০২. উত্তর ভারতে সাম্রাজ্যের লড়াই : আফগান, রাজপুত ও মুঘল

দ্বিতীয় অধ্যায় – উত্তর ভারতে সাম্রাজ্যের লড়াই : আফগান, রাজপুত ও মুঘল

১৫১৭ থেকে ১৫১৯ সালের মধ্যে এমন দুটি পারস্পরিক সম্পর্কহীন ঘটনা ঘটেছিল যা ভারতের ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। প্রথমটা ছিল ১৫১৭ সালের শেষ দিকে আগ্রায় আফগান শাসক সিকান্দার লোদির মৃত্যু এবং উত্তরসূরি ইব্রাহিম লোদির অভিষেক। আর দ্বিতীয়টা ছিল ১৫১৯ সালের শুরুর দিকে বাবরের উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাবের সীমান্তবর্তী এলাকা বাজাউর ও ভিরা অধিকার। সিকান্দার লোদির মৃত্যুর পর আফগান অভিজাত গোষ্ঠী যাদের তখনও বেশ ঘনিষ্ঠ উপজাতি যোগ ছিল, তাদের কাছে একটা সুবর্ণ সুযোগ এসে গিয়েছিল এতদিনকার লোদিদের কড়া শাসনের ফলে হারিয়ে ফেলা ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তিকে আবার ফিরে পাওয়ার। অভিজাতরা সেজন্যে প্রথমে প্রস্তাবও দিয়েছিল যে, সিকান্দার লোদির রেখে যাওয়া সাম্রাজ্য দুই ভাগ করে এক ভাগ তার জ্যেষ্ঠ সন্তান ইব্রাহিম লোদিকে ও অন্যভাগ অর্থাৎ সাম্রাজ্যের পূর্বাংশে, যা আগে জৌনপুরের শারকি (Sharqi) বংশের অধিকারে ছিল, তার দায়িত্ব ইব্রাহিম লোদির কনিষ্ঠ ভ্রাতা জালালকে দেওয়া হোক। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইব্রাহিম লোদি এই সাম্রাজ্য বিভাজনের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি সিংহাসনে আরোহণ করার আগে পর্যন্ত ভুলেও এই বিভাজন কার্যকর হতে দেননি। ইতিমধ্যে জালালকে আটক করে মেরে ফেলা হয়। এই ঘটনা নতুন সুলতান ও আগেকার অভিজাতদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করে। কিন্তু নতুন সুলতান ইব্রাহিম লোদি তাদের কাউকেই রেহাই দেননি যাদেরকে তার সন্দেহজনক ও ভবিষ্যতের পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে হয়েছিল। এরকম অবস্থায় উত্তরপ্রদেশের পূর্বদিক ও বিহারে একাধিক বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল সুলতানের বিরুদ্ধে, আর সে বিদ্রোহে যে কেবল লোদি-মসনদে অন্য দাবিদাররা যোগ দিয়েছিলেন তাই নয়, স্বয়ং এক অভিজাত, বিহারের সুলতানি প্রাদেশিক শাসক দরিয়া খান নুহানি নিজেকে। রীতিমতো রাজা বলে ঘোষণাও করে দিয়েছিলেন। লোদি শিবিরের আর-একটা বিদ্রোহী গোষ্ঠী রানা সঙ্গ-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। এই রানা সঙ্গ পূর্ব মালবে নিজের প্রতিপত্তি তৈরি করেছিলেন এবং অবশিষ্ট মালব ও পূর্ব রাজস্থানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে লোদির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন। লোদি ও রানা সঙ্গ-র মধ্যে সংগঠিত খাটোলির যুদ্ধে প্রথম সারির বেশ কয়েকজন আফগান সর্দার রানার পক্ষ নিয়েছিলেন। মসনদের আর-এক দাবিদার, বাহোেল লোদির সন্তান আলম খানকে ইন্ধন জোগাতে শুরু করেছিলেন গুজরাতের শাসক। কিছু আফগান অভিজাতগণ তো তাকে আলাউদ্দিন উপাধি দান করে রাজা হিসেবেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন।

ইব্রাহিম লোদি ছিলেন একজন তরতাজা যুবক। যদিও পুরোনো সুপ্রতিষ্ঠিত অগ্রজ অভিজাতদের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক রাখতে হয়ে সে ব্যাপারে খুব একটা কাণ্ডজ্ঞান না থাকলেও তিনি কিন্তু আফগান অভিজাতদের বাগে আনতে পেরেছিলেন এবং শাসকের অধীনে একজন কর্মচারী হয়ে থাকার বদলে সাম্রাজ্যের ছোটোখাটো নিয়ন্ত্রক হয়ে পড়ার যে প্রবণতা আফগান অভিজাত গোষ্ঠীর বড়ো নেতাদের মধ্যে বড় বেশি দেখা দিচ্ছিল, তা রোধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই ছবি পলকেই বদলে গেল বাবরের এখানে আবির্ভাবের ফলে। আমরা আগেই জেনেছি, বাবর ১৫১৯ সালে বাজাউর ও ঝিলাম নদীর তীরবর্তী ভিরার দুর্গ দখল করে এই দাবি তুলেছিলেন যে একদা তৈমুরের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলোর ওপর একচেটিয়া শাসনের অধিকার কেবল তারই রয়েছে এবং সেসব অঞ্চল যাতে অবিলম্বে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় সেই মর্মে বাবর দূত-ও প্রেরণ করেছিলেন ইব্রাহিম লোদির কাছে। সে সময় লাহোরের প্রাদেশিক শাসক ছিলেন দৌলত খান লোদি, যিনি ছিলেন এমন একজন অভিজ্ঞ অভিজাত, যার পিতা বাহনলাল লোদিকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন এবং যার পরিবার দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে পাঞ্জাবে প্রতিপত্তি কায়েম করে রেখেছিল। এহেন পোড় খাওয়া দৌলত খান বারের এই দূত-বার্তাকে প্রবল অবজ্ঞা ভরে শুধু যে প্রত্যাখান করেছিলেন তাই য়, সেই দূতকে কোনোভাবে ইব্রাহিম লোদির দরবারের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেননি। বাবর যখন কাবুল ফিরে যাচ্ছিলেন, তখনই তিনি বাবরের দূতকে আটকে দেন লাহোরে, সেই সঙ্গে তিনি ভিরা অঞ্চল থেকে বাবরের আধিকারিককেও উৎখাত করে ছাড়েন।

১৫১৯-২০ সাল নাগাদ বাবর পুনরায় ভিরা দখল করে নেন ও ভারতে প্রবেশের অন্যতম দ্বার হিসেবে পরিগণিত হওয়া শিয়ালকোট পর্যন্ত পৌঁছে যান। এই অবস্থায় বাবর আরও অগ্রসর হবার পূর্বেই তার এলাকায় কান্দাহারের শাসক আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছেন এমন সংবাদ পেয়ে তড়িঘড়ি তিনি কাবুল প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু শিয়ালকোট পর্যন্ত বাবরের অগ্রসর হওয়ার ঘটনা একটা জিনিস পরিষ্কারভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে বাবর এবার ভীষণভাবে চাইছেন তাঁর সাম্রাজ্যকে সমগ্র পাঞ্জাব পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে। আর এরপরেই শুরু হয় কূটনীতির খেলা। ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে বকেয়া হিসেব মেটানোর জন্য এবং নিছকই একজন যুবক সুলতানের তাঁর মতো একজন অগ্রজ অভিজাতের বিরুদ্ধে নেওয়া কিছু পদক্ষেপ মোটেই পছন্দ না হওয়ার– কারণে, একসময় বাবরের দাবিকে নস্যাৎ করে দেওয়া সেই দৌলত খান এবার স্বয়ং নিজের পুত্র দিলাওয়ার খানকে কাবুলে বাবরের কাছে ১৫২১-২২ সালে প্রেরণ করেন। ইব্রাহিম লোদিকে একজন স্বেচ্ছাচারী হিসাবে বর্ণনা করে এবং সিকান্দারের অভিজাতদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা ও বিনা কারণে তাদের মধ্যে পঁচিশ জনকে হত্যা করার অভিযোগে দৌলত খানের পুত্র বাবরকে ভারত আক্রমণ করার জন্যে স্পষ্টভাবে আমন্ত্রণ জানান। তিনি বাবরকে আশ্বস্ত করে বলেন যে, অভিজাত গোষ্ঠীর অনেকেই আশা ও ভরসা নিয়ে তাকে বাবরের কাছে পাঠিয়েছেন এবং তারা বাবরকে মান্য করে চলতে প্রস্তুত হয়েই সন্তর্পণে তার আগমনের প্রহর গুনছেন। ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে এককভাবে খুব একটা এঁটে উঠতে না পেরে আলম খান লোদিও কাবুল যাত্রা করলেন। এটাও মনে করা হয় যে, এই সময় রানা সঙ্গ-র তরফ থেকেও দূত মারফত একপ্রকার পাশে থাকার বার্তা বাবর পেয়েছিলেন, কারণ বাবর নিজে জানিয়েছিলেন যে সে বার্তায় তার দিল্লি আক্রমণের সময় রানা সঙ্গ আগ্রা আক্রমণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ভারত আক্রমণের জন্যে কোনোরকম আমন্ত্রণ যদি না-ও আসত, এই ধরনের বার্তাই বাবরকে এটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিল যে ভারত আক্রমণের যথার্থ পরিস্থিতি এবার তৈরি হয়ে গিয়েছে।

ভারত আক্রমণের জন্যে বাবরকে যারা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ও আমন্ত্রণ জানানোর পশ্চাতে ক্রিয়াশীল কারণগুলো সবই দাঁড়িয়েছিল একরাশ অনুমানের ওপর। তারা আশা করেছিলেন তৈমুরের মতোই বাবরও দিল্লি জয় করে সেখানে একজন অনুগত ও দুর্বল শাসক রেখে চলে যাবেন, আর তারা যেভাবে নিজ নিজ এলাকায় শাসন করছিলেন সেভাবেই শাসন করবেন এবং সুযোগ বুঝে অভীষ্ট অঞ্চলগুলো যে যার মতো করে হাতিয়ে নেবেন। দৌলত খান লোদির পরিকল্পনা ছিল পাঞ্জাবে নিজ শাসন অব্যাহত রেখে বাবরকে সেইসব অঞ্চলের অধিকারই কেবলমাত্র ছেড়ে দেবেন যেগুলো বাবর নিজের বলে দাবি করেছিলেন। যদিও ঘটনাক্রম প্রমাণ দিয়েছে যে দৌলত খান লোদির এক্ষেত্রে চরম বাস্তববোধের অভাব ছিল। বাবর তাঁর দাবি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার মাত্রা তার ওই অঞ্চলে অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়েই চলেছিলেন। তিনি আর কেবল পাঞ্জাবের একটা অংশের দখল নিয়ে ক্ষান্ত থাকতে চাইলেন না, তাঁর দাবি এবার সমগ্র পাঞ্জাব। এইভাবে ইব্রাহিম লোদিকে হটানোর পরেই পাঞ্জাবকে ঘিরে ও পরে পাঞ্জাব ছাড়িয়ে সমগ্র উত্তর ভারতে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে ঘোরতর সংঘাতের পরিবেশ ঘনিয়ে উঠেছিল।

দৌলত খান লোদি, যিনি বাবরকে আক্রমণের জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তিনি এই পরিস্থিতির মধ্যে কোনো যুক্তিই খুঁজে পেলেন না। তিনি এটাও অনুধাবন করতে পারলেন না যে এই সংঘাতের মাঝে তিনি কেবলই একজন বলির পাঁঠায় পরিণত হয়েছেন। তার দুই পুত্র এটা বুঝেছিলেন এবং যে যার অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। দিলওয়ার খান বাবরের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ও গাজি খান বাবরের বিরোধিতা করেছিলেন। দৌলত খান বাবরকে সমর্থন করবেন না বিরোধিতা করবেন, সেই দোদুল্যমানতায় দুলতে দুলতে অবশেষে জীবনটাই ত্যাগ করলেন।

ইব্রাহিম লোদি ও বাবরের মধ্যে সংঘাত-–পানিপথের যুদ্ধ

ইব্রাহিম লোদি ও বাবরের মধ্যে সংগঠিত পানিপথের যুদ্ধ (২০ এপ্রিল, ১৫২৬) কিন্তু উভয় পক্ষের মধ্যে ঘটা কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না, বরং ছিল উভয় শক্তির মধ্যে অনেক আগে থেকেই শুরু হওয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক চরম বহিঃপ্রকাশ। কাবুলের কিছু আফগান অভিজাতের ষড়যন্ত্রের খবর পেয়ে ইব্রাহিম লোদি বাহার খানের নেতৃত্বে এক বিশাল সামরিক বাহিনীকে পাঞ্জাবে প্রেরণ করলেন দৌলত খান ও তার পুত্রদের শায়েস্তা করা এবং বৈদেশিক সকল প্রকার অনুপ্রবেশ বানচাল করার আদেশ দিয়ে। সামরিক বাহিনী দৌলত খান লোদিকে লাহোর থেকে বিতাড়িত করে এলাকাটির দখল নেয়। যদিও বাহিনী সেখানে নিজেদের অবস্থান শক্তপোক্ত করে উঠবার আগেই বাবর আবার ভারতে প্রবেশ করেন এবং ১৫২৪-এর গোড়ার দিকে তিনি লাহোরের কাছে। এসে হাজির হন। লোদি বাহিনী লাহোের শহর থেকে বেরিয়ে এসে বাবরের বাহিনীকে আটকানোর চেষ্টা করে ঠিকই, কিন্তু বাবরের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাদের অবশেষে। সরেই যেতে হয়। প্রতিশোধের আগুন নেভাতে গিয়ে বাবার শহরটাকেই দু’দিন ধরে আগুনে পুড়িয়ে দেন আর তারপর সেনা অভিযান চালান দিপালপুরে, যেখানে তিনি আলম খান ও দৌলত খান লোদিকে পাশে পেয়ে যান। তবে বাবর কিন্তু দৌলত খানের লাহোর ফেরত নেওয়ার আবদার কোনোভাবেই আর রাখলেন না, বরং শিয়ালকোট, লাহোর ও কালানৌর-এ নিজের মনোনীত শাসককেই দায়িত্ব দিয়ে কাবুল ফিরে যান। দিপালপুরের দায়িত্ব পান আলম খান। কিন্তু আলম খানকে অচিরেই সেখান থেকে উৎখাত করেন ইব্রাহিম লোদি। এরপর আলম খান কাবুল-এ গিয়ে বাবরের কাছ থেকে পূর্বের প্রতিশ্রুতি মতে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। আসলে আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল যে, ইব্রাহিম লোদিকে অপসারণ করে আলম খান বসবেন দিল্লির মসনদে, আর বাবর পূর্ণ শক্তি নিয়ে লাহোর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিমের সমস্ত এলাকায় শাসন কায়েম করবেন।

এইভাবে বাবর কৌশলে আফগান সুযোগসন্ধানী অভিজাতদের নিজের কাজে লাগাতে শুরু করলেন। তাঁরই আনুকূল্যে আলম খান বিশাল সেনা সহযোগে বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন, লাহোরে তাকে সহায়তা করার জন্যে মুঘল বেগদের বিশেষ রাজকীয় আদেশও দেওয়া হল। বাবর তার প্রতিশ্রুতি রাখতে চাইলেও আলম খান লাহোরে এসে দেখলেন সেখানকার বেগরা তাকে সমর্থন করতে বেশ ইতস্তত করছে। দৌলত খান লোদি এবার আলম খানকে কাছে টানার চেষ্টা চালালেন। সেই চেষ্টাকে সফল করে আলম খান বাবরের সঙ্গে সমঝোতা ভেঙে দৌলত খানের সঙ্গে হাত মেলালেন। উভয়ে মিলে ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ সেনা জোগাড় করে দিল্লি আক্রমণের ডাক দিলেন। কিন্তু ইব্রাহিম লোদির তৎপরতায় সে আক্রমণ বিনষ্ট হয়ে যায়। লোদি সঙ্গে সঙ্গে লাহোর দখলের চেষ্টায় সেখানে সেনা প্রেরণ করলেও সে চেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি।

এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে, এবার ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে বাবরের সম্মুখ সমরের। সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। কোনোমতেই ইব্রাহিম লোদি বাবরকে পাঞ্জাব অঞ্চল ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না, কারণ তা করলে আগের ঘুরিদের মতো বাবরও পাঞ্জাব থেকে ভবিষ্যতে গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে আক্রমণ শানানোর একটা রাস্তা প্রস্তুত করে নিতে পারবেন বলে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন। বাবর ইব্রাহিম লোদির শুক্রশিবিরের অন্যতম নেতা আলম খানের সঙ্গেও সমঝোতা করে ইতিমধ্যেই একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, যদিও সেই সমঝোতা থেকে সাফল্য পাওয়ার জায়গাটা বাবরের কাছে বেশ নড়বড়ে ছিল। যদি আলম খানকে সঙ্গে নিয়ে দৌলত খান লোদির ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে এই শেষের অভিযানটা সফল হত, তাহলে বাবরের কাজ এখানে বেশ কঠিন হয়ে পড়তেই পারত। দিল্লি আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে বাবর উজবেকদের কাছ থেকে বালখ (Balkh) অঞ্চল ছিনিয়ে নিয়ে আফগানিস্তানে নিজের মাটি শক্ত করলেন। তিনি কান্দাহারও দখল করলেন। এইভাবে নিজের চারপাশের সুদৃঢ় অবস্থা সুনিশ্চিত করে বাবর ১৫২৫ সালের নভেম্বরে কাবুল থেকে হিন্দুস্তান জয় করার উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করলেন। হুমায়ুনের বাদাখশান থেকে ফিরতে সামান্য বিলম্ব হওয়ায়, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে তারা সিন্ধু নদী অতিক্রম করে ভারতের দিকে এসেছিলেন বলে জানা যায়। বাবরের মতে, সে সময় তাঁর বাহিনীর শক্তিটা নিহিত ছিল বিশাল আবার সীমিত, ভালো আবার মন্দ, ভাড়া করা আবার ভাড়া করা নয়’এমন মোট ১২, ০০০ জন সেনার মধ্যেই। সেই সেনাদের নিয়ে বাবর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অধিকৃত শিয়ালকোট অতিক্রম করে লাহোরে পৌঁছেলে, সেখানেই প্রথম তাঁকে দৌলত খান লোদি ও তাঁর পুত্র গাজি খানের অবরোধের সম্মুখীন হতে হয়। দুই হাতে দুই তরবারি। নিয়ে দৌলত খান যেন দুই প্রান্তের দুই শত্রু বাবর ও ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে যুদ্ধ করতে ময়দানে নেমেছিলেন। তার পক্ষে ছিল ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০-এর মতো সেনা। তবুও সে সেনা বাবরের বাহিনীর কাছে টিকতেই পারেনি। গাজি খান পাহাড়ের কোলে পালিয়ে বাঁচলেও দৌলত খান বাবরের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। তাকে অবশেষে আটক করে ভিরাতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পথেই তার মৃত্যু ঘটে। এইভাবে দৌলত খানকে সংহার করে বাবরের সামনে পাঞ্জাব প্রবেশ করবার সমস্ত পথ উন্মুক্ত হয়ে গেল।

সিন্ধু অতিক্রমের মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই পাঞ্জাব জয় করে বাবর সন্তর্পণে দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হতে শুরু করলেন। সবদিকে অনুচর প্রেরণ করলেন ইব্রাহিম লোদির সবরকম গতিবিধির হদিস জানার জন্যে। ইব্রাহিম লোদিও বাবরকে পাঞ্জাবে আর না ঘাঁটিয়ে অপেক্ষা করছিলেন বাবরের পরবর্তী পদক্ষেপের। বাবরের বিরুদ্ধে অল্পসংখ্যক সেনাবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করতে আসা হিসার-ফিরৌজা(Hisar-firuja)-র সিকদার হামিদ খানের সঙ্গে প্রথম সংঘাতটা লাগে হুমায়ুনের। তিনি হামিদ খানকে পরাস্ত করে একশোর-র বেশি যুদ্ধবন্দি ও পাঁচ থেকে সাতখানা হস্তী সঙ্গে নিয়ে বীরের মতো ফিরে আসেন। এইসব বন্দিকেই নিমর্মভাবে হত্যা করার আদেশ দিয়ে বাবর লোদি শিবিরে স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেও অচিরেই তিনি বুঝতে পারেন ইব্রাহিম লোদি ধীরে চলার নীতি নিয়ে দুই থেকে চার মাইল এগিয়ে সেনাশিবির গড়ে সেখানে দু-তিন দিন ধরে সময় কাটাচ্ছেন।

তবে সবশেষে দুই পক্ষই একে অপরের মুখোমুখি হয় পানিপথের প্রান্তরে। ইব্রাহিম লোদির তুলনায় অনেক দুর্বল সেনাশক্তি থাকায় এবং সহজেই যাতে তাকে। ইব্রাহিম লোদির বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে না হয়, এই পরিকল্পনা করেই বাবর খুব সতর্কভাবে এই যুদ্ধক্ষেত্র নির্বাচন করেছিলেন। তিনি তার ডানদিকে পানিপথ শহর ঘেঁষে সেনা মোতায়েন করে বামদিকে কাটা গাছপালা দিয়ে পরিখা গড়ে তুলেছিলেন, যাতে বিপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনী তা অতিক্রম করতে না পারে। সামনে তিনি রেখেছিলেন মোট ৭০০টি প্রশিক্ষিত ও স্থানীয় এলাকার জোগাড় করা ঘোড়ার যুদ্ধ-গাড়ি। এই ঘোড়ার গাড়িগুলো একে অপরের সঙ্গে চামড়ার দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকত এবং দুই সারির গাড়ির মাঝে মাটির কৃত্রিম বাঁধ তৈরি করা ছিল যেখানে দাঁড়িয়ে গোলন্দাজ বাহিনী গোলা ছুঁড়তে পারত। বাবর এই দড়ি বাঁধা ঘোড়ার গাড়ির যুদ্ধ পদ্ধতিকে বলতেন অটোমান (রুমি) হাতিয়ার। কারণ কামানে গোলাবর্ষণের সঙ্গে এই পদ্ধতিতে সেনা মোতায়েন করে অটোমান সুলতান ইরানের শাহ ইসমাইলের বিরুদ্ধে ১৫১৪ সালের বিখ্যাত চালদিরনের (Chaldiran) যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু বাবর এই পদ্ধতিতে নতুন একটি বিষয় যোগ করেছিলেন, সেটা হল ঘোড়ার যুদ্ধ-গাড়ির সারির মাঝে এমন একটা ফাঁক তৈরি করা যেখানে পঞ্চাশ বা একশোটা ঘোড়া পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অনায়াসে আক্রমণ শানাতে পারত।

এটা ছিল রীতিমতো শক্তিশালী একটি রক্ষণাত্মক ও একই সঙ্গে আক্রমণাত্মক ব্যবস্থাপনা। বাবরের এক বেগ যথার্থই বলেছিলেন, এরকম একটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার পর কীভাবে আর তার (ইব্রাহিম) পক্ষে যুদ্ধ করতে আসা সম্ভব হবে? বাবরের এক্ষেত্রে অভিমত ছিল, ইব্রাহিমকে উজবেক খান বা সুলতানদের মতো ভাবলে ভুল করা হবে, কারণ তার এই পরিকল্পিত যুদ্ধপদ্ধতি ও সেনা মোতায়েনের কারসাজি সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। আসলে বাবর কোনোভাবেই ইব্রাহিম লোদিকে একজন রণকৌশল নির্মাণে দক্ষ বলে মনে করেননি। বাবর বলেছেন, তিনি একজন অপ্রমাণিত (অর্থাৎ অনভিজ্ঞ) সাহসিক, তার সামরিক অভিযানগুলোতে তিনি কিছুই করে দেখাতে পারেননি, কীভাবে যুদ্ধে অবস্থান নিতে হয়, কীভাবে এগোতে হয়, কেমন ভাবে লড়তে হয়, কিছুই পরিপূর্ণভাবে করতে পারেননি তিনি।

এই যুদ্ধটা আসলে শেষ হয়েছিল সংখ্যার ওপর সামরিক নৈপুণ্যের জয় দিয়ে। বাবরের ১২,০০০-এর সামরিক বাহিনী হয়তো পরে অনেকটাই সমৃদ্ধ হয়েছিল বহুসংখ্যক আফগান ও হিন্দুস্তানির যোগদানের ফলে, নাহলে ইব্রাহিমের বাহিনীর সামনে বাবরের ১০০,০০০ সেনা ও ১০০০ হাতি জমা হতে পারত না। তাছাড়া বাবরের বাহিনীতে নিশ্চিতভাবেই একটা বড়ো সংখ্যায় সাধারণ ভৃত্য ও অন্যান্য অসামরিক মানুষজনকেও শামিল করানো হয়েছিল যারা কোনো-না-কোনো ভাবে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। আফগান সূত্র অনুযায়ী, পানিপথে ইব্রাহিম লোদির প্রভাবশালী সামরিক শক্তি ছিল মোটে ৫০,০০০ জন সৈনিক, যদিও তা বাবরের তুলনায় সংখ্যায় বেশিই ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ইব্রাহিম লোদি বাবরের রক্ষণাত্মক সামরিক ব্যবস্থাপনা বুঝতে পারেননি, এমনকি টানা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দুই পক্ষের সেনা পরস্পরের সম্মুখীন হয়ে যুদ্ধ করলেও তিনি বাবরের কৌশল অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শেষমেশ যখন চূড়ান্ত দিনে ইব্রাহিম লোদি স্বয়ং বাবরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন, তিনি দেখলেন যে বাবরের বাহিনীর সম্মুখ ভাগ অত্যন্ত সংকীর্ণ। তিনি প্রাথমিকভাবে ইতস্তত করলেন কিন্তু পরে যখন সকল আড়ষ্টতা কাটিয়ে বাবরের সংকীর্ণ সেনা সম্মুখভাগ ভেদ করে প্রবেশের চেষ্টা করলেন, তখনই তিনি বাবরের জালে ধরা দিলেন। বাবর তার দু’প্রান্তের সেনাদলকে (তুলঘুমা) উজবেকি কায়দায় চক্রাকারে ঘুরিয়ে দিয়ে ইব্রাহিমের বাহিনীকে দুদিক ও পিছন থেকে ঘিরে ধরলেন, আর সামনের দিক থেকে বাবরের অশ্বারোহী বাহিনীর ক্রমাগত তির বর্ষণ ও গোলন্দাজ বাহিনীর অতর্কিত মৃত্যুগোলার আঘাতে ইব্রাহিমের আফগান বাহিনী হতচকিত হয়ে গেল। বাবর পূর্বেই দু’জন অটোমান গোলন্দাজ-উস্তাদ আলি ও মুস্তফাঁকে ভাড়া করেছিলেন এবং উস্তাদ আলিকে তার যুদ্ধাস্ত্র বিভাগের প্রধান পদে নিয়োগও করেছিলেন। বাবর বলেছেন যে, এ-যুদ্ধে উস্তাদ আলি ও মুস্তাফা কেন্দ্রে। থেকে বেশ ভালো মতোই স্থল-কামানের গোলা ছুঁড়েছিলেন। যদিও সে সময়, দ্রুততার সঙ্গে স্থল-কামানের গোলা নিক্ষেপ করা ছিল খুব কষ্টসাধ্য একটা কাজ। তবে বাবর ছিলেন মূলত একজন অশ্বারোহী যোদ্ধা, এবং পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। প্রধানত অশ্বারোহী ও ধনুর্ধর বাহিনীর জোরেই। সব দিক থেকে আটকে পড়েও, ইব্রাহিম লোদি মাত্র ৫০০০-৬০০০ সেনা নিয়ে সাহসের সঙ্গে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। বাবর ইব্রাহিম লোদির। সাহসিক এই অন্তিম লড়াইকে সম্মান জানিয়ে ওই স্থানেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন। করেছিলেন। বলা হয় এই যুদ্ধে নাকি ১৫,০০০-এরও বেশি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। গোয়ালিয়রের শাসক বিক্রমজিৎ ছিলেন এদের মধ্যেই একজন যোদ্ধা, যিনি এই লড়াইয়ে বলি হয়েছিলেন।

নিঃসন্দেহে পানিপথের যুদ্ধ ছিল ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম একটি নির্ণায়ক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের রাজনৈতিক তাৎপর্যকে আমাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করে দেখা প্রয়োজন। এই যুদ্ধই আসলে লোদিদের ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে বিনষ্ট করে ভারতে একেবারে জৌনপুর পর্যন্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণের অধিকার বাবরের হাতের মুঠোয় তুলে দিয়েছিল। আগ্রায় সঞ্চিত লোদি সুলতানদের বিপুল ধনসম্পদ করায়ত্ত করে বাবর। তার এতদিনের আর্থিক সমস্যা নিবারণ করবার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন। যদিও বাবরকে সম্পূর্ণভাবে এদেশে নিজের অবস্থাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আরও দুটো কঠিন যুদ্ধে জয়লাভ করতে হয়েছিল, একটা ছিল মেবারের রানা সঙ্গের বিরুদ্ধে আর অন্যটা ছিল পূর্বাঞ্চলের আফগানদের বিরুদ্ধে। তাই রাজনৈতিক ভাবে পানিপথের যুদ্ধ হয়তো অতটা নির্ণায়ক ছিল না যতটা ছিল সামরিক দিক থেকে। তবে এই যুদ্ধ উত্তর ভারতে প্রাধান্য বিস্তারকারী রাজনৈতিক শক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবধারিত ভাবেই একটা নতুন অধ্যায় রচনা করেছিল।

পানিপথের যুদ্ধের পর বাবরের সামনে সমস্যা–রানা-সঙ্গের সাথে সংঘাত

পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভ করেই বাবরকে একগুচ্ছ গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তিনি প্রথম যে কাজটা করেছিলেন তা হল লোদিরা দিল্লি ও আগ্রার রাজকোষে যে বিপুল ধনসম্পদ ফেলে গিয়েছিল, সেগুলির উপর কবজা করা। তিনি দ্রুত সেনাদল পাঠিয়ে দিল্লি ও আগ্রা দখল করে সেখানকার রাজকোষগুলোর ওপর প্রহরা বসালেন। আগ্রায় প্রেরিত এরকমই এক সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হুমায়ুন। দিল্লিতে নিজের নামে খুৎবা পাঠ করে বাবরও আগ্রায় পৌঁছোলেন। সেখানে পৌঁছেই তিনি বাজেয়াপ্ত করা ধনসম্পদ দিয়ে বিপুল আর্থিক দান খয়রাত শুরু করলেন। প্রথমেই তিনি হুমায়ুন ও তার ভ্রাতাদের প্রচুর মূল্যবান উপহার প্রদান করলেন। তাঁর বিশেষ কয়েকজন বেগকে ১০ লক্ষ টঙ্কা ও বাকিদের ৭ কিংবা ৬ লক্ষ টঙ্কা উপহার দেওয়া হয়েছিল। যথাযথ অর্থমূল্য উপহারস্বরূপ দান করা হয়েছিল সমস্ত সেনা বাহিনীকেও এমনকি বাবরের হয়ে যুদ্ধ করতে আসা আফগান, হাজারা, আরবি, বালুচ ইত্যাদি উপজাতির যোদ্ধা এবং বণিক, ছাত্র ও অন্য সবাইকেই একাধিক উপহারে। খুশি করা হয়েছিল। সমরখন্দ ও খুরাসানে থাকা বাবরের আত্মীয়-পরিজন ও সুদূর মক্কা-মদিনার অনেক ধার্মিক ব্যক্তিও এসময় মূল্যবান উপহার লাভ করেছিলেন। কাবুল ও বাদাখশান উপত্যকার সকল নরনারী, শিশু, দাসদাসী, ভবঘুরে সবাইকেই একটা করে রৌপ্য মুদ্রা (শাহরুখী) দান করা হয়েছিল। এই প্রকার দানশীলতা আসলে ছিল বাবরের চরিত্রের একটা দিক, সেই সঙ্গে তাঁর দর্শনের একটা অঙ্গও বটে। তার মনে হয়েছিল যে, ইব্রাহিম লোদি তার অভিজাত ও সঙ্গী-সাথীদের নিজের পক্ষে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি, কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত কৃপণ আর নিজের রাজকোষ ভরানোর দিকেই ছিল তার বেশি মনোযোগ।

যদিও, এই প্রকার বিশাল উপহার প্রদানের তাৎক্ষণিকভাবে যে কুপ্রভাব পড়েছিল, তা একেবারেই বাবরের ভাবনা-বহির্ভূত ছিল। তার বহু বেগ ও সিপাহি এই উপহার পেয়ে কার্যত ভেবে নিয়েছিলেন যে, তাদের বাবরের হয়ে লড়াই করার পুরস্কার পাওয়া হয়ে গিয়েছে তাই এবার সময় নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করার। ভারতের কোনো কিছুই তাদের সেভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি হয়তো সে কারণে। বাবর তাই লিখেছেন, ‘আশাতীত ঘৃণা ও শত্রুতা’জন্মেছিল তাঁর লোকজনও আগ্রার মানুষদের মধ্যে। এলাকার মানুষরা তখনও পর্যন্ত তৈমুরের শহর লুণ্ঠনের স্মৃতি ভুলে যেতে পারেনি। তার ওপর প্রত্যেক দুর্গঘেরা নগরগুলো নিজেদের নিরাপত্তা শক্তিশালী করে বুঝিয়ে দিয়েছিল তারা বাবরকে সহজে মান্য করবে না, সেকারণেই ইটাওয়া ও সম্বল থেকে বায়ানা, মেওয়াট, ঢোলপুর, গোয়ালিয়র পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল স্থানীয় সামরিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল দ্রুত। ওদিকে বিদ্রোহী আফগানরাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। কনৌজ থেকে বাবরের সাম্রাজ্যের পূর্বদিক পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলেই ক্রমশ সক্রিয় হতে শুরু করেছিল আফগানরা। তারা তো আবার মেহমুদ লোদিকে তাদের মনোনীত সুলতান হিসেবে ঘোষণাও করে দিয়েছিল।

আগ্রায় বাবরের বাহিনীর আগমনের ফলে এলাকাবাসী পালিয়ে যাওয়ায় মানুষের খাওয়ার জন্যে না ছিল শস্য, না ছিল ঘোড়াদের জন্যে একফোঁটা দানা। গ্রামবাসীরা রাস্তাঘাটে চুরি-ডাকাতি শুরু করায় পথে ঘোরাফেরাও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায় এসময় গরমের মরশুম শুরু হওয়ায়। এ পরিবেশের সঙ্গে বাবরের সঙ্গীসাথী তথা তার বেগরা কিছুতেই মানিয়ে উঠতে পারছিলেন না। ফলে পরিণতি স্বরূপ ‘জনগণ মারা যেতে শুরু করে।

তাছাড়া, বাবরের বেগরা সবদিক থেকেই ভারতকে বিদেশভূমি বলেই ভেবে নিয়েছিলেন। তারা যে ধরনের (সেঁকা) রুটি খেতেন, যে ধরনের হামাম (স্নানাগার) ব্যবহার করতেন, যে ধরনের সামাজিক সম্পর্কে তারা অভ্যস্ত ছিলেন তার ছিটেফোঁটাও ভারতে খুঁজে পাননি তারা। তাই বাবর বলেছেন, একবার সিন্ধু নদী অতিক্রম করলেই ভূমি, জল, গাছ, পাহাড়, মানুষ, যাযাবর, তাদের মতামত ও আচার আচরণ সবকিছুই যেন হিন্দুস্তানের মতো হয়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে বাবরের বেগদের একটা বড়ো অংশই মনে করতে শুরু করেছিল যে ভারতে থেকে আর কিছুই করার নেই।

বাবর এই সমস্যা মেটাবার জন্যে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি একটি মন্ত্রণাসভার (Council) আয়োজন করে পরিষ্কার ভাবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে তাদের সারা বছর ধরে এই কষ্ট সহ্য করতে হবে না। এবং খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা হবে। তাই বিনা কারণে এই দেশ পরিত্যাগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি নিজেও কাবুল প্রত্যাবর্তন কর্মসূচি বাতিল করেছিলেন এবং তার শুভচিন্তকদের এই বিষয়টা পুনরায় উত্থাপন করার ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। তবে যারা ভারত ত্যাগের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিলেন তাদের তিনি বাধা দেননি। তাঁর প্রিয় ও অন্যতম সেরা বেগ খাজা কালান ভারত ছেড়ে কাবুল চলে গিয়েছিলেন। তবে তাকে বাবর হারাতে চাননি, তাই তাকে কাবুল ও গজনি দেখভাল করার দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছিল। সেই সঙ্গে আবার পাঞ্জাবের একটা পরগনাও তাকে নিজ ব্যয়নির্বাহের জন্যে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এই ঘটনা একটা রাস্তা খুলে দিল। বাবর এবার জৌনপুর পর্যন্ত এলাকাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে এভাবেই যুদ্ধে জেতা নয় এমন জায়গাগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব এক-একজন বেগের হাতে তুলে দিলেন এবং তাদের সেই অঞ্চলগুলোতে যেনতেনপ্রকারেণ সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আবেদন করলেন। এই রাস্তা ছাড়া আর কোনোভাবেই বাবর তার বেগদের সামলাতে পারতেন না, সেই সঙ্গে তাদের বাহিনীর ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানেরও একটা উপায় এভাবে তৈরি হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কারণ ইতিমধ্যেই পূর্বের কবজা করা রাজকোষের সম্পদ নিঃশেষ হতে আর বেশি বাকি ছিল না।

এরকম পরিস্থিতিতে বাবরকে দুটি বড়ো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। প্রথম চ্যালেঞ্জটা এসেছিল রানা সঙ্গর পক্ষ থেকে, আর দ্বিতীয়টি এসেছিল পূর্বাঞ্চলের আফগানদের তরফ থেকে। এসব চ্যালেঞ্জ কীভাবে সামলাবেন সে ব্যাপারে বাবর প্রথমদিকে একেবারেই অন্ধকারে ছিলেন। সভা (Council) চলাকালীন বোঝা গিয়েছিল যে আফগানরাই সবথেকে বড়ো আশঙ্কার কারণ হতে চলেছে। তারা ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ বাহিনী সহযোগে সমগ্র কনৌজ ও গঙ্গা নদীর দিকে দুই থেকে তিন মাইল এলাকা জুড়ে অবস্থান করছিল। যদিও রানা সঙ্গ রনথম্ভোরের কাছে কুন্ধারের শক্তিশালী দুর্গ দখল করে নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাও তিনি অনেকটাই দূরে ছিলেন। হুমায়ুনকে এক সামরিক বাহিনীর সঙ্গে পূর্বাঞ্চলে আফগানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানো হয় আর বাবর নিজে আগ্রায় থেকে যান। কিন্তু বাবরকে খুব দ্রুতই তার পরিকল্পনা বদলে ফেলতে হয়েছিল। কারণ আফগানদের আগেই রানা সঙ্গের দিক থেকে বিপদ ধেয়ে আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। আমরা প্রথম খণ্ডে আলোচনা করেছি কীভাবে রানা সঙ্গর উত্থান ঘটেছিল এবং মালব ও পূর্ব রাজস্থানের ওপর অধিকারকে কেন্দ্র করে কীভাবে ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ বেঁধেছিল। এই বৈরিতার কারণেই সঙ্গ ও বাবর ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে আঁতাত করেছিলেন। আমরা এও দেখেছি যে, ১৫১৯ সালে বাজাউর ও ভিরায় আগমনের পরেই এই আঁতাতের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু এই আঁতাতের প্রয়োজন বেশি ছিল রানা সঙ্গর-ই, কারণ ইব্রাহিম লোদির শক্তিশালী হয়ে ওঠার ফলে বাবরের তুলনায় তিনিই বেশি আতঙ্কিত ছিলেন। বাবরের অভিযোগ ছিল, রানা তার সঙ্গে হওয়া এই গোপন সমঝোতায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেননি। ইব্রাহিম লোদিকে আক্রমণের জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়ে রানা কথা দিয়েছিলেন ‘যদি সম্মানীয় পাদশাহ (বাবর) তার তরফ থেকে দিল্লির দিকে অভিযান চালান, তাহলে তিনিও তার তরফে আগ্রার অভিমুখে এগিয়ে আসবেন। বাবর ইব্রাহিমকে পরাস্ত করে দিল্লি ও আগ্রার দখল নিয়ে নিলেও রানা সঙ্গর তরফে কোনো পদক্ষেপই চোখে পড়েনি একবারও।

এটা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয় যে সঙ্গ ঠিক কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বাবরকে। সেখানে কি যৌথ সামরিক অভিযান চালানোর কথা বলা হয়েছিল নাকি লোদি সাম্রাজ্যকে তাদের দু’পক্ষের মধ্যে দু’ভাগে ভাগ করে নেবার পরিকল্পনার আভাস ছিল–তা স্পষ্ট নয়। যদি রানা সঙ্গের মনে সত্যিই শেষোক্ত পরিকল্পনাই থেকে থাকত এবং তিনি সত্যিই আগ্রা দখলে ইচ্ছুক থাকতেন, তাহলে তিনি কেন এগিয়ে এলেন না? আমাদের সামনে এ-বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ না থাকায় কেবল অনুমানের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। হয়তো সঙ্গ ভেবেছিলেন বাবর ও লোদির মধ্যে দীর্ঘকালীন যুদ্ধ চলবে, আর সে সুযোগে তিনি তাঁর অভীষ্ট এলাকাগুলো দখল করে নেবেন। অথবা তিনি এটাও কল্পনা করে থাকতে পারেন যে, তৈমুরের মতো বাবরও দিল্লি ও আগ্রার ধনসম্পদ লুঠ করে নিজ দেশে চলে যাবেন। কিন্তু যখনই তিনি বুঝতে পারেন যে বাবর ভারতে থেকে গিয়ে একটি নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছেন, তখনই সব পরিস্থিতি বদলে যায়। যদি এ-সাম্রাজ্য সত্যিই গড়ে ওঠে তাহলে রানা সঙ্গর কাছে তা লোদির সাম্রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি আতঙ্কের সৃষ্টি করবে। তাই হয়তো পানিপথের যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই সঙ্গ এমন একটি মহাজোট গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করেছিলেন যাতে হয় বাবরকে বাধ্য হতে হবে ভারত ত্যাগ করার জন্যে, নাহলে তাকে কোনোভাবে পাঞ্জাবেই আটকে রাখা যাবে।

১৫২৭ সালের শুরুর দিকেই সঙ্গর এই প্রচেষ্টা মোটামুটি সারা হয়ে যায় এবং বাবরও খবর পেতে শুরু করেন যে তিনি আগ্রার দিকে সেনা জমায়েত করছেন। এই পরিস্থিতিতে বাবর দ্রুত হুমায়ুনকে পূর্বাঞ্চল থেকে ডেকে পাঠান এবং ঢোলপুর, গোয়ালিয়র ও বায়ানা অধিকার করার জন্যে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। এই তিন অঞ্চলের শক্তিশালী দুর্গগুলি ছিল আগ্রার বাহ্যিক পরিখা এবং একই সঙ্গে মালব ও পূর্ব রাজস্থান-গামী পথের অতন্দ্র প্রহরী। এখানে স্বতন্ত্র মুসলিম সামরিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। সঙ্গর আগমনের খবর পেয়ে ঢোলপুর ও গোয়ালিয়রের সামরিক নেতারা বাবরের লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়ে নিজ নিজ দুর্গ তার হাতে সমর্পণ করে দেন। যদিও বায়ানার নিয়ন্ত্রক নিজাম খান দু’পক্ষের সঙ্গেই সমঝোতার পথ খোলা রাখেন। রানার আগমনের আভাস পেয়ে বাবর বায়ানায় সেনা পাঠালে সে বাহিনীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে দেয় রানার সেপাইরা। তার বাহিনীর মনোবল একেবারেই ভেঙে যায়। এই পরাজয়ের হতাশা তাদের পরেও পিছু ছাড়েনি। বাবর-প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী, রানার ছিল দুই লক্ষের বেশি সেনা। হয়তো এই হিসাব অতিরঞ্জিত, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে সংখ্যার বিচারে বাবরের বাহিনীর তুলনায় বহুগুণ বেশি শক্তিশালী ছিল রানার বাহিনী।

১৫২৭ এর ১৬ মার্চ ফতেপুর সিক্রির নিকটস্থ খানুয়ায় সংগঠিত বাবর ও রানা। সঙ্গর মধ্যে যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ প্রয়োজন এখানে আছে বলে মনে হয় না। তবে এ যুদ্ধের বেশ কিছু দিক পরিষ্কার করে নেওয়ার দরকার অবশ্যই আছে। রানা সঙ্গর সাথে এই যুদ্ধে রাজস্থানের প্রায় সকল প্রথম সারির রাজপুত রাজারা যোগদান করেছিলেন। যাদের মধ্যে ছিলেন দক্ষিণ ও পশ্চিম রাজস্থানের হারাউতি, জালোর, সিরোহি ও দুঙ্গাপুরের রাজারা এবং পূর্বদিকের ধুন্দর ও অম্বরের রাজারা। মারোয়ার, রাজা রাও গঙ্গা স্বয়ং যোগদান না করলেও মেরতার রাইমল ও রতন সিং-এর নেতৃত্বে সেনা পাঠিয়েছিলেন। মালবের চান্দেরি বংশের রাজা রাও মেদিনী রাও-ও যোগ। দিয়েছিলেন। আর যোগ দিয়েছিলেন সিকান্দার লোদির কনিষ্ঠ পুত্র মেহমুদ লোদি, যাকে আফগানরা তাদের সুলতান বলে ঘোষণা করে দিয়েছিল। শর্তাধীন জায়গির না। থাকলেও তিনি ১০,০০০ সেনা জোগাড় করে ফেলেছিলেন অনায়াসেই। মেওয়াটের প্রকৃত শাসক হাসান খান মেওয়াটিও রানার পক্ষে ১২,০০০ সেনা নিয়ে যোগ। দিয়েছিলেন। বাবরকে আফগানদের একটা অংশ কাফের ও মুলহিদ (অর্থাৎ যিনি ইসলাম থেকে বিচ্যুত) বলে অপমান করায় তিনি তাদের ভর্ৎসনা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এই ঘটনা এটা বুঝিয়ে দিয়েছিল যে এ ধরনের শব্দগুলো ধর্মীয় অর্থে ব্যবহারের পাশাপাশি অনেক সময় নিছকই রাজনৈতিক অর্থেও ব্যবহৃত হত।

এইভাবে রানা সঙ্গকে সামনে রেখে বাবরের বহিষ্কার তথা লোদি সাম্রাজ্যের পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে ঘনিয়ে উঠেছিল রাজপুত-আফগান জোট। তাই খানুয়ার যুদ্ধকে নিছকই হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় সংঘাত বা রাজপুতদের উত্তর ভারতে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়াই ভাবলে খুব বড়ো ভুল হয়ে যাবে আমাদের।

তবে বাবর তার সামরিক শিবিরকে চাঙ্গা করার জন্যে এই যুদ্ধকে ধর্মীয় যুদ্ধ বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। যুদ্ধের প্রাক্কালে তার সঙ্গীসাথী ও বাহিনীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বার্তায় তিনি তাদের সামরিক উৎসাহ ও উদ্দীপনা জাগরিত করার পাশাপাশি রানার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধকে জিহাদ (jihad) বা পবিত্র যুদ্ধ (holy war) বলে ঘোষণা করে তার লোকজনদের ধর্মীয় ভাবাবেগকে উসকে দিতেও কসুর করেননি। বেগ ও অন্যান্য যোদ্ধাদের রীতিমতো কোরানের শপথ নিতে হয়েছিল এই বলে যে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কোনোভাবেই ফিরে আসা যাবে না বরং দেহে প্রাণ থাকা অবধি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। নিজেকে পবিত্র মুসলিম প্রমাণ করার জন্যে বাবর সুরা পর্যন্ত পরিত্যাগ। করেছিলেন, বাছাই করা গজনির সুরার পাত্র ভেঙে দিতেও পিছপা হননি তিনি। যদি রানার বিরদ্ধে যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেন তাহলে সকল মুসলিমদের ওপর থেকে তামঘা (tamgha) বা শুল্ক আদায়ে ছাড় দেবারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। সবশেষে তিনি এই ঘোষণাও করেছিলেন যে, যুদ্ধের পর তাঁর শিবিরের কেউ কাবুলে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলে কোনোরকম ভাবে বাধা দেওয়া হবে না। এইভাবে বাবর তাঁর যোদ্ধাদের মধ্যে এক নতুন উচ্ছ্বাস আমদানি করতে সফল হয়েছিলেন। তাই হয়তো এই যুদ্ধের পরেই বাবরের ‘গাজি’ উপাধি গ্রহণ করার ঘটনা আমাদের খুব একটা অবাক করে না।

যুদ্ধের পূর্বে বাবর খুব নিখুঁতভাবে যুদ্ধক্ষেত্র পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছিলেন। পানিপথের মতো এখানেও তিনি তার আক্রমণের সম্মুখভাগকে শক্তিশালী করতে অটোমান যুদ্ধশৈলীর অনুকরণে ব্যবহার করেছিলেন নির্মীয়মাণ ঘোড়ার যুদ্ধ-গাড়ি, যেগুলি একে অপরের সঙ্গে লৌহ শিকলে যুক্ত ছিল (পানিপথের যুদ্ধে এক্ষেত্রে চামড়ার মোটা দড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল)। এই বিশেষ ব্যবস্থা আসলে পিছনের অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ বাহিনীর শক্তিশালী আচ্ছাদনের কাজ করত। প্রত্যেক ঘোড়ার যুদ্ধ-গাড়ির মধ্যে নির্দিষ্ট জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছিল যাতে সেখানে দাঁড়িয়ে অশ্বারোহী বাহিনী প্রয়োজনমতো বিপক্ষের আক্রমণের জবাব দিতে পারে। সেনা জমায়েতের সারি দৈর্ঘ্যে বাড়ানোর জন্যে কাঠের পাটাতন গড়ে তার চাকায় চামড়ার দড়ি আটকে একটা কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ করা হত যার পিছন থেকে গোলন্দাজ বাহিনী কামান দাগতে দাগতে এগিয়ে যেতে পারত। প্রথাগত সেনা জমায়েতের সঙ্গে বাম দিক ও সামনের দিকে বিশেষ এক বাহিনী মোতায়েন থাকত সাঁড়াশি আক্রমণের (তুলঘুমা) জন্যে। এইভাবে বাবর এই যুদ্ধেও পানিপথের মতো এক শক্তিশালী রক্ষণাত্মক তথা আক্রমণাত্মক রণকৌশল গ্রহণ করেছিলেন।

এটা মনে করার কোনো প্রয়োজন নেই যে পানিপথে বাবর কর্তৃক গৃহীত রণকৌশল। থেকে রানা সঙ্গ কিছু পন্থা শিখে নিয়েছিলেন। বরং তিনি তার হস্তী বাহিনী ও অসিযোদ্ধাদের নিয়েই গর্বের সঙ্গে সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তারা তাদের চিরাচরিত সমরকৌশলেই বাবরের বাহিনীকে ডানদিক দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিল। সে আঘাত আরও বাড়তে পারত, কিন্তু সময়মতো সেনা মোতায়েন করে বাবর তার দক্ষতার। প্রমাণ দিয়েছিলেন। রাজপুত ও তাদের আফগান সহযোগীদের বাহিনী আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গেই বাবরের বিশেষ সাঁড়াশি আক্রমণকারী সেনাদলের কাজ শুরু হয়ে যায়। ঘোড়ার যুদ্ধ-গাড়ি ও গোলন্দাজ বাহিনীকেও এগোনোর নির্দেশ দেওয়া হয়। অচিরেই রানা ও তার দলবলকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে তারা। বীরত্ব ও শৌর্যের সাথে যুদ্ধ করলেও এরপর রানা সঙ্গের চরমভাবে পরাজয় ঘটে।

এটা আবার প্রমাণ হয়ে গেল যে নিছক সাহসিকতা ও শৌর্যই যুদ্ধে প্রখর কৌশলধারী ও সংগঠিত প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। বাবরের মত ছিল, ‘অনেক হিন্দুস্তানিই হয়তো ভালো অসিযযাদ্ধা ছিলেন, কিন্তু তাঁদের বেশিরভাগই সামরিক গতিবিধি, পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে উদাসীন ও অদক্ষ ছিলেন। যদিও এই মন্তব্যটি বাবর আফগানদের উদ্দেশ্যে করেছিলেন, তবুও তা রাজপুতদের জন্যেও সমানভাবে প্রযুক্ত ছিল বলেই মনে হয়। যুদ্ধে হেরে রানা চিতোরে পলায়ন করেছিলেন আর তার সম্মিলিত রাজপুত ও আফগান জোটের দাপট এক পলকেই নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল। তাই রাশব্রুক উইলিয়ামস বলেছেন, মেবারের গরিমা ও শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে যে সম্মিলিত মৈত্রী জোট গড়ে উঠেছিল, তা কেবলমাত্র একটা যুদ্ধে পরাজয়ের পরেই ছারখার হয়ে যায় এবং এই একটা পরাজয়ই হিন্দুস্তানের রাজনীতির দিক পরিবর্তন করে দেয়।

জয়ের পর বাবরের পরিকল্পনা ছিল চিতোর পর্যন্ত সেনা অভিযান সম্প্রসারণ করবেন, কিন্তু প্রচণ্ড গরম ও পথে জলাভাবের কারণে সে পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। পরিবর্তে তিনি সেনা অভিযান চালালেন মেওয়াটে, যেখানকার শাসক হাসান খান রানা সঙ্গর পক্ষ নিয়েছিলেন। বাবর এর আগে মেওয়াটে শতাব্দী-প্রাচীন শাসক পরিবারের সদস্য হাসান খানের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েও অগ্রসর হননি। কিন্তু এবার খানুয়ার যুদ্ধে বাবরের বিরুদ্ধে হাসান খান জোটবদ্ধ হওয়ায় শাস্তিস্বরূপ তার দুই রাজধানী–তিজারা ও আলওয়ার সহ সমগ্র মেওয়াট দখল করে নেওয়া হয়, যদিও কয়েক লক্ষ অর্থমূল্যের পরগনাগুলি হাসান খানের পুত্র নাহার খানকে দান করে বাবর আগ্রা ফিরে এসেছিলেন।

খানুয়ার যুদ্ধ পানিপথের যুদ্ধের সাফল্যকে সম্পূর্ণ করেছিল আর গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলে বাবরের অবস্থানগত প্রতিষ্ঠাকে বিশালাকারে নিশ্চয়তা এনে দিয়েছিল। বস্তুত লোদিদের উত্তরাধিকারী হিসাবে এরপর বাবরের নজর দ্রুত গিয়ে পড়েছিল মালবের ওপরে। তাছাড়া রানা সঙ্গ যাতে আর কোনোভাবেই কোনো জোট তৈরি করে তার বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে না পারেন (রানা সে পরিকল্পনা বাস্তবেই করছিলেন), সেদিকটা নিশ্চিত করতেও বাবর তৎপর হলেন। ১৫২৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকেই বাবর আগ্রা থেকে চান্দেরিতে এসে হাজির হন, যেখানকার প্রধান মেদিনী রাও ছিলেন রানা সঙ্গর একজন ঘনিষ্ঠ মিত্র। বাবর তাকে চান্দেরি ছেড়ে দেবার বিনিময়ে শামসাবাদ-এর অধিকার প্রদানের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মেদিনী রাও ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে ও ভয়ঙ্কর জওহর (jauhar) অনুষ্ঠান পালন করে মৃত্যুবরণ করাকেই শ্রেয় বলে বেছে নিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যুদ্ধে মেদিনী রাওয়ের দুই কন্যা বাবরের হাতে ধরা পড়েছিল এবং তিনি তাদের হুমায়ুন ও কমরানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার যে চান্দেরি আক্রমণের সময়েও বাবর ‘জেহাদ’ ঘোষণা করেছিলেন। খানুয়া ও চান্দেরি উভয় জায়গাতেই বাবর পরাজিত প্রতিপক্ষের সৈনিকদের মাথার খুলি (Pagan skulls) দিয়ে স্তম্ভ (tower) নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। এটা একটা বিশেষ প্ৰথা যা তৈমুরকেও ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে তাঁর সকল প্রতিপক্ষের বিরূদ্ধে গ্রহণ করতে দেখা গিয়েছিল।

চান্দেরির পর বাবর রাইসিন, ভিলসা ও সারহগপুরের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবার পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি রানা সঙ্গর বিরুদ্ধে চিতোরে হামলা চালাতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবর জানতেন না যে এর অনেক আগেই রানার মৃত্যু (৩০ জানুয়ারি, ১৫২৮) ঘটেছিল তারই এক সর্দারের বিষপ্রয়োগের ফলে, যে সর্দারের মনে হয়েছিল রানার পুনরায় বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার পরিকল্পনা নিছকই আত্মহত্যার শামিল। এরমধ্যেই বাবর উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে আফগানদের সক্রিয়তার খবর পেতে শুরু করলে আর তার পক্ষে মালব ও রাজস্থান অঞ্চলে সেনা অভিযান চালানোর পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। ১৫২৮-এর ফেব্রুয়ারিতে তাই তাকে ফিরে আসার তোড়জোড় শুরু করতে হয়েছিল।

পূর্বাঞ্চলের সমস্যা এবং আফগান প্রশ্ন

বাবরের হাতে আফগানরা পরাজিত হলেও একদিকে মুঘলদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার ক্ষেত্রে তাদের যেমন আপত্তি ছিল, তেমনই তারা তাদের আফগান অধিরাজ্যের ভাবনা পরিত্যাগ করার ব্যাপারেও ঘোর অনিচ্ছুক ছিল। ভারতে মুসলিম জনজাতির একটা বিরাট অংশ ছিল আফগানরা এবং তারা এদেশের বিভিন্ন প্রদেশে শহর ও শহরতলির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করত। বিশেষত, আধুনিক উত্তরপ্রদেশের পূর্বভাগ ও বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বহুসংখ্যায় এদের অবস্থান ছিল সে সময়। এরা ছিল সংগ্রামপ্রিয় মানুষ এবং যে-কোনো সময় এরা একজন নেতার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে সামরিক বাহিনী নির্মাণ করতে পারত। এ-দেশের মানুষের সঙ্গে এদের নানা দিক থেকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, বহু স্থানীয় হিন্দু রাজা এদেরকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করতেন। যদিও এদের নানা বিষয়ে, এমনকি উপজাতিগত ক্ষেত্রে পারস্পরিক মতানৈক্য এবং তা থেকে এদের একজন একক সেনাধিপতির নেতৃত্বে বেশিদিন ঐক্যবদ্ধ না থাকতে পারার ব্যাপারটা আফগান শক্তির দুর্বলতার জায়গা তৈরি করেছিল।

পানিপথের পর একাধিক সমস্যা নিয়ে এদেশের আফগান শক্তির সামনে বাবরকে বারংবার দাঁড়াতে হয়েছে। আফগানদের প্রতি বাবরের নীতি ঠিক কী ছিল তা বুঝতে গেলে আমাদের চারটি দিক একটু মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, এটা আমরা জানি শহর ও শহরতলির দুর্গগুলির সামরিক নিয়ন্ত্রক (ইকতাদার) হিসেবে কাজ করত এই আফগানরা। ইব্রাহিম লোদির পতনের পর এরাই দুর্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকার শাসনাধিকার নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছিল। বাবর এদের বলপূর্বক ও মন জয় করে কাছে টানার নীতি নিয়েছিলেন। দুর্গ থেকে এদের অপসারিত করতে, বিশেষত দোয়াব বা আগ্রার পার্শ্ববর্তী এলাকার দুর্গগুলিকে আফগানমুক্ত করতে প্রথমে সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগানো হয়েছিল। ইটাওয়া, রাপরি, কলপি প্রভৃতি এলাকায় ও ঢোলপুর, বায়ানা, গোয়ালিয়র প্রভৃতি দুর্গে এইভাবে সেনা অভিযান করা হয়েছিল। এর পাশাপাশি এদের অনেকের সামনেই তাদের অধিকৃত এলাকা ছেড়ে দেবার প্রতিদানে অন্যত্র পরগনা দান হিসাবে দেবার শর্তও রাখা হয়েছিল। ইব্রাহিম লোদির প্রথম সারির আফগান অভিজাতদের অনেককেই এভাবে দলে টানার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বাবর। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুস্তাফা ফারমুলির ছোটো ভাই অযোধ্যার শেখ বায়াজিদ, যিনি দলবল নিয়ে ইব্রাহিম লোদির আমলে পূর্ব উত্তরপ্রদেশের আফগান বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বাবর কাছে টেনেছিলেন বিবনকেও, যিনি বায়াজিদ-পরবর্তী সময়ে উত্তরপ্রদেশের পূর্বদিকের আফগান বিদ্রোহে নেতা ছিলেন। আরও ছিলেন, যেমন আজম হুমায়ুনের পুত্র ফতহ খান সারওয়ানি, যাকে খান-ই-জাহান উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তাকে দান করা হয়েছিল মুকুট, বাবরের নিজস্ব পরিধেয় সামগ্রীর থেকে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের (সারোপা) বস্ত্র ও নিজেরই পরগনার অধিকার। ইব্রাহিম লোদির পরিবারের প্রতি তার যে কোনোরকম বিদ্বেষ ছিল না, সেটা প্রমাণ করার জন্যে বাবর ইব্রাহিম লোদির মাকে প্রদান করেছিলেন সাত লাখি পরগনা ও বসবাসের জন্যে একটি মনোরম জায়গা। যদিও এই মহিলা পরে বাবরকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। এই ঘটনা বাবরের প্রতি আফগান অভিজাতদের অসন্তোষ ও সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। খানুয়া যুদ্ধের কিছুটা আগেই হিন্দুস্থানি (অর্থাৎ আফগান) সেনাদল বাবরের শিবিরে পাঠানো হলেও হিন্দুস্থানি মানুষের মনে বাবরের প্রতি পূর্ণ আস্থা জন্মেছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাই শেখ বায়াজিদকে অযোধ্যায় প্রায়। দেড় কোটি টঙ্কার পরগনা পুরস্কারস্বরূপ দান করা হলেও সে অঞ্চলের আফগান বিদ্রোহের আগুন নেভানো যায়নি। বরং বাবরের এ-ধরনের পারিতোষিক প্রদান তাদের বিদ্রোহকে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল বলেও আশঙ্কা ভেসে আসছিল আফগানদের মধ্যে। তবে আফগানদের মধ্যে সকলেই এইভাবে ভাবেননি। সাধারণভাবে আফগানদের সম্পূর্ণরূপে মুঘল বিরোধিতা চলাকালীনও আহমেদ খান নিয়াজির মতো বেশ কয়েকজন। আফগান অভিজাত বাবরের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। কারণ এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, বাবর তার এদেশের সাম্রাজ্যের মোট জমার এক চতুর্থাংশই আফগান অভিজাতদের দান করেছিলেন।

দ্বিতীয়ত, উত্তরপ্রদেশের পূর্বভাগে, বিশেষ করে জৌনপুর সংলগ্ন এলাকার আফগানরা ছিল এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই অংশের আফগানরাই মূলত ইব্রাহিম লোদির সময়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল এবং এদের শায়েস্তা করতেই ইব্রাহিম অতি তৎপরতার সঙ্গে বাহার খান লোদি, মুস্তাফা ফারমুলি ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে সেনা। পাঠিয়েছিলেন সেখানে। এই আফগানরা মোটেই তাদের বংশধরদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করত না। এমনকি, পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদির পরাজয়ের পরে এই অংশের আফগানরাই গুজরাটের শাহজাদা বাহাদুর শাহকে আমন্ত্রণ জানায় জৌনপুরের সিংহাসন দখল করার জন্যে। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে এই সময় কনৌজ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা এদের দখলে ছিল এবং এই অধিকৃত অঞ্চল আগ্রা থেকে খুব দূরে ছিল না। বাবর ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করার পর নৈতিকভাবে ইব্রাহিমের বিহার পর্যন্ত সমগ্র সাম্রাজ্যের ওপরে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভেবে নিয়েই যে কোনো মূল্যে সেই সাম্রাজ্যের এক ফোঁটা জমিও বিদ্রোহী আফগানদের ছেড়ে দেবার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই শুরু থেকেই বাবর পূর্বাঞ্চলের আফগানদের হঠাতে হুমায়ুনকে বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। আফগানরা হুমায়ুনের সামনে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুললেই পারেনি, ফলে তিনি দ্রুত জৌনপুর পর্যন্ত এলাকা দখল করে নিতে পেরেছিলেন। হুমায়ুন সেখানে আরও কিছুদিন থাকলে হয়তো আফগানদের এই বিদ্রোহ দমন করতে পারতেন, কিন্তু সেই মুহূর্তেই হুমায়ুনকে। বাবর ডেকে পাঠিয়েছিলেন রানা সঙ্গর আতঙ্ক সামলানোর জন্য। হুমায়ুনের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়েই বিদ্রোহী আফগানরা দ্রুত কনৌজ পর্যন্ত এলাকা পুনরায় দখল করে নিয়েছিল।

তৃতীয় ও চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল যথাক্রমে বিহার ও বাংলা। দীর্ঘদিন ধরেই বিহার ছিল বাংলার নানা রাজবংশ ও জৌনপুরের শারকি বংশের মধ্যে বিবদমান এক ফাঁকা অঞ্চল (no man’s land)। জৌনপুরের রাজবংশের পতনের পর বিহারের অবস্থান আরও যেন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। সাম্রাজ্যের অঙ্গ হলেও লোদিরা বিহারে সেভাবে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বিহারের ভারপ্রাপ্ত প্রাদেশিক শাসক দরিয়া খান নুহানি প্রথমে পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী আফগানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিলেও পরে তিনি বিদ্রোহীদের দলেই ভিড়ে গিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বাহাদুর খান নিজেকে বিহারের স্বাধীন শাসক হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন এবং সুলতান মহম্মদ উপাধি ধারণ করে রীতিমতো নিজের নামে খুৎবা পাঠ থেকে নিজ নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলন ইত্যাদি কোনোকিছুই বাদ রাখেননি। খানুয়ার যুদ্ধের কিছু সময় পরে, সিকান্দার লোদির কনিষ্ঠ পুত্র মহম্মদ লোদি বিহার দখলে এনেছিলেন এবং বিবন ও বায়াজিদের মতো পূর্ব উত্তরপ্রদেশের আফগানরা সকলেই প্রায় তাকে শাসক হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। বাংলার সুযোগসন্ধানী শাসক নুসরত শাহর অভিসন্ধি ছিল বিহার পর্যন্ত নিজের সাম্রাজ্যকে সম্প্রসারিত করার। সেই লক্ষ্যেই রানা সঙ্গর সাথে বাবরের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে তিনি তার সাম্রাজ্যকে ত্রিহুত থেকে বাল্লিয়া পর্যন্ত প্রসারিত করে সেখানে তার দুই শ্যালক আলাউদ্দিন ও মাখদুম-ই-আলমকে শাসনভার অর্পণ করে দিয়েছিলেন। এই মাখদুম-ই-আলম নিজে বর্তমান পাটনা অঞ্চলের কাছে গঙ্গার পার্শ্ববর্তী হাজিপুর এলাকায় শক্তিশালী নিয়নন্ত্রণ গড়ে তুলতে সফল হয়েছিলেন। তিনি তার এই নিয়ন্ত্রণের সীমা পরে গঙ্গার দুই তীর বরাবর আজমগড় পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন বলেও জানা যায়।

এই নুসরত শাহ-এর সঙ্গে বিহার তথা পূর্ব উত্তরপ্রদেশ অঞ্চলের আফগানদের মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক। তবুও মুঘলদের বিরুদ্ধে ঢাল হিসাবে আফগানদের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে নুসরত শাহ পূর্ব উত্তরপ্রদেশের আফগান নেতা–বিবন, বায়াজিদ ও মারুফ ফারমুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছিলেন। আফগান বিদ্রোহীরাও বিহারকে মুঘল চাপ সামলানোর নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে দেখেছিল বলেই নুসরত শাহর সঙ্গে সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটায়নি।

এরকম পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে মালবে থাকাকালীন বাবর তড়িঘড়ি প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন এবং ফিরেই সরাসরি কনৌজের উদ্দেশ্যে অভিযান চালান। আফগানদের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাবর গঙ্গার ওপরে সেতু নির্মাণ করেন এবং কামান, গোলা বারুদ সহযোগে আফগানদের প্রতিরোধ নিষ্ক্রিয় করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নদী অতিক্রম করে তিনি অচিরেই জৌনপুর পর্যন্ত এলাকা দখল করে নিলেও বিদ্রোহী আফগানদের কিন্তু সমূলে উৎখাত করতে পারেননি। তারা গঙ্গার তীর ধরে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাবর এই এলাকায় আর অত্যধিক সময় দিতে চাইছিলেন না, তাই আস্কারির অধীনে অঞ্চলটি শাসনের দায়িত্ব অর্পণ করে তিনি আগ্রায় ফিরে আসেন। পরে বাংলার শাসক নুসরত শাহ নিজের নিরপেক্ষতা প্রমাণের তাগিদে বাবরের কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দ।

পরের বছরেই বাবর তার সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল থেকে বিদ্রোহকে একেবারের জন্যে নিঃশেষিত করবেন বলে মনঃস্থির করেন। সে-কারণেই প্রয়াগ ও বেনারসের উদ্দেশ্যে। অভিযান চালিয়ে তিনি বিহারের প্রবেশদ্বার চুনারে এসে হাজির হন। ইতিমধ্যে বাংলার শাসক নুসরত শাহ বাবরের কাছে দূত প্রেরণ করেন। জানা যায় বাবর তাকে বেশ কিছু শর্ত দিয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে সেই শর্তগুলো ঠিক কী ছিল তা আমাদের কাছে আজও অজ্ঞাত, কারণ বাবরের স্মৃতিগ্রন্থটিতে এই তথ্য সম্বলিত পৃষ্ঠাগুলি এক ঝড়ের প্রকোপে বিচ্ছন্ন হয়ে হারিয়ে গিয়েছে। তবে এটা নিশ্চিত যে বাবর বাংলাকে আফগানদের প্রভাব থেকে আলাদা করতে ও গঙ্গার তীরবর্তী ওই অঞ্চল জুড়ে একটা মুক্ত এলাকা তৈরি করতে চাইছিলেন ভীষণভাবে। কিন্তু বাবরের। এই চাহিদার মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিহার। তাই নুসরত শাহের সঙ্গে কোনোরকম সমঝোতায় পৌঁছতে পারেননি বাবর। সম্ভবত বিহারের ওপর বাংলার। শাসকের যে অধিকার বলবৎ ছিল তা বজায় রাখার ব্যাপারে বাবরের সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছিল নুসরত শাহের তরফ থেকে, কিন্তু বাবরের এই প্রস্তাবে সায় ছিল। না। তাই গঙ্গা ও ঘর্ঘরা নদীর সঙ্গম উপকণ্ঠে পোঁছে বাবরকে অবাক হতে হয়েছিল নদীর অপর প্রান্তে বাংলার শাসক ও আফগান বিদ্রোহীদের যৌথ সামরিক বাহিনী দেখে। কম করে চব্বিশ জায়গায় সেনা মোতায়েন করে বাংলার শাসক বাবরকে নদী অতিক্রমে বাধা দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। এতকিছু সত্ত্বেও বাবর নদী অতিক্রম করে এগিয়ে যান। অন্যদিক থেকে আস্কারির নেতৃত্বে ২০,০০০ সেনা আক্রমণ শানায়। ফলে বাংলার ও আফগানদের যৌথ বাহিনী দু’দিক দিয়ে বাবর বাহিনীর আক্রমণের সামনে পড়ে যায়। ১৫২৯-এর ৫মে সংগঠিত এই যুদ্ধ ঘর্ঘরার যুদ্ধ নামে পরিচিত। যেখানে সম্পূর্ণভাবে মুঘলরা বিজয়ী হয়। সাত থেকে আট হাজার নুহানি সহ বিশালসংখ্যক আফগান সেনা আত্মসমর্পণ করে। মারুফ ফারমুলি ধরা পড়েন। কিন্তু বিবন ও বায়জিদ মেহমুদ লোদির সঙ্গে ঘর্ঘরা নদী দিয়ে পালিয়ে গিয়ে লখনউ-এ আশ্রয় নেন।

এবার বাবর বিহারের দখল নিলেন। তবে বিহারের প্রাত্যহিক ব্যাপারে নিজেকে জড়াতে একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না তিনি, তাই পূর্বে নিযুক্ত বিহারের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক খান-ই-জামানকে সরিয়ে নুহানি প্রধানদের ওপর বিহার দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পণ করলেন। এই দায়িত্বপ্রাপ্ত নুহানি প্রধানদের মধ্যে একজন ছিলেন বিদ্রোহী আফগানদের সমর্থক ও যুদ্ধে নিহত সুলতান মহম্মদের পুত্র জালাল খান। জালাল আগেই বাবরের আনুগত্য মেনে নিয়েছিলেন এবং বাবর তাকে এক কোটি টঙ্কা নজরানা হিসাবে দেবার প্রতিদানে বাৎসরিক এক কোটি টক্কা খালিসা’ রূপে প্রদান নিশ্চিত করেছিলেন। অপর এক নুহানি প্রধান, গাজীপুরের ইক্তাদার মেহমুদ খান নুহানিকে আবার বিহারে পঞ্চাশ লক্ষ টঙ্কা অর্থমূল্যের সম্পত্তি দান করা হয়েছিল।

বাবর এরপর বাংলার শাসক নুসরত শাহের সঙ্গে এক চুক্তি করেছিলেন। যদিও সে চুক্তির সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি, তবুও এটা মনে হয় যে বাবর সে চুক্তির মাধ্যমে বিহারে নিজের অবস্থানকে অক্ষত রাখতে পেরেছিলেন। যদিও তা পরের দিকে বাংলা ও বিহারের মধ্যে বড়ো ধরনের সংঘর্ষের পথ প্রশস্ত করেছিল, কিন্তু তা ছিল অন্য প্রসঙ্গ।– আসলে এই চুক্তির পর বাবর তার পদক্ষেপ পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি বিবন ও বায়াজিদকে লখনউ থেকে বিতাড়িত করলে তারা কালিঞ্জরের মোহাবায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাবর বুঝতে পারছিলেন যে আফগান সমস্যা এখনও সমূলে সমাধান করা যায়নি। আফগানদের সামাজিক গঠন ও তাদের সামরিক প্রবণতার দিকগুলো মাথায় রেখে বাবর এই সমস্যা সমাধানের জন্যে আরও সময় ও উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তার ওপর আফগানদের বিহার-ছাড়া করতে হলে বাবরকে তার নিরাপত্তাবলয় আরও প্রসারিত করতে হত, দরকার হলে বাংলার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু তাই বলে তিনি এখনই বিহার নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে চাননি। কারণ তিনি হয়তো বাংলা ও বিহারের সমস্যা একসঙ্গে সামলাবার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাছাড়া বাংলার সঙ্গে এখনই বিরোধিতায় যাওয়ারও তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। কারণ তিনি দেখেছিলেন বাংলাতেই একমাত্র বিপুল ধনসম্পদ সঞ্চিত রয়েছে। ওদিকে মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতেও উজবেক শাসক উবাইদুল্লাকে জাম-এর যুদ্ধে শাহ তাহমাসাপ (Shah Tahmasp) পরাজিত করার পর আক্রমণের সম্ভাবনা তৈরি হলেও বাবর আর সেদিকে সেভাবে নজর দিতে চাইছিলেন না। এবার পুরোপুরিভাবেই তার নজর সন্নিবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল দোয়াবে তাঁর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ওপর।

তাই এটা পরিষ্কার যে বিহার ও বাংলায় বাবর যে সমঝোতা ও চুক্তিগুলো করেছিলেন তা ছিল যথেষ্ট বাস্তব পরিস্থিতি-প্রসূত।

বাবরের অবদান ও তার ভারত আগমনের গুরুত্ব

স্বল্প রোগভোগের পর ১৫৩০ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাবর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। যদিও তার মৃত্যুকে ঘিরে ও তার সঙ্গে হুমায়ুনের জন্যে তার জীবন ত্যাগ করার প্রস্তাবকে যুক্ত করে এক ধরনের রোমান্টিক গাথার বিস্তার করা হয় ঠিকই, কিন্তু বাবরের শারীরিক অবস্থা যে শেষ কয়েক বছরে ক্রমাগত খারাপ হয়ে যাচ্ছিল তার ইঙ্গিত তিনি নিজেই দিয়েছিলেন তাঁর স্মৃতিচারণায়। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে ১৫২৮-২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি অন্তত ছয়বার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং সেই অসুস্থতা কম করে দুই সপ্তাহ ধরে তাকে বিব্রত করেছিল। তাছাড়া ক্রমাগত যুদ্ধ ও সামরিক অভিযানের ক্লান্তি আর তার কাছে একেবারে নতুন ভারতের উষ্ণ আবহাওয়া তার স্বাস্থ্যের দিন-দিন অবনতি ঘটানোর জন্যে অনেকাংশে দায়ী ছিল।

যদিও বাবর তার আফগানিস্তানের সাম্রাজ্যকে ফেলে এদেশে এসেছিলেন এবং দেশের প্রতি প্রথমদিকে মনোভাব খুব একটা ভালো ছিল না তাঁর, তবুও যত দিন গিয়েছে বাবরের কাছে ভারত শুধু যে তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল তাই নয়, রীতিমতো তাঁর নিজের গৃহে পরিণত হয়েছিল। তার যে সমস্ত বেগরা এদেশের প্রতি টান অনুভব না করে চলে যেতে চেয়েছিল, তাদের খানুয়ার যুদ্ধের পর ভারত ছেড়ে চলে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বাবর নিজে এদেশের প্রতি এক গোপন বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন নিশ্চিত।

এটা সত্যি যে বাবর আফগানিস্তান ছেড়ে ভারতে তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত্তিটা খুঁজে পেয়েছিলেন এদেশের অর্থনৈতিক গুরুত্বের জন্যেই। তিনি আফগানিস্তানের সাম্রাজ্যের থেকে এদেশের সাম্রাজ্যকে বেশি গুরুত্ব দিলেও প্রাচীন কাল থেকে আফগানিস্তান অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবেই ছিল এবং মধ্যযুগেও তা প্রায়শই ‘ক্ষুদ্র ভারত’ নামে অভিহিত হত। যদিও রাজনৈতিক ভাবে কুষাণ যুগের পত্ন ও পরবর্তীকালে মহম্মদ ঘুরির হাতে সেখানকার হিন্দু রাজত্বের অবসান ঘটার পর আফগানিস্তান আর ভারতের অংশ থাকেনি, তবুও আদিকাল থেকেই আফগানিস্তান ভারতের ওপর উত্তরে বহিরাক্রমণের গতিপ্রকৃতি নির্ধারক একটি রঙ্গমঞ্চ হিসাবে কাজ করে এসেছে। তাই আফগানিস্তান ও ভারতে প্রবেশের দুই কেন্দ্র কাবুল ও কান্দাহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে বাবর এবং তার উত্তরসূরিরা পরবর্তী ২০০ বছর ভারতকে বৈদেশিক আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে গিয়েছিলেন।

বাবর ও তাঁর উত্তরসূরি কর্তৃক দীর্ঘদিন আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ ভারতকে মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে সংযুক্ত রেখেছিল। সেখানকার তুখোড় শক্তিগুলি অর্থাৎ তুরান, ইরান, অটোমান তুর্কি ও অন্যান্যরা সকলেই এই সময়ে ভারতের সঙ্গে নিবিড় কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল এবং প্রয়োজনে সমর্থনও প্রার্থনা করেছিল। মুঘলদের তরফ থেকেও বাবর ও তার পরবর্তী মুঘল শাসকগণ নিয়মিত দূত প্রেরণের মধ্য দিয়ে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন। এভাবেই বাবরের হাত ধরে ভারতের বৈদেশিক নীতি ও কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নব অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিল। বাবর যে মুঘল প্রভাবকে হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে কেবল বাদাখশান পর্যন্তই বজায় রাখতে পেরেছিলেন তা কিন্তু নয়, বরং তা প্রসারিত হয়েছিল অক্সাস নদীর তীর পর্যন্তও। এমনকি, ১৫২৮-এর জাম-এ শাহ তাহমাসাপের হাতে উজবেক প্রধান উবাইদুল্লাহ পরাজিত হবার পর বাবর সেখানে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। তিনি হুমায়ুনকে আদেশ দিয়েছিলেন ইরানীয় সাহায্য নিয়ে এই সুযোগে সমরখন্দ পুনর্দখল করার, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ইরানীয় সাহায্য না আসায় সে উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি।

অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখলে কাবুল ও কান্দাহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ফলে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যও শক্তিশালী হবার সুযোগ পেয়েছিল। বাবর তার স্মৃতিচারণায় তাই বলেছেন, “হিন্দুস্তান ও খুরাসনের মধ্যবর্তী স্থলপথে দুটি বাণিজ্য কেন্দ্র রয়েছে; একটি হল কাবুল ও অন্যটি কান্দাহার। কাবুলে কাশগর থেকে পণ্য এসে জমা হত, এই কাশগর ছিল চিন, ট্রানসঅক্সিয়ানা, তুর্কিস্তান প্রভৃতি অঞ্চলের বাণিজ্য ঘাঁটি। আবার কান্দাহারে খুরাসান অর্থাৎ ইরান ও পশ্চিম এশিয়া থেকে পণ্য আসত। বাবর আরও বলেন ‘আমরা কাবুলে খুরাসান, তুরস্ক, ইরান ও চিনের জিনিস পেলেও তা আসলে হিন্দুস্তানের নিজস্ব বাজার। তাই কাবুল ও কান্দাহারকে বাবর তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার ফলে ভারতের কাছে সুযোগ এসে গিয়েছিল ট্রান্স-এশীয় বাণিজ্যে নিজেদের ভাগীদারী বৃদ্ধি করার।

ইব্রাহিম লোদি ও রানা সঙ্গকে পরাজিত করার পর বাবর ভারতে নতুন সাম্রাজ্য। নির্মাণের রাস্তা খুঁজে পেয়েছিলেন। পঞ্চদশ শতকে এদেশে শক্তিসাম্যের তারতম্যের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে নতুন সাম্রাজ্য নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল তাকে কাজে লাগিয়েছিলেন বাবর। যদিও এই সাম্রাজ্য নির্মাণের জন্যে দরকার ছিল আরও অনেক পদক্ষেপের যা বাবরের পরে হুমায়ুন কিছুটা গ্রহণ করলেও সে পথের দিকে সবচেয়ে দীর্ঘ পদক্ষেপগুলো পরবর্তীকালে শের শাহ সুরি ও আকবরকেই গ্রহণ। করতে দেখা গিয়েছিল।

ভারতে কামান ও মাস্কেট বন্দুকৈর প্রচলন বাবরের হাত ধরেই হয়েছিল। তথাপি, বারুদের আবিষ্কার চিনের এবং তারাই এদেশে প্রথম বারুদ নিয়ে এসেছিল। ত্রয়োদশ শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে বারুদ দুর্গের প্রাচীর ছিদ্র করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত আর কামানের ব্যবহারের পদ্ধতি ইউরোপেই প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল। মধ্য এশিয়া ও ইরানে কামানের গোলাবারুদের ব্যবহার শুরু হয়েছিল চতুর্দশ শতক নাগাদ যখন। চলদিরনের যুদ্ধে (১৫১৪) অটোমানরা শাহ ইসমাইলের বিরুদ্ধে কামান দেগেছিল। বাবর এই পদ্ধতি নিজের যুদ্ধবিগ্রহে প্রয়োগ করার জন্যে দু’জন অটোমান গোলন্দাজ বিশেষজ্ঞকে নিযুক্ত করেছিলেন এবং কামানের ব্যবহার প্রথম করেছিলেন ১৫১৯ সালে বাজারে। আর এর ব্যবহার বাবর যে ভারতে পানিপথ, খানুয়া ও অন্যান্য যুদ্ধেও করেছিলেন তার কথা তো আগেই বলেছি। এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার পরের দিকে বড়ো রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের পক্ষে বিদ্রোহী ছোটো রাজা ও জমিদার বাগে আনার ক্ষেত্রে খুব কাজে দিয়েছিল। কারণ ছোটো রাজা বা জমিদারদের এধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয় ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি ও মুনশিয়ানা থাকত না সাধারণত। এভাবে এই আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াকে সহজ করে দিয়েছিল। তবে এটা ভুললে চলবে না যে, এই ধরনের সমারায়ুধ যুদ্ধকে করে তুলেছিল অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক।

বাবর অটোমান ও উজবেকদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এদেশে এক নতুন সামরিক কৌশল আমদানি করেছিলেন, যা ছিল লৌহ শিকল সহযোগে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ও পরিখা পরিবেষ্টিত ঘোড়ার যুদ্ধ-গাড়ির সারি এবং দু’পাশ দিয়ে আক্রমণকারী বিশেষ বাহিনীর আয়োজন (তুলঘুমা)। তবে এটা কখনোই বলা যাবে না যে কেবল তার এই নতুন যুদ্ধাস্ত্র ও নতুন রণকৌশলের জোরেই বাবর ভারতে একের-পর-এক যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। সেখানে তার দক্ষ যুদ্ধ পরিচালনা, সংগঠন, যত্নসহকারে যুদ্ধক্ষেত্র নির্বাচন ও তার দলবলকে ঠিকঠাক জায়গায় উপযুক্ত সময়ে মোতায়েন করার বিষয়গুলোও সমান ভাবে কাজ করেছিল বাবরের সাফল্যের সপক্ষে।

মুঘলদের আগমনের ফলে ভারতে রাজশক্তির গৌরব (the prestige of the Crown) আবার ফিরে আসতে শুরু করেছিল। যদিও সিকান্দর লোদি ও ইব্রাহিম লোদি রাজশক্তিকে মজবুত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাদের রাজত্বে শক্তিশালী আফগান ঐক্য ও স্বাধিকারের ঐতিহ্য সক্রিয় থাকায় তারা সে কাজে খুব বেশি সাফল্য লাভ করতে পারেননি। অন্যদিকে, এশিয়ার দুই মহান যোদ্ধা চেঙ্গিজ ও তৈমুরের বংশধর হওয়ার সুবাদে বাবর ছিলেন ব্যক্তিগতভাবে উচ্চ গরিমার অধিকারী। তাছাড়া যে মোঙ্গল-পারসিক ঐতিহ্যের বিকাশ এসময় ঘটেছিল, যেখানে মহান খানরা ছিলেন বেগদের প্রভু ও রাজ্য শাসনের ঐশ্বরিক আদেশপ্রাপ্ত, সেই ধারার অনুগামী হিসাবে বাবর নিজেকে এমন এক রাজশক্তির আধার রূপে তুলে ধরেছিলেন যাতে তার কোনো বেগ তাকে চ্যালেঞ্জ করা বা ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখার কথা কল্পনাও করতে পারত না। বাবর এদেশে রাজশক্তির গৌরব নষ্ট হয়ে যাবার কথা নিজেই লিখেছিলেন। তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন এটা জেনে যে, বাংলায় রাজতন্ত্রে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ছিল অতি দুর্বল। সেখানে যে কেউ পাদশাহকে হত্যা করে সিংহাসনে বসতে পারত। তাই সেখানকার আমির, উজির ও সেনাবাহিনী বাবরের শরণাপন্ন হয়ে তাকেই প্রকৃত শাসক হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল। তৈমুরীয় শাসক ও তাদের অধীনস্থ বেগদের মধ্যে কি ধরনের রাজতান্ত্রিক পরম্পরাগত পার্থক্য থাকত তার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে তাদের রাজসভায় প্রচলিত কিছু অবশ্য পালনীয় প্রথার মধ্যে। যেমন, সম্রাটের আগমনে সকল বেগকেই বয়েস বা পদাধিকার নির্বিশেষে উঠে দাঁড়াতে হত। কিন্তু ভারতে এসে বাবর বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন যখন ইব্রাহিম লোদির অন্যতম প্রাক্তন অভিজাত বিবন তার কাছে। আত্মসমর্পণ করার পরেও আসন গ্রহণ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, অথচ আলম। খান(লোদি)-এর পুত্র রাজপরিবারের সন্তান হয়েও দাঁড়িয়ে ছিলেন।

তবে এ-কথা বলতেই হবে যে, যতই মোঙ্গল-তৈমুরীয় ঐতিহ্যে শাসক ও তার বেগদের মধ্যে পদমর্যাদাগত পার্থক্যগুলি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করা হোক, বাবর কিন্তু তার বেগদের সঙ্গে অনেক স্বাভাবিকভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাঁর প্রথম সারির বেগদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন এবং তাদের পরামর্শ কার্যকর করতে হুমায়ুনকে নির্দেশও দিতেন। তিনি তার বেগদের ভাতা ও পুরস্কার প্রদানের ব্যাপারেও ছিলেন রাজ। তাদের সঙ্গে বাবরের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল মধুর। সাধারণ নাচ গান ও কবি-সম্মেলনের জলসায় বাবরের সঙ্গে সুরা পানের আসরেও এদের আমন্ত্রণ থাকত। এমনকি আফিম খাওয়ার আসরেও বেগরা আমন্ত্রিত হতেন। বাবর তার বেগদের সঙ্গে পোললা খেলতে ভালোবাসতেন। একবার তিনি তার সকল বেগদের একটা ছোটো নদী লাফিয়ে অতিক্রম করতে বলেছিলেন। আর বেশ কয়েকজন দুর্বল বা বৃদ্ধ বেগ লাফাতে না পেরে জলে পড়ে গেলে বাবর হাততালি বাজিয়ে মজা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, চলার পথে বহু কষ্ট ও সংকটের মুহূর্তও তিনি অনায়াসে ভাগ করে নিতেন তার বেগদের সঙ্গে। তাই কাবুলের শাসক হিসাবে, যখন বাবর হেরাটের মিরজাস এলাকা ভ্রমণ করতে এসেছিলেন এবং শীতকালে সেখান থেকে ফিরতে গিয়ে তার দলবল পর্বতের বরফ পথে দিভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ও প্রবল বরফ ঝড়ে প্রায় চাপা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন বাবর কোনোরকম ইতস্তত না করে তাঁর সঙ্গীসাথীদের উদ্ধার করতে হাত লাগিয়েছিলেন যা দেখে অনেক বেগ-ও উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিল। বেগদের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করলেও নিয়মানুবর্তিতার দিক দিয়ে বাবর ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। যে সমস্ত বেগ যুদ্ধের সময় যথাযথ তেজ দেখাতে পারত না, তাদের অচিরেই পদ ও সুযোগসুবিধা হারাতে হত। তাদের কাছ থেকে পরগনা কেড়ে নেওয়া থেকে শুরু করে জনসমক্ষে দাড়ি কামিয়ে অপমান করা, কোনোকিছুই বাদ দেওয়া হত না।

একজন ধর্মপ্রেমী মুসলিম হিসাবে বাবর নিয়মিত নামাজ পাঠ যেমন করতেন। তেমনি রমজানের উপবাসও সম্পূর্ণ পালন করতেন। তিনি তৈমুরীয় শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করা নকসাবন্দী সুফি সাধক শেখ উবাইদুল্লাহ আহরর-এর একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন। এই সাধক বরাবরই তার শিষ্যদের কঠোরভাবে শরিয়ত পালন করার কথা বলতেন। তাই বাবরকেও তা পালন করতে হত নিষ্ঠার সঙ্গেই। এমনকি তিনি নাকি কয়েকবার ওই সুফি সাধককে স্বপ্নেও দেখেছিলেন। তবে তাই বলে বাবর কিন্তু সংকীর্ণ ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিত্তিক বিভিন্নতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। ট্রানসঅক্সিয়ানার পরিবেশটা সে সময় সংকীর্ণ ধর্মীয় গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ ছিল না, বরং ধর্মীয় ব্যাপারে মানুষের স্বাধীনতার জায়গাটা ছিল। বাবর এরকম কয়েকটা ছবি নিজেই তুলে ধরেছেন, যেমন তিনি সুলতান আহমেদ মির্জার কথা বলেছেন, যিনি একজন সত্যিকারের মুসলমান ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং প্রত্যহ পাঁচবার নামাজও পড়তেন। তিনি তার এই ধর্মীয় উপাচার পালন ‘তার সুরাপানের দিনগুলোতেও কোনোভাবে ছাড়েননি। অত্যধিক সুরাপান সেখানে ছিল সাধারণ ব্যাপার, এমনকি মহিলারাও বিশেষ অনুষ্ঠানে সুরাপানে মেতে থাকত। বাবর বাবা কুলির কথা উল্লেখ করেছেন যিনি বাবরের অভিভাবক ছিলেন কিন্তু না তিনি নামাজ পড়তেন, না রোজার উপবাস রাখতেন, তার হাবভাব ছিল একেবারেই বিধর্মীর মতো…’। এরকম পরিবেশেই নিজের ধর্মীয় চিন্তাভাবনাকে গড়ে তুলেছিলেন বাবর। তাই তিনি তাসখন্দে অনায়াসেই কিজিলবাসদের (শিয়া মতাবলম্বী পারসির) পোশাক পরিধান করতে পেরেছিলেন যা তথাকথিত ধর্মবিরুদ্ধ। কাজ হলেও রাজনৈতিক ভাবে সে পোশাক তখন তাকে ভালোই মানিয়ে গিয়েছিল।

হিন্দুদের প্রতি বাবরের মনোভাব কীরকম ছিল? একথা সত্য যে রানা সঙ্গর বিরুদ্ধে চালানো সামরিক অভিযানকে বাবর ‘জেহাদ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং সে যুদ্ধে জয়লাভের পর সুরা ত্যাগ করে ও সুদানি ভেঙে তিনি রীতিমতো ‘গাজি’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। তবে এগুলি অবশ্যই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ। রানার ঘনিষ্ঠ সহযোগী চন্দেরির শাসক মেদিনী রাও-এর বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানও ‘জেহাদ’ বলে ঘোষিত হয়েছিল এবং সেটিও ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। আর খানুয়ার যুদ্ধ জয়ের পরে পরাজিত প্রতিপক্ষের সৈনিকদের মাথার খুলি দিয়ে স্তম্ভ নির্মাণের বিষয়টা আসলে মোঙ্গল ও তৈমুরীয়দের একপ্রকার প্রথা ছিল। এটা যে কেবল যুদ্ধজয়ের স্মৃতিচিহ্নই ছিল তা নয়, বিপক্ষ শিবিরে আতঙ্ক সৃষ্টির এক মোক্ষম মাধ্যমও ছিল। এই প্রথা বাবর আফগান ও রাজপুতদের বিরুদ্ধেও একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন।

বাবর হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন এমন কোনো সূত্র মেলেনি এখনও। আগ্রার পাশেই ছিল মথুরা, আর বাবর সে এলাকা দিয়ে বহুবার যাতায়াত করেছিলেন। সেখানকার কোনো মন্দির ভাঙা হয়নি কিন্তু। বাবর গোয়ালিয়র দুর্গের অভ্যন্তরে অবস্থিত রাজকীয় প্রাসাদ ও মন্দির প্রদর্শন করেছিলেন এবং সেখানকার ছবি তুলে ধরেছিলেন নিজের স্মৃতিকথায়, কিন্তু একবারও সেগুলি বিনষ্ট করা বা ধ্বংস করার চেষ্টা করেননি। শুধু উরওয়া উপত্যকার (Urwa Valley) জৈন দেবদেবীর মূর্তি ভেঙে দেবার নির্দেশ বাবর দিয়েছিলেন কারণ সেগুলি ছিল সম্পূর্ণভাবে নগ্ন। নির্দেশমতো কেবল মূর্তিই ভাঙা হয়েছিল, মন্দির নয় এবং পরে সেই মন্দিরে জৈন সাধকরা পুনরায় মূর্তি নির্মাণ করে নিয়েছিলেন।

বলা হয়ে থাকে যে, সম্বল ও অযোধ্যা-বাবরের ভারতে সাম্রাজ্যের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রেই নাকি বাবরের নির্দেশে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু সম্বল ও অযোধ্যায় প্রাপ্ত লেখ অনুযায়ী সে জায়গায় মসজিদ নির্মাণের জন্যে স্থানীয় শাসকদের যথাক্রমে মির হিন্দু বেগ ও মির বাকি-র কৃতিত্ব লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং ঈষৎ উল্লেখ রয়েছে বাবর কর্তৃক মসজিদ নির্মাণের নির্দেশের। কিন্তু সেখানে কোথাও এটা বলা নেই যে ওই জায়গায় হিন্দু মন্দির ছিল বা হিন্দু মন্দির ভাঙা হয়েছিল। বরং যে দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই দুই বৃহৎ মসজিদের নির্মাণকার্য সম্পন্ন হবার কথা বলা হয়েছে, তাতে এটা মনে হতে পারে যে ওখানে হয়তো পূর্বে মসজিদই ছিল আবার বাবর কেবল সেগুলি সংস্কার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মাত্র। ফলে পরিষ্কারভাবেই এই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে ওই অঞ্চলে আগে আদৌ কোনো হিন্দু বা বৌদ্ধ মন্দির ছিল কি? আর থাকলে কে ও কবে তা ধ্বংস করেছিল?

বাবর যে ধর্মীয় ব্যাপারে বেশ নমনীয় ছিলেন এবং হিন্দুদের প্রতি তাঁর যে সেরকম কোনো বিদ্বেষ ভাব ছিল না তার প্রমাণ মেলে ভারতের স্বাধীন হিন্দু রাজাদের প্রতি তাঁর আচরণে। বাবরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করার পরেও পাঞ্জাবে গোক্ষরদের প্রধান হাতি গোক্ষরদের তার পৈতৃক ভূমিতে পূর্বের মতোই শাসন করার অনুমতি দিয়েছিলেন বাবর। ফল স্বরূপ আদম গোক্ষর এক বিশাল গোক্ষর সেনাবাহিনী সহযোগে বাবরের সঙ্গে আগ্রা পর্যন্ত এসেছিলেন এবং খানুয়ার যুদ্ধে বাবরের হয়ে যুদ্ধও করতে দেখা । গিয়েছিল সেই বাহিনীকে। সেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন সঙ্গোর গোক্ষর। তাছাড়া বাবর রানা সঙ্গীর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীদের সঙ্গেও রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় আসতে চেয়েছিলেন। তাই রানা সঙ্গের বিধবা পত্নী রানি পদ্মাবতী তার পুত্র বিক্রমজিৎ যখন ভ্রাতার দ্বারা নিপীড়িত হচ্ছিল তখন স্বয়ং বাবরের সাহায্যের প্রার্থনা করেছিলেন। রানি বাবরকে রনথম্বর ও মহম্মদ খলজির মুকুট আর কোমরবন্ধ সমর্পণের বিনিময়ে ৭০ লক্ষ টঙ্কা অর্থমূল্যের পরগনা ও সম্পত্তি চেয়েছিলেন। যদিও কোনো চুক্তি হয়নি তবুও বাবর রানির দূতকে সসম্মানে আপ্যায়ন করেছিলেন এবং রানির চাদিহা অনুযায়ী বায়ানা নয় বরং শামসাবাদ দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

 বাবরের ধর্ম ভাবনায় যে উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা তাঁর গোঁড়া ধর্মীয় বিষয় বহির্ভূত চিত্রকলা, সঙ্গীত, নৃত্য ও কাব্যের প্রতি অনুরাগ থেকেও প্রতিফলিত হয়। তিনি হিরাটে, বাইসানকর মির্জার সভা অলঙ্কৃত করা প্রথিতযশা চিত্রকর বিহাজাদ-এর তুমুল প্রশংসা করেছিলেন। তাছাড়া তার স্মৃতিগ্রন্থে লিপিবদ্ধ কবিতার ছত্রগুলিকে একত্রিত করে তিনি তুর্কি ভাষায় একটি কাব্যসমগ্র বা ‘দিবান’ লিখেছিলেন। তিনি সেইসঙ্গে শেখ উবাইদুল্লাহ আহরের বিখ্যাত রচনা ‘ওয়ালাদিয়াহ রিসালা’কে ছত্রাকারে পরিবেশন করবার কাজ শুরু করেছিলেন। বাবর সে সময়কার বিখ্যাত কবি যেমন আলি শের নাভাই প্রমুখদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন।

বাবরের স্মৃতিগ্রন্থ বা ‘তুজুক’ হল বিশ্বসাহিত্যের এক অন্যতম ক্লাসিক। চাঘতাই তুর্কি ভাষায় লেখা এই গ্রন্থে ভাষা নিয়ে যে পরীক্ষানিরীক্ষা বাবর করেছিলেন, তার কারণেই তাকে কবি আলি শের নাভাই-এর সঙ্গে একযোগে আধুনিক উজবেকি তুর্কি ভাষার রূপকারের আসনে বসানো হয়। এ গ্রন্থে যে কেবলমাত্র সমকালীন ঘটনাবলির। ওপরেই নজর দেওয়া হয়েছিল তাই নয়, এখানে বাবরের প্রকৃতির প্রতি গভীর। অনুরাগের, বিষয়টাও ধরা পড়েছিল। তিনি সে সময়কার ভারতের ফলমূল, ফুল, পশুপাখি ও নানা দ্রব্যের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন। বর্ণনা ছিল সেখানকার সামাজিক জীবন ও আচার আচরণের। একইভাবে তিনি ফারগানা, সমরখন্দ, কাবুল প্রভৃতি অন্য যে সমস্ত দেশে জীবন কাটিয়েছিলেন, সেখানকার বর্ণনাও তুলে ধরেছিলেন। তার সমকালীন ব্যক্তিত্বদের ভালো ও খারাপ দুই দিকের কথাই খুব দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে বাবর তাঁর স্মৃতিগ্রন্থে ব্যক্ত করেছিলেন। এমনকি নিজের পরিজনদের ব্যাপারেও অপ্রিয় তথ্য জানাতে তিনি কুণ্ঠা বোধ করেননি। তার নিজ পিতা উমর শেখ মির্জা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, পিতা ছিলেন ‘খর্বকায় ও জমকালো দাড়ি বিশিষ্ট নাদুসনুদুস’ প্রকৃতির লোক যিনি এত আঁটোসাঁটো অন্তর্বাস পরিধান করতেন যে যে-কোনো মুহূর্তে নিজেই ফেটে যেতে পারতেন। আর একজন ছিলেন। বাবরের প্রথম অভিভাবক শেখ মির্জা বেগ। তার বর্ণনা দিয়ে বাবর বলেছেন, উমর শেখের জমানায় মির্জা বেগের মতো লোভী শেখ আর দুটো ছিল না, তাছাড়া তিনি ছিলেন অত্যন্ত কদভ্যাসযুক্ত একজন মানুষ যার পুরুষ যৌনসঙ্গী ছিল। যদিও বাবর এটাও জানিয়েছেন যে সে সময় এ-ধরনের যৌনক্রিয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল। বাবর এসব কার্যকলাপ থেকে বিরতই থাকতেন, যদিও তিনি উল্লেখ করেছেন ১৪৯৯ সালে সমরখন্দে থাকাকালীন একবার তিনি শিবিরের বাজারে একটি ছেলের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বাবর সবসময়েই শাসনকার্যকে আন্তরিকভাবে? অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছিলেন। নাহলে জীবনসায়াহ্নে এসে তিনি হুমায়ুনকে একথা লিখতেন না–কোনো দাসত্বই সার্বভৌমত্বের সুখের সমান হতে পারে না, অবসর গ্রহণ তাই শাসন করার সামনে বেমানান।

এভাবেই বাবর তুর্কো-মোঙ্গল কর্তৃত্বমূলক অধিরাজ্যের আদর্শকে সামনে রেখে রাষ্ট্র শাসনের নতুন এক ধারণার অবতারণা করেছিলন যা দাঁড়িয়েছিল রাজমুকুটের শৌর্য ও শক্তির ওপর, যেখানে ধর্ম ও বৈষম্যের গোঁড়ামি প্রাধান্য পেত না, প্রাধান্য পেত ললিতকলা চর্চা থেকে বৃহৎ পরিসরে সংস্কৃতির প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ। এর সঙ্গেই ছিল ‘হামাম’ (নাগরিক ও ব্যক্তিগত স্নানাগার) ও ঝরনার প্রবহমাণ জলধারা সমন্বিত বাগানের সমাহার যা বাবরের সুরুচির পরিচয় বহন করত। এভাবেই তিনি এমন একটা দৃষ্টান্ত, এমন একটা পথের সন্ধান দিয়ে গিয়েছিলেন যা অবলম্বন করে তার উত্তরসূরিরা ভারতে এক মজবুত সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *