১৩. সামাজিক পরিকাঠামো এবং পরিবর্ধন

ত্রয়োদশ অধ্যায় – সামাজিক পরিকাঠামো এবং পরিবর্ধন

আমরা আগে সুলতানি আমলের যে সামাজিক কাঠামো দেখেছিলাম মুঘল সমাজেও তা অপরিবর্তিত ছিল। যদিও এর ধারাবাহিকতার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনেরও চিহ্ন দেখা। যাচ্ছিল। সব থেকে লক্ষণীয় পরিবর্তনগুলি হল যথাক্রমে গ্রামীণ সমাজের অধিকতর সংকোচন, নগরায়ণ এবং কারিগর ও ওস্তাদ কারিগরদের সংখ্যাবৃদ্ধি, আমলাতন্ত্র এবং বাণিজ্য মুখীনতা-সমন্বিত একটি নূতন ধরনের শাসকশ্রেণির উদ্ভব মধ্যবর্তী শ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বণিক শ্রেণির অধিকতর শক্তি সঞ্চার এবং বিস্তার বা বেড়ে ওঠা। পরিসংখ্যানের অভাবে তৎকালীন দেশের মোট জনসংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন। তবুও মোট চাষজমি, শস্য উৎপাদন, রাজস্বের হার এবং জমা অর্থাৎ জমি থেকে আনুমানিক রাজস্বের পরিমাণ ইত্যাদি থেকে আধুনিক পণ্ডিতেরা ১৬শ শতাব্দীর শেষে এই জন্মসংখ্যাকে ১৪ থেকে ১৫ কোটি হিসাব করেছিলেন, যা ১৮শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ধীরে ধীরে ২০ কোটিতে পৌঁছে যায়। এর থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে হার পাওয়া যায় তা হল প্রতি বৎসরে শতকরা ০.২১ ভাগ।

গ্রামীণ সমাজ

১৬শ এবং ১৭শ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষই গ্রামে বাস করত। তাই সমাজব্যবস্থা বিষয়ক কোনো সমীক্ষা অবশ্যই গ্রাম থেকে শুরু হওয়া উচিত। তবে সমকালীন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে এমনকি বেশিরভাগ বিদেশি ঐতিহাসিকদের বিবরণেও গ্রাম্য জীবন-সংক্রান্ত বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে রাজস্থানের বিভিন্ন অংশে প্রায় ভূমি-রাজস্ব এবং গ্রামীণ পরিস্থিতি সংক্রান্ত কাগজপত্র থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মারাঠি নথিপত্র থেকে এবং দাক্ষিণাত্য-সংক্রান্ত মুঘল দলিল দস্তাবেজ পরীক্ষা করার পর এই তথ্যের অভাব কিছুটা পূরণ করা গেছে। এছাড়া সাহিত্যের মাধ্যমেও গ্রাম্য জীবন ও পরিস্থিতির কিছু চিত্র পাওয়া যায়।

দেশের গ্রামীণ সমাজের প্রধান বিশেষত্ব ছিল এর বহুমাত্রিক বিভাজন। গ্রামের মানুষ ছিল বহুস্তরে বিভক্ত, যথা তার অবস্থানিক মর্যাদা, জাতি ও বর্ণ এবং পদ মর্যাদা। যদিও তাদের বৈষয়িক পরিস্থিতিতে প্রচুর তারতম্য ছিল, তথাপি বৈষয়িক অবস্থা কিন্তু গ্রাম্য সমাজে কারও পদমর্যাদা নির্ধারণের প্রাথমিক শর্ত ছিল না।

স্থানীয় (গ্রামীণ) কৃষিজীবী সম্প্রদায়-রিয়ায়তি এবং খুদ-কস্‌ত

গ্রামের অধিবাসীদের বৃহত্তম অংশই ছিল কৃষিজীবী এবং তাদের বেশিরভাগই দাবি করত যে তারা গ্রামের প্রথম বা আদি বসতকারীদের উত্তরপুরুষ। পুরাতন গ্রামবাসীদের সংস্কৃতে বলা হত স্থানিক অর্থাৎ স্থানীয় ব্যক্তি এবং মহারাষ্ট্রে এদের যে ‘থানি’ ‘স্তলওয়াক’ (স্থল বাহক) বলে ডাকা হত, তাও স্পষ্টতই এই শব্দেরই অপভ্রংশ। এই শ্রেণির মানুষদের মহারাষ্ট্রে ‘মিরাসি’ এবং রাজস্থানে ‘গাঁওভেতি’ বা ‘গাভেতি’ বলেও ডাকা হত।

স্থানীয় কৃষিজীবীদের প্রায়শই দুই ভাগে বিভক্ত করা হত, যথা ‘রিয়ায়তি’ এবং ‘রায়তি’ অর্থাৎ সাম্মানিক এবং সাধারণ। রিয়ায়তি অর্থে যেসব স্থানীয় কৃষিজীবী নিজেরাই জমির মালিকও হত তাদের বোঝাত (নিজ চাষি)। এই সবজমির মালিক, যারা নিজেরাই নিজের জমির কৃষিকার্যও করত তাদের মহারাষ্ট্রে ‘মিরাসি’ বলে ডাকা হত এবং রাজস্থানের কোনো-কোনো অংশে এদের বলা হত ‘ঘারু হালা’। এরই ফারসি প্রতিশব্দ ছিল ‘খুদ-কস্‌ত’। অষ্টাদশ শতকের নামের তালিকা দেখে দেখতে পাই যে খুদ-কস্‌ত শব্দটির সংজ্ঞা এই রূপ দেওয়া হয়েছে–যারা ষণ্ড (ষাঁড়) ইত্যাদি নিজের পয়সায় কিনে, কৃষকদের দিয়ে জমির চাষ করিয়ে নেয়। এক কথায় বলতে গেলে যদি জমির মালিক (মালিকজমিন) নিজেই জমির চাষ করে, তাকে বলা হয় ‘খুদ-কসত’।

তাহলে খুদ-কস্‌ত বলে অভিহিত হবার প্রয়োজনীয় শর্তগুলি হল নিজ জমির মালিকানা তার নিজেরই থাকতে হবে, বাড়ির কৃষাণদের দিয়ে সে জমির কৃষিকার্য। করিয়ে নেবে, অবশ্য প্রয়োজনে ভাড়াটে শ্রমিকদেরও নিয়োগ করতে পারবে। এই হল খুদ-কস্‌ত-এর সংজ্ঞা। খুদ-কস্‌ত জমির উপর খাজনা বা ভূমি রাজস্ব দিত, অবশ্য তার উপর সে ছাড় পেত, কিন্তু অন্যান্য কর, যেমন বিবাহের ওপর আরোপিত কর ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবে তারা অব্যাহতি পেত। তাছাড়া গ্রামে তার কেবল একটিই বাসস্থান থাকলে তাকে গৃহ রাজস্বও দিতে হত। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর মননশীল ইংরাজ রাজদূত ডাবলু ডাবলু হান্টার বলেছেন। ‘খুদ-কস্‌ত’-এর অধিকার এক মূল্যবান স্বত্ব, কেননা কেবল অর্থনৈতিক সুবিধাই নয়, এ ছিল এক সামাজিক সম্মান, সামাজিক স্তরের উন্নয়ন। এই মালিক কৃষকেরাই ছিল গ্রামীণ সমাজের পরিচালক, গ্রামের সম্মানীয় ভদ্রলোক। এছাড়া এরা আরও অনেক সুবিধারও অধিকারী ছিল, গ্রামের চারণভূমি ও অরণ্যভূমি এরা ব্যবহার করতে পারত। স্থানীয় জলাশয়গুলি এবং মৎস্যকুলের উপরও এদের অধিকার ছিল। এবং গ্রামের কর্মচারী ও মজুরদেরও এরা নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারত।

খুদ-কস্‌ত ছাড়া, রাজস্থান এবং দেশের অন্যান্য জায়গায় রিয়াইয়াতি বা সুবিধাভোগীর শ্রেণির মানুষদের মধ্যে ছিল উচ্চবর্ণের উচ্চজাতির মানুষ। যথা ব্রাহ্মণ, রাজপুত, এবং মহাজন (বানিয়া) এবং স্থানীয় গ্রামীণ আধিকারিকগণ, যেমন প্যাটেল বা চৌধুরী, কানুনগো, পাটোয়ারি ইত্যাদি, যদিও এদের অনেকেই মূলত খুদ-কস্‌ত শ্রেণি থেকেই এসেছিলেন।

দেশের বিভিন্ন স্থানে রিয়ায়তিদের বিভিন্ন ‘দস্তুর’ বা কর প্রথা ছিল। কাগজপত্র থেকে দেখা যায় যে রাজস্থানে উৎপন্ন শস্যের এক চতুর্থাংশ পর্যন্ত দাবি করা হত। যদিও অন্য স্থানে করবাবদ অর্ধেক থেকে এক চতুর্থাংশ দাবী করা হত। এখানে লক্ষণীয় যে বর্ণ বিভেদের জন্য ব্রাহ্মণেরা নিজেরা নিজেদের জমি চাষ করতেন না বরং ভাড়াটে শ্রমিকদের দিয়ে চাষ করিয়ে নিতেন। এছাড়া দেখা যায় যে অন্য শ্রেণির মানুষদেরও করের ব্যাপারে কখনও ছাড় দেওয়া হত।

পাহি বা বহিরাগত কৃষক

মধ্যে মধ্যে ভুল করে খুদ-কস্‌তদের সমগ্র স্থানীয় কৃষি উৎপাদকদের সঙ্গে এক বলে মনে করা হয়। এদের আবার পাহি বা পাহি-কতদের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। পাহিরা নিকটবর্তী গ্রাম ও পরগনা থেকে আগত কৃষিজীবী মানুষজন, যারা গ্রামের উদ্বৃত্ত জমি চাষ করতে, কোনো বিধ্বস্ত গ্রামকে পুনরুদ্ধার করতে অথবা নূতন গ্রামকে গুছিয়ে দিয়ে আসত। বহুক্ষেত্রে পাহিদের সুবিধাজনক দরে জমির পাট্টা দেওয়া হত। পুরো দাম তৃতীয় অথবা পঞ্চম বর্ষে এবং কখনও আরও পরেও নেওয়া হত। আমরা পূর্ব রাজস্থানের মালারনা পরগনার মেহরাজপুর গ্রামের কথা শুনেছি। এই গ্রামটিতে। অনাবৃষ্টির জন্য সমস্ত কূপ ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় ১৭২৮ সালে পরিত্যক্ত হয়। পরে এর ভূতপূর্ব প্যাটেলকে ডেকে এই গ্রামে এসে আবার বাস করতে এবং এক বছরের মধ্যে গ্রামের সমস্ত জমিকে চাষযোগ্য করে লাঙল চালাবার ব্যবস্থা করার অঙ্গীকার দিতে বলা হয়। এই ভাবে এই গ্রামটিকে আবার বাঁচিয়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হল। তাকে এবার তিন বছরের জন্য ফসলের মাত্র এক তৃতীয়াংশের বিনিময়ে । পাট্টা দেওয়া হয়। এই কৃষিকার্য করার জন্য যেসব পাহি-কত গ্রামে এল, তাদের এক বছরের জন্য ফসলের এক তৃতীয়াংশের বিনিময়ে পাট্টা দেওয়া হয়। এই বন্দোবস্ত কেবল সেই বছরের জন্যই করা হয়েছিল।

এই ধরনের সুবিধা কখনো সময়-কালের ভিত্তিতে, কখনো-বা খাজনার পরিমাণের ভিত্তিতে কমবেশি হত, যা তৎকালীন পরিস্থিতির উপর ছিল সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভরশীল। পাহিদের কোনো চাষবাসের যন্ত্রপাতি না থাকলে তাদের লাঙল, বলদ, বীজ, সার এবং অর্থ সবই দেওয়া হত। কখনো রাজ্যের পক্ষ থেকে সরাসরি আবার কখনো-বা গ্রামের তেজারতি মহাজনের (বোহরা) নিকট থেকে। যতদিন তারা ভূমিরাজস্ব বা খাজনা দিয়ে যেত ততদিন তারা জমিটিও নিজেদের অধিকারে রাখতে পারত।

দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে কৃষকদের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চলে যাওয়া কোনো নূতন ব্যাপার ছিল না, যা ১৬শ শতাব্দীতে হিন্দি কবি তুলসীদাসও তার লেখায় উল্লেখ করেছেন। কৃষকদের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাওয়া এক পুরোনো ঘটনা ছিল। তারা কখনও নিজেদের অবস্থার উন্নতির জন্য, যথা নতুন গ্রামে বসতি স্থাপন করা, কোনো পুরোনো গ্রামের কৃষিকার্যের উন্নতি সাধন করা বা কোনো পুরোনো গ্রামকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য এইভাবে যাতায়াত করত এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। অর্থাৎ গ্রামীণ সমাজ, আমরা যেমন ভেবে থাকি, তেমনি স্থায়ী এবং পরিবর্তন-হীন ছিল না। অশান্তি এবং অনিশ্চয়তার সময়ে পাহিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেত, যা অষ্টাদশ শতকের হিসাব থেকে পাওয়া যায়। তবে আরও মিলিয়ে দেখার জন্য। পূর্বতন সময়ের কোনো নথিপত্র পাওয়া যায়নি।

যে সমস্ত দলিতেরা নূতন বা ভেঙেপড়া গ্রামে এসে তাদের জমিকে চাষযোগ্য করে তুলত, অনেক সময়ই সেই সমস্ত উদ্ধার করা জমির উপর মালিকানা পাবার আশায় তারাই পাহি-রূপে সেখানে আবার ফিরে আসত। সামাজিক বাধা-নিষেধের জন্য, অর্থাৎ দলিত হওয়ার জন্য তাদের গ্রামে এটা সম্ভব ছিল না। তবে বহু স্থানে যেমন কোটায় এমনও দেখা গেছে যে দলিতদেরও তাদের জমির মালিক হবার। অধিকার দেওয়া হয়েছে।

পাহিদের অস্থায়ী বা ভ্রাম্যমাণ শ্রমিক বলে নির্দিষ্ট করা উচিত হবে না, কেননা তারা বেশিরভাগই ওইসব গ্রামে বসতি স্থাপন করত। এবং পরে পুরুষানুক্রমে সেখানকার স্থানীয় কৃষকমণ্ডলীর সঙ্গেই মিশে যেত।

রায়তিগণ

রাজস্থানে সাধারণ কৃষকদের সচরাচর রায়তি বা পালটি বলা হত ফারসি ভাষায় এদের বলা হত মুজারিয়ান। পালিতরা সাধারণত মধ্যবর্তী বর্ণ থেকে আসত যথা জাঠ, গুজার, মালি, আহির মীনা ইত্যাদি। যে জমি চাষ করত তারা তার মালিক হতে পারত (মালিক, ধনী), বা ভাড়াটিয়াও হতে পারত। রায়তি মালিকদের রাজস্বের নিরূপণে রায়তি দস্তুর অনুসারে করা হত, নিজেরাই ছিল পরিবর্তন সাপেক্ষে। এর মান নির্ভর করত কী ধরনের শস্য ফলানো হচ্ছে, মরশুম, জলসেচ প্রণালী ইত্যাদির উপর। সুতরাং এই রাজস্ব অবশ্যই কমবেশি হওয়া স্বাভাবিক ছিল। তবে এর একটি মানও ছিল। সাধারণত সাধারণ কৃষক এবং পোলাজ জমির উপর উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ। দাবি করা হত। গম এবং বজরার উপর এই রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৫.ভাগের ২ ভাগ। ভূমি রাজস্বের মধ্যে অন্যান্য কর (জিহাত) অন্তর্ভুক্ত করা হত না।

রায়তি বা পালতি ভাড়াটিয়াদের দুই ভাগে ভাগ করা হত। প্রথম হচ্ছে যারা। রাজ্যের চাষযোগ্য পতিত জমির (বানজার) চাষ করত, বা জমির মালিক বা পানির পরিত্যক্ত জমিতে কর্ষণ করত, এই ধরনের ভাড়াটিয়া কৃষকদের সচরাচর নিজেদের বলদ (ষাঁড়) এবং লাঙল থাকত এবং তারা হয় এক বছরের কিংবা একফসলি পাট্টা পেত। তবে এই পাট্টা সচরাচর নবীকরণ করা যেত। দ্বিতীয় শ্রেণির জমির ভাড়াটিয়ারা ছিল ধানি শ্রেণির, যারা জমিদারের প্যাটেলদের, ভূমিয়াদের বা ইমাম। জমির অধিকারীদের জমির চাষ করত। সাধারণত তারা বলদ, লাঙ্গল, বীজ ইত্যাদির জন্য মহাজন, জমিদার এবং প্যাটেলদের উপর নির্ভর করত। হয় তারা জমির আরোপিত ভাড়া দিত নয়তো ভাগে চাষ করে ফসল দিয়ে ভাড়া মেটাত। এই ধরনের কৃষিজীবীদিগের সামাজিক অবস্থান খুব নীচু ছিল, এবং তাদের পালটি নামটি নিন্দাসূচক অর্থে ব্যবহার করা হত। পালটিরা আরও উন্নতির আশায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াত বা তাদের কোনো পরিত্যক্ত বা নতুন গ্রামে কৃষিকার্য করার জন্য রাজস্বে ছাড় দিয়ে জমি দেওয়া হত। এই পালটিদের মাঝে মাঝে পাহিদের থেকে পৃথক করতে ভুল হয়ে যায়।

কৃষিজীবীরা ছাড়াও দেশে অনেক ভূমিহীন মানুষ ছিল যারা শ্রমিকের (মজুর) কাজ করত। এ ছাড়া কারুজীবীরাও সমাজে ছিল যেমন কর্মকার, সূত্রধর, কুম্ভকার, রজ্জকার, চর্মশিল্পী, পরোমানিক, ধোপী, চৌকিদার ইত্যাদি। মহারাষ্ট্রে এই সব পরিষেবার সংখ্যা ছিল বারোটি এদের বলা হত বালুতদার’ এবং এরা গ্রামের উৎপন্ন দ্রব্যের একটি স্থির নির্ণয় করা অংশ বা ভাগ (বালুটা) পাবার অধিকারী ছিল। এছাড়া ‘আলুতেদার’ বলে আর-এক শ্রেণির কর্মী ছিল যাদের দাক্ষিণাত্যের সকল গ্রামে দেখা যেত না এবং গ্রামীণ জীবনের জন্যে এরা অত্যাবশ্যকও ছিল না। তবে বৃহৎ পল্লীগ্রামগুলিতে তাদের মাঝে মাঝে দেখা যেত। এরা ছিল গ্রামের পুরোহিত, দর্জি, জলবাহক বা ভিস্তি, ঢাকি, গায়ক, তিলি, সুপারিওয়ালা, স্বর্ণকার ইত্যাদি। এরা শস্যের অনেক নিম্নতর ভাগ পেত, অথবা চাষ করার জন্য এদের এক টুকরো জমি দেওয়া হত। ভূমিহীন এবং পরিষেবায় নিযুক্ত শ্রেণির এক বৃহৎ অংশকে বলা হত কামিন বা নীচ। এবং এদের মধ্যে দলিতদের একটা বড়ো অংশও ছিল।

গ্রামসমাজের তিনটি প্রধান অংশ যথা রিয়ায়তি, রায়তি, এবং পরিষেবা সংক্রান্ত কর্মীদের আনুপাতিক অংশ হিসাব করা কঠিন। কোনো-কোনো হিসাব অনুযায়ী পূর্ব রাজস্থানে এদের অনুপাত এইরকম। রিয়ায়তি বা সুবিধাভোগী শ্রেণির ভাগ ১৩ শতাংশ, পরিষেবা কর্মী ১১ শতাংশ এবং বাকি অন্যশ্রেণির মানুষদের অনুপাত ৭৬ শতাংশ। কিন্তু এ থেকেও গ্রামসমাজের সার্বিক অসাম্যের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। পূর্ব রাজস্থানের ছান্দাওয়ারের একটি ‘তখসিমা দলিল হিসেবে (১৬৬৬) ৮৬ জন কৃষিজীবীর মধ্যে ৯ জন গড়ে ১২৬ বিঘা মাথাপিছু হিসাবে চাষ করত, ২৩ জনের চাষজমির পরিমাণ ছিল জনপ্রতি ৭০ বিঘা, এবং বাকি ৫০ জনের ছিল জন-প্রতি ৩০ বিঘা চাষযুক্ত জমি। চাস্তুর পরগনা দুটি গ্রামের (১৬৬৬) পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে চাঙ্গু গ্রামে মাত্র ১০ আসামি (মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ) ছিল মাথা কিছু ৫-৮ ষণ্ড, ৬১ আসামি (৩০.৫ শতাংশ) ছিল মাথাপিছু মাত্র ১টি ষাঁড়–তা চাষের পক্ষে অপ্রতুল। এবং বাকি ১২৯ আসামি (৬৪ শতাংশ) ছিল ২টি থেকে ৪টি ষাঁড়। কোটখোয়াদা নামে আরেকটি গ্রামে এই অনুপাত ছিল ৮.৮ শতাংশের ৫ থেকে ৭ ষাঁড়, ২১.৫ শতাংশের একটি এবং ৬৯.২ শতাংশের ২ থেকে ৪টি। লাঙলের ক্ষেত্রেও এই চিত্রেরই পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। যেমন মুলথান গ্রামে ৪ আসামি (১০ শতাংশের) ৩ থেকে ৫টি লাঙল আছে আর বাকি সমগ্ৰ অংশের আছে কেবল এক থেকে দুইটি লাঙল।

এই সীমিত তথ্য প্রমাণ থেকে আমরা যদি ধরে নিই যে কৃষিজীবীদের এক বৃহৎ অংশই মধ্য-পর্যায় ভুক্ত, সেখানে বেশিরভাগ বৃহৎ গ্রামেই ৪-১৫ আসামি (৫-১০ শতাংশ) প্রকৃতই অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধিশালী, তাহলে খুব একটা ভুল হবে না। অপর দিকে বহু গ্রামে ১৫-৩০ শতাংশ কৃষিজীবীর নির্জস্ব জমি বা কৃষিকার্যের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। সুতরাং তাদের দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত করা যেতে পারে। এখানে ভূমিহীনদের এবং কারুজীবীদের দরিদ্রতর অংশকে হিসাবে আনা হয়নি।

দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল কিনা এবং ধনীরা আরও সম্পদশালী হয়ে উঠছিল কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত করার মতো যথেষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে যখনই কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক স্তরে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়েছে, তখনই গ্রামের অর্থশালী ব্যক্তিরা তাদের বোঝা দরিদ্রতর গ্রামবাসীদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে। তবে এই প্রসঙ্গে প্রধানত এটিই আমাদের বুঝতে হবে মুঘল রাজত্বকালে গ্রামীণ সমাজ কেবল দরিদ্র নিঃসম্বল ব্যক্তিতে পরিপূর্ণ ছিল না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে এই যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা গেল, গ্রামীণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বৃদ্ধির উপর তার কি প্রভাব পড়তে পারে? আমরা এর ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুই রকম প্রমাণই পেয়েছি। এর ঋণাত্মক বা মন্দের দিকটা দেখতে হলে বলা যায় যে সমাজের ধনবান অংশ যথা মহাজনেরা চাষ করবার জন্য দরিদ্র কৃষকদের ষণ্ড, লাঙ্গল, বীজ ইত্যাদি দিয়ে বা রাজস্ব দেবার জন্য টাকা ধার দিয়ে ফসল কাটার সময় তাদের কাছ থেকে সুদ সমেত সেই টাকা আদায় করে। টাকা দিতে না পারলে তারা জমিটিই দখল নিয়ে নেয়। আবার দুর্ভিক্ষের সময় অর্থবান গ্রামবাসীরা দুর্বলতর শ্রেণির গ্রামবাসীদের অর্থ ঋণ দিয়ে বিনিময়ে তাদের দিয়েই পরিত্যক্ত ক্ষেত জমি চাষ করে কৃষিযোগ্য করে তোলে। প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো মাথা ঘামায়নি। তাদের একমাত্র চিন্তা ছিল রায়তি ভূখণ্ড যেন রিয়ায়তি জমিতে পরিবর্তিত না হয়ে যায়, কারণ তারা ছাড় দিয়ে ন্যূনতম রাজস্ব দেয়।

আবার এর ধনাত্মক বা ভালো দিকটি দেখতে হলে, সুবিধাভোগী শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ যথা গ্রামের জমিদার এবং ধনী কৃষিজীবীগণ গ্রামের কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তথা গুণমানের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ উপকরণ এবং তত্ত্বাবধান দিয়ে অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। এই সাহায্যের ফলে উচ্চমানের অনেক শস্যের উৎপাদনও শুরু করা গেছে। যেমন–গম, তুলা, নীল, তৈলবীজ ইত্যাদি অর্থকরী শস্য। এরজন্য অবশ্য আরও অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়েছে এবং তামাক, ভুট্টা ইত্যাদি নূতন শস্যের উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। এই উন্নততর শস্যগুলির জন্য অধিকতর জলের প্রয়োজন হয় এবং এতে আরও বেশি শ্রমিকও নিয়োগ করার প্রয়োজন হয়।

এইভাবে বিভিন্ন সামাজিক স্তরের বিন্যাস, অর্থনৈতিক বৈষম্যের বৃদ্ধি এবং অপরদিকে কৃষিকর্মের বৃদ্ধিসাধন গুণমানের উন্নয়ন পাশাপাশি চলতে থাকে। তবে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার কারণে, এবং ভূমি রাজস্ব নিরূপণ এবং সংগ্রহের প্রক্রিয়া সামঞ্জস্য পূর্ণ না হলে, এই সমস্ত উন্নয়নমুখী দিকগুলি বাধাপ্রাপ্ত হতে পারত।

গ্রাম সমাজ

যদিও ব্যাডেন পাওয়েলের মতো ব্রিটিশ শাসকেরা ‘পল্লীসমাজ বা গ্রাম্য সম্প্রদায়’ কথাটি সৃষ্টি করেন এবং জাতীয়তাবাদী নেতারা এটিকে ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল বলে ধরে নেন, তাহলে প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় ভাষাগুলিতে এর সমার্থক কোনো শব্দ। আছে বলে মনে হয় না। এর কারণ গ্রাম কথাটিই একটি স্থানীয় সমাজ বা সম্প্রদায়কে বোঝায়–তা বর্ণ, জাতি, আর্থিক অবস্থা, সামাজিক স্তর ইত্যাদির ভিত্তিতে যতই বিভক্ত হোক না কেন। আমরা দেখেছি যে গ্রামের পঞ্চায়েতগুলি খুদ-কস্‌ত বা মালিক কৰ্ষকদেরই অথবা সমাজের ওই স্তরেরই কয়েকজন প্রামাণ্য ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ থাকত না (কলাতারান)। আমরা এও দেখেছি গ্রামীণ সম্প্রদায় জমির মালিক ছিল না। জমিগুলি ব্যক্তিগত মালিকানায় ন্যস্ত ছিল। যাদের পৃথকভাবে মান নিরূপণ করা হত। তাহলেও মাঝেমধ্যে মালিক কৰ্ষকদের একটি সমন্বয়কে নিরূপিত ভুমিরাজস্ব দেবার দায়িত্ব দেওয়া হত। গ্রাম থেকে কৃষিজীবী মানুষের স্থান ত্যাগকে প্রতিরোধ করার এটি একটি ব্যবস্থা ছিল বলা যায়। ১৮শ শতাব্দীতে কেন্দ্রীয় প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ায় জমিদাররা ক্রমশ আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ গ্রামের সম্ভ্রান্ত কৃষিজীবীদের গুরুত্বও হ্রাস পেতে থাকে।

শহর এবং নাগরিক জীবন

শহর এবং নাগরিক জীবনকে কোনো দেশের উন্নয়ন ও সংস্কৃতির সূচক বলে ধরে নেওয়া হয়। আবুল ফজলের মতে পৃথিবীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা শহরেই মিলিত হবেন, এ না হলে দেশের প্রগতি আসবে না। মুসলিম সভ্যতায় নাগরিক জীবন একটি বিশেষ অঙ্গ ছিল। বর্তমানকালে এক খ্যাতনামা ফরাসি ঐতিহাসিক ফার্নান্দ ব্ৰদেল বলেছেন, ‘শহরগুলি বৈদ্যুতিক চাপ বৃদ্ধির যন্ত্র বা ট্রান্সফর্মারের সঙ্গে তুলনীয়। তারা উৎকণ্ঠা বাড়ায়, পারস্পরিক আদান-প্রদানের ছন্দকে দ্রুততর করে, এবং সর্বদা মনুষ্য জীবনকে নতুন উদ্যম যোগায় নগরগুলি প্রসারের প্রেরণা দেয় আবার সেই প্রসারণ থেকে নিজেই সৃষ্ট হয়।’ (সভ্যতা ও পুঁজিবাদ ১৫শ-১৮শ শতক)

আমরা এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে সুলতানি যুগে ভারতে শহর এবং নাগরিক জীবনের পরিবর্ধনের কথা বলেছিলাম, ১৬শ এবং ১৭শ শতকে নগরগুলির এই বেড়ে ওঠা আরও দ্রুততর হয়ে ওঠে এবং ১৮শ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এই পরিবর্ধন অক্ষুণ্ণ থাকে।

একটি শহরের পরিমাপ কী হতে পারে তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে কোনো ঐক্যমত নেই। যদিও এ ব্যাপারে সকলেই স্বীকৃত যে, কোনো শহরের আয়তন দেশের জনসংখ্যার উপর নির্ভরশীল। শহরের একটি প্রধান অঙ্গ হল সেখানের বাজার। ভারতের সবথেকে ক্ষুদ্র শহরগুলি, যাদের কসবা বলা হয় তাদের সংজ্ঞাই হল বাজার সহ একটি গ্রাম বলে। অন্যভাবে বলা যায় যে এখানে গ্রাম্য জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলি বর্তমান। যথা কৃষিজ উৎপাদন এবং একটি বাজার। সাধারণত কসবা একটি পরগনারও প্রধান শহর হত। শহরের গুরুত্ব ছিল স্তরে স্তরে বিভক্ত। সাদামাটা কসবার পরে জেলার সদর (সরকার) যেখানে ফৌজদার বাস করতেন এবং এর পরবর্তী পর্যায়ে প্রাদেশিক প্রধান শহর ও রাজধানী যথা আগ্রা, দিল্লি, লাহোর ইত্যাদি।

বলা হয় যে আকবরের আমলে ১২০০ প্রধান শহর এবং এবং ৩২০০ উপনগরী বা গ্রামীণ শহর (কসবা) ছিল। অবশ্য এর মধ্যে দাক্ষিণাত্যের ছোটো-বড়ো শহরগুলি ধরা নেই। ১৭শ শতাব্দীতে আগ্রা ছিল বৃহত্তম শহর–মোট জনসংখ্যা ৫ লক্ষ। অবশ্য বাদশাহ যখন আগ্রাতে আসতেন তখন এই জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াত ৬ লক্ষ। ১৭শ। শতাব্দীর মধ্যভাগে বাদশাহের দরবার দিল্লিতে স্থানান্তরিত হবার পরেও দিল্লি এক বৃহৎ নগরীই ছিল। দিল্লির জনসংখ্যা তখন ইউরোপের বৃহত্তম নগরী প্যারিসের সমান ছিল। পর্যটক করিয়াট-এর বিবরণ অনুযায়ী ১৭শ শতাব্দীর প্রারম্ভে লাহোর আগ্রার থেকেও বৃহত্তর ছিল এবং তাঁর মতে ‘সমগ্র বিশ্ব চরাচরের মধ্যে বৃহত্তম নগরী ছিল। আমেদাবাদ, লন্ডনও শহরতলির থেকেও বড়ো ছিল, এবং বলা হয় যে পাটনার জনসংখ্যা ছিল ২ লক্ষ। অন্যান্য বৃহৎ নগরীর মধ্যে ঢাকা, রাজমহল, থাট্টা, বারহামপুর এবং মসলিপট্টনমের নাম উল্লেখযোগ্য ছিল।

তবে শহরের আয়তনের অপেক্ষা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে তার অবদান বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যান হিসাবে ১৭শ শতাব্দীতে দেশের সমগ্র জনসংখ্যার অনুপাতে নাগরিক জনসংখ্যা ছিল অতি উচ্চ, প্রায় ১৫ শতাংশ। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এই অনুপাত আর অতিক্রম করা যায়নি। যদি এই নগরায়ণের পরিসংখ্যানকে নিয়ে কোনো বিতর্ক থেকেও থাকে, তাহলেও মুঘল আমলে বৃহৎ শহর বা মহানগরগুলি ছিল উৎপাদন এবং বিপণনের, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ সংস্থা এবং শিল্প বাণিজ্যিক উদ্যোগের সমৃদ্ধ প্রাণকেন্দ্র। স্থলপথে এবং জলপথেবাহিত যোগাযোগ এবং সংবাদ আদান-প্রদানের প্রশাখাগুলি এই সব শহরেই পরস্পরকে ভেদ করে, বা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে বারবার এই মহাদেশকে অতিক্রম করে সুদূর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম ইউরোপ এবং অন্যত্র ছড়িয়ে যেত। কিন্তু যোগাযোগের এই অঞ্চলগুলির সংযোগস্থল ছিল কিন্তু এই মহানগরগুলিই।

চার রকমের পৃথক নাগরিক কেন্দ্রকে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত যে শহরগুলি মূলত প্রশাসনিক কেন্দ্র যেখানে ধর্মচর্চা বা উৎপাদন শিল্পের বিশেষ গুরুত্ব ছিল না। দিল্লি, আগ্রা, লাহোর এবং অন্যান্য অনেক প্রাদেশিক রাজধানীকে এই পর্যায়ে ফেলা যায়। পরবর্তীকালে পুনা, ফায়জাবাদ এবং হায়দরাবাদ এ ধরনের শহর হিসাবে গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় পর্যায়ের শহর বলতে সেগুলিকে ধরা যায় যেগুলি মুখ্যত বাণিজ্য এবং উৎপাদন-ভিত্তিক জনপদ ছিল। পরে অবশ্য প্রশাসনিক কাজকর্মও তার সঙ্গে যুক্ত হয়। পাটনা এবং আহমদবাদ এই পর্যায়ের শহর। তৃতীয় পর্যায়ে সেই শহরগুলির কথা বলা যায় যেগুলি মুখ্যত তীর্থস্থান কিন্তু যেখানে কারুশিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যেরও বিপুল বিকাশ ঘটেছিল। এই শহরগুলির জনসংখ্যার এক বড়ো অংশেই ছিল ভ্রাম্যমাণরা। তারা শহরে আসত ও যেত। বারাণসী, মথুরা এবং দাক্ষিণাত্যের কাঞ্চী ও তিরুমালাইকে এই পর্যায়ের শহর বলা যায়। আজমীর ছিল একাধারে এক বিখ্যাত ধর্মস্থান, আবার তার সঙ্গে প্রশাসনিক কেন্দ্র। সবশেষে সেই শহরগুলির কথা বলা যায় যেগুলি এক বিশেষ ধরনের উৎপাদন শিল্প বা উচ্চাঙ্গের কারুশিল্পের জন্য বিখ্যাত, বা যেখানে কোনো আকর্ষক জনপ্রিয় বস্তু স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন হয়। এ ধরনের কয়েকটি শহর হল–নীলের জন্য বায়না, গুজরাটের পাটান রঞ্জক শিল্পের জন্য, বা অওয়াধ জেলার খৈরাবাদ বস্ত্র শিল্পের জন্য, যেগুলি তাদের উৎপন্ন বস্তু বা স্থানীয় শিল্পের জন্য বিখ্যাত।

মুঘলরা উত্তর ও মধ্য ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সফল হবার ফলে দেশে শিল্প ও বাণিজ্যের বিশেষ প্রসার হয় এবং সেইজন্যই এই সময়কালকে নগরায়ণের প্রকৃত স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। অবশ্য দেশের সর্বত্র কিন্তু বিকাশ একভাবে হয়নি। ১৭শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে এবং পূর্ব পাঞ্জাবে এই উন্নতি ছিল দ্রুততম। আবার নবাব বা স্থানীয় শাসকদের দৃঢ় শাসনের জন্য উত্তরপ্রদেশের পূর্বভাগ, বিহার ও বঙ্গে ১৮শ শতাব্দীর প্রথমভাগে প্রভূত উন্নতি লাভ করে। মারাঠা শাসনের ছত্রছায়ায় পুনা, হুগলি ইত্যাদিরও উন্নয়ন দেখা যায়।

নতুন শহর শাহজাহানাবাদের নকশা দেখে বার্নিয়ের মন্তব্য করেন যে গৃহের স্থাপত্যগুলি ভারতবর্ষের আবহাওয়ার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই গড়ে উঠেছিল। বাড়িতে প্রচুর হাওয়া আসার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা ছিল। আবার গ্রীষ্মের রাত্রে খোলা হাওয়ার মধ্যে শোবার জন্য উন্মুক্ত ছাদের ব্যবস্থা বাড়িগুলিতে থাকত। তিনি বলেছেন ‘খুব অল্পসংখ্যক গৃহই সম্পূর্ণ ইট বা পাথরে তৈরি হত এবং অনেক বাড়িই ছিল মাটি ও খড় দ্বারা নির্মিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই সমস্ত বাড়ি হত বাতাসময় এবং আরামপ্রদ। বেশিরভাগ বাড়িতেই একটি বড় উঠান এবং বাগান থাকত। বাড়িগুলি ছিল প্রশস্ত এবং উত্তম আসবাবপত্রে সজ্জিত। খড়ের চালগুলি লম্বা, কঠিন ও সুন্দর এক স্তর বেতের উপর স্থাপিত থাকত এবং দেওয়ালগুলি চুনকাম করা হত হালকা সাদা চুন দিয়ে।’

শহরে এইরকম বহুসংখ্যক বড়ো আকারের বাড়ি ছাড়াও ছিল অনেক দোকানপাট, যার দোতলায় দোকানদারেরা বাস করত। আর ছিল অজস্র ছোটো ছোটো মাটির তৈরি এবং খড়ে ছাওয়া বাড়ি–সাধারণ সৈন্য, দাসদাসী, এবং শিবিরের সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ মানুষদের বাসস্থান।

সমস্ত পথ সরু, আঁকাবাঁকা এবং কাঁচা ছিল ভাবলে ভুল হবে। প্রতি শহরেই দুটি-একটি প্রধান রাজপথ থাকত যার পাশে চৌক গড়ে উঠত। এই রাস্তাগুলি সাধারণত বাঁধানো থাকত। শহরকে অনেকগুলি অংশে বা মহল্লায় ভাগ করা হত এবং এক-এক মহল্লায় একই পেশা বা জাতিবর্ণের লোক বাস করত। যদিও দিল্লিতে অনেক মহল্লায় হিন্দু ও মুসলিমরা পাশাপাশি বাস করত। রাত্রে নিরাপত্তার জন্য মহল্লাগুলি তালাবন্ধ করে দেওয়া হত, যে ব্যবস্থা দিল্লিতে আজকাল আবার ফিরে আসছে।

বলা হয় যে ভারতের নগরগুলির কোনো আইনসিদ্ধ চরিত্র ছিল না। যা ইউরোপে সবসময় থাকে, সেই জন্য কোনো পৌরব্যবস্থাও ছিল না। এই মতবাদকে অবশ্যই পরিবর্তন করার প্রয়োজন আছে। শহরের শাসনব্যবস্থা কোতোয়ালের হাতে থাকত, সুরক্ষা ও পাহারার জন্য কোতোয়ালের নিজস্ব কর্মচারী থাকত। কোনো-কোনো। বিশেষ ক্ষেত্রে তিনি ফৌজদারের সাহায্য নিতেন। পণ্যদ্রব্যের ওজন নিয়ন্ত্রণ, মূল্য নিয়ন্ত্রণ, বেআইনি শুল্ক চাপানো বন্ধ করা ইত্যাদি ছাড়া তার বেশ কিছু পৌর কর্তব্যও ছিল। যেমন জলাশয়গুলির দেখাশোনা করার জন্য কর্মচারী নিয়োগ করা, দাসেদের ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধকরণ, কর্মহীন অলসদের কিছু হাতের কাজ দেওয়া এবং বিভিন্ন মহল্লায় সাধারণ লোকেদের সংঘবদ্ধ করে সহায়ক বাহিনী গঠন করা, দক্ষ কারিগরদের সমিতি বা গোষ্ঠীর একজন করে প্রধান নিয়োগ করা। আমরা জানি যে বহু শহরে ব্যবসায়ীদের একজন প্রধান (মালিকউৎতুজ্জর, বা নগর শেঠ) থাকত, যাকে কখনো-কখনো বর্ণ বা ধর্মের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হত। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে স্থানীয় ভাবে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শের একটি মঞ্চ ছিল এবং তাতে অংশগ্রহণের সুবিধাও সকলের ছিল। কোতোয়াল আবার মানুষের আসা-যাওয়ার। হিসাব জন্ম-মৃত্যুর খতিয়ান রেখে আবার লোকগণনারও ব্যবস্থা করে একপ্রকার গোয়েন্দার কাজও করত।

এককথায় বলতে গেলে একথা লক্ষণীয় যে শহরের অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থা। নাগরিক জীবনের মূল উদ্দেশ্যসাধনের বিষয়ে সন্তোষজনক ভাবেই কাজ করে যেত।

কারিগর এবং ওস্তাদ কারুশিল্পীরা

বর্ষে রাজপ্রাসাদ নির্মাণের কাজে অসংখ্য মানুষ নিযুক্ত ছিল। শোনা যায় যে আলাউদ্দিন খলজি তার প্রাসাদ নির্মাণে ৭০,০০০ শ্রমিককে নিয়োগ করেছিলেন, বাবর দাবি করেছিলেন যে তাঁর আগ্রার প্রাসাদে প্রত্যহ ৬০০ জন লোক কাজে আসে এবং তার আগ্রা সিক্রি ও বায়ানার আগ্রা, সিক্রি বায়ানার ও কোলপুর প্রাসাদের পাথর কাটার জন্য কর্মরত ছিল ১৪৯১ জন। আকবরের সময় আগ্রা দুর্গ নির্মাণের জন্য প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হাজার জন কারিগর, শ্রমিক মজদুর কাজ করত, এবং পাথর চূর্ণ সরবরাহ করার জন্য ৮০০০ জন মানুষ নিযুক্ত ছিল। ট্যাভার্নিয়ারের কথা বিশ্বাস করলে বলতে হয় তাজমহল নির্মাণের কাজে ২০,০০০ জন শ্রমিক নিরন্তর কাজ করে যেত, এরসঙ্গে অভিজাত ব্যক্তিদের বাসস্থানের কথা যোগ করলে দেখা যায় যে একমাত্র গৃহনির্মাণ শিল্পেই বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি নিযুক্ত ছিল।

এরপরে বলা যায় শহরে ও গ্রামে যেসব হস্তশিল্পী ও দক্ষ কারিগর নিযুক্ত ছিল তাদের কথা। শহরে ও গ্রামে বিভিন্ন উৎপাদনমুখী শিল্পে বহু কারিগর কর্মরত ছিল। তাদের মোট সংখ্যা সম্বন্ধে কিছু অনুমান করা কঠিন, তবে এটুকুই বলা যায় যদিও জাতি ও বর্ণ অনুসারেই এইসব কারুশিল্পের কর্মীরা কার্যে নিযুক্ত হত (যথা কুম্ভকার জাতির মানুষজনই মাটি দ্রব্যের কাজ করত), তবে বস্ত্রের চাহিদা খুব বেড়ে গেলে আরও বেশিসংখ্যক অন্য মানুষও এই শিল্পে যোগ দিত। প্রধান শিল্প অবশ্যই ছিল বস্ত্র শিল্প। এর মুখ্য উপাদান তুলা হলেও বঙ্গদেশে প্রস্তুত তসর বা রেশমি সুতা ব্যবহার করে, তুলার সুতা ও রেশম মিশ্রিত বস্ত্র খুবই জনপ্রিয় ছিল এবং অনেক সময়ে এই কাপড়কে রং দিয়ে রাঙানোও হত। নৌকা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প সহ কাঠের কাজ এবং চর্মজ বস্তু উৎপাদন বা চামড়ার কাজ ছিল আরও দুটি প্রধান শিল্প। এছাড়াও ধাতব শিল্পকর্ম, কাগজ প্রস্তুত, কাঁচ তৈরি ইত্যাদিও শিল্পের তালিকায় যুক্ত ছিল।

ভারতীয় কারিগরেরা অতি সহজ যন্ত্রপাতি দিয়ে অতি উচ্চ গুণমানের বস্তু উৎপাদন করতে পারত বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। এর একটি কারণ হল স্থানীয় চাহিদার সীমাবদ্ধতার জন্য এবং কারুশিল্পীরা কর্মহীন হয়ে পড়বে এই ভয়ে উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতির বিষয়ে কেউ বিশেষ চিন্তা করত না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে ১৬৭২ সালে ওলন্দাজরা এমন একটি প্রণালী সফলভাবে প্রয়োগ করে যাতে করে পূর্বের তুলনায় চতুগুণ লোহার পেরেক, এবং কামানের গোলা উৎপাদন করা যেত। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসকরা তাড়াতাড়ি এই পদ্ধতি বন্ধ করে দেয় যাতে করে স্থানীয় লৌহশিল্পীরা কর্মহীন না হয়ে পড়ে। তপন রায়চৌধুরী লিখছেন যে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের এই ভারতবর্ষ থেকে মধ্যযুগের চীন এবং প্রারম্ভিক পর্যায়ের আধুনিক ইউরোপ বহু অতি প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক বেশি উন্নত ছিল যথা জল এবং বায়ুশক্তির ব্যবহার, ধাতুবিদ্যা, ছাপাখানার কাজ, নৌচালনার যন্ত্রপাতি, সকল কার্যে ব্যবহারের উপযুক্ত কিছু মৌলিক সরঞ্জাম এবং সূক্ষ্ম প্রয়োগের উপযুক্ত কিছু উন্নত যন্ত্র।

এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে মধ্যযুগের ভারতে প্রযুক্তির বিশেষ কোনো অগ্রগতি হয়নি। ভারতে বিশেষ করে সুরাটে যেসব জাহাজ নির্মাণ হত সেগুলি ইউরোপ থেকে আমদানি করা যে-কোনো জাহাজের সমতুল্য। এ দেশে বেশ উচ্চমানের ভারী কামানও নির্মিত হত। এছাড়া কঁচা রেশমি সুতা গুটিয়ে নেবার পদ্ধতিতে নীল ও সোরা উৎপাদন, কাপড় রঙে ছোপানো এবং ছাপার পদ্ধতি ইত্যাদিতে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির নির্দেশে অনেক পরিবর্তন ও উন্নয়ন হয়েছিল। এসব দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায় ভারতীয় কারিগরেরা আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করতে অবশ্যই প্রস্তুত ছিল যদি এতে তাদের আয়ের বৃদ্ধি হয় এবং যতক্ষণ না এরজন্য তাদের জীবিকার উপর কোনোরকম অনিশ্চয়তা নেমে আসে।

ইউরোপে যেমন উৎপাদন শিল্পগুলি গ্রামগুলিকে বাদ দিয়ে কেবল শহরেই গড়ে উঠেছিল, ভারতবর্ষে কিন্তু তা হয়নি। গ্রামগুলিতে কেবল চিরাচরিত চিনি, তেল, নীল, কাঁচা রেশমি কাপড় ইত্যাদিরই উৎপাদন হত না, এখানে আবার স্থানীয় উৎপাদন কেন্দ্রগুলিও গড়ে উঠেছিল। এইভাবে মাদ্রাজ থেকে আরমগাঁও তীরবর্তী অঞ্চলে অনেক কুশলী কারুশিল্পীদের গ্রাম ছিল যারা রপ্তানিযোগ্য বস্ত্রাদি তৈরি করত। ‘অরম’-এর বক্তব্য অনুসারে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলায় রাজপথ বা বড়ো শহরের সন্নিকটে এমন কোনো গ্রাম ছিল না বললেই হয়, যেখানে প্রতিটি গ্রামবাসীই বস্ত্রশিল্প উৎপাদনে কার্যে ব্যাপৃত ছিল না। গুজরাট, অওয়া ইত্যাদি অঞ্চলেও ব্যবস্থা এই রকমই ছিল।

প্রধানত এইসব কারুশিল্পীরা কিন্তু পারিবারিক ভিত্তিতেই কাজ করত। যথা একটি তন্তুবায় পরিবারে নারী ও শিশুরা তুলা পরিষ্কার করত এবং সুতো কাটত। পুরুষেরা তাতে কাজ করত। সাধারণত এইসব কারিগরদের নিজেদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকত। একমাত্র বাদশাহর কারখানাগুলিতেই কারিগররা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্যের তত্ত্বাবধানে কাজ করত, সেখানে তাদের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল সবই কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে দেওয়া হত। কোনো কোনো অধিকতর ধনশালী এবং ক্ষমতাবান অভিজাতরাও এই পদ্ধতি অনুসরণ করত। একমাত্র কোনো বিশেষ প্রকল্পে, যথা সরকারের দ্বারা সাধারণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত বিশাল ভবন নির্মাণ, এছাড়া জনকল্যাণমূলক কাজ যথা, পুকুর, হিরের খনির কাজ, জাহাজ নির্মাণ ইত্যাদিতে সমস্ত কর্মীকে এক জায়গায় নিয়ে এসে কিছুটা উপরওয়ালার তত্ত্ববধানে। কাজ করানো হত। শোনা যায় হিরে উত্তোলনে ২০,০০০ বা ৩০,০০০ লোককে নিয়োগ করা হত, যেখানে প্রতিটি ঠিকাদারের অধীনে দুই থেকে তিন হাজার লোক কাজ করত। তবে এগুলো বেশিরভাগই তদর্থক সংস্থা ছিল, কোনো স্থায়ী প্রতিষ্ঠান নয়। কাজ শেষ হলেই কর্মীরা যে-যার ঘরে চলে যেত। অর্থাৎ বড় মাপের উদ্যোগে বা প্রকল্পে হাত দেবার মতো তেমন কোনো স্থায়ী সংস্থা ছিল না।

কারিগরদের মোটামুটি দুইটি ভাগে ভাগ করা হত। যেমন গ্রামীণ কর্মীরা, তারা আংশিক সময়ের কারিগর ছিল, এদের প্রায়শই কৃষকদের থেকে আলাদা করে চেনা যেত না। উদাহরণস্বরূপ, যারা তেলের ঘানিতে বা তেল নিষ্কাশনে কাজ করত, নীল বা সোরা উৎপাদনে কর্মরত ছিল–এরা ছিল মরশুমি কর্মী, এবং এদের অনেকেই উৎপাদন শিল্পে বছরে পাঁচ থেকে ছয় মাস কাজ করত। আবার কাজের চাহিদা বাড়লে তারা তাদের জমি অন্যদের চাষ করার জন্য ভাড়া দিত। ঠিক যেমন রেশমের চাহিদা বাড়লে গুটি পোকা চাষিদের কাজ বাড়ত। তাঁতিরা অবশ্য ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামের লোকদের কাপড় বুনে দিয়ে বিনিময়ে শস্যের একটা ভাগ পেত। তবে উপায় হিসাবে তাদের প্রায়ই ছোটো একখণ্ড জমি থাকত, যা ছিল গ্রামের সঙ্গে তাদের। বন্ধন। অতিরিক্ত যা উৎপাদন হত সেগুলি তারা বাজারে বিক্রি করে দিত।

দ্বিতীয় শ্রেণিতে পেশাদার কারুশিল্পীরা যারা শহরে ও গ্রামে উভয়তই কাজ করত। ব্যবসা এবং উৎপাদন বাড়লে বণিকেরা ধীরে ধীরে এই পেশাদার কারিগরদের তাদের প্রভাবে আবার কাজ শুরু করে দাদনি বা বিনিয়োগ করে। তারা ঋণ দিয়ে কারিগরদের নিজেদের আওতায় নিয়ে আসত। কাঁচামাল দিয়ে এবং উৎপাদিত বস্তুটির মাপ, তার কারুকার্য ইত্যাদি সবই নির্দিষ্ট করে দিয়ে। এইভাবে করমণ্ডল অঞ্চলের মাদ্রাজ (চেন্নাই) থেকে আরমগাঁও পর্যন্ত কর্মরত সমস্ত তন্তুবায়কে কাশি ভিরান্না তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিলেন, সুতরাং সেগুলিকে ভিরান্নার গ্রাম বলা হত। এক্ষেত্রে নিজেদের তাঁত থাকা সত্ত্বেও এই কারিগরেরা প্রকৃতপক্ষে মজুরি-নির্ভর ছিলেন। কাঁচামাল এবং অন্যান্য শ্রমিকদের দরুন খরচা ব্যবসায়ী নিজেই দিতেন। এইভাবেই ১৬৭৬ সালে মাদ্রাজের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিদের জানান যে উৎপন্ন কাপড়ের গুণমানের উন্নতির জন্য তারা তন্তুবায়দের পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে এ সত্ত্বেও এটি একটি প্রকৃত ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায় তা কিন্তু ছিল না। রাশিয়ান পণ্ডিত চিচেরভের মতে ‘এ ছিল এমন এক ধরনের ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা, যেখানে মালিকের কর্তৃত্ব (মালিকানা) যথেষ্ট শিথিল করা হয়েছিল।’ ইনি আরও বলছেন যে ‘এই ব্যবস্থায় অবশ্য পুরাতন উৎপাদন পদ্ধতি পরিত্যক্ত হয়নি বরং তা সংরক্ষণের ব্যবস্থাই করা হয়েছিল। এই পদ্ধতি কিন্তু সর্বত্রই প্রকৃত ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার এক প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’

উন্নয়নের আর-একটি বিকল্প পথ দেখা গেল যখন দক্ষ কারুশিল্পীরা নিজেরাই উৎপাদনের ব্যবস্থাপনা, সমগ্র ব্যবসার দায়িত্ব এবং আর্থিক বিনিয়োগের সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। এই সুদক্ষ কারিগর বা ওস্তাদদের ক্রমশ বেড়ে ওঠার বিষয়টি নিয়ে কিন্তু বিশেষ চর্চা হয়নি। এই শ্রেণির ‘ওস্তাদ’দের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের কথা স্বীকার করেই আবুল ফজল সমাজে এদের দ্বিতীয় স্তরে স্থান দেন, অর্থাৎ অন্যান্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একই শ্রেণিতে, অথচ অভিজাত এবং সৈনিক শ্রেণির থেকে অপেক্ষাকৃত নীচে, আবার পণ্ডিত এবং ধর্মতাত্ত্বিকদের উর্ধ্বে। (আমি ইচ্ছা করেই ধার্মিকশব্দটি ব্যবহার করিনি, বরং ধর্ম ব্যবসায়ীদের বোঝাতে চেয়েছি।) এই উদ্যোগী মানুষদের তিনি নাম দিয়েছিলেন (atifitar) ‘কারুকৃৎ’ বলে। শাহেন শাহ আকবরের। একটি ফরমান বা আদেশপত্র থেকে এই কারুশিল্পীদের সামাজিক মর্যাদা বোঝা যায়, যেখানে যিনি এদের দুজনকে জমি প্রদান করেন। বাংলাতে আমরা এই রকম অনেক অর্থবান অতি দক্ষ কারিগর বা তন্তুবায়ের কথা জানি যাঁরা নিজেদের মূলধন বিনিয়োগ করে নিজেরাই ব্যবসা চালাতেন স্বাধীনভাবে। আবার অওয়াধ বা অযোধ্যাতে এইরকম একজন কারুবিদের অধীনে ৫০০ জন শিক্ষানবীশ কাজ করত। কাশ্মীরি শাল শিল্পে এমন সব ওস্তাদ শালকর ছিলেন, যাদের নিজেদেরই ৩০০ টি করে শালবোনার যন্ত্র ছিল। এইরকম ওস্তাদ কাষ্ঠ শিল্পী সুরাট, বঙ্গ ও বিহারেও কর্মরত ছিলেন, যারা ইতস্তত কাজের জন্য সূত্রধারদের ভাড়া করে নিয়ে আসতেন। তাই তপন রায়চৌধুরীর উদ্ধৃতি অনুসারে–কারুশিল্পীদের পুঁজিবাদী উদ্যোগপতি রূপে আত্মবিকাশ মার্ক্স-এর মতে ব্যবসায়িক থেকে শিল্পভিত্তিক ধনতন্ত্রে উপনীত হবার যে প্রকৃত বৈপ্লবিক পথ–তা কিন্তু ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিত অনুপস্থিত ছিল না।

নারীদের কথা

ভারতের সর্বত্র মেয়েদের সকলেরই কিছু সাধারণ সমস্যা ছিল। যথা তাদের পিতা, স্বামী বা পুত্রের উপর নির্ভরশীলতা, এবং পুরুষ প্রাধান্যময় পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাস করার কিছু বাধ্যবাধকতা। একমাত্র কেরল এবং কিছু উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল ছাড়া ভারতের অন্যত্র সর্বত্রই সমাজচিত্র ছিল একই রকম। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে আবার উচ্চশ্রেণির মহিলাদের সঙ্গে শ্রমজীবী মহিলা সম্প্রদায়ের প্রচুর তফাত ছিল। উচ্চশ্রেণির মহিলারা সাধারণত শিক্ষিত হতেন এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন, তবে হারেমের মধ্যে বন্দি হয়ে, যেখানে তাদের অন্যান্য বহু পত্নী ও উপপত্নীর সঙ্গে তার স্বামীকে ভাগ করে নিতে হত। এদের মধ্যে কেউ কেউ সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন এমনকি রাজ্যের শাসনভারও নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। যথা গণ্ডোয়ানার রানী দুর্গাবতী এবং আহমদনগরের চাঁদ বিবি। আবার কেউ কেউ তাঁর স্বামীর মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তার করেছিলেন, যেমন নূরজাহান। অন্যদের মধ্যে জাহানারার কথা বলা যায়, যিনি তাঁর পিতা শাহজাহানের সঙ্গে এবং শাহজাহানের মৃত্যুর পর ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে থেকে দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। আরও অনেক মহিলা, উদাহরণস্বরূপ মুহম্মদ শাহর রাজত্বকালে সবজিওয়ালী জুহবা বা তার পত্নী, ভূতপূর্ব নর্তকী উধমবাই ইত্যাদিরা। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সময় দেশের রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন।

তবে পর্দার পিছন থেকেও মহিলারা সমাজে যে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তা ছিল এসবের থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তারা সম্রাটদের রুচি ও পৃষ্ঠপোষকতার যোগ্য মানুষের নির্বাচনকে সঠিকভাবে প্রভাবিত করতেন এবং নিজেরাও অনেক শিল্পী, সংগীতজ্ঞ ইত্যাদিদের অনুগ্রহ করতেন। তারা অনেকে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। জাহানারা ‘মাখাফি’ (লুক্কায়িত) ছদ্মনামে সাহিত্য রচনা করতেন, এবং ঔরঙ্গজেব জেব-উন-নিশা দিল্লিতে নির্বাসন দেবার পর তিনি সেখানে সাহিত্য-সংক্রান্ত একটি কর্মশালা (বেত-উল-উলুম) খুলেছিলেন।

মধ্যযুগে আরও অনেক অন্যায় প্রথা সমাজে প্রচলিত ছিল। যথা শিশুবিবাহ, জোর করে বিবাহ দেওয়া, পিতার সম্পত্তির ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করা ইত্যাদি। আকবর ছেলে ও মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারিত করে দিতে চেয়েছিলেন, মেয়েদের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, পারিবারিক চাপে বাধ্য হয়ে বিয়ে না করে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করার। কিন্তু এগুলি বেশিরভাগ মানুষই মেনে নেয়নি। এ ছাড়া মুঘলদের সতীদাহ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাও বিফল হয়, কেননা বেশিরভাগ প্রভাবশালী রাজপুত রাজারা সতীদাহ প্রথা মেনে চলতেন। তাই দাক্ষিণাত্যের এলিচপুরে ১৬১৪ সালে যখন কাছওয়াহার মহারাজ মান সিংহ-এর মৃত্যু হয়, তখন তাঁর সঙ্গেই চারজন রানী সতী হন, এবং অম্বরে আরও পাঁচ রানীর সতীদাহ করা হয়। তবে সতীদাহে সম্মত হওয়ার জন্য সমাজে কিন্তু সর্বাত্মক চাপ দেওয়া হত না কেননা কোনো রাজার মৃত্যুর পরও বহুসংখ্যক রানী বিধবা হয়ে বেঁচেছিলেন। সমসাময়িক রাজস্থানি সূত্রে তাদের নাম ও বংশমর্যাদা পাওয়া যায়। আবার পরিবারে সতীদের জন্য সমাজে বংশের মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। তাই দুর্ভাগ্যবশত রাজারা সতী হবার যোগ্য সহচরীর সংখ্যা বাড়াবার জন্য অলিখিত আইন মতে অনেককে বিবাহ করতেন। আবার অনেক পরিচারিকাকে রাজা নিজের শয্যায় আহ্বান করে তাদের অনেক সুবিধাও দিতেন। এই মহিলারা সচরাচর রাজপুত-বংশীয় হতেন না। এবং প্রায়শই নিম্নবর্ণ জাত হতেন। এরা রাজপরিবারে আসতেন সতী হওয়ার জন্য। তাই ১৬৯৮ সালে বিকানিরের মহারাজা অনুপ সিংহ-এর মৃত্যু হলে সঙ্গে ২ রানী, ৯ জন অলিখিত আইনগত স্ত্রী (খাওয়াস, পাতার, খালসা) এবং ৭ জন পরিচারিকা (সহেলি) সতী হন।

মুসলিম বড়োমানুষেরা সচরাচর বিবাহবিচ্ছেদ পছন্দ করতেন না, যদিও কয়েকটি বিবাহবিচ্ছেদের কথা আমাদের জানা আছে। সম্পত্তির বিষয়ে বলতে গেলে বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবার পর প্রশাসক প্রয়াত অভিজাতের ধনসম্পদ নিজের পছন্দমতো তার ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। অভিজাতদের কন্যারা পিতার সম্পত্তির কোনো অংশ পেতেন বলে কোথাও উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তবে অভিজাত ব্যতীত অন্য মুসলিমদের ক্ষেত্রে বিচারক হয়তো এইরকম আইন প্রণয়ন করে থাকতেও পারেন।

সাধারণ ঘরের মহিলাদের জীবন অত্যন্ত কঠোর ছিল। আমরা তৎকালীন ছবি থেকে দেখতে পাই যে শিশুসহ মহিলারা বাড়ির নির্মাণ কার্যে কাজ করছেন। মহিলা শ্রমিকরা পুরুষদের থেকে কম পারিশ্রমিক পেতেন। সরকারি নথিপত্র থেকে দেখা যায় যে কোটা অঞ্চলে ক্ষেতমজুর মহিলারা পুরুষদের থেকে কম বেতন পেতেন। কোনো-কোনো পেশাতে আবার মেয়েদের প্রচুর হাতযশ ছিল। যথা সকল শ্রেণির মহিলারাই প্রচুর সুতো কাটতেন। বঙ্গদেশে বিখ্যাত ঢাকাই মসলিমের জন্য প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম সূতা, বিশেষত উচ্চশ্রেণির মহিলারাই তৈরি করতেন। এঁদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ছিল এবং আঙুল ছিল অতি তৎপর। আমরা শুনেছি এই সব মহিলারা একজন দক্ষ কারিগরের সমান বেতন পেতেন, যার পরিমাণ ছিল মাসে তিন টাকা। অওয়াধের বিখ্যাত চিকন-এর কাজেও মহিলা শিল্পীদের বিশেষত্ব ছিল। তবে একথাও পরিষ্কার যে এই সমস্ত মহিলারা কিন্তু একজন ব্যবসাদার অথবা ওস্তাদ কারিগরের কঠোর তত্ত্বাবধানে কাজ করতেন।

ভৃত্য এবং দাস

১৬শ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে আগত ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ী ও পর্যটকেরা দেশের শাসক এবং শাসক পরিবারের বিভিন্ন সদস্যেরা যে কতজন ভৃত্য এবং অনুচর রাখতেন সে বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। কিছুটা জাঁকজমক এবং লোক দেখানোর জন্য, আবার কিছুটা তাদের বৃহৎ গৃহস্থালির প্রয়োজনেই। India at the Death of Akbar অর্থাৎ ‘আকবরের মরণোত্তর ভারতবর্ষ’ শীর্ষক পুস্তকে মোরল্যান্ড এ বিষয়ে আলোচনা করে বলেছেন ‘এই সব গৃহস্থালির পরিষেবা এক বৃহৎ অপচয় ছাড়া কিছু না।’ তার মতে এর ফলে ‘মূল্যবান জনশক্তির এক বিশাল অংশকে প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী কর্মসংস্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে অলাভজনক কাজে নিয়োগ করা হচ্ছে।’

সেই সময়ে সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিষেবা ক্ষেত্র কর্মসংস্থানের এক বিশাল অংশ অধিকার করে রেখেছিল। একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে গ্রামে কৃষিকার্য এবং শহরে কায়িক শ্রম বা কোনো উৎপাদন শিল্পের কাজকর্ম ছাড়া অপেক্ষাকৃত উচ্চতর পর্যায়ের কর্মক্ষেত্র বলতে ছিল একমাত্র রাজা বা অভিজাত সামন্ত পরিবারের গৃহে ব্যক্তিগত পরিষেবা (এখানে অবশ্য সামরিক বাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রটি বিবেচিত হয়নি)। শহরগুলিতে প্রচুরসংখ্যক ভিক্ষুকের উপস্থিতি দেখেই বোঝা যায় যে সমাজে নিয়োগের ক্ষেত্র কত সীমাবদ্ধ ছিল। অজস্র সাধু, সন্ন্যাসী, ভ্রাম্যমাণ ফকির ও বাউল ইত্যাদি ছিল আরেক শ্রেণির মানুষ, যাদের সম্বন্ধেও মোরল্যান্ডের বক্তব্য সমভাবে প্রযোজ্য।

তবে একথা ভুললেও চলবে না শাসকশ্রেণির অভিজাতদের ঘরে কাজকর্মের সুযোগে অনেকের কাছেই ছিল গতানুগতিক গ্রাম্য সমাজর একঘেয়ে জীবনযাত্রার থেকে মুক্তি। এবং সেখানে উচ্চতর জীবনযাত্রার চাহিদা মেটাতে বহুসংখ্যক কারিগরেরও কর্ম সংস্থান হত। এরা একথাও বিশ্বাস করত যে শাসকশ্রেণির বৈভবে তারাও ন্যায্য অংশভাগী, তা যেভাবেই সেই অধিকার অর্জিত হোক না কেন। অন্যভাবে বলতে গেলে আধুনিক যুগের সামাজিক মাপকাঠিকে অপরিবর্তিত ভাবে প্রাক-আধুনিক সমাজের উপর আরোপ করা সম্ভব নয়।

তবে মোরল্যান্ড সঠিক বলেছিলেন যে দাসেদের দেওয়া কোনো কাজ, তাদের হাত থেকে নিয়ে মুক্ত শ্রমিকদের এবং বিপরীতক্রমে মুক্ত শ্রমিকদের দেওয়া কোনো দায়িত্ব আবার দাসেদের হাতে তুলে দেওয়া যেতে পারত। অর্থাৎ কর্মর্ভর ছিল সর্বত্র দুই শ্রেণির শ্রমিকদের মধ্যে বিনিময়যোগ্য। ভারতে ক্রীতদাস ব্যবস্থা এক বহু পুরাতন প্রথা। তবে সাধারণত ক্রীতদাসদের শস্যক্ষেত্রে বা কর্মশালার উৎপাদন-সংক্রান্ত কোনো কাজে লাগানো হত না। ফিরূজ তুঘলক বোধ হয় একমাত্র বাদশা যিনি দাসেদের উৎপাদনমুখী কাজে নিয়োগ করেছিলেন। আফগানদের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধক্ষেত্রে দাসেদের ব্যবহার করার প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। আকবর অবশ্য ‘চেলা’ নাম দিয়ে তাদের সৈন্যদলে ব্যবহার করেছিলেন তবে সে কেবল খিদমতগার হিসেবে।

সুলতানি আমলে দাসেদের সম্পর্কিত অনেক খবর জানা থাকলেও এই সময়কার দাসেদের দাম সম্পর্কিত বিশেষ কোনো তথ্য আমাদের সংগ্রহে নেই। পাইরার্ড-এর মতে গোয়াতে একটি বালিকা দাস (দাসী?)-এর মূল্য ছিল ৫০ টাকার মতো। পর্তুগিজরা প্রচুর দাস নিয়োগ করত। পর্তুগিজ আরাকানি এবং মগেরা ক্রীতদাসের সন্ধানে পূর্ববঙ্গে দিয়ে চট্টগ্রাম, সন্দীপ, হুগলি (?) এবং পিপলিতে দাস কেনাবেচার বাজার খুলে দিয়েছিল, আবার গোয়াও ছিল একটি কর্মব্যস্ত দাস ব্যবসায় কেন্দ্র। এইরকম বহু দাসকে আবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিক্রি করে দেওয়া হত। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে শায়েস্তা খান দাসব্যবসার জন্য এই হানাদারি বন্ধ করে দেন।

নানা স্থান থেকেই দাস সংগ্রহের কাজ চলত। স্বল্প পরিমাণে হলেও পূর্ব আফ্রিকা থেকে অনবরতই দাস আমদানি হত। জেড্ডা গমনকারী তীর্থযাত্রীদের জাহাজগুলিও দাসব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। লোহিত সাগর থেকে প্রত্যাবর্তনকারী সমস্ত জাহাজ, তা ইউরোপীয় হোক, বা ভারতীয়ই হোক, মোচা (মক্কা?) বা জেড থেকে ক্রয় করা অন্তত ৫০টি দাসকে নিয়ে আসত। ভারতীয় দাসেদের অনেকে বংশপরম্পরায় এই প্রথার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এছাড়া যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কিংবা রাজদ্রোহ বা সরকারের খাজনা মেটানোর অস্বীকার করার অপরাধের শাস্তি হিসেবে গ্রামে অভিযান চালিয়ে বহু মানুষকে দাস হিসাবে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন প্রায়ই দুর্ভিক্ষ হত এবং বহু লোক অন্নাভাবে তাদের শিশুদের বিক্রি করে দিত। পরাজিত পক্ষের যুদ্ধবন্দিদের দাসপ্রথায় নিযুক্ত করা এবং তাদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার প্রথাটি আকবর নিষিদ্ধ করে দেন। যে-সব পরিবার তাদের শিশুকে বিক্রয় করে দিয়েছিলেন, তিনি তাদের সেইসব শিশুকে পুনর্বার কিনে নেওয়ার এবং পুনরায় নিজ ধর্মে দীক্ষিত করে নেওয়ার অনুমতি দেন। তবে এই সমস্ত পদক্ষেপ কতটা কার্যকরী হয়েছিল, তাতে কিন্তু সন্দেহের অবকাশ আছে।

ভারতবর্ষে দাসেদের সঙ্গে সচরাচর দুর্ব্যবহার করা হত না, এবং দাসেদের মুক্তি দেওয়া নৈতিকতার এক নিদর্শনস্বরূপ ছিল। তথাপি ক্রীতদাসত্ব ছিল অত্যন্ত নীচ ও অপমানজনক। এর ফলে মুক্ত কর্মীদেরও সামাজিক মর্যাদার অবনমন ঘটত।

জীবনযাত্রার মান

দেশীয় সূত্র থেকে, এবং যেসব বিদেশি পর্যটক যোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতে পরিভ্রমণ করেন, তাঁদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে শাসকশ্রেণির একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর লোকজন প্রচুর ভোগবিলাস ও আড়ম্বরের মধ্যে বাস করতেন। পক্ষান্তরে কৃষক, কারিগর এবং অন্যান্য শ্রমজীবী শ্রেণির লোকজনের অবস্থা ছিল শোচনীয়। তবে অভিজাত শাসকশ্রেণির সঙ্গে শ্রমিক-কৃষকদের জীবনযাত্রার মানের এই পার্থক্য কিন্তু শুধুমাত্র ভারতে ছিল তা নয়। প্রকৃতপক্ষে এই সময় ইউরোপ সহ পৃথিবীর সমস্ত সভ্য দেশেই কমবেশি এই একই অবস্থা বিরাজ করত।

গ্রামেই অধিকাংশ ভারতবাসীর বাস, কিন্তু তৎকালীন গ্রামীণ জীবনযাত্রার বিষয়ে আমাদের বিশেষ কিছু জানা নেই। আমরা দেখেছি যে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে ভারতের গ্রামগুলি বহুস্তরে বিভক্ত ছিল। গ্রামের প্রচুর পতিত জমি (বাঞ্জার) ছিল, কিছু অর্থ ও শ্রমিক দিয়ে যথাযথ বন্দোবস্ত করলে সেগুলিকে চাষযোগ্য করে তোলা সম্ভব হতে পারত। কিন্তু এই অতিরিক্ত জমি থাকা সত্ত্বেও গ্রামবাসীদের মধ্যে জমির বণ্টনে বহু তারতম্য ছিল।

বিভিন্ন শ্রেণির কৃষকেরা তাদের উৎপন্ন শস্যের কতভাগ রাজস্ব হিসাবে দিত, তার হিসাব করা সহজ নয়। এ ব্যাপারে মুঘলদের সাদাসিধা হিসাব ছিল এক তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত, কিন্তু সঠিক পরিমাণ বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপরে নির্ভরশীল ছিল। যথা–কী ধরনের জমি বা ভূমি চরিত্র, মালিক বা কৰ্ষণকারীর সামর্থ্য, এলাকার প্রধান জমিদারের স্বভাব, শুল্ক ইত্যাদি। আবার জমির মালিকের বর্ণ (জাতি) ইত্যাদিরও গুরুত্ব ছিল। তাই রাজস্থান ও উড়িষ্যার কোনো কোনো অংশে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, রাজপুত ইত্যাদি বংশীয়েরা ছাড় দেওয়া হারে ভূমি রাজস্ব দিত। উদাহরণস্বরূপ নিম্নতম বর্ণের ভুস্বামীরা যখন শতকরা চল্লিশ ভাগ খাজনা দিত, তখন এরা দিত উৎপন্ন দ্রব্যের মাত্র ২৫ শতাংশ। আবার গ্রামের কর্তাব্যক্তি যথা চৌধুরী, মুকাদ্দাম ইত্যাদিদেরও হ্রস্ব মূল্যে রাজস্বের নিরূপণ করা হত। সাধারণ গ্রামবাসীদেরও কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে রাজস্বের মূল্যের উপর ছাড় দেওয়া হত, যখন কোনো পরিত্যক্ত গ্রামকে আবার বাসযোগ্য করে তোলার পুরস্কার হিসেবে। তবে এই সুবিধা ছিল স্বল্পকালীন। এরপর ধীরে ধীরে ভূমি রাজস্ব বাড়িয়ে তৃতীয় বা পঞ্চম বর্ষে প্রচলিত মূল্যের সমান করে দেওয়া হত।

একটি গ্রামে বসবাসকারী সমস্ত কৃষিজীবী এবং কারিগরদের জীবনযাত্রার মান সমান বলে প্রতিপন্ন করা এক অবাস্তব চিন্তা। প্রকৃতপক্ষে কোনো গ্রামই অন্য একটি গ্রামের সমকক্ষ ছিল না। কোনো কোনো বৃহৎ গ্রাম ছিল শস্য সংগ্রহের ভাণ্ডার (মাণ্ডি) বা সেখানে একটি স্থানীয় বাজারও গড়ে উঠেছিল। শস্যের ব্যবসায়ী (মহাজন) এবং উত্তমর্ণ ব্যবসায়ী বা সুদখোর মহাজন ইত্যাদি কৃষক সম্প্রদায়ের অর্থশালী ব্যক্তিদের অধিকাংশই এইসব গ্রামেরই অধিবাসী ছিল যা পরবর্তীকালে আরও সমৃদ্ধ কসবায় পরিণত হয়।

গ্রামীণ সমাজের বিভিন্ন স্তরের বৈষম্যের বিষয়টি আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছি। কোনো বৎসরে শস্যের ফলন কম হলে বা দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব হলে, দরিদ্রতর গ্রামবাসীদের উপোস করতে হত এবং অনেকে আবার গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যেত। এই সুযোগে ধনী বা মধ্যবর্গীয় কৃষকেরা অনেকেই ওই সব দরিদ্রতর গ্রামবাসীদের ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলত বা তাদের জমি ও চাষবাসের সাজ-সরঞ্জাম নিজেরা ঋণের দায়ে দখল করে নিত।

বাবর লক্ষ করেছিলেন যে ভারতে কৃষক এবং নিম্নবর্গের লোকেরা অনেকেই খালি গায়ে ঘোরাফেরা করে। তিনি এরপর ছেলেদের পরিধেয় সেলাই করা ছিন্ন বস্ত্র এবং মেয়েদের শাড়ি সম্বন্ধেও বর্ণনা দেন। এরপরেই আবুল ফজল-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে হয় যে, সাধারণ মানুষ শরীরের প্রায় সর্বাংশই অনাবৃত রেখে কেবল নিম্নাঙ্গে একটি লুঙ্গি জড়িয়ে রাখত। আকবরের সময়কালের আর-এক লেখক রাল ফিচ বলেছেন ‘কোমরে জড়ানো একটি ছোটো বস্ত্রাংশ ছাড়া লোকেরা অনাবৃত শরীরেই ঘোরাফেরা করত। কিন্তু শীতকালে (অর্থাৎ আমাদের মে মাসের মতো) তুলে দেওয়া নোপের লম্বা জামা এবং লেপের টুপি পরত।

তার মানে এইসব অভিমতের এক বিপুল অংশই পরিহিত বস্ত্রের স্বল্পতার কথাই বলেছেন। আবহাওয়ার অবস্থা, এবং সামাজিক প্রথার কথা ধরে নিলেও বলতে হয় দারিদ্রই এই বস্ত্রাল্পতার মূল কারণ, কেননা তারা যে উন্নতমানের জামাকাপড় পরত তা দিয়েই উচ্চবর্ণ এবং সমাজের সুবিধাভোগী অংশের মানুষদের চিনে নেওয়া যেত। সেই সময় থেকে প্রচুর তুলার উৎপাদন এবং সারা দেশে বয়ন শিল্পের ব্যাপ্তি হওয়া সত্ত্বেও দেশে বস্ত্রের মূল্য গমের মূল্যের থেকে বেশি ছিল। ।

মেয়েদের কাপড় সম্বন্ধে আমরা ইতিমধ্যেই সুতার দ্বারা প্রস্তুত শাড়ির বিষয়ে বলেছি। মিেরল্যান্ড বলেছেন যে শাড়ির সঙ্গে মেয়েরা কোনো ব্লাউজ পরত না এবং এটিকে ইনি বস্ত্রের স্বল্পতার একটি উদাহরণ বলেই গণ্য করেছেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায়। যে পূর্বে ভারতের বহু গ্রামীণ এলাকায়, এমনকি বেশ সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত মেয়েদের মধ্যে জামা বা ব্লাউজ পরা খুব স্বাভাবিক ছিল না, বা জামা বা ব্লাউজ পরার চল ছিল না। তাদের আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন। মালাবারে মেয়ে-পুরুষ। কেউই কোমরের উপরিভাগে কিছু পরত না। আবার উত্তর-পশ্চিম ভারতের গ্রামেও সাধারণ মেয়েরা সকলেই ঊর্ধ্বাঙ্গের জামা (চোলি বা আঙ্গিয়া) পরে থাকত। তাই সমসাময়িক হিন্দি কবি সুরদাস তার লেখায় আগ্রা-মথুরা অঞ্চলের গোপিনীদের নানা রঙের চোলি বা আঙ্গিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।

সাধারণ লোকেদের মধ্যে জুতো পরার চল ছিল না। খালি পায়ে যাতায়াত করাই ছিল দস্তুর। জুতো পায়ে দেওয়াকে আপাতদৃষ্টিতে এক সামাজিক সম্মানের নিদর্শন। বলে মানা হত, এবং গ্রামের ধনী গৃহস্থরাই জুতো পরতেন। আবার সমসাময়িক চিত্রকলায় মেষপালক, রাজমিস্ত্রি, মজুর এবং পালকি বাহকদের পায়ের জুতো দেখানো আছে।

বর্তমান কালের মতো সেকালেও ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে মহিলারা প্রচুর গয়নাগাটি পরতেন। সমসাময়িক লেখকেরা পারসিয়ান এবং স্থানীয় ভাষায় এর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। এই সময়কার অনেক চিত্রকরের আঁকা ছবিতেও এর নিদর্শন পাওয়া যায়। বিদেশি পর্যটকেরা একে এক অদ্ভুত ব্যাপার বলে আখ্যা দিয়েছেন। রালফ ফি পাটনার বিষয়ে লিখেছেন—’এখানে মেয়েরা তার রুপার এত গয়না পরে, যে অবাক লাগে পায়ে রুপা ও তামার আংটি পরে থাকার জন্য তারা জুতো পরে না।’ সোনা ছাড়াও, রুপা ও তামার গহনা তো ব্যবহৃত হতই, এছাড়া কাঁচ এবং হাতির দাঁতের গহনাও অনেকে পরত।

গ্রামীণ দরিদ্রদের গৃহ ব্যবস্থায় মুঘলদের সময়কাল থেকে আজ পর্যন্ত বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। অধিকাংশ কৃষিজীবী মানুষই এক কামরার খড়ে ছাওয়া মাটির ঘরে বাস করত। দক্ষিণে আবার শ্রমজীবী মানুষের বাসস্থান বলতে কেবল কাজান পাতায় ছাওয়া একটি ঘর মাত্র বোঝাত। এ ঘরগুলি আবার এত নীচু ছিল সেখানে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। উষ্ণ আবহাওয়ার জন্য ঘরগুলিতে সচরাচর কোনো জানলা থাকত না, ঘরে আলো হাওয়া আসার জন্য দরজাই যথেষ্ট ছিল। ম্যানরিক দেখেছিলেন যে, কুটিরগুলি খুবই পরিষ্কার থাকত, এরং মাটির সঙ্গে গোবর মিশিয়ে দেওয়াল ও মেঝে ঘন-ঘনই লেপে দেওয়া হত। গুজরাটে কিন্তু বাড়িগুলি প্রায়ই ইট এবং চুন দিয়ে তৈরি এবং (খাপরিল) টালি দিয়ে ছাওয়া হত। বঙ্গদেশ এবং উড়িষ্যাতে আবার বাঁশ এবং নলখাগড়ার দেওয়াল এবং খড়ে ছাওয়া ছাদ-সম্বলিত কুটির দেখা যেত।

তামা বা কাঁসার বাসনপত্র খুব মহার্ঘ হওয়ার জন্য দরিদ্রেরা সেগুলি ব্যবহার করতে পারত না। লোহার ব্যবহার কেবলমাত্র রুটি সেঁকার জন্য লোহার উনানেই দেখা যেত।

সমসাময়িক বিবরণগুলি থেকে দেখা যায় যে সাধারণ লোকের প্রধান খাদ্য ছিল চাল (ভাত), জোয়ার এবং ডাল। বাংলা, উড়িষ্যা, সিন্ধুদেশ, কাশ্মীর এবং দক্ষিণ ভারতের কোনো কোনো অংশে চাউলই মুখ্য খাদ্য হওয়ার জন্য চাল (ভাত) ছিল প্রধান ভোজ্য। আবার পশ্চিম ভারতে যথা রাজস্থান ও গুজরাটে ওই একই কারণে বাজরা ও জোয়ারই ছিল মুখ্য খাদ্যশস্য। ইরফান হাবিব লিখেছেন যে, সাধারণত কৃষকেরা উৎপন্ন খাদ্যশস্যের সব থেকে নিম্নমানের খাদ্যসামগ্রীই নিজের এবং নিজ পরিবারের জন্য আলাদা করে রাখত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আগ্রা, দিল্লি ইত্যাদি প্রধান গম-উৎপাদক অঞ্চলে, গম কিন্তু জনসাধারণের খাদ্য তালিকায় ছিল না। মালওয়ার সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে টেরী বলেছেন, সাধারণ মানুষ গম খেত না বরং গমের থেকে নিকৃষ্ট (মোটা) কোনো খাদ্যশস্যের আটা থেকে গোল চওড়া এবং মোটা, একটি সেঁকে খাওয়ার উপযোগী খাবার, অর্থাৎ চাপাটি তৈরি করত, যা ছিল পুষ্টিকর এবং সুখাদ্য। খাদ্যশস্যের পাশে থাকত শাক, বরবটি বা সিম-জাতীয় সবজি এবং অন্য যে সমস্ত সবজি গ্রামেই ফলত সেই সমস্ত। বঙ্গ, উড়িষ্যা এবং সিন্ধু সহ অন্যান্য সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের লোকেদের জন্য মাছ খাদ্যদ্রব্যের প্রকরণকে সম্পূর্ণ করত।

পালসার্ট দিল্লি আগ্রা অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষদের সম্পর্কে বলছেন যে, প্রাত্যহিক বৈচিত্র্যহীন আহারের জন্য বা রাত্রে তারা খেত কেবল সবুজ ডাল ও চাল-মিশ্রিত খিচুড়ি। একটু মাখন দিয়ে। দিনের বেলা তারা একটু ছাতু চিবিয়ে থাকত।

আজকালকার মতো তখনও মেলা বা উৎসবে বেশ অর্থ ব্যয় হত। এবং এসব উৎসবের আসরও প্রায়শই বসত। এইসব উৎসব আয়োজনে দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে গ্রামবাসীরা মুক্তি পেত, আবার হাট থেকে তারা এমন সব জিনিস কিনতে পারত যা তাদের গ্রামে পাওয়া যায় না। জন্ম, মৃত্যু এবং বিবাহে গ্রামবাসীরা অনেকসময় ধার করেও যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করত। গ্রামীণ জীবনে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী ছিল দুটি বিভীষিকা। দুর্ভিক্ষ এবং আকাল প্রায়ই নেমে আসত, অনেক সময়। মহামারীকে সঙ্গে নিয়ে। তখন গ্রাম-কে-গ্রাম খালি হয়ে যেত। এসব সত্ত্বেও তৎকালীন দেশীয় ভাষায় রচনাকারী বহু লেখকের মতোই গ্রামের জীবন ছিল এক আদর্শ জীবনধারা। জীবনে আনন্দ ও বেদনা দুই-ই তো সহজ করে নিতে হয়।

শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করার বিষয়ে আমরা কিন্তু কিছুটা সুনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছি, বিশেষ করে আইন’-এ, তাদের পারিশ্রমিকের বিষয় লিপিবদ্ধ হবার পরে। আইন’-এর মতে একজন সাধারণ শ্রমিকের বেতন ছিল দিন প্রতি দুই দাম বা মাসে দেড় টাকা, যেখানে একজন উচ্চমানের শ্রমিক দিনে ৩ থেকে ৪ দাম বা মাসে আড়াই থেকে তিন টাকা অবধি উপার্জন করতে পারত। সূত্রধর বা । কাঠের মিস্ত্রিরা দিনে ৩ থেকে ৭ দাম এবং রাজমিস্ত্রিরা ৫ থেকে ৭ দাম আয় করতে পারত৷৷ পিয়েত্রো ডেল ভেলার মতে সুরাটে একজন গৃহভৃত্যের বেতন ছিল খুবই কম। মাসে তিন টাকা মাত্র। হিসাব করে দেখা গেছে যে তখন একজন মানুষের মূল প্রয়োজনটুকু মাসে ১ টাকার বিনিময়েই মেটানো যেত। আবার পাঁচজনের পরিবারের জন্য মাসে ২ টাকাই যথেষ্ট ছিল। দেশে তখন বহুসংখ্যক ক্রীতদাস ছিল। এবং তারা কোনোমতে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারত। পেলসার্ট বলছেন যে পালকিবাহকরা (বেহারা) অল্পদূরত্বে যাবার জন্য মাসে ৪ টাকা পেত। কিন্তু ষাট দিনের বেশি যাত্রা করতে হলে তাদের মাসে ৫ টাকা করে দিতে হত। সুরক্ষার জন্য নিযুক্ত সৈন্যরাও এই বেতনই পেত।

মধ্যযুগে এবং আধুনিক কালে দরিদ্র জনসমূহের কী ধরনের খাবার উপলব্ধ ছিল তার তুলনামূলক বিচার করা কঠিন। মুঘল আমলে কৃষকেরা সৌভাগ্যক্রমে ঘি। খেতে পারত। আবার তাদের আধুনিক কালের উত্তরপুরুষদের আয়ত্তের মধ্যে রয়েছে আরও বেশি পরিমাণ লবণ, ভুট্টা, আলু এবং লঙ্কার মতো তিনটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের খাদ্যদ্রব্য। একজন আধুনিক অর্থনীতিবিদ অশোক দেশাইয়ের মতে তিনটি কারণে, যথা গড়ে অনেক বেশি পরিমাণ চাষজমির মালিকানা, জমির উচ্চতর উৎপাদকতা, এবং আরও সুবিধাজনক জমি এবং শ্রমিকের অনুপাত, তখন মানুষ বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি (খাদ্য) আহার করত।

আকবরের সময়কালের এবং বর্তমান সময়ের বেতন ও দ্রব্যমূল্যের তুলনা করলে আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারি। তখন যেমন একজন শ্রমিক আজকের তুলনায় আরও অনেক গম কিনতে পারত, আবার তখন তারা সচরাচর গম খেত না বললেই চলে। তারা আবার আজকের শ্রমিকদের তুলনায় অনেক বেশি ছোলা, বার্লি, দুধ, ঘি এমনকি পাঁঠার মাংসও কিনতে পারত। অবশ্য মুসলমানরা ছাড়া সেই সব শ্রমিকদের মধ্যে অধিকাংশই মাংস খেত না। অশোক দেশাইকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলি, ১৫৯৫ সালে পারিশ্রমিকের অনুপাতে তাদের যা ক্রয়ক্ষমতা ছিল, ১৯৬১ সালেও প্রায় তাই আছে। তবে আকবরের সময়কার বেতন অনেক কম হলেও শ্রমিকরা আজকের তুলনায় অনেক বেশি পুষ্টিকর খাদ্য পেতে পারত। কারণ মাংস, ঘি এবং দুধ অনেক সস্তা ছিল। অবশ্য দুধ, চিনি ও গুড়ের দাম বেশি ছিল। এমনকি লবণের মূল্যও তাদের কাছে বেশি মনে হত।

সমাজের উচ্চশ্রেণি বলতে অভিজাত শ্রেণির মানুষজন, সর্দাররা এবং শহরের ধনী বণিককুল বোঝাত। তাদের জীবনযাত্রার মান নিয়ে আলোচনা ইতিমধ্যেই করা হয়েছে।

শাসকশ্রেণির কথা

মধ্যযুগের ভারতে শাসককুলকে মোটামুটি দুইভাগে বিভক্ত করা যেত; প্রথমে, রাজকীয় ক্ষমতার এবং কেন্দ্রীয় অধিকর্তাদের প্রতিনিধিস্বরূপ অভিজাত শ্রেণির ব্যক্তিরা (মুঘলকালে যাদের খান বলা হত)। আর দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্থানীয় শক্তির প্রতীকস্বরূপ স্থানীয় প্রধান বা সর্দারকে, ভূস্বামী বা জমিদার ইত্যাদিদের বুঝাত। তবে এই দুই শ্রেণির মধ্যে কোনো স্পষ্ট সীমারেখা টানা সম্ভব নয়। কেননা লোদিদের সময় থেকে শুরু করে এবং বিশেষ করে আকবরের শাসনকালে আঞ্চলিক প্রধানগণ এবং জমিদারদের অভিজাত বলেই গণ্য করা শুরু হয়। এবং তারপর থেকেই স্থানীয় বা আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তারা অনেক বেশি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়ে। এই দুই অংশের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রচুর উদ্বেগ ও সংশয়াকুল ছিল, ছিল বিবাদ-বিসংবাদও আবার স্থানীয় বিষয় নিয়ে পরস্পরের সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। এবং একে অপরের থেকে সেই সহযোগিতা চেয়েও নিত। উদাহরণস্বরূপ, কোনো অঞ্চলের কৃষিকার্য সম্প্রসারণ করার জন্য বা কৃষিকার্যে উন্নতি সাধনের জন্য স্থানীয় প্রশাসকেরা বা জমিদারেরা প্রায়ই কেন্দ্রীয় শাসকদের আইনগত অনুমোদন চাইত। এই দুই শ্রেণির মধ্যে একটি সাধারণ বিষয় হল যে উভয়পক্ষই যে-সমস্ত কৃষিজীবী ভূমিতে চাষবাস করত, তাদের উদ্বৃত্ত অংশের থেকে আর্থিক সম্পদ আহরণ করত। এই পরিপ্রেক্ষিতে দুই পক্ষই স্বভাবত ছিল সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণিভুক্ত।

অভিজাত সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়

ইউরোপে অভিজাত সম্প্রদায় বলতে একটি আইনানুগ বা আইনবদ্ধ স্বতন্ত্র শ্রেণিকে বোঝাত। ভারতবর্ষে কিন্তু অভিজাত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিত্বরা শুধু উচ্চতর প্রশাসনের পরিচালক ছিল তাই নয়, তারা ছিল সংস্কৃতি ও কৃষ্টির এক স্বতন্ত্র স্তরের বাহক। মুঘল সাম্রাজ্য যখন নিজেদের অবস্থান দৃঢ়তর করার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র দেশে বিস্তার লাভ করে, অভিজাত শ্রেণির মানুষের সংজ্ঞা এবং সংখ্যাও তেমনি পরিবর্তিত হতে থাকে। তাই ১৫৯৫ থেকে ১৬৫৬-৫৭ সময়কালে উচ্চ পর্যায়ের মনসবদারের সংখ্যা পঁচিশ জনেই স্থির হয়ে থাকে, মধ্যম বর্গের মনসবদারদের (৫০০/১০০০ থেকে ২৫০০) সংখ্যা ৯৮ থেকে ২২৫-এ পৌঁছে দ্বিগুণের থেকেও বেশি হয়ে যায়। অভিজাত শ্রেণির সংজ্ঞা অর্থাৎ কারা অভিজাত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবার যোগ্য বিবেচিত হচ্ছে সেই নির্ণয়েরও পরিবর্তন দেখা যায়। যথা–বাবর ও হুমায়ুনের সময় যারা ভারতবর্ষে এসেছিলেন, সেই সব অভিজাতরা প্রধানত মুঘলদের মাতৃভুমি অর্থাৎ তুরান ও খোরাসান থেকে ভারতে আসেন, যাদের সঙ্গে কিছু উজবেক ও তাজিকও ছিলেন। তবে আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে মুঘলরা সংকীর্ণ বর্ণ বা জাতি ভিত্তির নীতি অনুসরণ করত না। তাই আকবরের সময় থেকে শেখজাদা বা ভারতীয় মুসলিমগণ এবং এদেশি শাসকবর্গের প্রতিনিধি হিসাবে রাজপুতেরাও অভিজাত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবার সম্মান পান। বাবর বহুসংখ্যক প্রথম শ্রেণির আফগান ব্যক্তিদের অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কার্যত আফগানেরা অত্যন্ত অস্থিরমনস্ক এবং বিশ্বাসের অনুপযুক্ত বলে প্রতিপন্ন হল। হুমায়ুনের সঙ্গে এবং আকবরের সঙ্গে বিহার, বাংলা এবং উড়িষ্যাতে আফগানদের ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের ফলে শেষ পর্যন্ত সমস্ত অভিজাত উচ্চ পদ থেকে আফগানদের অপসারণ করা হল। আবার জাহাঙ্গিরের সময় এরই বিপরীত প্রক্রিয়া দেখা গেল যখন খান-ই-জাহান লোদি তার একজন প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। ঔরঙ্গজেবের সময়েও দাক্ষিণাত্যের বহু আফগানকে মুঘল অভিজাতদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হল।

যাদের বোঝবার জন্য মুঘল শব্দটি ব্যবহার করা হত, সেই ইরানি এবং তুরানিরা কিন্তু অভিজাতদের মধ্যে সর্ববৃহৎ সম্প্রদায় বলে বরাবরই গণ্য হতে থাকলেন। এমনকি ১৬৭৯ এবং ১৭০৭ সালের মধ্যে অর্থাৎ ঔরঙ্গজেবের রাজ্যকালের শেষ পঁচিশ বৎসরেও ১০০০ জাঠ বা তদুর্ধ্ব সম্পদের অধিকারী সম্রান্তের মধ্যে চল্লিশ শতাংশই ছিলেন ইরানি বা তুরানি গোষ্ঠীর লোক। তবে এদের মধ্যে অর্থাৎ ১০০০ জাঠ বা তদুর্ধ্ব মনসবের অধিকারীদের মধ্যে ১০ শতাংশেরও সমসংখ্যক ব্যক্তি ভারতের বাইরে জন্মেছিলেন। তাই বার্নিয়ের বলেছিলেন যে, ‘মুঘল অভিজাতরা প্রকৃতপক্ষে বিদেশি, যারা একে অপরকে দরবারে প্রলুব্ধ করে নিয়ে যেত।’ তা কিন্তু সূক্ষ্ম বিচারে সত্য নয় বলে বিবেচিত হয়। বার্নিয়ের আরও বলেছেন, ‘বহিরাগতরা সাধারণত হত নীচু শ্রেণির মানুষ। যাদের অনেকে পূর্বে দাস ছিল, এছাড়া তাদের অধিকাংশই ছিল সম্পূর্ণ অশিক্ষিত।’ এই উক্তিটি অবশ্যই আরও অসত্য। মুঘলরা উচ্চবংশীয়দের বিশেষ সম্মান দিতেন এবং ভবিষ্যৎ প্রগতির জন্য উচ্চ শিক্ষাকে তারা। অতি প্রয়োজনীয় বিবেচনা করতেন। একথাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে বহিরাগতরা তাদের পরিবারকে সঙ্গে নিয়েই ভারতে এসেছিলেন এবং ভারতকেই তাদের দেশ বলে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় সমাজে যে মিশ্রিত দরবার ঘরানা তখন। এদেশে প্রতিষ্ঠিত ছিল, মুঘলরা নিজেদের তারই সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলিয়ে দিয়েছিলেন। সুতরাং বিদেশি বলতে যা বোঝায় তারা কোনোমতেই তা ছিলেন না। তবে ভারতীয়, ইরানি ও তুরানিদের মধ্যেকার সকল পার্থক্য কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। যারা নিজেদের বিদেশি বংশোদ্ভূত বলে জানতেন, সেই সমস্ত অভিজাতরা নিজেদের একটি শ্রেষ্ঠতর শ্রেণির মানুষ বলে বিশ্বাস করতেন। যারা আবার বিভিন্ন সামাজিক মর্যাদার অধিকারী, এঁরা নিজেদের গোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যেই বিবাহাদি সম্পন্ন করতেন।

যদিও বংশগত ভাবে ‘অভিজাত’ সম্মান অর্জিত হত না, তাহলেও যেসব মানুষের পূর্বপুরুষরা এক বংশ-কালের অধিককাল রাজার সেবায় নিযুক্ত থেকেছেন, তাদের বলা হত ‘খানাজাদ’ অর্থাৎ ঘরের ছেলে। বাদশাহের বংশের সঙ্গে তাদের এক ঘনিষ্ঠতা বোধ ছিল এবং মনসব পাওয়ার সময় তারা নিজেদের বিশেষ সুবিধাভোগী। বলেও দাবি করতেন। সেইজন্য সন ১৬৭৯-১৭০৭-এর মধ্যবর্তী সময়ে, ১০০০ জাঠ বা তারও উচ্চবর্তী সম্পদের অধিকারীদের মধ্যে প্রায় শতকরা পঞ্চাশভাগই ছিলেন খানজাদ, অর্থাৎ মনসবদারদের বংশধর। অবশ্য জামাতাদের খানজাদ সম্মান দেওয়া। হত না। তবে এতেও পুরাতন মনসবদারেরা সন্তুষ্ট ছিলেন না কেননা তাদের উত্তরপুরুষদের মধ্যে অনেকেরই মনসবের দাবি বহুদিন ধরেই মুলতুবি ছিল। এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর ব্যক্তিদেরই যে কেবল মনসবদারের অধিকার। দেওয়া হত তা নয়, বরঞ্চ অনেক উন্মুক্ত ক্ষেত্র থেকেই এইসব অভিজাতদের নিয়োগ করা হত। আবার অভিজাত অমাত্য নির্বাচনে বংশ মর্যাদাকে প্রাধান্য দেওয়া হত। এবং উচ্চবংশীয় অভিজাতদেরই উচ্চপর্যায়ের অবস্থানে নিয়োগ করা হত। এদের মধ্যে হিন্দু রাজাদেরও বংশ মর্যাদাকে গণ্য করা হত। এইভাবেই ১৬৫৮-৭৯ সালের মধ্যকালে, ৫০০০ এবং তদুর্ধ্ব মনসবের অধিকারীর মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগই ছিলেন। ইরানি ও তুরানি। কিন্তু এদের মধ্যে আবার ১১ শতাংশের অধিকারী ছিলেন প্রধান। রাজপুত রাজন্যবর্গ। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ অবস্থার মানুষের যোগ্যতা থাকলে। উচ্চতম পদে উন্নীত হতে পারত। উদাহরণস্বরূপ আকবরের অধীনে রায় পত্র দাস এবং শাহজাহান এবং ঔরঙ্গজেবের রাজত্ব কালে রায় রঘুনাথের নাম উল্লেখযোগ্য।

মুঘল অভিজাতদের মাথাভারী বন্দোবস্তের প্রভাব অন্য ক্ষেত্রেও দেখা যায়। হিসাব করে দেখা গেছে যে শাহজাহানের রাজত্ব কালে উচ্চশ্রেণির অভিজাতের ৭৩ জন মোট ৩৩,০৯১কোটি বাদশাহের কাছ থেকে পেয়েছিলেন, যা সমগ্র সাম্রাজ্যের নিরূপিত আয়ের ৩৭.৬ শতাংশ। তারা ব্যক্তিগত ভাবে যে বেতন পেতেন তা একজন মাঝারি আয়তনের স্বয়ংশাসিত রাজ্যের রাজার আয়ের সমতুল্য। এই উচ্চশ্রেণি অভিজাতরা অপর্যাপ্ত ঐশ্বর্যের পরিবেশে জীবন কাটাতেন। তাদের বহুতল বিলাসবহুল অট্টালিকা, বিশাল বাগান এবং সর্বক্ষণের জন্য জল সরবরাহ ইত্যাদি তো ছিলই। এছাড়া ছিল বৃহৎ হারেম মহিলামহল এবং অসংখ্য দাস বা দাসী এবং অধীনস্থ নর-নারী। দাক্ষিণাত্যে কোনো অভিজাতের মনের মতো একটি বাড়ির মূল্য ছিল ১, ৫০,০০০ টাকা। জমকালো কার্পেট, মূল্যবান পর্দা, এবং সুন্দরভাবে নকশা করা বা অলংকৃত শোবার পালঙ্ক, আয়না, চেয়ার (কেদারা) এবং টুল ইত্যাদি আসবাব ছিল তাদের বাসের পক্ষে অত্যাবশ্যক। ঘরের ছাদ হত বহুমূল্য সোনা দিয়ে গিলটি করা এবং দেওয়াল ও মেঝে সুন্দরভাবে বাঁধানো। আহার্যের জন্যও বহু অর্থ ব্যয় হত। আমরা শুনেছি যে প্রত্যহ আবুল ফজলের জন্য রান্না হত এক শত পদ। ফল এবং বিদেশ থেকে নিয়ে আসা মদিরার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় হত। বরফকে তখন এক বিলাস দ্রব্য মনে করা হত–কিন্তু সারা বছর ধরেই অভিজাতদের বরফ ছাড়া চলত না। চিনামাটির বাসনের ব্যবহার ছিল চরম বিলাসিতার নিদর্শন, কিন্তু সোনা ও রুপার বাসনপত্রের ব্যাপক ব্যবহার ছিল।

খানেদের (অভিজাত) আস্তাবল ছিল আর-এক বিলাসিতার দৃষ্টান্ত। প্রত্যেক সম্ভ্রান্তকেই বহুসংখ্যক ভারবাহী পশু রাখতে হত–যথা হাতি, উট, অশ্ব এবং অশ্বতর। এছাড়া যাতায়াতের জন্য ঘোড়ার গাড়ি, পালকি ইত্যাদি। আর তাঁবু ছিল আর-এক মূল্যবান সামগ্রী।

পুরুষ এবং নারী উভয়েই নানা প্রকার মণিরত্নে তাদের অঙ্গ সজ্জিত করতেন। জাহাঙ্গিরের সময় থেকেই কান বিধিয়ে মুক্তো পরার চলন শুরু হয়। সাধারণত তারা সাদা বা ছাপ সূতির কাপড় ব্যবহার করতেন। কিন্তু এছাড়া প্রচুর মহামূল্য বস্তু সামগ্রী যথা সাদা বা ডোরাকাটা রেশমি কাপড়, জরির পোশাক এবং বহুমূল্য কাশ্মীরি শালও অভিজাতদের পরিধেয়র শোভা বর্ধন করত।

শিল্পকর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করা দেশের প্রধান অভিজাতদের কর্তব্য বলে মনে করা হত। তাই কবি, সংগীতজ্ঞ, চিত্রকর ইত্যাদি বা কখনো-কখনো অপর্যাপ্ত ইনাম পেতেন। (পুরস্কার পেতেন)। শোনা যায় যেসব কবিরা তার প্রশস্তি রচনা করতেন, আবদুর রহিম খান-ই-খান (বৈরাম খানের পুত্র) তাদের গাধার পিঠে বোঝাই করা অর্থ পুরস্কারস্বরূপ দিতেন। বহু অভিজাত তাদের অধীনস্থ ব্যক্তিদের এবং ফকির সাধুদের। যে জমি ও সক্ষম দান করতেন, তারও উল্লেখ আছে।

জমানোর কথা চিন্তা না করে খরচ করা–অভিজাতদের জীবনযাত্রার সারবস্তু ছিল এইটাই, ঠিক যেমন মিেরল্যান্ডের উপরিউক্ত উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সারা পৃথিবীতে সকল অভিজাত ভূস্বামীদের জীবনেই এই ধারাটি পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু বাস্তবধর্মী অভিজাতরা টাকা জমাতেও পারতেন। সমসাময়িক সংবাদপত্র থেকে আমরা অনেক অভিজাতের নাম পাই যাঁরা মৃত্যুকালে প্রভূত সম্পদ ও টাকাকড়ি রেখে গেছেন। ১৬৫৭ সাল আলি মরদান খানের মৃত্যুর আগে তিনি এক কোটি টাকা মূল্যের অর্থ ও বস্তুসামগ্রী রেখে যান, যা শাহজাহান বাজেয়াপ্ত করে নেন। বঙ্গদেশের প্রশাসক আজম খান কোকা (৪০০০/৪০০০) ২২ লক্ষ টাকা এবং ১,১২,০০০ মোহর রেখে যান। গুজরাটের সুবেদার মহম্মদ আমির খান ১৬৮২ সাল তার মৃত্যুকালে যে বিশাল সম্পত্তি রেখে যান তার পরিমাণ হল–৭০ লক্ষ টাকা, এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার শরাফি, বহুসংখ্যক পশু এবং দশ সিন্দুক ভরতি সকল প্রকারের সূক্ষ্ম চিনামাটির বস্তু যা ঔরঙ্গজেব বাজেয়াপ্ত করে নেন। এই সব অভিজাত পুরুষেরা তাঁদের নিজেদের রাজ্যের জন্য যা অর্থ অগ্রিম হিসাবে নিয়েছিলেন, সেগুলি পরিশোধের জন্যই এইভাবে অধিকার করে নেওয়া হত। এইসব কাজ সারা হলে বাদশা বাকি সম্পত্তি তার অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তাদের যোগ্যতা অনুসারে ভাগ করে দেন। এখানে শরাই’ আইনকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কেননা মুঘল শাসকেরা তাদের অধীনস্থ অভিজাতদের সমস্ত সম্পত্তিই নিজের বা রাজসম্পত্তি বলে মনে করতেন। ১৬৬৬ সালে ঔরঙ্গজেব এই নীতির পরিবর্তন করেন। যেসব অভিজাত সম্রাট তাদের ঋণশোধ করতে পারেননি, একমাত্র তাদের সম্পত্তিই বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয়। তবে নিজেদের পছন্দমতো অভিজাতদের সম্পত্তি ভাগ ও বিতরণ করার অধিকার শাসকেরা বজায় রেখেছিলেন।

অভিজাতদের সম্বন্ধে দুটি বিষয় বিশেষ লক্ষণীয়। সাম্রাজ্যের পরিস্থিতি ক্রমশ সুস্থির এবং সুস্থায়ী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অভিজাতদের উপর তাদের বেতন, ক্রমোন্নতি, ব্যবসায় পরিচালনা, পুরস্কার বা ইনাম এমনকি আচরণ-সংক্রান্ত বিষয় নিয়েও নানা রকম বিধিনিষেধ প্রযোজ্য হতে থাকল। দস্তুরউলআমাল নামক এক নিয়ন্ত্রণবিধিতে এগুলি বিস্তারিত ভাবে লিপিবদ্ধ ছিল। সাধারণত মনসবদারেরা একটি ক্ষুদ্র মনসব থেকে শুরু করে প্রচলিত আইন-কানুন (জাবতা) অনুপাতে উচ্চতর মর্যাদায় উন্নীত হতেন। যদিও শাসকেরা ইচ্ছা করলেই সেগুলিকে অগ্রাহ্য করতে পারতেন। এই জন্যই অভিজাতদের প্রশাসনে আরও হিসাব-নিকাশ ও আমলাতন্ত্রের প্রচলন শুরু হয়। গ্রামীণ স্তর থেকে ক্রমাগত উচ্চতর পর্যায়ের শাসন কার্যে নিখুঁতভাবে যে সমস্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ সবিশেষ বর্ণনাপূর্ণ নথিপত্র রাখা হত, সেইগুলি এই আমলাতন্ত্রের পরিচায়ক।

দ্বিতীয়ত, মুঘল অভিজাতরা এমনকি বাদশাহ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও ব্যবসায়ে অরুচি ছিল না। অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে ব্যবসায়ীদের কাছে অর্থ বিনিযোগ করে নিজেদের আয় বাড়িয়ে নিতেন। আবুল ফজল অভিজাতদের কিছু কিছু ঝুঁকি নিয়ে টাকা খাটাতে এবং লাভজনক ব্যবসায়ে অর্থ বিনিযোগ করতে উপদেশ দেন। তিনি আরও বলেন কিছু বাণিজ্যদ্রব্যকে নিজের অধিকারে রেখে, অন্যের ফাটকাবাজিতে কিছুটা অংশ নিতে।সুদ নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রচলিত ইসলামিক নীতিকে অমান্য করে আবুল ফজল অভিজাতদের নির্দেশ দেন যে যারা ঋণ গ্রহণ করেন তাদের থেকে কিছু অংশ রেখে দেওয়া যেতে পারে, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়ে সকলের ভোলা মনে চলা উচিত, এবং হৃদয়ে আত্মসমালোচনার কোনো স্থান যেন না থাকে।

মুঘল অভিজাতরা কি পরিমাণে ব্যাবসায়িক বিষয়ে লিপ্ত ছিলেন, তার অনুমান করা কঠিন। দেখানো হয়েছে যে ১৭শ শতাব্দীতে বাদশাহী পরিবারের সদস্যগণ অর্থাৎ স্বয়ং বাদশাহ, শাহজাদাগণ, শাহজাদীগণ এমনকি হারেম-এর বেগমরাও বাণিজ্যিক ব্যাপারে যুক্ত ছিলেন। যেমন জাহাঙ্গির, নূরজাহান, যুবরাজ খুররম, এবং বেগমের মায়েরও জাহাজ ছিল যেগুলি সুরাট এবং লোহিত সাগরের বন্দরগুলির মধ্যে যাতায়াত করত। শাহজাহান, এমনকি ঔরঙ্গজেবের সময়েও এই ব্যবস্থা অব্যাহত ছিল।

অনেক অভিজাত ব্যক্তি নিজেদের নামেই ব্যবসা করতেন, অনেকে আবার অন্যের অংশীদারও হতেন। যথা, মির জুমলার অনেকগুলি জাহাজ ছিল এবং সেই জাহাজ বার্মা (মায়ানমার) ম্যাকাসার মালদ্বীপ পারস্য আরবদেশে ইত্যাদি চলাচল করত। আসফ খান, শাফি খান ইত্যাদি অভিজাতদেরও নিজস্ব ব্যাবসায়িক জাহাজ ছিল। সুরাটের ইংরাজ প্রতিনিধি ১৬১৪ সালে লেখেন ‘উচ্চশ্রেণির ব্যক্তিগণ এবং সাধারণ মানুষও ব্যবসায়ে রত।’ অনেক অভিজাত তাদের উচ্চপদের অধিকার দেখিয়ে বেশি। লাভ করার চেষ্টা করতেন। যেমন লাহোরের প্রশাসক ওয়াজির খান লাহোরে যা কিছু কেনাবেচা হত, সবের থেকেই লভ্যাংশ নিতেন। বঙ্গদেশের প্রশাসক মির জুমলা এবং পরবর্তীকালে শায়েস্তা খান সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বস্তুর ব্যবসাবাণিজ্য একচেটিয়া করে। নিতে চেয়েছিলেন। যেমন শায়েস্তা খান সময়ে সময়ে সোরা, মৌচাকের মোম, এমনকি পশুখাদ্যের উপরও তাঁর একচেটিয়া ব্যবসায়িক অধিকারের মেয়াদ বাড়িয়ে। নিতেন। যুবরাজ আজিম উস-শান সওদা-ই-খাস নামে বণিকদের তার ফরমাইসি দামে জিনিসপত্র কিনতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ঔরঙ্গজেবের তীব্র তিরস্কারের পর এই নীতি পরিবর্তন করা হয়। আবার ঔরঙ্গজেবের প্রধান কাজি কাজি আবদুল ওয়াহাবেরও যথেষ্ট ব্যবসাপাতি ছিল, তিনি অবশ্য তা ঔরঙ্গজেবের থেকে গোপন করতে চেয়েছিলেন।

মনে হয় মুঘল আমলে দেশে শান্তি বজায় থাকার জন্য ব্যবসা বাণিজ্য যথেষ্ট বিস্তার লাভ করে। বৈদেশিক বাণিজ্য আরও বৃহত্তর আকার ধারণ করে বিশেষ করে অনেক সংস্থা এতে যোগদান করার ফলে। মুঘল অভিজাতগণ, রাজপরিবার বর্গের সদস্যগণ, এমনকি আইন ও অধ্যাত্ম-বিষয়ক আধিকারিকরাও ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি সম্পন্ন হয়ে পড়েন। তপন রায়চৌধুরীর মতে অবশ্য ব্যবসা বাণিজ্য এইসব শ্রেণির মানুষের যোগদান কতটা মূল্যবান তাতে সন্দেহ আছে। অভিজাতদের এই বাণিজ্য। প্রকল্পগুলি অবশ্য দেশের সামগ্রিক বাণিজ্যের একটি ভগ্নাংশ মাত্র ছিল। তবুও এর। মাধ্যমে কৃষিজাত দ্রব্যের থেকে সংগৃহীত সম্পদের এক অংশ দেশি ও বিদেশি বাণিজ্যের খাতে স্থানান্তরিত হত। অভিজাতরা অবশ্য দক্ষ শিল্পী এবং তাদের সৃষ্ট বাণিজ্যগুলিরও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ট্যাভারনিয়ের বলছেন যে সুরাটে এসে জাহাজে ওঠা মাত্রই চারিদিকে প্রচুর টাকার লেনদেন চোখে পড়ে, কারণ এইটিই ছিল ভারতীয় অভিজাতদের প্রধান ব্যবসা। তারা ফাটকা খেলার জন্য হরমুজ, বসরা ও মোচা এমনকি বানতাস, আচিন এবং ফিলিপাইন-গামী জাহাজেও টাকা রাখত। মির জুমলাও এই ভাবেই ইংরেজদের টাকা ধার দিতেন।

অভিজাত খানেদের এই অর্থলিপ্সার জন্য নানারকম অনৈতিকতারও সৃষ্টি হত। কিছু উপহার বা তোফা না দিলে কোনো বিষয়ে কিছু ব্যবস্থাও নেওয়া হত না। যে সমস্ত ‘রইস’ বাদশাহের ঘনিষ্ঠ ছিল, তারা অপরের কোনো দাবি বা চাহিদা মেটাবার জন্য যিনি সবথেকে বেশি মূল্য দিতে প্রস্তুত তাকেই সাহায্য করতেন। এইভাবে ঔরঙ্গজেবের মির মুনশি কাবিল খান তাঁর আড়াই বছরের কার্যকালে অর্থ এবং মূল্যবান সামগ্রী মিলিয়ে ১২ লক্ষ টাকা হস্তগত করেন। এই জন্যই মুঘল অভিজাতদের থেকে শুরু করে দপ্তরের কেরানিদেরও ঘুসখোর ও ভ্রষ্টাচারী বলে বদনাম হয়ে গিয়েছিল। তবে অভিজাতরা অনেক মসজিদ, সরাই, ঢাকা বাজার বা কাটারা, খানকা, অতিথিশালা ইত্যাদি নির্মাণ করা ছাড়াও নিজেদের বাসস্থানের নিকটে পুকুর ও জলাশয় ইত্যাদি আবার জমি কিনে ফলের বাগানও নির্মাণ করেছিলেন। এ-সবই যে মুনাফার জন্য সৃষ্টি করা হত তা নয়, এগুলি জনহিতকর কার্য বলেও স্বীকৃত ছিল। এইভাবে বাজার এবং ফলের বাগিচার থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই অনেক সময় মসজিদ, শরাই, অতিথিশালা, ইত্যাদির রক্ষণাবেক্ষণ করা হত। এ অভিজাতদের এই ধনলিপ্সার জন্যই তারা কৃষকদের সঙ্গে এক আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে ব্যবহার করত। শেখ ফরিদ বাখারি যিনি শাহজাহানের রাজত্বকালের প্রথম দিকে মুঘল আমিলদের জীবনপঞ্জী লিখেছিলেন, তার অভিমত অনুযায়ী জাহাঙ্গিরের মির বকশি এবং তার প্রিয়জন ফরিদ বুখারি তার জায়গিরের আমিলদের থেকে পঞ্চাশ শতাংশ বেশি রাজস্ব চেয়েছিলেন, এর ফলে যদি কৃষকেরা সেই জমি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেত, তাহলে তিনি ওই জায়গিরটি পরিত্যাগ করে বাদশার সমর্থন নিয়ে আরও একটি নতুন ভূখণ্ড সংগ্রহ করতেন। তবে সাধারণত সকলেই এরকম করত কিনা তা বলা কঠিন। বাদশাহের মূল নীতিতে কৃষিকার্যের বিবর্ধন এবং উন্নয়নের উপর যথেষ্ট জোর দেওয়া হত এবং জায়গিরদারেরা কৃষকদের উপর অত্যাচার করছে। কি না সেই বিষয়ে নজর রাখার জন্যই বন্দোবস্ত ছিল। কিন্তু সরকারি নীতির সঙ্গে বাস্তব ঘটনার প্রায়ই সমন্বয় হয় না।

মোগল শাসনে নিয়মিত ভাবেই জায়গির পদের পরিবর্তন হলেও এগুলি কোনো নিয়ম বিধি মেনে করা হত না। যথা তিন বছর কি চার বছর পরে পরেই জায়গির-এর স্থান পরিবর্তন করা, যাতে করে অভিজাতরা স্থানীয় ভাবে তাদের প্রভাব না বিস্তার করতে পারে। জাহাঙ্গীর আল-তামগা নামক এক প্রকার জায়গির সৃষ্টি করেছিলেন, যাতে করে প্রত্যেক অভিজাত ব্যক্তিই একটি স্থায়ী কর্ম স্থলে তাদের নিজস্ব আবাস এবং পরিবারকে রেখে দিতে পারতেন। সম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে। অভিজাত ব্যক্তিবর্গের জায়গিরগুলি তাদের কর্মস্থলের নিকটেই থাকত। এই ধরনের দায়িত্ব অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারত যেমন জয় সিংহ প্রথমে বিহার এবং পরে বাংলার প্রশাসক পদে প্রায় ২০ বছর ধরে ছিলেন। টোডর মলের পুত্র রাজা কল্যাণ । ১৬১১-১২ থেকে ১৬১৭ সাল অবধি উড়িষ্যার মুখ্য প্রশাসক ছিলেন। শাহজাহান ঔরঙ্গজেবের সময় এরকম বহু দৃষ্টান্তই পাওয়া যায়। কিন্তু সিন্ধু প্রভৃতি কোনো কোনো প্রদেশে পরিস্থিতি ছিল অনিশ্চিত। খুব ঘন ঘন পদ পরিবর্তন ঘটতে এবং জায়গির বদলাত। ভীম সেনের নথি অনুযায়ী ঔরঙ্গজেবের সময় দাক্ষিনাত্যে জায়গির নিয়ে প্রচণ্ড অনিশ্চিয়তা দেখা যায় যাতে করে ক্ষুদ্রতর মনসবদাররাও সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ হত।

গ্রামীণ ভদ্র-সম্প্রদায় বা জমিদারবর্গ

ব্রিটিশ শাসন কালের প্রারম্ভে জমিদারদের সামাজিক অবস্থান ও তাদের প্রকৃতি নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছিল। তারা কি প্রকৃতপক্ষে জমির মালিক না কি কেবল রাজস্ব সংগ্রাহক, অর্থাৎ তাদের অধিকার কি জমির উপর, না কি জমি থেকে আহরিত রাজস্বের উপর, বিতর্কের বিষয়বস্তু ছিল এইটাই। আধুনিক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে জমিদার শব্দটি ১৪শ শতাব্দী থেকে শুরু হয়ে ১৭শ শতকেই সাধারণভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে জমিদারেরা যে-যে সুবিধা ও অধিকার পেতেন তাদের মধ্যে কিন্তু বিস্তর পার্থক্য আছে। ব্যাকরণগত ভাবে জমিদার শব্দটি এমন একজন মানুষকে বোঝায়, যিনি যে জমিটি চাষ করেন, সেটি তার নিজস্ব সম্পত্তি। দেশের পাঞ্জাব ইত্যাদি নানা স্থানে এখনও এই অর্থে জমিদার শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মুঘল পরিভাষায় এর অর্থ এই যে যিনি একটি গ্রাম বা উপনগরীর (কসবা) সমস্ত জমির মালিক এবং সেই জমিতে যিনি কৃষিকার্যও সংবহন করেন, তাকেই বলা। হয় জমিদার। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের মতে ‘জমিদারি হচ্ছে এমন একটি গ্রামীণ শ্রেণির অধিকার, যারা কৃষক সম্প্রদায়ের থেকে পৃথক এবং সামাজিক মর্যাদায় কৃষাণ শ্রেণির ঊর্ধ্বে অবস্থিত।’ জমিদার শব্দটি বরাবর এই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে, যদিও মুঘলরা অনেক সময় স্বশাসিত রাজা এবং প্রধানদের ক্ষেত্রেও জমিদার শব্দটি ব্যবহার করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল তারা যে এক অধীনস্থ শ্রেণি এইটিই প্রমাণ করা। স্বশাসিত অঞ্চলের রাজারা এবং সর্দারেরা এক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থসামগ্রী পেশকাশ হিসাবে সমর্পণ করে, তারপর স্বাধীনভাবে তাদের অঞ্চলের কৃষকদের কর নিরূপণ ও সংগ্রহ করতে পারতেন। আবার যে-সমস্ত জমি কেন্দ্রীয় অধিকারভুক্ত ছিল, সেখানে প্রশাসন সরাসরি কৃষকদের রাজস্ব বা খাজনা নির্ণয় করার চেষ্টা করতেন। তাই এই স্বায়ত্তশাসিত রাজাদের ‘খারাজ’ বা রাজার হয়ে তার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত জমিদার শ্রেণিতে রূপান্তরিত করার জন্য প্রশাসন অনবরত চেষ্টা করে যেতেন, এবং জমিদাররাও বাদশাহদের এই নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে ফেলার চেষ্টা করে যেতেন।

জমিদারেরা গ্রাম্য জীবনের শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করতেন। তাদের নিজেদের সশস্ত্র রক্ষী থাকত এবং তারা নিজেদের দুর্গ বা বাড়িতে বাস করতেন। এইগুলি ছিল একাধারে আশ্রয়স্থল এবং তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠার নিদর্শনস্বরূপ। সম্মিলিত ভাবে জমিদারের অসামান্য সৈন্যবল ছিল। আইন’-এর তথ্যানুসারে আকবরের রাজত্বকালে তাদের মোট, ৩,৮৪,৫৫৮ জন সওয়ার, ৪২,৭৭,০৫৭ জন পদাতিক, ১৮৬৩ টি হাতি এবং ৪২৬০ টি কামান ছিল। কিন্তু এই সমস্ত জমিদারেরা দেশের নানাস্থানে বিন্যস্ত ছিল। এবং তারা কখনোই একসঙ্গে এতজন লোক বা সাজসরঞ্জাম একত্র করতে পারত না। তবে এই পরিসংখ্যানে সম্ভবত অধীনস্থ রাজাদের সেনাবাহিনীকেও ধরা হয়েছে।

তাদের জমিতে যেসব কৃষকেরা কৃষিকার্য করত তাদের সঙ্গে জমিদারদের সচরাচর জাতি, বর্ণ, বা উপজাতি-সূচক আত্মীয়তা থাকত। জমির উর্বরতা সম্বন্ধেও তাদের কাছে প্রচুর তথ্য থাকত। জমিদারেরা ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি বহুসংখ্যক এবং শক্তিশালী শ্রেণি। দেশের সর্বত্রই জমিদারদের দেখা যেত এবং তাদের দেশমুখ, পাতিল, নায়ক ইত্যাদি নামে ডাকা হত। তাই কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসন বা বাদশাহের পক্ষে তাদের উপেক্ষা করা বা তাদের শত্রুতাচরণ করা সম্ভব হত না।

জমিদারদের জীবনযাত্রার মানের বিষয়ে সঠিক ভাবে কিছু বলা কঠিন। অভিজাতদের তুলনায় তাদের আয় ছিল সীমাবদ্ধ। ছোটোখাটো জমিদারদের জীবনযাত্রা আসলে সচ্ছল কৃষকদেরই সমতুল ছিল। বৃহত্তর পর্যায়ের জমিদারেরা অবশ্য ক্ষুদ্র শ্রেণির রাজা বা অভিজাতদের মতোই জীবনযাপন করত। বেশিরভাগ জমিদারেরা অবশ্য গ্রামেই থাকত এবং তারা ছিল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত একটি ভদ্রসমাজের প্রতিনিধি।

জমিদারির অধিকার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অথবা বিক্রয়যোগ্যও ছিল। আকবরের সময় থেকেই বহু জমিদারি সম্পূর্ণভাবে অথবা খণ্ডে খণ্ডে বিক্রি হত। এই বিক্রয়ের ব্যাপারে জাতিগত বা বর্ণগত কোনো বাধানিষেধ ছিল না। অবশ্য মহারাষ্ট্রে এইসব বিক্রির ব্যাপারে গ্রামীণ পরিচালিকা সমিতি (পঞ্চায়েত) অথবা পাতিলদের অনুমতির প্রয়োজন হত এই মর্মে নথিপত্র পাওয়া গেছে, অন্য যে-কোনো সম্পত্তির মতো জমিদারিকেও নানাভাগে বিভক্ত করা যেতে পারত।

জমিদারির অধিকার একাধারে আর্থিক উপার্জন ও সামাজিক প্রতিপত্তি উভয়েরই দ্যোতক ছিল। জমিদারেরা সবসময় জমিদারি থেকে তাদের প্রকৃত আয় গোপন রাখতে চেষ্টা করতেন এবং স্থানীয় আধিকারিকদের কাছেই ছিল সেই আয়ের পরিমাণ সঠিকভাবে জেনে নেওয়া এবং তার নিয়ন্ত্রণ করা। আইনত উৎপন্ন দ্রব্যের এক অংশের ওপর জমিদারের অধিকার ছিল যা অর্থ বা বস্তুর বিনিময়ে আদায় হত। যেমন অওয়াধ-এ জমিদারির অধিকার ছিল প্রতি বিঘার জন্য ১০ সের করে শস্য, এবং সেই পরিমাণ জমির জন্য একটি করে তাম্রমুদ্রা (দাম)। এইসব ভূস্বামী অন্যান্য শুল্কও চাপাতে পারতেন, যথা বনজ এবং জলজ বস্তুর উপর শুল্ক। বিবাহ, জন্ম ও গৃহের উপর কর ধার্য করা ইত্যাদি। জমিদারের শুল্কের পরিমাণ আবার স্থান থেকে স্থানান্তরে ভিন্ন ভিন্ন হত যথা বিলই (১/২০) দো-বিলই (১/১০) বা সাঁতারহী (১/১৭) অথবা চৌথাই (১/৪)। মুঘল প্রশাসন জমিদারদের পাওয়া অর্থ নির্দিষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন এবং তাকে ভূমি রাজস্বের সঙ্গে যুক্ত করে নিতে চেয়েছিলেন। এইসব ক্ষেত্রে জমিদারের প্রাপ্যকে শতকরা দশ ভাগ ধরে নিয়ে তাকে বলা হত মালিকানা। এই মালিকানা নগদ অর্থে অথবা শুল্ক যুক্ত জমি বা মান কর’-এর অধিকার দিয়ে মেটানো যেত। কিন্তু কৃষক প্রজাদের নিকট থেকে জোর করে কিছু আদায়, যথা জিনিসপত্র এক স্থান থেকে অন্যস্থানে বহন করার জন্য ‘বেগার’খাটা ইত্যাদি বন্ধ করা অত্যন্ত কঠিন ছিল।

কখনো-কখনো জমিদারদের নিজের জমিদারির বাইরের অন্য জমি থেকেও রাজস্ব আদায় করার অনুমতি দেওয়া হত। সাধারণত একে ‘তালুক’ বলা হত। এক্ষেত্রে জমিদার অবশ্য কেবল রাজস্ব আদায়কারীর ভূমিকা পালন করতেন, যার জন্য তাকে ‘মান কর’ বা করমুক্ত জমির মাধ্যমে পারিশ্রমিক দেওয়া হত।

জমিদারেরা পরম্পরাগত ভাবে শক্তিমান কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বিরোধী ছিলেন। তাই গ্রামাঞ্চলে সেই জমিদারদের সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে রূপান্তরিত করার এই মুঘল প্রচেষ্টা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল। তবে এই প্রকল্প রূপায়ণের পথে বহু বাধা-বিপত্তির সৃষ্টি হয়। কৃষকদের সঙ্গে জমিদারদের বর্ণগত, জাতিগত, গোষ্ঠীগত সম্পর্ক প্রায়ই থাকত, এবং জমি ও জমির উৎপাদকতা সম্বন্ধে তাদের যথেষ্ট জ্ঞানও ছিল। সরকার জমিদারদের এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই নিজেদের রাজস্ব বৃদ্ধির চেষ্টায় ছিল। এছাড়াও জমি যারা চাষ করে বিশেষ করে মালিকজমিন, অর্থাৎ যারা একযোগে জমির মালিক ও কৃষক উভয়ই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। প্রশাসন জমিদারদের আধিপত্য সংকুচিত করার চেষ্টা করতে লাগল। যেহেতু জমিদাররা নিজেরাই কৃষকদের শোষণ করতেন, সরকারের এই কাজে তাদের এই অত্যাচার করার ধারা কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হল। কিন্তু জমিদারেরা যখন কৃষকদের সঙ্গে দল বেঁধে প্রশাসনের এই লালসার প্রতিরোধ করার চেষ্টা শুরু করল তখনই এক বিরোধের পরিস্থিতির সৃষ্টি হল।

জমিদার বলতে আমরা যদি ভাবি যে তারা কেবল জমির অধিকার নিয়ে লড়াই করত এবং তাদের আয়ত্তাধীন অঞ্চলে সকল কৃষককে শোষণ করে যেত তাহলে কিন্তু ভুল হবে। বহু জমিদারদেরই তাদের প্রজাদের সঙ্গে আত্মীয়তা ছিল বা তারা একই বর্ণের মানুষ হওয়ার জন্য তাদের মধ্যে যথেষ্ট নিবিড় সম্পর্ক ছিল। জমিদারেরা কেবল সামাজিক রীতি-নীতি নির্ধারিত করে দিত তাই নয়–তারা কিন্তু নতুন গ্রাম প্রতিস্থাপনের জন্য এবং কৃষিকার্যের বিস্তার ও গুণমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ এবং সংগঠনেরও ব্যবস্থা করত। তবে এই সমস্ত প্রকল্পের সাফল্য কিন্তু বহুলাংশে নির্ভর করত ‘খুদ-কস্‌ত’ বা মালিক কৰ্ষকদের সহযোগিতা বা সহায়তার উপর, কারণ এই খুদক-রাই গ্রাম্য সম্পদের বিশেষ প্রভাবশালী পরিবার ছিল, এরাই ছিল ভূসম্পত্তির অধিকারী, এবং প্রয়োজনে লোকবলও এরাই সরবরাহ করত।

জমিদারেরা অবশ্যই একটি বহু-সদস্য বিশিষ্ট এবং শক্তিশালী শ্রেণি ছিল তথাপি সমস্ত গ্রাম কিন্তু তাদের অধীনে ছিল না। তাই এই সময়ের রাজস্বের কাগজপত্রে দেখা যায় যে গ্রামগুলিকে রায়তি জমিদারের কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং তালুক বা জমিদারের অধিকারস্থ এইভাবে ভাগ করা হয়েছে। যেসব গ্রাম একই পরগনার অন্তর্ভুক্ত সেখানেও এইরূপ বিভাজন করা হয়েছিল। নিজেদের তালুক থেকে খাজনা আদায় করার সময়েও জমিদারদের সরকারি আইন মেনে চলতে হত। এবং কোনো কৃষককে জমিদাররা তাদের জমি থেকে বিতাড়িত করতেও পারত না। আসলে যেখানে প্রচুর জমি উদ্বৃত্ত রয়েছে সেখানে জমিদারেরা চাইবে যে কৃষকেরা জমিতে থাকুক এবং যথাসম্ভব জমি চাষ করে তুলুক। এটিই তো স্বাভাবিক। কৃষকেরা অবশ্য তাদের পক্ষে ছিল না এবং নিজেদের ইচ্ছামতোই তারা থাকতে বা ছেড়ে চলে যেতে পারত, কিন্তু স্থানীয় আধিকারিকদের বলা হয়েছিল যেভাবেই হোক, এমনকি প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করেও তাদের আটকে রাখতে।

সমাজের মধ্যম স্তর

বর্ষে কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল কিনা তা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের-এর মতে ভারতে তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে কিছু ছিল না। মানুষ অত্যন্ত ধনি হত। হয়তো কষ্টেসৃষ্টে জীবনযাপন করত। তবে এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত হওয়া সম্ভব নয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে দোকানদার বা ছোটোখাটো ব্যবসাদার বোঝাত। তখন ভারতবর্ষে বহু ধনী বণিক ও ব্যবসাদার ছিলেন যাদের মধ্যে অনেকেই তৎকালীন বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ধনবান ব্যবসায়ীদের সমতুল বলে গণ্য হতেন। এইসব ব্যবসাদারদের কিছু পরম্পরাগত অধিকার ছিল এবং জীবন ও সম্পদ রক্ষার অধিকারও ছিল। কিন্তু তাদের কোনো শহরকে শাসন করার অধিকার ছিল না। এই নগর শাসনের অধিকার ইউরোপে বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোনো ব্যবসায়ী অর্জন করতে পেরেছিলেন। আবার ফ্রান্স ও ব্রিটেন-এর মত যেখানে শক্তিশালী অঞ্চলভিত্তিক রাজ্য গড়ে উঠেছিল সেখানেই এই সমস্ত অধিকার খর্ব করা হয়।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে যদি এমন একটি শ্রেণির ব্যক্তিদের কথা কথা ধরে নেওয়া হয় যারা জায়গির থেকে কোনো অংশ পেত না, কেবল তাদের পেশাভিত্তিক কার্যের বিনিময়েই বা চাকরি থেকে পারিশ্রমিক পেত, তাহলে আমরা শহরাঞ্চলে বহুসংখ্যক পেশাভিত্তিক এবং চাকুরিজীবী গোষ্ঠীর সন্ধান পাই, যাদের নাগরিক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বলা যেতে পারে। মুঘল প্রশাসনের এমনই ধারা যে তাদের দলে দলে হিসেবরক্ষক আর কেরানির প্রয়োজন হত কেবল সরকারি দফতরেই নয়, অভিজাতদের এমনকি সওদাগরদেরও কাজকর্মের জন্য। আবার অর্থবান কারুশিল্পীরাও দরিদ্রদের তুলনায় অনেক উন্নতমানের জীবন কাটাত।

সমসাময়িক নথিপত্র থেকে দেখা যায় যে কোনো-কোনো শ্রেণির রাজস্ব অধিকর্তারা বেশ সমৃদ্ধিশালী জীবন অতিবাহিত করত (অথবা বেশ রাজার হালেই থাকত)। এইসব আমিল এবং কারকুরা নকল হিসেবের খাতার মাধ্যমে ভূমি রাজস্ব আত্মসাৎ করে এবং আরও ভ্রষ্টাচার এবং জালিয়াতি দিয়ে নিজেদের প্রকৃত আয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে নিত। তাদের বেশিরভাগই ক্ষত্রি এবং বানিয়া জাতির বা জৈন সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ার জন্য তারা চাকুরির পাশাপাশি অন্য ব্যবসায়ও করত। যথা কৃষিকার্য, চড়া সুদে ঋণ দেওয়া, নানা জিনিসে টাকা লাগানো, উদ্যান পালন, ভাড়া দেওয়া সম্পত্তির তত্ত্বাবধান, রাজস্ব উৎপাদন ইত্যাদি। কোনো সংস্থার কোষাধ্যক্ষ বা কারোরিরা তাদের সংগৃহীত অর্থ মহাজনদের কাছে দীর্ঘসময়ের জন্য সুদ সহ বিনিয়োগ করে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করত। শহর থেকে বিভিন্ন দ্রব্য ক্রয় করার মতো এদের পর্যাপ্ত আর্থিক সঙ্গতি ছিল। এমনকি তাদের কারও কারও জীবনযাত্রা উচ্চশ্রেণির অভিজাতদের সমমানের ছিল। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে জাহানবাদের আমিন এবং ফৌজদার আবদুস সামাদ খান তার নিজের ছেলের নামে একটি ক্ষুদ্র নগর পত্তনও করেছিলেন। সেই উপনগরীতে ফলের বাগিচা, একটি সরাই এবং তুর্কি হামামেও সুসজ্জিত ছিল।

এই শ্রেণির নাগরিকেরা যে কি পরিমাণ সম্পদ আহরণ করেছিল তা বোঝাবার জন্য নিচের হিসাবটিই যথেষ্ট। ১৭২৫ সালে আহমদাবাদের রাজনৈতিক প্রশাসকেরা সেখানে কর্মে নিযুক্ত আটজন আমলার কাছ থেকে মোট ৫,৭৩,০০০ টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাধারণত রাজস্ব আধিকারিকদের অর্থাৎ খাজনা সংগ্রহকারীদের বেশ বদনাম ছিল। এবং মাঝে মাঝে তাদের অন্যায় ভাবে সংগৃহীত সম্পদ প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করার জন্য তাদের কারাবাস এবং ইত্যাকার অপমানকর শাস্তিও দেওয়া হত।

পেশাদারদের মধ্যে চিকিৎসকেরা (তাবিব) শুধুমাত্র ধনী অভিজাতদেরই চিকিৎসা করতেন না। পরন্তু ছোটোখাটো কর্মচারী, বণিক ও সওদাগর, ক্ষুদ্রতর মনসবদার এবং পেশাদার নাগরিকেরা এবং সম্পন্ন কারুশিল্পীদেরও তারা পরিচর্যা করতেন। কোনো কোনো তাবিব প্রশাসকদের বা উচ্চতর অভিজাতদের দ্বারা নিযুক্ত হতেন এবং মনসবও লাভ করতেন। কিন্তু অনেকেই স্বাধীন ভাবে তাদের পেশার প্রয়োগ করতেন। সম্ভ্রান্ত ইতালীয় মানুচ্চি বলছেন যে গোলন্দাজ বাহিনীতে তার দ্বারা প্রদত্ত চাকুরির মেয়াদ শেষ হলে, তিনি লাহোরে ব্যক্তিগত ভাবে চিকিৎসাবিদ্যা শুরু করেন এবং শীঘ্রই তার এত সুনাম হয় যে লাহোরের দূরবর্তী স্থান থেকেও তার কাছে রোগীরা চিকিৎসার জন্য আসতে থাকে।

সংগীতজ্ঞ নিপুণ হস্তলিপিকার (খুশখৎ) এবং শিক্ষকেরাও পেশাদারি বিশেষজ্ঞদের এক অংশ ছিলেন। লেখক, ঐতিহাসিক, ধর্মতত্ত্ববিদ ইত্যাদিরাও প্রায় শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসতেন, যদিও মাঝে মাঝে নিষ্কর জমির ইনাম পেয়ে তারা সামন্ত ভূস্বামীদের কাছাকাছি চলে আসতেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে মধ্যস্থরের মনুষ্যবর্গে বিভিন্ন বিষয়ে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং তারা ছিলেন বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণাশ্রয়ী।

বাণিজ্যিক শ্রেণি

ভারতীয়দের মধ্যে বাণিজ্যিক শ্রেণি ছিলেন আয়তনে বিশাল, সারা দেশে বিস্তৃত এবং পুরোপুরি পেশাদারি মনোভাবাপন্ন। এদের মধ্যে অনেকের ব্যবসার পরিধি ছিল বহুদূর ব্যাপী, দেশের এক অংশ থেকে অন্য অংশের মধ্যে। আবার আর-এক অংশের ব্যবসায়ীগণ স্থানীয় খুচরো কেনাবেচার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। প্রথমোক্ত ব্যবসায়ীদের বলা হত শেঠ, বোহরা, অথবা মোদী। এবং দ্বিতীয় প্রকারের বাণিজ্যিক শ্রেণির মানুষদের ব্যাপারী অথবা বণিক বলে ডাকা হত। খুচরো বিক্রয় কার্য ছাড়াও বিভিন্ন গ্রামে এবং উপনগরে এইসব বণিকদের নিজস্ব প্রতিনিধি থাকত যাদের কাজ ছিল সস্তায় খাদ্যশস্য এবং বাণিজ্যিক শস্য কিনে নেওয়া। এদের সাধারণত বানিয়া অথবা বাক্কাল, অর্থাৎ খাদ্যশস্যের ব্যবসাদার বলা হত। বানিয়ারা আবার গ্রামাঞ্চলে টাকা ধার দেওয়ার তেজারতি ব্যবসাও করতেন এবং সেইজন্য তাদের লোভী এবং অর্থশোষকের বদনামও ছিল। তবে এদের কাজকর্মের একটি কার্যকরী দিকও ছিল। এরা গ্রাম অথবা মাণ্ডি থেকে শহরে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যশস্য পরিবহণের সুযোগ করে দিত এবং গ্রামীণ মূলধনেরও জোগান দিত।

ভারতের ব্যবসায়ী শ্রেণির মানুষজন কোনো একটি বিশেষ ধর্ম বা জাতির হত না। গুজরাটি ব্যবসাদারদের মধ্যে হিন্দু, জৈন ও মুসলিম সব ধর্মেরই লোক ছিল এবং এদের বোহরা বলা হত। রাজস্থানে, অসওয়াল, মাহেশ্বরী এবং আগরওয়ালদের মাড়োয়াড়ি বলে ডাকা শুরু হয়। মধ্য এশিয়ার দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল। মুলতানি আফগান এবং ক্ষত্রিদের হাতে। বাংলার ব্যবসায়ীদের গন্ধ-বণিক বলা হত। তবে পরবর্তীকালে আফগান ও মুসলিম বণিকেরা এদের বহুলাংশেই কর্মচ্যুত করে। ১৮শ শতাব্দীতে মাড়োয়াড়িরা মহারাষ্ট্র এবং বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। করমণ্ডল। উপকূলের চেট্টিয়াররা এবং মালবারের চুলিয়া, মুপিল্লাহ শ্রেণির এবং আরব মুসলমানেরাই ছিল দক্ষিন ভারতের সর্বপ্রধান বাণিজ্যিক গোষ্ঠী।

ভারতের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, বিশেষ করে বন্দর শহরের অধিবাসীদের মধ্যে অনেকেই ছিল সম্পদশালী, ইউরোপের বাণিজ্যিক রাজপুত্রদের সঙ্গে যাদের তুলনা করা যেত। ১৬৬৩ সালে পর্তুগিজ বণিক গডিনহো বলেন যে সুরাটের ব্যবসায়ীরা ছিল অত্যন্ত ধনী, যাদের অনেকেই ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকার মালিক ছিল। বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য তাঁদের পঞ্চাশটি জাহাজ রাখা ছিল। সুরাটের ব্যবসা-বাণিজ্যে বহু বর্ষব্যাপী একাধিপত্যের অধিকারী বীরাজি বোহরার এক বিশাল নৌবহর ছিল। তার সময়কালের সর্ববৃহৎ সম্পদের অধিকারী বলে খ্যাত বীরজি বোহরা স্থানীয় রাজার থেকে আফিম ও তুলা কিনে তার বিনিময়ে মালাবার এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে মরিচ সংগ্রহ করতেন। সেই মরিচ আবার তিনি ইংরেজ এবং ওলন্দাজ ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করতেন। শোনা যায় এক সময় তার মূলধনের পরিমাণ ছিল ৮০ লক্ষ টাকা। এইসব সূত্রে এমন সব গুজরাটি বণিকদের কথাও বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, যারা এক জাহাজ ভরতি সমস্ত মাল কিনে নিতে পারতেন বা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সমস্ত বৎসরের বিনিয়োগের অর্থ নিজেরাই জোগান দিতে পারতেন। ১৭১৮ সালে তার মৃত্যুর সময় আবদুল গফুর বোইয়া নগদ ৮৫ লক্ষ টাকা ১৭টি সমুদ্রগামী জাহাজ রেখে গিয়েছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ করমণ্ডল উপকূলের মলয় চেট্টি, কাশি ভিরান্না এবং সুষ্কা রামা শেট্টিও অত্যন্ত ধনবান ছিলেন এবং ভারতে ও দেশের বাইরেও তাদের প্রচুর লেনদেন ছিল। এছাড়া আগ্রা, দিল্লি, বালেশ্বর (ওড়িষ্যা) এবং বঙ্গদেশেও বহু ধনবান বণিক ছিলেন। এদের অনেকেই, বিশেষ করে উপকূলের নিকটস্থ শহরে যারা বাস করতেন, তারা প্রচুর আড়ম্বরের সঙ্গে বাস করতেন, এবং অভিজাতদের জীবনযাত্রার নকল করতে সচেষ্ট ছিলেন।

বণিকদের জীবনযাত্রার মান ছিল পারিপার্শ্বিকের উপর নির্ভরশীলতাই এরমধ্যে অনেক তারতম্য দেখা যেত। বার্নিয়ের বলেছেন বণিকেরা চেষ্টা করত যাতে তাদের গরিবদের মতো দেখতে লাগে। যাতে করে বড়োলোক ভেবে কেউ তাদের নিংড়ে টাকা-পয়সা বের করে নিতে না পারে। অভিজাতরা অনেক সময় তাদের সামাজিক মর্যাদার সুযোগ নিত, বিশেষ করে অনিশ্চিত সময়কালে যেমন আকবরের মৃত্যুর সময় জৌনপুরে ঘটেছিল। জৈন ব্যবসায়ী বানারসী দাসের মতে রাজকুমাররা মাঝেমধ্যে জোর করে ঋণ আদায় করত, তবে মোটামুটি ভাবে এগুলি প্রচলিত রীতি ছিল না, বরং রীতির ব্যতিক্রম ছিল। তাই মিরাত-ই-আহমদি পুস্তকের রচয়িতা গুজরাট সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আহমেদাবাদের দুইটি শহরতলিকে ‘দুটি স্বর্ণময় ডানা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এখানে ধনী হিন্দুরা বাস করত যারা বেশিরভাগই ছিল। অধিকাংশের মালিক এবং লক্ষপতি।

দিল্লি আগ্রার বণিকেরা যেসব সুগঠিত ও সুপ্রশস্ত গৃহে বাস করতেন ইউরোপীয় পর্যটকেরা তার উল্লেখ করেছেন। সাধারণ ব্যবসাদারেরা অবশ্য তাদের দোকানের উপরে নির্মিত গৃহে থাকতেন। কিন্তু বানিয়েরের মতে এগুলো কিন্তু মোটামুটি প্রশস্ত বাসযোগ্য ছিল। দিল্লিতে কোনো-কোনো সওদাগরের সুন্দর সমতল ছাদ-বিশিষ্ট দোতলা বাড়ি দেখা যেত। তবে সকলেই কিন্তু নিজেদের প্রাচুর্য লুকিয়ে রাখতে চাইত না। যেমন আগ্রাতে সাবাল সিংহ সাহু নামে একজন ব্যবসায়ীর সভাগৃহ শাহজাদাদের দরবারের মতো মনে হত। সামাজিক রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যের কথাও স্মরণে রাখা অবশ্যই উচিত। ট্যাভার্নিয়র অবশ্য শ্রফদের সাধারণ ভাবে সকল ভারতীয়েরই চরম মিতব্যয়িতার কথা উল্লেখ করে এও বলেছেন যে–বেনিয়ারা যেমন করে তাদের সন্তানদের বাল্যকাল থেকেই-আলস্য ত্যাগ করে ধন অর্জন করার কৌশল শিখে নেওয়ার কথা বলতেন।

ব্যবসায়ীদের অবশ্যই আধিকারিকদের নিকট থেকে কিছু কিছু উৎপাত সহ্য করতে হত, তবে তাদের সম্পত্তি কিন্তু মোটামুটি সুরক্ষিত ছিল। অভিজাতদের সম্পত্তি যে প্রশাসন মাঝে মাঝে বাজেয়াপ্ত করে নিতেন, সে ভয় থেকে অবশ্য বণিকগণ মুক্ত ছিলেন। শের শাহের সময় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সম্রাট বণিকদের সম্পদ রক্ষা করার জন্য বহু আইন প্রবর্তন করেন। জাহাঙ্গিরের আদেশের একটি শর্ত ছিল। ‘মুসলমান বা অবিশ্বাসী যেই হোক না কেন, কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার সমস্ত সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীদেরই জন্যই রাখা থাকবে। কেউ তার উপর কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।’

কোনো কোনো ইউরোপীয় পর্যটক অভিযোগ করে থাকলেও পথ-ঘাট কিন্তু সাধারণত নিরাপদ ছিল। বানারসি দাস আকবরের রাজত্বের শেষ দিকে এবং জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে আগ্রা, জৌনপুর ও পাটনার মধ্যে বহুবার যাতায়াত করলেও মাত্র একবারই তার উপর ডাকাতি হয়েছিল। জিনিসপত্র বিমা করা থাকত, এবং বিমার হারও খুব কম ছিল % থেকে ১ শতাংশ, যদিও পরবর্তীকালে তা শতকরা 1%% পর্যন্ত বর্ধিত হয়। বিমার হারের এই স্বল্পতা থেকেই বোঝা যায় যে বিপদের মাত্রার কম ছিল। এ পরিবহণ ব্যবস্থা ছিল সস্তা এবং প্রয়োজন অনুসারে যথেষ্ট। রাজপথের উপর ৫ ক্রোশ দূরত্বের সরাই পর্যন্ত যাবার ব্যবস্থা তকালীন ইউরোপের সমমানের ছিল। কিন্তু এ সত্ত্বেও ব্যবসা ও বণিক উভয়েরই সামাজিকভাবে নিম্ন পর্যায়ভুক্ত ছিল। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উপর বণিক সম্প্রদায়ের প্রভাবও তর্কাতীত ছিল না। যেখানে তাদের নিজেদের স্বার্থ জড়িত সেখানে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পিছপা হত না। তাই সকল বণিক সম্প্রদায়েরই নিজস্ব একজন নেতা বা মগরশেঠ’ থাকতেন, যিনি স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সকল ব্যবসায়ীর তরফেই মধ্যস্থতা করতেন। নিজেদের মতামতকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য বা প্রশাসনের হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য আহমেদাবাদ এবং অন্যত্র ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট (হরতাল) করেছিলেন, সেই দৃষ্টান্তও আছে। থেতবটের সময়ে হিন্দু অধিকোষ (ব্যাংকের) মালিকেরা ভাবানগরে (হায়দরাবাদ) আমিরদের জোর করে অর্থ আদায়ের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করেছিলেন, এবং প্রশাসন সেই অধিকৃত সম্পদ ফিরিয়ে দিলেই তবেই এই ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। ১৬৬৮-৬৯ সালে জিজিয়া কর আরোপের বিরুদ্ধে, এবং সুরাটের বণিকরা এক ব্যক্তিকে জোর করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার প্রতিবাদে হরতাল করেন।

১. হিন্দু সমাজে কয়েকটি জাতের মধ্যে বিধবা বিবাহ প্রথা স্বীকৃত ছিল। মহিলাদের সম্পত্তি বিশেষ করে গৃহ, জমি ও দোকানের উপর অধিকার থাকার বহুনিদর্শন পাওয়া যায়। যদিও এই অধিকার তারা পেত সাধারণ পরিবারের পুরুষ বংশধর না থাকলে বা স্বামীর মৃত্যুতে ‘মেহর’।

২. সম্প্রতি গবেষনায় দেখা গেছে যে ১৫৯৫ সাল নাগাদ রাজকীয় ব্যবহারের জন্য রাখা মোট রাজস্ব আয়ের ২২% এরও বেশি অর্থ ব্যক্তিগত খাতে খরচা করা হয়েছিল। যেখানে অভিজাতরা এই আয়ের প্রায় ২০% নিজেদের কাজে ব্যায় করেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *