১১. ঔরঙ্গজেব–তার ধর্মীয় নীতি, উত্তর ভারত ও রাজপুত প্রসঙ্গ

একাদশ অধ্যায় – ঔরঙ্গজেব-তার ধর্মীয় নীতি, উত্তর ভারত ও রাজপুত প্রসঙ্গ

উত্তরাধিকারিত্বের লড়াই

শাহজাহান অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ছিলেন যে তার প্রিয়তমা পত্নী মুমতাজ মহলের গর্ভজাত চার সন্তান যোগ্য, কর্মঠ ও মুঘল ধারায় মদ্যপানের কুভ্যাসের ছায়া থেকে মুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠছিলেন। সাবালক হয়ে ওঠার পর এঁদের সকলকেই প্রশাসনিক দায়িত্ব ও উচ্চ মনসব প্রদান করা হয়েছিল। দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ সন্তান সুজাকে ১৬৩৭ সালে বাংলার শাসক হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল যিনি পরবর্তী দুই দশক সেখানে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে প্রাদেশিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিলেন। সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মুরাদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গুজরাট প্রদেশের, পরে তার দায়িত্বে যুক্ত হয়েছিল মালবও। শাহজাহানের আর-এক পুত্র ঔরঙ্গজেব ১৬৩৬ সালে মাত্র আঠারো বছর বয়সে দাক্ষিণাত্যে মুঘল রাজপ্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত হন এবং টানা ছয় বছর ধরে তিনি সেখানে এই দায়িত্ব সামলেছিলেন। ১৬৫২ সালে তিনি পুনরায় দাক্ষিণাত্যে মুঘল রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত হয়েছিলেন। জ্যেষ্ঠ সন্তান দারা এলাহাবাদের প্রাদেশিক শাসক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং পরে তাঁকে লাহোরের প্রাদেশিক শাসক হিসাবে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু যেহেতু তিনি পিতার সবথেকে প্রিয় সন্তান ছিলেন সেহেতু তিনি দরবারে সব সময় পিতার কাছে কাছে থাকতেন। পিতার এই পক্ষপাতিত্ব বাকি সন্তানেরা মেনে নিতে পারেননি এবং বাকি তিন ভাই দারার বিরুদ্ধে একপ্রকার জোটবদ্ধ হতে শুরু করেছিলেন। এই কারণেই ১৬৫২ সালে সুজা তার কন্যাকে ঔরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলতান মহম্মদের সঙ্গে বিবাহ দেবেন বলে কথা দিলে। ঔরঙ্গজেবও তার কন্যার সঙ্গে সুজার পুত্রের বিবাহ দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। মুরাদও ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে মিত্রতা বাড়িয়ে তুলেছিলেন নানা ভাবে।

শাহজাদা হাতে প্রচুর ক্ষমতা থাকার কারণে উত্তরাধিকার নিয়ে সমস্যা অনেক জটিল আকার ধারণ করেছিল এবং তা রক্তাক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। মুসলিমদের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে কোনো স্বচ্ছ ঐতিহ্য ছিল না। যদিও প্রথম দিকে জনগণের মতামত নেওয়া হত এ ব্যাপারে, কিন্তু সময় যত এগিয়েছে ততই সফল শাসক তাঁর উত্তরসূরি মনোনয়নের অধিকার নিজের হাতেই রেখে দিয়েছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতি বিশারদরাও তা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও উত্তরসূরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আবশ্যিক ভাবে জ্যেষ্ঠ পুত্রকে বিশেষ প্রাধান্য দেবার নিয়ম কিন্তু ছিল না। ভারতে তৈমুরীয়দের বিভাজনের ঐতিহ্য খাটেনি, এখানে যাঁরা শক্তিশালী সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রাখতেন এবং যাদের পর্যাপ্ত সামরিক ক্ষমতা ও যোগ্যতা ছিল, তাঁরাই শাসক হবার দৌড়ে এগিয়ে থাকতেন।

হিন্দুদের মধ্যেও রাজতন্ত্রে উত্তরসূরি নির্বাচনের কোনো নির্দিষ্ট ঐতিহ্য ছিল না। সেই বুদ্ধের সময়ে অজাতশত্রু যেভাবে তার পিতাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন ও কারারুদ্ধ করেছিলেন এবং যেভাবে অশোক মৌর্য উত্তরাধিকারের প্রশ্নে তার ভাইদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন তা দেখে এটা মনে হয় যে সে সময়েও উত্তরসূরি মনোনয়ন নির্ভর করত সামরিক ক্ষমতার ওপরেই। এই ধারা পরবর্তীকালে রাষ্ট্রকূট ও রাজপুতদের মধ্যেও দেখা গিয়েছিল। তাই রানা সঙ্গকে গদ্দি-তে বসার জন্যে তার ভাইদের সঙ্গে তিক্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়েছিল।

শাহজাহান তার নবনির্মিত শহর শাহজাহানবাদ বা দিল্লিতে থাকাকালীন ১৬৫৭ সালে ভীষণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিছুদিনের জন্যে হলেও তাঁর জীবন হতাশায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু পুত্র দারার যত্ন ও শুশ্রূষায় দ্রুত তিনি সুস্থ ও সবল হয়ে উঠেছিলেন। এই ঘটনায় একাধিক গুজব ছড়িয়ে যায়। বলা হয় যে শাহজাহান নাকি ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন, দারা কেবল তার স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সে সংবাদ লুকিয়ে রেখেছেন। যাই হোক, ১৬৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন শাহজাহান সুস্থ হয়ে আগ্রা গমন করেন তখন বাংলা থেকে সুজা, গুজরাট থেকে মুরদ ও দাক্ষিণাত্য থেকে ঔরঙ্গজেব সেইসব গুজব সত্যি বলে মেনে নিয়েই হোক বা মেনে নেবার ভান করেই হোক, অবধারিত উত্তরাধিকারিত্বের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।

শাহজাহান দারাকেই তার সঠিক উত্তরসূরি মনে করতেন। ১৬৫৪ সালের শুরুর দিকে তিনি দারাকে সুলতান বুলন্দ ইকবাল উপাধি, সিংহাসনের পাশেই বসার জন্যে সোনার আসন এবং উচ্চ মনসব প্রদান করেছিলেন। তাঁর মনসব ১৬৫৮ সাল নাগাদ অভাবনীয় ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ৬০,০০০ জাত/৪০,০০০ সাওয়ার (যার মধ্যে ঔরঙ্গজেব-তার ধর্মীয় নীতি, উত্তর ভারত ও রাজপুত প্রসঙ্গ ৩০,০০০ হল দু-আসপা সি-আসপা)। সরকারি ভাবেও দারাকে শাহজাহানের উত্তরাধিকার (ওয়ালি আহদ) ঘোষণা করে সকল অভিজাত ও কর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে দারার সঙ্গে যেন ভবিষ্যতের সম্রাটের মতো আচরণ করা হয়। কিন্তু এসব করে খুব সহজে দারার সিংহাসনে বসার রাস্তা মসৃণ করে রাখার যে আশা শাহজাহান করেছিলেন তাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি অন্য সব শাহজাদারা। দারার প্রতি মুঘল সম্রাটের এই পক্ষপাতমূলক আচরণ তাদের সিংহাসন দখলের প্রতি খিদে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।

শাহজাহানের প্রিয় সন্তান দারার সঙ্গে সবথেকে দাপুটে সন্তান ঔরঙ্গজেবের দ্বন্দ্ব তখনই চরমে পৌঁছায় যখন ঔরঙ্গজেব সন্দেহ করেছিলেন যে দারা তার পিতার সঙ্গে। ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে বারবার তাঁকে অপদস্থ করছেন ও বাধা দিচ্ছেন। যখন ঔরঙ্গজেবকে কান্দাহারে তার দুই অভিযানের ব্যর্থতার পর মুলতান ও সিন্ধ অঞ্চলের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দাক্ষিণাত্যের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল তখন তার জায়গিরও দাক্ষিণাত্যের এমন একটি জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল যেখানে চাষবাস খুব একটা ভালো হত না, ফলে তার ক্ষতি হয়েছিল প্রচুর। দাক্ষিণাত্য অঞ্চলটিও দীর্ঘ দিন ধরে ঘাটতির মাশুল গুনে চলেছিল। ফলে তাকে তার প্রশাসনের খরচ মেটাতে অর্থ আনতে হচ্ছিল মালব ও গুজরাট থেকে। কিন্তু শাহজাহানের বক্তব্য ছিল যে সুবার আর্থিক ঘাটতি মেটানোর জন্য সব সময় সুবার কৃষির বৃদ্ধি ও বিকাশের দিকে নজর। দিতে হবে। ঔরঙ্গজেব সেই চেষ্টা করেছিলেন দাক্ষিণাত্যের দিওয়ান মুর্শিদ কুলি খানের সহায়তায়। কিন্তু শাহজাহান বড্ড বেশি অধৈর্য হয়ে পড়ে ঔরঙ্গজেবকে অনৈতিক ভাবে অবহেলা ও অযোগ্যতার দায়ে দোষী বানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি অভিযোগ করে বলেছিলেন যে ঔরঙ্গজেবের অভিজাতদের ওই অঞ্চলের সবথেকে উর্বর গ্রামগুলি জায়গির হিসাবে প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু তাও সেখানে কৃষির উন্নতি ঘটাতে তারা ব্যর্থ। এমনকি পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হয়ে ওঠে যে বুরহানপুরের শাহজাহানের সবথেকে প্রিয় আম গাছ থেকে নাকি ঔরঙ্গজেব নিজের জন্য আম পেড়ে নিয়ে চলে গিয়েছেন এমন সরাসরি অভিযোগ তিনি করে বসেন ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে!

অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করার জন্যে ঔরঙ্গজেব চেষ্টা করেছিলেন। শাহজাহানকে দিয়ে গোলকুণ্ডা ও বিজাপুর আক্রমণের অনুমতি আদায় করাতে, কারণ তিনি জানতেন ওই দুই দক্ষিণী রাজ্য কর্ণাটক আক্রমণ করে প্রচুর ধন সম্পদ লুঠ করেছিল আর ওই দুই রাজ্য জয় করতে পারলে দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের এলাকারও বিস্তার ঘটতে পারত। যেখানে পরিষ্কার ভাবে জানতেন যে তিনি ওই দুই অঞ্চল জয় করতে পারবেন সেখানে তাকে সম্পূর্ণ ভাবে ধোঁয়াশায় রেখে শাহজাহান গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরের সঙ্গে সমঝোতা করে নিলে ঔরঙ্গজেব মনে মনে খুবই অসন্তুষ্ট হন। এই দুই ক্ষেত্রেই ঔরঙ্গজেব শাহজাদা দারার হাত ছিল ও দক্ষিণী শাসকদের থেকে ঘুস। খেয়ে এই কাজ করা হয়েছিল বলে সন্দেহ করেন। কিন্তু সেই সময় শাহজাহানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল মুঘল সাম্রাজ্য জুড়ে, ফলে তিনি প্রাথমিক ভাবে দারার কথায় প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে মনে হয় না।

দারা ও ঔরঙ্গজেবের চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। দারা নিয়মিত উদার সুফি ও ভক্তিবাদী সাধু সন্তদের সান্নিধ্যে থাকতেন এবং একেশ্বরবাদের সন্ধানে গভীর ভাবে নিমজ্জিত থাকতে ভালোবাসতেন। তিনি বাইবেল ও বেদ পড়ে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে একেশ্বরবাদের খোঁজ করতে হলে কোরান ছেড়ে বেদ পড়া উচিত। অন্যদিকে ঔরঙ্গজেব নিজেকে সব সময় কোরান ও মুসলমান সাধকদের জীবনীমূলক গ্রন্থ অধ্যয়নে কুঁদ রাখতে পছন্দ করতেন এবং অত্যন্ত কড়া ভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার। বিচার পালন করতেন। দারা ঔরঙ্গজেবকে ‘ভণ্ড’বলে কটাক্ষ করতেন আর ঔরঙ্গজেব দারাকে বলতেন ‘ধর্ম বিরোধী। কিন্তু এই যে ধর্ম নিয়ে উভয়ের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য তার ফল অভিজাত শ্রেণি ও উদারনৈতিক ও গোঁড়া–দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। অভিজাতরা নিজেদের স্বার্থ ও যোগাযোগ বুঝেই শিবির নির্বাচন করতেন। আবার শাহজাদারাও দরবারের প্রভাবশালী অভিজাতদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তাদের দলে টানবার চেষ্টা করতেন। সেই কারণে ঔরঙ্গজেব ১৬৩৬ সাল থেকে জয় সিংহের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চেয়েছিলেন। ১৬৪৭ সালে রাজা জয় সিংহকে লেখা এক পত্রে ঔরঙ্গজেব রাজার সঙ্গে তার মিত্রতার প্রশংসা করেছিলেন, যদিও তিনি খুব ভালো করেই জানতেন যে জয় সিংহ সুজার দলের লোক ছিলেন।

সুজা, মুরদ ও ঔরঙ্গজেবের সামরিক প্রস্তুতি এবং একজোট হয়ে পিতার সঙ্গে দেখা করতে আসার ভান করে দারার নিয়ন্ত্রণ থেকে পিতাকে মুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের আগ্রার অভিমুখে অগ্রসর হবার খবর পেয়ে শাহজাহান দারার কথায় পূর্ব দিকে দারার জ্যেষ্ঠ সুলেমান শেখোহ ও মির্জা রাজা জয় সিংহের নেতৃত্বে একটি বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন ইতিমধ্যে নিজেকে স্বাধীন শাসক হিসাবে ঘোষণা করে দেওয়া সুজার মোকাবিলা করার জন্যে। আর একটি বাহিনী রাজা যশোবন্ত সিংহের নেতৃত্বে মালবে গিয়ে হাজির হয় মুরাদকে আটকানোর জন্যে, যিনি নিজেকে শাসক হিসাবে ঘোষণা করে দিয়ে গুজরাট থেকে আগ্রা অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিলেন। যশোবন্ত সিংহ মালবের ধরমত অঞ্চলে এসে দেখেন যে মুরদ ও ঔরঙ্গজেবের বাহিনী একজোট হয়ে এগিয়ে আসছেন। এই যৌথবাহিনীকে কীভাবে মোকাবিলা করবেন ঔরঙ্গজেব-তার ধর্মীয় নীতি, উত্তর ভারত ও রাজপুত প্রসঙ্গ তাঁর কোনো স্পষ্ট নির্দেশিকা পাননি যশোবন্ত সিংহ। দুই শাহজাদা তাকে আগ্রা যাবার পথ থেকে সরে যেতে অনুরোধ করেন। যদিও একজন নিছক অভিজাত হয়ে সম্রাটের নিজের পুত্রদের সঙ্গে যুদ্ধ করা শিষ্টাচার-বিরুদ্ধ কাজ ছিল এবং শাহজাদাদের যৌথবাহিনীর শক্তিও অনেক বেশি ছিল, তবুও যশোবন্ত সিংহ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যাওয়াটা অসম্মানজনক বলে মনে করে এগিয়ে যান। ধরমতের যুদ্ধে (১৫ এপ্রিল, ১৬৫৮) ঔরঙ্গজেবের জয় তার সমর্থকদের মধ্যে নব উন্মাদনার সৃষ্টি করে এবং তার সম্মান ও মর্যাদাও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়, কিন্তু ঔরঙ্গজেবের এই উত্থানে যথেষ্ট অস্বস্তিতে পড়ে যান দারা ও তার সমর্থকরা।

এর মধ্যে দারা একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেন। নিজের ক্ষমতার ওপর অত্যধিক আত্মবিশ্বাসী হয়ে তিনি তার সেরা বাহিনীকে পূর্ব ভারতে সুজার বিরুদ্ধে অভিযানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তিনি রাজধানী আগ্রাকে কার্যত উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। সুলেমান শেখোহর নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী পূর্ব দিকে বেশ ভালো জবাব দিয়েছিল সুজাকে এবং সেই বাহিনীর তৎপরতা দেখে চমকে গিয়েছিলেন সুজা। বেনারসের কাছে যুদ্ধে (ফ্রেব্রুয়ারি, ১৬৫৮) এই বাহিনীর কাছে সুজা পরাজিত হয়েছিলেন। সেই বাহিনী বিহারের দিকে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কিন্তু এমন সময় ধরমতের যুদ্ধে যশোবন্ত সিংহের পরাজয় ঘটায় সেই বাহিনীর কাছে তড়িঘড়ি আগ্রা ফিরে আসার বার্তা চলে যায়। সুজার সঙ্গে দ্রুত চুক্তি সম্পাদন করে (৭ মে, ১৬৫৮) সুলেমান শেখোহ পূর্ব বিহারের মোনগড়ে তাঁর শিবির থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে তিনি আদৌ আগ্রা পৌঁছোতে পারতেন কিনা সে নিয়ে সন্দেহ থেকে গিয়েছিল।

এদিকে ধরমতে ব্যর্থ হবার পর দারা নিজের ঘর গোছানোর জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। যোধপুরে সরে যাওয়া যশোবন্ত সিংহকে একের-পর-এক পত্র প্রেরণ করতে থাকেন তিনি। উদয়পুরের রানাকেও আবেদন করা হয় সহযোগিতার জন্যে। যশোবন্ত সিংহ ধীরে ধীরে আজমেরের পুষ্করে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে দারার পাঠানো সেনা ও অর্থ নিয়ে উদয়পুরের রানার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে রানাকে নিজের দলে টেনে নিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব। ফলে দারার গুরুত্বপূর্ণ রাজপুত রাজাকে পাশে পাওয়ার শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল।

দারা এবং ঔরঙ্গজেবের যুদ্ধ বাধে সমুদ্রগড়ে (২৯ মে, ১৬৫৮) যেখানে মূলত যুদ্ধটা হয়েছিল সেনা নিয়ন্ত্রণের দক্ষতার, কারণ সংখ্যার দিক থেকে উভয় শিবিরই প্রায় সমান ক্ষমতাবান ছিল (দু পক্ষের কাছেই প্রায় ৫০,০০০ থেকে ৬০,০০০ সেনা ছিল)। যুদ্ধক্ষেত্রে দারা ঔরঙ্গজেবের কাছে দাঁড়াতেই পারেননি। এই যুদ্ধের জন্যে হাদা রাজপুত ও বারহার সৈয়দর ওপর প্রচণ্ড রকম নির্ভরশীল ছিলেন দারা, কিন্তু বাদবাকি নিযুক্ত অকর্মণ্য সৈনিকদের ফলে তারাও খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি। অন্যদিকে ঔরঙ্গজেবের বাহিনী ছিল যথেষ্ট ক্ষিপ্র ও সংগঠিত।

দারা যে কেবল সেনা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ঔরঙ্গজেবের কাছে পিছিয়ে ছিল তাই নয়, তিনি প্রচণ্ড উদ্ধত ও নিজের প্রতি অতি-আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। ফলে সাধারণ ভাবে অভিজাতদের মধ্যে নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তিনি অন্য যোগ্য ব্যক্তিদের পরামর্শ নেবার ব্যাপারেও খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে মারাত্মক ভুল করেছিলেন। তখনও সার্বভৌম ক্ষমতার অধীশ্বর শাহজাহান দারাকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন যদি ঔরঙ্গজেব ভুল স্বীকার করে সমঝোতায় সম্মত না হন। তাহলে তার সামনাসামনি আসার কোনো প্রয়োজন নেই দারার।

দারা ও ঔরঙ্গজেবের মধ্যে যুদ্ধ কিন্তু কোনো অর্থেই ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উদারনৈতিক ধর্মীয় নীতির মধ্যে লড়াই ছিল না। দুই শিবিরেই হিন্দু-মুসলিম সমর্থক সমান ভাবে ছিল। আমরা ইতিমধ্যেই রাজপুত রাজাদের মনোভাব প্রত্যক্ষ করেছিল। একই ভাবে শিয়াপন্থীরাও সমান ভাবে দারা ও ঔরঙ্গজেবের শিবিরে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে সমুদ্রগড়ের যুদ্ধ পর্যন্ত সময়ে ১০০০ জাট ও তার অধিক পদাধিকারী অভিজাতদের মধ্যে ২৭ জন ইরানীয় ঔরঙ্গজেবকে সমর্থন করেছিলেন এবং ২৩ জন দারার পক্ষ নিয়েছিলেন। অন্য সব যুদ্ধের মতো এই যুদ্ধেও অভিজাতরা নিজেদের স্বার্থ ও যুবরাজদের সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে সামনে রেখেই শিবির নির্বাচন করেছিলেন।

এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে অভিজাতদের মতো মুঘল রাজপরিবারের সদস্যরাও নিজ নিজ স্বার্থে বিবদমান যুবরাজের পক্ষ নিয়েছিলেন। অনেকে বিশ্বাস করেন যে রাজকন্যা জাহানারা দারার পক্ষ নিয়েছিলেন, রৌসনারারা ঔরঙ্গজেবের সমর্থক ছিলেন এবং গৌহারারা মুরাদের হয়ে অনুচরের কাজ করতেন। কিন্তু তৎকালীন কিছু চিঠিপত্র বিশেষ করে ঔরঙ্গজেবের লেখা কিছু পত্র থেকে এটা মনে হয় জাহানারা ধর্মীয় ভাবনাচিন্তা ও উদার মনোভাবের দিক থেকে ভাই দারার খুব কাছের লোক হলেও তিনি তার অন্য ভাইদের জন্য কখনো দরজা বন্ধ করে রাখেননি। শাহজাহানের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও তাকে ঔরঙ্গজেব সহ অন্যান্য যুবরাজরা সমর্থনের আর্জি করে পত্র লিখেছিলেন এবং তাদের সমর্থনে সম্রাটের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদের অনুরোধও করেছিলেন। জানা যায় যে বিভিন্ন সময়ে জাহানারা তাদের নানা ভাবে সাহায্যও করেছিলেন।

ঔরঙ্গজেবের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দারা পালিয়ে যাবার পর শাহজাহানও আগ্রা দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্গের জল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে ঔরঙ্গজেব শাহজাহানকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। শাহজাহানকে দুর্গের মহিলা কক্ষে নজরবন্দি করে রাখা হয়, কিন্তু তাই বলে তার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করা হয়নি। সেখানে তিনি টানা আট বছর ছিলেন এবং পিতার সঙ্গে স্বেচ্ছায় দুর্গে বসবাস করতে ইচ্ছুক প্রিয় কন্যা জাহানারার সেবা শুশ্রূষা লাভ করেছিলেন। শাহজাহাঁনের মৃত্যুর পর জাহানারা আবার জনসমক্ষে আসেন এবং তখন তাকে বিপুল সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করে অভ্যর্থনা জানান ঔরঙ্গজেব। তাঁকে দরবারের প্রধান রাজমাতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল এবং বাৎসরিক ভাতা বারো লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে সতেরো লক্ষ টাকা করা হয়েছিল।

ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে মুরাদের সমঝোতা অনুযায়ী সাম্রাজ্য উভয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল এবং পাঞ্জাব, কাবুল, কাশ্মীর ও সিন্ধ অঞ্চলের শাসনভার মুরাদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব। কিন্তু যুদ্ধে জয়লাভের পর ঔরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের ভাগ করার কোনোরকম উদ্যোগ নেননি। অতঃপর বিশ্বাসঘাতকতা করে ঔরঙ্গজেব মুরাদকে বন্দি করেন এবং গোয়ালিয়রের কারাগারে নিক্ষেপ করেন। দু’বছর পর তাকে হত্যা করা হয়।

সমুদ্রগড়ের যুদ্ধে পরাজয়ের পর দারা লাহোরে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং ওই অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ঔরঙ্গজেব শক্তিশালী এক বাহিনী নিয়ে লাহোরের পার্শ্ববর্তী প্রদেশে এসে হাজির হন। দারা আর বেশি সাহস দেখাতে পারেননি। বিনা যুদ্ধেই তিনি লাহোর ত্যাগ করেন ও সিন্ধু অঞ্চলে পালিয়ে যান। ফলে কার্যত দারার ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে গেল। যদিও এর পরেও গৃহযুদ্ধ দু’বছরের বেশি সময় ধরে চলেছিল, কিন্তু সেখানে কার দাপট বজায় ছিল তা অনুমানযোগ্য। মাড়ওয়ারের শাসক যশোবন্ত সিংহের আমন্ত্রণে সিন্ধ অঞ্চল থেকে গুজরাট হয়ে আজমেরে প্রবেশ করেছিলেন দারা আর এরপর যে বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা ঘটেছিল তা সবার জানা। আজমেরের কাছে দেওরাই-এর যুদ্ধ (মার্চ, ১৬৫৯) ছিল দারার ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে লড়া শেষ বড়ো যুদ্ধ। তিনি যদি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইরানে পালিয়ে যেতেন তাহলে হয়তো ভালো করতেন, কিন্তু তার ইচ্ছে ছিল আরও একবার আফগানিস্থানে থেকে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করবেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি যখন বোলান গিরিখাতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন এক বিশ্বাসঘাতক আফগান নেতা কৌশলে তাকে বন্দি করেন এবং চরম শত্রুর হাতে তুলে দেন। বিচারকদের এক মণ্ডলী নিদান দেন যে পবিত্র বিশ্বাস ও আইনের রক্ষার্থে এবং রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা (তথা) নাগরিক শান্তি ফেরাতে’ দারাকে আর বাঁচিয়ে রেখে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। এই ভাবে ঔরঙ্গজেব তার রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন। দারার প্রাণদণ্ডের দুই বছর পর তাঁর পুত্র সুলেমান শেখোহ যিনি গাড়োয়ালের শাসকের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে ছুটে গিয়েছিলেন তাকেও আক্রমণের অজুহাতে তুলে দেওয়া হয় ঔরঙ্গজেবের হাতে। অচিরে তারও পরিণতি তার পিতার মতোই হয়।

আগেই ঔরঙ্গজেব সুজাকে এলাহাবাদের খাজোয়া নামক একটি জায়গায় যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন (ডিসেম্বর, ১৬৫৮)। সুজা আর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে, কারণ মির জুমলা ক্রমাগত চাপ দিয়ে তাকে একেবারে ভারত ছাড়া করে ছেড়েছিলেন এবং তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন আরাকানে (এপ্রিল, ১৬৬০)। এর কিছুদিনের মধ্যে সেখানে বিদ্রোহে প্ররোচনা দেওয়ার অপরাধে সুজা ও তার পরিবারকে চরম অপমানজনক মৃত্যু উপহার দেয় আরাকানিরা।

মুঘল সাম্রাজ্যের সিংহাসন দখলকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে দেখা গেল যে শাসকের মনোনীত কাউকে বা সাম্রাজ্য ভাগবাটোয়ারা করার পরিকল্পনাকে গ্রহণ করতে রাজি নন সিংহাসনের দাবিদারেরা। সামরিক শক্তির দাপটই উত্তরাধিকার নির্বাচনের মূল ধারক-বাহকে পরিণত হয়েছিল এবং তাকে ঘিরে গৃহযুদ্ধ ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠেছিল। সিংহাসনে বসার রাস্তা পরিষ্কার করার পর ঔরঙ্গজেব উত্তরাধিকারের প্রশ্নে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করার মুঘল প্রথা বদলানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাই জাহানারা বেগম, দারার অপর এক পুত্র সিপিহর শিখাহ প্রমুখদের ১৬৭১ সালে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে ঔরঙ্গজেব তাঁদের মনসব প্রদান করেছিলেন এবং দারার পুত্রের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন। মুরাদের পুত্র ইজ্জত বকশকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এবং মনসব প্রদান করে ঔরঙ্গজেবের আর-এক কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়েছিল। আগে ১৬৬৯ সালে দারার কন্যা জানি বেগম, যাকে প্রায় নিজের মেয়ের মতো লালন-পালন করতেন জাহানারা বেগম, তাকেও ঔরঙ্গজেব তার তৃতীয় পুত্র মহম্মদ আজমের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন। এইভাবে ঔরঙ্গজেব তার পরাজিত ভাইদের আরও সন্তান ও পৌত্র-পৌত্রীদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। এবং তৃতীয় প্রজন্মে এসে ঔরঙ্গজেবের পরিবার ও তার ভাইদের পরিবার কার্যত একটা পরিবারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।

ঔরঙ্গজেবের শাসন–তার ধর্মীয় নীতিসমূহ

ঔরঙ্গজেব প্রায় পঞ্চাশ বছর শাসন চালিয়ে ছিলেন। এই দীর্ঘদীনের শাসনকালে মুঘল সাম্রাজ্যের আয়তন চরম সীমায় পৌঁছেছিল। উত্তর দিকে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে জিনজি পর্যন্ত আর পশ্চিম দিকে হিন্দুকুশ থেকে পূর্বে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। ঔরঙ্গজেব মনে হয় একজন কর্মঠ শাসক ছিলেন, তিনি তার প্রশাসনিক কাজকর্মে কোনো শিথিলতা বরদাস্ত করতেন না। তার চিঠিপত্র থেকে প্রমাণিত হয় যে তিনি কত নিখুঁত ভাবে রাষ্ট্রের সমস্ত বিষয়ে তত্ত্বাবধান করতেন। তিনি অত্যন্ত কড়া নির্দেশক ছিলেন, নিজের পুত্রদের পর্যন্ত রেয়াত করতেন না। ১৬৮৬ সালে তিনি গোলকুণ্ডার শাসকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অপরাধে শাহজাদা মুয়াজ্জমকে কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন এবং ১২ বছর ধরে তাকে জেলে আটকে রেখেছিলেন। তার অন্যান্য পুত্রেরাও নানা কারণে তার প্রচণ্ড রাগ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এই রকম রাগী ভাব ঔরঙ্গজেবের শেষ বয়সেও দেখা গিয়েছিল, কারণ কাবুলের প্রাদেশিক শাসক থাকাকালীন মুয়াজ্জম দক্ষিণ ভারত থেকে পিতার একের-পর-এক ধমক ভরা চিঠি পেতেন। ঔরঙ্গজেব তার পূর্বসূরিদের মতো সম্রাট বলে নিজের বৈভব। প্রকাশ করতেন না। তার ব্যক্তিগত জীবন খুবই সরল ভাবে কেটেছিল। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসাবে তিনি কোরানের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন, এমন কি ছিঁড়ে যাওয়া টুপি সেলাই করে পরতেন। কিন্তু তাঁর সমকালীন তথ্যপ্রমাণ থেকে তিনি এই রকম সোজা সরল ভাবে জীবনধারণের খরচ বহন করতেন কিনা খুব একটা জানা যায় না। তার একাধিক পত্নী ও উপপত্নী ছিল, ছিল দাসীও। হীরা বাই (যিনি পরে পরিচিত হয়েছিলেন জইনাবাদি মহল নামে)-এর সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের সাক্ষাৎ হয়। ও ১৬৫২ সালে তিনি ওনাকে বিবাহ করেন। তার প্রিয়তমা ছিলেন উদয়পুরি মহল, যিনি ছিলেন একজন জর্জিয়ান দাসী এবং পূর্বে তিনি দারার হারেমএ থাকতেন। এই সব মহিলাদের সঙ্গে ঔরঙ্গজেব খুব সুন্দরভাবে সম্পর্ক বজায় রাখতেন।

ঔরঙ্গজেব নিজে খুব জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। রাজ্যাভিষেকের পরে কোরান মুখস্থ বলে দেবার পাশাপাশি তাঁর হাদিস ও মুসলিম আইন-কানুনের ওপর প্রচুর পাণ্ডিত্য ছিল। গোঁড়া মুসলিম ইমাম গাঁজালির লেখালেখি খুব পছন্দ করতেন তিনি। এছাড়া উদারপন্থী সুফি সাধক হাফিজ ও মৌলানা রুমির লেখাও পড়তেন তিনি।

শাসক হিসাবে ঔরঙ্গজেবের কৃতিত্ব বিচারে ঐতিহাসিকরা রীতিমতো দ্বিধাবিভক্ত। কেউ কেউ মনে করেন তিনি আকবরের ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি ধরে রেখেছিলেন, তাই সাম্রাজ্যে হিন্দুদের আনুগত্য বজায় ছিল, কিন্তু বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মতে তার নীতির ফলেই সাম্রাজ্যের একের-পর-এক বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল যা সাম্রাজ্যের প্রাণশক্তি বিনষ্ট করে দিয়েছিল। তাঁর সন্দেহপ্রবণ চরিত্র, শরিয়াআদেশ কঠোরভাবে পালন করতে জোর করা ও কয়েকটি ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে অস্বীকার করা তার সমস্যা এত পরিমাণ বাড়িয়ে তুলেছিল যে কাফি খান বলেছিলেন তার সকল উদ্যোগ বেশ বড়ো বড়ো হলেও তা সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। কোনো কোনো আধুনিক ঐতিহাসিক মনে করেন যে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে অনৈতিক ভাবে কুৎসা করা হয়। আসলে তার আমলে হিন্দুরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিল কারণ তার পূর্বসূরিরা হিন্দুদের সঙ্গে বড় বেশি ঢিলেঢালা আচরণ করেছিল, ফলে তার কাছে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া ও সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্যে মুসলিম গোষ্ঠীকে হাতে রাখা ছাড়া আর কোনো রাস্তাই ছিল না। সাম্প্রতিক কালে ঐতিহাসিক মহলে ঔরঙ্গজেবের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নীতির বিচার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা হচ্ছে সেই সময়ের সামাজিক, আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ঘটনার ক্রমবিকাশের ওপর ভিত্তি করে। এ ব্যাপারে খুব বেশি সন্দেহ নেই যে তিনি গোঁড়া ছিলেন। তিনি ওইসব বিতর্ক বা রহস্যবাদে বিশ্বাস করতেন না–তবে তিনি অনেক সময় সুফি সাধকদের কাছে আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলেন এবং তাঁর সন্তানদের সুফিবাদে দীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে তিনি কখনো আপত্তি জানাননি। তাঁর এই ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে তার সামগ্রিক ধর্মীয় নীতি সম্পর্কে বাঁধাধরা ছকে কোনো সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না। শাসক হিসাবে ঔরঙ্গজেবকে অনেক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক সমস্যা সামলাতে হয়েছিল। ফলে তাঁকে যেমন এটা দেখতে হত যে তার সাম্রাজ্যের শরিয়া যাতে সবাই মেনে চলে, তেমনি এটা দেখতে হত যে রাষ্ট্রের অখণ্ডতার প্রশ্নে কোথাও কোনো শক্তিশালী হিন্দু অভিজাত, রাজা বা জমিদারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে কি না।

আলোচনার সুবিধার্থে আমরা ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতিকে দুটি পর্বে ভাগ করতে পারি–প্রথম পর্ব চলেছিল ১৬৭৯ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্ব চলেছিল ১৬৭৯ সাল থেকে ১৭০৭ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত। এই দুই পর্বকে আবার একাধিক উপপর্বেও ভাগ করে নিয়ে আলোচনা করব।

প্রথম পর্ব : ১৬৫৮-১৬৭৯

সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরেই ঔরঙ্গজেব একাধিক নৈতিক ও ধর্মীয় নিয়ম নীতি জারি করেছিলেন। তিনি সিজদা বা সম্রাটের সামনে এসে বিশেষ অভিবাদন জানানোর প্রথা রদ করে দিয়েছিলেন এই যুক্তি দেখিয়ে যে এই প্রথা সাধারণত আল্লার পরম উপাসক কেবলমাত্র আল্লার উদ্দেশ্যেই পালন করে। তিনি মুদ্রায় কালমা খোদাই করার নিয়মও তুলে দিয়েছিলেন, কারণ তার যুক্তি ছিল এই মুদ্রাগুলি মানুষ পায়ে মাড়ায়, হাতে হাতে আদানপ্রদানের ফলে কলুষিত হয়। তিনি জরোস্ট্রিয়ানদের উৎসব হিসাবে এবং সাফাডিদের প্রিয় বলে ‘নওরোজ’ উৎসব বাতিল করেন। প্রত্যেক প্রদেশে মুহতাসিব-দের নিয়োগ করা হয়েছিল। এই কর্মচারীরা ঘুরে ঘুরে দেখত যে সাধারণ মানুষ ঠিকঠাক ভাবে শরিয়া মেনে জীবনযাপন করছে কি না। অর্থাৎ কর্মচারীদের অন্যতম কাজ ছিল সুরা বা ভাঙ-এর মতো মাদক দ্রব্য সাধারণ মানুষের মধ্যে যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সে দিকে নজর রাখা। এই কর্মচারীরা ঘোড়াদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর করত, জুয়ার ঠেকের ওপর নজর রাখত এবং জিনিসপত্রের পরিমাপ ও ওজন পরীক্ষানিরীক্ষা করত। অন্য ভাবে বললে, এরা আসলে শরিয়া ও জাওয়াবিৎ (অন্যান্য নির্দেশ)-এ যেসব কাজ নিষিদ্ধ বলে উল্লেখ করা আছে সেগুলি যতটা সম্ভব মানুষের কাছে নিষিদ্ধই রাখা। যদিও ভারতে দীর্ঘদিন বসবাস করে যাওয়া ইতালীয় পর্যটক মানুচ্চি বলেছিলেন সে এই সকল নিয়ম কানুন সর্বসমক্ষেই লঙ্ঘিত হত। মুহতাসিব-দের নিয়োগ করে ঔরঙ্গজেব আসলে এটা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে রাষ্ট্রও নাগরিকদের কল্যাণ সাধনের ব্যাপারে চিন্তাশীল । তবে আধিকারিকদের স্পষ্টত এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে কোনোভাবেই যেন তারা নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ না করে।

ঔরঙ্গজেব তার শাসনের একাদশতম বর্ষে (১৬৬৯) এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ। করেছিলেন যেগুলোকে গোঁড়ামির নামান্তর বলা চলে, তবে সেগুলির কোথাও কোথাও। আর্থিক ও সামাজিক চরিত্রও ছিল বা বলা যায় সেগুলি ছিল অনেকটা কুসংস্কারমূলক বিশ্বাস সঞ্জাত। দরবারে তিনি গান-বাজনা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন, সরকারি সঙ্গীতজ্ঞদের ভাতা দান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে যন্ত্রসঙ্গীত ও নৌবৎ (রাজকীয় ব্যান্ড) প্রদর্শন অব্যাহত ছিল। হারেম-এর মহিলাদের মধ্যে ও অভিজাতদের নিজ নিজ বাসভবনে সঙ্গীত চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা চালু ছিল। উল্লেখ্য যে ঔরঙ্গজেবের সময়েই ধ্রুপদি ভারতীয় সঙ্গীতের ওপর ফারসি ভাষায় সবথেকে বেশিসংখ্যক লেখালেখি হয়েছিল এবং ঔরঙ্গজেব নিজে বীণা বাজানোয় পারদর্শী ছিলেন। সুতরাং ঔরঙ্গজেব সঙ্গীতজ্ঞদের বিরুদ্ধাচরণ করে সঙ্গীতের শব মাটির এত গভীরে কবর দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যাতে তার কোনো শব্দের প্রতিধ্বনি আর না শোনা যায় বলে যে অভিযোগ করা হয় তা একেবারেই ঔরঙ্গজেবের প্রতি ক্রোধবশত মন্তব্য বলে মনে হয়।

ঔরঙ্গজেব রোকা দর্শর্ন বা বারান্দায় এসে জনগণকে সাক্ষাৎ করার প্রথা তুলে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি মনে করতেন যে এটি একটি কুসংস্কার এবং ইসলাম-বিরুদ্ধ। একইভাবে তিনি সম্রাটকে তাঁর জন্মদিনে সোনা ও রুপো বা অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে ওজন করার প্রথাও রদ করে দিয়েছিলেন। আকবরের আমলে এই প্রথা কার্যত চালু করা হয়েছিল এবং তা ছোটো অভিজাতদের পক্ষে পালন করা খুব ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সমাজে এই প্রথার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ছিল, কারণ এতে সাধারণ মানুষের উপকার হত। তাই যখন তার রোগভোগের পর সুস্থ হয়ে ওঠার আনন্দে তাঁর সন্তানেরা এই প্রথা পালন করতে চেয়েছিলেন তিন মানা করতে পারেননি। তিনি জ্যোতিষীদের দিয়ে কুষ্ঠী তৈরি করার নিয়ম বন্ধ করার আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই আদেশ কেউ পালন করেনি, এমননি রাজপরিবারের লোকজনেরাও না।

এছাড়া এমন বহু আদেশনামা জারি করা হয়েছিল যেগুলো কিছু নৈতিক দিক থেকে ঠিক ছিল, কিছু কঠোর প্রকৃতির ছিল আর কিছু ইসলামীয় ভাবাবেগে আঘাত লাগার দোহাই দিয়ে বলবৎ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। যেমন নতুন কোনো রাজাকে সম্রাট কর্তৃক কপালে গেরুয়া টিকা লাগিয়ে অভিবাদন জানানোর রীতি রদ করে। দেওয়া হয়েছিল। হোলি বা মহরমের মিছিল করার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। দরবারের সভাসদদের রেশমের পোশাক বা রেশম সুতি মেশানো পোশাক পরতে মানা করা হয়েছিল। সিংহাসন ছিল যে কক্ষে সেই কক্ষকে খুব সাদামাটা করে সাজানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, দরবারি চাকচিক্য প্রদর্শনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল, করণিকদের রুপোর কলমের বদলে দোয়াত কালি দিয়ে কাঠের দণ্ডে আদেশনামা লিপিবদ্ধ করতে বলা হয়েছিল; দেওয়ানিআম-এর সোনার বারান্দা বদলে দিয়ে সোনার পাতে এক ধরনের পাথর (lapis lazuli) বসানো বারান্দায় পরিণত করা। হয়েছিল। এমনকি অর্থনৈতিক ব্যয়সংকোচের দোহাই দিয়ে ইতিহাস রচনার বিভাগটিও বন্ধ করে দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব।

কঠোর মানসিকতা নিয়ে যেভাবে ঔরঙ্গজেব এইসব নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছিলেন তাতে প্রাথমিক ভাবে মনে হতে পারে সিংহাসনে আরোহণের পর যে আর্থিক সংকটের মুখোমুখি তাঁকে হতে হয়েছিল তা মোকাবিলা করতেই এই সব উদ্যোগ। নেওয়া হয়েছিল। গৃহবিবাদের ধাক্কা কাটিয়ে উত্তরাধিকারের লড়াই যখন ঔরঙ্গজেব জিতে এলেন ১৬৬০ সালে, তখন একের-পর-এক প্রদেশে অনাবৃষ্টি ও শস্যহানির ঘটনা ঘটছিল। সিংহাসনে বসার ঔরঙ্গজেব রাহদারী বা পরিবহণ শুল্ক আদায় রদ করে দিয়েছিলেন এবং গ্রামীণ ও শহরের বহু অতিরিক্ত কর আদায় বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল। যদিও এর মধ্যে বহু কর আদায় আগেকার শাসকেরা রদ করেছিলেন, কিন্তু তাও সেগুলি স্থানীয় জায়গিরদাররা বেআইনি ভাবে আদায় করতেন, এমনকি খালিসা। বা সংরক্ষিত জমি থেকেও কর আদায় করতে ছাড়তেন না তারা। আমরা জানি না কতটা কঠোর ভাবে এই সব নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল ঔরঙ্গজেবের আমলে, কিন্তু এটা বলা হয় যে কেবলমাত্র খালিসা জমি থেকেই নাকি বছরে ২৫ লক্ষ টাকা কর আদায় করা হত। আর-একটি অতিরিক্ত কর ছিল পানদারী বা রাজধানী সহ গুরুত্বপূর্ণ নগরের বাজার এলাকায় দোকান করার জমি কর। এটিও তুলে দেওয়া হয়। আর-একটি বিরক্তিকর কর ছিল শহরে তামাক প্রবেশ করার জন্য শুল্ক যা ১৬৬৬ সালে রদ করা হয়েছিল।

ঔরঙ্গজেবের আধা-সরকারি ইতিহাস মাসির-ই-আলমগিরি অনুসারে তার শাসনের ত্রয়োদশতম বর্ষে পূর্বের বছরের তুলনায় রাষ্ট্রের খরচ আয়কে ছাপিয়ে গিয়েছিল। তাই ঔরঙ্গজেব বেশ কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, যেমন ‘সম্রাট, শাহজাদা ও বেগমদের খরচের খাতা থেকে অনেক জিনিসপত্র কেনা কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’

যেসব মুসলিম ব্যবসায়ীরা একেবারেই রাষ্ট্রের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল, মনে হয় তাদের বাণিজ্যকে উৎসাহ দেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন ঔরঙ্গজেব। ১৬৬৫ সালে মুসলিম বণিকদের আমদানিজাত দ্রব্যের ওপরে ধার্য শুল্কের পরিমাণ পাঁচ শতাংশ থেকে কমিয়ে আড়াই শতাংশ করা হয়েছিল, এমনকি দুইবছর পর এই শুল্ক একেবারেই তুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যখন তিনি দেখেন যে মুসলিম বণিকরা হিন্দু বণিকদের পণ্যও এই শুল্ক ছাড়ের সুবিধা নিয়ে আমদানি করছে, তখন তিনি পুনরায় এই শুল্ক বলবৎ করেছিলেন। কিন্তু তাও মুসলিম বণিকদের আমদানিজাত দ্রব্যের ওপর শুল্কের পরিমাণ আড়াই শতাংশের বেশি করা হয়নি।

এছাড়া ১৬৭১ সালে ঔরঙ্গজেব আদেশ দিয়েছিলেন যেসব খাস জমির কড়োড়ি হবেন মুসলিম এবং সকল প্রাদেশিক শাসক ও আধিকারিকদের অবিলম্বে নিজ নিজ কোষাধ্যক্ষ (দিওয়ান) ও করণিক (পেশকার) পদের জন্য অ-মুসলমানদের সরিয়ে মুসলমানদের নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু যথার্থ মুসলিম না থাকায় অভিজাতদের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়ে যায় এই আদেশকে ঘিরে। কাফি খানের মতে, এর ফলে পদক্ষেপটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেদিকে খুব বেশি নজর পড়েনি ঐতিহাসিকদের।

কিন্তু তাও এটা বলতেই হবে যে এই পদক্ষেপগুলি বিশেষ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে পরিষ্কার ভাবে ঔরঙ্গজেবের সংকীর্ণ। ও সীমাবদ্ধ মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

হিন্দু মন্দির

এবার আমরা ঔরঙ্গজেবের তথাকথিত বৈষম্যমূলক পদক্ষেপগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে পারি যেখানে অন্য ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের অসহিষ্ণু মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছিল। এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল হিন্দু মন্দির ও জিজিয়া কর বলবৎ সম্পর্কে ঔরঙ্গদেবের দৃষ্টিভঙ্গি।

শাসনের শুরুর দিকে ঔরঙ্গজেব হিন্দু মন্দির, ইহুদি, ধর্মস্থান, গির্জা প্রভৃতি জায়গায় শরিয়ার গরিমা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, তাই ‘দীর্ঘদিনের মন্দিরগুলিকে ধ্বংস না করা হলেও নতুন কোনো মন্দির নির্মাণের সম্মতি দেওয়া হয়নি। পরে যখন পুরোনো ধর্মীয় স্থানের নির্মাণগুলো ভেঙে পড়বে তখন সেগুলি মেরামতি করার উদ্যোগ নেওয়া। হবে, তার আগে নয়। হিন্দু মন্দির সম্পর্কে তার এই অবস্থান বারাণসী ও বৃন্দাবনের ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে তাঁর জারি করা একাধিক ফরমান’-এর মধ্যেও ফুটে উঠেছিল।

মন্দির সম্পর্কে ঔরঙ্গজেবের এই আদেশ জারি নতুন ঘটনা ছিল না। সেই সুলতানি যুগ থেকেই মন্দির নিয়ে এমনই মনোভাব ছিল মুসলিম শাসকদের মধ্যে, এমনকি শাহজাহানও তার শাসনকালের প্রথম দিকে এই নীতি মেনে চলেছিলেন। সে সময়। কার্যক্ষেত্রে স্থানীয় আধিকারিকদের কাছে এই দীর্ঘদিনের’ মন্দির বলতে ঠিক কী বোঝানো হয়েছিল তা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। এই ব্যাপারে শাসকের ব্যক্তিগত অভিমত যেটা ছিল তা আধিকারিকদের মনোভাবের থেকে আলাদা কিছু ছিল না। যেমন শাহজাহানের প্রিয় পুত্র হিসাবে উদারমনস্ক দারা যখন শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন, তখন নতুন নির্মিত মন্দির রেখে পুরোনো কিছু মন্দির ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। গুজরাটের শাসক হিসাবে ঔরঙ্গজেব গুজরাটের কিছু নতুন মন্দির ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তবে এই ভেঙে ফেলা মানে মূলত বিকৃত নকশাগুলোকে ভেঙে সেখানে ইট গেঁথে বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছিল। নিজ শাসনের প্রারম্ভিক পর্বে ঔরঙ্গজেব। দেখেন যে এই সব মন্দিরের নকশাগুলো নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে এবং সেখানে আবার মূর্তি পুজো শুরু হয়েছে। ফলে তিনি আবার ১৬৬৫ সালে আদেশ জারি করে মন্দিরগুলো সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দিতে বলেছিলেন। এর মধ্যে ছিল বিখ্যাত সোমনাথ মন্দির যা ঔরঙ্গজেব প্রথম দিকেই ভেঙে দেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ঔরঙ্গজেবের নতুন মন্দির নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করার মধ্য দিয়ে তার আমলে। প্রচুর পরিমাণে মন্দির ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল এমনটা কিন্তু বলা যাবে না। মারাঠা, জাট প্রভৃতি শক্তিগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করার জন্যে ঔরঙ্গজেব সম্ভবত একটি নতুন অবস্থান নিয়েছিলেন। স্থানীয় শক্তিগুলোকে শায়েস্তা করতে ও তাদের সাবধান করে দিতে তিনি বেছে বেছে পুরোনো জনপ্রিয় মন্দিরগুলি ভেঙে দেবার নীতি নিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন এই মন্দিরগুলো নাশকতামূলক ভাবনা তৈরির কেন্দ্র, আর এই ভাবনাচিন্তাগুলি ছিল গোঁড়া মুসলিম ভাবনা-বিরোধী। তাই ১৬৬৯ সালে যখন তিনি জানতে পারেন যে থাট্টা, মুলতান ও বিশেষ করে বারাণসীর কিছু মন্দিরে অনেক দূরদূরান্ত থেকে হিন্দু ও মুসলিম মানুষ ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য আসছে, তখন তিনি কড়া পদক্ষেপ নিতে দেরি করেননি। এই প্রদেশগুলির শাসকদের উদ্দেশ্যে আদেশনামা জারি করে ঔরঙ্গজেব স্পষ্ট করে। বলে দিয়েছিলেন যে সেখানে মন্দিরগুলিতে এই ধরনের কোনো প্রথা যেন না চলতে দেওয়া হয়। এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির ও মথুরায় জাহাঙ্গিরের আমলের বীর সিংহ দেও বুন্দেলা কর্তৃক নির্মিত কেশব রাইয়ের মন্দির সহ একাধিক মন্দির ধ্বংস করে দেওয়া হয় এবং তার স্থানে মসজিদ গড়ে তোলা হয়। এই সব। মন্দির ভেঙে ফেলার পশ্চাতে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির একটা ব্যাপার ছিল। মথুরার কেশব রাইয়ের মন্দির ভাঙার প্রসঙ্গে মাসিরআলমগিরি-এর লেখক মুস্তাইদ খান। বলেছিলেন যে ‘সম্রাটের ধর্মবিশ্বাসের ক্ষমতা ও আল্লার প্রতি ভক্তির মহিমা দেখে দাম্ভিক রাজারাও ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল এবং তারা বিস্ময়ে এমন ভাবে স্তম্ভিত হয়েছিল যেন দেওয়ালে আঁকা কোনো ছবি দেখছে।

এই একই কারণে বিগত দশ থেকে কুড়ি বছরে উড়িষ্যায় তৈরি হওয়া একাধিক মন্দির ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু এই বিপুল ধ্বংসাসাধনের পিছনে কোনো আদেশ ছিল বলে মনে করলে ভুল হবে। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ঔরঙ্গজেবের ইতিহাস। লিখতে গিয়ে তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মুস্তাইদ খান জানিয়েছিলেন যে এসবের পশ্চাতে ঔরঙ্গজেবের যে উদ্দেশ্যে ছিল তা হল ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠা’ আর তাই সম্রাট সকল প্রাদেশিক শাসককে সমস্ত মন্দির ধ্বংস করার ও এই অবিশ্বাসী অর্থাৎ হিন্দুদের ধর্মীয় আচার আচরণ নিষিদ্ধ করে দেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যদি মুস্তাইদ খানের বক্তব্য। সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে ঔরঙ্গজেব শরিয়া-র অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিলেন, কারণ শরিয়া কখনোই অ-মুসলিমদের নিজ নিজ বিশ্বাস ও আচার আচরণ পালন। করাকে নিষিদ্ধ করার কথা বলে না। তাছাড়া মুস্তাইদ খানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ রকম বিপুল পরিমাণে মন্দির ভেঙে দেবার কোনো নির্দেশ বা ফরমান জারি করা। হয়েছিল বলেও তথ্য পাওয়া যায়নি এখনো।

পারস্পরিক শত্রুতার এই পর্বে পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। ১৬৭৯-৮০ সালে যখন মাড়ওয়ারের রাঠৌর ও উদয়পুরের রানার মধ্যে যুদ্ধ চলছিল, তখন উদয়পুর, যোধপুর ও তার পরগনাগুলির দীর্ঘদিনের পুরোনো বহু মন্দির ভেঙে দেওয়া। হয়েছিল।

মন্দির নিয়ে যে নীতি ঔরঙ্গজেব নিয়েছিলেন তা মূলত ছিল শরিয়া কেন্দ্রিক এবং সেক্ষেত্রে যে অবস্থান তিনি নিয়েছিলেন তা তার পূর্বসূরিদের নেওয়া বৃহত্তম সহিষ্ণুতার। নীতিকে ভেঙে দিয়েছিল বলে মনে করলে বোধ হয় ভুল করা হবে। পণ্ডিতদের একাংশের মতে যে-কোনো অজুহাতে এভাবে মন্দির ভেঙে দেওয়ার নীতি কখনোই মেনে নেওয়া যায় না, সম্রাটও তা স্বাগত জানিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। আমরা ঔরঙ্গজেবের বহু হিন্দু মন্দির ও মঠ নির্মাণের জন্য জমি দানের নিদর্শন পাই। তিনি গুরু রামদাসকে দেরাদুনে গুরদোয়ারা নির্মাণের জন্য জমি দান করেছিলেন। অন্য মন্দিরের জন্যেও জমি দান করার কথা জানা যায়। গুজরাটে ১৬৭২ সালে জারি হওয়া এক নির্দেশে হিন্দুদের নিষ্কর জমি প্রদানকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হলেও জমি দান করার ঘটনা দেখা গিয়েছিল একাধিক জায়গায়, যেমন বৃন্দাবনের বৈষ্ণর মন্দিরে, পাঞ্জাবের লাখবারের যোগীদের, সরকারনগরের নাথপন্থী যোগীদের এবং রাজস্থানের পরগনা সীমানার পন্থ ভারতীয়দের জমি দেওয়া হয়েছিল। পন্থ ভারতীদের তত ১০০ পাক্কা বিঘা জমি দেওয়া হয়েছিল। অন্যদেরও জমি দান করা হয়েছিল। তবে অ-মুসলিমদের নিষ্কর জমি কতদিন দান করা হয়েছিল সে নিয়ে সন্দেহ আছে।

সামগ্রিক ভাবে হিন্দুদের প্রতি নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি গ্রহণ করে এবং পুরোনো বহু মন্দিরকে ভেঙে দিয়ে যে পরিবেশ ঔরঙ্গজেব সৃষ্টি করেছিলেন তাতে হিন্দুদের একটা বড়ো গোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল এবং সেখান থেকে পরবর্তীকালে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতি অসন্তোষ ও বিরোধিতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল।

জিজিয়া

দারার সঙ্গে সমুগড়ের যুদ্ধে নামার আগে পর্যন্ত ঔরঙ্গজেব কিন্তু ইসলাম রক্ষার স্লোগান তোলার প্রয়োজন অনুভব করেননি, তিনি অনায়াসে রাজপুত রাজাদের সঙ্গে মিত্ৰতা তৈরির চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তারপর একাধিক কারণে ঔরঙ্গজেবকে বাধ্য হতে হয়েছিল নিজেকে শরিয়ার রক্ষাকর্তা হিসাবে তুলে ধরে মুসলিম মৌলবাদীদের মন জয় করতে। প্রধান কারণ হিসাবে বলা যায় তার বিরুদ্ধে জনমানসে তৈরি হওয়া ক্ষোভকে বাগে আনা। যেভাবে তিনি সিংহাসনে বসার জন্যে তাঁর পিতা শাহজাহানকে কারারুদ্ধ করেছিলেন, যেভাবে সাধারণ গরিব অসহায় মানুষের প্রতি উদার মনোভাবাপন্ন তাঁর দুই ভাই মুরাদ ও দারার সঙ্গে তিনি নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলেন, তাতে জনমানসে তাঁর ভাবমূর্তি মোটেও ভালো তৈরি হয়নি। ১৬৫৯ সালে দ্বিতীয় রাজ্যাভিষেকের সময় পিতা জীবিত থাকায় প্রধান কাজি তাঁকে রাজমুকুট পরিয়ে দিতে অস্বীকার করেছিলেন দেখে ঔরঙ্গজেব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। যদিও আর-এক কাজি আবদুল ওয়াহাব গুজরাটি সেই যাত্রায় ঔরঙ্গজেবকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন এই যুক্তি দিয়ে যে যেহেতু শাহজাহানের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়, ফলে তার পক্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের সার্বভৌমিকতা রক্ষা করা অসম্ভব, তাই ঔরঙ্গজেবের মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দেওয়ায় কোনো অসুবিধা নেই। সম্রাট হয়ে ঔরঙ্গজেব এই আবদুল ওয়াহাবিকে পুরস্কৃত করে দরবারের প্রধান কাজি নিয়োগ করেছিলেন।

তিনি অ-ইসলামীয় রীতিনীতিগুলোকে সরিয়ে দিতে কীভাবে ইসলামীয় ধর্মতত্ত্ববিদদের পুরস্কৃত করতেন তা আমরা আগেই দেখেছি। তিনি অবহেলায় পড়ে থাকা মসজিদ, সমাধি সৌধগুলি সংস্কার করেছিলেন এবং ইমাম, মুয়াজ্জিন ও পরিষেবকদের বেতন দিয়ে নিয়োগ করেছিলেন। এই সব পদক্ষেপে ধর্মতত্ত্ববিদরাই যে সবথেকে বেশি। লাভবান হত তা বোঝা যায়।

এ সময় আর একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল যা উলেমাদের যথেষ্ট উৎফুল্ল করে তুলেছিল আর তা হল আকবরের নীতির সংশোধনস্বরূপ হিন্দুদের কাছ থেকে মথুরা, কুরুক্ষেত্র প্রভৃতি জায়গায় যাওয়ার ক্ষেত্রে তীর্থ কর আদায় করা। না কিন্তু ঔরঙ্গজেব সবথেকে বেশি সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলেন জিজিয়াকরের প্রশ্নে। গোঁড়া কর্মচারীরা ক্রমাগত এই করের পুনর্বহালের দাবি করছিলেন এই কারণ দেখিয়ে যে এই কর চাপানো নাকি শরিয়া অনুযায়ী ওয়াজিব (আবশ্যক) আর তারা মনে। করতেন যে হিন্দুদের ওপর জিজিয়াকর চাপানোর অর্থ হল অ-মুসলিমদের ইসলামীয় রাষ্ট্রের পদতলে রেখে ধর্মতত্ত্ববিদ তথা ইসলামের প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা করা। বলা হয় যে সিংহাসনে বসার অব্যবহিত পরেই নাকি ঔরঙ্গজেব জিজিয়া কর চাপানোর কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু কিছু রাজনৈতিক সংকটের কারণে তিনি ব্যাপারটা স্থগিত রেখেছিলেন। কিন্তু যেভাবে তিনি তার বাইশ বছর পর পুনরায় জিজিয়াকর পুনর্বহালের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন তাতে এটা পরিষ্কার যে সরকারি ব্যাখ্যা বা তাকে নির্ভর করে সমকালীন কয়েকজন ঐতিহাসিকের যুক্তি অনুসারে কেবল ইসলামীয় বিশ্বাস। ও শরিয়ার নিয়ম প্রচার’-এর জন্যেই এই উদ্যোগ কোনোমতেই নেওয়া হয়নি, বরং এর পশ্চাতে অবশ্যই কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক কারণ ছিল।

কয়েকজন ইংরেজ পর্যটক ও ইতালীয় মানুচ্চির মতে, ঔরঙ্গজেব এই কাজ করেছিলেন কারণ যুদ্ধে তাঁর যে খরচ হয়ে গিয়েছিল তা পূরণ করার একটা প্রয়োজন। ছিল, আর গরিব হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ইচ্ছেটাও সমান ভাবে ক্রিয়াশীল ছিল।

আধুনিক ঐতিহাসিকদের একাংশের মতে, তিনি একাধিক বেআইনি কর তুলে দিয়েছিলেন, ফলে সেই সূত্র ধরে তিনি শরিয়ৎ-এর অনুমোদিত জিজিয়াকর পুনর্বহাল করার মধ্যে কোনো অযৌক্তিক কিছু দেখেননি।

তবে আর যাই হোক, এইসব যুক্তি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের মধ্যে পড়ে না। সমকালীন কাফি খানের দেওয়া তথ্য অনুসারে সম্রাট নাকি এরকম অনেক করের ভাগ নিতেন, যার মধ্যে জমা দামি বা জায়গিরের নির্ধারিত রাজস্ব আয়ও ছিল। ফলে সম্রাটের আর্থিক স্বার্থ যে এইসব কর আদায়ের মধ্যে জড়িত থাকত তা বোঝা যায়।

দ্বিতীয়ত, জিজিয়া কর থেকে যে আয় হত তা একটি পৃথক কোষাগারে রাখা হত। যা থেকে অসহায় মুসলিমদের আর্থিক সাহায্য দেওয়া হত। ফলে এই করের অর্থ আসল রাজকোষের আর্থিক সংকট মেটাত না।

হতদরিদ্র হিন্দুদের ওপর এই জিজিয়া করের কী আর্থিক প্রভাব পড়েছিল তা বোঝার আগে আমাদের অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে হিন্দুরা কিন্তু নিজেদের বিশ্বাসের জোরে অনেক কষ্ট সহ্য করার ব্যাপারে বেশ সিদ্ধহস্ত ছিল, এবং তা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মতো সুফি সাধক বা বহু কবি ও চিন্তাবিদদের লেখা থেকে স্পষ্ট। যদিও জিজিয়া কর চাপানো ও আদায় করা হত সেই দিল্লি সুলতানি প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই, কিন্তু তখন তা এত বিশাল আকারে ধর্মান্তরিতকরণের কারণ হয়ে ওঠেনি। এমনকি স্বয়ং ঔরঙ্গজেবের আমলেও এত ধর্মান্তর ঘটেনি, যদিও তিনি একে তার সাফল্য ভেবেই আল্লাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন, কিন্তু আমরা জানি সিন্ধ, পশ্চিম পাঞ্জাব, কাশ্মীর ও পূর্ববঙ্গের মানুষ ঔরঙ্গজেবের অভিষেকের আগেই হারে জিজিয়া কর দেবার ভয়ে মুসলিম হয়ে গিয়েছিল।

নিখুঁত ভাবে দেখলে বোঝা যায় যে জিজিয়া কর খুব একটা লাভজনক ছিল না, কারণ তা যত না আর্থিক ভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ থেকে আদায় করা হত তার থেকে অনেক বেশি আদায় করা হত গরিব মানুষের কাছ থেকে। করদাতাদের সম্পত্তির হিসাবে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হত, যাদের ২০০ থেকে ১০,০০০ দিরহামসম্পত্তি ছিল তাদের আর একটি শ্রেণিতে এবং যাদের ১০,০০০ দিরহামএর বেশি ছিল তাদের তৃতীয় শ্রেণিতে রাখা হত। এবার এই তিন শ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক ৩/ ১/৩, //ও ১৩/১/৩ টাকার হিসাবে যথাক্রমে ১২, ২৪ বা ৪৮ দিরহাম অর্থ কর হিসাবে দিতে হত। প্রথম শ্রেণি অর্থাৎ দর্জি, ধোপা, মুচি, জুতো নির্মাতা প্রমুখদের ওপরেই এই করের সবথেকে বেশি চাপ পড়ত, কারণ সে সময় একজন সাধারণ কারিগর বা শ্রমিক মাসে ৩ টাকার বেশি মজুরি পেতেন না। উল্লেখ্য যে, মহিলা, উন্মাদ ও সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত আধিকারিকদের পাশাপাশি যাদের কোনো সম্পত্তি ছিল না বা যেসব শ্রমিকের আয় তার পরিবারের খরচ মেটানোর জন্যেও যথেষ্ট ছিল না, তাদের থেকেও জিজিয়া কর আদায় করা হত। অন্যভাবে বললে জিজিয়া করকে আয়কর বলা যাবে না, এটা ছিল একপ্রকার সম্পত্তি কর।

সিংহাসনে বসার দীর্ঘদিন পর কেন ঔরঙ্গজেব জিজিয়া কর পুনর্বহাল করতে চাইলেন? মনে হয় তিনি যখন ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলেন তখনই এই পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন। ১৬৭৬ সালেই শিবাজিকে নিজ দলে টানার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। তারপর মুঘল সম্রাট হয়ে ঔরঙ্গজেব দক্ষিণে দ্রুতগতিতে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করেছিলেন যেখানে তাকে সাহায্য করেছিলেন গোলকুণ্ডার প্রভাবশালী দুই ভাই মান্না ও আকান্না। বিজাপুরের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলতার সুযোগ নিয়ে ঔরঙ্গজেব সেই রাজ্য জয় করার ও মারাঠা সেনাদলকে নিজ বাহিনীতে টানার উদ্দেশ্যে একাধিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু এসব যখন ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন সংকীর্ণমনা ঔরঙ্গজেব মুসলিমদের পাশে পাবার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠেন।

শুধু এই কারণেই যে ঔরঙ্গজেব জিজিয়া কর পুনর্বহাল করেছিলেন তা নয়, বরং ধর্মীয় ব্যক্তিদের মন জয় করার মধ্য দিয়ে মুসলিম গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করার বাসনা কোথাও-না-কোথাও তার মনে নাড়া দিয়েছিল। জিজিয়া আদায়ের দায়িত্ব ছিল সৎ ও ধর্মভীরু মুসলিমদের ওপর যাদের কেবলমাত্র এই কাজেই লাগানো হয়েছিল। এর জন্যে নাকি বার্ষিক প্রায় চার কোটি টাকা খরচ হত যা সে সময় ছিল বিশাল অঙ্কের অর্থ এবং তা কেবল উলেমাদের জন্যেই বরাদ্দ রাখা থাকত। ফলে এটা কার্যত ধর্মীয় ব্যক্তিদের ঘুর পথে বিশাল পরিমাণে ঘুস দেওয়ার শামিল ছিল এবং অনেকে অন্য কোনো কাজ না করে কেবল এই অর্থ আত্মসাৎ করার জন্যে উদগ্রীব হয়ে বসে থাকত। কিন্তু এই পদক্ষেপের কিছু অসুবিধাও ছিল। একে হিন্দুরা বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ বলে তুলে ধরে প্রচণ্ড অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। এই কর আদায়ের পদ্ধতির মধ্যেও কিছু ব্যাপার ছিল যা উল্লেখ করা দরকার। করদাতাকে নিজে এসে এই কর প্রদান করতে হত এবং অনেক সময় তা ধর্মীয় ব্যক্তিদের হাতে দিয়ে গেলেও তা পকেটে পুরে নিতেন তাঁরা। গ্রামীণ এলাকায় জিজিয়া কর আদায়ের জন্যে আমিন-দের নিয়োগ করা হয়েছিল, তবে মনে হয় তাদের ভূমি রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কর আদায় করতে হত। শহর এলাকায় সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের জিজিয়া কর আদায়ের নাম করে আধিকারিকরা নানা ভাবে হেনস্থা করত। এমন অনেক ঘটনার কথা শোনা যায় যেখানে হিন্দু বণিকরা নিজেদের জুতো খুলে এই কর আদায়কারীদের জোরজুলুমের প্রতিবাদে হরতাল পর্যন্ত করেছিলেন। এর সঙ্গে ছিল একাধিক পর্যায়ে দুর্নীতি এবং শোনা যায় যে জিজিয়া কর আদায়কারী কর্মচারী নাকি লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিতেন। একাধিক এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে দুষ্কৃতীরা বিপুল অর্থ জোর। করে হাতাতে গিয়ে আমিন বা জিজিয়া কর আদায়কারী কর্মচারীকে খুন পর্যন্ত করে দিয়েছিল।

জিজিয়াকরকে আমরা রাষ্ট্রে ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসাবে দেখতে পারি। এর অর্থ এই নয় যে অ-মুসলিমদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছিল বা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়েছিল, জিজিয়া কর পুনর্বহালের মধ্য দিয়ে মুসলিমদের কোথাও-না-কোথাও একটা শ্রেষ্ঠ জায়গা করে দেবার প্রচেষ্টা ছিল।

ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতির মধ্যে একাধিক স্ববিরোধিতা ছিল যা তিনি হাজার চেষ্টা করেও শুধরে নিতে পারেননি। তিনি সর্বাত্মক ভাবে দরবারের গোঁড়া মুসলিম গোষ্ঠীদের খুশি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কিছুতেই শেখ আহমেদ শিরিনদির মতো মানুষদের ‘মৌলবাদী’ স্বার্থ চরিতার্থ করতে পারেননি। ঔরঙ্গজেব হিন্দু রাজা ও অন্যান্যদের দরবারের কাজ থেকে বরখাস্ত করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এমন আবেদনের বিপক্ষে তিনি যথার্থই বলেছিলেন যে ধর্মের সঙ্গে এই সব পার্থিব বিষয়ের কি সম্পর্ক? এবং ধর্মীয় বিষয়ের এরকম গোঁড়ামি করার কি অধিকার আছে? তোমার কাছে এটা তোমার ধর্ম, আমার কাছে এটা আমার ধর্ম। যদি (তোমাদের কথা মতো) এই নিয়ম চালু করা হয়, তাহলে আমায় তো সকল (হিন্দু) রাজা ও তাদের অনুগামীদের ধ্বংস করে ফেলতে হবে। বস্তুত এই সময় অর্থাৎ ঔরঙ্গজেবের শাসনের দ্বিতীয়ার্ধে সাম্রাজ্যের সমস্ত স্তরের কাজে হিন্দুদের অংশগ্রহণের আনুপাতিক হার অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল।

দ্বিতীয় পর্ব : ১৬৭৯-১৭০৭

ঔরঙ্গজেবের আধুনিক কালের জীবনীকার স্যার যদুনাথ সরকার মনে করেন যে, ‘বয়স বা জীবনের অভিজ্ঞতা কোনোটাই ঔরঙ্গজেবের গোঁড়ামি কমাতে পারেনি। যদিও সাম্প্রতিক কালের গবেষণায় এই মত কিছুটা হলেও সংশোধিত হয়েছে।

১৬৭৯ সাল থেকে ১৬৮৭ সাল পর্যন্ত ঔরঙ্গজেব নিজেকে মুসলিমদের আশ্রয়দাতা’ হিসাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন যিনি ‘সত্যিকারের ধর্মবিশ্বাসীদেরই (মুসলমান) একমাত্র সম্মান করতেন। এই সময়ে দক্ষিণী শাসকরা মারাঠা যোদ্ধাদের সঙ্গে জোট বাঁধার ফলে তাদের নাকি ইসলাম ও তার ভক্তদের ওপর আর কোনো শ্রদ্ধা ছিল না এবং মসজিদগুলো জৌলুস হারালেও মন্দিরগুলো ঝলমল করছিল, তাই তাদের ‘কামুক ও পাপী’ বলে তিরস্কার করা হয়েছিল। (মাসিরআলমগিরি) । যদিও এই সময় মানুষদের ধরে ধরে ধর্মান্তরিত করার প্রক্রিয়া, জোরকদমে চলেছিল, কিন্তু ব্যক্তিগত মহলে ঔরঙ্গজেব অনুযোগ করে বলেছিলেন যে যাদের নতুন ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে তারা বড় বেশি দাম্ভিক ও অভদ্র।

উল্লেখ্য যে এই সময় ঔরঙ্গজেব না দক্ষিণী শাসকদের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক ভেঙে ফেলতে পেরেছিলেন, না দরবারের মুসলিম গোষ্ঠীকে খুশি করতে পেরেছিলেন। তাই উচ্চ পদাধিকারী মুসলিম নেতা তথা রাজকীয় বাহিনীর অত্যন্ত সম্মানীয় সদর কাজি শইকুল ইসলাম ১৬৮৮ সালে এক দক্ষিণী শাসককে এক মুসলিম রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ‘আইনি বৈধতাস্বরূপ তোয়া প্রদান করতে অস্বীকার করেছিলেন। পরিবর্তে তিনি পদত্যাগ করে মক্কা ভ্রমণে চলে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন। ঔরঙ্গজেবেরও নতুন কাজি নিয়োগ করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিল না।

বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা জয়ের পর ঔরঙ্গজেবকে তেলেঙ্গানা ও কর্ণাটকের শক্তিশালী রাজা, নায়ক ও দেশমুখদের মন জয় করার কাজে নামতে হয়েছিল। ফলে তাঁকে অবধারিত ভাবে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যে পুরোনো মন্দির ভেঙে ফেলার নীতি সংশোধন করতে হয়েছিল। তাই সমকালীন এক পর্যবেক্ষক ভীমসেন লিখেছিলেন, ‘বিজাপুর ও হায়দ্রাবাদি কর্ণাটকের মন্দিরগুলি সংখ্যায় ছিল অগুন্তি আর সেগুলো প্রত্যেকটা যেন পারো ও শোলাপুরের এক-একটা দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। সে সময়ের বহু বিখ্যাত মন্দিরের নাম ও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন ভীমসেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে, পার্শ্ববর্তী আদোনি ও কাঞ্চি থেকে শুরু করে জিঞ্জি রাজ্য ও সমুদ্র পর্যন্ত এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে ছোটো হোক বা বড়ো একটাও মন্দির গড়ে ওঠেনি। যদিও পরবর্তীকালের বিরোধিতার সম্ভাবনা ভেস্তে দিতে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য ঔরঙ্গজেব কয়েকটি মন্দির ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

সিংহাসনে আরোহণের পর থেকে ঔরঙ্গজেব নিয়মিত ভাবে শেখ ও গরিবদের জন্য দান হিসাবে মক্কায় অর্থ প্রেরণ করতেন। তবে ক্রমে ধর্মীয় ব্যক্তিদের এই অর্থ প্রেরণের কাজে স্বার্থপরতা ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখে হতাশ ঔরঙ্গজেব মক্কার শরিফকে চিঠি লিখে সাবধান করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে তিনি মক্কায় অর্থ প্রেরণ করছেন সেখানকার দুঃস্থ মানুষের জন্য। তিনি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন যে, যেখানে সব দেশে আল্লার আশীর্বাদ ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে কেন সেই দেশের গরিব মানুষদের মধ্যে এটা (অর্থাৎ অর্থ) বিতরণ করা হচ্ছে না?

এই রকম গোঁড়ামি-বিরোধী মনোভাব ঔরঙ্গজেবের জিজিয়া কর আদায়ের ক্ষেত্রে ধরা পড়েনি। যদিও অনেক সময় শস্যহানির মতো ঘটনা ঘটলে জায়গিরদারদের অনুরোধে জিজিয়া কর আদায়ে কিছু ছাড় দেওয়া হত। অবশেষে ১৭০৪ সালে ‘দক্ষিণে যুদ্ধ চলার কারণে’ ঔরঙ্গজেব জিজিয়া কর রদ করে দিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে মারাঠারা পরাজিত হয়ে যাবার পরে দক্ষিণেও সম্ভবত এই কর তুলে দেওয়া হয়েছিল। আনুষ্ঠানিক ভাবে ঔরঙ্গজেবের দুই প্রথম সারির অভিজাত আসাদ খান ও জুলফিকর খানের অনুরোধে জিজিয়া কর প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ১৭১২ সালে।

কয়েকজন আধুনিক ঐতিহাসিক মনে করেন যে এই সব পদক্ষেপের মাধ্যমে ঔরঙ্গজেব ভারতকে দার-উহারব বা অবিশ্বাসীদের জন্মভূমি থেকে দারউলইসলাম বা মুসলমানদের জন্মভূমিতে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। এই অভিমত সঠিক নয়। শরিয়া অনুসারে যে রাষ্ট্রে ইসলামের আইন প্রচলিত থাকে ও শাসক মুসলিম হন, সে দেশকেই দারউলইসলাম বলা হয়। এই ধরনের রাষ্ট্রে যেসব হিন্দু মুসলিম শাসকের আনুগত্য মেনে চলতে ও জিজিয়া কর দিতে সম্মত হত তারা শরিয়ার নিয়ম অনুসারে জিম্মি বা সংরক্ষিত ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত হত। ভারতে যখন তুর্কি আগমন ঘটেছিল তারপর থেকে এই দেশকে দার-ইসলাম রাষ্ট্র বলা হত। এমনকি ১৭৭২ সালে যখন মারাঠা সেনাপতি মহাদজি সিন্ধিয়া দিল্লি দখল করে নিয়ে মুঘল শাসককে কার্যত হাতের পুতুলে পরিণত করেছিলেন, তখনও ইসলামের আইন বজায় ছিল এবং সিংহাসনে মুসলিম শাসক অধিষ্ঠান করছিলেন। যদিও ঔরঙ্গজেব ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠাকে নানা ভাবে উৎসাহ দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু জোর করে ধর্মান্তরিতকরণের নিয়মমাফিক ও পরিকল্পিত উদ্যোগের যথেষ্ট অভাব ছিল বলা যায়।

হিন্দু অভিজাতদের সঙ্গে সেই ভাবে বৈষম্যমূলক আচরণের ঘটনাও খুব একটা দেখা যায় না। আতাহার আলির গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ঔরঙ্গজেবের শাসনের শেষার্ধে মুঘল অভিজাততন্ত্রে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল এবং মারাঠাদের নিয়ে হিন্দুদের অংশগ্রহণ ছিল মোট অভিজাততন্ত্রের প্রায় এক তৃতীয়াংশ।

এই সময় হিন্দুদের পরিস্থিতি পরিষ্কার হয়ে যাবে নিম্নলিখিত সারণির মাধ্যমে।

ঔরঙ্গজেব তার শাসনকালের শেষার্ধে প্রচুর সংখ্যায় মারাঠাদের কাজে নিয়েছিলেন। ১৬৭৯ সাল থেকে ১৭০৭ সালের মধ্যে মোট ৯৬ জন মারাঠা ১০০০ জাট পদের মনসব পেতেন যাদের মধ্যে ১৬ জন পেতেন ৫০০০ বা তারও বেশি সাওয়ার, ১৮ জন পেতেন ৩০০০ থেকে ৪০০০ সাওয়ার এবং ৬২ জন পেতেন ১০০০ থেকে ২৭০০ সাওয়ার পদ। রাজপুতদেরও এত পদ দেওয়া হয়নি। তবে মারাঠাদের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদ বা নেতৃত্ব দেওয়া হত না বা তাদের সাম্রাজ্যের কাজকর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেও দেখা হত না। তাদের সঙ্গে রাজপুতদের মতো কোনো ব্যক্তিগত বা সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার কোনো চেষ্টাও করা হয়নি। মারাঠা মনসবদাররা সাধারণত ত্রৈমাসিক জায়গির লাভ করতেন এবং তাদেরকে জায়গির প্রদানের ক্ষেত্রে সেই শাহজাহানের সময় থেকেই মুঘলরা যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করত এবং যে পরিমাণ জায়গির দেওয়া হত তার এক চতুর্থাংশ পরে নিয়ে নেওয়া হত।’

সাম্রাজ্যের বিস্তার ও এলাকা দখল–উত্তর ভারত

ঔরঙ্গজেবদের উত্তরাধিকারিত্বের যুদ্ধের সময় বহু স্থানীয় রাজা ও জমিদার রাজস্ব প্রদান বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং অনেকে মুঘল এলাকা ও রাজপথ সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে লুঠতরাজ শুরু করেছিলেন। সিংহাসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ঔরঙ্গজেব একজন কড়া শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রথমেই তিনি কয়েকটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যেমন দাক্ষিণাত্য ও উত্তর-পূর্ব ভারতে মুঘল সীমানা বৃদ্ধির চেষ্টা সিংহাসনে বসার পরে এই ধরনের পদক্ষেপ ছিল আসলে সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও শৌর্য প্রদর্শনের অভিপ্রায়। এই পদক্ষেপের আওতায় ছিল এমন কিছু এলাকা জয় করা যেগুলি উত্তরাধিকারিত্বের যুদ্ধে মুঘলদের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল এবং যেগুলি তাদের দখল করার অধিকার আছে বলে মনে করত। প্রথমেই ঔরঙ্গজেব যুদ্ধের মাধ্যমে এলাকা জয় বা অন্তর্ভুক্তির রাস্তায় না হেঁটে সাম্রাজ্যের এলাকাভিত্তিক সুদৃঢ়করণের দিকে নজর দিয়েছিলেন। তাই তিনি বিকানেরে সেনা পাঠিয়ে মুঘল সম্রাটকে মান্য করার বার্তা দিয়েছিলেন, কিন্তু একবারও এলাকা দখল করার চেষ্টা করেননি। কিন্তু অন্যদিকে বিহারের পালামৌতে শাসক মুঘল সম্রাটকে মেনে নিতে অস্বীকার করলে তাকে ভৎর্সনা করা হয়েছিল এবং তার অধিকৃত অনেকটা অঞ্চল দখল করে নেওয়া হয়েছিল। বুন্দেলা বিদ্রোহী নেতা চম্পত রাই এক সময় ঔরঙ্গজেবের মিত্র ছিলেন, কিন্তু যখন তিনি লুণ্ঠনের জীবন বেছে নিয়েছিলেন তখন তাকে শায়েস্তা করতে আটক করা হলেও বুন্দেলা নেতার অধিকৃত অঞ্চল দখল করা হয়নি।

উত্তর-পূর্ব ও পূর্ব ভারত

সুলতানি আমল থেকে একদিকে আসাম উপত্যকায় অহম শক্তির উত্থান ও তাদের সঙ্গে কামাতা (কামরূপ) শাসকদের দ্বন্দ্ব এবং অন্যদিকে বাংলায় আফগান শাসকদের দাপট ছিল উত্তর-পূর্ব ও পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে কামাত বংশের পতন ঘটে এবং সেখানে উত্থান ঘটে কুচ (কোচবিহার) রাজবংশের, যারা সমগ্র উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিম আসামে নিয়ন্ত্রণ করত। এরাও অহমদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল। সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে কুচ বংশের ভাগাভাগি হয়ে যায় এবং কুচ শাসকদের একাংশের আমন্ত্রণেই আসাম অঞ্চলে প্রথম মুঘলদের আগমন ঘটে। কুচ বংশের বিরোধী গোষ্ঠীকে পরাজিত করে ১৬১২ সালে মুঘলরা কুচ বাহিনীর সহায়তায় বার নদী বা কুচ হাজো পর্যন্ত সমগ্র পশ্চিম আসাম অঞ্চল দখল করে নেয়। কুচ শাসকরা মুঘল অনুগততে পরিণত হন। এরপর বার নদী বরাবর সমগ্র পূর্ব আসামে শাসন করা অহমদের সঙ্গে মুঘলদের সরাসরি যুদ্ধ বাঁধে। দীর্ঘ যুদ্ধ চলার পর ১৬৩৮ সালে মুঘলদের সঙ্গে অহমদের সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ঠিক হয় যে বার নদী উভয়ের মধ্যে সীমানা হিসাবে কাজ করবে। এই ভাবে গুয়াহাটি মুঘলদের দখলে চলে এসেছিল।

ঔরঙ্গজেবের আমলে অহমদের সঙ্গে মুঘলদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চলেছিল। অহম শাসকরা গুয়াহাটি ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল থেকে মুঘলদের উৎখাত করে সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে নতুন করে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়। এই সময় ঔরঙ্গজেব মির জুমলাকে বাংলার শাসক নিয়োগ করেছিলেন এবং কোচবিহার সহ সমগ্র আসাম অঞ্চল মুঘল নিয়ন্ত্রণে আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রথমে মির জুমলা মুঘলদের অনুগত কোচবিহারের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান এবং সমগ্র অঞ্চলটিকে মুঘল সাম্রজ্যের আওতায় নিয়ে আসেন। এরপর তিনি অহম রাজত্বে আক্রমণ করেন। তিনি অহম রাজধানী গড়গাঁও দখল করেন এবং প্রবল বৃষ্টি ও অহমদদের মরিয়া অবরোধ সত্ত্বেও টানা ছয় মাস ধরে সেখানকার দুর্গে মুঘল নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখেন। বৃষ্টি থামলে মির জুমলা বাদবাকি অহম রাজত্ব দখলের উদ্যোগ নিলে প্রবল যুদ্ধ বাঁধে। অবশেষে তিনি অহমদের নতিস্বীকার করে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করান (১৬৬৩)। চুক্তি মতো অহম রাজা তার কন্যাকে মুঘল হারেমে পাঠাতে, যুদ্ধজাত প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে এবং বাৎসরিক নজরানা হিসাবে ২০টি হাতি মুঘলদের বাহিনীর হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। এইভাবে মুঘল সাম্রাজ্য বার নদী থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার একেবারে উত্তরে ভারালি নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং গুয়াহাটি মুঘল অধিকারভুক্ত হয়।

এই দুর্ধর্ষ যুদ্ধ জয়ের পরেই মির জুমলা মারা যান। তবে আসামের মতো এলাকায়। অগ্রসর হয়ে খুব বেশি সুবিধা হয়নি মুঘলদের। কারণ অঞ্চলটি সেভাবে উর্বর ছিল, তাছাড়া অঞ্চলটি পাহাড়ে বসবাসকারী নাগাদের মতো একাধিক যুদ্ধবাজ উপজাতিতে ঘেরা ছিল। কিছুদিন পরে দেখা যায় অহমদের শক্তিও তখনও শেষ হৃয়ে যায়নি, ফলে তাদের সঙ্গে পরবর্তী চুক্তি কার্যকর করা মুঘলদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৬৬৭ সালে অহমরা পুনরায় আক্রমণ করে এবং ১৬৬৩ সালে হাতছাড়া হওয়া এলাকা ছাড়া গুয়াহাটি অঞ্চলও তারা মুঘলদের থেকে কেড়ে নিতে সক্ষম হয়। ইতিমধ্যে কোচবিহার থেকেও মুঘল বাহিনীকে উৎখাত করা হয়েছিল। ফলে মির জুমলার হাত ধরে মুঘলরা। যা কিছু অর্জন করেছিল সব যেন এক লহমায় হারিয়ে ফেলেছিল তারা। এরপর মুঘলদের সঙ্গে অহমদের প্রায় এক দশক ধরে যুদ্ধ চলেছিল এবং এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে মুঘল বাহিনীর নেতৃত্ব ছিল মির্জা রাজা জয় সিংহের পরে অম্বরের গদ্দি-তে বসা রাজা রাম সিংহের হাতে। অহম শাসকদের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্যে প্রয়োজনীয় রসদ রাম সিংহের কাছে ছিল না। তাছাড়া অহমরা যুদ্ধক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষ, ক্ষিপ্র ও সংগঠিত ছিল এবং শত্রুর ওপর দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়তে এদের জুড়ি মেলা ভার। তাদের বাহিনীতে বেশিরভাগ ছিল পদাতিক সৈন্য যাদের শক্তি ছিল অসংখ্য হাতির পাল। মূলত জলা জঙ্গল এলাকা, ঝোঁপঝাড়, সংকীর্ণ নদীনালা ও জলকাদা ভরা পরিবেশ থাকায় তারা অশ্বারোহী বাহিনীর খুব বেশি ব্যবহার করত না। অহমদের কাছে বন্দুকধারী একটি শক্তিশালী নৌবাহিনীও ছিল। তাদের কাছে লোহার বল্লম ছাড়াও আংটা দেওয়া বন্দুক ও গাদা বন্দুকও ছিল। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে এমন সব কাঠের পরিখা তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত ছিল যার আড়ালে লুকিয়ে থেকে তাদের পদাতিক বাহিনী খুব সহজে বিপক্ষের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারত। মির জুমলা যখন এই অঞ্চলে অভিযান চালিয়েছিলেন। তখন তার কাছে ছিল ১২,০০০ অশ্বারোহী ও ৩০,০০০ পদাতিক বাহিনী এবং একটি শক্তিশালী নৌবহর। কিন্তু রাজা রাম সিংহের কাছে ছিল মাত্র ৮০০০ সেনা, যার মধ্যে ৪০০০ জন ছিল মূল সেনা, ৫০০ জন আহাদি যারা গাদা বন্দুক বহন করত, ৫০০ গোলন্দাজ ও অন্যান্যরা। সঙ্গে কোচবিহার থেকে ১৫,০০০ জন তিরন্দাজকেও নেওয়া হয়েছিল। এই বাহিনীকে টক্কর দিতে অহমদের শিবিরে ছিল ১০০,০০০ প্রাণবন্ত ও তুখোড় সৈন্যদল যারা যুদ্ধের জন্য প্রাণ দিতে দু’বার ভাবত না। রাম সিংহের যথেষ্ট নৌবহরও ছিল না। মুঘল গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে পেরে না উঠে অহমরা সরাসরি লড়াই এড়িয়ে পিছু হটে গিয়েছিল এবং তারপর গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ চালিয়েছিল।

এই রকম পরিস্থিতিতে আসাম উপত্যকায় থাকা মুঘলদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তাদের একটাই আশা ছিল অহম শিবিরে ভাঙন লাগলে তা কাজে লাগানো, কিন্তু ১৬৭০ থেকে ১৬৮১ সালের মধ্যে অহম রাজত্বে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা চরমে উঠেছিল–এই ‘এগারো বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে সাত রাজার মধ্যে একজনেরও স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু হয়নি’, তাও মুঘলরা তার সুযোগ নিতে পারেনি। গোয়ালিয়র একাধিকবার হাতে এসেছে আবার হাতছাড়া হয়েছে। ১৬৭৪ সালে রাম সিংহ ফিরে আসেন। অবশেষে ১৬৮১ সালে অহমরা এক শাসকের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুঘলদের কুচ হাজো থেকে হটিয়ে দেয় এবং মানস নদীকে উভয় শক্তির সীমানা হিসাবে মুঘলদের মেনে নিতে বাধ্য করে। এই সময় ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ নিয়ে পূর্ণমাত্রায় ব্যস্ত ছিলেন এবং এই রকম একটি অনুর্বর, পাহাড়ি ও দুর্গম সীমান্তবর্তী অঞ্চল, যেখান থেকে আর্থিক লাভ পাওয়ার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না তা দখল করার। কোনো চেষ্টা তার মধ্যে দেখা যায়নি।

মুঘলদের বরং অনেক বেশি স্বার্থ জড়িয়ে ছিল পূর্ব বাংলায় এবং সাফল্যও এসেছিল এখানে বেশি। ১৬৬৩ সালে মির জুমলার মৃত্যুর পর শিবাজির সঙ্গে যুদ্ধে ধাক্কা খাওয়া শাইস্তা খানকে বাংলার প্রাদেশিক শাসকের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। তিনি যথেষ্ট ভালো প্রশাসক ও সেনাপ্রধান ছিলেন। তিনি মির জুমলার অগ্রসর নীতির সংশোধন করেছিলেন। প্রথমে তিনি কোচবিহারের রাজার সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন। কোচবিহারের রাজা মুঘল আধিপত্য স্বীকার করে নিয়ে বাৎসরিক সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা নজরানা প্রেরণে সম্মত হয়েছিলেন। এরপর তিনি দক্ষিণবঙ্গের সমস্যার দিকে নজর দেন যেখানে মগ (আরাকানী) জলদস্যুরা চট্টগ্রামে তাদের ঘাঁটি থেকে ঢাকা পর্যন্ত সমগ্র এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছিল। চট্টগ্রাম ছিল বাংলায় মুসলিম শাসক ও আরাকানী শাসকদের স্বার্থের দ্বন্দ্বের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। বাংলার শাসক দুর্বল হয়ে গেলে চট্টগ্রাম ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা আরাকানীদের দখলে চলে গিয়েছিল। পর্তুগিজ বা ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের সাহায্য নিয়ে তারা দাস ব্যবসা থেকে শুরু করে অত্যাচার, লুঠপাট চালানো, কোনো কিছুই বাদ রাখেনি, যার ফলে বাংলার শিল্প ব্যবসা বাণিজ্য যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। শাইস্তা খান আরাকানীদের মোকাবিলা করার জন্য একটি নৌবহর গড়ে তুলেছিলেন এবং চট্টগ্রামে তাদের বাহিনীর সঙ্গে টক্কর দেবার জন্য সোনদ্বীপ নামে একটি দ্বীপ দখল করে নিয়েছিলেন। তারপর অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তিনি ফিরিঙ্গিদেরও নিজের পক্ষে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুঘলদের আক্রমণে চট্টগ্রামে অবস্থিত আরাকানী নৌবহর বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের অনেক যুদ্ধজাহাজ মুঘলদের হাতে এসেছিল। ১৬৬৬ সালের মধ্যে স্থল ও জলপথে আক্রমণ চালিয়ে মুঘল বাহিনী চট্টগ্রামের দখল নিয়েছিল। আরাকানী নৌশক্তি ভেঙে যাবার পর সমুদ্র বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। এরপর বাংলার বৈদেশিক বাণিজ্যে দ্রুত বৃদ্ধি ও পূর্ব বাংলার কৃষির উল্লেখযোগ্য বিকাশের যে ঘটনা ঘটেছিল তার পশ্চাতে মুঘলদের এই আরাকানী দৌরাত্ম নাশের প্রভাব নেহাত কম ছিল বলে। মনে হয় না।

তাছাড়া এ সময় উড়িষ্যায় পাঠানদের বিদ্রোহ প্রশমন করে বালাসোর বন্দর বাণিজ্যের জন্য নতুন করে খুলে দেওয়া হয়েছিল।

গণবিদ্রোহ : জাট, সতনামি, আফগান ও শিখ

মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীভূত শাসন প্রক্রিয়ায় কৃষক অসন্তোষ, তা সে কখনো জাত বা উপজাতীয় নেতাদের অধীনে হোক বা গ্রাম সম্প্রদায়ের মতো কোনো প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে হোক, সব সময় লেগেই থাকত এবং অনেক সময়ে সেই অসন্তোষ ও বিক্ষোভ অত্যন্ত নির্মম ভাবে দমন করা হত। এর পাশাপাশি এই জাতি/ উপজাতির নেতাদের বা গ্রামের প্রভাবশালী অংশকে নানা রকম উপহার, ছাড় ইত্যাদি দিয়ে মুঘলরা প্রশাসনিক বা ভূমি রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায়ের কাজে লাগাত। সুতরাং অত্যাচার, দমন ও সঙ্গে সমন্বয়সাধনের যথাযথ প্রচেষ্টা সব সময় চলত। তবে ঔরঙ্গজেবের আমলে নতুন যে বৈশিষ্ট্য আমাদের চোখে পড়ে তা হল কৃষক অসন্তোষ ও বিক্ষোভের বৃহত্তর আস্ফালন এবং স্থানীয় ভূম্যধিকারী শ্রেণি বা চোখ ধাঁধানো নেতৃত্বের দ্বারা অনেক বড়ো ও বেশি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার প্রবণতা।

এই সব আন্দোলনকে এক জায়গায় করে অনেকে একে ঔরঙ্গজেবের সংকীর্ণ ও গোঁড়া নীতির বিরুদ্ধে হিন্দু প্রতিক্রিয়া বা ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চাপের বহিঃপ্রকাশ। বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। একথা ঠিক যে এই সব গণ অসন্তোষ জাগরণের পশ্চাতে অনেক ক্ষেত্রেই ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি বা আর্থিক সংকট দায়ী ছিল। কিন্তু কখনোই তা দিয়ে প্রত্যেক আন্দোলনের চরিত্র বোঝার চেষ্টা করা ঠিক হবে না। এ কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে মধ্যযুগের প্রায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আন্দোলনের পিছনে কোথাও-না-কোথাও ধর্ম বা আন্দোলন সংগঠিত করার জন্যে ধর্মীয় স্লোগান ব্যবহারের একটা ভূমিকা ছিল। তবে জাট বা শিখ আন্দোলন কিন্তু তাদের নিজস্ব পৃথক প্রদেশের দাবিতে সংগঠিত হয়েছিল এবং সেখানে শিখদের। থেকে জাটরাই আগে সাফল্য লাভ করেছিল। আফগানরাও তাদের নিজস্ব উপজাতি অধ্যুষিত রাজ্যের দাবি তুলেছিল, কিন্তু তাদের আন্দোলন দমন করে রাখা হয়েছিল। যতদিন না পর্যন্ত অন্য পরিস্থিতিতে একটি আফগান রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল।

ফলে এই সব গণবিক্ষোভের নিজস্ব সব আঞ্চলিক চরিত্র ছিল, যেমনটা ছিল মারাঠাদের ক্ষেত্রে যা আমরা পৃথকভাবে আলোচনা করেছি।

জাট ও সতনামি

যমুনা নদীর দুই তীরে বসবাসকারী জাট সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সৌভ্রাতৃত্ব ও একতার বেশ জোরালো চেতনা ছিল যা তাদের ছাপ গড়ে ওঠার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল। ছাপছিল অনেকটা আদিবাসীদের জিরগার মতো, তবে এটা ছিল অনেক বেশি স্তর ভিত্তিক। জাটরা মূলত ছিল কৃষক, তবে দোয়াব ও ট্রান্স-যমুনা সমভূমি অঞ্চলে কয়েকজন জমিদারও ছিল। এরা যখন অনাচার দেখত একসঙ্গে সশস্ত্র প্রতিরোধ করত। হতে পারে যে মুঘল কেন্দ্রীভূত শাসন এদের কৃষিজীবী জীবনশৈলীতে। কোনোভাবে বিপদ ডেকে এনেছিল, তাই তারা হয়তো মুঘলদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের রাস্তা বেছে নিয়েছিল। আমরা জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের আমলে এই অঞ্চলে জাটদের সঙ্গে মুঘল রাষ্ট্রের সংঘর্ষের দৃষ্টান্ত পাই। কিন্তু এই বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ একটি বিস্তৃত বিদ্রোহের আকার নেয় ঔরঙ্গজেবের আমলে। ১৬৬৭ সালের শুরুর দিকে মথুরার জাটরা ছোটো জমিদার গোকলার নেতৃত্বে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে অনেক কৃষক এসে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল, ফলে বিদ্রোহীদের সংখ্যা এক ঝটকায় ২০,০০০-এ পৌঁছে গিয়েছিল। মথুরার ফৌজদার আবদুন নবি এই বিদ্রোহে প্রাণ হারিয়েছিলেন। যদিও তিনি অতিশয় ধার্মিক ও সদাশয় ব্যক্তি বলে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তার যা সম্পত্তি পাওয়া গিয়েছিল তা অবাক করার মতো, ছিল ৯৩,০০০ সোনার মোহর ও ১৩ লক্ষ টাকা। ওই বছর । জাটদের লুঠতরাজের ঘটনা বৃদ্ধি পেতে থাকায় ঔরঙ্গজেব দিল্লি থেকে আগ্রা চলে আসেন এবং এক জোরালো যুদ্ধে গোকলাকে পরাজিত করে আটক করে নেন। এরপর তাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়, তার পুত্রকে জোর করে ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত করা হয় এবং কন্যাকে সম্রাটের কোনো এক উচ্চপদস্থ দাসের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়।

জাটদের এই অভ্যুত্থান সবদিক দিয়েই কৃষক আন্দোলনের চরিত্র ধারণ করেছিল। ধর্মীয় ভাবাবেগ খুব একটা ভূমিকা পালন করেনি বোধ হয় এই আন্দোলনে, তবে আবদুন নবি মথুরাতে একটি ঝাঁ-চকচকে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন অবশ্য। কিন্তু মথুরায় বীর সিংহ দেও বুন্দেলার মন্দির ভাঙা হয়েছিল জাটদের পরাজিত করার পরে।

১৬৭২ সালে মথুরার অনতিদূরে নারনাউল অঞ্চলে মুঘলদের সঙ্গে কৃষকদের আরও একটি সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। এই সময় সংঘর্ষটা একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে লেগেছিল যারা সতনামি নামে পরিচিত ছিল। সতনামিরা ছিল বৈরাগীদের একটা সম্প্রদায় যাদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থ ছিল। কবীরের মতো এরাও একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল এবং আচার আচরণ ও কুসংস্কার সমর্থন করত না। গরিবদের প্রতি দয়া ও সম্পদশালী ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করা ছিল এদের কাজ। তাই মূলত নিচু তলার। মানুষদের মধ্যে এদের আবেদন ছিল। মূলত কৃষিজীবী, কারিগর ও নিচু জাতের মানুষরাই ছিল এই সম্প্রদায়ে, এক সমকালীন লেখক তাই এদের ‘ছুতোর, কামার, ঝাড়ুদার, বস্ত্রশিল্পী ও অন্য সকল অবহেলিত মানুষ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তারা হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে কোনোরকম জাতপাত বা পদের বৈষম্য করত না এবং সব সময় নিয়ম নীতি মান্য করে চলত। একজন স্থানীয় আধিকারিকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রদর্শন থেকে শুরু হয়ে তাদের বিক্ষোভ একটি মুক্ত বিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল।

বহু গ্রাম লুঠ করে ও স্থানীয় ফৌজদারকে পরাস্ত করে সতনামিরা নারনাউল ও বৈরাট অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। শোনা যায় যে তাদের বিক্ষোভের ধ্বনি দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, সেখানে খাদ্যশস্য জোগান কমে গিয়েছিল, নাগরিকদের তাদের আগমনের ভয়ে ব্যাপকভাবে সতর্ক ও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঔরঙ্গজেব ১০,০০০ জনের একটা বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন সতনামিদের আটকাতে, এই বাহিনীতে ছিল রাদান্দাজ খান ও রাজা বিশান সিংহের মতো উচ্চপদস্থ অভিজাতদের নেতৃত্বে একটি বিশাল গোলন্দাজ বাহিনী। বিদ্রোহীরা ভালো লড়াই করলেও এই রকম বিশাল ও সুসংগঠিত বাহিনীর সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেনি।

এদিকে জাট সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত হতে শুরু করেছিল। আবার এবং এবার তারা প্রতিবাদের চিরাচরিত পন্থা অবলম্বন করে ভূমি রাজস্ব প্রদান বয়কট করে দিয়েছিল। জাটদের এই কাজের প্রতিশোধ নিতে ১৬৮১ সালে আগ্রা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের ফৌজদার মুলতাফাত খান সিনসানির জাট গ্রামে আক্রমণ চালান। সময় যত এগোতে থাকে সিনসানি গ্রামের জমিদার রাজারামের নেতৃত্বে ওই অঞ্চলের জাটরা সংগঠিত হতে শুরু করে এবং জমিদার তাদের সামরিক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন। এরপর আগ্রার সঙ্গে বুরহানপুর ও আজমের অঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপনকারী গুরুত্বপূর্ণ রাজপথে একের-পর-এক লুঠতরাজের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার পর প্রশাসনের সঙ্গে জাটদের সংঘর্ষের চরিত্র বদলে যায়, এবার প্রথমে ওই অঞ্চলের জাট নয় এমন জমিদারদের উৎখাত করা হয়, তারপর জাট অধ্যুষিত অঞ্চলে আক্রমণ করা হয়। এর মধ্যে জমিদারি স্বত্ব নিয়ে জাট ও রাজপুতদের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়। বেশিরভাগ প্রাথমিক জমিদার ছিলেন কৃষিজাবী ও জমির স্বত্বাধিকারী জাটরা আর মধ্যবর্তী রাজস্ব আদায়কারী জমিদাররা ছিলেন বেশিরভাগই রাজপুত। জাট ও রাজপুত জমিদারদের মধ্যে বিবাদের সুযোগ নিয়ে ঔরঙ্গজেব কচ্ছওয়াহ রাজা বিশান সিংহকে জাট বিদ্রোহ দমন করতে আদেশ দেন। বিশান সিংহ মথুরা অঞ্চলের ফৌজদার নিযুক্ত হন এবং তাকে এই সমগ্র অঞ্চল জমিদারি হিসাবে দান করা হয়। জাট বিদ্রোহীরা জোর প্রতিরোধ চালালেও অবশেষে ১৬৯১ সালে রাজারাম ও তার উত্তরাধিকারী চৌরামান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। তবে জাট কৃষকদের বিক্ষোভ অসন্তোষ যে এর পর থেমে গিয়েছিল তা বলা যাবে না। দিল্লি-আগা সড়ক পথে এদের লুঠপাট চালানো অব্যাহত থাকে এবং এদের দৌরাত্মে সড়কপথটি পথিকদের কাছে রীতিমতো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে অষ্টাদশ শতকে মুঘল গৃহবিবাদ ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জাট নেতা চৌরামান ওই অঞ্চলে রাজপুত জমিদারদের হটিয়ে দিয়ে একটি পৃথক জাট রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। ফলে আমরা দেখলাম যে একটি কৃষক অসন্তোষ হিসাবে জাটরা আন্দোলন শুরু করে ধীরে ধীরে তার চরিত্র বদলে তা রীতিমতো জাট রাজ্য গড়ে তোলার সংগ্রামে রূপ নিয়েছিল এবং জাট নেতা পরিণত হয়েছিলেন শাসকশ্রেণিতে।

আফগান

আফগানদের সঙ্গেও ঔরঙ্গজেবের সংঘর্ষ বেঁধেছিল। পাঞ্জাব ও কাবুল অঞ্চলের মধ্যবর্তী পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী আফগান জনজাতির শক্তিশালী নেতাদের সঙ্গে মুঘলদের সংগ্রাম নতুন কিছু ছিল না। এই আফগানদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে এক সময় আকবর তার প্রিয় বন্ধু রাজা বীরবলকে চিরতরে হারিয়েছিলেন। শাহজাহানের আমলেও আফগান জনজাতির নেতাদের সঙ্গে মুঘলদের লড়াই অব্যাহত ছিল। এই লড়াই কিছুটা আর্থিক আর কিছুটা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে ঘটেছিল। রুক্ষ পার্বত্য অঞ্চলের নিম্নমানের জীবনযাপনে বাধ্য হয়ে আফগানদের কারাভ্যান লুঠ করা বা মুঘল বাহিনীতে নাম লেখানো ছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিল না। ভারতে আফগানরা ক্রমাগত বাইরে থেকে আক্রমণ চালাত এবং অনেকেই এ দেশে হয় কৃষক বা জমিদার, হলে বিভিন্ন রাজ্যের অভিজাত হিসাবে কাজ করত। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলের পাঠানরা এদের একদম দেখতে পারত না। এই পাঠানদের হিংস্র স্বাধীনতার স্পৃহার কারণে ঠিকঠাক ভাবে কাজ করতে পারত না। মুঘলরা এদের নানা রকম ভর্তুকি দিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা করত। কিন্তু এদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ও কয়েকজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতার উত্থানের ফলে এই রকম শান্তি প্রতিষ্ঠার সমঝোতা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

ঔরঙ্গজেবের আমলে আমরা নতুন করে পাঠানদের উত্থান লক্ষ করি। ১৬৬৭ সালে ইউসুফজাই জনজাতির নেতারা নিজেদের রাজা হিসাবে ঘোষণা করে দেন। এবং মোহম্মদ শাহ নামে এক ব্যক্তি নিজেকে প্রাচীন এক রাজবংশের উত্তরসূরি হিসাবে দাবি করে নিজেকে উজির বলে ঘোষণা করেন। মনে হয় যে আফগান বা জাটদের মতো পাঠানরাও ধীরে ধীরে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি নিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছিল এই সময় থেকে। রৌসানাই নামে একটি ধর্মীয় সংস্কারপন্থী আন্দোলন যা একটি কঠিন জাতিগত জীবনযাপন করা ও নির্বাচিত পির-এর অধীনে ভক্তিভরে জীবন উৎসর্গ করার ওপর জোর দিত, তা এই পাঠান অভ্যুত্থানের পশ্চাতে একটি বৌদ্ধিক ও নৈতিক ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছিল বলা যায়।

ক্রমে ভাঙ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং এই আন্দোলনের সমর্থকরা হাজারা, আটোক ও পেশোয়ার জেলায় তাণ্ডব চালায়। খাইবার গিরিপথ পর্যন্ত অবরোধ করে তারা। খাইবার গিরিপথ বিপদমুক্ত করতে ও এদের বিদ্রোহ দমন করতে ঔরঙ্গজেব প্রধান বকশি আমির খানকে নিয়োগ করেন। রাজপুত সৈন্যদের একটা দলও পাঠানো হয়। একের-পর-এক দুর্ধর্ষ যুদ্ধে আফগান বিদ্রোহ ভেঙে যায়। বিদ্রোহ দমন করা হলেও আফগানদের গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্যে ১৬৭১ সালে মাড়ওয়ারের শাসক মহারাজা যশবন্ত সিংহকে জামরুদ এলাকার থানেদার নিয়োগ করা হয়েছিল।

১৬৭২ সালে দ্বিতীয়বার আফগান বিদ্রোহ শুরু হয়। এবার বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। আফ্রিদি নেতা আকমল খান, যিনি নিজেকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন এবং নিজের নামে খুৎবা পাঠ ও সিক্কা প্রচলন করেছিলেন। তিনি সরাসরি মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন এবং সকল আফগান জনজাতির মানুষকে এই যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্যে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সমকালীন এক লেখকের মতে, তাঁর। ডাকে সাড়া দিয়ে ‘পিপীলিকা ও পঙ্গপালদের থেকেও বেশি সংখ্যায় তারা জড়ো হয়েছিল এবং খাইবার গিরিপথ বন্ধ করে দিয়েছিল। এদের শায়েস্তা করার জন্যে আমির খান বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেও সংকীর্ণ গিরিপথে আটকে পড়ে আফগানদের। হাতে পরাস্ত হয়ে যান। প্রাণ হাতে নিয়ে সেখান থেকে আমির খান পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও প্রায় ১০,০০০ মানুষের হত্যা এবং আফগানদের দ্বারা প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের জিনিসপত্র ও নগদ টাকা লুঠ হওয়া আটকানো যায়নি। মুঘলদের এই পরাজয় অন্য আফগান জনজাতির নেতাদের মনেও উৎসাহ তৈরি করেছিল, বিশেষ করে খুসসাল খান খাট্টক যিনি ছিলেন ঔরঙ্গজেবের চরম শত্রু এবং একবার তার হাতে মুঘল সম্রাটকে কিছুদিন কারারুদ্ধও থাকতে হয়েছিল, তিনি এবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

১৬৭৪ সালে আর-এক মুঘল অভিজাত সুজাত খান খাইবার অঞ্চলে আফগানদের। বিক্ষোভের মধ্যে পড়েছিলেন। কিন্ত তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসেন যশবন্ত সিংহের প্রেরিত বীর রাঠৌর সেনার একটি দল। অবশেষে ১৬৭৪ সালের অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত সেখানে অতিবাহিত করেছিলেন। বল প্রয়োগ ও কূটনীতির আশ্রয় নিয়ে আফগানদের একতা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এবং আস্তে আস্তে সেখানে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ কাজে সবথেকে বেশি যার কৃতিত্ব ছিল তিনি হলেন কাবুলের নবনিযুক্ত শাসক ও রাজনীতিতে সুদক্ষ অভিজাত আমির খান।

আফগান অভ্যুত্থান দেখাল যে মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্পৃহা ও আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রতার দাবি শুধুমাত্র জাট, মারাঠা প্রভৃতি হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেই সঙ্গে আফগান গণবিদ্রোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শিবাজির ওপর মুঘল চাপ সৃষ্টি করা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল। আফগানদের সামলাতে গিয়ে দাক্ষিণাত্যে ১৬৭৬ সাল পর্যন্ত মুঘল আগ্রাসী নীতি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি, সম্ভবত সেই সুযোগেই শিবাজি নিজেকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন এবং বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক তৈরি করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

শিখ

আমরা ইতিমধ্যে পাঞ্জাব অঞ্চলে গুরু নানকের নেতৃত্বে কীভাবে গণতান্ত্রিক ও একেশ্বরবাদী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল তা আলোচনা করেছি। নানক-পরবর্তী শিখগুরুদের সঙ্গে আকবরের সুসম্পর্ক বজায় ছিল, কিন্তু বিদ্রোহী ভ্রাতা খসরুকে আশীর্বাদ করার কারণে গুরু অর্জুনের সঙ্গে জাহাঙ্গিরের একটা সংঘাত বেঁধেছিল। তবে এই কারণে যে শিখদের শাস্তি পেতে হয়েছিল তা কিন্তু নয়। গুরু হরগোবিন্দকে জোর করে আটক করে রাখা ছাড়া জাহাঙ্গিরের সঙ্গে শিখদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই বজায় ছিল। শাহজাহানেরশাসনের প্রথম দিকে রাজকীয় বাহিনীর সঙ্গে গুরু হরগোবিন্দের একটা ঝামেলা বেঁধেছিল। আর পি. ত্রিপাঠির মতে, এই দ্বন্দ্বের কারণ ছিল প্রায় ‘অপ্রাসঙ্গিক। যখন অমৃতসরে মুঘল সম্রাট শিকার করছিলেন তখন তার প্রিয় বাজপাখি। উড়তে উড়তে শিখ গুরুর শিবিরে চলে গিয়েছিল এবং গুরু তা ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করলে উভয়ের মধ্যে গুরুতর সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় (১৬২৮)। যুদ্ধে শিখরা ভালো অবস্থায় ছিল। তাদের বাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন একজন দক্ষ পাঠান পাইডা খান।

দ্বিতীয় দ্বন্দ্ব শুরু হয় যখন জলন্ধর দোয়াবে বিপাশা নদীর তীরে গুরু একটি নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করার জন্যে উদ্যোগী হয়েছিলেন যাতে মুঘল কর্তৃপক্ষ আপত্তি জানিয়ে কাজ বন্ধের আদেশ দিয়েছিল। কিন্তু এই দ্বন্দ্বেও শিখগুরু জয়লাভ করেছিলেন।

তৃতীয় দ্বন্দ্ব শুরু হয় যখন হিংস্র ডাকাত বিধি চাঁদ মুঘল ঘোড়াশাল থেকে দুটি ঘোড়া চুরি করে গুরুকে দান করেছিলেন। বলা হয় যে এই ঘোড়া দুটি নাকি ‘যথেষ্ট সুন্দর ও দ্রুতগামী ছিল এবং যখন মুঘল আধিকারিকরা এই দুই ঘোড়াকে বাজেয়াপ্ত করেছিলেন তখনই তা গুরুর কাছে আনা হয়েছিল।

কারণ যাই হোক, এই ঘটনার পর উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এইবার পাইন্ডা খান মুঘল শিবিরে চলে গেলে শিখরা যথেষ্ট চাপে পড়ে যায়। যদিও বীরত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে তারা যুদ্ধ শুরু করেছিল কিন্তু ক্রমে গুরুকে বাধ্য করা হয় প্রথমে করতারপুর ও পরে কাশ্মীরের পার্বত্য অঞ্চলে পলায়ন করতে।

আমরা যদি এই সকল দ্বন্দ্বের গভীরে প্রবেশ করে আসল কারণটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করি তাহলে দেখব যে শিখ আন্দোলনের বাড়বাড়ন্তের জন্যেই মুঘল, কর্তৃপক্ষ যে-কোনো অজুহাতে বারবার তাদের আক্রমণ করছিল। পাঞ্জাবে ছোটো ও অগ্রসর শিখ সম্প্রদায়ের উত্থান, তাদের নির্দিষ্ট জাতিগত ও ধর্মীয় কাঠামো, গুরুর প্রতি তাদের গভীর ভক্তি ও তার কথায় সকল অবিচারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ। পর্যন্ত দেবার মানসিকতা প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠবে বলাই বাহুল্য। সেই সঙ্গে অনুগামীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য মসন্দ নামক কর্মচারীর নিযুক্তি, গুরু রামদাসের পরে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র অর্জুনকে ১৫৮১ সালে পরবর্তী গুরু হিসাবে নিয়োগের মধ্য দিয়ে বংশানুক্রমিক গুরুবাদের উত্থান এবং তার পুত্র ও গুরুবাদের উত্তরাধিকারী হরগোবিন্দের দুটি তরবারি ধারণের মধ্য দিয়ে সামরিক চরিত্র গ্রহণ মুঘলদের চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছিল। হরগোবিন্দ সামরিক অনুগামী নিয়োগ করার ধারাও শুরু করেছিলেন। পাঠান নেতা পাইন্ড খান শিখদের শিবিরে যোগ দিলে মুঘলদের সন্দেহ আরও বাড়ে। গুরুর শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি ঘটায় জলন্ধর ও মিয়ানা। অঞ্চলের বহু জাট কৃষক গুরুর ভক্তে পরিণত হয়েছিল। ফলে শিখগুরু ক্রমে অসহায় মানুষের অবলম্বনের কেন্দ্রে পরিণত হয় যারা অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দু’বার ভাবত না।

মুঘল কর্তৃপক্ষ শিখগুরুদের এই উত্থান সম্পর্কে অবহিত ছিল বলেই মনে হয় এবং তাই হয়তো নানা ভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিয়েছিল।

সিংহাসনে বসে ঔরঙ্গজেব প্রথমেই শিখ সমস্যা খতিয়ে দেখেছিলেন। শিখগুরু হরগোবিন্দের উত্তরাধিকারী শিখগুরু হরকিষানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি নাকি দারা শুকোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন এবং ঔরঙ্গজেবের বিরোধিতা করার জন্য তাকে সহযোগিতা করেছিলেন। তাছা। শুনি নাকি অলৌকিক সব জিনিস দেখিয়ে ইসলামকেও অপমান করেছিলেন। জাহাঙ্গিরের আমলেও এই একই অভিযোগ ছিল কিন্তু এবার ঔরঙ্গজেব অপেক্ষাকৃত নমনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি গুরু রাইকিযানকে দরবারে সমন পাঠিয়ে ডেকে এই রকম কাজ কেন করেছেন তার ব্যাখ্যা দিতে বলেছিলেন। গুরু তার পুত্র রাম রাইকে দরবারে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু গুরুর এই পদক্ষেপ খুব একটা পছন্দ হয়নি সম্রাটের এবং শাস্তি হিসাবে তিনি রাম রাইকে দরবারে আটক করে রেখেছিলেন। এ.সি.ব্যানার্জির মতে, ‘হতে পারে যে মুঘল সম্রাট চেয়েছিলেন ভবিষ্যতের গুরুকে দরবারে আটকে রেখে সেখানকার পরিবেশ দিয়ে জোর করে তার মুঘল প্রভাব প্রভাবিত করতে। ঔরঙ্গজেব রাম রাইকে নানা ভাবে নিজের দলে টানতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন এবং দেরাদুনের কাছে একটি জমি দান করে সেখানে বসতি গড়ে দিয়েছিলেন। ওদিক রাম রাইয়ের অনুপস্থিতিতে গুরুতন্ত্রে উত্তরাধিকার সমস্যা শুরু হয়েছিল। ঔরঙ্গজেব সেই ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে চাননি। আর সে সময় শিখদের সঙ্গে মুঘলদের দ্বন্দ্বের খবরও পাওয়া যায় না। ফলে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হওয়ায় ১৬৬৪ সালে নতুন গুরু তেগ বাহাদুর বিহারে গিয়ে রাজা জয় সিংহের পুত্র রাজা রামসিংহকে আসাম অভিযানে সহায়তা করেছিলেন।

১৬৭১ সালে গুরু তেগ বাহাদুর পাঞ্জাবে ফিরে আসেন। এরপর ১৬৭৫ সালে তেগ বাহাদুরকে গ্রেফতার করে দিল্লিতে নিয়ে এসে কেন নির্মম ভাবে শিরচ্ছেদ করে হত্যা করা হয়েছিল সে নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। গুরু তেগ বাহাদুরের প্রাণদণ্ডের কোনো সমকালীন ফারসি তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে মুস্তাইজ খানের সরকারি তথ্য নির্ভর গ্রন্থ মাসিরআলমগিরি থেকে এটা পরিষ্কার যে, ১৬৭৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে ১৬৭৬ সালের মার্চ মাসের শেষ দিক পর্যন্ত ঔরঙ্গজেব বিদ্রোহী আফগানদের মোকাবিলা করার জন্যে দিল্লির বাইরে ছিলেন। একশো বছর পরে লেখা এক ফারসি সূত্র থেকে জানা যায় যে শেখ আহমেদ শিরিন্দির ভক্ত হাফিজ আদমের সহযোগিতায় গুরু তেগ বাহাদুর পাঞ্জাব প্রদেশে লুঠতরাজ শুরু করেছিলেন। অষ্টাদশ শতকে লেখা শিখ সূত্রেও এই ফারসি তথ্যের সমর্থন মেলে, সেখানে বলা আছে ‘গুরু এ দেশের মুসলিম শাসকদের হিংসাত্মক বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যদিও সেখানে বলা হয় যে এই বিরোধিতা ঔরঙ্গজেবের সংকীর্ণ ধর্মীয় নীতিসমূহের প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না। শিখ ঐতিহ্য অনুসারে কাশ্মীরের মুঘল শাসক শের আফগান কাশ্মীরের হিন্দুদের জোর করে ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত করছিলেন এবং এই প্রক্রিয়ার প্রতিবাদ করার মাশুল দিতে হয়েছিল গুরু তেগ বাহাদুরকে। ঐতিহাসিক গল্পগাথা অনেক সময় ঘটনার গভীরে অনেক না বলা কথা তুলে ধরে ঠিকই, কিন্তু বিস্তারিত ঘটনা বা তারিখ সাল নিয়ে অনেক ভুল তথ্যও প্রদান করে। ১৬৭১ থেকে কাশ্মীরে মুঘল প্রাদেশিক শাসক ছিলেন ইফতেকার খান, তাঁর পূর্বসূরি ছিলেন সইফ খান যিনি যথেষ্ট মানবদরদি ও মুক্তমনা মানুষ ছিলেন। তাঁকে প্রশাসনিক ব্যাপারে পরামর্শ দেবার জন্য তিনি একজন হিন্দুকে নিয়োগ করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি কাশ্মীরে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করতেন বলে যথেষ্ট নামডাক ছিল। ইফতেকার খান শিয়া-বিরোধী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু কাশ্মীরের কোনো ঐতিহাসিক বিশেষ করে ১৭১০ সালে নারায়ণ কৌলের লেখা কাশ্মীরের ইতিহাসে কোথাও এই কথা উল্লেখ নেই যে তিনি কোনো হিন্দুকে শাস্তি দিয়েছিলেন।

ফলে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এ হল এক ঐতিহাসিক ঘটনার দুই রকম ব্যাখ্যা : একদিকে মুঘল সরকারি লেখালেখিতে গুরুকে শান্তি বিঘ্নকারী হিসাবে দেখানো হয়েছে। এবং এর শাস্তি হিসাবে হয় তাকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়ে যেতে হত, না হলে হত্যা করা হত। শিখরা গুরুকে এমন এক ধর্মীয় নেতা হিসাবে দেখত যিনি সকল প্রকার অত্যাচারের প্রতিবাদ করতেন এবং নিজ ধর্মবিশ্বাসকে অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রাণ দিতেও পিছপা হত না।

ঔরঙ্গজেব দিল্লির মধ্যে বা বাইরে যেখানেই থাকুন না কেন, তার সম্মতি ছাড়া বা তাকে অবগত না করে গুরুর প্রাণদণ্ড কার্যকর হয়েছিল বলে মনে হয় না। অন্য অনেক ক্ষেত্রে ঔরঙ্গজেবের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ সংকীর্ণ হলেও গুরুর প্রাণদণ্ডের কিন্তু খুব। একটা প্রয়োজন ছিল না। তার এই শহিদ হয়ে যাওয়ার ঘটনা অবশেষে শিখদের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় সামরিক আন্দোলনের স্পৃহা জাগিয়ে তোলে। এই আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন গুরু গোবিন্দ সিং। পাঞ্জাবের পাহাড়ি এলাকায় গা ঢাকা দিয়ে গুরু গোবিন্দ সিং এক সময় রাজা নাহান যে বাহিনী ব্যবহার করতেন সেই ছোট্টো বাহিনীকে একত্রিত করছিলেন। ১৬৯৯ সালে গুরু আনন্দপুরে সামরিক সৌভ্রাতৃত্ব বা খালসা গড়ে তুলেছিলেন। খালসাতে উদ্বুদ্ধ শিখ বাহিনী দু’মুখ খোলা তরবারি রাখত, গুরুর জন্যে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত থাকত, কেশ বা গোঁফ দাড়ি রাখত, অস্ত্র রাখত, যেসব মসন্দর-র একতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না তাদের অপসারণ করত, হয় খালসা পন্থ না হলে আদি গ্রন্থ অনুসারে গুরুতন্ত্রকে মেনে চলত, কিছু পুরোনো রীতিনীতি ত্যাগ করে নতুন নীতি গ্রহণ করত, এই ভাবে ইতিমধ্যেই কোনো পৃথক সামাজিক-ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধে বিশ্বাসী হলেও খালসার সামাজিক পরিচিতিতে নিজেকে রাঙিয়ে নিত। (জে.এস.গ্রেরওয়াল)

এরপর শিখদের সঙ্গে মুঘলদের সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাস আলোচনার প্রয়োজন নেই এখানে। গুরু তাকে সাহায্যের জন্য পার্বত্য অঞ্চলের যে রাজাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা দেখেছিলেন যে গুরু যথেষ্ট শক্তিশালী। আনন্দপুরে অনেক রকম পাহাড়ি রাজার মিলিত বাহিনী গুরুকে আক্রমণ করেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। ফলে গুরুর বিরুদ্ধে ও তাদের হয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য তারা মুঘলদের কাছে আবেদন জানায়। আসলে আনন্দপুরে গুরুর বাহিনী যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে খাদ্য ও রসদের জন্য আক্রমণ করা দরকার হয়ে পড়েছিল। ফলে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির রাজাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল।

ঔরঙ্গজেব গুরুর এই ক্ষমতা বৃদ্ধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং তিনি ফৌজদারকে ‘গুরুর থেকে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন। তিনি লাহোরের শাসক ও সিরহিন্দের ফৌজদার ওয়াজির খানকে লেখা এক পত্রে পাহাড়ি রাজাদের গুরু গোবিন্দ সিং-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সব রকম সাহায্য করতে বলেছিলেন। মুঘল বাহিনী আনুপুর আক্রমণ করলেও শিখ বাহিনী দারুণ জবাব দেয় এবং সব রকম আক্রমণ প্রতিহত করে। মুঘল ও সহযোগী বাহিনী এবার দুর্গ বয়কট করে। যখন দুর্গে অনাহার দেখা দিয়েছিল তখন গুরু বাধ্য হন ওয়াজির খানের তরফ থেকে কোনোরকম আক্রমণ না হবার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে দুর্গের দ্বার খুলতে। কিন্তু যখন গুরুর বাহিনী দুর্গ থেকে বেরিয়ে একটি খরস্রোতা নদী পার করছিলেন, ওয়াজির খানের বাহিনী তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। গুরুর দুই পুত্রকে আটক করা হয় এবং তাদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বললে তা অস্বীকার করায় সিরহিন্দে তাদের শিরচ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। গুরু আর-একটি যুদ্ধে অবশিষ্ট দুই পুত্রকে হারিয়ে ফেলেন। এরপর গুরু তালওয়ান্দি অঞ্চলে অবসর জীবন কাটাতে চলে গিয়েছিলেন এবং তাকে তারপর আর কেউ জ্বালাতন করেনি বলেই জানা যায়।

গুরুর পুত্রদের এভাবে নির্মম ভাবে হত্যা করার ব্যাপারে ঔরঙ্গজেব অবগত ছিলেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সম্ভবত ঔরঙ্গজেব গুরুকে এভাবে শেষ করে দিতে চাননি, তিনি লাহোরের শাসককে লিখেছিলেন, ‘গুরুর সঙ্গে সমঝোতা করতে। যখন গুরু ঔরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যে লেখা একটি পত্রে সমগ্র ঘটনার কথা জানিয়েছিলেন তখন ঔরঙ্গজেব তাকে তার সঙ্গে দেখা করতে আসতে বলেছিলেন। ১৭০৬ সালের শেষ দিকে গুরু দাক্ষিণাত্যে সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে রওনা দিলেও পথে তিনি যেতে যেতেই ঔরঙ্গজেব মারা গিয়েছিলেন। কয়েকজনের মতে, তার আশা ছিল ঔরঙ্গজেবকে বলে আনন্দপুরের অধিকার পুনুরুদ্ধার করবেন, কিন্তু সব আশা শেষ হয়ে গেল।

গুরু গোবিন্দ সিং মুঘলদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হলেও তিনি এমন একটা ঐতিহ্যের জন্ম দিয়েছিলেন যেখানে অস্ত্র উঁচিয়ে পরবর্তীকালে শিখ রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে একটি একেশ্বরবাদী ধর্মীয় আন্দোলন কয়েকটি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়ে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক আন্দোলনের রূপ নিতে পারে এবং সেখান থেকে আস্তে আস্তে আঞ্চলিক স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হতে পারে।

রাজপুতদের সঙ্গে সম্পর্ক-মাড়ওয়ার ও মেবারের সঙ্গে বিবাদ

রাজপুতদের সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের সম্পর্ক একাধিক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল এবং আমাদের বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যে সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে কীভাবে ১৬৭৯ সালে মাড়ওয়ার ও মেবারের সঙ্গে মুঘলদের বিবাদ দেখা দিয়েছিল।

প্রথমদিকে ১৬৫৮ সাল থেকে ১৬৬৭ সালে জয় সিংহের মৃত্যু পর্যন্ত রাজপুতদের। সঙ্গে মুঘলদের সম্পর্ক যথেষ্ট সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। এমনকি এই সময় রাজপুতদের সাম্রাজ্যের অংশীদার হিসাবে দেখা হত এবং জাহাঙ্গির বা শাহজাহানের আমলের তুলনায় রাজপুতদের এই সময় অনেক বেশি সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করা হয়েছিল। উত্তরাধিকারের লড়াই হবার সম্ভাবনা দেখে দারা ও ঔরঙ্গজেব উভয়েই দরবারের রাজপুত সহ অনান্য অভিজাতদের নিজের দিকে টানার চেষ্টা করেন। বালখ ছেড়ে পালানোর সময় জয় সিংহ ঔরঙ্গজেবের বাহিনীর হাল ধরেছিলেন এবং কান্দাহার অভিযানের সময় বাহিনীর পশ্চিম অংশের সামরিক নেতৃত্বদানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আগে তিনি দারার হয়ে যুদ্ধ করতেন, কিন্তু কান্দাহার অভিযানের পর দারা তাঁকে ভৎর্সনা করায় তিনি দারার শিবির ছেড়ে ঔরঙ্গজেবের শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন এবং দারাকে হেনস্থা করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ঔরঙ্গজেবের এত ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে এক সমকালীন ঐতিহাসিক ঈশ্বরদাস তাকে ঔরঙ্গজেবের মস্তিষ্কের চাবিকাঠি’ বলেছিলেন। রাজপুতদের ব্যাপারে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ঔরঙ্গজেবের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন জয় সিংহ এবং তার অনুরোধেই দারার। সঙ্গে একদা সম্পর্ক রাখা যশোবন্ত সিংহকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল এবং তার মনসব পুনরায় প্রদান করা হয়েছিল। এছাড়া যশোবন্ত সিংহকে গুজরাটের শাসক পদ দেওয়া থেকে শুরু করে প্রথা অনুযায়ী সাধারণ ছুটি নিতে গেলে যে দরবারে আসতে হত, তাতেও ছাড় দেওয়া হয়েছিল। দাক্ষিণাত্যের প্রাদেশিক শাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। জয় সিংহ। এই পদ সাধারণত দরবারের রক্তের সম্পর্কের শাহজাদাদের বা উচ্চপদের ও সবথেকে বিশ্বস্ত অভিজাতদের দেওয়া হত। তিনি সেই অল্পসংখ্যক অভিজাতদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি পৃথক মারাঠা নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং তা মানতে বাধ্য। ছিলেন ঔরঙ্গজেব।

সিংহাসনে বসার পর ঔরঙ্গজেব মেবারের শাসক রানা রাজ সিংহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। উত্তরাধিকারিত্বের সংগ্রাম শুরুর ঠিক আগে ঔরঙ্গজেব। রানার সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং ১৬৫৪ সালে শাহজাহান যেসব পরগনা দখল করে। নিয়েছিলেন সেগুলো ফিরিয়ে দেবার ও দুঙ্গাপুর, বানসাওয়াড়া প্রভৃতি অঞ্চলে কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রানাকে তিনি নিজের দলে টেনে এনেছিলেন। মহারানাকে সেই সঙ্গে ধর্মীয় সহনশীলতা ও রানা সংগ্রাম সিংহের তুলনায় অধিক উচ্চ মর্যাদা প্রদানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। ঔরঙ্গজেব সিংহাসন দখল করার পর রানার মনসব বাড়িয়ে ৬০০০/৬০০০ (১০০০ দুআসপাসিআসপা) করা হয়েছিল, বাজেয়াপ্ত পরগনাগুলি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং দুঙ্গারপুর, বানসওয়াড়া, দেবালিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের ওপর তার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল।

একইভাবে বিকানের, বুন্দি, কোটা প্রভৃতি অন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের সঙ্গেও মুঘলরা এ সময় সুসম্পর্ক ধরে রেখেছিল। শাহজাহানের অসুখের কথা শুনে দাক্ষিণাত্যে এক সময় ঔরঙ্গজেবকে ফেলে রেখে চলে এসেছিলেন বিকানেরের শাসক রাজা করণ। কিন্তু সিংহাসনে বসে ঔরঙ্গজেব তাকে মাফ করে দিয়েছিলেন। এক সময় বুন্দির শাসক ছত্ৰসাল কোটার রাজা মুকুন্দ সিংহ ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়াই করলেও তারা কখনোই উত্তরাধিকারিত্বের সমস্যায় হস্তক্ষেপ করেননি বা কোনো ব্যাপারে অসম্মতি জানাননি।

ফলে দেখা যাচ্ছে যে ঔরঙ্গজেবের নিজস্ব একটা কট্টরপন্থী ধর্মীয় মনোভাব থাকলেও তার শাসনের শুরুর দিকে রাজপুতদের সম্মান যথেষ্ট বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছিল। এবং তাদের সাম্রাজ্যের অংশীদার করে যেন আকবরের জমানা ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু এই সম্পর্কের উষ্ণতা ধীরে ধীরে যেন শীতল হয়ে গিয়েছিল। ১৬৬০ সালে রানা রাজ সিংহকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কেন তিনি রাজশক্তির অনুমতি ছাড়া কিষাণগড় আক্রমণ করেছিলেন ও রাজার ভগিনী চারুমতাঁকে বিবাহ করেছিলেন। রাজ সিংহের চটজলদি জবাব ছিল যে রাজপুতরা সব সময় রাজপুতদের বিবাহ করে, এটা কোনো নিষিদ্ধ ব্যাপার নয়। তাই তার জন্যে অনুমতি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তার ওপর তার পূর্বসূরিরা এক সময় আজমেরের পাওয়ারদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তিনি এও বলেন যে তিনি অনুমতি নেননি বলে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে তিনি মুঘল রাজশক্তিকে অস্বীকার করেছেন। রানার এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়, কিন্তু ঔরঙ্গজেব কোথাও-না-কোথাও অসন্তুষ্ট ছিলেন, তাই তিনি রানা কর্তৃক এক সময় উৎখাত করা হরি সিংহকে গিয়াসপুর (দেবালিয়া) ও বানসওয়াড়া অঞ্চল ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর চারুমতীর কনিষ্ঠ ভগিনীর সঙ্গে যুবরাজ মুয়াজ্জামের বিবাহও দেওয়া হয়েছিল।

শিবাজির কাজকর্ম ঔরঙ্গজেবের রীতিমতো চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল এবং তাকে আটকানোর জন্য পালা করে যশোবন্ত সিংহ ও জয় সিংহকে নিয়োগ করা হয়েছিল। যশবন্ত সিংহের অবহেলার কারণে শিবাজির ১৬৬২ সালে শাইস্তা খানের শিবিরে অতর্কিত আক্রমণ ও ১৬৬৬ সালে মির্জা রাজা জয় সিংহের পুত্র রাম সিংহের আগ্রার হেফাজত থেকে শিবাজির পালানোর ঘটনা রাজপুতদের সম্পর্কে সেই প্রথম। নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেয় মুঘল শিবিরে। শিবাজির প্রতি সহানুভূতি ছিল বলেই দুই প্রথম সারির রাজপুত রাজা এমন কাজ করেছিলেন কিনা এবং সেই কারণে ঔরঙ্গজেব তাদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করেছিলেন কিনা তা পরিষ্কার নয়। কারণ জয় সিংহ ও যশবন্ত সিংহ ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে তখনও উচ্চ মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করছিলেন এবং যতদিন তারা জীবিত ছিলেন ততদিন সেই সুযোগ-সুবিধা ভোগে কোনো ভাটা পড়েনি। এর অর্থ এই নয় যে সম্রাট নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এদের ওপরেই অন্ধ ভাবে নির্ভর করতেন। কারণ শিবাজি ও দাক্ষিণাত্য নিয়ে জয় সিংহ যেসব নীতির কথা বলেছিলেন তার সঙ্গে ঔরঙ্গজেব অনেক তফাত ছিল। উল্লেখ্য যে জয় সিংহের কথাতেই শিবাজি আগ্রা গিয়ে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আর যেভাবে সেখান থেকে শিবাজি পালিয়ে গিয়েছিলেন তা ঔরঙ্গজেব প্রচণ্ড অপমানজনক বলে মনে করে রাম সিংহের দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের জন্য তাকে কিছু সময়ের জন্য তার মনসব থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি জয় সিংহকে দাক্ষিণাত্যের শাসকের পদ থেকে অপসারিত করে দরবারে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু জয় সিংহ প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন দাক্ষিণাত্য ছেড়ে না যেতে এবং সেখানে গিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে কিছুদিনের মধ্যে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন (১৬৬৭)।

১৬৬৬ থেকে ১৬৭৯ সাল পর্যন্ত ঔরঙ্গজেবকে, একের-পর-এক ঘরোয়া প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল এবং তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ছিলেন। এই সময় যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। জাট ও সতনামি বিদ্রোহ, আফগান, অসমীয়া ও মারাঠাদের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের ফলে সাম্রাজ্যের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে তৈরি হয়েছিল বিস্তর ফারাক। এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে তিনি আরও একবার ইসলামকে সম্প্রীতির প্রধান মাধ্যম হিসাবে তুলে ধরে বেশ কিছু গোঁড়া পদক্ষেপ নিয়ে উলেমাদের কাছে আসতে চেয়েছিলেন। আর তিনি যেটা করেছিলেন তা হল উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সমস্যাগুলি মোকাবিলা করার জন্যে রাজপুত বাহিনী প্রেরণ করা। মাসির-ই-আলমগিরি অনুসারে ‘সম্রাট ঠিক করেছিলেন যে দরবারের অন্যতম যোগ্য ও সেরা অভিজাতকে সেনাবাহিনী সহযোগে বাংলায় পাঠাবেন যাতে তিনি সেখানে শত্রুদের উৎখাত করে সেখানকার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সেখানে থেকে যেতে পারেন ……’। জয় সিংহের মৃত্যুর পর ৫০০০/৫০০০ মনসবে উন্নীত অভিজাত রাজা রাম সিংহকে এই কাজ দেওয়া হয়েছিল। তবে পূর্বের মির জুমলার মতো তাকে সমগ্র সুবা বাংলার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি বাংলার সম্পদ থেকে অভিযানের খরচ মেটানোর জন্য।

উত্তর-পশ্চিম দিকে ১৬৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে গুজরাট থেকে সমন পাঠিয়ে সেখানকার শাসক যশবন্ত সিংহকে ডেকে এনে তড়িঘড়ি জামরুদের থানেদার নিযুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। যদিও মুঘল আমলে কোনো পদের গুরুত্ব নির্ভর করত সেই পদাধিকারীর মনসবের বহরের ওপর, আর সেইদিক থেকে দেখতে গেলে কাবুলের সুবেদার মহম্মদ আমির খান ও লাহোরের শাসক ফিদাই খানের তুলনায় অনেক বেশি মনসব পাওয়া যশবন্ত সিংহকে কেন থানেদারের মতো এত নিচু পদে নিয়োগ করা হয়েছিল তা নিয়ে কিছুটা বিস্ময়ের উদ্রেক হয়. তো বটেই। তবে সে সময় কাজি শেখ-উল-ইসলামের হয়ে কাজ করা ঐতিহাসিক ঈশ্বরদাস এই বলে ব্যাপারটাকে ধামা চাপা দিতে চেয়েছিলেন যে যশবন্ত সিংহকে নাকি ‘কাবুলের সর্দারি’ পদে নিয়োগ করা হয়েছিল।

দুই সমস্যাকীর্ণ এলাকায় রাম সিংহ ও যশবন্ত সিংহকে তড়িঘড়ি নিয়োগ করার বিষয়টা এতটা আশ্চর্যের নয় যতটা তাদের দীর্ঘদিন সেখানে ফেলে রেখে দুর্বল করে দেওয়া ছিল। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে দরবারে এই দুই প্রথম সারির রাজপুত রাজার উপস্থিতি ঔরঙ্গজেবের নীতিকে প্রভাবিত করত। কিন্তু তাঁদের যেভাবে দূরবর্তী জায়গায় পাঠিয়ে কার্যত নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল তাতে সমকালীন পর্যবেক্ষক মামুরি যে বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন অর্থাৎ এই সময় ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশ্যে গমন করার আগে রাজপুতদের বাড়বাড়ন্তে লাগাম টানতে চেয়েছিলেন–তা সত্যি বলে মেনে নেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।

আরও আশ্চর্যের বিষয় ছিল ১৬৬৭ সালের পর যখন ঔরঙ্গজেব নতুন করে দাক্ষিণাত্যের নীতি কার্যকর করছিলেন, তখন প্রায় কোনো অভিযানেই রাজপুতদের সঙ্গে নেওয়া হয়নি। এই সব ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে ঔরঙ্গজেব ধীরে ধীরে রাজপুতদের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং তা ক্রমে মাড়ওয়ার ও মেবারের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল। ওদিকে জামরুদে কিছু দিন । রোগভোগ করার পর ১৬৭৮ সালে মহারাজা যশবন্ত সিংহের মৃত্যু ঘটছিল।

মাড়ওয়ার ও মেবারের সঙ্গে বিবাদ

ঠিক কি কি কারণে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে মাড়ওয়ার ও মেবারের মতো দুই প্রধান। রাজপুত রাজ্যের বিবাদ দেখা দিয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে বির্তকের শেষ নেই। স্যার যদুনাথ সরকার একে ঔরঙ্গজেবের সংকীর্ণ ধর্মীয় নীতির ফলে রাজপুতদের সঙ্গে তার ক্রমাগত সম্পর্কের যে অবনতি ঘটছিল তারই পরিণতি বলে মনে করেন। তিনি বলেন যে ঔরঙ্গজেব মাড়ওয়ার রাজ্যটিকে দখল করতে বা দুর্বল করে দিতে চেয়েছিলেন কারণ তিনি যে জোর করে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার পরিকল্পনা করেছিলেন তার জন্যে প্রয়োজন ছিল যশোবন্তের রাজ্যকে স্থায়ী অধীনস্থ বা সাম্রাজ্যের নিয়মিত প্রদেশে পরিণত করে রাখা। যদুনাথ সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অনেক ঐতিহাসিকই নানা বক্তব্য রেখেছেন, তবে সাম্প্রতিককালে দুটি তৎকালীন তথ্যসূত্র আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে যা আমাদের এই বিষয়ে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করবে বলে মনে হয়। এই দুই সূত্র হল ফারসি লেখা ওয়াকাআজমের এবং রাজস্থানি গ্রন্থ যোধপুর হুকুমতরিবহি। প্রথমটি হল রাঠৌর বিদ্রোহের সময় রনথম্বর ও আজমেরে নিযুক্ত ও পরে রাজপুত যুদ্ধে মুঘল বাহিনীতে যুক্ত অনুচরের গোপন প্রতিবেদন। আর যোধপুর হুকুমতরিবহিতে যশোবন্ত সিংহের আমলে যোধপুর রাজ্যের ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে, বিশেষ করে মহারাজার মৃত্যুর পর দুর্গা দাস ও রানিদের দিল্লিতে আগমন এবং তারপর আবার মোধপুরে প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে সেখানে।

১৬৭৮ সালের ২৮ নভেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে মারা যাওয়া মহারাজ যশোবন্ত সিংহের কোনো জীবিত বংশধর ছিলেন না (বহি), তাঁর এক পুত্র পৃথ্বী সিংহ আগেই ১৬৬৭ সালে আগ্রাতে গুটিবসন্ত রোগে মারা গিয়েছিলেন, আর-এক পুত্র জগৎ সিংহ মারা গিয়েছিলেন ১৬৭৬ সালে। যশবন্ত সিংহের মৃত্যুর পর কে যোধপুরের গদ্দিতে বসবে তা নিয়ে জটিলতা শুরু হয়। ওদিকে মাড়ওয়ার রাজ্যে উত্তরাধিকার নির্ধারণের কোনো নিয়ন্ত্রণ বিধি ছিল না। জাহাঙ্গির বলতেন যে রাঠৌরদের মধ্যে অগ্রজ সিংহাসনে বসার নিয়ম সব সময় মানা হত না। যে সন্তানের জননী পিতার বেশি ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় হতেন তিনিই গদ্দির জন্য মনোনীত হতেন। এই হিসাবে ১৬৩৮ সালে মহারাজা গজ সিংহ নিজের জ্যেষ্ঠ সন্তান অমর সিংহকে সরিয়ে রেখে যশবন্ত সিংহকে মনোনীত করেছিলেন। অমর সিংহ মুঘলদের হয়ে খান-ই-জাহান লোদি ও দাক্ষিণাত্যে জহর সিংহের বিরুদ্ধে খুব উপযোগী পরিষেবা প্রদান করা এবং তার মনসব বাড়িয়ে ৩০০০/২৫০০ করে দেওয়া সত্ত্বেও শাহজাহান কিন্তু গদ্দিতে লোকবলহীন যশবন্তের মনোনয়নকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। অমর সিংহকে পার্শ্ববর্তী নাগোর অঞ্চলও যা আগে বিকানেরের রাও সুর সিংহের কাছে ছিল তা দান করা হয়েছিল। যশবন্ত সিংহের সংখ্যালঘু রাজত্বের সময়ে মাড়ওয়ারের প্রশাসনিক বিষয় দেখাশোনা করতেন মুঘল মনোনীত মহেশ দাস রাঠৌর এবং এ নিয়ে কোনো পক্ষই কোনো অভিযোগ করেনি।

যখন কোনো বংশধর না রেখে যশোবন্ত সিংহের মৃত্যু ঘটার খবর ১০ ডিসেম্বর আগ্রায় ঔরঙ্গজেবের কাছে এসে পৌঁছোয় তখন তিনি একটি আদেশনামা জারি করে যোধপুর সহ সমগ্র মাড়ওয়ার রাজ্যকে খালিসা জমিতে পরিণত করতে ও যশবন্তের সম্পত্তির তালিকা তৈরি করতে বলেন। তিনি নিজেও আজমের পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে সোজাত ও জৈতরন পরগনা দিল্লির রানিদের ঘনিষ্ঠ সর্দারদের অনুরোধে মৃত মহারাজার পরিবারকে দানও করা হয়েছিল। (বহি)

যোধপুরকে খালিসাজমিতে রূপান্তরিত করা হয়েছিল বলে যে তা মুঘল সাম্রাজ্যের ‘অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল তা কিন্তু নয়। যদিও সেখানে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক একটা শাখা করা শুরু করে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যোধপুর যথেষ্ট স্বতন্ত্রতা ভোগ করত। সে সময় এমন অনেক রাজ্য ছিল যেখানে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হলে তা মুঘল কর্তৃপক্ষ আপাত দখল নিয়ে নিত। যেমন ১৬৬৯ সালে রায় সিংহ যখন তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র সতরসলকে (ছত্ৰসল) উৎখাত করতে আক্রমণ। চালাচ্ছিলেন তখন মুঘলরা এই অঞ্চলটি দখল করে নিয়েছিল। সেখানকার রাজধানীর নাম পরিবর্তন করে ইসলামনগর করা হয়েছিল। কিছুদিন পর রাজ্যটি রায় সিংহের পুত্র তমাচিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘আনুগত্য ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ প্রয়োগ করার শর্তে। একই ঘটনা আমরা দেখি জয়সলমেরের ক্ষেত্রেও। ১৬৫০ সালে, অহেতুক কারণে রাওয়াল মনোহরদাসের মৃত্যুর পর রানি ও ভাটুরা মিলে রাওয়াল মালদেও-এর দ্বিতীয় পুত্র ভবানী সিংহের বংশধর রামচন্দ্রকে জয়সলমেরের সিংহাসনের জন্যে মনোনীত করেছিলেন। যদিও এই রাজ্যটি ইতিমধ্যেই শাহজাহান রাওয়াল সিংহের অষ্টম সন্তান খেতসির বংশধর সবল সিংহকে প্রদান করে দিয়েছিলেন। যশবন্ত সিংহকে এই জয়সলমেরে মুঘল মনোনীত শাসককে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সেনাবাহিনী সহযোগে নিয়োগ করা হয়েছিল এবং সে কাজ সফল করায় যশবন্ত সিংহকে পুরস্কারস্বরূপ পোখরানের জায়গির দান করা হয়েছিল।

উত্তরাধিকারিত্বের বিবাদ ছাড়াও যোধপুর সহ সমগ্র মাড়ওয়ার রাজ্য খালিসা জমিতে পরিণত করা ও আজমের অভিমুখে অগ্রসরের আরও কারণ ছিল। মহারাজার মৃত্যুর পর সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদার ও অন্য সকল জমি-সংক্রান্ত শক্তিগুলি রাজস্ব প্রদানে গড়িমসি করছিল। অনেক সময় রনথম্বর, সোজাত ও যোধপুরের মতো এলাকায় বিশৃঙ্খলও তৈরি হয়েছিল। তাছাড়া ফালেদি,পোখরানের মতো পরগনাগুলি যা এক সময় মহারাজাকে জায়গির হিসাবে দান করা হয়েছিল তা দখল করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিল পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো এবং তা দখল করতে তারা রীতিমতো শক্তি প্রদর্শনও করতে শুরু করেছিল। আহেমদাবাদ যাওয়ার রাস্তা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।

যশোবন্ত সিংহের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না, কারণ সে সময় ঋণগ্রস্ত অভিজাতদের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নিয়ম বলবৎ ছিল। বেশিরভাগ মুঘল অভিজাতের মতোই যশোবন্ত সিংহেরও রাষ্ট্রের কাছে ঋণ ছিল। ১৬৭২ সাল পর্যন্ত গুজরাটের শাসক থাকাকালীন তিনি সরকারের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ ঋণ নিয়েছিলেন এবং তাকে তা ফিরিয়ে দিতে বলা হয়েছিল বাৎসরিক দু’লক্ষ টাকার কিস্তিতে। শোনা যায় যশোবন্ত সিংহ নাকি টাকাপয়সার ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক ভাবে করতে পারতেন না। তিনি তার ভাগের বেশিরভাগ গ্রাম সর্দারদের পাট্টা হিসাবে দিয়ে দিয়েছিলেন আর কেবল ৩২ টা গ্রাম নিজের কাছে। নিজের খরচের জন্য রেখেছিলেন। ফলে তিনি সেই ঋণ আর জীবনে শোধ করতে পারেন নি। (ওয়াকাআজমের)

যশোবন্ত সিংহের মৃত্যুর পর মাড়ওয়ারের-র ওপর দাবি করতে শুরু করেন যশোবন্ত সিংহের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অমর সিংহের পৌত্র ইন্দ্র সিংহ ও অমর সিংহের কন্যার পুত্র অনুপ সিংহ। ইন্দ্র সিংহের যুক্তি ছিল অমর সিংহের প্রতি অবজ্ঞা করা হয়েছিল তার একটা সুবিচার হওয়া দরকার। তিনি তাই দাবি করেছিলেন যে আগের এই ভুল এবার শুধরে ফেলতে হবে। তিনি কুড়ি লক্ষ টাকা পেশকাশ দিতেও রাজি ছিলেন। অনুপ সিংহ আবার পঁচিশ লক্ষ টাকা পেশকাশ দিতে রাজি ছিলেন এবং সেই সঙ্গে যশোবন্ত সিংহের অধীনে থাকা এলাকা থেকে কুড়ি লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে মুঘল রাজকোষে জমা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। (ওয়াকাআজমের)

তখনও যোধপুরে বসবাসকারিনী যশোবন্ত সিংহের প্রধান রানি হাদি শহর ছেড়ে চলে যেতে অস্বীকার করেছিলেন, কারণ তার যুক্তি ছিল যে যোধপুর হল যশোবন্তের ওয়াতন, ফলে তার বংশধরদের সেই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া প্রথা বহির্ভূত। শুধুমাত্র যোধপুর পরগনা ছেড়ে মাড়ওয়ারের বাদবাকি পরগনা খালিসা জমিতে পরিণত করা হলে তার কোনো আপত্তি ছিল না বলে তিনি জানিয়েছিলেন। যশোবন্ত সিংহের আরও দুই রানি সন্তানসম্ভবা ছিলেন। তাই রানি হাদি যোধপুর ত্যাগ করতে দেরি করছিলেন। রানির এই দাবিকে রাঠৌরদের একটা শক্তিশালী গোষ্ঠী ও মেবারের রানা রাজ সিংহ সমর্থন জানিয়েছিলেন। রানা রাজ সিংহ হাদিকে সাহায্য করার জন্য তাঁর অন্যতম প্রধান সেনাপতি সানওয়াল দাসের নেতৃত্বে ৫০০০ অশ্বারোহী বাহিনী নিয়োগ করেছিলেন।

রানি হাদির দাবি এবং তার সমর্থনে রাঠৌরদের একটা শক্তিশালী গোষ্ঠী ও মেবারের রানার এগিয়ে আসা পরিস্থিতিকে বেশ ঘোরালো করে ছিল। ঔরঙ্গজেবের তরফ থেকে আজমেরের ফৌজদার ইফতিকার খানের বক্তব্য ছিল যে কোনো মহিলা বা কর্মচারীকে মনসব বা রাজ ক্ষমতা দেওয়া ঠিক নয়। তিনি অভিযোগ করে বলেছিলেন যে ‘দুই জায়গায় যশোবন্ত সিংহ নেমকহারামি করেছিলেন। তিনি ঔরঙ্গজেবের ইচ্ছা অনুযায়ী যশোবন্তের অনুগামীদের পাট্টা-গুলি রাজ পাট্টাবা জায়গির জমিতে রূপান্তরিত করার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন কারণ তা না করলে যোধপুর অন্য জনের কাছে হস্তান্তরিত হয়ে গেলে ওই পাট্টাগুলির সুফল আর মুঘলরা পেত না (ওয়াকাআজমের)। কিন্তু এদিকে রানিহাদির কথায় রাঠৌররা যোধপুর ছেড়ে দিতে অস্বীকার করে এমনকি দরকার হলে প্রতিরোধের রাস্তায় হাঁটতেও তারা প্রস্তুত ছিল।

রানি হাদি ও তার সমর্থকদের যোগ্য জবাব দিতে ঔরঙ্গজেব একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে ১৬৭৯ সালের ৯ জানুয়ারি দিল্লি ছেড়ে আজমেরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তিনি তাঁর পক্ষে যোগ দেবার জন্য আসাদ খান, শাইস্তা খান ও যুবরাজ আকবরকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এই বিশাল বাহিনীর সামনে দাঁড়াবার মতো কোনো অবস্থাই ছিল না রানি বা রানির সুমর্থকদের। ফলে রানি পিছু হটতে বাধ্য হন এবং যোধপুর প্রবেশ করে মুঘল বাহিনী। মহারাজার সম্পদ কোথাও লুকোনো রয়েছে কিনা তা ভালো করে খুঁজে দেখা হয়, সিওয়ানা দুর্গের চারপাশের মাটি খুঁড়ে খোঁজ চলে। যোধপুর ছাড়াও মাড়ওয়ারের অন্য সব পরগনাতে একজন কাজিও একজন মুহতাসিব সহ মুঘল আধিকারিকদের একটি পুরোদস্তুর দলকে নিয়োগ করা হয়। তবে তখনও যোধপুর দুর্গের অধিকার রানি হাদির হাতেই ছিল।

এর মধ্যে ২৬ ফেব্রুয়ারি খবর আসে লাহোরে মৃত মহারাজার রানিরা দুই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এই ঘটনা সমস্ত ছবি বদলে দেয়। যশোবন্তের বংশধর এসে যাওয়ায় তার পরিবারের দাবি এবার সমর্থন করেন বিকানেরের শাসক অনুপ সিংহ, রাজ বকশি খান-ই-জাহান সহ আরও অনেকে। চারিদিক থেকে দাবির চাপ এত জোরালো হতে শুরু করেছিল যে তা ঔরঙ্গজেবকে রীতিমতো অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। শেষমেশ ২৬ মে তিনি মাড়ওয়ারের গদ্দি ইন্দ্র সিংহকে ছত্রিশ লক্ষ টাকা পেশকাশএর বিনিময়ে দান করতে বাধ্য হন।

এর আগে ইন্দ্র সিংহের পক্ষে সিদ্ধান্ত আসছিল না দেখে রানি হাদি গোপনে একটি বিস্ময়কর প্রস্তাব দিয়ে বলেছিলেন যে যদি যশোবন্তের সন্তানের কপালে রাজটিকা দেওয়া হয় তাহলে রাঠৌররা নিজেরাই মাড়ওয়ারের সব মন্দির ভেঙে দেবেন (ওয়াকাআজমের)। তবে এই প্রস্তাব রানি নয়, দিয়েছিলেন যোধপুরের ফৌজদার তাহির খান। এই প্রস্তাব ঔরঙ্গজেব খারিজ করে দিলেও তার মনোভাব নিয়ে রাজপুত ও তার নিজ কর্মচারীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি দেখা দেয়। সবাই সম্রাটকে দোষ দিয়ে বলতে থাকেন যে তিনি নাকি যে-কোনো অজুহাতে ও সুযোগে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করতে আগ্রহী ছিলেন। তার ওপর ঔরঙ্গজেবের কিছু পদক্ষেপ যেমন, যোধপুর সহ মাড়ওয়ারের অন্য পরগনাতে কাজি ও মুহতাসিব নামক কর্মচারীদের নিয়োগ করা, আধিকারিকদের পূর্ণ দল ও দরকার হলে মন্দির ভাঙার জন্যে পাথর কাটাইয়ের লোককে কাজে লাগানো এবং আজমের অভিযানের পর ফিরে গিয়ে জিজিয়া কর পুনর্বহাল করা রাজপুতদের মনে আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছিল, ফলে পরবর্তী কোনো বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানো দুই পক্ষের কাছে খুব কঠিন হয়ে গিয়েছিল। এদিকে শেষ চেষ্টা হিসাবে রানি হাদি প্রস্তাব দিয়ে বলেছিলেন যে যোধপুর ইন্দ্র সিংহকে দান না করে তা খালিসারেখে দেওয়া হোক। (ওয়াকাআজমের)

যদি স্যার যদুনাথ সরকারের মত অনুসারে ঔরঙ্গজেব মাড়ওয়ারের মানুষকে ইসলামে রূপান্তরিত করে তাকে এক অধীনস্থ রাজ্যে পরিণত করতে চেয়ে থাকেন তাহলে তিনি রানি হাদির প্রস্তাব গ্রহণ করে মারওয়ারকে খালিসারেখে দিতে পারতেন। অথবা তিনি যশোবন্ত সিংহের কোনো এক সন্তানের নেতৃত্বে একটি সংখ্যালঘু প্রশাসন তৈরি করে রাজ্যটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দিওয়ান নিয়োগ করতে পারতেন, যেমনটা আগে কয়েকবার শাহজাহান করেছিলেন। কিন্তু ঔরঙ্গজেব এসব না করে সরাসরি মাড়ওয়ারের সিংহাসন তুলে দিয়েছিলেন ইন্দ্র সিংহের হাতে। রাজপুতদের এই ঘটনায় এই কারণে আপত্তি ছিল যে আগের নজির অনুযায়ী রাজার সরাসরি বংশধরকে সরিয়ে সম্রাট নিজের লোককে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে পারেন। এই ভাবে রাজপুতরা ঔরঙ্গজেবের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন যার রঙে মাড়ওয়ারে মন্দির ভাঙার মতো সম্রাটের অন্য পদক্ষেপগুলোও রাঙিয়ে গিয়েছিল।

১৫ এপ্রিল যশবন্তের দ্বিতীয় পক্ষের দুই সন্তান, তাদের মায়েরা ও দুর্গা দাস দিল্লি আসেন। রাজপুতরা আবার জোরালো ভাবে দুই সন্তানের দাবি তুলে ধরলেন। মির বকশি খান-ই জাহান, যিনি যশোবন্তকে সব সময় নিজের ভাই বলে মনে করতেন, তিনিও রাজপুতদের দাবিকে সমর্থন জানালেন। কিন্তু ঔরঙ্গজেব দুই পক্ষের দাবি মতো রাজ্যটিকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন। তাই যোধপুরের রাজা হিসাবে ইন্দ্র সিংহের কপালে রাজটিকা পরানোর আগে তিনি যশোবন্ত সিংহের অন্য পুত্র যিনি দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন, সেই অজিত সিংহকে মনসব প্রদান করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর পর আবার মনে করা হতে শুরু করেছিল যে অজিত সিংহের কাছে। সোজাত ও জৈতরন থাকা সত্ত্বেও তাকে সম্রাট দাক্ষিণাত্যের ৫০০ সৈন্যের একটি চৌকির নিয়ন্ত্রক করে দিয়ে নিজের কাজেই লাগিয়েছিলেন। (বহি)

উল্লেখ্য যে সোজাত ও জৈতরনের রাজস্ব আয় ছিল ৮ লক্ষ টাকা, যেখানে যোধপুর ও নাগোরের আয় ছিল ৬ লক্ষ টাকা। ফলে রাজ্যটিকে এভাবে ভেঙে দিলে যোধপুর সত্যিই খুব দুর্বল হয়ে পড়ত, আর আমরা যেমন আগে বলেছি যে ঔরঙ্গজেব রাজপুতদের কোথাও-না-কোথাও সীমাবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করছিলেন বলেই হয়তো এই পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন ঘুরপথে। দুর্গা দাসের নেতৃত্বে রাঠৌর সর্দাররা এই প্রস্তাবিত সমঝোতা তাদের রাজ্যের স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করে তা অস্বীকার করেছিল। প্রস্তাব মেনে নিতে অস্বীকার করায় ঔরঙ্গজেব প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এবং তিনি যুবরাজ ও তাদের জননীদের নূরগড়ের দুর্গে বন্দি করে রাখার আদেশ দেন। এই ঘটনা রাজপুতদের সতর্ক করে দেয় এবং তারা তুমুল যুদ্ধের পর একজন রাজপুত্রকে নিয়ে দিল্লি থেকে পালাতে সক্ষম হয়। অজিত সিংহ ও দুর্গা দাস নিরাপদে ফিরে এলে উৎসব শুরু হয় আর সঙ্গে শুরু হয় মুঘলদের বিরুদ্ধে রাঠৌর অভ্যুত্থান। যোধপুরে নিযুক্ত তাহির খানকে মেরতা পর্যন্ত তাড়া করে সরিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ইন্দ্র সিংহ যিনি যোধপুরের নিকটেই যে ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন তা ভেঙে দেওয়া হয় এবং মাড়ওয়ার সংকটের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। রাঠৌররা যোধপুরে সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে যশবন্তের দুই সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সন্তানকে অজিত সিংহ উপাধি দিয়ে রাজটিকা প্রদান করা হয়। সাফল্যের জোয়ারে ভেসে রাঠৌররা জৈতরন ও সিওয়ানা সহ অন্য একাধিক এলাকা থেকেও মুঘল আধিকারিকদের উৎখাত করে দিয়েছিল। তবে মেরতা থেকে মুঘল ঘাঁটি সরাতে রাঠৌররা ব্যর্থ হয়েছিল।

ঔরঙ্গজেব এবার হয়তো রাজপুতদের কড়া শিক্ষা দেবার কথা ভাবছিলেন। তাই তিনি শরবুলন্দ খানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী বাহিনীকে যোধপুরের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। দূরদূরান্তের প্রদেশ থেকে প্রচুর সংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়। কিছু দিনের মধ্যে ইন্দ্র সিংহকে গদ্দি থেকে অপসারিত করা হয় এই কারণ দেখিয়ে যে তিনি রাজ্য শাসন করতে ও বিশৃঙ্খলা দূর করতে একেবারেই ব্যর্থ। মুঘল খবরাখবর দানকারীর প্রতিবেদন অনুসারে ‘ইন্দ্র সিংহের চারপাশের ছোটো-বড়ো সব মানুষই তাকে ঘৃণা । করে এবং তারা সম্পূর্ণ ভাবে তার বিরোধী। ইন্দ্র সিংহকে সরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ অজিত সিংহের সঙ্গে সমঝোতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল, ঔরঙ্গজেবের অবস্থান ইন্দ্র সিংহকে স্বীকৃতি দেবার আগের জায়গায় চলে এসেছিল এবং রানি হাদির দেওয়া প্রস্তাব এবার অনেক বেশি সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছিল যে যশবন্তের সন্তানের দাবি না মানা পর্যন্ত যোধপুরকে খালিসা জমির আওতায় রাখা হোক।মহারাজরা যে সন্তানকে রাঠেীররা আগ্রাতে রেখে চলে এসেছিল সেই সন্তানকে ঔরঙ্গজেব ইসলামে রূপান্তরিত করে নাম দেন মহম্মদি রাজ এবং হারেমএ দেখাশোনার জন্যে পাঠান। এটা তাঁর কোনো ভয়ংকর অভিসন্ধির অঙ্গ ছিল না, কারণ একটা পরিচিত নিয়ম ছিল যে কোনো রাজার সন্তান যদি ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ধর্ম পরিবর্তন করেন তাহলে তিনি সিংহাসনের ওপর আর কোনো দাবি করতে পারতেন না। একই ভাবে জুঝর সিংহ বুন্দেলাকে পরাজিত করার পর শাহজাহান তার আত্মীয় দেবী সিংহকে গদ্দি-র অধিকার দান। করেছিলেন এবং জুঝর সিংহের পুত্রদের হয় খুন করেছিলেন না হলে ইসলামে রূপান্তরিত করেছিলেন যাতে তারা আর জীবনে কোনোদিন গদ্দি-র অধিকার দাবি না করতে পারে।

যদিও কিছুদিনের জন্য ঔরঙ্গজেব এই দাবি তুলেছিলেন যে দুর্গা দাসের সঙ্গে পালিয়ে আসা মহারাজার আর-এক সন্তান অজিত সিংহ নাকি আসল সন্তান নয় (অর্থাৎ জালি বাচ্চা)। ফলে তিনি তার সঙ্গে কোনোরকম আলোচনায় বসতে চাননি। আগস্টে আজমেরের কাছে ফৌজদার তহউর খানের সঙ্গে এক সমঝোতায় রাঠৌররা মুঘলদের সঙ্গে আর বেশি সংঘর্ষে যেতে অনিচ্ছুক হওয়ায় মরু অঞ্চলে নিজে থেকেই সরে যেতে রাজি হয়েছিল আর সেখান থেকেই বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ চালানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ঔরঙ্গজেব নিজে আজমের পৌঁছেছিলেন। তারপর কিছুদিনের মধ্যে মাড়ওয়ারের প্রতিরোধ দমন করা হয় এবং রাঠৌরদের রাজধানী যোধপুর দখল করে নেওয়া হয়। এমনকি কিছুদিন পরে রানি হাদিও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন এবং তাঁকে ভরণপোষণের জন্য বারান পরগণা দান করা হয়। অজিত সিংহের সঙ্গে দুর্গা দাস মেবারের দিকে পালিয়ে যান এবং সেখানে তাদের আশ্রয় দেন রানা। তাদের সেখানে জায়গিরের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল বলে জানা যায়।

মেবার

যদি রাঠৌরদের উচ্ছেদের পর মেবারের রানা রাজ সিংহ সাহায্য না করতেন, উৎসাহ না দিতেন, তাহলে কখনোই তারা মুঘল-বিরোধী আন্দোলন প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে পারত না। রাজস্থানের সব রাজ্যের মধ্যে একমাত্র মেবারই ছিল এমন একটি রাজ্য যাদের আয়তন, চড়াই-উতরাই এবং ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে মুঘলদের টক্কর দেবার ক্ষমতা ছিল। যদিও ১৬১৫ সালে রানা অমর সিংহ মুঘলদের কাছে। আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তবুও রানারা সীমানা থেকে আগ্রার আগে পর্যন্ত সমগ্র দক্ষিণ ও পূর্ব রাজপুতানা জুড়ে অবস্থিত ছিল। আকবর ও তার উত্তরসূরিদের আমলে মাড়ওয়ার, বিকানের ও আম্বেরের মতো রাজ্যগুলি মেবারকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল। মুঘল সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এই রাজ্যের শাসকেরা নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিকে যেমন সুদৃঢ় করে তুলেছিলেন তেমনি স্থানীয় রাজা ও জমিদারদের কবল থেকে অনেক অধীনস্থ জমি মুক্ত করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। অপরপক্ষে মেবারকে কোনো সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়নি। অন্যদিকে চিতোরের ওপর সামান্য অসন্তুষ্ট থাকলেও মুঘল নীতি অনুসারে হারাউতি এবং বানসওয়াড়া, দুর্গাপুর, প্রতাপগড়, দেবালিয়া প্রভৃতি মেবারের দক্ষিণ দিকের সীমান্তবর্তী কয়েকটি রাজ্যকে রীতিমতো স্বাধীন রাজ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। মেবারের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে ১৬৫৪ সালে শাহজাহান আবার মেবারের কয়েকটি পরগনা চিতোরের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গের শাস্তি হিসাবে কেড়ে নিয়েছিলেন। চারিদিক থেকে একঘরে হয়ে গিয়ে রাজপুতানায় মেবারের গৌরব ম্লান হতে শুরু করেছিল। মেবারের এই শোচনীয় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ঔরঙ্গজেব রানা রাজ সিংহকে নিজের উত্তরাধিকারিত্বের যুদ্ধে কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি রানাকে অনেক কিছু ছাড় দিলেও (রানা) সংগ্রাম সিংহের মতো ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ফিরিয়ে দেবার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রানা রাজ সিংহকে তা পূরণের কোনো চেষ্টাই করেননি। ক্ষুব্ধ হয়ে রানা রাজ সিংহ ঔরঙ্গজেবের শিবির ছেড়ে চলে যান এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সঞ্চয় করতে শুরু করেন। এ দিকে যশবন্ত সিংহ ও মির্জা রাজা রায় সিংহের নেতৃত্বে মাড়ওয়ার ও আম্বের সবথেকে শক্তিশালী রাজপুত রাজ্যে পরিণত হয় এবং ক্রমাগত নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে থাকে।

মাড়ওয়ারে উত্তরাধিকারিত্বের বিবাদ শুরু হওয়ায় তার সুযোগে রানা রাজ সিংহ রাজপুত দুনিয়ার মেবারের গুরুত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে মাড়ওয়ারের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজ্যের উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত বিবাদ তখনই মিটতে পারে যদি মেবারের রানার মতো কোনো প্রথম সারির রাজপুত শাসক সাহায্য করে। অথবা তিনি হয়তো এই আশাও করেছিলেন যে তার শ্যালিকা রানি হাদির প্রশাসন জরুরি অবস্থায় সাহায্য ও উপদেশ করতে হয়তো তাকে ডাকা হতে পারে। ফলে মাড়ওয়ারের বিবাদে মেবারের রানার হস্তক্ষেপ করার সেখানে প্রাধান্য বিস্তার করার কোনো অভিসন্ধি ছিল বলে মনে হয় না। তিনি কেবল রাজার দুই অন্য পক্ষের সন্তান জন্ম ও ইন্দ্র সিংহের দাবি শক্তিশালী হওয়ার আগে পর্যন্ত রানি হাদিকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। রানার এই তৎপরতাকে ঔরঙ্গজেবের হিন্দু মন্দির ধ্বংসসাধন ও জিজিয়া কর পুনর্বহাল করে হিন্দু ধর্মের ওপর আতঙ্ক সৃষ্টি করার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার নিদর্শন হিসাবে দেখাও বোকামো হবে। এটা ভাবাও বোধ হয় ঠিক হবে না যে অজিত সিংহের মাতার সঙ্গে রানার কোনো সম্পর্ক ছিল। অজিত সিংহের মাতা ছিলেন কারাউলির রাজা ছত্র মানের পৌত্রী এবং ভোপালের সেনাপ্রধানের কন্যা ছিলেন। ফলে রানার সঙ্গে অজিত সিংহের কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত ছিল বলে মনে হয় না।

যেভাবে মেবার মাড়ওয়ারের ঘরোয়া সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল তাতে মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধ মাড়ওয়ার থেকে মেবারে ছড়িয়ে পড়বে। দুই পক্ষই এই ব্যাপারে সচেতন ছিল। মহারানা চিতোর দুর্গ ঘিরে ফেলেন এবং উত্তর দিক থেকে মেবারের রাজধানী উদয়পুর পর্যন্ত দেবারি গিরিপথকে বন্ধ করে দেন। ঔরঙ্গজেবের বিশাল বাহিনী সহযোগে আজমেরে আগমন ও কয়েকজন যুবরাজ সহ গুরুত্বপূর্ণ সেনানায়কদের তলব করার পশ্চাতে প্রধান কারণ ছিল যাতে কোনোভাবেই যুদ্ধ মেবারে ছড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করা।

প্রথম ধাক্কাটা দিলেন ঔরঙ্গজেব নিজেই, ১৬৭৮ সালের নভেম্বর মাসে তিনি নিজেই মেবারের দিকে অগ্রসর হলেন। হাসান আলি খানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী বাহিনী উদয়পুর পর্যন্ত প্রবেশ করেছিল, এমনকি মেবারের শিবিরের একেবারে মাঝখানে অতর্কিত হানা দিয়েছিল তারা। রানা সমতল ও রাজধানী ত্যাগ করে গভীর পাহাড়ি এলাকায় গা ঢাকা দিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে মুঘলদের যোগ্য জবাব দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন। এরপর ঔরঙ্গজেব আজমেরে ফিরে এসেছিলেন এবং তার পুত্রেরা ও কয়েকজন সেনাপ্রধান মিলে রানাকে পাহাড়ে বন্দি রেখে সমগ্র সমতল দখল করে নিয়েছিলেন। মেবারের যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তা রাজপুতানায় দ্বিতীয় বিক্ষোভের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ওদিকে রাঠৌরদের বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধও অব্যাহত ছিল।

এবার যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল অর্থাৎ পাহাড়ি ফাঁক-ফোকর থেকে অতর্কিত আক্রমণ, তা মুঘলদের কাছে পরিচিত ছিল না। পাহাড়ি চড়াই-উতরাই, স্থানীয় জ্ঞান ও স্থানীয় সমর্থন সবটাই রাজপুতদের পক্ষে ছিল। রাজপুতদের পাহাড়ি এলাকায় তাড়া করে ধরতে মুঘল সেনা ও সেনাপতিরা কোননামতেই ইচ্ছুক ছিলেন না। ঔরঙ্গজেব কেবল তাঁর সেনাদলকে সতর্ক ও ভয় দেখানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারলেন না। যুদ্ধ সমান জায়গায় চলে গেলে ইন্দ্র সিংহ নতুন করে তার দাবি উত্থাপন করেন এবং বলেন যে যদি ঔরঙ্গজেব তাঁকে মাড়ওয়ারের গদ্দি ফিরিয়ে দেন তাহলে এখানে মুঘলদের সব সমস্যার অবসান ঘটবে। (ওয়াকাআজমের)

ঔরঙ্গজেব এবার মেবারকে শায়েস্তা করতে একটা পরিকল্পনা করলেন। দেসুরি গিরিপথ বরাবর পশ্চিম দিকে কুম্ভলমের অঞ্চলে মহারানার প্রধান দুর্গে তিনি হানা দিলেন। পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে যুদ্ধ করা মুঘলদের পক্ষে সব সময়েই একটু সমস্যার ছিল। ফলে এই বক্তব্য সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে যে ঔরঙ্গজেব রানাকে কয়েকদিনের মধ্যেই তার পায়ের নিচে এনে ফেলেছিলেন এবং এ কাজে তিনি আকবর ও জাহাঙ্গিরকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। মুঘলদের গতিবিধি ছিল মূলত সেখানে ধীরস্থির ভাবে অগ্রসর হওয়া। রানা এরপর মুঘলদের সঙ্গে সন্ধি করতে আগ্রহ দেখান। রাঠৌররাও অজিত সিংহকে মাড়ওয়ারের গদ্দি-তে বসানোর দাবি তোলে এবং বলে যে যদি তাদের এই দাবি মানা হয় তবে মাড়ওয়ারে শান্তি বজায় থাকবে। এই সব কথাবার্তা চলছিল তাহাউর খানের তত্ত্বাবধানে, কিন্তু ঔরঙ্গজেব তাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।

এই সময় রানা রাজ সিংহ মারা যান (সেপ্টেম্বর, ১৬৮০)। তার মৃত্যুর পর সিসোদিয়া ও রাঠৌরদের মধ্যে একতার বন্ধন ছিঁড়ে যায়। আগেও রানা ও রাঠৌরদের মধ্যে বিবাদ হয়েছিল, গুজরাট আক্রমণে দুর্গা দাস কুনওয়ার ভীম সিংহের সঙ্গে যেতে অস্বীকার করেছিলেন এবং গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করতে রাজি হননি এই কারণে যে এভাবে খোলামেলা যুদ্ধ করা রাজপুতদের রীতি। দুর্গা দাসের তরফ থেকে সোনক ভাটি মুঘলদের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন যে মেবার থেকে গোরওয়ারকে বাদ দেওয়া উচিত এবং তা যোধপুর হারের ক্ষতিপূরণ হিসাবে অজিত সিংহকে জায়গির হিসাবে দান করা উচিত। নতুন রানা জয় সিংহ এই সব গোপন প্রস্তাব সম্পর্কে জানতেন বলে অজিত সিংহ সম্পর্কে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না।

১৬৮১ সালের জানুয়ারি মাসে যুবরাজ আকবর বিদ্রোহ করেছিলেন এবং দুর্গা। দাস ও তাহাউর খানের সহায়তায় তিনি আজমের জয় করে মহারাষ্ট্রে অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায় যে ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির কোথাও-না-কোথাও গলদ ছিল, নাহলে রাজপুত ছাড়াও তার নিজ অভিজাতদের একটা অংশ তার বিরুদ্ধে চলে যেতেন না। তবে আকবরের বিদ্রোহ ভেঙে পড়ার মধ্য দিয়ে এটাও বোঝা গিয়েছিল যে খুব কম অভিজাতই ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো বৃহত্তর বিক্ষোভে শামিল হতে সাহস পেয়েছিল, কারণ তারা সকলে খুব ভালো করে জানত যে তখনও পর্যন্ত রাজতন্ত্র ও সকল সুযোগ-সুবিধার কাণ্ডারি ছিলেন ঔরঙ্গজেব।

যুবরাজ আকবরের বিদ্রোহের ফলে ঔরঙ্গজেব রাজপুত নীতির কোনো পরিবর্তন সুচিত হয়নি। রানা জয় সিংহ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু ঔরঙ্গজেব তার ওপর বেশ কড়া শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিলেন। মহারানাকে বাধ্য করা হয়। জিজিয়া কর না দেবার কারণে মণ্ডল, বিন্দুর ও মণ্ডলগড় পরগনা দখল করতে এবং রাঠেীরদের সমর্থন না করার প্রতিশ্রুতি দিতে। সেই সঙ্গে মনসব ৫০০০ থেকে বৃদ্ধি করে ৬০০০ করার প্রেক্ষিতে রাজ সিংহকে যে দুঙ্গারপুর, দেবালিয়া প্রতি অঞ্চল দান করা হয়েছিল, তাও কেড়ে নেওয়া হয়। এই সব শর্ত মানার প্রতিদানে জগৎ সিংহকে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং ৫০০০/৫০০০ মনসব দান করা হয়। অজিত সিংহের ক্ষেত্রে তার আগের দাবি বিবেচনা করা হয় এবং বলা হয় যে যখন তিনি সাবালক হয়ে যাবেন তখন তাকে ক্ষমতা ও মনসব দুই দেওয়া হবে।

১৬৮১ থেকে ১৭০৭–এই সময়টা মুঘলদের সঙ্গে রাজপুতানার সম্পর্কের ক্ষেত্রে একেবারেই শীতল হাওয়া বয়ে এনেছিল। এই সময় রাঠৌর যুদ্ধ অব্যাহত ছিল এবং মাঝে মাঝে তারা তার জোরও বাড়াচ্ছিল। সবথেকে সুখের পর্ব ছিল ১৬৮১ সাল। থেকে ১৬৮৬ সাল পর্যন্ত সময় যখন দুর্গা দাস যুবরাজ আকবরের সঙ্গে মহারাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন আর অজিত সিংহ সিরোহিতে মুখ লুকিয়েছিলেন। এই সময় সব নেতাই একে ওপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের মতো করে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৬৮৬ সালে দুর্গা দাস মাড়ওয়ারে ফিরে এলে এবং অজিত সিংহ বিক্ষোভ আন্দোলনের নেতা হিসাবে উঠে এলে রাঠৌররা নব শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ জয় করেছিল। কিন্তু যোধপুরের ফৌজদার তথা ১৬৮৯-১৭০১ পর্যন্ত নিযুক্ত গুজরাটের শাসক একজন বলিষ্ঠ ও সাহসী যোদ্ধা সুজাত খানের নেতৃত্বে রাঠৌরদের আবার কোণঠাসা করে দেওয়া হয়। মুঘলদের সঙ্গে দুর্গা দাসের সমঝোতা ১৬৯২ সাল থেকে আস্তে আস্তে দানা বাঁধতে শুরু করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৬৯৬ সালে মেবারের রানা তার ভাগ্নির সঙ্গে অজিত সিংহের বিবাহ দিলে ঔরঙ্গজেবের দেওয়া শর্ত ভেঙে যায়। ১৬৮১ সালে মাড়ওয়ারে রেখে যাওয়া শাহজাদা আকবরের কন্যাকে এ সময় রাঠৌররা সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য ঔরঙ্গজেবের কাছে ফিরিয়ে দেন। কোনো বৃহত্তর চুক্তি না হলেও ঔরঙ্গজেব এবার অজিত সিংহের দাবিও মেনে নিতে রাজি হয়ে যান। অবশেষে ১৬৯৮ সালে অজিত সিংহ ইতস্তত করেও যোধপুরে মুঘল, অধিকার মেনে নেন এবং নিজে মাড়ওয়ারের শাসক হয়ে মনসব লাভ করে খুশি হয়ে যান। যদিও তিনি যোধপুর নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং ১৭০১ ও ১৭০৬ সালে তা দখলের জন্য বিদ্রোহও শুরু করেছিলেন, তবুও তিনি সাফল্য পাননি।

মেবারের রানারও ইচ্ছা পূরণ হয়নি। রানার মনসবের জন্য প্রয়োজনীয় ১০০০ ঘোড়ার দল সরবরাহের আগে তিনি দাবি করেছিলেন মণ্ডল, বিন্দুর ও মণ্ডলগড় পরগনা যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ১৬৮৪ সালে ঔরঙ্গজেব পরগনাগুলি ফিরিয়ে দেন, কিন্তু মহারানাকে জিজিয়া কর বাবদ বাৎসরিক এক লক্ষ টাকা প্রদানের জন্য বাধ্য করা হয়। এ থেকে পরবর্তী ঝামেলার সূত্রপাত হয়। ১৭০২ সালে মেবার থেকে ১০০০ ঘোড়া গুজরাটে এসে পৌঁছায়। কিন্তু মণ্ডল, বিন্দুর ও মণ্ডলগড়ের প্রশ্নই ঝামেলার। মূল কারণ হিসাবে দেখা দেয়। রানা নতুন করে দুঙ্গারপুর, বানসওয়াড়া প্রভৃতি অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে মুঘল সম্রাটের কাছে অভিযোগ গিয়ে পৌঁছায়। ঔরঙ্গজেবের নীতিতে যে ভুল হচ্ছিল তার প্রমাণ মেলে আবারও। সম্রাটের সবথেকে প্রিয় সন্তান। ও সম্ভবত ভবিষ্যতের সম্রাট যুবরাজ আজম রানার সঙ্গে গোপনে চুক্তি করেন এবং উত্তরাধিকারের যুদ্ধে তাঁকে সাহায্য করার বিনিময়ে তিনি রানাকে সমস্ত পরগনা ফিরিয়ে দেওয়া ও জিজিয়া কর মুকুব করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

মাড়ওয়ার ও মেবারের সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের বিবাদ কিন্তু সামগ্রিক ভাবে মুঘলদের সঙ্গে রাজপুতদের বিবাদ ছিল না। আম্বের, বিকানের, বুন্দি কোটার শাসকেরা মুঘল সেনাবাহিনীতে যুদ্ধ করেছেন ১৬৭৯ সালের পরেও। ১৬৮৮ সালে রাম সিংহের মৃত্যুর পর বিকানেরেরে রাজা বিশান সিংহকে ৩০০০ মনসব দান করা হয়েছিল এবং জাটদের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা থাকায় তাকে মথুরার ফৌজদারি পদে নিয়োগ করা হয়েছিল। বিকানেরের রাজা অনুপ সিংহ ও তাঁর পুত্র কেশরী সিংহ এবং বুন্দির রাও ভাও ও তাঁর পুত্র তথা উত্তরসূরি অনিরুদ্ধ সিংহ মুঘলদের হয়ে দাক্ষিণাত্যে ও জাটদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, কিশোর সিংহকে মনসব বাড়িয়ে ২৫০০/ ৩০০০ করা হয়েছিল। আর কোনো রাজপুত রাজার মনসব ৩০০০ জাটের অধিক যায়নি। বিশান সিংহের উত্তরসূরি জয় সিংহ ১৬৯৮ সালে দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের হয়ে কাজ করেছিলেন এবং তাকেও ২০০০/২০০০ (১০০০ দুআসপা সিহআসপা) মনসব দান করা হয়েছিল। খেলনা দুর্গ অবরোধ করার ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট তৎপরতা। দেখিয়েছিলেন এবং যুবরাজ বিদর বখতের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু ঔরঙ্গজেব যুবরাজের পরামর্শ অনুযায়ী জয় সিংহকে মালবের শাসক নিয়োগ করার প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিলেন।

যেভাবে আম্বের, বিকানের ও হারাউতি মুঘলদের হয়ে কাজ করেছিল এবং রাজকীয় মনসব লাভ করেছিল, তাতে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে মাড়ওয়ার ও মেবারের সঙ্গে একের-পর-এক যুদ্ধের ফলে রাজপুতদের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তোলার যে নীতি আকবর নিয়েছিলেন তা থেকে ঔরঙ্গজেব সরে এসেছিলেন। বরং সেই নীতিকে আরও বৃহত্তর নীতির সঙ্গে যুক্ত করে স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা চলছিল পুরোদমে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই সময় ধীরে ধীরে মারাঠাদেরও উত্থান ঘটছিল।

তবে এই যুদ্ধ মুঘল ও রাজপুতদের মধ্যে সম্পর্কের ধরনটা বদলে দিয়েছিল। প্রথমে ঔরঙ্গজেব রাজপুতদের সাম্রাজ্যের অংশীদার বলে মনে করতেন, তাদের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ সব পদ দেওয়া হত। জয় সিংহ ঔরঙ্গজেবের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন এবং নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। এই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তিক্ততায় পরিণত হয়েছিল এবং জয় সিংহের মৃত্যুর পর রাজপুতদের পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম দিকের সীমান্ত এলাকায় পাঠিয়ে দিয়ে তাদের জমি দান করার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও তাদের তখনও সাম্রাজ্যের তরবারি-হাতিয়ার হিসাবেই ভাবা হত। ১৬৭৯ সালের পর দাক্ষিণাত্যে রাজপুতদের সামরিক কার্যকলাপ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারা মিত্র হিসাবে বিবেচিত হলেও তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ জেগে গিয়েছিল। তাই আকবরের সময়ে রাজপুত-মুঘল সম্পর্ক যদি বইয়ের উপরের পাতা হয়, তাহলে ঔরঙ্গজেবের সময় সে সম্পর্ক বইয়ের একেবারে নিচের পাতা ছিল।

সম্পর্কের এই পরিবর্তন কি ঔরঙ্গজেবের সংকীর্ণ ধর্মীয় নীতি ও তার সন্দেহবাতিক। চরিত্রের কারণেই ঘটেছিল? দুটি কারণই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল, মাড়ওয়ার ও মেবারের প্রতি ঔরঙ্গজেবের মনোভাব কোনো নির্ধারিত নীতির তুলনায় অনেক বেশি সন্দেহবাতিক ও বিদ্বেষপূর্ণ ছিল। অনেকে বলেন যে যেভাবে মুঘলদের সাম্রাজ্য উত্তর ভারতে বিস্তার লাভ করছিল ও দাক্ষিণাত্য জয়ের গুরুত্ব কমে যাচ্ছিল, অনেক বেশি স্থানীয় ভূমধ্যধিকারী শ্রেণির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা হচ্ছিল এবং বিশেষ করে মারাঠাদের অভিজাতন্ত্রে জায়গা করে দেওয়া হচ্ছিল, তাতে রাজপুতদের সঙ্গে মিত্রতার প্রয়োজন। প্রায় ফুরিয়ে গিয়েছিল। রাজপুত রাজাদেরও বোধ হয় মুঘলদের সঙ্গে মিত্ৰতা করার থেকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামলানো অনেক বেশি জরুরি ছিল এবং ওয়াতন ছাড়াও রাজস্থানের বাইরে জায়গির জমি বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করার প্রয়োজন ছিল। রাজপুতদের গুরুত্ব হ্রাসের কারণ অনেকটা লুকিয়ে ছিল শাহজাহান, ও ঔরঙ্গজেবের আমলে জয় সিংহ ও যশবন্ত সিংহের দরবারে ব্যক্তিগত প্রতিপত্তি লাভের মধ্যে। শাহজাহানের সময় থেকে মারাঠারা রাজকার্যে উৎকর্ষতার বিচারে রাজপুতদের ছাপিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শিবাজির সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হলে এবং দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের নীতির অনিশ্চয়তা দেখা দিলে মারাঠারা নিজেদের মতো করে শক্তি সঞ্চয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

মুঘলদের সঙ্গে মাড়ওয়ার ও মেবারের বিবাদের প্রভাবকে বেশি করে দেখানোর কিছু নেই। ১৬৮১ সালে রানার সঙ্গে চুক্তির পর যে মাত্রায় ওই অঞ্চলে সামরিক কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল তা মুঘলদের অন্য সব সামরিক অভিযানের থেকে কম ছিল বা হয়তো অনেকে চলে গিয়েছিল। তাছাড়া এই বিবাদের জেরে ওই অঞ্চলের স্থলপথে ক্যাম্বে বন্দরের সঙ্গে বাণিজ্যের কোনো প্রভাব পড়েছিল বলে জানা যায় না।

আমরা স্যার যদুনাথ সরকারের সঙ্গে একমত হয়ে বলতে পারি যে ‘রাজপুত নীতির ফলে ঔরঙ্গজেবের যা ক্ষতি হয়েছিল, তা ওই মরু জমিতে যে মানুষ ও অর্থ তিনি এনেছিলেন তা দিয়ে মাপা সম্ভব হবে না। রাজপুত রাজ্যগুলোর সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতা সম্রাটের গরিমাকে ম্লান করেছিল এবং আইনশৃঙ্খলাবিহীন এলাকার পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সর্বোপরি এই ঘটনা ঔরঙ্গজেবের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল, সেই সঙ্গে অ-মুসলমানদের প্রতি তার কর্মচারীদের মনোভাব কতটা স্বচ্ছ ছিল সে নিয়েও সন্দেহ জাগিয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনা দেশে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধর্মীয় মতানৈক্যের বাতাবরণ তৈরি করেছিল ও বিভিন্ন যুবরাজরা রাজপুতদের সঙ্গে আঁতাত করে নিজেদের গোষ্ঠী গড়ে তুলতে উৎসাহ পেয়েছিল।

১. বারাণসীর ফরমানটি রাখা আছে কলকাতার ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে, আর বৃন্দাবন ফরমানটি রখা আছে বর্তমানে জয়পুরের একটি মন্দিরে।

২. এর মধ্যে ছিল পাঁচটি ক: কেশ, কৃপাণ, কারা, কঙ্গো এবং কাচ্ছা আর সিং পদবি গ্রহণ করা, তামাকজাত দ্রব্য সেবন নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি।

১৭০৮-৯ সালে বান্দার অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কাফি খান বলেছিলেন, যে গুরুর হয়ে অর্থ সংগ্রহ করত যে মসন্দরা তাদের শহর থেকে উৎখাত করার ও তাদের মন্দির ভেঙে দেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব। এই আদেশ ঠিক কবে দেওয়া হয়েছিল সে ব্যাপারে কিছু যানা যায় না এবং অন্য কোনো ঐতিহাসিক তথ্যে এই ঘটনার উল্লেখও পাওয়া যায় না। যদি এই আদেশ সত্যিই কার্যকর হত তাহলে আজ আর শিখদের পবিত্রতম হরমন্দির বা অন্য সব গুরুদোয়ারা আস্ত থাকত না।

৩. ওয়াকা-আজমের, আসাফিয়া লাইব্রেরি, হায়দ্রাবাদ, সঙ্গে আগিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত বিশেষ চিত্র (rotography) হুকুমত-রিহবি (সঙ্গে ইংরাজিতে সারাংশ), সম্পাদনা, সতীশ চন্দ্র, রঘুবীর সিংহ, জি.ডি. শর্মা, মীনাক্ষী প্রকাশনা, দিল্লি, মিরাট, ১৯৭৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *