১৭. মারাঠাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচেষ্টা

সপ্তদশ অধ্যায় – মারাঠাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচেষ্টা

মারাঠা জাগরণের যে আন্দোলন তার সূত্রপাত হয় শাহজী কর্তৃক কর্ণাটকে বস্তুত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপন, এবং বিজাপুর ও প্রবল-পরাক্রান্ত মুঘলদের শক্তিকে উপেক্ষা করে শিবাজির স্বরাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই পথ ধরেই পেশোয়ার প্রতিনিধিদের দ্বারা ১৭৫৯ সালে দিল্লি জয় এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে একটি সর্বভারত ব্যাপী সাম্রাজ্য গঠন করার যে প্রচেষ্টা তা ইতিহাসের একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ও কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

মারাঠা আন্দোলনের বিকাশকে মোটামুটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বটি ছিল শিবাজির স্বরাজ্য প্রতিষ্ঠা এবং সুরক্ষিত রাখার সংগ্রাম এবং দাক্ষিণাত্যের দরুন চৌথ ও সরদেশমুখীর উপর মারাঠিদের দাবির স্বীকৃতি অর্জন। ১৭১৯ সালে বালাজী বিশ্বনাথের দিল্লি গমন এবং শাহুকে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের দরুন চৌথ ও সরদেশমুখীর অধিকারের জন্য মুঘল সম্রাটের যথাযথ অনুশাসন প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই এই পর্যায়টি শেষ হল বলা যায়। ১৭২০ সালে বাজিরাওর পেশোয়ার আসনে অধিষ্ঠান এবং মালব ও গুজরাটে বিজয়ের জন্য মারাঠা প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। ১৭৪১ সালে এই দুইটি প্রদেশ মোটামুটি সম্পূর্ণ ভাবেই মারাঠাদের অধিকারে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই পর্যায়টি শেষ হয় বলা যেতে পারে। তৃতীয় পর্যায়ের শুরু হয় ১৭৪১ সালে। এই পর্যায়ে মারাঠারা রাজস্থান, দোয়াবের কিছু অংশ এবং আটোক পর্যন্ত পাঞ্জাবের ভূখণ্ড অধিকারের চেষ্টা করে ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে এই পর্যায়টি তার চরম সীমায় পৌঁছায়। যদিও আমাদের পর্যালোচনা ১৭৪৮ সালে মুহম্মদ শাহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হচ্ছে কিন্তু ১৭৪১ থেকে ১৭৬১ সাল পর্যন্ত রাজনীতির যে ধারা পরিলক্ষিত হয় পূর্ববর্তীকালের ঘটনাবলীর উপর তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে।

মারাঠা শক্তি এবং তাদের রাজ্য বিস্তারের নীতি

মারাঠা আন্দোলনের চরিত্র জটিল ছিল। পূর্বেকার ধর্মীয় সামাজিক সংস্কারের সঙ্গে মারাঠা সর্দারদের নেতৃত্বে আঞ্চলিক স্বাধীনতার সংগ্রাম এখানে একত্রে জড়িত হয়ে উঠেছিল। অবশ্য এই আন্দোলনের রাজনৈতিক, ধর্মীয়-সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অভিমুখের মধ্যে মতভেদ দেখা গিয়েছিল। এই মতভেদগুলি আবার মারাঠাদের মধ্যেকার বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থের সঙ্গেই জড়িত ছিল। মারাঠা সমাজের সবথেকে প্রভাবশালী সদস্য সর্দারদের অবশ্য ধর্মীয়-সামাজিক সংস্কারে অথবা কৃষকদের কল্যাণ সাধনে কোনো উৎসাহ ছিল না, যদি না এর সঙ্গে তাদের নিজেদের স্বার্থও কোনোমতে জড়িত থাকে। রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়-সামাজিক সংস্কারমুখী। আন্দোলনের যোগসূত্রও দুর্বল হয়ে পড়ে। শিবাজি যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন মুঘলদের আক্রমণে তা বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং তারপর বিভিন্ন মারাঠা সর্দারেরা একধরনের গেরিলা বা খণ্ড যুদ্ধে অনেক সময় একইভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে এইসব সর্দাররা সাধারণত মহারাষ্ট্রের শক্তিশালী দেশমুখ বংশোদ্ভূত ছিলেন না। পরন্তু তারা প্রায়ই অতি সাধারণ পরিবার থেকেই এসেছিলেন, যাঁরা তাঁদের এই ধরনের বিচ্ছিন্ন যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শীতা এবং অবশ্যই লোকসংগ্রহের ক্ষমতার জন্য এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন। মারাঠাদের এই মুক্ত সর্বজনগ্রাহ্য সমাজ রাজস্থানের বংশানুক্রমের আত্মীয়তা-ভিত্তিক সমাজ ধারা বা মুঘলদের উত্তরাধিকার সূত্রে সৃষ্ট সমাজ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে পৃথক ছিল।

কিন্তু ১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর শাহু মুঘলদের বন্দিদশা থেকে ফিরে আসার পর এই সকল শক্তিমান সর্দারেরা যে তার বশ্যতা স্বীকার করবেন–এমন সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। প্রকৃতপক্ষে নিজেদের ক্ষমতা এবং অবস্থান বজায় রাখার জন্য তারা শাহু এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা উভয়ের মধ্যেই চলমান ছিল। তবে বালাজী বিশ্বনাথ ১৭১৯ সালে শাহু এবং তাঁর সর্দারদের মধ্যে এক জটিল রাজস্ব বিভাজন প্রথা সম্পন্ন করে এই দ্বিচারিতা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে এই ব্যবস্থায় সর্দারদের উপর চৌথ ও সরদেশমুখী আদায়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এই সংগৃহীত অর্থ থেকে রাজাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করার ব্যবস্থা করা হল, সংগৃহীত সরদেশমুখী এবং চৌথের শতকরা ৩৪ ভাগ। সুতরাং রাজা রাজস্বের জন্য এবার প্রধানত সর্দারদের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠলেন। আবার চৌথ ও সরদেশমুখী আদায়ের দায়িত্ব এমনভাবে ভাগ করে দেওয়া হল যাতে করে কোনো মারাঠা সর্দার একক ভাবে কোনো বিশাল ও ঘনসন্নিবিষ্ট এলাকার উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করতে না পারেন। যেসব অঞ্চল সরাসরি পেশোয়ারদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেখানে ধীরে ধীরে পেশোয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকল।

বালাজী বিশ্বনাথের প্রণীত এইসব ব্যবস্থাগুলিকে প্রায়ই সমালোচনার মুখে পড়তে হত এবং তাদের দোষত্রুটিগুলিও ছিল সহজেই চোখে পড়ার মতো। যেমন মারাঠা মুঘল অঞ্চলগুলিকে হঠাৎ আক্রমণ ও লুণ্ঠন করার বাড়তি সুবিধা দেওয়া ছাড়াও তাদের বস্তুত রাজার নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতাও দেওয়া হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে মারাঠাদের মধ্যে কোনো কার্যকরী রাজনৈতিক একতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সম্পূর্ণভাবেই পেশোয়ারূপী প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল ছিল এবং এখন থেকে মারাঠা রাজনীতির ক্ষেত্রে পেশোয়া একটি মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠবেন।

বংশানুক্রমে পেশোয়ার পদে অভিষিক্ত হবার যে পরম্পরা, তার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাজীরাও। অতুলনীয় কর্তব্য-নিষ্ঠার পুরস্কার-স্বরূপ শাহুজী ১৭২০ সালে বাজীরাওকে তাঁর পিতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার এই সিংহাসন বংশানুক্রমে বালাজী বিশ্বনাথের পরিবারবর্গই যে অধিকার করবেন, এই সময়ে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত শাহুজী নিয়েছিলেন কিনা তার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। তবে শাহুর দরবারে যেসব সভাসদ উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তারা সেই সব পদগুলিকেই তাদের বংশানুক্রমিক অধিকার বলে গণ্য করতেন।

তবে যুদ্ধক্ষেত্রে তার সাফল্যের নিদর্শন দিয়ে এবং নিজের উপরেই ক্রমবর্ধমান দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব ন্যস্ত করে বাজীরাও তার উত্তরাধিকারের বিতর্কটি সন্দেহাতীত ভাবে অবসান করলেন। এবং শেষ পর্যন্ত বাজীরাও যে পদে আসীন সেই পেশোয়ার পদটি হয়ে উঠল মারাঠা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের কেন্দ্রবিন্দু।

বাজীরাও পেশোয়ার আসনে অভিষিক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারাঠা আন্দোলনের চরিত্রে এক পরিবর্তন এল। আন্দোলন হয়ে উঠল আত্মরক্ষা থেকে আত্মবিকাশমুখী। স্বজাতিকে রক্ষা করার সংগ্রাম রূপান্তরিত হল সাম্রাজ্য গড়ে তোলার সংগ্রামে। তবে এই পরিবর্তন রাতারাতি হয়নি। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষকালে মারাঠারা যখন বারবার গুজরাট ও মালবে আঘাত হানছিল তখনই মারাঠা আন্দোলনের চরিত্রের। পরিবর্তন দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠছিল। কিন্তু বাজীরাও ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হবার পরই এই পরিবর্তনের ধারাকে ভিত্তি করে একটি নূতন সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণীত হল। তবে এই নূতন নীতি গ্রহিত হবার পূর্বে মারাঠা দরবারে বাজীরাও এবং তাঁর প্রতিনিধি শ্রীপত রাওয়ের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী মতান্তর দেখা দিয়েছিল। দুই পক্ষ কীভাবে এই সমস্যাটির দিকে অগ্রসর হয়েছিল এবং তাদের যুক্তিতর্কের ধারাই বা কি ছিল–চিটনিসের এক বিবরণ থেকে কিছুটা তার মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। তবুও চিটনিস তাঁর মুখ্য চরিত্রদের মুখে যেসব দীর্ঘ ভাষণ এবং নানা বিচিত্র অলংকার তার লেখায় উপস্থিত করেছেন সেগুলিকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে নেওয়া বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তবে মনে হয় এই বিতর্কের মুখ্য প্রশ্নগুলি ছিল নিম্নরূপ (১) মারাঠা রাজ্যবিস্তারের। অভিযানের কী অভিমুখ হবে। এবং কোন সঠিক সময়েই এর সূত্রপাত হবে। (২)। নিজাম-উল-মুলকের মনোভাব এবং তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা যাবে কি না। (৩) অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা, বিশেষ করে মারাঠা সর্দারদের নিয়ন্ত্রণ করে এবং আর্থিক অনুশাসন এবং সেনাবাহিনীর সমস্যার সমাধান করে সুবিন্যস্ত করা এবং সবশেষে আসে ক্ষমতার প্রশ্ন। রাজপরিষদের কর্তৃত্বে কে থাকবেন, পেশোয়া না প্রতিনিধি?

এই প্রতিনিধিরা রাজ্য বিস্তারের নীতির বিরুদ্ধাচরণ করেননি। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন যে সর্বাগ্রে কোনোক্রমে অভিযান চালানো হোক যেখানে সিদি ও জামিরা বহু অঞ্চল পুনরাধিকার করে নিয়েছে এবং শিবাজি কর্ণাটকে যে বিজয় অভিযান শুরু করেছিলেন তার নিষ্পত্তিও এই সঙ্গেই করা হোক। অর্থাৎ প্রতিনিধির মতে সর্বাগ্রে এই ভাবে দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের অবস্থান সুসংবদ্ধ করে তার পরেই উত্তর ভারতে অভিযানের কথা ভাবা যেতে পারে। সেই প্রতিনিধি সাধারণভাবে সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে বলে অনুরোধ করেন যে মুঘলদের যেন অতিরিক্ত উত্তেজিত করে তোলা না হয়। তাহলে হয়তো মারাঠা মাতৃভূমিতেও তারা আক্রমণ শানাতে পারে। সর্বোপরি তিনি প্রবল পরাক্রান্ত নিজাম-উল-মুলকের সঙ্গে বন্ধুত্ব চেয়েছিলেন। তাই সেই প্রতিনিধি এই মত প্রকাশ করেন যে যতক্ষণ না রাষ্ট্রের আর্থিক অবস্থা সুনিশ্চিত হয় এবং একটি শক্তিশালী সৈন্যদল ও সুস্থায়ী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণমাত্রায় সম্প্রসারণের বিষয়টি স্থগিত রাখা উচিত।

অপরপক্ষে বাজীরাও মুঘল দরবারের দুর্বলতা এবং অক্ষমতার উপর দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন। মুঘল রাজসভা দলাদলি ও পারস্পরিক কলহে এতই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ছিল যে প্রায়ই মারাঠাদের সাহায্য চাওয়া হত এবং তাদের দ্বারাই রাজন্যবর্গ সৃষ্টি হত। আবার বিনষ্টও হত। বাদশাহী তক্তের ভাঙাগড়া মারাঠাদের উপরই নির্ভরশীল ছিল। কর্ণাটকের বিষয়টিকে তিনি একটি ঘরোয়া সমস্যা বলেই নস্যাৎ করে দেন। এবং হাজারাত বা ঘরের সৈন্যদের উপরেই এর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে অভিমত। প্রকাশ করেন। শিবাজির স্বপ্নের হিন্দু আধিপত্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি হিন্দু শক্তিগুলির সঙ্গে মারাঠাদের ঘোষিত বন্ধুত্বের কথা আলোচনা করে নিজামের শক্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে উত্তরের দিকেই অগ্রগতি হবার উপর গুরুত্ব দেন। এছাড়া উত্তর ভারতের অজস্র সম্পদের কথা উল্লেখ করে তিনি মারাঠা। সর্দারদের শিকারি মনোবৃত্তিকেও জাগিয়ে তোলেন, কারণ দীর্ঘকাল যুদ্ধবিগ্রহের ফলে দাক্ষিণাত্য ইতিমধ্যেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। আঘাত করো, গাছের গুঁড়িতে ঘা মারো, ডালপালা আপনি আপনিই পড়ে যাবে। কেবল আমার পরামর্শ গ্রহণ করুন এবং (তার পরিবর্তে) ‘আটকের’ দেওয়ালে দেওয়ালে আমি মারাঠা পতাকা উড়িয়ে দেব।

তবে বাজীরাওয়ের উত্তরমুখী সম্প্রসারণ নীতি থেকে একথা ভাবা ভুল হবে যে দক্ষিণের বিষয়ে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। ১৭২৪ সালের মতো পূর্ববর্তী সময়ে বাদশাহ নিজাম-উল-মুলকের বিরুদ্ধে বাজীরাওয়ের সহায়তা চাইলে বাজীরাও হায়দরাবাদ সুবাহর তাঁর কাছে সমর্পণের দাবি করেছিলেন এবং দাক্ষিণাত্যে মুঘল রাজপ্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকারও চেয়ে নিয়েছিলেন।

সুতরাং বাজীরাও নিজেও দাক্ষিণাত্যে মারাঠা আধিপত্যের বিষয়ে উৎসাহিত ছিলেন। তবে নিজামের দিক থেকে তীব্র বিরোধিতা ছাড়াই মারাঠারা কর্ণাটককে পর্যুদস্ত করতে পারবে এবং মহারাষ্ট্র এককভাবে নিজামের মতো একজন ধূর্ত ও জেদি শত্রুর বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের কর্তৃত্ব অর্জন করতে পারবে, প্রতিনিধির এই লোক দেখানো আশাবাদীতার শরিক হতে বাজীরাও সম্মত ছিলেন না। সেই জন্যই তিনি মালব ও গুজরাটের মতো সম্পন্ন এবং সমৃদ্ধ রাজ্য জয় করে মারাঠাদের কর্তৃত্বে নিয়ে আসার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। শতকের প্রথম ভাগ থেকেই মারাঠা সর্দাররা এইসব অঞ্চলে হানা দিয়ে নিয়মিত নজরানা আদায় করেছে। বাজীরাও এইসব হঠকারী হামলাকে একটি সুসংবদ্ধ এবং রাজনীতি-ভিত্তিক রূপ । দিতে চেয়েছিলেন, কেননা তিনি এই প্রদেশগুলির রাজনৈতিক এবং কৌশলী গুরুত্ব সম্বন্ধে ছিলেন সচেতন। মারাঠারা মালব এবং গুজরাটে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে নিজাম। এবং দিল্লির মধ্যে এক ব্যবধান গড়ে দেওয়া যাবে। মারাঠারা তখন নিজামের অধিকৃত অঞ্চলকে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখে নিজেদের দিল্লি থেকে নিজামের কোনো সাহায্য না আসার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তাকে আক্রমণ করতে পারবে। এছাড়া তারা দোয়াব। এবং তার পূর্ব ও পশ্চিমস্থ অঞ্চলগুলিতেও হানা দিতে পারবেন।

সুতরাং মালব ও গুজরাটে মারাঠা অধিকার স্থাপনই হবে ভারতে এক সুবৃহৎ এবং শক্তিশালী মারাঠা রাজত্ব স্থাপনের প্রথম পদক্ষেপ। বালাজী রাও এর থেকে আর কিছু বেশি নিজের কর্তব্য হিসাবে ভেবেছিলেন, বা এর থেকে তার অধিকতর কিছু রাজনৈতিক উচ্চাশা ছিল একথা ভাবলে তা হবে এক ঐতিহাসিক ভ্রান্তি। আটকে মারাঠা পতাকা ওড়াবার যে কথা তিনি তার ভাষণে প্রয়োগ করেছিলেন, তা ছিল কেবল এক রাজনীতিকের অতিশয়োক্তি মাত্র। এই কর্মটি অন্তত সুদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত সম্পন্ন করা ছিল মারাঠা সামর্থ্যের অতীত এবং এমন একটা অসম্ভব লক্ষ্য বাজীরাও-এর মতো একজন বাস্তবমুখী রাজনীতিজ্ঞ যে তাঁর কর্মসূচির মধ্যে রাখতে পারেন, তা কখনোই সম্ভব নয়।

মারাঠা এবং নিজাম-উল-মুলক

নিজাম-উল-মুলকের সঙ্গে মারাঠাদের সম্পর্ক বেশ কয়েকটি পর্বের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছিল, আবার মালব ও গুজরাটে মারাঠাদের কর্মকাণ্ডের উপরেও এই সম্পর্কের গভীর প্রভাব ছিল।

১৭১৫ থেকে ১৭১৭ সালে দাক্ষিণাত্যের মুখ্য রাজপ্রতিনিধি থাকাকালীন নিজাম মারাঠাদের সমগ্র দাক্ষিণাত্যের জন্য চৌথ ও সরদেশমুখীর অধিকারের দাবিকে কঠোর ভাবে প্রতিহত করে এসেছেন এবং কোনোরকম দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য না পাওয়া সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে প্রায় সর্বক্ষণই লড়াই চালিয়ে গেছেন। সৈয়দদের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ সফল হওয়ার পর নিজাম-উল-মুলক মারাঠাদের দাক্ষিণাত্যের জন্য চৌথ ও সরদেশমুখী সংগ্রহের অধিকার প্রদানের রাজকীয় ফরমান বা আদেশপত্রটি মেনে নিলেও, রাজধানী ঔরঙ্গাবাদের নিকটবর্তী অঞ্চলে অর্থাৎ আশেপাশে মারাঠাদের কোনো প্রতিনিধিকে নিযুক্ত করার প্রচেষ্টাকে তিনি প্রতিরোধ করে গেছেন। স্বল্পকাল পরেই ৪ জানুয়ারি ১৭২১ সালে ব্যক্তিগত ভাবে প্রথমবার তিনি বাজীরাও-এর সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। নিজাম এই যুবক পেশোয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করলেও কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমঝোতা দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠেনি বা কোনো চুক্তিও হয়নি। মারাঠা ও নিজাম-উল-মুলকের মধ্যে দ্বন্দ্বের মূল কারণ ছিল কর্ণাটক। বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সিংহাসনে আরোহণ করার সুবাদে নিজাম কর্ণাটককে তার নিজস্ব অধিকারভুক্ত বলে মনে করতেন। কিন্তু তার এই দাবির প্রতি মারাঠারা কর্ণপাতও করেননি। প্রকৃতপক্ষে শাহজীর সময় হতেই মারাঠারা কর্ণাটকের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন এবং এই ভুখণ্ডকে নিজেদের মৃগয়া-ভূমি জ্ঞানে অধিকারভুক্ত করে সর্বদাই এর সম্পদ লুণ্ঠন ও শোষণ করে যেতে চেয়েছিলেন।

১৭২১ সাল থেকে ১৭২৪ সাল পর্যন্ত দিল্লিতে নিজামের অনুপস্থিতির সময়কালে তাঁর কর্মরত উপপ্রধান মুবারিজ-উল-মুলক মারাঠাদের চৌথ ও সরদেশমুখীর আবেদন অগ্রাহ্য করেন এবং ফলত এতে তার সঙ্গে মারাঠাদের শত্রুতারও সূচনা হয়। নিজাম অবশ্য মারাঠাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে গেছেন। গুজরাট যাবার পথে ১৭২৩ সালে মালবে তিনি বাজীরাও-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আবার ১৭২৪ সালে মুবারিজ-উল-মুলক দাক্ষিণাত্যে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা থেকে নিজামকে যখন বাধা দিতে চান, তখন নিজাম বাজীরাও-এর সঙ্গে আর-একটি সম্মেলনের আয়োজন করে মুবারিজ-এর এই চালকে বিফল করতে সক্ষম হন। ১৭২৫ সালে শকর খেরার যুদ্ধে মারাঠাদের এক সৈন্যদল নিজামের হয়ে যুদ্ধও করেছিল।

১৭২৮ সালে নিজাম-উল-মুলকের সঙ্গে মারাঠাদের সম্পর্ক যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়। মালব ও গুজরাটে মারাঠাদের ঝটিকা আক্রমণের সংখ্যা বাড়ায় নিজামের যেমন অস্বস্তি বৃদ্ধি হয়, তেমনি তিনি আবার শঙ্কিতও হয়ে পড়েন। এছাড়া তিনি কর্ণাটকে মারাঠাদের অনধিকার প্রবেশেরও নিন্দা করেছিলেন। শাহু ১৭২৫-২৬ এবং ১৭২৬-২৭ সালে কর্ণাটকে যে দুটি অভিযান করেছিলেন তাতে নিজাম অংশগ্রহণ করা সত্ত্বেও তিনি তার সেনাধ্যক্ষদের নির্দেশ দেন মারাঠাদের বিরোধিতা করার জন্য। সাতারা এবং কোলাপুরের দরবারের মধ্যেকার বৈরিতা এবং বাজীরাও সেই প্রতিনিধির পারস্পরিক মতপার্থক্যের মতো বিষয়গুলি অবশ্য তার সাহায্যে এসেছিল। যথা, যখন মারাঠা সৈন্যদলের অধিকাংশই কর্ণাটকে ব্যস্ত ছিল, তখন তিনি চৌথ ও সরদেশমুখী প্রদান বন্ধ করে দেন। এর কারণস্বরূপ এইসব রাজস্বের বিষয়ে শাহু এবং কোলহাপুরের রাজা শম্ভুজীর মতভেদকে উল্লেখ করে তিনি আবার মুঘল বাদশাহের প্রতিনিধি সেজে শাহুকে তার আপত্তির বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য পেশ করতে আমন্ত্রণ করেন। তিনি আবার তাঁকে বাজীরাওকেবরখাস্ত করার পরামর্শ দিয়ে কোলহাপুরের রাজার সৈন্যদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন।

এই ঘটনা পরম্পরায় হতবাক হয়ে শাহু নিজামের উপদেশ মতো সমস্যাটি নিষ্পত্তির জন্য পাঠিয়ে দিতে প্রায় উদ্যত হয়েছিলেন। তিনি কিন্তু এরপর তাড়াতাড়িই নিজেকে সংযত করে মারাঠা সৈন্যদলকে ডেকে পাঠান এবং বিভিন্ন মারাঠা দুর্গের সেনাপতিদের আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। এদিকে কর্ণাটক থেকে দ্রুত ফিরে এসে বাজীরাও তৎক্ষণাৎ সমরাভিযানের প্রস্তুতি নেবার সিদ্ধান্ত নেন। নিজামের দেওয়া সমস্ত সন্ধির প্রস্তাবও তিনি খারিজ করেন। যদিও আসলে এইরকম যুদ্ধ করার কোনো অভিপ্রায়ই নিজামের ছিল না। তারপর একটি স্বল্পস্থায়ী অথচ চমৎকার লড়াইয়ের শেষে বাজীরাও পালখেদ-এর যুদ্ধে নিজামকে পরাস্ত করেন। এই অবরোধ থেকে মুক্তির জন্য ১৭২৮ সালে মুঙ্গি শিবগাঁওয়ে এবারে যে সন্ধি হল তার চুক্তি অনুসারে নিজাম দাক্ষিণাত্যে চৌথ ও সরদেশমুখীর উপর শাহুর একচ্ছত্র অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং এ-ছাড়াও কোলহাপুরের রাজা শম্ভুজীকে কোনোপ্রকার সাহায্য না দেবারও প্রতিশ্রুতি দেন।

যদিও এই চুক্তির ফলে দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। একথা ভাবা একটি ঐতিহাসিক ভুল হবে কিন্তু এবারে দাক্ষিণাত্যে চৌথ ও সরদেশমুখীর উপর শাহুর অধিকার নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠিত হল। এর ফলে বালাজী শেষপর্যন্ত নিশ্চিত ভাবে সেই তার্কিক প্রতিনিধিকে স্থানচ্যুত করে মালব ও গুজরাটের প্রতি তার অখণ্ড মনোযোগ দিতে সক্ষম হলেন। তবে বেশ কিছুদিন যাবার আগেই নিজাম আবার তার চক্রান্ত শুরু করলেন। দাক্ষিণাত্যে নিজামের উপস্থিতি এবং তার অনবরত চক্রান্তের ফলে বাজীরাওকে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হয় এবং এর ফলে। গুজরাট ও মালবে মারাঠাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করাও আরও কঠিনতর হয়ে পড়ে।

গুজরাট ও মালবে মারাঠাদের অগ্রগতি

মারাঠারা গুজরাটকে ১৭০৫ সাল থেকে এবং মালবকে ১৬৯৯ সাল থেকেই মাঝে মাঝে আক্রমণের মুখে ফেলে দিয়েছে। তবে একমাত্র ১৭২০ সালের পরেই ওই অঞ্চলে মারাঠাদের এই সব আক্রমণ হয়ে উঠল আরও নিয়মিত এবং সংগঠিত। যদিও বহু পূর্বপরিকল্পিত অর্থাৎ শিবাজির সময় থেকেই মালব ও গুজরাটের চৌথের অধিকার সম্পর্কে দাবি তোলা হয়েছিল, কিন্তু ১৭১৭ সালের পূর্বে মুঘলদের সঙ্গে তার কথাবার্তা চলাকালে গুজরাট এবং মালবের উপর মারাঠাদের দাবিকে সরকারি ভাবে স্বীকৃতি দেবার দাবি জানান। ১৭১৯ সালে তার দিল্লি সফরের সময় বালাজী বিশ্বনাথকে এই দুটি প্রদেশের জন্য চৌথ সংগ্রহ করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়।

এই দাবিগুলি স্বীকার করে নেওয়া হয়নি। ফলে এই দুটি প্রদেশে মারাঠা আক্রমণ হয়ে উঠতে থাকে প্রবল থেকে প্রবলতর। আবার ১৭২৪ সালে নিজাম-উল-মুলক। বিদ্রোহ করলে, নিজাম এবং বাদশাহ, উভয় পক্ষই মারাঠাদের সমর্থন লাভের জন্য দরাদরি শুরু করেন। মারাঠারাও পুনর্বার মালব এবং গুজরাটের উপর তাদের দাবির স্বীকৃতির জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। কিন্তু এই দুটি প্রদেশের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক গুরুত্বের কথা ভেবে নিজাম বা বাদশাহ, কেউই এই দাবির স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু বাজীরাও-এর হাতে তার পরাজয়ের পর (১৭২৮ সাল) নিজাম-উল-মুলক কিছুদিনের জন্য অন্তত মালব ও গুজরাটে তার অভিযানগুলি মেনে নিতে বাধ্য হন। এমনকি তার রাজ্যের মধ্য দিয়ে মারাঠি সৈন্যদলের যাতায়াত করার পথ করে দেওয়ার চক্রান্তও করেন। সুতরাং ১৭২৮ সাল পর্যন্ত মুঘলরা মালব ও গুজরাটে মারাঠাদের শক্তির পূর্ণ পরিচয় পাননি।

মারাঠাদের গুজরাট এবং মালবের বিজয় কার্য তিনটি পর্যায়ে সমাধা হয়েছিল। প্রথম পদক্ষেপ ছিল চৌথ এবং সরদেশমুখীর উপর মারাঠাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। পরবর্তী পর্যায়ে এই রাজস্বের পরিবর্তে নূতন করে এই প্রদেশগুলিকে মুঘল সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্নকরণের দাবি জানানো হয় এবং এই প্রদেশগুলিকে বিভিন্ন মারাঠা সর্দারদের প্রভাবের ক্ষেত্র অনুযায়ী তাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। এবং শেষ পর্যায়ে সরাসরি অঞ্চলগুলিকে অধিকার করে মারাঠা রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্তিকরণ সম্পন্ন হয়।

গুজরাটে রাজকীয় প্রশাসক সরবুলন্দ খান ১৭২৬ সালের মে মাসে চৌথ ও সুবাহর সরদেশমুখীর জন্য মারাঠাদের দাবি মেনে নেন। দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের চৌথ এবং সরদেশমুখীর দাবি একবার মেনে নিলে, গুজরাটেও সেই ব্যবস্থা প্রবর্তন করার বিষয়ে আপত্তি থাকার কোনো নৈতিক কারণ থাকা উচিত নয়। অবশ্য বলপ্রয়োগ করে নিবৃত্ত করার পক্ষে মারাঠারা অনেক বেশি শক্তিশালী, একথা একবার প্রমাণিত হলে তারপরই। তবে চৌথ এবং সরদেশমুখীর অধিকার প্রাপ্তির পর যে মারাঠা সর্দারদের লুণ্ঠন কার্যের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল তা কিন্তু নয়। দাভাদের দুই মুখ্য সহকারী পিলাজী গায়কোয়াড় এবং কান্ত কদমের মধ্যে চৌথের ভাগ নিয়ে যে বিবাদ শুরু হয়, তার ফলে এদের মধ্যে লড়াই লেগেই থাকত। আবার প্রতিনিধি মহোদয়কে শাহু গুজরাটের চৌথের যে অধিকার প্রদান করেছিলেন, তারা সেই দাবির বিরোধিতা করেন। তবে বাজীরাও অবশ্য তখন দাক্ষিণাত্যে অত্যন্ত কর্মব্যস্ত ছিলেন এবং পরে মালব দেশের বিষয়েও তিনি জড়িত হয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে মারাঠা সর্দারেরা দক্ষিণ গুজরাটের আঠাশটি জেলা অধিকার করে নেন। ১৭৩০ সালে বাজীরাও আবার গুজরাটের রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। তৎকালীন গুজরাটের প্রশাসক অভয় সিংহ ১৭১১ সালে বাজীরাও-এর সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। সেই চুক্তি অনুসারে বাজীরাও যদি গুজরাট থেকে গায়কোয়াড় এবং কাঙ্খা কদমকে বহিষ্কার করতে সম্মত হন, তাহলে অভয় সিংহ চৌথের পরিবর্তে বাজিরাওকে ১৩ লক্ষ টাকার একটি নির্দিষ্ট অর্থ প্রদান করবেন।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ১৭৩২ সালের মধ্যে মারাঠারা কেবল গুজরাটের প্রশাসকের কাছ থেকে চৌথ ও সরদেশমুখীর উপর তাদের অধিকারের স্বীকৃতিই আদায় করতে পেরেছিলেন, তাই-ই নয়, উপরন্তু যেসব জেলা থেকে এই রাজস্ব আদায় হওয়া সম্ভব, সেগুলিও নিজেদের অধিকারে দিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। ১৭৩১ সালে তিলোই-এর যুদ্ধে বাজীরাওয়ের হাতে দাভাদের পরাজয়ের পর দুই সর্দারের মধ্যে যে চুক্তি হয়, তার ফলে গুজরাটের বৃহত্তর অংশই দাভাদের অধিকারে আসে। কিন্তু কালক্রমে গায়কোয়াড় তার প্রভু দাভাদেকে গুজরাট থেকে বিতাড়ন করেন।

মারাঠাদের শক্তিপ্রয়োগের দ্বারা বিতাড়ন করার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হবার পর। নৈরাজ্যবোধে আক্রান্ত অভয় সিংহ ১৭৩৩ সালে পিলাজি গায়কোয়াড়কে একটি আলোচনার নিমন্ত্রণ দেন। কিন্তু সেখানে চরম বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি গায়কোয়াড়কে হত্যা করেন। এতে অবশ্য তার কোনো লাভই হয়নি। কারণ তাদের অন্যতম প্রধান সর্দারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে মারাঠারা উমা বাই দাভাদের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হন। অভয় সিংহ শীঘ্রই অবস্থা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে একথা বুঝতে পেরে মারওয়াড়ে পালিয়ে গেলেন। এবার পরবর্তী পর্যায়–অর্থাৎ প্রদেশের অবশিষ্ট অংশ অধিকার করে নেওয়ার ক্ষেত্র সম্পূর্ণ হল। কেবল বাদশাহের কাছ থেকে একটি যথাযথ আদেশনামার ভিত্তিতে বিষয়টি আইনসিদ্ধ করে নেওয়াই বাকি রইল। রোশন-উদ-দৌলার ভাই ফকর-উদ-দৌলাকে গুজরাটের রাজ্যপাল নিযুক্ত করে সাম্রাজ্যবাদীরা ১৭৩৯ সালে আর একবার শেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু যাকে রাজ্যপালের পদ দেওয়া হল তিনি নিজের দায়িত্ব নিতে এক পা-ও অগ্রসর হলেন না। ১৭৫৩ সালে আহমেদাবাদের পতনের পর গুজরাট থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ চিহ্নটুকুও মুছে গেল।

মালব

১৭২৩ সালে বাজীরাওয়ের নেতৃত্বেই সর্বপ্রথম সুপরিকল্পিত ভাবে মালব দেশ থেকে চৌথ আদায়ের দাবিটির রূপায়ণ শুরু হয়। ১৭২৫ সালে কেশো মহাদেও, কেশো বিশ্বনাথ, গোদাজী ডোকোলা এবং উদয়জী পাওয়ারের মতো স্থায়ী মারাঠি আধিকারিকদের দক্ষিণ মালব থেকে চৌথ আদায়ের জন্য নিযোগ করা হয়।

১৭২৫-এর জুন মাসে গিরধর বাহাদুরকে মালবের মুঘল সুবাদার রূপে নিয়োগ করা হয়। সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ গিরধর মারাঠাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন। তিনি মারাঠা কামাভিশদারদের বিতাড়ন করেন এবং শাহু চৌথ আদায়ের কাছে বাধা সৃষ্টি না করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাও তিনি অস্বীকার করেন। গিরধর বাহাদুরের ভ্রাতুস্পুত্র দয়ারাম একটি সুসজ্জিত সৈন্যদল নিয়ে সমগ্র প্রদেশ জুড়ে বিচরণ করতেন এবং সাহসিক উদ্যমে মারাঠা সর্দারদের তার অঞ্চল থেকে বিতাড়ন করেন। এই যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রপাত হল ১৭২৮ সালে সামঝারার যুদ্ধে গিরধর বাহাদুর এবং দয়ারামের মৃত্যুর পরই তার অবসান হয়। বাজীরাও এবার ঝড়ের মতো বুন্দেলখণ্ডে প্রবেশ করে জয়িনপুরে এম. খান বাঙ্গাশকে অবরুদ্ধ করার পর তাকে তার বুন্দেলখণ্ডে জয় করা সমস্ত অঞ্চল সমর্পণ করতে বাধ্য করেন। কৃতজ্ঞ রাজা এর বিনিময়ে চৌথ দিতে সম্মতহন। সমগ্র গ্রীষ্মকালই মারাঠা বাহিনী মালব দেশে অবস্থান করে এবং এর তিন বৎসর পরে বাজীরাও সমগ্র প্রদেশটিকে নিজ প্রভাব-প্রতিপত্তি অনুযায়ী তাঁর সর্দারদের মধ্যে ভাগ করে দেন।

মারাঠা অভিযানের ক্রমবর্ধমান ব্যাপকতা এবং মারাঠাদের ক্রমান্বয়ে ঊধ্বমুখী দাবি এবং উচ্চাশা দিল্লির দরবারের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠল। এই চিন্তা উত্তর ভারতের অন্যান্য অর্ধস্বাধীন এবং স্বায়ত্ত শাসিত রাজ্যের প্রধান, যথা আম্বেরের কছওয়াহা, যোধপুরের রাঠোর, বুন্দেলা, রাজন্যবর্গ, অওধ-এর (অযোধ্যা) সাদাত খান ইত্যাদিকেও সমভাবে শঙ্কিত করে তুলল। এদের কেউই অবশ্য চাননি যে দিল্লির সরকার আবার তার শক্তি ও কর্তৃত্ব ফিরে পাক। আবার সেই সঙ্গে মারাঠাদের ভীতিও এরা মন থেকে মুছে দিতে অপারগ ছিলেন এবং তাদের একক চেষ্টায় এই মারাঠা শক্তিকে যে পরাভূত করা যাবে না এ চিন্তাও তাদের ছিল। আসলে তখন একটি সম্মিলিত শক্তি বা মোর্চা গঠনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তাদের পারস্পরিক ঈর্ষা ও সন্দেহের জন্য এইরকম একটি জোট গঠন করার কাজকে কঠিনতরো করে তুলেছিল। অনেক কিছুই বাস্তবিক বাদশাহ এবং তাঁর উপদেষ্টাদের উপর নির্ভরশীল ছিল। তারা একটি সুনির্দিষ্ট এবং সুদৃঢ় নীতি অবলম্বন করতে পারলে হয়তো অনেক নবাব এবং রাজন্যবর্গকে তাদের সঙ্গে যোগদান করতে সম্মত করা যেতে পারত। দিল্লি দরবারের নীতির দৃঢ়তার অভাবের জন্য এই সব রাজন্যবর্গের ভিতরেও দ্বিধা ও অনিশ্চিত মনোভাবের সৃষ্টি হল এবং তাই তারা একক ও পৃথক ভাবে মারাঠাদের সঙ্গে চুক্তি করতে চাইলেন। এর ফলে বাদশাহের রাজনৈতিক এবং নৈতিক কর্তৃত্ব আরও দ্রুত ভেঙে পড়তে লাগল। তাই এইভাবে মারাঠাদের উত্তর ভারতে অভিযানের ফলে রাজত্বের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলি আরও বর্ধিত আকার ধারণ করে শেষপর্যন্ত এর আভ্যন্তরীণ অবক্ষয়কে দ্রুততর করে তুলল। ১ ১৭২৮ সালে মারাঠাদের সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টায় জয় সিংহকে মালবের রাজ্যপাল পদে নিয়োগ করা হয়। জয় সিংহ প্রস্তাব দেন যে বাদশাহ যেন শাহুজীর পোষ্যপুত্র খুশল সিংহকে বৎসরে ১০ লক্ষ টাকার আয়-বিশিষ্ট একটি মনসব দান করেন। বিনিময়ে তাকে কথা দিতে হবে তিনি ভবিষ্যতে মালবে আর কোনোপ্রকার গোলযোগের সৃষ্টি করবেন না, এর ফলে ভুখণ্ডে শান্তি ফিরে আসবে এমং মুঘল মনসবদারকে সাহায্যের জন্য একদল সৈন্য প্রেরণ করার ব্যয় ভার থেকেও মুক্ত হওয়া যাবে।

মুঘল বাদশাহ প্রথমে রাজি হলেও পরে মত পরিবর্তন করেন। জয় সিংহকে অপসারণ করা হয় এবং মারাঠাদের অগ্রগতি রুদ্ধ করার চেষ্টা চলতে থাকে। ১৭৩২ থেকে ১৭৩৫ সালের মধ্যেকার তিনটি অভিযানের মধ্য দিয়ে এই মারাঠা প্রতিরোধ পর্ব তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। এই তিনটি অভিযানের মধ্যে ওয়াজির কোয়ামারউদ্দিন খান ৮০ থেকে ৯০,০০০ সংখ্যক সৈন্যবাহিনী নিয়ে গোয়ালিয়র অবধি অগ্রসর হন এবং মারাঠিদের পশ্চাদ্ধাবন করার জন্য কয়েকটি বাহিনী প্রেরণ করেন। মারাঠারা কিন্তু তাদের স্বভাবসিদ্ধ ভাবে যুদ্ধকে এড়িয়ে যান। বাজীরাও-এর সহকারী পিলজিকে পরাভূত করার পর তাকে নর্মদার পারে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। এর পর রাজকীয় বাহিনী ফিরে এলেও ভবিষ্যতে মারাঠা আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য নর্মদা নদীতে কোনো রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থায় করা হয়নি।

১৭৩৩-৩৪ সালে এইরকম আর একটা চেষ্টা করা হয় যখন মির বকশির ভ্রাতা খান-ই-দৌরান সিরোজ অবধি অগ্রসর হন।

১৭৩৪-৩৫ সালে সকল বাদশাহী প্রচেষ্টা এক চরম সীমায় পৌঁছায় যখন যথাক্রমে ওয়াজির কোয়ামারউদ্দিন এবং বকশি-উল-মামালিক খান-ই-দুরানের নেতৃত্বে দুইটি অতি বিশাল বাহিনী মারাঠাদের নর্মদার অপর পারে বহিষ্কার করার জন্য প্রস্তুত হয়। জয় সিংহ, অভয় সিংহ, কোটার দুর্জন সাল ইত্যাদি সকল রাজপুত রাজা খান-ই-দউরানের সঙ্গে যোগ দেন। আগের বৎসর রাজপুতানার উপর হোলকারদের আক্রমণে তাদের চোখ খুলে যায় এবং ১৭৩৪ সালে জয় সিংহ-এর নেতৃত্বে আয়োজিত এক মন্ত্রণাসভায় সকলে মিলিত হয়ে একত্রিত ভাবে মারাঠাদের প্রতিরোধ করার শপথ গ্রহণ করে। এই পর্যায়ে ওয়াজিরের অধীন ২৫,০০০ জন এবং খান-ই দৌরানের নেতৃত্বে ৫০,০০০-এরও বেশি সৈন্যের সমাবেশ হয়। কিন্তু মারাঠাদের লঘু অস্ত্রধারী পদাতিক বাহিনীর সম্মুখে এই বিরাট সৈন্যদলও পুনরায় অসহায় হয়ে পড়ে। খান-ই-দৌরান এবং অভয় সিংহকে তোডা জলাশয়ের কাছে সম্পূর্ণভাবে পরিবেষ্টিত করে অবশিষ্ট সৈন্যবাহিনীর থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় এবং মারাঠাদের। সামনে জয়পুর সম্পূর্ণ সুরক্ষাবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত জয় সিংহ-এর দেখাদেখি খান-ই দৌরান আলোচনা শুরু করেন এবং মালবের চৌথ হিসাবে মারাঠাদের বাৎসরিক ২২ লক্ষ টাকা দিতে সম্মত হন। কোয়ামারউদ্দিন খান। মাড়ওয়ারের সন্নিকটে পিলাজী যাদবের সঙ্গে একটি ছোটোখাটো সংঘর্ষে লিপ্ত হলেও মারাঠাদের কোনো উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে অক্ষম হন। এই সব অভিযান থেকে স্পষ্টত বোঝা যায় যে মারাঠাদের লঘু অস্ত্র সজ্জিত পদাতিক বাহিনীর যুদ্ধ-কৌশলের বিপক্ষে মুঘলেরা কোনো সমুচিত রণনীতি নির্ধারণ করে উঠতে পারেননি। তাদের এই পরাজয়ের ফলে রাজস্থান, এমনকি দোয়াব ও দিল্লিতে মারাঠা আক্রমণের পথ সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যায়।

তিন বৎসর ব্যাপী অভিযানের ব্যর্থতা এবং মারাঠা ঝটিকা আক্রমণের ক্রমবর্ধমান ব্যাপ্তির ফলে দিল্লির দরবারে যুদ্ধ ও শান্তির এক জমায়েতের সৃষ্টি হল। যুদ্ধকামী দলের নেতৃত্বে ছিলেন অওয়াধের (অযোধ্যা) সাদাত খান এবং তার পক্ষে ওয়াজির কোয়ামারউদ্দিন খান স্বয়ং। আবার দাক্ষিণাত্যের নিজাম-উল-মুলকও সংঘাতের সমর্থক ছিলেন, যাঁর নীতি ছিল মারাঠাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া এবং যথাসম্ভব তাদের ক্ষমতাকে সীমিত রাখা। তিনি একথা বুঝেছিলেন যে মারাঠারা মালব অধিকার করতে পারলে তার সঙ্গে দিল্লির সব সম্পর্ক ছিন্ন হবে এবং তখন দাক্ষিণাত্যে তাকে একক শক্তিতে মারাঠাদের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। আবার শান্তিকামী গোষ্ঠীতে মির বশি খান-ই- দৌরান, জয় সিংহ এবং আরও কয়েকজন রাজপুত রাজা ছিলেন। জয় সিংহ-এর যুক্তি ছিল যুদ্ধের মাধ্যমে মারাঠাদের কার্যকরীভাবে নিবৃত্ত করা যাবে না। তিনি বলেন–”বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে অমি পেশোয়া কিংবা তার ভাইকে মহামান্য বাদশাহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি করাতে পারব। তাঁর দাবি যদি মেনে নেওয়া যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাদশাহের রাজত্বে আর কোনো অশান্তি হবে না। আবার যদি সাদাত-খান ও নিজাম একত্রিত হয়, তাহলে তারা এক নতুন বাদশাহের সৃষ্টি করবে।

এই যুদ্ধবন্দি দলকে অক্ষচ্যুত করতে পেশোয়া ১৭৩৪-৩৫ সালে একটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিলেন। তাঁর মাতা ঠাকুরানী উত্তর ভারতে তীর্থযাত্রায় রওনা হলেন এবং প্রত্যেক রাজার রাজধানীতে পদার্পণ করলেন এবং তার সহযাত্রী মারাঠা ওয়াকিল বা কূটনৈতিকরা এই সুযোগে তাদের অভিমত গ্রহণ করতে থাকলেন। জয় সিংহ এবং বুন্দেলখণ্ড বন্ধুভাবাপন্ন প্রতিপন্ন হলে উদয়পুরের মহারাজা ইতস্তত মনস্ক এবং অভয় সিংহ-এর মনোভাব অনিশ্চিত দেখা গেল। জয় সিংহ তার প্রাত্যহিক ৫০০০ মুদ্রার খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পেশোয়ারকে উত্তর ভারতে আমন্ত্রণ করলেন। মালব দেশের চৌথের দাবি পূরণের অঙ্গীকার করে তিনি বাদশাহের সঙ্গে বাজীরাও-এর পরিচয় করিয়ে দেবারও প্রতিশ্রুতি দিলেন, অবশ্য তার ব্যক্তিগত সুরক্ষার আশ্বাস দিয়েই। বাদশাহের সাক্ষাতে তাঁর অন্যান্য দাবিরও মীমাংসা করার অবকাশ থাকবে।

এরপর ১৭৩৫-৩৬ সালে শান্তি আলোচনা পর্ব, যখন উভয় পক্ষই সবরকমের শত্রুতা বন্ধ রেখেছিলেন এবং যার জন্য বাজীরাও স্বয়ং উত্তর ভারতে যাত্রা করেছিলেন। বাজীরাও মালব ও বুন্দেলখণ্ডের জন্য চৌথ, সব ক’টি কেল্লার নিয়ন্ত্রণসহ মালব ও গুজরাটের সুবাদারি নিজের এবং সর্দারদের জন্য মনসব এবং জায়গির ও সমগ্র দাক্ষিণাত্যের সরদেশপাণ্ডের পদের জন্য বংশানুক্রমিক অধিকার, (অর্থাৎ মোট রাজস্বের শতকরা ৫ ভাগ অংশ) দাবি করেছিলেন। এই দাবিগুলি মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও যে পেশোয়া নুতন দাবি পেশ করেন। যা বস্তুত পক্ষে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের অধিকার তার হাতে তুলে দেওয়ার সমতুল্য পেশোয়া খান্দেশ, ঔরঙ্গাবাদ এবং বিজাপুরে ৫০ লক্ষ টাকার জায়গির দাবি করেন। তিনি আরও দাবি করেন যে বাদশাহের শাহজাদাকে দাক্ষিণাত্যের জন্য রাজপ্রতিনিধি এবং তাকে অর্থাৎ বাজীরাওকে শাহজাদার উপপ্রধান পদে নিয়োগ করা হোক। সমস্ত প্রশাসনিক কাজকর্ম এই উপপ্রধান মাধ্যমেই সম্পন্ন করা হবে। এবং দাক্ষিণাত্যে অতিরিক্ত কোনো রাজস্বের উৎপাদন হলে তা উভয়ের মধ্যে আধাআধি ভাগ করে নেওয়া হবে।

এই মাত্রাতিরিক্ত দাবিগুলির উত্থাপনের প্রতিক্রিয়া হিসাবেই বাদশাহ এবার যুদ্ধপন্থী গোষ্ঠীর পক্ষ অবলম্বন করতে শুরু করলেন। এছাড়া এই সময়কালে নিজাম-উল-মুলক প্রতিদিনই বাদশাহকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে এবং মারাঠাদের বিরুদ্ধে সাহায্য প্রদান করবার জন্য উৎসাহিত করতেন। এছাড়া মালব ও গুজরাটকে মারাঠাদের হাত থেকে রক্ষা করার কোনো সুপ্ত বাসনাও সম্ভবত বাদশাহের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছিল। আবার একথাও সত্য যে–যে-কোনো বিষয়েই বাদশাহ দীর্ঘদীন স্থির সিদ্ধান্তে থাকতে পারতেন না।

বাজীরাও তাঁর দাবির উত্তরের অপেক্ষায় মালবে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করার পর এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে মহারাষ্ট্রের দিকে প্রত্যাবর্তন করলেন যে তিনি সামনের এক বৎসরের মধ্যেই তার সমস্ত দাবির স্বীকৃত আদায় করবেন, না হলে তার এই সমরাভিযান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত করবে।

মুঘল বাদশাহের স্থলে একজন হিন্দু বা মারাঠা সম্রাটকে প্রতিস্থাপন করার কথা ভাবা দূরে থাক, বাজীরাও খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন যাতে বাদশাহ বিরক্ত না হন, বা কোনোভাবে তার সম্মান হানি হয়। যদিও মারাঠারা প্রায়ই ‘হিন্দু-পদ-পাদশাহী’র কথা বলতেন, বাজীরাও কিন্ত জানতেন যে সিংহাসন থেকে তৈমুর বংশীয়দের। স্থানচ্যুত করে সেখানে তারা একজন মারাঠা বা একজন রাজপুতকেও প্রতিষ্ঠা করলে। সমগ্র ভারত ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাঁদের বিপক্ষে দাঁড়াবে। সুতরাং পেশোয়াদের নীতি এই ছিল যে তৈমুরীয়দের সিংহাসন রেখে এবং তাদের নামের সম্মান এবং গৌরবজ্যোতিকে ব্যবহার করে সমগ্র ভারতে মারাঠাদের কর্তৃত্ব বিস্তার করা।

মনে হয় বাজীরাওয়ের তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য ছিল সম্রাটের নিকট থেকে মালব এবং তার সন্নিহিত ভূখণ্ডের বিজয় লাভের স্বীকৃতি পাওয়া। এবং বাদশাহের অনুমোদন। নিয়ে সমগ্র দাক্ষিণাত্যে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া আরও বিবিধ কিছু দাবিও ছিল, যেগুলি ১৭৩৬ সালে পেশ করা হয়। তবে একটি উল্লেখযোগ্য দাবি ছিল যে পেশোয়ার ক্রমবর্ধমান ঋণের ভার লাঘব করার জন্য বাদশাহের নিকট থেকে একটি বৃহৎ অঙ্কের অর্থের অনুদানের অনুমোদন লাভ করা। অবশ্য যুদ্ধকামী গোষ্ঠীকে, পরাজিত অথবা সম্পূর্ণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলতে না পারলে এই সমস্ত উদ্দেশ্য সফল হওয়া সম্ভব ছিল না। এই সমস্ত লক্ষ্য সামনে রেখে ১৭৩৬ সালে দশেরার দিন পেশোয়া দাক্ষিণাত্য থেকে প্রস্থান করলেন। তিনি স্থির করে নিয়েছিলেন যে তিনি এবার দোয়াব আক্রমণ করে বাদশাহকে তাঁর অজেয় শক্তির পরিচয় দেবেন।

১৭৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পেশোয়া আগ্রায় পৌঁছান। দিল্লিতে। যুদ্ধমনস্ক গোষ্ঠী এক বিশাল আয়োজন সম্পন্ন করলেন। কোয়ামারউদ্দিন খান এবং খান-ই-দুরানের নেতৃত্বে দুটি সৈন্যদল প্রেরণ করা হল। সাদাত খান এবং অভয় সিংহ আগ্রাতে এদের সঙ্গে যোগ দেবেন এবং সকলের এই সম্মিলিত বাহিনী তখন। মারাঠাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হবে। ইতিমধ্যে এম. খান বাঙ্গাশ ১২,০০০ জন অশ্বারোহী নিয়ে ইতিমধ্যেই খান-ই দৌরানের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল।

যুদ্ধের সূত্রপাত পেশোয়ার পক্ষে ভালো হয়নি। হোলকার দোয়াব আক্রমণ করলে সাদাত খান তাকে প্রতিরোধ করেন এবং এই যুদ্ধে মারাঠাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুটি রাজকীয় বাহিনী আগ্রার দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং বাজীরাওকে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হতে হয়। তারপরে এক সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করে তিনি আগুয়ান মুঘল সৈন্যদলের পাশ কাটিয়ে চলে গিয়ে সহসা দিল্লিতে আবির্ভূত হন। তিনি বাদশাহের সম্মানহানি করতে চাননি। অথবা দিল্লিতে লুটপাট চালিয়ে তার সঙ্গে শত্রুতা করতেও চাননি। কিন্তু তাঁর ভ্রাতা চিমনাজীকে তিনি নিজে যেমন একটি পত্রে লিখেছেন তা হল ‘বাদশাহ যাতে সত্য কি এই জানতে পারেন, আমি তাই চেয়েছিলাম। আমি প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম যে আমি এখনও হিন্দুস্তানেই আছি। আমি তাকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে মারাঠারা দিল্লির তোরণে অবস্থান করছে…সাদা খান বাদশাহকে সংবাদ পাঠান যে বাজীরাও-এর সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। বাজীরাও নিজে চম্বল পেরিয়ে পলায়ন করেছেন সুতরাং তার দূতকে আর সম্মান না করে এখনি তাকে বরখাস্ত করা হোক। ধান্দো পত-কে তাই বিতাড়িত করা হয় এবং সে এখন আমার শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। আমি এখন রাজধানীতে লুণ্ঠন করার। পরিকল্পনা ত্যাগ করেছি। কেননা আমি জানি যে বাদশাহ এবং খান-ই-দুরান আমার দাবিগুলি মেনে নেবার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু মুঘল গোষ্ঠী এই বোঝাপড়ার নীতির বিরুদ্ধে। আমি চাইনি রাজধানীতে লুণ্ঠন কার্য চালিয়ে আমার বন্ধুদের এক সীমানায় । ঠেলে দিতে। তাই আমি সম্রাটকে আশ্বস্ত করে চিঠি দিয়েছি।’

এইভাবে বাজীরাও যুদ্ধগোষ্ঠীকে অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে সফল হলেন। বাদশাহ সাদাত খানের উপর অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন। হোলকারদের সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে তার অতিব্যস্ততার ফলেই দিল্লির উপর আক্রমণ ঘটেছে। কিন্তু তার সঙ্গে সন্ধি করার বিষয়ে বাজীরাও সম্রাটকে রাজি করতে পারেননি। তার আক্রমণের ফলে সকলেই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। বাদশাহ এখন কোনো শান্তি প্রস্তাব-এর পরিবর্তে নিজাম-উল-মুলকের যাবতীয় প্রস্তাব শুনতেই অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। তাই তাকে দরবারে আহ্বান করে একটি ফরমানও (আদেশপত্র) জারি করা হয়।

নিজাম-উল-মুলক উত্তর ভারতে মারাঠা ফৌজের অগ্রগতির বিষয়টি খুবই গভীরভাবে পরীক্ষা করে দেখছিলেন। তিনি মারাঠাদের সঙ্গে দিল্লির বাদশাহীর শক্তির একটি সামঞ্জস্য বিধান করতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং মাঝে মাঝে নিজেকে একটু বিশ্রাম। দেবার জন্য মুঘল সাম্রাজ্যের সম্পদ অধিকার করে মারাঠাদের এই বাহ্যাড়ম্বরকে দেখেও দেখতেন না। তবে নিজাম-উল-মুলক কখনও চাননি যে মারাঠারা উত্তর ভারতে প্রবল প্রতাপান্বিত হয়ে উঠুক। তিনি হয়তো আশাও করে রাখবেন যে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে তিনি নিজের কিছু সুবিধা নিতে পারবেন। বাদশাহী সৈন্যের সহায়তায় তিনি যদি মারাঠাদের পরাজিত করতে পারতেন, তাহলে তিনিও হয়ে উঠতেন নিঃসন্দেহে ভারতের প্রধান মধ্যস্থতাকারী।

সুতরাং মারাঠা এবং নিজাম-উল-মুলকের মধ্যকার সংগ্রাম ছিল উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের উভয় খণ্ডের উপরই আধিপত্য বিস্তারের সংগ্রাম। এই পরিস্থিতির সঙ্গে কি কি সমস্যা জড়িত ছিলেন সে বিষয়ে বাজীরাও সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন। তার পক্ষে এ ছিল মুখ্যত দাক্ষিণাত্যের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, উত্তর ভারতে আধিপত্য স্থাপন তার পক্ষে অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ১৭৩৬ সালে ভূপালের যুদ্ধের পূর্বাহ্নে তিনি চিমনাজীকে লেখেন, প্রতিটি মারাঠাই আমার সঙ্গে যোগদান করুন, এবং সকলে মিলে এক জোরালো ধাক্কা দিলেই আমরা সমগ্র দাক্ষিণাত্যের অধিপতি হয়ে। উঠব। নবাবের (নিজাম-উল-মুলক) ব্যবস্থা করতে পারলেই (অর্থাৎ পরাজিত করতে পারলেই) সমগ্র দাক্ষিণাত্য হবে বিপদমুক্ত।

নিজাম-উল-মুলক দিল্লি পৌঁছোবার পূর্বেই তাকে স্থায়ীভাবে আগ্রা এবং মালবের সুবেদার নিযুক্ত করা হয়, তবে তিনি মারাঠাদের ওই কল অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করবেন এই শর্তসাপেক্ষে। শোনা যায় যে মারাঠাদের বিরুদ্ধে এই সংঘর্ষে সাফল্যলাভ করলে তার বন্ধু এবং মনোনীত ব্যক্তিদের এলাহাবাদ, গুজরাট এবং আজমেরের কর্তৃত্ব প্রদান করা হবে, এই কথাও তাকে দেওয়া হয়েছিল। তাহলে একথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে অপ্রত্যাশিত কোনো কিছু না ঘটলে, বাদশাহকে এই দুই মুখ্য চরিত্রের কারুর-না-কারুর আধিপত্য স্বীকার করা থেকে মুক্তি পাওয়া আর সম্ভব ছিল না।

১৭৩৭-এর জুলাই মাসে নিজাম-উল-মুলক দিল্লি পৌঁছোলে তাকে এক রাজসিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আগস্ট মাসে তাকে যথাযথ ভাবে বাজীরাওয়ের স্থলে মালবের মুখ্য প্রশাসক বা রাজ্যপালের পদে অভিষিক্ত করা হয়, এবং বর্ষাকালের শেষে তিনি মালবের দিকে অগ্রসর হন এই মারাঠা ব্যাধিকে চিরস্থায়ীভাবে নিরাময় করার জন্য। নিজামের ৩০০০ সৈন্য ছাড়াও রাজস্থান ও বুন্দেলখণ্ডের প্রত্যেক শক্তিশালী প্রধান, অবশ্য ব্যক্তিগত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়েই, প্রত্যেকেই নিজামের সাহায্যার্থে একটি করে বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। পেশোয়াও ৮০,০০০ সৈন্য নিয়ে নিজামের বিপক্ষে দাঁড়ালেন। আবার নিজামও তার শক্তিবৃদ্ধির জন্য সাদাত খানের শিবির এবং দাক্ষিণাত্যের থেকে তার সাহায্যে যে সৈন্যদলের যোগদান করার কথা, তার প্রতীক্ষা করতে থাকেন। সফদরজঙ্গের প্রেরিত একটি সৈন্যদল অবশ্য ইতিমধ্যেই তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। মারাঠারা কিন্তু দাক্ষিণাত্য থেকে প্রেরিত এই সৈন্যদলের নিজামের সৈন্যদের সঙ্গে মিলিত হবার পথ বন্ধ করতে সক্ষম হন। নিজামের প্রচুর অস্ত্রসম্ভার ছিল কিন্তু তার সৈন্যদল ছিল ধীরগতি সম্পন্ন। তাই ক্ষিপ্রগতি এবং সংখ্যায় অনেক বেশি মারাঠা সৈন্যরা শীঘ্রই নিজামের বাহিনীকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধল এবং নিজাম ভূপালে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। আবার সেই পুরাতন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। আবার সেই শম্বুকগতির. মুঘল বাহিনী অতি ক্ষিপ্র এবং লঘু অস্ত্রবাহী মারাঠা। সৈন্যদলের সঙ্গে সংঘর্ষে ব্যর্থতা বরণ করল। তার রাজপুত সঙ্গীদের প্রতি সন্দেহের জ্বালা নিজামের যন্ত্রণাকে আরও বাড়িয়ে তুলল। যদিও এ সন্দেহ সম্পূর্ণ অমূলক ছিল। প্রকৃতপক্ষে সংগ্রামের সিংহভাগই রাজপুত বাহিনী বহন করেছিল। এরপরেই নিজামের শিবিরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে অবশ্য আরও অনেকের মতোই রাজপুত সেনারা। সেখান থেকে পলায়ন করে। একে নিজামের সৈন্যদল ছিল একেবারে শম্বুক গতির, তার উপর খাদ্যভাণ্ডারে ঘাটতির জন্যও তিনি আগুয়ান হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। অপরাগ ছিলেন। আবার মুঘলদের সঙ্গে ছিল শক্তিশালী ভারী গোলন্দাজ বাহিনী, তাই তাঁর শিবিরে ঝটিকা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত মারাঠাদের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। সুতরাং আলাপ-আলোচনা শুরু হল এবং প্রচুর দর-কষাকষির পর ১৭৩৯ সালে জানুয়ারি মাসে নিজাম-উল-মুলক সমস্ত জায়গির সহ সমগ্র মালব প্রদেশই পেশোয়ার হাতে তুলে দিতে সম্মত হলেন এবং এছাড়া যুদ্ধের ব্যয়ের দরুন পঞ্চাশ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করার অঙ্গীকারও করলেন। মারাঠারা হয়তো আরও বেশি চাইতে পারতেন, কিন্তু বাজীরাও চিমানজীকে লিখলেন, আমি দেখলাম যে নিজামের সঙ্গে ভারি গোলন্দাজ বাহিনী আছে এবং বুন্দেল ও রাজপুতেরাও শক্তিশালী সঙ্গী হিসাবে তার সঙ্গে রয়েছে। এমতাবস্থায় আমি তোমার পরামর্শ মেনে নিয়ে যে পরিমাণ সম্পদ আমি তার কাছ থেকে আদায় করতে পারতাম, তার থেকে অনেক স্বল্প মূল্যে আমি চুক্তিবদ্ধ হতে সম্মত হলাম।

সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা প্রতাপশালী সেনাপতির পরাজয়ের পর, সম্রাট মালব এবং বুন্দেলখণ্ড তার অধিকারচ্যুত হবার সত্যটি মেনে নেবেন, এবং যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে সেটিকে তার অনুমোদন দেবেন এইটিই সম্ভাব্য ছিল বললেও কম বলা হয়। বিশেষ করে যেহেতু জয় সিংহ এবং খান-ই দৌরান এইরকম একটি চুক্তির জন্য বহুদিন থেকে আবেদন করে আসছিলেন। এর পরে অবস্থা কি রূপ নিত তা বলা সম্ভব নয়। মালবকে ভিত্তি করে বাজীরাও গঙ্গানদীর অববাহিকায় প্রবেশ করতে পারতেন। অথবা তিনি দাক্ষিণাত্য সম্বন্ধে তার যে সমস্ত দাবি পূরণ হয়নি তার উপরে মনোনিবেশ করতে পারতেন। যথা সকল প্রদেশগুলির শাসনভার (নিজামও) তাঁকে হস্তান্তর সহ দাক্ষিণাত্যে সম্পূর্ণ একাধিপত্য অর্জন, তার এই আশা তখনও পূরণ হয়নি। মনে হচ্ছিল যে আগে হোক বা পরেই হোক, সমগ্র ভারতবর্ষই মারাঠাদের অধীনে আসবে, এই যেন ভাগ্যের বিধান।

নাদির শাহের আক্রমণের ফলে এই সম্ভাবনা ব্যাহত হল এবং ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। বেশিরভাগ ভারতীয় পর্যবেক্ষকের কাছেই নাদির শাহের আক্রমণ ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। কেননা উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গিরিপথগুলি এতদিন তারা মুঘলদের দ্বারা সুরক্ষিত দেখতেই অভ্যস্ত ছিলেন।

মারাঠাদের কাছে নাদির শাহর আক্রমণ যে-মাঠে তারা এতদিন খেলে এসেছেন। সেখানে একজন বহিরাগতর অপ্রীতিকর অনুপ্রবেশের সঙ্গে তুলনীয়। নাদির শাহ যদি ভারতে থেকে যাওয়া মনস্থ করতেন এবং চুঘতাইদের অপসারণ করে নিজের রাজবংশ স্থাপন করতেন। বস্তুত তিনি নিজেকে ভারতের সম্রাট ঘোষণা করার পর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বলে কথাবার্তায় শোনাও গিয়েছিল, তাহলে পরে তা মারাঠাদের উচ্চাশার উপর এক বিশাল আঘাত বলে গণ্য হত এবং নর্মদার পরপারে তাদের নূতন জয় করা জনপদগুলি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ত। সুতরাং এমতাবস্থায় এক নূতন চিন্তাধারা এক নূতন পদ্ধতি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল। শাহু বাজীরাওকে দ্রুত বাদশাহের সাহায্যে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। আমরা ঔরঙ্গজেবের কাছে সম্রাট কোনো অসুবিধায় পড়লে আমরা তার সাহায্যে অগ্রসর হবার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তারই সম্মান রক্ষার্থে আমাদের এখন বাদশার পাশে দাঁড়ান উচিত। পেশোয়ার সৈন্যদলের সঙ্গে রাজপুত ও বুন্দেলা রাজদের সেনানীদের ঐক্যবদ্ধ করে একটি যৌথ দায়িত্বের প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনাও আরম্ভ হয়। হাসির জঙ্গকেও পত্রলেখা হয়। কিন্তু মারাঠাদের সৈন্যদল তখন বেসিনের অবরোধে নিযুক্ত ছিল। রঘুজী ভোঁসলে তার নিজের প্রকল্পগুলি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, দাভাদেরা চাপা রাগের বশে সহযোগিতা স্থগিত করে রেখেছিল এবং এক বিরাট সৈন্যদল ব্যতিরেকে বাজীরাও অগ্রসর হতে চাননি।

পেশোয়ার সৈন্যরা বেসিনে ব্যস্ত থাকাকালীনই নাদির শাহ ইরানের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। যাবার সময় তিনি বাজীরাওকে মুঘল বাদশাহের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার আদেশ দিয়ে একটি ভীতিপ্রদ পত্রের মাধ্যমে নিজের মত ব্যক্ত করেন। আবার তার আজ্ঞা পালন না করলে ফিরে এসে তিনি বাজীরাওকে শাস্তি দেবার ভয়ও দেখাতে ভোলেননি। বাজীরাও এই পত্রের একটি কূটনৈতিক উত্তর পাঠিয়ে তার সঙ্গে ১০১ মোহরের নজর বা উপঢৌকনও পেশ করেন।

নাদির শাহের আক্রমণের ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত দুর্বলতা সারা বিশ্বের কাছে। প্রকট হয়ে পড়ে। এর বেশি কিছু নয়। মারাঠারা অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই এই দুর্বলতার বিষয়ে অবহিত ছিলেন। তবে নাদির শাহের আক্রমণের ফলে দেশের উপর বিদেশি আক্রমণের যে বিপদ তা মারাঠাদের সম্যক রূপে বোধগম্য হল। এর ফলে বাজীরাও এক চিত্তাকর্ষক প্রস্তাব সর্বসমক্ষে পেশ করলেন। এই প্রস্তাবের সারমর্ম হল এই যে। উচ্চ বা নীচ, সকল পর্যায়ের অভিজাতরা তাদের সৈন্যদলকে একত্রিত করে এক ধরনের একটি পরিষদ গঠন করবেন, যাতে করে তৈমুর-বংশীয় রাজারা তাদের দেশ শাসন ব্যবস্থা আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেন এবং সম্মিলিত ভাবে দেশের উপর বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। যেসব অভিজাতদের নিকট তিনি এই প্রস্তাবটা নিয়ে আলোচনা করেন এম. খান, বাঙ্গাশ তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।

বাজীরাও-এর এই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। কিন্তু এই সুদক্ষ পেশোয়া অন্তত আবছা ভাবেও একথা বুঝতে পেরেছিলেন যে উত্তর-পশ্চিম থেকে আগত কোনো বৈদেশিক আক্রমণকে প্রতিহত করতে হলে বাদশাহ, তার মন্ত্রীবর্গ এবং উত্তর ভারতের সব কয়টি অগ্রণী শক্তির সম্পূর্ণ সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। এবং এই আক্রমণ একটি সম্ভাব্য ঘটনা, যা যে-কোনো সময়েই ঘটতে পারে।

মালব ও বুন্দেলখণ্ডের বিচ্ছিন্নকরণের শেষ পর্যায়

নাদির শাহের আক্রমণের ফলে মুঘল দরবারে বিভিন্ন গোষ্ঠীর অবস্থান এবং তার প্রভাবে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এসেছিল। মারাঠা-বিরোধী গোষ্ঠীর স্তম্ভ সাদাত খানের মৃত্যু হয় এবং নিজাম-উল-মুলুক ও কোয়ামারউদ্দিন খান উভয়েই বাদশাহ মুহম্মদ শাহের চোখে অপযশ প্রাপ্তি ঘটে। নিজাম-উল-মুলক দরবার থেকে প্রস্থান করে মারাঠাদের সঙ্গে আবার একটি বোঝাপড়ায় আসেন। অপর পক্ষের সভাসদদের ভিতর খান-ই-দৌরানও নিহত হন। ফলত দরবারে পুরাতন অভিজাতদের মধ্যে জয় সিংহ সওয়াই সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী বিবেচিত ওঠেন। বাদশাহ অবশ্য মালব ও গুজরাট পুনরুদ্ধার করার আর-একবার শেষ চেষ্টা করেন এবং অকৃতকার্য হন। অবশেষে নুতন পেশোয়া বালাজী রাওয়ের পুনর্বার আক্রমণের ভয়ে ভীত হয়ে এবং জয় সিংহ-এর আগ্রহে ১৭৪১ সালে মারাঠাদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

শেষ পর্যন্ত যে শর্তে মারাঠাদের সঙ্গে মীমাংসায় পৌঁছানো গেল তা ছিল ১৭৩৬ ও ১৭৩৮ সালে পেশ করা বাজীরাও-এর দাবির অনুরূপ। মালবের অধিকার ত্যাগ করা হল ঠিকই, তবে সম্রাটের সম্মান রক্ষার্থে পেশোয়াকে সেই প্রদেশের নায়েব সুবাদারি, বা উচ্চ প্রধানের দায়িত্ব মাত্র দেওয়া হয় এবং একজন রাজপুত্র বা শাহজাদাকেই প্রদেশের প্রথাগতভাবে রাজ্যপাল পদে নিয়োগ করা হয়। পেশোয়াকে যে-যে অধিকার প্রদান করা হয় তার মধ্যে সব কটি ফৌজদারিই অন্তর্ভুক্ত ছিল। যার অর্থ সব ক’টি রাজ্য সহ সমগ্র প্রদেশের উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব। চম্বলের দক্ষিণে অবস্থিত। সমস্ত রাজ্যের উপর চৌথ আদায় করার দাবিটিও মনে হয় স্বীকার করে নেওয়া হয়। পেশোয়ারের দাবিমতো ৫০ লাখ টাকার নগদ অর্থের পরিবর্তে তাঁকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার চৌথের অধিকার দেওয়া হয়। সম্ভবত নিজাম-উল-মুলক এবং পেশোয়ার পারস্পরিক সুসম্পর্কের জন্যই দাক্ষিণাত্যের উপর কোনো চুক্তি হয়েছিল। বলে মনে হয় না। তিন কিস্তিতে পনেরো লক্ষ করে টাকা পেশোয়াকে দেবার কথা ছিল। প্রত্যুত্তরে পেশোয়া এই মর্মে একটি লিখিত অঙ্গীকারপত্র দেন (১) তিনি বাদশাহের দর্শনে আসবেন। (২) কোনো মারাঠা নর্মদা অতিক্রম করবেন না এবং যদি কেউ নর্মদা পেরিয়ে আসে, তাহলে তার সমস্ত কার্যের জন্য পেশোয়া নিজেই দায়ি থাকবেন। (৩) মালব ছাড়া আর অন্য কোনো প্রদেশে হস্তক্ষেপ করা হবে না। (৪) যা অর্থ প্রদান করা হয়ে গেছে, ভবিষ্যতে তার অতিরিক্ত আর কিছু দাবি করা হবে না। (৫) ৫০০ জন অশ্বারোহী সৈনিক সহ একজন মারাঠা সেনাপতিকে বাদশাহের সেবায় নিযুক্ত করতে হবে। এবং ৬) যখনই রাজকীয় বাহিনি কোনো অভিযানে নির্গত হবে, তখন পেশোয়া ৪০০০ জন সৈনিক নিয়ে বাদশাহের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেবেন। এর অতিরিক্ত কোনো সাহায্য প্রয়োজন হলে পরিমাণমতো তার মূল্য দেওয়া হবে।

এই সব শর্তগুলিকে মারাঠা ও মুঘলদের মধ্যে একটি কার্যকরী চুক্তি বলে মেনে। নেওয়া যেতে পারে। মারাঠাদের দাক্ষিণাত্যে মোটামুটি স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল, বিনিময়ে তারা বাদশাহের উত্তর ভারতের অঞ্চলগুলিতে উপদ্রব না করার এবং প্রয়োজনে, অর্থাৎ বহিঃশত্রুর আক্রমণের ক্ষেত্রে বাদশাহকে সাহায্য করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। এর পর থেকেই একজন মারাঠা প্রতিনিধি মহাদেব ভাট হিঙ্গানে, দিল্লির দরবারে নিযুক্ত হলেন। তাঁর বুলন্দশহর ও মিরাট অঞ্চলে জায়গির ছিল, এবং ক্রমে তিনি রাজকীয় কূটনীতিতে একজন প্রভাশালী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠলেন।

দোয়াব এবং পাঞ্জাবে মারাঠাদের অগ্রগতি–পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ

১৭৪১ থেকে ১৭৬১ সাল পর্যন্ত সময়কালকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। এর প্রথম পর্ব ছিল ১৭৪১ থেকে ১৭৫২ পর্যন্ত, যার শুরু হয় বাজীরাও-এর মৃত্যু এবং মুঘল সাম্রাজ্য থেকে মালব ও গুজরাটের বিচ্ছিন্নতা দিয়ে। আবার ১৭৫২ সালে মারাঠাদের দোয়াবে এবং আহম্মদ শাহ আবদালির পাঞ্জাবে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ভারতের রাজনীতির এক নূতন পট পরিবর্তন হয়। আবার ১৭৫২ থেকে ১৭৬১ অবধি যে সময়কাল তা ছিল উত্তর ভারতের আধিপত্য বিস্তারের জন্য মারাঠা শক্তি আবদালির সংঘর্ষের প্রস্তুতিপর্ব।

প্রথম পর্ব (১৭৪১-৫২)

১৭৪১-৫২ সময়বর্তী প্রথম পর্যায়ে মারাঠারা যাকে ‘সীমান্ত অঞ্চল’ বলা হয় সেই ভূখণ্ডে চৌথের উপর দাবি প্রতিষ্ঠা করার উপরেই মনোনিবেশ করে। সুতরাং রঘুজী ভোঁসলে ১৭৪১-৪২ সালে চৌথ সংগ্রহের জন্য বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। ১৭৪৩ সাল থেকে শাহু রঘুজীকে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যা রাজ্যগুলি বণ্টন করে দেওয়ার পর থেকেই মারাঠাদের এই ধরনের অভিযান একটা বাৎসরিক ঘটনা হয়ে উঠল। কিন্তু নবাব আলিবর্দী খানের দৃঢ় বিরোধিতার জন্য শেষ পর্যন্ত ১৭৫১ সালে একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়। এই চুক্তিতে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার মোট চৌথের পরিমাণ ১২,০০০ টাকায় হিসাব করে তার বিনিময়ে দক্ষিণ উড়িষ্যার কিছু অংশ রঘুজীকে প্রদান করা হয়। এছাড়া রঘুজী ভোঁসলেকে তার প্রদেশের মুখ্য প্রশাসনকে নির্বাচন করার অধিকারও দেওয়া হয়। সুতরাং এইভাবে বস্তুত উড়িষ্যা রাজ্যটি মারাঠাদের হাতে চলে যায়।

দাক্ষিণাত্যে কর্ণাটক এবং খান্দেশের অধিকারের জন্য মারাঠারা নিজাম (আসফ জাহ) এবং তার উত্তরসূরি নাসির জঙ্গের সঙ্গে সংঘর্ষে করে। রঘুজী ভোঁসলে কর্ণাটকের উপর আক্রমণ চালালেও বঙ্গদেশ এবং উড়িষ্যায় তার জড়িত থাকার কারণে নিজাম তখনকার মতো অন্তত কৰ্ণাটকে তার প্রাধান্য বজায় রাখতে পেরেছিলেন।

বুসি নামক এক ফরাসি রাজপুরুষ ১৭৪৮ সালে আসফ জাহর মৃত্যুর পর থেকেই হায়দরাবাদ রাজ্যে কর্তৃত্ব ফলিয়ে আসছিলেন। তাই এই বুসির সঙ্গে পেশোয়াদের প্রতিদ্বন্দিতা শেষপর্যন্ত যুদ্ধে পর্যবসিত হয়। এই যুদ্ধে কেউই জয়লাভ করেছিলেন বলা যায় না। কিন্তু বুসিকে খান্দেশের রাজস্বের অবশিষ্টাংশ, বেরারের পশ্চিম ভাগ। এবং বাগোনার ক্ষুদ্র প্রদেশটি মারাঠাদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করা হয়। এই ছিল ১৭৫১ সালে ভালকে চুক্তির মূল অংশ। এছাড়া তৃতীয় অঞ্চলটি মারাঠাদের লাভ হয়েছিল সেটির নাম রাজস্থান। বিভিন্ন রাজপুত রাজ্যগুলির উত্তরাধিকারের বিষয়ের দ্বন্দ্ব বিবাদ সহ সবরকম অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ফলে পেশোয়ার-সহকারী হোলকার এবং সিন্ধিয়া প্রায় সমস্ত প্রদেশকেই চৌথ দিতে বাধ্য করাতে সফল হলেন। আবার কখনো-কখনো তারা মারাঠাদের এই সব অভিযানের যাবতীয় খরচই (খানদানি) জোগাতে বাধ্য হত। এটি একটি লক্ষণীয় বিষয় যে আগে রাজপুতদের অভ্যন্তরীণ ঝগড়া বিবাদ কিন্তু মুঘল সম্রাটরাই সমাধান করে দিতেন। এই সব এলাকায় মারাঠাশক্তির প্রবেশ কিন্তু মুঘল সম্রাটদের ক্রমক্ষীয়মান ক্ষমতা ও সম্মানের পরিচায়ক।

রণকৌশলের দিক থেকে বিচার করলে রাজস্থানে মারাঠদের আত্মপ্রতিষ্ঠাকে কিন্তু ভবিষ্যতে আগ্রা, দিল্লি ও পাঞ্জাবকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টার প্রথম পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে সফল হতে গেলে রাজপুত রাজাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনই প্রয়োজন ছিল, তাদের থেকে চৌথ আদায়ের নয়। রাজস্থানকে মোটামুটি ভাবে একটি ঘাটতি অঞ্চল বলা যেতে পারে এবং এখানকার অনেক শাসকই রাজস্থানের বাইরে অবস্থিত তাদের বহু জায়গিরের থেকে প্রাপ্য আয়ের উপরে নির্ভরশীল ছিলেন। অনেক রাজপুত্র সর্দার এবং সৈন্য আবার মুঘল অভিজাতদের অধীনে চাকুরি করতেন। একদিকে মারাঠাদের অবিরাম চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ রাজপুত্রেরা ক্রমশ অসন্তুষ্ট এবং অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছিল। যার ফলে মাধো সিংহ-এর লোকজন এবং জয়পুরের নাগরিকরা মিলে ১৭৫১ সালে জয়পুরে প্রায় ৫০০০ মারাঠাকে হত্যা করে। যদুনাথ সরকারের ভাষায় এই ঘটনার প্রতিঘাত রাজধানীর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামীণ রাজপুতেরাও এবার উত্তেজিত হয়ে ধরতে পারলেই মারাঠাদের সংবাদবাহকদের হত্যা করতে শুরু করল।

রাজপুতদের ঘৃণার বিস্ফোরণ যে এই প্রথম ঘটল, তা নয়। এর পূর্বে মাড়োয়ার-এর অভয় সিংহ-এর পৌত্র ও উত্তরাধিকারী বিজয় সিংহ বিশ্বাসঘাতকের মতো জয়াপপা সিন্ধিয়াকে হত্যা করেছিল। এই ঘটনাগুলি রাজপুতদের প্রতি মারাঠাদের স্বার্থপর এবং ক্ষুদ্রমনস্কতার কুফল মাত্র, এবং যার জন্য পেশোয়া ও তার সহকারী সিন্ধিয়া এবং হোলকাররাই সম্পূর্ণভাবে দায়ি ছিলেন।

দ্বিতীয় পর্যায় (১৭৫২-৬১)

বালাজী রাও, অথবা লোকে যাঁকে নানাসাহেব পেশওয়া বলে ডাকত—একজন দয়াবান ও সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ ছিলেন। তিনি পুনাতে অনেক সুন্দর গৃহ নির্মাণ করেছিলেন এবং এই শহরটিকে কলাকৃষ্টির একটি কেন্দ্র বলে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। এ ছাড়া তার প্রভাবে অনেক ব্রাহ্মণ অধিকোষপতিও এই শহরে বসতিস্থাপন করেন। যে-যে অঞ্চলগুলি পেশোয়ার অধিকার সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে সেখানে তিনি একটি সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে সতর্ক দৃষ্টি দেন। প্রত্যেক জেলাতে কামভিসদারদের নিয়োগ করা হয়। যাদের কাজ ছিল কৃষির অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত সংবাদ পাঠানো। এই প্রতিবেদনগুলি মুঘলদের বিবরণের ধাঁচেই প্রস্তুত করা হত এবং এতে কৃষকের নাম, জমির পরিমাণ এবং কী কী শস্য উৎপাদন হয় তার বিবরণ, লাঙ্গল ও যণ্ডের সংখ্যা এবং গ্রামে কতগুলি পাতকুয়া আছে ইত্যাদি উল্লেখ করা হত। এতে প্রথমত কোনো জমির উপর রাজস্বের পরিমাণ স্থির করতে সুবিধা হত এবং দ্বিতীয়ত এর দ্বারা বিধ্বস্ত গ্রামগুলির পুনরুজ্জীবন এবং কৃষিকার্যের বিস্তারের মতো বিষয়গুলি অনেক উৎসাহ পেত। জমিদার এবং গ্রামের মোড়ল উভয়কেই ভূমি রাজস্ব আদায়ের কাজে লাগানো হত।

তবে এইসব সুষ্ঠু পদ্ধতির দ্বারা প্রকৃতপক্ষে রাজ্য এবং অর্থনীতির কতটা উপকার। হয়েছিল তা নিয়ে কিন্তু এখনও সন্দেহ আছে। বাজীরাও যে ঋণ অপরিশোধিত রেখে গিয়েছিলেন তার পরিমাণ ছিল সতেরো লক্ষ থেকে এক কোটি টাকার মতো। জি.এস. সরদেশাই একজন আধুনিক ঐতিহাসিক এর মূল্য পঞ্চাশ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করেছেন। এর মধ্যে পুনার অধিকোষপতিদের থেকে নেওয়া ঋণও ছিল যারা অনবরত এই ঋণ শোধের জন্য তাগাদার চাপে পেশোয়ার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এই জন্যই বাজীরাও ভূপালে যুদ্ধের পরে নিজাম-উল-মুলক-এর নিকট হতে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দাবি করেছিলেন। নিজাম এই অর্থ দিতে সম্মত হলেও নিজাম বা মুঘল সম্রাট, এই দুজনের মধ্যে কোনো একজন এই অর্থ প্রদান করেননি, যার ফলে এই টাকা পাওয়া। যায়নি। বস্তুত বালাজীর মতো একজন কুশল অর্থনীতিক-এর পক্ষেও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পরিণাম এবং বিধ্বস্ত শাসন ব্যবস্থার দ্বারা জর্জরিত এই দেশের সমস্যার সমাধান করা। সম্ভব হয়নি। তাছাড়া এই রাজ্যের স্বল্প মাত্রার উৎপাদকতা এবং উন্নয়নের পশ্চাদপদতাও এই সমস্যাকে জটিলতর করে তুলেছিল। এছাড়া তার স্ফীদের (বৃহৎ) সৈন্যদলের অভিযানের খরচও তাকে বহন করতে হয়েছিল। এর ফলে মারাঠা সৈন্যদল প্রায় একটি অর্থ-লোভী বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল, যাদের ভাড়া করে ব্যবহার করা যেত, নয়তো তারা সবসময়ই লুণ্ঠনের প্রচেষ্টায় ব্যস্ত থাকতে। এর ফলে মারাঠা শাসকদের পক্ষে কোনো দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে প্রকল্পের রচনা করা কঠিন হয়ে উঠে ছিল।

মনে হয় যে মারাঠা শাসন ব্যবস্থার এখন দূর দেশে আগ্রাসী যুদ্ধযাত্রার পরিবর্তে প্রয়োজন ছিল এক স্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টির করা। বাজীরাও-এর সময়ে সেই প্রতিনিধি যে ধরনের কর্মসূচি অনুসরণ করার কথা বলেছিলেন, আপাতদৃষ্টিতে সেই পথই অবলম্বন করে বালাজী রাও এখন তার প্রশাসন যন্ত্রকে সুবিন্যস্ত করার এবং দাক্ষিণাত্যে তাঁদের জয় করা অঞ্চলগুলি সুসন্নিবদ্ধ করার দিকে তার সমস্ত উদ্যম প্রয়োগ করলেন। ১৭৫৩ সাল থেকেই কর্ণাটককে হায়দরাবাদের অধিকার থেকে মুক্ত করার জন্য পেশোয়া প্রতিবৎসরই সেখানে অভিযান চালাতেন। ফরাসি পরামর্শদাতা বুসির প্রস্থানের সুযোগ নিয়ে পেশোয়া হায়দরাবাদ রাজ্য আক্রমণ করলেন এবং ১৭৬১ সালে উদগীরে হায়দরাবাদকে আহমেদনগর, দৌলতাবাদ, বুরহানপুর এবং বিজাপুর আদি চারটি উত্তরের জেলা, এবং ৬০ লক্ষ টাকা মূল্যের আরও কিছু অঞ্চল। সমর্পণ করতে বাধ্য করলেন।

বালাজী অবশ্য তাঁর স্থায়িত্ব সৃষ্টির প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ভারতের ক্ষেত্রে এক আগ্রাসী ও উদ্ধত নীতি অবলম্বন করেছিলেন। এটিই ছিল একটি রহস্য, কেন না সি. এস, সরদেশাই-এর মতে ‘নতুন পেশোয়া বালাজী রাওকে মানসিকতার নিরিখে বা পেশাগত ভাবে, কোনো দিক দিয়েই একজন লড়াকু সৈন্য বলা যায় না। তাই তিনি। তাঁর নিজের বিশ্বস্ত এবং অনুগত সহকারীদের হাতেই এই সব যুদ্ধ পরিচালনার ভার দিতেন।’ তবে এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা তো সহজবোধ্য। এ ছাড়া এই সমস্যা এই জন্য আরও জটিল হয়ে পড়ে যে নূতন পেশোয়া উত্তর ভারতের রাজনীতির সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতেন না। ১৭৪৭-৪৮ সালে তিনি চতুর্থ ও শেষ বারের মতো উত্তর ভারতে গিয়ে রাজস্থান যান এবং সেটিই ছিল আমৃত্যু তার সর্বশেষ উত্তর ভারতে গমন।

বালাজী রাওয়ের পক্ষে সম্ভবত এক সীমিত সময়ের জন্যও তাঁর উদ্ধত প্রসারণবাদী নীতিকে ত্যাগ করা সম্ভব ছিল না। কারণ রামোজী সিন্ধিয়া এবং মলহার রাড হোলকারের মতো উচ্চাশী এবং কর্মঠ সহকারীরা ছিলেন তার শক্তির উৎস এবং তাদের কর্মহীন অলস করে রাখলে তাতে পেশোয়ার নিজের আসনই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ত। অন্যভাবে বলতে গেলে, গুজরাট ও মালব জয়ের সঙ্গে সঙ্গে পেশোয়া এক ব্যাঘ্রের পিঠে বসতে শুরু করেছিলেন, যেখান থেকে নেমে আসা খুবই কঠিন।

১৭৪৮ সালে আহমদ শাহ আবদালির ভারত অভিযান এবং তারপরে নিয়মিতভাবে অনেকগুলি আক্রমণের ফলে উত্তর ভারতে এক নুতন রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। আবদালির লাহোর অধিকারের খবর পেয়েই শাহেনশাহ পেশোয়ার কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করেন। পেশোয়া এতে সম্মত হয়ে সিন্ধিয়া এবং হোলকারকে পুণা ছেড়ে সম্রাটের সাহায্যে এগিয়ে যেতে আদেশ দেন। বাজীরাও নাদির শাহের আক্রমণের সময় বৈদেশিক শত্রুর বিরুদ্ধে মুঘল ও মারাঠাদের যে। সংযুক্ত বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, বালাজী রাও-এর এই কার্য তারই অনুরূপ ছিল। কিন্তু মারাঠারা উত্তর ভারতে পৌঁছোবার আগেই আবদালির পরাজয় ঘটে। এর অল্পদিন পরেই জয়পুর ভ্রমণ করে বালাজী দিল্লিতে এসে সম্রাট মুহম্মদ শাহের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে মিলিত হন। এখন প্রশ্ন উঠে এল যে বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মারাঠারা মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংস করার তাদের ঘোষিত নীতি কী বর্জন করবে বা পরিবর্তন করবে? এই প্রশ্নটি হয়তো মারাঠাদের মনে উঠত না, কিন্তু আবদালির পৌনঃপুনিক আক্রমণ এইভাবে চিন্তা করতে তাদের বাধ্য করেছিল।

উত্তর ভারতে মারাঠাদের উচ্চাশার সম্ভবত শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসাবে ১৭৪৩ সালে রঘুজী ভোঁসলে এবং পেশোয়ার দাবির বিষয়ে শাহু যে মীমাংসা করেছিলেন তার কথা উল্লেখ করতে হয়। এই মীমাংসার ফলে বাংলা, বিহার (১৯ লক্ষ বাদ দিয়ে) এবং উড়িষ্যার চৌথ.ও সরদেশমুখীর স্বত্ব রঘুজী ভোঁসলেকে দেওয়া হয় এবং পেশোয়াকে মালব, আজমের, আগ্রা এবং এলাহাবাদের চৌথ এবং সরদেশমুখী ছাড়াও সেখানে অভিযান চালানোর অধিকার দেওয়া হয়। যদিও পেশোয়ার কোনো অঞ্চলের জন্যই প্রায় দশ বছর কোনো দাবি পেশ করেননি। এবং পাঞ্জাবের উপর আরও ছয় বৎসর পরে তার প্রথম দাবি জানান, কিন্তু শাহুর ‘পুরস্কার’-এর কথা তিনি ভুলে যাননি এবং পেশোয়ার রাজনৈতিক চিন্তাধারার উপর এর প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু বাজীরাও-এর সামরিক দক্ষতা না থাকায় তাকে নূতন অনভিজ্ঞ সেনানীদের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। এই সমর কুশলতার অভাব এবং মারাঠা সর্দারদের ভিতর চিরস্থায়ী অন্তর্কলহকে তদানীন্তন মারাঠা নীতির অনিশ্চয়তা এবং বিভ্রমের জন্য আংশিক ভাবে দায়ি করা যায়।

১৭৪৮ সালে সম্রাট মুহাম্মদ শাহর মৃত্যুর পর, নূতন বাদশাহ আহমদ শাহ আওধ এবং এলাহাবাদের প্রশাসক পদে সফদরজঙ্গকে নিয়োগ করেন। ওয়াজির হিসাবে সফদরজঙ্গের মনে হল যে তার সবথেকে বড়ো দুই জন ভিতরের শত্রুর সঙ্গে বোঝাপড়ার করার এ এক সুবর্ণ সুযোগ। এই দুই শত্রু হল যথাক্রমে শাহজানাবাদের এবং বেরিলির রুহেলা আফগান এবং ফারুখাবাদের বাঙ্গাশ, আফগান। রুহেলারা বাউন, পিলিভিট ইত্যাদি অঞ্চলে বহু নূতন এলাকা আত্মসাৎ করেছিল এবং বাঙ্গাশ আফগানরা তাদের অধিকার একদিকে কোড়া-জাহানাবাদ এবং অপরদিকে আলিগড় পর্যন্ত তাদের অধিকার বিস্তার করেছিল। এরপর এই সংঘাত একটি জটিল আকার ধারণ করল যখন সফদরজঙ্গ রুহেলাদের সঙ্গে পেরে না উঠে বাঙ্গাশদের আক্রমণ করলেন। এবং এখানেও আহমেদ শাহ বাঙ্গাশের কাছে তার তীক্ষ্ণ পরাজয় ঘটল। সফদরজঙ্গ এবার মারাঠাদের কাছে সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করলেন। সিন্ধিয়া এবং হোলকারের অধীনস্থ মারাঠারা অবিলম্বে সম্মতি জানালেন কেননা সফদরজঙ্গকে সাহায্য করলে তারা শুধু বাদশাহের সুনজরে পড়বেন তাই নয়, এছাড়া তারা। নিজেদের গঙ্গা ও যমুনার মধ্যেকার উর্বর অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। ওয়াজির তাদের কথা দিয়েছিল এই অঞ্চলে অবস্থানের জন্য প্রত্যেক দিন ২৫,০০০ টাকা করে দেবে। জাটরাজা সুরজমলকেও এই কার্যে নিযুক্ত করা হল।

আমেদ বাঙ্গাশকে মারাঠারা বিপুল ভাবে পরাজিত করল। কিন্তু শত্রুকে একেবারে ধ্বংস করে দেবার পূর্বে তারা বাদশাহের কাছ থেকে আহমদ শাহ আবদালির আর একটি নূতন অভিযানের বিরুদ্ধে যোগদান করার জন্য জরুরি ডাক পেলেন। এমতাবস্থায় রুহেলা ও বাঙ্গাশ আফগানদের সঙ্গে কোনোমতে একটি চুক্তি করা হল। মারাঠাদের যুদ্ধ অভিযানের সমস্ত ব্যয়ভার সফদরজঙ্গ আফগান নেতা আহমেদ বাঙ্গাশের উপর ন্যস্ত করলেন। মনে হয় যে তাদের দাবির ভিত্তিতে, মারাঠারা ফাপুন্দ, শিকোহাবাদ এবং এটাওয়ার পরগনাগুলি দখল করলেন। এগুলি অবশ্য মারাঠাদের নিযুক্ত প্রতিনিধিরাই দেখাশোনা করতে লাগলেন এবং মারাঠারাও নদীমাতৃক ভূখণ্ডে প্রশেবাধিকার অর্জন করলেন।

মনে হয় সফদরজঙ্গ এবার মারাঠাদের বিষয়ে এক উচ্চ ধারণা পোষণ করতে শুরু করলেন এবং তিনি এই মীমাংসায় পৌঁছোলেন যে একমাত্র মারাঠাদের সাহায্যেই আবদালিদের বিপদকে প্রতিহত করা যায়। তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ শত্রু, যথা রুহেলা এবং বাঙ্গাশ আফগানদের সঙ্গে আবদালির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানতেন। সম্ভবত এই জন্যই তিনি এই সময় মারাঠারা কিছু গগনচুম্বী দাবি ও অঙ্গীকারের বিষয় পেশ করলেও তিনি সেগুলি সহানুভূতির সঙ্গে শ্রবণ করেন। ১৭৫২ সালের ১২ই এপ্রিলে করা এক নথিতে চুক্তি হয়েছিল যে মারাঠাদের সম্রাটকে পাঠান, রাজপুত এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ শত্রুর হাত থেকে এবং আফগান রাজা আবদালির মতো বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করবেন, এবং তাদের এই সাহায্যের জন্য বাদশাহ তাদের ৫০ লক্ষ টাকা দেবেন; এছাড়া পেশোয়াদের আগ্রা এবং আজমেরের সুবেদারিও দেওয়া হবে। এই নথিতে আরও উল্লেখ করা ছিল যে পেশোয়াকে পাঞ্জাব, সিন্ধু এবং দুই নদীর মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলে চৌথ আদায় করার অধিকারও দেওয়া হবে। সম্ভবত এইগুলিই মারাঠাদের দাবি এবং প্রস্তাব ছিল। তবে সফদরজঙ্গ তার রাজত্বের মধ্যে দোয়াব অঞ্চলের জন্য চৌথ প্রদানে সম্মত হতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু এই দাবিগুলো মেটানোর প্রয়োজন হয়নি, কারণ সফরদজঙ্গ তার মারাঠা সাথীদের সঙ্গে দিল্লি পৌঁছোবার পূর্বেই বাদশাহ লাহোর এবং সিন্ধের সুবাহদারির জন্য আবদালির দাবি মেনে নিয়েছিলেন।

এইসব দাবি এবং প্রস্তাবগুলি থেকে মারাঠাদের উচ্চাশার পরিমাণ, আবার তাদের সহজাত পরস্পর বিরোধিতার নিদর্শনও পুনর্বার পাওয়া যায়। অযোধ্যার নবাব, জাটগণ আফগান এবং রাজপুতদের সম্মিলিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে তাকে অতিক্রম করে উঠতে না পারলে, মারাঠাদের পক্ষে কেবল আবদালির সঙ্গে যুদ্ধ করেই এসব সুদূরপ্রসারী দাবিগুলি পূরণ করা সম্ভব হত না। আবার যাদের নাম উল্লেখ করা হল আবদালির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে মারাঠাদের তাদেরই সাহায্য প্রয়োজন হত।

পেশোয়া ও তার সাথীরা এই সব জাজ্বল্যমান অন্তর্দ্বন্দ্বগুলির মীমাংসার জন্য কোনো চেষ্টা করেছিলেন বলে মনে হয় না। ১৭৫৩ সালে একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল, যখন বাদশাহ আহমেদ শাহের সঙ্গে ওয়াজির সফদরজঙ্গের কলহ বাঁধে এবং ফলত প্রায় গৃহযুদ্ধের অবস্থার সৃষ্টি হয়। পূর্বতন ওয়াজির কোয়ামারউদ্দিন শাহের ১৬ বৎসর বয়স্ক পুত্র গাজিউদ্দিন-উল-মুলক ওয়াজির সফদরজঙ্গের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। ওয়াজির এক জেদি শত্রু এবং আবদালির মিত্র নাজির খান রুহেলা তার সঙ্গে যোগ দেন। দুই পক্ষই মারাঠাদের সাহায্যপ্রার্থী হয়। তাঁকে ওয়াজিরের পদে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করলে ইমাদ-উল-মুলক পেশোয়াকে এক কোটি মুদ্রা এবং অওয়াধ ও এলাহাবাদের সুবার অধিকার দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। পেশোয়া হোলকারও সিন্ধিয়াকে ইমাদ-এর সাহায্যে পাঠান,কিন্তু তারা এসে পৌঁছোবার পূর্বেই সফদরজঙ্গ পরাজিত হন। তাকে ওয়াধ এবং এলাহাবাদের প্রশাসকের পদে কাজ করে যেতে বলা হয় এবং তিনি তার দায়িত্বে যাত্রা করেন। এক বৎসর পরে তার মৃত্যু হয় এবং ইমাদ-উল-মুলক একাধারে ওয়াজির ও নাজির মির বকশির পদ গ্রহণ করেন।

আমরা আজও জানি না, কোন যুক্তির বশে বালাজীরাও সফদরজঙ্গের মতো একজন পুরাতন বন্ধুকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে একজন অপরিণত কিশোরের পাশে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নেন, বিশেষ করে যখন কিশোর ইমাদ-উল-মুলক রুহেলা প্রধানের সাহায্যেই এই সংঘাতে অবতীর্ণ হন, যে রুহেলা প্রধানকে বিশ্বাস করা বা বন্ধুত্ব করা পেশোয়ারের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। সম্ভবত পেশোয়া ভেবেছিলেন যে একজন দুর্বল ওয়াজির ক্ষমতায় থাকলে দুই নদীর মধ্যবর্তী দোয়াব থেকে চৌথ আদায়ের মারাঠা উচ্চাশার পূরণ সহজতর হবে। এর ফলে মারাঠাদের প্রতি অওধের, নবাবের মনে এক গভীর সন্দেহের সৃষ্টি হয় যার জন্য মারাঠাদের পরে এক উচ্চ মূল্য দিতে হয়েছিল। এখানে বিশেষ মনোযোগের বিষয় হচ্ছে যে জাঠ রাজা সুরজমল, যিনি মারাঠাদের সঙ্গে একত্রে সফদরজঙ্গের পক্ষে থেকে আফগানদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি কিন্তু তার পুরাতন বন্ধুকে (অর্থাৎ সফদরজঙ্গ) পরিত্যাগ করেননি।

ওয়াজির ইমাদ-উল-মুলক-এর সঙ্গে মারাঠারা ১৭৫৩ থেকে ১৭৫৯ সাল পর্যন্ত জোটবদ্ধ ছিল। এই সময়কালেই উত্তর ভারতে মারাঠাদের শক্তি তার সর্বোচ্চ সীমায়। পৌঁছোয়, আবার এই সময়েই মারাঠারা তাদের সকল সম্ভাব্য বন্ধু ও সঙ্গীদের শত্রু ভাবাপন্ন করে তুলেছিল। এইভাবেই ১৭৬১ সালে পানিপথের রণক্ষেত্রে মারাঠাদের চরম ধ্বংসের পথ প্রস্তুত হচ্ছিল। এই ইতিহাসের এই পর্যায়ে ওয়াজির ইমাদ-উল-মুলক-এর দ্বারা পর পর দুজন বাদশা, ১৭৫৪ সালে আহমদ শাহ এবং ১৭৫৯ সালে দ্বিতীয় আলমগির নিহত হওয়ার পর মুঘল সম্রাটের সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। ইমাদের সঙ্গে তাদের জোটবদ্ধতার জন্য মারাঠাদেরও এই রকম কলঙ্কময় কার্যের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপবাদে নিন্দা ও কলঙ্ক সহ্য করতে হয়েছিল।

পেশোয়া এই সময়ে উত্তর ভারতে তিনটি বড়ো অভিযান সম্পন্ন করেন। তার ছোটো ভাই রঘুনাথ প্রথম দুটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৮ বৎসর বয়সি রঘুনাথ। ইতিপূর্বে কখনও উত্তর ভারতে আসেননি। তৃতীয়টির নেতা ছিলেন তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র সদাশিব ভাউ, এক খ্যাতনামা সেনাধ্যক্ষ ও প্রশাসক এবং উদগিরের বিজেতা। উত্তর ভারতে মারাঠাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট যে ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছিল। এবং যার জন্য সাধারণত রঘুনাথ রাওকেই দায়ি করা হত, তা ক্রমশ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছল যে পরবর্তীকালে ভাউ-এর পক্ষে যার সমাধান করা অসম্ভব পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তবে রঘুনাথ রাও এবং ভাও দু’জনকেই এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, যার কোনো সমাধান হয় না। তাদের বলা হয়েছিল পেশোওয়ার বিশাল ঋণভার সম্পূর্ণভাবে মেটাবার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে এবং সেই সঙ্গে আবদালির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য জোটসঙ্গী সংগ্রহ করতে–এর ফলে ১৭৫৩-৫৫ সালে তার প্রথম অভিযানেই রঘুনাথ রাও-এর প্রথম কাজই ছিল জাঠ রাজার নিকট থেকে ১ কোটি টাকার অর্থ দাবি করা এবং যে সমস্ত এলাকায় তিনি বলপূর্বক প্রবেশ করেছেন তা প্রত্যার্পণ করা। ইমাদ-উল-মুলক চালাকি করে ইতিমধ্যে পেশোয়াকে আগ্রা এবং আজমেরের সুবেদার করেছেন। চারমাস ধরে মারাঠারা শক্তিশালী কুম্ভের দুর্গ অবরোধ করে রাখলেও জোরালো অবরোধের কামান না থাকার জন্য শেষ পর্যন্ত তাদের মিটমাট করতেই হল। জাঠ রাজা তিন বৎসর সময়ের মধ্যে কিস্তিবদ্ধভাবে ৫০ লক্ষ টাকা দিতে রাজি হলেন বটে, কিন্তু সেই পরিমাণ অর্থ কখনো দেওয়া হয়নি, প্রতিবারই কিছু কিছু বাকি থেকে যেত। এ ছাড়া আর একমাত্র সমৃদ্ধ দোয়াব অঞ্চল থেকেই এই পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা যেত। তার অর্থই ছিল সফদরজঙ্গ এবং আফগানদের সঙ্গে যুদ্ধ। যেহেতু এরকম কোনো বড়ো যুদ্ধবিগ্রহ সম্ভব ছিল না, তাই রঘুনাথ রাও খালি মাঝে মাঝে দোয়াব-এ ছোটোখাটো হামলা করত, এই পর্যন্ত। তারপর তিনি রাজস্থানে সসৈন্যে প্রবেশ করলেন যা হোলকার এবং সিন্ধিয়ার অধিকারেই ছিল। সুতরাং এরপর রঘুনাথ রাও কোনো অর্থ বা কোনো ভূখণ্ড সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েই ফিরে এলেন।

১৭৫৬-৫৭ সালে রঘুনাথ রাও-এর অনুপস্থিতিতে আহমদ শাহ আবদালি দিল্লিকেই শুধু ছারখার করেননি, তার ধ্বংসকার্যকে মথুরা, গোকুল এবং বৃন্দাবন পর্যন্ত প্রসারিত করেছিলেন। মারাঠাদের অনুপস্থিতিতে ইমাদ-উল-মুলককে আবদালির সঙ্গে সন্ধি করতেই তিনি নাজিব-উদ-দৌল্লাকে তার মির বকশি এবং বস্তুত তার নিজস্ব প্রতিনিধি হিসাবে রেখে গেলেন। আবদালি একমাত্র জাঠরাজার থেকেই বাধা পেয়েছিলেন যিনি তার দিগ, ভরতপুর ইত্যাদির শক্তিশালী দুর্গের পিছনে সতর্ক প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন।

১৭৫৭ সালের প্রারম্ভে রঘুনাথ রাও উত্তর ভারতে ফিরে এলেও তিনি আবদালির প্রতিরোধকল্পে উত্তর ভারতস্থ শক্তিগুলিকে সম্মিলিত করার কোনো চেষ্টাই করেননি। অন্তত আবদালির বিপদের মোকাবিলা করা পর্যন্ত যদি পেশোয়া তার উত্তর ভারতের উচ্চাশী পরিকল্পনাগুলি ব্যাপক পরিবর্তন করতে পারতেন, বা অন্তত স্থগিত রাখতে। পারতেন তাহলে হয়তো এইপ্রকার জোট বাঁধা সম্ভব হত। প্রকৃতপক্ষে এই সময়েও পেশোয়ার নানাপ্রকার জমকালো, জাঁকজমকপূর্ণ পরিকল্পনা ছিল যা ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৯ সালে সিন্ধিয়ার কর্মকর্তা রামাজী অনন্তকে লেখা একটি পত্র থেকে বোঝা যায়। পেশোয়া এক কি দেড় কোটি টাকা আদায় করে তার সমস্ত ধার শোধ করার। জন্য বাংলা ও বিহার জয় করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এই অভিযানে অওয়াধের নবাব শুজা-উদ-দৌলাকে রাজকীয় ওয়াজিরের পদ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যোগ। দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। বিনিময়ে তাঁকে বেনারস ও এলাহাবাদের হস্তান্তর করা ছাড়াও ৫০ লক্ষ টাকা দিতে হত। নাজিব-উদ-দৌলা বিশ্বাসের যোগ্য ছিলেন না। সুতরাং তাকে ধ্বংস করা হত। আফগানদের বিরুদ্ধে শুজার সহায়তা নেবার কোনো উল্লেখ নেই।

একথা পরিষ্কার ভাবে বোধগম্য হয় যে মূল বিষয়টি কেবল বহিঃশত্রুর বা আহমদ শাহ আবদালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই নয়, প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল যে মারাঠাদের, বিশেষ করে পেশোয়ার উত্তর ভারতে প্রতিপত্তি স্থাপন। এইজন্যই না সুরজমল জাট, বা শুজা, কেউই মারাঠাদের সঙ্গে যোগ দিতে উৎসুক ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে দুই জনই আবদালির সঙ্গে আলোচনা করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মারাঠারা যদি দাক্ষিণাত্য, পরিত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা করে, তাহলে তিনিও ভারত ছেড়ে চলে যাবেন–এই মর্মে তাকে বোঝাবার চেষ্টা হয়েছিল।

অযোধ্যার নবাব কিংবা জাঠ রাজা সুরজমলের মনোভাবকে উপেক্ষা করে রঘুনাথ উত্তর ভারতে মারাঠা প্রাধান্য স্থাপনের চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। আহমদ শাহ আবদালির প্রস্থানের পর ১৭৫৭ সালের প্রারম্ভে দিল্লি পৌঁছে মারাঠারা ইমাদ-উল-দৌলাকে সরিয়ে দিয়ে বা রুহেলা প্রধান নাজিব-উদ-দৌলাকে ধ্বংস করার ঘটনাবলির মাধ্যমে শুজাউদ্দিনকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসার কোনো চেষ্টাই করেননি। আবদালির দ্বারা প্রস্তুত ও সজ্জিত এবং ইমাদ-উল-মুলক-এর দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত সৈন্যদলের আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য শুজাউদ্দিনকে তাঁরা সাহায্য করেন। তারা শুজাকে এলাহাবাদ প্রদেশ থেকে বঞ্চিত করার ইমাদ যে প্রচেষ্টা করেছিলেন, তাকে প্রতিহত করেন। কিন্তু যদি ইমাদ-উল-মুলক কুব্ধ হন, সেই ভয়ে তারা শুজার সঙ্গে কোনো জোট গঠন করতে পারেননি।

শুজার সঙ্গে বন্ধুত্ব না করে বা রুহেলাদের সঙ্গে বিবাদে না গিয়েই রঘুনাথ রাও পাঞ্জাবে প্রবেশ করেন। ইমাদ-উল-মুলকের আদেশক্রমে একজন নতুন মুঘল আধিকারিককে লাহোরের রাজ্যপাল নিয়োগ করা হয় কেননা পূর্বর্তন রাজ্যপাল মুইম-উল-মুলক পরলোকগমন করেছিলেন। আবদালির অনুপস্থিতে তার নিযুক্ত কর্মচারীদের সরিয়ে দেওয়া বিশেষ কঠিন কাজ ছিল না। যদিও মারাঠা সৈন্য আটোক অবধি অগ্রসর হয়েছিল, তাহলেও বোঝা গেল যে পাঞ্জাবে এক শক্তিশালী ও সুসংবদ্ধ এবং সুদক্ষ সেনাপতির দ্বারা পরিচালিত সৈন্যবাহিনী ছাড়া সিন্ধু নদীর জলরেখাকে আবদালির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। এই রকম একটি সেনাদলকেও আবার দোয়াব এবং দিল্লি থেকে সমর্থন পাবারও আবশ্যকতা আছে। এই সব প্রয়োজনীয় গুণাবলীর কোনোটিই উপস্থিত না থাকায় রঘুনাথ রাওয়ের হঠকারী পাঞ্জাব অভিযানের ব্যর্থতা নিশ্চিত ছিল। পাঞ্জাবের অভ্যন্তরে বেশ কিছুদূর অগ্রসর হবার পর রুহেলা নেতা নাজিব-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে অভিযান করে মারাঠা বাহিনীর পশ্চাদভাগকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা বোঝা গেল। যাই হোক, অওধের নবাবের সঙ্গে মিলিত হয়ে এইভাবে বাহিনীর পশ্চাদভাগের সুরক্ষা বিধানের কোনো চেষ্টাই করা হয়নি, যদিও অওধ নবাবের সঙ্গে রুহেলাদের বংশানুক্রমিক শত্রুতা বর্তমান ছিল। এর ফলে মারাঠা নেতা ওজী সিন্ধিয়া নবাবের কাছ থেকে কোনো সাহায্যই পায়নি। আসলে ১৭৫৯ সালে মারাঠারা তাকে শুকরাতালে অবরুদ্ধ করলে শুজা তার সমর্থনে এগিয়ে আসেন। তার বিশ্বাস ছিল রুহেলারা যদি ধ্বংস হয়, তাহলে তার পরেই অযোধ্যার পালা আসবে।

এমতাবস্থায় সদাশিব ভাইয়ের পক্ষে আবদালির সঙ্গে আসন্ন যুদ্ধে অযোধ্যার নবাবকে স্বপক্ষে নিয়ে আসা বা এমনকি অন্তত তাকে নিরপেক্ষ রাখাও অত্যন্ত কঠিন। হয়ে উঠল। মারাঠা প্রতিনিধি গোবিন্দ বল্লালের এটাওয়ার নিকটে অসময়ের বৃষ্টির জন্য নৌকা সংগ্রহ করার ব্যর্থতার বিষয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। এই নৌকা না থাকার জন্য মারাঠারা দুই নদীর মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলে প্রবেশ করে অযোধ্যার নবাবকে শুজার উপর চাপ দিয়ে তাকে তার সঙ্গে যোগ দেবার বা নিরপেক্ষ থাকার জন্য সম্মত করার চেষ্টা করা সম্ভব হয়নি। অনেকদিন থেকেই শুজার সঙ্গে মারাঠাদের এবং শুজার সঙ্গে নাজির-উদ-দৌলার সমর্থনে আবদালির কথাবার্তা চলছিল। মারাঠারা। তাদের বংশগত শত্ৰু সফদরজঙ্গের সঙ্গে মারাঠাদের মৈত্রীর বিষয়ে বারবার জোর দিয়েছিলেন। তারা উজির পদপ্রাপ্তির জন্য শুজার দাবি মেনে নিতে এবং ইমাদের শত্রু আলি গৌহারকে দিল্লির সিংহাসনে বসাতেও ইচ্ছুক ছিলেন। নাজিব-উদ-দৌলার মাধ্যমে আবদালিও শুজাকে উজিরের পদ প্রদান করতে এবং আলি গৌহারকে দিল্লির বাদশাহ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি ধূর্ততার সঙ্গে একথাও যোগ করেন যে। মারাঠাদের নীতি, যা অবশ্য একজন সাধারণ ব্যক্তির নিকটও সহজবোধ্য ছিল, আসলে সমগ্র হিন্দুস্থানকেই দাসত্বে পরিণত করার এক কৌশল। আবদালি এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িক যুক্তিও উত্থাপন করেন।

শুজার আবদালির সঙ্গে যোগদান কিন্তু তারপক্ষে একটি কূটনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সহায়তাও ছিল। আমরা আগেই দেখিয়েছি যে কেমন করে গত ছয় বছরে তাদের বিচারবুদ্ধির ভুলের জন্য মারাঠারা শুজা ও নাজিব-উদ-দৌলার মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী পার্থক্যকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়।

অবশ্য যদি শূজা নিরপেক্ষও থাকতেন, তাহলেও ভাউয়ের পক্ষে আবদালির উপর প্রাধান্য বিস্তার করা সম্ভব হত না, কারণ তাঁর উপর ভারী গোলন্দাজ বাহিনী এবং সহগামী-স্ত্রীলোকদের বোঝাও বর্তমান ছিল। এখানে তার পক্ষে হোলকারের প্রস্তাব মেনে নেওয়া সমীচীন ছিল যে তিনি যেন চম্বল অতিক্রম না করে গোয়ালিয়র ঢোলপুর অঞ্চলকেই তার প্রধান কেন্দ্ররূপে ব্যবহার করেন। অথবা তিনি জাট রাজা সুরজমলের পরামর্শ নিতে পারতেন যে তিনি যেন তার কামান ইত্যাদি ভারি সরঞ্জাম এবং মহিলাদের ও শিশুদের জাঠ রাজার তত্ত্বাবধানে রেখে গিয়ে দ্রুত গতি নিয়ে আবদালির সম্মুখীন হন। কেননা এই দ্রুত সঞ্চরণশীলতাই ছিল বরাবর মারাঠাদের প্রধান অস্ত্র। এতে অবশ্য উত্তর ভারত থেকে অর্থসংগ্রহ করে তার এক কোটি টাকার বিশাল ঋণ ভার লাঘব করার পেশোয়ার দ্বিতীয় ইচ্ছাও ব্যাহত হত না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভাউ কেবল ১৭৬০ সালের জুলাই মাসে দিল্লি অবধি অগ্রসর হলেন তাই নয়, তিনি ইমাম-উল-মুলককে উজির হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠাও করলেন, যার ফলে সুরজমল তার সঙ্গ পরিত্যাগ করলেন। তারপর আরও এগিয়ে গিয়ে ১৭৬০ সালের নভেম্বর মাসে তিনি পানিপথে পরিখা খুঁড়ে নিজের শিবির প্রতিষ্ঠা করলেন এবং এর ফলে দোয়াবে তার পার্শ্বভাগ আবদালির দিকে উন্মুখ রইল।

১৪ জানুয়ারি ১৭৬১-তে পানিপথে মারাঠাদের পরাজয়ের ফলে তাদের যুদ্ধপ্রযুক্তির অনেক দুর্বলতা প্রকাশ পেল এবং নতুন পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের মানিয়ে চলার ব্যর্থতাও দৃশ্যমান হল। দ্রুত চরণশীল মারাঠা যুদ্ধপদ্ধতি ধীরে ধীরে বহুভারাক্রান্ত মুঘল ধারায় পরিবর্তিত হচ্ছিল যেখানে সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং মহিলারা শিবিরের সঙ্গে যাত্রা করতেন। মুঘল শিবির কিন্তু একটি দ্রুত চলমান গোলন্দাজ বাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। যাকে বলা হত ‘ঘোড়সওয়ার গোলন্দাজ’। এই গোলন্দাজ বাহিনী এবং বুসির শৃঙ্খলাপরায়ণ সৈন্যদের দেখে পেশোয়া বালাজী রাও এত প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তিনি ইব্রাহিম গর্দির অধীনে এই রকম একটি বাহিনী নিয়োগ করেছিলেন। পেশোয়াদের আমলে গোলন্দাজীর তো উন্নতি হয়েছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু আমরা জানি না, যে উট ইত্যাদি বাহিত চলমান গোলন্দাজ বাহিনী কতটা ব্যবহৃত হয়েছিল। মনে হয় যে মারাঠা সৈন্যরা তরোয়াল এবং বর্শার উপরই তখনও নির্ভর করত। যেখানে আফগানরা ক্রমশ চকমকি জ্বালানো বন্দুকের ব্যবহারের পদ্ধতি অবলম্বন করছিল, যে বন্দুক দ্রুত গুলি ছুঁড়তে সক্ষম। ইব্রাহিম গর্দির যে গোলন্দাজ বাহিনী পানিপথে নিয়োজিত হয়েছিল, তা ছিল মূলত একটি নিশ্চল বাহিনী এবং বন্দুকধারী অশ্বারোহী সৈন্যদলের দ্বারা সুরক্ষিত–না হলে এর কোনো মূল্যই ছিল না। অন্যদিকে আহমদ শাহ আবদালির উষ্ট্ৰচালিত গোলন্দাজ বাহিনী ছিল অতি চলমান এবং অবস্থা অনুসারে যেখানে প্রয়োজন সেখানেই এই সব কামানকে নিয়ে যাওয়া। সম্ভব ছিল। শোনা যায় যে তার উষ্ট্রবাহিত ২০০০টি চতুরপাল বা ছোটো আকারের ঘূর্ণায়মান কামান ছিল। এছাড়া মারাঠাদের অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ার অভাব তাদের দুর্বলতার একটি কারণ ছিল।

পানিপথে মারাঠাদের পরাজয়ের অর্থ ছিল উত্তর ভারতে পেশোয়ার প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টার অবসান। তার ব্যর্থতার ফলে অন্যান্য মারাঠা সর্দাররা, যথা গায়কোয়াড়, ভোঁসলে, হোলকার, সিন্ধিয়া ইত্যাদিরা তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক রাজত্ব স্থাপন কার্যে স্বাধীনভাবে উদ্যোগী হয়ে পড়ল। এর মধ্যে কোনো কোনো রাষ্ট্র আয়তন ও ক্ষমতায় যথেষ্ট সম্পন্ন হয়ে উঠল। শুধু পেশোয়া নয়, পরন্তু মারাঠা নেতা মাহাদজী সিন্ধিয়া (আলি গৌহর) বাদশাহ বা ২য় শাহ আলমকে ১৭৭২ সালে রক্ষী সহচর হিসাবে দিল্লিতে সঙ্গে করে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।

সুতবাং পানিপথের যুদ্ধকে আবার কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে আঞ্চলিক শাসন ব্যবস্থার সংঘাতও বলা যায়। কিন্তু ১৭৬১ সালে যখন পেশোয়ার সর্বাধিপতি এবং কেন্দ্রীভূত শাসনের প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম পানিপথে অকৃতকার্য হয়, তখন কিন্তু মারাঠা সর্দাররা বা আঞ্চলিক শাসনের পক্ষপাতী মুঘল অভিজাতরা, কেউই কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পরাজয়ের চরম সুফল লাভ করতে পারেনি। এর প্রকৃত সুবিধালোভী ছিল ইংরাজরা যারা এক নুতন ধরনের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল, যার নাম ঔপনিবেশিকতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *