6 of 8

আইনমাফিক

আইনমাফিক

আজকাল একটা কথা খুব চলছে, যা হবার আইনমাফিক হবে। দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে অধুনালুপ্ত এবং একদা বিখ্যাত ‘অচলপত্র’ পত্রিকায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, “রেল স্টেশনগুলিতে ফেরিওয়ালারা ‘গরম চা, গরম চা’ করে চেঁচায় কেন? চা তো গরমই হয়, গরমই হওয়া নিয়ম।” উত্তরটা দীপ্তেন্দ্রকুমার নিজেই দিয়েছিলেন, “হকারেরা ‘গরম চা, গরম চা’ বলে চেঁচায় কারণ চা-টা মোটেই গরম নয়, বেশ ঠান্ডা, তাই চেঁচাতে হয় গরম গরম বলে।”

এই আইনমাফিক ব্যাপারটাও প্রায় তাই দাঁড়িয়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা ভঙ্গ করেননি এমন কোনও গুরুতর দেওয়ানি বা ফৌজদারি আইন নেই। খুন-রাহাজানি, জাল-জোচ্চুরি, হাওলা-গাওলা-ঘুষ এমনকী ব্যভিচার, ধর্ষণ,—সভ্য সংসারে এমন কোনও অপরাধ নেই যা এঁরা এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে করেননি।

এই প্রাতঃস্মরণীয় মহামহিম ব্যক্তিগণ, ভারতীয় রাজনীতির কান্ডারিবৃন্দ, যাঁদের আমার-আপনার মতো নির্বোধেরা রোদে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে, তর্জনী কালিমালিপ্ত করে ক্ষমতায় পাঠাই, তাঁরা যখন সাফাই গান ‘সবকিছু আইনমাফিক হবে’ তার পরিষ্কার অর্থ হল কিছুই আইনমাফিক হবে না। কোনওদিন কিছুই আইনমাফিক হয়নি। এখনও হবে না। কখনও হবে না। আইন অতি জটিল ব্যাপার। অসংখ্যবার দেখা গেছে, নীচের আদালতে কোনও মামলায় যে পক্ষ হারল, জেলা আদালতে তারাই আপিলে জিতল। এরপর আবার আপিলের আপিল। হাইকোর্ট আছে, সুপ্রিম কোর্ট আছে। ইংরেজ আমলে সুপ্রিম কোর্টের স্থলে ছিল ফেডারাল কোর্ট। তারও পরে ছিল প্রিভি কাউন্সিল, সে সেই খোদ বিলেতে। তিমি একটা বিশাল প্রাণী, সেই তিমি মাছকে গিলে খেতে পারে এমন জলচর প্রাণী সমুদ্রে আছে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একটি কাহিণীতে সেই অতিকায় প্রাণীর কথা বলেছিলেন, যার নাম নাকি ‘তিমিঙ্গিল’ এবং সেই তিমিঙ্গিলকে গিলে খেতে পারে এমন প্রাণীও মহাসমুদ্রের গভীরে আছে তার নাম হল তিমিঙ্গিল গিল। এখানেই শেষ নয়, তিমিঙ্গিল গিলকে গ্রাস করতে পারে তিমিঙ্গিল গিলগিল, এইভাবে অনন্ত তিমিঙ্গিল গিলগিল গিল…।

আইনের আঙিনাতেও তাই প্রথমে ছোট আদালত। সুলেখক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত নিজে বিচারক ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন ছোট আদালত মানে ছোটো আর ছোটো, ছুটতে ছুটতে কালঘাম বেরিয়ে যাবে। তা সেই ছোট আদালতের পরে সেজ, মেজ কত আদালত, বড় আদালতে পোঁছে মামলার নিষ্পত্তি হতে একটা জীবন বরবাদ হয়ে যায়। মামলার ঘাড়ে মামলা, আপিলের পিঠে আপিল। একবার এ পক্ষ জেতে, ও পক্ষ জেতে পরের বার। ততদিনে সর্বনাশ হয়ে যায়,— অর্থনাশ, কর্মনাশ, ধর্মনাশ। এসব কথা তো পাঠক-পাঠিকারা সবাই জানেন। একথাও সকলেরই জানা যে মামলা করে কোনও লাভ হয় না। উত্তেজনা বাড়ে, রক্তচাপ বাড়ে, রক্তে শর্করা বাড়ে, হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়। এদিকে টাকা-পয়সা, ধনদৌলত, বাড়ি-জমি সব যায় মামলার গহ্বরে। সাধে কি গ্রামবৃদ্ধেরা কারও ওপরে কুপিত হলে অভিসম্পাত করেন, ‘তোর ঘরে যেন মামলা ঢোকে।’ ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন, এর চেয়ে বড় অভিশাপ আর হয় না।

এক মহিলার কথা জানি। তিনি আমার দূর-সম্পর্কের বউদি, অত্যন্ত দজ্জাল রমণী। আমার সেই সম্পর্কিত দাদার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। বউদির সৌভাগ্যবশত উক্ত দাদা একদিন পথ দুর্ঘটনায় পরলোকগমন করেন। বউদি প্রথামতো কাঁদাকাটি, শ্রাদ্ধশান্তি ইত্যাদি সাঙ্গ করে দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ, স্বামীর সম্পত্তি, জীবনবিমা, অফিসের প্রাপ্যাদি সংগ্রহে মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু আদালতের দরজা দিয়ে সহজে প্রাপ্য আদায় করা যায় না। সেইসময় একদিন সামাজিক ভদ্রতার কারণে বউদির সঙ্গে বিজয়াদশমীর পরে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম বউদি কেমন চুপসিয়ে গেছেন, তাঁর সেই তেলে-বেগুনে ভাব আর নেই, নিতান্ত নিষ্প্রভ। আমি একথা সেকথার পর বউদিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বউদি, দাদার টাকাপয়সা কিছু উদ্ধার হল?’

বউদি বললেন, ‘এক পয়সাও নয়।’ তারপরে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘দ্যাখ খোকন, কী যে ঝামেলা তুই ভাবতে পারবি না! আমার একেক সময় মনে হচ্ছে যে তোর দাদা না মরলেই ভাল হত।’

সত্যের খাতিরে বলা ভাল, আমার এই বউদি এই সময়েই এক মামলায় এক গোলমেলে প্রশ্ন শুনে উকিলবাবুকে বলেছিলেন, ‘আপনার মতো উকিলকে আমি আমার ভ্যানিটি ব্যাগে পুরে রাখতে পারি!’

বউদি অবশ্য স্বীকার করেন না, কিন্তু শুনেছি, সেদিন সদাসতর্ক উকিলবাবু বউদিকে বলেছিলেন, ‘মেমসাহেব, তখন কিন্তু আপনার ভ্যানিটি ব্যাগে আপনার মাথার থেকে অনেক বেশি ঘিলু থাকবে।’

মাননীয়া বউদি যাই বলুন, উকিলবাবুর এই কথা কিন্তু আমরা অস্বীকার করতে পারছি না। আইনের পুরো ব্যাপারটাই ঘিলু তথা বুদ্ধির ব্যাপার। যে উকিলবাবুর যতটা ঘিলু, তাঁর মক্কেল ততটা নিরাপদ।

এক বিদেশি হাস্যরসিক একদা বলেছিলেন, ‘তুমি সাধু না চোর, জোচ্চোর না সৎ সবকিছু নির্ভর করছে যে উকিলবাবু তোমার হয়ে মামলা লড়ছেন, তাঁর ওপরে।’

এই সুযোগে উকিলবাবুদের বুদ্ধির একটা গল্প বলি। খুব পুরনো গল্প।

বুদ্ধির গল্পে খুনের মামলাই প্রকৃষ্ট। পিনাল কোডের দুটি ধারা তিনশো দুই এবং তিনশো চার। তিনশো দুই ধারায় ফাঁসি হতে পারে। তিনশো চার ধারায় মৃত্যুদণ্ড হয় না, দীর্ঘ কারাদন্ড হয়। আইনঘটিত ভয়াবহ টেকনিক্যাল বিষয়, পিনাল কোডের ভাষায় Culpable homicide amounting to murder, এটা হল তিনশো দুই এবং Culpable homicide not amounting to murder—এটা হল তিনশো চার।

এক উকিলবাবু দায়রা আদালতে মামলায় হেরে গেলেন, তাঁর মক্কেলের ফাঁসির হুকম হল। কিন্তু উকিলবাবু তাতেও দমে যাননি। মক্কেলের আত্মীয়স্বজনরা তাঁকে এসে যখন জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কী হল?’

তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘মামলা খুব খারাপ ছিল, তিনশো দুই ধারায় আদেশ নামিয়ে এনেছি, তিনশো চার ধারাতেও সাজা হতে পারত।’

তা হলে খুন ও ফাঁসির গল্পে এসে গেলাম। কোনও গত্যন্তর নেই, আইনমাফিক এই বিষয়টি একটু ছুঁয়ে যেতেই হবে।

বিলিতি জোক-বুকে এক যুবকের গল্প আছে, সে তার মা-বাবাকে খুন করেছিল। সেই খুনের মামলায় যুবকের ব্যবহারজীবী আদালতকে বলেছিল, ‘মাননীয় ধর্মাবতার, আমার মক্কেল, ওই কাঠগড়ায় সরল ছেলেটি আজ অনাথ, এই মামলা একটু অনুকম্পাভরে বিবেচনা করবেন।’ প্রসঙ্গত সাম্প্রতিক চাঞ্চল্যকর, জনচিত্ত আলোড়নকারী নোয়াপাড়া হত্যা মামলার প্রসঙ্গ আসতেই পারে।

প্রিয় পাঠিকা ঠাকুরানি, আপনি বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়, আমি সুদীপার প্রসঙ্গে যাচ্ছি। সদ্য টিন-এজ-অতিক্রান্তা এই নবীনা যুবতী, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলি, যে বয়েসটাকে ইংরেজিতে টিন-এজ বলে, তেরো থেকে উনিশ, (থার্টিন থেকে নাইনটিন) তার অধিকাংশ সময় এই কাণ্ডজ্ঞানরহিতা কারাগার প্রাচীরের অভ্যন্তরে কাটিয়েছে। আপাতত দেখা যাচ্ছে, নোয়াপাড়ার এই হত্যা মামলায় জেলা আদালতের রায় জনসাধারণের মনঃপূত হয়নি। আইনগত এবং নীতিগত উভয় কারণেই আদালতে রায় নিয়ে মন্তব্য বা আলোচনা করা অবশ্যই সমীচীন নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সংবাদমাধ্যম তথা জনসাধারণ দুটো জিনিস ভালভাবে নেয়নি।

প্রথম হল, রাজসাক্ষী হয়ে সুদীপার খালাস হয়ে যাওয়া। এই মামলায় সে-ই মূল অভিযুক্ত। খুনের মামলার প্রধান অপরাধীকে রাজসাক্ষী করা খুব নীতিসংগত নয়। দ্বিতীয় হল, কেমিস্ট কৃষ্ণেন্দু জানার ফাঁসির হুকুম। বেশি কথা না বলে কৃষ্ণেন্দু জানার একটি বক্তব্য একটি পত্রিকায় বেরিয়েছে, সেটি নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। কৃষ্ণেন্দু বলেছে, ‘যাঁরা মারা গেছে তাদের আমি জীবিত বা মৃত কোনও অবস্থাতেই কখনও দেখিনি। অকুস্থল নোয়াপাড়া কোথায় সেটাও আমি জানি না। আর আমার হল ফাঁসির হুকুম!’ মামলাটি এখন হাইকোর্টে এসেছে। জল অনেক দূর গড়াবে মনে হয়। জেফারসন বলেছিলেন, আইনের চেয়ে আইনের প্রয়োগ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ওই মামলার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে, আইনের প্রয়োগ, মনে হচ্ছে, ঠিকমতো হয়নি। এখনও বিচারাধীন এই মামলার বিষয়ে এর বেশি বলতে গেলে আদালত অবমাননার পর্যায়ে চলে যাবে। তার চেয়ে আইনঘটিত হাসির গল্পই ভাল। চুরির মামলার আসামি এক মক্কেল এসেছে উকিলবাবুর কাছে। উকিলবাবু তুখোড় ব্যক্তি, অল্প একটু কথা বলেই বুঝলেন মক্কেলের খুবই দুরবস্থা, টাকাপয়সা কিছু নেই। তিনি সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার ফি দিতে পারবে? মামলার খরচ চালাতে পারবে?’ মক্কেল হাতজোড় করে বলল, ‘হুজুর, আমার টাকাপয়সা কিছুই নেই।’ তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, ‘তবে একটা গোরু আছে।’ উকিলবাবু খুশি হয়ে বললেন, ‘তবে আর কী? ওই গোরুটা বেচেই মামলার খরচ চালাবে, আমার কি দেবে।’ লোকটা একথায় রাজি হয়ে যেতে উকিলবাব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা হলে এবার বলো কী চুরির মামলা? পুলিশ তোমার নামে কী চুরির মামলা দিয়েছে?’ মক্কেল কাঁচুমাচু বলল, ‘ওই যে গোরুটার কথা বললাম, ওই গোরু চুরির মামলা আমার বিরুদ্ধে।’

বয়েস হয়েছে। এসব পচা গল্প লিখতে আর ভাল লাগে না। বরং আমার ব্যক্তিগত খোলামেলা অভিজ্ঞতার কথা বলি। অনেকদিন আগের কথা। কলকাতার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে এক সাহিত্য সম্পর্কিত মামলায় সম্প্রতি প্রয়াত আমার এক বিখ্যাত বন্ধু কাঠগড়ায় উঠেছিলেন। সেদিন আদালতকক্ষে আরও অনেকের সঙ্গে আমিও ছিলাম। সরকারি উকিল আমার সেই বন্ধুকে জেরা করছিলেন, প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কী করেন?’ বন্ধুটি বললেন, ‘আমি একজন কবি।’ সরকারি উকিল বললেন, ‘কীরকম কবি।’ বন্ধু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আমি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি।’ মামলার শেষে আদালতে বারান্দায় বন্ধুকে বললাম, ‘সব সময়ে বিনীত হয়ে থাকিস, আর আদালতে বলে এলি, আমিই শ্রেষ্ঠ কবি।’ তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘কী করব? সত্যি কথাটা বলে ফেললাম। আদালতে শপথ নিয়ে মিথ্যে কথা তো আর বলতে পারি না!’

অধুনালুপ্ত বোম্বাই শহরে বেশ কিছুকাল আগে ‘চুপ, আদালত চলছে’ নামে একটি নাটক খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। বহুশত রজনী অতিক্রান্ত সেই নাটক কলকাতায়ও মঞ্চস্থ হয়েছিল। ওই নাটকের নামের অনুকরণ করে সে সময়ে আমি একটা হালকা রচনা লিখেছিলাম। সেই রচনার গল্পগুলি এখনও যথেষ্ট যুক্তিবহ। একেবারে নার্সারি থেকে শুরু করা যাক। এক প্রাইমারি স্কুলে টিফিনের সময় বাচ্চারা খেলছে। হঠাৎ দুটো বাচ্চা, কৌটিল্যলাল এবং আশ্বিনকুমার (আজকাল এ রকমই নামকরণ হচ্ছে শিশুদের, বিশ্বাস না হলে যে কোনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাজিরার খাতা খুলে দেখে নেবেন), মারামারি শুরু করল এবং পরিণামে দু’জনেই কাঁদতে লাগল। দিদিমনি ছুটে এলেন। ততক্ষণে চতুরানন বলে অন্য একটি ছেলে ওদের মারামারি থামিয়েছে। দিদিমনি এসে দেখলেন কৌটিল্য আর আশ্বিন চোখ মুছছে, আর চতুরানন একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা কমলালেবুর খোসা ছাড়িয়ে ধীরেসুস্থে খাচ্ছে।

‘কী হয়েছে? মারামারি কেন?’ দিদিমনি প্রশ্ন করায় চতুরানন জানাল, ‘কৌটিল্য আশ্বিনের কাছে ওর কমলালেবুর অর্ধেক চেয়েছিল।’ দিদিমনি বললেন, ‘কেন?’ চতুরানন বলল, ‘কৌটিল্য বলছে গতকাল ওর আপেলের অর্ধেক আশ্বিনকে দিয়েছিল, তাই সে আজ আশ্বিনের কমলালেবুর অর্ধেক চেয়েছিল। কিন্তু আশ্বিন দেবে না। তাই নিয়ে ঝগড়া, মারামারি।’ দিদিমনি বললেন, ‘আশ্বিনের সেই কমলালেবুটা কোথায়?’ নিজের হাতের নিশ্চিহ্নপ্রায় লেবুটা দেখিয়ে চতুরানন বলল, ‘এই তো আমি খাচ্ছি!’ দিদিমনি বললেন, ‘যে কমলালেবু নিয়ে ওদের দু’জনের এত ঝগড়া, তুমি খাচ্ছ সেই কমলালেবু?’ চতুরানন দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘আমি যে ওদের উকিল।’

এক বিবাহবিচ্ছেদের মামলার বিষয়েও অনুরূপ গল্প আছে। অলক এবং অলকার দুই ছেলে। তাদের দশ বছরের বিয়ের তিন বছর ধরে ডিভোর্সের মামলার শেষে পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটল। অলকা বলল, ‘অলকের হাত থেকে মুক্ত হয়ে আমি রক্ষা পেয়েছি। সব চুকিয়ে বুকিয়ে দিয়েছি। এক ছেলে এখন আমার কাছে, আরেক ছেলে তার বাবার কাছে।’ একজন শুভানুধ্যায়ী বললেন, ‘কিন্তু তোমরা দু’জনে যে অফিস থেকে টাকা ধার করে সুন্দর ফ্ল্যাটটা কিনেছিলে বেহালায়, সেটার কীভাবে ভাগ হল?’ অলকা বলল, ‘সেটা ভাগ করতে হয়নি। সেটা উকিলবাবু নিয়েছেন।’

ডিভোর্সের ভাগাভাগি নিয়ে আরও একটা গল্প আছে, সেটা একটু মোটা দাগের। বিবাহ বিচ্ছেদের মামলার পর আদালতের নির্দেশে স্বামী-স্ত্রীর সমস্ত বিষয়সম্পত্তির চুলচেরা ভাগ করা হল। কিন্তু বিচারক একটা জায়গায় আটকিয়ে গেলেন, প্রাক্তন দম্পতিকে বললেন, ‘কিন্তু আপনাদের তো তিনটি সন্তান, সেটা কীভাবে ভাগ হবে?’ পুরুষটি ইতস্তত করছিলেন। কিন্তু মহিলা বললেন, ‘কুছ পরোয়া নেই। ডিভোর্স একবছর মুলতুবি রাখুন। আরেক বছর ঘর করি, তখন আরেকটা বাচ্চা নিয়ে চারটে বাচ্চা হয়ে যাবে। সে সময় দু’জনের ভাগে দুটো দুটো করে বাচ্চা দিয়ে দেবেন।’

দাম্পত্য-বিচ্ছেদ নিয়ে আর রসিকতা নয়। এবার আমরা উকিলবাবুর কাছে আবার ফিরে যাই। এক ভদ্রলোক উকিল থেকে হাকিম হয়েছিলেন। তাঁর আদালতে এক প্রতারণার মামলায় আসামিকে কেমন চেনা চেনা মনে হওয়ায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রতারণার মামলায় এর আগেও তো আপনার সাজা হয়েছিল!’

আসামি বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন হুজুর। বিনা দোষে আমার উকিলের জন্যে আমার সাজা হয়েছিল।’

হাকিম বললেন, ‘উকিলের জন্যে সাজা হয়েছিল? বুঝব কী রে?’

‘বুঝবেন না কেন স্যার?’ আসামি মলিন হেসে বলল, ‘সে মামলায় তো আপনিই আমার উকিল ছিলেন।’

এইরকম অন্য একটি মামলায় হাকিম সাহেব বিবাদীকে বলেছিলেন, ‘আপনি বড় উলটোপালটা মিথ্যে কথা বলেছেন, আমার কথা শুনুন, একজন উকিল রাখুন।’ খুবই অর্থপূর্ণ পরামর্শ। মিথ্যে কথাটুকু উকিলবাবুই গুছিয়ে বলবেন, বিবাদীকে উলটোপালটা বলতে হবে না। জানি না আদালতকক্ষে কোনও ব্যবহারজীবী সেইক্ষণে উপস্থিত ছিলেন কিনা, তিনি এই ব্যাপারে কোনও প্রতিবাদ করেছিলেন কিনা। তবে হাকিম সাহেবরাও বিপদে পড়েন। একটু আগের গল্পে তার উদাহরণ আছে। পরবর্তী উদাহরণটি বিশ্ববিদিত।

সুদীর্ঘ ফৌজদারি মামলার শুনানি ও সাক্ষ্যের অবসানে রায়দানের আগে যথারীতি পোড়খাওয়া, ঝুনো আসামিকে হাকিম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি দোষী না নির্দোষ?’ আতার বিচির মতো কালো ঝকঝকে পান-খাওয়া দাঁত, কাঁচা করমচার আধফালির মতো চোখ, হুলো বেড়ালের লেজের মতো গোঁফ কাঠগড়ায় দাঁড়ানো বিবাহবিশারদ যোগীলাল ব্রহ্মচারী, ক্রমাগত বিবাহ করে যাওয়াই যাঁর পেশা, এবারও যিনি সেই পেশাগত কারণে গ্রেফতার হয়েছেন, সেই যোগীলাল অবিচল কণ্ঠে হাকিমকে বললেন, ‘হুজুর, হাকিমসাহেব, আমি দোষী না নির্দোষ সেটা নির্ণয় করার জন্যেই জনদরদি সরকার আপনাকে মাসে মাসে এত টাকা মাইনে দিয়ে পুষছেন। আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনিই বলুন আমি দোষী না নির্দোষ? ভুলে যাবেন না, এর জন্যে আপনি মাইনে পান।’

পুনশ্চ: লম্বা রম্যরচনা এক বিড়ম্বিত ব্যাপার। বিড়ম্বনা শুধু লেখকের নয়, পাঠকের বিড়ম্বনাও কিছু কম নয়। এলেবেলে লেখা কেইবা লিখতে চায়, আর কেইবা পড়তে চায়! আর হাসির লেখা বড় হলেই এলেবেলে হয়ে যায়। অবশেষে আইনমাফিক একটি ঐতিহাসিক কাহিনী দিয়ে বিদায় গ্রহণ করছি।

চার্লস ডিকেন্স শ্রেষ্ঠ ইংরেজ ঔপন্যাসিকদের একজন। তাঁর ছেলে হেনরি বিচারবিভাগে কাজ করতেন। হেনরি এক মামলায় এক দাগী আসামিকে সাজা দেওয়ার পরে সেই আসামিটি চেঁচিয়ে বলে, ‘হেনরি, তোমার বাবার পায়ের নখের যুগ্যিও তুমি নও।’

হতভম্ব হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি আমার বাবার বিষয়ে কী জানো?’

লোকটি বলল, ‘আমি তোমার বাবার অনেক বই পড়েছি।’

হেনরি বললেন, ‘নথিপত্রে দেখছি তুমি সর্বদা হইহল্লা, গুণ্ডামি, মাতলামি করে বেড়াও। বই পড়লে কখন?’

লোকটি বলল, ‘জেলে থাকার সময় জেল লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়েছি। আমি তোমার বাবার লেখা প্রায় অর্ধেক বই পড়ে ফেলেছি।’

হেনরি বললেন, ‘তোমাকে আবার জেলে পাঠাচ্ছি। বাবার বাকি বইগুলো পড়ে শেষ করে ফেলো।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *