আমার ভাগ্য

আমার ভাগ্য

আমাদের পাড়া থেকে ফুটবল খেলার মাঠে যেতে পথে একটা বাজার পড়ত। সেই বাজারের মধ্য দিয়ে আমরা কয়েকটা কাপড়ের দোকানের ঝাঁপের নীচ দিয়ে খেলার মাঠ যাতায়াতের পথে শর্ট-কাট করতাম।

একদিন সন্ধ্যাবেলা দুই দলের খেলোয়াড়, রেফারি ইত্যাদি সমেত প্রায় আঠারো উনিশজন। আমরা একসঙ্গে ফিরছি, আমার হাতেই ফুটবল, আমার কণ্ঠস্বরই সবচেয়ে গমগমে। যখন সেই কাপড়ের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে যাচ্ছি, এক বুড়ো মুসলমান ভদ্রলোক এত ছেলের মধ্যে তীক্ষ্ণ চোখে যাচাই করে নিয়ে আমাকে ডাকলেন। তিনি দোকানদার নন, ক্রেতা। একগাদা ছোট বহরের ডুরে শাড়ি সামনে নিয়ে বাছাই করছেন। তিনি আমাকে ডেকে দাঁড় করিয়ে ভাল করে দেখে দোকানিকে বললেন, ‘হ্যাঁ, এইরকমই লম্বা হবে’ এবং এই বলে একটা শাড়ি তুলে নিয়ে আমার কোমরের কাছে ধরে পায়ের পাতা পর্যন্ত বিস্তৃত করে দেখলেন; ‘আরেক সাইজ বড় চাই’ বলতেই দোকানদার আরেক রঙিন ডুরে শাড়ি এগিয়ে দিলেন, এটা একটু বড়। আবার বুড়ো ভদ্রলোক আমার কোমরের কাছ থেকে মাপ নিলেন এবং খুশি হয়ে সেটাই পছন্দ করলেন।

এতক্ষণ আমি ফুটবল হাতে বিমূঢ় হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। পুরো ঘটনাটা মিনিট দেড়েকের মধ্যে ঘটে গেল। কোনও এক দূর গ্রামের অপরিচিতা বালিকার সঙ্গে সম-উচ্চতাসম্পন্ন হওয়ার জন্যে তার শাড়ির মাপ দেওয়ার কাজে আমাকে ব্যবহার করা হল; আমার চার পাশে তখন দেড়-ডজন বন্ধু আমাকে ঘিরে রয়েছে, অনেকেই মুখ টিপে হাসছে।

তখন আমার বারো-তেরো বছর বয়েস হয়েছে। বালকত্ব পার হয়ে প্রায় প্রথম যৌবনই বলা যায়। এই সময়ে এই ঘটনায় আমার পৌরুষ যেভাবে আহত হয়েছিল, বিশেষ করে বান্ধব-সমাজে আমার মর্যাদা যেভাবে পতিত হয়েছিল, তা হয়তো এখন আর কাউকে বোঝানো যাবে না।

আমার জীবনে চিরকালই এইরকম হয়ে আসছে। চিরকাল আমার আশেপাশের লোকেরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় এমন সমস্ত বিষয়ের সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে দিয়েছে যা কল্পনা করাই কঠিন।

একবার আমার বারান্দায় রাত বারোটা থেকে শুরু করে একেবারে ভোর হওয়া পর্যন্ত দুটো হুলো-বেড়াল এমন ঝগড়া করল, তিনবার বিছানা থেকে উঠে দরজার বার হাতে নিয়ে তাড়িয়ে দিলাম, তবু আবার ফিরে এসে ঘুরে ঘুরে সারারাত ধরে কর্কশ কন্ঠে ঝগড়া করেই চলল; সেই রাতে একবিন্দু ঘুম হল না। কিন্তু ভেবে দেখুন পরদিন সকালবেলায় শুনলাম বাড়িসুদ্ধ লোক, এমনকী পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশিনী পর্যন্ত বললেন যে কাল রাতে আমি নাকি এমন মাতলামি করেছি যে পাড়াসুদ্ধ লোকের সারা রাত ঘুম হয়নি।

হায় ঈশ্বর, কী করে বোঝাব! কী করে বোঝাব যে, কালীপুজোর রাতে মুখে ভুষো কালি মেখে, কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে পাড়ার মোড়ে যে লোকটা থানার জমাদারসাহেবকে ভয় দেখিয়েছিল সে আর যেই হোক আমি নই, সে রকম যোগ্যতাই আমার নেই। কী করে বোঝাব যে, যে-কুকুরটা পাগল হয়ে ধনপতিবাবুকে কামড়িয়ে দেয়, সেই কুকুরকে আমি মাঝে মাঝে সকালবেলা বাসি রুটি খাওয়াতাম বটে কিন্তু সেই জন্যে সে পাগল হয়নি; কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে আমি কখনও জানতামই না যে কুকুরটা ভবিষ্যতে পাগল হতে পারে, পাগল হয়ে ধনপতিবাবুকে কামড়াতে পারে। এ ব্যাপারে আমার যে কোনও প্ররোচনা, অভিসন্ধি, কলাকৌশল ছিল না, পাড়ার কেউই বিশ্বাস করতে চায় না, আমাকে আড়ালে পেলেই হেঁ হেঁ করে হেসে বলে, ‘দাদা, আপনার মতো তুখোড়…।’

সেই কবে এক সরল গ্রাম্য ভদ্রলোক শাড়ির মাপ দিয়ে শুরু করেছিলেন, তারপর থেকে সারাজীবন ধরে যা নয় তাই। চিরকাল আমি শিশুদের ভালবেসেছি, আর স্বকর্ণে আড়াল থেকে শুনেছি, শিশুর মায়েরা শিশুদের ভয় দেখাচ্ছে, ‘সাবধান, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, না হলে এখুনি তারাপদকে ডেকে আনব’, এবং তারপর স্বচক্ষে পর্দার পিছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখেছি, ভয়ে নীল হয়ে শিশুরা প্রাণপণ খেয়ে নিচ্ছে। একবার দু’বার নয়, এ রকম ঘটনা পৌনঃপুনিক দশমিকের মতো আমার জীবনে ঘুরে ঘুরে বারবার।

না হলে কেউ বিশ্বাস করতে পারে, এই কয়েকদিন আগে চিৎপুর আর লালবাজারের মোড়ে সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে বাড়ি ফেরার জন্যে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলাম আবার সেই একই ঘটনা ঘটল। কিংবা বলা উচিত, তার চেয়েও মারাত্মক।

চিৎপুরের এই মোড়টায় কয়েকটা দোকান আছে যেখানে চামড়ার বেল্টে লাগানো ঘুঙুর বেচে। আমি জানতাম এগুলো নর্তকীরা নাচবার সময় পায়ে পরে নেয়। সেইখানে এক দোকানে এক অভিজাত চেহারার ভদ্রলোক ওইরকম একটা ঘুঙুর লাগানো বেল্ট কিনছিলেন, হঠাৎ তাঁর কী মনে হল, তিনি বেল্টটা হাতে করে নিজের গলায় একবার লাগিয়ে নিয়ে তারপর আমাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেই ঘুঙুরটা শক্ত করে ধরে, ‘দাদা, কিছু মনে করবেন না’, শুধু এইটুকু ভূমিকা করে আমার গলায় লাগিয়ে গর্দানের মাপ নিলেন। আমি তো বিস্মিত, অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, এই মোটা ঘাড়ের মাপের গোদা পায়ের নর্তকী কেমন করে নাচবে? আমার বিস্মিত ভাব দেখে ভদ্রলোক নিজেই ব্যাখ্যা করলেন, তাঁর প্রিয় ছাগলের গলার মাপটা নাকি তাঁর নিজের গলার চেয়ে একটু চওড়া, প্রায় আমার গর্দানের মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *