5 of 8

চিনা-অচিনা

চিনা-অচিনা

সেই কবে চিনাংশুক থেকে শুরু হয়েছিল, তারপর চিনি, চিনেজবা, চিনেমাটি এমনকী সধবার সিঁথেয় চিনে সিঁদুর। আমি চিনি গো চিনি তারে। চিনেদের সঙ্গে আমাদের বহুকালের চেনা। তাদের আর আমাদের গল্পগুজব হিমালয়ের গিরিপথ ধরে বহুকাল ধরে যাতায়াত করছে দু’দিকে।

সম্প্রতি ইন্দ্র মিত্র ‘রহস্যালাপ’ গ্রন্থে ‘চীনে রঙ্গ’ পরিচ্ছেদে অসামান্য কয়েকটি রসকথিকা বাঙালি পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি মাতালের গল্পও রয়েছে। ‘সিদ্ধি’ দিয়ে যেমন সব শুভকাজের কেনাকাটার সূচনা করতে হয়, তেমনিই মাতাল-কাহিনী শিরোধার্য করে চিনে রঙ্গে প্রবেশ করি।

এক বাড়িতে খুব খানাপিনা হচ্ছে। বিশাল পার্টি। বন্ধুবান্ধব, কাছের-দূরের অতিথি অভ্যাগতে জমজমাট সন্ধ্যা ক্রমশ গভীর রাতের দিকে গড়াচ্ছে। এই সময়ে একজন অতিথি ঘোষণা করলেন, ‘যাদের দূরে চলে যেতে হবে, তাদের এখনই চলে যাওয়া উচিত।’

একথায় কাজ হল। ধীরে ধীরে সবাই যে যার বাড়ির পথ ধরল। শুধু যিনি একথাটা বললেন, তিনি গেলেন না, বাড়ির কর্তার সঙ্গে বসে মদ খেয়ে যেতে লাগলেন। অবশেষে মদ যখন প্রায় শেষ, তিনি আবার ঘোষণা করলেন, ‘যাদের যেতে হবে তাদের এখনই চলে যাওয়া ভাল।’

বাড়ির কর্তা একথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, ‘এ কী কথা? এখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। শুধু তুমি বাকি আছ যাওয়ার, আর কে যাবে ?’

এবার ঘোষণাকারী বললেন, ‘সেই কথাই যে বলছি। আমি তো এখানেই শুয়ে পড়ব, আমাকে তো যেতে হবে না। তোমাকেই এখান থেকে হেঁটে নিজের শোয়ার ঘরে যেতে হবে।’

মাতালের গল্পের মতোই চিনে ডাক্তারের গল্পও চমৎকার। এককালে কলকাতায় চিনে ডাক্তার বলতে দাঁতের ডাক্তার বোঝাত। এই সেদিনও কলকাতার রাস্তাঘাটে পাড়ায় পাড়ায় ‘Chinese Dentist’ লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়ত, এখন আর তেমন দেখি না।

সে যা হোক, এ হল আসল চিনে ডাক্তারের গল্প। চিন দেশের চিকিৎসকের গল্প। এই গল্পে চিকিৎসক মহোদয় নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খুব খারাপ অসুখ, বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

চিকিৎসকমহোদয়ের এক বন্ধু এসেছেন তাঁকে দেখতে। তিনি সেই বন্ধুকে বললেন, ‘দেখো আমার কাছে একটি চমৎকার ওষুধ আছে। যে কোনও অসুখই হোক, যত মারাত্মকই হোক, সেই ওষুধ এক ডোজ খেলে সঙ্গে সঙ্গে রোগমুক্তি। তারপর আর কোনও অসুখ হবে না, হেসে খেলে ফুর্তি করে একশো বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকা যাবে।’

এই কথা শুনে স্বাভাবিক কারণেই বন্ধুটি বললেন, ‘তা হলে তুমি নিজেই খাচ্ছ না কেন অমন আশ্চর্য একটা ওষুধ?’ এই কথা শুনে ডাক্তারবাবু হেসে ফেললেন, বহুদিন পরে হাসলেন, তারপর বললেন, ‘কী বলছ তুমি? কোনও দিন শুনেছ, কোনও বড় ডাক্তার নিজের অসুখে নিজে ওষুধ দিয়েছে? নিজের অসুখ নিজে চিকিৎসা করেছে?’

মাতালের গল্প হল, ডাক্তারের গল্প হল, এরপর চিনে শিল্পীর গল্প।

শিল্পী মানে চিত্রকর, আর্টিস্ট। চিত্রকর মহোদয় নতুন গ্যালারি করেছেন। গ্যালারির দরজার দু’পাশে নিজের এবং নিজের স্ত্রীর ছবি এঁকে টাঙিয়ে দিয়েছেন। হঠাৎ একদিন চিত্রকরের শ্বশুরমশায় এসেছেন। ঘরের সামনে নিজের মেয়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখে জামাতাকে কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ কী? কে এই মেয়েটি? কার ছবি এঁকেছ তুমি ?’

জামাতা বেচারি করজোড়ে বললেন, ‘সে কী চিনতে পারছেন না? এ তো আমার স্ত্রীর, আপনার মেয়ের ছবি।’

এবার পাশের ছবিটির দিকে তাকিয়ে শ্বশুরমশায় বললেন, ‘তাই নাকি! তা হলে তুমি আমার মেয়ের ছবির পাশে একটা অচেনা পুরুষমানুষের ছবি টাঙিয়ে দিয়েছ কেন ?’

চিনে রঙ্গের শেষ নেই। এবারের গল্পে শ্বশুরমশায় নেই, শাশুড়ি ঠাকরুন আছেন। পুরনো যুগের গল্প। তখনও আয়না সহজলভ্য নয়। ঘরে ঘরে আয়না ছিল না।

এদিকে, গ্রামের বাজারে নতুন আয়না এসেছে। শাশুড়ি ঠাকরুন এসেছেন দেখে জামাতা বাবাজীবন বহু ব্যয়ে একটি আয়না কিনে এনেছেন। সেটি তিনি বাজার থেকে ফিরে স্ত্রীর হাতে দিয়েছেন। সেই আয়নায় বউ নিজের মুখ দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল, তারপর আয়নাটা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘মা আমার সর্বনাশ হয়েছে। আমার বর বাড়িতে আরেকজন বউ নিয়ে এসেছে।’

মেয়ের হাত থেকে আয়নাটা নিয়ে শাশুড়ি আয়নাটায় নিজের মুখ দেখতে পেলেন, তিনিও মেয়ের মতোই কেঁদে উঠলেন, ‘ওরে আমাদের সর্বনাশ হয়েছে। ওরে তোর বর কি শুধু আরেকজন বউ নিয়ে এসেছে, এ যে দেখছি আরেকটা শাশুড়িও নিয়ে এসেছে।’

পুনশ্চ: চিনে রঙ্গের অনেকগুলিই পুরনো চেনা গল্প। চেনা অথবা চিনে গল্প। সেই চিনা গল্প দিয়েই শেষ করি।

এ গল্পটির উৎস কোথায় তা জানি না, কিন্তু ছোট বয়সে এ গল্প আমরাও শুনেছি। তবে, ইন্দ্রমিত্র তাঁর ‘চীনে রঙ্গ’ পরিচ্ছেদে যে অসামান্যভাবে পরিবেশন করেছেন এই রসকাহিনী, সে ভাবে আগে শুনিনি। এটাও ডাক্তারের গল্প। এই গল্পের ডাক্তারবাবুর ছেলেও ডাক্তারি পড়ে।

ডাক্তারবাবু ভিন গাঁয়ে রোগী দেখতে গিয়েছেন নদী পার হয়ে। দুর্ভাগ্যবশত সেদিন সেই গাঁয়ে পর পর তিনজন রোগী মারা গেল ডাক্তারবাবুর হাতে। উত্তেজিত গ্রামবাসীরা লাঠিসোটা নিয়ে ডাক্তারবাবুকে তাড়া করে এল। গত্যন্তর না দেখে ডাক্তারবাবু ছুটে গিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তিনি সাঁতার জানতেন, গ্রামবাসীরা জানত না। প্রাণপণে নদী সাঁতরে নিজের বাড়িতে ঢুকে দেখলেন, ছেলে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। ‘কী বই পড়ছ’, জিজ্ঞাসা করায় ছেলে বলল, ‘ডাক্তারি বই পড়ছি।’ ভেজা জামাকাপড় পরে হাঁপাতে হাঁপাতে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘ডাক্তারি বই পড়া দরকার, কিন্তু সাঁতার জানা আরও বেশি দরকার।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *