০৯. পৌষ

পৌষ

হেমন্তের হাত ধরে দেখতে দেখতে এসে যেত পৌষ।

বাতাসে শীতের গন্ধ। শীতের কুয়াশায় মোড়া চারিদিক। দেখতে দেখতে জাঁকিয়ে বসে শীত। গরিব কৃষকদের জন্য কষ্টের সময়। শীতবস্ত্রের অভাব কাঁপতে থরথর করে। মুখে বলত–কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ।

দিন ছোট হয়ে যায় অনেক। সূর্য ভালো করে উঠতে না উঠতেই দুপুর এসে পড়ে। দুপুর গড়াতেই না গড়াতেই বেলা পড়ে আসে। নেমে আসে প্রকৃতিতে সন্ধ্যার ছায়া। সামনে হরিৎ বর্ণ মাঠ। ম্রিয়মাণ গাছের পাতা। শীতের টানে শরীরের চামড়ায় আসে শুষ্কতা। ফাটে ঠোঁট।

এই সময়ে নমশূদ্র গৃহস্থরা বাড়িসংলগ্ন জমিতে, পালানে চাষ করত উচ্ছে, বেগুন, লাউ, কুমড়া, কপি, মুলা, সিম, আলু, রসুন। করত আরও নানা রকম শাক-সবজির চাষ। পাটকাঠির বেড়া দিত খেতে খেতে। তৈরি করত জাংলা বা মাচা। মাচায় ঝুলত উচ্ছে, লাউ, শসা, ঝিঙ্গে। ঘরের চালে দেখা যেত কুমড়া, লাউ, চাল কুমড়া।

মাঠে মাঠে দোল খেত সবুজ চৈতালি ফসল। এই ফসলের যত্নের প্রয়োজন হয় না। আগাছা পরিষ্কার বা অন্য পরিচর্যারও তেমন দরকার হয় না। আপনাআপনিই বেড়ে ওঠে গাছ। নমশুদ্র কৃষকের ভাষায় চৈতালি ফসল হলো ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। মূল ফসল তাদের ধান আর পাট। চৈতালি বোনা হয় নিতান্ত অবহেলায়। ঘরের ডাল, তেলের প্রয়োজন মিটানোর জন্যই মূলত চৈতালির চাষ।

পৌষ মাসে বিলের উপরের দিকের জল পুরোপুরি শুকিয়ে যেত। কিন্তু বিলের গভীরে থাকত কোথাও হাঁটুজল, কোথাও বা কোমর সমান। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি থেকে সেই জলে দলে দলে শীতের পাখি এসে পড়ত। নানা বর্ণের, নানা আকারের, নানা চেহারার। স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন নাম ছিল সেসব পাখির। শামুকভাঙা, কাচিকাটা, মদনা, ওয়াক ইত্যাদি। এসব পাখি দেখতে অনেকটা সারসের মতো। শামুকভাঙা পাখি তাদের বড় বড় ঠোঁট দিয়ে। শামুক ভেঙে ভিতরের মাংস খেত। এ কারণেই সম্ভবত এর নাম ছিল শামুকভাঙা। লম্বা কাইচির মতো ঠোঁটওয়ালা পাখিগুলোকে বলত কাচিকাটা। ওয়াক, ওয়াক শব্দে ডাকত বলে সেই পাখিগুলোর নাম ছিল ওয়াক। কোনো কোনোটার ওজন পাঁচ-সাত সের পর্যন্ত হতো। আর ছিল বালি হাঁস, বুনো হাঁস।

মাঝে মাঝে শিকারি নামত বিলে জলে ছড়রা বন্দুক নিয়ে। একসাথে অথবা পরপর ছড়রা বন্দুকের নল দিয়ে একাধিক গুলি বেরিয়ে আসত। পাখির ঝকের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রেখে কখনও পা টিপে টিপে, কখনও বা হামাগুড়ি দিয়ে বিলের জল ভেঙে এগোত তারা। সুবিধামতো জায়গায় গিয়ে পজিশন নিত শিকারিরা। সুযোগমতো গুলি ছুড়ত। উড়ন্ত ঝাঁকেও কখনও কখনও ফায়ার করত তারা। একসাথে দশ-বারোটা পাখির গায়েও লাগত কখনও কখনও! আহত পাখিরা প্রাণের তাগিদে এদিক-সেদিক উড়ে পালানোর চেষ্টা করত। এলাকার নমশূদ্র ছেলেরা দূর থেকে নজর রেখে ছুটত সেই পাখিদের অনুসরণ করে। শিকারির চোখ ফাঁকি দিয়ে আহত পাখি ধরে লুকিয়ে ফেলত। তারপর রান্না করে সবাই মিলে মহা উৎসবে খেত।

নিজেরা ফাঁদ পেতে বা জাল দিয়ে শিকার করত বক, ডাহুক, চ্যাগা, কাদাখোঁচা, নলঘোঙরা ইত্যাদি পাখি। একধরনের সাদা বক ছিল গরুর পেছন পেছন হাঁটত। এজন্য এদেরকে বলা হতো গো-বক। গো-বকের মাংস কেন যেন নমশূদ্র গেরস্থরা খেত না।

.

নমশুদ্র কৃষকরা ছিল ভীষণ রকমের ধর্মপরায়ণ। স্বাত্তিক ভাবধারায় চলত তাদের জীবন। তাদের রান্নাবান্নায় কখনও পেঁয়াজ-রসুনের ব্যবহার থাকত না। মাছে, তরকারিতে তো নয়ই, এমনকি মাংসেও নয়। মাংসে দিত গরম মসলা। আর পেঁয়াজ-রসুনের বদলে দিত চালের গুঁড়ার পিটুলি। মাংসের ঝোলের ঘনত্ব বাড়ত তাতে খানিকটা। নমশুদ্র গেরস্থরা তাদের বাড়িতে কখনও মুরগি পুষত না। মুরগির ডিমও খেত না তারা। তারা খেত শুধুমাত্র হাঁস আর কচ্ছপের ডিম। কচ্ছপের মাংস ছিল তাদের প্রিয় খাবার।

চৈতালি ফসল না পাকা পর্যন্ত কৃষকদের মাঠের কাজকর্ম তেমন থাকত না। এই অবসরে এরা মেতে উঠত লাঠি-সড়কি খেলার মহড়ায়। সেই আনন্দ উদ্দীপনায় বড়দের সাথে ছোটরাও যোগ দিত। শিখত লাঠি খেলার নতুন নতুন পাঁচ আর লাঠি ঘোরানোর কৌশল।

লাঠি খেলা এবং শেখার কোনো বয়স নেই। পনেরো থেকে পঁচাত্তর–সব বয়সের পুরুষই দাদু-নাতি-বাবা নির্বিশেষে একই সাথে লাঠি খেলার আনন্দে মেতে উঠত। বাঁশের লাঠি এবং বাঁশের সড়কির লাঠিতে তেল মাখিয়ে রোদে শুকাত তারা। একে বলে তেলাই কোলাই। তেলাই কোলাইয়ের পর তৈরি করত লাঠির কুঁড়ো।

খেলার মাঠে বাপ-ব্যাটা মালকোচা মেরে সড়কি বা লাঠি হাতে মুখোমুখি হতো। মুখ দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় শব্দ বের করে একে অপরকে যুদ্ধে আহ্বান জানাত–আও… আও…

সুযোগ বুঝে তারা লাঠি-সড়কির মারপ্যাঁচে একে অপরকে আঘাত করত, প্রতিক্ষের আক্রমণ ঠেকাত। দক্ষ, মজবুত সর্দারি আঘাত হানার চেষ্টা করত সবাই। নমশূদ্রদের ভাষায় একে বলা হতো বিজয়ী আঘাত’। এছাড়া ছিল দলগত খেলা, দলগত প্রতিযোগিতা।

পৌষ থেকে ফাল্গুন নমশূদ্রদের লাঠি–ডুকি খেলার মৌসুম। এ সময় প্রতি গ্রামে এদের এই খেলার মহড়া চলত। শুধু মহড়াই না, এ গ্রাম, ও গ্রাম পাল্লা করে লাঠি খেলত তারা। আড়ং বা মেলায়ও লাঠি খেলা প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো। ঘোষণা থাকত পুরস্কারের। খেলায় উৎসাহ দেবার জন্য থাকত ঢোল-কাসির মাতন। লাঠিয়ালদের তেজের দাম্ভিকতা আর লাঠি সড়কির কর্মকাণ্ডে কেঁপে উঠত মাটি। বাজনার তালে তালে জংলি নৃত্যের উন্মাদনায় উত্তেজিত হয়ে উঠত হাজারো দর্শক।

লাঠিয়াল সর্দারদের ছিল গোঁফের বাহার! যেমন থাকত তাদের মুখে বেজির লেজের মতো তাগরাই গোঁফ, তেমনি থাকত মাথাভরা আউলা-ঝাউলা বাবরি চুল। এই গোফ ও চুল ছিল এদের শক্তি ও অহমিকার প্রকাশ। এক এক সর্দারের লাঠি ও সড়কির প্যাঁচ ছিল এক এক রকম।

খেলার আসরে দু-পক্ষ প্রতিযোগিতায় নামলে সর্দারের মুখে থাকত দাম্ভিক তর্জন, গর্জন। যা শুনে শিশুরা ভয়ে কুঁচকে যেত। যে সর্দার বিজয়ী হতো, সে যেন জয় করত নতুন এক ভুবন। তার চলাফেরায় চলে আসত সিংহের ভাব। দর্শকরাও তাকে দেখত চোখে মহা বিস্ময় নিয়ে।

শীতের কুয়াশা ভেদ করে নমশূদ্র পল্লি থেকে কখনও কখনও ভেসে আসত উলুধ্বনি। অসময়ের উলুধ্বনি হলে বুঝতে হবে, আরও একটি নতুন জীবনের আবির্ভাব হলো ধরণীতে। উলুধ্বনির শব্দ তিনবার হলে বুঝতে হবে কন্যা সন্তান হয়েছে। পাঁচবার হলে পুত্র সন্তান। নমশূদ্র গ্রামে অবশ্য সন্তান প্রসব হওয়া বলত না, বলত খালাস হওয়া।

সন্তানের জন্ম ঘরের মধ্যে হতো না। শীত, কুয়াশার ফ্যাচফেচে উঠোনের এক কোণে বানানো হতো আঁতুড় ঘর। সেই ঘরে শুকনো খড় বিছিয়ে তার উপরে ছেঁড়াছুটো খেজুরের পাতার পাটি, তার উপরে ছেঁড়া কাথা। এভাবেই শীত-গ্রীষ্ম, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে উঠোনের আঁতুড় ঘরে জন্ম নিত নমশূদ্র সন্তানরা।

সন্তান জন্ম নেয়ার আনন্দে উলুধ্বনির সাথে আহ্লাদিত হয়ে মেয়েরা গান ধরত–

নয়া মাটির নয়া রে ফুল
পাকিয়া হইচে টলমল
নয়া বাতি ঝলোমল করি আইচে।
রাজা হোক রানি হোক
কালা হোক গৌর হোক
বংশবাতি উজালা হইচে ॥

শিশু জন্মের পর মাকে খেতে দেয়া হতো নিরামিষ। নরম ভাত আর লাউ, পেঁপের মতো সহজপাচ্য সিদ্ধ তরকারি। যাতে মায়ের পেটের কোনো সমস্যা না হয়। কারণ তার সাথে জড়িয়ে আছে সদ্যোজাত সন্তানের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার প্রশ্ন। ভাতের সাথে দিত ঘি অথবা রসুন দিয়ে কালো জিরে বাটা। উদ্দেশ্য মায়ের কাটা নাড়ির ঘা শুকনো। এভাবেই কেটে যেত পাঁচ রাত।

ষষ্ঠ রাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নমশূদ্ররা তাদের ভাষায় এই রাতকে বলত ছয়কালে রাত। এই দিনে আঁতুড় ঘরে মাকে খেতে দেয়া হতো ছয় আনার ছয় রকমের তরকারি দিয়ে ভাত। এই রাত নবজাতকের ভাগ্য লেখার রাত। তাদের বিশ্বাস, বিধি স্বয়ং আঁতুড় ঘরে এসে এই রাতে সন্তানের কপালে ভাগ্য লিখে দিয়ে যায়।

সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে তাই বিধি ঢোকার মতো সামান্য ফাঁক রেখে আঁতুড় ঘরের মুখ বন্ধ করে দেয়া হতো। যাতে নির্বিঘ্নে ভালো ভাগ্য লিখে যেতে পারে সন্তানের কপালে। এই রাতে যা লেখা হবে, সেই বিধিলিপি খণ্ডানোর উপায় থাকবে না আর কোনো।

এ নিয়ে প্রচলিত ছিল কাহিনি–

এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার হলো একটা ফুটফুটে কন্যা। ছয়কালে রাতে আঁতুড় ঘরের সামনে বিধি আসে দাঁড়াল রাজকন্যার ভাগ্য লেখার জন্যে। কিন্তু ধাত্রী বসে আছে আঁতুড় ঘরে ঢোকার মুখে পা আটকে। বলল–রাজকন্যার ভাগ্যে কী ল্যাকপা, সিতা কতি হবি আগে। নালি ঢুকতি দেব না।

বিধি বলে–তা তো বলা যাবে না।

ধাত্রী কয়–না কলি পথ আটকায়ে রাখপো।

বিধি বলে–না লিখলে বলব কীভাবে? আগে তো লিখতে দাও।

তালি যাওয়ার কালে কয়ে যাবা, কতা দ্যাও। নালি কিন্তুক বার হতি দেব না।

ঠিক আছে। তাই হবে।

রাজকন্যার কপালে ভাগ্য লিখে চলে যাবার সময় বিধি বলে গেল–রাজকন্যার বিয়ে কোনো রাজপুত্রের সাথে হবে না। হবে কাঁপালির ছেলের সাথে।

এই কথা বলে বিধি তো গেল চলে।

ধাত্রী এখন কী করে! এ কথা তো কারো কাছে বলার মতো না।

কালে কালে রাজকন্যা বড় হয়। সেই সুন্দর মুখের দিক তাকিয়ে ধাত্রীর বুকের ভিতর খচখচ করে। আর মনে মনে বলে–আহা রে! এমন সোন্দর রাজকন্যা, তার বিয়ে হবি বুনো কাঁপালির সাথে!

ধাত্রী ঠিক করে, রাজকন্যাকে সাবধান করে দেবে। যাতে সে চেষ্টা করে তার বিধিলিপি খণ্ডন করে ফেলতে পারে।

রাজকন্যা এ কথা শুনে মনে কষ্ট পায়। ভাবে, তার বিয়ে হবে কাঁপালির সাথে! না, সে থাকবেই নে দেশে।

ভাগ্য বদলে ফেলতে একদিন সে রাজবাড়ি ছেড়ে রাতের আঁধারে বের হয়ে চলে গেল।

রাজ্য পার হয়ে রাজকন্যা চলে গেল আরেক দেশে। সামনে পড়ল বিরাট এক প্রাসাদ। ভাবল, এই বাড়িতে সে থাকবে। তাহলে কেউ আর তারে খুঁজে পাৰে না। ছদ্মবেশে কাজের লোকের বেশে রাজকন্যা থাকে। মাথায় বড় ঘোমটা। কেউ যেন চিনে ফেলতে না পারে। ভোররাতে উঠে সে সব কাজ করে ফেলে। বেলা হলে পালিয়ে থাকে ঝাপির ভিতর। আবার বের হয় রাতের বেলা।

সেই বাড়ির সাত ছেলে। ছয় ভাই বিয়ে করে ঘর সংসার করে। ছোট ভাই বিয়ে করে নাই। সে একদিন ভোররাতে দূর থেকে রাজকন্যাকে দেখে ফেলল। ভাবে কে এই কন্যা! তারপর সে দেখে, সাত তাড়াতাড়ি ঘরের কাজ সেরে কন্যা ঝুপির ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। সন্দেহ হলো ছেলের মনে। সে থাকে তাকে তাকে। তারপর একদিন এক ফাঁকে সে রাজকন্যার মুখ দেখে ফেলে। রাজকন্যার রূপ দেখে ছেলে পাগল হয়ে যায়। বলেসে বিয়ে করবে এই মেয়েকে।

কাজের মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয় না বাড়ির লোকজন। তখন সে রাগ করে রাজকন্যা যে ঝুপির ভেতর পালিয়ে থাকে, সেটা পুড়িয়ে দিল। এখন রাজকন্যা লুকাবে কোথায়! রাজকন্যার রূপ দেখে সবাই মুগ্ধ। শুভদিন দেখে ছোট ছেলের সাথে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে দিল তারা। রাজকন্যাও অমত করল না। ছোট ছেলে দেখতে সুন্দর। রাজপুত্রের মতো। অবস্থাও তাদের অনেক ভালো। রাজপ্রাসাদের মতো বিশাল বাড়ি। কাঁপালির সাথে তো আর বিয়ে হচ্ছে না। বিধিলিপি খণ্ডন করতে পেরেছে। সেই আনন্দ মনে নিয়ে কন্যা ঘর-সংসার করতে লাগল।

একদিন ছেলেটা কদম্বডালে বসে মনের সুখে বাঁশি বাজাচ্ছিল। সেই বাঁশি শুনে মুগ্ধ হয়ে তার বড় বৌদি বলে উঠল-কাঁপালির ব্যাটা হলি কী হৰি, বাঁশি বাজায় কালা কেষ্টর মতো।

রাজকন্যা শুনে ভাবে, এ কী হল! এত কষ্ট করেও বিধিলিপি খণ্ডন করা গেল না! শেষমেশ সেই কাঁপালির সাথেই তার বিয়ে হল!

আঁতুড় ঘরে কেটে যেত একে একে আট দিন। এই সময়ে মাকে আমিষ দেয়া হতো না। নবম দিনে মা নবজাতকসহ আঁতুড় ঘর থেকে বের হয়ে ঘরে যেত। নাপিত ডেকে জাতকের মাথার চুল চেঁছে ফেলে দিত। এই দিনে মায়ের জন্য আনা হতো রুই-কাতলা জাতীয় বড় মাছ। নমশূদ্ররা বিশ্বাস করত, মাছ যত বড় হবে, হৃষ্টপুষ্ট হয়ে আকার-আকৃতিতে ততই মোটাতাজা হবে নবজাতক। মাছে ঝাল তেল মসলা কম দেয়া হতো। মা মাছ খাওয়া শুরু করলেও সাথে সবজিও থাকত পরিমাণে অনেক। তারা মনে করত, এতে মায়ের বুকে দুধ আসে। লাউয়ের মতো রসালো তরকারি বেশি খেলে, দুধেরও আধিক্য হবে।

ঠাকুর বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হতো শান্তিজল। আঁতুড় ঘরের বাইরে এনে, স্নান করিয়ে শান্তিজল ছিটিয়ে বাচ্চাসহ মাকে ঘরে তোলা হতো। আঁতুড় ঘরে ব্যবহৃত সব কাপড়, কাঁথা, বালিশ ফেলে দেয়া হতো।

সন্তান যদি ছেলে হয়, তাহলে একুশ দিনে আর মেয়ে হলে ত্রিশ দিনে করা হতে ষষ্ঠী পুজো। গ্রামের মহিলাদের ডেকে আনা হতো বাড়িতে। চালন কুলোয় ধান দূর্বা, এক ফানা কলা, প্রদীপ আর ধুপতিতে থাকে ধূপ। চালনে থাকে কাঁচা টাকা, এক সের চাল, বেগুন তরি-তরকারি, কাজলদানি। মেয়ে হলে থাকে সিদুরের কৌটা।

ষষ্ঠী পুজোর আয়োজন হতো বাড়ির উঠোনে। ঠাকুর আসত। ফুল বিল্বপত্র সাজিয়ে জলঘট বসানো হতো। পুজো শেষে গ্রামের মোড়ল ডেকে মুরব্বিদের হাতের আশীর্বাদী ধান-দূর্বা জাতকের মাথায় দিয়ে তাকে বরণ করে নেয়া হতো। নমশূদ্রদের ভাষায় ‘সামাজিক করা। পুজো শেষে ধান-দূর্বো দিয়ে সবাই আশীর্বাদ করত নতুন শিশুকে। ঠাকুর জাতকের নাম রাখত। এই কাজের পর সমাজ নবজাতকের ভালোমন্দ দেখার ভার নিত। প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে সন্তান বড় হতো। নানা রকম গান গেয়ে সবকিছুর সাথে একটু একটু করে পরিচিত করানো হতো সন্তানকে।

যেমন ঘুমপাড়ানি গানের ভিতর দিয়ে বাচ্চাকে খাল বিলের মাছ চেনাত মা–

মনি আমার সোনার চাঁদ
কে তোমারে সাধল বাঁধ
মাগুর মাছে গান গায়
ট্যাংরা মাছে মোছ পাকায়
পাঙাস মাছে রাধে বাড়ে
পাবদা মাছে মাজে ঘষে
বোয়াল মাছে প্যাট করে টান টান।।

এইসব নবজাতকরা মাটির বারান্দায়, উঠোনের ধুলোয় গড়াগড়ি করে দিনে দিনে শিশু হয়ে বেড়ে উঠত। উঠোনের জল-কাদায় মাখামাখি করে একদিন কিশোর হয়ে যেত। তারপর উঠোন পেরিয়ে মাঠে-ঘাটে ছুটোছুটি। এভাবেই খেত-খামার, মাটি, প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে যৌবনে পা দিত। কখন যে একদিন তারা মেধা, মগজ, শ্রম, অভিজ্ঞতায় বলিষ্ঠ দক্ষ কৃষক হয়ে উঠত, তা তারা বুঝতেও পারত না।

মাটি, খেত নমশূদ্রদের লক্ষ্মী, জীবন-জননী। একদিন তারা বিয়ে করে বড় হয়ে সংসারের দায়িত্ব নেয়। কর্তা হয় সংসারের। বাবা-মা ততদিনে বয়সী হয়। আস্তে আস্তে অকর্মণ্য হয়ে পড়ে। তাদের দেখাশুনার দায়িত্বভার আপনা আপনিই এসে পড়ে নবকর্তার উপর অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথেই তারা বৃদ্ধ বাবা মার দেখাশুনা করত, সেবা-যত্ন করত।

পৌষ এলেই নমশূদ্রদের হৃদয় গভীরে পৌষমেলার দোলনা দুলত। এই মেলা তাদের প্রাণের মেলা, স্বজনদের মিলনমেলা। এই মেলায় এদের উঠোন ভরে যেত আত্মীয়-স্বজনে। মেলা থেকে কিনে আনত ধামা, কাঠা, চালন, কুলো, হুঁকো, কলকে, মাটির কলসি। কিনত পিঠে তৈরির ছাঁচ, খেজুর রসের নওয়ালি গুড়, পাটালি আরও কত কী!

আত্মীয়-স্বজন মিলে পৌষের মিঠে রোদে পিঠ ঠেকিয়ে পিঠে খাওয়ার ধুম পড়ত। এক আত্মীয়ের ঘরে পিঠের পালা শেষ হলে আয়োজন হতো আরেক আত্মীয় বাড়িতে। এভাবেই চলত মাসভর পিঠের আয়োজন।

পিঠে-পুলির সাথে নিবিড় সম্পর্ক চালের গুঁড়োর। টেকির পাড়ের শব্দে মুখরিত হয়ে উঠত গ্রাম। মনের আনন্দে পাড়ের শব্দের তালে গান ধরত যূথবদ্ধ নারী কণ্ঠ–

ঘরের কোনায় ওই যে ফুলের গাছটি রে
ও তার আগ ডালেতে কোকিল ছাড়ে ধ্বনি রে
ওই কোকিলের সুরেতে ওই কোকিলের রবেতে
আমার ঘরের মেনকা চমকে ওঠে রে
মায়ে তোরে ডাকে রে ও মেনকা রানি রে
তুমি ঘরে এসে খাওসে ক্ষীর ননী রে ॥

ও ঘরে যাব না, ক্ষীর ননী খাব না
আমার মন চলেছে রাখাল রাজার দ্যাশে রে
ঘরের কোণায় ওই যে ফুল গাছটা রে
ও তার আগার ডালে কোকিল ছাড়ে ধ্বনি রে ॥

বাবায় ডাকে ও মেনকা রানি রে
তুমি ঘরে আসে খাও দুধ ভাত রে
ও ঘরে তে যাব না, দুধভাত খাব না
আমার মন চলেছে অচিন রাজার দ্যাশে রে ॥

ভায়ে ডাকে ও মেনকা রানি রে
তুমি ঘরে আসে পায়েস জাউ খাও রে
ও ঘরেতে যাব না পায়েস জাউ খাব না
আমার মন চলেছে রূপ কুমারের দ্যাশে রে ॥

আরও আছে খই ভাজা। খইয়ের খোলায় বালির মধ্যে ধান থেকে ফটফট শব্দে খই বের হয়ে আসে। ছন্দময় সেই শব্দের তালে বেরিয়ে আসত গান–

নতুন বাগে ফুল তোলে কোন মালী
বাছে বাছে তোল রে ফুল না ছেড়ে য্যান জালি
মেয়ার মাকে দেখে আলাম ঘরে
আঁয়েগনের সঙ্গে নিয়ে পান খাচ্ছে ওরে
নতুন বাগে ফুল তোলে কে রে ॥

মেয়ার বাবার দেখে আলাম ঘাটে
গিয়েত কুটুম সঙ্গে নিয়ে বসে আছে ঠাঁটে
নতুন বাগে ফুল তোলে কে রে ॥

মেয়ার দাদার দেখে আলাম মাঠে
বসে বসে খাচ্ছে হুঁকো সূর্য গেছে পাটে
নতুন বাগে ফুল তোলে কে রে।।

আত্মীয়-স্বজন আসবে বলে মনের সুখে উঠোন, ঘর ঝাড় দিত, লেপে পুছে ঝকঝকে করত মেয়েরা। আর গেয়ে উঠত–

কোথা হতে এলো বিয়াই বাজাইতে বাজাইতে বাঁশি
সেই না বাঁশির বাজনা শুনে রাধা কান্দে ঘরে
বাঁশি বাজে রাধা রাধা বলে।।

রাধা নিতে রাজা কী কী গয়না আনিছে
নাকের আনছে নাকফুল, কানের আনছে দুল
হাতের আনছে সাদা শঙ্খ, সিথেতে সিঁদুর
মাজার আনছে কাকড়া বিছে, গলার আনছে হার
নগুলি আনছে সোনার আঙট কপালে আনছে টিপ
বাঁশি বাজে রাধা রাধা বলে….

ধান ভেজানো, সিদ্ধ, ঢেঁকিতে ধান ভেনে চাল করা, সেই চাল থেকে হতো ভাত রান্না। সারা বছরই চলত ধান সেদ্ধ, ধান ভানা। আগের দিন বড় মাটির কোলায় ধান ভিজিয়ে রাখা হতো। ভেজা ধান থেকে পচা পচা একধরনের জাগ দেয়া গন্ধ বের হতো। সেই ভেজা ধান বড় হাঁড়িতে উনুনে চাপিয়ে দেয়া হতো সিদ্ধ করার জন্য। মদির গন্ধে বাড়িঘর ভরে উঠত। সিদ্ধ ধান খেজুরের পাটির উপরে রোদে শুকাতে দিত। শুকানো ধান ভেঁকিতে ভেনে হতো চাল। সেই চাল ধবধবে সাদা হতো না। থাকত চালের উপরে লালচে আবরণ।

পৌষ মাস আমোদের মাস। বৃষ্টি নাই, গরম নাই।

শীতের হিমেল আমেজে চাদর গায়ে জড়িয়ে এরা আমোদে মেতে উঠত। কথায় কথায় গলায় তুলত সুর, গাইত গীত। এই সময়ে বিয়ের ধুম পড়ে যেত গ্রামে গ্রামে। বিয়ের গানে ভরে উঠত নমশূদ্র গ্রামের আকাশ-বাতাস। শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানই নয়; নানা রকম আনন্দ-খুশির উলুধ্বনিতে গ্রাম সরগরম হয়ে থাকত সারা মাস। বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা, পাকা কথা, আশীর্বাদ অষ্টমঙ্গলা চলতেই থাকত একের পর এক অনুষ্ঠান। ছেলের বাড়ি, মেয়ের বাড়ি দুই বাড়িতেই চলত একটার পর একটা আনুষ্ঠানিকতা। ছড়িয়ে পড়ত খুশির ঢেউ।

নীল পুজো গ্রামের কৃষকদের পুজো। এলাকাভেদে নলে বা নলিয়া পুজো নামে অভিহিত। এই পুজোয় কোনো ব্রাহ্মণ ঠাকুরের প্রয়োজন নেই। কৃষকেরাই পুজোয় পৌরোহিত্য করে। যিনি পৌরোহিত্য করেন, তাকে বলে গাছা বা বালা ঠাকুর। পুজোর দিন বালা ঠাকুর সারাদিন উপোষ থেকে পুজো করে।

পৌষ মাসের অমাবস্যা গিয়ে নতুন চাঁদ উঠলে এই চাঁদের শেষ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হতো নীল পুজো। এই পুজোর কোনো মন্দির থাকে না। প্রাচীন বটবৃক্ষতলে পুজোর আয়োজন হতো। থাকত সান বাঁধানো বেদি। মোট এগারো দেব-দেবীর পুজো দেওয়া হতো সেখানে। রাতভর চলত এই পুজো।

এগারো দেব-দেবীর মাঝখানে থাকে মা রক্ষাকালীর বেদি। এই পুজো হিন্দু-মুসলমানের এক মিলন উৎসব। সে কারণে, মা রক্ষাকালীর বাম আসনে বসেন মাদার সাহেব। তারপরের আসনে ভাটেশ্বরী। তারপরে বুড়ো, ঠাকুর, মনসা কালী। মা রক্ষা কালীর ডাইনে প্রথম থেকে সন্ন্যাসী ঠাকুর, হরি ঠাকুর, হড়াই পাটনী, নিশিকালী, শ্মশানকালী। এভাবে পুজোর এগারোটি আসন এগারো দেব-দেবী অলংকৃত করেন।

পুজোর দিন উপোস থেকে এই এগারোটি আসনে এগারোজন নারী-পুরুষ দেব-দেবী সেজে পুজো নিত। গাছা বা বালা ঠাকুর করত পৌরোহিত্য। পুজোর শুরুতে একদল কৃষক সমস্বরে হাতে তালি বাজিয়ে পুজোর বন্দনা শুরু করত–

বন্ধন, মা কালির চরণ আমার মস্তকের উপর
সন্ন্যাসী ঠাকুরের চরণ বন্ধন মস্তকের উপর
রক্ষাকালীর চরণ বন্ধন…

এভাবে তারা এগারো আসনের এগারো দেব-দবীর বন্দনা গাইত। বন্দনা শেষ হলে একই ভঙ্গিতে হাতে তালি বাজিয়ে গাইত দেব-দেবীর আহ্বান গীত–

অযোধ্যা ছাড়িয়া এলাম রে পথে বসে কান্দে আমার মা
মা মা বলিয়া ডাকি সেও তো শোনে না
সন্ন্যাসী ঠাকুর দিল কড়াল সেও তো এলো না
মা মা বলিয়া ডাকি আমি রে..

শ্মশান ঘাটে কী করে মা সেও তো জানি না
ডাকিনী যুগিনী কনে তাও তো জানি না
রক্ষাকালী দিল কথা সেও তো এলো না
আগে আগে যায় নিশে কালী পাপেরও পথ দিয়া
পিছেপিছে বুড়ো শিব যায় পাপী উদ্ধারিয়া
তারে ডাকি কত কাঁদি সেও তো আসে না।

এভাবে চলত গীত। তারপর সারাদিনের উপোসী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা এক এক দেব-দেবী সেজে বেদিতে দাঁড়িয়ে যেত। এরপর বালা ঠাকুর আলাদা আলাদা মন্ত্র পড়ে এক এক ঠাকুরের পূজা শেষ করত। পুজো শেষে ভোররাতে হতো প্রসাদ বিতরণ। প্রসাদে হিন্দু-মুসলিম কোনো ভেদাভেদ থাকত না। সবাই তা ভক্তিভরে গ্রহণ করত।

নীল পুজো বহু পৌরাণিক। মনে করা হয়, যখন মানুষের মধ্যে ঝড় জলোচ্ছ্বাস, আগুন ও প্রাকৃতিক নানা বিষয়ে ছিল নানা ভয়, তখন সেই ভয় থেকে শক্তি ও সাহস সঞ্চয়ের উপায় হিসেবে কৃষিজীবীরা শুরু করেছিল এই পুজো। নমশূদ্র অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে ধুমধামের সাথে করা হতো এই পুজো।

পৌষ সংক্রান্তিতে হতো পৌষ পার্বণ উৎসব। এলাকাজুড়ে সব গ্রামেই। এই উৎসবের নাম স্থানীয়ভাবে পুষুরে। গ্রামের সামনের মাঠ পরিষ্কার করে তৈরি হতো রান্নার জায়গা। লাইন ধরে কাটা হতো উনুন। গোটা পৌষ মাস ধরেই চলত পুষুরের প্রস্তুতি। মাসের পয়লা দিন থেকেই দলবেঁধে গান গেয়ে ছেলেরা মাঙনে বের হতো। গোল হয়ে নেচে নেচে গান করত তারা। একেক দিন এক গান। কোনোদিন তারা দিত সোনাহারের বিয়ে। সবাই মিলে তখন গান ধরত

ওরে… এক দিবসে সোনাহার নল কাটিতে যায়,
ওরে… নল কাটিতে যাইয়ারে সে খাট পালংক পায় ওরে…
খাট পালংক পাইয়ারে সে শুইয়া নিদ্রা যায়।
ওরে… দেবপরির কন্যা আসে গায়ে বাতাস দেয়।

ওরে… গায়ে বাতাস দিলে কন্যা, তোমায় করব বিয়া
ওরে… আমি হলাম ব্রাহ্মণ কন্যা, তুমি সোনাহার
ওরে… আমারে যে করতে বিয়া লাগবে একটা ফুল
ওরে… আনলো রে তোর বড় গাঁদার ফুল ডালা সাজাইয়া
ওরে… এও ফুলেতে হলো না রে সোনাহারের বিয়া।
ওরে… আবার যাওরে, যাওরে মালী ফুলের লাগিয়া
ওরে… আনলো রে তোর বিন্যের ফুল চাদরে পেঁচাইয়া
ওরে… এই ফুলেতেই হবে রে সোনাহারের বিয়া।

ওরে… আইলো রে তোর নিমে নাপিত ভাঙা খুরখান নিয়া
ওরে… এই খুরে তো হলো না রে সোনাহারের খেউরি
ওরে… আইলো রে তোর নবা নাপিত ভালো খুরখান নিয়া
ওরে… আইলো রে তোর ভূ-শ্যাম ঠাকুর ছেঁড়া পইতা নিয়া
ওরে… এই পইতায় হলো না রে সোনাহারের বিয়া
ওরে… আইলো রে তোর কার্তিক ঠাকুর নতুন পইতা নিয়া
ওরে… এই পইতায় হলো রে সোনাহারের বিয়া ॥

কোনোদিন গাইত রাধা-কৃষ্ণ লীলা। ‘কানাই-রাধার মিলন’, ‘রাধার মান ভঞ্জন’ বা ‘কানুর ননী খাওয়া’

(১)

কাঠের দ্যাশে থাকো কানাই, কাঠের করো সুর
কানাই খেওয়া বায়…
ভাঙা নৌকায় খেওয়া দিয়ে কিবা পেলে সুখ
কানাই খেওয়া বায়…
ভাঙা নয় রে, চুরো নয় রে শ্যামলেরই সুর
কানাই খেওয়া বায়…

হস্তী-ঘোড়া পার করি হে রাধা কত ভার
কানাই খেওয়া বায়…

সব সখী রে পার করিতে নিব আনা আনা
কানাই খেওয়া বায়…

শ্রী রাধিকা পার করিতে নিব কানের সোনা
কানাই খেওয়া বায়…

এক আনার জন্যে তুমি চাও হে কানের সোনা
কানাই খেওয়া বায়…
ঐ কথা শুনিয়া হালেতে মারে কাছা
কানাই খেওয়া বায়…

ছিড়লো পারস্যের দড়ি, হায়রে ভাঙলো নায়ের পাছা
কানাই খেওয়া বায়…
আগা ডোবে, পাছা ডোবে, মধ্যে মাচাইল ভাসে
কানাই খেওয়া বায়…
শ্রী রাধিকারে কোলে নিয়ে কানাই জলে ভাসে
কানাই খেওয়া বায়…
ভাসিতে ভাসিতে রাধে যখন পাইলো কুল
কানাই খেওয়া বায়…
কুল ও না পাইয়ারে রাধে ঝাইরা বাধে চুল
কানাই খেওয়া বায়…
চুল ও না বান্ধিয়া রাধে, মাথায় দ্যায় রে হিয়া (সিঁদুর)
কানাই খেওয়া বায়…
মথুরা তে চললো রাধে উলুধ্বনি দিয়া
কানাই খেওয়া বায়…

(২)

ধান নাড়ো, ধান নাড়ো রাধে আউলে মাথার চুল
বলো হরি বোল…
জল পিপাসায় জীবন গেল, ইডা কেমন দেশ
বলো হরি বোল…
এই কথা শুনিয়া রাধের কিঞ্চিৎ দয়া হলো
বলো হরি বোল…
কংকেতে (কাখে) কলসি নিয়ে যমুনায় চলিল
বলো হরি বোল…
মাঠে ছিল শ্রীদাম-সুবোল কলসি ভাঙিল
বলো হরি বোল…
ওপার ছিল কুমোর ভাই রে, বলে হরি হরি
বলো হরি বোল…
হরি হরি বলে কুমোর মাটিখানি ছ্যানে
বলো হরি বোল…
মাটিখানি ছেনে কুমোর তুলে দিল চাকে
বলো হরি বোল…
শ্রী রাধিকার মান কলসি হলো আড়াই পাকে
বলো হরি বোল…
সোনার দিও পেটিখানি, রুপার দিও কাঁধা
বলো হরি বোল…
কাদার উপর লিখে দিও কলঙ্কিনী রাধা
বলো হরি বোল… ॥

(৩)

নন্দ যায় রে বাথানেতে, যশোদা যায় ঘাটে
শূন্য গৃহ পেয়ে গোপাল সকল ননী ললাটে।
ও করিলি কী রে গোপাল, ও করিলি কী
কংসের যোগানো ননী সকলে খাইলি
আমি তো খাইনি রে ননী, খাইছে বলাই দাদা
আমি যদি খাইতাম ননী, ভাণ্ডে থাকত আধা।
বলাই দাদা খাইছে ননী, ভাণ্ড হলো সাদা
ছড়ি হাতে নন্দরানি ধায় গোপালের পিছে
লম্ফ দিয়ে উঠল গোপাল কদম্বেরই গাছে
পাতায় পাতায় ফেরে গোপাল, ডালে না দেয় পাও
তাই দেখে নন্দরানির ভয়ে কাঁপে গাও।
নামো নামো নামো গোপাল পেড়ে দেই তোর ফুল
কদম্বেরও ডাল ভাঙিয়া হারাবি তোর কুল।
একো সত্য করো মাগো, দুয়ো সত্য করো
নন্দঘোষ তোমার পিতা যদি আমায় মারো।
দুয়ো সত্যি করি গোপাল, তিনো সত্যি করি
নন্দঘোষ তোমার পিতা যদি আমি মারি।
নালা ভোলা দিয়ে রানি গোপালকে নামাল
গাভী বাধা দড়ি দিয়ে গোপালকে বাঁধিল।
কি না বান্ধন বাঁধলি মাগো, পিষ্ঠে দিয়ে মোড়া
বান্ধনের তাপে মাগো ছুটলো হাড়ের জোড়া।
ঐ কথা শুনে রানির কিঞ্চিৎ দয়া হল
হস্তের বাঁধন খুলে দিয়ে গোপালরে কোলে নিল।
আসুক আজ নন্দ বাড়ি, বেচে ফেলুক ধেনু
নগরে মাঙিয়া খাব, কোলে সোনার কানু।।

কখনও বা ধরত নিমাই সন্ন্যাস। মূল গায়ক গান গাইত। তার পিছেপিছে দোহাররা সুর মেলাত ‘নিমাই যেও না সন্ন্যাসে…।’ শচীমাতার আকুতি নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মনকে খুব সহজেই স্পর্শ করত–

নিমাই যেও না সন্ন্যাসে…
ঘরে তোমার শচীমাতা বাঁচিবে কেমনে!
ওরে একো মাসের কালে নিমাই নিয়া রে হিয়া
দুয়ো মাসের কালে নিমাই হলেন জানি জানি রে
তিনো মাসের কালে নিমাই রক্তে হলেন ঘোনা
চারো মাসের কালে নিমাই হাড়ে মাংস জোড়া
পঞ্চো মাসের কালে নিমাই পঞ্চ ফুল ফোটে
ছয়ে মাসের কালে নিমাই মাথায় চুল ওঠে
সাতো মাসের কালে নিমাই সাথে অন্ন খায়
অষ্টো মাসের কালে নিমাই মামা বাড়ি যায়
নয়ো মাসের কালে নিমাই নব গণস্থিতি
দশো মাসে দশশা দিনে হলো পূর্ণতিথি
নিমাই চাঁদ যে জন্ম নিল নিম্বতরু তলে
বাইছা বাইছা নাম রাখিলাম নিমাই চাঁদ তোমারে
বড় হইয়া নিমাই সন্ন্যাসে যায় জননী রে ছাড়িয়া।
ঘরে বধূ বিষ্ণুপ্রিয়া জ্বলন্ত অগিনি (অগ্নি)
আর কতকাল রাখব তারে দিয়া মুখের বাণী
দেখ দেখ নদীয়ার লোক, দেখ রে চাহিয়া
নিমাই চাঁদ যে সন্ন্যাসে যায় জননী ছাড়িয়া
লেখাপড়া করে নিমাই পণ্ডিত হলেন বড়
জগৎকে তুমি বুঝাইতে পারো, জননী কেন ছাড়ো
নিমাই যেও না সন্ন্যাসে…

দলের সাথে ধামা নিয়ে দুই-তিনজন থাকত পেছনে। গান শেষ হলে তারা ধামা নামিয়ে হাঁক দিত–কৈ গো মা নক্ষী, মাঙন দ্যান গো…। মা লক্ষ্মীরা চাল দিত, ডাল দিত, তরি-তরকারি এনে দিত। দুই-চার পয়সা নগদও দিত কেউ কেউ। যে যা দেয়, তা-ই সই। জোর নাই, জবরদস্তি নাই।

পুষুরের আগের দিন বিলে পলো নামত। এলাকার কোনো একটা বিল সংরক্ষিত থাকত এই দিনটার জন্য। পুষুরের আগে কেউ সেই বিলে মাছ ধরতে নামত না। সবার জন্য উন্মুক্ত হতো এই দিন থেকে। এলাকার ছেলে বুড়ো হাজার হাজার মানুষ সূর্য ওঠার আগেই গিয়ে জড়ো হতো বিলে। লাইন দিয়ে তারা পলো নিয়ে দাঁড়াত। টিনের চোঙা নিয়ে দুই দিকে কমিটির লোকজন দাঁড়ানো থাকত। চোঙা ফুকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সাথে সাথে সার বেঁধে তারা পলো নিয়ে জলে ঝাঁপ দিতে দিতে সামনের দিকে এগোত।

মাছ মেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেলা দুপুর। শুরু হয়ে যেত মেয়েদের কাজ। উঠোনে সারি সারি ফেলে রাখা মাছ ছাই দিয়ে দক্ষ হাতে আঁশবটিতে কুটে ফেলত। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামত। লবন-হলুদ মাখিয়ে সামান্য তেলে নাড়াচাড়া করে হেঁই দিয়ে রাখা হতো মাছগুলো। রান্না হতো পুষুরের দিন সকালে। পিঠে খাবার পর ঝালমুখ হবে এই মাছে।

পৌষ সংক্রান্তিতে নমশুদ্র গৃহস্থ বাড়িতে বাড়িতে হতো বাস্তু পূজা।

সন্তান-সন্ততির মঙ্গল কামনায় এই পুজার আয়োজন। পৌষ মাসের শেষদিন সকালে গৃহস্থ বাড়ির বাহির উঠোনে তারা এ পুজো করত। আলা মাটিতে (গোবর ছাড়া শুধু মাটি দিয়ে) উঠোন লেপত। মাটি দিয়ে তৈরি করত সাপ, কুমির, কচ্ছপ, গরু, মোষ, গাছ ইত্যাদি। চালের গুঁড়োর পিটুলি দিয়ে উঠোনজুড়ে আঁকত আলপনা।

তারপর কৃষাণীরা যেত পুকুরঘাটে। স্নান সেরে উপোস মুখে জলহীন দুধ এবং আতপ চাল দিয়ে ক্ষীর রান্না করত। মাটির মুচিতে করে সেই ক্ষীর প্রত্যেক বিগ্রহের সামনে প্রসাদ হিসেবে দিত। তারপর বন্ধুরা আপন আপন আঁচল গলায় জড়িয়ে ভক্তিমনে স্থাপিত সকল মূর্তিকে দেবতা জ্ঞানে ধান-দূর্বা, বিলপত্র দিয়ে আপন আপন পুত্র-কন্যা, ঘর-সংসারের মঙ্গল কামনা করত।

যারা বিগ্রহ তৈরি করতে না পারে, তারা উপোস থেকে ঘর, উঠোন, গোয়াল ঝাড় দিয়ে লেপে সকালে স্নান করে এসে যার যার গাভী দোহন করে। নিজের না থাকলে অন্যের কাছ থেকে দুধ কিনে নিয়ে আসে। থোয়া-কাঁচা কাপড় পরে গোয়ালঘরের বাস্তু খামের (গোয়ালঘরের উত্তরের কোনার যে কোনো খাম) গোড়ার মাটি খানিকটা খুঁড়ে সেই গর্তে কাঁচা দুধ আর ধান-দূর্বা, বিল্বপত্র রেখে গলায় আঁচল বস্ত্র জড়িয়ে পুত্র-কন্যাসহ সংসারের সার্বিক মঙ্গল কামনা করত নমশূদ্র রমণীরা।

পুজো শেষে পাড়ার সকল বয়সী নারী উঠোনে বিগ্রহগুলোর পাশে বসে বাস্তুপুজোর ব্রত আলাপ করত। বয়সী কোনো নারী ব্রতকথা বলত। অন্যরা গভীর মনোযোগে ভক্তি বদনে তা শুনত

ধন-সম্পদআলা এক চাষার এট্টা মাত্র আহ্লাদে মেয়া। তার বিয়ে হয়। গাঙের পাড়ে এক গ্রামে। সেই গাঙে আছে কাছে (কচ্ছপ), কুমির, সাপ আরও কত কী! সেই গাঙে যারা ডুবোতি যায়, মাঝেমদ্যি সেই কাচো, সাপ তাগের কামড়ায়। কুমির ধরে নিয়ে খায়ে ফেলায়। সবাই ডরায়, কিন্তু কিছু করতি পারে না।

আহ্বাদে ওই মেয়া শ্বশুরবাড়ি আসে পেত্যম দিনই গাঙের ঘাটে বসে জলে পা ডুবোয়ে পাও নাচায় আর কয়–এ গাঙে বোলে কাছছা, কুমির, সাপ সবাইরে ধরে ধরে খায়।

সাতের বউরা কয়–হয় লো রো বউ, হয়।

আহ্লাদে বউ কয়–আমারে কামড়াক তো দেহি কেমুন পারে।

সাথের এক বউ কয়–মাগি, পাও নাচায়ে অত অহংকার করিস নে। অহংকার ভালো না।

বউ কয়–কী অবি! অহংকার করলাম।

আরেক বউ কয়–খালি তুমারই যে কিছু অবি তা কিন্তুক না। তুমার ছাওয়াল-মেয়ারও হতি পারে।

বউ কয়-খাক আগে। তহন দেকপানে।

এই বউ সোয়ামীর গোয়ালঘরে যায়েও ঠ্যাং পাও আছড়ায়। আর কয় এত গরু মোষির গু মুত কি ফেলা যায়? দুই-চারডে কমে গিলিউ বাঁচতাম।

বছর ঘুরতিই আহ্লাদে বউর যমজ ছাওয়াল জন্মায়। ফুটফুটে চাঁদের মতো দুড়ে ছাওয়াল। ছাওয়ালরা আস্তে আস্তে বড় হয়। খেলা করে বেড়ায়। আর থাহে থাহেই দোড়োয়ে আসে মার গলা জড়ায়ে ধরে চুমো খায়। মাও তাদের সেইরম আদর করে আবার ছাড়ে দেয়। সংসারে আনন্দ আর ধরে না। এরম করে করে ছাওয়াল দুডে গাঙে ডুবোয়ে নাওয়ার যুগ্যি হয়। একদিন দুই ভাই মার সাথে গাঙে যায়ে নামে। আরও কত ছাওয়াল পাল ডুবোচ্ছে। আহ্বাদে বউর ছাওয়ালরাও তাগের সাথে ডুবোতি লাগল। খানিক পর আহ্লাদে বউ তার বড় ছাওয়াল রে খুঁজে পায় না। সগগোলে মিলে ছাওয়ালডারে খুঁজতি থাহে। কিন্তু পায় না তো, পায়ই না। শ্যাষম্যাশ দেহে, মধ্যি গাঙে কুমিরির মুহির মদ্যি সেই ছাওয়াল। জল গাঙ মাতায় করে মা কানতি শুরু করে।

কুমির এক এক করে সাতবার ছাওয়ারভারে তার মারে দেহায়। তারপর ডুব দিয়ে আর ওঠে না। এরপর এক বছর না গড়াতিই ছোট ছাওয়ালডারেও ধরে নিয়ে গেল অজগর সাপে। সেই সাপ আস্তে আস্তে গিলে খায়ে ফেলে ছাওয়ালডারে।

আহ্লাদে বউর মুহির কতা ফুরোয়ে যায়। চোখের জল শুকোয়ে যায়। পাগোলের মতো চায়ে থাহে। জ্ঞান গম্যি সব ফুরোয়ে এ জাগা সে জাগায় ধন্ধ ধরার মতো বসে থাহে। এরপর একদিন বউর গোয়ালের গরু মরতি শুরু করে। সাঁঝবেলা ভালো গরু গোয়ালে বাঁধে থোয়, সকালবেলা উঠে দেহে মরা। দেকতি দেকতি গোয়াল খালি হয়ে গেল।

শ্যাষে, এক রাতে সেই আহ্লাদে বউ স্বপ্ন দেহে। স্বপ্নে আদেশ পায়, সাপ, কুমির, কাছে, গরু, মোষ আর গাছের পুজো দে। পোষ সংক্রান্তিতে জল ছাড়া দুধির ক্ষীর রাধে ভোগ দিবি। তারা খুশি হবি। আর তোর অমঙ্গল কাটপি।

সেই দিনির তে নমশূদ্ররা তাদের সন্তানের মঙ্গল কামনায় ঘরে ঘরে করে বাস্তু পুজো।

হ্যাজাক লাইটের আলোয় হতো যাত্রাগান। গোটা শীতকালজুড়ে চলত অনুষ্ঠান। বেশিরভাগ সময় মঞ্চস্থ হতো ঐতিহাসিক যাত্রাপালা। নবাব সিরাজউদ্দৌলা, টিপু সুলতান ইত্যাদি। কিছু পালা ছিল সামাজিক। সেসব পালার ছিল বেশ কাব্যিক ধরনের নাম। সিঁদুর নিও না মুছে, নিচতলার মানুষ, এ পৃথিবী টাকার গোলাম, গলি থেকে রাজপথ ইত্যাদি সব নাম। যাত্রাপালার আয়োজন বিশাল খরচের ব্যাপার। তাই এই উদ্যোগ এককভাবে নয়, নেয়া হতো যৌথভাবে ব্যবসাভিত্তিতে।

দর্শকরা টিকিট কেটে যাত্রা দেখত। প্যান্ডেলে তৈরি হতো বড় কোন বাজার সংলগ্ন স্থানে বা স্কুলমাঠে। মাঝখানে খোলা মঞ্চ। চারদিকে বসততা দর্শক। মাথার উপরে টানানো হতো শামিয়ানা। নিচে বিছিয়ে দেয়া হতো খড়। কখনও খড়ের উপরে থাকত চট। দর্শকরা খাওয়া-দাওয়া সেরে কয়েক মাইল পথ পায়ে হেঁটে যাত্রা দেখতে যেত। গায়ে থাকত চাদর। গলায়, মাথায় প্যাচানো থাকত মাফলার। যাত্রার চরিত্র আর ডায়ালগের সাথে মিশে একাত্ম হয়ে যেত তারা। আলো, বাদ্যবাজনায় অলৌকিক এক পরিবেশ তৈরি হতো। স্বপ্নের ঘোরে কেটে যেত দরিদ্র নমশুদ্র কৃষকদের কয়েকটা দিন। নিজেকে বসাত ন্যায়পরায়ণ রাজার আসনে। কখনও বনে যেত শক্তিশালী নীতিবান নায়ক। কখনও বা বিবেক হয়ে সুর তুলত গলায়। সেই সুর কেঁপেকেঁপে ছড়িয়ে পড়ত চতুর্দিকে, ভোলা মাঠের প্রান্তরে।

যাত্রার পাশাপাশি হতো সার্কাস, পুতুল নাচ। সার্কাস দলের বাঘ, ভালুক, হাতি ছিল তাদের কাছে অন্যতম আকর্ষন। সেগুলোকে দেখত তারা মহাবিস্ময় নিয়ে। আর হতো কবিগান। কবির লড়াই দারুণ জমত। ভীষণ উপভোগ করত বিলের নমশূদ্র কৃষকরা। মুখে মুখে উত্তর বানিয়ে ছন্দে ছন্দে প্রশ্ন করত, যুক্তির নিরিখে উত্তর দিত প্রতিপক্ষ কবির। সৃজনশীলতা, রসবোধ, অভিনয় শৈলী, উপস্থিত বুদ্ধি প্রদর্শনের সে ছিল এক বিস্ময়কর সমন্বয়। দর্শকদেরকে অন্য এক জগতে নিয়ে যাবার অভাবনীয় কৌশল থাকত কবিদের মধ্যে। আধ্যাত্মিক জগতে বিরাজ করত কবির সাথে একাত্ম হয়ে উপস্থিত দর্শকরাও।

কবি যখন গানে গানে তার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করত, তখন দর্শকদের মনে হতো, অকাট্য এই যুক্তি খণ্ডন করার সাধ্য ইহজগতে আর কারো নেই। কিন্তু দেখা যেত প্রতিপক্ষ কবি অনায়াসে সেই যুক্তি খণ্ডন করে আবার ছুঁড়ে দিত নতুন কোনো প্রশ্ন। এভাবেই চলত যুক্তির খেলা। কথার মালা। সুরের খেলা। সুরে সুরে একের পর এক প্রশ্ন উত্থাপন, যুক্তি খণ্ডন, আবার নতুন প্রশ্নবাণ। বিমোহিত দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে শুনত সেই কবিগান।

বসত পদাবলি কীর্তনের আসর। হতো অষ্টগান, রামায়ণ।

নানাবিধ গান, পার্বণ আর উৎসবের ভিতর দিয়ে এভাবেই দেখতে দেখতে পার হয়ে যেত নমশূদ্রদের পৌষ মাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *