শেফালি

শেফালি

তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের বাংলা শারদীয়া সংখ্যাগুলিতে কবিতার পাতার একটা অনিবার্য আকর্ষণ ছিল। প্রধান কবিরা সেইসব পুজো সংখ্যায় লিখতেন, আমরা তরুণ কবিরা হা পিত্যেশ করতাম তাঁদের পাশে আমাদের কবিতা দেখার জন্যে। এবং কখনও কখনও বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ত।

বেড়ালের কথা নয়। ফুলের কথা বলি।

অনেককাল, অন্তত পঁয়ত্রিশ বছর আগের একটা শারদীয়া সংখ্যা, খুব সম্ভব কোনও দৈনিক কিংবা তখনকার সাপ্তাহিক পুজো সংখ্যা। কবির নাম খুব সম্ভব কিংবা নিশ্চয় দীনেশ দাস। সেই কবিতার প্রথম দুই পঙ্‌ক্তি, এতদিন পরে স্মৃতি থেকে উদ্ধার করছি, যদি ভুল হয়, আমি ক্ষমা চেয়ে। নিচ্ছি।

‘শরৎ শেফালি পড়ে ঝরে,

তার সাথে কোনদিন ঝরিনি অঝোরে।’

এতকালের কথা, অবশ্যই আমার স্মৃতি আমাকে প্রতারণা করতে পারে। এমনও হতে পারে উদ্ধৃত প্রথম পঙ্‌ক্তির দ্বিতীয় শব্দটি শেফালি ছিল না, ছিল শিশির।

কিন্তু এতকাল পরে এতে আর কিছু আসে যায় না। এতদিন বাদে, এই তিনযুগ পরে শেফালি ফুলের অমল সৌরভ হঠাৎ ফিরে আসে। রবীন্দ্রনাথ এক সাহসিকার কথা বলেছিলেন। আকুল আশ্বিনে, মেঘে ঢাকা দারুণ দুর্দিনে সেই সাহসিকা পায়ে নুপুর বেঁধে ঝঞ্ঝার মধ্যে পথে বেরিয়েছিলেন। কবি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘এ ঝড়ে কি বাঁধা রবে কবরীর শেফালি মালিকা?’

মহাকবির ভুল প্রশ্ন। শেফালি বাঁধা থাকে না, শেফালি ঝরে যায়, প্রতি রাতে শয়নে-স্বপনে ঝরে যায়। বকুল ছাড়া আর কোনও ফুল এমন অঝোরে ঝরে না।

কিন্তু বকুল সারাদিনই ঝরে। আর শেফালি ঝরে রাতের গভীরে, গোপনে, অগোচরে। ভোরের সূর্য ওঠার আগে শরৎ বা হেমন্তরজনীর শিশিরবিন্দুর সঙ্গে।

তা ছাড়া বকুল পোড়খাওয়া ফুল। ঝরে যাওয়ার পরেও সে টিকে থাকে। বাসি বকুলের গন্ধ আমাদের উন্মনা করে ফেলে।

শেফালি ক্ষীণায়ু। কোমলতনু। সংস্কৃতে শেফালি ফুলের সমাসজাত অর্থ হল যাতে ভ্রমর শয়ন করে। শেফ মানে হল শয়নকারী আর অলি হল ভ্রমর। শেফালি ফুল হল অলির বিছানা। এমন ব্যঞ্জনা শুধু সংস্কৃত শব্দেই সম্ভব।

শুনেছি আমাদের উপমহাদেশের পশ্চিম উপকূলে গুজরাটে, পুরনো সিন্ধু প্রদেশে শেফালি ফুলকে বলা হয় পারিজাত ফুল। পারিজাত কোনও সাধারণ ফুল নয়। সমুদ্র মন্থনে সেই আদি যুগে দেব-দানবের মিলিত প্রয়াসে দেবতরু পারিজাত উঠে এসেছিল। পারি হল সমুদ্র, সেই সমুদ্র থেকে জাত, পারিজাত, পরিষ্কার পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস।

শেফালিকে আমরা পূর্ববঙ্গে, আমাদের গ্রামদেশে শেফালিই বলতাম। পশ্চিমবঙ্গে শিউলি বলে। আমি বলি না। শিউলি কেমন যেন সাদামাটা, ঘরগৃহস্থ। কেমন যেন বাড়িউলি, মুড়িউলির মতো মনে হয়। আমার বাঙাল কানে একটু খটকা লাগে।

এবার শেফালি ফুলের বর্তমানে চলে আসি। নিউ ইয়র্কে পূর্বী নদীর তীরে পূর্বপাড়া, ইস্ট রিভারকে পূর্বী নদী বলেছিলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী, সেই বিখ্যাত কবিতা ‘ডুবে যাওয়া মানহাটানের পাশে। এক ধারা অশ্রুজল।’ ঘরের কাছে শান্তিনিকেতনে রয়েছে পূর্বপল্লী। অনেক গ্রামে, মফস্বল শহরেও আছে পূর্বপাড়া অথবা পুবের পাড়া। ঠিক সেই রকম কলকাতায়ও সম্প্রতি একটা পূর্বপল্লী গজিয়ে উঠেছে, যার সরকারি নাম বিধাননগর, খবরের কাগজে লবণহ্রদ আর লোকমুখে সল্টলেক।

আমার বর্তমান বসবাস এইখানে। এই কথাটা এখানে এল এই কারণে যে এত শেফালি ফুলের গাছ আর কোথাও দেখিনি। পাড়ায় পাড়ায়। বাড়িতে বাড়িতে, পার্কের মধ্যে। রাস্তার ধারে শুধু শেফালি আর শেফালি, অগুনতি শেফালি।

বর্ষার শুরুতেই দুয়েকটি গাছে ফুল ফুটতে শুরু করেছিল, আর আজ এই শেষ হেমন্তেও অধিকাংশ গাছই ফুলবন্তী।

সারারাত টুপটুপ শেফালি ঝরে পড়ে। ভোরবেলায় ঘাসের ওপরে শিশিরভেজা শেফালি, হিমেল হাওয়ায় তার সৌরভ। হিন্দি ভাষায় শেফালিকে বলে হরশৃঙ্গার, দেবাদিদেবের পুষ্প সজ্জার জন্যে প্রকৃতি এই ফুল রচনা করেছিল। সেই সৌরভে মহাদেবের পুষ্পশৃঙ্গারের আভাস মেলে।

সকালবেলায় শেফালি ফুলের গন্ধে কেমন একটা উদাস উদাস ভাব। কত কালের পুরনো স্মৃতি ফিরে এসে মনের মধ্যে ভিড় করে। আমার প্রতিবেশীরা প্রায় সবাই প্রৌঢ়, অবসরপ্রাপ্ত। ঝরে পড়া শেফালির ঘ্রাণে অবসরের দিন ভরে ওঠে। রোদ বাড়তে ঘাসের ওপর ফুলগুলোর ওপরে শিশির শুকিয়ে যায়, ফুলগুলো নেতিয়ে পড়ে। মৃদু করুণ গন্ধ ভাসে কাছাকাছি বাতাসে।

ছোট বয়েসে এই ফুলগুলো কুড়িয়ে আমরা মালা গাঁথতাম। শেফালি ফুলের বোঁটা ছিঁড়ে হলুদ রঙে কাপড় রাঙাতাম। শেফালি ফুলের গাছের নীচে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সে যে এই তো সেদিন।

এই লেখাটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। দোষ শেফালির। দোষ আমার নয়। দোষ প্রকৃতির, দোষ বাতাসের। গত বসন্তের দক্ষিণা হাওয়া বর্ষায় এসে পূরবৈয়া হয়েছিল এখন সে উত্তরে ঘুরছে। তবে এখনও মন স্থির করতে পারেনি। কখনও আমার বাঁদিকের জানলার ওপাশে শেফালি গাছের পাতাগুলোর আলতো করে বিলি কেটে দিচ্ছে, আবার পরমুহূর্তেই জোরে ঝাঁকি দিয়ে কয়েকটা ফুল মাটিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

সেই হাওয়া, ঝরা শেফালির হাওয়া, এই লেখাতেও এসে একটু লেগেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *