০৫. সাম্রাজ্য সুদৃঢ়করণ ও বিস্তার—আকবরের আগমন

পঞ্চম অধ্যায় – সাম্রাজ্য সুদৃঢ়করণ ও বিস্তার—আকবরের আগমন

আফগানদের সঙ্গে সংঘর্ষ : দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধ

মুঘলদের ১৫৫৫ সালে দিল্লি ফিরে আসার মধ্য দিয়ে আফগান আতঙ্ক কিন্তু নিঃশেষিত হয়ে যায়নি বরং দিল্লিতে হুমায়ুনের মৃত্যুর (১৫৫৬) অব্যবহিত পরেই তাদের ভারত থেকে পুনরায় বিতাড়িত করে দেওয়া হয়েছিল। ঈশ্বরীপ্রসাদের কথায়, ‘…আফগান সাম্রাজ্যের পতন হয়ে গেলেও তাদের লোকজন ও নেতাদের কাছে তখনও অবধি এত শক্তি ও সম্পদ অবশিষ্ট ছিল যে মুঘলদের পুনরায় ভারত জয় করা ছিল কার্যত অসম্ভব।’ ১৫৫৪-র সিরহিন্দের যুদ্ধে মুঘলদের হাতে সিকান্দার শূরের বাহিনীর একটা বড়ো অংশ খুব বাজে ভাবে পরাজিত হলেও তার কাছে পাঞ্জাবের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বেশ শক্তিশালী বাহিনী তখনও গচ্ছিত ছিল। শূর সিংহাসনের অন্যতম দাবিদার। আদালি চুনার থেকে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। বাংলা ছিল মহম্মদ খান শূরের দখলে। জৌনপুরের কাছে জালাল খান শূরের পুত্রের উদ্যোগে ৫০,০০০ আফগান সেনার জমায়েত হয়েছিল। হুমায়ুনের মৃত্যুর কথা শুনে আফগান সেনা হীন-মনোবল ঝেড়ে ফেলে নব উদ্যোগে ‘হাজারে হাজারে ছুটে গিয়েছিল। দশজন বড়ো পাগড়িওয়ালা অশ্বারোহী যোদ্ধা অর্থাৎ মুঘলদের দিকে’ (বদায়ুনি)। শক্তির নব কলেবরে জেগে ওঠা আফগানরা এক ধাক্কায় মুঘলদের বায়না, ইটাওয়া, সম্ভল, কল্পি, নারনাউল ও আগ্রা থেকে উৎখাত করে দিয়েছিল এবং আদালির সেনাপ্রধান হেমু ‘হিন্দুস্থানের সীমান্তবর্তী এলাকা (অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম ভারত) থেকে সরে এসে’ বদায়ুনির মত অনুসারে, ‘৫০,০০০ ঘোড়সওয়ার, ১,০০০ হস্তীবাহিনী, ৫১টি বড়ো কামান ও ৫০০ ছোটো কামান সহযোগে দিল্লির উদ্দেশ্যে অভিযান চালিয়েছিলেন।’

একজন ‘বাক্কাল’ (ব্যবসায়ী) হেমুর রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে উত্থান নিয়ে এক বড়োসড়ো ঐতিহাসিক বিভ্রান্তি রয়েছে। দেওলি-সাচারীতে বসবাস করতেন তিনি, সেখান থেকে বলা হয় তিনি অলওয়ার নগরীতে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই রেওয়ারিতে সোরা ব্যবসায়ী হিসাবে কর্মজীবনের সূচনা করেছিলেন। এরপর তিনি নাকি ইসলাম শাহের আমলে দিল্লির বাজারে ‘শুহনা’ (তত্ত্বাবধায়ক) পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং একই সঙ্গে সৈনিকবৃত্তিও গ্রহণ করেছিলেন। এরপর থেকে আদালির সেনাবাহিনীর প্রধান ও উজির পদে হেমুর উত্থানের ইতিহাস আমাদের কাছে অজানা। তবে এটা জানা যায় যে তিনি প্রথম থেকেই আদালির বিশ্বাসভাজন ছিলেন। সুলতান। আদিল শাহ বা আদালির হয়ে তিনি বাইশটি যুদ্ধ জিতেছিলেন বলে জানা যায়। যদিও হেমুকে দিল্লিতে হিন্দু শক্তির পুনরুদ্ধার অভিযানের নেতা হিসাবে তুলে ধরার যে চেষ্টা কেউ কেউ করেছিলেন তা একেবারেই ভ্রান্ত। আবুল ফজলের মতে, তরদি বেগের। বিরুদ্ধে দিল্লির যুদ্ধে জয়লাভের পর হেমুর মাথায় ‘স্বাধীন হবার বাসনা’ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। বায়ুনি বলেছেন যে ঠিক হিন্দুস্থানের এক মহান রাজার মতো হেমু বিক্রমজিৎ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন এবং নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন ইসলামের প্রতিপত্তি চুরমার করে দিতে। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় যে এই অভিযোগের পরিপ্রক্ষিতে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ দিতে পারেননি বায়ুনি। নিজামুদ্দিন আহমেদ কেবলমাত্র এটা উল্লেখ করেছেন যে হেমু ‘রাজা বিক্রমজিৎ’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং উপরিউক্ত সকল ঐতিহাসিক এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে হেমু এই উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে নিজের স্বাধীন হিন্দু রাজনৈতিক পরিচিতি প্রতিষ্ঠায়। উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে এটা বলতেই হবে যে এই ‘বিক্রমজিৎ’ উপাধি গ্রহণ করার অর্থ এই নয় যে হেমু নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন বা হিন্দুত্বের জয়গান গেয়েছিলেন। কারণ তার অধীনে থাকা সেনাদলে প্রায় সকলেই ছিল আফগান। তাছাড়া ৫ নভেম্বর, ১৫৫৬ পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে বৈরাম খাঁ-এর বিরুদ্ধে যে বাহিনী নিয়ে হেমু লড়াই করেছিলেন তার কেবল বাম দিকের অংশের সেনাধিপতি ছিলেন তার ভগিনীর পুত্র রামিয়া। বাকি বাহিনীর কোথাও কোনো হিন্দু বা রাজপুত সেনা থাকার কথা জানা যায় না। তাই এরকম পরিস্থিতিতে হেমু নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং হেমুর বিরুদ্ধে তারই আফগান সেনাদের প্রতি অত্যাচারের অভিযোগ শোনা যায়। বদায়ুনি তো নিজেই বলেছেন যে তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তারা তার পতনের প্রার্থনা করেছিলেন। তাই এই অবস্থায় নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করা ছিল হেমুর কাছে। একপ্রকার অসম্ভব ও বিপজ্জনক। তাছাড়া হেমুর এই দ্রুত ক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে আসা ও আদালির বিশ্বাস অর্জন করে তার সেনাবাহিনী ও রাজকোষ ব্যবহারের অবাধ অধিকার ভোগ করার ঘটনা যে অনেককেই ঈর্ষান্বিত করেছিল সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আসলে হেমুর এই উত্থানটা ছিল আফগান শাসনে বিকশিত হওয়া অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা এবং আফগানদের সঙ্গে হিন্দু রাজাদের ক্রমবর্ধমান মেলবন্ধনের এক সার্থক সূচক। এটা বাবরের সময়েও দেখা গিয়েছিল এবং তার ফলেই আমরা দেখেছি রানা প্রতাপের দিকে এগিয়ে এসেছিল আফগানদের সাহায্যের হাত।

পানিপথের প্রান্তরে হেমুর পরাজয়ের পিছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। যেমন তাঁর অধীনে থাকা কয়েকজন আফগান সর্দার শেষবেলায় এসে তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। নিজ গোলন্দাজ বাহিনীকে হেমু ভীষণভাবে উপেক্ষা করেছিলেন এবং আগে একবার এই উপেক্ষার জন্যেও মুঘল বাহিনীকে আঘাত হানার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। তাছাড়া তিনি বড্ড বেশি তার সু-অস্ত্র সজ্জিত ও প্রশিক্ষিত হস্তীবাহিনীর ওপর নির্ভর করে নিজের বিপদ ডেকে এনেছিলেন। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে ভাগ্য সঙ্গে ছিল না হেমুর। মুঘল বাহিনীর ডান ও বাম দিকের অংশ যখন দিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল তখন সুযোগ বুঝে হেম খুব সাফল্যের সঙ্গেই মাঝখান দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু তখনই একটা তির এসে তার চোখে লাগে এবং তিনি জ্ঞান হারিয়ে নিচে পড়ে যান। তাকে না দেখতে পয়ে তার সেনাবাহিনী আতঙ্কিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। হেমুকে আটক করে বৈরাম খায়ের কাছে আনা হয় এবং বালক আকবর তরবারি দিয়ে তার গলায় শক্ত করে ধরার শখ পূরণ করার পরেই বৈরাম খাঁ তাকে হত্যা করেন।

হেমুর পরাজিত সেনাবাহিনীকে হত্যা করে তাদের কাটা মাথা দিয়ে প্রথাগতভাবে মিনার বানানো হয়। জানা যায় যে প্রচুর পরিমাণে ধন সম্পদ লুঠ করা হয়। এমনকি হেমুর পত্নী সোনা বোঝাই এক হস্তীতে চড়ে পালানোর সময় তাকে না কি কোনোভাবেই আটকানোর বা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে বাধা দেওয়ার কোনোরকম চেষ্টাও করা হয়নি। কারণ সোনা যতটা না তিনি নিয়ে পালিয়েছিলেন তার থেকে অনেক বেশি সোনা তিনি ফেলে রেখে গিয়েছিলেন। এরপর হেমুর বাসস্থানে আক্রমণ চালানো হয় এবং তাঁর পিতাকে হত্যা করা হয়। ঐতিহাসিক আবুল ফজল হেমুর অদম্য স্পৃহা, সাহসিকতা ও উদ্যমের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন যে, যদি আকবর নিজে সে সময় যুদ্ধক্ষেত্রে পদার্পণ করতেন বা মুঘল শিবিরের কোনো দূরদর্শী নেতা হেমুর সঙ্গে যুদ্ধ করতেন তাহলে নিঃসন্দেহে হেমুকে তারা হত্যা করতেন না, বরং তাকে বন্দি করে নিয়ে যেতেন, আর যদি তাকে রাজকীয় কাজে নিয়োগ করা হত তাহলে তিনি প্রতিদানে দারুণ কাজ করে দেখাতে পারতেন।

যাই হোক, হেমুর পরাজয়ের পরেও কিন্তু আফগান আতঙ্ক শেষ হয়ে যায়নি। মানকোটে সিকান্দার শূরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে মুঘলদের প্রায় ছয় মাস ধরে ক্রমাগত সামরিক অভিযান ও অবরোধ করতে হয়েছিল। আদালি অনেক আগেই বাংলার রাজার সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন। কিন্তু তখনও জৌনপুরের আফগান সর্দাররা বেশ সক্রিয় ছিলেন। আবুল ফজলের মতে, ‘আফগানদের মগজে তখনও বিদ্রোহের বুদবুদ ভরে ছিল। আলি কুলি খান জামান সম্ভল পর্যন্ত আফগানদের তাড়া করেছিলেন এবং ২০,০০০ সাওয়ার বাহিনীকে আটক করেছিলেন। এরপর তিনি জৌনপুরের দিকে অগ্রসর হন এবং কোনোরকম বাধা ছাড়াই তা দখল করেন। আফগান সর্দারদের তখনও চুনার ও রোহতাসের মতো শক্তিশালী দুর্গের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল এবং তারা বারবার চেষ্টা করছিল জৌনপুরকে ঘিরে পৃথক রাজ্য গড়ে তোলার। তাই বৈরাম খাঁর পরাজয়ের পরে (১৫৬০) আফগানরা চুনার দুর্গের সেনাপ্রধান তথা আদালির পুত্র শের খানকে তাদের রাজা হিসাবে ঘোষণা করে দেয় এবং ২০, ০০০ অশ্বারোহী, ৫০,০০০ পদাতিক ও ৫০০ হস্তীবাহিনী সহযোগে জৌনপুরের দিকে অগ্রসর হয়। জৌনপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক আলি কুলি খান জামানের ভাগ্য ভালো যে তিনি সেখানকার স্থানীয় জায়গিরদারদের সাহায্য পেয়েছিলেন এবং আফগানদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৫৬৪ সালে আফগানরা সালিন শূরের পুত্র আওয়াজ খানকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করে তৃতীয়বার জৌনপুর আক্রমণের চেষ্টা করেছিল। তারা শহরটি ঘিরে ফেলে লুণ্ঠন শুরু করে ও ছড়িয়ে পড়ে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আলি কুলি খান জামান তাদের ওপর পালটা আক্রমণ চালান এবং পুরোপুরিভাবে আফগানদের পরাজিত করেন।

এরপর পূর্বদিক থেকে সমস্যা দেখা দেয়। আফগানদের পরাজিত করে আলি কুলি খান জামান নিজের স্বাধীন হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। বিহারের আফগানদের সঙ্গে সক্রিয় আঁতাত স্থাপন করে তিনি বাংলার আফগানদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। মুঘলদের সামনে পূর্ব দিক থেকে তৈরি হয় নতুন জটিলতা।

এভাবেই আকবরের শাসনের একেবারে প্রথম দিকে মুঘল সাম্রাজ্যকে পূর্বাঞ্চলের সমস্যাগুলির সম্মুখীন হতে হয়েছিল ঠিক যেমনটা ঘটেছিল হুমায়ুনের সিংহাসন আরোহণের অব্যবহিত পরে। এখন আমাদের দেখার আকবর কীভাবে সেই সমস্যগুলির মোকাবিলা করেছিলেন।

অভিজাতদের সঙ্গে সংঘাত

বৈরাম খাঁর অন্তর্বর্তী শাসন

১৫৪২ সালের ১৫ই অক্টোবর অমরকোটে জন্মগ্রহণ করেন জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবর। জন্মের সময় তার পিতা হুমায়ুন বিকানের থেকে অন্যত্র পলায়ন করছিলেন বলে জানা যায়। ফলে আকবরের জীবন ছিল রোমাঞ্চকর। আকবরের যখন এক বছর বয়স তখন কামরানের আক্রমণ থেকে বাঁচতে নিজ পুত্রকে পরিত্যাগ করে হুমায়ুন ইরানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। দু’বছর ধরে আকবর কামরানের হেফাজতেই বহাল তবিয়তে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। হুমায়ুন কিছুদিন পর ইরানীয় সামরিক বাহিনীর সহায়তায় কান্দাহার দখল করে কাবুল পুনর্দখলের উদ্দেশ্যে কামরানের দিকে এগিয়ে এলে অত্যন্ত জঘন্যতার পরিচয় দিয়ে কামরান বালক আকবরকে হুমায়ুনের পদাতিক বাহিনীর গোলার নিশানার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং এরপরই হুমায়ুন কামরানের কাছে কাবুল হারিয়ে ফেলেন। তবে অক্ষত অবস্থায় আকবর সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এরপর একাধিক গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করে ছোট্ট আকবরকে একজন যোগ্য যুবরাজ হয়ে ওঠার জন্যে প্রয়োজনীয় সকল পাঠ প্রদানের চেষ্টা করা। হয়। কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্রই মনোযোগ ছিল না, বরং শিকার করতে, ঘোড়ায় চড়তে, জন্তু জানোয়ারের খেলা দেখতে বা পায়রা ওড়ানোর মতো সময় কাটানোর কাজ করতেই বেশি ভালো লাগত তার। তাই তিনি বুনিয়াদি শিক্ষা লাভে এত অবহেলা করেছিলেন যে আর পরে তিনি কখনোই লিখতে শিখতে পারেননি।

যখন আকবর কালানৌরে সিকান্দার শূরের বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে যাচ্ছিলেন তখন দিল্লিতে গ্রন্থাগার থেকে পড়ে গিয়ে হুমায়ুনের মৃত্যু ঘটার সংবাদ এসে পৌঁছায়। মুঘল দরবারের সম্মিলিত অভিজাতগোষ্ঠী এরপর পরবর্তী মুঘল সম্রাট হিসাবে নাবালক আকবরকে সিংহাসনে বসিয়ে দেয় এবং হুমায়ুন কর্তৃক নিযুক্ত আকবরের গৃহশিক্ষক ও অভিজ্ঞ প্রশাসক তথা যোদ্ধা বৈরাম খাঁকে ‘ওয়াকিল মুতলগ’ পদে নিয়োগ করে তাঁর হাতে সমস্ত রকম রাজনৈতিক ও আর্থিক বিষয় দেখাশোনার দায়িত্ব তুলে দেয়। যেহেতু এই সময় মুঘলদের অবস্থা এদেশে সেরকম সুদৃঢ় ছিল না এবং অভিজাততন্ত্রের মধ্যে তখনও দলাদলি ও ঝিমিয়ে পড়ার প্রবণতা বর্তমান ছিল, সেহেতু বহু অভিজাতই আফগানদের পুনরায় আক্রমণের ভয়ে পালিয়ে যেতে চাওয়ায় কেউ আর আলাদা করে বৈরাম খাঁয়ের গৃহশিক্ষক থেকে ওয়াকিল পদে উন্নীত হবার বিরোধিতা করেননি। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বৈরাম এরপর তুচ্ছ অজুহাতে তরদি বেগকে হত্যা ও তার দলবলকে কারারুদ্ধ করেন। আগেই হুমায়ুনের ঘনিষ্ঠ আর-এক অভিজাত আবুল মৌলীকে আকবরের রাজ্যাভিষেকের সম্মানার্থে আয়োজিত এক উৎসব থেকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। আসলে এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়াটা বৈরাম খাঁর পক্ষে জরুরি ছিল, কারণ তিনি জানতেন এইসব অভিজাতরা ছিলেন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। এইসব পথের কাঁটা পেরিয়েই তাকে উপরে উঠতে হয়েছিল। তাই তরদি বেগের মৃত্যুদণ্ডের খবর তিন মাস গোপন রাখা হয়েছিল যাতে বৈরাম খাঁর নতুন পদ গ্রহণ করার প্রক্রিয়া শান্তিতে মিটে যেতে পারে। এসব দেখে আর-এক প্রতিদ্বন্দ্বীও হুমায়ুনের বিশ্বাসভাজন অভিজাত তথা কাবুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক মুনিম খান কাবুল ছেড়ে ভারতে চলে আসার পরিকল্পনা বাতিল করেছিলেন। কিন্তু কেন, তা নিয়ে কোথাও-না-কোথাও সন্দেহের উদ্রেক হয়। তবে যাই হোক এই সব ঘটনা প্রকৃতপক্ষে বৈরাম খাঁর তথাকথিত অন্তর্বতী শাসনের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল এবং এই শাসন বলবৎ ছিল ১৫৫৬ থেকে ১৫৬০ টানা চার বছর। গতকাল ম এই অন্তর্বর্তী শাসন চলাকালীন বৈরাম খাঁ নিজ দক্ষতায় অনেক কিছু করেছিলেন। তিনি কাবুল থেকে বাদাখশানের শাসক মির্জা সুলেমানের হুঁশিয়ারি বিনষ্ট করে সে অঞ্চল জয় করেছিলেন এবং পূর্বে কাবুল থেকে জৌনপুর ও পশ্চিমে আজমের পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়ে ছিলেন। গোয়ালিয়রের শক্তিশালী দুর্গ দখল করেছিলেন। মালব জয়ের জন্যেও এক সেনা অভিযান, প্রেরণ করেছিলন তিনি। এমনকি রনথম্বর অধিকার করারও একটা চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সে চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় তার পতন শুরু হওয়ায়।

বৈরাম খাঁ-এর এই দ্রুত পতনের পশ্চাতে একাধিক কারণ ছিল। বলা বাহুল্য, উচ্চতম পদে বসে অভিজাতদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তাকে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল একেবারে শুরু থেকেই। আগেই আলোচনা করেছি কীভাবে বৈরাম তার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করে, অভিজাতদের ভয় দেখিয়ে তাদের আনুগত্য আদায় করতেন। সেই আনুগত্য ততদিনই ছিল যতদিন নাবালক আকবরের সমর্থন ও আস্থা পেয়েছিলেন বৈরাম। কিন্তু আকবরকে ছোটোবেলা থেকে লালন-পালন পালিকা মাতা (foster-mother) মাহম আনাগ, আটকা খাইল সহ অন্যান্য পালিকা মাতাগণ বৈরাম খাঁ-এর মাতব্বরিতে প্রচণ্ড ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিলেন এবং প্রাণপণে চেষ্টা। করেছিলেন আকবর ও বৈরামের সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরাতে। তাদের এই চেষ্টাকে আরও প্রবল করে দেন আকবরের নিজ মাতা হামিদ বানু বেগম সহ অন্যান্য মহিলা আত্মীয়স্বজনেরা। এরা কাবুল থেকে দিল্লি এসে আকবরের মাথায় বৈরামের বিরুদ্ধে বিষ ঢালতে শুরু করেন। ছোটো ছোটো ঘটনা যেমন বৈরামের তাঁবুর দিকে ভুল করে ছুটে আসা কিছু হাতির মাহুতকে সাজা দেওয়া, আকবরের কাছ থেকে কিছু হাতি কমিয়ে তার কয়েকজন অনুগামীকে দেওয়া ইত্যাদি তুলে ধরে বৈরামের বিরুদ্ধে আকবরকে বিষিয়ে দিতে শুরু করেন তারা। তবে তখনও পর্যন্ত আকবর এসব ব্যাপারে বৈরাম খাঁকেই সমর্থন করে যাচ্ছিলেন। এছাড়া ক্রমে অভিজাতরাও বৈরাম। খাঁর অবাধ্য হতে শুরু করেছিল। যেভাবে সব ক্ষমতা তিনি নিজের হাতে নতুবা তাঁর। একটি বিশ্বস্ত অভিজাত গোষ্ঠীর হাতে রেখে দিতে চেয়েছিলেন, তাতে বাকি অভিজাতদের অসন্তুষ্ট হয়ে পড়াটা ছিল স্বাভাবিক। বৈরাম খাঁ যেহেতু স্বাধীন কোনো শাসক ছিলেন না সেহেতু তার উপর নির্ভরশীল কোনো নূতন অভিজাত শ্রেণি গড়ে তুলতে পারেননি। তিনি তার প্রতি অনুগত নিচুতলার কিছু আধিকারিকদের অনুমোদনের জন্যে সুপারিশ করতেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি কার্যত নিজের পছন্দের লোকজনদের নিয়েই দরবারে পৃথক অভিজাত গোষ্ঠী গড়ে ফেলেছিলেন যা অনেক অভিজাতই ভালো চোখে দেখেননি। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলে তার এই পছন্দের লোকজনদের নিয়ে গড়া গোষ্ঠীর অনেকেই কাজে দক্ষতা প্রমাণে ব্যর্থ হন। বা অনেকের মধ্যেই ঔদ্ধত্য দেখা দিতে শুরু করে। বৈরাম খাঁ-এর পছন্দের এক সদর। শেখ গাদাই-এর ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা গিয়েছিল। আগে বৈরামের প্রতিনিধি হিসাবে। সাম্রাজ্যের রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয় দেখাশোনা করতেন বরিষ্ঠ অভিজাত পীর মহম্মদ খান। অনিচ্ছাকৃত ব্যক্তিগত একটি কারণে রুষ্ট হয়ে বৈরাম তাকে কাজ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন একটা সময়। এই পীর মহম্মদ যখন অসুস্থ ছিলেন তখন তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন বৈরাম, কিন্তু তার ভৃত্য বৈরামকে না চেনার ভান করে তাকে ঘরে ঢুকতেই দেয়নি। বৈরাম-ঘনিষ্ঠ শেখ গাদাই এবার সেই সুযোগে রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয় দেখাশোনার কাজে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন। মদত-ই-মাশ (নিষ্কর জমি) প্রদানের। সময় তিনি প্রচণ্ড রকম ঔদ্ধত্য ও কার্পণ্য প্রদর্শন করেছিলেন বলে জানা যায়। এমনকি আবেদনকারী নিজে উপস্থিত না থাকলে তাকে মদত-ই-মাশ তিনি প্রদানই করতেন না। কয়েকজন আধুনিক ঐতিহাসিক অভিযোগ করেন যে শেখ গাদাই না ছিলেন। অন্ত্যজ, না ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। তবুও বৈরামের অন্তর্বর্তী শাসনের প্রথম বছরেই তাঁকে সদর পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল। এভাবেই শুরু থেকে গাদাইকে আশকারা দিয়ে গিয়েছিলেন বৈরাম। কিন্তু গোঁড়া মুসলিম বায়ুনি তার পাণ্ডিত্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন যে, কয়েক বছর ধরে শেখ গাদাই হিন্দুস্থান, খুরাসান, ট্রানসঅক্সিয়ানা ও ইরাকের সন্ত ও পণ্ডিতদের ধর্মীয় প্রশ্নের সঠিক জবাব দিয়ে যথেষ্ট নাম কুড়িয়েছিলেন। এটাই তার শিয়া মুসলমান হওয়ার প্রমাণ। আর বৈরাম খাঁ-ও শিয়া ছিলেন বলে তুর্কি অভিজাতদের দাবি ছিল। কারণ তিনি নাকি জাতিতে ইরানীয় তুর্কি ছিলেন। ইরানীয় তুর্কিরা সাধারণত শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এটা ধরে নেওয়া হত। তাই হয়তো গাদাইকে বৈরাম প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করা হত। কিন্তু বৈরাম খাঁ নিজে ছিলেন উদারপন্থী এবং সকল সম্প্রদায়ের মানুষের। সঙ্গেই তিনি কাজ করতেন। তাঁর জ্ঞান, উদারতা, বিচক্ষণতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা ও মানবতার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন বায়ুনি। এমনকি এটাও বলেছিলেন যে মুঘলরা দ্বিতীয়বার হিন্দুস্থান জয় করতে ও নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে কখনোই পারত না বৈরামের অবদান ছাড়া। বৈরামকে ‘ধর্ম বান্ধব’ বলে উল্লেখ করে বদায়ুনি তার প্রত্যহ নামাজ পড়ার কথাও জানিয়েছিলেন। একজন গোঁড়া সুন্নি মুসলমান হয়েও যেভাবে বদায়ুনি তার প্রশংসা করেছিলেন তা এক কথায় ছিল অভাবনীয়। মুঘল দরবারে সে সময় চাঘতাই তুর্কি অভিজাতদের প্রাধান্য ছিল। বৈরাম তাদের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে কাজ করেছিলেন এবং তদের স্থানান্তরিত করার কোনো চেষ্টা করেননি। আলি কুলি খান জামান, তাঁর ভ্রাতা বাহাদুর খান প্রমুখ তাবড় তাবড় উজবেকদের নিয়ে গঠিত শক্তিশালী তুর্কি অভিজাত গোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তুর্কি অভিজাতরাও বৈরাম খাঁর সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু তারা খুবই ঈর্ষান্বিত ছিলেন বৈরামের প্রতি এবং সব সময়েই চেষ্টা করতেন তার বিরুদ্ধে আকবরের কান ভাঙাতে। শেখ গাদাই যখন নিছক একজন করণিক হয়ে রাজস্ব ও প্রশাসনিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছিলেন, তখন এই অভিজাত গোষ্ঠীর কাছে একটা সুযোগ এসে যায় বৈরাম খাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ দেবার। শেখ গাদাই-এর ঔদ্ধত্যও সকলকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।

কিন্তু যারা নিজেরাই সব ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ভোগ করতে চাইত তারা শুধু ঈর্ষান্বিত ছিল এটা বলা ঠিক হবে না, এরা চিন্তিত ছিলেন একটা বিষয়ে যে যুবরাজ আকবর ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছিলেন, কিন্তু তার ক্ষমতা ভোগ করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না, অথচ এক শ্রেণির নিচু পদের লোকজন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কাজে প্রচণ্ড ভাবে হস্তক্ষেপ করছিলেন, এটা তারা সহ্য করতে পারছিলেন না। এখানেই আকবরের কাছে থাকা মহিলাদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। মাহাম আনাগা আকবরকে বুঝিয়েছিলেন যে, ‘যতদিন বৈরাম খাঁ থাকবেন ততদিন তিনি তার প্রভুকে (আকবর) সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে দেবেন না। বাস্তবে সাম্রাজ্যের সব ক্ষমতাই কিন্তু তাঁর কাছে রেখে দেবেন’ (নিজামুদ্দিন)। বৈরাম খাঁর তরফ থেকেও করা কিছু ভুল বাধ্য করেছিল এই মন্তব্য কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য করতে। যখন সম্রাটের কর্মচারীরা কম। জায়গির নিয়ে দারিদ্রে দিন কাটাচ্ছিল, তখন খান-ই-খানান বৈরাম খাঁ বহাল তবিয়তে বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন করছিলেন। জঘন্যতম ঘটনা তো তখন ঘটল যখন কেউ বৈরামের কাছে সতেরো টাকা চেয়েছিল। সম্রাটের নিজস্ব কোনো অর্থকোষ থাকে না বলে বৈরাম তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। সৌভাগ্যের বিষয় যে সে-সময় মাহাম আনাগ এ-ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে নিজের তহবিল থেকে সেই অর্থ প্রদান করেছিলেন।

আমাদের আর আলাদা করে এটা বলে দেবার প্রয়োজন নেই যে বৈরাম খাঁর পতনের পিছনে একাধিক ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছিল। সবথেকে বড়ো ষড়যন্ত্রটা করা হয়েছিল আকবরের শিকারের জন্যে আগ্রা থেকে দিল্লি গমনের পর। একবার শুধু আকবর একটা ফরমান জারি করে সকল অভিজাতদের তার কাছে উপস্থিত হতে বলেছিলেন, আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বৈরাম-বিরোধী সকল অভিজাত গোষ্ঠী এককাট্টা হয়ে বৈরামের কর্তৃত্ব পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন আকবরের কাছে। এমনকি বৈরামের ঘনিষ্ঠ অভিজাতদেরও দল ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একা বৈরাম আকবরের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে চাইলেন কিন্তু তাকে উৎখাত করতে চাওয়া অভিজাতদের বিদ্রোহের কাছে আটকে পড়লেন। বিকানের থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে যখন তিনি পাঞ্জাবে পৌঁছোলেন, সবাই তাঁকে পলাতক বিদ্রোহীর তকমা দিল। আত্মরক্ষার্থে আকবরের বিরুদ্ধে সেখানে যুদ্ধ করতে চেষ্টা করলেও পরাজিত হলেন এবং অবশেষে আকবরের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। আকবর তাকে কল্পি ও চন্দেরির সরকারে বিশাল জায়গির, সম্রাটের গোপন উপদেষ্টা পদ বা মক্কা ভ্রমণ–এই তিনটির মধ্যে থেকে একটা বিকল্প বেছে নেওয়ার, সুযোগ দিলেন। বৈরাম বাছলেন শেষ বিকল্পকে এবং সব ছেড়ে-ছুঁড়ে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে পথে গুজরাটের পাটানের কাছে এক আফগানের হাতে খুন হয়ে যান তিনি। বৈরমের অন্যতম স্ত্রী তথা আকবরের দূরসম্পর্কের বোন সালিমাকে আকবর এরপর বিবাহ করেন। অভিজাত আবদুর রহিমের কাছে যুবক আকবরের দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়; এবং এই সময়ে আবদুর রহিম একজন বড়ো অভিজাত হয়ে উঠেছিলেন।

বৈরাম খাঁর পতনকে খুরাসানি (পূর্ব ইরান) অভিজাতদের বিরুদ্ধে তুর্কি আমির ওমরাহদের প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা ঠিক হবে না বোধ হয়। কারণ এ সময় কোনো তুর্কি অভিজাতের পদস্খলন হয়নি কিন্তু। বরং আধুনিক ঐতিহাসিকদের একাংশ তার পতনকে দেখতে চেয়েছেন ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে রাখার একটি প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে। এ ধরনের কেন্দ্রীভূত নীতি একজন সত্যিকারের সম্রাট যাঁর নিজস্ব সামরিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব আছে, তার পক্ষেই নেওয়া সম্ভব। বৈরাম খাঁর মতো রাজকর্মচারীর পক্ষে নিজ হাতে রাজকীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তার আর-একটি ভুল হয়েছিল। তিনি কিন্তু অভিজাতদের জায়গির থেকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা কেড়ে নেবার চেষ্টা, করেননি, ফলে ‘খালিসা’ জমির রাজস্ব এই সকল অভিজাতদের পকেটেই চলে যেত, রাষ্ট্রের কাছে কার্যত কিছুই আসত না। এদিকে ‘জমা বা রাষ্ট্রের নির্ধারিত রাজস্ব আয়ের হিসাব দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কাগজের আয় ও বাস্তবিক আয়ের মধ্যে ফারাক ক্রমশ বেড়ে গিয়েছিল। এর ফলে স্বজনপোষণের প্রবণতা দরবারে ব্যাপক আকার ধারণ করে–যা বৈরামের সমালোচকদের হাতে তাঁকে বিরোধিতা করার একটা বাড়তি হাতিয়ার তুলে দেয়।

ওয়াকিলিয়ত-এর জন্য লড়াই, উজবেক ও অন্যান্য অভিজাতদের বিদ্রোহ

বৈরাম খাঁর পতন অভিজাততন্ত্রের মধ্যে দলাদলি প্রকট করে তুলেছিল আর রাজকীয় ইচ্ছা ও স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে শক্তিশালী অভিজাতদের মধ্যে যে যার মতো করে কাজ করার ভয়ানক প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে আর্থিক, সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে একাধিক সুযোগসুবিধা সম্বলিত অত্যন্ত সম্মানীয় ‘ওয়াকিল’ পদটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ বিভিন্ন গোষ্ঠীর অভিজাতদের মধ্যে এই পদকে ঘিরে শুরু হয় চরম সংঘাত। এই পদের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মাহাম আনাগ, যিনি তার নিজ পুত্র অধম খানের জন্য এই পদ দখল করার জন্যে উদগ্রীব ছিলেন। আর ছিলেন আকবরের পালক পিতা তথা বৈরাম খাঁর পতনের পিছনে অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী শামসুদ্দিন আটকা খান। কিন্তু আকবর এই পদটি এদের কাউকেই দিয়ে দান করেন মুনিম খানকে। কাবুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক এই মুনিম খান আসলে হুমায়ুনের খুব ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এবং আকবর তাঁকে বৈরাম খাঁর মতোই ‘খান বাবা’ বা ‘বাবা-আম’ (আমার বাবা) বলে ডাকতেন। মুনিম খান কিন্তু মাহাম আনাগের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই কাজ করতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি খুব ভালো করেই জানতেন। যে যুবক সম্রাটের সবথেকে নিকটে থাকার দরুন মাহাম আনাগের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল বিশাল। তার বহু অনুগামী ও ঘনিষ্ঠদের দরবারের উচ্চ পদ নিয়োগ করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। কোনো কোনো ঐতিহাসিক তো বৈরামের পতন (মার্চ, ১৫৬০) থেকে মুনিম খানের প্রথম ‘ওয়াকিল’ পদ গ্রহণ (সেপ্টেম্বর, ১৫৬০-নভেম্বর ১৫৬১) পর্যন্ত সময় টিকে বলে থাকেন এমন একটা পর্ব যখন রাজদরবারে মাহাম আনাগের প্রভাব পৌঁছেছিল চরমে। আবুল ফজলের মতে, এই সময়ে মাহাম আনাগ নিজেকেই প্রকৃত ওয়াকিল বলে মনে করতেন ও সেই হিসাবে মসনদে বসতেন। তবে তাই বলে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে এই সময়টা ছিল ‘এক নারীর আঁচলে বাঁধা শাসন’ (petticoat government) পর্ব, কারণ শাসনব্যবস্থায় তখন আকবরের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখা শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং তার আদেশ কোনোভাবেই অমান্য করা হত না। যদিও আবুল ফজলের কথায় ‘আকবর তখনও পর্দার আড়ালেই ছিলেন।’ অর্থাৎ তিনি প্রাত্যহিক প্রশাসনিক কাজে সেভাবে অংশ নিতে চাইতেন না ঠিকই, কিন্তু সময়মতো নিজেকে প্রকাশ করতেন। যেমন ১৫৬১ সালের শুরুর দিকে যখন আকবর জানতে পেরেছিলেন। যে মাহামের পুত্র অধম খান মালব জয় করতে গিয়ে লুঠ করে প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে। এসেছেন, তখন তিনি একদল সেনা নিয়ে অধম খানকে ঘিরে ধরেন এবং বাধ্য করেন। যুদ্ধে লুঠ করা সম্পদ ও হাতি তার হাতে তুলে দিতে। আবার আলি কুলি খান জামানের বিরুদ্ধে কারা (আধুনিক এলাহাবাদের কাছে) অঞ্চলে সেনাবাহিনী নিয়ে হানা দিয়ে তার কাছ থেকে প্রচুর ধনসম্পদ আদায় করেছিলেন। এসব আলি কুলি খান জৌনপুরে আফগানদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় বাজেয়াপ্ত করে নিজের জিম্মায় রেখে দিয়েছিলেন। আলি কুলি খান জামান মুনিম খানের পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থন লাভ করেছিলেন বলে সে-যাত্রায় বেঁচে গেলেও ১৫৬১ সালের নভেম্বরে মুনিম খানের। ওয়াকিল পদ থেকে অপসারণ এবং সেই পদে আটকা খানের নিয়োগ অভিজাতদের মধ্যে দলাদলিকে আরও তীক্ষ্ণ করে তুলেছিল যার ফলস্বরূপ মাহাম আনাগের প্রভাব কমে গিয়েছিল। মাহামও চুপ করে বসে থাকেননি। তাঁর পুত্র অধম খানকে দিয়ে আটকা খানকে তাঁরই দিওয়ানের মধ্যে খুন করিয়ে দেন। এই ঘটনায় আকবর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে অধম খানকে দুর্গের জানালা দিয়ে ফেলে মারার শাস্তি দেন। এই ঘটনার পর থেকেই কার্যত মাহাম আনাগের দাপট শেষে হয়ে যায় এবং কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। কোনোরকম প্রতিহিংসা মনের মধ্যে পুষে না রেখে আকবর অধম খানের জন্যে একটি মনোরম সমাধি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন যা এখনও রয়েছে।

আটকা খানের খুনের পর মুনিম খানকে পুনরায় ওয়াকিল করা হয়। কিন্তু এবার আকবর অভিজাততন্ত্রের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণকে সুদৃঢ় করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে মনঃস্থির করে ফেলেন। প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হয় ১৫৬১ সালে, যখন সমস্ত সরকার ও সুবার (সুবাগুলিকে বলা হত বিলায়ত) প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা সেনাপ্রধানদের তলব করে তাদের এলাকার রাজস্ব ক্ষেত্রগুলোর অনুসন্ধান শুরু করেন তিনি। এই পদক্ষেপের পিছনে একটা কারণ ছিল, আর তা হল দীর্ঘদিনের একটা অভিযোগ যে সরকার ও সুবার দায়িত্বে থাকা অভিজাতরা, বিশেষ করে তাদের জায়গির অঞ্চলের সেনাপ্রধানরা (হাকিম) খালিসা জমি থেকে রাষ্ট্রের আয়ের একটি অংশ আত্মসাৎ করছে। আর সেই কারণে সাম্রাজ্যের রাজকোষ প্রায় শূন্য হতে বসেছিল। এই কারণেই বোধ হয় আকবর বিভিন্ন অভিজাতের কাছ থেকে তাদের। যুদ্ধে লুণ্ঠিত ধনসম্পদের যথাযথ ভাগ কেড়ে নেবার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

এ সময় আর একটি পদক্ষেপের কথা ভাবা হয়েছিল। তা হল জায়গিরদারদের কার্যকরী ও রাজস্ব-সংক্রান্ত দায়িত্ব পৃথক করে দেওয়ার জন্যে তাদের জায়গিরের আয়তন কমিয়ে দেওয়ার, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে জায়গির ভেঙে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত প্রথম প্রয়োগ করা হয়েছিল ওয়াকিল মুনিম খানের হিসার-ফিরৌজার সরকার এলাকায় থাকা জায়গিরের ওপর। তবে শক্তিশালী অভিজাত ও তাদের জাতির লোকজনদের দখলে থাকা বিশাল বিশাল জায়গিরগুলোর ক্ষেত্রে এই নীতি কতটা প্রযুক্ত হয়েছিল তা বলা খুব কঠিন। কারণ এ সময় আটকা খাইল পাঞ্জাবে, উজবেকরা উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশ ও মালবে, কাকশালরা কারা-মানিকপুর অঞ্চলে এবং মির্জারা সম্ভল ঘিরে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বহাল তবিয়তে জায়গির ভোগ করছিল। আকবরই প্রথম এদের মধ্যে উজবেক অভিজাতদের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠীকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর দখলে থাকা বিশাল অঞ্চলের জায়গির ভাঙতে পেরেছিলেন।

আলি কুলি খান জামান, বাহাদুর খান, সিকান্দার খান, ইস্কান্দার খান ও আবদুল্লাহ খানের মতো প্রথম সারির উজবেক অভিজাতরা হুমায়ুনের সময় থেকেই একে অপরের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছিলেন এবং বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ ও ক্ষমতা দখল করে রেখেছিলেন। বাহাদুর খান পানিপথের যুদ্ধে হিমুর বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং বৈরাম খাঁর পতন-এর পর ওয়াকিল পদটি কিছু সময়ের জন্য সামলে ছিলেন। আলি কুলি খান জামান উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশের আফগানদের বিরুদ্ধে লড়াই করে মুঘল সাম্রাজ্যে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছিলেন এবং জৌনপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসকের পদ লাভ করেছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম স্বাধীন হবার উদ্যোগ শুরু করেছিলেন মেবারের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক আবদুল্লাহ খান উজবেক। তিনি স্বতন্ত্র শাসকের মতো আচরণ করতে শুরু করায় আকবর তাকে শায়েস্তা করতে মেবারের তৎকালীন রাজধানী সরঙ্গপুরের কাছে চলে এসেছিলেন, কিন্তু আবদুল্লাহ গুজরাটে পালিয়ে গিয়েছিলেন (১৫৬৪)। তার অপরাধের শেষ ছিল না, কিন্তু তা দেখেও না দেখার ভান করে বসেছিলেন ওয়াকিল মুনিম খান। আবদুল্লাহ খানের এই আচরণ আকবরের উজবেকদের বিরুদ্ধে বিরূপ ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছিল। নিজামুদ্দিন জানিয়েছিলেন আকবর উজবেকদের একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। খান-ই-জামান সম্পর্কেও খুব খারাপ মনোভাব পোষণ করতেন তিনি। যেহেতু সে এক উট চালকের প্রেমে পড়েছিল। আমার ‘পাদশাহ’ হিসাবে তাকে গন্য করে তার সামনে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে নতজানু হওয়া এবং ‘কুর্নিস’ করা ছিল খুবই অপমানজনক। সে সময় অযোধ্যা, জৌনপুর ও বেনারস নিয়ে গঠিত সমগ্র জৌনপুর রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে বসেছিলেন আলি কুলি খান জামান ও তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোকজন। ওই অঞ্চলের একের-পর-এক আফগান বিদ্রোহের হাত ধরে যেভাবে স্থানীয় স্বাধীন চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তাকে সম্বল করে আলি কুলি খান জামান বাংলার আফগান শাসক সুলেমান কারানির সঙ্গে নিবিড় মিত্রতার সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেন। তিনি বিহারের কিছু আফগান সর্দারের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন এবং আফগান, হিন্দুস্তানি ও উজবেক সহ সকল সম্প্রদায়ের যোদ্ধাদের নিয়ে তিনি প্রায় ৩০,০০০ জনের শক্তিশালী একটি বাহিনী সংগঠিত করেন। বোঝাই যাচ্ছে যে মুঘল সাম্রাজ্যের হয়ে কাজ করতে গিয়ে দিনের-পর-দিন যেভাবে অবহেলার শিকার হয়েছেন, যেভাবে আকবর তাদের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব নিয়ে তাঁদের ধ্বংস করে দেবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন, তাতে করে আলি কুলি খানের এই ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ছিল উজবেক অভিজাতদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার চেষ্টা। কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে তড়িঘড়ি আকবর ১৫৬৫ সালে এদের নির্মূল করে ফেলবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং দূত পাঠিয়ে অযোধ্যার দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক ইস্কান্দার খানকে রাজদরবারে আসার জন্য জরুরি তলব করেন। এই পদক্ষেপে বিদ্রোহী উজবেক ও আফগান অভিজাতরা বুঝে যান যে এবার সময় এসে গেছে। তারা জৌনপুরে মিলিত হয়ে সরাসরি বিদ্রোহের পথে হাঁটবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ইস্কান্দার খানের নেতৃত্বে একটা দল লখনউ হয়ে কনৌজ আক্রমণ করেন এবং আর একটি দল কারা-মানিকপুর অঞ্চলে (বর্তমান এলাহাবাদের কাছে) অভিযান চালায়।

উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে উজবেকদের মুখোমুখি হয়ে আকবর বুঝতে পেরেছিলেন। যে বাংলার শাসক বিহার অধিকার করবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন এবং রোহতাস দুর্গ অবরোধও করেছেন। একই সময় বাংলার শাসক জৌনপুরের উজবেক বিদ্রোহীদের নানা ভাবে সাহায্য করছিলেন যাতে মুঘল বাহিনী বিহারের দিকে আসতে না পারে। আলি কুলি খান জামানকে সাহায্য করতে দুই পরিচিত আফগান সেনাপ্রধান সুলেমান মানকালি ও কালাপাহাড়ের নেতৃত্বে একট বাহিনীও প্রেরণ করেছিলেন তিনি।

এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে আকবর বেশ কিছু বলিষ্ঠ কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি বাংলার শাসকের পুরোনো শত্রু উড়িষ্যার শক্তিশালী শাসকের সঙ্গে আঁতাত করে তাঁকে এই বিষয়ে রাজি করিয়ে নিয়েছিলেন যে যদি বাংলার শাসক খান জামানকে সাহায্য করা অব্যাহত রাখেন, তাহলে তিনি বাংলা আক্রমণ করবেন। বাংলার শাসকের দ্বারা অবরুদ্ধ রোহতাস দুর্গের প্রধানের কাছেও গোপনে দূত পাঠিয়ে আকবর সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই ভাবে তিনি উজবেকদের কূটনৈতিক ভাবে একঘরে করে দেবার পরেই তাদের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি এই অভিযানে জৌনপুরকে প্রধান কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে তাঁর অভিজাতদের আদেশ দেন যে, উজবেকদের সম্পূর্ণভাবে উৎখাত না করা পর্যন্ত এই অঞ্চলে অবস্থানের জন্যে বেশ কিছু আবাস যেন নির্মাণ করা হয়। উজবেক-বিরোধী এই অভিযান চলেছিল টানা দুই বছর। অনেক আগেই আকবর উজবেকদের সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করে দিতে পারতেন যদি মুনিম খান এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করতেন। কিন্তু মুনিম খান উজবেকদের সঙ্গে পুরোনো বন্ধুত্বের কারণে কিছুতেই তাদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিতে পারেননি, সব সময়েই মুঘল প্রশাসন ও উজবেকদের মধ্যে একটা ভারসাম্যের সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইতেন। তাই এবারও তিনি আকবরকে রাজি করান উজবেকদের ক্ষমা করে তাদের জায়গির ফিরিয়ে দিতে (১৫৬৬)।

এর মধ্যে আকবরকে নতুন এক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাঁর সৎভাই মির্জা হাকিমকে বাদাখশানের শাসক মির্জা সুলেমান কাবুল থেকে উৎখাত করে দিলে তিনি পাঞ্জাবে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। আকবর সে আবেদন মঞ্জুরও করে দেন। কিন্তু পাঞ্জাব আসার পথে কিছ দুষ্ট লোক মির্জা হাকিমকে প্ররোচিত করে বলেন যে যেহেতু আকবর পূর্বদিকে উজবেকদের সামলাতে ব্যস্ত আছেন, সেহেতু তিনি খুব সহজেই লাহোর দখল করে নিতে পারবেন। মির্জা হাকিম সেই প্ররোচনায় পা দিয়ে ভোরা আক্রমণ করেন এবং তারপর সোজা লাহোরের দুর্গ অবরোধ করে বসেন। এই খবর পেয়ে আকর্বর তড়িঘড়ি ৫০,০০০ সেনা নিয়ে আগ্রা থেকে লাহোরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। মির্জা হাকিম স্থানীয় অভিজাতদের ঘুস ও পুরস্কারের লোভ দেখিয়েও বাগে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় ১৫৬৭ সালে আকবরের আক্রমণের ভয়ে দ্রুত পিছু হটতে শুরু করেন। আকবর তাকে সিন্ধু নদীর ওপার পর্যন্ত ধাওয়া করেন। মির্জা হাকিম এরপর কাবুলে এসে মির্জা সুলেমানের সঙ্গে সমঝোতা করতে সক্ষম হন। মির্জা সুলেমান তাকে কাবুল ফিরিয়ে দিয়ে পুনরায় বাদাখশান ফিরে যান।

আকবরের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে উজবেক অভিজাতরা বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপ আবার শুরু করে দেয় এবং কনৌজ পর্যন্ত অঞ্চল দখল করে শহরে ব্যাপক লুঠপাট চালায়। তা ছাড়া এবার তারা আকবরের শিবিরে ফাটল ধরানোর জন্যে একটা চেষ্টা চালায়। আকবরের সঙ্গে তার সৎ ভাইয়ের সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে বলে ধরে নিয়ে তারা মির্জা হাকিমকে তাদের রাজা হিসাবে ঘোষণা করে তার নামে সিক্কা চালু ও খুৎবা পাঠ শুরু করে দেয়। কিন্তু তাদের এই উদ্যোগ একেবারেই ব্যর্থ হয়। আকবরের তাড়ায় পাঞ্জাব ছেড়ে ইতিমধ্যে মির্জা হাকিম পালিয়েছিলেন। কাবুলেও খুব বেশিদিন-সুবিধে করতে না পেরে তার শিরদাঁড়া একেবারেই ভেঙে গিয়েছিল। আর এদিকে উজবেক অভিজাতরাও পুনর্বার সসম্মানে ও পূর্ণ শক্তি দিয়ে আকবরের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারেনি।

আকবর খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে পূর্বদিকে উজবেক আতঙ্ক এবং পশ্চিমদিকে হাকিমের ১৫৬৬ সালের পাঞ্জাব আক্রমণের সম্ভাবনা এই দুই সমস্যাকে মোকাবিলা করেছিলেন। আর এ ব্যাপারে অহেতুক অতিরঞ্জনের কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু এটা সত্যি যে এরপর আকবরের সাম্রাজ্যের ঘরোয়া পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল হয়ে গিয়েছিল। প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণও সুদৃঢ় হয়েছিল। তা না হলে সুলতান হাসান মির্জার পুত্রেরা যখন তাদের প্রাপ্য সম্ভল এলাকার জায়গির তাদের ক্রমবর্ধমান পরিবারের সাপেক্ষে স্বল্প বলে অভিযোগ তুলে বিদ্রোহের চেষ্টা করেছিল তখন শুধুমাত্র স্থানীয় আধিকারিকদের দিয়েই সেই বিদ্রোহ খুব সহজে দমন করে বিদ্রোহীদের মালব হয়ে গুজরাটে বিতাড়িত করে দেওয়া সম্ভব হত না।

তবে উজবেকদের সমূলে উৎপাটনের জন্যে লাহোর থেকে ফিরেই আকবর। তাদের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৫৬৭ সালে কারার কাছে সংগঠিত দুর্দান্ত এক যুদ্ধে খান-ই-জামানকে হত্যা করা হয় এবং বাহাদুর খানকে বন্দি করে খুন করা হয়। ক্ষমতার অলিন্দে নিজের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে আকবর পাঞ্জাব থেকে আটকা জাতির বিভিন্ন অভিজাতদের বের করে ‘তারকার বিকিরণের মতো তাদের প্রত্যেককে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে পৃথক পৃথক জায়গির দান করে ছড়িয়ে দিলেন’ (বায়াজিদ বায়াত, আকবরের সর্বপ্রথম জীবনীকার)।

উজবেক অভিজাতদের পরাজয় ও মির্জাদের বিদ্রোহের অবসানের মধ্য দিয়ে পুরোনো অভিজাতদের একটা গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটানো গিয়েছিল। এবার আর সম্রাটের সামনে একদিকে কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখা এবং অন্যদিকে প্রাদেশিক স্তরে বিশ্বস্ত অভিজাতদের যথাযথ ক্ষমতা ও মর্যাদা প্রদান করে। বিকেন্দ্রীভূত শাসনকে অনেক বেশি মজবুত করে গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় আর কোনো বাধা রইল না। তবে এটা ঠিক যে এই বিকেন্দ্রীভূত শাসনের প্রতিষ্ঠা অভিজাতদের মধ্যে পারস্পরিক অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল এবং পুরোনো সাম্রাজ্য জৌনপুর, মালবের মতো জায়গায় স্থানীয় ভাবাবেগের পুনর্জাগরণ ঘটার রাস্তা খুলে দিয়েছিল।

সে সময় যে অভিজাত বিদ্রোহগুলো সংগঠিত হয়েছিল তাতে ইরানি অভিজাতদের তুলনায় তুরানি অভিজাতদের অংশগ্রহণ অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল। একমাত্র গড়-কাটঙ্গের যুদ্ধে পাওয়া সম্পদ নিজের কাছে রাখার জন্যে ইরানি অভিজাত আসফ খানের করা বিদ্রোহ বাদ দিলে আর তেমন কোনো বিদ্রোহ চোখে পড়ে না। আর এই কারণেই এ সময় মুঘল অভিজাততন্ত্রে তুরানিদের বদলে ইরানি অভিজাতদের অন্তর্ভুক্তি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এছাড়া বারহ সৈয়দদের মতো ভারতীয় মুসলমানদের ওপরেও এ সময় বেশ ভরসা করা হয়েছিল, আমরা এ ব্যাপারে পরে আলোকপাত করব।

সাম্রাজ্যের প্রারম্ভিক বিস্তার (১৫৬০-৭৬)

মাত্র পনেরো বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ের সময়ের মধ্যে মুঘল সাম্রাজ্য উচ্চ গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চল থেকে মালব, গণ্ডোয়ানা, রাজস্থান, গুজরাট, বিহার ও বাংলা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। সাম্রাজ্যের এই সম্প্রসারণের জন্যে যে যুদ্ধগুলো জয় করতে হয়েছিল তার জন্যে বেশিরভাগ কৃতিত্বটাই আমাদের দেওয়া উচিত আকবরকে। তার অসম্ভব তেজ, উদ্যোগ, দৃঢ়তা ও ব্যক্তিগত নেতৃত্ব দানের প্রতিভা এমনকি সকল অসম্ভব পরিস্থিতি অদ্ভুতভাবে উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে মোকাবিলা করার ক্ষমতার জন্যেই মুঘল সাম্রাজের এই বিস্তার সম্ভব হয়েছিল। সে সময় আরও বেশি যোগ্য নিষ্ঠাবান মানুষদের উত্থান ঘটলেও তার সাফল্যকে ছোটো করে দেখার কোনো জায়গা নেই। বরং সেই সব প্রতিভাকে খুঁজে বের করার ক্ষমতা এবং তাদেরকে সাম্রাজ্যের নানা কাজে ব্যবহার করার ইচ্ছা আকবরের ছিল। তাই তার আমলে যেভাবে প্রশাসনের দরজা প্রতিভাধর ব্যক্তিদের জন্যে উন্মুক্ত ছিল তা এর আগে কখনো দেখা যায়নি।

মালব

সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটানোর প্রক্রিয়া কার্যত ১৫৬১ সালে মালব জয়ের মধ্য দিয়ে যা থেকে আকবর ১৫৬৭ সালের উজবেক বিদ্রোহ দমনের উৎসাহ লাভ করেছিলেন। মালব আক্রমণ ও দখল করার কারণ হিসাবে আকবর যে যুক্তিটা সামনে রেখেছিলেন তা হল–একদা এই অঞ্চলের ওপর হুমায়ুনের নিয়ন্ত্রণ ছিল। এখন সেখানে শাসন করছিলেন শের শাহের আমলে মালবের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক সুজাত খানের পুত্র বাজ বাহাদুর। কিন্তু তিনি আদালির উত্থানের সময় বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। বাজ বাহাদুর ছিলেন যথেষ্ট গুণী যোদ্ধা। তিনি তার সকল ভাইদের পরাজিত ও হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। যদিও তিনি গণ্ডোয়ানায় নিজের শাসনকে সম্প্রসারিত করতে গিয়ে সেখানকার দুর্ধর্ষ রাণি দুর্গাবতীর কাছে যুদ্ধে একবার পরাজিত হয়েছিলেন। আদালির মতো তিনিও স্বনামধন্য সংগীতজ্ঞ ও কবিতাপ্রেমী ছিলেন। মালবের ঘরে ঘরে তার অপরূপা সুন্দরী সঙ্গী রূপমতীর প্রতি উদ্দেশ্য করে বলা কিছু সম্বোধন আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। আকবরের ‘বখশী’ নিজামুদ্দিন আহমেদ মালবের ওপর মুঘল আক্রমণের যে যুক্তিটি খাড়া করেছিলেন তা হল বাজ বাহাদুর নাকি ক্রমেই বেআইনি ও দুর্নীতিমূলক কাজকর্মের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। যদিও এ অভিযোগ সম্পর্কে পরিষ্কার করে তিনি কিছুই বলেননি, তাও তাঁর মতে, বাজ বাহাদুর নাকি ‘তার রাজত্ব সম্পর্কে ধীরে ধীরে উদাসীন হয়ে গিয়েছিলেন, তাই স্বৈরাচার এবং ফকির ও দুঃস্থ গরিব মানুষের ওপর অত্যাচার দিন দিন বাড়তে শুরু করেছিল, তারা সেই অনাচারের কবলে পড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল।’

এভাবেই কারও কারও বর্ণনায় স্বৈরাচার ও অপশাসনের কবল থেকে মানুষের মুক্তির জন্যেই আকবরের মালব আক্রমণের যৌক্তিকতা খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে পরবর্তীকালে মুঘল শাসনের চরিত্র যাই হোক না কেন, ১৫৬১ সালে অধম খান ও পীর মহম্মদ খানের নেতৃত্বে মালবে যে মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তাতে সেখানকার সাধারণ মানুষের মুক্তি পাওয়া তো দূরের কথা, সেখানে মুঘল শাসনের দৌলতে বিরাজ করছিল আতঙ্ক ও নিষ্ঠুরতা। পরাজিত হবার পর বাজ বাহাদুর মালবকে ঘিরে তার সকল উদ্যোগ, তার অনুগতদের, মহিলাদের এমনকি তার প্রিয়া রূপমতাঁকে ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। অধম খান সকল যুদ্ধবন্দিদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন, এমনকি শেখ ও সৈয়দদেরও রেহাই দেননি। আর বহু সুন্দরী নারীদের তিনি ঠাঁই দিয়েছিলেন নিজ হারেমে। কিন্তু রূপমতী হারেমে যাওয়ার বদলে মৃত্যুকেই শ্রেয় বলে গণ্য করেছিলেন। আকবর এরপর মালবে অভিযান চালিয়েছিলেন এই নৃশংসতার কাণ্ডারীদের শাস্তি দিতে নয়, বরং যুদ্ধে বাজেয়াপ্ত বিপক্ষ শিবিরের বিপুল ধনসম্পদের ভাগ নিতে। পরে যখন অধম খানকে দিল্লি দরবারে ডেকে নেওয়া হয়েছিল তখন পীর মহম্মদ খান খান্দেশের বুরহানপুরে আক্রমণ চালিয়েছিলেন এবং সেখানে আশ্রয় নেওয়া বাজ বাহাদুরকে উৎখাত করে মালবের মতো নৃশংসতা ও বর্বরতার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিলেন। যদিও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাজ বাহাদুর মালব পুনরুদ্ধার করেছিলেন, তবুও পীর মহম্মদের তাড়া খেয়ে দ্বিতীয়বারের জন্যে তাকে পালাতে হয়েছিল এবং কিছুদিনের জন্যে রানা উদয় সিংহের কাছে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। সেখান থেকে বাজ বাহাদুরকে আকবর উদ্ধার করে ১০০০ মনসব দিয়ে মালব শাসনের দায়িত্বে পুনর্বহাল করেছিলেন এবং পরে তার সংগীতের প্রতি গভীর জ্ঞান দেখে মনসবের পরিমাণ ২০০০ করে দিয়েছিলেন।

গড়-কাটঙ্গ

যখন মালবে মুঘল সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া চলছিল তখন একই রকম উদ্যোগ গড়-কাটঙ্গ বা আধুনিক গণ্ডোয়ানা রাজ্যেও নেওয়া হয়েছিল। কারা (এলাহাবাদ) অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক আসফ খানের ওপর কোষাগার ও আঞ্চলিক উভয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পঞ্চদশ শতক জুড়ে এই অঞ্চলের একাধিক রাজার উত্থান-পতনের হাত ধরে গড়ে উঠেছিল এই রাজ্য। তখন এই রাজ্যের আয়তন ছিল প্রায় ৪৮,০০০ বর্গমাইল। এখানে একাধিক দুর্গ, জনবহুল নগর ও প্রায় ৭০,০০০ গ্রাম ছিল। আধুনিক জব্বলপুরের দুই নগর গড় ও কাটঙ্গের নাম অনুসারেই এই রাজ্যের নামকরণ করা হয়েছিল গড়-কাটঙ্গ। এখানে মূলত গণ্ড জাতির লোকজন। বসবাস করত তাই এই অঞ্চলের আর একটি নাম ছিল গণ্ডোয়ানা। মুঘল সাম্রাজ্যের দখলে চলে যাবার আগে পর্যন্ত এই রাজ্যে বিগত ষোলো বছর ধরে শাসন করতেন অত্যন্ত সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী রাণি দুর্গাবতী। মাহোবা এলাকার শাসক রাজা শালিবাহনের কন্যা দুর্গাবতী স্বামীর মৃত্যুর পর রাজকার্য নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কারণ তাদের একমাত্র সন্তানের বয়স তখন ছিল তিন কি চার বছর। তখন থেকেই রানি কয়েকজন উপদেষ্টার সহায়তায় রাজ্য শাসন করছিলেন। তিনি নাকি তির-ধনুক ও বন্দুক এক সঙ্গে চালানোয় পারদর্শী ছিলেন। এও জানা যায়, তিনি যদি একবার কোনো বাঘের গর্জন শুনতে পেতেন, তাহলে যতক্ষণ না সেই বাঘকে শিকার করতেন। ততক্ষণ তিনি বিশ্রাম নিতেন না।

যদিও অপেক্ষাকৃত প্রত্যন্ত, তবুও এই রাজ্যকে ভাটা (বুন্দেলখণ্ডের রেওয়া অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী রাজ্য) ও মালবের শাসকদের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধ করে যেতে হয়েছিল। মালবের ওপর যখন মুঘলরা আক্রমণ চালাল এবং ভাটাকে বাধ্য করল মুঘল আধিপত্য মেনে নিতে, তখন এই রাজ্য দু’দিক দিয়েই মুঘল আক্রমণের চাপে পড়ে গিয়েছিল। রাণি হয়তো এই পরিস্থিতিটা ঠিক বুঝতে পারেননি তাই তিনি তার এক মন্ত্রী আধার কায়স্থকে আকবরের কাছে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রেরণ করেছিলেন। সম্ভবত আকবর রাণির আত্মসমর্পণ ও কিছু এলাকার দখল দাবি করায় রাণির তরফ থেকে সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। আসফ খান আগে থেকেই অনুচর পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন যে এই রাজ্যে রানির প্রচুর ধনসম্পদ রয়েছে, তাই এই রাজ্য আক্রমণ করার জন্যে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। অবশেষে ১৫৬৪ সালে ১০,০০০ সেনা নিয়ে রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় তিনি আক্রমণ করে লুঠপাট শুরু করে দেন। রানির কাছে ২০,০০০ পদাতিক, একাধিক গোলন্দাজ ও ১০০০ হস্তীবাহিনী থাকা সত্ত্বেও মাত্র ২০০০ সেনা ‘নিয়েই তিনি আসফ খানকে আটকাতে গিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ শুধু একটা আক্রমণেই থেমে থাকেননি আসফ খান, পর পর লুঠপাট চালাতে শুরু করেন তিনি। রাণিকে তাঁর মন্ত্রী আধার কায়স্থ পরামর্শ দেন যে এই অল্প বাহিনী নিয়ে আসফ খানের সঙ্গে যুদ্ধ করা ঠিক হবে না, তাই শক্তি বাড়ানোর জন্যে এখন পিছু হটে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু রাজপুত কায়দায় রাণি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালানোকে অসম্মানের নামান্তর বলে মনে করে কোনো কিছুর পরোয়া না করেই এগিয়ে যান। প্রথম দিকে যুদ্ধে মুঘল বাহিনীর সামনের দিকের সেনাবলয়কে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম হলেও অচিরেই দামোহের কাছে আসফ খানের প্রধান বাহিনীর সামনে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হন তিনি। এই অল্প সময়ের মধ্যে আসফ খানের বাহিনীর সংখ্যা বেড়ে ৫০,০০০ হয়ে গিয়েছিল আর এই সেনার সংখ্যা বৃদ্ধির একটা কারণ ছিল এ সময় রাণির অধীনে থাকা অনেক রাজাই রাণিকে বিপদে ফেলে আসফ খানের শিবিরে যোগ দিয়েছিল। বিধ্বস্ত রাণি বিপক্ষের হাতে ধরা দেওয়া ও অপমানিত হবার চেয়ে মৃত্যু বরণকেই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন। এভাবে রাণি দুর্গাবতীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভারতের এক বীরাঙ্গনা যোদ্ধার শাসনের অবসান ঘটেছিল। এ

আসফ খান এরপর রাজধানী চৌরাগড়ের দিকে অগ্রসর হলে সেখানে রুখে দাঁড়ান রাণির পুত্র বীরনারায়ণ। প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে অবশেষে আসফ খানের কাছে পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন তিনি। পরিবারের মহিলাদের বাধ্য করা হয় ‘জওহর’ প্রদর্শনের জন্য। আসফ খান রাজকোষ থেকে প্রচুর অর্থ, অগণিত সোনা ও রুপো এবং ১০০০ হস্তী লুঠ করে নিয়ে যান। আর পরিবারের একমাত্র অক্ষত সদস্যা দুর্গাবতীর কনিষ্ঠ ভগিনী কমলাদেবীকে তুলে নিয়ে গিয়ে হারেমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

গণ্ডোয়ানা রাজ্যকে দখল করে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটালেও আসফ খানের ভাগ্যে কিন্তু বিপদ ছিল বিস্তর। কারণ মালবে অধম খানের মতো তিনিও এই এলাকা থেকে লুঠ করা সম্পদের অনেকটা অংশ আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন এবং মাত্র ২০০টি হস্তী আকবরের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। সব কিছু বুঝতে পেরেও উজবেক বিদ্রোহ সামলাতে হচ্ছিল বলে আকবর সেই মুহূর্তে আসফ খানকে কিছুই বলেননি। কিন্তু আসফ খানকে যখন গণ্ডোয়ানা জয়ের হিসাব দিতে বলা হয়েছিল তখন তিনি পলায়ন করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি দোষী। আসফ খান পালিয়ে প্রথমে উজবেকদের কাছে গিয়েছিলেন, তারপর তিনি গণ্ডোয়ানায় ফিরে এসেছিলেন এবং বেশ কিছুদিন সেখানে অতিবাহিত করেছিলেন। কিন্তু আকবর ছেড়ে কথা বলার মানুষ ছিলেন না। তার চাপে অবশেষে আসফ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন এবং আকবরও তাকে ক্ষমা করে দিয়ে আগের পদে পুনর্বহাল করে দেন। পরবর্তীকালে আসফ খান খুব ভালো কাজ করে আকবরের মন জয় করে নিয়েছিলেন। তবুও আবুল ফজলের মতে, তাজিক তুর্কি ও লিখিয়ে শ্রেণির (আহাল-ই-কলম) লোক হওয়া সত্ত্বেও তিনি (আসফ খান) এমন সব কীর্তি করেছিলেন যা তুর্কি জাতকে ছোটো করে দিয়েছিল। কিন্তু আকবর তার জাত চিনেছিলেন, তাই তাকে পদে ফিরিয়ে এনেছিলেন। এভাবেই তিনি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রশাসনের কাজে লাগিয়েছিলেন। আকবর দেখলেন গড়-কাটঙ্গ অঞ্চল দখল করে ফেলে রাখার কোনো মানেই নেই। তাই ১৫৬৭ সালে আসফ খানকে পুনরায় সেখানে ডেকে পাঠানো হয় এবং তারই উদ্যোগে মালব অঞ্চলকে ঘিরে ফেলা যায় এমন দশটি দুর্গের দখল নিজেদের কাছে। রেখে রাণির মৃত স্বামীর ভাই চন্দ্র শাহের হাতে বাকি রাজ্যপাট সামলানোর দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়।

রাজস্থান

মালব কিংবা গড়-কাটঙ্গের মতো মুঘলদের রাজস্থান জয় কিন্তু নিছক এলাকা দখলের ইচ্ছা বা সেখানকার সম্পদ লুঠ করার বাসনা নিয়ে সংগঠিত হয়নি। রাজস্থানে কোনো শক্তিশালী শত্রু ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেললে উচ্চ গাঙ্গেয় উপত্যকার কোনো সাম্রাজ্যের পক্ষেই সেটা খুব একটা স্বস্তিদায়ক ছিল না। ঠিক এই কারণেই বাবরের যুদ্ধ বেঁধেছিল। রানা সঙ্গের সাথে আর শের শাহের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল রাও মালদেওয়ের সঙ্গে। রাজস্থানে প্রভাব বাড়াতে শুরু করলে বাণিজ্যিক দিক থেকেও উচ্চ গাঙ্গেয় কোনো সাম্রাজ্যের পক্ষে খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না। কারণ উত্তর ভারত থেকে গুজরাট ও তার সামুদ্রিক বন্দর এবং একই সঙ্গে মালবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে গেলে রাজস্থানের ভূমিকে কোনো-না-কোনো ভাবে ব্যবহার করতেই হত। তাই ওই দুই অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজস্থানের কিছু এলাকার ওপর অবশ্যই দখল রাখা প্রয়োজন ছিল।

তাই মুঘলরা ১৫৫৬ সাল থেকেই চেষ্টা করেছে মেওয়াটের একটা অংশের ওপর অধিকার কায়েম করতে। ধীরে ধীরে আজমের ও নাগোরের ওপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পরবর্তীকালে। ১৫৬২ সালে যখন আকবর প্রথম আজমেরের খাজা মইনুদ্দিন। চিশতীর দরগা ভ্রমণে গিয়েছিলেন তখন অম্বরের শাসক রাজা ভরা মল তার বশ্যতা। স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তার ফলে মুঘলদের সুবিধা হয়েছিল মেরটার শক্তিশালী দুর্গ। এবং মালদেওয়ের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে কিছু সময়ের জন্য। যোধপুর দখল করতে। মালদেও চন্দ্রসেনকে তার উত্তরসূরি হিসাবে মনোনীত করে গেলেও তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামচন্দ্র সেটা মেনে নিতে পারেননি, তাই তিনি মুঘল দরবারে সাহায্যের প্রার্থনা করলে চন্দ্রসেনকে উৎখাত করে যোধপুরের সিংহাসনে রামচন্দ্রকেই বসানো হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে চন্দ্রসেন যোধপুর পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।

এই সময় আকবর উজবেক বিদ্রোহ দমন করে রাজস্থানের দিকে পূর্ণ নজর দিয়েছিলেন। সে সময় রাজস্থানের সবথেকে শক্তিশালী ও খ্যাতিসম্পন্ন রাজ্য ছিল মেবার। ঘটনাচক্রে রানার পুত্র সকত ঢোলপুরের মুঘল শিবিরে গিয়েছিলেন এবং সেখানে আকবর তাকে নাকি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে যদি তিনি রানাকে আক্রমণ করেন তাহলে প্রতিদানে সে মুঘলদের জন্য কী করবে। শোনা যায় যে সেখানে দুইপক্ষের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়েছিল, কিন্তু ঠিক কী ধরনের বোঝাপড়া হয়েছিল সেটা জানা যায় না। আবুল ফজল বলেছেন যে রানা তার এলাকার সুউচ্চ পাহাড় পর্বত, শক্তিশালী বেশ কয়েকটি দুর্গ, প্রচুর জমি, ধনসম্পদ ও জান লড়িয়ে দেবার মতো রাজপুত যোদ্ধা থাকার সুবাদে কারও কাছেই মাথা নত করতে প্রস্তুত ছিলেন না। এটা আবুল ফজল এত ফলাও করে বলেছিলেন কারণ এই রানাই আকবরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, এমনকি মুঘলরা যখন চিতোরের দুর্গ অবরোধ করছিল তখন রাজপুতরা কার্যত আকবরের পায়ে পড়ে মুঘল আধিপত্য মেনে নিয়ে পেশকাশ দিতেও রাজি হয়ে গিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন আবুল ফজল। তাছাড়া রানা উদয় সিং মালব থেকে বিতাড়িত বাজ বাহাদুরকে এবং সম্ভল থেকে পালানো মির্জাদের আশ্রয় দিয়ে আকবরকে রুষ্ট করেছিলেন।

চিতোর দুর্গ এত শক্তিশালী ছিল যে তা অবরোধ করে রাখতে গিয়ে শত্রুপক্ষ অনাহারে মারা পড়তে পারত। তাছাড়া ‘সবত’ বানানোর পরে দুর্গের দেওয়াল ভেদ করে সুড়ঙ্গ বানানো বা দেওয়াল পর্যন্ত নিরাপদ পরিখা বানানো–এই দুই পথ ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকত না এই দুর্গ আক্রমণ করার। বলা হয় যে মুঘল শিবিরের। তরফ থেকে ‘সবত’ বানাতে ও সুড়ঙ্গ নির্মাণ করতে প্রায় পাঁচ হাজার জন প্রশিক্ষিত স্থপতি, রাজমিস্ত্রি ও ছুতোর মিস্ত্রি জোগাড় করা হয়েছিল–কিন্তু দুর্গ থেকে রাজপুতদের ক্রমাগত গোলাবর্ষণের ফলে প্রত্যেক দিন মুঘলদের প্রায় দুশো জনের প্রাণ যেত। এই কারণেই আকবর টানা চার মাস চিতোর দুর্গ অবরোধ ও আক্রমণ চালিয়ে অবশেষে যখন তাদের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জয়মলকে হত্যা করতে সক্ষম হলেন তখন সরাসরি দুর্গে হত্যাকাণ্ড চালানোর আদেশ দিয়েছিলেন। জানা যায় যে দুর্গ থেকে যাদের আটক করা হয়েছিল তারা ছাড়াও প্রায় ৮০০০ রাজপুত যুদ্ধ করতে গিয়ে ও কিছুটা দুর্গের ভিতরে থাকা মন্দির রক্ষা করতে গিয়ে মারা গিয়েছিল। এছাড়া দুর্গের অভ্যন্তরে প্রায় ৪০, ০০০ কৃষক ছিল যারা রাজপুত যোদ্ধাদের সাহায্য করছিল। আকবরের আদেশে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়ে প্রায় ৩০,০০০ মানুষকে চিরকালের জন্যে শেষ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আকবর সেইসব তুখোড় গোলন্দাজ বাহিনীকে ধরতে পারেননি যারা লুকিয়ে দুর্গ থেকে গোলাবর্ষণ করে মুঘল শিবিরের বহু মানুষকে হত্যা করেছিল। মূলত তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। তাই শেষবারের জন্যে আকবর এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে এটা বিশ্বাস করা খুব মুশকিল যে আকবর এই ঘটনার পর হত্যাকাণ্ড চালানোর এই মধ্য-এশীয় বর্বরতার ঐতিহ্যকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।

চিতোরের পতনের (১৫৬৮ সালের মার্চ) পরে মুঘল বাহিনীর দখলে এক-এক করে রনথম্বর ও বুন্দেলখণ্ডের কালিঞ্জর অঞ্চল চলে আসে। তবে এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ যেটা ছিল তা হল যখন আকবর নাগোরে অবস্থান করছিলেন (১৫৭০) তখন মাড়োয়ার, বিকানের, জয়সলমেরের মতো রাজস্থানের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলির শাসক তাদের অঞ্চলে শাসন অব্যাহত রাখার প্রতিদানে মুঘল কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। আকবর তাদেরকে মনসব ও জায়গির দান করেছিলেন। ফলে আঞ্চলিক স্বতন্ত্রতার ধ্বজা ওড়ানোর জন্য রাজস্থানে পড়ে রইল একমাত্র মেবার।

গুজরাট

এরপর আকবর গুজরাটের দিকে নজর দেবার সময় পেয়ে যান। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর গুজরাটের সিংহাসন দখলকে কেন্দ্র করে শুরু হয় উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্ব এবং সিংহাসনে বসানোর জন্যে সেখানকার অভিজাতদের দ্বারা আসল বা নকল প্রার্থী মনোনীত করার খেলা। গুজরাটের এই রাজনৈতিক ডামাডোল আরও বেড়ে যায়। মির্জারা ব্রোচ, বরোদা ও সুরাট দখল করার ফলে। পর্তুগিজরাও এই সুযোগে গুজরাট ও সংলগ্ন বন্দর এলাকায় প্রভাব বাড়াতে উঠে-পড়ে লাগে। এরকম পরিস্থিতিতে আকবর কখনোই কৌশলগত ভাবে গুজরাটের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ এবং কারিগরি ও কৃষিজ উৎপাদনে সমৃদ্ধ একটা অঞ্চলকে অন্যের হাতে ছেড়ে দিতে পারতেন না। তাই নিজামুদ্দিনের মতে, আকবরের এক বার্তায় বলা হয়েছিল স্বর্গের মতো করে সাজানো গুজরাটে কিছু দুরাচারী শাসকের শাসন ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদের জেরে জনগণের জীবনে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয় ও হাহাকার। তাই আকবরের উচিত সেই বিপর্যয় থেকে গুজরাটকে উদ্ধার করা। তবে আকবর নিজে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই তৎকালীন আহমেদাবাদের শাসক ইতিমাদ খান হাবশি গুজরাটের অপশাসনের অবসানের জন্যে সক্রিয় হস্তক্ষেপ গ্রহণ করতে আকবরকে আমন্ত্রণ। জানান।

১৫৭২ সালের শেষের দিকে এক বিশাল বাহিনী সঙ্গে নিয়ে আকবর আজমের, মেরাট ও সিরোহি হয়ে গুজরাট এসে পৌঁছান। কথামতো হাবশি ও গুজরাটের অভিজাতদের সমর্থন থাকায় আকবরের আহমেদাবাদ দখল করতে কোনো সমস্যাই হয়নি। কিন্তু দক্ষিণ গুজরাট থেকে মির্জাদের উৎখাত করার জন্যে তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। এই অভিযানে আকবর তার অসীম সাহস ও তেজের পরিচয় দিয়েছিলেন। ইব্রাহিম হাসান মির্জা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এমন খবর পেয়ে আকবর মাত্র চল্লিশ জন সেনা নিয়ে তার শক্তিশালী বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধে জিতলেও তিনি মির্জাকে ধরতে পারেননি। এরপর তিনি ১৫৭৩ সালের শুরুর দিকে। সুরাটের শক্তিশালী দুর্গ আক্রমণ করে তা দখল করে নিয়েছিলেন। ফলে ভয় পেয়ে পার্শ্ববর্তী বহু রাজা তার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। পর্তুগিজরাও এসে সম্রাট আকবরকে উপহার প্রদান করে গিয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে খাম্বাত উপসাগরের উপকণ্ঠে এসে আকবর সেই প্রথমবারের জন্য সমুদ্র দর্শন করে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং ওমান সাগরে (আরব সাগর) পাড়িও দিয়েছিলেন। তৎকালীন এক জনৈক আরিফ কান্ধারির মতে, ১৭ই শ্রাবণ/২৩শে ডিসেম্বর, ১৫৭২ ‘সম্রাট এক দ্রুত গতির নৌকায় চড়ে আমোদ প্রমোদের আসর সাজাবার আদেশ দিয়েছিলেন এবং নিজে স্বয়ং মদ্যপানের উৎসবে মেতেছিলেন।

সুরাট জয় করার পর আকবর তার সহোদর ও খুব প্রিয় খান-ই-আজম আজিজ কোকাকে গুজরাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক নির্বাচন করেন এবং পাটান, ঢোলকা, ব্রোচ ও বরোদার সরকারের দায়িত্ব আমির ওমরাহদের হাতে তুলে দিয়ে আগ্রা ফিরে যান। আগ্রায় তাকে ফিরতেই হত, কারণ পূর্বদিকের পরিস্থিতি সেদিকে তার দৃষ্টি ঘোরাতে বাধ্য করছিল।

হুমায়ুন যেমনটি করেছিলেন ঠিক তেমন ভাবেই গুজরাটে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সাজিয়ে গিয়েছিলেন আকবর। যে কারণে আকবরকে গুজরাট জয় করে ফিরে যেতে হয়েছিল সেটাও অনেকটা হুমায়ুনের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ছিল। একই ভাবে সম্রাটের চলে যাওয়ার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত মুঘল প্রশাসনকে গুজরাট থেকে উৎখাত করার জন্যে আব্বাসীয় (হাবশি) ও গুজরাটি অভিজাত এবং মির্জারা উঠে-পড়ে লেগেছিল। তবে যেভাবে আসকারি পিছু হটেছিলেন, সেভাবে কিন্তু আজিজ কোকা দমে যাননি, বরং আহমেদাবাদে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে বিরোধীদের মোকাবিলা করেছিলেন। আকবর এসব দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারেননি, তিনি পূর্বদিকে অভিযান স্থগিত রেখে আবার এক মোহময় আবির্ভাবে গুজরাট কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। ফতেপুর সিক্রি ছেড়ে তিনি মাত্র এগারো দিনের মাথায় ৩০০০ সেনা নিয়ে আহমেদাবাদে এসে পৌঁছান। এবং বিরোধীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। সম্রাটের আবার পূর্ণ শক্তি নিয়ে গুজরাটে আগমন বিরোধীদের মনোবলে বড়োসড়ো চিড় ধরিয়ে দেয় এবং আকবর যুদ্ধে বিরাট সাফল্য অর্জন করেন। এই যুদ্ধ জয় গুজরাটের মাটিতে মুঘলদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া শক্তিগুলোর শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েছিল (১৫৭৩), যদিও বিক্ষিপ্ত কিছু প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কিছুদিন ধরে চলেছিল।

বাংলা

গুজরাট জয় সম্পূর্ণ করার পর আকবর পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পূর্ব দিকে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের চিন্তাভাবনা করতে পেরেছিলেন। ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর বাংলা প্রদেশ প্রায় স্বাধীনই হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। কোনো এক সংগ্রামের পর যেভাবে হোক সুলেমান কারানি বাংলার ক্ষমতা দখল করেছিলেন। কারানিরা বিহারে বিশাল জায়গির ভোগ করত আর তাই বাংলার শাসকের বিহারের ওপর প্রভাব আরও একবার বেশ জোরালো হয়ে উঠেছিল। শের শাহের প্রতিষ্ঠিত পাটনা শহর এবং গঙ্গার অপর প্রান্তের হাজিপুর নগর বাংলার আফগান শাসকের নিয়ন্ত্রণে ছিল সেসময়। এমনকি শক্তিশালী রোহতাসের দুর্গও দেখাশোনা করতেন বাংলার শাসক। সুতরাং আকবর যখন পূর্বদিকে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্যে অভিযান চালিয়েছিলেন তখন তার লক্ষ্য শুধু বাংলা ও লাখনৌতি (উত্তরবঙ্গ) অঞ্চল দখল করাই ছিল না, সেই সঙ্গে যেমনটি নিজামুদ্দিন বলেছেন, “বিহার প্রদেশ’ জয় করারও পরিকল্পনা ছিল। আগে বাংলার শাসকেরা নিজেদের নামে খুৎবা পাঠ ও সিক্কা চালু না করে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতি মোটামুটি একটা প্রতীকী আনুগত্যের সম্পর্ক বজায় রাখতেন, কিন্তু সে সময় বাংলার শাসক দাউদ খান তার ৪০,০০০ সুসংগঠিত অশ্বারোহী, ১,৪০,০০০ পদাতিক ও ৩, ৬০০ হস্তীবাহিনী এবং ২০,০০০ বন্দুক ও সহস্রাধিক নৌ-বহর সম্বলিত একটি জমকালো গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে এত অহংকারী হয়ে উঠেছিলেন যে নিজেকে তিনি স্বাধীন ঘোষণা করে নিজ-নামে খুৎবা ও সিক্কা প্রচলন করে দিয়েছিলেন। এই বাড়বাড়ন্ত সহ্য করতে পারেননি আকবর, আর সেটাই তাঁর তড়িঘড়ি পূর্বদিকে অভিযান চালানোর তাৎক্ষণিক কারণ ছিল বলা যায়। এটা পরিষ্কার যে বাংলা ও বিহারে ঠিকঠাক মতো আফগান নেতৃত্ব উঠে এলে তার সঙ্গে আকবরের সংঘর্ষ হওয়া ছিল স্বাভাবিক। প্রথমে বাংলার পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য জৌনপুরের নিযুক্ত শাসক মুনিম খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মুনিম খান অভিযান চালিয়ে পাটনার দুর্গ অবরোধ করলেও সামরিক ভাবে সুসজ্জিত আফগানদের হঠানোর ক্ষেত্রে তিনি কোনোরকম দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারেননি। কিন্তু গুজরাট জয় করে আকবর বিশাল বাহিনী ও নৌবহর নিয়ে বাংলার উদ্দেশ্যে অভিযান চালান। প্রথমে হাজিপুর ও পাটনা জয় করে তিনি দাউদ খানকে বাংলা পর্যন্ত ধাওয়া করেন। যদিও অচিরে এই সামরিক অভিযানের দায়িত্ব মুনিম খানের হাতে দিয়ে এবং তাকে বাংলার প্রাদেশিক শাসক নিয়োগ করে আকবর। আগ্রা ফিরে যান। এখানে আবার হুমায়ুনের মতোই আকবর একযোগে বাংলা ও বিহার জয় করেছিলেন, কিন্তু অভিযানের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে হুমায়ুনের সঙ্গে তার একটা পার্থক্য ছিল। তিনি প্রথমে গুজরাটে নিজ-অবস্থানকে পাকা করে তবেই বাংলার দিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু বাংলা জয় করার ক্ষেত্রে নিজে ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি অংশগ্রহণ করেননি।

যদিও মুনিম খান এরপর ১৫৭৫ সালের মার্চ মাসে তুকারোই (বালাসোর জেলা)-এর প্রবল এক যুদ্ধে দাউদকে পরাজিত করে তার সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, কিন্তু এর অব্যবহিত পর মুনিম খানের মৃত্যু গৌড়কে কেন্দ্র করে পুনরায় মুঘল-বিরোধী শক্তিগুলোকে চাঙ্গা করে দেয় এবং দাউদ তার পুরোনো রাজধানী টান্ডা (Tanda) পুনরুদ্ধার করে নেন। দাউদের চাপে মুঘল শক্তি বাধ্য হয় বিহারের দিকে সরে আসতে। এই পরিস্থিতিতে আকবর হুসেন কুলি খান-ই-জাহানকে বাংলার নতুন। শাসক নিযুক্ত করেন এবং তার উদ্যোগে আর এক দুর্ধর্ষ যুদ্ধে দাউদ খানকে পরাজিত ও হত্যা করা হয় (১৫৭৬)।

দাউদ খানের বিরুদ্ধে জয়লাভ আফগানদের বিরুদ্ধে মুঘলদের কার্যত চূড়ান্ত সংগ্রাম ছিল বলা যায়। যদিও’ এরপর জাহাঙ্গিরের আমল পর্যন্ত উড়িষ্যার আফগান শাসকদের সঙ্গে এবং বাংলার দক্ষিণ ও পূর্বদিকের বেশ কিছু শক্তিশালী আফগান জমিদারের সঙ্গে মুঘলদের বিক্ষিপ্ত লড়াই চলেছিল বলে জানা যায়।

রাজপুতদের সঙ্গে সম্পর্ক : এক সুগঠিত শাসকশ্রেণির বিকাশ

আকবরের আমলে রাজপুতদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলার নীতি পরিণতি লাভ করেছিল এবং তা পরিণত হয়েছিল ভারতে মুঘল শাসনের এক অবিস্মরণীয় বৈশিষ্ট্যে যা পরেই অবশ্য তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। সুলতানি আমলে আঞ্চলিক শাসকদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় শক্তির সম্পর্ক নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। তুর্কি সুলতানরা সব সময় স্থানীয় রাজাদের, যাদের মধ্যে অনেকেই ছিল রাজপুত, তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি হ্রাস করার চেষ্টা করতেন। মূলত তারা চাইতেন এই সব আঞ্চলিক রাজারা যেন সবসময় তাদের সামনে পদানত হয়ে থাকে, যখন প্রয়োজন হবে তখন যথাযথ সামরিক সাহায্য দিতে ও পেশকাশ প্রদান করতে তারা যেন বদ্ধপরিকর হন। আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন প্রথম সুলতান যিনি দেওগড়ের স্বাধীন রাজা রাম দেও-এর সঙ্গে সক্রিয় মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। যুদ্ধে পরাজয়ের পর রাজাকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং প্রচুর উপঢৌকন প্রদান করে তাঁকে তাঁর রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুধু কি তাই, সেই সঙ্গে তাকে গুজরাটের নওসারি নামে একটি জেলাও উপহারস্বরূপ দান করা হয়েছিল। আলাউদ্দিন রাজা রাম দেও-এর কন্য ঝাট্যপালীকে বিবাহ করেছিলেন এবং তাঁদের সন্তান ও ভবিষ্যৎ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী খিজর খানের সঙ্গে গুজরাটের ভূতপূর্ব শাসকের কন্যা দেওয়াল দেবীর বিবাহও দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের আঞ্চলিক শাসকদের সঙ্গে এই সম্পর্ক গড়ে তোলার নীতি রাম দেও, আলাউদ্দিন খলজি ও খিজর খানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে বাহালোল লোদি ও সিকান্দার লোদির আমলে গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলের কয়েকজন রাজপুত রাজার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার একটা চেষ্টা করা হয়েছিল, এমনকি তাদের অনেককে আমির পদও প্রদান করা হয়েছিল বলে শোনা যায়। হয়তো এই পদ দেওয়ার জন্যেই আফগান ও হিন্দু রাজাদের মধ্যে মৈত্রী সম্পর্কের পথ প্রশস্ত হয়েছিল যা মুঘলদের ভারত জয়ের পরে দীর্ঘদিন বজায় ছিল।

ভারতে প্রত্যাবর্তন করে হুমায়ুন জমিদারদের মন জয় করার একগুচ্ছ নীতি নিয়েছিলেন বলে মুঘলদের সরকারি দলিলপত্র থেকে জানা যায়। এই জমিদার বলতে আসলে হিন্দু ও মুসলিম সকল স্বাধীন রাজাদেরও বোঝানো হয়েছিল। আবুল ফজলের মতে, যখন হুমায়ুন দিল্লিতে ছিলেন তখন তিনি ‘জমিদারদের মন ভোলাতে তাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এভাবেই ১৫৫৬ সালে মেওয়াটের হাসান খানের আত্মীয় জামাল খান ‘যিনি ছিলেন ভারতের অন্যতম এক বিরাট জমিদার’ তিনি এসে মুঘল সম্রাটের কাছে আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন। তার দুই সুন্দরী কন্যা ছিল যাদের একজনকে বিবাহ করেছিলেন হুমায়ুন আর-একজনকে গ্রহণ করেছিলেন বৈরাম খাঁ।

এ থেকে বোঝা যায় যে রাজপুতদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলার যে নীতি মুঘল প্রশাসন গ্রহণ করেছিল তা আসলে জমিদার বা এদেশের ঘরোয়া রাজাদের প্রতি নেওয়া তাদের বৃহত্তর নীতিরই একটা অঙ্গ ছিল। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে শেখ ফকরুদ্দিন ভাল্কারির একটা লেখা থেকে জানা যায়, যখন হুমায়ুন ইরানের শাসক শাহ তাহমাসপ-এর দরবারে অবস্থান করছিলেন তখন শাহ হুমায়ুনের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন কেন ভারত থেকে মুঘলদের বিতাড়িত করা হল, কারাই বা বিতাড়িত করলেন, কোন ধরনের মানুষদের নিয়ে সে দেশের জনজাতি গঠিত আর কারাই বা সবথেকে দুর্ধর্ষ সাহসী জাতি? যখন জানতে পারলেন যে এরা ছিল আফগান ও রাজপুত, তখন শাহ তাহমাসপ হুমায়ুনকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, যখন জমিদারদের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম না করতে পারলে হিন্দু শাসন করা সম্ভব নয়’ তখন সেরা পন্থা হল ‘রাজপুতদের আপন করে নাও। ভাক্কারির লেখা থেকে আরও জানা যায় যে মৃত্যুশয্যায় হুমায়ুন আকবরকে বলে গিয়েছিলেন, এই কয়ৌমকে (রাজপুত) অবশ্যই আপন করে নিতে হবে কারণ এদের কখনোই আইন ভঙ্গ করতে বা অমান্য করতে দেওয়া চলবে না, এদের আনুগত্য ও পরিষেবা সব সময় দরকার।

এভাবেই মুঘলরা চেয়েছিল জমিদার অর্থাৎ এদেশীয় শাসকশ্রেণির মন জয় করতে এবং রাজপুতদের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের আনুগত্য ও পরিষেবা নিশ্চিত করতে। তাছাড়া ১৫৫৭ সালে যখন আকবর একটি হাতির ওপর চড়তে গিয়ে অকস্মাৎ হাতিটি চটে যাওয়ার কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন তখন পাশে থাকা সবাই ভয়ে পালিয়ে গেলেও আম্বেরের এক ছোটো রাজা ভরা মলের নেতৃত্বে একদল রাজপুত এগিয়ে এসে হাতিটিকে বাগে এনেছিলেন। এই ঘটনার পর আকবরের রাজপুত প্রীতি বেড়ে গিয়েছিল বলে মনে করা হয়।

এরই সঙ্গে আজমের খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগায় প্রথম ভ্রমণ করতে গিয়ে ফেরার পথে আম্বেরের রাজা ভরা মলের কন্যা বাই হরখাকে আকবরের বিবাহ করার কাহিনি সর্বজনবিদিত। এই কাহিনির প্রেক্ষাপটটা ছিল অনেকটা এইরকম, যখন আকবর আজমের থেকে ফিরে আসছিলেন তখন ভরা মল আকবরের কাছে গিয়ে নালিশ। জানান যে মেওয়াটের মুঘল নিযুক্ত হাকিম মির্জা শারফুদ্দিন তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র সুজার সঙ্গে বিবাদের জেরে তাকে অপদস্থ করেছেন। যদিও ভরা মলের খুব বেশি প্রভাব ছিল না তবুও তিনি মির্জা শারফুদ্দিনের চাপে তাকে পেশকাশ প্রদান করতে এবং তার নিজ সন্তান ও দুই ভাগ্নেকে জামিন রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এতেও শারফুদ্দিন সন্তুষ্ট না হয়ে ভরা মলকে শেষ করে দেবার হুমকি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। আকবর ভরা মলকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন যদি রাজা তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন তাহলে তিনি তার কন্যাকে বিবাহ করবেন এবং বাকি সমস্যার সমাধান করে। দেবেন। কথা মতো ভরা মলের বশ্যতা ও কন্যাকে বিবাহের পরেই আকবর তার নিজ ভগ্নিপতি শারফুদ্দিনকে বলেন যেন রাজা ভরা মলের কোনো ব্যাপারে তিনি হস্তক্ষেপ না করেন।

রাজপুত রাজাদের সঙ্গে আকবরের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলার নীতি নিয়ে একাধিক বিভ্রান্তি রয়েছে। সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রনীতিতে একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক সব। সময়েই বিশ্বাস অর্জনের অন্যতম নির্ভরযোগ্য পন্থা হিসাবে কাজ করে। এ ধরনের সমাজে তাই বিভিন্ন রাজপরিবারের মধ্যে তৈরি হওয়া বৈবাহিক সম্পর্ক একসঙ্গে মিত্রতা ও আনুগত্য প্রদর্শনের প্রতীক হিসাবে কাজ করত। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ শিলালেখতে (খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক) পরিষ্কার করে বলা আছে যে অধীনস্থ সকল রাজাকেই সম্রাটের রাজপরিপারে তাদের কন্যাদের পাঠাতে হত। রাজশক্তির এই মনোভাব অব্যাহত ছিল পরের দিকে, যদিও প্রথম দিককার তুর্কি সুলতানরা চাইতেন না অধীনস্থ হিন্দু রাজাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠুক, কিন্তু পরবর্তীকালে এই ধরনের বহু দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে আমাদের। আমরা আগেই আলাউদ্দিন খলজির সঙ্গে দেওগড়ের রাজা রাম দেওয়ের কন্যার বিবাহের কথা উল্লেখ করেছি। ১৪০৬ সালে ফিরোজ শাহ বাহমনি ও বিজয়নগরের শাসক দেব রায়ের কন্যার মধ্যে ধুমধাম করে বিবাহ হয়েছিল। এ সময় থেকেই রাজপুত রাজা ও মুসলিম শাসকদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের কথা ক্রমাগত জানতে পারা যায়। ১৯৮৫ সালের নিজের রাজ্য বাঁচাতে গুজরাটের শাসক মহম্মদ শাহের সঙ্গে নিজের কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন ইদারের শাসক রাজা ভান। ১৫০৩-০৪ সাল নাগাদ মালবের শাসক আবুল মুজাফফর নাসিরুদ্দিন শাহ চিতোর আক্রমণ করার পরে রানা রাই মলের আত্মীয় ভবানী দাস তার কন্যাকে, নাসিরুদ্দিন শাহের হাত তুলে দিয়েছিলেন নজরানা হিসাবে। নজরানা দিলেও ভবানী দাসের কন্যা যথেষ্ট ভালো ব্যবহার পেয়েছিলেন নাসিরুদ্দিনের তরফ থেকে এবং তাকে ‘রানি চিতোরী’ উপাধিও দেওয়া হয়েছিল। বাঙ্কি দাস রি খায়াত’ অনুসারে মারোয়াড়ের শক্তিশালী রাজা মালদেও তার কন্যা বাই কনকাকে গুজরাটের শাসক মেহমুদের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন। আর-এক কন্যা লালা বাই-এর সঙ্গে ইসলাম শাহ শূরের বিবাহ মেহমুদের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন এবং তার তৃতীয় কন্যা রত্নাবতাঁকে শের শাহের এক ক্রীতদাস ও মেওয়াটের অলিখিত শাসক হাজী খান পাঠানের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়েছিল। নাগোরের শক্তিশালী কাইম খানি শাসকদের ফিরোজ তুঘলকের সময় রাজপুত থেকে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গিয়েছিলেন। হাজী খান আম্বের আক্রমণ করতে এলে তার সঙ্গে নিজ জ্যেষ্ঠ পুত্রীর বিবাহ দিয়েছিলেন ভরা মল নিজেই। তাছাড়া এই সময়ে আকবরও মানো গুনে রোহিলার কন্যা টিপুর পুত্রী রুক্মবতাঁকে বিবাহ করেছিলেন।

একটু নজর দিলে বোঝা যাবে যে এই সব বিবাহ সংগঠিত হয়েছিল বিশেষ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে–অর্থাৎ কখনো শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে তো কখনো শত্রুর বিরুদ্ধে অন্য কাউকে সাহায্য করতে। এ ধরনের বিবাহের মধ্য দিয়ে সাধারণত দুই পক্ষের মধ্যে কোনো স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে উঠত না। তবে ভরা মলের কন্যার সঙ্গে বিবাহের পর আকবর কিন্তু তাদের পরিবারের সঙ্গে নানা ভাবে বিশেষ সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তাই উজবেক বিদ্রোহের সময় ভরা মলের পুত্র ভগবন্ত দাস সব সময় আকবরের সঙ্গে ছিলেন। ১৫৬২ সালে যখন আকবর এক হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে মাত্র গুটিকতক সৈন্য সহযোগে ডাকাতি, বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার জন্যে কুখ্যাত আধুনিক উত্তরপ্রদেশের এটাই জেলার পারাউঙ্খ সহ মোট আট খানা বিদ্রোহী গ্রামে (আটগড়) আক্রমণ চালিয়েছিলেন তখন তার পাশে পাশে সর্বদা ছিলেন ভগবন্ত দাস। এছাড়া বিভিন্ন সময় ভগবন্ত দাস মুঘল রাজপরিবারের মহিলাদের দেখাশোনা সহ বেশ কিছু রাজকীয় বিষয়ে তত্ত্বাবধায়কের কাজ করতেন যা করার অধিকার একমাত্র সেই সব অভিজাতদের ছিল যারা হয় সরাসরি রাজপরিবারের সদস্য হতেন বা রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসভাজন হতেন। ১৫৬৯ সালে কচ্ছওয়াহি রাজকন্যা যাকে আকবর বিবাহ করেছিলেন, তার গর্ভে সেলিম জন্ম নেবার পর আকবর প্রবল আবেগতাড়িত হয়ে এবং কৃতজ্ঞতাবশত কচ্ছওয়াহ রাজপরিবারকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। একই ভাবে: ১৫৭০ সালে দানিয়াল জন্ম নেবার পর আকবর অম্বরে লোক পাঠিয়ে ভরা মলের স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন। ১৫৭২ সালে যখন আকবর গুজরাট অভিযানে বেরিয়েছিলেন তখন আবদুল্লা সুলতানপুরির সঙ্গে ভরা মলকেও রাজধানী আগ্রার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে সেখানে রাজপরিবারের সকল মহিলারা থাকতেন আর তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পিত হেয়ছিল ভরা মলের ওপর।

যদিও আকবর একাধিক উদারনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, যেমন–তিনি তার সিপাইদের নিষেধ করেছিলেন বিদ্রোহী গ্রামের নারী ও শিশুদের যেন দাস না বানানো হয়, কোটি টাকার ধর্মীয় কর আদায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, এমনকি ১৫৬৪ সালে চূড়ান্ত ভাবে জিজিয়া কর প্রত্যাহারও করে নিয়েছিলেন। কিন্তু রাজপুতদের সঙ্গে তার সম্পর্ক অধিকতর গম্ভীর হয়ে ওঠে ১৫৬৮ সালে চিতোর দুর্গের পতন ও রনথম্বর জয় করবার পরে। ১৫৭০ সালে যখন আকবর নাগোরে অবস্থান করছিলেন তখন বিকানেরের রাজা রই কল্যাণ মল তার পুত্র রাই সিংহকে নিয়ে আকবরের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আকবর কল্যাণ মলের ভ্রাতুস্পুত্রী কহনকে বিবাহ করেন। জয়সলমেরের রাজা রাওয়াল মল-ও আকবরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে তার এক কন্যার সঙ্গে সম্রাটের বিবাহ দেবার প্রস্তাব দেন। কথামতো ভগবন্ত দাসকে জয়সলেমেরে পাঠানো হয় রাওয়ালের কন্যাকে নিরাপত্তা প্রদানের জন্য। এই সব রাজা যারা আকবরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন তাদের সবার রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং কল্যাণ মল ও রাই সিংহ উভয়কেই রাজকার্যে নিয়োগ করা হয়। যোধপুরের রাজ চন্দ্রসেনও এসময় একই ভাবে আকবরের কাছে বশ্যতা স্বীকারের জন্য তার অন্যতম কন্যাকে সম্রাটের সঙ্গে বিবাহ দেবার আশায় অপেক্ষা করছিলেন। তাকেও নিরাশ করেননি আকবর। কিন্তু চন্দ্রসেনের দুই ভাই রাম রাই ও উদয় সিংহের বিরোধিতার কারণে আকবর চন্দ্রসেনকে যোধপুর রাজ্য ফিরিয়ে দিতে পারেননি। ফলে চন্দ্রসেনের সঙ্গে মুঘলদের দীর্ঘ যুদ্ধ হয়, কিন্তু ১৫৬৩ সাল থেকে যোধপুর মুঘল অধিকারেই খালিসা জমি হিসাবে থেকে যায়।

এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে রাজপুতদের ওপর আকবর এই বৈবাহিক সম্পর্কের নীতি এবং ভরা মলের কন্যাকে বিবাহ করার পদক্ষেপ জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। বরং এটা পরিষ্কার যে এগুলো ছিল অনেক বেশি পরিস্থিতির পরিহাস এবং কিছুটা রাজাদের এই বিবাহের সূত্র ধরে সুযোগ সুবিধা আদায়ের প্রত্যয়। আবুল ফজল যেমন বলেন যেসব রাজা এ ধরনের মৈত্রী জোটে আবদ্ধ হতেন তারা ‘জমিদারদের থেকে পৃথক’ মর্যাদা লাভ করতেন। আকবরও এ ধরনের জোটকে আনুগত্য ও বশ্যতার সঙ্গে এক করে দেখেননি, যদি দেখতেন তাহলে রনথম্বরের হাদাদের বশ্যতা লাভ করার পরে তাদের সঙ্গেও তিনি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। অথচ সুর্জন হাদাকে গড়-কাটঙ্গে জায়গির দান করা হয়েছিল। গুজরাটে ও অন্যত্র কাজ দেওয়া হয়েছিল এবং তার মনসবদারি দু’হাজারি করে দেওয়া হয়েছিল। একই ভাবে সিরোহি ও বান্সওয়াড়া রাজ্য বশ্যতা স্বীকার করলেও তাদের সঙ্গে কোনো রকম বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়নি।

আকবরের রাজপুত নীতির অগ্রগতিকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্ব যেটা চলেছিল প্রায় ১৫৭২ সাল পর্যন্ত সেখানে যেসব রাজপুত রাজা তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন তাদের সকলকে বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসাবে মেনে নেওয়া হয়েছিল। তাদের সবার কাছ থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য প্রয়োজন অনুসারে সামরিক পরিষেবা আশা করা হয়েছিল। তবে কখনোই তাদের নিজ রাজ্যের কাজে লাগানো হয়নি। রাজা ভরা মলের পুত্র ভগবন্ত দাস উজবেক বিদ্রোহ দমনের সময় আকবরের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকলেও তিনি কোনো সামরিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেছিলেন এমন তথ্য পাওয়া যায় না। অথচ টোডর মল ও রাই পাত্র দাস সক্রিয় ভাবে সামরিক কার্যকলাপে অংশ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। আবার চিতোর দুর্গ অবরোধের সময়। মান সিংহ মুঘল শিবিরে উপস্থিত থাকলেও আকবর তাকে একবারও সামরিক কাজে ব্যবহার করেননি। রাজস্থানে ১৫৬২ সালে যখন মুঘল বাহিনী মেরটা দুর্গ অবরোধ করেছিল তখন একদল কচ্ছওয়াহ সেনা মুঘলদের হয়ে কাজ করেছিল। পরের বছর মুঘলদের যোধপুর আক্রমণের সময়ে চন্দ্রসেনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাম রাই সক্রিয়ভাবে তাদের সহায়তা করেছিলেন। রাজপুত প্রধান মেবার ছেড়ে মালবের খলজি শাসকদের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। বিতাড়িত খলজি অভিজাতরাও রানার দরবারে আশ্রয় পেতে ছুটে এসেছেন অনেক বার।

আকবরের রাজপুত নীতির দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছেল মোটামুটি ১৫৭২ সালে তাঁর গুজরাট অভিযানের সময় থেকে। প্রথমে মান সিংহকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক বাহিনী সহযোগে শের খান ফৌলাদি ও তার পুত্রদের তাড়া করার জন্যে নিয়োগ করা হয়েছিল। যদিও শের খান ফৌলাদির পুত্ররা মান সিংহের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল তবুও তিনি তাদের অস্ত্রশস্ত্র, অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ও প্রচুর ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে এসেছিলেন যা দেখে আকবর খুব খুশি হয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর আকবর যখন অল্পসংখ্যক সেনা নিয়ে সরনলে ইব্রাহিম হুসেন মির্জা ও তার দলবলকে আক্রমণ করেছিলেন তখন সেই বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মান সিংহ এবং আকবরের পাশে ছিলেন ভগবন্ত দাস। এই লড়াইয়ে মির্জাদের হাতে আকবরের রাজপুত সঙ্গী রাজার সন্তান ভুপত রাই খুন হয়ে গেলে আকবর সেটাকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসাবে গণ্য করেন এবং প্রতিশোধস্বরূপ মহম্মদ হুসেন মির্জার সৎ ভাই শাহ মাদাদকে হত্যা করেন।

আকবর যে শুধু কচ্ছওয়াহদের ওপরেই ভরসা করতেন বা এই সময় মুঘল রাষ্ট্রের হয়ে কেবল যুদ্ধ করত তা কিন্তু নয়। গুজরাট অভিযানে যাওয়ার আগে আকবর বিকানেরের রাই রাই সিংহকে যোধপুর ও সিরোহির দায়িত্বে নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন যাতে রানার তরফ থেকে কোনোরকম আক্রমণ প্রতিহত করা এবং গুজরাট যাওয়ার সমস্ত রাস্তা খোলা রাখার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা না হয়। ফলে যখন ইব্রাহিম মির্জা চুপিসারে গুজরাটে হানা দিয়েছিল এবং নাগোর দুর্গ অবরোধ করেছিল তখন রাই রাই সিংহ ও রাম সিংহ (যোধপুরের দায়িত্বে ছিলেন) বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে এসে এক দুর্ধর্ষ যুদ্ধে ইব্রাহিম মির্জাকে উৎখাত করেছিলেন। এছাড়া রনথম্ভরের রাও সুর্জন হাদা ও শেখাওয়াতের রাইসাল দরবারিও আকবরের গুজরাট অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

এভাবে এ সময় রাজপুতরা কেবল বশ্যতা স্বীকার করে অনুগত মিত্র হয়েই থাকেনি, তারা রীতিমতো সাম্রাজ্যের সামরিক সহযোগীতে (sword-arm of the empire) পরিণত হয়েছিল। এই ধারা পূর্ণতা লাভ করে ১৫৭৬ সালে যখন মান সিংহকে রানা প্রতাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুঘল সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছিল।

রাজপুতদের সঙ্গে আকবরের সম্পর্কের তৃতীয় পর্ব শুরু হয় মোটামুটি ১৫৭৮ সাল নাগাদ যখন রাজা ভগবন্ত দাস ও সেনাপ্রধান মান সিংহ কাশ্মীর সহ সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ভারতে আক্রমণ চালানোর জন্য পশ্চিম পাঞ্জাবের ভেরা অঞ্চলে নির্মিত মুঘল শিবিরে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। এই সময় মুঘল দরবারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। যেমন–আকবরের সঙ্গে মুসলিম গোঁড়া ধর্মগুরুদের সম্পর্কে চিড় ধরে, সদর শেখ আবদুন নবীকে অপসারিত করা হয় এবং মাহজার’ জারির মধ্য দিয়ে শরিয়তে উল্লেখিত বিভিন্ন প্রকার আইনের মধ্যে থেকে নিজের মতো নির্বাচন করার অধিকার লাভ করেন আকবর। যেহেতু তখনও পর্যন্ত আকবর গোঁড়া ধর্মীয় কাঠামো থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বের করে আনেননি, ফলে বায়ুনির মতো কট্টরপন্থী মোল্লারা এটা বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন যে যতই মান সিংহকে হলদিঘাটিতে হিন্দু ও মুসলিম, উভয় বাহিনী নিয়ন্ত্রণের ভার দেওয়া হোক, আসলে এটা ইসলামের তরবারির নিচে এক হিন্দুর পদানত থাকারই নামান্তর মাত্র। এই তৃতীয় তথা শেষ পর্বে রাজপুতরা হয়ে উঠেছিলেন সাম্রাজ্যের অংশীদার এবং দরবারি অভিজাততন্ত্রের এক অন্যতম স্তম্ভ। উলেমাদের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মুসলিম অভিজাত বিশেষ করে তুরানি অভিজাতদের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে আকবর আর ভরসা রাখতে পারেননি, তাই সেই বিশ্বাসের জায়গা পূরণ করেছিল এই নতুন রাজপুত অভিজাত শ্রেণি।

এই নতুন পরিস্থিতিতে রাজপুতদের সম্রাটের নিজ সত্তাই মির্জা হাকিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও পাঠানো হয়েছিল। ভেরাতে পৌঁছোনোর অব্যবহিত পরেই ভগবন্ত দাসকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাঞ্জাবের মুঘল মনোনীত শাসক সাইদ খানকে সহযোগিতা করার জন্য। এটা অনুমান করা যেতে পারে কিছু প্রশাসনিক কাজের দায়িত্বও ভগবন্ত দাসের কাঁধে অর্পিত হয়েছিল। ১৫৮০ সাল নাগাদ পূর্ব দিকে সাম্রাজ্যের কিছু রাজকীয় নিয়ম-কানুনে অসন্তুষ্ট হয়ে সেখানকার অভিজাতরা গোঁড়া ধর্মগুরুদের একটা গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিতভাবে বিশাল এলাকা জুড়ে বিদ্রোহ ও দাঙ্গা শুরু করে। তারা মির্জা হাকিমকে তাদের সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে তার নামে খুৎবা পাঠ করে। মির্জা হাকিম সে সময় পাঞ্জাব আক্রমণ করেছিলেন এবং লাহোর অবরোধে ব্যস্ত ছিলেন। পূর্বাংশের এই বিদ্রোহ দেখে তাঁর মনে হয়েছিল যে যেভাবে আকবর মাহজার জারি করে এবং রাজপুতদের একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে বহু মানুষের অসন্তোষের কারণ হয়ে উঠেছিলেন, তাতে এই সময় আকবরকে আক্রমণ করলে সকল ইরানি ও তুরানি। অভিজাতদের তার পাশে পেতে কোনো অসুবিধা হবে না আর আকবরও কেবল রাজপুত ও শেখজাদাদের নিয়ে একা হয়ে পড়বেন। কিন্তু মির্জা হাকিমের এই অনুমান সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছিল। আকবর একদিকে পূর্বাংশের বিদ্রোহ দমনের জন্য মির্জা আজিজ কোকা ও রাজা টোডর মলকে পাঠিয়ে নিজে লাহোরে চলে যান। ভগবন্ত দাস ও সাইদ খানকে সাহায্য করার জন্য। আকবরের এই অভিযানে তার সঙ্গে ছিল বিশাল সংখ্যক বিশ্বস্ত রাজপুত সৈন্য। আকবরের আক্রমণে মির্জা হাকিম কাবুলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। আকবর কাবুলের দিকে অগ্রসর হন এবং মান সিংহ, রাই রাই সিংহ ও অন্যদের সিন্ধু নদ অতিক্রম করার আদেশ দেন। মির্জা হাকিমকে তারা যুদ্ধে হারাতে পারেননি। আকবরও কাবুল আক্রমণ করে মির্জা হাকিমকে দমাতে ব্যর্থ হন। তবে এই অঞ্চলে মুঘল নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আঁটসাঁট করার ক্ষেত্রে রাজপুতদের ওপর নির্ভর করেছিলেন আকবর। মান সিংহকে সিন্ধু অঞ্চলের দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়েছিল এবং ভগবন্ত দাসকে সাইদ খানের সঙ্গে যৌথভাবে লাহোরের শাসক মনোনীত করা হয়। কিছুদিন পর সাইদ খানকে দিল্লিতে বদলি করা হলে ভগবন্ত দাসকে লাহোরের একক শাসক নিয়োগ করা হয়। (জানুয়ারি, ১৫৮৩)

এভাবেই একদিকে রাজপুতরা সাম্রজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য সহযোগীতে পরিণত হয়ে উঠেছিল যাদের যে-কোনো জায়গায় যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করা যেত, এমনকি সম্রাটের নিজের রক্তের ভাইদের বিরুদ্ধেও এদের অনায়াসে ব্যবহার করা হয়েছিল। আর অন্যদিকে তাদের রাষ্ট্র শাসনের কাজেও নিয়োগ করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে রাজপুত রাজাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কও পরবর্তীকালে আরও মজবুত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যেমন ভগবন্ত সিংহের কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়েছিল সেলিমের (১৫৮৩)। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে খালিসা জমি হিসাবে পড়ে থাকা যোধপুর অঞ্চলটি চন্দ্রসেনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মোটা রাজা উদয় সিংহকে দান করা হয়েছিল। শুধু কি তাই, এই যে সব বিবাহ সংগঠিত হয়েছিল সেগুলোর ধুমধাম করে আয়োজন করা হত মুঘল রাষ্ট্রের তরফ থেকে। আকবর নিজেই তার বহু বিবাহে সেজেগুজে শোভাযাত্রা করে কনের বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং সেখানে হিন্দু বিবাহ রীতিও মানা হয়। বিকানের ও জয়সলমেরের শাসক পরিবারের কন্যাদের সঙ্গেও সেলিমের বিবাহ দেওয়া হয়েছিল। কিছুকাল পর দানিয়ালের বিবাহ হয়েছিল রাই মালদেও-এর পুত্র রাইমলের কন্যার সঙ্গে। তাই এটা স্পষ্ট যে আকবর তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যেও রাজপুতদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার নীতি সঞ্চারিত করেছিলেন।

আকবরের রাজত্বকালের শেষের দিকে রাজপুতদের সঙ্গে এই সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছিল। ১৫৮৫-৮৬ সালে যখন প্রত্যেক সুবায় দুজন করে সুবাদার নিয়াগ করা হচ্ছিল তখন লাহোর, কাবুল, আগ্রা ও আজমের–এই চার সুবায় অতিরিক্ত যুগ্ম-মুঘল মনোনীত শাসক (joint governor) হিসাবে রাজপুতদের নিয়োগ করা হয়েছিল। সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ যেটা ছিল তা রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রদেশ-লাহোর ও কাবুলে মান সিংহ ও ভগবন্ত দাসকে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত। এছাড়া বহু দুর্গের ফৌজদার ও সেনাপ্রধান হিসাবেও রাজপুতদের নিয়োগ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে মানসিংহকে বাংলা ও বিহারের শাসক হিসাবে নিযুক্ত করে পাঠানো হয়েছিল এবং ৭০০০ পদ দান করা হয়েছিল যা সে সময় একমাত্র একজন অভিজাতই ভোগ করতেন, আর তিনি হলেন মির্জা আজিজ কোকা। আকবরের আমলে কচ্ছওয়াহরা সবথেকে শক্তিশালী ছিল। তাই ১.৫৯৩-৯৪ সালে। রচিত আইন-ই আকবরী গ্রন্থে ২৭ জন রাজপুত অভিজাতের তালিকায় ১৩ জন ছিলেন কচ্ছওয়াহ। অন্যান্য রাজপুতরাও উন্নতি করেছিলেন– বিকানেরের রাই রাই সিংহকে ১৫৯০-৯১ সালে লাহোরের মনোনীত শাসক নিযুক্ত করার পাশাপাশি তারা পুত্র সুরজ সিংহকে গুজরাটের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। তবে আকবরের আমলে যেভাবে রাজকার্যে কচ্ছওয়াহদের আধিক্য দেখা গিয়েছিল তা কিছুটা সংশোধন করে নিয়েছিলেন জাহাঙ্গির সিংহাসনে বসার পর।

মুঘল-রাজপুত মৈত্রী সম্পর্ক কিন্তু উভয়পক্ষের জন্যেই লাভজনক হয়েছিল। এই মৈত্রীর জোট মুঘল শিবিরে জুগিয়েছিল এক ঝক নির্ভরযোগ্য ও দুঃসাহসিক যোদ্ধা। তাদের দৃঢ় কর্তব্যনিষ্ঠাকে পাথেয় করে মুঘল সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ও সমৃদ্ধি অনেকটাই সম্ভব হয়েছিল। অন্যদিকে মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হতে পারার দরুন রাজপুত রাজারা তাদের ঘর ছেড়ে অনেক দূর-দূরান্তে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এবং বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ লাভ করেছিলেন। এসব তাদের পরবর্তীকালে সামাজিক সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে কাজে এসেছিল। আর্থিকভাবেও লাভবান। হয়েছিলেন তাঁরা। রাজস্থানে তাদের সম্পত্তি তো ছিলই, তার পাশাপাশি রাজস্থানের। বাইরেও তাদের মনসব অনুপাতে জায়গির বরাদ্দ করা হয়েছিল। এই হিসাবে প্রথম এ ধরনের জায়গির কচ্ছওয়াহরা লাভ করেছিল পাঞ্জাবে, তারপর ভগবন্ত দাস ও মান সিংহ যখন পাঞ্জাবে নিযুক্ত ছিলেন তখন সেখানে তাদের জায়গির দেওয়া হয়েছিল। এরও পরে মান সিংহ যখন বাংলা ও বিহারের দায়িত্ব লাভ করেছিলেন তখন তার ও ভগবন্ত দাসের জন্য সেখানেও জায়গির বরাদ্দ করা হয়েছিল। এসব জায়গির যে। রাজাদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস ছিল সে ব্যাপারে খুব একটা সন্দেহ নেই। যেখানে এই সব বাইরের জায়গির অন্য জায়গিরের মতোই হস্তান্তরযোগ্য ছিল, সেখানে। রাজপুত রাজাদের নিজ এলাকায় জায়গির বরাদ্দ করা হত; এগুলোকে বলা হল ‘ওয়াত জায়গির’। এই জায়গিরগুলো এক শাসকের জীবনকালের মধ্যে হস্তান্তর করা। যেত না ঠিকই, কিন্তু মনসব বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে এই জায়গিরের পরিমাণও বাড়ত।

রাজপুত রাজাদের নিজ নিজ এলাকায় অনেক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া। হয়েছিল। তবে মুঘলদের তরফ থেকে তাদের এটা বলা হয়েছিল যে রাহাদারী’ বা পথ করের মতো নিষিদ্ধ করগুলি যেন কোনোভাবেই আদায় করা না হয়। মুঘল কর্তৃপক্ষ এটা চায়নি যে রাজস্থান থেকে সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথে বাণিজ্যিক গতিবিধি কোনোভাবেই এ ধরনের কর আদায়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হোক। এছাড়া মুঘলরা রাজস্থানে নিজস্ব ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা বা ‘জবত’ প্রচলন করার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিল, কিন্তু সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কারণ রাজস্থানের নিজস্ব রাজস্ব ব্যবস্থা ‘রেখ’ সেখানে ইতিমধ্যেই প্রচলিত ছিল যা মুঘল ব্যবস্থা বা জমার থেকে অনেকটা আলাদা।

মুঘলরা রাজপুত রাজাদের পারস্পরিক এলাকা দখলের লড়াইয়ে হস্তক্ষেপ করত এবং পরিস্থিতি বাগে আনার জন্য মাঝেমধ্যে যুদ্ধনীতিরও সাহায্য নিত। আসলে রাজপুতানার বিভিন্ন রাজার মধ্যে এলাকা দখল নিয়ে বিবাদের রীতিমতো ঐতিহ্যই ছিল বলা যায়। যেমন জয়সলেমেরের ভাটি ও বিকানের বা যোধপুরের রাজারা বরাবরই পোখরান পরগনা দখল করে দ্বন্দে মেতে থাকত। কিন্তু আকবর এই পরগনা যোধপুরের শাসক মোটা রাজা উদয় সিংহকে দিয়েছিলেন। তবে ভাটিদের বিরোধিতার কারণে উদয় সিংহ পোখরানের দখল নিতে পারেননি। আবার মেরটাকে নিয়ে যোধপুর ও মেবারের মধ্যে বিবাদ ছিল। কিন্তু মেরাট এই দুই রাজ্যের আধিপত্য ছেড়ে একক। ভাবে স্বতন্ত্র রাজ্যের মর্যাদা ভোগ করতে চাইত আর মেরটার সেই প্রচেষ্টাকে কিছুদিন সমর্থনও করেছিল মুঘল কর্তৃপক্ষ।

রাজপুত রাজ্যগুলোর মধ্যে আর এক সমস্যা ছিল উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিবাদ। হিন্দু বা মুসলিম কোনো রাজবংশের মধ্যে জ্যেষ্ঠাধিকারের ঐতিহ্য কোনোদিনই প্রায় ছিল না, অর্থাৎ রাজার মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্রই যে সর্বদা সিংহাসনে বসবেন, এমন কোনো সর্বসম্মত নিয়ম ছিল না। সে কারণে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই এদেশে সেই মৌর্য বা প্রাক-মৌর্য যুগ থেকেই চলে আসছে। আকবরের আমলে অন্যতম জনপ্রিয় এক হিন্দি কবি তুলসীদাস ঘোষণা করেছিলেন রাজার সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্বাচন বা ‘রাজটিকা প্রদানের অধিকার লেখা রয়েছে ধর্মগ্রন্থে বা রাজ ঐতিহ্যের মধ্যেই। কিন্তু সে নিয়ম সবসময় পালন করা হত না, তাই গৃহযুদ্ধ বেঁধে যেত। মৈত্রী সম্পর্কে আবদ্ধ রাজপুত রাজাদের এ ধরনের বিবাদেও মুঘল সাম্রাজ্যের হস্তক্ষেপ করার অধিকার ছিল বলে মনে করতেন সার্বভৌম শক্তির অধিকারী সম্রাটরা। তাই যখন রাও মালদেও মারা গেলেন তখন তার দ্বারা মনোনীত তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র চন্দ্রসেন মাড়োয়া রাজ্যের সিংহাসনে বসুক এটা মেনে নিতে না পেরে মালদেওয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র মোটা রাজা উদয় সিংহকে বসিয়েছিলেন সম্রাট আকবর। এর মধ্যে অনেকদিন ধরেই যোধপুর মুঘল নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা বা খালিসা জমি হিসাবে পড়েছিল। কোনো উত্তরাধিকারীকেই সেখানে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ১৫৯৩ সালে পান্নার শাসক রাজা রামচন্দ্রের পুত্র বালভদ্রের মৃত্যুর পর মারা যান। রাজা নিজেই। তখন রাজ্যের প্রধানরা মিলিত হয়ে আলোচনা করে রাজার নাবালক সন্তান বিক্রমজিৎকে ‘গদ্দি’ বা সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছিলেন। সম্রাটকে এ ব্যাপারে একেবারেই অবগত করা হয়নি। এতে আকবর প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়ে যান এবং পাত্র দাসকে পান্না দখল করতে পাঠান। পান্না মুঘল দখলে এলেও অবশেষে ১৬০১ সালে বিক্রমজিৎ তার হারানো ‘গদ্দি’ পুনরুদ্ধার করেন। আকবরের পর জাহাঙ্গিরেরও উত্তরাধিকার বিবাদে হস্তক্ষেপ করার মনোভাব প্রায় একই ছিল। যখন রাজা রাও রাই সিংহের মৃত্যুর পর বিকানেরের সিংহাসনের উত্তরসূরি হিসাবে সুর সিংহকে মনোনীত করা হয়েছিল তখন জাহাঙ্গির সে ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে এই মনোনয়ন বাতিল করে দিয়েছিলেন এবং সুর সিংহের ভাই দলপত সিংহকে পরবর্তী রাজা মনোনীত করে রাজটিকা দান করেছিলেন। তবে অচিরেই সুর সিংহ এই রাজ্য দখল করে ফেলেছিলেন।

সুতরাং এই ধরনের ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার যে রাজপুতদের সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে মুঘল স্বীকৃতি কার্যত আবশ্যিক হয়ে পড়েছিল। বস্তুত উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি তাদের অধিকারের থেকেও অনেক বেশি মুঘল সাম্রাজ্যের অনুগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল।

মুঘলদের কর্তৃত্বের ধারণায় রাজপুত রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শান্তি। এই ব্যাপারটাকে অনেকটা Pc Mughalica বলা চলে যেখানে নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠিটা ছিল মুঘল কর্তৃপক্ষের হাতে এবং তাদের কৃপাতেই দেশে এক প্রকার শান্তির শাসন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে যে সমস্ত রাজপুত রাজা তাদের নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র শাসনের দায়িত্ব পালন করতে যেতেন, তাদের এলাকায় শান্তি বজায় রাখার বিষয় নিয়ে ভাবতে হত না। সেখানকার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার সকল দায়িত্ব নিয়ে নিত মুঘলকর্তৃপক্ষ। তবে যেহেতু মুঘল কর্তৃত্বের এই ধারণায় সম্রাটকে রাজপুত রাজ্যের উত্তরাধিকার মনোনয়নের দিকটা তত্ত্বাবধান করতে হত, সেহেতু কোথাও-না-কোথাও সম্রাটের প্রতি রাজাদের যে অসন্তোষ জমা হচ্ছিল সেটা অনুমান করাই যায়। তবে, রাজপুতদের সঙ্গে এধরনের সম্পর্ক গড়ে তোলা ও বজায় রাখার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বৃহত্তর ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতি নিঃসন্দেহে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাই এই নীতি পরবর্তীকালে যখন লঙ্ঘিত হয়েছিল তখন রাজপুতদের সঙ্গে মুঘলদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চাপান-উতোর দেখা দিয়েছিল।

মেবারের সঙ্গে সম্পর্ক

রাজস্থানের প্রায় সকল রাজ্যের সঙ্গে আকবর সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, একমাত্র মেবার ছাড়া। আসলে মেবারের আয়তন, ঘন জঙ্গল, পাহাড়ি ভূভাগ ইত্যাদি মেবারকে প্রথম থেকেই ভৌগোলিক ভাবে অন্য রাজপুত রাজ্যের তুলনায় অনেকটা বেশি স্বতন্ত্র রাখতে সাহায্য করেছিল। মেবার রাজস্থানের প্রথম সারির রাজ্য হিসাবে নিজের ক্ষমতা ও নেতৃত্বের দক্ষতা সম্পর্ক অবগত ছিল। মুঘলদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বাঁধা ছিল তাই একপ্রকার অবশ্যম্ভাবী। তাছাড়া গুজরাট জয় করার পরে মুঘলদের সেই অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে গেলে মেবারের ভূখণ্ড ব্যবহার। করতেই হত। তাই এই অঞ্চলকে বাগে আনাটা মুঘলদের কাছে বেশ আবশ্যক হয়ে। পড়েছিল।

১৫৭২ সালে যখন মেবারের গদিতে বসলেন মহারানা প্রতাপ তখন তার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে একাধিক কূটনৈতিক রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করেছিলেন আকবর। প্রথম প্রেরিত দূতদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আকবর ঘনিষ্ঠ জালাল খান কুরচি। এরপর যান রাজা মান সিংহ। মান সিংহকে মহারানা সম্পূর্ণ রাজপুত দরবারি প্রথা মেনে। আপ্যায়ন করেছিলেন বলে জানা গেলেও এমনটাও শোনা যায় যে পরে মান সিংহকে আকবরের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক রাখার জন্যে সেখানে প্রবল অপমানজনক কথাও নাকি শুনতে হয়েছিল। কূটনৈতিক দিকে থেকে মান সিংহের এই সফর সফল হয়নি, কারণ রানা আকবরের দরবারে আসার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে এর পরে রাজা ভগবন্ত দাসকে পাঠিয়ে আকবর অনেকটাই সফল হয়েছিলেন এবং রানার পুত্র অমর সিংহকে সঙ্গে নিয়ে ভগবন্ত দাস মুঘল রাজধানীতে এসেছিলেন। তবে রানা যেহেতু ব্যক্তিগতভাবে আকবরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে চাননি সেহেতু উভয় পক্ষের মধ্যে কোনো চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। তা ছাড়া চিতোর নিয়েও উভয় পক্ষের মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল। সর্বশেষ দূত হিসাবে টোডরমলকে পাঠিয়েও আকবর রানাকে বাগে আনতে পারেননি।

সমঝোতার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার ফলে মেবারের সঙ্গে মুঘলদের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। তবে সবার আগে বিহার ও বাংলা জয় করার দিকে মনোনিবেশ করেন। এর মধ্যে তিনি এক নতুন প্রশাসনিক কাঠামো নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন যেখানে বহুত্বের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে বিভিন্ন জাতের মুসলমানদের এবং পরে বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের একটি অখণ্ড প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর সঙ্গে এ সময় সিওয়ানাতে ঘাঁটি গেড়ে চন্দ্রসেন যেসব কার্যকলাপ শুরু করেছিলেন তার ফলে মেবারের উত্তেজনা শুরু হয়েছিল আর সেদিকেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিলেন আকবর। চন্দ্রসেন সে সময় নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে মেবারে এসে আশ্রয় পেয়েছিলেন এবং পাশের শক্তিশালী সিওয়ানা দুর্গ দখল করে নিয়েছিলেন (১৫৭৫)। মূলত এর পরেই আকবর মেবার জয়ের জন্য ঝাঁপিয়েছিলেন।

১৫৭৬ সালের শুরুর দিকে আকবর প্রথমে আজমেরে এসে উপস্থিত হন আর তারপর রাজা মান সিংহকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় ৫০০০ মুঘল ও রাজপুত সৈন্য সহযোগে তিনি রানা প্রতাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এ ধরনের আক্রমণ ধেয়ে আসার সম্ভাবনা আঁচ করে রানা প্রতাপ আগে থেকেই একেবারে চিতোর পর্যন্ত লুঠপাট চালিয়ে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলেন যাতে মুঘল বাহিনী মেবারে যুদ্ধ করতে এসে কোনোরকম খাদ্য রসদ না পায়। পাহাড়ি এলাকার সংকীর্ণ পথগুলিও আগে থেকে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘিরে দিয়েছিলেন। সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে তবেই রানা আকবরের আক্রমণ প্রতিহত করতে ৩০০০ সৈন্য নিয়ে রাজধানী কুম্ভলগড় থেকে বেরিয়ে আসেন এবং কুম্ভলগড় প্রবেশের একমাত্র সংকীর্ণ পাহাড়ি পথের সামনে হলদিঘাটি অঞ্চলে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেন। রানাকে সহায়তা করার জন্যে হাকিম খান শূরের নেতৃত্বে একটি আফগান বাহিনী এগিয়ে এসেছিল। এছাড়াও একটা ছোটো সেনাদল নিয়ে এসেছিল রানার মিত্র ভিলরা যাদের অমূল্য সাহায্য পরের দিকে রানার খুব দরকারে পড়েছিল।

হলদিঘাটির যুদ্ধে (১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৫৭৬) উভয়পক্ষ মূলত পদাতিক ও হস্তী বাহিনী নিয়ে লড়াই করেছিল। মুঘলরা ওই দুর্গম অঞ্চলে কিছু ছোটো কামান বহন করে আনলেও কোনো বৃহৎ পদাতিক বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সমস্যার মুখে পড়েছিল। রানা প্রতাপের কাছে বোধ হয় কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। হয় তার এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহারে অনীহা ছিল অথবা এই ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ ও ব্যবহার করার পর্যাপ্ত আর্থিক ক্ষমতা ছিল না। যাই হোক-প্রথাগত পদ্ধতিতে যুদ্ধ হওয়ায় প্রথম থেকেই এগিয়ে ছিল রাজপুতরা। তাদের ক্ষিপ্র আক্রমণ মুঘল বাহিনীর ডান ও বাম দিকের অংশকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে কেন্দ্রীয় অংশের ওপর গুরুতর চাপ বাড়িয়ে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্যে সংরক্ষিত বিশেষ বাহিনীর সহায়তা এবং জনশ্রুতি অনুসারে বোধ হয় যুদ্ধক্ষেত্রে স্বয়ং আকবরের আগমন সেই যাত্রায় মুঘলদের রক্ষা করেছিল। রাজপুতদের অদম্য সাহস, প্রচণ্ড গরম ও পাহাড়ি অঞ্চলের যে-কোনো জায়গা থেকে অতর্কিত আক্রমণের আশঙ্কায় মুঘল বাহিনী আর অগ্রসর হতে পারেনি। ফলে সহজেই রানা ও তাঁর সেনারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্যে পাহাড়ে লুকিয়ে পড়বার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। এভাবেই যুদ্ধ আপাত নিষ্ফলা থেকে গেল।

হলদিঘাটির যুদ্ধে রানা মূলত তার অধীনস্থ অনুগামীদের সেনা নিয়েই লড়াই চালিয়েছিলেন, তবে ছোটো কিছু সেনাদল পাঠিয়ে অভাবনীয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন গোয়ালিয়রের পূর্বতন শাসক রাম শাহ ও তাঁর পুত্র এবং আফগান নেতা হাকিম শূর। মুঘল বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেনাপ্রধান মান সিংহ। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের হয়ে লড়াই করেছিলেন, তাই কোনো দিক দিয়েই এই যুদ্ধকে নিছক হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সংগ্রাম বলে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। এমনকি এটা ভাবাও অযৌক্তিক হবে যে এই যুদ্ধ রাজপুতদের স্বাধীনতার লড়াই ছিল। কারণ ইতিমধ্যেই রাজপুতদের একটা প্রভাবশালী অংশ মুঘলদের হয়ে কাজ করছিল। তাই এই যুদ্ধকে বরং বলা ভালো একটি রাজ্যের মুঘল আগ্রাসন থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রাম। ষোড়শ শতকে ভারতে স্থানীয় ও আঞ্চলিক দেশাত্মবোধের চেতনা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল এবং তা সব সময়েই ঐতিহ্য ও প্রথার জিগির তুলে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করা হত। যদিও সেই সব স্লোগান বেশিদূর শোনা যেত না। রাজপুতদের ক্ষেত্রেও অনেকটা সেরকমই ঘটেছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে দেশপ্রেম জাগরিত হলেও তা সমগ্র রাজস্থান জুড়ে একত্রিত করার মতো প্রভাবশালী শক্তির অভাব ছিল স্পষ্ট। রাজস্থান সব সময়েই বড় বেশি যুদ্ধ ও আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে মেতে থাকতে ভালোবাসত। আঞ্চলিক স্বতন্ত্র চেতনাকে সংগঠিত করার কোনো তাগিদ দেখা যায়নি সেখানে।

হলদিঘাটির যুদ্ধের পর আকবর আজমেরে ফিরে আসেন এবং সেখান থেকে তিনি নিজে সরাসরি রানা প্রতাপের বিরুদ্ধে অভিযানের নেতৃত্ব দেন। এই প্রক্রিয়ায় আকবর গোগাণ্ডা, উদয়পুর ও কুম্বলমের দখল করে প্রতাপকে এমন চাপ দিলেন যে যাতে তিনি দক্ষিণ মেবারের পাহাড়ি এলাকায় আরও বেশি করে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। মুঘলরা একই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জালোর-এর আফগান প্রধান এবং ইদর, সিরোহি, বানসওয়াড়া, দুঙ্গাপুর ও বুন্দির রাজপুত প্রধানদের বিরুদ্ধেও আক্রমণ শানায়। এই সব রাজ্যগুলো গুজরাতের নিকটবর্তী মেবারের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত ছিল এবং এই অঞ্চলে যে শক্তি ক্ষমতাসীন ছিল প্রথাগতভাবে তাদের প্রভুত্বই এরা মেনে নিত, সে যতই মেবারের সঙ্গে জাতিগত ও বৈবাহিক সম্পর্ক থাকুক না কেন। মুঘল আক্রমণের সামনে এই সব রাজ্যগুলোর প্রধানদের কাছে নতিস্বীকার করা ছাড়া আর। কোনো বিকল্প ছিল না। বুন্দি অঞ্চলে রাও সুর্জন হাদার পুত্র দুদা রানা প্রতাপের সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা করায় মুঘলদের একটা বাহিনী তড়িঘড়ি বুন্দি আক্রমণ চালিয়ে বুন্দি সহ পার্শ্ববর্তী এলাকার দখল নেয়। এই যুদ্ধে দুদা সহ তার পিতা রাও সুর্জন হাদা ও ভ্রাতা ভোজ অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু মুঘল বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডে তাদের সকল প্রতিরোধ অকেজো হয়ে যায় এবং দুদা পাহাড়ি এলাকায় পালিয়ে যান। এরপুর বুন্দির দায়িত্ব অর্পণ করা হয় ভোজের হাতে যিনি ইতিমধ্যেই বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

এভাবেই রানা প্রতাপকে চারিদিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। যদিও এরপর তিনি অনেক বেশি শক্তিশালী মুঘলদের বিরুদ্ধে দুঃসাহসিক ও অসম একটা যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে রাজপুতানায় রাজপুতদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তিনি একেবারেই প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন। ১৫৭৯ সাল পর্যন্ত মেবারের ওপর মুঘলদের চাপ অব্যাহত ছিল। ১৫৭৯ সাল পরবর্তী একের-পর এক ঘটনা যেমন বাংলা ও বিহারে বিদ্রোহ এবং ১৫৮৫ তে মির্জা হাকিমের পাঞ্জাব আক্রমণ, আকবরের মনোযোগ মেবারের দিক থেকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছিল। এরপর আকবর সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম অংশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার জন্যে দীর্ঘ বারো বছর লাহোরে থেকে গিয়েছিলেন। এই সময় মুঘলদের তরফ থেকে রানা প্রতাপের বিরুদ্ধে কোনোরকম অভিযান চালানো হয়নি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রানা কুম্ভলগড় ও চিতোর সংলগ্ন এলাকা সহ বহু অঞ্চল পুনরুদ্ধার করে নেন। তবে চিতোর দখল করতে পারেননি। এই সময় তিনি আধুনিক সিঙ্গারপুরের নিকট চবন্তে তার নতুন রাজধানী নির্মাণ করেন। রানা প্রতাপের মৃত্যু ঘটে ১৫৯৭ সালে মাত্র ৫১ বছর বয়সে একটি শক্ত ধনুকে দড়ি পরাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় গুরুতর চোট লাগার কারণে।

এটা বলা খুব কঠিন যে আকবর যদি রানা প্রতাপকে ব্যক্তিগত ভাবে নতিস্বীকার করতে না বলে অপেক্ষাকৃত নমনীয় নীতি নিয়ে মেবার দখলের চেষ্টা করতেন তাহলে এই সময়ে পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে যে রক্ত ঝরেছিল ও বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছিল তা অনেকটা এড়ানো যেত। তবে যেভাবে রানা প্রতাপের মৃত্যুর পর মুঘল বাহিনী মেবারের দখল নিয়েছিল এবং কঠোর কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ জারি করেছিল আর যত সহজে রাজপুতরাও সেখানে মুঘলদের অনুগত সহযোগীতে পরিণত হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে এটা মনে হয় যে আকবর রানা প্রতাপকে সরাসরি বশ্যতা স্বীকারের চ্যালেঞ্জ না জানিয়েও অনেক সহজে এসব করতে পারতেন। কাশ্মীর ও সিন্ধু অঞ্চল দখল নেবার জন্যেও আকবর সেখানকার তৈমুরীয় শাসক মির্জা জানি বেগকে রানা প্রতাপের মতো ব্যক্তিগত বশ্যতা প্রদর্শনের দাবি করেছিলেন এবং তা না মানায় সে অঞ্চল দখল করতে বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন।

রানা প্রতাপের মৃত্যুর পর মেবারে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন তাঁর উত্তরসূরি পুত্র অমর সিংহ। তাকে প্রতিহত করতে আকবর ১৫৯৮ থেকে ১৬০৫ পর্যন্ত একাধিক সেনা অভিযান চালিয়েছিলেন। যুবরাজ সেলিমকেও ১৫৯৯ সালে রানার বিরুদ্ধে অভিযানে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু সেলিম খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি। ১৬০৩ সালে আবার তাঁকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সেবারেও তিনি ব্যর্থ হন। তবে সিংহাসনে অধিষ্ঠানের পর তিনি যখন সেলিম থেকে ‘জাহাঙ্গির’ হয়ে উঠেছিলেন তখন তিনি এই ব্যাপারটা অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে সামলাতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই সময় যুবরাজ পারভেজ, মহবত খাঁ কিংবা আবদুল্লা খাঁর একের-পর-এক পরিচালিত কোনো অভিযানেই মুঘলরা আপাতত অমর সিংহকে বাগে আনতে পারেননি। ১৬১৩ সালে জাহাঙ্গির স্বয়ং রানার বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করতে আজমেরে এসে হাজির হন। মেবারের পাহাড়ি এলাকা দখল করার জন্যে শাহজাদা খুররমের নেতৃত্বে একটা বিশাল বাহিনীকে নিয়োগ করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে মুঘলদের আক্রমণ, অসংখ্য রাজপুত সেনার মৃত্যু, রাজ্যের জনসংখ্যার হ্রাস এবং এ সময় কৃষিতে অবক্ষয় অবশেষে মুঘলদের সাফল্যের মুখ দেখায়। মেবারের সর্দাররা শাহজাদা খুররমের মাধ্যমে মুঘলদের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সমঝোতার রাস্তা খোলার উদ্যোগ নেয়। রানা অনেক কষ্টে সমঝোতায় সম্মতি জানাতে বাধ হন। নরম অথচ কূটনৈতিক একটা ভাবমূর্তি নিয়ে জাহাঙ্গির এই সমঝোতাকে বাস্তবায়িত করেন। আগে যখন পারভেজের নেতৃত্বে রানার বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেছিলেন তখন জাহাঙ্গির পারভেজকে। বলেছিলেন : ‘যদি রানা ও তার জ্যেষ্ঠ পুত্র করণ দেখা করতে এসে অপেক্ষা করেন। এবং আনুগত্য প্রদর্শন করে ও অধীনস্থ থেকে কাজ করার প্রস্তাব দেন, তাহলে তুমি ওদের কোনো ক্ষতি করো না।’ তিনি শাহাজাদা খুররমকে রানার সঙ্গে সমঝোতা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং তার হাতে রানার জন্য পাঠিয়েছিলেন সৌজন্যমূলক এক ফরমান। রানা জাহাঙ্গিরের ডাকে সাড়া দিয়ে খুররমের কাছে আসেন এবং দেখা করবার জন্যে অপেক্ষা করেন। পুত্র করণ সিংহকে তিনি আজমের প্রেরণ করেন। জাহাঙ্গিরের সঙ্গে দেখা করবার জন্য। রানার সম্মান রক্ষার্থে জাহাঙ্গির তাঁকে ব্যক্তিগত বশ্যতা স্বীকার করার ব্যাপারে জোর দেননি। করণ সিংহকে আজমেরে মুঘলদের তরফ থেকে হার্দ্য অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং প্রচুর উপহার দান করা হয়। তাঁকে যথাক্রমে ৫০০০ জাট ও ৫০০০ সাওয়ারের মনসব এবং মালবের রতলাম, ফুলিয়া, বানসওয়াড়া সহ একাধিক জায়গার জায়গির প্রদান করা হয়েছিল। এরপর থেকে মনসবদার হিসাবে করণ সিংহ ১৫০০ অশ্বারোহী বাহিনী সহযোগে মুঘল সম্রাটের সেবায় নিযুক্ত হন। রানা প্রতাপের আমলে আকবরের পক্ষে যোগ দেওয়া উদয়। সিংহের পুত্র সাগরকে জাহাঙ্গির ‘রানা’ উপাধি দান করেছিলেন এবং চিতোর দুর্গে নিয়োগ করেছিলেন। তাঁকে জাহাঙ্গির পরে চিতোর সহ মেবারের সকল পরগনার। দায়িত্বও অর্পণ করেছিলেন। দুঙ্গারপুর, বানসওয়াড়া প্রভৃতি অঞ্চলকে আকবরের আমলে স্বাধীন মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু জাহাঙ্গির এই রাজ্যগুলো পুনরায় রানার দায়িত্বে হস্তান্তর করেছিলেন। এই অঞ্চলগুলির জমা নির্ধারিত হয়েছিল প্রায় আট কোটি দাম (দুই কোটি টাকা) যার মধ্যে পঞ্চাশ লক্ষ দাম দুঙ্গারপুর, বানসওয়াড়া প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বিশেষ কর হিসাবে নেওয়া হয়েছিল। কুনওয়ার করণ সিংহকে প্রদত্ত জায়গিরের সঙ্গে রানার অধিকারে থাকা এলাকাগুলো যুক্ত করা হয়েছিল।

মেবারের রানাকে মুঘল দরবারে ব্যক্তিগত ভাবে উপস্থিত থেকে সেবা করার যে নিয়ম ছিল, তা তুলে দিয়ে জাহাঙ্গির একটা নতুন ধারা শুরু করেছিলেন; যদিও রানার পুত্র বা ভ্রাতাকে দরবারে আসতে হত এবং সম্রাট দরবারে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত। এভাবেই রানা অমর সিংহের পুত্র যুবরাজ ভীম দাক্ষিণাত্যে গিয়ে শাহজাদা খুররমের সেবা করেছিলেন। জাহাঙ্গির আর-একটা ধারা তৈরি করেছিলেন, তা হল মুঘল সম্রাটের সঙ্গে রানার বৈবাহিক সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে কোনো জোরজুলুম না করা। মেবারের প্রতি অনুসৃত এই দুই ধারা পরবর্তী মুঘল আমল জুড়ে অব্যাহত ছিল। তবে মুঘল কর্তৃপক্ষ বিনা কারণে মেবারের শাসকদের এই সব ছাড় দিয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।

রানার ওপর একটা মাত্র শর্ত জাহাঙ্গির আরোপ করেছিলেন–তা হল চিতোর দুর্গের ভেঙে যাওয়া দেওয়ালগুলো যেন কোনোভাবেই আর মেরামত না করা হয়। চিতোর দুর্গের প্রাচীরগুলো এত মজবুত ছিল যে মুঘল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই চাইত না এই দুর্গটি পুনর্নিমিত হয়ে মুঘল-বিরোধী আর কোনো কার্যকলাপের কেন্দ্র হয়ে উঠুক। হয়তো তারা চিতোর দুর্গের প্রাচীরের ধ্বংসস্তূপগুলোকে মেবারের স্বাধীন সত্তার ওপর মুঘল আধিপত্যের প্রতীক হিসাবে মনে করত, তাই চিতোর দুর্গ মেরামত করতে তাদের এত আপত্তি ছিল।

আকবরের নীতি অব্যাহত রেখে সম্রাট জাহাঙ্গির রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। আকবরের জীবদ্দশাতেই তিনি কচ্ছওয়াহের রাজা ভগবন্ত দাসের কন্যাকে এবং যোধপুরের রাজকুমারী মোটা রাজা উদয় সিংহের কন্যা মণি। বাইকে বিবাহ করেছিলেন (১৫৮৫)। অষ্টাদশ শতকের রাজপুত গ্রন্থ যোধপুর রাজ্যকি খায়াত-এ বলা আছে মণি বাঈয়ের আর এক নাম ছিল যোধা বাঈ। আকবর তাকে ‘তাজবিবি’ উপাধি দান করেছিলেন এবং আগ্রায় তার নামেই তাজগঞ্জ মহল্লা নির্মাণ করেছিলেন। ইনি ছিলেন শাহজাহানের গর্ভধারিণী জননী। জাহাঙ্গির বিকানের ও জয়সলমেরের রাজকুমারীদেরও বিবাহ করেছিলেন। সিংহাসনে বসার পর তিনি অন্য রাজপুত শাসকশ্রেণির সঙ্গেও একাধিক বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, যেমন রামচন্দ্র বুন্দেলার কন্যা, রাজা মানসিংহের জ্যেষ্ঠ পুত্র জগৎ সিংহ কচ্চওয়াহের কন্যা প্রমুখকেও বিবাহ করেছিলেন। যতদিন মেবার মুঘলদের নিয়ন্ত্রণে আসেনি ততদিন এই সব বিবাহ সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু মুঘলদের সামনে মেবারের নতিস্বীকার ও তাদের সহযোগী হয়ে কাজ করার পর থেকে প্রথমসারির রাজপুত রাজ্যগুলির সঙ্গে এই সব বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘটনা একেবারেই কমে গিয়েছিল।

এক জটিল শাসকশ্রেণির উত্থান

যেভাবে রাজপুত ও অন্যান্য হিন্দুদের রাজকাজে যুক্ত করা হয়েছিল এবং অন্যদের মতোই তাদের সমান পদ ও মর্যাদা দান করা হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে মুঘল আমলে এক বিরাট ও জটিল শাসকশ্রেণি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আইনআকবরীতে ১৫৭৫ থেকে ১৫৯৫ সালের মধ্যে ৫০০ ও তার অধিক পদাধিকারী অভিজাতদের যে তালিকা দেওয়া আছে সেখানে মোট ১৮৪ জনের মধ্যে ৩০ জনই ছিলেন হিন্দু। সেই ৩০ জন হিন্দুর মধ্যে আবার ২৭ জন ছিলেন রাজপুত। যদিও মুঘল রাজকার্যে রাজপুত ও অন্যান্য হিন্দুদের প্রকৃত গুরুত্ব অনুধাবন করা এই পরিসংখ্যান থেকে সম্ভব নয়। যারা এই প্রবণতায় খুশি ছিলেন না এবং আকবরের উদারপন্থী ধর্মীয় নীতি নির্ধারণে তাঁর রাজপুত পত্নীদের ভূমিকা নিয়ে যারা চিন্তিত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম বায়ুনি পরিহাস করে বলেছিলেন, ‘…ক্রমশ অপরিহার্য হয়ে ওঠা হিন্দু কাফেরের দল, যারা অচিরেই সৈন্যবাহিনী ও দেশের অর্ধেক জায়গা। পূর্ণ করে দেবে এবং যারা মুঘল ও হিন্দুস্থানিদের মতো কোনো শক্তিশালী কয়ৌম ছিল , তাদের থেকে ভালো আর তিনি (আকবর’ কাদেরই পা পেতেন!’

আগেই বলা হয়েছে যে আকবর কিন্তু শক্তিশালী রাজা ও জমিদারদের রাজকার্যে নিযুক্ত করেননি। তিনি রাজকার্যের দরজা শুধু প্রতিভাবান মানুষদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, ফলে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়েরই বহু দক্ষ মানুষ সাধারণ অবস্থা থেকে উঠে এসেছিলেন, এবং তাদের মধ্যে অনেকেই দরবারের উচ্চ ও সম্মানীয় পদ লাভ করেছিলেন। রাজপুতদের মধ্যে এমন অনেকে ছিল যারা হয়তো কোনো রাজার অধীনস্থ সর্দার হিসাবে কাজ করত, কিন্তু আকবরের নজরে পড়ে যাওয়ায় তাদের মুঘল রাজকীয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাইসাল দরবারী, রাই মনোহর, বেদী চাঁদ, লুনকরণ কচ্ছওয়াহ প্রমুখ।

আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজস্ব বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসাবে ক্ষত্রী ও কায়স্থদের মতো হিন্দু জাতের মানুষদের নিয়োগ। এরা দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রের রাজস্ব দফতরের নিচুতলায় কাজ করত এবং বিশাল সংখ্যক অভিজাত পরিবারের আর্থিক উপদেষ্টা (পেশকার) হিসাবেও এদের দেখা যেত। আকবরের সময়ে এদের সাম্রাজ্যের রাজস্ব দফতরের উচ্চ পদে নিয়োগ করা শুরু হয়েছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন টোডর মল, যিনি আগে শের শাহের আমলে রাজস্ব বিভাগে কাজ করতেন, তাঁকে আকবর নিজের জমানায় শুধু যে উজবেক অভিজাত ও গুজরাটের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে সঙ্গে নিয়েছিলেন তাই নয়, বাংলা জয়ের ক্ষেত্রেও তাকে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল। তিনি উজির পদ লাভ করেছিলেন এবং রাজস্ব ব্যবস্থায় বেশ কিছু যুগান্তকারী সংস্কার করেছিলেন। আর একজন ছিলেন ক্ষত্রি রাই পাত্র দাস। ইনি এক সময় বিহার ও কাবুলের দেওয়ান হিসাবে কাজ করতেন। একে বিক্রমজিৎ উপাধি দান করে ৫০০০ মনসবদারি পদে উন্নীত করা হয়েছিল। আর আকবরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বীরবলের কথা তো সর্বজনবিদিত। এছাড়াও ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ রাই পুরুষোত্তম যাকে বকশি হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। যখন মুঘল সুবাগুলো গঠন করা হচ্ছিল তখন বারোটা সুবাতেই একজন করে দিওয়ান নিয়োগ করা হয়েছিল, আর এদের মধ্যে আটজনই ছিলেন ক্ষত্রি ও কায়স্থ।

রাজকার্যে রাজপুত অন্যান্য হিন্দুদের নিয়োগ করা হলেও সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক বিভাগে কিন্তু ভারতীয় মুসলিমদের অন্তর্ভুক্তি থেমে থাকেনি। আর এইদিকে তাদের পদোন্নতিরও যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল।

বাবরের আমলে হিন্দুস্থানিদের মধ্যে মূলত আফগানদের রাজকীয় প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু হুমায়ুনের সময়ে সংঘাতের কারণে বহু আফগানকে প্রশাসন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ভারতে নতুন করে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর মুঘল প্রশাসনে। দুই ধরনের হিন্দুস্থানি বা ভারতীয় মুসলিমদের নিয়োগ করা হয়েছিল। প্রথমত ছিল বারহা-র সৈয়দ মুসলমানরা। এরা সামরিক শৌর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল এবং মনে হয় সুলতানি আমলে আরব দেশ থেকে এরা ভারতে এসেছিল। তাদের বেপরোয়া সাহসিকতার জন্যই আকবর তাদের সামরিক বাহিনীর একেবারে সামনের সারিতে রাখতেন। তবে এরা কেউ পরে উচ্চপদ লাভ করতে পারেনি। এদেশীয় মুসলমানদের দ্বিতীয় যে সম্প্রদায়কে মুঘল আমলে প্রশাসনে যুক্ত করা হয়েছিল তারা হল শেখজাদা। ভারতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী শিক্ষিত শেখ পরিবারের সদস্য ছিল এরা। বৈরাম খাঁর খুব প্রিয় শেখ গাদাই ছিলেন এমনই একজন। একজন মোল্লা হয়েও বায়ুনি এই জাতের মুসলিমদের ভণ্ড ও নিছক সময়সেবক বলে কুৎসা করেছিলেন। এরা সকলেই প্রায় মাদাদমাশ বা নিষ্কর জমিতে বসবাস করতেন। এদের মধ্যে কয়েকজন। আবার জমিদারও ছিলেন। শেখজাদারা সমাজের খুব প্রভাবশালী একটা গোষ্ঠী ছিল এবং উজবেক অভিজাতদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে যাবার পরেই আকবর এদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যে বিশেষ উদ্যোগ নেন। তাঁর আবেদনে সাড়া দিলে তিনি এদের রাজকার্যে শামিল করে নেন।

হিন্দুস্থানিদের আর-একটা গোষ্ঠী ছিল কাম্বো। পাঞ্জাবের হিন্দু ও শেখদের মধ্যে একটা বিশেষ উপজাতিভুক্ত গোষ্ঠী ছিল এরা। কাম্বোদের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন শাহবাজ খান যিনি রানা প্রতাপ বা বাংলার বিরুদ্ধে অভিযানসহ মুঘলদের বহু সামরিক অভিযানে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। মির বকশির মতো তিনিও দাগ ব্যবস্থাকে খুব কড়া ভাবে প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি তাঁর অসীম ধার্মিকতা ও সম্পদের জন্য পরিচিত ছিলেন। জাহাঙ্গিরের সময় থেকে আফগানরাও মুঘল রাজকার্যে। যুক্ত হয়েছিল। মুঘলরা দাক্ষিণাত্যে তাদের প্রভাব বিস্তার করলে এদের অংশগ্রহণ আরও বেড়ে যায়। মারাঠাদেরও এ সময় থেকে প্রশাসনে নিয়োগ করা শুরু হয়েছিল। বলে জানা যায়।

এইভাবে নানা জাতির মানুষদের নিয়ে যে জটিল অভিজাততন্ত্র গড়ে উঠেছিল সেখানে তুরানি অভিজাতদের প্রভাব প্রতিপত্তি অনেকটাই কমে গিয়েছিল। আমরা আগেই দেখেছি কীভাবে উজবেক বিদ্রোহের পর মূলত পূর্ব ইরানের খুরাসান থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ইরানিদের মুঘল অভিজাততন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। প্রশাসনিক কাজকর্মে তুরানিদের তুলনায় ইরানিদের অনেক বেশি উপযোগী বলে মনে করা হত সে সময়।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে ১৫৭৫ সাল থেকে ১৫৯৫ সাল পর্যন্ত প্রশাসনে মোট ১৮৪ জন ৫০০ জাট বা তারও বেশি পদাধিকারী অভিজাত ছিলেন। যাদের মধ্যে ৬৪ জন (৩৪.৭৮শতাংশ) ছিলেন তুরানি, ৪৭ জন (২৫.৫৪) শতাংশ। ছিলেন ইরানি, ৩৪জন (১৮.৪৮শতাংশ) ছিলেন হিন্দুস্থানি এবং রাজপুত ও অন্যান্য হিন্দুরা ছিলেন ৩০ জন (১৬.৩০শতাংশ)। আর অবশিষ্ট ৯ জনের জাতি পরিচয় জানা যায় না।

আকবরের সময় থেকে প্রশাসনে জাতি ভিত্তি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। সে কারণেই সেনাবাহিনীতে একটা নিয়ম বানানো হয়েছিল যে অভিজাতদের সেনাদলে যেন অবশ্যই মুঘল, হিন্দুস্তানি ও রাজপুতদের নিয়ে মিলিত সৈন্য রাখা হয়। যদিও জরুরি পরিস্থিতিতে অনেক সময়েই মুঘল ও রাজপুত অভিজাতদের সেনাদলে শুধু মুঘল বা রাজপুত সৈন্যদেরই রাখা হয়েছিল।

এভাবে আকবরের নেতৃত্বে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে গড়ে উঠেছিল রাজকীয় ও অভিজাততন্ত্র ও সামরিক বাহিনী, যেখানে সংকীর্ণ জাতপাতের কোনো সুযোগ-সুবিধা ও পক্ষপাতিত্বের স্থান। ছিল না। এই পদক্ষেপের পশ্চাতে কোথাও যেন সেই নিজামুলমুলকের সিয়াসত নামা (দশম শতক)-র সময় থেকে চলে আসা একটা ধারণা কাজ করেছিল যেখানে বলা হয়েছিল যে কোনো অভিজাততন্ত্র ও সামরিক বাহিনী বিশেষ কোনো একটি জাতিগোষ্ঠীর লোকজনদের নিয়ে গঠিত হওয়া উচিত নয়, না হলে শাসকের সেই একটি গোষ্ঠীর ওপরেই নির্ভরশীল হয়ে পড়বার আশঙ্কা থাকে। আসলে সেই সময়ে শাসকশ্রেণিতে কেবলমাত্র মুসলিমরাই থাকত। আকবর এই ধারণাকে আরও বিকশিত করেছিলেন সেনাবাহিনী ও অভিজাততন্ত্রে হিন্দুদের, বিশেষ করে রাজপুতদের অন্তর্ভুক্ত করে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছিলেন।

বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের অংশগ্রহণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে যে অভিজাততন্ত্র গড়ে উঠেছিল এই সময়ে তা পরবর্তীকালে অবশ্যই একটি অখণ্ড শাসকশ্রেণি নির্মাণের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। কিন্তু এর জন্যে প্রয়োজন ছিল ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি অখণ্ড ও সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গির । পরবর্তী পর্বে আমাদের আলোচনা থেকে উঠে আসবে কীভাবে এই জাতিগত ভারসাম্য রেখে গড়ে ওঠা শাসকশ্রেণি কাঠামোর মধ্যে অখণ্ড ও সমন্বয়ী ভাবনা জাগরণের পথে নানা রকম বাধা বিপত্তি এসে ভর করেছিল।

আকবরের শাসনের অন্তিম পর্ব–বিদ্রোহ ও সাম্রাজ্যের পরবর্তী প্রসার

আমরা দেখলাম কীভাবে মুঘল সাম্রাজ্য ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল। এরপর সময় এল এই বিস্তারিত সাম্রাজ্যটাকে সুদৃঢ়করণের। যদিও ১৫৮০-র পর থেকে সাম্রাজ্যের পূর্বাংশে ক্রমাগত বিদ্রোহ এবং বাংলা ও বিহার, রাজস্থান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিবাদ চলেছিল, আর এর মধ্যেই সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটেছিল পূর্ব, পশ্চিম ও দাক্ষিণাত্যের দিকে। অবশেষে দেখা গিয়েছিল আকবরের প্রিয়পুত্র তথা তাঁর উত্তরসূরি সেলিমের বিদ্রোহ।

১৫৮০-র শুরুর দিকে বাংলায় নিযুক্ত অভিজাতরা বিদ্রোহ শুরু করেছিল। এই বিদ্রোহকে বাংলার অভিজাতদের দ্বারা ১৫৬৭-র উজবেক বিদ্রোহ দমনের পর মুঘল কর্তৃপক্ষের ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অভিসন্ধিকে প্রতিহত করবার শেষ মরিয়া একটা চেষ্টা বলা যেতে পারে। উজবেক বিদ্রোহ দমনের পর সব প্রদেশেই ১৫৭৪ সাল থেকে ঘোড়া ও অন্যান্য পশুদের চিহ্নিতকরণ (দাগ) প্রক্রিয়া চালু করা হয়। এবং প্রাদেশিক অভিজাতদের দায়িত্বে থাকা ঘোড়াগুলির গুণগত মান ও দাগ ব্যবস্থার নিয়মিত নিরীক্ষণ করা শুরু হয় যা অভিজাতদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার করে। বাংলায় আফগানদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ চলার কারণে সেখানে এই নিয়মগুলো এতদিন যথাযথভাবে বলবৎ করা যায়নি। কিন্তু বিদ্রোহ দমনের পর রাই পুরুষোত্তম ও মৌলানা তৈয়বকে এই নিয়মগুলো প্রচলনের জন্যে পাঠানো হয়। তারা বাংলার ও বিহারের অভিজাতদের কাছ থেকে আগেকার হিসাবপত্র দেখতে চেয়ে রীতিমতো কঠোর ও অপ্রীতিকর ব্যবহার শুরু করেছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মির্জা হাকিমের কয়েকজন অনুচর কর্তৃক মুঘলদের বিরুদ্ধে বাংলার অভিজাতদের প্ররোচিত করার ষড়যন্ত্র। বেশ কয়েকজন মোল্লাও এ সময় তাদের জন্য বরাদ্দ নিষ্কর জমি অপসারণ বা পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার আশঙ্কায় অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। যেমন জৌনপুরের এক কাজি ফতোয়া জারি করে বলেছিলেন তাঁরা ‘পথে নামতে ও সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য হচ্ছেন’ কারণ ‘সম্রাট তাদের ও ঈশ্বরের জন্য দান করা জমির ওপর বলপূর্বক হস্তক্ষেপ করেছেন।’

বাংলা ও বিহারের অভিজাতদের ক্ষোভের বাঁধ অবশেষে ভেঙে গেল যখন তাদের প্রদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের তরফ থেকে প্রদেয় অনুদানের (ভাট্টা) পরিমাণ অর্ধেক বা তারও কম করে দেওয়া হল। বাংলা ও বিহার উভয় অঞ্চলেই প্রবল বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল এরপর থেকেই এবং সেখানে মির্জা মহম্মদ হাকিমের নামে খুৎবা পাঠ করেছিলেন বিদ্রোহীরা।

বিদ্রোহীদের দমন করার জন্যে আকবর বেশ কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। মির্জা মহম্মদ হাকিম যখন পাঞ্জাব আক্রমণে ব্যস্ত তখন মির্জা আজিজ কোকা ও টোডর মলের নেতৃত্বে বাংলা ও বিহারের বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এমনকি মির্জা হাকিম নিজে এসেও বিদ্রোহীদের বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারেননি। আকবরকে আসতেই হয়নি এখানে, তিনি বিশাল বাহিনী নিয়ে আগ্রাতেই থেকে গিয়েছিলেন, কিন্তু মাদকাসক্ত ও দুর্বল মির্জা হাকিম যিনি একাধিকবার কাবুল দখল করেও হেরে গিয়েছিলেন তার কোনো ক্ষমতাই ছিল না আকবর বা তাঁর দলবলের সামনে কোনো যুদ্ধে টক্কর দেবার। সেই কারণে মির্জা হাকিম তড়িঘড়ি লাহোর পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকেও মুঘল বাহিনীর আক্রমণে বিতাড়িত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুঘলদের আতঙ্ক তার মনে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে পূর্বাংশের বিদ্রোহ শেষ না হলেও তিনি আর এদিকে আসার কোনো পরিকল্পনা করেননি।

উত্তর-পশ্চিম দিকে মুঘল সাম্রাজ্যের পরবর্তী বিস্তার শুরু হয়েছিল ১৫৮৪ সালে যখন আবদুল্লাহ উজবেক তৈমুরীয় শাসকদের হাত থেকে বাদাখশান অঞ্চল কেড়ে নিয়ে দ্রুত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন। কাবুলে উজবেক আক্রমণের আশঙ্কা করে মির্জা হাকিম এবং বাদাখশান থেকে বিতাড়িত তৈমুরীয় শাসক মির্জা সুলেমান আকবরের সাহায্য প্রার্থনা করেন। আকবর কিছু করার আগেই অত্যধিক মদ্যপান করার কারণে মির্জা হাকিম মারা যান (১৫৮৫)। আকবর সীমান্তবর্তী অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মান সিংহকে কাবুল অভিযান করে দখল করার আদেশ দেন। এই অভিযান তদারকি করতে তিনি স্বয়ং সিন্ধু অঞ্চলে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং আটোক অঞ্চলে ঘাঁটি নির্মাণ করে বেশ কয়েকদিন সেখানে অবস্থানও করেছিলেন। এই সময় তিনি মান সিংহকে কাবুলের শাসক মনোনীত করেছিলেন। একই সঙ্গে এই সময় আকবর বিদ্রোহী আফগান জনজাতির মানুষদের হাত থেকে খাইবার গিরিপথকে মুক্ত করার জন্যেও বেশ কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সেই দুর্গম এলাকায় মুঘলদের একাধিক অভিযান সংগঠিত হয়েছিল বলে জানা যায়। এর মধ্যে একটি অভিযানে আকবরের অন্যতম প্রিয়পাত্র বীরবল বোকার মতো পাহাড়ি এলাকার দুর্গম অঞ্চলে প্রবেশ করার ফলে বিদ্রোহীদের হাতে পড়ে বেঘোরে প্রাণ দিয়েছিলেন। এই ঘটনায় প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলেন আকবর, আর তার পরেই তিনি বিদ্রোহী আফগানদের শেষ করে দেবার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। কিন্তু শেষমেশ ওই অঞ্চল থেকে আফগান বিদ্রোহীদের উৎখাত করা গেলেও প্রক্রিয়াটা খুবই কষ্টসাধ্য ও মন্থর ছিল।

১৫৮৬ সালে আকবর ঠিক করেন কাশ্মীর জয় করবেন। কারণ সেখানকার স্থানীয় রাজা ইয়াকুব খান আকবরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেও ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে আনুগত্য প্রদর্শনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কাশ্মীরে প্রাথমিক ভাবে আক্রমণের ভার দেওয়া হয়েছিল রাজা ভগবন্ত দাসের ওপর, কিন্তু তিনি অধৈর্য হয়ে চলে গেলে সেই কাজ সম্পূর্ণ করেন কাশিম খান (১৫৮৭)। কাশ্মীর দখল করার পর জম্মু এমনকি বালিস্তান ও লাদাখের বহু পাহাড়ি রাজাও (এরা পরিচিত ছিল তিব্বতি খুদ বা ছোটো রাজা আর তিব্বতি বুজর্গ বা বড়ো রাজা নামে) মুঘলদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এরপর ১৫৮৯ সালে আকবর প্রথম কাশ্মীর ভ্রমণ করেন।

এর কিছুদিনের মধ্যেই ১৫৯০ সালে আকবর নিম্ন সিন্ধু অঞ্চল দখল করার জন্য সেনা প্রেরণ করেছিলেন। রাজধানী ভাক্কার সহ সমগ্র উচ্চ সিন্ধু অঞ্চল ইতিমধ্যেই মুঘলদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। নিম্ন সিন্ধু অঞ্চল জয় করা প্রয়োজন ছিল কারণ এর ফলে কান্দাহার থেকে মুলতান ও সিন্ধু নদীর নিম্ন এলাকা থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বাণিজ্য পথ ব্যবহার করার সুবিধা হয়েছিল। এছাড়া এ সময় উত্তর ভারতে বালুচিস্তানের মতো কিছু রাজ্য যেখানে মুঘল কর্তৃত্ব তখনও বলবৎ হয়নি, তারা হম্বিতম্বি শুরু করেছিল যা অচিরে ঠান্ডা করে দেওয়া হয়। শেষ কাজ ছিল কান্দাহার জয় করা আর সে কাজ শেষ হতেই মুঘল সাম্রাজ্যের সীমান্ত বৈজ্ঞানিকভাবে অনেক বেশি নিরাপদ। হয়ে গিয়েছিল।

পশ্চিমে কাথিয়াবাড় অঞ্চল অধিকার করেছিল মুঘলরা। মান সিংহকে কাবুল থেকে বিহারে স্থানান্তরিত করা হয় ১৫৮৭ সালে। তিনি সেখানে গিয়ে বেশ অগ্রণী নীতি গ্রহণ করে প্রথমে উড়িষ্যা এবং পরে আফগানদের কাছ থেকে পূর্ববঙ্গের ঢাকা অঞ্চল দখল করেছিলেন। কোচবিহারকেও বাধ্য করা হয়েছিল মুঘল আধিপত্য স্বীকার করে নিতে।

উত্তর ভারতে মুঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর আকবর নজর দিয়েছিলেন দাক্ষিণাত্যের দিকে। যেহেতু আমরা পৃথক অধ্যায়ে মুঘলদের সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব সেহেতু এখন এই প্রসঙ্গ তোলা থাক।

আকবরের শাসনের শেষ বছরে ঘনিয়ে এসেছিল তার নিজ পুত্র তথা মুঘল সিংহাসনের মনোনীত উত্তরসূরি সেলিমের বিদ্রোহের কালো মেঘ। যদিও আকবর সে সময়েও পারতেন এই বিদ্রোহ দমন করতে কিন্তু এই ঘটনা আরও একবার মুঘল, সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার সমস্যাকে প্রকাশ্যে এনে দিয়েছিল।

১. মধ্যযুগের ভারতে সমস্ত ব্যবসায়ীদেরই বলা হত ‘বাক্কাল’। জাতিগত ভাবে হেমু ছিলেন ধূসর বা ভারগভ জাতের। যদিও তিনি নিজেকে গৌর ব্রাহ্মণ হিসাবে দাবি করতেন।

২. নিজে একজন বণিক হয়েও বদায়ুনি শেষ রদাই এর সম্পর্কে বলেছেন এরা আসলে ছিল ভারতে পুরনো শেখ জাতির লোক, যারা মূলত ছিল কন্তু “সর্বদাই কৃষক স্বভাবের দাশ ভাবাপন্ন ও হীন মনস্ক। এদের প্রভাব প্রতিপত্তি কখনোই তরবারির ঝংকারে আন্দোলিত হত না, তবে এরা ধর্মীয় বুজরতার ধোকাবাজি ও কপটতা দিয়ে অন্যদের তোষামদ করত এবং নিজেদের সার্থের চোরাপথে এরা সমাজে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করত।”

৩. তিনি ছিলেন জামাল খান মেওরাটির পুত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *