০৭. কার্তিক

কার্তিক

দেখতে দেখতে এসে যেত কার্তিক মাস।

দিনে চামড়া পোড়া গরম। রাতে ঠান্ডা কুয়াশা। একদিকে উত্তরের বাতাস, অন্যদিকে শুষ্ক আবহাওয়া। ঠান্ডা বাতাসে ভেসে আসে শীতের আগমনী বার্তা। শুকিয়ে যায় মুখ-চোখ। চামড়া হয় খসখসে। ফাটতে শুরু করে ঠোঁট। একটু একটু করে দিন ছোট হয়ে আসতে থাকে। দেখতে দেখতে পড়ে যায় কার্তিকের বেলা।

বর্ষায় ছিল বিলের ভরা যৌবন, কার্তিকে সেই যৌবনের পড়ন্ত বেলা। বুনো ঘাস, লতা-গুল, জলজ উদ্ভিদের ফুল ফল বীজ পাকার সময় হয়ে আসে। চুপড়ি শাকের ফল পেকে লাল হয়ে যেত এই সময়ে। সেই ফলের টক রান্না করে খেত তারা। পেকে লাল হয়ে যেত পুঁইশাকের খুঁটিফল। পাকা ফলের রস টিপে বের করে আলতার মতো করে পায়ে লাগাত মেয়েরা। আকাশে উড়ে বেড়াত পাখি, প্রজাপতি, ফড়িং, নানা ধরনের কীট-পতঙ্গ, পোকা-মাকড়।

আশ্বিনের শেষ থেকে কার্তিকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে নমশুদ্র কৃষকের ঘরে ঘরে অভাব ফণা উদ্যত বিস্তার করে বসে থাকত। আকুল অপেক্ষায় থাকত তারা, কবে কাটা হবে পাকা আমন। ঘরে উঠবে নতুন ধান।

বিলের জল আস্তে আস্তে শুকাতে শুরু করত। শেওলা, শাপলা, কচুরিপানায় ভরে যেত বিল। সেসব পচে তৈরি হতো মিথেন গ্যাস। বাতাসের সংস্পর্শে রাত-বিরেতে জ্বলে উঠত আগুন। ওরা বলত ভূতের আগুন। জল কমে যাওয়ায় অল্প জায়গার মধ্যে মাছ গাদাগাদি করে লাফালাফি করত। ভেসে বেড়াত পুঁটি, সরপুঁটি, খলসে, পাবদা, চাদা, বাঁচা ইত্যাদি মাছ। মাছের লোভে আকাশে উড়ে বেড়াত সোনালি ডানা মেলে চিল, শঙ্খচিল, ভুবনচিল। গাছের ডালে ঠায় বসে থাকত মাছরাঙা।

ডাঙ্গায় উঠে বাড়ির আনাচে-কানচে ডিম পেড়ে যেত কাছিম। সেই ডিম খুঁজে খুঁজে বের করে নিয়ে আসত ছেলেরা।

মাঠে মাঠে রাই, সরিষা, কলাই বোনা শুরু হয়ে যেত। খেতে খেতে পাক ধরত আমন ধানে। কৃষকরা প্রতিদিন এই সময়ে ধান খেতের আলে আলে ঘুরে বেড়াত। ঘুরে ঘুরে দেখত, আর বোঝার চেষ্টা করত কত দিনে ধান কেটে ঘরে তুলতে পারবে তারা। পাট কাটা খালি জমিতে ছিটিয়ে দিত মটর, মসুরি, যব, গম, তিল, গুজি ইত্যাদি চৈতালি ফসল। কার্তিক মাসে বুনত বলে চৈতালি ফসলের আর এক নাম তাই ‘কাতেলি চাষ’।

কার্তিকে খেতে খেতে ধানের বাহার। গাঢ় সবুজ গাছের ডগায় সোনালি রঙের আভা। পুষ্ট ধানের শিষ।

সেই দৃশ্য নমশূদ্র কৃষাণ-কৃষাণীর অন্তরে খুশির বন্যা বইয়ে দিত। পথে, ঘাটে, উঠোনে সবার মুখে মুখে ফিরত একই আলোচনা। ধান কেমন হবে এ বছর। ভালোভাবে ঘরে তুলতে পারবে কি না ফসল! চিন্তা লেপটে থাকত তাদের ললাটে। প্রকৃতি যদি কোনো কারণে আবার বিরূপ হয়ে পড়ে! সবকিছু ঠিকঠাকমতো থাকলে, শেষ পর্যন্ত ধান গোলায় উঠে গেলে তাদের চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ত খুশির ঝিলিক।

নমশূদ্রদের জীবন-জীবিকার সবচেয়ে বড় অবলম্বন ছিল গরু। নমশূদ্র গ্রাম মানেই উঠোনের কোণে বাঁধা থাকবে গাই, পথের পাশে বলদ, তিড়িং-বিড়িং করে লাফিয়ে ছুটোছুটি করে বেড়াবে ছেড়ে দেয়া বাছুর।

গো-মাতার প্রতি নমশূদ্রদের ছিল অবিচল ভক্তি। গরুকে খাওয়ানো, যত্ন করা, পরিচর্যা করা, স্নান করানো-সব দিকেই সমান খেয়াল রাখত তারা। গরুকে দেবতাজ্ঞান করত। ভাবত, গরু তাদের আত্মার পরম আত্মীয়।

নমশূদ্রদের মুখে প্রবাদ ছিল–গরু হারালে নমশুদ্ররা অজ্ঞানে বউকেও মা বলে ফেলে।

কার্তিক মাসের ঘন কুয়াশা আর প্যাঁচপ্যাঁচে বৃষ্টিতে দেখা দিত গো-রোগ। নমশূদ্রদের আপ্রাণ চেষ্টা থাকত যতটা সম্ভব গরুর যত্ন নেয়ার। তাদের অন্তরের ত্রিনাথ ঠাকুর হলো গো-দেবতা। তাদের ভাষায় তিন্নাথ ঠাকুর। কার্তিক মাসের শুরুতেই তাই তোড়জোড় পড়ে যেত ত্রিনাথ ঠাকুরের আরাধনার।

প্রতি শনি বা মঙ্গলবার রাতে নমশূদ্র পল্লিতে কোনো-না-কোনো বাড়িতে বসত তিন্নাতের মেলা। এই মেলার আসন হলো পিড়ি। আতপ চালের গুঁড়োর গোলা দিয়ে কৃষাণীরা এই পিঁড়ির উপরে আঁকত ফুল, লতা-পাতা, পাখি, গাই বাছুর, এঁড়ে-বলদ আরও কত কী! তারপর আঁকত তিন্নাত ঠাকুরের চরণ। অঙ্কিত এই পিড়িকে তিন্নাত ঠাকুরের বেদী বানিয়ে তার উপর বসাত সিঁদুরের রেখা টানা মেটে ঘট। সেই ঘটে ধান-দূর্বা, তিল-তুলসী, গঙ্গাজল ও চারপাতা বিশিষ্ট আমের ছোট্ট শাখা বসিয়ে স্থাপন করত ত্রিনাথ ঠাকুরের মঙ্গল ঘট। তারপর হতো পুজো।

পাড়ার সব কৃষকেরা সারদিনের মাঠকর্ম শেষে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আসন আর মঙ্গল ঘট সামনে রেখে গোল হয়ে বসত। একেই বলত তিন্নাতের মেলা। সবাই মিলে একসাথে বসে তারা ত্রিনাথ ঠাকুরের কৃপা প্রার্থনায় গীত গাইত। এই পুজোর উপাচার অতি সামান্য। এক পয়সার গাঁজা, এক পয়সার পান-সুপারি, এক পয়সার তেল। আর সাথে লাগত কিছু হরির লুট।

এসব সামনে রেখে সবাই সমস্বরে গাইত–

দিন গেলে তিন্নাতের নাম নিও সাধু রে ভাই
দিন গেলে তিন্নাতের নাম নিও।।
নিও নামটি পরমও যতনে সাধু রে ভাই
দিন গেলে তিন্নাতের নাম নিও।।

এক পয়সার পান সুপারি
এক পয়সার গাঁজা
আর এক পয়সার ত্যাল হলে হয়
তিন্নাতেরই মেলা
সাধু রে ভাই।।

বেশি কিছু লাগে না রে তিন্নাতের এই মেলায়
ঠাকুর দয়াল সেজে এসেছে রে
দুঃখী পাপী উদ্ধারিতে
দয়াল সেজে এসেছে রে
দিন গেলে তিন্নাতের নাম নিও।।

তিন্নাতের এই মেলা দেখে
যে করবে হেলা
তার হাত পাও দে গোট বাড়াবি
চোখ দে বাড়ায় ঢেলা
এই মেলা দেখে হেলা কোরো না রে
দিন গেলে তিন্নাতের নাম নিও।।

ঠাকুর গোয়ালে রে করল দয়া
গোর খালির ওই মাঠে
রাখালে রে করল দয়া
নিয়ে শুশান ঘাটে
শত সনের মরা বিরি (বৃক্ষ) ছিল মদ্যি মাঠে
তিন্নাতের পরশ পায়ে কুশি পাতা ফোটে
এই মেলা দেখে হেলা কোরো না রে
সাধু রে ভাই ॥

ঠাকুর দয়া করো কৃপা করো আমরা হলাম দীন
আমরা তোমার গো-সেবক আমরা বড় হীন
গোরু বাঁচলে আমরা বাঁচি আর নয় তো মরি
বাঁচাও বাঁচাও বাঁচাও ঠাকুর তোমার চরণ ধরি
তুমি দয়াল সাঁঝে এসেছো রে তুমি দয়াল হরি
সাধু রে ভাই… ॥

গানের সাথে চলে গঞ্জিকা সেবন। এটাকে শুধুমাত্র গাঁজা বলে হেয় করত না তারা। এ হলো পুজোর প্রসাদ। বাবা তিন্নাতের প্রসাদ। সবাইকে কমবেশি সেবন করতে হয়। এটাই নিয়ম।

এ পুজো যে শুধু কার্তিক মাসেই হতো, তা নয়। যখনই গরু রোগবালাই দেখা দিত, তখনই এই পুজোর আয়োজন করত নমশূদ্ররা।

কার্তিক মাসের মাঝামাঝি থেকেই শুরু হয়ে যেত আমন ধান কাটা।

ধানকাটার শুরুতে একমুঠো পাকাধান এনে চালে বা বেড়ায় বেঁধে রাখত। তারা বলত ‘লক্ষ্মীর ছড়া। তারপর শুরু হতো ধান কাটা। হঠাৎই যেন কুম্ভকর্ণের নিদ্রা থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠত বিলের নমশূদ্ররা। ধুম পড়ে যেত ধান কাটার। কাদাজল ভেঙে কাটা ধানের আঁটি মাথায় করে এনে ফেলত বাড়ির উঠোনে। চলত ধানের পালা দেয়া, উঠোনে মলন মলা, ঝাড়া, ধান শুকিয়ে ডোলে তোলা। রাত-দিন কাজ। দম ফেলার ফুরসত নেই। দিনে ধান কাটা, রাতে মলন মলা। ভালো ধান বেছে রাখত বীজ। বস্তায় ভরে সেই বীজধান যত্ন করে মাচায় উঠিয়ে রাখত।

এক খেতের ফসল কাটা শেষে কৃষকরা যেত আর এক খেতে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত খড়। ধামা নিয়ে ফসল কাটা খেতে খেতে ঘুরে ফিরত পাড়ার গরীব মেয়েরা। ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান খুঁজে বের করত তারা। কেউ নিষেধ করত না।

কৃষকেরা ভোর থেকে ধান কাটত, বোঝা বেঁধে মাথায় করে বয়ে আনত হাঁটু সমান কাদা পার হয়ে। পরাঙ্গী, শ্যামলিমা, লক্ষ্মীপ্রিয়া, লক্ষ্মীলতা, নাজির শাইল, লতা শাইল, শালকুড়ো, শিশুমতি, শিবজটা, কইজুরি, জাগোলি, বাঁশিরাজ, দেবমণি, দলকচু, দিঘা, হচ্চামুড়ি–আরও সব নতুন ধানে ঝকঝক করত তাদের উঠোন। নতুন ধানের পিঠে-পায়েসের ঘ্রাণে মৌ মৌ করত সারা গ্রাম। হাতে আসত কাঁচা পয়সা। সে পয়সায় হতো আনন্দ-ফুর্তি। হতে নমশূদ্র কৃষকদের সারা বছরের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান।

কার্তিক মাসে হতো কালিপূজো। লক্ষ্মীপুজোর পূর্ণিমার পরের অমাবস্যায় হয় কালিপুজো। নমশূদ্র কৃষকদের মা কালীর উপরে অচলা ভক্তি। যেমন ভয়, তেমনি শ্রদ্ধা। নমশুদ্র গ্রামে বারোয়ারি কালীমন্দির দেখা যায়। সেখানে গ্রামের সবাই মিলে পুজো করত। সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে জালত মাটির প্রদীপ। আগে থেকেই মাটি দিয়ে ছোট ছোট প্রদীপ বানিয়ে শুকানো হতো। পুজোর দিনে। সেই প্রদীপে ঢালা হতো সরষের তেল। তেলের ভিতরে ডোবানো হতো পুরনো নরম ছেঁড়া কাপড় দিয়ে পাকানো সলতে। সারিবদ্ধভাবে প্রদীপ সাজিয়ে জেলে দেয়া হতো। অন্য রকম এক আবহ তৈরি হতো।

লক্ষ্মীপুজোর পরের পূর্ণিমাতে হতো রাসপুজো। এই পূর্ণিমাকে বলা হতো। কার্তিকী পূর্ণিমা। ভগবা ওর রাসযাত্রা। গ্রামের অবস্থাপন্ন দু-চারটা বাড়িতে এই পুজো হতো। এই পুজো আপামর নমশূদ্র গেরস্থদের কাছে তেমন জনপ্রিয় ছিল না।

কার্তিক মাসের শেষদিনে হতো কার্তিক পুজো। কার্তিক পুজো বিল এলাকার নমশূদ্রদের সবচেয়ে বড় উৎসব। সারা বছর ধরে তারা এই পূজার অপেক্ষায় বসে থাকত। দূর্গা পুজা লক্ষ্মীপূজা বিলের জনজীবনে তেমন জমত না। কারণ, তখন তাদের হাতে টাকা-পয়সা থাকত না বলে সারা হতো নমঃ নমঃ করে। ধুমধাম হতো কার্তিক পূজায়। মেয়েদের পরনে উঠত নতুন শাড়ি, বাচ্চাদের গায়ে নতুন জামা। হাট থেকে ইলিশ কিনে হাতে ঝুলিয়ে ঘরে ফিরত তারা। সাথে থাকত শিঙে, খাজা, জিলাপি, দানাদার, বাতাসা।

কার্তিক ঠাকুর রূপ, গুণ ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক।

পুজোর দিনে গোটা উঠোনজুড়ে আলপনা আঁকত বাড়ির রমণীরা। আলপনা আঁকত ছোট ছোট মাটির হাঁড়িতে। এই হাঁড়িকে এরা বলত নুছনার (রোসনাই) পাতিল। এই পাতিল খই-মুড়কি দিয়ে ভরা হতো। একখানা পুজোয় অনেকগুলো নোছনার পাতিল থাকত। পুজো শেষে উপস্থিত সবার মাঝে সেই খই-মুড়কি বিতরণ করা হতো।

পাল পাড়া থেকে ঠাকুর কিনে নিয়ে আসত নমশুদ্র কৃষকরা। উঠোনে তৈরি হতো মণ্ডপ। খেজুর পাতা ব্যবহার করা হতো এই মণ্ডপ তৈরিতে। খেজুরের ডগা পুঁতে তৈরি করা হতো মণ্ডপের বেড়া। মণ্ডপের মধ্যে রাতের বেলা হতো কার্তিক ঠাকুরের পুজো। পরদিন সকালেই হতো তার বিসর্জন।

কার্তিক পুজোয় ব্রাহ্মণ তার মন্ত্র উচ্চারণ করত তিল-তুলসী, ফুল বিল্বপত্র-সহকারে। গাঁয়ের কৃষকরা পুজোর বাকি কৃতকর্মে লেগে পড়ত। ব্রাহ্মণের পুজো শেষে তারা কার্তিক ঠাকুরকে তাদের ফসল বোনা, নিড়ানো এবং ফসল কাটার দেবতা জ্ঞানে ভক্তিভরে মণ্ডপের সামনে গোল হয়ে বসে গান ধরত।

প্রথমে ধান বোনা গীত–

কার্তিক মাসে কাতেলি
ধান বুনিব জাগোলি
ও কার্তিক শোনো না
ধান কেনে বোনো না রে…

মাটি রসে ভরে ভরো
কাকপক্ষী নড়ো নড়ো
তাও কেনে বসে থাকো রে…
কার্তিক মাসে কাতেলি
ধান বুনিবো জাগোলি ॥

এরপর কৃষকেরা গোল হয়ে হাতে নিড়ানি চালানোর ভঙ্গি করে গাইত–

কার্তিক ঠাকুরের নিড়েনি
তাতে নেইকো জিরেনি
দিন গেলি মাদেনি (মধ্যাহের খাবার) খাই
তারা উঠলি বাড়ি যাই।।
চিনের খ্যাতে চিনচিনানি
ধানের খ্যাতে পানি
জলদি চালাই নিড়েনি ভাই
আর কিছু না জানি
কার্তিক ঠাকুর নিড়েনি…

নিড়ানো শেষ করে এবার তারা খেতের আইলে ফসল পাহারায় বসত। এ হলো ধানখেত পাহারা দেবার সময় বাঘ তাড়ানোর মহড়া। বাঘের কামড় থেকে উদ্ধার করা পাহারাদারকে চিকিৎসার জন্য ব্যস্ত হয়ে তারা গাইত–

এসো এসো বৈদ্য
এসো আমার বাড়ি
ভাইরে খাইছে বাঘে
আহা মরি মরি ॥

যার হয় কাশের গিরে
তারে খাওয়াই বাঁশের গিরে
কানা খোঁড়া রুগি পালি
তারে খাওয়াই বিষ বড়ি
সৎকার্য করে শ্যাষে
খায়ে যাই দই চিড়ে।।

এরপর ধান কাটা, ধানের মলন দেয়া শেষ হলে গাইত–

ধামা আনো ঝাঁকা আনো
কার্তিক ঠাকুরের কাঠা আনো
যে কাঠার বুকটান পিঠটান
সেই কাঠায় মাপপো ধান রে..

সকল দাওয়াল কাটে ধান
গোছে আর গোছে রে
আমার দাওয়াল কাটে ধান
বাবরি ওড়ে বাতাসে রে
ধামা আন ঝাঁকা আন…

এরপর ধান মাপা শেষ করে পুজো সমাপ্তে সবাই নোচনার পাতিলের খই মুড়কি খেয়ে ঘরে ফিরত। পরদিন সকালে মাঠে যেত ধান কাটতে। চকচকে রোদের উজ্জ্বল আলোয় ধারালো কাস্তে ঝকঝক করে উঠত। সোনারঙা ধান কেটে পাটপাট করে সাজিয়ে রাখত ধানের খেতে। কৃষক-কৃষাণীর চোখে ভেসে বেড়াত আগামীদিনের সুখ-স্বপ্ন।

কৃষকেরা খেতে কাস্তে চালাত। হুঁকো খেত। মনের খুশিতে গাইত–

শোনো বলি গুরুধন একখান কথা করি জিজ্ঞাসন
সে তোমার দেহেরই গঠন
কত চিচে অযুত পয়দা করেছে সাঁই নিরঞ্জন
তোমার দেহেরই গঠন।।

দশজনার আঠারো চিচে কোনজনার কয় চিচে
বলো গুণধন, আরেক কথা করি জিজ্ঞাসন
গেলাম নদীর ঘাটে ওরে একটা গাছে মানুষ ঝলতেছে
ও তার মুণ্ডু ছাড়া ধড় আছে সেই ধড়ে রক্ত পড়তেছে
এ কিসেরই কারণ।।

অগ্নি মাঝে রক্ত পড়ে সেই রক্ত পুস্প সাজে
পুষ্পে দড়িয়া ভেসে যায়
অধম ইয়াদালি কয়, কী দ্যাখালে দয়াময়
তোমার কুদরত বোঝা দায়
আমি জিজ্ঞাস করি গুরুর কাছে
সেই পুষ্প ভাসে ভাসে চলতেছে কোথায়।।

এই গীত শেষ হতেই আরেক খেত থেকে সাথে সাথে ভেসে আসত এর উত্তর-গীত। এভাবে সকাল থেকে বুড়ি বিকেল পর্যন্ত ঝকমকে সোনার ধান আর সুরেলা গীত এক হয়ে যেন কৃষকের অন্তরে খেলা করত। সেই ধানের সোঁদা গন্ধের মদিরতায় কৃষাণীরাও কাজ করে যেত ঘোরের মধ্যে। কৃষকেরা ধান কাটত, বোঝা টানত, মলন মলত। কৃষাণীরা ধান ঝাড়ত, উড়াত, শুকাত। ডোলে উঠাত, গোলায় ভরত। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কৃষক-কৃষাণীর সময় কাটত মাতাল-ব্যস্ততায়।

কার্তিক মাসের শেষ দিনে হতো ভূত তাড়ানো অনুষ্ঠান। চলত ভূত দাবড়ানো প্রতিযোগিতা। সামনের এক বছর যাতে গ্রামের ত্রিসীমানায় ভূত আর না আসতে পারে। পাটকাঠি দিয়ে তৈরি হতো ভূত। মোটামোটা চারটে কাঠি মাপমতো দড়ি দিয়ে বেঁধে বানানো হতো বর্গক্ষেত্রের মতো ভূতের শরীর। মাঝখান দিয়ে একটা বড় বাঁশের চটা লম্বালম্বিভাবে বেঁধে সেই চটার উপরে কঁচা নরম কঞ্চি গোল করে বসানো হতো ভূতের মাথা। তার নিচে দুটো পাটকাঠি বেঁধে তৈরি হতো দুটো হাত! নিচের দিকে শরীরের ফ্রেমের সাথে আরও দুটো পাটকাঠি জুড়ে দিয়ে বানানো হতো দুই পা।

কচুপাতার মধ্যে খলসে, পুঁটি, টাকি, চাঁদা ইত্যাদি ছোটোমাছ পেঁচিয়ে বাধা হতো। তারপর সেটা ঝুলিয়ে দেয়া হতো ভূতের দুই হাতের সাথে। ভূতের মাথায় বাধা হতো কেরোসিন তেলে ভেজানো ন্যাকড়া। তারপর আওড়ানো হতো ভূত তাড়ানো মন্ত্র–

ইটের গুঁড়ো, খলসের গুঁড়ো
ভূত দাবড়াই দক্ষিণ মুড়ো।
ভূত পেত্নী দূরে গেল
রাম লক্ষ্মণ কাছে আলো।
মশা-মাছি যাক দূর
লক্ষ্মী আসে ঘর ভর।।

কোরাসের মতো সেই মন্ত্র সমস্বরে আউড়ে প্রাণপণে ছুটতো সবাই। ভূত আগুনকে ভয় পায়। তাই ভূতের মাথায় বাঁধা ন্যাকড়ায় আগুন ধরিয়ে দিত তারা। ভূতকে দাবড়িয়ে গা ছাড়া করে, এলাকা ছাড়া করে বাড়ি ফিরত ছেলের দল।

এলাকাভেদে হতো ভুল ওড়ানো। মাসের শেষ দিন সন্ধ্যায় খড় দিয়ে বানানো হতো নুড়া বা মু। তাতে খলসে মাছ, মশা, মাছি, পোকামাকড় ভরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হতো। তারপর দলবেঁধে ভাঙাকুলো, ভাঙা থালা পিটিয়ে দৌড়াত। ছুটোছুটি করে সেগুলো একসময় ছুঁড়ে ফেলে দিত বাড়ির দক্ষিণ দিকে। দৌড়ানোর সময় সুর করে ছড়া কাটত সবাই–

ঘাটের ভুল, মাঠের ভুল, পথের ভুল
দক্ষিণের ভাটিতে যা
উড়ির কুটা, ইন্দুরটা, বান্দরটা, পোকটা, জোকটা
দক্ষিণের ভাটিতে যা ॥

নৌকা বাইচ ছিল তখন নমশূদ্রদের চিত্তবিনোদনের একটা বড় মাধ্যম।

শুধু চিত্তবিনোদনই নয়, এটা ছিল তাদের উৎসবও বটে। পুরো কার্তিক মাসজুড়ে চলত নৌকা বাইচ। সারা বছর মাঠেঘাটে হাড়ভাঙা খাটুনির পর দুর্গোৎসব শেষে লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে তারা মেতে উঠত নৌকা বাইচে। ছোট-বড় নদী-খালে বাইচের আয়োজন হতো। কার্তিক মাসকে গণ্য করা হতো নৌকা বাইচের মাস হিসেবে।

নদীর কিনারে আড়ং বসিয়ে পুরস্কার ঘোষণা করে এরা নৌকা বাইচ দিত। বাইচে দূর-দূরান্ত থেকে নানা মাপের নৌকো আসত। সেইসব নৌকা সজ্জিত করা হতো নানাভাবে। বসানো হতো পিতলের চোখ। দু’একটা নৌকায় সোনার চোখও দেখা যেত কখনও কখনও। এক একখানা নৌকা চল্লিশ, পঞ্চাশ হাত থেকে একশো সোয়াশো হাত পর্যন্ত লম্বা হতো। যে নৌকো যতবড়, তত বেশি হতো বৈঠার বাইচে। নৌকার দুই ধার দিয়ে এই বাইচেরা বসে গা-মাথা ঝাঁকিয়ে যখন তালে-তালে বৈঠায় টান দিত, তখন নৌকা যেন। জলের উপর দিয়ে উড়ে চলত। দুই ধারের বৈঠাকে মনে হতো নৌকার দু-খানা পাখা।

এইসব নৌকা চমৎকার চমৎকার নামও থাকত। যেমন–জলপরি, জলকুমারী, জলরাজ, জলদস, জলকন্যা, মা জননী, চোখের পলক। এ রকম আরও কত নাম!

নৌকো যখন বাইচে চলত তখন বৈঠাধারীদের সেকি আনন্দ! সেই আনন্দের পৌরোহিত্য করত গুণীন ফকির। প্রত্যেক নৌকায় একজন করে গুণীন থাকত। নৌকা ও নৌকার বাইচেদের শরীরে যাতে কেউ জাদুটোনা করতে বা বাণ না মারতে পারে, সে জন্য বাইচ শুরুর আগেই গুণীন মন্ত্রপড়া জল, মন্ত্রপড়া ধূলি নৌকো ও নৌকোর বাইচেদের ছিটিয়ে দিয়ে নৌকোর মাঝখানে দাঁড়াত। নৌকো ছুটতে শুরু করলে গা-মাথা ঝাঁকিয়ে ঘনঘন জাগ বলত গুণীন। সেই জাগের তালে তালে বাইচেরা মাথা ঝাঁকিয়ে বৈঠা মারত। যারা যত ঘন বৈঠা মারতে পারত, তাদের নৌকো তত বেশি বেগে ছুটত। আর তত বাহাদুরি নিত গুণীন। পাল্লায় যে নৌকা বিজয়ী হতো, সেই নৌকার গুণীন বাদশা বনে যেত। গ্রীবা উঁচু করে এদিক-ওদিক তাকাত। দর্শকরাও তার দিকে গভীর শ্রদ্ধার চোখে তাকাত। নৌকা বাইচের সময় এরা গীত গাইত–

নৌকো চলো চলো রে, পাল্লার মাথায় যাই
পাল্লার মাথায় যায়ে আমরা পান তামুক খাই
ঐ দেখা যায় পাল্লার মাথা, বেশি দূরে নাই
নৌকো চলো চলো রে…
বুড়ো গাঙে নয়া জলে নয়া নয়া বাইচে
চালাও নৌকো মনের সুখে মনে দোষ না রাখে
ঐ দেখা যায় পাল্লার মাথা আর তো দূরে নাই
নৌকো চলো চলোরে…

নদী কিনারের নমশূদ্ররা কার্তিক মাসে নৌকো বাইচকে তাদের চিত্তবিনোদনের বড় এক উৎসব বলে মনে করত। দূরের যারা, তারাও যেত আনন্দ উপভোগ করতে।

অন্য মাসগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো সময়ই কাটাত নমশূদ্ররা কার্তিক মাসে। পরিবেশ থাকত মোটামুটি আনন্দঘন। ধান কাটা, ফসল ঘরে তোেলা, কার্তিক পুজো, নতুন জামা-কাপড় সবকিছু মিলিয়ে আর একটা কার্তিক মাস এভাবেই পার করে ফেলত নমশূদ্র কৃষকরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *