০১. মধ্য এশিয়ার রাজনীতি এবং ভারত অভিমুখে বাবরের আগমন

প্রথম অধ্যায় – মধ্য এশিয়ার রাজনীতি এবং ভারত অভিমুখে বাবরের আগমন

সমগ্র ভারতীয় ইতিহাস জুড়ে মধ্য এশিয়ার ঘটমান পরিস্থিতি ও তার গতিপ্রকৃতি এদেশের ওপর গভীর ও স্থায়ী প্রভাব ফেলে এসেছে শুরু থেকেই। আমরা দেখেছি, দশম ও দ্বাদশ শতকে মধ্য এশিয়ার ঘটনাক্রম ভারতে প্রথমে গজনভিদের ও পরে ঘোরিদের অভিঘাত ঘটিয়েছিল। একইভাবে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে মধ্য এশিয়ার ঘটনাপরম্পরা ভারতে এক নতুন তুর্কি আক্রমণের পথ প্রশস্ত করেছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর।

মোঙ্গলদের দ্রুত উত্থান ও পতন এবং পারস্পরিক দ্বন্দ্ব চতুর্দশ শতকে এক নতুন মধ্য-এশীয় সাম্রাজ্যের আবির্ভাবের পরিমণ্ডল রচনা করেছিল। সে সাম্রাজ্য গড়েছিলেন তৈমুর, একজন বারলাস (Barlas) সম্প্রদায়ভুক্ত তুর্কি, যারা ট্রানসঅক্সিয়ানায় (Transoxiana) জমির মালিকানা ভোগ করত ও মোঙ্গলদের সাথে অবাধ অন্তর্বিবাহ সম্পর্কে লিপ্ত থাকত। এমনকি তৈমুরও কাজান খান নামে এক মোঙ্গল খানের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন এবং যেহেতু এই কাজান খান চেঙ্গিজ খানের পুত্রের উত্তরসূরি ছিলেন, সেহেতু তৈমুরও নিজেকে চেঙ্গিজের বংশধর বলে দাবি করতেন। আধুনিক লেখক গবিন হাম্বলে (Gavin Hambly) মনে করেন এশিয়ায় চেঙ্গিজ খানের কর্মজীবন এক নতুন অবিংসবাদী সাম্রাজ্যের ধারণার জন্ম দিয়েছিল–যেখানে পুরুষের কল্পনায় প্রথমেই ভেসে আসত আতঙ্কের অধীশ্বর হওয়ার স্বপ্ন…মোঙ্গল। সাম্রাজ্যের পতনের পর মধ্য এশিয়ার প্রত্যেক শাসকই নিজ শাসনকে আলাদা মাত্রা দান করার আশায় পারলে নিজেকে চেঙ্গিজ খানের বংশধর প্রতিপন্ন করতেও ছাড়তেন না।

তৈমুরের জীবনের বিজয় অভিযানে অতিবাহিত করেছিল প্রায় এক শতাব্দীর এক চতুর্থাংশ কাল এবং এর পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ১৪০৪-০৫ সালে তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আরাসন (পূর্ব ইরান), ইরান, জর্জিয়া, ইরাক এবং সিরিয়া ও আনাতোলিয়া (তুরস্ক)-র অটোমান সাম্রাজ্যে উড়েছিল তার বিজয়কেতন। এমনকি তিনি দক্ষিণ রাশিয়া এবং এখনকার সিনকিয়াং ও সাইবেরিয়ার কিছু অংশে একসময় কর্তৃত্ব কায়েমকারী উলুস মোঙ্গল জাতি যারা আবার ‘সোনালি যাযাবর’ নামে খ্যাত, তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালিয়ে গিয়েছিলেন ক্রমাগত। যদিও তাদের কখনও তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেননি। তিনি দিল্লিতে লুঠপাট চালিয়েছিলেন এবং পাঞ্জাব দখলেরও মৃদু প্রয়াস করতে ছাড়েননি। মৃত্যুর পূর্বে তিনি চিন আক্রমণের পরিকল্পনাও করতে শুরু করেছিলেন।

তৈমুরকে ‘মানব ইতিহাসের অন্যতম দুঃসাহসিক ও বিনাশকারী যুদ্ধজয়ী নায়ক’ বলা হয়ে থাকে। পূর্বের চেঙ্গিজের মতো তিনিও যুদ্ধে বিপক্ষ শিবিরে আতঙ্ক সৃষ্টিতে অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ানো শহরগুলিতে তিনি নির্মমভাবে ধ্বংসলীলা চালাতেন, বহু মানুষকে হত্যা করতেন, ক্রীতদাস বানাতেন এবং কারিগর, কলাকুশলী ও বিদ্বজ্জনদের ধরে নিয়ে আসতেন তার রাজধানী সমরখন্দে। এই নীতি তিনি খুরাসান, ইরান এবং দিল্লি আক্রমণের সময় ভারতের বিরুদ্ধেও অনুসরণ করেছিলেন।

তৈমুরের এই দ্যুতি কোনো স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাঁড়াতে পারেনি এবং তার মৃত্যুর পরেই তাঁর সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়। যদিও তিনি সাম্রাজ্য গড়েছিলেন এবং তার ফলে যে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও অনুশাসনের জন্ম হয়েছিল, তা যে শুধু ভারতে মুঘলদের অনুপ্রেরণার আধার হিসেবে কাজ করেছিল তাই নয়–উজবেক, সাফাভিদ ও অটোমানদের উত্থানেও উৎসাহ জুগিয়েছিল। মোঙ্গলরা তুর্কিদের মতো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিলেও তারা বহু মোঙ্গল রীতিনীতি ও আচারবিচার, যেমন চেঙ্গিজ প্রবর্তিত ইয়াসা (yassa) বা নিয়মকানুনগুলি পালন করা ছাড়তে পারেনি। তৈমুর নিজেকে একনিষ্ঠ মুসলিম হিসেবে দাবি করতেন, যদিও সমকালীন লেখক ইবন আরব শাহ-র মতে, চেঙ্গিজের ইয়াসা ও মোঙ্গল ঐতিহ্য তৈমুরের চরিত্র ও নীতিতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, বাহ্যিক আবরণ ছাড়া তৈমুরের কাছে কোরান ও শরিয়তের কোনো মূল্যই ছিল না। এমনকি তৈমুরের বহু উত্তরসূরি নিজেদের গোঁড়া মুসলিম হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়ে মুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠীকে তোষণ করলেও, তাদের জন্য ধর্মীয় ভাতার ব্যবস্থা করা। থেকে শুরু করে সমাধি, মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণে উদ্যোগী হলেও কখনোই তারা ‘ইয়াসা’কে অমান্য করতে পারেনি। এইভাবে ‘ইয়াসা’কে শরিয়ত-এর বিকল্প হিসেবে দেখার ইচ্ছা ও যখন যেখানে প্রয়োজন শরিয়ার সংশোধন করার বিশেষ রাজকীয় অনুশান (ইয়ারলিঘ) জারি করার মধ্য দিয়েই তৈমুরীয় সাম্রাজ্য তার আগেকার। সাম্রাজ্যগুলোর থেকে পৃথক বৃহত্তর ও অধিক উদারনৈতিক চরিত্র লাভ করেছিল। তৈমুরীয় শাসকগণ ইবন আরবির দর্শন ‘ওয়াহাদত-আল-ওয়াজুদ বা ঐশ্বরিকসমন্বয়বাদ (Unity of God)- নির্ভর নতুন এক ঝাঁক উদার চিন্তাধারার বিকাশেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যা নতুন কবিদের উত্থানের মধ্য দিয়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সে সময়ের অন্যতম নামজাদা কবি জামি (Jami) হিরাত-এ তৈমুরের উত্তরসূরি শাহরুখ কর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তথাকথিত ‘ফার্সি সাহিত্যের সর্বশেষ মহান যুগ’-এ তৈমুরীয়দের প্রধান ভূমিকা পালন করতে দেখা গিয়েছিল। চাঘতাই তুর্কি ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে গড়ে তোলার কাজে তারা উৎসাহ দান করেছিলেন। তৈমুরের আর-এক উত্তরসূরি সুলতান হুসেন বৈকারা সমকালীন প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী বিহজাদের তত্ত্বাবধানে হিরাটে-এ গড়ে তুলেছিলেন একটি চিত্রকলার প্রশিক্ষণকেন্দ্র।

এভাবেই তৈমুরের সময় ও তার প্রচেষ্টা এবং তার উত্তরসূরিদের উদ্যোগ এক নতুন উদার মুসলিম রাষ্ট্রের উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছিল যেখানে কাউকেই তাদের বিশ্বাসের ও আস্থার সাপেক্ষে পৃথক করে রাখা হত না। আর সে কারণেই, খ্রিস্টান বা অন্য অ-মুসলিম ধর্মবিশ্বাসীরা অনায়াসে স্থান পেয়েছিল তৈমুরের সেনাদলে। রাষ্ট্র নিজেও বৃহত্তর সাংস্কৃতিক চিন্তাদর্শ প্রচার ও প্রসারে অংশগ্রহণ করত।

তাই গবিন হাম্বলে (Gavin Hambly) বলেছেন, ‘মধ্য এশিয়ার আর কোনো রাজবংশ এই প্রকার পরম্পরা রেখে যেতে পারেনি।

তৈমুরীয়রা আরও একটি মোঙ্গল ঐতিহ্য গ্রহণ করেছিলেন, তা হল ‘ক-আন’ (Qa-an) বা পরম নেতৃত্বের প্রতি সর্বদা পূর্ণ বিশ্বস্ত ও সহযোগী থাকার অঙ্গীকার। চেঙ্গিজ ও তাকে অনুসরণ করে তৈমুরীয়রা এক স্বর্গীয় শাসনের অধিকার দাবি করতেন। তাই কোনো সাধারণ অভিজাত বা সামরিক নেতা তাদের বিরুদ্ধাচরণের কথা স্বপ্নেও ভাবতেন না। বস্তুত, তারা অন্তর থেকে নিজেদের চাকর (নোকর) বলেই ভাবতেন।

এগুলিই হল সেইসব ঐতিহ্য ও শাসনধারা যা মুঘল, সাফাভিদ, উজবেক, অটোমান ইত্যাদির মতো মোঙ্গল-পরবর্তী সময়ে উঠে আসা বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলোকে প্রাক্ মোঙ্গল রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় অনেক বেশি স্থায়িত্ব ও দৃঢ়তা প্রদান করেছিল। এগুলি ভারতে মুঘল রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির রূপ পরিগ্রহণেও সহায়তা করেছিল।

তৈমুরীয়-উজবেক ও উজবেক-ইরানীয় সংঘাত এবং বাবর

আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের বাঁধন আলগা হতে শুরু করার পরই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় তিনটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল। ট্রানসঅক্সিসয়ানায় প্রাধান্য বিস্তার করেছিল উজবেক সাম্রাজ্য, ইরান দখলে নিয়েছিল সাফাভিদ সাম্রাজ্য এবং আনাতোলিয়া (আধুনিক তুরস্ক) ও সিরিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত কর্তৃত্ব বিস্তার করেছিল অটোমান সাম্রাজ্য। এরা ভূমধ্যসাগরে রাজত্ব করত। অটোমানরাই একমাত্র এশীয় সাম্রাজ্য যাদের বৃহৎ নৌবাহিনী ছিল। বাগদাদ, দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানে ও আজারবাইজান এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যে সাফাভিদদের সঙ্গে তাদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এই সাফাভিদরা, যারা নিজেদের সন্তদের কোনো আদি সম্প্রদায়ের বংশোদ্ভূত বলে দাবি করত, ষোড়শ শতকের সূচনালগ্নে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তারা ঘোর শিয়ামুসলমান ছিল ও ইরানে বহু ধর্মগুরু সহ সুন্নিদের ওপর প্রায়শই অত্যাচার চালাত। তারা সিরিয়া ও আনাতোলিয়ায় শিয়া ইসলামি আদর্শ প্রচারে সচেষ্ট হয়েছিল। অন্যদিকে গোঁড়া সুন্নি মুসলমান অটোমানরা সিরিয়া ও আনাতোলিয়ায় শিয়াপন্থীদের ওপর আঘাত এনে পালটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল সাফাভিদদের কাছে। এভাবে, সম্প্রদায়ভিত্তিক দ্বন্দ্ব এই দুই শক্তির মধ্যে রাজনৈতিক শত্রুতাকে আরও তিক্ত ও তীব্র করে তুলেছিল। তৈমুরীয়দের প্রধান শত্রু তথা যাযাবর তুর্কি ও তুর্কিভাষী মোঙ্গল জনজাতি নিয়ে সম্মিলিত উজবেকরা বসবাস করত বর্তমান কাজাকিস্তান অঞ্চলে। সেখানে তারা পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। উজবেক খানাত (মোঙ্গলীয় খানদের দ্বারা শাসিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা) গড়ে তুলেছিল। যদিও সেই খানাত অচিরেই ভেঙে যায় এবং উজবেক সাম্রাজ্য নতুন করে গড়ে তোলেন মহম্মদ শাইবানি খান। একজন যুদ্ধবাজ হিসেবে জীবন শুরু করে মহম্মদ। শাইবানি খান কিছুদিন মুঘলস্থানের মোঙ্গল খানের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু ক্রমেই নিজের ক্ষমতায় তিনি উজবেক ও মোঙ্গল ভাগ্যান্বেষী সেনাদলের সর্বেসর্বায়। পরিণত হয়েছিলেন।

এইসব শক্তির কাছে ট্রানসঅক্সিয়ানা অধিকার ছিল অন্যতম লক্ষ্য। সে সময়। ট্রানসঅক্সিয়ানা একাধিক তৈমুরীয় রাজপুরুষদের অধিকারে নানা ভাগে বিভক্ত ছিল। সেই উত্তপ্ত দিনগুলোতে প্রত্যেক তৈমুরীয় রাজপুরুষ কেবল যে তার নিজের শাসনাধীন সাম্রাজ্য দখলে রেখেই ক্ষান্ত হতেন তা কিন্তু নয়, বরং প্রায়শই তার ভাই, জ্যাঠা, কাকা ও অন্যান্য আত্মীয় পরিজনদের অধিকৃত পার্শ্ববর্তী এলাকাও ছিনিয়ে নেবার অভিসন্ধিতে মত্ত থাকতেন। আর সেজন্যে তারা উজবেক বা মোঙ্গল যুদ্ধবাজদের ভাড়া করে আনতে কিংবা বহিঃশক্তিদের আমন্ত্রণ করে তাদের এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে হস্তক্ষেপের রাস্তা পরিষ্কার করে দিতেও পিছপা হতেন না। এইরকম পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড বলিষ্ঠ ও নিমর্ম কোনো ব্যক্তিই আশা করতে পারতেন নিজেকে টিকিয়ে রাখতে। যেখানে কাউকেই (রাজপুরুষ, অভিজাত, সেনাদল) বিশ্বাস করার যোগ্য ছিল না, সেখানে সবথেকে বেশি বিশ্বাসঘাতকতার নজির গড়তে দেখা যেত ভাড়াটে মোঙ্গল যুদ্ধবাজদের। পরবর্তীকালে, যখন বাবর স্বয়ং বাধ্য হয়েছিলেন মোঙ্গল যুদ্ধবাজ ভাড়া করতে, তখন তিনি লিখেছিলেন—’যদি এরা জয়লাভ করে, জয়ের পুরস্কার আত্মসাৎ করবে; আর যদি পরাজিত হয়, এরা নিজেরাই নিজেদের আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে মরবে!’

উজবেকরা ছাড়াও মোঙ্গল খানরা, যাদের সাম্রাজ্য মূলত আধুনিক সিংকিয়াং এলাকা বা মুঘলিস্থানে বিস্তৃত ছিল; কিন্তু ট্রানসঅক্সিয়ানাতে ছিল মৃদু নিয়ন্ত্রণ, তারাও এখানে তাদের আধিপত্য বিস্তারে তৎপর হয়ে উঠেছিল। মহম্মদ খান এবং আহমদ খান–এই দুই মোঙ্গল খান ছিলেন যথাক্রমে বাবরের মাতৃপক্ষের আত্মীয়। তারা বাবরকে ক্ষমতায়নের নানা মুহূর্তে সাহায্য করলেও কখনো নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে রাখতে পারেননি।

ট্রানসঅক্সিয়ানা দখলের দ্বন্দ্বে তৃতীয় পক্ষ ছিলেন তৈমুরীয় শাসক হুসেন বইকারা, যার অধীনে ছিল খুরাসন (পূর্ব ইরান)। তিনি পূর্ণশক্তি নিয়ে আসরে না নামলেও সবসময়েই ট্রানসঅক্সিয়ানাকে অন্যভাবে সন্তর্পণে দখলের চেষ্টায় ছিলেন।

ট্রানসঅক্সিয়ানাকে নিয়ে এই পারস্পরিক টানাপোড়েনের পশ্চাতে প্রধান কারণ ছিল সমরখন্দের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। সমরখন্দ এলাকাটির প্রভূত গুরুত্ব ছিল, কারণ দীর্ঘ প্রায় ১৪০ বছর ধরে এই এলাকাটি তৈমুরীয় বংশের রাজধানী ছিল। সেইসঙ্গে এলাকাটি এত উৎকৃষ্ট ও সমৃদ্ধশালী ছিল যে পরের দিকে বাবরও এটা স্বীকার না করে থাকতে পারেননি–’সমরখন্দের মতো খুব কমই সুখকর শহর সমগ্র বাসযোগ্য পৃথিবীতে রয়েছে। তিনি এ-শহরের মনোমুগ্ধকর নির্মাণকার্য ও বাগান, সেখানকার উৎপাদিত ফলমূল ও সুরা, সেখানকার বাণিজ্য ও শিল্পোৎপাদন এবং পার্শ্ববর্তী উৎকৃষ্ট পশুচারণভূমি দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন।

এই ছিল সেই পশ্চাৎপট যেখানে জন্মগ্রহণ করেন বাবর এবং এখানেই তিনি জীবনের শুরুর দিকগুলো কাটান। এ-কথা সুবিদিত যে, বাবর তার পিতা ওমর শেখের আকস্মিক মৃত্যুর পর ১৪৯৪ সালে মাত্র বারো বছর বয়সে ফারগানা (Farghana) নামক একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সে সময় ফারগানা প্রদেশটি চারপাশ দিয়ে আক্রান্ত হচ্ছিল, বিশেষ করে তার কাকা সুলতান আহমেদ মির্জা, তার মামা সুলতান মাহমুদ খানের সহায়তায় ক্রমাগত ফারগানায় আক্রমণ শানাচ্ছিলেন। কিন্তু ভাগ্য, দৃঢ়তা ও প্রজাদের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ মনোভাব বুকে নিয়ে বাবর এই সব আক্রমণ সফলভাবে মোকাবিলা করেন ও আক্রমণকারীদের বাধ্য করেন তাঁর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রাজি হতে।

পরবর্তী দশ বছর ধরে বাবর দু’দুবার সমরখন্দ জয় করেছিলেন। যদিও মাঝে কিছু সময়ের জন্য সমরখন্দ হারাতেও হয়েছিল তাকে। যাই হোক, প্রথম বার ১৪৯৭ সালে যখন তিনি ছিলেন পনেরো বছরের কিশোর, তখন সাত মাসের অবরোধের পর তিনি সমরখন্দ জয় করেছিলেন। এ-ব্যাপারে সমরখন্দের তৈমুরীয় শাসক বইসনগর মির্জার শিবিরে সে সময় চলা বিবাদ খুব কাজে এসেছিল, কারণ সেই বিবাদের সুবাদে বইসনগর মির্জার ভ্রাতা স্বয়ং বাবরের পক্ষ নিয়েছিলেন। বইসনগর শাইবানি খানের কাছ থেকে বারংবার সাহায্য প্রার্থনা করেন, শাইবানি খান তাতে সাড়াও দেন, কিন্তু বাবরের পক্ষ অধিক শক্তিশালী দেখে তিনি পিছু হটেন। সমরখন্দের মানুষও সে সময় বাবরকে উষ্ণ আহ্বান জানায়। যদিও অচিরেই সেই উন্মাদনা উবে যায় কারণ শহরের তৎকালীন খাদ্যাভাব ও অর্থাভাব পূরণ করার ক্ষমতা বাবরের ছিল না। সেখানে লুঠ করার মতো কিছু না থাকায় বাবরের ভাড়াটে মোঙ্গল যুদ্ধবাজরাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তাদের অনেকেই বাবরকে ছেড়ে ফারগানার আরামের জীবনে ফিরে যায়। এরপর হঠাৎ গুরুতর অসুখ ও তারই এলাকায় তার বিরুদ্ধে সংগঠিত ষড়যন্ত্র বাবরের পরিস্থিতি খারাপ করে তোলে এবং তিনি বাধ্য হন সমরখন্দ পরিত্যাগ করতে। এরই মধ্যে বাবরের এক ভ্রাতা জাহাঙ্গির মির্জা বাবরের কয়েকজন ভাড়াটে যুদ্ধবাজকে ফারগানা শহরে মোতায়েন করে দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, আর অন্যদিকে শহরের কিছু অংশ দখল করে নেন বাবরের মামা মাহমুদ খান। এভাবে সমরখন্দ হারানোর পরপরই বাবর তার নিজের সাম্রাজ্যও হারাতে বাধ্য হন। নিদারুণ বেদনায় বিদ্ধ বাবর তার সেই সকল মামাদের কাছে সাহায্যের প্রার্থনা করতে থাকেন। যারা তাকে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।

বাবর যখন এভাবে তার অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত, তখন সমরখন্দে শুরু হয়। আর-এক ষড়যন্ত্রের খেলা। সেখানকার তৈমুরীয় সুলতানের মাতা-সম্পর্কিত এক উজবেক রমণী তাঁকে বিবাহ করার প্রতিদানস্বরূপ শাইবানি খানকে সমরখন্দ দখল করবার আহ্বান জানান এবং তার নিজ সন্তানকে সেখানে কোনো লাভজনক পদে বসানোর প্রস্তাব দেন। শাইবানি খানের কাছে এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল যা কাজে লাগিয়ে তিনি মাওয়ারা-উন-নাহারের আপাত প্রধান হয়ে যান এবং বুখারা অঞ্চলটাকেও করায়ত্ত করেন। শাইবানি খানের এই বাড়বাড়ন্ত রোধ করতে আসরে নামেন বাবর মধ্য এশিয়ার রাজনীতি এবং ভারত অভিমুখে বাবরের আগমন এবং সমরখন্দবাসীদের সহায়তায় স্বল্প কয়েকজন সেনা সহযোগে তিনি সমরখন্দ পুনরায় অধিকার করে নেন (১৫০১)। বাবর বলেছেন, সমরখন্দে উজবেকরা এতটাই ঘৃণ্য ছিল যে সমরখন্দবাসীরা তাদের কুকুরের মতো লাঠি-পাথরের আঘাতে মেরে ফেলেছিল। কিন্তু বাবরের প্রতি সমরখন্দবাসীদের কেবল এই সমর্থনটুকু যথেষ্ট ছিল না। উজবেকদের হটানোর জন্যে দরকার ছিল অন্য তৈমুরীয় শাসকদের সাহায্য। বাবরের সে আবেদনে সাড়া দেওয়া তো দূরের কথা, হিরাটের তৈমুরীয় সুলতান বইকারা তখনও বুখারা অঞ্চল আঁকড়ে থাকা শাইবানি খানের কাছে উলটে কূটনৈতিক দূত প্রেরণ করলেন। বাবরের মাতৃপক্ষের আত্মীয় মোঙ্গল খানেরা অল্প কিছু সাহায্য পাঠালেন ঠিকই, কিন্তু এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে, একটা নিজস্ব সাম্রাজ্য থাকলে যে পরিমাণ বৈভব বিকশিত হয় ও তা অন্যান্য সাহায্য পেতেও সাহায্য করে, তা বাবরের কাছে না থাকার ফলে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শাইবানি খানের নেতৃত্বাধীন উজবেকদের মোকাবিলা করে তার সাফল্য অর্জনের সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল না। তবে বাবর তাঁর এই দুর্বলতার ব্যাপারে খুব একটা সচেতন ছিলেন বলে মনে হয়নি। শাইবানি খান বুখারা থেকে পালটা আক্রমণ শুরু করলে বাবরও সমরখন্দ শহর থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন। যদিও সার-ই-পুল-এর কাছে যুদ্ধে শাইবানি খানের হাতে পরাজিত হন বাবর (১৫০২)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই যুদ্ধের শাইবানি খান বিশেষ জনপ্রিয় উজবেক রণকৌশল বা তুলঘুমা (tulghoma) (চক্রাকারে সৈন্যবাহিনীকে ঘুরিয়ে দিয়ে শত্রুকে পরিবেষ্টিত করা) পদ্ধতির প্রয়োগ করেছিলেন, যা বাবরকে আমরা পঁচিশ বছর পর ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধেও ব্যবহার করতে দেখি। যাই হোক, পরাজয় মেনে নিয়ে সমরখন্দে ফিরে আসেন বাবর। কিন্তু তিনি কোনো তরফ থেকেই কোনো সাহায্য পাচ্ছিলেন না, শহরে আবার শুরু হয় খাদ্যাভাব, একের-পর-এক তার ভাড়াটে যুদ্ধবাজরা (বেগ) চলে যেতে শুরু করে। এমন অবস্থায় বাবরের কাছে শাইবানি খানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। যদিও বাবর এমনটা চাননি, তবুও শান্তি চুক্তির একটা শর্ত হিসাবে ঠিক হয় যে বাবরের জ্যেষ্ঠ ভগিনী খানাজাত বেগমের সঙ্গে শাইবানি খানের বিবাহ সংগঠিত হবে। কিন্তু এই বিবাহ বাবর তথা তৈমুরীয়দের সঙ্গে শাইবানি খানের বিরোধের ফাটল মেটাতে পারেনি। বরং শাইবানি খান ক্রমাগত ওই অঞ্চলের অন্যান্য তৈমুরীয় সাম্রাজ্যগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে উঠে-পড়ে লাগেন।

এমতাবস্থায় বাবর পুনরায় সাম্রাজ্যহীন হয়ে পড়েছিলেন আর এই পরিস্থিতিকে তিনি নিজেই বলেছিলেন অত্যন্ত দারিদ্র্য ও অবমাননাকর। এবার তাঁর ভোগান্তির আর শেষ রইল না। অবশেষে উজবেকদের ক্রমবর্ধমান আতঙ্কের সামনে মোঙ্গল খানরা জেগে উঠলেন এবং বিশাল বাহিনী সহযোগে তারা শাইবানি খানকে প্রতিহত করতে তাসখন্দ থেকে ফারগানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। বাবরের মতো মোঙ্গল খানরাও আশা করেছিলেন উজবেকদের বিরুদ্ধে তৈমুরীয় শাসকরা তাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন। সে সম্ভাবনা আঁচ করেই চতুর শাইবানি খান তড়িঘড়ি ৩০,০০০ ঘোড়া নিয়ে আরচিনের কাছে মোঙ্গল খানদের আটকাতে ছুটে যান। আর তারপরেই দুপক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। মোঙ্গল ও তুর্কিদের মধ্যে হওয়া অন্যতম বড়া এই যুদ্ধে মোঙ্গল বাহিনী চূড়ান্তভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় (১৫০৩) এবং মোঙ্গল খানদের অনেককেই বন্দি করা হয়। এরপর শাইবানি খান মোক্ষম চাল চাললেন। মোঙ্গল খানদের প্রাণে না মেরে তিনি মুক্তি দিলেন এবং প্রতিদানে তাঁদের সাথে বৈবাহিক আত্মীয়তার সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে তিনি নিজের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির বহর আরও অনেকটা বাড়িয়ে নিলেন। এর পাশাপাশি তিনি তাঁর উজবেক বাহিনীতে ৩০,০০০ মোঙ্গল সেনা অন্তর্ভুক্ত করে নিতেও দেরি করলেন না।

সার-ই-পুল ও আরচিনের যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে সমগ্র ট্রানসঅক্সিয়ানায় তৈমুরীয় ও মোঙ্গল উভয় শক্তির বিরুদ্ধেই উজবেকদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হল। বাবরও বুঝতে পারলেন এই পরিস্থিতিতে এই অঞ্চলে তাঁর অবস্থা শোচনীয়। তাই আর দেরি না করে একটা সাহসী পদক্ষেপ নিলেন এবং প্রবল শীতে হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে কাবুল (১৫০৪) ও গজনি আক্রমণ তথা দখল করলেন। কাবুলের গুরুত্ব যথাযথভাবেই বাবর সহ তার অভিজাত দল, এমনকি তার ভাড়াটে যুদ্ধবাজরাও (বেগ) বুঝেছিলেন এবং এবার তারা বাবরের ওপর ভরসা করতেও শুরু করেছিলেন। বাবরের কাছে এই কাবুল জয় যে কেবল ক্রমাগত উজবেক আক্রমণের ঝড় থেকে একপ্রকার পরিত্রাণ ছিল তাই নয়, আধুনিক লেখক রাশব্রুক উইলিয়ামস (Rushbrooke Williams) এর মতে, বাবরের কাছে দুটো রাস্তাই মাত্র খোলা ছিল, হয় পশ্চিমে সমরখন্দের দিকে পুনরায় অগ্রসর হওয়া, নতুবা পূর্বে হিন্দুস্তানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা। নিজ স্মৃতিগ্রন্থে বাবর লিখেছেন, ‘কাবুল হল হিন্দুস্তান ও খুরাসনের মধ্যবর্তী কেন্দ্র। ১৫০৫ সালে তিনি তার কাকা সুলতান হুসেন বইকারার আমন্ত্রণে হিরাট। অভিযান করেন, কারণ সুলতান বইকারার অধিকৃত খাওয়ারাজম (KhawaraZm) অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল উজবেকরা, তাই তিনি চাইছিলেন বাবরকে সঙ্গে নিয়ে উজবেকদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালাতে। কিন্তু এই সময়েই সুলতানের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে এবং তার দুই সন্তান মোটেই সুযোগ্য না হওয়ায় ও উজবেকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সদর্থক না থাকার কারণে বাবর বাধ্য হন, কাবুলে প্রত্যাবর্তন করতে।

বলাই বাহুল্য, সুলতানের সন্তানদের এই দুর্বলতার কথা আন্দাজ করতে দেরি করেননি শাইবানি খান। তিনি দ্রুত হিরাট দখল করে ওই অঞ্চলের তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের শেষ আশার প্রদীপখানিও প্রশমিত করে দেন। এবার হয়তো সোজা কাবুলের ওপর উজবেক আক্রমণ ধেয়ে আসতে চলেছে এই আশঙ্কায় বাবর চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাই তাঁর অনুগামীদের মনোবল ধরে রাখার উদ্দেশ্যে ১৫০৬ সালে তিনি ঘোষণা করলেন, এবার থেকে তার অনুগামীরা তাকে ‘পাদশাহ’ (Padshah) বলে সম্বোধন করবে। এই পদক্ষেপ আরও একবার প্রমাণ করল যে তৈমুরীয় রাজবংশ এখনও সমূলে উৎপাটিত হয়ে যায়নি। তাই যেসব চাঘতাই ও মোঙ্গল জনজাতির মানুষ, রাজপুরুষ, বেগ-গণ এখনও তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত, তাদের আনুগত্যের অগ্নিপরীক্ষা দেওয়ার সময় এসেছে। যদিও বাবর এতকিছু ভেবে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয় না। সে সময় ‘পাদশাহ’ কথাটির যথেষ্ট চল ছিল মধ্য এশিয়ায়। বাবর তার স্মৃতিকথায় সমরখন্দ জয়ের পরবর্তী পর্বে তথা অন্যন্য বহু সময়ে তার অনুগামীদের দ্বারা তাকে ‘পাদশাহ’ সম্বোধন করার কথা নিজেই উল্লেখ করেছেন।

ঠিক এই সময়ে উজবেকরা প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। খুরাসনের ওপর উজবেক আক্রমণ ধেয়ে আসার ফলে ইরানে সাফাভিদদের প্রতিপত্তিতে কোনো বিপদ আসতে পারে, এই আশঙ্কায় শাহ ইসমাইল সাফাভি শাইবানি খানের বিরুদ্ধে। আক্রমণ হানেন। মার্ভের কাছে যুদ্ধে (১৫১০) উজবেক বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং স্বয়ং শাইবানি খানকে যুদ্ধে নিহত শবদেহের মিছিলে মৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়। যে পারস্যের সুলতানকে তাঁর পূর্বপুরুষ সুফি সন্ত হবার কারণে শাইবানি খান একসময় ‘ভিক্ষুক দরবেশ’ বলে অপমান করেছিলেন, সেই সুলতান শাহ ইসমাইল শাইবানি খানের মৃত্যুর পর তার মাথার খুলি সোনায় মুড়ে পেয়ালা বানিয়ে ঘরে রাখার আদেশ দিয়ে কার্যত প্রতিশোধ নিলেন।

উজবেকদের এই পরাজয় বাবরকে আবার সমরখন্দে নিজের ভাগ্য পরীক্ষার একটা সুযোগ এনে দিল। কিন্তু, আমু-দরিয়া (অক্সাস) নদীর কাছে এসে বাবর উজবেকদের একটা যুদ্ধে হারিয়েও এটা বুঝতে পারলেন যে ট্রানসঅক্সিয়ানা থেকে উজবেকদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ঘটানোর মতো ক্ষমতা এখন তার নেই। তাই তিনি শাহ ইসমাইলের দরবারে দূত প্রেরণ করলেন। শাহ ইসমাইল ইতিমধ্যে শাইবানি খানের মৃত্যুর পর বাবরের ভগিনী খানাজাদ বেগমকে উজবেক শিবির থেকে সসম্মানে উদ্ধার করে বন্ধুত্বের মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। আর যদিও-বা উজবেকদের সঙ্গে শাহের পূর্বে সম্পাদিত এক চুক্তি অনুসারে অক্সাস নদী তাদের উভয়ের সাম্রাজ্যের সীমানা হিসাবে নির্ধারিত ছিল, তবুও ট্রানসঅক্সিয়ানা থেকে উজবেকদের উৎখাত করার ব্যাপারে তৈমুরীয়দের সাহায্য করতে তার কোনো বিড়ম্বনা ছিল না, কারণ তার বিশ্বাস ছিল এভাবে তাঁর সাম্রাজ্যের পাশেই গজিয়ে ওঠা উজবেক নামক একটা বিপদকে চিরতরে বিলীন করে দেওয়া সম্ভব হবে। তবে বাবরকে সাহায্য করার প্রতিদানস্বরূপ তিনি দাবি করলেন, বাবর যেন শাহের নামে খুবা পাঠ করেন, মুদ্রায় শাহের নাম উল্লেখ করেন এবং নিজ সাম্রাজ্যে শিয়া ধর্মমত প্রচার করেন। এই নিয়ম কেবল পারস্যের সাহায্য নিয়ে জয় করা এলাকাগুলোর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে এবং আফগানিস্তান ও তার পিতৃভূমি ফারগানায় বাবর নিজের নামেই মুদ্রা (সিক্কা) উৎকীর্ণ করতে পারবেন।

বাবর প্রাথমিকভাবে এই শর্তগুলো মেনে নিয়েছিলেন। পারসিক সেনার সহায়তায় এরপর তিনি বুখারা ও পরে সমরখন্দ উজবেকদের থেকে ছিনিয়ে নিতে পেরেছিলেন। সমরখন্দের মানুষ ও বেগ-রা পুনরায় বাবরকে সাদরে গ্রহণও করে নিয়েছিল। তিনি এবার পারস্যের ওপর নির্ভরতা ঝেড়ে ফেলতে ও নিজেকে স্বাধীন হিসেবে জাহির করতে পারসিক সেনাদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু পারস্যের অধিপতি বাবরকে তার অধীনস্থ শাসক রূপেই দেখতে চাইছিলেন। তাঁর প্রাত্যহিক কাজকর্মের ওপর সমরখন্দে নিযুক্ত পারসিক প্রতিনিধির নজরদারি বিষয়টা বাবর মেনে নিতে। পারেননি। সকলেই নিশ্চিত ছিল যে ৰাবর যথার্থ সময় ও সুযোগ বুঝে শাহর নামে খুৎবা পাঠ ও সিক্কা উৎকর্ণের প্রতিশ্রুতি বর্জন করবেন ও নিজেকে স্বতন্ত্র শাসক হিসাবে ঘোষণা করবেন। শুধু উজবেক আতঙ্কের কথা মাথায় রেখে বাবর চেষ্টা করতেন শাহর সঙ্গে সখ্যতাটুকু বজায় রাখতে। বেশিরভাগ স্থানীয় সমস্যার সময়েই বাবরকে শিয়া বা কিজিলবাসদের (Kizilbash) বিশেষ পারসিক পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখা যেত। তবে শিয়াদের বিশ্বাসকে সমর্থন করে সুন্নি ধর্মগুরুদের ওপর নির্যাতন চালানোর প্রবণতাকে বাবর কখনোই প্রশ্রয় দেননি।

সমরখন্দে নিযুক্ত ইরানীয় প্রতিনিধি তথা শাহ-র খাস লোক মহম্মদ জান ইশাক গোপনে শাহকে জানিয়ে দেন যে বাবর বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছেন। এ-কথা জানতে পেরে অত্যন্ত ক্রোধে শাহ বাবরকে শায়েস্তা করতে একদল পারসিক সেনাকে প্রেরণ করেন। সেই সেনা সমরখন্দে আসার পূর্বেই উজবেকরা হানা দেয় ও বুখারা দখল করে নিয়ে বাবরকেও এক যুদ্ধে অনায়াসে পরাজিত করে। নীরব ও অসহায় শহরবাসীই ছিল যার কেবল সঙ্গী, তার পরাজয় ছিল অনিবার্য, তাই আবার বাবরকে পরাজয়ের গ্লানি সঙ্গে নিয়ে সমরখন্দ পরিত্যাগ করতে হল ও আমু-দরিয়ার অপর প্রান্তে হিসার-এ সরে যেতে হল। কিন্তু উজবেকদের দাপটে বাবরকে শায়েস্তা করতে আসা পারসিক সেনাদল উলটে বাবরের পক্ষ নিয়েও কোনো সুবিধে করার সুযোগ পায়নি। তারাও পরাজিত হয়ে যাওয়ায় আমু-দরিয়া নদী আবারও পারস্য ও উজবেকদের সীমানারেখায় পরিণত হল। বাবরের কাছে ট্রানসঅক্সিয়ানা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না, তাই তিনি তিন বছরের ব্যবধানের পর কাবুলে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হলেন।

তৃতীয়বার তথা শেষবারের জন্য বাবর সমরখন্দে প্রবেশের যে চেষ্টা করেছিলেন, তা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। তিনি সমরখন্দ পুনরায় জয়ের জন্যে পারস্যের সামরিক সাহায্য না নিয়ে কেবল নিজ শক্তি ও সামর্থ্যকে এতটাই যথেষ্ট বলে মেনে ভুল করেছিলেন যে বাকি ট্রানসঅক্সিয়ানার খুব বেশি অঞ্চল সেই শক্তি নিয়ে দখল করতে। পারেননি। বরং এই প্রক্রিয়ায় তিনি তার নীতি বিসর্জন দিয়ে এমন সব চুক্তির জাঁতাকলে জড়িয়ে পড়েছিলেন যা তিনি বাস্তবায়িত করতে ও অমান্য করতেও সক্ষম। হননি।

ঠিক একইভাবে পারস্য কর্তৃপক্ষও উজবেকদের প্রকৃত শক্তি ও পালটা আঘাত হানার ক্ষমতাকে আগে থেকে না বুঝে ভুল করেছিল। সে কারণেই শাহ ইসমাইল। ট্রানসঅক্সিয়ানা থেকে উজবেকদের উৎখাত করার অভিযানে বাবরকে নিছকই ব্যবহার করে কার্যসিদ্ধি হবার পর তাকে সহজেই পথ থেকে সরিয়ে দেবার মতো একটা অমূলক পরিকল্পনা করেছিলেন। এইভাবে বাবর ও শাহ-র মধ্যে শিয়া-সুন্নি বিরোধ (যে বিরোধটাই প্রকৃতপক্ষে উভয়ের মধ্যে ছিল পূর্ব থেকে, কিন্তু সেটা পিছনে চলে গিয়েছিল অবলীলাক্রমে)-এর বদলে কেবল একরাশ ভুল বোঝাবুঝি ও অন্তর্দ্বন্দ্বের পরিবেশ বাবরের শেষ সমরখন্দ জয়ের উদ্যোগকে শুরুতেই অস্তমিত করে দিয়েছিল। তবে এই সমগ্র পর্বটার সদর্থক দিক যদি কিছু থেকে থাকে তা হল–এক, বাবর এবার চূড়ান্তভাবে ভারতের দিকে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং দুই, এই ঘটনা উজবেরকদের বিরুদ্ধে তৈমুরীয়-সাফাভিদ শক্তির জাতিগত বিরোধিতা ভুলে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র নির্মাণ করতে সাহায্য করেছিল। তারপর

ভারত অভিমুখে বাবরের অভিযান

বাবরের ভারতভূমি দখল করার স্বপ্ন ছিল অনেকদিনের। যখন তিনি সাম্রাজ্যহীন অবস্থায় ট্রানসঅক্সিয়ানায় ভাগ্য পরীক্ষায় রত ছিলেন, তখন থেকেই তৈমুর কর্তৃক ভারত আক্রমণের কাহিনি শুনে তিনি উত্তেজিত হয়ে যেতেন এবং তৈমুর-অধিকৃত পাঞ্জাব অঞ্চল পুনরায় দখল করে তার নিজ বংশধরদের সেখানে দীর্ঘদিনের জন্য। শাসন করতে রেখে যাওয়ার বাসনা মনের ভিতরে লালন-পালন করতেন। বাবর বলেছেন যে, কাবুল জয় (১৫০৪) থেকে পানিপথের লক্ষ্যভেদ পর্যন্ত সময়ে ‘আমি একবারও হিন্দুস্তান অধিকার করার চিন্তা থেকে বিরত হইনি।’ তিনি আরও বলেন যে, ১৫০৫ সালে কাবুল বিজয় করেই তিনি তৎক্ষণাৎ হিন্দুস্তানের দিকে অভিযান। চালিয়েছিলেন এবং নিঙ্গনাহার জেলা (বর্তমান জালালাবাদ) পর্যন্ত পৌঁছেও গিয়েছিলেন। পরের বছর আবারও একটা অভিযান তিনি সংঘটিত করেছিলেন বলে জানান। যদিও এগুলো যতটা না বাবরের ভারত আক্রমণের পরিকল্পিত প্রস্তুতি ছিল, তার থেকে বেশি ছিল প্রান্তিক আফগান জনজাতিভুক্ত মানুষদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের। জন্যে হানা দেওয়া এবং তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। তাছাড়া আমরা আগেই দেখেছি সমরখন্দে বাবরের তৃতীয় ও অন্তিম অভিযান (১৫১১) ব্যর্থ হবার পর বাবর ভারতের তুলনায় মধ্য এশিয়ার প্রতি বেশি মনোযোগী ছিলেন। তিনি যে প্রথম দিকে ভারতে অভিযান চালাতে চাননি তার সপক্ষে যুক্তি দিয়ে নিজেই লিখেছিলেন, “কখনো আমার যুদ্ধবাজ বেগদের আশঙ্কা, কখনো আমার ও আমার ভ্রাতাদের সঙ্গে মতবিরোধ আমায় বাধা দিয়েছে কিন্তু এটা ছিল আংশিক ব্যাখ্যা। আসলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন, উজবেকদের শক্তির পুনরুত্থান ও নিজের ক্রমবর্ধমান আর্থিক সমস্যা প্রবল। আকার না নিলে বাবর শেষবারের মতো সমরখন্দ অভিযান পণ্ড হবার পর পাঞ্জাব তথা ভারতের দিকে অবিলম্বে ঝুঁকতেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উঠেছিলেন বাবর এসময়। তার যুদ্ধবাজ সেনাদল ও আমির ওমরাহদের ভরণপোষণের খরচ চালানো শুধুমাত্র কাবুল থেকে যেটুকু আয় হচ্ছিল, তাতে সম্ভব ছিল না। কাবুল থেকে মূল আয়টা আসত আমদানি ও রপ্তানির ওপর। আরোপিত বিশেষ শুল্ক বা তমঘ (tamgha) থেকে। কিন্তু বাকি সব এলাকার বেশিরভাগটাই ধ্বংসগ্রস্ত থাকায় বাবর বাধ্য হয়েই তার সমর্থক যুদ্ধপ্রিয় জনজাতিকে সজীব রাখতে লুণ্ঠন অভিযান নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু তাতেও সমস্যা মিটছিল না। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায় যখন বাবর ট্রানসঅক্সিয়ানা থেকে একপ্রকার বিতাড়িত হয়ে চলে আসার পর বহু তুর্কি ও মোঙ্গল জনজাতির আইমাক [aimaq]) মানুষ তার দলে ভিড়তে ও তার অধীনে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করতে চাইছিলেন। বাবর এদের অস্বীকার করতে পারতেন না, কারণ ১৫১৪ সালে চালডিরনের (Chaldiran) যুদ্ধে অটোমানদের হাতে শাহ ইসমাইল সাফাভি পরাজিত হবার পর উজবেকরা নতুন উৎসাহে খুরাসন দখলে যেভাবে উদ্যত হয়ে উঠেছিল তাতে কাবুলের ওপর নবশক্তিতে বলীয়ান উজবেক আঘাত ঘনিয়ে আসার আশঙ্কা বাবরকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। তখন এদের সাহায্যেই অবরুদ্ধ ও বারংবার ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও বাবর শেষমেশ কান্দাহার দখল করতে পেরেছিলেন (১৫২২)। তিনি বাদাখশান-এও নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু এসব করতে গিয়ে বাবরকে বিশাল সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের মধ্য এশিয়ার রাজনীতি এবং ভারত অভিমুখে বাবরের আগমন চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। ঐতিহাসিক আবুল ফজল বাবরের এই আর্থিক সঙ্কটকে ব্যাখ্যা করে লিখেছেন যে, তিনি (বাবর) বাদাখশান, কান্দাহার ও কাবুল-এ শাসন করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তার সেনাবাহিনীর জন্যে প্রয়োজনীয় আয় সেখান থেকে হয়নি; বস্তুত বেশ কিছু সীমান্তবর্তী এলাকায় সেনা নিয়ন্ত্রণের ও শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্যে যে খরচ হত তা মোট আয়ের থেকে কার্যত বেশি ছিল।

১৫১৮ সালে বাবর বাজাউর-এর দুর্গ আক্রমণ করে কবজা করেন, তারপর দখলে নেন পার্শ্ববর্তী ঝিলাম নদীর তীরবর্তী ভিরা যা ছিল সল্ট রেজের কিছু পরে। সিন্ধু নদের পরে পশ্চিম দিকে এই দুই এলাকাই ছিল প্রথাগতভাবে কার্যত ভারতের নিরাপদ সীমানা, যাকে বাবর নিজের বলে দাবি করলেন এই কারণ দেখিয়ে যে এই এলাকা নাকি একদা তৈমুরের সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। তিনি এই অঞ্চলকে ‘একদা তুর্ক অধিকৃত হওয়ার দরুন নিজ এলাকা’ বলে মনে করে আদেশ জারি করলেন– (এখানে) আর কোনো সেনা অভ্যুত্থান বা লুণ্ঠন করা হবে না। তবে এটা মনে রাখা ভালো যে এই আদেশ কেবলমাত্র সেই এলাকার জন্যেই ছিল যেখানে কোনো গণপ্রতিরোধ দেখা যায়নি। নাহলে পূর্বেই বাজাউরে আফগান জনজাতির কিছু মানুষজন প্রতিরোধ করতে গেলে তাদের নির্মমভাবে হত্যা ও ঘরের মেয়ে শিশুদের বন্দি করার নির্দেশ দিতে পিছপা হননি বাবর।

এইভাবে বাজাউর দখলের মধ্য দিয়ে বাবরের সুযোগ বুঝে পাঞ্জাব জয়ের প্রচেষ্টার সূচনা ঘটল। বাবর নিজেই বলেছেন– এই সময় থেকে ৯২৫ হিজরি (১৫১৯) পর্যন্ত আমি সক্রিয়ভাবে হিন্দুস্তানের ঘটনাপ্রবাহের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতাম। আমি সেখানে সাত বা আট বছরে অন্তত পাঁচ বার সেনার নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়েছিলাম। পঞ্চম বারের অভিযানটা ছিল ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে।

যদিও বাবর তার ভারত জয় করার আকাঙ্ক্ষা প্রথম থেকেই ছিল বলে জানিয়েছিলেন, তবুও এটা বলতেই হবে যে, তাঁর এই আকাঙ্ক্ষা ক্রমাগত নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছিল। সবার আগে তার প্রাথমিক চেষ্টা ছিল পাঞ্জাবের সেই সব অংশ দখল করা যেখানে তিনি তাঁর বংশগত অধিকার দাবি করেছিলেন। তাই ভিরা অধিকার করবার পরই তিনি ইব্রাহিম লোদিকে দূত মারফত বার্তা পাঠিয়ে একদা তৈমুরের অধিকারে থাকা এলাকাগুলো তার কাছে হস্তান্তর করার আর্জি জানান। ইব্রাহিম লোদির তরফ থেকে এ-ধরনের প্রস্তাব মেনে নেবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। আর হলও তাই, লাহোরের প্রাদেশিক শাসক দৌলত খান, লোদি যার নিয়ন্ত্রণে ছিল বাজাউর ও ভিরা, বাবর-দূতকে লাহোরেই আটকে দিলেন, দিল্লি যেতে দিলেন না। বাবরের কাবুল ফিরে আসার আগেই দৌলত খান লোদি হিন্দু বেগ সহ বাবর কর্তৃক তার দাবি করা এলাকাগুলোতে নিযুক্ত আধিকারিকদের দ্রুত উৎখাত করে দিলেন।

এরপর বাবর একাধিকবার উত্তর-পশ্চিম উপজাতিভুক্ত এলাকায় ও পাঞ্জাবে আক্রমণ চালিয়েছিলেন। ১৫২০ সালে তিনি পুনরায় ভিরা দখল করে শিয়ালকোট পর্যন্ত এগিয়েছিলেন, কিন্তু ইরানের মিত্র কান্দাহারের আরখুন শাসকরা পালটা আক্রমণ জানালে বাবরকে আবার কাবুল প্রত্যাবর্তন করতে হয়। কিন্তু আমরা দেখি এর পরেই বাবর কান্দাহার ও বাদাখশান অধিকার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ১৫২৪-এ তিনি আফগানিস্তানে নিজের কর্তৃত্বকে মজবুত করতে পেরেছিলেন। এবার তিনি পাঞ্জাবের সামনে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলেন। বস্তুত বলা ভালো এবার দিল্লির শাসক ইব্রাহিম লোদিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাতে আর কোনো দ্বিধা থাকল না বাবরের। আর এখান থেকেই ক্ষেত্র প্রস্তুত হল পাঞ্জাব তথা সমগ্র উত্তর ভারত অধিকার নিয়ে এক অবিস্মরণীয় সংগ্রামের।

১. একজন সম্ভ্রান্ত অভিজাত তথা ‘তারিখ-ই-রশিদি’ গ্রন্থের লেখক মির্জা হায়দার দুঘলত এ-প্রসঙ্গে আলোকপাত করে বলেছিলেন, প্রয়োজনের খাতিরে যতই বাবর প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে গিয়ে রীতিমতো সুন্নি মতাদর্শের প্রতি অবিশ্বাস প্রদর্শন করে কিজিলবাসদের (বা শিয়া) পোশাক পরিধান করুন না কেন, মানুষ যথার্থভাবেই এই প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছিল যে, যে মুহূর্তে তিনি সমরখন্দের সিংহাসনে আরোহণ করবেন ও সুন্নি মহম্মদির তাজ মাথায় পরবেন, সে মুহূর্তেই তিনি শাহ-র অধীনতা পরিত্যাগ করবেন।

২. এই হত্যাকাণ্ডের সমর্থনে বাবর যুক্তি দিয়েছেন, বাজাউবিসরা ছিল বিদ্রোহী এবং ইসলামের শত্রু। এবং যেহেতু মূর্তি উপাসক হিসাবে তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিধর্মী প্রথা প্রচলিত ছিল তার ফলে ইসলামের নামটাই মুছে যেতে বসেছিল। কিন্তু উইলিয়াম রাশব্রুক মনে করেন যে বাবরের এই সন্ত্রাসের ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল যেসব আফগান উপজাতিরা তার পথে বাধা সৃষ্টি করছে, তাদের সেই ভাবেই শিক্ষা দিতে হবে যা তারা বোঝে।

৩. এই পাঁচটি অভিযান সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি আছে। আবুল ফজলের মতে এগুলি ১৫০৫ ও ১৫০৮-এর মধ্যে সংঘটিত হয়, অন্যদিকে ফেরিস্তা মনে করেন যে বাজাউর-ভিরা অভিযানই প্রথম হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *