পদাবলি কীর্তনের আসর। ভালো দরদি গায়ক হলে চোখের জলে ভাসত শ্রোতা-দর্শক। সুরের মূছণায় মুগ্ধ হতো সবাই। হৃদয় হতো আর্দ্র।

বসততা রাধা-কৃষ্ণের লীলাভিত্তিক অষ্ট গানের আসর। কখনও বাড়ির উঠোনে। কখনওবা কালীতলা, হরিতলার সামনে খোলা চত্বরে। রাধা-কৃষ্ণের মান-অভিমান, বিরহের আকুলতা, মানভঞ্জন উপস্থিত দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করত। আকুল হতো তাদের মন।

এভাবেই আনন্দ-উৎসবে দেখতে দেখতে পার হয়ে যেত নমশূদ্রদের আর একটা ফাল্গুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *