০৯. মুঘলদের বৈদেশিক নীতি

নবম অধ্যায় – মুঘলদের বৈদেশিক নীতি

উজবেক, সাফাবিদ ও অটোমান–যোড়শ শতকে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার এই তিন শক্তিশালী সাম্রাজ্যের অবস্থান মুঘলদের সঙ্গে এদের কুটনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের একটা নিখুঁত ধারার বিকাশের পথ প্রশস্ত করেছিল। বৈদেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার প্রাথমিক পদ্ধতি ছিল রাষ্ট্রদূত আদান-প্রদান। এই ধরনের দূত আদান-প্রদানের ব্যবস্থা অনেকটাই নির্ভর করতে বিদেশে রাষ্ট্রদূত, যাদের বলা হত এলচি বা সাফির, এদের দূতাবাস থাকা বা না থাকার ওপর। রাষ্ট্রদূতদের সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হত, যথা অসাধারণ ও সাধারণ। অসাধারণ রাষ্ট্রদূতকে অবশ্যই হয় একজন প্রথম সারির যাজক বা উচ্চপদের অভিজাত বা কোনো রাজপরিবারের সদস্য হতে হত। রাষ্ট্রদূতের কাজ ছিল তিনি যে দেশে থাকবেন সে দেশের শাসকের কাছে তার প্রভুর একটি আবেদনপত্র নিয়ে যাওয়া। পত্রে হয় তার প্রভুর সাম্প্রতিক রাজ্যস্তরের কীর্তি উল্লেখিত থাকত, না হলে তার নিজ দেশের গুরুত্বপুর্ণ উন্নতিও মিত্রতার বাতাবরণ, সহায়তার প্রতিশ্রুতি, সাহায্যের আর্তি বা হুমকির কথা লেখা থাকত। চিঠিতে সংশ্লিষ্ট শাসককে সম্পর্ক অনুযায়ী নানা সম্বোধন করা হত।

রাষ্ট্রদূত প্রেরণের অভিযান ছিল এক এলাহি ব্যাপার। শতাধিক ভারবাহী ভৃত্য, দাস সঙ্গে যেত, সেই সঙ্গে থাকত কৃষকদের একটা দল যারা দেশের ফসল ও দুর্লভ সব জিনিস বয়ে নিয়ে যেত। যে দেশের উদ্দেশ্যে এই অভিযান প্রেরণ করা হত সেই দেশে একবার এই সম্ভার পৌঁছে গেলে বাদবাকি খরচ ও নিরাপত্তার দায়দায়িত্ব সামলাতে হত সংশ্লিষ্ট দেশকেই। তারপর রাষ্ট্র এই দূতকে স্বীকৃতি প্রদান ও সম্রাটের। সঙ্গে সাক্ষাতের যে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করত তা ছিল দেখার মতো। এ সবের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর পৌঁছে যেত সংশ্লিষ্ট দূত প্রেরণকারী রাষ্ট্রের কাছে। রাষ্ট্রদূত যে উপহার সামগ্রী নিয়ে আসত তা ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নেওয়া হত। অনেক সময় দূতকে রাষ্ট্রের তরফ থেকে গ্রহণ ও আপ্যায়ন করার আগে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হত। এই ধরনের অভিযানের যেমন কোনো পূর্ব নির্ধারিত সময় থাকত না, তেমনই অভিযান সেরে ফেরারও কোনো দিন ঠিক করা থাকত না। অনেক সময় রাষ্ট্রের তরফ থেকে ছাড় পেতে রাষ্ট্রদূতদের বছরের-পর-বছরও অপেক্ষা করতে হত। এই সময় প্রধান রাষ্ট্রদূত তার নিজ দেশের শাসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলতেন।

এত সব করার পিছনে একটাই উদ্দেশ্য থাকত, আর তা হল যে দেশে দূত প্রেরণ করা হয়েছে সে দেশের হাল-হকিকত জেনে নেওয়া। অনেক সময় দূতদের নেতা যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করত তা সংশ্লিষ্ট দেশের রাজপুরুষ, অভিজাত এমনকি রাজপরিবারের সদস্যরাও দেখে সংশোধন করে দিত। তবে তা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি না হলে বা উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না থাকলে কখনোই সম্ভব হত না।

রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাবর্তনের সময়েই অনেক ক্ষেত্রে সেই দেশ থেকে জবাবি দূত প্রেরণ করা হত। এইভাবে যতদিন পর্যন্ত কোনো স্থায়ী দূতাবাস তৈরি না হত ততদিন উভয় দেশের মধ্যে রাষ্ট্রদূত আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলত যাতে একটি যথাযথ বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করা যায়।

যদিও উজবেক ও তৈমুরীয়রা ভারতে মুঘল হিসাবে বিবেচিত হত, তাদের জাতিগত উৎস হয়তো এক ছিল এবং একই ভাষায় এরা কথা বলত, তবুও তারা দুই পৃথক উপজাতীয় সম্প্রদায় থেকে উঠে এসেছিল এবং এক সময় এরা ট্রানসঅক্সিয়ানা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা দখল করাকে কেন্দ্র করে লড়াইও করেছিল। তবে পরবর্তীকালে উজবেকরা নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করে বাবরকে রীতিমতো সমরখন্দ ও ফারগানা ছাড়া করে ছেড়েছিল এবং বালখ ও বাদখাশান সহ সমস্ত তৈমুরীয় রাজ্য জয় করে নিয়েছিল। তৈমুরীয় মুঘলরা তাদের এই হারানো জমি উজবেকদের থেকে পুনরুদ্ধার করার অভিপ্রায় গ্রহণ করলেও তা বাস্তবায়িত করতে অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাই আধুনিক ঐতিহাসিক আবদুল রহিমের দেওয়া এই যুক্তি মেনে নেওয়া যায় না যে, বাবর ভারতে পূর্বপুরুষের ভূমি জয় করার অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে এসেছিলেন, এবং সেই বাসনা তার সব উত্তরসূরির ভাবনা চিন্তায় এমনভাবে সঞ্চারিত হয়েছিল যে তাদের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের মধ্যেও তার ছাপ ছিল স্পষ্ট। কিন্তু আমরা দেখব যে মুঘলদের বৈদেশিক নীতি মূলত ছিল ভারত-কেন্দ্রিক এবং সেখানে সবথেকে বেশি ভারতের নিরাপত্তার ওপরেই জোর দেওয়া হয়েছিল।

উজবেকরা খুরাসনের (পূর্ব ইরান) দখল নিয়ে সাফাভিদদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। সাফাভিদরা শুধু খুরাসন দাবি করেই চুপ করে বসে থাকেনি, তাদের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল ট্রানঅক্সিয়ানার ওপর যা তুর্কিদের উত্থানের পূর্বে একটি ইরানীয় প্রদেশ ছিল। খুরাসন ও ট্রানঅক্সিয়ানা অঞ্চল দক্ষিণ দিক থেকে ভারতের সঙ্গে, উত্তর দিক থেকে রাশিয়ার সঙ্গে এবং পশ্চিম দিক থেকে অটোমান দুনিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে সড়কপথের যোগাযোগকে নিয়ন্ত্রণ করত। এই কারণে। এই অঞ্চলের ওপর অধিকার স্থাপন করা যে-কোনো শাসকের কাছেই ছিল স্বপ্ন।

একমাত্র কান্দাহার ছাড়া আর কোনো সীমান্ত বিবাদ যেহেতু ছিল না সেহেতু উজবেকদের ক্রমবর্ধমান বিপদ থেকে বাঁচতে সাফাভিদ ও মুঘল সম্রাটরা যে। একজোট হবেন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না। উজবেকরা ইরানের সাফাভিদ শাসকদের সুন্নি বিরোধিতা, সুন্নিদের প্রতি চালানো নির্মম অত্যাচার ও সাম্প্রদায়িক বিভেদকে কাজে লাগিয়েছিল। অন্যদিকে উজবেক ও মুঘলরা উভয়েই সাম্প্রদায়িক বিভিন্নতা বজায় রাখার ব্যাপারে এত গোঁড়া ছিল না। মুঘলদের সঙ্গে শিয়া শক্তির মিত্ৰতা তৈরি হতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ইরান ও উজবেকরা সময়ে সময়ে। পেশোয়ার থেকে কাবুল পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলের আবেগপ্রবণ আফগান ও বালুচিদের নানাভাবে প্ররোচিত করতে শুরু করে দিয়েছিল।

এ সময় পশ্চিম এশিয়ার সবথেকে শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল অটোমান তুর্কিরা। অটোমান বা তাদের সাম্রাজ্যের প্রথম শাসক উসমানের (মৃত্যু, ১৩২৬ সালে) নামানুসারে পরিচিত উসমানলি তুর্কিরা সমগ্র এশিয়া মাইনর ও পূর্ব ইউরোপ দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের বিস্তারের নতুন অধ্যায় শুরু হয় দ্বিতীয় মেহমেটের আমলে যিনি কনস্টান্টিনোপল জয় করেছিলেন (১৪৫৫) এবং ভূমধ্যসাগরের পূর্বাংশকে রীতিমতো তুর্কি হ্রদে পরিণত করে দিয়েছিলেন। অটোমানদের গৌরব শিখরে পৌঁছায় বলবান সেলিম ও অত্যাশ্চর্য সুলেমানের নেতৃত্বে। সেলিম সিরিয়া ও মিশর দখল করেছিলেন, যার ফলে মক্কার শরিফ বাধ্য। হয়ে মক্কা ও মদিনার কর্তৃত্ব অটোমানদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কায়রোয় তমসাচ্ছন্ন খালিফ তাদের রোমের সুলতান’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন এবং পরে। তারা নিজেরাই পাদশা-ই-ইসলাম ও খলিফা উপাধি হাসিল করে নিয়েছিলেন। যে-কোনো মুসলিম শাসকের পক্ষে অভাবনীয় সংগ্রামের পর খলিফা উপাধি লাভ করা ছিল সে সময় অত্যন্ত মর্যাদার ব্যাপার।

ইউরোপ দখলের অভিসন্ধির পাশাপাশি অটোমানরা সবার আগে চাইছিল পর্তুগিজদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। এরা পারস্য ও লেভ্যান্ট (পূর্ব ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল) থেকে মশলা ও অন্যান্য জিনিসের বাণিজ্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার তালে ছিল, তাই তাদের আটকানো সবার আগে দরকার ছিল। আর দ্বিতীয়ত সাফাভিদদের সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করার দরকার ছিল, কারণ তারা শতাধিক ধর্মপ্রচারককে আনাতোলিয়ায় পাঠিয়ে সেখানকার মানুষদের তুর্ক থেকে শিয়া সম্প্রদায়ে ধর্মান্তরিত করে আতঙ্ক সৃষ্টি করছিল। এছাড়া বাগদাগ ও বাসরা অঞ্চল এবং উত্তর ইরানের এরিভান ও রেশম উৎপাদক অঞ্চল দখল করাকে কেন্দ্র করেও অটোমান ও সাফাভিদদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল।

একাধিক সংঘর্ষের পর ১৫১৪ সালে সেলিম সাফাভিদ শাসক শাহ ইসমাইলকে চলদিরনের যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন এবং কিছুদিনের জন্য হলেও রাজধানী তাবরিজের ওপর অধিকার কায়েম করেছিলেন। যদিও অটেমানরা সাফাভিদদের প্রতিপত্তি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে পারেননি, তবুও তারা বাগদাদ ও বাসরা, এমনকি আরবের ইয়েমেন উপদ্বীপ অঞ্চল সাফাভিদদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল। পর্তুগিজরা ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত প্রাচ্যের সমস্ত সামুদ্রিক বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগরের ওপর প্রভাব বাড়াতে শুরু করায় অটোমানরা ইয়েমেন ও বাসরা উভয় উপত্যকাতেই নৌবহর নির্মাণ করেছিল।

পশ্চিম দিক থেকে অটোমান আক্রমণের বিপদ ধেয়ে আসায় পারস্যের অভিজাতরা (ইরানি) মুঘলদের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষ করে যখন তারা পূর্ব দিকে ক্রমাগত আক্রমণাত্মক উজবেক শক্তির তাড়া খেয়েছিলেন, তখন মুঘলদের সঙ্গে হাত মেলাতে তারা উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। পারস্যের অভিজাতদের বিরুদ্ধে গিয়ে মুঘলরা একযোগে অটোমান-মুঘল-উজবেক ত্রি-মৈত্রী আঁতাত তৈরি করতে রাজি ছিল না, কারণ তা হলে এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবার একটা ভয় থেকে যেত, তাই উজবেকদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য মুঘলরা পারস্যের অভিজাতদের একা ছেড়ে দেয়নি। ইরানের সঙ্গে মৈত্রী করার ফলে মুঘলরা মধ্য এশিয়ায় তাদের বাণিজ্যিক কার্যকলাপকে বৃদ্ধি করার একটা সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। যদি মুঘলদের একটি শক্তিশালী নৌবহর থাকত, তাহলে তারা খুব সহজেই আর-এক নৌশক্তিতে বলীয়ান রাষ্ট্র তুরস্কের সঙ্গে মিত্ৰতা করতে পারত এবং ভূমধ্যসাগরে চলা ইউরোপীয় নৌ-সংগ্রামে অংশ নিতে পারত। তবে মুঘলরা তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধানী ছিল, কারণ তারা ইতিমধ্যেই তুরস্কের বিরুদ্ধে ইরানকে সমর্থন করা শুরু করেছিল। সেই সঙ্গে তুরস্কের সুলতান নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে নিজেকে বাগদাদের পরবর্তী খলিফা হিসাবে ঘোষণা করায় মুঘলরা যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়েছিল তুরস্কের ওপর। ( মোটামুটি এই সব ঘটনা ও পরিস্থিতিই মুঘলদের পরবর্তী বৈদেশিক নীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। আর এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যের অগ্রগতিও যে একটা বড়ো কারণ ছিল সে ব্যাপারে অনেকের নজর পড়ে না।

আকবর ও উজবেক

১৫১১ সালে সাফাভিদদের হাতে উজবেক প্রধান শাইবানি খানের মৃত্যুর পর বাবর সংক্ষিপ্তভাবে সমরখন্দ পুনর্দখল করেছিলেন। যদিও বাবরকে অচিরেই এই শহর ত্যাগ করতে হয়েছিল, কারণ উজবেকরা পারস্য সাম্রাজ্যের ওপর আক্রমণ চালালে তিনি পারস্যের শাসককে সাহায্য করতে ছুটে গিয়েছিলেন আর এভাবেই মুঘল ও সাফাভিদদের মধ্যে মৈত্রী সম্পর্কের একটা ধারার সূচনা হয়েছিল। পরবর্তীকালে হুমায়ুন যখন শের শাহের আঘাতে নিরুপায় হয়ে ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে সাফাভিদ শাসক শাহ তাহমাসপের দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন তখন সাফাভিদ সম্রাট তাকে নিরাশ করেননি।

ষোড়শ শতকের সত্তরের দশকে আবদুল্লাহ খান উজবেকের নেতৃত্বে উজবেকদের ক্ষমতা ও রাজ্য জয় ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ১৫৭২-৭৩ সালে আবদুল্লাহ খান উজবেক বালখ অঞ্চল দখল করেছিলেন। এই বালখ অঞ্চল বদাখাসানের সঙ্গে মিলে মুঘল ও উজবেকদের মধ্যে একপ্রকার বাফারের মতো কাজ করত। বালখ জয় করার পরে আবদুল্লাহ খান আকবরের কাছে কূটনৈতিক দুত পাঠিয়েছিলেন। কী ধরনের প্রস্তাব সেই দূত-বার্তায় রাখা হয়েছিল সে ব্যাপারে খোলসা করা না থাকলেও পরবর্তীকালের কিছু তথ্য প্রমাণ থেকে এটা মনে হয় যে সেখানে ইরানের বিরুদ্ধে জোট গড়ার একটা প্রস্তাব ছিল বোধ হয়। আকবর এই দূতকে খুব শান্তভাবে আপ্যায়ন করেছিলেন এবং উজবেক প্রধানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবার জন্য কেবল সামান্য একটা প্রত্যুত্তর দূতের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আবুল ফজলের মতে, আকবর সে সময় তুরান জয় করার লক্ষ্যে মনোনিবেশ করছিলেন, তাই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছিল। যদিও তখন আফগানিস্তান মির্জা হাকিমের দখলে থাকায় আকবরের এ ধরনের পদক্ষেপ কিছুটা অবাক করেছিল তো বটেই।

১৫৭৭ সালে আবদুল্লাহ খান আকবরের কাছে দ্বিতীয়বারের জন্য দূত প্রেরণ করেন এবং ইরান ত্যাগ করে নেবার প্রস্তাব দেন। শাহ তাহমাসপের মৃত্যুর (১৫৭৬) পর ইরানের পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিশৃঙ্খলা ও অপশাসনের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল সেখানে। আবদুল্লাহ উজবেকের যুক্তি ছিল যে, ‘আকবরকে ভারত থেকে ইরানের উদ্দেশ্যে একটি সেনা অভিযান পরিচালনা করা উচিত যাতে করে একযোগে ইরাক, খুরাসন ও ফারকে শিয়াদের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার কারণে আকবর এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারেননি। শক্তিশালী। উজবেক দাপট কমানোর জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ইরানের হাত শক্ত করা। একই সঙ্গে যতদিন না কাবুল ভারতের ওপর সরাসরি কোনো আক্রমণ হানছে, ততদিন উজবেকদের সঙ্গেও কোনোরকম বিবাদে জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছুক ছিলেন না আকবর। এটাই ছিল আকবরের বৈদেশিক নীতির মূল মন্ত্র। আবদুল্লাহ উজবেক মুঘলদের পাশাপাশি অটোমান সম্রাটকেও প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইরানের বিরুদ্ধে সুন্নি শক্তিগুলির একটি ত্রিপাক্ষিক মৈত্রী জোট গড়ে তোলার, কিন্তু আকবর যে প্রত্যুত্তর। প্রেরণ করেছিলেন তাতে পরিষ্কার ভাবেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে তিনি আইন ও ধর্ম নিয়ে বৈষম্যের রাস্তায় হাঁটতে রাজি নন। মক্কা যাবার পথে ইরান হয়ে যেতে গিয়ে হয়তো কিছু সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছিল, কিন্তু আকবরের বিশ্বাস ছিল গুজরাট জয় করবার পর মক্কা যাবার এক নতুন পথের সন্ধান পাওয়া যাবে।

আবদুল্লাহ উজবেক আকবরকে কান্দাহার পুনর্দখল করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, কারণ তা একদা ছিল তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের অধিকারে। আকবর এর জবাবে বলেছিলেন, পারস্যের শাসকরা (অর্থাৎ কান্দাহারে শাসন করা মির্জারা) তার কাছে বশ্যতা সুলভ দূত প্রেরণ করেছেন এবং বণিকদের কার্যকলাপে যাতে কোনোরকম অসুবিধা না হয় তার জন্যে সড়কপথের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। এটাই আকবরের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আকবর মহাসমারোহে ঘোষণা করে বলেছিলেন যে যদি মির্জারা তাদের এই প্রতিশ্রুতি থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসে মুঘল বাহিনী অনায়াসে কান্দাহারের দখল নিতে বিন্দুমাত্র পিছপা হবে না। ‘নব্যতান্ত্রিক’ সাফাভিদদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় যুদ্ধে যাবার যে অনুরোধ ও প্রস্তাব আবদুল্লাহ করেছিলেন তাকে কোনোরকমে এড়িয়ে যাবার জন্য আকবর যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন যে তিনি ভারতে ইতিমধ্যেই কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন এবং ফিরিঙ্গিদের (অর্থাৎ পর্তুগিজ) বিরুদ্ধে তার ক্রুসেড অব্যাহত রয়েছে। তিনি ইরানের সঙ্গে পুরোনো বন্ধুত্বের কথা তুলে ধরে আবদুল্লাহ খান উজবেককে তার এই সাফাভিদদের বিরুদ্ধে অপমানজনক অভিযোগ আনার জন্য সাবধান করে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে তারাও সৈয়দ ও সার্বভৌম শক্তির অধিকারী, তাই তাদের এত খাটো করে দেখা ঠিক হবে না।

আকবর যে ক্রমশই মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে মনোযোগী হয়ে পড়ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় বদাখাসান থেকে পৌত্র কর্তৃক বিতাড়িত তৈমুরীয় শাসক মির্জা সুলেমানকে তাঁর রাজসভায় আশ্রয় দেওয়ার মধ্য থেকে। আবুল ফজল বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভঙ্গিতে বলেছেন যে খাইবার গিরিপথ সড়ক পরিবহণের জন্য আদর্শ আর তাই মুঘলদের ভয়ে বালখের দ্বার সাধারণত বন্ধ করেই রাখা হত। বদাখাসানে আগাম মুঘল অভিযান ব্যর্থ করতে আবদুল্লাহ উজবেক উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলের উপজাতি ওধ্যুষিত এলাকায় তার প্রতিনিধি উগ্র ধর্মীয় নেতা জালালকে দিয়ে। বিশৃঙ্খলা তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর হয়ে উঠেছিল যে আকবরকে আট্টোকে চলে যেতে হয়েছিল। এই অভিযানের সময়েই আকবর তার অন্যতম প্রিয় বন্ধু রাজা বীরবলকে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে ছিলেন।

১৫৮৩ সালে আবদুল্লাহ খান তৈমুরীয় শাসক শাহরুখ মির্জার হাত থেকে বালখ। অঞ্চল কেড়ে নিয়ে ১৫৮৫ সালের মধ্যে বদাখাসান পর্যন্ত এলাকা দখল করে নিয়েছিলেন। মির্জা সুলেমান ও তাঁর পৌত্র দুজনেই পালিয়ে এসে আকবরের দরবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং আকবর তাঁদের বেশ ভালো মনসব দান করে রেখে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সভাই মির্জা হাকিমের মৃত্যুর (১৮৮৫) পর আকবর কাবুল। অধিকার করে নিয়েছিলেন। সুতরাং এবার উজবেক ও মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা একেবারে পাশাপাশি হয়ে যাওয়ায় একে ওপরের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছিল।

১৫৮৬ সালে আবদুল্লাহ খান উজবেক আকবরের কাছে আর-একটি দূত বার্তা প্রেরণ করেন, আকবর তখন সিন্ধু নদের তীরে আট্টোক অঞ্চলে অবস্থান করছিলেন। সীমান্তের এত কাছে আকবরের উপস্থিতি বেশ অস্বস্তিতেই রেখেছিল আবদুল্লাহ খানকে। কিন্তু আবদুল্লাহের এই দূত বার্তার আসল উদ্দেশ্য ছিল সাফাভিদদের বিরুদ্ধে তার পরিকল্পিত খুরাসন আক্রমণে আকবরের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি আদায় করা। পরে এই প্রস্তাব সংশোধন করে মক্কা যাবার রাস্তা খোলার জন্য সাফাভিদদের বিরুদ্ধে মুঘলদের সঙ্গে নিয়ে যৌথ ভাবে আবদুল্লাহ খান আক্রমণ শানানোর আবদন জানান।

শাহ তাহমাসপের মুত্যুর (১৫৭৬) পর যেভাকে পারস্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল তাতে সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অটোমান সুলতান উত্তর ইরান আক্রমণ করেছিলেন, আর অন্যদিকে উজবেকরা খুরাসনে হিরাটকে ভয় দেখাতে শুরু করেছিল। এইবার আকবর আবদুল্লাহ উজবেকের প্রস্তাবের জবাব দিয়ে একটি দীর্ঘ পত্র প্রেরণ করেন। সেখানে তিনি তুর্কি অভিযানের পরিকল্পনাকে একেবারেই অনুমোদন দেননি, বরং ইরানকে সাহায্যে করার জন্য সেখানে একজন রাজপুরুষের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এটি ছিল আবদুল্লাহ উজবেককে রীতিমতো পাত্তা না দিয়ে মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে মুঘলদের সরাসরি হস্তক্ষেপের প্রচ্ছন্ন এক বার্তা, যদিও আবদুল্লাহকে এই কাজে সহযোগিতা করার জন্য ডাকা হয়েছিল এবং আশাও করা হয়েছিল যে ইরানে তাদের সাক্ষাৎ হবে। কয়েকজন আধুনিক ঐতিহাসিকের মতে, যদিও ইরানকে সাহায্য করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আকবরের এই প্রস্তাবের আড়ালে পারস্য সম্পর্কে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর মনোভাব বুঝে নেবার একটা পরিকল্পনা লুকিয়ে ছিল পরিষ্কার। তবে ইরান অভিযানের যথাযথ প্রস্তুতি আকবরের ছিল না। এদিকে আকবরের পত্র পৌঁছানোর আগেই আবদুল্লাহ উজবেক খুরাসন আক্রমণ করেছিলেন এবং বেশিরভাগ অঞ্চলই দখল করে নিয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে আকবর বুঝেছিলেন উজবেক প্রধানের সঙ্গে বোঝাপড়া করার এটাই সবথেকে আদর্শ সময়। তাই তার এক প্রতিনিধি হাকিম হুমানকে তিনি একটি পত্র ও মৌখিক কিছু বার্তা দিয়ে আবদুল্লাহ উজবেকের কাছে প্রেরণ করেন। মনে হয় এই বার্তায় উভয়ের সাম্রাজ্যের সীমানা হিসাবে হিন্দুকুশ পর্বতমালাকে স্থির করার একটা প্রস্তাব ছিল। এর অর্থ মুঘলরা ১৫৮৫ সাল পর্যন্ত তৈমুরীয় রাজপুরুষের অধীনে থাকা বদাখাসান ও বালখ অঞ্চলের ওপর থেকে সবরকম মায়া ত্যাগ করে তা উজবেকদের কাছে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু এর অর্থ এও ছিল যে উজবেকরা যদি এই প্রস্তাব মেনে নেয় তাহলে তারা আর কোনোভাবেই কাবুল ও কান্দাহারের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি করতে পারবে না। যদিও কোনো পক্ষই তাদের দাবি পুরোপুরি ছেড়ে দিতে পারেনি, তবুও এই প্রস্তাবের মাধ্যমে যে সমঝোতা উভয় পক্ষের মধ্যে হয়েছিল তাতে মুঘলরা হিন্দুকুশকে একটি নিরাপদ সীমান্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৫৯৫ সালে কান্দাহার অধিকার করে আকবর সেই অঞ্চলকে একটি বিজ্ঞানসম্মত নিরাপদ সীমান্ত ঘাঁটিতে পরিণত করেছিলেন। এদিকে ১৫৮৬ সাল থেকে আকবর পরিস্থিতির পর্যালোচনার জন্য লাহোরেই থেকে গিয়েছিলেন। ১৫৯৮ সালে আবদুল্লাহ উজবেকের মৃত্যুর পর তিনি আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। আবদুল্লাহের মুত্যুর পর উজবেক সাম্রাজ্য। কয়েকটি যুদ্ধরত প্রদেশে বিভক্ত হয়ে যায় এবং জাহাঙ্গিরের আমলে একটি নতুন মোড় না নেওয়া পর্যন্ত মুঘলদের সামনে নানা ভাবে আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি করে।

কান্দাহার প্রসঙ্গ ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক

উজবেক শক্তির আতঙ্ক সাফাভিদ ও মুঘলদের জোট বাঁধতে সাহায্য করেছিল। উজবেকরা ইরানে শিয়া-বিরোধী ভাবাবেগ জাগরণের চেষ্টা করলেও এবং সাফাভিদ শাসকদের অসহনশীল রাজনীতি গ্রহণ করার চরম বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও মুঘলরা উজবেকদের ঠেকাতে সাফাভিদদের সঙ্গে মিত্ৰতা করতে রাজি ছিল। শুধু একটাই সমস্যা ছিল কান্দাহারকে নিয়ে। উভয় শক্তির কাছেই কান্দাহার দখল করা ছিল কৌশলগত ও অর্থনৈতিক ভাবে খুব দরকারি, তাছাড়া এর সঙ্গে ভাবাবেগ ও মর্যাদার প্রশ্নও জড়িত ছিল। কান্দাহার ছিল তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের একটা অংশ এবং সেখানে শাসন করতেন বাবরের আত্মীয় হিরাটের শাসকরা। ১৫০৭ সালে উজবেকরা এদের উৎখাত করে দেয়। বাবর এই সময় সংক্ষিপ্ত ভাবে কান্দাহারের দখল নিয়েছিলেন। ঠিকই কিন্তু ১৫১০ সালে যখন সাফাভিদরা উজবেক প্রধান শাইবানি খানকে পরাজিত করে হিরাট ও খুরাসনের অবশিষ্ট অবশিষ্ট অংশ দখল করে নিয়েছিল, তখন মুঘলদের পাশাপাশি কান্দাহারের ওপর সাফাভিদের দাবিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জোরালো ভাবে। যদিও পরবর্তী দেড় দশক কান্দাহারের দখল ছিল এমন এক আধা স্বাধীন প্রশাসকদের হাতে যারা প্রয়োজনমতো মুঘল ও সাফাভিদ উভয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গেই সমঝোতা করে কান্দাহারের শাসনকার্যে পরিচালনা করেছিলেন।

কৌশলগতভাবে কাবুলের নিরাপত্তার জন্য কান্দাহারের গুরুত্ব ছিল প্রচুর। কান্দাহারের দুর্গটি ওই অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী দুর্গ হিসাবে বিবেচিত হত সে সময় এবং জলপথে যোগাযোগেরও ছিল আদর্শ জায়গা ছিল। কাবুল ও হিরাট যাওয়ার একেবারে সংযোগ পথে অবস্থিত কান্দাহার সমগ্র দক্ষিণ আফগানিস্তানে তার প্রভাব বজায় রাখত এবং এর ছিল প্রভূত কৌশলগত গুরুত্ব। একজন আধুনিক ঐতিহাসিক তাই যথার্থই লিখেছেন, কাবুল-গজনি-কান্দাহার রেখা কোনো প্রাকৃতিক নিরাপদ সীমানা না হলেও একটি কৌশলগত ও যুক্তিপূর্ণ সীমান্তরেখার পরিচয় বহন করত তো বটেই। কার্যত কান্দাহার দখল করতে পারলে আফগানিস্তান ও বালুচ উপজাতিদের ওপর অনেক সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যেত।

আকবর সিন্ধ ও বালুচিস্তান জয় করার পর মুঘলদের কাছে কান্দাহারের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। কান্দাহার ছিল একটি সমৃদ্ধশালী ও উর্বর প্রদেশ এবং ভারত ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে পণ্য ও মানুষ আদানপ্রদানের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রথমে পণ্য মধ্য এশিয়া থেকে মুলতান হয়ে কান্দাহারে পৌঁছোত, আর তারপর তা সিন্ধু নদ মারফত গন্তব্যে চলে যেত। এই ভাবে সিন্ধু নদের মাধ্যমে জলপথের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণ হল ইরান বরাবর। বিস্তীর্ণ স্থলপথ যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কারণে প্রায়শই বিপর্যস্ত থাকত। আকবরও ইরানের পথ এড়িয়ে এভাবে জলপথে বাণিজ্য করার পক্ষপাতী ছিলেন এবং আবদুল্লাহ উজবেককে এই পথের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন যে এই পথই হল মক্কায় মুসলিমদের তীর্থ করতে যাওয়ার ও পণ্য পরিবহণের আদর্শ বিকল্প পথ। এই সব কারণে কান্দাহার পারস্যের পাশাপাশি মুঘলদের কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ইরানের কাছে কান্দাহার ছিল বাইরের একটি ঘাঁটির থেকেও অনেক বেশি কিছু, নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রের থেকে নিঃসন্দেহে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটা অঞ্চল।

প্রথম দিকে কান্দাহারকে কেন্দ্র করে বিবাদের জেরে এই দুই সাম্রাজ্যের সম্পর্কের মধ্যে কোনো ফাটল ধরেনি। ১৫২২ সালে উজবেকরা যখন আরও একবার খুরাসানে আক্রমণের চেষ্টা করছিল, তখন বাবর কান্দাহার দখল করেছিলেন। পরিস্থিতির কথা ভেবে পারস্যের সাম্রাজ্যের তরফ থেকে তখন মুঘলদের কান্দাহার দখল করাকে কেন্দ্র করে কোনোরকম আপত্তি জানানো হয়নি। কিন্তু যখন হুমায়ুন পালিয়ে এসে শাহ তাহমাসপের দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন, তখন ইরানের রাজতন্ত্র তাকে একটা শর্তে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিলেন, আর সে শর্তটা ছিল সহোদর কামরানের কাছ থেকে কান্দাহার ছিনিয়ে নিয়ে ইরানের হাতে তুলে দিতে হবে হুমায়ুনকে। হুমায়ুনের কাছে এই শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিল না। কিন্তু কান্দাহার জয় করার পর হুমায়ুন তার অধিকার নিজের কাছে ধরে রাখার জন্যে নানা অজুহাত খুঁজতে শুরু করেছিলেন। বস্তুত কান্দাহার না থাকলে হুমায়ুন সেই অঞ্চলকে কেন্দ্র বানিয়ে সেখান থেকে কামরানের বিরুদ্ধে কাবুল অভিযান চালাতে পারতেন না।

হুমায়ুনের মৃত্যুর পর বিভ্রান্তি শুরু হলে সেই সুযোগে শাহ তাহমাসপ কান্দাহার দখল করে নিয়েছিলেন। যতদিন না পর্যন্ত আবদুল্লাহ খানের নেতৃত্বে উজবেক শক্তি ইরান ও মুঘলদের ওপর নতুন করে আতঙ্ক তৈরি করেছিল, ততদিন পর্যন্ত আকবর। কান্দাহার পুনর্দখল করার ব্যাপারে সেভাবে কোনো উদ্যোগ নেননি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে মুঘলদের কান্দাহার দখল (১৫৯৫) কিন্তু আকবর ও উজবেকদের মধ্যে সংগঠিত যে সমঝোতার কথা আমরা আগে উল্লেখ করেছি, তার কোনো অংশ ছিল না। আসলে খুরাসান উজবেকদের অধিকারে চলে যাবার ফলে ও পারস্য সাম্রাজ্যের। বজ্রমুষ্টি থেকে কান্দাহার ক্রমশ আলগা হতে শুরু করলে সম্ভাব্য উজবেক আক্রমণ ঠেকানোর জন্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকায় একটি নিরাপদ ঘাঁটি গড়ে তোলা। খুব প্রয়োজন ছিল মুঘলদের কাছে। উজবেকরাও কান্দাহারের দখল নিতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। তারা ইতিমধ্যেই কান্দাহারের কাছে জমিনদাওয়াড় অঞ্চলের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল এবং সেখানকার শাসক মির্জাদের উৎখাত করার প্রচেষ্টা শুরু করে দিয়েছিল। আকবর ১৫৯১ সালের প্রথম দিকে কান্দাহার দখল করার জন্য প্রতিনিধি হিসাবে আব্দুর রহিম খান-ই-খানানকে নিয়োগ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তাকে যতটা সম্ভব তরবারি ব্যবহার না করে সেই কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। মির্জা শাসকরা বাধ্য হয়ে কান্দাহারকে মুঘলদের হাতে তুলে দেওয়ার পর মুঘলরাও জমিনদাওয়াড় ও গ্রামসির অঞ্চল থেকে উজবেকদের উৎখাত করতে উঠেপড়ে লেগে গিয়েছিল।

আকবর কান্দাহার দখল করে নিলেও মুঘলদের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কে তখনও কোনো চিড় ধরেনি। উজবেকদের বদলে মুঘলদের হাতে কান্দাহারের দখল যাওয়াটা পারস্যের কাছে অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক ছিল, কারণ এর ফলে খুরাসানে তাদের অবস্থা অনেকটা মসৃণ থাকলেও থাকতে পারত। তাই আকবর যখন যুক্তি দিয়েছিলেন যে মির্জারা মহান রাজবংশের (সাফাভিদ) সঙ্গে সহযোগিতা করতে অপারগ….(এবং) একতা ও সহমত গড়ে তোলার কোনো চিহ্নই তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না তাই তিনি কান্দাহার দখল করছেন, তখন শাহ আব্বাস কোনোরকম আপত্তি জানাননি।

১৫৯৮ সালে আবদুল্লাহ উজবেকের মৃত্যুর পর শাহ আব্বাস খুরাসান দখল করে নিয়েছিলেন। আকবরকে লেখা একটি পত্রে তিনি তাঁর এই বড়ো জয়ের কথা ঘোষণা করে বলেছিলেন যে তিনি তার সাম্রাজ্যের হৃত প্রায় সব অংশই পুনরুদ্ধার করতে পেরেছেন এক কান্দাহার ছাড়া, তাই তিনি আশাবাদী যে আকবর তার হাতে কান্দাহারের দুর্গ তুলে দেবেন।

শাহজাদা সেলিমের বিদ্রোহের পর তৈরি হওয়া বিভ্রান্তিকর পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে এবং ইরানের ওপর শাহ আব্বাসের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাওয়ার পর পারস্য কর্তৃপক্ষ দু’-দু’বার কান্দাহার দখলের নিষ্ফল প্রচেষ্টা করেছিল। এরপর আকবরের মৃত্যুর পর তারা কান্দাহার দুর্গ অবরোধ করেছিল এক বছর ধরে, কিন্তু মুঘল বাহিনী চলে আসায় সেই অবরোধ ভেস্তে যায়। আধুনিক ঐতিহাসিক রিয়াজুল ইসলাম তাই বলেন যে, পারস্যের এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে ছিল কান্দাহার পুনরুদ্ধারের দৃঢ় পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ। যদিও শাহ আব্বাস পরে বুঝেছিলেন যে এই প্রচেষ্টা হয়তো যথাযথ ছিল না। আসলে তিনি জাহাঙ্গিরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চেয়েছিলেন। তিনি কান্দাহার আক্রমণ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন এবং জাহাঙ্গিরকে একের-পর-এক জাঁকজমকপূর্ণ উপহার রাষ্ট্রদূত মারফত প্রেরণ করেছিলেন। ১৬১১ সালে তিনি একটি দূত অভিযানে আকবরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে এবং তার ভাই’ জাহাঙ্গিরকে সিংহাসনে অধিষ্ঠানের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে গিলান ঘোড়া, কার্পেট, রেশম বস্ত্র ও অন্য সব মূল্যবান দ্রব্য পারস্য থেকে উপহারস্বরূপ প্রেরণ করেছিলেন। সঙ্গে শাহ একটি পত্রও জাহাঙ্গিরকে উদ্দেশ্য করে পাঠিয়েছিলেন যা জাহাঙ্গিরের কথায় ছিল সর্বোত্তম বন্ধুত্বের আবেগে ভরা এবং তাতে শ্রদ্ধা ও মতানৈক্যের বিন্দুমাত্র খামতি ছিল না। তৈমুরের সময় থেকে তৈমুরীয় শাসকদের হয়ে কাজ করা পরিবারের সদস্য চাঘতাই মুঘল খান আলমের নেতৃত্বে জাহাঙ্গির একটি জবাবিদূত অভিযান প্রেরণ করেন শাহ আব্বাসকে। সেই অভিয়ানে খান আলমের সঙ্গে ছিল আরও প্রায় ১২০০ লোকজন, যাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন খান আলমের দেহরক্ষী ও ২০০ জন অনুগামী, আর ছিল বিশাল সংখ্যক ভারতীয় জীবজন্তু ও তাদের প্রতিপালক। যখন তারা কাজভিনে গিয়ে পৌঁছেছিলেন, তখন দরবারের সকল উচ্চপদস্থ অভিজাত বাইরে বেরিয়ে এসে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। খান আলমকে বিশেষ আপ্যায়নের দায়িত্বে ছিলেন শাহ স্বয়ং, তিনি খান আলমকে আলিঙ্গন করেছিলেন এবং ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেছিলেন।

যেখানে এই দুই শাসক একে অপরকে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান উপহার প্রদান করে মুগ্ধ করতে ব্যস্ত ছিলেন, সেখানে এই পারস্পরিক রাষ্ট্রদূত আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য এত বেড়ে গিয়েছিল যে তা দেখাশোনা করার জন্য জাহাঙ্গিরকে একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মানুষ মহম্মদ হুসেন ছালবিকে রাজকীয় বাণিজ্য মহাধ্যক্ষ নিয়োগ করতে হয়েছিল। উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো হবার সুবাদে এবং মানুষ ও সম্পদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হওয়ার কারণে বিশাল সংখ্যক হিন্দু ও জৈন বণিক, আর মুলতানি নামে পরিচিত ব্যাপারীরা দলে দলে ইয়েজাদ, শিরাজ, ইসফাহান, তেহরান, গিলান প্রভৃতি ইরানের প্রধান প্রধান শহরে গিয়ে বসতি গড়ে তুলেছিল। ঠিক কত পরিমাণ ভারতীয় বণিক এ সময় ইরানে বসতি গড়ে তুলেছিল তার সঠিক হিসাব দেওয়া সম্ভব না হলেও, রাজধানী শহর ইসফাহানে এই সংখ্যাটা ছিল আনুমানিক এক হাজার থেকে বারো হাজারের মধ্যে। এক ইংরেজ ভ্রমণকারী ফ্রেয়ারের (Fryer) মতে, হিন্দুরা সেখানে গিয়ে মন্দির বানিয়ে নিয়েছিল এবং সেখানে মূর্তি পুজার জন্যে পুরোহিতের ব্যবস্থা ছিল, আর ছিল সমস্ত ধর্মীয় উৎসব পালনের আয়োজনও। ইরানীয় শাসকদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কারণেই এরা এইভাবে জনসমক্ষে নিজেদের ধর্মীয় রীতিনীতি ও উৎসব পালন করার সাহস পেয়েছিল।

শাহ আব্বাস সাফাভিদ ও দাক্ষিণাত্যের রাজতন্ত্রের মধ্যে পুরোনো বন্ধুত্বকে সজীব করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, এবং এই উদ্যোগ এতটাই ফলপ্রসূ হয়েছিল যে দক্ষিণের শাসকরা খুৎবা পাঠের সময় সাফাভিদ শাসকের নামও অন্তর্ভুক্ত করতেন। মুঘলরা এটা পছন্দ করেনি এবং এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। তবে দাক্ষিণাত্যে সাফাভিদদের স্বার্থ সীমিতই ছিল এবং মুঘলদের সঙ্গে তাদের ভুল বোঝাবুঝির জন্য এই ব্যাপারটা সেভাবে কোনো কারণ হয়ে দাঁড়ায় নি কখনো।

সাফাভিদ সাম্রাজ্যের এই ভালো ব্যবহার কি জাহাঙ্গিরকে মিথ্যে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে এক প্রকার ছল করার চেষ্টা ছিল? বোধ হয় সেটা ভাবাটা ঠিক হবে না। কান্দাহার নিয়ে উলটোদিকের ভাবনা আমরা হয়তো বুঝতে পারব না। ১৬২০ সালে পারস্যের দূত জামবিল বেগ জাহাঙ্গিরের কাছে কান্দাহারের বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন কিন্তু জাহাঙ্গির তাতে কান দেননি। পরবর্তীকালের একাধিক দূত অভিযানে এই নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু কান্দাহার নিয়ে কোনো আলোচনাই সফল হয়নি। জাহাঙ্গির ভেবেছিলেন শাহ আব্বাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব থাকার কারণে তিনি কখনোই কান্দাহার আক্রমণ করবেন না। কিন্তু জাহাঙ্গির এটা ভুলে গিয়েছিলেন যে দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে নিরাপত্তার প্রশ্নে বন্ধুত্বের খাতিরে কখনো কেউ আপস করে না। ১৬২২ সালে যখন পারস্য কর্তৃপক্ষ কান্দাহার আক্রমণ করেছিল তখন সেখানকার দুর্গে মাত্র ৩০০০ মুঘল সৈন্য মোতায়েন করা ছিল। সেনাবাহিনী সংখ্যায় কম থাকলেও যোগ্য ও প্রাণবন্ত সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে তারা অনায়াসে দুর্গকে কিছু সময়ের জন্য পারস্যের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারত, কিন্তু তাও সম্ভব হয়নি। কারণ মুঘলরা ভাবতেই পারেনি যে পারস্য থেকে এভাবে আক্রমণ ধেয়ে আসতে পারে।

যদিও শাহ আব্বাস কান্দাহার হারানোর তিক্ততাকে প্রশমিত করার জন্য জাহাঙ্গিরকে প্রচুর মূল্যবান জিনিস উপহার হিসাবে প্রেরণ করেছিলেন এবং কান্দাহার আক্রমণের একটি সোজাসাপটা ব্যাখ্যাও লিখে পাঠিয়েছিলেন যা কার্যত মেনে নিয়েছিলেন জাহাঙ্গির, কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে যে অনাবিল মিত্রতার সম্পর্ক ছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটে যায়। এর পর থেকে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হয় কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন এক অধ্যায়।

১৫৯৮ সালে আবদুল্লাহ খান উজবেকের মৃত্যুর পর মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে কিছু সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন সূচীত হয়েছিল। উপজাতিগত বিবাদের জেরে উজবেক সাম্রাজ্যের সংহতি বিনষ্ট হয়ে যায়, যার সুযোগ নিয়ে পারস্য খুরাসান অঞ্চল দখল করে নেয়। কিন্তু আরও অঞ্চল দখলের জন্য এগোতে চাইলে বালখের কাছে উজবেক বাহিনীর কাছে তাদের জোর পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়। উজবেক শক্তিকে তখনও কোনোভাবে উপেক্ষা করার জায়গা ছিল না। কিছু সময় পরে বুখারা ও বালখের স্বাধীন শাসক হিসাবে উত্থান ঘটে ইমাম কুলির। যদিও উজবেকদের আর সেই শক্তি ছিল না যা দিয়ে তারা শাহ আব্বাসকে খুরাসান দখল করার জন্য চ্যালেঞ্জ করতে পারে, তবুও তারা চায়নি যে পারস্যের সেনা আফগানিস্তান লুঠপাট চালাক বা কাবুলে কোনরকম আক্রমণ করুক। তারপর পারস্যের কান্দাহার দখল (১৬২২) উজবেকদের চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। শাহ আব্বাস কান্দাহার দখল করার পরে পশ্চিম দিকে ঘুরে তুরস্কের কাছ থেকে বাগদাদ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে ইরানের বিরুদ্ধে তিন সুন্নি শক্তি-উজবেক, মুঘল ও অটোমানদের একজোট হওয়ার পুরোনো ভাবনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং সেই জোট চূড়ান্ত করার জন্যে উজবেক ও মুঘলদের মধ্যে একাধিক দূত চালাচালি শুরু হয়। এই প্রক্রিয়া জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর পর শাহজাহানের আমলেও অব্যাহত ছিল। ১৬২৭ সালে উজবেক প্রধান ইমাম কুলি জাহাঙ্গিরকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন একদা খুরাসানে আবদুল্লাহ খান উজবেককে আকবর সাহায্য করার জন্য। তবে শাহ আব্বাসের আক্রমণের ভয়ে তিনি ভিতরে ভিতরে পারস্যের শাসককে মুঘলদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করার কাজও করে যাচ্ছিলেন বলে জানা যায়। সেই সঙ্গে এই সময় কাবুলে উজবেকদের একাধিক আক্রমণ সংঘটিত হয়েছিল। শাহজাহানের সিংহাসন আহরণের আগে ও পরে এই ছিল মোটামুটি মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি।

শাহজাহান ও ইমাম কুলির মধ্যে কূটনৈতিক বার্তা আদানপ্রদানের সময় বেশি জোর দেওয়া হত শিয়া মতাবলম্বী পারস্যের বিরুদ্ধে সুন্নি শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনার ওপর। এই সকল কূটনৈতিক ভাব বিনিময়ের মধ্য দিয়ে কোথাও-না-কোথাও শাহজাহান ও দুই খান ভ্রাতৃদ্বয় ইমাম কুলি ও নজর মহম্মদের মধ্যে পারস্যের বিরুদ্ধে একটা বোঝাপড়ার জায়গা তৈরি হয়েছিল। ১৬৩৬ সালে শাহজাহান অটোমান সুলতান চতুর্থ মুরদকে লেখা একটি পত্রে তাঁর কান্দাহার পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে পারস্যের বিরুদ্ধে ভারত, তুরান ও তুরস্ক–এই তিন দিক দিয়ে আক্রমণ সংগঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। উজবেকরা এদিক ওদিক দুই দিক সামলাতে চেষ্টা করলেও পারস্য থেকে কোনো সাহায্য পায়নি। অটোমানরাও বেশ নিষ্ক্রিয় ছিল। সবথেকে বড়ো কথা তারা এমন একটা মনোভাব গ্রহণ করেছিল যা মুঘলদের একেবারেই পছন্দ হয়নি। তাই শাহজাহান কূটনীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। দাক্ষিণাত্যের সমস্যা থেকে মুক্ত হয়ে শাহজাহান কান্দাহারে পারস্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক আলি মরদান খানকে নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে নিজের পক্ষে টানার চেষ্টা করেন (১৬৩৮)। আলি মরদানের এই শিবির বদল আরও সম্ভব হয়ে যায় শাহ আব্বাসের পর ১৬২৯ সালে আসা নতুন পারস্যের শাসক শাহ শাফির নিষ্ঠুর চরিত্রের জন্য। এখানে উল্লেখ্য যে জাহাঙ্গিরের আমলে যেভাবে শাহ আব্বাসের সঙ্গে মুঘলদের সম্পর্ক ছিল তেমন সম্পর্কই বজায় রাখতে চেয়েছিলেন শাহজাহান শাহ শাফির সঙ্গে। বর্তমান ঘটনাগুলোকে পিছনে সরিয়ে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি একাধিক দূত অভিযান প্রেরণ করেছিলেন পারস্যে। এমনকি তিনি ইরানের শাহকে প্রতি বছর কান্দাহারের রাজস্বের সমান পরিমাণ অর্থ প্রদান করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে প্রশ্নটা অর্থের ছিল না, শাহ শাফি মনঃস্থির করেই নিয়েছিলেন যে তিনি যেভাবে হোক কান্দাহারের দুর্গ। পুনর্দখল করবেন। ১৬৩৯ সালে তিনি বাগদাগকে বাজি রেখে অটোমানদের সঙ্গে চুক্তি করেন, আর তারপরে তিনি কান্দাহার অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এই অভিযান আটকানোর জন্য শাহজাহান কাবুলে চলে যান এবং দারাকে আদেশ দেন বিশাল সংখ্যক গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে কান্দাহারকে দখল করতে। কিন্তু দারার ভাগ্য ভালো ছিল যে প্রায় দুই বছরের প্রস্তুতি নিয়ে কান্দাহার দখল করতে আসার পথে শাহ শাফি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও মারা যান। ১৬৪২ সালে পারস্যের বাহিনীকে কান্দাহার থেকে একেবারে সরিয়ে দেওয়া হয়। শাহের মৃত্যুর পর পারস্যে চরম বিশৃঙ্খলা শুরু হলে কিছু সময়ের জন্যে হলেও পারস্যের বিপদ থেকে শাহজাহান রেহাই পান এবং তার অন্য কাজে মনোনিবেশ করেন।

শাহজাহানের বালখ অভিযান

শাহজাহানের বালখ অভিযানকে (১৬৪৬) আমরা মুঘল বৈদেশিক নীতির উচ্চতম জোয়ার বলে উল্লেখ করতে পারি। আবার এই অভিযানের ব্যর্থতাকে অনেকে মুঘল সামরিক শক্তির পতনের সূচনা বলেও মনে করেন। এই অভিযানকে অবশ্যই আবদুল্লাহ খান উজবেকের মৃত্যু (১৫৯৮) পরবর্তী সময়ে মুঘলদের সঙ্গে তুরানের সম্পর্ক ও তাদের সামগ্রিক বৈদেশিক নীতির পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যেতে পারে।

আমরা দেখেছি যে কীভাবে আবদুল্লাহ উজবেকের মৃত্যুর (১৫৯৮) পর তৈরি হওয়া বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে শাইবানি খানের বংশের লোক না হয়েও ইমাম কুলি নিজেকে বালখ ও বুখারা অঞ্চলের স্বাধীন শাসক হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন (১৬১১)। তবে ইমাম কুলি উদার হয়ে বালখ ও বদাখাসানের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন তার ছোটো ভাই নজর মহম্মদের ওপর এবং নিজের হাতে রেখেছিলেন বুখারা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নজর মহম্মদ ওই দুই অঞ্চলের কার্যত স্বাধীন শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। উজবেক খানাতে এই বিভাজন মুঘলদের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল ছিল। যদিও নজর মহম্মদের সিংহাসনের বসার পর অনেক দিন ধরে উজবেক ও মুঘলদের মধ্যে কোনোরকম কূটনৈতিক যোগাযোগ হয়নি। এই সময় বরং মুঘলদের সঙ্গে ইরানের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক অনেক নিবিড় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু জাহাঙ্গিরের সময় তাঁর তরফ থেকে নিজ জন্মস্থান পুনর্দখল করার কোনো উদ্যোগে দেখা যায়নি।

সাফাভিদদের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় উজবেকরা পারস্যের উদ্দেশ্য নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। ১৬২১ সালে ইমাম কুলির মাতা নুরজাহানের উদ্দেশ্যে একটি দূত অভিযান পাঠিয়ে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার বার্তার পাশাপাশি মধ্য এশিয়ার কিছু দুর্মূল্য দ্রব্য উপহার দিয়েছিলেন। নূরজাহানও জবাবি দূত অভিযানে কিছু উপহার পাঠিয়েছিলেন। জাহাঙ্গির ও ইমাম কুলির মধ্যে এই ভাবে দূত অভিযানের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

পারস্য কর্তৃক কান্দাহার দখল (১৬২২), শাহজাহানের বিদ্রোহের পর মুঘল সাম্রাজ্যে তৈরি হওয়া জটিলতা এবং জাহাঙ্গিরের শারীরিক অবস্থার ক্রম অবনতি মুঘলদের সম্পর্কে উজবেকদের মনোভাব পরিবর্তন করে দিয়েছিল। ইমাম কুলি পারস্যের শাহের কাছে দূত পাঠিয়ে মিত্রতার প্রস্তাব রেখেছিলেন। এর পাশাপাশি নজর মহম্মদ কাবুল দখলের উদ্যোগ স্থগিত রেখেছিলেন। তাঁর অন্যতম প্রধান সেনাপতি ইয়ালিংটোশ কাবুল অভিযানে গিয়ে মুঘলদের শক্তিশালী গোলন্দাজ বাহিনীর কাছে জোর ধাক্কা খেয়েছিলেন। তারপর ইয়ালিংটোশ আফগানিস্তানের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে সেখানকার হাজারা ও আফগানদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরির চেষ্টা করেন। তারপর তিনি গজনি অভিমুখে রওনা দেন। এই দুই উদ্যোগই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কাবুলে মুঘল বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে আন্দাজ করে উজবেকদের পরিকল্পনা আবার বদলে যায়। তারা মুঘলদের কাছে বন্ধুত্বের বার্তা পাঠায় এবং ইয়ালিংটোশের কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি ইমাম কুলি খুরাসনে পারস্যের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। হয়তো এই প্রস্তাবের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল, কিন্তু একথা সত্যি যে তারা মুঘলদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রচণ্ড আগ্রহী ছিল। যে কারণেই হোক না কেন, জাহাঙ্গির এই প্রস্তাবকে খুব। একটা গুরুত্ব দেননি। আর তার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান।

১৬২৮ সালে জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর পর নজর মহম্মদ কাবুলের ওপর তৃতীয় আক্রমণ হানেন। এই আক্রমণে তিনি কাবুল শহরের দখল নেন ও লুঠ চালান দুর্গে। মুঘল বাহিনী তাকে প্রতিহত করতে ছুটে যায়। কিন্তু তারা কাছে আসার আগেই নজর মহম্মদ দ্রুত পালিয়ে যান। জবাবি হামলায় মুঘলরা বামিয়ান দখল করে নেয়। ওদিকে শাহজাহান ইমাম কুলির কাছে দূত পাঠিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তবে অবশ্যই নজর মহম্মদকে বাদ দিয়ে।

যখন ইমাম কুলির সঙ্গে মুঘলদের সুসম্পর্কের প্রক্রিয়া চলছিল তখন নজর মহম্মদ ১৬৩৩ সালে একটু দেরি করে হলেও দূত অভিযান পাঠিয়ে শাহজাহানকে সিংহাসনে বসার জন্য শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। পরবর্তী ছয় বছর ধরে দুই তরফ থেকে ক্রমাগত দূত চালাচালি চলতে থাকে এবং আগেই বলেছি যে এভাবে শিয়াপন্থী সাফাভিদের বিরুদ্ধে উজবেক-মুঘল-অটোমান এই তিন শক্তির ত্রিমুখী জোট গড়ে তোলার ভাবনা নতুন করে ফিরে আসে। কিন্তু উজবেকদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে শাহজাহান খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না। ইরান ঘেঁষা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায়। রাখার নীতি থেকেও তিনি সরে আসেননি। ১৬৩৮ সালে একক শক্তি হিসাবে তিনি। কান্দাহার পুনর্দখল করেছিলেন এবং মুর্শিদ কুলি খান নামে এক সুদক্ষ সেনানায়ক তথা ইঞ্জিনিয়ারকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিজ পক্ষে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৬৩৯ সালে ইমাম কুলি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। নজর মহম্মদ এই সুযোগে সমগ্র উজবেক সাম্রাজ্যকে নিজ করায়ত্ত করার পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন। কয়েকদিনের সংঘর্ষের পর ইমাম কুলি বাধ্য হন সিংহাসন ছেড়ে চলে যেতে ও ইরানে আশ্রয় নিতে। ইরান থেকে তিনি মক্কা চলে গিয়েছিলেন। এইভাবে উজবেক খানাতে। নজর মহম্মদের নেতৃত্বে একত্রিত হয়েছিল। তিনি ক্রমেই একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত কড়া ভাবে তার প্রশাসনকে পরিচালনা করেছিলেন এবং বহু ধর্মীয় ব্যক্তিকে বরাদ্দ নিষ্কর জমি প্রদান আটকে দিয়েছিলেন। তিনি আক্রমণাত্মক প্রসারণবাদী নীতিগ্রহণ করে খারিজম জয় করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যখন তিনি খারিজম জয় করার অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন তখন তাস্কেন্তে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। তিনি তাঁর পুত্র আবদুল আজিজকে বিদ্রোহ মোকাবিলার জন্য প্রেরণ করলেও, আজিজ বিদ্রোহীদের দলে নাম লিখিয়ে নিজেই নিজেকে বুখারার শাসক হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। নজর মহম্মদের কাছে তখন একটাই জায়গা থেকে গিয়েছিল–বালখ, কিন্তু সেখানেও তার পুত্রের আতঙ্ক নানা ভাবে তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। অবশেষে বিপাকে পড়ে তিনি শাহজাহানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সময়টা ছিল ১৬৪৫ সাল। শাহজাহান তৎপরতার সঙ্গে সেই আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন। তিনি লাহোর থেকে কাবুল অগ্রসর হয়ে শাহজাদা মুরদের নেতৃত্বে একটি বিশাল বাহিনীকে নিয়োগ করেছিলেন নজর মহম্মদকে সাহায্য করার জন্য। ১৬৯৬ সালের মাঝামাঝি কোনো-এক সময়ে কাবুল থেকে মুঘল বাহিনী রওনা দিয়েছিল, যেখানে ছিল ৫০,০০০ ঘোড়া ও ১০,০০০ পদাতিক বাহিনী যাদের মধ্যে এমনি ও মাস্কেট বন্দুকধারী, রকেটধারী ও রাজপুত সৈন্য ছিল। শাহজাহান শাহজাদা মুরদকে ভালো করে বলে দিয়েছিলেন যে যদি নজর মহম্মদ সম্ভ্রম ও আনুগত্য প্রদর্শন করে তবেই যেন তার অনুরোধগুলোকে মনোযাগ দিয়ে বিচার করা হয় ও বালখ পুনরুদ্ধারে সাহায্য করা হয়। সেই সঙ্গে যদি নজর মহম্মদ সমরখন্দ ও বুখারা ধরে রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তাহলে শাহজাদাকে সব কিছু দিয়ে তাকে সাহায্য করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। আসলে শাহজাহান সব সময় বালখ ও বুখারার এমন সব বন্ধুত্বপূর্ণ শাসক চাইতেন যারা বিপদে পড়লেই মুঘলদের কাছে এসে সাহায্য চাইবে। কিন্তু শাহজাদা মুরদের ছটফটানি সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়েছিল। তিনি বালখ অঞ্চলে প্রবেশ করে নজর মহম্মদের কোনোরকম অনুমতির অপেক্ষা না করেই তার লোকজনদের বালখের দুর্গে প্রবেশ করার আদেশ দিয়ে দেন। দুর্গের অন্দরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন নজর মহম্মদ, তড়িঘড়ি শাহজাদা তাকে দুর্গ থেকে বেরিয়ে যাবার আদেশ দিলে হতচকিত হয়ে তিনি দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে যান। বাধ্য হয়ে মুঘলদের বালখ দখল করতে হয় কিন্তু সে অঞ্চলের বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত জনতার সামনে তারা একেবারে নিরুপায় হয়ে পড়ে। নজর মহম্মদের পুত্র আবদুল আজিজ ট্রানসঅক্সিয়ানার কাছে মুঘলদের বিরুদ্ধে উজবেক জনজাতিকে খেপিয়ে দেন এবং ১২০,০০০ জনের একটা বিশাল সেনা নিয়ে মুঘল বাহিনীকে ঘিরে ধরেন অক্সাস নদীর তীর জুড়ে। এই সময় শাহজাদা মুরদ ফিরে যাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন ও অনুমতি চান ফিরে যাবার জন্য। সমকালীন এক ঐতিহাসিক লাহোরির মতে, তার সঙ্গে বহু আমির ও মনসবদার এক যোগে বাড়ি ফিরে যাবার অদ্ভুত কাকুতি মিনতি করতে শুরু করেছিলেন। গৃহে ফিরবার ব্যাকুলতা হিন্দুত্ববাদে একরকম প্রথাই ছিল বলা চলে, কিন্তু তা বালখের মানুষ ও তাদের ভাবনার সঙ্গে খাপ খায় না। তাছাড়া বালখ অঞ্চলের আবহাওয়ার রুক্ষতাও তাদের গৃহে ফিরে যাবার বাসনা প্রকাশে উৎসাহী করেছিল। শাহজাহান মুরদের এই মূর্খামিতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং শাস্তিস্বরূপ কিছুদিনের জন্য তাঁকে তাঁর মনসব ও মুলতানের জায়গির ভোগ করা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। বালখের প্রশাসনিক বিষয় সামলানোর জন্য শাহজাহান মুঘল উজির সাদুল্লাহ খানকে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু এতেও সেখানে থাকা মুঘল ও রাজপুত সেনাদের মধ্যে ঘরে ফেরার সাধ কমানো সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে সামরিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য শাহজাহান আমির-উল-উমারা আলি মরদান খানের সঙ্গে শাহজাদা ঔরঙ্গজেবকে নিয়োগ করেছিলেন।

ঔরঙ্গজেব অক্সাস নদী পার করে এগোনোর কোনোরকম চেষ্টা করেননি, এমনকি ওইপারে বিশাল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ শানানো আবদুল আজিজকে আক্রমণ করারও কোনো উদ্যোগ তার মধ্যে দেখা যায়নি। অক্সাস নদী কোনোভাবেই নিরাপদ সীমা ছিল না, কারণ বালখের কাছে তা অনায়াসে পার করা যেত পায়ে হেঁটেই। ঔরঙ্গজেব এপারে বিশেষ বিশেষ জায়গায় শক্তিশালী সেনা জমায়েত করে রেখেছিলেন এবং নিজের কাছে রেখেছিলেন সেরা গোলন্দাজ সৈন্য গোষ্ঠী সহ মূল বাহিনী যাতে যে-কোনো বিপদ দেখলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে বিপক্ষের দিকে। এই ভাবে মুঘল বাহিনী খুব সুন্দর ভাবে অবস্থান নিয়ে বসেছিল। আবদুল আজিজ অক্সাস নদী পার করে বালখের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে দেখেন যে সামনে ঔরঙ্গজেবের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী বাহিনী তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। দুর্ধর্ষ যুদ্ধে মুঘল গোলন্দাজ বাহিনীর কাছে দাঁড়াতেই পারেনি উজবেক সেনা এবং মুঘল বাহিনী তাদের বালখ ছাড়া করে ছাড়ে (১৬৪৭)। উজবেক বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং সবাই প্রায় আবদুল আজিজকে ফেলে রেখে চলে যায়।

বালখ জয় ও উজবেক শক্তির ছন্নছাড়া অবস্থা শাহজাহান যদি চেয়ে থাকেন। তাহলে তার কাছে সমরখন্দ ও বুখারা আক্রমণ করে দখল করার একটা সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল। অবশ্য আগে শাহ দ্বিতীয় আব্বাসকে লেখা একটি পত্রে শাহজাহান। বলেছিলেন যে বালখ জয় ছিল সমরখন্দ ও বুখারা জয় করার নিছক মুখবন্ধ এবং শাহকে এই অনুরোধও করা হয়েছিল যে যেহেতু নজর মহম্মদ ফিরে এসে আর কোনোভাবেই মুঘলদের হয়ে বালখের সিংহাসনে বসার জায়গায় নেই, সেহেতু তাকে সসম্মানে মক্কায় তীর্থ করতে যেতে অনুমতি দেওয়া হোক। বালখে শাহজাদা মুরদ থাকাকালীন শাহজাহান তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন যে তিনি তাকে সমরখন্দ ও বুখারার শাসক পদে বসাবেন। এসব দেখে মনে হয় শাহজাহানের হয়তো ইচ্ছা ছিল সমরখন্দ ও বুখারা জয় করার, কিন্তু যেভাবে স্থানীয় মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল, বিক্ষিপ্ত উজবেক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমঝোতা করার ক্ষেত্রে যেভাবে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল এবং সর্বোপরি মুঘল ও রাজপুত অভিজাতরা যেভাবে বালখে থাকার ব্যাপারে অনিচ্ছা প্রকাশ করছিলেন তাতে শাহজাহান বোধ হয় সেই বাসনা ছেড়ে বালখের শাসকের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার পুরোনো নীতিতেই ফিরে গিয়েছিলেন। বুখারা থেকে আবদুল আজিজ ও পারস্যে থাকা নজর মহম্মদ উভয়েই শাহজাহানের কাছে আবেদন করেছিলেন তাদের সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দেবার জন্য। অনেক বিচার বিবেচনা করে শাহজাহান নজর মহম্মদকে সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু নজর মহম্মদকে সবার আগে শাহজাদা ঔরঙ্গজেবের কাছে এসে ক্ষমা চাওয়া ও বিনম্র আনুগত্য প্রদর্শনের শর্ত দেওয়া হয়েছিল। এটা একটা ভুল পদক্ষেপ ছিল, কারণ জাতিগত গরিমায় গর্বিত উজবেক শাসক কখনোই এভাবে নিজেকে কারও কাছে বিকিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন না, বিশেষ করে যখন তিনি জানতেন যে দীর্ঘদিন ধরে মুঘলদের পক্ষে বালখ অঞ্চল দখল করে রাখা সম্ভব নয়। নজর মহম্মদ ব্যক্তিগত ভাবে এসে অনুগত প্রদর্শন করবেন এই নিষ্ফল আশা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে মুঘলরা অবশেষে ১৬৪৭ সালের অক্টোবর মাসে প্রবল শীতের মধ্যে রসদ ফুরিয়ে আসায় বালখ ত্যাগ করে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তাদের এই চলে যাবার খবর পেয়ে আশেপাশে ঘুরতে থাকা বিরোধী উজবেক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রবল দাঙ্গা বেঁধে যায় বালখের দখলকে কেন্দ্র করে। যদিও মুঘলরা নিদারুণ ক্ষতির শিকার হয়েছিল, তবুও ঔরঙ্গজেবের দক্ষতা ও বিচক্ষণতার কারণে সে যাত্রায় তারা বড়োসড়ো বিপর্যয় থেকে রেহাই পেয়েছিল।

শাহজাহানের বালখ অভিযান নিয়ে, আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। ঘটনা পরম্পরার যা বর্ণনা পাওয়া যায় তা থেকে এটা স্পষ্ট যে শাহজাহান মুঘল সীমানা তথাকথিত ‘বিজ্ঞানসম্মত রেখা’ আমু দরিয়া (অক্সাস নদী) পর্যন্ত নির্ধারণ করার খুব একটা চেষ্টা করেননি। আমরা আগেই দেখেছি আমু দরিয়া কোনোমতেই নিরাপদ সীমান্ত ছিল না। যদি শাহজাহান ভেবে থাকতেন যে সমরখন্দ ও বুখারা আক্রমণ করে মুঘলদের জন্মভুমি পুনরুদ্ধার করবেন, তাহলেও সেটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হত না। বালখ অঞ্চল দখল করেও মুঘলদের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের স্বাদ পূরণ হত বলেও মনে হয় না। যদিও বালখ অঞ্চলের চারপাশের এলাকার সুবিধা ছিল অনেক, কিন্তু পাশের বদাখাসান অঞ্চল ছিল পাহাড়ি এবং সেখানে সংকীর্ণ গিরিখাদগুলো শত্রুদের হাত থেকে সুরক্ষিত করে রাখা যথেষ্ট কঠিন ছিল। সেখান থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব কখনোই মুঘলদের আকৃষ্ট করত না। লাহোরির মতো বদাখাসানের সম্পদ থেকে একজন মুঘল রাজপুরুষের বেতন দেওয়াও সম্ভব হত না।

সমকালীন মুঘল ঐতিহাসিকরা এই যুক্তি দিয়ে শাহজাহানের বালখ অভিযানকে যথার্থ বলে প্রচার করতে চেয়েছিলেন যে কাবুল ও গজনি থেকে উজবেকদের আক্রমণের আশঙ্কা আগে থেকেই মুঘলদের বিব্রত করত, আর নজর মহম্মদকেও শায়েস্তা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল কারণ তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের অঞ্চল কাবুল আক্রমণ করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন। তাছাড়া শাহজাহান নাকি বালখ ও বদাখাসানের নাগরিকদের আবদুল আজিজের হয়ে লুঠতরাজ চালানো যাযাবর আলমান প্রজাতির হাত থেকে বাঁচানোর ইচ্ছা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। অন্যত্র উজবেকরা স্বৈরাচারী ও পাপী হিসাবে পরিচিত ছিল কারণ তারা আল্লা সাধনার পবিত্র স্থানকে অপবিত্র করেছিল। তাই তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোটা নাকি শাহজাহানের কর্তব্য ছিল।

কিন্তু এই সকল যুক্তি খুব একটা ধোপে টেকেনি। যেভাবে শাহজাহান ‘রোমাঞ্চকর’ নীতি নিয়ে প্রায় দেড় শতক আগে শেষ হয়ে যাওয়া মধ্য এশিয়ায় তৈমুরীয় শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার দুঃখজনক আবেগে ভেসেছিলেন, তার জন্য দোষ দিতে ছাড়েননি আধুনিক ঐতিহাসিক রিয়াজুল ইসলাম। তাই সুতীক্ষ্ণ ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে শাহজাহানই কার্যত কাবুল-কান্দাহার রেখাকে শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ উজবেক খানাতের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। উজবেক শিবিরে গৃহযুদ্ধ মুঘলদের কাছে খুব সুন্দর সুযোগ তুলে দিয়েছিল নজর মহম্মদকে তাঁর পুত্রের বিরুদ্ধে খাড়া করবার। সেই সঙ্গে মুঘলরা। উপরি পাওনা হিসাবে বদাখাসান লাভ করারও আশা করেছিল, এই বদাখাসান জায়গাটা অতটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও তাকে উপেক্ষা করা যেত না। তাই বলা হয় শাহজাহানের নীতি মূলত দাঁড়িয়ে ছিল বাস্তববাদী কূটনীতি বা real politik-এর ওপর। মুঘল বাহিনীর সহজ সাফল্যে মজে শাহজাহান প্রথম দিকে বালখ অঞ্চল দখল করার পরিকল্পনা করলেও কঠোর বাস্তবতা তাঁকে অচিরেই পরিকল্পনা বদলে ফেলতে বাধ্য করিয়েছিল।

সামরিক দিক থেকে বলা যায় মুঘলদের বালখ অভিযান বেশ সফল ছিল। : মুঘলরা বালখ অঞ্চল জয় করেছিল এবং উজবেকদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে। তাদের উৎখাত করে দিয়েছিল। এই অঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর এটাই ছিল প্রথম এত বড়ো জয় এবং তার জন্য শাহজাহানের গর্ব করা সাজে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ওই অঞ্চলকে সামরিক বাহিনী দিয়ে দখল করে রাখা কার্যত অসম্ভব ছিল। রাজনৈতিক ভাবেও এটা সম্ভব ছিল না কারণ পারস্যের শত্রুতা ও স্থানীয় মানুষের অসহযোগিতা বেশিদিন তাদের সেখানে টিকতে দিত না।

এসব সত্ত্বেও মুঘল অভিযানকে একেবারে নিষ্ফল বলা যাবে না। উজবেকদের মধ্যে বিভাজন কাবুল অঞ্চলকে নিরাপত্তা দান করেছিল এবং নাদির শাহের উত্থানের আগে পর্যন্ত প্রায় একশো বছর ভারত বৈদেশিক আক্রমণ থেকে নিরাপদ ছিল।

মুঘল-পারস্য সম্পর্ক—শেষ ধাপ

বালখের ধাক্কার পর কাবুল অঞ্চলে উজবেক উপদ্রব এবং খাইবার-গজনি অঞ্চলে আফগান উপজাতির অসন্তোষ নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। এরপর পারস্য ও কান্দাহার আক্রমণ ও অধিকার করার সাহস বেড়ে গিয়েছিল (১৬৪৯)। এটা ছিল শাহজাহানের কাছে একটা বড়ো বিপদ, আর তাই তিনি যুবরাজদের দিয়ে পরপর তিনটি অভিযান চালিয়ে কান্দাহার পুনর্দখলের চেষ্টা করেছিলেন। প্রথম আক্রমণ হানেন ৫০,০০০ সেনা নিয়ে বালখ অভিযানের নায়ক ঔরঙ্গজেব। পারস্য বাহিনীকে দুর্গের বাইরে বের করতে সক্ষম হলেও তাদের অদম্য লড়াইয়ের ফলে ঔরঙ্গজেবের নেতৃত্বে মুঘলরা সে-যাত্রায় কান্দাহার জয় করতে পারেননি।

তিন বছর পর ঔরঙ্গজেবের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বার আক্রমণ চালায় মুঘলরা, কিন্তু সেবারও অভিযান ব্যর্থ হয়। পরের বছর সবথেকে জমকালো প্রচেষ্টা চালান শাহজাহানের সবথেকে প্রিয় সন্তান শাহজাদা দারা (১৬৫৩)। যদিও তার জাঁকজমকের মতো কাজ তিনি করে দেখাতে পারেননি। বিশাল বাহিনী নিয়ে, সঙ্গে মুঘল সাম্রাজ্যের দুই বৃহত্তম বন্দুক কান্দাহারে বয়ে নিয়ে এসেও সারা দুর্গ দখল করতে পারেননি।

কয়েকজন ঐতিহাসিক বললেও কান্দাহারে মুঘলদের ব্যর্থতা দিয়ে সামরিক মুঘল গোলন্দাজ বাহিনীর দুর্বলতা প্রমাণ করা যায় না। বরং এটা প্রমাণ হয় যে কান্দাহার দুর্গের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা কত আঁটসাঁট ছিল, একজন দৃঢ়চেতা দুর্গ সেনাপতি কীভাবে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছিলেন এবং শক্তিশালী দুর্গের সামনে কীভাবে মধ্যযুগের কামান গোলা নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল (যা দাক্ষিণাত্যের ক্ষেত্রেও মুঘল বাহিনী প্রত্যক্ষ করেছিল)। সেই সঙ্গে কান্দাহারে বেশিদিন থাকাও মুঘলদের পক্ষে নিরাপদ ছিল না, কারণ শাহ পোড়ামাটির নীতি (scorched-earth policy) নিয়েছিল, আর মুঘলদের লাহোর থেকে রসদ আনতে হত যা খুব বেশিদিন এই নীতির ফলে অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। আর শীতকাল পর্যন্ত তো কোনোভাবেই মুঘলদের দুর্গ অবরোধ করে বসে থাকা যেত না। এটা মনে হয় যে শাহজাহানের এই কান্দাহার জয়ের বাসনা যতটা না বাস্তবিক ছিল, তার থেকে অনেক বেশি ছিল আবেগতাড়িত। উজবেক ও সাফাভিদদের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় কান্দাহারের কৌশলগত গুরুত্ব আগের মতো আর ছিল না। মুঘলদের একের-পর-এক ব্যর্থ চেষ্টা যা তাদের মর্যাদাহানি করলেও কান্দাহারের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। কিন্তু মুঘল বাহিনী বিদেশের মাটিতে তার গৌরব ও মর্যাদা চরমভাবে লাভ করেছিল ঔরঙ্গজেবের আমলে। এমনকি অহংকারী অটোমান সুলতানও ১৬৮০ সালে ঔরঙ্গজেবের কাছে। সাহায্য চেয়ে দূত প্রেরণ করেছিলেন বলে জানা যায়।

সিংহাসনে বসার পর ঔরঙ্গজেব কান্দাহার দখল করার নিরর্থক প্রতিযোগিতায় আর জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছুক ছিলেন না এবং তিনি চেষ্টা করেছিলেন ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে। যদিও ১৬৬৪ সালে ইরানের শাসক দ্বিতীয় শাহ আব্বাস মুঘল দূতকে অপমান করেছিলেন, ঔরঙ্গজেবকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন এবং আক্রমণের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। ইরানের শাহ কেন এটা করেছিলেন তা পরিষ্কার নয়। মনে হয় যে দ্বিতীয় শাহ আব্বাসদের দোদুল্যমান চরিত্রের এটা একটা দৃষ্টান্ত ছিল। তিনি পাঞ্জাব ও কাবুলে মুঘল কার্যকলাপ নিয়ে উদবিগ্ন ছিলেন বোধ হয়। কিন্তু তিনি কিছু করার আগেই মারা যান। তাঁর উত্তরসূরিরা সেভাবে দাগ কাটতে পারেননি এবং ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় কোনোরকম পারস্য আক্রমণের বিপদ কেটে যায় পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের জন্য, কারণ তারপরে আগমন ঘটেছিল নতুন শাসক নাদির শাহের।

সামগ্রিক ভাবে আমরা বলতে পারি যে মুঘলরা উত্তর-পশ্চিমে হিন্দুকুশকে পাশে রেখে এবং অন্যদিকে কাবুল-গজনি বরাবর কান্দাহারের গা ঘেঁষে একটি বিজ্ঞানসম্মত সীমান্ত রেখা বজায় রেখে চলতে সক্ষম হয়েছিল। সুতরাং তাদের বিদেশ নীতির মূল কথাই ছিল বৈদেশিক আক্রমণের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করা। এই সীমান্তরেখার নিরাপত্তা নির্ভর করত কূটনৈতিক পদক্ষেপের ওপর। কান্দাহার প্রশ্নে সাময়িক ধাক্কা খেলেও এই কূটনৈতিক পদক্ষেপের মূল স্তম্ভ ছিল পারস্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখা। মুঘল জন্মভুমির পুনরুদ্ধার করার বারংবার চেষ্টা আসলে ছিল কূটনৈতিক কৌশল, কখনোই তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি সেভাবে। মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বল হয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত সময়ে ভারতকে বৈদেশিক আক্রমণ থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে মুঘলদের এই পর্যায়ে সামরিক ও কূটনৈতিক সাফল্যের গুরুত্ব ছিল অনেক।

দ্বিতীয়ত, মুঘলরা সেই সময়কার এশিয়ার প্রথম সারির দেশগুলোর সঙ্গে সমতা বজায় রেখে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিল। বিশেষ করে সাফাভিদ, যারা। নিজেদেরকে ভাবগত ভাবে পরস্পরের সঙ্গে একটু বেশি সম্পর্ক আছে বলে দাবি করে মুসলিম দুনিয়ার কাছে বিশেষ সম্মানের প্রত্যাশা করত, আর অটোমান, যারা পাদশা-ই-ইসলাম উপাধি ধারণ করত এবং বাগদাদের খলিফের উত্তরসূরি বলে দাবি করত–এই দুই শক্তির সঙ্গে মুঘলরা বিশেষ সমতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। ছিল সব সময়।

তৃতীয়ত, মুঘলরা তাদের বৈদেশিক নীতিকে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করত। কাবুল ও কান্দাহার ছিল ভারতের মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করতে যাওয়ার দুই যমজ দ্বার। অসংখ্য ভারতীয় বণিক এ সময় ব্যবসার খাতিরে ইরানের বিভিন্ন শহরে বসতি গড়ে তুলেছিল। ইরানকে কেন্দ্র করে ভারতীয় বণিকরা তাদের কার্যকলাপ রাশিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিল। বাকু, ভলগা নদীর তীরবর্তী অস্ট্রখান ও কিয়েভ অঞ্চলে তারা বসতি গড়ে তুলেছিল। তারা মধ্য এশিয়ার বাজারগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সমরখন্দ ও বুখারার বাজার এলাকায় বসতি গড়ে তুলে ইরান। ও রাশিয়া উভয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়েছিল।

তাই বলা যায় যে, কোথাও-না-কোথাও শাসকরা বৈদেশিক সম্পর্কগুলোকে তাদের খেয়াল, আবেগ ও পূর্বের ধ্যানধারণার মাধ্যমে চালনা করেছিলেন। (রিয়াজুল ইসলাম) নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সব সময়েই ব্যক্তিগত বিষয় প্রভাব ফেলে, তারপর তা যদি কোনো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ হয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই। কিন্তু উপরিউক্ত মুঘল বৈদেশিক নীতির গতিপ্রকৃতির বিশ্লেষণ করে মনে হয় যে

তথাকথিত ‘জাতীয় স্বার্থকে অনেক সম্রাটই তাদের নীতির মধ্যে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এবং সেই নীতি অনেক সময়েই ব্যক্তিগত আবেগকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল।

১. জাহাঙ্গির তাঁর স্মৃতিগ্রন্থে বলেছিলেন যে ওই সময়ে দুর্গে ৩০০ কি ৪০০ সেবা কর্মী ছিল। তবে মনে হয় এরা ছিল দুর্গে নিযুক্ত মুঘল সেনাপ্রধান খাজা আবদুল আজিজের ব্যক্তিগত অনুচরের দল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *