6 of 8

অনুভব অথবা ভাল লাগা

অনুভব অথবা ভাল লাগা

সখি, অনুভব কাকে বলে এ বিষয়ে আমার কাছে কেন জানতে চাইছ? বিদ্যাপতি নামে এক চিরদিনের কবি লিখেছিলেন, ‘সখি হে কি পুছসি অনুভব মোয়।’ বিদ্যাপতি যে অনন্ত অনুরাগ, অসীম ভাল লাগার কথা বলেছিলেন, যে অমোঘ বেদনা আমাদের সামান্য না পাওয়াকে চিরন্তনের মর্যাদা দেয় এই তরল, ক্ষণজীবী রচনায় সেই অমৃত রস পানের, অনুভবের কথা কেন? ভাল লাগার কথা কেন?

একটা গল্প বলে বিষয়টাকে একটু হালকা করে নিই। এই চিরদুঃখিনী মহানগরীর এক বাসিন্দা, আমাদেরই মতো তাড়িত, ক্লিষ্ট, জীর্ণ এক নাগরিক জুোতর দোকানে জুতো কিনতে যান। রং, চামড়া, ডিজাইন বেশ খুঁটিয়ে পছন্দ করার পরে এবং পায়ে দিয়ে যথার্থ ফিট হয়েছে কিনা পরীক্ষা করে ভদ্রলোক দোকানদারকে বললেন, ‘বাঃ চমৎকার। এবার এই জুতো জোড়া রেখে দিন, এটা লাগবে না। ঠিক এই রকম, এই রঙের এক সাইজ কম নম্বরের জুতো এক জোড়া দিন।’

দোকানদার বললেন, ‘সাইজ কম কেন? জুতো কি অন্য কারও পায়ের জন্যে?’ ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বললেন, ‘না, না। আমার জন্যেই জুতো কিনছি।’ বিস্মিত দোকানদারের মুখের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক ম্লান হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল, ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না?’ দোকানদার বিনীতভাবে ঘাড় নেড়ে জানালেন যে এক সাইজ কম মাপের জুতো কেনার ব্যাপারটা তাঁর মোটেই বোধগম্য নয়।

বর্ষার দুপুরবেলা এমনিতেই কেনা-বেচা কম, তা ছাড়া কয়েকদিন ধরে প্যাচপেচে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জুতোর দোকানে ক্রেতা বলতে ওই ভদ্রলোক আর দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন দোকানদার নিজে। নতুন খদ্দের এই মুহূর্তে আসার সম্ভাবনাও কম। সুতরাং কম সাইজের জুতোর এই আশ্চর্য এবং অভিনব খরিদ্দারের কাছে কারণটা জানতে দোকানদার উৎসাহী হলেন।

ক্রেতা ভদ্রলোক যা বললেন তা অবশ্য খুব অবান্তর নয়। ভদ্রলোক সকালে ঘুম থেকে উঠে দুধের ডিপোতে যান দুধ আনতে। সেখানে কখনও হাঁটুজলে, কখনও বৃষ্টিতে আবার অন্য ঋতুতে কোনও কোনও দিন বেশ বেলা পর্যন্ত রোদুরে ঠায় দাঁড়িয়ে কখনও দুধ পান, অধিকাংশ দিন পান না। শূন্য বোতল হাতে যখন বাড়ি ফিরে আসেন তখন গ্যাস ও কেরোসিনহীন কয়লার ধোঁয়াভর্তি রান্নাঘর থেকে গৃহিণী যে অভ্যর্থনা জানান তা শুনে মনে হয় যেন দুধটা তিনি ইচ্ছা করেই আনেননি অথবা বোতলের দুধ স্বার্থপরের মতো একা একা রাস্তায় পান করে শূন্য বোতল নিয়ে বাড়ি ঢুকেছেন। এদিকে কাল সারারাত লোডশেডিং ছিল, অসহ্য গরম এবং তীক্ষ্ণ মশার অত্যাচারে দুর্বিষহ রাত্রি গেছে। এখন সকালে কলে এক বিন্দু জল নেই। এর পরে আছে সাংঘাতিক বাজার, ভিড়ের ট্রামের রুদ্ধশ্বাস পাদানিতে অফিস যাত্রা, সেই ট্রাম বেলাইন, অফিস লেট, উপরওলার তিরস্কার। যে অফিসে তিনি কাজ করেন সেখানে তাঁকে ক্যাশ কাউন্টারে বসতে হয়। সেখানে খুচরোর অভাব, পাবলিকের বদমায়েশি, কটুক্তি, অশ্লীল গালাগাল এবং কখনও কখনও প্রহারের চেষ্টা।

ভদ্রলোক সময় পেয়ে এবং মনের মতো শ্রোতা পেয়ে জুতোওলাকে তাঁর দৈনন্দিন গ্লানির ফিরিস্তি প্রাঞ্জলভাবে বোঝালেন। দোকানদার তো বাইরের পৃথিবীর লোক নন, তিনি এসব সমস্তই জানেন, মোটামুটি এসব ঝামেলা তাঁকেও নিত্য পোহাতে হয়। তবে কখনও পর পর এভাবে সময়ানুযায়ী তালিকা করে ভেবে দেখেননি। কিন্তু তা হলেও এর সঙ্গে কম সাইজের জুতো কেনার সম্পর্কটা কী তিনি ধরে উঠতে পারলেন না। যাই হোক, তিনি উঠে গিয়ে আগের ফিট হওয়া মাপের চেয়ে এক সাইজ কম মাপের জুতোজোড়া নামিয়ে এনেছেন। বহু কষ্টে ক্রেতা ভদ্রলোক জুতোজোড়া পায়ে গলালেন। একেবারে পায়ে চেপে বসে গেছে, মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে তাঁর।

দোকানদার এতক্ষণে ধরে নিয়েছেন তাঁর এই ক্রেতা বেচারি নিতান্ত পাগল, হয়তো এবার বলবে যে এই দুর্দিনে সামান্য দু’-এক টাকা দাম বাঁচানোর জন্য তিনি এক সাইজ কম মাপের জুতো খরিদ করতে যাচ্ছেন। কিন্তু দোকানদারকে স্তম্ভিত করে খদ্দের ভদ্রলোক যা বললেন, তাতে তাঁকে পাগল বলে কার সাধ্যি।

সেই ছোট জুতো পায়ে জোর করে ঢুকিয়ে প্রায় ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে জুতোর দোকানের কার্পেটের উপর হাঁটতে হাঁটতে ক্রেতা ভদ্রলোক দোকানদারকে বললেন, ‘একবার ভেবে দেখুন তো সারা দিন কষ্ট করে এই জুতো পায়ে দেওয়ার পরে দিনের শেষে যখন এই জুতোজোড়া পায়ের থেকে খুলব তখন কী আরাম, কী শান্তি, কী আনন্দ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুধ বন্ধ, জল বন্ধ, লোডশেডিং, গাদাগাদি ভিড়, গর্ত, কাদা, গালাগাল, অপমান। কোথাও তো এক বিন্দু শান্তি, এক বিন্দু সুখ নেই, শুধু আপনার এই এক সাইজ কম মাপের জুতোজোড়াই আমাকে সন্ধ্যাবেলা এক দণ্ড শান্তি, এক দণ্ড সুখ দেবে।’ শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যায় জীবনানন্দ দাশের ক্লান্ত পথিককে শ্ৰীমতী বনলতা সেন দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিলেন। সে বহুকাল আগের কথা। কলকাতার এই দুঃস্থ নাগরিক, বিদ্যাপতি বা জীবনানন্দ দাশের কাছে কিছু পাওয়ার অধিকারী নন, শুধু টাইট জুতো পা থেকে খুলে ফেলার যে আনন্দিত অনুভব, সারা দিনের শেষে এক দণ্ড সেটুকু পেলেই তিনি খুশি।

অনুভব বিষয়টি খুব জটিল এবং আপেক্ষিক। একই মুহূর্তে একই বিষয়ে আপনার অনুভব আর আমার অনুভব এক রকম নাও হতে পারে।

আমার এক বাল্যবন্ধু, অনেকদিন পরে তার সঙ্গে দেখা গত বছর, অনেক কথা হল, হঠাৎ সব শেষে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর লোডশেডিং ভাল লাগে না?’ শুধু এই নয় আমার এক বউদির জুতোর কালির গন্ধ ভাল লাগে, আমার ভাইয়ের পোড়া পাঁউরুটি খেতে ভাল লাগে, এমনকী নিশুতি মধ্যরাতে দূরের বাড়ির ছাদে হুলো বেড়ালের লড়াই দূরবীক্ষণ যন্ত্র চোখে লাগিয়ে পরম আনন্দের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেন যে ভদ্রলোক তাঁকেও চিনি। মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, ভাল লাগা মানেই নিঃসঙ্গ একাকী হয়ে যাওয়া। হয়তো এই চির-ছন্নছাড়া খামখেয়ালি লেখক নিজের জীবনে আবিষ্কার করেছিলেন যা কিছু ভাল লাগে সবই তাঁর নিজস্ব, নিতান্ত আপন। আমাদের সমস্ত জীবন চলে যায় সেই ভাললাগার অংশীদার খুঁজতে। সেই অমূল্য অংশীদার কখনও আমাদের বন্ধু, কখনও প্রিয়া বা জায়া, কখনও সন্তান, ছাত্র বা শিষ্য।

এক অসফল আধুনিক কবির ভাষায় ভাল আছি মানেই ভাল থাকা। সেই কবির ধারণা ছিল, যেভাবে সাদা মেঘের মধ্যে সন্ধ্যাতারা ভাল থাকে, যেভাবে সবুজ পাতার মধ্যে চন্দ্রমল্লিকা ভাল থাকে হয়তো আমাদের ভাল থাকা কখনওই সে রকম হবে না। তবু যদি ভাবতে পার যে ভাল আছি, তা হলেই ভাল আছ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *