১৬. অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে উত্তর ভারত

ষষ্ঠদশ অধ্যায় – অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে উত্তর ভারত

১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর অভিজাতদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দলাদলি এবং মুঘল বাদশাহ এবং রাজকীয় কেন্দ্রের ক্ষমতার এবং সম্মানের দ্রুত অবনতি ছাড়াও জায়গিরদার সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠল। এছাড়া আঞ্চলিক রাজ্যগুলি, যথা সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রদেশসমূহ অথবা যারা মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়েও মুঘল বাদশাহের প্রতি নামমাত্র আনুগত্য প্রদর্শন করতে প্রস্তুত ছিল, তাদের উত্থান শুরু হল। মারাঠারা মহারাষ্ট্র থেকে ঝড়ের মতো বাইরে এসে অনেকগুলি আঞ্চলিক রাজ্য স্থাপন করে দেশব্যাপী কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা করে যার সমাপ্তি হয় ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে। নাদির শাহ এবং আহমেদ শাহ আবদালির আক্রমণের ফলে বিদেশি আক্রমণকারীদের নিকট উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত উন্মুক্ত হয়ে যায়। ১৭৪৮ সালে মুহম্মদ শাহর মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য ক্ষুদ্র হয়ে পূর্বেকার ছায়ায় পরিণত হল। যদিও সম্রাটকে তখনও লোকদেখানো আনুগত্য প্রদর্শিত হতে থাকল।

বাহাদুর শাহ প্রথম এবং ওয়াজির পদের জন্য লড়াই (১৭০৭-১২)

দাক্ষিণাত্যের আহমদনগরে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হল, যা অবধারিতই ছিল। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মুয়াজ্জম–যাঁর উপাধি ছিল শাহ আলম এবং তার ছোটো ভাই রাজকুমার আজম। বৃদ্ধবয়সে ঔরঙ্গজেবের প্রিয়পাত্র হওয়া সত্ত্বেও সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা কাম বকশ রাজসিংহাসনে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। দক্ষিণী রাজ্যগুলির সঙ্গে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ১৬৮৭ সালে শাহ আলমকে বন্দি করে আবার ১৬৯৫ সালে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার নামে প্রকৃতপক্ষে নির্বাসিত করা হয়। কেননা তাকে পেশাওয়ারের নিকটবর্তী সুদূর জামরুদে কাবুলের শাসক হিসাবে নির্বাসিত করে বিদ্রোহী কুমার আকবরের গতিবিধির উপর নজর রাখতে বলা হয়। আকবর পারস্যের সম্রাটের দরবারে আশ্রয় নেন এবং ফলে সিংহাসনের স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী হিসাবে শাহজাদা আজমের পথ প্রশস্ত হয়। আসন্ন সংঘাতের জন্য প্রস্তুতিকল্পে আজম কয়েকজন নেতৃস্থানীয় অজ্ঞাতদের নিজের পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ব্যবহারে ছিলেন উদ্ধত, মাথা গরম এবং হঠকারী। শাহ আলম তাঁর বিশেষ ঘৃণার পাত্র ছিলেন, যাঁকে তিনি অশ্রদ্ধায় হাক্কাল অথবা দানার ব্যবসায়ী বলে সম্বোধন করতেন। পক্ষান্তরে তার নম্র আচরণ এবং অনুজ্জ্বল ব্যবহার সত্ত্বেও শাহ আলম অনবরত কুচকাওয়াজ করিয়ে তার সৈন্যদের সুশৃঙ্খল করে তুলেছিলেন এবং তাঁর প্রধান সহকারী বা আপ্ত-সহায়ক মুনিম খানের। সাহায্যে কিছু নৌকা ইত্যাদিও সংগ্রহ করেছিলেন। যাতে করে প্রয়োজন পড়লে দ্রুতগতিতে নদী পার হয়ে আগ্রায় পৌঁছাতে পারেন। তার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে রাখা কাবুল ও লাহোর ছাড়া শাহ আলমের এক পুত্র বঙ্গদেশের ও অপর পুত্র মুলতানের প্রশাসক ছিলেন। তাহলে শাহ আলমের হাতে যথেষ্ট উপকরণ ছিল এবং তার পক্ষে যেখানে শাজাহানের সঞ্চিত সম্পদ রাখা ছিল–সেই আগ্রার পথ সুদূর দাক্ষিণাত্য-বাসী রাজকুমার আজাদের থেকে ছিল অনেক হ্রস্বতর এবং আগ্রায় পৌঁছানো ছিল সহজতর।

এর অর্থ এই যে, সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অভিজাতদের দাক্ষিণাত্যের প্রবীণদের এবং রাজকীয় গোলন্দাজ বাহিনীর যে সমর্থন শাহাজাদা আজম দাবি করতেন তা বাস্তবের তুলনায় অধিক আপাত বা কল্পিত ছিল। এছাড়া তিনি অর্থাভাবেও বিব্রত ছিলেন। তার বহু সৈন্য প্রায় তিন বৎসরকাল বেতন পায়নি। তাই তার নিকট কেউ অর্থ দাবি করলে তিনি রূঢ়ভাবে তার উত্তর দিতেন। মহম্মদ আমির খান চিব এবং গাজিউদ্দিন খান ব্যক্তিগত কারণে গৃহযুদ্ধের সময়ে তার সঙ্গে আগ্রা যেতে অসম্মত হন।

গোয়ালিয়রে পৌঁছে আজম জানতে পারলেন যে শাহ আলম ইতিমধ্যেই আগ্রা দখল করে নিয়েছেন। আজম দ্রুতগতিতে ভ্রমণ করার জন্য বেশিরভাগ কামান গোলা দাক্ষিণাত্যে রেখে এসেছিলেন। তার থেকে বৃহত্তর এবং শ্রেষ্ঠতর সৈন্যদলের মুখোমুখি হয়ে আজম ১৭০৭ সালের জুন মাসে শাহ আলমের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করেছিলেন তা ছিল এক ধরনের জুয়া, যাতে তার হার হয়।

আগ্রার সিংহাসনে আরোহণ করার স্বল্পদিন পরেই বাহাদুর শাহ রাজস্থান হয়ে ৩০, ০০০ সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে দক্ষিণাত্যের দিকে যাত্রা করেন এবং ১৭০৯ সালের জানুয়ারি মাসে সহজেই হায়দরাবাদের নিকট কাম বখশকে পরাজিত করেন। তারপর তিনি আবার উত্তর ভারতে ফিরে এসে ১৭১২ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত পরবর্তী দেড় বৎসর কাল বান্দা বাহাদুরের নেতৃত্বে শিখদের বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকেন।

বাহাদুর শাহর পাঁচ বৎসর ব্যাপী সংক্ষিপ্ত রাজ্যকালে রাজত্ব একতাবদ্ধ থাকলেও অভিজাতদের মধ্যেকার দলাদলি এক নূতন উচ্চতায় পৌঁছায়। কিছুটা এই অভ্যন্তরীণ দলাদলির জন্য এবং কিছুটা বাহাদুর শাহের একটি স্বচ্ছ নীতি নির্ধারণের অসফলতার জন্য দেশে ক্ষমতার অনেকগুলি কেন্দ্র স্থাপিত হয় এবং তাতে করে ধীরে ধীরে রাজকীয় কর্তৃত্বও দুর্বল হয়ে পড়ে।

দলাদলি

তার রাজত্বের প্রারম্ভেই বাহাদুর শাহকে দুটি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। প্রথমটি ছিল ঔরঙ্গজেবের নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কিছু রাজনৈতিক এবং ধর্ম-সম্বন্ধীয় সমস্যা এবং দ্বিতীটি হচ্ছে অভিজাতদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দলাদলি। ঔরঙ্গজেবের শেষ কয়েক বৎসরে যাতে কিছু নূতন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছিল।

ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষ কয়েক বৎসরে অভিজাতদের দুটি দল সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রথম গোষ্ঠীটির প্রধানের নাম ছিল আসাদ খান। আসাদ খান ইরানের এক খ্যাতনামা বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামহ জুলফিকার খান শাহ আব্বাস (১)-এর শাসনকালে শিরওয়ানের প্রশাসক ছিলেন। জুলফিকার খানের মৃত্যুদণ্ডের পর ১৬০০-০১ সালে তার পরিবার ভারতে চলে আসে এবং ধীরে ধীরে পদোন্নতি লাভ করে। শাহজাহান এবং পরে ঔরঙ্গজেবের প্রিয়পাত্র আজম খান নূরজাহানের ভ্রাতা আসফ খানের কন্যাকে ১৬৯৯ সালে ৪৬ বৎসর বয়সে বিবাহ করেন। ওয়াজির বা মন্ত্রী জাফর খানের মৃত্যুর পর তাঁকে নায়েব ওয়াজির বা উপপ্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করা হয়। তখন কেউ ওয়াজির না থাকলেও ১৬৭৬ সালে তাঁকেই ওয়াজির বা মন্ত্রী করা হয়। যদিও এই নিয়োগ তার থেকে দীর্ঘতর কাল কর্মরত অনেকের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। আজাদ খান ১৭০৭ সাল পর্যন্ত উজিরের দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘতর কাল কর্মরত ওয়াজিরদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। আমরা

শুনেছি যে ঔরঙ্গজেব তাঁর কর্মক্ষমতা এবং যোগ্যতা সম্বন্ধে সুউচ্চ মত পোষণ করতেন যদিও ঔরঙ্গজেবের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সম্বন্ধে আমরা সুনিশ্চিত নই। তিনি প্রশাসনিক দক্ষতার সঙ্গে সামরিক কৌশলের সম্মিলন করে তার দায়িত্ব পালন করতেন। বিশাল সৈন্যদলের অধিনায়ক পদে তিনি অনেক পর্ব সম্পন্ন করেন। ১৬৮৭ সাল থেকে তিনি ৭০০০/৭০০০-এর সম্মানপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

আসাদ খানের পুত্র জুলফিকার, বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের মাতুল শায়েস্তা খানের কন্যা আমিরুল উমারাকে বিবাহ করেন। মাত্র এগারো বৎসর বয়সে ১৬৬০ সালে নিজের প্রথম মনসবটি পাওয়ার পর তিনি ধীরে ধীরে অগ্রসর হন তারপর ১৬৮৯ সালে যেখানে শম্ভাজীর পরিবার ও ধনসম্পদ রক্ষিত ছিল সেই রাজগড় দুর্গটি অধিকার করে নিজ কীর্তি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে তাকে জিনজি অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া হয়, যে জিনজিতে রাজারাম পলায়ন করেন এবং ১৭০২ সালে তাঁকে মির বকশি উপাধিতে ভূষিত করা হয়। একটি পরিবারের উপরই মির বকশি এবং ওয়াজিরের মতো দুইটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করা এক অস্বাভাবিক ব্যবস্থা এবং এর ব্যাখ্যা প্রয়োজন। নিজের ছেলেদের সম্বন্ধে ঔরঙ্গজেবের ধারণা ছিল মন্দভাবাপন্ন। তিনিই প্রায়ই তাদের ভুলভ্রান্তির জন্য তাদের তিরস্কার করতেন। তাই তিনি আজমকে লেখা একটি চিঠিতে তাকে তার প্রজাদের পছন্দের পক্ষে অতি তিক্ত (পড়ুন, লবণাক্ত) এবং শাহ আলমকে বর্ণহীন ফ্যাকাশে (অর্থাৎ, লবণহীন) বলে বর্ণনা। করেছেন। সম্ভবত ঔরঙ্গজেব আশা করেছিলেন যে তার যে পুত্রই সিংহাসনে আরোহণ করুক না কেন তাকে আসাদ খান ও জুলফিকার খানই পরামর্শ দেবেন এবং সেই পুত্রও এদের উপরেই নির্ভর করবেন। তাই তার শেষ ইচ্ছাপত্রে লিখে যান যে। তার যে পুত্রই সিংহাসনে বসুন না কেন তিনি যেন অবশ্যই আসাদ খানকে তার ওয়াজির রাখেন। তবে এইভাবে সম্রাট ও মন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার চিন্তার মধ্যে অবশ্যই বিপদ নিহিত ছিল। তবে এটি ছিল এক নতুন পদক্ষেপ। যা। হয়তো অন্য কোনো সময়ে কার্যকরী হতে পারত। ঔরঙ্গজেব নিজেই একাধিকবার আসাদ খান ও জুলফিকার খানকে মারাঠা সমস্যা মেটাবার কোনো পথ খুঁজে বের করার জন্য কাজে লাগিয়েছেন। এ থেকেই বোঝা যায় তার এই শেষ ইচ্ছার ব্যাপারে তিনি কতটা আন্তরিক ছিলেন। এইভাবেই ১৭০৬ সালে শাহুকে মারাঠাদের সঙ্গে একটি মীমাংসার ছক প্রস্তুত করার জন্য শাহুকে জুলফিকার খানের সৈন্যদলে বদলি করে দেওয়া হয়। জুলফিকার মীমাংসা করার মনোভাবের উপর ভিত্তি করে মারাঠা প্রধানদের চিঠি দিয়ে তাদের শাহুর সৈন্যদলে যোগদানের আহ্বান করেন, কিন্তু মারাঠারা এবিষয়ে অত্যন্ত সন্দিহান ছিলেন। এর পূর্বে জুলফিকার খান জিনজিতে রাজারামের সঙ্গে এক মীমাংসার চেষ্টা করেন। অনেকের মতে জুলফিকার নানাভাবে মারাঠাদের সঙ্গে কথাটা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন কারণ তিনি স্বয়ং দাক্ষিণাত্যের একটি অংশকে নিজের অধিকারে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন। ‘চিন’ গোষ্ঠীরও এই রকম অভিপ্রায় ছিল।

গাজিউদ্দিন খান ফিরুজ জঙ্গ চিনগোষ্ঠীর নেতা ছিলেন এবং তাঁর পুত্র চিন কুলিচ খান (পরে ইনি নিজাম-উল-মুলক হন) এবং তার জ্ঞাতি ভ্রাতা মুহম্মদ আমিন খান। চিন এবং অন্যান্য আত্মীয়েরাও চিনগোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। এই পরিবারের পূর্বপুরুষ ছিলেন বুখারার প্রসিদ্ধ সাধু শেখ শিহাবউদ্দিন সোহরাওয়ারাদি। গাজিউদ্দিন খান মারওয়াড়ের যুদ্ধেই প্রথম অংশগ্রহণ করেন। ১৬৮৭ সালে বিজাপুর অধিকারের মুখ্য কৃতিত্ব তাকেই দিয়ে সেই সঙ্গে তার মনসবের মূল্য ৭০০০/৮০০০ করে দেওয়া হয়। সেই বছরেই প্লেগ মহামারীতে অন্ধ হয়ে গেলেও তাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হতে থাকে। এইভাবে ১৬৯৫ থেকে তিনি বেরারের প্রশাসক নিযুক্ত হন। তিনি মুখ্যত তুরানিদেরই সৈন্যদলে নিয়োগ করতেন। এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিমাণে গোলন্দাজ বাহিনীর এক বিরাট অংশকে নিজের আয়ত্তে রেখে দিয়েছিলেন। ১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেব তার গোলন্দাজ বাহিনী পরিদর্শন করে তার বেশিরভাগই বাজেয়াপ্ত করেন এবং বলেন তার যা প্রয়োজন সেইমতো সবকিছুই, বা যা কিছু তার প্রয়োজন নয়, সেই সব কিছুই তিনি নিজের জন্যে রেখে দিয়েছেন।

১৭০৬ সালে ওয়াগনগিরা জয়ে তার ভূমিকার জন্য চিন কুলিচ খান ঔরঙ্গজেবের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। মহম্মদ আমিন খান চিন ছিলেন সদর।

এই পরিবারটি বিশেষ গোঁড়া বলে পরিচিত ছিল এবং রাজকীয় প্রসাদ লাভের তালিকায়ও বহু উচ্চে অবস্থান করত। তবে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আসাদ খানের পরিবার তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবেন, এই চিন্তা করে তারা নিজেদের প্রভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার কথা চিন্তা করতে শুরু করেন। তাই ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এই চিনগোষ্ঠী গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বানে দাক্ষিণাত্য ছেড়ে যাবার কোনো অভিপ্রায় দেখাননি। এই শক্তিশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টায় আজম চিন কুলিচ খানের মসনদ ৭০০০/৭০০০-এ এবং মহম্মদ আমিন খানের মসনদ ৬০০০/৭০০০-এ বর্ধিত করেন এবং চিন কুলিচ খানকে খান্দেশ-এর প্রশাসকও নিযুক্ত করেন। কিন্তু অ সত্ত্বেও চিন কুলি খান ঔরঙ্গাবাদের থেকে দু’এক ধাপ মাত্র অগ্রসর হন। এবং তারপরে তার নিজের দায়িত্বের দেখাশোনা করার অজুহাতে ফিরে যান। মুহম্মদ আমিনও যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে ঔরঙ্গাবাদে ফিরে যান। এবং সেখানে চিন কুলিচ খানের সঙ্গে কয়েকটি জিলা অধিকার করে নেন। গাজিউদ্দিন খান ফিরুজ জং-ও দৌলতাবাদেই বসে থাকেন এবং আজমের সঙ্গে যোগদানের কোনো চেষ্টাই করেননি। তবে ফিরুজ খানকে শত্রু অপেক্ষা বন্ধু হিসাবে পাওয়ার অভিপ্রায়ে আজম খান ফিরুজ খানকে ঔরঙ্গাবাদের প্রশাসক এবং দাক্ষিণাত্যের আজম খান ফিরুজ খানকে ঔরঙ্গাবাদের প্রশাসক এবং দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধি করে নেন এবং তাঁকে বহু পুরষ্কারও প্রদান করেন।

বাহাদুর শাহকে আগ্রায় বাদশাহ বলে ঘোষণা করার পরেই অভিজাতদের পারস্পরিক দলাদলি সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ল। বাহাদুর শাহ যথেষ্ট বুদ্ধি-বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেন যে, যে-সমস্ত অভিজাতরা আজমকে সমর্থন করেছিলেন, তারা যদি তৎক্ষণাৎ তার আনুগত্য স্বীকার করেন তাহলে তাদের মনসব আবার তাঁদের কাছে প্রত্যার্পণ করা হবে। এর ফলে তিনি বহু অভিজ্ঞ, আলমগিরের। সময়কার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে তার স্বপক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেনই, উপরন্তু তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী কাম বশের সমর্থনের ভিত্তিকেও করে দিলেন দুর্বলতর। আসাদ খান ও জুলফিকর খান আত্মসমর্পণ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঔরঙ্গজেবের সুপারিশ এবং নিজস্ব যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, আসাদ খান ওয়াজির বা মহামন্ত্রীর পদটি নিজের জন্য চাইলেন এবং জুলফিকার খানের জন্য মির বকশির পদটি চেয়ে নিলেন। তাঁর প্রাক্তন ৬০০০/৬০০০ মনসব সহ জুলফিকার খানকে মির বকশির পদটি দিতে বাহাদুর শাহের কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ওয়াজিরের পদটি নিয়ে তিনি দ্বিধায় পড়েন, কারণ পূর্বেই তিনি এই উচ্চপদটি তার বন্ধু ও সমর্থক মুনিম খানকে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এর একটি সমাধান সূত্র বের হল। মুনিম খানের মনসবদারিকে ১৫০০ থেকে ৭০০০/৭০০০-এ বর্ধিত করে তাকে ওয়াজিরের পদটি দেওয়া হয়, তাকে আবার লাহোরের (অনুপস্থিত) প্রশাসকও নিয়োগ করা হয়। আসাদ খানকে ৮০০০/৮০০০ মনসব দিয়ে ওয়াকিল-ই-মুতলিক পদে আসীন করা। হয়। এ ছাড়া তাঁকে আসাফ-উদ-দৌল্লার উপাধি সহ সমস্ত নিয়োগ ও পদোন্নতি সংক্রান্ত কাগজপত্র এবং প্রদেশ থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনগুলি দেখার অধিকার দেওয়া হয়। মুনিম খানের পক্ষে এই ব্যবস্থা একঘেয়ে এবং অপমানজনক বোধ হওয়ায় আসাদ খানকে দিল্লিতে প্রতিষ্ঠিত করার একটি সুযোগ পাওয়া গেল। জুলফিকার খানকে তার পিতার উপপ্রধান নিয়োগ করা হল। কিন্তু এর একটি ব্যতিক্রম ছিল। সকল রাজস্ব এবং দেওয়ানি পরোয়ানা এবং সনদে ওয়াজিরের সিলমোহর আগে দিয়ে, তারপর আসফ-উদ-দৌলার সিলমোহর পড়বে। প্রকৃতপক্ষে সরকারের কাজ-কর্মে তার কোনো দায়িত্বই ছিল না।

চিন কুলিচ এবং মহম্মদ আমিন খানকেও দাক্ষিণাত্য থেকে ডেকে পাঠানো হল। কিন্তু তাদের এত সামান্য কর্তৃত্বসম্পন্ন কাজ দেওয়া হয় যে তাতে তারা সন্তুষ্ট হতে না পেরে কিছুদিন পরে চিন কুলিচ তাঁর মনসব এবং খান-ই-দৌরান উপাধি ত্যাগ। করে দিল্লিতে অবসর জীবন কাটাতে থাকেন, তবে অবশ্যই আরও ভালো সুযোগের প্রতীক্ষায়। গাজিউদ্দিন খানকে গুজরাটের প্রশাসক নিযুক্ত করা হয় এবং তিনি সরাসরি দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, প্রচলিত প্রথামতো প্রথমে দরবারে হাজিরা দিয়ে নয়। ১৭৭০ সালে আহমেদাবাদে তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গোষ্ঠী আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। মূল সংঘর্ষের ক্ষেত্রে তখন একদিকে ছিলেন জুলফিকার খান ও অপরদিকে মুনিম খান, আর চিনগোষ্ঠী ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের কিনারায় অপেক্ষমাণ।

রাজপুত পর্ব

জুলফিকার খান ও মুনিম খানের সংঘর্ষের মধ্যে কিছু নীতিগত বিষয়ও নিহিত ছিল। নূতন অভিজাত মুনিম খান প্রচলিত রীতিনীতি থেকে কোনো নূতন, দুঃসাহসী ব্যতিক্রম ঘটাতে চাননি। আওরঙ্গজেবের মতো বাহাদুর শাহর ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না, এমনকি শিয়া ধর্ম নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি করার অভিযোগও তাকে শুনতে হয়েছে। তবে মুনিম খানের মতোই তিনিও সাবধানী চরিত্রের লোক ছিলেন, সে রাজপুতদের বিষয়েই হোক বা মারাঠাদের সম্বন্ধেই হোক। জুলফিকার খানের আদেশে আজম খান যখন আগ্রার দিকে তার সৈন্যদল নিয়ে অগ্রসর ছিলেন, তখনই তিনি জয় সিংহ এবং অজিত সিংহকে ৭০০০/৭০০০ মনসব এবং যথাক্রমে মির্জা রাজা এবং মহারাজা উপাধি দিয়ে, বিশাল বাহিনী সহ আজমের সঙ্গে যোগ দিতে আদেশ দেন। অজিত সিংহকে যোধপুরে প্রত্যার্পণ করার উদ্দেশ্যে আলাপ-আলোচনাও শুরু হয়।

বাহাদুর শাহের রাজপুত নীতিকে দুই পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বটি ১৭০৯ পর্যন্ত সময়ের যখন তিনি ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি কেবল সংরক্ষণই করেননি, তাকে আরও এগিয়েও নিয়েছিলেন। কিন্তু অজিত সিংহ-এর নামে অনেক অনুযোগ ছিল। যথা তিনি দরবারে হাজিরা তো দেনই-নি, এমনকি রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে বাহাদুর শাহকে অভিনন্দনপত্রও পাঠাননি। এছাড়া তিনি যোধপুর অধিকার করে নিয়ে সেখানে ইসলাম ধর্মাচরণের বিরোধিতা করে অনেক মন্দিরকেও পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই জন্য বাহাদুর শাহ আজমের হয়ে দক্ষিণাত্যের দিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই রাজকীয় বাহিনী আজমের কাছে এসে পৌঁছালে রানা এসে বাদশাহের আনুগত্য স্বীকার করেন এবং তা গ্রহণ করাও হয়। অজিত সিংহ ক্ষমা প্রার্থনাও করেছিলেন এবং মহব্বত খানের নিকট পরাজিত হবার পর সেই প্রার্থনাও স্বীকার করে নেওয়া হয়। যোধপুরের ফৌজদার উপাধিধারী অজিত সিংহকে তার পূর্বেকার ৩৫০০/৩০০০-এর মনসব ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং মহারাজা উপাধিও তিনি লাভ করেন। কিন্তু তার রাজধানী যোধপুর বাদশাহের নিয়ন্ত্রণেই থাকে। এর পূর্বে জয় সিংহ এবং তাঁর ভাই বিজয় সিংহ-এর মধ্যে সিংহাসনের অধিকার নিয়ে বিরোধ দেখা দেয় এবং প্রসঙ্গত এই বিজয় সিংহ জামুতে বাহাদুর শাহকে সাহায্যও করেছিলেন। তাই বাহাদুর শাহ আজমেরের সুবেদারকে আদেশ দেন আম্বার রাজ্যকে সরাসরি নিজের দখলে এনে সেখানে একজন মুঘল ফৌজদারকে নিয়োগ করতে। আম্বারে পৌঁছে বাহাদুর শাহ সেখানে দিন দিন বাস করে শহরটির ইসলামাবাদ নামকরণ করেন। জয় সিংহ-এর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয় এবং আম্বেরে একজন বাদশাহের ফৌজদারকে নিযুক্ত করে, রাজ্যের অধিকার বিজয় সিংহকে অর্পণ করা হয়।

বাহাদুর শাহ এবং তার ওয়াজির মুনিম খান শীঘ্রই বুঝতে পারলেন যে এই নীতি বজায় রাখা সম্ভব নয়। অজিত সিংহ এবং জয় সিংহ তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বাদশাহের সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু এই বাদশাহী শিবির নর্মদার তীরে মহাবালেশ্বরে পৌঁছালে, তারা উদয়পুরে পালিয়ে গিয়ে সেখানের মহারানার সঙ্গে মুঘলদের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য চুক্তি করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজপুতদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ছিল না বললেই হয়। জয় সিংহ আম্বার পুনরুদ্ধার করেন এবং অজিত সিংহ যোধপুর থেকে মুঘল ফৌজদারকে বিতাড়ন করেন। এবং বিদনুর পরগনাগুলি উদ্ধার করেন। রাজপুতরা দিদওয়াল অধিকার করেন এবং সম্ভরের ফৌজদার সেখ হুসেন খান বরাহার বিরুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য বিজয় লাভ করেন। এই যুদ্ধ চলাকালীন এক দুর্ঘটনায় যাঁর মৃত্যু হয়। বর্ষাকাল শেষ হলে অজিত সিংহ ২০০০০ জন সৈন্য নিয়ে আজমির অবরোধ করেন, কিন্তু জয় সিংহ বা মহারাজা তাকে কোনোরকম সহযোগিতা করেননি। শেষ পর্যন্ত প্রশাসক সুজাত খান তাকে ৮০,০০০ টাকা দিয়ে সম্মত করলে পর অজিত সিংহ এই অবরোধ প্রত্যাহার করেন। যদিও সুজাত নিজের মুখ রক্ষার জন্য তার জয় হয়েছে বলে বাহাদুর শাহকে একটি মিথ্যা পত্র দেন।

ইতিমধ্যে কাম বকসের বিরুদ্ধে বাহাদুর শাহ-এর বিজয় এবং উত্তর ভারত ফিরে সৈন্যদল গঠন করে রাজপুতদের শিক্ষা দেবার বিষয়ে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। রাজপুতেরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাদের পুরোনো বন্ধু আসফ খান ও শাহজাদা আজিম-উল-শাহর শরণাপন্ন হলেন। তাদের উদ্যোগে জয় সিংহ এবং অজিত সিংহ ভঁদের হৃত মসনদ ফিরে পেলেন। আসাদ খান, যাঁকে লাহোের দিল্লি এবং আজমেরের সুবাগুলির সর্বাঙ্গীণ কর্তা নিয়োগ করা হয়েছিল, তিনি রাজপুত রাজাদের তাদের বাসভুমির অধিকার তাদের দিয়ে সনদ জারি করতে রাজি হলেন, অবশ্য যদি তারা সম্ভর এবং দিওয়ানাতে তাদের ঘাঁটি ভেঙে দিয়ে কাবুল এবং গুজরাটে কর্মভার গ্রহণ করতে সম্মত হন এই শর্তে।

তাহলে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে রাজপুতদের বিষয়ে একদিকে বাহাদুর শাহ ও মুনিম খান এবং অপরদিকে আসাদ খান ও জুলফিকার খানের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। এই শেষোক্ত দুইজন নানাভাবে যথা, রাজপুতদের বাসভূমি তাদের আবার প্রত্যার্পণ করে এবং উচ্চ প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে প্রকৃতপক্ষে রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে তাদের অংশীদার করে তুলে পারস্পরিক সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেন। আবার উত্তর ভারতে ফিরে এসে বাহাদুর শাহ ও মুনিম শাহ প্রথাগতভাবে রাজপুত সমস্যা সমাধানের একটি প্রচেষ্টা করেন। ১৭১০ সালের জুন মাসে অজিত সিংহ এবং জয় সিংহকে রাজসাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে দরবারে নয়, তার পরিক্রমা কালেই, অর্থাৎ শিবিরে। এছাড়া তাদের দেশভুমি অর্থাৎ, যোধপুর ও আম্বেরেও তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। তাদের গৃহে ফিরে যেতে অনুমতি দেওয়া হয়, তবে এই শর্তসাপেক্ষে, যে ছয় মাসের মধ্যে এক সৈন্যদল গঠন করে তারা সম্রাট যেখানে আদেশ করবেন সেইখানেই যোগদান করবেন। আসলে বান্দা বাহাদুরের বিদ্রোহের কথা ইতিমধ্যেই বাহাদুর শাহের কানে পৌঁছেছিল এবং তিনি তার বিরুদ্ধে রাজপুতদের প্রয়োগ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। আবার আরও উৎকোচ হিসাবে মুনিম খান এই দুই রাজাকে গুজরাট ও কাবুলে নিযুক্ত করার প্রস্তাবটি আবার উত্থাপন করলেন। অবশ্য রাজপুতদের মতে এটি ছিল দুজনকে আলাদা করে দিয়ে পৃথক পৃথকভাবে তাঁদের শায়েস্তা করার একটি পরিকল্পনা মাত্র।

আরও প্রচুর চাপের মধ্যে পনেরো মাস কেটে গেলে অজিত সিংহ এবং জয় সিংহ ১৭১১ সালের অক্টোবর মাসে বাহাদুর শাহের দরবারে উপস্থিত হন বা সেলাম জানান এবং বান্দার অনুচরদের কাছ থেকে পাহাড়তলিকে রক্ষা করার জন্য তাদের সাদহাউরাতে নিয়োগ করা হয়। ইতিমধ্যে মুনিম খানের মৃত্যু হওয়ায় সকল ক্ষমতা আজিম-উল-শাহের হাতে বর্তেছে। আজিম-উল-শাহ রাজপুতদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। ছিলেন বটে। কিন্তু জুলফিকার খানের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল এবং তিনি আসন্ন গৃহযুদ্ধের প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে ঔরঙ্গজেবের সময়কার অভিজাতদের (রইস) নিজের দিকে নিয়ে আসার জন্যে উৎসুক ছিলেন। তবে মনে হয় এই সকল আলমগিরি অভিজাতরা রাজপুতদের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন না। মির্জা মহম্মদ হারিসি এই অভিজাতদের বিশ্লেষণ করে বলেন যে তারা রাজপুতদের সঙ্গে সম্পাদিত পূর্ববর্তী চুক্তিগুলিকে ‘সঠিক নীতির এবং বাদশাহের সম্মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন’ ধারণা করতেন। সম্ভবত এই কারণেই এক বিশাল সৈন্যদল সঙ্গে নিয়ে আড়াই মাস কাল বাদশাহের দেওয়া দায়িত্ব পালন করার পর জয় সিংহকে চিত্রকূটের এবং অজিত সিংহকে গুজরাটের অন্তর্গত সোরামের ফৌজদার নিযুক্ত করা হয়। এগুলি রাজপুত রাজাদের প্রত্যাশার বহু নিম্নে হওয়ায় তারা দেশে যাওয়ার ছুটি প্রার্থনা করেন। তারা তাদের চৌকি বা পাহারার ঘাঁটিগুলি রেখে যাবেন এই শর্তে তাদের ছুটি মঞ্জুর করা হয়।

মারাঠা শক্তি এবং দাক্ষিণাত্য

বাহাদুর শাহের রাজত্বকালে কেবল রাজপুতদের প্রতিই নয় মারাঠাদের প্রতি কি নীতি অবলম্বন করা হবে তা নিয়েও তীব্র মতপার্থক্য দেখা দেয়। আজম শাহ যখন উত্তর ভারতের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন নর্মদার নিকটবর্তী দৌরাহাতে ৫০-৬০ জন অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে শাহুকে পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়। শাহুকে এইভাবে ছেড়ে দেওয়ার পিছনে কৌশল ও হিসাব দুই-ই ছিল। তিনি ভেবেছিলেন এতে তারাবাইয়ের। অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং মারাঠাকে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-বিবাদে লিপ্ত থাকার জন্য আজমের অনুপস্থিতিতেও মুঘলদের অধিকৃত অঞ্চল সুরক্ষিত থাকবে। এছাড়া শাহুকেই শম্ভাজীর উপযুক্ত উত্তরাধিকারী বলে চিন্তা করা হত যার সঙ্গে কোনো চুক্তি করাও সম্ভব ছিল। সমসাময়িক ঐতিহাসিক কাফি খানের মতে জুলফিকার খানের অনুরোধেই শাহুকে ছেড়ে দেওয়া হয় কেননা তিনি শাহুর খুব অন্তরঙ্গ ছিলেন এবং বহুদিন থেকেই তার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। আবার কোনো। কোনো মারাঠা সূত্রের খবর ছিল যে আজম শাহ শাহুকে শিবাজির স্বরাজ্য, দাক্ষিণাত্যের ছয়টি সুবার চৌথ এবং সরদেশমুখী এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা দিয়ে একটি চুক্তি করেছিলেন। যদিও এমতের সমর্থনে অন্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

একটি যুদ্ধে তারাবাইকে পরাজিত করে সাতারায় নিজের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হওয়ার পর, শাহু মুঘলদের নিকট হতে তার রাজত্বের অনুমোদন এবং দাক্ষিণাত্যে চৌথ ও সরদেশমুখীর উপর তার অধিকারের সম্মতি আদায় করে নিজেকে শক্তিশালী। করে তোলার প্রয়াস পেলেন। বাহাদুর শাহের সিংহাসনে আরোহণ সম্পন্ন হবার অব্যবহিত পরেই শাহু তাকে একটি অভিনন্দন-সূচক পত্র পাঠিয়ে নিজের কৃত পাপকর্মের জন্য মক্কায় প্রার্থনা করেন। বিনিময়ে তাকে ৭০০০/৭০০০-এর মনসব ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং কাম বকশ-এর বিরুদ্ধে সামরিক সাহায্য করতে বলা হয়। শাহু নিজে এই যুদ্ধে যেতে অক্ষমতা প্রকাশ করে। তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সর্দার শিবাজি সিন্ধিয়াকে এক বিশাল সৈন্যদল সহ বাহাদুর শাহের সঙ্গে প্রেরণ করে উত্তম রাজসেবা প্রদর্শন করেন।

১৭০৯ সালের জানুয়ারি মাসে কাম বশ-এর পরাজয়ের পর বাহাদুর শাহ তার পুত্র শাহজাদা আজিম-উল-শানকে দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধির পদটি প্রদান করেন। প্রসঙ্গত আজিম-উল-শান ক্রমশ বাহাদুর শাহর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন কিন্তু আজিম-উল-শান পূর্ব প্রদেশগুলি (অনুপস্থিত) প্রশাসকের পদটি গ্রহণ করতে অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। পূর্ব প্রদেশগুলি অর্থাৎ বাংলা বিহার ও উড়িষ্যা পূর্বে তাঁরই অধীনে ছিল এবং দাক্ষিণাত্যের তুলনায় এই ভূখণ্ড ছিল অনেক শান্তিপূর্ণ এবং উৎপাদনশীল। তখন দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধির সম্মানটি পরবর্তী সর্বাপেক্ষা যোগ্যতম ব্যক্তি জুলফিকার খানকে দেওয়া হয়। শোনা যায় যে জুলফিকার খানকে দাক্ষিণাত্যের রাজস্ব ও প্রশাসন-সংক্রান্ত সর্ববিষয়ে পূর্ণ কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং নিজে দরবারে অবস্থান করেই তার পুরাতন মির বকশি দায়িত্ব এবং এই নূতন দায়িত্ব একই সঙ্গে পালন করার অনুমতিও তিনি পেয়েছিলেন। তার পুরাতন সঙ্গী এবং আশ্রিত দাউদ খান পান্নিকে দাক্ষিণাত্যে তাঁর সহকারী মনোনীত করা হয়। ৭০০০/৫০০০-এর দো-আপসা-সি-আপসা পদমর্যাদা ছাড়াও তাকে বিজাপুর, বেরার এবং ঔরঙ্গাবাদের প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। পুরাতন নিজামশাহী রাজ্য আহমদনগরের সন্নিকটে দৌলতাবাদে তার প্রধান কেন্দ্র অবস্থিত ছিল।

এইসব ক্ষমতা ও সুবিধার জন্য ওয়াজির মুনিম খানের অপেক্ষায় জুলফিকার আরও অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। তবে বাহাদুর শাহ যদি দাক্ষিণাত্য-সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে জুলফিকারের পথনির্দেশে চলতে পারতেন, তাহলে এই ব্যবস্থা আরও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠত কেননা দাক্ষিণাত্যের বিষয়ে জুলফিকারের জ্ঞান ছিল ভালোই। তবে বাহাদুর শাহ জুলফিকারের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে অনিচ্ছুক ছিলেন। কাম বকশ-এর বিরুদ্ধে জয়লাভের পরে জুলফিকার শাহুর উকিলকে বাদশাহের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি দাক্ষিণাত্যের ছয়টি সুবার উপর চৌথ এবং সরদেশমুখী অধিকার প্রাপ্তির জন্য আবেদন জানান, অবশ্য সেই বিধ্বস্ত ভূখণ্ডকে আবার সমৃদ্ধ করে তোলার চুক্তির বিনিময়ে। মুনিম খান তারাবাইয়ের উকিলকে বাদশাহের নিকট নিয়ে গেলে তিনি তারাবাইয়ের নাবালক পুত্র শিবাজি (২)-র নামে একটি ফরমান বা আদেশপত্রের জন্য আবেদন করেন। তারাবাইয়ের উকিল চৌথের নাম উল্লেখ না করে কেবল সরদেশমুখী চেয়েছিলেন। এবং তার বিনিময়ে তিনি অন্যান্য বিদ্রোহীদের দমন করে রাজ্যে স্থিতিশীলতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রস্তাব প্রদান। করেন।

তখন এ বিষয়ে মুনিম খান এবং জুলফিকার খানের মধ্যে এক বিশাল বিতর্কের সূচনা হয়। এবং মুনিম খান যখন খান্দেশ এবং বেরারের অন্তর্গত পেইনঘাটকে দাক্ষিণাত্য থেকে পৃথক করে স্বতন্ত্র একটি সুবা গঠন করে, তার পুত্র মহাব্বত খানকে রাজকর্মচারী এবং আমলাদের নিয়োগ, বরখাস্ত এবং বদলি করার সমস্ত ক্ষমতা সহ সেই সুবার প্রশাসকের পদে নিয়োগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তখন তাদের ‘পারস্পরিক সম্পর্কের আরও অবনতি হয়। বাহাদুর খান অবশ্য দুজনের কাউকেই অখুশি করতে চাননি এবং সেই জন্য তিনি দাক্ষিণাত্যের মধ্যে বিভাগ সৃষ্টি করার প্রস্তাবটি নাকচ করে দেন এবং মুনিম খান এবং জুলফিকার খান উভয়েরই অনুরোধক্রমে কেবল সরদেশমুখীর জন্য সনদ জারি করেন।

বাহাদুর শাহের অভিপ্রায় যাই হোক না কেন, তার এই সিদ্ধান্ত শাহু এবং তারাবাই উভয়ের কাছেই তাদের দাবি আদায়ের জন্য সমস্ত রাজকীয় ভূখণ্ড বা বাদশাহের খাস অঞ্চলকে যথেচ্ছ লুটপাট করার আমন্ত্রণ নিয়ে এল। বাহাদুর শাহ দাক্ষিণাত্য ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শাহু রাজগড় কেল্লা থেকে বেরিয়ে এসে তার সর্দারদের আদেশ করলেন বাদশাহ আমাকে এই অঞ্চলের উপরে (সর) দেশমুখীর অধিকার দিয়েছেন, কিন্তু চৌথের নয়। সুতরাং আপনারা বাদশাহের খাস এলাকাগুলিতে হামলা করে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করান (যাতে তিনি এই চৌথ দিতে সম্মত হন)। শীঘ্রই মারাঠাদের দল খান্দেলার বুরহানপুর লুণ্ঠন করে সেখানের প্রশাসক মির আহমেদ খানকে পরাজিত এবং নিহত করেন। এছাড়া তারা বিজাপুর এবং আহমেদনগর আক্রমণ করেন এবং ঔরঙ্গাবাদের নিকট উপস্থিত হয়ে সমগ্র এলাকাটিতে লুণ্ঠন চালান। দাউদ খান পন্নি এক বৃহৎ সৈন্যদল নিয়ে মারাঠাদের পশ্চাদ্ধাবন করলেও মুঘলদের এই সমস্ত আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা ছিল না। তিনি আবার রাও রম্ভা নিম্বলকার, পাইমা রাজ সিন্ধিয়া এমনকি চন্দ্রসেন যাদবকেও নিজের পক্ষে নিয়ে এসে মারাঠিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেন, কিন্তু মারাঠাদের আক্রমণ চলতেই থাকে।

শেষপর্যন্ত ১৭১১ সনের প্রথমার্ধে দাউদ খান শাহুর সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। এই চুক্তি অনুসারে শাহুকে চৌথ এবং সরদেশমুখী অধিকার চেওয়া হয়। কিন্তু মারাঠা রাজকর্মচারীদের পরিবর্তে দাউদ খানের সহকারী হিরামন এই অর্থ আদায় করে তার থেকে মারাঠাদের কেবল একটা নির্দিষ্ট অংশ প্রদান করবেন এই শর্তে, রাজপুত্রদের জায়গিরগুলির উপর অবশ্য কোনো কর ধার্য করা হবে না।

কোনো লিখিত অনুমোদন দেওয়া না হলেও, জুলফিকার খানের প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকলে এবং বাদশাহের মৌন সম্মতি না থাকলে এই চুক্তি সম্পাদন করা যেত না। অবশ্য ইতিমধ্যে মুনিম খানের মৃত্যু হওয়ায় অবস্থা অনেক সুবিধাজনক হয়ে। উঠেছিল।

তবে এই চুক্তিতেও শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। কারণ মারাঠা সর্দার এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে উঠেছিল। কারুর আদেশই তারা মান্য করত না এবং নিজেরা লুটপাট করার জন্য সর্বদাই ব্যগ্র থাকত। তবে মারাঠাদের হামলার প্রাবল্য কমে এসে ছিল।

পারস্পরিক দলাদলির স্পষ্ট প্রকাশ

১৭০৮ সালের শেষ দিকে বান্দা বাহাদুরের নেতৃত্বে শিখ অভ্যুত্থান শুরু হয়। প্রথমেই সোনেপত এবং সিরহিন্দের ফৌজদারদের পরাজয়ের পর ‘দিল্লি থেকে কয়েকদিনের পথ থেকে শুরু করে লাহোরের শহরতলি অবাধি’ ফলত শিখ নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়। এই শিখ অভ্যুত্থান নিয়েই ১৭১০ সালের মধ্যভাগ থেকে ১৭২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে তাঁর মৃত্যুকাল অবধি বাহাদুর শাহ ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। লৌহগড়ে বান্দাকে অবরোধ করে রাখা হয়, কিন্তু বৎসরের শেষ দিকে যখন দুর্গটিতে হানা দেওয়া হয় তখন বান্দা পাহাড় অঞ্চলে পালিয়ে যান। এর পরে মুঘলদের কার্যকলাপও স্তিমিত হয়ে আসে এবং অভিজাতদের উপর বান্দার বিরুদ্ধে অভিযান চালাবার দায়িত্ব দিয়ে বাহাদুর শাহ লাহোর চলে যান।

১৭১১ সালে স্বল্পস্থায়ী রোগভোগের পর মুনিম খানের মৃত্যু হয়। লৌহগড় দুর্থ থেকে বান্দার পলায়নের জন্য বাহাদুর শাহ তার উপর যে দোষারোপ করেন, সেই মনোকষ্টেই তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। জুলফিকার খান এখন আবার ওয়াজির হবার দাবি তুলে ধরেন। বাহাদুর শাহর ঘনিষ্ঠ শাহজাদা আজিম-উশ-শান তার কথা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন যদি জুলফিকার দাক্ষিণাত্যের মির বকশি এবং রাজপ্রতিনিধির পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং সেই পদগুলি যদি মুনিম খানের পুত্রদের দেওয়া হয়, এই শর্তসাপেক্ষে। বাহাদুর শাহের এই প্রস্তাবটি পছন্দ হয়নি, কারণ মুনিম খানের পুত্রদের তিনি এই পদের জন্য যোগ্য মনে করেননি। জুলফিকার খানও এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। কারণ তিনি মির বকশি এবং দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধির পদ পরিত্যাগ করতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি আসাদ খানকে ওয়াজিরের পদে নির্বাচিত করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বাহাদুর শাহ এবং আজিম-উশ-শান ভেবেছিলেন যে ওয়াজির, মির বকশি এবং দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধি, এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদই যদি একটি পরিবারের হাতেই চলে যায় তাহলে তা রাজবংশের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। শেষ পর্যন্ত ওয়াজির পদে কাউকেই বসানো হয়নি। সাদুল্লা খানকে প্রধান দেওয়ান মনোনীত করে তাকে শাহজাদা আজিম-উশ-শাহের তত্ত্বাবধানে এবং নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে বলা হয়’ (কাফি খান)।

এইভাবে একজন উদ্যমী শ্রেষ্ঠ ও সমর্থ যুবরাজ এবং একজন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী এবং উচ্চাশী অভিজাত, যার উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষীগত করে রাজকীয় নীতিকে নিজের মনোমতো পরিবর্তন করা তারা এবার মুখোমুখি সংঘর্ষের পথে এসে দাঁড়াল।

বাহাদুর শাহ খুবই সাবধানতার সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের নীতি থেকে সরে আসছিলেন। সুরা পান এবং খোলা দরবারে সংগীত ও নৃত্যের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকলেও বাহাদুর শাহ ঔরঙ্গজেবের কট্টরপন্থী চিন্তাধারার সঙ্গে একমত ছিলেন না। তার ওয়াজির মুনিম খানের মতো তিনিও উদারপন্থী সুফি মতবাদে বিশ্বাস করতেন এবং ‘সৈয়দ’ উপাধিটি গ্রহণ করে তিনি মৌলবাদীদের অসন্তোষের কারণ হয়ে উঠেছিলেন। নিজেকে ঐশ্বরিক নীতি ও নিয়মের ব্যাখ্যাকারী বা ‘মুজতাহিদ’বলে ঘোষণা করে তিনি আদেশ দেন যে, শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় আলির নাম উচ্চারিত হলেই তারপরে ‘ওয়াসি’ উত্তরাধিকারী শব্দটি বসাতে হবে। এতে সুন্নি সম্প্রদায়ের লোকেরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন কেননা এখানে আলিকে অন্যান্য খলিফাঁদের অপেক্ষা উচ্চতর স্থলে বসানো হয়েছে। ফলত চতুর্দিকে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। এই আদেশটি। শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু এর পর থেকেই রক্ষণশীল সমাজ ও মুঘল সম্রাটের মধ্যেকার সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে চিড় ধরে।

নতুন ‘ওয়াজির’ জন্য সংগ্রাম জুলফিকার খান ও জাহান্দার শাহ (১৭১২-১৩)

বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে যে গৃহযুদ্ধ দেখা দেয় তা প্রকৃতপক্ষে ছিল তার সবথেকে উদ্যমী এবং সর্বাধিক সম্পদশালী শাহজাদা আজিম-উশ-শান এবং সর্বাধিক শক্তিশালী অভিজাত জুলিফিকার খানের মধ্যে। আজিম-উশ-শানকে প্রতিহত করার জন্য জুলফিকার অন্য তিনজন রাজপুত্রদের সঙ্গে এক চুক্তি করেন, এই মর্মে সাম্রাজ্য তিনজনের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে কিন্তু সিক্কা এবং খুতবা থাকবে সর্বজ্যেষ্ঠ জাহান্দার শাহের নামে। জুলফিকার হবেন তিনজনেরই একমাত্র ওয়াজির, যিনি জাহান্দার শাহের দরবারে অবস্থান করবেন, অবশ্য তিনজনেরই দরবারে তাঁর সহকারী থাকবেন। শোনা যায় যে সাম্রাজ্যকে বিভক্ত করার নির্দেশ ঔরঙ্গজেবই তার। ইচ্ছাপত্রে দিয়ে গিয়েছিলেন এবং যাজুর যুদ্ধের আগে এমনকি কাম বশের সঙ্গে তার সংঘাতের পূর্বে বাহাদুর শাহ এটি মেনে চলার জন্য প্রতিশ্রুত ছিলেন। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে কেউই গভীরভাবে চিন্তা করেননি। জুলফিকার খানের চেষ্টা এবং উদ্যমে আজিম-উশ-শান পরাজিত হবার পর আর কালক্ষয় না করে জুলফিকার অন্য । দুই ভ্রাতা রফি-উশ-শান এবং জাহান শাহকে পরাজিত করেন।

জাহান্দার শাহর লাহোরে সিংহাসনে আরোহণ করা জুলফিকার খান যেন অধিকার-বলেই ওয়াজির বা প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। দাক্ষিণাত্যে রাজপ্রতিনিধির পদটিও তিনি নিজ অধিকারে রাখেন এবং তার সহকারী দাউদ খানের মাধ্যমে সেখানকার শাসনকার্য নির্বাহ করেন। তাঁকে ১০,০০০/১০,০০০ দো আসপা, সিআসপাঅর্থাৎ দ্বিগুণ অশ্বারোহী এক অভূতপূর্ব সম্মান এবং ইয়ার বাফাদার (বিশ্বস্ত বন্ধুর) উপাধিও দেওয়া হয়। তার পিতা আসাদ খান ওয়াকিল-হ-মুতলক পদে স্থিত থাকেন এবং তাঁকে ১০০০/১০০০ মনসবের সঙ্গে গুজরাটের (অনুপস্থিত) প্রশাসকের পদও দেওয়া হয়। যদিও জাহান্দার তাকে সম্মান দিয়ে কাকা (চাচা) বলে ডাকতেন, আসাদ খান কিন্তু জনশাসন কার্যে কোনো উৎসাহ দেখাননি এবং কালেভদ্রে দরবারে যেতেন। সুতরাং জুলফিকার খানের হাতেই সকল ক্ষমতা রক্ষিত ছিল এবং জাহান্দার শাহ তার উপদেশ মতো চলতেন।

জুলফিকার তার ক্ষমতা ও অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে একটি উদার, মুক্ত এবং সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলার নীতি প্রস্তুত করেন। প্রথমে জাহান্দার শাহ সিংহাসনে বসার নদিনের মধ্যে এবং আসাদ খানের প্রস্তাবক্রমে জিজিয়া কর ব্যবস্থা বিলোপ করা হয়। যদিও যুদ্ধ চলাকালীন ১৭০৪ সালে ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে জিজিয়ার প্রয়োগ সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেন এবং ক্রমশ জিজিয়ার প্রয়োগ আর বিশেষ করাও হয়নি। যদিও বাহাদুর শাহ মাঝেমধ্যে জিজিয়ার ব্যবহার করেছিলেন। যথা অজিত সিংহকে পরিত্যাগ করার পর যোধপুরে জিজিয়া জারি করা হয়। সাধারণ হিন্দু জনসাধারণের সমর্থনকে নিজের দিকে নিয়ে আসার জন্যই অবশ্য জুলফিকার খান এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

এরপরে জয় সিংহ এবং অজিত সিংহ-এর পদমর্যাদা, ৭০০০/৭০০০-এ বৃদ্ধি করা হয় এবং তাদের যথাক্রমে মির্জা রাজা সওয়াই এবং মহারাজ উপাধিও দেওয়া হয়। শীঘ্রই জয় সিংহকে মালওয়া এবং অজিত সিংহকে গুজরাটের সুবেদারির পদও দেওয়া হয়। এইসব পদ কিন্তু কেবল কাগজে-কলমে দেওয়া হয়েছিল তা নয়; প্রকৃতপক্ষে অজিত সিংহ সবে গুজরাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার অব্যবহিত পরেই খবর আসে যে আজিম উশ-শানের পুত্র ফারুকসিয়ার পূর্বদেশে যে বিদ্রোহ করেছিলেন তা বেশ চিন্তাজনক হয়ে উঠেছে। অগত্যা তাঁকে গুজরাত যাত্রা স্থাপিত রাখতে হয়।

মারাঠাদের ক্ষেত্রে অবশ্য দাউদ খান পূর্বে যে চুক্তি করেছিলেন তা অব্যাহত ছিল। রাজারামের পুত্র শিবাজিকে (২) ৩০০০/২০০০-এর মনসব দিয়ে জুলফিকার খান আর-একটি নূতন পদক্ষেপ নেন। এ ছাড়া তাকে হায়দরাবাদের (সর) দেশমুখী প্রদান করে একটি খিলাত (সম্মান সূচকবস্ত্র) এবং ফরমান (আদেশ-পত্র) দেওয়া হয়। এইভাবে জুলফিকার খান শিবাজির স্বরাজ্যকে এবং দাক্ষিণাত্যের চৌথ এবং সরদেশমুখীকে ও শাহু এবং দ্বিতীয় শিবাজির মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত করে দিতে সক্ষম হন।

কিন্তু জায়গিরদারি ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান সংকট এবং অভিজাতদের সঙ্গে তরুণ বাদশাহের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে তার সম্পর্ক, এই দুটিই ছিল জুলফিকার খানের প্রধান সমস্যা। আসলে বেহিসেবি ভাবে মনসব এবং ইনাম (পুরস্কার) বিতরণ করার ফলে বাহাদুর শাহের সময়ে জায়গিরদারি সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। সমসাময়িক ভীমসেনের মতে এমনকি করণিকরাও (মুনশি) উচ্চ মনসব লাভ করেন। সম্রাটের এই বেহিসেবি বদান্যতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুনিম খানের সমর্থন নিয়ে মুস্তায়েদ খান নামে একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ করা হয়। তিনি যাদের নূতন কার্যে নিয়োগ করা হয়েছে এবং যাদের পদোন্নতি হয়েছে তাদের যোগ্যতা বিচার করা এবং যেসব ধর্মীয় ব্যক্তি বা বিদ্বজ্জনকে সাহায্য দেওয়া হয়েছিল সেগুলিও পরীক্ষা করে দেখার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতে অত্যন্ত কালবিলম্ব ঘটায় যে সমস্ত খানজাদা বা অভিজাতরা ঔরঙ্গজেব কর্তৃক নূতন নিয়োগের উপর ন্যস্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের খবর শোনবার জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। মনে হয়, তারা দু’জন বেগমের নিকট তাদের আর্জি পেশ করেন, যাঁরা আবার মুস্তায়েদ খানের উপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। বাদশাহ কর্মকর্তাদের জানান যে তার হস্তাক্ষর কেবল একটি লৌকিকতা মাত্র এবং আরজ মুকাররর বা জায়গির-এর স্বত্ব অনুমোদন করার জন্য নিযুক্ত আধিকারিকরা নিজেদের ইচ্ছামতোই কাজ করতে পারেন। এর ফলে রাজকীয় স্বাক্ষরের আর কোনো মূল্য থাকল না এবং বিনা বাধায় জায়গির বিতরণ হতে লাগল।

এই সময় আর-একটি যে সংস্কার শুরু করা হয়, তা হল রাজকীয় বাহনের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ভার (খুরাক দাওয়ার) বহন করার পদ্ধতিটি বন্ধ করে দেওয়া। এবার থেকে মনসবদারদের যে বেতন ধার্য হয়েছিল তার থেকেই এই খরচের পরিমাণটি বাদ দেওয়া হত। অবশ্য তাদের জায়গির প্রদান করার পরে। এতে অবশ্য অভিজাত খানজাদাদের অনেক অসুবিধার থেকে মুক্তি দেওয়া হল। এবং কাফি খানের কথায় এর অর্থ ‘পশুদের পালন করার খরচ প্রদান করা। কিন্তু এর ফলে বাদশাহী। নিজস্ব সম্পদের উপর অতিরিক্ত চাপ আসে। যে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে বাহাদুর শাহকে এই পদক্ষেপ নিতে হয় তা শিখ অভ্যুথানের সময় ১৭১১ সালে তার প্রতিনিধি ছবিলা দাসের এই উক্তিটি থেকেই বোধগম্য হয়। সৈন্যদলের সাহায্যেই যুদ্ধ করা হয় এবং সৈন্যদলের প্রয়োজন মেটাতে অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই টাকাকড়ি তো দেখাই যাচ্ছে না। দেখা যাক ঈশ্বর কীভাবে জয়ী হন। কাফি খান বলছেন যে আগ্রা কেল্লা জয়ের সময় বাহাদুর শাহ তেরো কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণ ও রৌপ্য, মুদ্রা বা অন্য ভার পেয়েছিলেন। অথচ তার রাজত্বকাল শেষ হবার মধ্যেই এই সম্পদ সম্পূর্ণ ব্যয় হয়ে যায়। এর জন্য সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে বাদশাহের গৃহস্থালিতে কঠোর ব্যয়সংকোচ শুরু হয়। উদাহরণস্বরূপ দৈনিক খরচ মেটাবার জন্য প্রতিদিন শাহাজাদা আজিম-উশ-শাহের তহবিল থেকে সেদিনের দরুনই অর্থই পাওয়া যেত।

জুলফিকার খান এই পরিস্থিতিরই উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। এবং এই জন্যই সমসাময়িক বহু লেখকই তার বিরুদ্ধে কৃপণতার অভিযোগ এনেছেন। আমরা শুনেছি। যে পরাজিত রাজপুত্রদের যারা সমর্থক, জুলফিকার খান তাদের কোনোরকম চাকুরি দিতে সরাসরি অস্বীকার করেন–যা ছিল পূর্বতন পরম্পরার সম্পূর্ণ বিরোধী। এইসব রাজপুত্রদের সমর্থকদের অনেকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয় যা ছিল বাহাদুর শাহের নীতির বিরোধী। ইবাদত খান ছিলেন এই রকম একজন যাঁকে কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। তিনি অভিযোগ করে বলেন যে অন্য কাউকে জায়গির দিতে এত অনিচ্ছুক হলেও জুলফিকর নিজের জন্য বিশাল রাজস্ব ও নানাপ্রকার সুবিধা আত্মসাৎ করেছিলেন এবং প্রাচীন অভিজাতদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে তাদের ধ্বংস করার চক্রান্তের অভিযোগেও তাকে অভিযুক্ত করেন। জুলফিকর খান আদেশ দেন যে তার দাবি সম্পূর্ণ ভাবে খুঁটিয়ে না দেখে কোনো মনসবদারকে সনদ বা জায়গির দেওয়া হবে না এবং ততক্ষণ তার পদমর্যাদারও কোনো বৃদ্ধি করা হবে না। এছাড়া তিনি মনসবদারদের তাদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী সৈন্য রাখবার আদেশ দেন এবং অশ্বাদির শরীরে চিহ্ন দেওয়া এবং সেনা সমাবেশে নিয়মবিধি চালু করতে বলেন। আমরা জানি না এর ফলে প্রাচীন খানজাদাদের কী অসুবিধা পড়তে হয়েছিল। তবে এই রকম প্রতিযোগিতামূলক পরিমণ্ডলে আর্থিক নিয়ন্ত্রণ এবং আইন শৃঙ্খলার প্রয়োগ অবশ্যই কঠিন ছিল। শীঘ্রই জুলফিকারের প্রবর্তিত আইন শৃঙ্খলা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় এবং আরার উদার হাতে বাদশাহের প্রিয়পাত্রদের জায়গির বিলানো হতে থাকে।

জুলফিকার রাজস্ব বিষয়ে সমস্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব তাঁর ভূতপূর্ব দেওয়ান শোভা চাঁদের হাতে ছেড়ে দেন। একজন কায়স্থ শোভারামকে রাজা উপাধি ও ভূখণ্ডের দেওয়ানের পদ দেওয়া হয়। শোনা যায় জাহান্দর শাহর সময়কালে সমস্ত পুরোনো নিয়ম বাতিল করে দেওয়া হয় এবং (ভূমি রাজস্ব) ইজারা হয়ে দাঁড়ায় সর্বজনীন।

জুলফিকার খান প্রবীণ আলমগিরি এবং বাহাদুর শাহী অভিজাতদের জিতে নেবার চেষ্টা করেন। তার এই প্রচেষ্টার জন্যই এই রকম বহু অভিজাত দেশের শাসনকেন্দ্রে এবং প্রদেশগুলিতে নিজেদের পদ সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হন। তিনি নীচু পরিবার-জাত নূতন প্রার্থীদের উচ্চ অবস্থানের পদোন্নতিতে বাধা দিতেন। এইভাবে বহুবার তিনি রানী লাল কুনওয়ারের বন্ধু ও আত্মীয়দের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পুরাতন অভিজাতদের স্বপক্ষে দাঁড়িয়েছেন কেননা লাল কুনওয়ার, কলাওয়ান্ত অর্থাৎ, পেশাদারি সংগীতশিল্পীদের পরিবার থেকে এসেছিলেন। শোনা যায় যে এই সময় পেশাদার সংগীত-কুশলী ও চারণকবিদের স্বর্ণযুগ ছিল এবং এরা দিল্লির পথে পথে উদ্ধত ভাবে ঘুরে বেড়াত। এই গাইয়ে-বাজিয়েরা তাদের সারাক্ষণ হইহল্লা এবং অহংকারী ব্যবহারের জন্য উচ্চ ও নীচ উভয়ের কাছেই ঘৃণ্য বলে গণ্য হত। এই সময় একদিন জুহরা নামে লাল কুনওয়ারের বন্ধুস্থানীয় এক সবজি বিক্রেতা একটি নাতিপ্ৰশস্ত পথে চিন কুলিচ খানের পথ আটকে তাঁকে চেঁচিয়ে ‘সেই কানাটার ছেলে’ (সেই অন্ধের পুত্র) বলে অপমান করে, এবং এর ফলে চিন কুলিচ খানের লোকজন জুহরার সঙ্গীদের বেশ উত্তম-মধ্যম প্রহার করে। লাল কুনওয়ারের কাছে জুহরার নালিশ নিষ্ফল হয়, কেননা ওয়াজির স্বয়ং চিন কুলিচ খানের পক্ষ নিয়েছিলেন।

জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসার অব্যবহিত পরেই জুলফিকার খান তার পুরাতন প্রতিদ্বন্দ্বী চিন কুলিচ খানকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা শুরু করেন। এদিকে আজিম-উশ-শান উচ্চ পদ দেবার প্রতিজ্ঞা করে তাঁকে নিজের পক্ষে নিয়ে এসেছেন। বাহাদুর শাহর মৃত্যুর পর একটি সৈন্যদল গঠন করে দিল্লির বাইরে কয়েক পা-মাত্র অগ্রসর হওয়ার পরেই আজিম-উশ-শানের পরাজয়ের খবর পেয়ে চিন কুলিচ খান তার সৈন্যদের ছেড়ে দিয়ে নিজে দিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন। আবার চিন কুলিচ খানের বিরুদ্ধে জুলফিকার খান অভিযানে উদ্যত হলে তুরানি অভিজাত সামাদ খান তাঁকে নিবৃত্ত করেন। সামাদ খান একজন তুরানি অভিজাত, চিন পরিবারে বিবাহ করা সত্ত্বেও কিন্তু গৃহযুদ্ধের সময় তিনি গোলন্দাজ বাহিনীর অধ্যক্ষ রূপে জুলফিকার খানকে সক্রিয় ভাবে সাহায্য করেন। ৭০০০-এর অবস্থানের অধিকারী রূপে তাঁকে ‘সদর’ পদে নিযুক্ত করা হয়। জাহান্দর খান দিল্লি পৌঁছোলে চিন কুলিচ খান তাকে নগরের বাইরে গিয়ে দেখা করেন। ফলত চিন কুলিচ খান তার পাঁচ হাজার মনসব ফিরে পান এবং তাঁকে মালওয়ারের প্রশাসকও নিযুক্ত করা হয়। এতে কিন্তু তিনি খুশি হননি এবং তার মনসব ও পদ থেকেই পদত্যাগ করেন। বাহ্যত এর কারণ ছিল নূতন অভিজাতদের উত্থান এবং খানাজাদ অর্থাৎ রাজপ্রাসাদ-জাত অভিজাত সন্তানদের প্রতি অবহেলা।

পুরাতন অভিজাতদের এক শক্তিশালী অংশই অসন্তুষ্ট হয়ে যান। এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যা প্রাচীন তুরানি অভিজাতদের প্রতি অবহেলাই একমাত্র নয়, বরঞ্চ তাদের গোষ্ঠীরই একজনের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষীগত হওয়া–যার নাম জুলফিকার খান। এই সিদ্ধান্তটি তারা পছন্দ করেননি।

জুলফিকার খানের বিরোধিতায় দুটি আভ্যন্তরীণ উৎস প্রকাশিত হয়। কোকাল তাশ খান তৎকালীন মির বকশ ছিলেন তাদের একজন, এবং তার সঙ্গে তার বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়রাও ছিলেন। জাহান্দার খানের পালিত ভ্রাতা কোকাল তাল খান দীর্ঘদিন যাবৎ তার মুখ্য কর্মকর্তা ছিলেন। এছাড়া এই ২৫০০/২২৫০-এর মনসবদার মুলতানে ছিলেন তার উপপ্রধান। জাহান্দার খান তাকে কথা দিয়েছিলেন যে নিজে বাদশাহ হলে তাকে ওয়াজির-এর পদে প্রতিষ্ঠিত করবেন। জুলফিকার খান যখন ওয়াজিরের পদে উন্নীত হন, তখন জাহান্দার এর তীব্র নিন্দা করলেও তিনি জানতেন যে এটি অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোকল তালাশ খানকে ৯০০০/৯০০০-এর মনসব দিয়ে মির বশ-এর পদে উন্নীত করা হয়। এ ছাড়া তাকে মুলতান ও থাট্টার প্রশাসক এবং বাখার-এর ফৌজদারও করে দেওয়া হয়। তার পরিবারবর্গের প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি হয়। একজন ভাইকে ৮০০০-এর পদ দিয়ে আগ্রার প্রশাসক করে দেওয়া হয় এবং একজন জামাতাকে দ্বিতীয় বকশি পদে নিয়োগ করা হয় ৮০০০/৮০০০-এর সম্মান দিয়ে। যেসব অসন্তুষ্ট অভিজাতরা তার দলে যোগ দেন তাদের মধ্যে সর্বপ্রধান ছিলেন সাদুল্লা খান নামে একজন কাশ্মীরি। মুনিম খানের মৃত্যুর পর জুলফিকার খানকে ওয়াজিরের দেওয়ার বিরোধিতা করবার জন্য একে নিয়োগ করা হয়েছিল। এবং এখন তিনি তার রোষানলে পড়লেন।

এই উপদলটি কেবল যে প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করত তাই নয়, এছাড়া এই ওয়াজির অত্যন্ত উচ্চাশী এবং তার উচ্চাশা পূরণের জন্য তিনি শীঘ্রই এক নূতন শাহজাদাকে সিংহাসনে বসাবেন ইত্যাদি কুমন্ত্রণা দিয়ে জাহান্দার খান ও তার ওয়াজিরের পারস্পরিক সম্পর্কে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করত। তবে তখন এই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। এমনকি আজ মুকাররার-এর পদ নিয়ে জুলফিকার ও কোকল তালাশ খানের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হলে জাহান্দার শাহ তার ওয়াজির জুলফিকারেরই পক্ষ নেন। আর একবার তিনি কোকল তালাশকে পরিষ্কার বলে দেন যে ওয়াজিরের নিজের বিবেচনা মতো কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। এবং তিনি, স্বয়ং বাদশাহ, এতে কোনোপ্রকার হস্তক্ষেপ করবেন না বা এর প্রতিবাদে একটি কথাও উচ্চারণ করবেন না।

দ্বিতীয় বিরোধী গোষ্ঠী ছিল লাল কুনওয়ার এবং তার আত্মীয় বন্ধুগণ। তাঁকে নাচনি বা নর্তকী বলা হলেও লাল কুনওয়ার কিন্তু বাদশাহের উপপত্নী ছিলেন না। আসলে তিনি কলাওয়ান্ত পেশাদারি গায়ক-বাদকদের এক শ্রেণিতে জন্মেছিলেন। তার পিতা খাসউসিয়াৎ খান আকবরের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ তানসেন-এর বংশধর ছিলেন। রানি (বেগম) হবার পরে তাকে বাদশাহের মতো ঢাক-ঢোল সহযোগে শোভাযাত্রা করে চলবার অনুমতি দেওয়া হয়। এবং তার এই মিছিলে পাঁচশো জন ভদ্র গায়ক-গায়িকা (আহাদি) উপস্থিত থাকত। শোনা যায় যে তার নামে মুদ্রাও ছাপানো হয়েছিল, যদিও তা আজও পাওয়া যায়নি। তিনি বাদশাহের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন এবং যারা রাজানুগ্রহ চান তাদের জন্য বাদশাহের কাছে আসার একটি পথও ছিলেন বলা যায়। এই ব্যাপারটি ওয়াজিরের পক্ষে বিরক্তিজনক ছিল, কেননা প্রত্যেক পদপ্রার্থীরই তাকে কিছু উপহার এবং দস্তুরী দিতে হত। লাল কুনওয়ারের পরিবারের ব্যক্তিবর্গ মনসব লাভ করতেন। এবং তার অন্তত তিনি জন ভাই ৫০০০ থেকে ৭০০০-এর মনসব, জায়গির এবং নানা প্রকার আরামের নিষ্কর্মা পদও পেয়েছিলেন। শোনা যায় যে লাল কুনওয়ারের প্রভাবে অনেক কুলাওয়ান্ত ৫০০০ থেকে ৭০০০-এর মনসব পেয়েছিলেন। তবে ওয়াজির, লাল কুনওয়ায়ের কোনো ভাইকে প্রশাসকের পদ দিতে রাজি হননি। কেননা তার মতে এতে অভিজাতদের মধ্যে। অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। আর-একবার খুশ লাল নামে লাল কুনওয়ারের একজন ভাইকে এক বিবাহিতা মহিলার শ্লীলতাহানির অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয় এবং তাকে সামুগড়ের এক কিল্লা কয়েদখানায় পাঠানো হয়। লাল কুনওয়ারের কিছু করার ক্ষমতা ছিল না।

সুতরাং লাল কুনওয়ার ও নূরজাহানের মধ্যে কোনো তুলনাই করা চলে না। লাল কুনওয়ারের রাজনীতিতে কোনো আগ্রহ ছিল না। তিনি শিশুর মতো নানান উৎসব এবং আলোকসজ্জা পছন্দ করতেন। সমসাময়িক ভদ্রজন কী করে এত নিম্নমুখী পেশার একজন নারী বেগমের মর্যাদা পেতে পারেন তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা তাঁর প্রতি জাহান্দারের অত্যুগ্র আসক্তির বর্ণনা করে কয়েকটি গল্পও শোনান। জাহান্দার শালীনতা ও নৈতিকতার সীমা লঙ্ঘন করেছিলেন। যেমন শোনা যায় যে তিনি একটি চলমান সিংহাসনে বসে কেনাকাটা করতে গেছিলেন। একটি রথে বসে তিনি মদ্যপান করেন এবং পরের দিন সকালে সেই রথে তাঁকে মদ্যপ অবস্থায় দেখা যায় অবশ্য এই গল্পটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কিন্তু তার এইসব ব্যবহারে বাদশাহের সম্মান এবং সম্ভ্রম এতটাই নষ্ট হয়ে যায় যে তিনি যখন শিকারে বা কোনো উৎসবে যোগদান করতে যেতেন তখন কোনো অভিজাত বা ন্যৈবাহিনী তার সঙ্গে যেতেন না। জাহান্দর শাহ এবং অভিজাতদের মধ্যেকার এই বিভেদই রাজ্যাভিষেকের মাত্র তেরো মাস পরেই আজিম উশ শানের দ্বিতীয় পুত্র ফারুখশিয়ারের হাতে তার পরাজয়ের মূল কারণ বলা হয়। সৈয়দ আবদুল্লা খান এবং হোসেন আলি বরাহা অবশ্য তাকে সমর্থন জুগিয়ে ছিলেন।

১৭১২ সালের মে মাসে লাহোর থেকে দিল্লির যাত্রাপথে জাহান্দার শাহ পূর্বদেশে ফারুখশিয়ারের গতিবিধির কথা জানতে পারেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজকুমার আজজুদ্দিনকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ করে তিনি তাকে অবস্থার পর্যবেক্ষণ করবার জন্য আগ্রায় পাঠিয়ে দেন। এই প্রচেষ্টা অবশ্য অনেকের কাছেই হাস্যকর মনে হতে পারে। জুলফিকার খানের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই সমস্ত সেনাবাহিনী সামগ্রিক প্রশাসন কোকল তালাশ খানের শ্যালক খান-ই- দৌরানকে অর্পণ করা হয়। তিনি যুদ্ধের বিষয়ে একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিলেন এবং একজন সমসাময়িকের ভাষায় ‘জীবনে একটা বিড়ালও তিনি মারেননি।

পরবর্তী ছয় মাসে দিল্লিতে জাহান্দার শাহ ভোগ-বিলাসেই কাটান। সৈয়দ ভাইদের সঙ্গে সম্মিলিত হবার পর ফারুখশিয়ার-এর এলাহাবাদ পৌঁছোবার সংবাদ পেলে শাহজাদা আজজুদ্দিন কোরার নিকটবর্তী খাজওয়া পর্যন্ত অগ্রসর হলেন। কিন্তু তিনি সহজেই পরাজিত হলেন। এবার জাহান্দার শাহ তার বিপদ সম্বন্ধে সচেতন হলেন। এগারো মাস যাবৎ সৈন্যদের বেতন দেওয়া যায়নি এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য সকলে পাগলের মতো চেষ্টা করতে লাগল। এই এলাকার জমিদারেরা রাজস্ব প্রদান ব্যাহত রেখেছিল এবং সমগ্র সঞ্চিত অর্থ বহু পূর্বেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং আকবরের সময় থেকে সঞ্চিত সোনা ও রুপার পাত্রগুলি ভেঙে ফেলে কারখানাগুলি আবার খোলা হল যাতে করে সৈন্যদের বেতন দেওয়া যায়। এমনকি রাজার প্রাসাদের সোনার ছাদগুলিও খুলে ফেলা হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে জাঠ, মারাঠা ও নাদির শাহের আগমনের বহু পূর্বেই দেশে লুটপাটের উৎপাত শুরু হয়। যার সূত্রপাত মুঘলরাই করেছিলেন। এইভাবে এক লক্ষ সৈন্য ও এক শক্তিশালী গোলন্দাজ বাহিনী গঠন করে আগ্রায় অভিযান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

(আগামী দিনের নিজাম-উল-মুলক) চিন কুলিচ খানের পক্ষে এই ঘটনাগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হল। জুলফিকার খানের নির্দেশে তাকে ৭০০০-এর সম্মান দেওয়া হয়, এবং তার জ্ঞাতিভাই মোহাম্মদ আমিন খান, যিনি মধ্যে মধ্যে বান্দার সঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ করছিলেন, তাঁকেও ডেকে পাঠানো হয়। এই দুই শক্তিশালী অভিজাতকে আগ্রায় গিয়ে মুখ্য সেনাদলের সঙ্গে যোগ দিতে আদেশ করা হল।

ফারুখশিয়ারের থেকে অনেক বৃহৎ সৈন্যদল থাকা সত্ত্বেও অনেকগুলি কারণে, যথা জুলফিকার খান ও কোকাল তালাশ খানের মধ্যে মতবিরোধ, চিন গোষ্ঠীর তুরানি। অভিজাতদের নিস্পৃহতা, এবং সৈয়দ ভাইয়ের ভয়শূন্যতার জন্য, ফারুখশিয়ার সম্পূর্ণভাবে জালান্দারকে পরাস্ত করেন (জানু : ১৭১৩)

জাহান্দার শাহ এবং জুলফিকার খানের স্বল্প সময়ব্যাপী সম্মিলিত শাসনে অনেকগুলি নতুন নিয়মেরও সৃষ্টি হয়। দেখা গেল যে একদল সুদক্ষ ও সুকৌশলী শাসক না থাকলে তার একমাত্র বিকল্প হল এমন এক ওয়াজির বা প্রধানমন্ত্রী, যার যথেষ্ট প্রশাসনিক দক্ষতা থাকবে, যিনি আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবেন। কিন্তু এমন একজন সম্পূর্ণ ক্ষমতাশীল ওয়াজিরকে সম্ভবত বাদশাহ সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারবেন না এবং অভিজাতরা ঈর্ষা করবেন। এ ক্ষেত্রে সফল হতে গেলে ওয়াজিরকে এমন একটি গোষ্ঠী গঠন করতে হবে যা যে-কোনো বিরোধী পক্ষ বা বিরোধী পক্ষের জোটকে পরাজিত করতে সমর্থ হবে এবং এছাড়া তাকে দরবার বহিঃস্থ শক্তিদের–যথা রাজপুত, মারাঠা ইত্যাদিদেরও সাহায্য নিতে হবে। এই অবস্থানও আবার রাজবংশের ভয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। এর একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান হল একটি নূতন রাজবংশ এবং একটি নূতন অভিজাত শ্রেণির সৃষ্টি করা, ঠিক যেমন সুলতানাত-এর সময় ঘটেছিল যখন সম্রাট সম্পূর্ণভাবে তার ওয়াজিরের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। জাহান্দার শাহর শাসনকালে ঠিক এইরকমটি হয়নি যদিও এর সবরকম উপাদানই মজুত ছিল।

দ্বিতীয়ত জাহান্দার শাহর সময়ে ঔরঙ্গজেবের সকল নীতিও পরিত্যক্ত হতে থাকল। যথা জিজিয়া প্রত্যাহার এবং রাজপুত ও মারাঠাদের নানাবিধ সুবিধা প্রদান। এর থেকে মনে হয় জাহান্দার শাহ আকবরের উদার পরম্পরাকে আবার পুনর্জীবিত করতে চাইছিলেন এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মোটামুটি সমর্থনের উপর ভিত্তিশীল একটি রাষ্ট্র নির্মাণ করতে সচেষ্ট ছিলেন। ঔরঙ্গজেব ইসলামের উপর ভিত্তি করে। রাজত্বের যে ইসলামি চরিত্র গঠনে সচেষ্ট ছিলেন, এর থেকেই তার ব্যর্থতা প্রতীয়মান হয়।

নূতন প্রধানমন্ত্রিত্ব (ওয়াজির) লাভের জন্য সৈয়দ ভাইদের সংগ্রাম

আজিম-উল-শাহের দ্বিতীয় পুত্র ফারুখশিয়ার ১৭০৭ সাল থেকে বঙ্গে তার সহকারী ছিলেন। ১৭১১ সালে বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করে তাকে

আবার দরবারে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। পাটনায় কয়েক মাস ধরে অবস্থান করা। কালীন তিনি বাহাদুর শাহের মৃত্যুর খবর পান, এবং এ সংবাদ পেয়েই তার পিতা আজিম-উশ-শানকে রাজা বলে ঘোষণা করেন। হোসেন আলি বারাহা ১৭০৮ সালে থেকে বিহারে আজিম-উশ-শাহের উপপ্রধান ছিল এবং ফারুখশিয়ার পাটনায় আসার পরে কয়েকটি বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে হোসেন আলির তীব্র মতভেদ সৃষ্টি হয়। ফারুখশিয়ারের এত শীঘ্র আজিম-উশ-শানকে রাজা ঘোষণা করার বিষয়টি তার পছন্দ। হয়নি। আজিম-উশ-শানের লাহোর পরাজয় ও মৃত্যুর পরে হোসেন আলি নিজেকে তুলে নিতে চান। কিন্তু সম্রাটের মা তাকে সরে না আসতে সম্মত করান, কেননা তাহলে তার পক্ষে এটি একটি চিরস্থায়ী বদনাম হয়ে যাবে। এছাড়া ফারুখশিয়ার বাদশাহ হলে হোসেন আলিকে উচ্চ পদমর্যাদার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে দু’জনের পারস্পরিক সম্পর্ক কিন্তু ক্ষুণ্ণ হয়েই থাকে, কেননা ফারুখশিয়ারের নিম্নশ্রেণির ধূর্ততার জন্য বদনাম থাকায় হোসেন আলি তাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে তিনি একটি ফরমান জারি করে সেখানের সেনানায়ককে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রোহতাস কেল্লা দখল করলেও তিনি তাকে বিশ্বাস করে কেল্লা ছেড়ে দেবার পরেও ফাররুক সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন।

ফারুখশিয়ার এবং হোসেন আলির সম্মিলিত সৈন্যদল ১৭১২ সালে নভেম্বর মাসে এলাহাবাদ পৌঁছোলে পর হোসেন আলির জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আবদুল্লা খান তাদের সঙ্গে যোগদান করেন। আবদুল্লা খান সেই প্রদেশে আজিম-উশ-শানের প্রতিনিধি ছিলেন। শীঘ্রই আবদুল্লা খান এই মিলিত শক্তির প্রধান ব্যক্তি হয়ে ওঠেন এবং নিজ প্রভাব খাঁটিয়ে হোসেন আলি এবং ফারুখশিয়ারের মধ্যেকার অসদ্ভাব নিরসন করার চেষ্টা করেন।

জানুয়ারি ১৭১৩ সালে ফারুখশিয়ারের আগ্রার যুদ্ধ জয় কিন্তু সম্পূর্ণভাবেই সৈয়দ ভাইদের প্রচেষ্টাতেই সম্ভব হয়েছিল। তাই আবদুল্লা খানকে ওয়াজির এবং হোসেন আলিকে মির বকশি পদে নিয়োগ না করে ফারুখশিয়ারের আর উপায় ছিল না। তাদের পদমর্যাদা ৭০০০/৭০০০-এর স্তরে উন্নীত করে যথাক্রমে মুলতান ও বিহারের প্রশাসক নিযুক্ত করা হয় এবং সহকারী বা উপ-প্রশাসকের দ্বারা এই প্রদেশগুলির শাসনভার নির্বাহ করার অনুমতিও দেওয়া হয়। আবদুল্লা খানের মামা সৈয়দ মুজাফ্ফর খানকে আজমেরের রাজ্যপাল পদে নিয়োগ করা হয় এবং সৈয়দের কিছু আত্মীয়স্বজনের মনসবের অধিকারও প্রাপ্তি ঘটে। এছাড়া সৈয়দ আর কোনো সুযোগসুবিধা চাননি। প্রকৃতপক্ষে তারা পুরাতন আলমগিরি এবং বাহাদুর শাহের সময়কার অভিজাত খানদের সঙ্গে মিটমাট করে নিজের স্বপক্ষে নিয়ে আসার জন্যই উৎসাহী ছিলেন। প্রথমে এই মর্মে একটি সাধারণ নীতি প্রণয়ন করা হয় যে সমস্ত আলমগিরি (ঔরঙ্গজেবের সময়কার) অভিজাতদের তাঁদের পূর্ববর্তী মর্যাদায় আবার প্রতিষ্ঠিত করা হবে এবং জাঠেদের থেকে বাহাদুর শাহ ৩০০-র উপর আর যা পদোন্নতি প্রদান করেছিলেন সেগুলি খুঁটিয়ে দেখা হবে। চিন কুলি খানকে ৭০০০/৭০০০-এর মনসব এবং নিজাম-উল-মুলককে উপহার দিয়ে দাক্ষিণাত্যের প্রশাসক পদে নিয়োগ করা হয়। এর সঙ্গে তাকে তার নিজের জন্য এবং নিজের সহযোগীদের জন্য জায়গিরের জমি নির্বাচন করার এবং সেখানকার মুখ্য ভূস্বামী বর্গ অর্থাৎ রাজপুত ও মারাঠাদের কী মনসব দেওয়া হতে পারে সে সম্বন্ধে পরামর্শ দেবার অধিকার ও দায়িত্বও প্রদান করা হয়। আবদুল্লা খান বলতেন যে তিনি নিজাম-উল-মুলককে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলে জ্ঞান করেন এবং তিনি দাক্ষিণাত্যের অভিমুখে যাত্রা শুরু করার প্রাক্কালে তার সঙ্গে মূল্যবান উপহার সামগ্রীও বিনিময় করেন। নিজাম-উল-মুলক-এর জ্ঞাতি ভাই মোহাম্মদ আমিনকে ইন্তিমাদ-উদ-দৌল্লা উপাধি দিয়ে দ্বিতীয় বকশি পদে নিয়োগ করা হয়। এই গৃহযুদ্ধে লাহোর জুলফিকার খানের প্রধান সহকারী আবদুস সামাদ খানকে ৭০০০/৭০০০-এর মসনদ দিয়ে। লাহোরের প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। তবে পূর্বের অভিজাতদের নিজেদের পক্ষ নিয়ে আসার যে প্রচেষ্টা সৈয়দরা করেছিলেন তা কেবল আংশিক ভাবে সফল হয়। এসব বয়োবৃদ্ধদের অনেকেই সৈয়দদের প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন এবং তাদের হঠাৎ বড়ো হয়ে ওঠা বা ভুইফোড় হিন্দুস্থানি বলে নীচু চোখে দেখতেন।

সৈয়দরাও একটি উদার এবং মুক্ত মনের নীতি অবলম্বন করার চেষ্টা করতেন। যথা ফারুখশিয়ার বিহারে থাকাকালীন হুসেন আলির নির্দেশে জিজিয়া প্রথা বাতিল করা হয়। আবার আগ্রায় জাহান্দার শাহের পরাজয়ের ছ’দিন পরে এই আদেশটি জারি করা হয়। বহু স্থানে বসানো তীর্থ কর তুলে নেওয়া হয়। এছাড়া হিন্দুদের পালকি ব্যবহার করা এবং আরবি ও ইরাকি ঘোড়ায় চড়ার উপর যে নিষেধাজ্ঞা ঔরঙ্গজেব জারি করেছিলেন এবং বাহাদুর শাহও যার অনুসরণ করেছিলেন তাও কয়েক বৎসর পরে সম্পূর্ণ বিলোপ করা হয়।

সৈয়দরা রাজপুতদের সঙ্গেও মীমাংসায় উৎসাহী ছিলেন। তাই তাদের আগ্রহে দ্বিতীয় রানা সংগ্রাম সিংহকে একটি ৭০০০/৭০০০ মনসব এবং ৮ কোটি দাম পুরস্কার বা ইনাম হিসাবে দেওয়া হয়। জয় সিংহ এবং অজিত সিংহ ফারুখশিয়ারকে অভিনন্দনসূচক পত্র পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ব্যক্তিগত আনুগত্য প্রকাশের জন্য নিজেরা উপস্থিত হননি। তাঁদের উকিলের মাধ্যমে তারা উচ্চ মনসব এবং মালওয়া এবং গুজরাট সুরাটে নিয়োগের পুরাতন দাবিগুলি আবার পেশ করেন। এটি অবশ্য ফারুখশিয়ারের মোটেই ভালো লাগেনি যার জন্য তিনি রাজপুতদের সমুচিত শিক্ষা দিতে মনস্থ করেন। তিনি বিশেষ করে অজিত সিংহ-এর উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন কেননা তিনি মুঘল মনসবদার ইন্দর সিংহ-এর দুই পুত্রকে হত্যা করেন। জয় সিংহ এবং অজিত সিংহকে ৭০০০/৭০০০-এর স্তরে পদোন্নতি দেওয়া হয়, কিন্তু দুই রাজপুত রাজার জোটকে ভাঙবার জন্য জয় সিংহকে মালওয়ার এবং অজিত সিংহকে থাট্টার প্রশাসক রূপে নিযুক্ত করা হয়। জয় সিংহ মালওয়ারের দিকে যাত্রা শুরু করলেও অজিত সিংহ কিন্তু থাট্টায় যেতে অস্বীকার করেন এবং তখন হুসেন আলিকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করতে আদেশ দেওয়া হয়।

১৭১৪ সালের প্রারম্ভেই হোসেন আলি এক বিশাল বাহিনী নিয়ে অজিত সিংহ-এর বিরুদ্ধে যাত্রা করেন। ইতিমধ্যে সৈয়দদের সঙ্গে ফারুখশিয়ার-এর সম্পর্কের এত অবনতি হয় যে ফারুখশিয়ার অজিত সিংহকে গোপনে পত্র দিয়ে জানান যে মির বকশিকে পরাজিত করে হত্যা করতে পারলে তিনি অজিতকে পুরস্কৃত করবেন। অবশ্য এই সমস্ত পদক্ষেপের কথা শীঘ্রই হোসেন আলি জানতে পারলেন। কেননা তিনি রাজপুত রাজাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলেছিলেন। হোসেন আলির সহযোগিতার জন্য রানা ৪০০০ সওয়ার পাঠিয়েছিলেন। তবে কয়েকমাস ব্যাপী অভিযানের পর একটি চুক্তি রচিত হয়। এই চুক্তিতে অজিত সিংহ তার কন্যাকে ফারুখশিয়ারের সঙ্গে বিবাহের জন্য প্রেরণ করতে সম্মত হন এবং তার পুত্র অভয় সিংহকে মির বকশির সঙ্গে পেশকাশ বা দর্শনমূল্য দিতে দরবারে পাঠান। এছাড়া তিনি থাট্টার প্রশাসকের পদও স্বীকার করেন। একটি গোপন চুক্তি অনুযায়ী অজিত সিংহ আনুগত্য প্রকাশের প্রমাণ হিসাবে থাট্টার দিকে কিছুটা অগ্রসর হলেই তাঁকে গুজরাটের প্রশাসক পদে নিয়োগ করা হবে। হুসেন আলি ব্যক্তিগত ভাবে অজিত সিংহকে গুজরাটের প্রশাসক পদে নিয়োগের জন্য নিজ দায়িত্বে হুকুমনামা জারি করেন, বাদশাহের কাছ থেকে যথাযথ অনুমতি গ্রহণের পূর্বে।

সৈয়দদের সঙ্গে ফারুখশিয়ারের প্রথম শক্তিপরীক্ষা

মির বকশির অবর্তমানে বাদশাহের প্রিয়জনদের বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে নিজের অবস্থান সুস্থির রাখতে আবদুল্লা খানকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল, বিশেষ করে মির জুমলা এবং খান-ই দুরান এই দুজনেই ফারুখশিয়ারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং উচ্চপদের উপযুক্ত কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও সৈয়দদের বিতাড়িত করে ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে চেয়েছিলেন। তাদের পূর্বেকার জুলফিকার খানের মতো সৈয়দরা ক্ষমতার সমস্ত চাবিকাঠি নিজেদের হাতে রাখতে চেয়েছিলেন। তারা এও চেয়েছিলেন যে ‘তাদের নির্দেশমতো এবং তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো কাজ করা যাবে না এবং কোনো মনসব প্রদান এবং চাকুরিতে কাউকে নিয়োগও করা যাবে না। (কাফি খান) বাদশাহের কাছের লোকেরা আবার যুক্তি দিলেন যে ওয়াজির এবং মির বকশির নিজের ক্ষমতার সীমারেখা জানা উচিত এবং বাদশাহের অনুমতি এবং সম্মতি না নিয়ে কোনো কাজ করা সমীচীন হবে না।

উজিরের কর্মক্ষেত্র নিয়ে এই দুটি পরস্পরবিরোধী ধারণার জন্য একের-পর-এক সংকটের সূচনা হয় যাতে সৈয়দরা ধীরে ধীরে লাভবান হয়ে উঠতে থাকেন যতক্ষণ না তারা ফারুখশিয়ারকে সিংহাসনচ্যুত করে তাদের নিজেদের কোনো ব্যক্তিকে মসনদে বসাতে সক্ষম হন। সমস্ত রাজকার্যই এই দ্বন্দের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে যাতে করে জায়গিরদারি প্রথার সংকট আরও ঘনীভূত হয় এবং মুঘল সম্রাটের প্রতি অভিজাতদের আনুগত্যেও চিড় ধরে।

বাদশাহের প্রিয়পাত্ররা যখন ওয়াজিরের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ শুরু করে তখনই এই সংকটের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ‘মির জুমলার কথা ও সিলমোহর আনার কথা ও সিলমোহরের সমান মর্যাদাসম্পন্ন এই কথা ঘোষণা করে ফারুখশিয়ার মির জুমলাকে তার হয়ে সকল কাগজপত্রে সই করার বৈধতা প্রদান করেন। মির জুমলাও মনসব এবং পদোন্নতির বিষয়গুলি নিজেই দেখাশুনা করতে শুরু করেন এবং দিওয়ান-ই-উইজারাত অর্থাং ওয়াজিরের দস্তুরকে না জানিয়েই সেইসব অনুমোদনপত্রে বাদশাহের সিলমোহর দিতে আরম্ভ করেন, যেখানে এইসব বিষয়। ওয়াজিরের দপ্তরের মাধ্যমেই মীমাংসা হওয়া উচিত। এই ব্যবস্থা নিয়মবিধির বিরুদ্ধাচরণ তো ছিলই এছাড়া এর দ্বারা ওয়াজিরের আর্থিক ক্ষতিও হত, কেননা প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাপ্য পাঝিতোষিকের থেকে ওয়াজির বঞ্চিত হতেন। আর একটি কারণে অবস্থার আরও অবনতি হয়। আবদুল্লা খান প্রকৃত-প্রস্তাবে একজন। যযাদ্ধা ছিলেন। তাই তিনি প্রশাসনের সমস্ত বিষয় তার সহকারী রতনৰ্চাদের উপরে। ছেড়ে দিয়েছিলেন। রতনাদ অদক্ষ ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন উদ্ধত এবং অহংকারী নিজে ও নিজের প্রভু আবদুল্লা খানের জন্য কিছু উৎকোচ না নিয়ে তিনি কোনো কাজই করতেন না। মির জুমলা এই ধরনের অন্যায় কাজ করতেন না, এছাড়া তিনি চটপট কাজও করতেন।

আর-একটি যে বিষয় নিয়ে ফারুখশিয়ারের অভিযোগ ছিল তা হচ্ছে রতনচাঁদের জমি ইজারা দেওয়ার প্রবণতা এমনকি খাস জমিও ইজারায় দেওয়া হত। যখনই কোনো খাজনা আদায়কারী আমিল কর্মচারীকে চাকুরি দেওয়া হত তখনই রতনাদ তার সঙ্গে একটি লিখিত চুক্তি করে সেই অর্থ তার যেখানে সঞ্চিত, সেখান থেকে বা তার জামিনদারের কাছ থেকে আদায় করে নিতেন। প্রচলিত রীতি ও পরম্পরা অনুযায়ী ইজারা প্রথাকে চরম ক্ষতিকর বলা হয়ে থাকে এবং ফারুখশিয়ার এই প্রথাকে নিষিদ্ধ করে দেন। তবে জাহান্দার শাহর সময়ে ইজারা দেওয়া খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যা দেশের সাধারণ শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ারই একটি নিদর্শন। জমিদাররা রাজস্ব প্রদান স্থগিত রাখছিল, এছাড়া ফারুখশিয়ারের রাজত্বের প্রারম্ভে এক দুর্ভিক্ষে দিল্লির আশপাশের অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক সমসাময়িকের মতে ‘খাদ্যশস্যের অভাব এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।

মির জুমলা এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে ফারুখশিয়ারকে বোঝাবার চেষ্টা করতে থাকলেন যে সৈয়দরা এই উচ্চপদের অনুপযুক্ত এবং যতদিন তাদের হাতে প্রশাসন থাকবে ততদিন দেশে কোনো শান্তি বা সমৃদ্ধি আসবে না। তিনি আরও অভিযোগ করেন যে তারা একাধারে উদ্ধত ও আরামপ্রিয়। এবং বাদশাহের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করে সৈয়দরা তার সম্মান হানি করছেন।

সৈয়দদের ভয় দেখিয়ে তাদের স্বেচ্ছায় দায়িত্ব থেকে অবসর নিতে বাধ্য করার জন্য ফারুখশিয়ার তার প্রিয়জন মির জুমলা এবং খান-ই-দুরানের সামরিক শক্তি বর্ধিত করতে শুরু করলেন। তাদের কয়েকজন আত্মীয়কেও সামনে আনা হল এবং তাদের প্রত্যেকের হাতেই ১০,০০০-এর থেকে বেশি সৈন্য ছিল।

মাড়ওয়াড় থেকে ফিরে এসে হোসেন আলি এই অবস্থার সম্মুখীন হলেন। যথাযথ শলা-পরামর্শ করে সৈয়দ ভাইয়েরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে অতি গুরুত্বপূর্ণ সুবার একটিকে অন্তত সম্পূর্ণ নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসতে না পারলে তারা দরবারে নিজেদের অবস্থা সুরক্ষিত করতে পারবেন না। তাই হোসেন আলি নিজাম-উল-মুলকের পরিবর্তে দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধির পদটি দাবি এবং অধিকারও করে নেন। তার উদ্দেশ্য ছিল জুলফিকার খানের পূর্ব পরিকল্পনার একজন সহকারীকে নির্বাচিত করে নিজে মুঘল দরবারে যোগ দেওয়া। ফারুখশিয়ার এবং তার প্রিয়পাত্রেরা সঠিক ভাবেই আপত্তি করেন যে ওয়াজির, মির বকশি এবং দাক্ষিণাত্যের রাজ্যপাল, এই তিনটি অত্যন্ত শক্তিশালী পদ একজনেরই হাতে থাকলে তা হয়ে উঠবে অত্যন্ত অবাঞ্ছনীয় এবং বিপজ্জনক। তাই ফারুখশিয়ার হোসেন আলিকে নিজেই দাক্ষিণাত্যে যাবার আদেশ দেন। এছাড়া অজিত সিংহকে গুজরাটের প্রশাসকের নিয়োগপত্রটিও তিনি প্রকাশ করতে বিলম্ব করেন।

এ ব্যাপারে একটি সংকট দেখা ছিল। বাদশাহের সমর্থকদের আক্রমণের ভয়ে ভীত হয়ে সৈয়দরা তাদের গৃহে আশ্রয় নেন, এবং উভয় পক্ষেই যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। মির জুমলা ও খান-ই দৌরান কিন্তু শেষ পর্যন্ত সৈয়দের সঙ্গে অস্ত্র পরীক্ষায় পশ্চাদপদ হলেন, কেননা এক তৎকালীন পর্যবেক্ষকের কথায় তারা ছিলেন কেবল ঘরকুনো তালপাতার সেপাই, আসল যোদ্ধা নন। দ্বিতীয় বকশি এবং নিজাম-উল-মুলকের জ্ঞাতি ভাই এম. আমিনকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হল। আমিন রাজি হলেন কিন্তু পুরস্কারস্বরূপ ওয়াজিরের পদের দাবি করে। বাদশাহ এবং তাঁর অনুগামীরা বুঝলেন যে এর পরে তাকে সরিয়ে দেওয়া বিশেষ কঠিন হয়ে উঠবে। তবে শেষ পর্যন্ত বাদশাহের মাতার মধ্যস্থতায় একটি মীমাংসা সূত্র খুঁজে পাওয়া গেল। স্থির করা হল যে হোসেন আলি দাক্ষিণাত্যে গিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে প্রশাসনের দায়িত্ব নেবেন। মির জুমলা, যাকে বিহারের এবং সম্ভবত বাংলার রাজ্যপালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তিনি ব্যক্তিগত ভাবে সেই প্রদেশের দায়িত্ব পালন করবেন। সৈয়দরাও এতে সম্মত হন যে বাদশাহের অন্যতম পছন্দের মানুষ খান-ই-দৌরানকে মির বকশির কার্য সম্পাদন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৭১৪ সালের মে মাসের মাঝামাঝি হুসেন আলি দাক্ষিণাত্যের দিকে রওনা হলেন। দাক্ষিণাত্যে জায়গিরদার এবং আমলাদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করা এবং দুর্গের অধিনায়কদের বদলি করার অধিকারও তিনি সঙ্গে নিয়ে গেলেন। এই সমস্ত ক্ষমতাই আগে বাদশাহের বিশেষ অধিকার রূপে আগ্রহের সঙ্গে তিনি রক্ষা করে চলতেন। এই সমস্ত রাজকীয় অধিকার স্থানান্তরিত হয়ে দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধিতে যে বর্তাল, এটিকেও বাদশাহের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার প্রথম পদক্ষেপ বলা যায়।

হোসেন আলির প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই ফারুখশিয়ার গুজরাটের তৎকালীন প্রশাসক দাউদ খান পান্নিকে বুরহানপুরে স্থানান্তরিত করে তাকে আদেশ দেন হোসেন আলিকে প্রতিহত করতে। দাউদ খান দ্রুতগতিতে সৈন্য নিয়ে বুরহানপুরে পৌঁছে যুদ্ধক্ষেত্রে হোসেন আলির মুখোমুখি হলেন। হোসেন আলি সহজেই জয়লাভ করে দাউদ খানের নিকট থেকে তাকে গোপনে পাঠানো ফারুখশিয়ারের পত্রগুলি উদ্ধার। করলেন। এই পত্রগুলি সৈয়দদের কাছে তাদের অধিকর্তার প্রতারণার আরও একটি নিদর্শন হয়ে থাকল।

শেষ সংকট এবং ফারুখশিয়ারের পদচ্যুতি

এইভাবে প্রথম শক্তি পরীক্ষায় কোনো ফলাফল হয় না। এটিই একমাত্র বলা যেতে পারে যে এতে সৈয়দরা তাদের দুর্বলতা সম্বন্ধে আরও ওয়াকিবহাল হয়ে ওঠে এবং যাতে করে যেভাবে হোক তারা সঙ্গী জোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফারুখশিয়ার প্রাচীন অভিজাতদের দিকে নজর দেন। বিশেষ করে এম. আমিন খান, নিজাম-উল-মুলক এবং তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের জোটের প্রতি। তিনি অজিত সিংহ, জয় সিংহ এবং মহারানা দ্বিতীয় সংগ্রাম সিংহকে ও তার দিকে নিয়ে আসতে চান। এইভাবে জয় সিংহের নিদর্শন দেখে বানসওয়ারা, দুঙ্গারপুর ইত্যাদিরাও রানার অধিনায়কত্ব মেনে নেয়। তার মাতাকে গড় মুক্তেশ্বরে তীর্থ যাত্রার সহায়তা করবার জন্য রানা ফারুখশিয়ারের অনুমতি প্রার্থনা করলে রানা একটি সৌজন্যপূর্ণ ফরমান বা আদেশপত্র জারি করে মহারানার মাতার সুগম যাত্রার ব্যবস্থা করে দেন। রানাকে অন্যান্য কিছু সুবিধাও দেওয়া হয়েছিল।

যদিও সৈয়দদের সুপারিশেই জয় সিংহকে মালওয়ারের প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়, তাহলেও তিনি কিন্তু নিশ্চিতভাবেই সৈয়দদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। কোটা ও বুন্দি এই দুই রাজ্যের লড়াইয়ে, সৈয়দা হস্তক্ষেপ করে বুধ সিংহ-এর বিরুদ্ধে যান, যে বুধ সিংহ জয় সিংহ-এর জামাতা ও শিষ্য ছিলেন। দুই পক্ষের সম্পর্কের অবনতির অবশ্যই এটি একটি কারণ। দ্বিতীয় কারণ হিসাবে চূড়ামন জাঠের পক্ষে সৈয়দদের সমর্থনকে উল্লেখ করা যায়। চুড়ামন জাঠ আম্বের সীমান্তে একটি রাজশাসিত রাজ্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল অথচ সেই ভূখণ্ডের উপর জয় সিংহ-এরও দৃষ্টি পড়েছিল। ১৭১৪ সালে মারাঠাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য বিজয় লাভের পরে জয় সিংহ-এর উচ্চাশাও হয়ে উঠেছিল ক্রমবর্ধমান। তিনি মারাঠাদের প্রচুর ক্ষতিসাধন করে তাদের নর্মদার ওপারে পাঠিয়ে দেন। এছাড়া পরম্পরা অনুযায়ী তিনি সরাসরি বাদশাহের সঙ্গেই রাজকার্য সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন, তার উজিরের সঙ্গে নয়। ১৭১৬ সালের মধ্যভাগে ফারুখশিয়ারের কাছ থেকে বারবার জরুরি আহ্বান পেয়ে জয় সিংহ দরবারে এসে উপস্থিত হন। প্রথমে বুন্দি থেকে ভীম সিংহকে বিতাড়ন করে হৃত আসনে বুধ সিংহকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর পর জয় সিংহকে জাঠেদের বিরুদ্ধে একটি অভিযানের নেতৃত্ব দিতে বলা হয়। এই সমস্ত বিষয়ে কিন্তু আবদুল্লা খানের সঙ্গে কোনো আলোচনাও করা হয়নি।

ইতিমধ্যে অভ্যন্তরীণ সংকট আরও ঘনীভূত হয়। ইনায়েত উল্লা খান কাশ্মীরি, যিনি ঔরঙ্গজেবের অধীনে কাজ করেছিলেন এবং ফারুখশিয়ারের রাজত্বকালের প্রথম দিকে তাঁর পুত্র সাদুল্লা খানের মৃত্যুদণ্ডের পরে মক্কায় চলে গিয়েছিলেন তিনি আবার ফিরে আসেন। ফারুখশিয়ার প্রাচীন অভিজাতদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে প্রয়াসী হওয়ায় তাকে তান অর্থাৎ বেতন এবং খাস জমি বা খালিসার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। কিছুদিন ইনায়াতুল্লা খান ওয়াজির আবদুল্লাহ খানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার পর। তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ইনায়াতুল্লা খান মক্কার শরিফের কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠি তার সঙ্গে নিয়ে আসেন যাতে লেখা ছিল অমুসলমানদের উপর জিজিয়া কর আরোপ বাধ্যতামূলক। সুতরাং তার অনুরোধে জিজিয়া কর আবার প্রবর্তিত হয়, এতে অবশ্য আবদুল্লা খান বিশেষ অসন্তুষ্ট হন।

ইনায়তুল্লা খান-এর পরে জায়গিরের সমস্যা নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। যে। বিষয়ে খানজাদা বা প্রাচীন অভিজাতদের (খান) পুত্রদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। তিনি জায়গিরগুলির বেতন এবং জায়গির থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশের খুঁটিনাটি হিসাব রাখতে শুরু করলেন এবং যারা গায়ের জোর বা ছলচাতুরী করে নিজেদের যোগ্যতার থেকে অনেক অতিরিক্ত মনসব আদায় করেছিল এবং সবথেকে উর্বর জায়গিরগুলিও আয়ত্ত করেছিল সেগুলি তিনি বাতিল করার প্রস্তাব দেন। এগুলির মালিকদের তিনি হিন্দু, হিজড়া এবৎ কাশ্মীরি’ এবং দিওয়ানি, বকশি বা খান সামানী যাদের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট হোক না কেন, অত্যন্ত নিম্নশ্রেণির মানুষ বলে গণ্য করেন। সমসাময়িক ঐতিহাসিক কাফি খান এবং মির্জা মুহম্মদের মতে এর ফলে অন্যদের দেবার মতো জায়গিরের অভাব দেখা যায় এবং প্রাচীন অভিজাত শ্রেণির ব্যক্তিদের ধূলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়।

ঔরঙ্গজেবের রাজত্ব কালের শেষ দিকেও জায়গিরের সমস্যা এবং খানজাদাদের অভিযোগ বিশেষ ভাবে চোখে পড়ে এবং এই অবস্থা কিন্তু নিশ্চিত ভাবে আরও খারাপ হতে থাকে, যা আমরা আগেই দেখেছি। সেইসব রাজসভার পারস্পরিক অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসংবাদ ও এই জায়গির মঞ্জুর করার বিষয়টিকে নিয়েই বেড়ে ওঠে। বিশেষ করে উৎপাদনশীল জায়গিরগুলিই ছিল এই অন্তর্কলহের মূল কারণ।

যেহেতু রতনৰ্চাদের পিছনে প্রশাসনের সহকারী পর্যায়ের আধিকারিকদের এবং হিন্দুস্থানিদের, অর্থাৎ ইরানি, তুরানি ও প্রাচীন অভিজাতদের বাদ দিয়ে সমর্থন ছিল, তাই তিনি এই সকল সংস্কারের বিরোধিতা করেন এবং তার কথামতো আবদুল্লা খান এইগুলি কার্যকরী করতে অস্বীকার করেন। ( ইতিমধ্যে চোদ্দো মাস ধরে জাটেদের শক্ত ঘাঁটি টুন অবরোধ করে রেখেও জয় সিংহ সরাসরি জয় লাভ করতে সক্ষম হয়নি। তখন জয় সিংহকে উপেক্ষা করেই আবদুল্লা খান জাট নেতা চুড়ামনের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। এই চুক্তি-মতে জাট নেতা রাজ্যকে নগদে এবং বস্তুসামগ্রীতে ৫০ লক্ষ টাকা দিতে এবং ওয়াজিরকে ২০ লক্ষ টাকা ব্যক্তিগত উপঢৌকন হিসাবে দিতে সম্মত হন। এছাড়া চুড়ামন টুন, ডিগ ইত্যাদি কয়েকটি শক্ত ঘাটিও মুঘলদের সমর্পণ করেন। বিনিময়ে তার মনসব এবং অনেক অঞ্চলের উপর তার আধিপত্যও কোনো কিছু না বলেই, অর্থাৎ কার্যত মেনে নেওয়া হয়।

তবে চুড়ামনের সঙ্গে এই চুক্তিতে সৈয়দদের কতটা সুবিধা হয়েছিল তা নিয়ে সন্দেহ আছে। পরে তারা বুঝতে পেয়েছিলেন যে চুড়ামন কেবল এক সুসময়ের বন্ধু চরিত্রের ব্যক্তি। লাহোরে চুড়ামন আজিম-উশ-শানের সহযোগী ছিলেন, কিন্তু তার, কাজ ছিল কেবল লুটপাট করা। আগ্রাতে তিনি ছিলেন জাহান্দার শাহের দলভুক্ত। কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল তার বিপক্ষে যাচ্ছে দেখলেই তিনিই সর্বপ্রথম লুণ্ঠন শুরু করেন। এ ছাড়া এই চুক্তির ফলে জয় সিংহ-এর মনে হয় তাকে বোধ হয় প্রতারণা করে সাফল্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এর অর্থ ছিল যে তার সঙ্গে সৈয়দদের সম্পর্কের এক নিশ্চিত চিড় ধরা। সৈয়দরা অনুতাপ করে পরে এই সম্পর্কের ভেদ মেরামত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতে বিশেষ ফল হয়নি। কিন্তু শাহুর সঙ্গে। হোসেন আলির চুক্তির ফলে সৈয়দরা যথেষ্ট সুবিধা লাভ করেছিলেন। দাক্ষিণাত্যে পৌঁছানোর পরেই নিজাম-উল-মুলকের যুক্তি অনুসারেই হোসেন আলি, দাউদ খান পনি যে থোক টাকার মারাঠাদের একসঙ্গে চৌথ ও সরদেশমুখী দিয়ে দেবার যে চুক্তি করেছিলেন, তা অস্বীকার করেন। এর ফলে মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ আবার শুরু হয়ে গেল। মারাঠারা যেখানে-সেখানে সর্বত্রই আবির্ভূত হতে থাকল। এবং সকল স্থানেই লুণ্ঠনে ও ধ্বংসে প্রবৃত্ত হল। প্রতিটি পরগনাতেই মারাঠারা মাটির কেল্লা। (গড়িস) তৈরি করেছেন এবং চাপে পড়লেই তারা পালিয়ে এই সকল কেল্লায় আশ্রয় নিত। রাজশক্তির পক্ষে এই গঢ়িগুলি ধ্বংস করা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। আবার ফারুখশিয়ারের গোপন বিরোধিতার জন্যই বিষয়টি আরও জটিল হয়ে ওঠে, তিনি হোসেন আলির বিরোধিতা করবার জন্য শাহুকে এবং কর্ণাটকের জমিদার দেওয়ানদের পত্র লেখেন। এর ফলে বিজাপুর, হায়দরাবাদ এবং কর্ণাটকে হোসেন আলির কর্তৃত্ব প্রায় শূন্য হয়ে উঠেছিল’ (কাফি খান)।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৭১৭-র মধ্যকালে হোসেন আলি শংকরজী মালহারের মাধ্যমে শাহুর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেন। শংকরজী মালহার শিবাজির অধীনে কাজ করেছেন এবং রাজারাম-এর অধীনে একজন সচিব ছিলেন ও বেনারসে স্থিত হয়ে বসবার পরে দিল্লিতে হোসেন আলির সঙ্গে যোগদান করেন। দীর্ঘদিন ব্যাপী আলোচনা ও দরকষাকষির পর ১৭১৮ সালে একটি চুক্তি রচিত হয়, যার ফলে শাহুকে নিজের প্রতিনিধির মাধ্যমেই সমগ্র দাক্ষিণাত্যের চৌথ ও সরদেশমুখী আদায় করার অধিকার দেওয়া হয়। তাকে শিবাজির স্বরাজ্যও প্রদান করা হয় এবং বেরার, গণ্ডোয়ানা এবং কর্ণাটকেও মারাঠাদের বিজিত অঞ্চলকে তারই সম্পদ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিনিময়ে শাহু দশ লক্ষ টাকার পেশকাশ, (অধীনস্থ শাসনের দ্বারা প্রদত্ত নজরানা বা দক্ষিণা) এবং দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধির কর্তৃত্বাধীনে ১৫,০০০ অশ্বারোহী দল মোতায়েন করা ছাড়াও দেশকে জনবহুল ও সমৃদ্ধ করে তুলতে এবং অনিষ্টকারীদের শাস্তি দিতে সম্মত হন। আবার সরদেশমুখীর অধিকার প্রদানের বিনিময়ে শাহ বাধ্যতামূলক দর্শনী হিসাবে এক কোটিরও অধিক অর্থ দিতে সম্মত হন।

হোসেন আলি বাদশাহের অনুমতি না নিয়েই শাহুকে এই চুক্তি অনুযায়ী সনদ বা আদেশপত্র লিখে দেন। তার নিকট এই বিষয়টি উপস্থাপন করলে ফারুখশিয়ার এই চুক্তিটি অসিদ্ধ বলে বাতিল করে বলেন রাজস্ব এবং প্রশাসনের বিষয়ে ঘৃণিত শত্রুরা (মারাঠারা) কর্তৃত্বধারী অংশীদার হয়ে উঠবেন এ কখনোই কাম্য নয়।

এই আপত্তি অবশ্য বৈধ ছিল, কিন্তু তার তৎকালীন ওয়াজির এবং মির বকশির বিরুদ্ধে নানা রকম চক্রান্ত করে ফারুখশিয়ার নিজেই এই বিপদ ডেকে এনেছিলেন। হোসেন আলিকে তার বিরুদ্ধে অভিযান থেকে বিরত রাখার জন্য ফারুখশিয়ার কয়েকটি বেপরোয়া পদক্ষেপ নেন। নিজাম-উল-মুলক-এর জ্ঞাতি ভ্রাতা এবং একজন তুরানি প্রধান এম.আমিনকে মালওয়াতে নিয়োগ করা হয় জয় সিংহকে সাহায্য করে অত্যাচারীদের প্রতিহত করতে। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে হোসেন আলির দিল্লি অভিযানের পথ রূদ্ধ করতে। তবে হোসেন আলির সঙ্গে চুক্তি সত্ত্বেও বুরহামপুরে এমন কয়েকটি চাকুরি দেওয়া হয় যার ফলে ওই অঞ্চলের উপর হোসেন আলির কর্তৃত্ব খর্ব হয়। তারপর তিনি তার দরবারে অজিত সিংহ নিজাম-উল-মুলক এবং সরবুলান্দ খানকে ডেকে পাঠান। সরবুলান্দ খান সম্রাটের মাতুল, বিহারের প্রশাসক এবং একজন খ্যাতনামা যোদ্ধাও ছিলেন। এই প্রাচীন অভিজাতদের বলা হয়েছিল অনুগামীদের এক বিশাল দল’ সঙ্গে নিয়ে আসতে। হিসাব করে দেখা গেছে যে রাজা, অভিজাতবর্গ এবং বাদশাহের ওয়ালাশাহী অর্থাৎ ব্যক্তিগত অনুগামীদের মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল ৭০ থেকে ৮০,০০০ অশ্বারোহী। যখনই বাদশাহ শিকারে যেতেন, গুজব শোনা যেত যে এই সময়েই আবদুল্লার উপর আক্রমণ নেমে আসবে। এবং আবদুল্লাও তার নিজস্ব। সৈন্য সংখ্যা নিরন্তর বাড়াতে থাকেন। কিন্তু বরাহা এবং অ-বরাহাদের ধরেও তাঁর সৈন্যসংখ্যা ছিল ১৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ জন। সুতরাং তার জোটশক্তি বজায় রাখতে পারলেই ফারুখশিয়ার ওয়াজিরকে বিতাড়িত করতে পারতেন। তবে ফারুখশিয়ারের কৃপণতা ও অদূরদর্শীতার জন্য তা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু তার আরও একটি চিন্তা ছিল যে এইসব শক্তিশালী অভিজাতদের সাহায্যে যদি তিনি সৈয়দদের বহিষ্কারও করেন, তাহলে পরবর্তীকালে এদের সরিয়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তাই ফারুখশিয়ার ওয়াজিরের জন্য তার একজন সদ্য উস্থিত প্রিয়পাত্র মুহম্মদ মুরাদ কাশ্মীরিকে নির্বাচন করেন। তাঁকে অতি দ্রুত। ৭০০০/৭০০০-এর মনসবের সম্মান দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে গুজরাট, দিল্লি ও আগ্রাতে শ্রেষ্ঠ জায়গিরগুলিও তাকে পুরস্কার দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে তার পুরাতন প্রিয়পাত্র মির জুমলা এবং খান-ই-দৌরানকে পরিত্যাগ করা হয়েছে। মির জুমলা বিহারে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ফল হয়ে বাদশাহের অনুমতি না নিয়েই দিল্লি চলে এসেছিলেন। কারণ তিনি তার সৈন্যদের বেতন দিয়ে উঠতে পারেননি এবং তার প্রদেশের বিদ্রোহী জমিদারদেরও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। ফারুখশিয়ার তর মনসব এবং জায়গিরগুলি বাজেয়াপ্ত করে নেন এবং আবদুল্লা খানের মধ্যস্থতার ফলেই পরে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আবদুল্লা খানের পৃষ্ঠপোষকতায় তাকে লাহোরের সদর পদে নিয়োগ করা হয়। শোনা যায় যে খান-ই-দুরান গোপনে সৈয়দদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে সম্রাটের সব কিছু গোপন পরিকল্পনার কথা তার কাছে। বলে দিতেন।

অল্পবয়সি বালকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিষয়ে মহম্মদ মুরাদের বদনাম ছিল। তার এই পদোন্নতির বিষয়ে প্রাচীন অভিজাতরা অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে ফারুখশিয়ারের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। ইতিমধ্যে নিজাম-উল-মুলক এবং সরবুলন্দ খানকে উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত করে আবদুল্লা খান তাদের নিজের পক্ষে নিয়ে অসেন। এমনকি অজিত সিংহ ও সম্রাটের সঙ্গ ত্যাগ করেন, কেননা অত্যাচারের দায়ে বাদশা তাকে গুজরাট থেকে সরিয়ে দেন। তাই দরবারে এসে অজিত সিংহ ওয়াজিরের পক্ষ নেন।

১৭১৮ সালের শেষ দিকে, হুসেন আলি পেশোয়া বালাজী বিশ্বনাথের অধিনায়কত্বে ১০,০০০ মারাঠি সৈন্য সহযোগে যখন ঔরঙ্গাবাদ থেকে দিল্লির দিকে রওনা হলেন–তখন জয় সিংহ-এর সমর্থন ব্যতীত ফারুখশিয়ার সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। উপরন্তু এর ফলে চীন দলের তুরানি অভিজাতদের তৈমুরের রক্ষাকর্তা হিসাবে উত্থান ঘটে, হুসেন আলির দিল্লি আগমনের কারণ ছিল শাহুর থেকে প্রাপ্ত যুবরাজ আকবরের এক (কাল্পনিক) পুত্রকে বাদশার নিকট সমর্পণ করা। ১ ফেব্রুয়ারি ১৭১৯ সালে ফারুখশিয়ারের পদচ্যুতি এবং কয়েক মাস পরে বন্দিদশায়

তার প্রাণনাশের বিষয়ে আমাদের বিশদ বর্ণনায় যাবার প্রয়োজন নেই। এই সিংহাসন। চ্যুতির ব্যাপারে এম. আমিন খান ও অজিত সিংহ আবদুল্লা খানকে সমর্থন দেন, এমনকি খান-ই-দৌরানও এর স্বপক্ষেই ছিলেন, অপরপক্ষে আবদুল্লা খানের মত অনুযায়ী–যেহেতু দুর্গটি এখন সম্পূর্ণ সৈয়দদের নিয়ন্ত্রণে, বাদশাহের ঘনিষ্ঠ প্রতিটি পদই তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের দ্বারা অধিকৃত, অথবা শীঘ্রই সেই মনোনীত জনের হাতেই তুলে দেওয়া হবে, সুতরাং আপাতত ফারুখশিয়ারকে সিংহাসনে বহাল রাখলে কোনো ক্ষতি নেই; কিন্তু শহরের জনমত উদভ্রান্ত ও চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধে ২০০০ জন মারাঠা সৈন্য নিহত হয় এবং বাকিরা শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। দিল্লি থেকে মাত্র ২০ কোশ (২৫ কি. মি) দূরে ২০,০০০ সৈন্য নিয়ে জয় সিংহ অবস্থান করেছিলেন এবং শহরের কিছু অভিজাত তার সঙ্গে মিলিত হলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে সৈয়দদের মনোনীত সদস্যদের তাদের দেয় সমস্ত পদগুলি বিতরণের বিষয়ে ফারুখশিয়ার বিলম্ব করছিলেন।

তবে সমস্যা যাই থাকুক না কেন, ফারুখশিয়ারের পদচ্যুতি এবং পরে তার হত্যাকাণ্ড, এই দুটি ভুল এবং অপরাধ থেকে সৈয়দরা কিছুতেই নিজেদের মুক্ত করতে পারেননি। আগে সৈয়দদের জীবন ও সম্মান রক্ষার জন্য একজন অকৃতজ্ঞ প্রভুর সঙ্গে সংগ্রামরত শৌর্যবান পুরুষ বলে শ্রদ্ধা করা হত, কিন্তু ফারুখশিয়ারের সিংহাসন চুতির পরে তাদের অত্যাচারী এবং বিশ্বাসঘাতক বা নিমকহারাম বলে তারা সকলের ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠলেন।

সৈয়দদের ‘নতুন’ ওয়াজিরত

ফারুখশিয়ারকে সরিয়ে দেবার পর সৈয়দরা ২০ বৎসর বয়স্ক রফি-উদ-দারজাতকে নূতন সম্রাটের পদে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু তিনি ক্ষয়রোগগ্রস্ত ছিলেন এবং কয়েকমাস পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। তার স্থলে তার ভাই রফি-উদ-দৌলাকে সিংহাসনে বসানো হলেও তিন মাস পরে একই রোগে তারও মৃত্যু হয়। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে সৈয়দ ভাইরা বেশিরভাগ রাজবংশীয় যুবরাজদের তার দেওয়া রাজসিংহাসনের। প্রস্তাবে সম্মত করতে ব্যর্থ হন। এই দুই রাজপুত্রের সাতমাস ব্যাপী রাজত্বকালে সৈয়দরা সকল পদের জন্যই তাদের মনোনীত প্রার্থীদের সংরক্ষিত করে রেখেছিল। যথা দিওয়ান-ই খাসের বা গোসলখানার (কলঘর) সংরক্ষক। বা হামামের (স্নানঘরের) অধ্যক্ষ ইত্যাদি। এমনকি শাসকদের নপুংসক কর্মী এবং ব্যক্তিগত ভৃত্যদেরও সৈয়দরা নিজ হাতে বাছাই করতেন। সৈয়দ হিম্মত খান বরাহাকে বাদশাহের তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হয় এবং কথিত আছে যে তার আদেশ না হলে বাদশাহকে খাদ্যও দেওয়া সম্ভব ছিল না এবং এইভাবে বাদশাহ তার সমস্ত ব্যক্তিগত স্বাধীনতাই হারিয়ে ফেলেছিলেন। বাহাদুর শাহর পৌত্র মুহম্মদ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করলে তাদের। বংশানুক্রমিক দ্বাররক্ষী এবং সহগামীদের তাদের পূর্ববর্তী পদে পুনরায় ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু রাজ্য শাসনের অন্য সব বিষয়ে সম্রাটের কোনো ক্ষমতাই ছিল না।

যে সমস্ত পদের মাধ্যমে সম্রাটের নিকটে যাওয়া যেতে পারে, সেগুলি ছাড়া। অন্যান্য বিষয়ে কিন্তু সৈয়দরা যথাসম্ভব কম পরিবর্তনই করতেন। তাই বেশিরভাগ প্রদেশেই পুরাতন রাজ্যপাল এবং আধিকারিকদের রেখে দেওয়া হয়েছিল। দরবারের মধ্যেও ফারুখশিয়ারের কয়েকজন কুখ্যাত বদনাম-গ্রস্ত প্রিয়পাত্র, যথা মুহম্মদ মুরাদ কাশ্মীরি এবং আর কয়েকজন ছাড়া, খান-ই-দৌরান এবং মির জুমলা সমেত আর প্রায় কাউকেই তাদের মনসব এবং জায়গির থেকে বঞ্চিত করা হয়নি ও তাদের কার্যে নিয়োগও করা হয়। সৈয়দরা সাধারণ ভাবে সরকারি উচ্চপদগুলির উপর একচেটিয়া অধিকার বিস্তারের চেষ্টাও করেননি। সুতরাং এম. আমিন খান দ্বিতীয় বকশির পদে কাজ করে যেতে থাকলেন, রোশন-উদ-দৌলা জাফর খান সমেত আরেকজন তুরানিকে তৃতীয় বকশির পদ দেওয়া হয়, এমনকি যার প্রস্তাবিত সংস্কারগুলি আবদুল্লা খানের ক্রোধের কারণ হয়ে উঠেছিল, সেই ইনায়াতউল্লা-খান ও তার খান-ই-সামান এবং কাশ্মীরের (অনুপস্থিত) প্রশাসকের পদগুলি অব্যাহত থাকল। ক্রমশ দাক্ষিণাত্যের ওয়াজির, মির বকশি এবং রাজপ্রতিনিধির পদগুলি সৈয়দরা তাদের অধিকারভুক্ত মনে করতেন। এছাড়া বরাহা বা সৈয়দদের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের একমাত্র যেসব নূতন পদে নিয়োগ করা হয়েছিল, সেগুলি হল আগ্রার এবং এলাহাবাদের মুখ্য প্রশাসক এবং মোরাদাবাদের ফৌজদারি–এর প্রত্যেকটিই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।

তাঁদের সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলার নীতির সাপেক্ষেও আগ্রা এবং এলাহাবাদে সৈয়দদের দুটি বিরোধী শক্তির কেন্দ্রের উদ্ভব হয়। আগ্রাতে মিত্র সেন নামে একজন দুঃসাহসী ভাগ্যান্বেষী এবং তার কয়েকজন সঙ্গী মিলে এক বিদ্রোহী রাজপুত্র নেকুশিয়ারকে সম্রাট ঘোষণা করলেন। এলাহাবাদে বিদ্রোহের নেতা ছিলেন। ফারুখশিয়ারের শিষ্য ছবিল রাম। নেকুশিয়ারই সকল বিরোধীদের একত্র হওয়ার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারেন বলে সৈয়দরা ভয় পেয়েছিলেন। এরপরে জোর গুজব শোনা গেল যে নিজাম-উল-মুলক যাকে মাড়ওয়ার প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়েছে তিনি ছবিল রাম এবং জয় সিংহ একত্রে নেকুশিয়ারের সাহায্যার্থে অগ্রসর হচ্ছেন। যাই হোক, তিনি প্রাচীন অভিজাতদের থেকে কোনোরকম সহযোগিতা পাননি এবং সৈয়দরা শীঘ্রই এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন। তবে এলাহাবাদের বিদ্রোহ আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত হাসানের সম্ভাব্য ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপের ভয়ে ছবিল রামের ভ্রাতুস্পুত্র গিরধার বাহাদুর দুর্গটি পরিত্যাগ করতে রাজি হন। তবে এর বিনিময়ে তিনি আওধের প্রধান প্রশাসনের পদ, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারি সহ সমস্ত জায়গির এবং নগদ ত্রিশ লাখ টাকা দাবি করেন। এইসব শর্তাবলী এবং এই দুইটি বিদ্রোহ দমনের জন্য চোদ্দো মাস সময় ব্যয় হওয়া, এগুলি সৈয়দদের শক্তি এবং সমর্থনের সীমাবদ্ধতার পরিচায়ক। আসলে তাদের অধস্তন রাজপুরুষদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও ক্ষমতা ছিল না এবং সৈয়দরা রাজধানী ছেড়ে আসতে কুণ্ঠিত ছিলেন।

সৈয়দরা রাজপুত এবং মারাঠাদের সঙ্গে তাদের জোটবদ্ধতাকে আরও শক্তিশালী করার এবং হিন্দুদের যথাসম্ভব খুশি রাখার পুরাতন নীতি অনুসরণ করে চলেন। ফারুখশিয়ারের পদচ্যুতির পরই জিজিয়া পুনর্বার রদ করে দেওয়া হয়, এবং এর কৃতিত্ব অবশ্য অজিত সিংহকেই দেওয়া হয়। আরেকটি শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসাবে অজিত সিংহ-এর যে কন্যা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ফারুখশিয়ারের পত্নীত্ব বরণ করেছিলেন, তাঁকে তাঁর নতুন ধর্ম পরিত্যাগ করে সকল ধনসম্পত্তি সহ তার গৃহে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেওয়া হয়। ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করা আইন-বিরুদ্ধ বলে কাজিরা এর যে প্রতিবাদ করেছিলেন, সৈয়দরা তা অগ্রাহ্য করেন।

অজিত সিংহ-এর মাধ্যমে সৈয়দরা জয় সিংহ এবং দ্বিতীয় সংগ্রাম সিংহকে জয় করে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। রানা এবং আম্বেরে আশ্রয় নেওয়া কিছু অসন্তুষ্ট অভিজাতের সাহায্যে জয় সিংহ এবার টোডা ভীম-এ এসে পৌঁছান। আগ্রা থেকে ২৫০ কি.মি দূরবর্তী টোডা ভীম থেকে তিনি অবস্থার পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। আগ্রার পতনের পরে তার নিজের অঞ্চল আক্রান্ত হতে পারে এই ভয়ে জয় সিংহ টোডা ভীম থেকে সরে যান। জয় সিংহকে খুশি করার জন্য তাকে গুজরাটের অন্তর্ভুক্ত সুরাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের ফৌজদারি প্রদান করা হয় এবং প্রচুর অর্থও দেওয়া হয়। অজিত সিংহকে গুজরাটের সঙ্গে আজমেরের সুবার প্রাপ্তি ঘটে। মেওয়ারের রানার সমর্থনে এই দুই রাজপুত রাজা মিলে এক শক্তিশালী মোর্চা গঠন করেন যারা একটি নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারতেন। কাফি খানের ‘অভিযোগ থেকেই বোঝা যায় যে হিন্দুদের আত্মবিশ্বাস ক্রমশ ফিরে আসছিল। সেখানে তিনি লিখছেন রাজধানীর পরিমণ্ডল থেকে নর্মদার তীর অবধি অবিশ্বাসীরা (অর্থাৎ হিন্দুরা) মন্দির মেরামত করতে এবং গো হত্যা বন্ধ করার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল।

নিয়মানুগভাবে বালাজী বিশ্বনাথনকে দাক্ষিণাত্যের চৌথ এবং সরদেশমুখী প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে মারাঠাদের সঙ্গে চুক্তি আরও মজবুত হয়ে ওঠে। এই চৌথ ও সরদেশমুখী বিশ্বনাথন, শাহুজীর পরিবারের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে একযোগে ভাগ করে নেন। যাঁরা বন্দিদশায় ছিলেন। উত্তরে কোনো মারাঠা সৈন্য না থাকলেও দাক্ষিণাত্যে হোসেন। আলির সহকারী আলম আলিকে সকল বিষয়ে শংকরজী মলহারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে বলা হয় যেহেতু শংকরজীর সঙ্গে শাহুজীর সম্পর্ক ছিল।

দিল্লি এবং গোয়ালিয়রের মধ্যকার রাজপথের দায়িত্ব পেয়ে চুড়ামন জাট খুশি হন, তবে এছাড়া তিনি অন্যান্য সুবিধাও পেয়েছিলেন। এর পরিবর্তে আগ্রা অবরোধ করার সময় চুড়ামন সৈয়দদের পাশে দাঁড়ান।

অভিজাতদের এক বৃহৎ অংশের অসন্তুষ্টি এবং তুরানিদের গোপন বিরোধিতা সত্ত্বেও সময় পেলে সৈয়দরা তাদের অবস্থাকে ভালো ভাবে গড়ে নিতে পারতেন। যদি দুই ভাইদের মধ্যে ক্ষমতা, রাজনীতি এবং অর্থ নিয়ে মতপার্থক্য না দেখা দিত, তাহলেও ‘দুই ভাইয়ের মধ্যে ফারুখশিয়ারের সিংহাসন চ্যুতির পরে দিল্লি কেল্লা থেকে পাওয়া লুণ্ঠিত দ্রব্য নিয়ে বিভেদ দেখা দিল। আসলে এইসব দ্রব্য একা আবদুল্লা খান এবং আগ্রার অনুমিত দুই থেকে তিন কোটি টাকা মূল্যের সম্পদের অধিকাংশই নেকুশিয়ারের পতনের পরে হুসেন আলিই করায়ত্ত করেন। তুরানি বিপদের কথা বলে রতন চাঁদ দুই পক্ষের মধ্যে একটা মিটমাট করে দিতে সক্ষম হন বটে, কিন্তু কেউই এতে সন্তুষ্ট হননি। এ ছাড়া ক্ষমতা অধিকারের জন্যও দুই ভাইয়ের মধ্যে এক প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্ব ছিল। আবদুল্লা খানের তুলনায় হুসেন আলি অনেক বেশি উদ্যমী ছিলেন এবং প্রকৃত শক্তির প্রদর্শনে তিনি শীঘ্র অপরজনকে অনেক পিছনে ফেলে দিলেন। কিন্তু হুসেন আলি ছিলেন এক মাথাগরম উদ্ধত চরিত্রের ছটফটে মানুষ এবং কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার আগে তিনি সবদিক ভালো করে খতিয়ে দেখতেন না। কাফি খান বলেছেন হুসেন আলি সামরিক এবং প্রশাসনিক ব্যাপারে নিজেকে তার ভাইয়ের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর ভাবতেন যদিও তিনি মূল বিষয়টি প্রায়ই মনে রাখতে পারতেন না এবং রণকৌশল ও কটনীতির সঙ্গেও তার বিশেষ পরিচয় ছিল না।

প্রাচীন অভিজাতদের গুরুত্ব সম্বন্ধে অবহিত থাকার জন্য আবদুল্লা খান এই সমবায়ের, বিশেষ করে নিজাম-উল-মুলক ও চিন গোষ্ঠীর প্রতি সমবায়ের বিশেষ নজর রাখতেন। তিনি বলতেন ‘আমার আসলে তিনটি ভাই, যাদের মধ্যে নিজাম-উল, মুলক সর্বজ্যেষ্ঠ এবং হুসেন আলি সর্বকনিষ্ঠ। নিজাম-উল-মুলককে লিখিত একটি পত্রে হুসেন আলি নিম্নলিখিত শব্দগুলিতে তার নীতির ব্যাখ্যা করেন। ‘হিন্দুস্থানের (ভারতবর্ষ) শাসনের মতো এক বিশাল এবং কঠিন কাজ কেউ একক ভাবে প্রসিদ্ধ অভিজাত এবং সুদক্ষ রাজপুরুষদের সাহায্য ছাড়া সম্পন্ন করতে পারেন না। এমতাবস্থায় আমার পক্ষে নূতন এবং অপরীক্ষিত ব্যক্তিদের এগিয়ে নিয়ে তাদের উপরই নির্ভর করা উচিত হবে, নাকি আপনার মতো কেউ, যিনি একসময় আমাদের বন্ধু ছিলেন, তারই উপর নির্ভর করা সমীচীন হবে? তবে নিজাম উল-মুলক যাতে অতি শক্তিশালী না হয়ে ওঠেন সেইজন্য তিনি তাকে বিহারের মুখ্য প্রশাসক পদে নিয়োগ করতে চান। কেননা বিহারে জমিদাররা ছিলেন কুখ্যাত ও উপদ্রব সৃষ্টিকারী এবং সেই প্রদেশ থেকে অর্থ আয়ও ছিল অত্যল্প। কিন্তু হুসেন আলি দাক্ষিণাত্যে তার উপপ্রধান এস. আলম আলির উত্তর ভারতে তাঁর নিজের অবস্থান নিয়ে এত সুনিশ্চিত ছিলেন যে, তিনি নিজাম-উল-মুলককে মালওয়াতে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেন। তার কাছ থেকে এই দায়িত্ব শীঘ্র ফিরিয়ে নেওয়া হবে না এই প্রতিজ্ঞার ভিত্তিতেই নিজাম প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। এ ছাড়া সৈয়দ হুসেন আলি বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি তাঁর পুত্রকে তার ওয়াকিল (মুখপত্র) হিসাবে দরবারে রেখে যেতে সম্মত হননি। মালওয়া যাত্রাকালীন তিনি তার সঙ্গে এক হাজারেরও বেশি মনসবদারদের সঙ্গে নিয়ে যান যাঁদের সঙ্গে তাঁদের পরিবারবর্গও গিয়েছিলেন।

সুতরাং নিজাম-উল-মুলকের নেতৃত্বাধীন চিন গোষ্ঠী এবং সৈয়দদের মধ্যে এক শক্তির পরীক্ষা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। হোসেন আলি নিজামকে মালওয়া থেকে সরিয়ে নিয়ে তাঁকে আগ্রা, এলাহাবাদ, বুরহানপুর বা লাহোর, এর থেকে পছন্দসই কোনো একটিকে বেছে নিতে বলায় সমস্যা আরও জটিলতর হয়ে ওঠে। সৈয়দরা এ খবর পাচ্ছিলেন যে প্রশাসকের যা প্রয়োজন, নিজাম তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণে সৈন্য এবং যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম সংগ্রহ করেছিলেন এবং তার নজর ছিল দাক্ষিণাত্যের দিকে। নিজাম এর উত্তরে বলেন যে ৫০,০০০ অশ্বারোহী নিয়ে মারাঠারা এই প্রদেশটি লুণ্ঠন করে চলেছিলেন এবং তাদের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই তিনি এই সাজসরঞ্জাম সংগ্রহ করছিলেন। এই উত্তরে অসন্তুষ্ট হয়ে হুসেন আলি তাঁর বকশি এস. দিলওয়ার আলি, যাকে তিনি কোটা বুন্দিতে একটি বিবাদের নিষ্পত্তি করার জন্য এক বিশাল সৈন্যদল দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, তাঁকে এবার মালওয়া সীমান্তে নজর রাখতে বললেন। নিজামকে মালওয়া থেকৈ বদলির আদেশ পাঠাবার পরই দিলওয়ার আলিকে প্রস্তুত থাকতে বলা হল এবং এস. আলম আলিকে দাক্ষিণাত্যে সতর্ক থাকার আদেশ দিয়ে পত্র পাঠানো হল। এই সমস্ত সাবধানতা অবলম্বন করার পর সৈয়দেরা নিজাম-উল-মুলককে দরবারে নিয়ে আসার জন্য একজন আসা-সোঁটা (রাজদণ্ড) ধারীকে পাঠালেন।

নিজামকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করার ব্যাপারে সৈয়দেরা নিঃসন্দেহে নিজেদের ক্ষমতা সম্বন্ধে অতিরিক্ত বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। নিজামের জ্ঞাতি ভ্রাতা এম. আমিন তাঁকে খবর দেন যে এলাহাবাদে গিরধর বাহাদুরের বিদ্রোহ সমাপনান্তে সৈয়দরা তার বিরুদ্ধে অভিযানের পরিকল্পনা করছেন। তিনি আবার বাদশাহ এবং তাঁর মাতার নিকট থেকেও সৈয়দদের নাগপাশ থেকে তাদের মুক্ত করার অনুরোধও পেয়েছিলেন তাই নিজাম-উল-মুলকও পুরোপুরি তৈরি হয়ে ওঠেন। তিনি দরবারে যাবার আহ্বান অগ্রাহ্য করে নর্মদা পার হয়ে দাক্ষিণাত্যে প্রবেশ করেন, যেখানে খান্দেশ ও বেরারের প্রশাসকরা তখনই তার সঙ্গে যোগ দেন। আরও অনেক অভিজাতই নিজাম-উল মুলকের উপরেই তাদের ভাগ্য সমর্পণ করলেন, যাদের মধ্যে সৈয়দদের ঘনিষ্ঠ অনেক বড়োমানুষও ছিলেন। নিজাম অত্যন্ত অধ্যবসায়ের সঙ্গে একথা প্রচার করতে থাকলেন যে তিনি যা কিছু করছেন তা শুধু রাজবংশের সম্মানের জন্যই করছেন, যেহেতু সৈয়দরা তৈমুরের বংশমর্যাদাকে ধ্বংস করতে উদ্যোগী হয়েছেন। নিজাম আরও প্রচার করতে থাকেন যে সৈয়দরা তার থেকে শুরু করে সমস্ত ইরানি এবং তুরানি অভিজাত পরিবারকে অপমান ও ধ্বংস করতে মনস্থ করেছেন। আর সৈয়দরা হিন্দুদের সঙ্গে জোট করে এমন সব নীতি অনুসরণ করছেন যা ইসলাম-বিরোধী এবং সাম্রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

সুতরাং নিজাম রাজবংশ, ধর্ম এবং রাজ্যের রক্ষার্থে যে সমস্ত আওয়াজ তোলেন, সৈয়দদের পক্ষে সেগুলিকে খণ্ডন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। আবদুল্লা খান শেষ মুহূর্তে নিজামকে দাক্ষিণাত্যের মুখ্য প্রশাসকের পদে প্রতিষ্ঠিত করে নিজামের সঙ্গে সমঝোতার যে শেষ চেষ্টা করেছিলেন তা কার্যকরী হয়নি এবং হোসেন আলির নিকট তা গ্রহণযোগ্যও মনে হয়নি। এছাড়াও সৈয়দরা তাদের সৈন্যদলকে দ্বিধাবিভক্ত করার যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা আরও মারাত্মক ভাবে ক্ষতিকর ছিল। এর ফলে হোসেন আলি বাদশাহকে সঙ্গে নিয়ে দাক্ষিণাত্যের দিকে এক অভিযান শুরু করেন। এর পূর্বে আলম আলি বালাজী বিশ্বনাথের ১৫-১৬,০০০ মারাঠি সৈন্য সহ নিজামের মুখোমুখি হলে নিজাম তাকে পরাস্ত করেন এবং এরপর উত্তরের দিকে অভিযান করে দিলাওয়ার আলি খানকে পরাভূত করেন। কিন্তু নিজামের মুখোমুখি হবার পূর্বেই হায়দার কুলি খান (মির আতশ) এবং এম. আমিন খান ও তার সহযোগীদের সৃষ্ট এক ষড়যন্ত্রের ফলে হুসেন আলি খানকে হত্যা করা হয়। আবদুল্লা খানের আর একটি নূতন হাতে-গড়া প্রতিনিধি এবং একটি নুতন সৈন্যদল গড়ে তোলার প্রচেষ্টা বিফল হয় এবং এর পরে ১৭২০-র নভেম্বর মাসে দিল্লির নিকটে এম. আমিন খান এবং সম্রাট মুহম্মদ শাহর যৌথবাহিনীর নিকট আবদুল্লা পরাজিত হয়।

সুতরাং এইভাবেই সৈয়দদের নুতন ওয়াজিরত বা মন্ত্রিত্বের কাল শেষ হয় দু’বৎসর কাল পূর্ণ হবার পূর্বেই। সৈয়দরা অনেকগুলি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। যথা উইজারাৎ অথবা ওয়াজিরকেই সমস্ত কর্মের কেন্দ্রবিন্দু বলে প্রতিষ্ঠিত করা। এছাড়া তারা আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ-কর্মে ব্ৰতী হয়েছিলেন। তারা ধীরে ধীরে আকবরের সময়কার উদার মতাবলম্বী এবং সমন্বয় ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের দিকে অগ্রসর হবার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এটির ব্যর্থতার আংশিক কারণ ছিল বারাহাদের সংকীর্ণ সামাজিক ভিত্তি। কিন্তু অভিজাতদের মধ্যেকার গভীর বিভাজন এবং প্রাচীন অভিজাতদের মধ্যেকার প্রবল জাত্যাভিমান আরও অনেক অধিক মাত্রায় এই পদক্ষেপগুলিকে ব্যাহত করেছিল। এই প্রাচীন মুঘলরা মনে করতেন যে একমাত্র তাঁরাই এই রাজবংশের এবং রাজত্বের স্থিতিশীলতা সুনিশ্চিত করার দায়িত্বের অধিকারী। ঘৃণ্য হিন্দুস্থানিদের এই ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালনের অনুমতি কখনোই দেওয়া সম্ভব নয়। উর্বর এবং উৎপাদনশীল জায়গিরের ক্রমবর্ধমান অভাব এবং জমিদারদের ক্রমবর্ধমান অশান্তির জন্যই এই পারস্পরিক দলাদলি আরও বর্ধিত হয়। এছাড়া সৈয়দরা নিজেদের অন্তর্কলহ ছাড়াও আরও কয়েকটি ভুল করেছিল যার ফলে তাদের পতন ত্বরান্বিত হয়।

মুহম্মদ আমিন ও নিজাম-উল-মুলকের ওয়াজিরত

সৈয়দদের পতনের পর মহম্মদ আমিন খানকে ইমাদ-উদ-দৌল্লা উপাধি এবং ৮০০০/৮০০০ মনসব (দো-আপসা, সি-আপসা) ও মুলতানের অনুপস্থিত প্রশাসন নিযুক্ত করে ওয়াজিরের পদে নিযুক্ত করা হয়। তাঁর পুত্র কোয়ামারউদ্দিন খানকে দ্বিতীয় বকশি নিযুক্ত করা হয়। তাকে ৭০০০-এর মনসব এবং মোরাদাবাদের ফৌজদারির দায়িত্বও দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত মোরাদাবাদ আয়তনে একটি সুবার মতো বৃহৎ ছিল। তাকে গোসলখানার বা স্নানঘরের দারোগা বা রক্ষী পদও দেওয়া হয়, যার ফলে তিনি সম্রাটের নিকটে আসতে পারতেন। এছাড়া তাকে আহাদী অর্থাৎ ভদ্র অপেশাদারি সেনানীদের দারোগা পদে নিয়োগ করা হয়। খান-ই-দেওয়ান প্রধান বকশি হন এবং হুসেন, আলির বিরুদ্ধে অন্যতম চক্রান্তকারী সাদাত খানকে অওয়াধ-এর মুখ্য প্রশাসক পদে নিয়োগ করে পুরস্কৃত করা হয়। আবদুস সামাদের লাহোরের রাজ্যপালের পদ অক্ষুণ্ণ রেখে তার পুত্রকে কাশ্মীরের ভার দেওয়া হয়। মহম্মদ আমিন, সৈয়দরা যে উজিরকে সকল ক্ষমতার কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন, সেই নীতিই অনুসরণ করেন। এছাড়া সৈয়দদের মতো তিনিও রাজপুত, মারাঠা ও সাধারণভাবে হিন্দুদের সমর্থন লাভের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। সুতরাং মুহম্মদ আমিন খান বাদশাহের উপর ওয়াজিরের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করার কোনোপ্রকার ইচ্ছা দেখাননি। একজন সমসাময়িক ওয়ারিদের মতে মুহম্মদ শাহের রাজকার্যের একমাত্র অংশ ছিল সিংহাসনে বসা এবং মাথায় মুকুট দেওয়া। সম্রাট মহামন্ত্রীকে ভয় করতেন এবং তাকে সম্পূর্ণ সমর্থন দিতেন।

রাজা জয় সিংহ এবং রাজা গিরধর বাহাদুরের বিরোধিতার জন্য জিজিয়া কর । পুনরায় প্রবর্তন করার চেষ্টা পরিত্যক্ত হয়। দাক্ষিণাত্যের জন্য চৌথ ও সরদেশমুখীর যে অধিকার মারাঠাদের দেওয়া হয়েছিল, নতুন সনদ প্রকাশ করে সেটিকে বৈধতা দেওয়া হল। প্রকৃতপক্ষে সৈয়দদের পতনের অব্যবহিত পর নিজাম-উল-মুলক পেশোয়া বাজীরাও-এর সঙ্গে একটি গোপন মন্ত্রণায় এই সনদের বিষয়টি স্বীকার করেন। অজিত সিংহকে প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য গুজরাটের প্রশাসকের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। তবে ওয়াজির তাকে আবার গুজরাট বা আজমেরে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বলে সন্দেহ হয়।

মুহম্মদ আমিন খান অবশ্য এক বৎসর তিন মাস পরে ১৭২১ সালের জানুয়ারি মাসে মারা যান। এখন নিজাম-উল-মুলক-এর পক্ষে ওয়াজিরের পদ গ্রহণ করার পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। নিজাম-উল-মুলক অবশ্য ওয়াজিরের পদ গ্রহণ করতে কোনো ঔৎসুক্য দেখাননি। এমনকি এই বিষয়ে রাজার আদেশ পাওয়ার পরেও তিনি সেখানের ব্যবস্থা করবার জন্য আগে কর্ণাটকে যান। মহম্মদ আমিনের মৃত্যুর প্রায় এক বৎসর পরে ১৭২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিজাম দিল্লিতে এসে দেখেন যে প্রশাসনের অবস্থার প্রভূত অবনতি ঘটেছে এবং দরবারে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বিবাদ অবস্থাকে আরও সঙ্গীন করে তুলেছে। তবে শীঘ্রই প্রতীয়মান হয়ে উঠল যে নিজাম প্রকৃতপক্ষে দাক্ষিণাত্যের বিষয়েই বেশি উৎসাহী এবং সম্ভব হলে মালওয়াকে নিজের অধিকারে রাখা এবং গুজরাটকে তার সঙ্গে যুক্ত করার অভিপ্রায়ও তার ছিল। তাই তিনি তাঁর পুত্র গাজিউদ্দিন খানের হস্তে গুজরাটের শাসনভার তুলে দেন এবং তৎকালীন শাসক হায়দার কুলি খানকে বহিষ্কার করার জন্য এক বিশাল বাহিনী নিয়ে গুজরাটের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথে তার সঙ্গে মালওয়ারের নিকটে তার দ্বিতীয়বার বাজীরাও-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। প্রকৃতপক্ষে বাজীরাও একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মালওয়া আক্রমণ করেছিলেন। ইতিমধ্যে দাক্ষিণাত্যে নিজামের উপপ্রধান মুরাজির খান মারাঠাদের চৌথ এবং সরদেশমুখীর অধিকার দানের চুক্তিটি কার্যকরী করতে অঙ্গীকার করেন। নিজাম-উল-মুলক এবং বাজীরাওয়ের মধ্যকার গোপন চুক্তিটি এটিই প্রমাণ করে যে তার নিজের স্বার্থের জন্য নিজাম রাজপুত ও মারাঠাদের বিরুদ্ধে তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণের বিরুদ্ধেও যেতে পারেন, অর্থাৎ বন্ধুত্বও করতে পারেন।

গুজরাট থেকে হায়দার কুলিকে বহিষ্কার করে নিজাম আবার দিল্লি ফিরে এলেন। নিজাম এবার প্রশাসনে একটি নূতন সংস্কার বিধি প্রকাশ করেন। যার মুখ্য নীতি ছিল যে শারীরিকভাবে সুস্থ অভিজাত এবং সৈয়দদেরই রাজকর্মে নিয়োগ করা। যেমন, ঔরঙ্গজেবের সময়ে রীতি ছিল জায়গিরগুলি পুনর্বণ্টন করা হবে এবং জায়গিরে বাদশাহের খাসভূমি অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থাটি পুনরায় শুরু করা হবে। তিনি রাজার জমিতে কৃষিকার্য করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং উৎকোচ গ্রহণের কঠোর নিন্দা করেন। ঔরঙ্গজেবের সময়ের মতো তিনি জিজিয়া কর প্রথা পুনঃপ্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন।

প্রাচীন অভিজাতদের তার দিকে নিয়ে আসার জন্য নিজামের এইসব প্রচেষ্টা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। নূতন অভিজাতরা, যাদের মধ্যে অনেক হিন্দুস্থানিও ছিলেন–সকলেই জায়গিরের তৎকালীন অবস্থার কোনোরকম পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন। প্রসঙ্গত হিন্দুস্থানি অভিজাতরা এখন রাজ্যশাসন প্রক্রিয়ায় ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন। এই নূতন অভিজাতরা জিজিয়ার পুনস্থাপন করার বিরোধিতা করে এই পদক্ষেপটিকে সময়োপযোগী নয় বলে নিন্দা করেন। এমনকি নিজামের আত্মীয় লাহোরের প্রশাসক আবদুস সামাদ খানও জিজিয়া কর পুনর্বার আরোপ করার বিরোধী ছিলেন।

নিজাম-উল-মুলক তার সংস্কারগুলি প্রবর্তন করার বিষয়ে কতটা আন্তরিক ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। ১৭২৩ সালের শেষ দিকে তিনি হাওয়া বদলের জন্য তার মোরাদাবাদের জায়গিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, কিন্তু কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ মালব প্রদেশে মারাঠারা নূতন করে হানাদারি শুরু করেছে শুনে তিনি মালওয়ার অভিমুখ যাত্রা করেন।

মালব যাত্রাপথেই নিজাম-উল-মুলক সংবাদ পান যে দাক্ষিণাত্যের প্রমুখ রাজপ্রতিনিধির পদটি থেকে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেখানে তার সহকারী মুবারিজ খানকে নিয়োগ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাদশাহ, শাহু এবং অন্য কয়েকজন নেতৃস্থানীয় মারাঠাকেও নিজামের বিরুদ্ধে নিজের পক্ষে নিয়োগ করার চেষ্টা করেন।

১৭২৪ সালের অক্টোবর মাসে শকর খেরার যুদ্ধে বাজীরাও-এর মারাঠা সেনাদের সহায়তায় নিজাম-উল-মুলক মুরারিজ খানকে পরাজিত করেন। এই তারিখ থেকেই কার্যত হায়দরাবাদ স্বাধীনতা অর্জন করল এবং মুঘল সাম্রাজ্যের খণ্ডীকরণ প্রক্রিয়ারও সূত্রপাত হল। মুঘল বংশ এবং সাম্রাজ্যের রক্ষকগণ নিজেরাই সম্পূর্ণভাবে আবর্তিত হয়ে এই ধ্বংসের প্রধান কারণ রূপে আত্মপ্রকাশ করলেন।

আঞ্চলিক সাম্রাজ্যগুলির অভ্যুত্থান এবং ভারতে বিদেশি আক্রমণ (১৭২৫-৪৮)

নিজাম-উল-মুলকের দিল্লি থেকে বিদায় গ্রহণ এবং তার হায়দরাবাদে গিয়ে নিজেকে দাক্ষিণাত্যের অর্ধস্বাধীন অধিকর্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার পরবর্তী দশকে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণভুক্ত রাজত্বের দ্রুত সংকোচন ঘটতে থাকল। ১৭০৩ সাল থেকেই বাস্তবিক মুর্শিদ কুলি খানই বঙ্গদেশের শাসক ছিলেন। তাকে বঙ্গদেশ থেকে অপসারণের সব চেষ্টাই বিফল হয় এবং ১৭১০ সাল থেকেই বঙ্গদেশ এবং উড়িষ্যা তার শাসনাধীন ছিল এবং পরে বিহারকেও তার অধীনে নিয়ে আসা হয়। ১৭২৭ সালে তার জামাতা সুজাত খান তার স্থলাভিষিক্ত হন। ১৭২৩ সালে সাদাত খানকে আওয়াধের মুখ্য প্রশাসক রূপে নিয়োগ করা হয় এবং ১৭২৬ সালে মালওয়া যেতে অস্বীকার করে তিনি কার্যত স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৭৩৯ সালে তার জামাতা সফদার জঙ্গ তার উত্তরাধিকারী হন। ১৭১৩ সালে পাঞ্জাবে আবদুস সামাদ খান। রাজ্যপাল নিযুক্ত হন এবং পরে তাঁর পুত্র জাকারিয়া খান শাসনভার গ্রহণ করেন।

এই সকল নূতন রাজ্যের উদ্ভবের ফলে মুঘল সাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেলেও তাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিন্তু ব্যাহত হয়নি, কারণ যাঁরা এইসব। দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তারা সকলেই ছিলেন অত্যন্ত সক্ষম এবং ব্যতিক্রমী দক্ষতার অধিকারী–এবং তারা তাঁদের অঞ্চলগুলির সামগ্রিক ভাবে সুশাসন প্রদান করার যোগ্য ছিলেন। তারা আবার বাদশাহের প্রতি প্রথাসিদ্ধ ভাবে লৌকিকতার জন্য আনুগত্য জানিয়ে এবং উপহার উপঢৌকনের মাধ্যমে বাদশাহের নিকট তাদের পদমর্যাদার অনুমোদন প্রার্থনা করে অন্তত বাহ্যত মুঘল সম্রাটের সম্মান ও পবিত্রতা বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু অরধ্যর উত্তর-পশ্চিমে রোহিলিদের অভ্যুত্থান আগ্রা, মথুরা অঞ্চলে নিরন্তর জাঠেদের গোপন কার্যকলাপ এবং পাঞ্জাবে শিখেদের আন্দোলনের ফলে দেশে যে পরিস্থিতির সূচনা হয়, তার ফলেই নূতন স্বাধীন রাষ্ট্র বা উপরাষ্ট্রের উদ্ভব হতে থাকে।

তবে এই সকল রাজ্যেই মারাঠাদের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতাও ঝটিকা আক্রমণই সব থেকে বড়ো বিপদের কারণ ছিল। নাদির শাহর রূপে বহিঃশত্রু ১৭৩৯ সালে দেশে হানা দেয়। যদিও আহমদ শাহ আবদালি ১৭৪৮ সালে পরাজিত হন, কিন্তু বেশিদিন যাবার আগেই পাঞ্জাব এবং আগ্রা বা আরও দূরবর্তী অঞ্চল সমূহে বারবার বিদেশিরা হানা দেন–অপরদিকে বঙ্গদেশে ইংরাজরা ধীরে ধীরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে থাকে।

এই সময়ে মুঘল দরবার ছিল নিষ্ক্রিয় এবং নানারকম দলাদলিতে পরিপূর্ণ। নিজাম-উল-মুলকের বিদায়ের ফলে মহম্মদ শাহ উজিরের নাগপাশ থেকে মুক্ত হলেও তিনি বিশেষ কোনো নিয়ন্ত্রণ বা প্রশাসনিক দক্ষতা দেখাতে পারেননি। যদিও বাহ্যত আকবর-প্রতিষ্ঠিত দরবারের প্রাত্যহিক কাজকর্ম এবং সরকারি নিয়ম-কানুন মেনে চলা হত। তার ২৯ বর্ষ ব্যাপী শাসনকালে মহম্মদ শাহ কোনো বিজয় অভিযান পরিচালনা করেননি। এমনকি তার পরিভ্রমণগুলিও ছিল নিকটবর্তী উদ্যানসমূহের শোভাদর্শন এবং মাঝে মাঝে গড় মুণ্ডেশ্বরের বার্ষিক উৎসবে অংশগ্রহণ। তবে ধর্মবিষয়ে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ উদার এবং হোলি, দশেরা ইত্যাদিতে খোলাখুলি অংশ নিতেন।

দুঃখের বিষয় তিনি তার পরামর্শদাতা হিসাবে এমন কিছু ব্যক্তিকে নির্বাচিত করেছিলেন যারা কেউ উদ্যোগী সুদক্ষ সেনাপতি ছিলেন না। বরং তাঁরা ছিলেন ঘরকুনো সব তালপাতার সেপাই–চটুল কথাবার্তায় দক্ষ এবং ব্যবহার নরম-সরম। তিনি তার উজির হিসাবে কোয়ামারউদ্দিন খানকে নির্বাচন করেন যিনি ছিলেন অলস ও মদ্যপ। এবং খান-ই-দৌরান এক হিন্দুস্থানি যিনি কখনো কোনো অভিযানে অংশগ্রহণই করেননি–তিনিই হলেন তার পছন্দের মির বকশি। তাঁর সমসাময়িক ওয়ারিদ বলেছেন সম্রাট ও তার মহামন্ত্রী এমন এক বিস্মৃতির পরিবেশে বাস করছিলেন যে প্রশাসনিক কাজকর্ম, রাজস্ব আদায় এবং সৈন্যদলের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি অত্যাবশ্যক রাজকার্য তারা যেন ভুলেই গেছিলেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার লিখেছেন যে ‘এক মূর্খ, অলস এবং চঞ্চলমতি বাদশাহ সিংহাসনে আসীন থাকার সুযোগ নিয়ে অভিজাতবৃন্দ বিনা বাধায় এক জঘন্যতম ধরনের স্বার্থপরতা চরিতার্থ করতে থাকলেন।’ বেপরোয়া ঘুস দেওয়া নেওয়া চলতে থাকল, জায়গিরও যথেচ্ছ বিক্রি হতে লাগল। এই সমস্ত অব্যবস্থায় যিনি মুখ্য ভূমিকা নিয়ে ছিলেন তার নাম কুকি জিউ; কুকি জিউ এর-মা এক জ্যামিতিক গনক, যিনি গণনা করে বলেছিলেন যে মহম্মদ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করবেন। আর তার পিতা আবদুল গফুর নামে একজন সাধু–যিনি নিজেকে জাদুশক্তির অধিকারী বলে দাবি করতেন। এদের সঙ্গে আবার তৃতীয় বকশি রোশন উদ দৌল্লাহ জাফর খান পাণিপতিতে যোগ দেন। এই গোষ্ঠীর তিনজন কাউকে কর্মে নিয়োগ করলে বা জায়গির প্রদান করলে উপহার-জনিত অর্থ দিয়ে নিজেদের ধন সম্পদ বৃদ্ধি করতেন। আবার বাদশাহের সঙ্গে এই সম্পদ ভাগাভাগি করে নিতেন। ১৭৩২-৩৩ সালে এই গোষ্ঠী ক্ষমতাচ্যুত হলেও শাসন ব্যবস্থার কোনো উন্নতি চোখে পড়েনি এবং স্বল্প শক্তির মনসবদারদের সবথেকে কষ্ট পেতে হয়েছিল। ক্রমবর্ধমান আইন-শৃঙ্খলার অবনতির জন্য তাদের জায়গির থেকে প্রাপ্য রাজস্ব আদায় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। যেভাবে অভিজাতদের সঙ্গে বাদশাহের দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং সৈন্যদলের বেতনের নিমিত্ত অর্থের অভাবও দেখা গিয়েছিল, তাতে রাজ্যের অবস্থা হয়ে উঠেছিল। সঙ্গীন।

এই সময়েই সামাজ্যের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যে নূতন বিপদের আবির্ভাব হল, তার নাম নাদির শাহ। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকেই সাফাভিদ সাম্রাজ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হত শুরু করেছিল। ১৭০৯ সালে মির ওয়াইজ নামক খিলজাই প্রধান পারসিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কাণ্ডাহার দুর্গ অবরোধ করেন। ১৭২২ সালে তার পুত্র সাফাভিদ রাজাকে আসনচ্যুত করে নিজেই সিংহাসন অধিকার করেন। ইরান এবার আফগানদের। অধীনে এল। আবার অটোমান তুরস্ক এবং রাশিয়া এই সুযোগে ইরানের পশ্চিম ও উত্তর অংশ অধিকার করে নিল।

নাদির কুলি বেগ, যিনি পরে নাদির শাহ নামে পরিচিত হয়েছিলেন, আফগানদের বিরুদ্ধে এক জাতীয় অভ্যুত্থানের নেতা রূপে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। ১৭৩০ সালে নাদির পারস্যের কেন্দ্রস্থল গিলজাই থেকে আফগানদের বিতাড়িত করে আবার আবদালিদের নিকট থেকে হিরাটও অধিকার করে নেন। তারপর তিনি অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরপর কয়েকটি অভিযানে তিনি তাদের ইরানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে বিতাড়ন করলেও বাগদাদ কিন্তু পুনরাধিকার করতে পারেননি। সম্পূর্ণ পরিশ্রান্ত হয়ে দুই পক্ষ ১৭৩৬ সালে একটি সন্ধি রচনা করতে বাধ্য হয়। দুঃসাহসী সেনাধ্যক্ষ রূপে খ্যাতি-প্রাপ্ত নাদির এক বিশ্বস্ত অনুগামীদের বাহিনী গঠন করতে সক্ষম হন। নাবালক নাফাভিদ শাসককে বিতাড়ন করতে নাদিরকে কোনো অসুবিধাই পেতে হয়নি এবং ১৭৩৭ সালে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন।

দিল্লির দরবার এক প্রসন্ন ঔদাসীন্যের সঙ্গে সমস্ত ঘটনাবলি লক্ষ করছিলেন। গিলজাই এবং আবদালিদের পারস্য থেকে বিতাড়ন এবং অটোমানদের সঙ্গে যুদ্ধের অচলাবস্থার পরে নাদিরের পক্ষে ভারত আক্রমণ ছিল একটি যুক্তিগ্রাহ্য পদক্ষেপ। অটোমানদের সঙ্গে পুনর্বার যুদ্ধ শুরু করার আগে একমাত্র দিল্লি থেকেই তিনি তার কোষাগারকে আবার পূর্ণ করে তুলতে পারতেন। মারাঠাদের হাতে মালব ও গুজরাটে প্রতিহত হওয়া এবং ১৭৩৭ সালে দিল্লির বহিঃসীমায় এক মারাঠা সৈন্য সমাবেশের ঘটনার পরে দিল্লির সরকারের দুর্বলতার কথা আর গোপন ছিল না।

উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে ভারতকে রক্ষা করার জন্য মুঘলেরা বহু কূটনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন যাতে পশ্চিম এশিয়ায় ভারতের পক্ষে শত্রু ভাবাপন্ন শক্তিরা জোটবদ্ধ হতে না পারে। এর জন্য তারা কাবুলে এক শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন এবং কান্দাহারকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিলেন। কাবুল এবং কান্দাহারকে ভারতের দুইটি প্রবেশপথ বলে গণ্য করা হত। মুঘলরা আফগান উপজাতিদের আর্থিক অনুদান দিয়ে এবং সৈন্যদলে নিয়োগ করেও নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছিল।

নিজাম-উল-মুলক ক্ষমতায় থাকাকালীন, ১৭২৪ সালে সাফাভিদদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবার জন্য ইস্পাহানে অভিযান রচনা করার একটি আবছা ভাসা ভাসা পরিকল্পনা করেছিলেন। কেননা কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সংঘর্ষ হওয়া সত্ত্বেও সাফাভিদদের সঙ্গে মুঘলদের এক পরম্পরাগত সুসম্পর্ক ছিল। তবে রাজদরবারে সে ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না। তাই পরিবর্তে তারা পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে ঘিলজাইদের প্রধান মাহমুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

তারও আগে ১৭৩০ সালে নাদির শাহ তার কান্দাহার অভিযানের অভিপ্রায় জানিয়ে মুহম্মদ শাহের নিকটে এক দূত প্রেরণ করেন। এই সময়ে তিনি দুই দেশের মধ্যেকার পুরাতন বন্ধুত্বের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে, আফগানদের বিষয়ে উভয় দেশেরই সমভাবাপন্নতার কথা আবার জানিয়ে বাদশাহকে অনুরোধ করেন যে নাদিরশাহ। অভিযান শুরু করলে বাদশাহ যেন আফগান উদ্বাস্তুদের ভারতে প্রবেশ রোধ করার জন্য সমগ্র আফগান সীমান্ত বন্ধ করে দেন। মুহম্মদ শাহ প্রত্যুত্তরে লেখেন যে কাবুল এবং সিন্ধু সুবেদারদের এই আদেশ পালন করতে নির্দেশিত করা হচ্ছে এবং এই উদ্দেশ্যে কাবুলস্থ সৈন্যদলেরও আরও শক্তি বৃদ্ধি করা হবে।

অবশ্য কান্দাহার আক্রমণের পরিবর্তে নাদির শাহ তুরস্কের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের প্রতি মনোযোগ দেন এবং মালব ও গুজরাটে মারাঠাদের ভয় নিয়ে চিন্তিত মুঘল দরবার ক্রমে ক্রমে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কথা ভুলেই যান।

ঔরঙ্গজেবের সময় থেকেই কাবুলের প্রশাসনকে আফগান উপজাতিদের মধ্যে বিত্তবানের জন্য এবং পার্বত্য দুর্গগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি বৎসর বারো লক্ষ টাকা করে প্রদান করা হত। কাবুলের একজন সুদক্ষ প্রশাসক ছিলেন, যার নাম নাসির খান। কিন্তু যাঁর উপর এই অর্থপ্রদানের ভার ছিল সেই তৃতীয় বকশি রোশন উদদৌলা

জাফর খান এই অনুদানের অর্ধেক পরিমাণ অর্থ নিজের জন্য সরিয়ে রেখে দিতেন। ১৭৩২-৩৩ সালে জাফর ক্ষমতাচ্যুত হলে তাকে আদেশ দেওয়া হয় যে দুই কোটি টাকা তিনি তছরূপ করেছেন তা রাজকোষে ফিরিয়ে দিতে। এই ভরতুকি প্রদানের দায়িত্ব তখন মির বকশি খান-ই-দৌরানের উপরে বিন্যস্ত হয়। খান-ই-দৌরান নিজে অসৎ ছিলেন না, কিন্তু তিনি নাসির খানকে বিশ্বাস করতেন না, যেহেতু নাসির ইরানি ছিলেন আবার জাফর খানের মাধ্যমেই তার পদ প্রাপ্তি ঘটে। যদিও কাবুল এবং ভারতে ইরানি আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল একটি বহুচর্চিত বিষয়। এমনকি বাজারি গালগল্পেও এই নিয়ে কথাবার্তা হত, কিন্তু খান-ই-দৌরান এই বিপদের সম্ভাবনাকে হেসে উড়িয়ে দেন নাসির খানের বিরুদ্ধে নাদির শাহের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগও আনেন। ফলত উপজাতীয়দের ও সৈনিকদের জন্য এই অনুদান অনিয়মিত, এমনকি কখনো-কখনো আংশিক পরিমাণেও দেওয়া হতে থাকে। অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবেই নাসির খান এই মর্মে আবদেন জানান যে সৈন্যদের পাঁচ বৎসরের প্রাপ্য বেতন থেকে অন্তত এক বৎসরের পরিশ্রমিক তাদের পাঠানো হোক। যাতে করে পাওনাদারদের। দাবি মিটিয়ে তাদের সামান্য কিছু অর্থ অন্তত অবশিষ্ট থাকে। খান-ই-দৌরান এই পত্রকে আরও অধিক অর্থ আদায়ের এক ফন্দি ভেবে লিখলেন যে আমাদের গৃহাদি সমতুলে নির্মিত এবং আমরা চোখে যা কিছু দেখতে পাই তাকে ভয় করি না। তোমাদের বাড়ি তো ভোচলা পাহাড়ের উপরে, তাই তোমরা হয়তো তোমাদের ছাদ থেকে মঙ্গল আর কিজিলবুশ সৈন্যদের দেখে থাকবে।

মনে হয় নাদির শাহ আফগানদের আফগানিস্থানের দিকে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কেবল সেখানে হস্তক্ষেপের একটা বাহানা হিসাবে ব্যবহার করছিলেন। ১৭৩২ সালে তিনি একই অভিযোগ দিয়ে দ্বিতীয় একজন পারিষদকে প্রেরণ করেন। দিল্লির দরবারে তারা দাক্ষিণাত্যে অবিশ্বাসীদের (অর্থাৎ যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী নয়) নিয়ে ব্যস্ত থাকার অজুহাতে অব্যাহতি চায় এবং গতবারের আশ্বাসগুলিরই পুনরাবৃত্তি করে। ১৭৩৭ সালে তার রাজ্যাভিষেক এবং তার কান্দাহার জয়ের পরিকল্পনা ঘোষণা করে দিল্লিতে এক তৃতীয় প্রতিনিধি পাঠান। এর সঙ্গে সঙ্গে আফগানদের কাবুল ও পেশোয়ারে প্রবেশ করতে না দেবার জন্য তার পূর্বেকার দাবিটিও পুনরাবৃত্তি করেন। এই। রাজপ্রতিনিধিকে দরবার থেকে চল্লিশ দিনের মধ্যে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। বাদশাহের আদালতের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া সত্ত্বেও কিন্তু নাদিরের এই প্রতিনিধিটি দিল্লিতে প্রায় এক বৎসরকাল বিলম্ব করেছিল। এর একটি কারণ দিল্লিতে এই আরামের জীবনযাপন আর দ্বিতীয়টি দিল্লির এক বারাঙ্গনার সঙ্গে তার মোহাবিষ্ট হয়ে পড়া। আবার নাদির শাহের এই দাবিগুলি তার ভারত আক্রমণের অছিলা ছিল মাত্র।

১৭৩৮ সালের প্রারম্ভে কান্দাহার জয়ের পর নাদির শাহ বাহিনী সহ কাবুলে প্রবেশ করলেন। কাবুলের প্রশাসকের অবস্থান শক্তিশালী করার কোনো পদক্ষেপেই দিল্লির রাজত্ব থেকে নেওয়া হয়নি। এমনকি কাবুল অধিকার করার পরেও নাদির শাহ মুহাম্মদ শাহকে ভারতীয় ভুখণ্ড সম্বন্ধে তাঁর কোনো অভিসন্ধির কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে একটি পত্র লেখেন। কাবুলের প্রশাসনকে নাসির খান নাদির শাহের পাঞ্জাবে। প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ করার জন্য খাইবার পাসকে কঠোরভাবে সুরক্ষিত করে তোলেন। নাদির কিন্তু নাসির খানের পার্শ্বদেশ দিয়ে পরিচালনা করে তাকে পরাস্ত করে লাহোর অবরোধ করেন। লাহোরের প্রশাসক জাকারিয়া খান আরও সৈন্য ও সাজসরঞ্জাম দিয়ে তার শক্তিকে দৃঢ়তর করে তোলার জন্য বারবার দিল্লির কাছে জরুরি আবেদন পাঠান। কিন্তু কোনো সাহায্যই আসেনি। তাই শৌর্যের সঙ্গে কিছুকাল নাদিরকে প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে জাকারিয়া অস্ত্র সংবরণ করেন। এবার দিল্লির পথ। হয়ে উঠল সম্পূর্ণ উন্মুক্ত।

এই আসন্ন আক্রমণের প্রতিরোধকল্পে দিল্লির দরবারে চূড়ান্ত পুরুষত্বহীনতা বিষয়ে আমাদের আর বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তারা এটাও সিদ্ধান্ত করে উঠতে পারেননি যে একজন রাজবংশীয় শাহজাদা স্বল্পদিন পূর্বে দিল্লি পৌঁছান নিজাম-উল মূলক অথবা ওয়াজির বা মির বকশি, না কি বাদশাহ স্বয়ং, কে দিল্লির সৈন্যদলের নেতৃত্ব দেবেন। জনসাধারণের বিশ্বাস ছিল যে ক্রমবর্ধমান মারাঠা-বিপদকে সংযত করতে নিজাম-উল-মুলক এবং অযোধ্যার শাসক সাদাত খান উভয়ে মিলে নাদির শাহকে ভারতে আহ্বান করেছিলেন। এর অবশ্য কোনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি, আর নাদির শাহের এরকম কোনো নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ছিল না।

কাৰ্মালে মুঘলদের পরাজয়, সাদাত খানের সাহায্যার্থে যুদ্ধ করতে গিয়ে মের বশি খান-ই-দুরানের মৃত্যু, নিজাম-উল-মুলক এবং সাদাত খান উভয়েরই গ্রেফতারি মুঘল বাদশাহের আত্মসমর্পণ দিল্লিতে অসংখ্য প্রাণহানি এবং চরম অত্যাচার, এসবই মানুষের মনে লেখা রয়ে আছে–সুতরাং এসব তথ্য দিয়ে আর আমরা বিলম্ব করব না। কিন্তু নাদির শাহের অভিযানের ফলাফল আমাদের বিশ্লেষণ করে দেখা প্রয়োজন।

নাদির শাহের আক্রমণ এবং কাবুল ও সিন্ধুনদের পশ্চিমে তীরবর্তী ভুখণ্ড হস্তচ্যুত হবার পর উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ভারতে বিদেশি শক্তির পুনঃপুনঃ আক্রমণের পথ খুলে গেল। নাদির শাহ সব দুর্গ কেল্লা ইত্যাদিসহ খাট্টা প্রদেশটিও অধিকার করে নিয়েছিলেন। মুঘল সম্রাটের এই পরাজয়ের ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষমতা যে ক্রমশ আরও বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে চলেছে, তার খবর যেন দিকে দিকে ছড়িয়ে গেল। এর ফলে সকল স্থানীয় রাজা, জমিদার ইত্যাদিরাও নিজেদের অধিকার দাবি করতে তাতে উৎসাহিত হলেন। তবে যেসব সম্পদ ও ঐশ্বর্য নাদির শাহ লুণ্ঠন করে দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার মধ্যে ময়ূর সিংহাসন ও বিখ্যাত কোহিনূর হীরকখণ্ডও ছিল এবং এই লুণ্ঠিত সম্পদের আনুমানিক মূল্য ছিল সত্তর কোটি টাকা। তবে ভারতীয় অর্থনীতি তখনও বলীয়ান এবং প্রাণবন্ত ছিল যার জন্য সহজেই এই ক্ষতি পূরণ হয়ে গেছিল। ১৭৭২ সালে পর্যন্ত সকল বাণিজ্য ও শিল্পের কেন্দ্রস্থল দিল্লি তখনও এক সমৃদ্ধ মহানগরী বলেই গণ্য হত।

নাদির শাহের আক্রমণে খান-ই-দুরান ও সাদাত খানের মৃত্যু হল এবং নিজাম-উল-মুলক দাক্ষিণাত্যে প্রস্থান করলেন। এরই ফলশ্রুতি হিসাবে প্রাচীনরা দরবার থেকে বিদায় নিলেন। এমনকি ওয়াজির কোয়ামারউদ্দিন খানও বাদশাহের ভাগী হলেন।

এইবার মুহাম্মদ শাহ এক নুতন ও সুদক্ষ মন্ত্রণাপরিষদ গঠনের এক সুবর্ণ সুযোগ পেলেন। এদের পরামর্শে তিনি দিল্লি রাজ্য নামে পরিচিত ভূখণ্ডকে সুসংহত করে তুলতে পারতেন। এই দিল্লির এলাকা একটি বৃত্তচাপের আকারে পশ্চিমে মোটামুটি সাহারানপুর থেকে নাগোর পর্যন্ত। পূর্বে ফারুখাবাদ এবং গঙ্গার নদী রেখা থেকে চম্বলের দক্ষিণ অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রকৃতপক্ষে পুরাতন পরিষদের স্থলে নূতন পারিষদ ঠিকই গঠিত হল, কিন্তু প্রশাসন হয়ে রইল সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। সুশাসনের কোনো চেষ্টাই দেখা গেল না। একজন সমসাময়িক আশুবের ভাষায় প্রতিটি জমিদার হয়ে উঠল রাজা এবং প্রতিটি রাজা এক একজন মহারাজা।

কিন্তু এই ক্ষয়প্রাপ্ত অবস্থাতেও মুঘল সৈন্যদল আফগান আক্রমণকারী আহমদ শাহ আবদালির মুখোমুখি হয়ে তাকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। ১৭৪৭ সালে নাদির শাহের হত্যাকাণ্ডের পর আবদানি আফগানদের রাজার আসনে বসেন। আহমদ শাহ লুটপাট করে তার দলের লোকজনকে পারিশ্রমিক দেবার উদ্দেশ্যে ভারত আক্রমণ করেন, লুটপাটই ছিল তাঁর লক্ষ্য। লাহোরের পতনের পরেই দিল্লি দরবার এই বিপদ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এবং ১৭৪৯ সালে মনুপুরের যুদ্ধে কোয়ামারউদ্দিন খানের পুত্র মইন-উল-মুলক এবং সাদাত খানের জামাতা ও উত্তরাধিকারী সফদরজঙ্গের সাহসিক প্রচেষ্টায় মুঘলরা জয়লাভ করে। এর থেকে প্রমাণ হয়েছে। অভিজাত এবং সৈন্যদের মধ্যে চারিত্রিক শক্তি এবং লড়াই করার ইচ্ছা কোনোটারই অভাব ছিল না। অভাব ছিল সংগঠন ও নেতৃত্বের, যার জন্য প্রয়োজন ছিল যে কাজের যে উপযুক্ত, তাকেই সেই কাজের দায়িত্ব দেওয়া।

উত্তর-পশ্চিমের দিক থেকে আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে বাদশাহের দরবার এবং উদীয়মান স্বাধীন রাজ্যগুলিকে আর-একটি বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। যার নাম পেশোয়ার নামে মারাঠাদের আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *