2 of 8

দুর্ঘটনার আগে ও পরে

দুর্ঘটনার আগে ও পরে

ডেভিড কপারফিল্ড নামক সেই বহুপঠিত, সুবিখ্যাত উপন্যাসে চার্লস ডিকেন্স মহোদয় দুর্ঘটনা বিষয়ে লিখেছিলেন যে, ‘সবচেয়ে সুশৃঙ্খল পরিবারে যেমন দুর্ঘটনা ঘটবে, তেমনি ঘটবে বিশৃঙ্খল পরিবারে।’

ডিকেন্স সাহেব অন্য এক সূত্রে এই কথাটি বলেছিলেন, তবে তাঁর ওই মন্তব্য সর্বতোভাবে গ্রহণযোগ্য। দুর্ঘটনা কোন পরিবেশে, কখন ঘটবে সে বিষয়ে কারও পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়। যদি বলা সম্ভব হয় তা হলে সেটাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না।

ইংরেজিতে ‘গড্‌স অ্যাক্ট’ (God’s Act) বলে একটি কথা আছে। যা কিছু মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, রাস্তায় একটি কুকুর ছানাকে বাঁচাতে পাশ কাটাতে গিয়ে যাত্রীসুদ্ধ গাড়ি খাদে পড়ে গেল কিংবা বাথরুমে পা পিছলিয়ে পড়ে তোমার সাধের কোমর দুমড়িয়ে গেল, এ সবই গড্‌স অ্যাক্ট। পুরনো বাড়ির ছাদ মাথায় ভেঙে পড়ল কিংবা লিফটের দড়ি ছিঁড়ে নীচে পড়ে গেল এগুলোও হয়তো গড্‌স অ্যাক্টের পর্যায়ে পড়ে তবে এর মধ্যে হয়তো মানুষী তদারকির অভাব বা অবহেলা। উপেক্ষার ব্যাপার থাকলে তখন সেটা আর ঈশ্বরীয় নয়। বরং সেখানে দোষী বা দায়ি ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে পারলে তাকে ফৌজদারির সোর্পদ করে দণ্ড সংহিতা অনুসারে সাজা দেওয়াও সম্ভব।

দুর্ঘটনার কাহিনীর সেই আদিম উদাহরণটি স্মরণ করছি। সবাই জানে গল্পটা তাই খুব ছোট করে লিখছি।

রাজপথের পাশে একটি অট্টালিকা নির্মিত হচ্ছে। এক রাজমিস্ত্রি সেই নির্মীয়মাণ অট্টালিকার দ্বিতল থেকে পা পিছলিয়ে পড়ে গেলেন রাজপথে এক পথচারীর ঘাড়ে।

যথাভাগ্য! সেই পদস্খলিত রাজমিস্ত্রির কিছু হল না সেই দুর্ঘটনায়, পথচারী ভদ্রলোক কিন্তু ঘাড় ভেঙে নিহত হলেন। ভদ্রলোকের ছেলে রাজমিস্ত্রির বিরুদ্ধে মামলা আনলেন আদালতে। তাঁর বাবার মৃত্যুর বিচার চাই।

আদালত খুব মনোযোগ দিয়ে দুই পক্ষের এবং সাক্ষীদের সকলের সবকথা শুনলেন। তারপর অনেক বিবেচনা করে বললেন, ‘এর আর কী করা যাবে। গড্‌স অ্যাক্ট। এতে কারও কোনও হাত নেই, আকস্মিক, নিতান্ত আকস্মিক এই দুর্ঘটনা, ওই রাজমিস্ত্রিকে কী সাজা দেব।’

কিন্তু মৃতের পুত্র ভয়ংকর জেদ করতে লাগলেন, বললেন, ‘আমার বাবার মৃত্যুর জন্যে এই রাজমিস্ত্রি দায়ি। ওকে আপনি কী করে খালাস দেবেন?’

আদালত বাদীকে বললেন, ‘কিন্তু ওই রাজমিস্ত্রির সঙ্গে তো আপনার বাবার কোনও শত্রুতা বা বিবাদ ছিল না। ওকী আর ইচ্ছা করে আপনার বাবার মাথার উপরে পড়েছে।’

কিন্তু মৃতের পুত্র ছাড়বে না, আরও জোর করতে লাগল। অবশেষে বিচারক সেই ঐতিহাসিক রায় দিলেন, ‘রাজমিস্ত্রি পথ দিয়ে হেঁটে যাবে আর দোতলা থেকে মৃত ব্যক্তির পুত্র তার উপরে লাফিয়ে পড়বে। এ ছাড়া এই মামলার আর কোনও সাজা যুক্তিযুক্ত হবে না।’

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য উক্ত বাদী কখনওই ছাদ থেকে লাফ দিয়ে রাজমিস্ত্রির উপরে পড়ে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করেনি।

এই সূত্রে ছাদ থেকে রাস্তার লোকের ঘাড়ে পড়ার ঘটনা সম্পর্কে এক মহাজনের বক্তব্য বলি।

সেই মহাজন বলেছিলেন যে কেউ যদি একদিন হঠাৎ পা পিছলিয়ে ছাদ থেকে রাস্তার কোনও লোকের ঘাড়ে পড়ে তবে সেটা হবে দুর্ঘটনা।

আর যদি সেই লোকটি পরপর দু’দিন ওইভাবে পা পিছলিয়ে একটা পথচারীর ঘাড়ে পড়ে তা হলে সেটা হবে ইংরেজিতে যাকে বলে কয়েনসিডেন্স (coincidence) একটা চমকপ্রদ মিলের ঘটনা।

অতঃপর যদি তার পরের দিনও ওই ব্যক্তি উক্ত পথচারীর ঘাড়ে পড়ে তবে তখন আর তাকে দুর্ঘটনা বা কয়েনসিডেন্স বলে অভিহিত করা যাবে না। সেটা হবে অভ্যাস, একটি খারাপ অভ্যাসের নমুনা।

খবরের কাগজে দুর্ঘটনার সংবাদ ক্রমাগতই বের হয়। কখনও লোক ভর্তি ট্রাক খাদে পড়ে যায় কখনও ট্রামে-বাসে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়, কখনও বা বিধ্বংসী আগুনে বিশাল বাজার পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

দু’রকম খুচরো দুর্ঘটনার খবর দৈনিকে প্রায় নিয়মিতই ছাপা হয়। এক, ছাদ থেকে পড়ে শিশুর মৃত্যু এবং মোটর দুর্ঘটনায় যাত্রাদলের নায়ক-নায়িকা আহত।

এইরকম সংবাদে ভুল করে একটি কাগজে এক যাত্রাদলের নায়িকার মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছিল। সে মহিলা কিন্তু মারা যাননি, দুর্ঘটনায় সামান্য আহত হয়েছিলেন। তিনি খবরের কাগজ অফিসে ফোন করলেন, ফোন করে বলেন, ‘দেখুন, আমি জলজ্যান্ত বেঁচে আছি। আর আপনারা আমার মৃত্যু সংবাদ আপনাদের কাগজে ছাপিয়ে দিলেন।’

খবরের কাগজের দপ্তর থেকে তাকে নাকি বলা হয়েছিল, ‘ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম। যা হোক আমরা ভুলটা সংশোধন করে দিচ্ছি। কালকের কাগজেই আপনার জন্মসংবাদ ছেপে মৃত্যুটা শুধরে দিচ্ছি।’

তবে দুর্ঘটনার কাহিনী বহু সময়েই খুব তরলভাবে পরিবেশিত হয়।

এক কাল্পনিক কৃপণের একটাই মাত্র চামচে ছিল। সেই চামচের গা থেকে চিনি চেটে খেতে গিয়ে তিনি সেই চামচেটা গিলে ফেলেন। খবর পেয়ে পাড়ার ডাক্তার তাঁকে দেখতে আসেন, ওই ঘটনার দু’দিন পরে।

ডাক্তারবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার কোনও অসুবিধা হচ্ছে?’ ভদ্রলোক শুকনো মুখে বললেন, ‘খুব অসুবিধে হচ্ছে।’

ডাক্তারবাবু বললেন, ‘কী অসুবিধে?’ ভদ্রলোক করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘এই দু’দিন ধরে চায়ের চিনি গুলতে পারছি না। আঙুল চুবিয়ে গুলতে গেলে আঙুলে গরম চায়ের ছ্যাঁকা লাগছে।’ বলে ডান হাতের তর্জনী তুলে ডাক্তারকে দেখালেন।

পুনশ্চঃ একটি অভাবিত কথোপকথন:—

(অল্প আগে একটি পথদুর্ঘটনা ঘটে গেছে, দুটি গাড়ি মুখোমুখি ধাক্কা মেরেছে, দুটিরই হেডলাইট ভেঙেছে, সামনের বনেট দুমড়িয়ে গেছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। দুই গাড়ির চালক এবং পুলিশ সার্জেন্ট, সেই সঙ্গে বহু পথচারী জটলা করছে, কেউ হতাহত হয়নি এটাই সুখের কথা।)

সার্জেন্ট সাহেব: (প্রথম ড্রাইভারের প্রতি) আপনি এবার যেতে পারেন।

দ্বিতীয় ড্রাইভার: আমি?

সার্জেন্ট সাহেব: আপনাকে থানায় যেতে হবে।

দ্বিতীয় ডাইভার: কেন?

সার্জেন্ট সাহেব: কেন আবার কী? এই দুর্ঘটনার জন্যে আপনিই দায়ি, তাই আপনাকে থানায় যেতে হবে।

দ্বিতীয় ড্রাইভার: আপনি বলছেন কী। আমি ছিলাম রাস্তার বাঁদিকে আর ওই ভদ্রলোক ডানদিকের থেকে এসে ওভারটেক করতে গিয়ে ধাক্কা দিলেন। এখনও আমার গাড়িটা বাঁদিকে রয়েছে।

সার্জেন্ট সাহেব: তা থাকুক। আপনিই দায়ি, আপনাকেই থানায় যেতে হবে।

দ্বিতীয় ড্রাইভার (মারমুখী হয়ে): আশ্চর্য! কারণটা বলবেন কি ওই ভদ্রলোক থানায় না গিয়ে আমি কেন থানায় যাব?

সার্জেন্ট সাহেব (গম্ভীর মুখে): সত্যিই কারণটা জানতে চান? তা হলে শুনুন ওই ভদ্রলোক হলেন আমাদের পুলিশ কর্তার শালা আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ভগ্নিপতি। এবার চলুন থানায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *