০৩. আষাঢ়

আষাঢ়

আষাঢ় মাস নমশূদ্রদের সর্বনাশা মাস।

দেখতে দেখতে জ্যৈষ্ঠ শেষে এসে পড়ত আষাঢ় মাস। এই মাসে ঘরে ঘরে অভাব এসে উদ্যত ফণা তুলে দাঁড়াত। এই সময়টাকে এরা বলত ‘দোকাটা মহল”। এই মাসে এসে সারা বছরের জন্য মজুদ করে রাখা ঘরের খাবার শেষ হয়ে যেত। অন্যদিকে খেতের আউশ ধানে পাক ধরে ধরে অবস্থা তখন।

আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। বাতাস, মেঘ, বৃষ্টি, রোদ খেলা করে একসাথে। রাতের আকাশে মেঘ, জোছনার লুকোচুরি। আবার কখনও ঝরঝর করে সারাদিন বৃষ্টি ঝরে অবিরল ধারায়।

বাচ্চারা সুর করে গাইত–

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
ধান দেব মেপে
লেবুর পাতায় করমচা
যা বৃষ্টি দূরে যা।

বর্ষায় প্রতিদিন জল বাড়ত। উপচে পড়ত খাল, বিল, পুকুর, নালা। মাঠের কাজ বন্ধ। বৃষ্টিতে আঠালো মাটি ঘন দৈ-এর মতো হাঁটু পর্যন্ত কাদাময় হয়ে থাকে। অচল হয়ে পড়ে জনজীবন। উঠোনে থকথক করত কাদা। পা ফেলতে হতে সাবধানে। পিছলে পড়ার সম্ভাবনা থাকত খুব। উঠোনময় ঘুরে বেড়াত গা ঘিনঘিন করা কেঁচো।

মাঠজুড়ে থাকত সবুজ সোনালি ধানের খেত। খেতের উপর দিয়ে বয়ে যেত ঝিরিঝিরি পূবালি বাতাস। চোখে ভাসত অনাগত দিনের স্বপ্ন। কাটা হবে ধান। ঘর ভরে উঠবে ফসলে। কিন্তু চোখে স্বপ্ন থাকলেও পেটে তখন খিদের হাহাকার। অভাবের এই সময়ে বৌ-বাচ্চার মুখে একমুঠো ভাত তুলে দিতে তাদের হাত পাততে হতো জমিদারের কাছে। নয়তো দ্বারস্থ হতে হতো দাদন ও সুদ ব্যবসায়ীদের। এক টাকার মাল ছয় আনায় কিনে নিত দাদনদারেরা। কিনে নিত জলের দামে খেতের ধান।

আষাঢ় মাস ছিল তাই নমশূদ্রদের কাছে ‘দানব মাস’।

আষাঢ় মাস অমাবতীর মাস।

আষাঢ় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নমশূদ্ররা সাত দিন ধরে পালন করত অমাবতী। তাদের বিশ্বাস, এই সাত দিন মৃত্তিকা মা রজোঃবতী থাকে। মাটিতে আঘাত লাগলে মা বসুন্ধরা ব্যথা পান, কষ্ট পান। কষ্ট পেলে তিনি রুষ্ট হয়ে অভিশাপ দিতে পারেন। তাই এই সাত দিন তারা দা-কাস্তে, খোন্তা-কোদাল, লাঙল-জোয়াল সব ধুয়ে-মুছে শূন্যে তুলে রাখত। পারতপক্ষে কোনো কাজ করত না তারা। এমনকি, মাটিকে বাঁচিয়ে পা ফেলার চেষ্টা করে। চৌকির উপরে বা মাচা বেঁধে তার উপরে শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিত।

নমশূদ্রদের বিশ্বাস, ঋতুবতী মায়ের শরীরে পা স্পর্শ করলে তার অমর্যাদা হয়। শরীরে কোনো আঁচড় লাগলে মায়ের রক্তক্ষরণ হয়; যা পাপ, অমার্জনীয় অপরাধ। তারা চেষ্টা করত মাটি মায়ের সংযমী পুত্র সেজে থাকতে।

এই সময়ে তারা বেড়াতে যেত মেয়ের জামাই বাড়ি, বোনের শ্বশুরবাড়ি বা অন্য কোনো কুটুম বাড়ি। অথবা বেড়াতে আসত আত্মীয়-স্বজন। তখন ধার দেনা করে চলত তাদের অতিথি আপ্যায়ন।

অমাবতীর পুরো সময়টা জুড়ে চলত বৃষ্টির ধুম। দিনরাত ঝমঝম বৃষ্টি। এই বৃষ্টিকে নমশূদ্ররা বলে কেঁচো রাজার সাত কন্যার কান্না। এদের বিশ্বাস, এই সাত দিন কেঁচো রাজার সাত কন্যা এক একজন এক একদিন কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি ফেরে। তাদের কান্না বৃষ্টি হয়ে অমাবতীর সাত দিন ধরে অবিরত ঝরে।

ঘরে খাবার নেই। তার উপরে আকাশভাঙা গলগলে বৃষ্টি। খেতে নেই কাজ, পেটের মধ্যে খিদের দাপাদাপি। দিনান্তে কেউ এক পেট খায়, কেউ আধাপেটা। কারো সারাদিনে কিছুই জোটে না। কচু, ঘেচু, কলমি, শাকপাতা, এটা-সেটা সিদ্ধ করে চলে পেট বাঁচানোর প্রতিযোগিতা।

দেখতে দেখতে এসে পড়ে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা। আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা শুরু। সাত দিন পর আবার উল্টোরথ। এই রথে জগন্নাথ দেব পুরী থেকে নিজধামে যাত্রা করেন। আবার ফিরে আসেন সাতদিন পর। এই রথকে নিয়ে যেমন হল্লা, তেমনি লোকারণ্যের মেলা। মাঠজুড়ে নারী পুরুষ। দূর দূর এলাকা থেকে আসত ভক্ত, পুণ্যার্থী, দর্শনার্থী এই উৎসবে। রথের রশি স্পর্শ করতে পারলেই পুণ্য। রশি ধরার জন্য তাই ঠেলাঠেলি, ভিড়। নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ নির্বিশেষে।

নমশূদ্রদের অধিকার ছিল না এই রশি ধরায়। সে অবশ্য অনেক আগের কথা। পরবর্তীতে নমশূদ্ররা তাই নিজেরাই জগন্নাথ দেবের রথ স্থাপন করে নিয়েছে অনেক জায়গায়। রথযাত্রা নমশূদ্রদের অন্তরাত্মার পার্বণ নয়। পুণ্য হয়, তাই করা। অন্তরের আবেগ এর সাথে খুব একটা মিশে নেই। যেন আম খাবার আনন্দ নয়, আপেল খাওয়া।

কাঠফাটা রোদ চরচর করে সারা দুপুর ধরে। গরমে অতিষ্ঠ সবাই। কাক পর্যন্ত টিকতে না পেরে ডোবায় নেমে জল ছিটিয়ে স্নান করে। গা ভেজায়।

খেতে খেতে বুক সমান পাট। এরা বলে কোষ্টা। এই সময়ে মাঠে মাঠে ছোট গাছ আর বড় গাছের বাছাবাছি। অপেক্ষাকৃত দুর্বল গাছ বেছে উঠিয়ে ফেলত তারা। যাতে পুষ্ট গাছগুলো আরও মোটাতাজা হয়ে বেড়ে উঠতে পারে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি। সাথে বাতাস। সেই বাতাসে পাট গাছের মাথাগুলো লকলকে সাপের মতো ফনা তুলে বাতাসে দোল খেত। সেই দৃশ্য কৃষকের হৃদয় জুড়াত। চোখে ভাসত স্বপ্ন। কাটা হবে পাট। সোনালি আঁশ বিক্রি করে জোগাড় হবে মুখের ভাত। কেনা হবে বউ, ছেলেমেয়ের পরণের কাপড়। শান দিতে শুরু করত তারা কাস্তেতে।

বাছাবাছি করতে করতেই খুশির আবেগে তাদের কণ্ঠে তখন উঠে আসত গীত–

আরে শুনো শুনো ও হে মহাশয়, একখান কথা জিজ্ঞাসি তোমায়
ওরে তিন বীর, বারো পীর সে কোন দেবতায়
তাই খুলে বলল রাজসভাতে শুনতে অভিপ্রায়।

আর একটি কাণ্ড দেখি ভবের পরে বড় আতার্য (আশ্চর্য) ব্যাপার
ওরে শৈশবকালে শিং দেখিলাম, যৈবনকালে (যৌবন) লুকোয় তার
আবার বৃদ্ধ কালে উঠিল শিং অতি ভয়ংকর ॥
ও সে শিং-এর মানুষ রূপের ভাণ্ডার, জগতে তুলনা নাই তার।
কোন দ্যাশেতে (দেশে) থাকে সে যে, সেই কথা বলো আমার (আমায়)
বলো বলো বিধানগুলো করিয়া প্রচার ॥

গানে গানেই উত্তর আসত পাশের পাট খেত থেকে–

শুনো শুননা বীরের পরিচয়
সেই তিন বীর খ্যালে (খেলে) এ ধরায়
ও সে পাশার গুটি (খুঁটি) পরিপাটি
তিন গুটির বারো শির হয়
সত্যি কি না দ্যাখেন গুনে
আছেন যত গুণী মহাশয় ॥

আর একটা কথা বলেছে সভায়
শৈশবকালে শিং ওঠে মাথায়
ও সে দ্বিতীয় চাঁদ আকাশেতে
শিং তারই দুই দিকেতে হয়
পূর্ণ চাঁদ লুকাইয়া সমান হইয়া যায় ॥

সেই চন্দ্র হইলো রূপের সার
ভুবনে তুলনা নাই তার
ও সে চাঁদের আলো যেমন
পুলকিত করে সবার
এই বিয়াখ্যা (ব্যাখ্যা) সভাতে করিলাম প্রচার ॥

এই উত্তরের পর আবার আসত প্রশ্ন। সে প্রশ্ন আসে হয়তো অন্য দিকের মাঠ থেকে–

সৃষ্টি মাঝে শুনি একজনার
আছে তার দারুণ কাজের ভার
ও তারে দেখলে সবাই হয় রে বোবা
চোক্ষে বহে জলের ধার
আবার চোয়াল ছাড়া চরণে তার দাঁতেরই বাহার ॥

সেই মহাত্মার নামটি শুনতে চাই
কোন জায়গা বলো তাহার ঠাঁই!
চোখ আছে, তার নাই কো পালক
নাই রে তাহার ঘুমের বালাই
বলো তাহার পরিচয়টা, খুলে বলল ভাই ॥

আর একটা লোক অতি ভয়ঙ্কর
দুই চোখ তার বুকেরই উপর
সেই নাকি সব নষ্ট করে
মন্ত্র দিয়ে সাধুর ঘর
নামটি কি তার বুলো গুণোধর ॥

উত্তর ভেসে আসত হয়তো দক্ষিনের খেত থেকে–

গানের উত্তর গানে বলে যাই
শোনেন যত শ্রোতা বন্ধু ভাই
চরণে যার দাঁত রয়েছে তার কথা শোনাই
আজরাইল নামটি তাহার শোন হে সবাই ॥

চারতলা আকাশের উপর তুরাগাছের গোরে
দিন রজণী থাকেন বসে
চোখের পলক না পড়ে
কখন কারে ধরতে হবে, সেই হিসেব করে ॥

আরেকজনের নাম হলো শয়তান
শোনো তার চোখেরই বয়ান
ছিনার উপর দুই চোখ তার
দলিলে তে বিদ্যমান
সেই তো সব সাধুজনের ঘটায় অকল্যাণ ॥

এইভাবে চলত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গানের পাল্লা, ধুয়োর পাল্লা। এসব গান যে শুধু মাঠেই হতো তা নয়।

আষাঢ়িয়া বৃষ্টিভেজা রাতেও বাড়ির কাছারি ঘরে, নয়তো উঠোনে জমে উঠত গানের পাল্লা। প্রশ্ন আর উত্তর। এই আসরের শ্রোতা নারী-পুরুষ সবাই? এই গান এদেরকে শুধু আনন্দই দিত না, কর্মশক্তিতেও প্রেরণা জোগাতো। রাতের মেটে প্রদীপের উদ্ভাসিত আলোয় চকচক করত তাদের মুখ। গানের রূপ, রস আস্বাদনে ভরতো মন।

পরদিন নতুন উদ্যমে মাঠের কাজে নামার প্রত্যয় নিয়ে ঘুমাতে যেত সবাই।

একটু একটু করে বাড়ত বিলের জল। গ্রামগুলো হয়ে যেত তখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। নৌকা ছাড়া চলাচলের উপায় থাকত না। আষাঢ়ের শেষদিকে শুরু হতো মাঠের আউশ ধান কাটা। কাজের সাথে চলত খোশগল্প, আনন্দ, রসিকতা। কোমর জলে নেমে বেছে বেছে ধান কাটা, আঁটি বেঁধে নৌকায় তোলা, নৌকা থেকে মাথায় করে সেই ধান উঠোনে এসে ফেলা। তারপর চলত মলন মলা। গভীর রাত পর্যন্ত চার পাঁচটা গরু একসাথে বেঁধে মুখে বেতের ঠুসি পড়িয়ে গোল করে বিছানো ধানগাছের উপর দিয়ে চক্রাকারে ঘোরানো হতো। ধান আলাদা হয়ে গেলে খড় বেছে সরিয়ে ফেলা হতো। ধান ঝেড়ে বেতের ধামায় ভরে পরদিন তা শুকাতে দিত রোদে শুকানো ধান কুলায় করে বাতাসে উড়াতে গৃহবধূরা। পুরুষরা খড় শুকিয়ে পালা দিত। আমন ধান না ওঠা পর্যন্ত এগুলোই গরুর খাবার এবং জ্বালানী।

এভাবেই ঘরে উঠে যেত আউশ ধান। মাঠে রয়ে যেত আমন। জলের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ত আমন ধানের গাছ।

ভরা বিলে থৈ থৈ করত জল। এই সময়ে বিলের নমশূদ্রদের কাজ থাকত না। বাদল দিনে কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুম আর অলসতার আয়েশ। কখনও বাঁশ দিয়ে বানাত পলো, দোয়াড়ি, হেচা। জাল বুনতো, মাছ ধরত। মেয়েরা কাথা সেলাই করত। কাচারি ঘরে দলে দলে ভাগ হয়ে বসে খেলতো টোয়েন্টি নাইন, বাঘবন্দি। কর্মকাণ্ডকোর কুড়ৎ কুড়ৎ শব্দ ছড়িয়ে পড়ত। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকত চারদিক।

বাকীরা গালগপ্প করত, মারতে রাজা উজির। সে গল্পের থাকত না কোনো মাত্রাজ্ঞান। বাস্তবে যা কখনই সম্ভব নয়, এমন সব গল্পও তারা অবলীলায় বিশ্বাস করে নিত। আষাঢ় মাসের বিল এলাকার গালগপ্পের বহরের কারণেই হয়তো ‘আষাঢ়ে গল্প’ কথাটি বাগধারা হিসেবে বইপত্রে স্থান পেয়েছে।

টানা বৃষ্টিতে জ্বালানী সংকট দেখা দিত। চাইলেও বেশি রান্নাবান্নার সুযোগ থাকত না। কোনোমতে চালেডালে খিচুড়ি বা আউশের ফেনাভাত রান্না হতো। সাথে থাকত শুকনো মরিচ পোড়া আর সরষের তেল।

হাঁস পালতো অনেকে। ডিম পাড়া, ডিমে তা দেয়া, বাচ্চা ফোঁটানোর উপযুক্ত সময় ছিল এটাই। ছানাপোনা নিয়ে মা হাঁস ঘুরে বেড়াতে। জলে নামতো। ছানার ধারেকাছে কেউ গেলে মা হাঁস তাড়া করত তাকে। বাড়ির চারপাশে জল। সেই জলে ভেসে বেড়াতো কচুরিপানা। খেলে বেড়াতো নানারকমের ছোট ছোট মাছ। কখনও জাল, কখনও বরশি দিয়ে বিলে মাছ ধরত তারা। আধার হিসাবে ব্যবহার হতো বড় মাছের জন্য কেঁচো, আর পুঁটি চ্যালার জন্য আটা বা ভাত।

জলে কিলবিল করে ভেসে বেড়াতো কালো কালো বড় সাইজের জোক। স্নান করতে নামলে হাতে, পায়ে জোক লাগত। রক্ত চুষে খেয়ে ঢোল হয়ে যেত। জোকের মুখে লবন পড়লেই তার কর্ম হতো কাবার। এটা সবাই জানত। হাত-পা থেকে জোঁক ছাড়িয়ে লবণ লাগিয়ে দেয়া হতো। লবনে জোকের চামড়া ফেটে গলে যেত। জোক মারা যেত। রক্ত ছড়িয়ে পড়ত মাটিতে।

এই সময়ে গরুর কোনো কাজ থাকত না। কৃষক গরুর সেবা-যত্ন করত ভালো করে। যাতে গায়ে-গতরে শক্তি আসে। লাঙল-মই দেবার সময় শ্রম দিতে পারে যাতে বেশি করে। ঘাস, কচুরিপানা, নানা ধরনের জলজ লতাপাতা কেটে এনে গরুকে খাওয়াত তারা। গ্রামের লোকজন হাটে যেত দলবেঁধে। গ্রামের সবচেয়ে বড় নৌকাটি বেছে নেয়া হতো। সেই নৌকায় চেপে সবাই একসাথে হাটে যেত। সদাইপাতি করে বাড়ি ফিরত আবার একসাথে।

অনেকটা নিষ্কর্মার মতো কাটত তাদের সময় পার হয়ে যেত এমনি করে আর একটি আষাঢ় মাস নমশূদ্রদের জীবন থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *