3 of 8

রবিবারের মহাভারত

রবিবারের মহাভারত

আমার এই নিবন্ধের নামকরণ দেখে পাঠিকা যদি মনে করেন যে ‘রবিবারের মহাভারত’ হয়তো নতুন কোনও সাপ্তাহিক পত্রিকার নাম, তা হলে সেটা ভুল হবে।

এ নিবন্ধ দূরদর্শনের মহাভারত নিয়ে, যা সারা দেশকে রবিবার সকালে বাড়ির মধ্যে বন্দি করে রাখত।

বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদের সেই বিখ্যাত বর্ণনা:

…গ্রামখানি গৃহময় কিন্তু লোক দেখি না। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা, পল্লীতে পল্লীতে শতশত মৃন্ময় গৃহ, মধ্যে মধ্যে উচ্চ-নীচ অট্টালিকা।…বাজারে দোকান বন্ধ, হাটে হাট লাগে নাই। রাজপথে লোক দেখি না, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না’…

মন্বন্তর-তাড়িত এক জনপদের প্রাচীন ছবি প্রতি রবিবার মহাভারতীয় সকালে বারবার ফিরে আসে। বঙ্কিমচন্দ্র আরও বর্ণনা দিয়েছিলেন, ব্যবসায়ী ব্যবসা ভুলে গেছে, তন্তুবায় তাঁত বন্ধ করেছে, দাতারা দান বন্ধ করেছে, অধ্যাপক টোল বন্ধ করেছে, ‘শিশুও বুঝে আর সাহস করিয়া কাঁদে না।’

এক বিদেশি পর্যটকের বর্ণনায় আছে, মোগলসম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুসংবাদ যখন পূর্বভারতে এসে পৌঁছল, সঙ্গে সঙ্গে দোকানপাট, সেরেস্তা-কাছারি, কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেল। রাস্তাঘাট, বাজার-হাট চারদিক শুনশান হয়ে গেল।

ইতিহাস এবং আনন্দমঠের ক্লাসিকতার পর মহাভারত-বৃত্তান্তকে প্রাণাধিকা চপলা পাঠিকার জন্যে কতটা লঘু করা যাবে বুঝতে পারছি না। আপাতত শিবরাম চক্রবর্তীকে স্মরণ করি।

আসল মহাভারত হল ব্যাসদেবের। আর বাংলায় কাশীদাসী মহাভারত, সাবলীল পয়ারে রচিত সে এক অসামান্য কালজয়ী গ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য এবং স্মরণীয় মহাভারত রয়েছে মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহের এবং রাজশেখর বসুর।

কিন্তু এতৎসত্ত্বেও নিতান্ত এক অবান্তর কারণে স্বর্গীয় শিবরাম চক্রবর্তীকে মনে পড়ে যেত রবিবার সকালে চোপড়ার মহাভারত দেখতে বসলে।

ওই যে মহাভারতের শুরুতেই গীতার সেই বিখ্যাত ‘মা ফলেষু কদাচন’ শ্লোকটি উদাত্ত কণ্ঠে গাওয়া হত, বিনা কারণেই আমার তখন শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পটি মনে পড়ত।

গল্পটি একটু প্যাঁচালো। গল্পকারের এক বন্ধুর খুড়শাশুড়ি সদ্য পরলোকগমন করেছেন। গল্পকারের মনে ধারণা হয়েছে যে বন্ধুটি নিশ্চয়ই শোকে অভিভূত ও মুহ্যমান হয়ে রয়েছে। খুড়শাশুড়ি-বিয়োগের এই গভীর শোকের দিনে প্রাণের বন্ধুকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে গল্পকার গীতার শ্লোক আওড়াতে লাগলেন বন্ধুর কাছে।

আসল ঘটনা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। বলা বাহুল্য, খুড়শাশুড়ির শোকে বন্ধু মোটেই মুহ্যমান হয়ে পড়েনি। সে ম্যাটিনি শোয়ের টিকিট কিনেছে, মেট্রো সিনেমায় গ্রেটা গারবোর ছবি দেখতে যাচ্ছে।

সেই সময় লেখক তার কাছে গিয়ে তাকে শোনাচ্ছে গীতার বাণী, ‘নৈনং ছিদ্রন্তি…সূঁচও ইহাকে ছিদ্র করিতে পারে না, আগুনও ইহাকে…’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব শুনে বন্ধুটি একেবারে খেপে গেল। চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করে উঠল, ‘ইহাকে-তাহাকে—কাহাকে? এসব কী হচ্ছে কী? আমার বাড়িতে এগুলো কী হচ্ছে?’

মহাভারতের আরম্ভে গীতার ওই শ্লোক ‘মা ফলেষু কদাচন…’ শোনামাত্র প্রতি রবিবার সকালে শিবরামের গল্পের চরিত্রের মতো আমারও চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে হত, ‘এসব কী হচ্ছে কী? আমার বাড়িতে এগুলো কী হচ্ছে?’

কিন্তু তা বলিনি। বরং শান্ত হয়ে বসে মহাভারত দেখেছি। রবিবার সকালে মহাভারতের সময়টা ছিল আমাদের বাড়িতে সকলের একসঙ্গে বাইরের ঘরে বসে নিঃশব্দে ছুটির দিনের জলখাবার খাওয়ার সময়।

খুব সুবিধে। এই সময় বাড়িতে কেউ আসে না। এমনকী ধোপা, নাপিত পর্যন্ত নয়। আমরা মনোযোগ দিয়ে মহাভারত দেখি এবং খাই। কৃষ্ণের মাখনচুরি দেখতে দেখতে মাখন না-মাখানো পাঁউরুটি, জিলিপি আর সিঙ্গাড়া কিংবা নিমকি দিয়ে প্রাতঃরাশ সারি।

একদিন একটু ব্যতিক্রম হল। মহাভারত শুরুর দিকের ঘটনা এটা। সবে শিশু শ্রীকৃষ্ণ বালকে পরিণত হতে যাচ্ছেন, পটভূমিকায় কিশোরী শ্রীরাধিকাকেও দেখা যাচ্ছে। বাইরের ঘরের টেবিলে যথারীতি পাঁউরুটি জিলিপি ইত্যাদি দেওয়া হয়েছে, আমরা খেতে আরম্ভ করতে যাচ্ছি, এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল।

কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে আমি একটু বিব্রত হয়েই দরজা খুললাম। খুলে দেখি হীরক দাঁড়িয়ে আছে, সে আমার এক পুরনো বন্ধু।

হীরক ঘরে ঢুকে আমরা মহাভারত দেখছি দেখে পরম বিরক্তি প্রকাশ করল। ‘তোমরা বাড়িসুদ্ধ সবাই মিলে এই রাবিশ মহাভারত দেখছ!’ গজগজ করতে করতে সে পাশের একটা খালি চেয়ারে বসল। তারপর বলল, এ পাড়াতেই কোনও এক ডাক্তারকে দেখাতে এসেছে। কিন্তু ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে দেখে দরজা বন্ধ, দরজায় নোটিশ লাগানো আছে: ‘মহাভারত চলাকালীন রোগী দেখা বন্ধ।’

মহাভারতের ওপরে হীরক অত্যন্ত খ্যাপা। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতে না পেরে সে সময় কাটানোর জন্যে পাশের একটা চায়ের দোকানে ঢোকার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেখানেও বেয়ারা, বয়, দোকানদার সবাই পাশের বাড়ির জানলা দিয়ে ‘মহাভারত’ দেখায় ব্যস্ত। অবশেষে বাধ্য হয়ে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও হীরক আমাদের বাড়িতে এসেছে। কিন্তু এখানেও সেই মহাভারত।

হীরক গজগজ করতে লাগল এবং গজগজ করতে করতেই হাতের সামনের থালা থেকে পাঁউরুটি, জিলিপি, নিমকি তুলে তুলে খেতে লাগল।

একসময় মহাভারত এবং হীরকের খাওয়া শেষ হল। আমরা বাড়ির কেউই কিছু খাইনি। বড়জোর এক স্লাইস রুটি বা একটা জিলিপি। বাকি সবটা হীরক গলাধঃকরণ করেছে। অবশেষে পর পর দু’ গেলাস জল খেয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘যাই। ডাক্তারের চেম্বার বোধ হয় এবার খুলল।’

ভদ্রতার খাতিরে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ডাক্তারের কাছে কেন যাচ্ছ? তোমার কী হয়েছে?’ হীরক বলল, ‘আর বোলো না। একদম খিদে হয় না, কিছু খেতে ইচ্ছে করে না।’

আমরা হতবাক হয়ে পারিবারিক প্রাতরাশের শূন্য থালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মহাভারতের কৃপায় চারজনের খাবার হীরক একা খেয়েছে, এবার ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে আরও খাবারের প্রয়োজনে।

পুনশ্চ একটি বিদেশি গল্প ও উপসংহার:

দুটি ক্যাথলিক শিশু নিজেদের মধ্যে ধর্ম-আললাচনা করছিল। প্রথমজন যাজকের সন্তান। সে বলল, ‘রবিবার কাজ করা মহাপাপ।’ দ্বিতীয়জনের বাবা পুলিশে কাজ করেন। সে প্রশ্ন করল, ‘কেন, রবিবার কাজ করলে কী হবে?’ যাজকতনয় উত্তর দিল, ‘স্বর্গে যেতে পারবে না।’ দ্বিতীয়জন জানাল, ‘আমার বাবাকে যে রবিবার কাজ করতে হয়।’ যাজকতনয় কিঞ্চিৎ চিন্তা করে বলল, ‘তা করুক। তোমার বাবার স্বর্গে যাওয়ার দরকার নেই, স্বর্গে পুলিশ দিয়ে কী হবে?’

গল্পটি নিমিত্তমাত্র। আসল কথা হল খ্রিস্টানরা অনন্তকাল চেষ্টা করে যাচ্ছেন রবিবারকে ধর্মবার করতে, শুধু ধর্মের জন্যে, কোনও ঐহিক কাজের জন্যে নয় সাবাথ বা রবিবার।

রবিবারের সকালে প্রথম সাগরের রামায়ণ এবং চোপরার মহাভারত ভারতীয়দের সেই ধর্মবারে পৌঁছে দিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *