3 of 8

আইনের আঙিনায়

আইনের আঙিনায়

গল্পটা অন্তত একবার লিখেছিলাম আগে, বোধহয় ‘বিদ্যাবুদ্ধি’তে।

ধরে নিচ্ছি, তখন কেউ কেউ হয়তো গল্পটা পড়েননি, আর যাঁরা পড়েছিলেন তাঁরাও ভুলে গেছেন।

গল্পটা একটু সাবধানে লিখতে হবে, আইন-আদালতের ব্যাপার, সামান্য এদিক-ওদিক হলে আর রক্ষে নেই।

এক ব্যক্তি এক ফৌজদারি মামলার উকিলের চেম্বারে এসেছে সন্ধ্যাবেলা। চুরির মামলায় লোকটি গতকালই বহু কষ্টে জামিন পেয়ে হাজত থেকে খালাস পেয়েছে। আগের উকিল তার পছন্দ হয়নি।

খালাস পাওয়ার পর অন্যদের পরামর্শ শুনে সে আজ এই নতুন উকিলের কাছে এসেছে। উকিলবাবু এই লোকটিকে দেখে বুঝতে পারলেন, এর এমন কিছু কথা আছে, যা সর্বসমক্ষে আলোচনা করা যাবে না। লোকটিকে তিনি ইশারায় অপেক্ষা করতে বললেন। উকিলুবাবুর জমজমাট পশার! অনেক রাত হল চেম্বার খালি হতে। অবশেষে শূন্য চেম্বারে মুখোমুখি বসে উকিলবাবু মক্কেলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার কেসটা কীসের?’

লোকটি অম্লান বদনে জবাব দিল, ‘আজ্ঞে চুরির।’

এ রকম জবাব শোনা উকিলবাবুর অভ্যেস আছে। পরবর্তী প্রশ্ন মক্কেলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী চুরির?’

মক্কেল উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে এক কেস বিলিতি হুইস্কির।’

উকিলবাবু একথা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠলেন। তাড়াতাড়ি বললেন, ‘তা কেসটা কোথায়?’ সেই হুইস্কির কেসের তথা চুরির কেসের শেষে কী হল, তা আমরা জানি না। অন্য একটি গল্প জানি।

আদালতে একটা মামলা কতদিন ধরে যে চলে তার ইয়ত্তা নেই। শোনা যায়, কলকাতা হাইকোর্টে এমন সব মামলা আছে, যেগুলি পঞ্চাশ বছরেরও বেশি পুরনো।

সুদর্শনবাবু বলে আমার এক বন্ধু একবার এক গোলমেলে মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। টাকাপয়সা বেশি নেই ভদ্রলোকের, কিন্তু একজন উকিল না-হলে তো মামলা করা যায় না।

আমার পরিচিত একটি ছেলে, আমাদের পুরনো পাড়ার প্রতিবেশীর ছেলে, তখন সদ্য উকিল হয়েছে, গাউন কাঁধে আদালতে যাতায়াত শুরু করেছে। আমি তার কাছে সুদর্শনবাবকে নিয়ে গেলাম। কিন্তু উকিল দেখে সুদর্শনবাবু মোটেই খুশি হলেন না। একেবারেই ভারভারিক্কি নয়, নিতান্ত বাচ্চা উকিল।

উকিলের সামনে মুখে বলেও ফেললেন কথাটা সুদর্শনবাবু। ‘তুমি এত তরুণ, এত অল্পবয়সি, তা আমি ভাবিনি। তুমি কি আমার মামলাটা করতে পারবে?’ ‘তুমি’ করেই বললেন সুদর্শনবাবু।

তরুণ উকিলটি কিন্তু সহজে মক্কেল ছাড়বার পাত্র নয়। একবার আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে তারপর সুদর্শনবাবুকে বলল, ‘আগে দেখুনই না মামলাটা কতদিন ধরে চলে, মামলা শেষ হতে হতে আমি প্রবীণ হয়ে যাব।’

আদালতি সময়ের আরও একরকম ব্যাপার আছে।

এক মারামারির মামলা চলছে আদালতে। সাক্ষীর জেরা শেষ হতে হতে দেড়টা বাজল। এবার কিছুক্ষণ বিরতি। এরপর আবার আড়াইটের সময় আদালত বসবে। তখন উকিলবাবুরা যাঁর যাঁর বক্তৃতা পেশ করবেন। তবে সাক্ষীর জেরা হয়ে যাওয়ার পরে মামলার আর বিশেষ কিছু থাকে না। মোটামুটি বোঝা যায় মামলার ফলাফল কী হবে।

এ রকম একটি মামলায় কাঠগড়ায় দাড়ানো আসামি সাক্ষীর জেরা হয়ে যাওয়ার পর বিরতির সময় জনান্তিকে তার উকিলবাবুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, আর কতক্ষণ লাগবে?’

একটু ভেবে উকিলবাবু বললেন, ‘আমার বোধহয় পনেরো মিনিট আর তোমার বোধহয় দু’বছর।’

অর্থাৎ, উকিলবাবু বুঝতে পেরেছেন যে, তার মক্কেলের অন্তত দু’বছর সাজা হবে।

এই উকিলবাবুর কথাই কিনা সেটা হলফ করে হয়তো বলতে পারব না, তবে আরেকটা গল্পও জানি।

এক আদালতের বার লাইব্রেরির মেম্বাররা অর্থাৎ মাননীয় উকিলবাবুরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তারা কেউই কখনও মক্কেলের কাছ থেকে বত্রিশ টাকার কম ফি নেবেন না।

হঠাৎ একদিন খবর পাওয়া গেল, জনৈক ব্যবহারজীবী তাঁর মক্কেলের কাছ থেকে মাত্র উনিশ টাকা ষাট পয়সা পারিশ্রমিক নিয়েছেন।

বিশেষ জরুরি অধিবেশন বসল মাননীয় বার লাইব্রেরির—রীতিমতো জেনারেল মিটিং, সমস্ত উকিলবাবু সেখানে উপস্থিত।

অভিযুক্ত উকিলবাবুকে পরিষ্কার জিজ্ঞাসা করা হল, ‘যেখানে নিম্নতম ফি বত্রিশ টাকা ধার্য করা হয়েছে, আপনি কেন কম নিলেন?’

এক প্রবীণ উকিল প্রশ্ন করলেন, ‘শুধু কম নয়, আপনি কী করে উনিশ টাকা ষাট পয়সার মতো এমন হাস্যকর ফি নিলেন। অন্তত বিশ টাকাও তো নিতে পারতেন।’

উক্ত প্রবীণ উকিলের উদ্দেশে উনিশ টাকা ষাট পয়সার উকিলবাবু বললেন, ‘দাদা, এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।’

একসঙ্গে পুরো বার লাইব্রেরি গর্জে উঠল, ‘কেন?’

উনিশ টাকা ষাট পয়সার উকিলবাবু আবার বললেন, ‘উপায় ছিল না।’

একসঙ্গে পুরো বার লাইব্রেরি আবার গর্জে উঠল, ‘উপায় ছিল না কেন?’

উকিলবাবু বললেন, ‘কারণ আমার মক্কেলের এর চেয়ে বেশি পয়সা ছিল না। যা ছিল সবই আমি নিয়েছি।’

অতঃপর বার লাইব্রেরির সমস্ত সদস্য, সব উকিলবাবু ‘ধন্য ধন্য’ করতে লাগলেন, কারণ একজন উকিল এর চেয়ে বেশি আর কী করতে পারেন?

এতসব অবমাননাকর আখ্যানের অবশেষে একটি নিতান্ত সরল ও সত্য কাহিনী নিবেদন করা যায়।

ফৌজদারি আদালতের কাঠগড়ায় আসামি মামলা শেষ হওয়ার আগেই, তাঁর পাশের উকিলবাবুর আরগুমেন্ট আরম্ভ হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আদালতের উদ্দেশে নিবেদন করল, ‘হুজুর, আমি স্বীকার করছি, আমিই দোষী।’

এই স্বীকারোক্তি শুনে চমকে উঠলেন আসামি পক্ষের দুঁদে উকিল, ছুটে গেলেন তাঁর মক্কেলের কাছে। বললেন, ‘আপনি প্রথমেই এই স্বীকারোক্তি করলেন না কেন? আমাদের অনেক ঝামেলা বেঁচে যেত।’

আসামি বলল, স্যার, আমি জানতাম আমি নির্দোষ। তাই পয়সা খরচ করে আপনাকে রেখেছিলাম। কিন্তু মামলার সাক্ষীদের কথা শুনে আমি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি, আমি নিশ্চয়ই নির্দোষ নই।’

পুনশ্চ

অনেকক্ষণ ধরে খুব মনোযোগ দিয়ে মক্কেলের সমস্ত কথা শুনলেন ব্যারিস্টার সাহেব। তারপর বেশ কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকিয়ে মক্কেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আপনি কি জানেন যে আপনি যেটা করতে চাইছেন, সেটা সম্পূর্ণ বেআইনি?’

একটুও দ্বিধা না করে মক্কেল জবাব দিলেন, সেটা জানি বলেই তো আপনার কাছে এসেছি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *