কাকের মাংস

কাকের মাংস

নগর বিশ্রুত এক মদ্যপের কথা অনেকেই জানেন। তিনি প্রতি সন্ধ্যায় গেলাসে একটু একটু করে পানীয় ঢালতেন আর অল্প পরেই কাঁদতে শুরু করতেন, ‘আমার কী যে হয়েছে, যত খাই তবু আমার কিছুতেই নেশা হয় না!’ অল্প খাওয়ার পরেই তার এই দুঃখ শুরু হত এবং তারপরে ক্রমশ খেয়ে যেতেন, ফলত নেশা বেড়ে যেত আর ‘নেশা হয় না’ বলে আরও বিলাপ জুড়ে দিতেন।

যখনই নটবর হালদারের কথা মনে পড়ে, আমার সঙ্গে সঙ্গে উপরের কাহিনীটি মনে পড়ে যায়। নটবর হালদার পাগল হতে চেয়েছিলেন। তাঁকে কে যেন বলেছিল কাকের মাংস খেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। বহু কষ্টে তিনি একটি কাক সংগ্রহ করেছিলেন। তারপর যথারীতি সেটাকে কেটে মাংস রান্না করে খেয়েছিলেন। খেতে কেমন লেগেছিল ভগবান জানেন, কিন্তু তারপর থেকে দৈনিকই তিনি যেভাবে হোক একটি কাক ধরে এনে তার মাংস খেতেন। আর কেবলই আক্ষেপ করতেন, ‘কী করে যে পাগল হব বলুন দেখি? কাকের মাংস খেলে নাকি পাগল হয়? কত যে কাকের মাংস খেলাম, ধরতে গেলে প্রতিদিনই একটা করে কাক রান্না করে খাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না আমার।’

নটবরবাবুর কিছু হল না বটে, কিন্তু নটবরবাবুর পাড়ার লোকেরা পাগল হয়ে উঠলেন। জবাই করা কাকের পালক রাস্তায় ফেলে দিতেই জগৎসংসারের যেখানে যত কাক ছিল নটবরবাবুদের পাড়া মনোহরপুকুরে এসে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। আর সে কী চেঁচামেচি, হাজার হাজার কাকের চিৎকারে কান পাতা যায় না। ছাদে ছাদে কাক, প্রত্যেক জানলার আলসেয় কাক, ল্যাম্পপোস্টে আষ্টেপৃষ্ঠে কাক সব তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, কাকের চিৎকার ছাড়া ঘন্টার পর ঘন্টা কিছু শোনা যাচ্ছে না; আর যত কোলাহল বাড়ছে দূর দূর থেকে আরও আরও কাক চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে আসছে।

দিনের পর দিন এইরকম চলল। পাড়ার লোকে অস্থির, শুধু নটবরবাবুরই ভ্রুক্ষেপ নেই। বহু লোক পাড়া ছেড়ে চলে গেল, পাড়ার মধ্যে দুটো স্কুল ছিল বন্ধ হয়ে গেল, মনোহরপুকুরে বাড়ি ভাড়া কমতে কমতে দুই কামরার ফ্ল্যাট পনেরো টাকা মাসিক এসে দাঁড়াল। পাড়ার দু’-একজন প্রভাবশালী লোক ওপর মহলে নালিশ জানাল। কিন্তু তাঁরা কেউই কিছু করতে সক্ষম হলেন না।

কোথাও এমন কোনও আইন নেই যার বলে কাকের মাংস খাওয়ায় বা রাস্তায় কাকের পালক ফেলায় বাধা দেওয়া যেতে পারে। একজন পরামর্শ দিলেন, পশুক্লেশ নিবারণী সমিতির কাছে যান। কিন্তু পশুক্লেশ নিবারণী সমিতি কী করবে? তাঁরা একটা চিঠি দিলেন নটবরবাবুকে, ‘কাকের মতন এমন নিরীহ পাখিকে প্রত্যহ হত্যা করা অতি গর্হিত কাজ। অন্তত আপনার মতো সদাশয় ব্যক্তির পক্ষে!’

নটবরবাবু পরদিনই জবাব দিলেন, ‘আমি মোটেই সদাশয় নই। আমাকে ঘাঁটাবেন না মশায়রা, আমি পাগল হতে চাই, তাই কাকের মাংস খাই। আর কাক মোটেই নিরীহ পাখি নয়, তা হলে তাদের অত্যাচারে আমাদের পাড়ার লোকেরা বাড়ি ছেড়ে চলে যেত না। তা ছাড়া বহুদিন ধরে মানুষ হাঁস-মুরগি এসব কেটে খাচ্ছে, আগে সেটা প্রতিরোধ করুন, তারপর আমাকে বলবেন।’

বলা বাহুল্য, এরপর পশুক্লেশ নিবারণী সমিতি আর একটুও এগোয়নি। তবে পাড়ার লোকের পীড়াপীড়িতে থানা থেকে একদিন লোক এসেছিল। ঠিক একদিন নয়, দু’দিন এসেছিল। একদিন দিনের বেলায়, কিন্তু সেদিন কাকের ভিড় ঠেলে হরকিষেণ জমাদার এবং তাঁর সঙ্গীরা মনোহরপুকুরে ঢুকতে না পেরে ফিরে যায়। পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় এল।

কিন্তু পুলিশই বা কী করবে? তারা নটবরবাবুকে অনেকরকম ভয় দেখাল। তিনিও নাছোড়বান্দা, ভয় পাবার লোক নন। আর পুলিশের কী ক্ষমতা আছে এ ব্যাপারে। কেউ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু কেউ পাগল হওয়ার চেষ্টা করছে, তার জন্যে ধরে নিয়ে যাওয়ার বিধান কোনও পুলিশ-সংহিতায় নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *