3 of 8

স্বপ্ন ও রমণী

স্বপ্ন ও রমণী

এই রকম বিপজ্জনক নামের গোলমেলে রচনায় রবীন্দ্রনাথের কবিতার আড়াল দিয়ে প্রবেশ করাই হয়তো নিরাপদ। ‘স্বপ্ন’ কবিতার সেই স্মৃতিগন্ধময়, উজ্জ্বল, অনিবার্য পঙ্‌ক্তিগুলি আরেকবার স্মরণ করি।

‘দূরে বহুদূরে
স্বপ্নলোকের উজ্জয়িনীপুরে
খুঁজিতে গেছি কবে শিপ্রা নদীপারে
মোর পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে।
মুখে তার লোভ্ররেণু, লীলাপদ্ম হাতে,
কর্ণমূলে কুন্দকলি, কুরুবক মাথে…’

নবীন বয়েসে যে বাঙালি তরুণ এই কবিতা পড়ে শিহরিত হননি, একবারের জন্যেও রোমাঞ্চিত হননি, তার জীবনযৌবন বৃথা। স্বপ্ন সকলেই দেখে। হয়তো সবাই স্বপ্নে শিপ্রা নদীপারে প্রথমা প্রিয়ার কাছে পৌঁছোয় না, কিংবা স্বপ্নে দেখতে পায় না যে ‘কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে।’ এমনকী হিং টিং ছটের হবুচন্দ্র ভূপ কবে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, যার অর্থ ভেবে ভেবে গবুচন্দ্র চুপ হয়ে যান, সেই অদ্ভুত স্বপ্ন, ‘শিয়রে বসিয়া যেন তিনটে বাঁদরে উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে’— আমাদের সকলের সে রকম স্বপ্ন দেখার সৌভাগ্যও কদাচিত হয়। তবু স্বপ্ন সকলেই দেখে। শুধু মহিলাদের জড়িয়ে লাভ নেই স্ত্রী-পুরুষ, তরুণ-বৃদ্ধ, মৃত্যুপথযাত্রী মুমূর্ষু, দুগ্ধপোষ্য শিশু সকলেই স্বপ্ন দেখে।

ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে ভয় পেয়ে শিশু কেঁদে ওঠে আবার মুহূর্তের মধ্যে পরম কৌতুকে ঠোঁট টিপে হাসে। মৃত্যুপথযাত্রীও স্বপ্ন দেখে, যন্ত্রণায় জর্জর তার শরীর কিন্তু তার স্বপ্নাচ্ছন্ন মুখে পরম প্রশান্তি।

শুধু মানুষ নয়, স্বপ্ন জীবজন্তুও দেখে। আমাদের বাসায় একটি প্রৌঢ় কুকুর ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে লড়াই করে ওঠে, তারপর তার ঘুম ভেঙে যায়, আচমকা জেগে উঠে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। কুকুরের স্বপ্ন আপাতত থাক। মানুষের স্বপ্নে যাই।

প্রথমে সেই অতি পুরনো বাজে গল্পটা বলে নিই। গল্পটা আগেও কোথায় যেন বলেছি বলে মনে হচ্ছে, তাই একটু ঘুরিয়ে নাট্যাকারে লিখছি।

প্রথম দৃশ্য। মধ্যরাত

একটি ডবল বেডের খাটে স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি নিদ্রিত।

স্বামী: (ঘুমের মধ্যে দুই বাহু প্রসারিত করে, উচ্চস্বরে) জলি, জলি, জলি।

স্ত্রী: (ঘুম ভেঙে উঠে, স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে তুলে) জলি? জলি কে?

স্বামী: (চোখ কচলাতে কচলাতে) জলি?

স্ত্রী: হ্যাঁ। এতক্ষণ স্বপ্নে যাকে জড়িয়ে ধরে জলি-জলি করে চেঁচাচ্ছিলে, সেই জলিটা কে আমি জানতে চাই।

স্বামী: (আলগোছে হাই তুলে) ও কিছু নয়।

স্ত্রী: কিছু নয়?

স্বামী: কী বিরক্ত করছ? জলি আসলে একটা ঘোড়ার নাম। দুপুরে রেস খেলতে গিয়েছিলাম না। জলিই তো বাজি জিতল। সেই পয়সা দিয়েই তো তোমার চকোলেটের বাক্স কিনে আনলাম।

দ্বিতীয় দৃশ্য। প্রভাত কাল।

ডবল বেডের খাটে স্বামী একা নিদ্রিত। কাছে জানালার ধারে চেয়ারে বসে স্ত্রী খবরের কাগজ পড়ছেন। সামনের তেপায়া টেবিলের উপরে টেলিফোন ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল।

স্ত্রী: (টেলিফোন তুলে) হ্যালো। হ্যালো। হ্যাঁ, কী নাম বললেন। আচ্ছা। ধরুন। ঘুমিয়ে আছে ডেকে দিচ্ছি।

স্ত্রী উঠে গিয়ে নিদ্রিত স্বামীকে ধাক্কা দিলেন।

স্বামী: (জেগে উঠে) কী হল?

স্ত্রী: তোমার ফোন।

স্বামী: কে ফোন করল? এই সকালে?

স্ত্রী: সেই যে জলি, রেসের ঘোড়াটার কথা রাতে বললে, সেই ঘোড়া ফোন করেছে। পুরনো গল্পই যখন বলছি, তা হলে অন্য এক সরস কাহিনীর আরেক মহিলার কথা বলি। সেই মহিলার স্বামী বেচারার কিন্তু কোনও দোষই ছিল না।

ভদ্রমহিলা একদিন রাতে ঘুম থেকে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত অবস্থায় পাশে গভীর নিদ্রামগ্ন পতিদেবতাকে দমাদম ঘুষি মারতে থাকেন।

স্বামী ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে জেগে উঠে মাথার বালিশটা বর্মের মতো ব্যবহার করে যথাসাধ্য আত্মরক্ষা করতে করতে আতঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল? আমাকে হঠাৎ মারছ কেন? আমি কী করলাম?’ তখনও মারতে মারতে স্ত্রী উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘কী করলাম? ন্যাকা আমার। বদমায়েসির আর জায়গা পাওনি।’

হতভম্ব স্বামী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এসব কী বলছ? কী বদমায়েসি করলাম আমি?’ স্বামীর এই সরল প্রশ্নে স্ত্রী এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন, বললেন, ‘বদমায়েসি নয়? এই মাত্র আমি স্বপ্নে দেখলাম, তুমি লিলিকে নিয়ে সিনেমায় গেছ। তাকে আদর-টাদর করছ।’

অবাক হয়ে স্বামী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে লিলি? তার সঙ্গে আমি সিনেমায়? …ফোপাতে ফেঁপাতে স্ত্রী বললেন, ‘তুমি জানো না লিলি কে? লিলি হল সামনের বাড়ির নতুন বউটা। রোববার সন্ধ্যাবেলা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এল। লিলির সঙ্গে অত হেসে হেসে গল্প করলে, এখন বলছ কে লিলি?’

বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, নিরুত্তর স্বামীকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে স্ত্রী বললেন, আমি যদি আর কখনও স্বপ্নে লিলির সঙ্গে তোমাকে দেখি, চিরদিনের জন্যে বাপের বাড়ি চলে যাব।’

স্বপ্নতত্ত্ব বড় কঠিন জিনিস। কেন এই সরলা মহিলা স্বপ্নে তাঁর স্বামীকে পাশের বাড়ির নতুন বউটির সঙ্গে দেখলেন, সে গভীর গবেষণার বিষয়।

শুধু এই সমস্ত জটিল স্বপ্ন নয়, আমাদের অনেক সুখস্বপ্ন, মধুর তন্দ্রার সর্বনাশ করে গেছেন মহামান্য সিগমুন্ড ফ্রয়েড গত শতকের শেষে এবং এই শতকের গোড়াতে। তারপরে তাঁর চেলাচামুণ্ডার হাতে ব্যাপারটা ভয়াবহ পরিণতি লাভ করেছে। ফ্রয়েডীয় মানুষের মনে কোনও চিন্তাই আর নিস্পাপ নয়, কোনও ভাবনাই সহজ, সরল নয়। সব জটিল হয়ে গেছে। এমনকী স্বপ্নের মতো তরল জিনিসও। বহু যুগ আগে এক মহাকবি বলেছিলেন, স্বপ্ন না মায়া না মতিভ্রম। আরও আগে, ঢের আগে সাহিত্যে স্বপ্নের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। রামায়ণে রাজা দশরথ স্বপ্ন দেখেছেন, অশোককাননে সীতা স্বপ্ন দেখেছেন।

স্বপ্নের মধ্যে দেবতারা চিরকাল ধরে নিঃসঙ্গিনী, বিরহাতুরা রমণীদের দেখা দিয়েছেন, প্রয়োজন বোধে সঙ্গদান করেছেন। মায় রমণীরা স্বপ্নের মধ্য দিয়ে তাঁদের গর্ভে ধারণ করেছেন স্বর্গীয় সন্তান।

এসব পুরনো কথা। স্বপ্নতত্ত্ব অত্যন্ত আকর্ষণীয় ব্যাপার। যে কোনও বড় পঞ্জিকায় ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে বেশ কয়েক পাতা ধরে স্বপ্নতত্ত্ব দেয়া থাকে। বটতলার বাইরে দোকানে স্বপ্নের বিষয়ে বই পাওয়া যায়। আর গবেষণাগ্রন্থের কোনও ভাষাতেই অভাব নেই। স্বপ্ন-বিজ্ঞানীরা এতকাল বলতেন যে স্বপ্নের নাকি কোনও রঙ নেই। সে শুধুই পুরনো দিনের সিনেমার মতো সাদাকালো। আমি নিজেও কখনও রঙিন স্বপ্ন দেখিনি, নিতান্তই সাদাকালো, আবছায়া।

কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে, স্বপ্ন নাকি রঙিনও হতে পারে, স্বপ্নের মধ্যে নানা বর্ণের প্রতিফলন আসা অসম্ভব নয়। জানি না বিদেশি স্বপ্ন গবেষকরা কখনও ভারতীয় হিন্দি সিনেমা দেখেছেন কি না এবং তাদের রঙিন স্বপ্নের ধারণা বোম্বে সিনেমার স্বপ্নের দৃশ্য দেখে তৈরি হয়েছে কিনা। বলা বাহুল্য, রঙিন স্বপ্নের হলিউডি সিনেমারও একদা অভাব ছিল না। সে যা হোক, স্বপ্ন ও রমণী সংক্রান্ত শেষ আখ্যানটি লিখি। এ গল্পের নায়ক এক চুরচুর মাতাল, ধরা যাক, তার নাম তিনকড়ি দাস। গভীর রাতে টলমল করতে করতে বাড়ি ফিরছিলেন তিনকড়িবাবু। বাড়ির কাছেই রাস্তা থেকে তাঁর অতিশয় তরল অবস্থা দেখে পুলিশ তাঁকে ধরল।

তিনকড়িবাবু স্খলিত কণ্ঠে পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তিনি কোনও অন্যায় করেননি, কাছেই তাঁর বাড়ি, তিনি বাড়ির কাছে রাস্তায় বায়ুসেবন করছেন। পুলিশ কি আর অত সহজে ছাড়ে?

তিনকড়িবাবু কোনও কথা সে বিশ্বাস করে না, শুধু বলে, ‘থানায় চলো। তোমার বাড়ি এখানে এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।’ তিনকড়িবাবু তখন টলতে টলতে পুলিশকে নিয়ে নিজের বাড়ির সামনে এলেন, তারপর বাড়ির সদর দরজায় নেমপ্লেটের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, ‘সেপাইজি, ওই যে দেখছেন নেমপ্লেটে লেখা রয়েছে মি. তিনকড়ি দাস, ওই তিনকড়ি দাস হলাম আমি।’ তারপর ডাকবাক্সে হাত দিয়ে কয়েকটা চিঠি বার করলেন। এবং বললেন, ‘এই যে চিঠিগুলো সব তিনকড়ি দাসের নামে এসেছে, আমিই হলাম তিনকড়ি দাস।’ তারপর তিনকড়ি দাস চাবি দিয়ে সদর দরজা খুলে পুলিশকে সরাসরি শোবার ঘরের মধ্যে নিয়ে গেলেন। সেখানে গোলমেলে ব্যাপার, তিনকড়িবাবু স্ত্রীর পাশে কে এক ব্যক্তি ঘুমিয়ে রয়েছে, মুখে হাসির ছটা, বোধহয় স্বপ্ন দেখছে।

অদমিত তিনকড়িবাবু পুলিশকে বললেন, ‘ওই যে মহিলা শুয়ে আছেন উনি হলেন আমার মানে তিনকড়ি দাসের স্ত্রী। আর ওঁর পাশে শুয়ে আছি, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি হলাম আমি, এই তিনকড়ি দাস।’

এই অখাদ্য নিবন্ধ রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম। ইয়েটসের স্বপ্ন দিয়ে শেষ করি। এই স্বপ্নের মধ্যেও রমণী বিজড়িত। অনুবাদে কিছু স্বাধীনতা নিলাম। বিদূষী, বিদ্যাবতী পাঠিকার অনুমতি নিশ্চয় পাব। সামান্যই কয়েক পঙ্‌ক্তি: কিন্তু আমি নিতান্ত গরিব। আমার আছে শুধু স্বপ্ন। আমি সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছি তোমার পায়ের নীচে, প্রিয়তমা। প্রিয়তমা, তুমি একটু নরম করে হাঁটো, তোমার পায়ের নীচে আমার স্বপ্ন। তুমি আমার স্বপ্ন মাড়িয়ে দিয়ো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *