3 of 8

হাঁচির গল্প

হাঁচির গল্প

রম্যনিবন্ধ রচনার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হল তার নামকরণ। কোনও একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে লেখা হলে নামকরণ অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যায়। কিন্তু সবসময় বিশেষ ভাল বিষয় থাকে না; যেমন এবার। ফলে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে এবারের এই পাঁচমিশেলি নিবন্ধের নাম হল ‘অবশেষে হাঁচির গল্প।

তা হোক এই নামটাই বা খারাপ কী?

রসায়নের ক্লাসে একটা কাচের পাত্রে কিছু অ্যাসিড নিয়ে এসেছেন অধ্যাপক মহোদয়। তারপর একটা বোতল থেকে অন্য কী একটা তরল পদার্থ সেই কাচের পাত্রে ঢেলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর ফেনা বুদবুদ ধোঁয়া উঠতে লাগল।

সে খুবই জ্বালাময়ী ধোঁয়া। ক্লাসসুদ্ধ সব ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক মহোদয় সমেত সকলেই খুব হাঁচতে-কাশতে লাগলেন। সেইসময় অধ্যাপক মহোদয় তাঁর হাতের আঙুল থেকে একটি সোনার আংটি খুলে নিয়ে সেই ফেলিল, বুদবুদময় তরল পদার্থের মধ্যে ফেলে দিয়ে হাঁচতে হাঁচতে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, তোমরা কেউ বলতে পারো আমার এই আংটিটা এই অ্যাসিডের মধ্যে গলে যাবে কিনা?’

সবচেয়ে পেছনের বেঞ্চ থেকে একটি ফাজিল মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জবাব দিল.. ‘গলবে না স্যার।’

অধ্যাপক বললেন, ‘তোমার উত্তর সঠিক, কিন্তু তুমি কী করে বুঝলে যে এটা গলবে না?’

মেয়েটি বলল, ‘গলে যাবার ভয় থাকলে আপনি কিছুতেই স্যার সোনার আংটিটা অ্যাসিডের মধ্যে ফেলতেন না।’ বলে খুব হাঁচতে লাগল।

অন্য একটা হাঁচির গল্প একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে। তার খুব সর্দি হয়েছে। সে বাসে একটা সিটে বসে স্কুলে যাচ্ছিল আর ক্রমাগত হাঁচছিল।

এক ভদ্রলোক এই ছেলেটির পাশে বসে যাচ্ছিলেন। এত হাঁচিতে বিরক্ত হয়ে এবং এতৎসত্ত্বেও ছেলেটি রুমাল ব্যবহার করছে না দেখে তিনি ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খোকা, তোমার রুমাল নেই?’

খোকা হাঁচতে হাঁচতে বলল, ‘আছে। কিন্তু অচেনা লোককে আমি রুমাল ধার দিই না।’

হাঁচি ব্যাপারটা মারাত্মক।

সবাই হাঁচে। রাজা-প্রজা, গরিব-বড়লোক, বড়বাবু-কেরানি সবাই হাঁচে। হাঁচতে বাধ্য হয়। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে এমনকী দুধের শিশু, মুমুর্ষু ব্যক্তিও হাঁচে।

হাঁচা বন্ধ করা কঠিন। তবে ভদ্রলোকেরা মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাঁচেন। কিন্তু সব সময় বাইরে যাওয়ার অবকাশ জোটে না, তার আগেই অদম্য হাঁচি স্বতঃস্ফূর্ত হয়।

নিঃশব্দে বা গোপনে হাঁচা মোটেই সম্ভব নয়। অভিধানে হাঁচি মানে পরিষ্কার বলেছে, ‘নাক সুড়সুড় করিবার ফলে নাক-মুখ দিয়া সশব্দে বায়ু নির্গম।’ এখানে ‘সশব্দে’ শব্দটি লক্ষণীয়।

তা ছাড়া আরও একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে এই আভিধানিক অর্থে, হাঁচি শুধু নাকের ব্যাপার নয়, মুখের ভূমিকাও রয়েছে এতে।

সে যা হোক, শুধু মানুষই যে হাঁচে তা নয়। আমি গোরুকেও হাঁচতে দেখেছি। আমাদের একটি বুড়ো পোষা কুকুর সামান্য ঠান্ডা লাগলে অনবরতই হাঁচে। একবার চিড়িয়াখানার একটা রয়াল বেঙ্গল টাইগারকেও সশব্দে হাঁচতে দেখেছি। শুধু সে হাঁচছিল তাই নয়, তার গলাও ঘড়ঘড় করছিল। সে রাগের বা গর্জনের ঘড়ঘড় নয়। নিতান্তই সর্দির ঘড়ঘড়।

তবে মাছ, কচ্ছপ ইত্যাদি জলচর প্রাণীরা হাঁচে কি না, কীট-পতঙ্গেরা হাঁচে কি না—সে-বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।

কিন্তু সাপ নাকি হাঁচে। প্রবাদকার বলেছেন, সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। তার মানে হয়তো এই সাব হাঁচলে অন্যেরা, সাধারণ লোকেরা টের পাবেনা। শুধু অভিজ্ঞ সাপের বেদেরাই বুঝতে পারবে সাপের হাঁচি।

এসব কথা থাক। মানুষের হাঁচির প্রসঙ্গে ফিরে আসি।

হাঁচির সঙ্গে কাশির, এবং হঁচিকাশির সঙ্গে সর্দির নিকট সম্পর্ক রয়েছে।

সর্দি হলে অবশ্যই হাঁচি হওয়ার সম্ভাবনা এবং সর্দির জমাট-মাখা হাঁচিতে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়।

তবে সব সময়ে হাঁচি মানেই সর্দি নয়। হাঁচি নানা কারণে হতে পারে। রান্নাঘরে শুকনো লঙ্কা-ফোড়ন দিলে সেই ঝাঁঝে বসার ঘরে বসে আমরা হাঁচতে পারি। নাকে ধুলোময়লা গিয়ে কিংবা হঠাৎ রোদ্দুর থেকে ফিরে এসে অথবা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে ঢুকে হাঁচি পেতে পারে।

চিকিৎসকেরা বলেন, হাঁপানি অথবা একজিমার মতোই হাঁচিও এক ধরনের অ্যালার্জি। কোনও জিনিস শরীরের বা মনের পছন্দ হচ্ছে না। তারই প্রকাশ হল অ্যালার্জি।

হাঁচিও অ্যালার্জি, মানে শারীরিক যন্ত্রের প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদের কারণ সদাসর্বদাই হয়তো স্পষ্ট নয়।

তবে হাঁচির মূল কারণ অধিকাংশ সময়েই সর্দি বা ঠান্ডা লাগা। এবং এই হাঁচি সংক্রামক। সর্দির পোকা এই হাঁচির সঙ্গে ঝড়ায়।

সবচেয়ে মারাত্মক কথা, সর্দি সারানোর কোনও উপায় অদ্যাবধি আবিষ্কার হয়নি।

বিলিতি রসিকতা আছে, তুমি যদি সর্দি হলে চিকিৎসা না করাও তা হলে সেটা সারতে সাতদিন লাগবেন। আর যদি ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে ভালভাবে চিকিৎসা করাও তা হলে নিশ্চয় এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠবে, সর্দি থেকে ভাল হয়ে যাবে।

হাঁচি-কাশি, সর্দির সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হল অন্য অসুখের চেয়ে এ অসুখে কষ্ট কম নয়, জ্বালা-যন্ত্রণাও কম নয়। কিন্তু সবাই জানে যে এ অসুখে কেউ মারা যায় না। তাই গুরুত্ব দেয় না। শুধু যে ভোগার সে ভোগে। হিতৈষীরা বড়জোর অনুকম্পা দেখিয়ে বলেন, ‘সিজন চেঞ্জের সময়, একটু সাবধানে থাকতে হয়।’

বলা বাহুল্য, বছরের কোন সময়টা সিজন চেঞ্জের সময় নয়, সব সময়েই সিজন চেঞ্জ হচ্ছে, শীত গিয়ে গরম পড়ছে, গরম থেকে বর্ষা, বর্ষা থেকে শীত। সারা বছরই সিজন চেঞ্জ, সারা বছরই হাঁচি-কাশি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *