2 of 8

রসিকতা

রসিকতা

দুর্লভ মানবজন্মের মহামূল্য দিনগুলি ইয়ারকি দিয়ে কেটে যাচ্ছে আমার। কী কুক্ষণে যে রসিকতা ভূত আমার ঘাড়ে চেপেছিল যতবার তাকে ঘাড় থেকে ঝাঁকি দিয়ে ঠেলে দিতে যাই সে আমাকে আরও জড়িয়ে ধরে।

এখন মনে হচ্ছে আর পরিত্রাণ নেই। এ ভূতের হাত থেকে এ জন্মে আর পরিত্রাণ পাব না।

রসিকতার মহত্ত্ব সম্পর্কে কত বড় বড় কথাই যে এ যাবৎ শুনেছি। সেই এক দার্শনিক বলেছিলেন, যার রসবোধ নেই, সে মানুষই নয়। মানুষের সঙ্গে জানোয়ারের পার্থক্য এইখানে যে জানোয়ার রসিকতা করতে জানে না।

দার্শনিক মহোদয়ের এই আপ্তবাক্য অবশ্য আমার কাছে সর্বতোভাবে গ্রাহ্য নয়। সুরসিক দু’-একটি জন্তু, বাঁদর, শুশুক এমনকী কুকুর-বিড়ালের কথা আমরা জানি। ছোট কুকুরছানার লেজ ঠোঁট দিয়ে টেনে পালিয়ে যায় এমন ফাজিল কাকও অনেক দেখেছি।

জীবজন্তুর রসিকতা বিষয়ে কথা বাড়ানোর মতো রসদ আমার হাতে আজ নেই, আমি আপাতত রসিকতার স্বভাবচরিত্র নিয়ে সামান্য দু’-একটা কথা নিবেদন করতে চাই।

রসিকতা ও হাসির গল্পের স্বভাব লক্ষণ হল যে এইসব গল্পগুলো মহাকাশের ধূমকেতুর মতো অনেকদিন পর পর ঘুরে ফিরে আসে। কিছুদিন ধরে কোনও একটা রসিকতা বৃত্তাকারে ঘুরপাক খায় হাটে-বাজারে, অফিস-কাছারিতে, ক্লাবে-বারে এগুলো লোকমুখে চলতে চলতে তারপর একদিন হারিয়ে যায়। কেউ আর মনে রাখে না। অনেকে একটা হাসির গল্প আজ হয়তো শুনল, তারপর তারা সেই গল্পটা কাল অন্যদের বলল। তারপর সেই অন্যেরা পরশুদিন আরও অন্যদের বলল। সবাই খুব হাসাহাসি করল, তারপর যথারীতি একদিন ভুলে গেল।

যদি কেউ অনেকদিন বেঁচে থাকে, যদি তার স্মৃতিশক্তি প্রখর হয় সে হয়তো দেখবে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পরে সেই গল্পটা আবার ঘুরে এসেছে। লোকের মুখে মুখে ঘুরছে। সেই গল্প লোকেরা বলছে, লোকেরা শুনছে। শুনে হেসে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে।

তিন-চার দশক আগের কোনও বিলিতি ম্যাগাজিন যদি খুলি, এমনকী আমাদের পুরনো ‘ইদানীং’ বা ‘অচলপত্র’, বিস্ময় সহকারে আবিষ্কার করব এখনকার সবচেয়ে বাজার-চালু গল্প সেইখানে ছাপা রয়েছে। এমনকী আমার এই অপাঠ্য মহাভারতেও হয়তো পাঠকেরা খুঁজে পাবেন সেইসব সরস আখ্যান।

একটা রসিকতার পরমায়ু পাঁচ-ছয় মাস, বড় জোর একবছর। হয়তো নিউইয়র্কে যেটা শোনা গেল যেদিন তার তিনদিনের মাথায় সেটা উড়ে এল লন্ডনে। সেখান থেকে অন্য আকারে অন্য ভাষায় পৌঁছাল দিল্লি, দিল্লি থেকে কল্পনায়। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে সেই রসিকতা হলুদ হয়ে যাওয়া কাঁঠাল পাতার মতো উড়ে গেল মহাকালের হাওয়ায়। কিন্তু একদিন সেই রসিকতা আবার কোথায় কুড়িয়ে পেল সবুজতা, হরিৎ আভা, ঘরে ঘরে চায়ের আসরে, বার লাইব্রেরির কালো কোট পরা উকিলেরা, সাদা অ্যাপ্রন পরা, সাদা মুখোশে নাক ঢাকা শল্য চিকিৎসকবৃন্দ সকলেই আবার অবসরে বলতে লাগলেন, ‘শুনেছেন সেদিন ভারতমাতা হোটেলে…।’

ভারতমাতা হোটেলের গল্পটা মর্মান্তিক হাসির গল্প। বিস্তারিত বলা প্রয়োজন।

এক ভদ্রলোক ভারতমাতা হোটেলে খেতে গিয়েছেন। ভারতমাতা হোটেলের স্পেশাল হল পাঁঠার মাংস। সেদিন নানা কাজ সেরে তাঁর হোটেলে যেতে যেতে রাত সাড়ে দশটা হয়ে যায়, গিয়ে নির্দিষ্ট টেবিলে বসে ভদ্রলোক বেয়ারাকে বলেন, ‘ভাত-মাংস৷’

বেয়ারা পুরনো খদ্দেরকে দুঃখিত করতে চাননি তবু বাধ্য হয়ে বললেন, ‘স্যার, মাংস ফুরিয়ে গেছে।’

এই কথা শুনে ভদ্রলোক উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বেয়ারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলল, ‘স্যার উঠবেন না, আমি দেখছি, কী করা যায়। একটু চেষ্টা করে দেখছি।’

এই বলে বেয়ারা হোটেলের রান্নাঘরের দিকে গেল। রান্নাঘরের দরজার কাছেই শুয়ে ছিল একটা কুকুর। অন্যমনস্কভাবে তাড়াতাড়ি যেতে গিয়ে বেয়ারাটি কুকুরের পা মাড়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটা চিৎকার করে কেঁউ কেঁউ করতে করতে ছুটে পালিয়ে গেল।

এদিকে হয়েছে কী শহরের মেয়র মহোদয় স্বয়ং কবুল করেছেন যে তাঁর শহরে পাঁঠার মাংসের বদলে হামেশাই কুকুরের মাংস চালানো হচ্ছে। মেয়র সাহেবের ওই উক্তি সুরঞ্জিত হয়ে প্রতিদিন কাগজে কাগজে বেরোচ্ছে।

সুতরাং কুকুরের আর্তনাদ শোনামাত্র ভদ্রলোক বুঝলেন এখনই তাঁকে মাংস দেয়ার জন্যে একটা কুকুর কাটা হচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভোজনালয় থেকে তিনি পলায়ন করলেন। কিছুক্ষণ পরে বেয়ারা মাংসের ডেকচির তলা কুড়োনো কয়েক টুকরো হাড়, চর্বি সমেত একটু শুকনো ঝোল একটা প্লেটে নিয়ে এসে দেখে মাননীয় খদ্দের উধাও।

এই গল্প এখন কলকাতা শহরের বাজারে চলছে। কিন্তু তিরিশ বছর আগেও আরেকবার এ গল্প লোকমুখে ফিরেছে। তারও বহু আগে লন্ডনের স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে এ গল্প ছাপা হয়েছিল। আরও পিছিয়ে গেলে হয়তো নাসিরুদ্দিনে অথবা মার্ক টোয়েনে এ গল্প পাওয়া যেতে পারে।

অতঃপর রসিকতার বিপজ্জনক দিকটি বলি।

কবি অরবিন্দ গুহ, যিনি ইন্দ্র মিত্র নামে সুপ্রসিদ্ধ, তাঁর মতো মজার গল্প ভূভারতে কখনও কাউকে বলতে শুনিনি। আমাদের চেনাজানা সব হাসির গল্প তাঁর নিজস্ব অননুকরণীয় বাচনভঙ্গিতে অনবদ্য হয়ে ওঠে। সেই অরবিন্দ বহুদিন আগে একবার রসিকতা বিষয়ে এই ভয়াবহ গল্পটি বলেছিলেন।

অরবিন্দ একটা সরকারি অফিসে কাজ করতেন। সেই অফিসের এক বড়বাবুর বদ অভ্যাস ছিল হাসির গল্প করা। তিনি যে খুব ভাল রসিকতা করতে পারতেন তা নয়। কিন্তু প্রতিদিন দুপুরে টিফিনের সময় জমিয়ে আধঘণ্টা বা তারও বেশি সময়, টিফিনের সময় অতিক্রান্ত করে তিনি তাঁর যোগ্যতা মতো যথাসাধ্য হাসির গল্প সবাইকে শোনাতেন। যাঁরা শুনতেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই তাঁর অধস্তন কর্মচারী, তাঁর বিভাগেই কাজ করেন, তাঁরাও এসব গল্প শুনে, কোনও কোনও গল্প বারবার শুনে যথারীতি হাসতেন।

স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় অরবিন্দ নিজেও বড়বাবুর এই আড্ডায় নিয়মিত যোগ দিতেন। এইসময় অফিসের নিয়মানুযায়ী অরবিন্দ এই সুরসিক বড়বাবুর দপ্তর থেকে অন্য দপ্তরে বদলি হয়ে গেলেন। সবাই ধরে নিয়েছিল সম্ভবত অরবিন্দ অতঃপর আর এই মধ্যাহ্ন আড্ডায় আসবেন না। কিন্তু পুরনো জায়গার মায়াতেই হোক অথবা অন্য যে কোনও কারণেই হোক পরের দিন বেলা দু’ টোয় টিফিন হওয়া মাত্র অরবিন্দ পাঁচতলায় তাঁর নতুন শাখা থেকে নেমে চারতলার পুরনো শাখায় এলেন।

আজ বড়বাবু বেশ জমিয়ে বসেছেন, গতকাল সন্ধ্যাতেই তিনি বাড়ি ফেরার পথে একটা ইংরেজি পকেট জোকবুক ফুটপাথের দোকান থেকে দেড় টাকা দিয়ে কিনেছেন। আজ তাঁর মনের মধ্যে রসিকতার বড় বড় বুদবুদ উঠছে। টিফিনের সময় সেইসব রঙিন বুদবুদ একটার পর একটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন তিনি, অনুগত শ্রোতারা হাততালি দিয়ে হো হো করে হাসতে লাগলেন।

কিন্তু অরবিন্দ নির্বিকার। ভাবলেশহীন গম্ভীর মুখে একটার পর একটা হাসির গল্প শুনে চলেন তিনি। এই ব্যতিক্রম সকলেরই নজরে পড়ল, বিশেষ করে রসিক বড়বাবুর। তিনি অবশেষে বাধ্য হয়েই প্রশ্ন করলেন, ‘কী হল অরবিন্দ? ব্যাপার কী? তোমার হলটা কী? এইরকম সব মজার গল্প, একবারও হাসছ না?’

তিক্ত, গম্ভীর বদনে অরবিন্দ উত্তর দিলেন, ‘যারা হাসবার তারা হাসছে। আমি হাসব কেন? আমি তো এখন আর আপনার দপ্তরে কাজ করি না।’

অরবিন্দ গুহের গল্পের এই মর‍্যাল সব বাক্যবিলাসীর সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *