5 of 8

অ্যালেন গিনসবার্গ

অ্যালেন গিনসবার্গ

অ্যালেন গিনসবার্গ মারা গেলেন। এখনকার সময়ের জীবিত মার্কিন কবিদের মধ্যে তিনি বিখ্যাততম ছিলেন এবং সেটা শুধু কবিত্বের কারণে নয়।

অ্যালেন নোবেল প্রাইজ তো দূরের কথা মার্কিন পুরস্কার পুলিতজার প্রাইজ পর্যন্ত পাননি। তবে পুলিতজারের জন্যে তিনি বিবেচিত হয়েছিলেন এবং গত বছর সেটা অল্পের জন্য পাননি।

অ্যালেনের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে। তাঁর কথাবার্তা, আচার আচরণ নিয়ে গত চল্লিশ বছর ধরে মার্কিন সমাজ আলোড়িত হয়েছে। কখনও সমকামিতার সপক্ষে, কখনও আমেরিকার ভিয়েতনাম নীতির বিরুদ্ধে, কখনও বা বাংলাদেশ যুদ্ধের সমর্থনে অ্যালেন গিনসবার্গের বিবিধ কার্যক্রমের মধ্যে আধুনিক মানুষ এক চিরবিদ্রোহী, প্রতিবাদমুখর সত্তাকে বারবার আবিষ্কার করেছে।

হোয়াইট হাউস তাঁকে সমঝিয়ে চলেছে। রিপাবলিকান হোক বা ডেমক্র্যাট হোক, প্রশাসনের পর প্রশাসন তাঁর কার্যকলাপ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে। কখন, কোন মুহূর্তে অ্যালেন চেঁচিয়ে উঠবেন, ‘এটা কী হচ্ছে?’ এই চিন্তা প্রবল ক্ষমতাশালী মার্কিন প্রশাসনকে শঙ্কিত রেখেছে।

প্রতিবাদের সেই কণ্ঠটি পূর্ব উপকূলের নিউ ইয়র্ক থেকে পশ্চিম উপকূলের সানফ্রান্সিসকো পর্যন্ত যুবমানসকে বারংবার আন্দোলিত করেছে। আমেরিকার বাইরেও তাঁর প্রভাব এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল অকল্পনীয়।

বিপরীত পৃথিবীতে এই সুদূর কলকাতায় আমরাও কয়েকজন তাঁর কাছের মানুষ ছিলাম। যত ক্ষীণই হোক এক মানসিক যোগাযোগ ছিল, আত্মীয়তা ছিল।

অ্যালেন গিনসবার্গ মারা গেলেন এক শনিবার ভোররাতে তাঁর নিউ ইয়র্কের বাসাবাড়িতে আত্মীয়পরিজন পরিবৃত হয়ে। তখন কলকাতায় রবিবার বিকেল, সেই সন্ধ্যাতেই সানফ্রান্সিসকো থেকে আমার ছেলে কৃত্তিবাস ফোন করে জানাল, ‘বাবা, অ্যালেনকাকা বেঁচে নেই।’

পঁয়ত্রিশ বছরের পরিচয়। তখন আমি অবিবাহিত, শীর্ণদেহ এক নবীন যুবক, সবে পাখা মেলেছি। কৃত্তিবাসের আড্ডার সঙ্গে অ্যালেন এবং তাঁর বন্ধু সদাহাস্যময় পিটার অরলভস্কি খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। শক্তি আমাকে ‘টর্পেডো’ বলে ডাকত, আমার কথাবার্তা চালচলন দেখে অ্যালেন এবং পিটারও আমাকে ‘টর্পেডো’ (তারাপদ’র অপভ্রংশ) বলে ডাকা শুরু করল। পরবর্তীকালে নিউ ইয়র্কে আমার সঙ্গে অ্যালেন পিটারের দেখা হয়েছে, তখনও আমি টর্পেডো।

এই পরিসরে অ্যালেনের কবিত্ব বা মহত্ত্ব নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই, আমি একটা ব্যক্তিগত ঘটনার কথা বলি।

ঘটনাটা ঘটেছিল কলকাতায় আমাদের কালীঘাটের পুরনো বাড়িতে। সেই ভাঙা বাড়িতে তখন আমি একাই থাকি। ১৯৬২ সাল, অ্যালেন পিটার এই উভপুরুষ কবিদম্পতি কলকাতায়। সুনীল-শক্তি এবং প্রয়াত শংকর চট্টোপাধ্যায় একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাদের বাড়িতে এল, তাদের সঙ্গে কয়েকটা ট্যাবলেট, যত্নে কাগজে মোড়ানো, অ্যালেন দিয়েছে। নতুন কোনও ড্রাগ বোধ হয় নাম মেসকালিন। ড্রাগ জমানার তখন সবে শুরু। এসব ট্যাবলেট তখন আমেরিকাতেও খুব পরিচিত নয়।

মোট ছয়টা ট্যাবলেট। সুনীল দুটো, শক্তি দুটো, শংকর দুটো, সুনীল জানত আমি কিছুতেই খাব না, তা ছাড়া আমার ওপর গুরু দায়িত্ব ড্রাগ খাওয়ার পর ওদের পর্যবেক্ষণ করা, প্রয়োজন পড়লে ডাক্তার ডাকা কিংবা তেমন অবস্থা হলে রকম বুঝে শ্মশানে বা মর্গে প্রেরণ করা।

সুনীল আর শক্তি জল দিয়ে দুটো দুটো করে ট্যাবলেট খেল, কিন্তু শংকর শেষ পর্যন্ত খেতে সাহস পেল না।

হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে, অসংলগ্ন নানারকম কথাবার্তা বলে কিছুক্ষণ পরে সুনীল আর শক্তি স্তিমিত হয়ে পড়ল। শংকর একটু পরে বাড়ি ফিরে গেল। আমিও খাটের একপাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে সুনীল শক্তি সজ্ঞানে সুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরে গেল। পরে এই ঘটনার বিবরণ সুনীল কোথাও কোথাও দিয়েছে। তবে শক্তির কথাটা মনে আছে? শক্তিকে সকালে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কী রকম বুঝলি?’ শক্তি হেসে বলেছিল, ‘মাথাটা একদম সাফ হয়ে গেছে।’

শংকর যে ট্যাবলেট দুটো রেখে গিয়েছিল সেটা আমি যত্ন করে আমার ওষুধের বাক্সে রেখে দিয়েছিলাম। অ্যালেন যখন জানতে পারল দুটো ট্যাবলেট রয়ে গেছে, সে আমাকে বলল, সাবধানে রেখে দিতে। কলকাতা থেকে যাওয়ার আগে ফেরত নিয়ে যাবে, এই ড্রাগ নিষিদ্ধ এবং দুষ্প্রাপ্য।

আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ট্যাবলেট দুটোর কথা। একদিন খুব ভোরবেলা অ্যালেন আর পিটার এসে উপস্থিত কালীঘাট বাসায়, কাল চলে যাচ্ছে, ট্যাবলেট দুটো ফেরত নিতে এসেছে।

ওষুধের বাক্স খুলে বোকা বনে গেলাম। মনে আছে সাদা, গোল সাধারণ চেহারার ট্যাবলেট, আর দশটা ওষুধের মতোই দেখতে। এখন আর চিনতে পারছি না কোনটা সেই নিষিদ্ধ ড্রাগ। যথাসাধ্য অনুমান করে দুটো ট্যাবলেট বেছে নিয়ে অ্যালেনকে দিলাম, দিয়ে বললাম, ‘যদি খেয়ে দ্যাখো নেশা হচ্ছে না, বুঝবে বাইকোলেটস খেয়েছ। পরের দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ো না যেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *