5 of 8

ভ্রমণকাহিনী (২)

ভ্রমণকাহিনী (২)

‘ডোডো-তাতাই’ কাহিনীমালায় এক জায়গায় আছে, ডোডোবাবু (নাকি তাতাইবাবু) একবার দূরপাল্লার ট্রেনে কোনও দূরদেশ থেকে কলকাতায় ফিরছিলেন। রেলগাড়ির ওই কামরাতেই ডোডোবাবুর সহযাত্রী ছিলেন এক সর্দারজি।

আসানসোল স্টেশন চলে যাবার পরই সর্দারজি চঞ্চল হয়ে উঠলেন, হাওড়া কতদূর, হাওড়া পৌঁছোতে আর কতক্ষণ লাগবে, মুহুর্মুহু প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে ভদ্রলোক ডোডোবাবুসহ অন্যান্য যাত্রীদের অস্থির করে তুললেন।

স্বভাবোচিত ঠান্ডা মাথায় ডোডোবাবু প্রথমদিকে সর্দারজিকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, হাওড়া এখনও দূরে আছে, হাওড়া স্টেশনে আমিও নামব। কিন্তু কে শোনে কার কথা।

ইতিমধ্যে সর্দারজি তাঁর হাতব্যাগ খুলে গুরুমুখী ভাষায় ছাপা একটি রেলওয়ে টাইমটেবিল বার করে ফেলেছেন। দ্রুতগামী এক্সপ্রেস ট্রেনের জানলা দিয়ে ক্রম অপসৃয়মান ছোট স্টেশনগুলির নাম তিনি পাঠ করার চেষ্টা করছেন, পাঠ করতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর টাইমটেবিলে মিলিয়ে নিচ্ছেন, হাওড়া আর কতদূর?

অবশেষে যথানিয়মে ট্রেন বর্ধমান, ব্যান্ডেল পেরোল। উদ্বিগ্ন সর্দারজি তাঁর বিশাল ট্রাঙ্ক, বিপুল বিছানা গাড়ির দরজার কাছে নিয়ে রেখে এসে ফাঁসির আসামির মতো থমথমে মুখে নিজের সিটে এসে বসলেন। শেষ পর্যন্ত উত্তরপাড়া, বালি স্টেশনও পার হয়ে গেল, ঝড়ের বেগে এক্সপ্রেস ট্রেন ছুটছে, কোথাও দাঁড়াচ্ছে না, সর্দারজি আশঙ্কান্বিত হয়ে ডোডোবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাই ট্রেনটা হাওড়ায় দাঁড়াবে তো?’

কামরাসুদ্ধ যাত্রী এই সরল প্রশ্ন শুনে থমকিয়ে গেল। শুধু ডোডোবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা সর্দারজি হাওড়ায় ট্রেনটা না দাঁড়ালে কী হবে?’

উত্তেজিত সর্দারজি বললেন, ‘তা হলে আমার সর্বনাশ হবে।’

ডোডোবাবু বললেন, ‘সর্বনাশ আমাদের সকলেরই হবে। হাওড়ায় ট্রেন না দাঁড়ালে আমরা সবাই মারা পড়ব, ট্রেন স্টেশনের দেয়াল ভেঙে গঙ্গায় গিয়ে পড়বে।’

ভ্রমণকাহিনী পর্বে সর্দারজি বিষয়ক আর একটি নিষ্কলুষ কাহিনী আছে।

দুই সর্দারজি এক নতুন জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে একদিন দুপুরে প্রচুর খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সন্ধ্যায় যখন ঘুম ভাঙল তখন দিগন্তে চাঁদ উঠেছে। সেদিন আবার পূর্ণিমা, বিরাট ঝলমলে চাঁদ। জ্যোৎস্নায় চারদিক ফুটফুট করছে।

গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠে প্রথম সর্দারজি ভাবছিলেন, ‘কতক্ষণ ঘুমিয়েছি, কে জানে। এখন তো মনে হচ্ছে সকাল হয়েছে। সারারাতটা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম নাকি?’

দ্বিতীয় সর্দারজিরও ওই একই চিন্তা। কিন্তু তিনি চুপ করে না থেকে রাস্তায় গিয়ে এক তৃতীয় সর্দারজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাই ওই যে আকাশে গোল থালামতো জিনিসটা উঠেছে, যে জিনিসটা এত আলো দিচ্ছে, ওটা চাঁদ না সূর্য?’

প্রশ্ন শুনে তৃতীয় সর্দারজি বহুক্ষণ ধরে পূর্ণিমা চাঁদটি নিরীক্ষণ করলেন। তারপর বেশ কয়েকবার ঘাড়ে ঝাঁকি দিয়ে বললেন, ‘ভাই আমি এখানে মাত্র এক বছর হল এসেছি। এখানকার ব্যাপার-স্যাপার ভাল বুঝি না। ওটা চাঁদ কি সূর্য সেটা বলতে পারব না।’

পুনশ্চ:

একবার দেওঘরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে বাড়ির কাছেই পাশাপাশি দুটো মুদির দোকান। একটি সাবেকি, পুরনো আমলের দোকান। পাশেরটি নতুন হয়েছে।

যেদিন প্রথম সেই পুরনো দোকানে মালপত্র কিনতে গেলাম, প্রবীণ দোকানি বললেন, ‘সাবধান! পাশের ওই নতুন মুদিখানা থেকে কোনও জিনিস কিনতে যাবেন না।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’

মুদি ভদ্রলোক গলা নামিয়ে প্রায় ষড়যন্ত্রী কণ্ঠে বললেন, ‘ওদের তো দাঁড়িপাল্লা ছিল না। আমাদের পুরনো দাঁড়িপাল্লা কিনে নিয়ে গেছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *